০১. আমার বাবা

জারুল চৌধুরীর মানিক জোড় – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশের গ্রন্থমেলা ১৯৯৫

১. আমার বাবা

বাসায় ঢোকার আগেই বুঝতে পারলাম আজকে আমার কপালে দুঃখ আছে। ছোটখাট দুঃখ নয়, বড়োসড়ো ডাবল সাইজের দুঃখ। বাইরে দড়িতে একটা লুঙ্গি ঝুলছে, তার মানে বাবা এসেছেন। শিউলী গাছের একটা ডাল আজকে আমার পিঠে ভাঙা হলে; বাসার এত কাছে শিউলী গাছ থাকার কোন অর্থই হয় না। সারা বছরে মাসখানেক তিন-চারটা ফুল দিয়েই তার কাজ শেষ, লাভের মাঝে লাভ বাবা যখন খুশি তখন পেটানোর জন্যে সেখান থেকে একটা ডাল ভেঙে আনতে পারেন।

আমি ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকলাম। মনে খুব একটা দুর্বল আশা, দড়িতে যে লুঙ্গিটা ঝুলছে সেটা বাবার না, অন্য কারো! গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ বেড়াতে এসেছে, কারো বিয়ে কিংবা অসুখ, জমি নিয়ে মামলা করতে এসেছে বা সে রকম একটা কিছু। ভিতরে ঢুকতেই আমার আশা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। শুনতে পেলাম বাথরুমে বাবা ঘড়ঘড় শব্দ করে জিব পরিষ্কার ২রছেন। জিব পরিষ্কার করার এই ব্যাপারটা আমি বাবা ছাড়া আর কাউকে কখনো করতে দেখিনি। প্রথমে একটা চিকন বাঁশের চাছ দিয়ে জিবটা চেঁছে ফেলেন। তারপরে শোল মাছ ধরার মত নিজের জিবটা ধরার চেষ্টা করতে থাকেন, সেটা বারবার পিছলে যায়, তবু তিনি হাল ছাড়েন না। একবার ধরার পর সেটা নানাভাবে কচলাতে থাকেন, ঘষতে থাকেন, রগড়াতে থাকেন, তখন একই সাপ তার গলা থেকে এক রকম ঘড়ঘড় শব্দ বের হতে থাকে। শুনলে মনে হবে কেউ বুঝি তাকে জবাই করে ফেলার চেষ্টা করছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা খুব খারাপ দৃশ্য, দেখার মত কিছু নয়। মাসে এক-দুইবার যখন বাবা আসেন তখন আমাদের প্রত্যেক বেলা সেই দৃশ্যটা দেখতে হয়, শুনতে হয়। বাবা ঢাকায় একটা ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করেন। যত টাকা বেতন পান এবং ঘুষ খেয়ে চুরি-চামারী করে আরো যত পয়সা পান সব দিয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে খুব সহজেই ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া করে থাকতে পারতেন। কিন্তু বাবা সেটা করেন না। আমাদেরকে মফস্বলের এই ছোট শহরে মায়ের সাথে রেখে তিনি ঢাকায় জঘন্য একটা মেসে একা একা থাকেন। ছুটিছাটায় বাবা বাসায় আসেন, বাসায় এসে দুই বেলা জিব পরিষ্কার করেন আর আমাদের দুই ভাইকে পেটান। আগে ভাবতাম, নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি আমরা কোন দোষ করি যার জন্যে এই শাস্তি। এখন বুঝতে পেরেছি, আমরা আসলে কিছু করিনি, বাবার পেটাতে ভাল লাগে, খুব একটা আনন্দ পান পিটিয়ে। ঠিক শুরু করার আগে আমি বাবাকে সুড়ুৎ করে মুখে লোল টেনে নিতে দেখেছি। কিছু কিছু মানুষ নিশ্চয়ই আছে যারা এরকম হয়, যাদের পেটাতে ভাল লাগে। আমার বাবা সেরকম একজন মানুষ। নিয়মিত পিটুনী খেলে মানুষের অভ্যাস হয়ে যাবার কথা, কিন্তু আমাদের এখনও অভ্যাস হয়নি। পিটুনিটা। একটু বাড়াবাড়ি, ছোটখাট চড় চাপড় বা কানমলা নয়, প্রচণ্ড মার, কখনো কখনো চামড়া ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। আমি তবু কোন মতে সহ্য করতে পারি কিন্তু লাবলুর একেবারে বারটা বেজে যায়। কেমন করে পিটুনী খেলে ব্যথা কম লাগে আমি লাবলুকে তনেকবার তার ট্রেনিং দিয়েছি, কিন্তু গাধাটা এখনো কিছু শিখেনি।

বাবা বাথরুম থেকে বের হওয়ার আগেই আমি শুট করে রান্নাঘরে ঢুকে যাবার। চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বাবা তবু দেখে ফেললেন। আমাকে দেখেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একটা গর্জন করে বললেন, শুওরের বাচ্চার এখন বাসায় আসার সময় হয়েছে? হারামজাদা, আজকে যদি আমি পিটিয়ে তোর পিটের চামড়া না তুলি-–

 বাবা আমাকে শুওরের বাচ্চা না হয় হারামজাদা ছাড়া আর কিছু ডাকেন না। আমার যে একটা নাম আছে, একসময়ে নিশ্চয়ই বাবাই (সটা দিয়েছিলেন, সেটা মনে হয় তার মনেই নেই। বাবার চেহারা, কথা বলার ধরন, চালচলন সব কিছুতে একটা পশু পশু ভাব রয়েছে। কোন পশু সেটা ঠিক ধরতে পারি না, মাঝে মাঝে মনে হয়। শেয়াল, মাঝে মাঝে মনে হয় বেজী না হয় নেউল। মুখটা একটু লম্বা, বড় বড় দাঁত, পান খেয়ে দাঁতে হলুদ রং, দাঁতগুলির মাঝে বড় বড় ফাঁক, থুতনিতে এক গোছা দাড়ি, পশু মনে হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত গুটালেন, মনে হল এখনই আমাকে এক রাউণ্ড পিটিয়ে নেবেন, কিন্তু কি মনে করে পিটালেন না। মনে হয় মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে গেছে, এখন জুত করে পেটানোর সময় নেই। গামছা দিয়ে দাড়ি মুছতে মুছতে দাঁত কিড়মিড় করে আমাকে গালি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামাজ পড়তে চলে গেলেন। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে আমি বাবার একামৎ শুনতে পেলাম।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে দরজার আড়ালে লাবলুকে খুঁজে পেলাম। ফোঁসফোঁস করে কাঁদছে। মা খুব হৈ চৈ করে ঘামতে ঘামতে রান্না করছেন। কড়াইয়ের মাঝে গরম তেলে কি একটা ছেড়ে দিলেন, ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ হতে লাগল। রান্নাঘরে তেল মশলার গন্ধ, চুলো থেকে ধোয়া উঠছে। আমি তার মাঝে লাবলুকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কখন এসেছে?

লাবলু ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, দুপুরে।

কাঁদছিস কেন?

লাবলু কিছু বলল না। জিজ্ঞেস করলাম, মেরেছে তোকে?

না। এখনো মারে নাই।

তাহলে কাঁদছিস কেন?

এখুনি তো মারবে।

আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। লাবলুটার মত গাধা আর একটাও নেই। আজকালকার দুনিয়ায় এরকম বোকা মানুষ কেমন করে জন্ম নেয় কে জানে! আমি গলা নামিয়ে বললাম, শার্টের তলায় একটা হাফ সোয়েটার পরে নে। আর মনে রাখিস, যখন মারবে তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবি। ভান করবি মরে যাচ্ছিস।

কেন?

তাহলে ব্যথা কম লাগে।

লাবলু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমার বয়স বার, লাবলুর আট, আমার থেকে চার বছরের মত ছোট। কিন্তু তার বুদ্ধিশুদ্ধি মনে হয় একেবারে তিন বছরের বাচ্চার। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আর খুব জোরে যদি চিৎকার করিস তাহলে কেউ . একজন এসে তো ছুটিয়েও নিতে পারে।

কে ছুটাবে?

আমি কিছু বললাম না। সত্যিই তো, কে ছুটাবে? মায়ের সেই সাহস নেই, ইচ্ছাও নেই। আশেপাশের বাসায় যারা আছে তারা শুধু মজা দেখে। আমি কেনে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মনে হয় আর কোন গতি নেই। লাবলুটার কি অবস্থা হবে সেটাই চিন্তা। মাঝে মাঝে বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ত্যাজ্যপুত্র করে দেয়, ত্যাজ্যবাবা করে দেওয়ার কি কোন নিয়ম নেই?

.

রাত্রে খাবার পর বাবা আমাকে আর লাবলুকে পিটালেন। সাধারণতঃ তাই করেন, খেয়ে মনে হয় আগে একটু জোর করে নেন। তারপর আমাদের বলেন বই নিয়ে আসতে। আমরা বই নিয়ে এসে বসি, তারপর আমাদের ইংরেজি বানান জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। একটার পর আরেকটা, যতক্ষণ না আটকে যাই। আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, “লেফটেনেন্ট”, সেটা জানতাম। ঠিক ঠিক বলামাত্র বাবার মুখ রাগে কালো হয়ে গেল। তখন জিজ্ঞেস করলেন ”নিমোনিয়া, সেটাও ঠিক ঠিক বলে ফেললাম। তখন বাবা আরও রেগে গেলেন, দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করলেন ”ইউক্যালিপ্টাস”, আমি আটকে গেলাম। সাথে সাথে বাবার চোখগুলো জ্বলে উঠল একশ ওয়াটের বাতির মত। মুখে লোল টেনে বললেন, শয়তানের বাচ্চা, বদমাইশের ধাড়ী, পড়াশোনা নেই, নামাজ রোজা নেই, দিনরাত শুধু ঘোরাঘুরি, আজকে যদি আমি তোর জান শেষ না করি।

শিউলী গাছের ডালটা আগেই ভেঙে এনেছিলেন, সেটা আমার উপর দিয়ে গেল। আমি গরুর মত চিৎকার করতে করতে একটা ভীড় জমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কোন লাভ হল না। আশেপাশে যারা থাকে তারা জানালা খুলে মজা দেখতে লাগল। লাবলুটাকে এত ট্রেনিং দেয়ার পরও কোন লাভ হল না। মাথা নিচু করে ফোঁসফোঁস করে কঁদতে কাঁদতে মার খেয়ে গেল। চিৎকার করে না বলে বাবা ঠিক বুঝতে পারেন মারটা ঠিকমত লাগছে কি না, বাবা মনে হয় তাই গাধাটাকে আরো জোরে জোরে মারেন।

আমাদের পেটানোর পর বাবার এক রকমের আরাম হয়। খানিকক্ষণ তখন হাসি হাসি মুখ করে মায়ের সাথে সাংসারিক কথাবার্তা বলেন। তারপর বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যান। আজকেও বের হয়ে গেলেন। কোথায় যান কাউকে বলে যান না, কিন্তু আমরা সবাই জানি। বাবার বাজারের ব্যাগ বোঝাই করা থাকে ওষুধ। যেখানে কাজ করেন সেখান থেকে চুরি করে আনেন। বাবা এই ওষুধগুলি বিক্রি করতে যান। মীনা ফার্মেসীর মতি মিয়ার সাথে ঠিক করে রাখা আছে, বাবা ওযুধগুলি তাদের কাছে কম দামে বিক্রি করে আসেন।

বাবা ফিরে আসার আগেই আমি আর লাবলু শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে শুনি বাবা ঘরে ঢুকছেন। ঘুমানোর আগে বাবা চা খান। চা খেয়ে ওজু করেন, আবার অনেকক্ষণ। সময় নিয়ে বিকট শব্দ করতে করতে জিব পরিস্কার করেন। তারপর এশার নামাজ। পড়েন। আমি আর লাবলু শুয়ে শুয়ে শুনি বাবা সুর করে করে সূরা পড়ছেন। বাবা কখনো নামাজ কাজা করেন না। মনে হয় অনেক রকম চুরিচামারি করেন, সেই সব পাপ কাটানোর জন্যে তাকে অনেক নামাজ পড়তে হয়।

লাবলু বিছানায় শুয়ে ফোঁসফোঁস করে কাঁদে। আমি তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিই। চাপা গলায় আদর করে, কিছু একটা বলে মনটা ভাল করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন লাভ হয় না। এই গাধাটা কাঁদতেই থাকে। যদি কোনদিন বাসা থেকে পালাই মনে হয় লাবলুটাকে নিয়েই পলাতে হবে। কি যন্ত্রণা!

1 Comment
Collapse Comments

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর আরো কিশোর উপন্যাস চাই!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *