আমার বড়খালা কিছুদিন হলো ভূত দেখছেন। ঠাট্টা না, সত্যি! ভূতগুলি তাঁর শোবার ঘরের চিপায় চাপায় থাকে। তাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করে। তিনি ধমক দিয়ে তাদের বের করে দেন। এই তো কিছুক্ষণ আগের কথা, আমি আমার ঘরে বসে জুতা ব্রাস করছি (আমার জুতা না, বাবার জুতা। তিনি আয়নার মতো ঝকঝকে জুতা ছাড়া পায়ে দেন না), তখন শুনলাম বড়খালা কাকে যেন ধমকাচ্ছেন। চাপা গলায় ধমক। আমি জুতা হাতেই বড়খালার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি খাটের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর হাতে একটা শলার ঝাড়। তিনি ঝাড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছেন, বের হ বলছি। বের হ। পুলাপান ভর্তি বাড়ি! তুই এদের ভয় দেখাবি? ঝাড় মেরে আজ তোর বিষ নামায়ে দেব। বদমাশ!
আমি বললাম, কার সঙ্গে কথা বলছ?
বড়খালা বললেন, বাবলু, জুতা দিয়ে তুই এর গালে একটা বাড়ি দে তো। এমন বাড়ি দিবি যেন এর চাপার দাঁত নড়ে যায়। বদমাইশটা খাটের নিচে।
আমি খাটের নিচে উঁকি দিলাম। দুটা ট্রাংক, একজোড়া স্যান্ডেল, একটা টিফিন কেরিয়ার এবং প্লাস্টিকের ছোট লাল বালতি ছাড়া আর কিছু নেই। আমি বললাম, খালা, কিছু দেখছি না তো।
খালা স্বাভাবিক গলায় বললেন, চলে গেছে! এর ভাগ্য ভালো। জুতার বাড়ি খাওয়ার আগেই গেছে।
আমি বললাম, জিনিসটা কী?
খালা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পিচকা ভূতটা। এইটাই বদের হাড্ডি। বাবলু, টিভিটা ছাড় তো। আর পিছনের পর্দা টেনে দে। তোর মাকে বল আমাকে কড়া করে যেন এক কাপ চা দেয়। চিনি কম দিতে বলবি। এরা চা ঠিকমতো বানাতে পারে না। আধা কাপ চায়ে চিনি দেয় তিন চামচ। এক চুমুক দিলে কলিজা পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যায়।
আমার খালার নাম মাজেদা বেগম। গত সাত বছর ধরে তিনি এবং তার বড়ছেলে জহির আমাদের সঙ্গে থাকেন। খালার স্বভাবে আচার-আচরণে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা নেই। শুধু মাঝে-মধ্যে ভূত দেখেন, এই ভূত দেখার মধ্যেও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। হৈচৈ চিৎকার নেই। যেন ভূত-প্রেতের দেখা পাওয়া মানব জীবনের স্বাভাবিক ঘটনার একটি।
খালার সময় কাটে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে এবং পুরনো ম্যাগাজিন পড়ে। নতুন ম্যাগাজিন তিনি পড়তে পারেন না। আমি একবার তাকে দুটা নতুন সিনেমা ম্যাগাজিন কিনে এনে দিয়েছিলাম। তিনি পড়েন নি। খাটের পাশে রেখে দিয়েছিলেন। কেউ আগে পড়বে, ময়লা করবে, পাতা কুঁচকাবে, তারপর তিনি পড়বেন। তার আগে না।
এটাকে তাঁর চরিত্রের অস্বাভাবিকতা বলা ঠিক হবে না। নতুন ম্যাগাজিন তিনি পড়তে পারেন না, কারণ খালু সাহেব এই বিষয়টা পছন্দ করতেন না। ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ তিনি আগে পড়তেন, তারপর অন্যরা পড়তে পারত। ভুলে কেউ যদি তার আগে খবরের কাগজ পড়ে ফেলত, তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতেন। নতুন খবরের কাগজ কিনিয়ে আনতেন, আগেরটা ছুঁয়ে দেখতেন না।
খালু সাহেব (মিজানুর রহমান খান, চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট) রোড অ্যাকসিডেন্টে সাত বছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু তার তৈরি করা নিয়মকানুন বড়খালার মধ্যে রেখে গেছেন। ঐ যে কবিতাটা আছে না— পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। খালু সাহেব উড়ে চলে গেছেন, কিন্তু পুরনো ম্যাগাজিন রেখে গেছেন।
খালু সাহেবের ব্যাপারটা পরে বলব, আগে বড়খালার বিষয়টা শেষ করি। আগেই বলেছি, বড়খালার বয়স পঞ্চাশের ওপর। কিন্তু বয়সের কোনো দাগ তার চেহারায় পড়ে নি। মোটাসোটা থলথলে একজন মানুষ। সুখী সুখী চোখমুখ। জর্দা দিয়ে পান খেতে পছন্দ করেন। সব ধরনের জর্দা না, ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা কিংবা ইন্ডিয়ান গোপাল জর্দা। জর্দা খাবার সময় পানের রস তার থুতনি গড়িয়ে প্রায় পড়ে পড়ে যখন হয় তখন তিনি শো করে টেনে সেই রস মুখে নিয়ে নেন। এই দৃশ্যটা খুব সুন্দর।
তাঁর গায়ের রঙ ফর্সা, মেমসাহেবদের মতো ফর্সা। মেমসাহেবদের স্বভাবের সঙ্গেও তার মিল আছে। তিনিও মেমসাহেবদের মতো গরম সহ্য করতে পারেন না। শীতের সময়ও তার ঘরে এসি চলে। (একমাত্র বড়খালার ঘরেই এসি আছে। এরিস্টন কোম্পানির দেড়টনি এসি। যখন চলে ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। মনে হয় ভোমরা উড়ছে।)
দিনরাত এসি চলার কারণে তাঁর ঘর ফ্রিজের ভেতরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। তারপরেও তার গরম যায় না। তিনি কোনোমতে একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রাখেন। শাড়ির নিচে পেটিকোট-ব্লাউজ কিছুই পরেন না। সেই শাড়িও যে সবসময় গায়ে লেপ্টে থাকে তা-না। উপরের অংশ যখন-তখন নেমে কোমরের কাছে চলে আসে। বড়খালা তা নিয়ে মাথা ঘামান না। আমাদের বাড়ির সবাই বড়খালাকে এই অবস্থায় অনেকবার দেখেছে। সবচে বেশি দেখেছি আমি। বয়সে ছোট বলে বড়খালা কখনো আমাকে গুনতির মাঝেই ধরতেন না। এখন আমি বড় হয়েছি। এইবার এসএসসি দেব। এখনো তিনি আমাকে গুনতিতে ধরেন না।
বড়খালার গরম বিষয়ক জটিলতার সঙ্গে আমরা পরিচিত বলে আমাদের কাছে বড়খালার ‘অর্ধনগ্ন’ সমস্যা কোনো সমস্যা না। বাড়িতে নতুন লোকজন এলে তারা ঝামেলায় পড়ে। কাজের মেয়ে জিতুর মা আমাদের বাড়িতে প্রথম কাজ করতে এসেই চোখ কপালে তুলে বলল, ও আল্লা, দোতলার ঘরে এক বেটি নেংটা হইয়া বইসা আছে?
বাবা তখন নাশতা খাচ্ছিলেন। তিনি টেবিল থেকে উঠে এসে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হোয়াট! এত বড় কথা। তুমি কানে ধর। কানে ধরে দশবার উঠবোস কর।
জিতুর মা বলল, আমি কানে ধইরা উঠবোস করব কী জন্যে? আমি করছি কী?
তুমি একজন সম্মানিত মহিলার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলেছ, এইজন্যেই তুমি কানে ধরে দশবার উঠবোস করবে। যদি না কর তোমার চাকরি নট।
জিতুর মা তেজি গলায় বলল, চাকরি নট হইলে নট। আমি ফুলপুরের মাইয়া। ফুলপুরের মাইয়া কানে ধইরা উঠবোস করে না।
বাবা বললেন, তাহলে বিদায়। এক্ষুনি বিদায়। তোমরা এই মেয়ের ট্রাংক কাঁথা বালিশ, ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখ। আমার ধারণা সে ইতিমধ্যেই কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছে। ফুলপুর ময়মনসিংহ ডিসট্রিক্টে। ময়মনসিংহের কাজের মেয়ে চোরের হাড়ি।
জিতুর মাকে সকাল নটায় বিদায় করে দেওয়া হলো। সেদিন সন্ধ্যাতেই বাবা তাকে বস্তি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। পঞ্চাশ টাকা বাড়তি বেতন দিয়ে আনতে হলো। ঢাকা শহরে কাজের মেয়ের খুব অভাব। গ্রাম থেকে শত শত মেয়ে শহরে আসে ঠিকই, কিন্তু তারা বাসা বাড়িতে ঢোকে না। সরাসরি গার্মেন্টসে চলে যায়।
জিতুর মা অনেকদিন আমাদের মাঝে ছিল। শেষের দিকে বড়খালার সঙ্গে তার খুবই খাতির হয়। তারা দুজন একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হিন্দি সিরিয়াল দেখত। জিতুর মা হিন্দি বুঝত না। বড়খালা বুঝিয়ে দিতেন।
শালগিরা হলো জন্মদিন। ঐ যে হ্যাপি বার্থ ডে। বুঝেছ?
জি বুঝেছি।
ঐ লম্বা মেয়েটার আজ শালগিরা। সে দুনিয়ার বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত দিয়েছে, তার বয়ফ্রেন্ডকে দাওয়াত দেয় নাই। বুঝেছ?
কাজটা অন্যায্য হইছে।
মোটেই অন্যায্য হয় নাই। ঠিকই হয়েছে। আমি হলেও তাই করতাম। তুমি কী করতে?
খালাজি, আমি দাওয়াত দিতাম। দশজনরে দিতে পারছি, আরেকজন অ্যাসট্রা দিলে ক্ষতি কী?
জিতুর মা কথাবার্তায় দুএকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যেমন— অ্যাক্সট্রা, মিসটেক, রিস্কি। সে আমাদের সঙ্গে তিন বছর ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যায়। যাবার সময় রান্নাঘর থেকে একটি গরুর গোশতের শুঁটকি নিয়ে যায়। বিষয়টা বেশ রহস্যজনক— এত জিনিস থাকতে সে একটি গরুর গোশতের শুঁটকি নিয়ে কেন পালাল? গোশতের শুঁটকি বাবার খুব পছন্দের। কোরবানির গোশতের অনেকটাই বাবার জন্যে শুঁটকি বানিয়ে রাখা হতো।
বাবা শুঁটকির শোকেই বেশ কাতর হলেন। সেদিন তিনি কাজে গেলেন না। হামকি ধামকি করতে লাগলেন— এই পিশাচী ডাইনিকে আমি যদি জেলের ভাত না খাওয়াই তাহলে আমার নাম তোফাজ্জল হোসেন না। আমার নাম কুত্তা হোসেন। ঢাকা সাউথের এসপি জয়নাল আমার বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। সে অঙ্ক একেবারেই পারত না। তার হোমওয়ার্ক আমি করে দিতাম। মেট্রিক পরীক্ষার সময় তার সিট পড়ল আমার পিছনে। সে যেন অংকে পাশ করতে পারে এই জন্যে আমি একটা করে অঙ্ক করতাম, খাতাটা খুলে রাখতাম। জয়নাল অঙ্কটা টুকত, তারপর আমি অন্য অংকে হাত দিতাম। তাকে পাশ করাতে গিয়ে আমি অঙ্ক খারাপ করলাম। যেখানে লেটার মার্ক থাকার কথা সেখানে পেলাম বাহান্ন। অংকের কারণে আমার ফার্স্ট ডিভিশন মিস হয়ে গেল। যাই হোক, এটা কোনো ব্যাপার না, জিতুর মাকে টাইট দেয়াটা হলো ব্যাপার। সে ঘুঘু দেখেছে। ফাদ দেখে নি। You have seen the bird, not the cage.
আমার বাবা তোফাজ্জল হোসেন খোন্দকার বোকা মানুষ না বুদ্ধিমান মানুষ, তা এখনো আমি ধরতে পারি না। তাঁর কথাবার্তা আচার-আচরণ বোকার মতো। এদিক দিয়ে তিনি বোকা। কিন্তু বোকাদের কর্মকাণ্ডের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। বাবার সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। বাইরের মানুষ বাবাকে তোফাজ্জল হোসেন বলে না। বলে টাউট হোসেন।
খালু সাহেবের মৃত্যুর পর বাবা যে বড়খালাকে এ বাড়িতে এনে তুললেন তার পেছনেও উদ্দেশ্য কাজ করেছে। খালু সাহেব ধনবান মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক টাকা-পয়সা রেখে গিয়েছিলেন। বাবার উদ্দেশ্য ছিল, বড়খালাকে আমাদের বাড়িতে তুলে তার টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া। বাবার এই উদ্দেশ্য সফল হয় নি। বড়খালা বাবার ফাঁদে কখনো পা দেন নি।
বাবা কিছুদিন পর পরই নতুন নতুন ব্যবসার পরামর্শ করতেন বড়খালার সঙ্গে। উৎসাহ এবং উত্তেজনায় তিনি তখন ঝলমল করতেন। বড়খালাও বাবার কথা খুব আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন।
আপা! আপনি যে শুধু সম্পর্কে আমার আপা, তা না। আপনি আমার মুরুব্বি। আজকে আমি এসেছি আপনার দোয়া নিতে। পা-টা একটু আগায়ে দেন। সালাম করি।
বড়খালা পা এগিয়ে দিলেন। বাবা সালাম করলেন। আয়োজন করে সালাম।
নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি আপা, আপনার দোয়া চাই। এতদিন যা করলাম, সবই তো টুকটাক। ঢাকের বাদ্য। এইবার গুড়ুম গাড়ম বজ্রপাত।
কিসের ব্যবসা করবে?
রঙের ব্যবসা। ডাই। সুতায় যে রঙ দেয়া হয় সেই রঙ। বাংলাদেশে এই ব্যবসা একচেটিয়া যে করত তার নাম নাজিম। চাঁদপুরে বাড়ি। বিয়ে করেছে জামালপুরের মুনশি বাড়ির মেয়ে। সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয়। আমাকে সে খুবই ভালো পায়। দুলাভাই ডাকে।
তোমাকে খামাখা দুলাভাই ডাকে কেন? তুমি তো আর তার বোনকে বিয়ে কর নাই।
এইখানে একটা মজা আছে। তার যে আসল দুলাভাই, সে লঞ্চড়ুবিতে মারা গেছে। তার চেহারা ছিল অবিকল আমার মতো। এই জন্যেই সে আমাকে ডাকে দুলাভাই। শুধু যে দুলাভাই ডাকে তা-না, সম্মানও সে-রকমই করে।
ও আচ্ছা।
নাজিম সামনের মাসে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। গ্রীন কার্ড না-কি ইয়েলো কার্ড কী যেন পেয়েছে। আমাকে সে ডেকে নিয়ে বলেছে, দুলাভাই, আমার রঙের ব্যবসাটা আপনার হাতে দিয়ে যাই। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। জাপানে এবং কোরিয়ায় এলসি খুলবেন। রঙ আনবেন। ক্যাশ পয়সায় বেচবেন। পার্টি আপনার বাড়িতে এসে টাকা দিয়ে যাবে, আপনাকে যেতেও হবে না। আপা, এখন আপনি বলেন, এই ব্যবসাটা করা উচিত না?
অবশ্যই উচিত।
একটা জায়গায় শুধু আটকা পড়েছি। ক্যাপিটেলের সমস্যা। পাঁচ লাখ টাকা ক্যাপিটেল লাগে। তিনমাসের মধ্যে অবশ্য ক্যাপিটেল উঠে আসবে। ক্যাপিটেলের বিষয়ে আপনি কি আমাকে কোনো বুদ্ধি দিতে পারেন?
আমি তোমাকে কী বুদ্ধি দিব? আমি মেয়েমানুষ, ব্যবসার আমি বুঝি কী?
একটা বুদ্ধি অবশ্যি আমার মাথায় এসেছে। ক্যাপিটেলটা আমি আপনার কাছ থেকে ধার নিলাম। তিনমাস পর আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দিলাম, প্লস লাভের একটা পারসেনটেজ। আপা, আপনি কী বলেন? আপনি হলেন ব্যবসার স্লিপিং পার্টনার! কিছুই করতে হচ্ছে না, ঘরে বসে টাকা।
আমি টাকা পাব কই? কেন, আপনার টাকা তো আছে!
আমার টাকা কোথায়? তোমার দুলাভাইয়ের টাকা। উনি কঠিন হুকুম দিয়ে গেছেন, আমি যেন টাকায় হাত না দেই। তার হুকুমের বাইরে যাব কীভাবে?
মাত্র তিন মাসের ব্যাপার।
তিনদিনের ব্যাপার হলেও তো পারব না। উনার হুকুম।
বাবা রবার্ট ব্রুসের মতো। মচকাবার লোক না। তিনি পেছনে লেগেই থাকেন। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে বড়খালার কাছে যান। একবার গেলেন বড়খালার মগবাজারের বাড়ির বিষয়ে কথা বলতে। নানান ভণিতার পর বললেন, আপা, আপনার মগবাজারের বাড়িটা এমন এক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে যে এটাকে বাড়ি বলা ঠিক না।
বাড়ি না বলে কী বলবে?
গোল্ড মাইন। সোনার খনি। এখানে একটা রেস্টুরেন্ট দিলে ছয় মাসের মধ্যে …
ছয় মাসের মধ্যে কী?
ছয় মাসের মধ্যে আপনি কোটিপতি। টাকা গুনতে গুনতে আপনার হাতে ঘা হয়ে যাবে।
হোটেল চালাবে কে?
আমি চালাব। শেফ আসবে ইন্ডিয়া থেকে। দেখেন না কী করি। রেস্টুরেন্টের একটা নামও ঠিক করেছি। আপনার পছন্দ হয় কি-না দেখেন— রসনা বিলাস।
নাম তো সুন্দর।
তিন ধরনের রান্না হবে, দেশী, মোঘলাই, চাইনিজ। অনেকটা ফুড কোর্টের মতো। আপনি অনুমতি দিলে কাজ শুরু করে দেই। অনেক পেপার ওয়ার্ক আছে।
তোমার দুলাইকে জিজ্ঞেস না করে অনুমতি দেই কীভাবে?
উনি মৃত মানুষ! উনাকে কীভাবে জিজ্ঞেস করবেন?
মৃত মানুষকে জিজ্ঞেস করার উপায় আছে। একে বলে ইস্তেখারা। দোয়া দরুদ পড়ে ঘুমাতে হয়। উত্তর-দক্ষিণে পাক পবিত্র হয়ে শুতে হয়। মুখ থাকে কাবার দিকে ফিরানো। দেখি আগামী বৃহস্পতিবার ইস্তেখারা করে দেখি…
বাবা বললেন, উনাকে এইসব জাগতিক বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করা ঠিক না। মগবাজারের বাড়িটাকে রেস্টুরেন্ট বানালে উনি খুশিই হবেন। ভাড়াটের কাছ থেকে আর কয় পয়সা আদায় হয় বলেন? আপনি অনুমতি দেন, ভাড়াটেদের উৎখাত নোটিশ দিয়ে দেই।
তোফাজ্জল শোন, তোমার দুলাভাইয়ের অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করব। কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর, আমি উনার কাছ থেকে জেনে নেই।
বড়খালার কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে বাবা আমার ঘরে এসে বসেন। তিনি ছোটখাটো মানুষ, ঐ ঘর থেকে বের হবার পর তাকে আরো ছোটখাটো দেখায়। ঠাণ্ডা ঘর থেকে হঠাৎ গরম ঘরে ঢোকার কারণে তিনি খুব ঘামতে থাকেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, পানি খাওয়া তো বাবা।
তিনি পানি শেষ করেন এক চুমুকে, তারপর বিড়বিড় করে বলেন, কঠিন মহিলা। অতি কঠিন। মচকাবার জিনিস না।
বড়খালার কথা বলছ?
হুঁ। তাকে এই বাড়িতে এনে বিরাট ভুল করেছি। সিন্দাবাদ যে ভুল করেছিল সেই ভুল। সিন্দাবাদ কী করেছিল জানিস তো? এক ভূত ঘাড়ে নিয়েছিল, আর নামাতে পারে না।
বাবা পানি শেষ করে সিগারেট ধরান। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে উদাস হয়ে যান। তার জন্যে তখন আমার বেশ মায়া লাগে।
আমি ছাড়া বাবার প্রতি আর কেউ মায়া বোধ করে বলে আমি মনে করি। মায়া বোধ করার কোনো কারণও নেই। বাবা কারো কাছ থেকে তার টাউট প্রকৃতি লুকাতে পারেন না। নিজের ছেলেমেয়ে স্ত্রীর কাছেও না। টাউটদের কেউ পছন্দ করে না।
আজ বৃহস্পতিবার। সকাল নয়টা মাত্র। আমার হাতে বাবার কালো চামড়ার জুতা। পালিশ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একটু আগে আমি বড়খালার ঘর থেকে এসেছি। ভূতের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি আবার টিভি দেখা শুরু করেছেন। তার চায়ের ফরমাস এখনো পালন করা হয় নি। তাতে কোনো সমস্যাও নেই। বড়খালার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। চা যদি তাঁর কাছে দুঘণ্টা পরেও যায় তিনি অভিযোগ করবেন না।
দরজা ঠেলে বাবা ঢুকলেন। গরমের মধ্যেও তার পরনে স্যুট। গলায় টাই। কিছুক্ষণ আগে শেভ করেছেন। গাল চকচক করছে।
বাবলু, জুতার খবর কী রে? দেখি। তিনি সময় নিয়ে জুতা দেখলেন। জুতায় মুখ দেখা যায় কি-না সেই চেষ্টা। ভালো হয়েছে। ভদ্রলোক চেনা যায় জুতা দিয়ে, এটা জানিস?
না।
মানুষের জুতা দেখে তার স্বভাব, চরিত্র, হাবভাব সব বলে দেয়া যায়। নে এই পাঁচটা টাকা রাখ। দে জুতা পরায়ে দে। অন্যকে জুতা পরায়ে দেয়া খুবই অসম্মানের কাজ। শুধু বাবার পায়ে জুতা পরানো সম্মানের কাজ।
আমি জুতা পরালাম। জুতার ফিতা লাগালাম। বাবা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমার সঙ্গে গল্প করবেন। এটা তাঁর নিত্য দিনের রুটিন।
তোর বড়খালা নাকি ভূত দেখা শুরু করেছে?
হুঁ।
দিনেদুপুরেও নাকি দেখে?
হুঁ।
মাথা তো মনে হয় পুরাপুরিই গেছে। তোর কী ধারণা?
কথাবার্তা শুনে সে-রকম মনে হয় না।
কথাবার্তায় কিছুই বোঝা যায় না। বোঝা যায় কর্মে। দিনেদুপুরে যে তৃ৩ দেখে, ভূতের সঙ্গে গল্প করে, সে মানসিকভাবে সুস্থ হয় কীভাবে?
তিনি হয়তো সত্যিই ভূত দেখেন।
তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? তুই থাকিস তার পাশের ঘরে। উনার রেডিয়েশন তোর উপর আসতে পারে। সব মানুষের রেডিয়েশন আছে, এটা জানিস?
না।
সব মানুষের রেডিয়েশন আছে। কারোরটা ভালো কারোরটা মন্দ। আমি একজন পীর সাহেবের কাছে যাই। উনার রেডিয়েশন মারাত্মক। ধাক টের পাওয়া যায়।
তোমার পীর সাহেব আছে না-কি?
আছেন একজন। তবে আমি উনার মুরিদ না। এমি মাঝে-মধ্যে যাই। আমাকে স্নেহ করেন। তোকে নিয়ে যাব একদিন। কিছুক্ষণ কথা বললেই উনার পাওয়ার বুঝবি। উনি থাকেন হাঁটার মধ্যে। দিনরাত হাঁটেন। তার পেছনে পেছনে ভক্তরা হাঁটে। মজুম অবস্থা।
মজুম অবস্থা কী?
সাধনার স্তর। শেষ স্তরের নাম ফানা ফিল্লাহ। সেটা কঠিন জিনিস। আল্লাহ পাকের সঙ্গে ডাইরেক্ট কানেকশন।
বাবার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তিনি এখনো উঠছেন না। মনে হয় তিনি আরো কিছুক্ষণ কথা বলবেন।
তোর বড়খালার ব্রেইন যদি সত্যি সত্যি আউট হয়ে যায় তাহলে তো বিরাট সমস্যা। তার টাকা-পয়সার বিলি ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা। টাকা পাবে কে?
উনার ছেলে জহির ভাই পাবেন।
বোকার মতো কথা বলিস না বাবলু। বোকা যখন বোকার মতো কথা বলে তখন শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু একজন বুদ্ধিমান ছেলে যদি বোকার মতো কথা বলে তখন শুনতে ভালো লাগে না। জহির উনার টাকা-পয়সা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোটও পাবে না।
কেন পাবে না?
আরে গাধা, জহির তো তাদের ছেলে না। পালক পুত্র। এখন বুঝেছিস? পালক পুত্র পুত্র নহে— এই কথা কোরান শরীফেও আছে। তোর খালার বিষয়সম্পত্তির মালিক আসলে আমরা।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। প্রথম যখন আমার ঘরে ঢুকেছিলেন তখন তাঁর চেহারায় একটা ক্লান্ত ভাব ছিল। এখন সেই ক্লান্তি নেই। বাবার চোখ তাঁর জুতার মতোই চকচক করছে।
বাবলু!
জি বাবা?
তোর বড়খালার সঙ্গে একটু হাই হ্যালো করে যাই। তাকে খুশি রাখা আমাদের কর্তব্য। মহিলার কাপড়চোপড় ঠিক আছে কি-না কে জানে! নেংটা মেংটা বসে থাকে। এক দিগদারি।
বাবা খালার ঘরে ঢুকলেন, আমি দোতলা থেকে একতলায় নামলাম। বড়খালার চায়ের অর্ডার দেব। নিজে চা খাব। নাশতা তৈরি হয়ে থাকলে নাশতা খাব। এই বাড়িতে দুধরনের নাশতা হয়। একদিন হয় পাতলা খিচুড়ি বেগুন ভাজা। আরেকদিন হয় আটার রুটি আলু ভাজা। শুধু আমার নীলা ফুপুর জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা। নীলা ফুপু পাতলা খিচুড়ি খেতে পারেন না। তার ধারণা, পাতলা খিচুড়ি ফকির-মিসকিনদের খাবার। যারা দিনের পর দিন পাতলা খিচুড়ি খায় তারা ভবিষ্যতে ফকির-মিসকিন হয়। তিনি আটার রুটিও খেতে পারেন না। শুকনা রুটি তার নাকি গলায় আটকে যায়।
নীলা ফুপু সকালবেলা দুধ দিয়ে এক বাটি কর্নফ্লেক্স খান, অর্ধেকটা কলা খান। বাকি অর্ধেক কলা চটকে (খোসাসুদ্ধ) তিনি একটা মিকচারের মতো বানান। এই মিকচার চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর দিয়ে রাখেন। তার দুই চোখের নিচেই কালো ছোপ পড়েছে। কলার মিকচার চোখের নিচের কালো দাগ দূর করার মহৌষধ।
নীলা ফুপু দেখতে খারাপ না। মায়া মায়া চেহারা। লম্বা চুল, বড় বড় চোখ। গায়ের রঙ দুধে-আলতা না হলেও ভালো। তাঁর একটাই সমস্যা। তিনি বেঁটে। ঢাকা শহরের সবচে বড় হিলের জুতা তিনি পরেন। তারপরেও তাঁকে বেঁটে লাগে। লম্বা হবার অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন। হাইটোলিন নামের একটা পেটেন্ট ওষুধ তিনি দুই বছর খেয়েছেন। এই ওষুধ খেলে প্রতি বছরে এক পয়েন্ট পাঁচ সেন্টিমিটার করে লম্বা হবার কথা। তিনি লম্বা হন নি, বরং শরীর ফুলে গেছে। ওষুধ খাওয়ার জন্যেই হয়তো তার খুকি খুকি চেহারা এখন বদলে মহিলা মহিলা চেহারা হয়ে গেছে।
লম্বা হবার আশা নীলা ফুপু এখনো ছাড়েন নি। তাঁর ঘরে কোনো ফ্যান নেই। ফ্যানের জায়গায় নাইলনের দড়ি দিয়ে রিং ঝুলানো। প্রতিদিন তিনি ঘড়ি ধরে পনেরো মিনিট রিং-এ ঝুলেন। প্রচণ্ড গরমেও তিনি ফ্যান ছাড়া ঘুমান। কারণ ফ্যানের বাতাসে ঘুমালে নাকি শরীর ভ্যাবসা হয়ে যায়।
শরীর ভ্যাবসা হয়ে গেলে নীলা ফুপুর বিরাট সমস্যা হবে। এখন তার কাছে শরীর, চেহারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি একটা মেগাসিরিয়ালে চান্স পেয়েছেন। সিরিয়ালের নাম কুসুম কানন। নায়িকার নাম কুসুম। নায়কের নাম কানন। দুজনের নাম দিয়ে সিরিয়ালের নাম। কাহিনী খুব ট্রাজিক। নায়িকা অ্যাকসিডেন্ট করে অন্ধ হয়ে যায়। নায়ক তার একটা চোখ দান করে নায়িকার একটা চোখ রক্ষা করে। তারপর আবার দুজনই কী করে যেন অন্ধ হয়ে যায়। শেষে একজন বিদেশী ডাক্তার অপারেশন করে দুজনকেই ঠিক করে দেন। সিরিয়ালে নীলা ফুপুর রোল খুবই ছোট। নায়কের বাড়ির সে সহকারী (আসলে কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ের রোলে অভিনয় করছেন বলতে নীলা ফুপুর লজ্জা লাগে বলেই তিনি সবাইকে বলেন, সহকারীর ক্যারেক্টার।) রোল ছোট হলেও অনেক কিছুই না-কি করার আছে। সিরিয়ালের পরিচালক মুকুল সাহেব নীলা ফুপুকে বলেছেন— শেষের দিকে এসে এই ক্যারেক্টারে অনেক টার্ন আছে।
নীলা ফুপু কয়েক বছর ধরেই ইন্টারেমিডিয়েট পড়ছেন–কমার্স। প্রথমবার পাশ করতে পারেন নি। পরের বার সিরিয়ালের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এবারো মনে হয় দিতে পারবেন না। তবে পড়াশোনা নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, কী পড়? তিনি হাসিমুখে বলেন, ইন্টার পড়ি। আমার ধারণা, ফুপু যতদিন বাঁচবেন, ইন্টার পড়ি বলেই কাটিয়ে দিবেন।
আমি রান্নাঘরে ঢুকে বড়খালাকে চা পাঠাতে বললাম। খাবার টেবিলে নীলা ফুপুর পাশে এসে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে বল ভর্তি পাতলা পানি পানি খিচুড়ি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে দুধের মতো সর পড়েছে। আমি খিচুড়ি নিতে যাচ্ছি, নীলা ফুপু বললেন, খিচুড়ি নিস না। আজকের খিচুড়িতে প্রবলেম আছে।
কী প্রবলেম?
খিচুড়িতে একটা তেলাপোকা পাওয়া গেছে।
আমি হাত গুটিয়ে বসলাম। খিচুড়িতে তেলাপোকা পাওয়া আমাদের বাসার একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। হাঁড়ির যে অংশে তেলাপোকা পাওয়া গেছে, মা সেখান থেকে তেলাপোকা সুদ্ধ এক খাবলা খিচুড়ি শুধু ফেলে দেবেন। তারপর সূরা এখলাস পড়ে ফুঁ দিবেন। সূরা এখলাস পড়ে ফুঁ দিলে খাবার শুদ্ধ হয়ে যায়। মা না-কি কোনো এক ধর্মের বইয়ে পড়েছেন।
নীলা ফুপু বললেন, তোকে টাকা দিচ্ছি, তুই হোটেল থেকে গোশত পুরোটা খেয়ে আয়।
আমি বললাম, ইন রিটার্ন তোমার জন্যে কী করতে হবে সেটা বলো।
কিছুই করতে হবে না। দশ টাকায় তোর নাশতা হবে না?
হবে।
বসে থাক, আমি খাওয়া শেষ করে তোকে টাকা এনে দিচ্ছি।
নীলা ফুপু অকারণে টাকা খরচ করার মেয়ে না। আমাকে নাশতা খাওয়ানোর জন্যে তাঁর কোনো ব্যাকুলতা থাকার কথাও না। রহস্য কিছু আছে।
আমি সেই রহস্যের অপেক্ষা করছি।
বাবলু, এই নে তোর নাশতার টাকা। আর এই খামটা নে। জরুরি একটা চিঠি আছে, মুকুল ভাইয়ের হাতে দিবি। পারবি না?
পারব।
মুকুল ভাই কিন্তু এগারোটার পর বাসায় থাকেন না। এগারোটার মধ্যে যাবি। আর শোন, চিঠিটা খুবই জরুরি। অন্য কারো হাতে যেন না পড়ে।
চিঠিতে কী লেখা?
আছে কিছু ব্যক্তিগত বিষয়। তুই বুঝবি না।
নাশতা খেতে খেতে আমি ফুপুর চিঠি খুলে ফেললাম। অনেক কায়দা করতে হলো। চায়ের গরম কাপের সঙ্গে খামের মুখ চেপে ধরা। ব্লেড দিয়ে ঘষা। তারপরেও সমস্যা হলো— খামের মুখ সামান্য ছিঁড়ে গেল। এবং খামের গায়ে মাংসের ঝোল লেগে গেল।
এত ঝামেলা করে উদ্ধার করা নীলা ফুপুর চিঠিটা এরকম—
মুকুল ভাই,
আপনি কি ঐ দিনের ঘটনা কাউকে বলেছেন? অবশ্যই বলেছেন। না বললে রিয়া কী করে এমন একটা কথা বলল? রাগে-দুঃখে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছি। আমি অনেকবার মোবাইলে আপনাকে ধরার চেষ্টা করেছি। রিং হয়, কিন্তু আপনি ধরেন না। আমার ধারণা আমার নাম্বার দেখেই আপনি ধরেন না।
এখন রিয়া আমাকে কী বলেছে সেটা শুনুন। রিয়া টেলিফোন করে বলল, সোমবার শুটিং শেষ করে তুই গুলশানের কোনো রেস্ট হাউসে গিয়েছিলি? আমি বললাম, রেস্ট হাউসে কেন যাব? আমি বাসায় চলে এসেছি। তখন রিয়া বলল, আচ্ছা শোন, তোর কি সবুজ রঙ খুব পছন্দ? আমি বললাম, কী আবোল-তাবোল কথা বলছিস! সবুজ রঙের কথা আসল কেন? তখন রিয়া বলল, না, তোর আন্ডার গার্মেন্টসের কালার সবুজ— এই জন্যই রঙের কথা আসল।
আচ্ছা মুকুল ভাই, আমার আন্ডার গার্মেন্টসের কালার রিয়া কীভাবে জানল? আপনি কি সবাইকে সবকিছু বলে দিচ্ছেন?
চিঠিতে আমি সব কথা বলতে পারছি না। আপনাকে আমার আরো কথা বলার আছে। দয়া করে আমি যখন টেলিফোন করব তখন টেলিফোন ধরবেন। আপনি আমাকে আপনার বাসায় যেতে নিষেধ করেছেন বলে আমি যাই না। নিষেধ না করলে সরাসরি আপনার বাসায় চলে যেতাম।
মুকুল ভাই, আমাদের Next Lot-এর শুটিংয়ের ডেট কি হয়েছে? আমাকে কেউ কিছু জানায় না। এই লটে আপনি কি আমার ক্যারেক্টারটার দিকে একটু নজর দিবেন? গত এপিসোডে আমি শুধু একবার গ্লাসে দুধ নিয়ে ঢুকেছি। কোনো ডায়ালগ নাই। ডায়ালগ না থাকলে অভিনয়টা করব কীভাবে?
মুকুল ভাই, আপনি আমার ওপরে রাগ করবেন না। যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে থাকি তার জন্যে ক্ষমা করবেন।
ইতি
আপনার স্নেহধন্যা
নীলা
মুকুল ভাই বিশাল এক ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছেন। তার মাথার নিচে বালিশ। ইজিচেয়ারের হাতলে একটা গ্লাসে খুব সম্ভব অরেঞ্জ জুস। মাছি ভনভন করছে। মুকুল ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি রাতে ঘুমান নি। চোখ লাল। চোখের নিচে কালি। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাঁর চেহারা পরিচিত কোনো মহাপুরুষের মতো। এখন নামটা মাথায় আসছে না। পরে নিশ্চয়ই আসবে।
তিনি হাই তুলতে তুলতে নীলা ফুপুর চিঠি পড়লেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, খামটা কি আগে ভোলা হয়েছে?
আমি বললাম, ভোলা হয়েছে কি-না জানি না। আমাকে যেমন দিয়েছে আমি নিয়ে এসেছি।
নীলা তোমার কে হয়?
ফুপু।
আপন?
জি।
ভেরি গুড। একটা কাজ করে দাও। ঘরে কোনো লোকজন নেই, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও। বেনসন। দেশীটা আনবে। সতুর টাকা প্যাকেট নিবে। সঙ্গে একটা ম্যাচ আনবে। পারবে না?
জি পারব।
মুকুল ভাই মানিব্যাগ হাতাহাতি করতে লাগলেন। একশ টাকার নোট খুঁজছেন। মানিব্যাগে একশ টাকার নোট নেই, সবই পাঁচশ টাকার নোট। মনে হয় তিনি আমাকে পাঁচশ টাকার নোট দিতে ভরসা পাচ্ছেন না।
তোমার নাম যেন কী? বাবলু।
পাঁচশ টাকার একটা নোট দিলাম। দুই প্যাকেট সিগারেট আর দুইটা ম্যাচ আনবে। দেরি করবে না। যাবে আর আসবে। সকাল থেকে সিগারেট খাই নি। ফুসফুস জ্যাম হয়ে আছে।
আমি পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে বাসায় চলে এলাম। একটু ভুল বললাম, বাসায় না, বাসার সামনেই ভিডিওর দোকান দি ইমেজে চলে এলাম। জহির ভাই বেশির ভাগ সময় এই দোকানেই বসে থাকেন। দোকানের মালিক ফারুক ভাই উনার জানি দোস্ত। দোকানে একটা পার্টিশান আছে। পার্টিশানের ওপাশে বড় ডিভান পাতা আছে। জহির ভাই এই ডিভানে শুয়ে ঘুমান কিংবা ম্যাগাজিনের ছবি দেখেন। যে-কোনো ম্যাগাজিনের নায়ক-নায়িকার ছবির দিকে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে পারেন।
জহির ভাই ডিভানে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে তার ঘুম ভেঙেছে। চোখে-মুখে এখনো ঘুম লেগে আছে। তার কানের ওপর একটা সিনেমা ম্যাগাজিন। একহাতে সিগারেট অন্য হাতে ম্যাচ। সিগারেট এখনো ধরানো হয় নি। ঘুম কাটলেই সিগারেট ধরাবেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাই তুললেন। আমি বললাম, নাশতা করেছ?
জহির ভাই বিরক্ত গলায় বললেন, না।
চল নাশতা করে আসি।
টাকা আছে?
হুঁ।
পাঁচশ পনের।
জহির ভাই আবারো হাই তুললেন। সিগারেট ধরালেন। বিরক্ত ভঙ্গিতে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমার সন্ধ্যার মধ্যে দুই হাজার টাকা দরকার। মাকে বলে টাকা জোগাড় করে দে।
আমি চাইলে দিবে না। তুমি চেষ্টা করে দেখ।
আমাকেও দিবে না। তোর নীলা ফুপুর কাছে আছে? নাটক-ফাটক করে যখন টাকা থাকার তো কথা।
থাকতে পারে।
চেষ্টা করে দেখবি?
চেষ্টা করতে পারি। এই পাঁচশ রাখ।
খুচরা-খাচরা নিয়ে লাভ নাই। পুরা দুই হাজার জোগাড় করতে পারলে দিবি, না পারলে নাই। ফ্লাক্স নিয়ে যা, আমার জন্যে চা নিয়ে আয়।
বাসার চা, না দোকানের চা? মজিদের দোকানের চা। মজিদকে বলবি যেন স্পেশাল করে বানায়।
জহির ভাই শুয়ে পড়লেন। ম্যাগাজিন খুলে বুকের ওপর ধরলেন। তার দুই হাতে ম্যাগাজিন ধরা, ঠোঁটে সিগারেট। তিনি হাত দিয়ে সিগারেট ধরছেন না। মাঝে-মাঝে মাথা ঝাকি দিচ্ছেন সিগারেটের ছাই ফেলার জন্যে। ছাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি নির্বিকার।
আমি জহির ভাইকে খুবই পছন্দ করি। কেন করি নিজেও জানি না। পছন্দ করার মতো তেমন কোনো গুণ তার নেই। অপছন্দ করার মতো অনেক কিছুই আছে। কোনো মানুষই সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ করে থাকতে পারে না। জহির ভাই পারেন। কেউই ময়লা কাপড় পরতে পছন্দ করে না, জহির ভাই করেন। তার সার্বক্ষণিক পোশাক স্যান্ডেল, জিনসের প্যান্ট এবং হলুদ শার্ট। শার্টে ময়লা জমতে জমতে ছাতা পড়ে গেছে। হলুদ শার্ট এখন আর হলুদ না— কালচে সবুজ।
সমস্যা হচ্ছে, সেই নোংরা কাপড়েও তাকে মানায়। তাঁর চেহারা রাজপুত্রের মতো। ময়লা জামা-কাপড়ে তিনি যখন বের হন তখন মনে হয় ছবির শুটিং হচ্ছে। ছবির নায়ক ভ্যাগাবণ্ড সেজে অ্যাকটিং করছে। জহির ভাইকে নিয়ে একটা মজার গল্প বললে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। তিনি আর আমি মোহাম্মদপুর বাজারে গিয়েছি। মাসের বাজার করা হবে। চাল, ডাল, তেল এইসব কেনা হবে। জহির ভাইয়ের মেজাজ খুবই খারাপ। তিনি বললেন, বাজার সদাই যা করার তুই করতে থাক। আমি এর মধ্যে নেই। আমি এখানে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকব। বাজার শেষ হলে আমাকে নিয়ে যাবি। বাজারের টাকা থেকে আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে যা।
জহির ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই এক লোক এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল। থলথলে হুঁড়িওয়ালা এক লোক। এক হাতে চারটা মুরগি, অন্যহাতে বাজারের থলে। লোকটার পেছনে এক মিন্তি। মিন্তির মাথায় আঁকা ভর্তি কাঁচা বাজার। লোকটা জহির ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, ভালো আছেন?
জহির ভাই জবাব দিলেন না। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা বলল, আমার নাম আজিজুর রহমান খোকন। আমি চিত্রপরিচালক। দূর থেকে আপনাকে দেখে ভালো লেগেছে। আপনি কী করেন?
থুথু ফেলতে ফেলতে জহির ভাই বললেন, কিছু করি না।
রোল কী?
নায়কের বন্ধু।
জহির ভাই বললেন, আমাকে নায়কের বন্ধু করলে আপনার নায়ক মার খাবে। সেটা কি ঠিক হবে?
আজিজুর রহমান খোকন সাহেব বললেন, হাটে বাজারে তো এইসব আলাপ চলে না, আপনি একদিন অফিসে আসুন। আমার অফিস কাকরাইলে। সিনেমা পাড়ায়।
জহির ভাই বললেন, আমি অফিসে যাই না।
থোকন সাহেব বললেন, মোবাইল নাম্বার দেন আমি যোগাযোগ করব।
জহির ভাই বললেন, মোবাইল নাই। আচ্ছা শুনুন, আপনি তো ভালো বাজার করেন। মুরগি ভালো কিনেছেন। দুইটা মুরগি আমাদের দিয়ে যান। এতগুলো দিয়ে কী করবেন?
আজিজুর রহমান খোকন সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন, বাবলু, উনার কাছ থেকে দুইটা মুরগি রেখে দে।
খোকন সাহেব বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, দুটা দিতে না চাইলে একটা দেন। সাদা গলার মুরগিটা দেন।
জোকারি কথাবার্তা বললেও জহির ভাই কিন্তু জোকার না। সিরিয়াস টাইপ মানুষ। খোকন সাহেবের কাছে সে যে মুরগি চেয়েছে জোকারি করে চায় নি, সত্যি সত্যি চেয়েছে।
জহির ভাইয়ের দুই হাজার টাকা সন্ধ্যার মধ্যে দরকার। অবশ্যই জরুরি কোনো কাজে দরকার। জরুরি কাজটা কী কে জানে? পনেরশ টাকার জন্যে আমি কার কার কাছে যাব তার লিস্ট করে ফেললাম। প্রথমে নীলা ফুপু, তারপর বড়খালা, তারপর মা, সবশেষে ভাইয়া।
নীলা ফুপু আমাকে দেখে প্রায় ছুটে এলেন। চোখ-মুখ শুকনা করে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? একটা চিঠি মগবাজারে দিয়ে আসতে একঘণ্টা ছাব্বিশ মিনিট লাগে? মুকুল ভাইকে পেয়েছিলি?
হুঁ।
চিঠি তার হাতে দিয়েছিস?
হুঁ।
চিঠি পড়েছেন?
হুঁ।
তোর সামনেই পড়ছেন?
হুঁ।
সব কথাতেই হুঁ হুঁ করছিস কেন? কথা বলা ভুলে গেছিস? চিঠি পড়ার পর মুকুল ভাই কিছু বলেছেন?
আমাকে বললেন, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিতে পারবে?
শুধু এইটুকু বলেছেন। আর কিছু বলেন নি?
না।
সিগারেট কিনে দিয়ে এসেছিস তো?
হুঁ।
উফ, লোকটা এত সিগারেট খায়! সারা শরীরে সিগারেটের গন্ধ।
আমি কিছুক্ষণ নীলা ফুপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমাকে পনেরশ টাকা ধার দিতে পারবে?
কী করবি?
আমি একজনকে দেব। আমার কাছে চেয়েছে।
সেই একজনটা কে?
জহির ভাই।
আমার কাছে টাকা নেই।
টাকা নেই, তাহলে এত কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? টাকা দিয়ে কী করবি? কাকে ধার দিবি?
জানার জন্যে জিজ্ঞেস করেছি। যা এখন ভাগ। সেদিনের ছেলে, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছে!
আমি নীলা ফুপুর সামনে থেকে বের হলাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সিক্সথ সেন্স আমাকে বলছে টাকা পাওয়া যাবে না। যার কাছে যাব সে-ই বলবে না। মাঝে মাঝে আমার সিক্সথ সেন্স খুব কাজ করে।
বাবলু, একটু শুনে যা তো।
আমি তাকিয়ে দেখি ভাইয়া তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরের দরজা খোলা। খুবই অস্বাভাবিক দৃশ্য, ভাইয়ার ঘরের দরজা কখনো খোলা থাকে না।
একতলার সবচে শেষের ঘরটা ভাইয়ার। ঘরটা ছোট। ঘরের একটাই জানালা, সেই জানালাটাও ছোট। জানালা ঘেঁসে বিশাল একটা পেয়ারা গাছ উঠেছে। গাছে এখন পর্যন্ত কোনো পেয়ারা হয় নি। এই গাছটা নাকি পুরুষ। পুরুষ পেয়ারা গাছের কারণে ভাইয়ার ঘরের জানালা দিয়ে কোনো আলো ঢুকে না। এটাই ভাইয়ার পছন্দ। তাঁর ঘর অন্ধকার থাকতে হবে। তার ঘরে কেউ ঢুকতে পারবে না। ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্যেও না। ভাইয়া তাঁর নিজের ঘর নিজে গোছায়। যে-কেউ ভাইয়াকে দেখলেই বুঝবে সে একজন অস্বাভাবিক মানুষ।
অস্বাভাবিক তো বটেই। এসএসসি পরীক্ষায় ভাইয়া ঢাকা বোর্ডের সব ছেলেমেয়ের মধ্যে থার্ড হয়েছিল। ইন্টারমিডিয়েটে হয়েছে ফোর্থ। ফিজিক্স অনার্স পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড। এমএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনো রেজাল্ট হয় নি। উড়া উড়া শুনতে পাচ্ছি, রেজাল্ট হবার আগেই ভাইয়া পিএইচডি করতে আমেরিকা যাবে। এই বিষয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু শুনি নি। ভাইয়া তার নিজের বিষয়ে কখনো কাউকে কিছু বলে না।
বাবলু বোস, খাটের ওপর বোস।
আমি বসলাম। ভাইয়া আমার সামনে চেয়ারে বসল।
লজেন্স খাবি? হরলিক্সের কৌটায় লজেন্স আছে। নিয়ে খা। আমাকেও একটা দে।
আমি লজেন্স নিলাম। ভাইয়াকে একটা দিলাম।
রাত জেগে পড়ি তো, তখন ব্রেইন প্রচুর সুগার খরচ করে। শরীরে সুগারের ঘাটতি পড়ে। তখন লজেন্স খাই।
আমি লজেন্স চুষছি। ইচ্ছা করছে লজেন্সটা দাঁত দিয়ে ভেঙে গুঁড়া করে ফেলতে। কড়মড় শব্দ হবে। ভাইয়া হয়তো বা বিরক্ত হবে, এই ভয়ে পারছি না।
বাবলু।
হুঁ।
শরীরের রক্তের তিন ভাগের এক ভাগ যে ব্রেইন নিয়ে নেয়, এটা জানিস?
না।
ব্রেইনেরই অক্সিজেন সবচে বেশি দরকার।
ও।
আমার কাছে একটা বই আছে, নাম বোকাওয়ার্স ব্রেইন। পড়ে দেখতে পারিস। মজা পাবি।
ইংরেজি পড়তে পারি না ভাইয়া
ইংরেজি পড়তে না পারার কী আছে? একটা ডিকশনারি নিয়ে বসবি। অজানা শব্দগুলির মানে ডিকশনারিতে দেখে নিবি। ভোকাবলারি বাড়বে।
আচ্ছা।
এখন তোর খবর কী বল?
আমি হুট করে বলে ফেললাম, আমাকে পনেরশ টাকা দিতে পারবে ভাইয়া।
কত?
পনেরশ।
তোষকের নিচে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ থেকে নিয়ে নে।
আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা নিলাম। হরলিক্সের কৌটা থেকে আরেকটা লজেন্স নিলাম। এই লজেন্স কড়মড় করে ভেঙে খাব। ভাইয়া বিরক্ত হলে হবে।
বাবলু, তোকে একটা কথা বলার জন্যে ডেকেছি। তোর সঙ্গে তো বাবার খুব খাতির। বাবা যে আরেকটা বিয়ে করেছে এটা জানিস? বাবা তোকে কিছু বলেছে?
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, না!
বিয়ে করেছে চার বছর আগে। ঐপক্ষে তার একটা মেয়েও আছে। মেয়ের নাম যূথী।
আমি কড়মড় করে লজেন্স ভাঙলাম। ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো না লজেন্স ভাঙার শব্দ তার কানে গেছে।
ঘটনাটা আমি জানি আর মা জানে। বাবা আর ঐ মেয়ে একটা ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। তোকে ঠিকানা দিচ্ছি, তুই ভেরিফাই করে আসবি।
এখন যাব?
না, এখন না। একটু রাত করে যা।
ভাইয়ার ঘর থেকে বের হয়ে দেখি মা বারান্দায় মোড়ার ওপর বসেছেন। মাথাটা উঠানের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। নতুন একটা কাজের মেয়ে মার মাথায় পানি ঢালছে। এটা নতুন কোনো দৃশ্য না। প্রায়ই মার মাথা গরম হয়ে যায়, তখন তাঁর মাথায় পানি ঢালতে হয়। কাজের মেয়েটিকে দেখে মনে হলো, পানি ঢালার কাজটায় সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। একহাতে জগে করে পানি ঢালছে অন্যহাতে মাথায় থাবড়া দিচ্ছে। থাবড়া দেয়ার সময় তার মুখ হাসি হাসি হয়ে যাচ্ছে।
মা আমাকে দেখেছেন। তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। বাবা বিষয়ে কোনো কথা বলবেন কি-না বুঝতে পারছি না। কাজের মেয়ের সামনে বলার কথা না— তবে উচিত অনুচিত নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ তিনি না। আমি কাছে গেলাম। মা ভাঙা গলায় (মার গলা কখনো ভাঙে না, তবে যে-কোনো সময়ে তিনি দুঃখের কথা ভাঙা গলায় বলতে পারেন। আমার সঙ্গে ভাঙা গলায় কথা বলে তার পরপরই অন্য একজনের সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কথা বলবেন। এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।) বললেন, খোকনের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিস?
হুঁ।
আমার স্যান্ডেলটা সাথে করে নিয়ে যা। যদি দেখিস ঘটনা সত্যি, আমার স্যান্ডেলটা দিয়ে তোর বাপকে দশটা বাড়ি দিবি। পারবি না? অবশ্যই আমার স্যান্ডেল নিয়ে যাবি। স্যান্ডেল না নিয়ে গেলে তুই আমার কু পুত্র। তোকে আমি পেটে ধরি নাই। অন্য কোনো মাগি তোকে পেটে ধরেছে।…
মা হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। তার ভাঙা গলা ঠিক হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা মার কথা শুনেও মজা পাচ্ছে। সে মুখ আড়াল করে হাসার চেষ্টা করছে। তার হাসির শব্দ মার কানে গেলে বিপদ আছে। মা কাজের মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে খুব পছন্দ করেন।
জহির ভাইকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তিনি টাকা হাতে নেন নি। বিরক্ত মুখে বলেছেন, ম্যাগাজিনটার নিচে রেখে দে। টাকা দিয়েছে কে?
ভাইয়া।
সাতদিনের মধ্যেই টাকা ফেরত দিব। তখন মনে করে যার টাকা তাকে দিয়ে দিবি।
আচ্ছা।
জহির ভাই বসে আছেন আমার ঘরে। আমার ঘর বলা ঠিক হচ্ছে না, আমাদের ঘর বলা উচিত। জহির ভাই আমার সঙ্গে থাকেন। এই ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট পাতা। তবে এখানে তিনি থাকেন না বললেই হয়। তার স্থায়ী ঠিকানা এখন দি ইমেজ।
বাবলু!
কী জহির ভাই।
এই দুই হাজার নিয়ে আমার কাছে এখন টোটাল ক্যাশ টাকা কত আছে জানিস?
না।
আন্দাজ কর।
পাঁচ হাজার?
পঁয়তাল্লিশ হাজার।
এত টাকা?
পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা বাংলাদেশে এখন কোনো টাকাই না। সদরঘাটে ভিক্ষা করে যে ফকির তাঁর কোচড়েও এই টাকা থাকে। একটা জার্মান লুগার পিস্তলের দাম সত্ত্বর হাজারের ওপরে। চাইনিজ পিস্তলের দাম ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার।
তুমি কি পিস্তল কিনবে?
জহির ভাই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন। এখন তার চোখে মুখে বিরক্তি নেই। তাঁকে আনন্দিতই মনে হচ্ছে।
বাবলু!
জি জহির ভাই।
তোর এখানে রাতে ঘুমাই না কেন বল তো?
জানি না।
অনুমান কর।
ঘরটা ছোট, সিলিং ফ্যানে শব্দ হয়। শব্দে তুমি ঘুমাতে পার না।
হয় নি। তোর ওপরে আমার আছর হোক, এটা চাই না বলেই তোর সঙ্গে ঘুমাই না। ঘুমের সময় আত্মা ফ্রি হয়ে যায়। একজনের আত্মার সঙ্গে আরেকজনের মিলমিশ বেশি হয়। আছরও বেশি পড়ে। তুই যদি সাতদিন কোনো ক্রিমিন্যালের সঙ্গে ঘুমাস, অষ্টম দিনে তুই নিজেও ক্রিমিন্যাল হয়ে যাবি।
তুমি কি ক্রিমিন্যাল?
এখনো জানি না। পিস্তল হাতে আসুক, তারপর বুঝব।
মানুষ মারবে?
হুঁ।
কাকে মারবে?
জহির ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, প্রথম ধরা খাবে দি ইমেজের মালিক– আমার প্রাণপ্রিয় দোস্ত, ফারুক ভাইজান।
উনি কী করেছেন?
উনি কী করেছেন তোর জানার দরকার নাই। এই জগতের নিয়ম যত কম জানবি তত সুখে থাকবি। পিঁপড়া সবচে কম জানে বলে সে মহাসুখে আছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিঁপড়ার চেয়ে একটু বেশি জানে উইপোকা। উইপোকাকে কী করতে হয়? আগুন দেখলেই তাকে উড়ে আগুনের কাছে যেতে হয়। উইপোকা যদি কম জানতো তাহলে তাকে আগুনে পুড়ে মরতে হতো না। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
পনের মিনিট ঘুমাব, বুঝতে পারছিস?
পারছি।
ঘড়ি হাতে নিয়ে বসে থাক। ঠিক পনের মিনিট পরে আমাকে ডেকে তুলবি। তোর ঘড়ি আছে না?
না।
ঠিক আছে তোকে একটা দামি ঘড়ি দেব। আপাতত আমার ঘড়ি হাতে বসে থাক। ঠিক পনের মিনিট পরে ডাকবি। পনের মিনিটের জায়গায় যদি ষোল মিনিট হয়, কনুইয়ের গুতা খাবি। জায়গা মতো কনুইয়ের গুতা দিলে যে মানুষ মরে যায়, এটা জানিস?
না।
মানুষের শরীরে কয়েকটা দুর্বল জায়গা আছে, সেখানে গুতা লাগলে শেষ। কলমা পড়ার সুযোগও পাবে না।
জহির ভাই তাঁর হাতঘড়ি খুলে আমার হাতে দিলেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন, আমি কাউন্টিং শুরু করতে বললেই কাউন্টিং শুরু করবি।
আচ্ছা।
মা না-কি আজকাল ভূত-প্রেত দেখা শুরু করেছে, এটা সত্যি?
হুঁ।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।
সত্যিও তো হতে পারে।
হতে পারে। There are many things in heaven and earth… কার কথা বল দেখি?
শেক্সপিয়ারের।
জানলি কী ভাবে?
তুমি আগে একবার বলেছিলে—
ভেরি গুড। হ্যামলেটে আছে। Ok, start counting.
জহির ভাই পাশ ফিরলেন। আমি তাকিয়ে আছি ঘড়ির দিকে। জহির ভাই বিষয়ে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি— জহির ভাইও খুব ভালো ছাত্র। ভাইয়ার মতো না হলেও বেশ ভালো। এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই স্টার পাওয়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হলেন। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় তাঁর সত্ত্বাবা (আমার বড়খালু) রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন। তখন খালা বললেন, জহিরের পড়ার খরচ আমি দিব কেন? ও তো ফকিরের পুলা। আমার ছেলে তো না। ফকিরের পুলার পিছনে আমি কেন পয়সা নষ্ট করব? আমার স্বামী নাই, প্রতিটা পাই পয়সা আমাকে হিসাব করে খরচ করতে হয়। ফকিরের পুলার পিছনে আমি আর একটা পয়সা খরচ করব না।
জহির ভাই তখন খালাকে বললেন, আমি তাহলে কী করব?
খালা বললেন, তুই তোর বাপ মারে খুঁজে বের কর। পরের ঘাড়ে আর কতদিন বসে থাকবি?
আলোচনার এই পর্যায়ে বাবা বললেন, বড়আপা, আপনারা একসময় আগ্রহ করে এই ছেলেকে পালক এনেছেন। এখন হঠাৎ করে…
বড়খালা বললেন, তোমার যদি এত দরদ থাকে তুমি পাল। তুমি তার পড়ার খরচ দাও।
বাবা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, কষ্ট টষ্ট করে খরচ আমিই দিব। অনার্সটা পাশ করে ফেললে চাকরির চেষ্টা করা যাবে। বড় বড় লোকজন আমার পরিচিত। আব্দুল গনি নামে একজন আছে, পুরান ঢাকায় রিয়েল স্টেট করে কোটিপতি হয়েছে। তার সঙ্গে একসময় একখাটে ঘুমাতাম। তাকে গিয়ে যদি বলি— গনি! ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করে দাও। সে আমার কথা ফেলতে পারবে না। তার অসংখ্য ফার্ম। কোনো একটার ম্যানেজার বানায়ে দিবে। পোস্ট থাকলে পোস্ট ক্রিয়েট করবে। এইটুকু আমার জন্যে তাকে করতেই হবে।
আমাকে ডাকতে হলো না। পনের মিনিট পার হবার আগেই জহির ভাই উঠে বসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?
আমি বললাম, এগারো মিনিটেরও কম।
এতেই চলবে, শরীর ফ্রেশ লাগছে। এগারো মিনিটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন দেখেছি। ইন্টারেস্টিং এবং ভয়াবহ।
কী স্বপ্ন?
আমি একটা ঠেলাগাড়িতে বসে আছি। দুজন মহিলা ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সামনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। পেছনের জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি। তাও ভালোমতো না। কারণ আমি যতবার মহিলার দিকে তাকাই, উনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। এই হলো স্বপ্ন।
আমি বললাম, ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন ঠিকই আছে। ভয়াবহ তো না।
অবশ্যই ভয়াবহ। দুজন মহিলার কারোর গায়েই কাপড় নেই। একগাছা সুতাও নেই। আমার গায়েও কাপড় নেই। অথচ রাস্তার সবার পরনে কাপড়। সবাই আমাদের দেখে মজা পাচ্ছে– হাসছে। এখন বল, স্বপ্নটা ভয়াবহ না?
হুঁ।
জহির ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। আমার শার্টের পকেটে ঠিকানা লেখা কাগজ আছে। সেই ঠিকানায় যেতে হবে। বিকাল ছটা বাজে। সূর্য ড়ুববে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। সেই সময় ঘর থেকে বের হতে নেই। ঘর ছেড়ে বের হতে হলে আগেই বের হতে হবে।