০১. আমার নাম কুটু মিয়া

আমার নাম কুটু মিয়া।

আলাউদ্দিন কুটু মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু মানুষ আছে যাদের ওপর চোখ পড়লে দৃষ্টি আটকে যায়। কুটু মিয়া সে-রকম একজন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, পুরনো আমলের বাড়ির খাম্বা দাঁড়িয়ে আছে। খাম্বার মতো পুরো শরীরটার ভিতর গেল ভাব আছে। তেলতেল মুখ, চকচক করছে। গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। সাধারণত কালো মানুষের মাথা ভর্তি চুল থাকে। কুটু মিয়ার মাথায় খাবলা খাবলা চুল। কোনো বিচিত্র চর্ম রোগে মাথার চুল জায়গায় জায়গায় উঠে চকচকে তালু দেখা যাচ্ছে। লোকটার চোখ অতিরিক্ত ছোট বলে চোখের সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে না। চোখের কালো মণি গায়ের কালো চামড়ার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় লোকটার চোখ নেই। তারচেয়েও বড় সমস্য! একটা চোখ প্রায় বন্ধ।

আলাউদ্দিন পরিষ্কার শুনেছেন লোকটার নাম কুটু মিয়া। তারপরেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা যেন কী? কথা খুঁজে না পেলে মানুষজন এই কাজটা করে একটা কথা নিয়ে পেঁচাতে থাকে।

স্যার, আমার নাম কুটু মিয়া।

আলাউদ্দিন বললেন, ও আচ্ছা, কুটু মিয়া নাম।

আলাউদ্দিন দ্রুত চিন্তা করছেন আর কী জিজ্ঞেস করা যায়। কোনো কথাই মনে আসছে না। লোকটার গা থেকে বাসি বাসি গন্ধ আসছে। কেমন টক টক গা গোলানো গন্ধ। কুটু মিয়া দুপা সামনে এগিয়ে এসে বলল, স্যার আপনের বাবুর্চি দরকার। আমি বাবুর্চির কাজ জানি।

কুটু মিয়া তার ফতুয়ার পকেট থেকে কাগজ বের করে এগিয়ে দিল। আলাউদ্দিন কাগজটা হাতে নিলেন। একটা টাইপ করা প্রশংসাপত্র। কাগজটা। লেমিনেট করা। বোঝাই যাচ্ছে খুবই যত্নে রাখা কাগজ।

প্রশংসাপত্র কে দিয়েছেন?

পাইলট স্যার দিয়েছেন। উনার বাড়িতে দুই বছর সার্ভিস করেছি। একটু পইড়া দেখেন।

আলাউদ্দিন প্রশংসাপত্রে চোখ বুলালেন। ইংরেজিতে যে কথাগুলি লেখা তার সারম— কুটু মিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলী। যাদুকর। বাবুর্চি হিসেবে তাকে পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি তার সাফল্য কামনা করি।

আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কী রান্না জানো?

কুটু মিয়া হাসি মুখে বলল, সব কিছু অল্প বিস্তর জানি। ইংলিশ, বেঙ্গলি, চাইনিজ, থাই।

তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি হোটেল রেস্টুরেন্টের প্রফেশনাল বাবুর্চি। আমার সে-রকম দরকার নেই। আমার কাজের লোক টাইপ একজন দরকার। ঘর ঝাট দিবে, বাথরুম পরিষ্কার করবে। রান্নাবান্না করবে, বাজার করবে।

আমি ঘরের কাজও জানি।

বেতন কত দিতে হবে?

আপনার দিলে যা চায় দিবেন। আমার কোনো দাবি নাই।

আলাউদ্দিন ধাধার মধ্যে পড়ে গেলেন। একটা কাজের লোকের তার খুবই প্রয়োজন। গত পনেরো দিনে তিনটা কাজের লোক চলে গেছে। সর্বশেষটির নাম জিতু মিয়া। সে খালি হাতে যায় নি। তিন ব্যান্ডের একটা দামি রেডিও এবং রাইস কুকারটা নিয়ে চলে গেছে। রাইস কুকার মাত্র গত মাসে কেনা হয়েছে। তার জন্য খুবই কাজের একটা জিনিস। এক পট চাল আধা পট পানি দিয়ে সুইচ অন করে দেন। ভাত হয়ে গরম থাকে। খেতে বসার আগে আগে একটা ডিম ভেজে নেয়া। এখন তিনি প্রায় অচল। দুই বেলা হোটেল খেকে খেয়ে আসতে হচ্ছে। হোটেলের বাবার এক দুই বেলা ভালো লাগে, তারপর আর মুখে দেয়া যায় না। গতকাল গোসল করতে পারেন নি। টংকে পানি ছিল না। কাজের একটা ছেলে থাকলে দুবালতি পানি নিয়ে আসত।

কুটু মিয়া নামের যে লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে যত ভালো বাবুর্চিই হোক তাকে রাখা যাবে না। অত্যন্ত বলশালী মধ্যবয়স্ক একজন লোক মর ঝাট দিচ্ছে, কাপড় ধুচ্ছে— এটা মানায় না। তাছাড়া লোকটার চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখের দিকে তাকালেই অস্বস্তি বোধ হয়। এ রকম মানুষ আশেপাশে থাকলে সব সময় খুব সুক্ষ্ম টেনশান কাজ করবে। আলাউদ্দিন টেনশানবিহীন জীবন চাচ্ছেন।

তুমি চলে যাও, তোমাকে রাখব না— এ ধরনের কথা মুখের ওপর বলা মুশকিল। আলাউদ্দিন চিন্তা করতে লাগলেন বুদ্ধি খাটিয়ে একে বিদায় করা যায়। কি-না। সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না— এ রকম কিছু। বুদ্ধিটাই মাথায় আসছে না।

কুটু মিয়া!

জ্বি স্যার।

আমি দরিদ্র মানুষ। কলেজে মাস্টারি করতাম, এখন রিটায়ার করেছি। একা বাস করি তারপরেও সংসার চলে না। আগে যে কাজের ছেলেটা ছিল তাকে মাসে তিনশ টাকা দিতাম। তিনশ টাকায় নিশ্চয় তোমার চলবে না। তিনশ টাকার বেশি দেয়া আমার সম্ভব না।

কুটু মিয়া শান্ত গলায় বলল, স্যার আপনাকে তো বলেছি। যা আপনার দিল চায় তাই দিবেন।

তুমি থাকবে তিনশ টাকায়?

জি।

আলাউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। দেশের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলের আসার কথা। সে এলে তোমাকে চলে যেতে হবে।

কবে আসবে?

এটা তো জানি না। কাল পরশু আসতে পারে। আবার দুই একদিন দেরিও হতে পারে। মোট কথা তোমার চাকরি টেম্পরারি। বুঝতে পারছ?

জ্বি।

রান্নাঘরের পাশে একটা ঘর আছে। সেই ঘরে থাকবে। ফ্যান নেই, গরমে কষ্ট হবে। আমার এখানে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। মাঝে মাঝে পানি থাকে না, তখন রাস্তার কল থেকে পানি আনতে হবে। অনেক কষ্ট। পারবে কিনা ভেবে দেখ।

পারব স্যার।

যদি পার তাহলে তো ঠিকই আছে। যাও তোমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আস।

জিনিসপত্র সবই সাথে আছে স্যার।

তাহলে তো ভালোই।

কাজের লোকদের জিনিসপত্র কলাতে একটা ব্যাগ থাকে। তারচেয়ে বেশি কিছু থাকলে একটা পুটলি। কুটু মিয়ার ক্ষেত্রে উল্টোটা দেখা গেল। আলাউদ্দিন ভুরু কুচকে লক্ষ করলেন কুটু বারান্দা থেকে তার জিনিসপত্র আনছে। দুটা বড় স্যুটকেস, একটা হ্যান্ড ব্যাগ। ফলের ঝুড়ির মতো ঝুড়ি। ফ্লাস্ক, পানির বোতল। ছোট্ট চামড়ার একটা ব্যাগও দেখা গেল। দূর থেকে মনে হচ্ছে ক্যামেরার ব্যাগ।

আলাউদ্দিন বললেন, তোমার ঐ ব্যাগে কী? ক্যামেরা না-কি?

কুটু বিনীত গলায় বলল, জ্বি না স্যার। দুরবিন। বিদেশে যখন ছিলাম শখ করে কিনছিলাম।

বিদেশে ছিলে না কি?

জ্বি।

কোথায় ছিলে?

কুইত।

কুইত নামে কোনো বিদেশ আছে বলে তার মনে পড়ল না। কুয়েতকেই কি কুইত বলছে?

কুইতে কী কাজ করতে?

বাবুর্চির কাজ করতাম।

চলে এসেছ কেন?

মালিকের ইন্তেকাল হয়েছে। উনার বড় বিবি থাকতে বলেছিল। মন টিকল না। স্যার, রাতে খানা কয়টার সময় দিব?

আমি দশটা সাড়ে দশটার দিকে খাই। ফ্রিজ খুলে দেখ— একটা মুরগি থাকার কথা। গত পরশু কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম নিজেই রাধব, পরে আর রাধা হয় নি। চাল ডাল আছে। মশলা আছে কিনা জানি না। গাদা খানিক ভাত রান্না করবে না। আমি খুবই অল্প খাই।

জি আচ্ছা।

কিছু পানি ফুটিয়ে রাখবে। পানি ফুটানো হয় না বলে কয়েক দিন ধরে ট্যাপের পানি খাচ্ছি। আরেকটা কথা— কাজকর্ম করবে নিঃশব্দে। আমি লেখালেখি করি। সাড়া শব্দ হলে আমার ডিসটার্ব হয়।

সকালে বেড টি খান?

পেলে খাই তবে বেড় টি-টা জরুরি না। ঐসব বড়লোকী চাল আমার জন্যে। আগেই বলেছি আমি গরীবের সন্তান।

বেড টি কয়টার সময় দিব?

ঘুম ভাঙলে দিবে। আমার ঘুম ভাঙার কোনো ঠিক নেই। কখনো কখনো খুব সকালে উঠি। আবার কোনো দিন নয়টা দশটা বেজে যায়। কত রাতে ঘুমাতে গিয়েছি তার ওপর নির্ভর। ঠিক আছে, এখন সামনে থেকে যাও। কাজ কর্ম করতে দাও।

জি আচ্ছা জনাব, শুকরিয়া।

কুটু মিয়া রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আলাউদ্দিন ভুরু কুঁচকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আসল কথাই কুটুকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। তার বাড়ি কোথায়? ঠিকানা কী? কে তাকে এখানে পাঠিয়েছে? হুট করে নতুন কোনো মানুষকে ঘরে ঢুকানো ঠিক না। দিনকাল আগের মতো নেই। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে কাজের মেয়ের হাতে গৃহকর্তী খুন। এইসব খুনখারাবি অবশ্যি টাকা পয়সার কারণে হয়। আলাউদ্দিন সাহেবের একটা বড় সুবিধা তার টাকা পয়সা নেই। ঘরের দামি জিনিসপত্রের মধ্যে আছে একটা পুরনো ফ্রিজ। পুরনো ফ্রিজের জন্য। তাকে কেউ খুন করবে এ রকম মনে হয় না। একটা ১৪ ইঞ্চি টিভি কেনার কথা কয়েকবার ভেবেছেন। তাঁর নিজের জন্য না, ঘরের কাজের লোকের জন্য। যে বাড়িতে টিভি নেই সে বাড়িতে কোনো কাজের লোক থাকে না এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। টিভি এখনো কেনা হয় নি, তবে টিভি কেনার টাকা আলাদা করা আছে।

আলাউদ্দিন নেত্রকোনার শেখ ইসলামুদ্দিন কলেজের ইসলামিক ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। রিটায়ার করে এখন ঢাকা শহরে স্থায়ী হয়েছেন। আশা ছিল। কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তিনি শুনেছেন কোচিং সেন্টারগুলির রমরমা ব্যবসা। অনেক ছোটাছুটি করেও তিনি কোনো সুবিধা করতে পারেন নি। ভূতের গলিতে একটা ফ্লাটের অর্ধেকটায় তিনি থাকেন। বাকি অর্ধেকটায়। গার্মেন্টস কোম্পানির এক ম্যানেজার থাকে। নাম সাইফুদ্দিন। লোকটা অবিবাহিত। কিন্তু প্রায়ই গভীর রাতে তার ঘর থেকে মেয়ে মানুষের গলা শোনা যায়। ছুটির দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাস খেলা হয়। তাদের আড়া বসলেও কোনো হৈচৈ হয় না। সাইফুদ্দিন লোকটি ভদ্র এবং বিনয়ী। আলাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রফেসর সাহেব ডাকে। আলাউদ্দিনও তার ওপর সস্তুষ্ট। কারণ ফ্ল্যাটের অর্ধেক ভাগাভাগিতে রান্নাঘর আলাউদ্দিনের ভাগে পড়েছে। কথা ছিল প্রয়োজনে রান্নাঘর সাইফুদ্দিনও ব্যবহার করবে। সাইফুদ্দিন সেটা কখনো করে নি। সে ইলেকট্রিক চুল কিনে আলাদা রান্নাঘর বানিয়েছে।

আলাউদ্দিন রিটায়ার করছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো অর্থেই অবসর জীবন যাপন করছেন না। তিনি এখন পেশাদার লেখক। ছদ্ম নামে বেশ কিছু বইপত্র লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তার সমস্ত বই-এর প্রকাশক মুক্তি প্রকাশনার মালিক হাজী একরামুল্লাহ। কখন কোন বই লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে হাজী একরামুল্লাহ তা সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। মুক্তি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আলাউদ্দিনের প্রথম বইটার নাম— সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্না। হাজী একরামুল্লাহ পাঁচটা রান্নার বই তাকে দিয়ে বলেছেন, বই দেখে দেখে নিজের মতো করে সাজিয়ে দেন। ভাষাটা যেন সহজ হয়। কচকচানি কম। আলাউদ্দিন তাই করেছেন। একশ পৃষ্ঠার বই চার রঙের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছে। প্রচ্ছদে একজন তরুণীর ছবি। সে রান্না করছে। তরুণীর পাশে সুদর্শন যুবক। সে পেছন থেকে তরুণীর কোমর জড়িয়ে ধরে তরুণীর মাথার পাশ থেকে নিজের মাথা বের করে অবাক হয়ে রান্না দেখছে। বইটির কয়েকটি বিষয়ে আলাউদ্দিন আপত্তি করেছিলেন। অর্ধনগ্ন তরুণী মূর্তি এবং গোঁফওয়ালা যুবক যেভাবে সেই তরুণীর কোমর ধরে আছে সেটা রান্নার বই-এ মানাচ্ছে না। বই এর দামও তার কাছে ঠিক মনে হয় নি। দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্না। চাইনিজ রান্না তো বিদেশী রান্নার মধ্যেই পড়ে। আলাদা করে চাইনিজ রান্না বলার দরকার কী?

হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে ধমক দিয়ে বলেছেন— তোমার কাজ হলো অন্য বই থেকে সুন্দর করে কপি করা। কপি করবে, পাণ্ডুলিপি জমা দিবে, ক্যাশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। প্রচ্ছদ কী হবে, বই-এর নাম কী হবে, লেখকের কোন নাম যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ক্লিয়ার?

আলাউদ্দিন বিনীত ভঙ্গিতে বলেছেন, ক্লিয়ার।

হাজী একরামুল্লাহর বয়স আলাউদ্দিনের চেয়ে খুব বেশি না। তবে তিনি আলাউদ্দিনকে তুমি করেই বলেন। আলাউদ্দিন তাতে কিছু মনে করেন না।

রান্নার বইটাতে লেখক হিসেবে নাম ছাপা হয়েছে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর। বই-এর ফ্ল্যাপে লেখিকার ছবি এবং জীবনবৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। লেখিকা পৃথিবীর নানান দেশ ভ্রমণ করেছেন। মালয়েশিয়ার পেনাং-এ একটি আন্তর্জাতিক রন্ধন প্রতিযোগিতায় সিনিয়র গ্রুপে স্বর্ণপদক পেয়েছেন।

আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় বইটির নাম ছোটদের হাদিসের কথা। বই-এর প্রচ্ছদে খেজুর গাছের ছবি। খেজুর গাছের নিচে একটা উট। অনেক দুরে মসজিদের মিনার। বইটিতে লেখকের নাম ছাপা হয়েছে- মৌলানা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান খান।

আলাউদ্দিন বর্তমানে লিখছেন হাত দেখার বই। বইটার নাম সহজ হস্তরেখা বিদ্যা এবং তিল তথ্য। হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে বলে দিয়েছেন এই বইটার ভাষা হবে খটমটা। এসেছি, গিয়েছি টাইপ ভাষা না। সাধু ভাষা। কারণ। বইটির লেখক হিসেবে নাম যাচ্ছে স্বামী অভেদানন্দের। স্বামী অভেদানন্দ জটিল ভাষায় লিখবেন এটাই স্বাভাবিক।

এইসব বই-এর পাশাপাশি পাঠ্য বই-এর নোটও তিনি লেখেন। সেখানে নাম যায়—কে, এন, লাল, এক্স প্রিন্সিপ্যাল এন্ড কালি নারায়ণ স্কলার।

 

খাটের ওপর একটা টুলবক্স। আলাউদ্দিন খাটে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন। চিন্তা শেষ করে এ4 কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখছেন। লেখায় কাটাকুটি তার অপছন্দ। লেখা যা পছন্দ হচ্ছে না তা তিনি ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলছেন। টুলবক্সের ওপর তিনটা পেনসিল সাজানো। পেনসিলের পাশে ইরেজার। যে সব বই দেখে দেখে তিনি লিখছেন সেই বইগুলি খাটে ছড়ানো।

আজ সন্ধ্যা থেকেই শিররেখার চ্যাপ্টারটা লিখছেন। লেখা যত দ্রুত হওয়া উচিত তত দ্রুত হচ্ছে না। লিখে আরাম পাচ্ছেন না। কখনো মনে হচ্ছে ভাষা বেশি খটমটে হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো মনে হচ্ছে বেশি সহজ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সাইফুদ্দিন সাহেবের বাসা থেকে অল্প বয়স্ক একটা মেয়ের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এই মেয়ের হাসি অত্যন্ত তীক্ষ। শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে চট করে মগজে ঢুকে যায়। মগজ রিনরিন করে কাঁপতে থাকে। লেখার কনসানট্রেশন থাকে না। আলাউদ্দিন তারপরেও লিখে যাচ্ছেন, শুধু মেয়েটা যখন হাসছে তখন লেখা খেমে যাচ্ছে। আলাউদ্দিন লিখছেন—

মানুষের পরিচয় মন ও মস্তিষ্কে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ মন ও মস্তিষ্কের সোনালি ফসল। মন নিয়ন্ত্রণ করে মানবিক আবেগ, যথা প্রেম ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে মেধা। হস্তরেখা বিজ্ঞানে শিররেখা মস্তিষ্কের পরিচায়ক। হৃদয়রেখা মনের পরিচায়ক। মন এবং মস্তিষ্ক যেমন সমান্তরাল চলে, হৃদয়রেখা এবং মস্তিষ্করেখারও হাতের তালুতে সমান্তরাল অবস্থান। এ যেন সেই চিরন্তন কথা— রেল লাইন বহে সমান্তরাল।

লেখাটা আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে না। স্বামী অভেদানন্দের লেখা বলে মনে হচ্ছে না। লেখার মাঝখানে হে বৎস জাতীয় কথা থাকা প্রয়োজন। গুরু জ্ঞান দিচ্ছেন ছাত্রকে। মানুষ না লিখে লেখা উচিত মানব। হাতের তালু না লিখে অন্য কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করা উচিত। হাতের তালু খুব কাছের কিছু মনে হচ্ছে। হাতের তালুর সংস্কৃত ক তিনি জানেন না। হাতের সংস্কৃত হস্ত। হস্ততালু নতে আবার তেমন ভালো লাগছে না।

এক বৈঠকে আলাউদ্দিন অনেকক্ষণ লিখতে পারেন। তেমন ক্লান্তি বোধ করেন না। লেখাটা দ্রুত শেষ করতে হবে। হাজী সাহেব নতুন একটা পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন। আলাউদ্দিনের দেরি হলে নতুনটা অন্য কেউ নিয়ে যাবে। তিনিই যে মুক্তি প্রকাশনীর একমাত্র ফরমায়েশি লেখক তা না। আরো লেখক আছে।

সার, খানা তৈরি।

আলাউদ্দিন রীতিমতো চমকে উঠলেন। ঘরে যে একজন বাবুর্চি আছে, সে রান্না করছে। এই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ছিল না। আলাউদ্দিন বলেন, রেঁধেছ কী?

কুটু মিয়া তার জবাবে হাসল। ম্যাজিসিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার সময় যে ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামতে নামতে বললেন, তোমার চোখে কি কোনো সমস্যা আছে? কীভাবে যেন তাকাচ্ছে।

কুটু বলল, একটা চোখে দেখি না।

সে কী! কোন চোখে।

বাম চোখে।

জন্ম থেকেই এরকম, না কোনো ব্যথা ট্যথা পেয়েছিলে?

কুটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন সাহেবের মনে হলো এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নি। চোখ নষ্ট হওয়া বিরাট দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে কষ্ট দেয়া ঠিক না। চোখ জন্ম থেকেই কষ্ট না পরে নষ্ট হয়েছে এই তথ্য জেনেও তো তার কোনো লাভ হচ্ছে না।

আলাউদ্দিন খেতে বসলেন। থালা বাসন ঝকঝক করছে। কাচের গ্লাস এত পরিষ্কার যে আলো জমকাচ্ছে। যে ছোট টেবিলটায় বসে তিনি খাওয়া দাওয়া করেন সেই টেবিল পরিষ্কার করা হয়েছে। টেবিলের ওপর ধবধবে সাদা টেবিল ক্লথ। তার যে টেবিল ক্লথ আছে এটাই তিনি জানতেন না।

খাবারের মেনু খুবই সাধারণ। আলু ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল, ডাল। এক পাশে পিরিচে লেবু, কাচা মরিচ। আলাউদ্দিন আলু ভাজি নিয়ে খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন— ব্যাপারটা কী, সামান্য আলু ভাজি তো এত স্বাদ হবে না। তার কাছে মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আলু ভাজি দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবেন। আলু ভাজি করেছেও কত সুন্দর। চুলের মতো সরু করে কাটা কাটা আলুর একটা টুকরা আর অন্যটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। সামান্য আলু ভাজিই খেতে এ রকম, মুরণির ঝোলটা না জানি কেমন! আলু ভাজি খাওয়া বন্ধ রেখে তিনি মুরগির ঝোল নিলেন। তিনি মনে মনে বললেন, কী আশ্চর্য! পাইলট সাহেব যে লিখেছেন— কুটুমিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলি জাদুকর। ঠিকই লিখেছেন, বরং একটু কম লিখেছেন। মুরগির ঝোল রান্নার কোনো কম্পিটিশনে এই মুরগির ঝোল পাঠিয়ে দিলে গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে আসবে। রান্নার বইটা তিনি না লিখে কুটু মিয়াকে দিয়ে লেখানো দরকার ছিল।

ডাল এক চামচ নেবেন কি-না আলাউদ্দিন বুঝতে পারছেন না। ডালটা দেখে খুব ভালো মনে হচ্ছে না। মুরগির ঝোলের স্বাদটা মুখে রেখে খাওয়াটা শেষ হওয়া দরকার। নেহায়েত কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে তিনি এক চামচ ডাল নিলেন। তখন মনে হলো বিরাট ভুল হয়েছে, ডাল দিয়েই খাওয়া শুরু করা দরকার ছিল। আলু ভাজি এবং মুরগির ঝোলের প্রয়োজন ছিল না, শুধু ডাল দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারেন।

কুটু মিয়া আশেপাশে নেই— এটাও একটা শান্তি। কেউ আশেপাশে থাকলে তিনি খেতে পারেন না। দীর্ঘদিন একা একা থেকে এই এক বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে। তার সমস্যা হয় না শুধু বিয়ে বাড়িতে। অনেকের সঙ্গে খেতে বসা যায়। তখন কেউ কারো দিকে তাকায় না।

আলাউদ্দিন খাওয়া শেষ করে ডাকলেন, কুটু মিয়া!

কুটু পাশে দাঁড়াল। আলাউদ্দিন বললেন, তোমার রান্না খারাপ না। চলবে।

কুটু বলল, শুকরিয়া।

আলাউদ্দিন ইচ্ছা করেই প্রশংসা চেপে রাখলেন। বাঙালি প্রশংসা নিতে পারে। প্রশংসা করলেই তারা মাথায় উঠে যায়। অদ্ভুত এক জাতি।

সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার সদাই করে আনবে।

জ্বি আচ্ছা।

ছোট মাছ, ভাজি ভুজি ভর্তা। এইসব। পোলাও-কোরমা-রোস্ট মুরগি মুসাল্লাম এইসবের প্রতি আমার লোভ নেই। গরিবের সন্তান, গরিবি খাদ্য খেয়ে অভ্যাস। বুঝতে পারছ?

জি।

তেল মশলা কম দিয়ে রাঁধবে। অনেকে মনে করে গাদাখানিক তেল মশলা হলেই তরকারি ভালো হয়। রান্নার পরে আমার লেখা একটা বই আছে— সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনীজ রান্না। সেই বই-এ এই ব্যাপারটা বিশদভাবে লিখেছি। বইটা পড়ে দেখতে পার। তোমার উপকার হবে। বই-এ খাদ্যের পুষ্টির উপর আলাদা একটা চ্যাপ্টার আছে।

আমি স্যার পড়তে জানি না।

সে কী! অ আ ক খ কিছুই না?

জ্বি না।

খুবই দুঃখের কথা। আমি নিজে শিক্ষক ছিলাম তো। বয়স্ক একজন কেউ যদি বলে লেখাপড়া জানি না তখন রাগ লাগে। যাই হোক, আমি বাংলাবাজার থেকে শিশু শিক্ষার একটা বই নিয়ে আসব। অবসরে পড়বে। শুধু রান্না জানলেই হবে না। লেখাপড়া জানতে হবে। ঠিক কিনা বল?

জ্বি।

রান্না না জানাটা দোষের না, কিন্তু লেখাপড়া না জানাটা দোষের। বুঝাতে শার।

জ্বি।

রান্না যে জানে না তাকে কেউ গালি দেয় না। কিন্তু যে লেখাপড়া জানে না তাকে সবাই মূর্খ বলে গালি দেয়।

লেখাপড়ার ওপর বক্তৃতাটা দিয়ে আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে। একটু ক্লান্তি ও লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি কথা বলা হয়েছে। কারণ খাওয়াটা বেশি হয়ে। গেছে। শরীর হাঁসফাস লাগছে। একটা মিষ্টি পান খেতে পারলে ভালো হতো। তিনি এম্নিতে পান খান না তবে বিয়ে শাদির খাওয়ার পর মিষ্টি পানি খেতে ভালো লাগে। পানের সঙ্গে একটা সিগারেট পান হজমের সহায়ক। সিগারেট ও মনে হয় তাই।

কুটু মিয়া।

জ্বি।

দোকানে যাও, একটা মিষ্টি পান নিয়ে আসি। একটা সিগারেটও আনবে। ভালো কষ্মা, একটা মোমবাতি ও আনবে। কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকার ঘরে বসে। থাকতে হয়। রোজ ভারি মোমবাতি আনব, মনে থাকে না। আমি আবার অন্ধকার সহ্য করতে পারি না।

 

রাত বেশি হয় নি। এগারোটা চল্লিশ। আলাউদ্দিন রাত দুটা আড়াইটার আগে কখনো ঘুমাতে যান না। গভীর রাতেই তার লেখালেখি ভালো হয়। আজ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তার মুখে পান, হাতে সিগারেট। তার মনে হচ্ছে মুখ ভর্তি পান এবং হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তিনি খাটে আধশোয়া হয়েই ঘুমিয়ে। পড়বেন। হাত থেকে সিগারেটটা মেলতেও পারছেন না। আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় সিগারেটের ধোয়া টানতে তার খুবই ভালো লাগছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে জীবনটা সুখের।

আলাউদ্দিন আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন। গ ঘুম। ঘরের বাতি জ্বলছে, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। সেই বাতাসও আরামদায়ক শীতল। তার ঘুম ভালো হঠাৎ। ঘরে বাতি নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার ওপর ফান চলছে না। তার বুক ধক করে উঠল। চারদিকে এত অন্ধকার কলা ঘরের বাতি এখন শোনা কে এ মনা তা এত অন্ধকার ঘাকে না। এপার্টমেন্ট হাউসের আলো এসে ঘরে ঢুকে। রাস্তার আলো কে। অন্ধকারেও বোঝা যায় ঘরের কোথায় কী আছে। ঘুমের মধ্যে এমন কিছু কি হয়েছে যে তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন? তার এক দূর সম্পর্কের চাচার এ রকম। হয়েছিল। তিনি হাটে গরু নিয়ে গিয়েছিলেন বিক্রির জন্য। দরে বললো না বলে গরু বিক্রি হলো না। মেজাজ খারাপ করে তিনি গেলেন চা খেতে। চা খেয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। টোস্ট বিসর্কিট দিয়ে চা খেয়ে চায়ের নাম দিতে যাবেন, হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন— কী হইছে আন্ধাইর ক্যান? এই যে তার কাছে পৃখিবী হঠাৎ আন্ধাইর হলো— আলো আর ফিরল না।

তাঁর বেলায় এরকম কিছু কি হয়েছে? না-কি গোটা শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় শহরই অন্ধকার হয়ে গেছে? কোথাও আলো নেই। ঘটনা মনে হয় এ রকমই। ইলেকট্রিসিটি নেই বলেই ফ্যান ঘুরছে না। ফ্যান ঘুরলে ফ্যানের ক্যাট ক্যাট আওয়াজটা থাকত। কুটু মিয়া মোমবাতি এনে রেখেছিল— মোমবাতিটা কোথায় আলাউদ্দিনের মনে পড়ছে না। খাটের পাশের টেবিলে রাখার কথা। টেবিলটা কোথায়? গভীর অন্ধকার ও এক সময় চোখে সয়ে যায়। এই অন্ধকার চোখে সইছে না কেন? এ খাটের নিচে শব্দ হলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। আলাউদ্দিন চমকে উঠলেন। হঠাৎ তার মানে হলো জীবিত কোনো প্রাণী খাটের নিচে আছে। প্রকা কোনো প্রাণী চার পায়ে খাটের নিচে ঘুরছে। প্রাণীটার নিয়মিত নিঃশ্বাসের শব্দ এখন তিনি পাচ্ছেন। ফো-ফোস। ফো-ফোস। তার গায়ের বোটকা গন্ধ নাকে লাগছে। খাটের নিচে গাদা কর খবরের কাগজ। এই তো প্রাণীটা এখন কাগজ ছিড়ছে। গলার ভেতর অস্পষ্ট শব্দও করছে। রাগী শব্দ।

বাদর না তো? পুরনো ঢাকায় প্রচুর বার আছে। জানালা খোলা থাকলে মাঝে মাঝে এৱা ঘরে ঢুকে পড়ে। নানানভাবে মানুষজনকে বিরক্ত করে। এই অঞ্চলেও হয়তো বাদ আছে— তিনি জানেন না।

আলাউদ্দিন কী করবেন ভেবে পেলেন না। একবার তাঁর মনে হলো এটা দুঃস্বপ্ন। রাতের খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। বদহজম হয়েছে। বদহজম থেকে দুঃস্বপ্ন। দেখছেন। তিনি থাকেন ছয়তলায়। দরজা বন্ধ করে শুয়েছেন। বাদর আসবে কোথেকে! না, একটু ভুল হয়েছে। তার ঘরের দরজা খোলাই ছিল। দরজা বন্ধ করার আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর ঘরের দরজা খোলা থাকলে ও বন্য কোনো পশু এসে ঘরে ঢুকবে না। তিনি তো সুন্দরবনের ভেতর কোনো ফরেস্টের বাংলোতে বাস করছেন। সমস্যাটা কোথায়? খাটের নিচ কাগজ ছেঁড়া এখনো চলছে।

অদ্ভুই একটা কথা আলাউদ্দিনের মাথায় এলো— তাঁর খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে নেই তো? হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। কাগজ ছিড়ছে। মাথা খারাপ মানুষদের পক্ষে এই কাজটা অস্বাভাবিক কিছুই না। সেতাবগঞ্জের এক পাগল ছিল হামাগুড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। পাগলের নাম সওদাগর। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, সওদাগর তুমি হট না কেন? সওদাগর বলত, হাঁটলে ব্যালেন্সের সমস্যা হয় ভাইজান। সওদাগর পাগলা অনেক ইংরেজি জানত। কথাবার্তা বলত খুবই স্বাভাবিকভাবে। শুধু হাঁটত চার পায়ে। কে জানে। কুটুও হয়তো সওদাগরের মতোই মানসিক রোগী। আলাউদ্দিন কাপা কাপা গলায় ডাকলেন, কুটু। খাটের নিচ থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, জ্বি স্যার।

আলাউদ্দিনের সারা শরীর হিম হয়ে গেল। এটা হতেই পারে না। খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে থাকবে কেন? তিনি আবারো ডাকলেন, কুটু। কুটু সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার। আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কী করছ?

কিছু করছি না স্যার।

খাটের নিচে বসে আছ কেন?

কুটু জবাব দিল না। ফোঁ-ফোল, ফোঁ-ফোস শব্দ করতে লাগল। আলাউদ্দিন ভয়ে জমে গেলেন। বন্যপশুর চেয়ে মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ অনেক ভয়ংকর। কুটুর। উপর অশুভ কোনো কিছুর ভর হয় নি তো?

আলাউদ্দিন আয়াতুল কুরসি সূরাটা পড়ার চেষ্টা করলেন। এই সূরাটা একবার ঠিকমতো পড়ে হাততালি দিলে খারাপ জিনিস দূরে চলে যায়। হাততালির শব্দ যতদূর যায় অশুভ জিনিসগুলি তত দূরেই যায়। আলাউদ্দিন সূরা পড়ে শেষ করেছেন কিন্তু হাততালি দিতে পারছেন না। হাততালি দেবার ক্ষমতা তার নেই। দুটি হাতই অসাড় হয়ে পড়ে আছে। যেন এই হাত দুটা নিজের না। অন্য কারোর হাত। এই দুই হাতের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আলাউদ্দিন চিৎকার করতে যাবেন তখনই খুট করে শব্দ হলো। ঘরের বাতি জ্বলে উঠল, ফ্যান ঘুরতে লাগল। আলাউদ্দিন ভাঙা গলায় ডাকলেন, কুটু মিয়া কুটু মিয়া।

থপথপ শব্দ করে কে যেন আসছে। কুটু মিয়াই অসিদ্রে। সে ছাড়া আর কে হবে! তার ঘরের দরজা ভেজানো। কেউ এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।

কুটু মিয়া।

জ্বি স্যার।

ভেতরে আস।

দরজা ঠেলে কুটু মিয়া ঢুকল। তার হাতে পানির গ্লাস। পানির গ্লাসে বরফ ভাসছে। পানির গ্লাস দেখে আলাউদ্দিনের মনে হলো তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গ্লাস পানিতে তার হবে না। এক কলসি পানি দরকার।

কুটুকে দেখে তার লজ্জা লাগছে। সহজ স্বাভাবিক একজন মানুষ। তিনি ডেকেছেন বলে বুদ্ধি করে পানির গ্লাস নিয়ে চলে এসেছে। অথচ তিনি তার সম্পর্কে কত কিছু ভেবেছেন। মস্তিষ্ক বিকৃত। ভূতের ভর হয়েছে। ছিঃ।

কুটু!

জি স্যার।

হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়েছিল। গরমে ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। পানি এনে ভালো করেছ। খুবই পানির পিপাসা হয়েছিল।

আলাউদ্দিন এক নিঃশ্বাসে পানির গ্লাস শেষ করে কুটুকে বললেন- কুটু দেশ তো আমার খাটের নিচে কিছু আছে কি না।

কুটু নিচু হয়ে খাটের নিচ দেখল। নিচু গলায় বলল, কিছু নাই স্যার।

আলাউদ্দিন বললেন, একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। কোনো একটা জতু আমার খাটের নিচে বসে আছে।

হাতে মুখে একটু পানি দেন। দিক, হাতে মুখে পানি দিব। তুমি আরেক গ্লাস ঠাপ্ত পানি আন।

কুটু মিয়া পা থপথপ করতে করতে চলে গেল। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামলেন। নিচু হয়ে খাটের নিচটায় উঁকি দিলেন। খাটের নিচে কেউ নেই তা ঠিক, তবে খাটের নিচে গাদা করে রাখা সমস্ত খবরের কাগজ কুচি কুচি করে ছেঁড়া। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন নি। কেউ একজন খাটের নিচে বসে সত্যি সত্যি কাগজ ছিঁড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *