নিবেদন
‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘রোববার’ ক্রোড়পত্রিকায় ২০০৯ সালে এক বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল এই উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশের বিষয়ে সম্পাদক শ্রীঋতুপর্ণ ঘোষ যে-আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, সেজন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রকাশনার নানা পর্বে সাহায্য করেছেন ক্রোড়পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক শ্রীঅনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও তরুণ সহকর্মী শ্রীভাস্কর লেট। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ এর সম্পাদক শ্রীসৃঞ্জয় বোস নানা বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন; এই উপন্যাস প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। বন্ধু শ্রীদেবাশিস বিশ্বাস প্রয়োজনীয় সংশোধনের কাজ করে দিয়েছেন।
এবার শুধু আপনাদের পৃষ্ঠা ওল্টানোর অপেক্ষা। পাঠিকা/পাঠক আমার নমস্কার গ্রহণ করুন।
রবিশংকর বল
শ্রাবণ ১৪১৭
০১.
আমার জীবনে এমন সব ঘটনা এসে হানা দিয়েছে, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আমি ঘটনাগুলোকে বোঝবার চেষ্টা করেও এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করি না। মনে হয়, ওরা যে আমার জীবনে অযাচিত ভাবে এসেছে, তার চেয়ে গভীর অর্থ আর কী হতে পারে! একদিন রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে আপনি যদি এমন কাউকে দেখে ফেলেন, যাকে চিত্রে বা স্বপ্নে দেখা যায়, হয়তো একটা মুহূর্তের জন্য মুখোমুখিও দেখা হয়ে যেতে পারে, তবে কী মনে হবে আপনার? মনে হবে না, এক আশ্চর্য দরজা খুলে গেছে আপনার সামনে?
সেবার লখনউতে গিয়ে এমন এক আশ্চর্য দরজাই খুলে গিয়েছিল আমার সামনে। খবরের কাগজের কলম পেষা মজুর আমি, গিয়েছিলাম লখনউয়ের তবায়েফদের নিয়ে একটা লেখার খোঁজে। লখনউতে পৌঁছে প্রথম দেখা করি পরভিন তালহার সঙ্গে; তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, লখনউয়ের ইতিহাস তাঁর চোখের পর্দায় ভাসতে দেখেছিলাম। পরভিন আমাকে বলেছিলেন, যে-তবায়েফদের কথা আপনি হালির পুরনো লখনউ বইতে, উমরাও জান উপন্যাসে পড়েছেন, তাঁদের দেখা লখনউতে আর পাবেন না। সত্যিই পাইনি। আমি তাই নানা মানুষের মুখে শোনা গল্প লিখে নিচ্ছিলাম ডায়েরিতে। এইসব গল্পই বা কম কী? বংশ পরম্পরায় যে-গল্প বয়ে চলেছে, তাকে ইতিহাসের চেয়ে ছোট করে দেখা, অন্তত, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এইরকম, এর ওর মুখ থেকে গল্প শুনতে শুনতে আমি গিয়ে পৌঁছলাম পুরনো লখনউতে, ফরিদ মিঞার কাছে। ধুলোয় ঢাকা ওয়াজিরগঞ্জ। রোদ থাকলেও এমন ছায়ায় জড়ানো যাকে একটা। লুপ্ত শহরই বলা যায়। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম ‘আদাবিস্তান’ নামের সেই বিরাট মহল, যেখানে উর্দু লেখক নাইয়ের মাসুদ থাকেন। এই নিয়তি-তাড়িত লেখককে দেখার ইচ্ছে আমার ছিল, কিন্তু উর্দু না জেনে, কীভাবে তাঁর গল্পের প্রতি মুগ্ধতা আমি জানাব? ইংরেজি বা হিন্দি বলা যেত, কিন্তু নাইয়ের মাসুদের সঙ্গে উর্দুতে কথা না বলতে পারলে, তাঁর কথোপকথনের রহস্য। কী বোঝা সম্ভব? এসবই আমার কল্পনা। লেখক আর তাঁর লেখা তো মেলে না।
ফরিদ মিঞার বসার ভঙ্গি দু-হাঁটু মুড়ে নামাজ আদায় করার মতো। আমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিলেন, একই ভাবে বসেছিলেন। তায়েফদের অনেক গল্প বলার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিস্সা লেখেন?’
-ওই আর কি
-আমিও একসময় লিখতাম।
-এখন আর লেখেন না?
-না।
-কেন?
-কিস্সা লিখলে বড় একা হয়ে যেতে হয়, জনাব। আল্লা যাকে কিস্সা লেখার হুকুম করেন, তাঁর জীবন জাহান্নাম হয়ে যায় জি।
-কেন?
-শুধু ছায়া ছায়া মানুষেদের সঙ্গে থাকা তো।
-তাই কিস্সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
-জি জনাব। জীবনটা কারবালা হয়ে যাচ্ছিল। কারবালা জানেন তো?
-মহরমের কাহিনিতে
-হ্যাঁ। কারবালা কী? সে কী শুধু মহরমের কথা? কারবালা মানে রি জীবন যখন মৃত্যুর প্রান্তর হয়ে ওঠে। কিস্সা লেখার নিয়তি এইরকমই জনাব।
-কেন?
-ওই যে, ছায়া ছায়া মানুষেরা তাকে সবসময় ঘিরে থাকে, তার সঙ্গে কথা বলে, আর কী যে পাগলামির দিকে নিয়ে যায় ওরা। আপনার কখনও এমন হয়নি?
হ্যাঁ।
-আপনার বিবি জিজ্ঞেস করেননি, কেন এই কিস্সাটা লিখলে?
-হ্যাঁ।
-আমাকেও কতবার বিবি জিজ্ঞেস করেছেন। কী বলব? আমি যা বলব, তাতেই তিনি হাসবেন, আর বলবেন, আপ পাগল হো গিয়া মিঞা।
-তাই কিস্সা লেখা ছেড়ে দিলেন?
-জনাব, আমি আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পেরেছি। দাওয়াত দিতে পারব না। এই তো কিস্সা লেখক।
তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আমি তাঁর অন্দরমহলের চবুতরা থেকে ভেসে আসা পায়রাদের বকবকম শব্দের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। এক সময় তাঁর গলা কবুতরের ডাকের ধূসরতার ভিতর ঢুকে পড়ল, ‘আমি একটা কিস্সা নিয়ে বড় মুসকিলে আছি, জনাব।
-কোন কিস্যা?
তিনি কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, আপনি একটু বসতে পারবেন?
-জরুর।
-কিস্সাটা তাহলে আপনাকে দেখাই।
-আপনার লেখা?
-না। ফরিদ মিঞা হাসেন। – একটু অপেক্ষা করুন। এও এক আশ্চর্য কিস্সা জনাব।
তিনি হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে ভিতরে চলে গেলেন। ভিতরে যাওয়ার দরজার ওপরে একটা মৎস্যকন্যা। হঠাৎ দৌড়ে কে একজন ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল। কালো, লোমে ভরা একটা শরীর, আমার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলতে শুরু করল, ‘মিঞা, পাগল হয়ে গেছে আপনি জানেন না?’
-জানি।
-তা হলে?
-আমি তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি।
-কেন?
-আপনি কে?
-আমি মিঞার নোকর হুজুর। মিঞা আবার পাগল হয়ে যাবেন।
-কেন?
-আবার একা একা কথা বলবেন।
-কেন?
-কিস্সার কথা তুললেই—
ভিতর থেকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতেই কালো লোকটি ‘এবার চলে যান, হুজুর’ বলে দৌড়ে পালাল। আমার চোখে আবার সেই মৎসকন্যার শরীরে ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগল। একটু পরেই ফরিদ মিঞা পর্দা সরিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। এক পরিতৃপ্তির আলো তাঁকে ঘিরে আছে, আমার মনে হল। একটু আগেও তাঁকে বেশ অস্থির মনে হয়েছিল। তিনি বুকের কাছে ধরে রেখেছেন নীল মখমলে মোড়া একটা পুঁটুলি। সেইরকম নামাজ আদায়ের ভঙ্গিতেই বসলেন। তিনি, যেন এক সদ্যোজাত শিশুকে শোয়াচ্ছেন তেমন ভাবেই পুঁটুলিটি রাখলেন ফরাসের ওপর। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।-এবার আপনাকে আমি যা দেখাব, মনে হবে খোয়াব দেখছেন।
কী খোয়াব দেখাবেন আমাকে ফরিদ মিঞা? স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো আমি এই পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এলাম। আর আমি এও জানি যে, আমাদের এই জীবন, যাকে বাস্তব জীবন বললে। বেশির ভাগ মানুষ খুশি হয়, তাও অন্য আরেকজনের দেখা স্বপ্ন। তখন মনে হয়, আমি একটা। ছবি মাত্র, যে ভেসে উঠেই হারিয়ে গেছে। কে যেন একজন প্রজাপতির স্বপ্ন দেখেছিল। জেগে উঠে তার মনে হয়েছিল, আসলে কি প্রজাপতিটাই তাঁকে স্বপ্ন দেখেছিল।
মখমলের আবরণ খুলতেই একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি জেগে উঠল আলোয়। কোথাও কোথাও পোকায় কাটা। পাণ্ডুলিপিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই কবিতাটা মনে পড়ল আমার।
আমি তো ওই নদীর ওপার থেকেই এসেছিলাম
বিশ্বাস না হলে অপ্রকাশিত
উপন্যাসকে জিজ্ঞাসা করো তার মাংস খুঁটে
খাওয়া রুপোলি পোকাদের জিজ্ঞাসা করো
আর আরশোলার বাদামী ডিমদের,
জিজ্ঞাসা করো পাণ্ডুলিপির শরীরে উইয়ে
কাটা নদীদের সেই সব নদীরা, যারা
মোহনায় পৌঁছানোর
আগেই মরে যায়
কে লিখেছিল কবিতাটা? অনেক ভেবেও তার নাম মনে পড়ল না। নিশ্চয়ই মনে পড়ার মতো বিখ্যাত সে ছিল না। সে হয়তো এমন একজন কবি, কবিতার মধ্যে যে শুধু আমাদের জীবনের ক্ষতচিহ্নগুলি এঁকে রাখে, তারপর একদিন অনায়াসে হারিয়েও যায়।
পাণ্ডুলিপিটাকে ফরিদ মিঞা শিশুর মত আদরে দু’হাতে তুলে নিলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন।
মানুষ যেভাবে পুরোহিতের হাত থেকে অঞ্জলির ফুল নেয়, সেভাবেই তাঁর কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিলাম। খর খর শব্দ পেলাম। পাতারা কি এই সামান্য স্পর্শেও ভেঙে যাচ্ছে? ফরাসের ওপর পাণ্ডুলিপিটা রেখে পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করলাম। উর্দুতে লেখা; এই ভাষা তো আমি বুঝি না। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টে আমি স্থির হয়ে যাই, লিপির সৌন্দর্য আমাকে সম্মোহিত করে রাখে। শুধু বুঝতে পারি, হারিয়ে যাওয়া অনেক সময় এখন আমাকে ছুঁয়ে আছে। একসময় ফরিদ মিঞাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কার পাণ্ডুলিপি?’
-সাদাত হাসান মান্টোর। আপনি নাম জানেন?
পাণ্ডুলিপির ওপর আমি ঝুঁকে পড়ি। আমার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, সাদাত হাসান মান্টো!
-কিস্সারা তাঁকে খুঁজে বেড়াত।
-আপনি কী করে পেলেন?
-এন্তেকালের কিছুদিন আগে আব্বাজান আমাকে দিয়ে যান। তাঁর কাছে কীভাবে এসেছিল বলেননি।
-কী লিখেছেন মান্টো?
-দস্তান। আপনারা যাকে নভেল বলেন। তবে কী জানেন, দস্তান ঠিক নভেল নয়। দস্তানের গল্প শেষ হতেই চায় না, আর নভেলের তো শুরু শেষ থাকে।
-কিন্তু মান্টো তো নভেল লেখেন নি।
-এই একটাই লিখেছিলেন।
-তা হলে ছাপা হয় নি কেন?
-কেউ যে বিশ্বাস করতে চায় না। আমি কতজনকে বলেছি। অনেকে হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে বলেছেন, এ ঠিক মান্টোসাবের হাতের লেখা নয়। কিন্তু উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর জীবনের সব কথা মিলে যায়। আপনি দেখবেন, ছাপা যায় কি না?
-আমি?
-আপনি তো আখবারে কাজ করেন। দেখুন না। মান্টোসাবের লেখা এভাবে পোকায় কাটতে কাটতে শেষ হয়ে যাবে?
আমি পাণ্ডুলিপির শরীরে হাত বোলাতে থাকি। আমার সামনে সাদাত হাসান মান্টোর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি? বিশ্বাস হয় না। তবু আমি পাণ্ডুলিপিকে ছুঁয়ে থাকি। এই তো সেই কাহিনী-লেখক, তাঁর কবরের ফলকে লিখতে চেয়েছিলেন, কে বড় গল্প লেখক, খোদা না মান্টো?
-আপনি পড়েছেন? আমি জিজ্ঞেস করি।
-আলবৎ। কতবার পড়েছি মনে নেই।
-কী লিখেছেন মান্টোসাব?
-মির্জা গালিবকে নিয়ে। মির্জাকে নিয়ে উপন্যাস লেখার খোয়াব দেখতেন মান্টোসাব। মির্জাকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিল বম্বেতে। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন মান্টোসাবই। আপনি জানেন?
-না।
-মান্টোসাব তখন বম্বেতে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখেন। গালিবকে নিয়ে তাঁর লেখা ছবিটাই হিট করেছিল। তবে দুঃখের কথা, ফিল্মটা যখন তৈরী হল, মান্টোসাব তখন ইন্ডিয়া থেকে। পাকিস্থানে চলে গেছেন। মির্জা গালিবের সেই প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুরাইয়া বেগম। ফিল্মটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিল। প্রথম হিন্দি ফিল্মের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়া, বুঝতে পারলেন? মির্জাকে সারা জীবন মান্টোসাব ভুলতে পারেননি। মির্জার গজল তাঁকে পাগল করত, মির্জার জীবনও। কত যে মিল দু’জনের মধ্যে। মির্জার গজল তাঁর মুখে মুখে ফিরত।
-এই উপন্যাস তাহলে পাকিস্থানে লিখেছিলেন?
-তাই তো। মান্টোসাবের স্বপ্নের দস্তান। আপনি নিয়ে যান, দেখুন ছাপতে পারেন কি না।
-উর্দুতে কেউ ছাপবে না?
-কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। আমি আর কতদিন বইব, বলুন। কবে আছি, কবে নেই। তারপর তো একেবারে হারিয়ে যাবে। ফরিদ মিঞা আমার দুই হাত চেপে ধরেন।
-আমাকে এই দস্তানের হাত থেকে রেহাই দিন। আমাকে সবাই এখন পাগল বলে। বলে, কিস্সা আমাকে খেয়ে নিয়েছে।
মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা মান্টোর অপ্রকাশিত উপন্যাস, আসল কি নকল আমরা কেউই জানি না, আমার সঙ্গে এই শহরে এসে পৌঁছল। উর্দু জানি না, তাই এমনি এমনি মাঝে মাঝে পাণ্ডুলিপিটা দেখি। সত্যিই মান্টোর লেখা, না অন্য কারোর? তারপর একদিন মনে হল, আমরা সবাই যদি কারও দেখা স্বপ্ন হই, তা হলে স্বপ্নের গালিবকে নিয়ে একজন স্বপ্নের মান্টো উপন্যাস লিখতেই পারেন। এখানে সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে?
উপন্যাসটা পড়ার জন্যই আমাকে উর্দু শেখার কথা ভাবতে হল। আমার বন্ধু উজ্জ্বল একজন শিক্ষিকা ঠিক করে দিলেন। তার নাম তবসুম মির্জা। আমি তার কাছে শিখতে যাওয়া শুরু করে কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝলাম, নতুন করে ভাষা শেখার মতো ধৈর্য ও অভিনিবেশ আমি হারিয়ে ফেলেছি। একদিন তবসুমকে বলেই ফেললাম, ‘উর্দু শেখাটা এ-জীবনে আমার আর হবে না।’
তবসুম বলল, ‘তা হলে উপন্যাসটি পড়বেন কী করে?
-আপনি যদি পড়ে পড়ে অনুবাদ করে দেন, আমি লিখে নেব।
-আমি কোথাও কোথাও ভুলও তো করতে পারি। আপনি বুঝবেন কী করে?
-ভুল ছাড়া কিছু হয় কি তবসুম?
-কেন?
-ভুল করেই তো আমি আপনার কাছে উর্দু শিখতে এসেছিলম।
-তার মানে?
কয়েকদিন পরেই আপনার নিকাহ্। জানলে তো আসতাম না। বিয়ের পর আপনি মুখে মুখে অনুবাদ করে যাবেন, আমি লিখে নেব। জীবন একরকম অনুবাদ, জানেন তো তবসুম? তবসুমের চোখদুটো বাতিঘরের ঘূর্ণায়মান আলোর মতো আমাকে কাটছিল।
এক বৃস্টি ঘনঘোর সন্ধ্যায় আমি তবসুমের কাছে উর্দু শেখার জন্য প্রথম গিয়েছিলাম। দীর্ঘ, অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তবসুমের বাবার নাম করে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িটা কোথায়?
-কার কাছে যাবেন?
তবসুমের বাবার নাম বললাম।
দোকানি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সাব তো মর গিয়া। আপনি জানেন না?’
-তবসুম মির্জা—
-উসকা লেড়কি। দোকানি হেঁকে ওঠেন, আনোয়ার, সাব কো কোঠি দিখা দে।
আনোয়ারের পিছন পিছন হেঁটে আমি একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। নিঝুম দোতলা বাড়িটা বৃষ্টিতে ভিজছে। আনোয়ার দরজা ধাক্কাতে থাকে। একসময় দরজা খুলে যায়, কিন্তু কাউকে দেখা যায় না, শুধু কথা শোনা যায়, কওন হ্যায়?
-ম্যায় আনোয়ার হুঁ, সাব।
-কী হয়েছে?
-মেহমান, সাব।
বৃষ্টির ভিতরে একটা মুখ ডেকে ওঠে। ‘কে? কে-রে আনোয়ার?’
আনোয়ার আমার মুখের দিকে তাকায়।
-তবসুম মির্জা আছেন? আমি সেই দেখা-না -দেখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলি।
-কী দরকার?
-আমার আসবার কথা ছিল।
-স্টুডেন্ট?
-হ্যাঁ।
আসুন-চলে আসুন আগে বলবেন তো—
আমি ভিতরে ঢুকে পড়ে আরও ভিজে যেতে থাকি। এই বাড়ির মাঝের খোলা চত্ত্বরের ওপর উন্মুক্ত আকাশ। যে আমাকে ডেকেছিল, তাঁকে দেখতে পাই না, কিন্তু সে চিৎকার করতে থাকে, ‘তবসুম দরজা খোল্-দরজা খো তবসুম-স্টুডেন্ট-স্টুডেন্ট—‘
দরজা খুলে যায়। বৃষ্টিছায়া ও অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে, তবসুম, আমার শিক্ষিকা, তার মাথায় ঘোমটা। গভীর রাতের ট্রেনের হুইসলের মতো তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আসুন আসুন-এত বৃষ্টি-ভেবেছিলাম আপনি আর আসবেনই না।’
বৃষ্টির জলে আমার জুতোকে ভিজতে দিয়ে তরমুজের মতো একফালি বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি। ছোট ঘরে বিরাট এক পালঙ্ক, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ-হয়তো দু-তিন পা হাঁটা যায়।
-চা খাবেন তো?
-না-না–
-এত বৃষ্টিতে ভিজে এলেন।
-তাতে কি?
-বসুন, আগে একটু চা খেয়ে নিন।
তবসুম পাশের ছোট বারান্দায় চা বানাতে চলে গিয়েছিল। ভাবছিলাম আমি একটা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছি। তবায়েফদের খোঁজে লখনউ গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম সাদাত হাসান মান্টোর অপ্রকাশিত উপন্যাসের সঙ্গে আর সেই উপন্যাস পড়বার জন্য প্রস্তুত হতে আমাকে হাজির হতে হল মধ্য কলকাতার অন্ধকার গলিতে তবসুম মির্জার ঘরে। কী আশ্চর্য, আমার আগে খেয়াল হয়নি, মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়বার জন্য উর্দু শিখতে আমি এসেছি তবসুম মির্জার কাছে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি একটা রাক্ষুসে আয়নার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। খেয়ালই করিনি, দেওয়াল থেকে ঝুলছিল প্রায় চারফুট লম্বা একটা আয়না, তার ফ্রেম কারুকাজ করা সেগুন কাঠের, মহার্ঘ বেলজিয়ান কাচ, যার ভিতরে পুরো ঘরটাই প্রায় ঢুকে পড়েছে,আর সেই ঘরের ভিতরে আমি, আমার দিকে নিমেষনিহত তাকিয়ে আছি। আয়নাটা যেন তার দিকে আমাকে টানছিল। এই ঘোর কাটল চায়ের কাপ নিয়ে তবসুম ঘরে আসায়।
-কী দেখছিলেন? তবসুমের ঠোঁটের কোণে ফালিচাঁদের হাসি।
-আয়নাটা, কোথায় পেলেন?
-আয়নাটা কার ছিল জানেন?
-কার?
-ওয়াজিদ আলি শাহর এক বেগমের।
-এখানে এল কী করে?
-আমার দাদা-দাদা জানেন তো-বাবার বাবা এনেছিলেন।
আমি আয়নার দিকে ফের তাকালাম। ওয়াজিদ আলি শাহ’র সেই বেগম এখন কোথায়? আয়নার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় ঘোমটা দেওয়া তবসুম মির্জা।
আমার উর্দু শিখতে আসার কারণ শুনে অবাক হয়ে গেল তবসুম। শুধু একটা উপন্যাস পড়ার জন্য উর্দু শিখবেন? আর কিছু করবেন না?
-আর কী করব?
-আপনি লেখেন শুনেছি। গজলও লিখতে পারেন।
-গজলের দিন শেষ হয়ে গেছে।
-গজলের দিন কখনও শেষ হবে না। আয়নার তবসুমের দিকে তাকিয়ে আমি তার কথা শুনি। গজলের দিন কখনও শেষ হবে না, তার এই কথা যেন একটা মেঘপ্রবাহের মত ভেসে যায়।
-এই গজলটা জানেন? তবসুম বলতে থাকেঃ
গলি তক্ তেরি লায়া থা হর্মে
শওক্
কহাঁ তাকত কেহ্ ফির জায়ে ঘর তক।
শব্দগুলো তবসুমের গলা থেকে ঝরনার মত ছড়িয়ে পড়ে। সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘কার গজল জানেন?’
-কার?
-মীর। মীর তকি মীর। মীরসাব কি বলছেন দেখুন। তোমার ঘরের দুয়ার পর্যন্ত তো টেনে এনেছিল আমার বাসনা, এখন শক্তি কই যে নিজের ঘরে ফিরে যাই? এরপরও বলবেন, গজলের দিন শেষ হয়ে গেছে?
-তবু
-বাদ দিন, এসব নিয়ে তর্ক চলে না। আপনার উপন্যাসটার কথা বলুন।
আমি কোন্ উপন্যাস পড়তে চাই, কার লেখা, কাকে নিয়ে লেখা, কীভাবে পেলাম এই উপন্যাস, সব কথা মাথা নীচু করে শোনে তবসুম। তাঁর এই শোনার মধ্যে একধরনের ধ্যানের মুদ্রা আছে। এই শহরের অধিকাংশ মানুষদের মতো নয় সে, যারা শুনতে ভুলে গেছে, আর তাই অপেক্ষা শব্দটাই তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমার সব কথা শোনবার পর অনেকটা নীরবতা ঘনিয়ে উঠতে দিয়ে সে ধীরে ধীরে বলে, ‘হঠাৎ এই উপন্যাসটা পড়ার ইচ্ছে হল কেন?’
-মান্টো আমার প্রিয় লেখক। তিনি যে উপন্যাস লিখেছেন, জানতাম না, তাও মির্জা গালিবকে নিয়ে।
-গালিবও আপনার প্রিয়?
-হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী, আমি অনেকদিন ধরে মির্জা গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি।
-কবে লিখবেন?
-দেখি। আমার খুব তাড়াতাড়ি কিছু হয়ে ওঠে না। যদি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতাম, তা হলে সহজেই লিখে ফেলা যেত। কিন্তু আমি—
তবসুম কোনও কথা বলে না, আমিও না। আয়নার ভিতরে আমাকে ও তবসুমকে দেখতে থাকি আমি।
এরপর আমার উর্দু শিক্ষা শুরু হয়েছিল। আলিফ… বে… পে… তে.। সে আমার হাত ধরে ধরে লেখা শিখিয়েছে, হয়তো কখনও বলে উঠেছে, বাঃ! কত সহজে আপনি লিখতে পারেন।’ কিন্তু একদিন আমি ঘোষণা করে দিলাম, এই বয়েসে শেখার ধৈর্য ও অভিনিবেশ আমার নেই।
অনেক তর্কাতর্কির পর তবসুম বলেছিল, ‘আমি জানি, আপনি কিন্তু পারতেন। আমার প্রস্তাব তবসুম মেনে নিয়েছিল। সে উপন্যাসটা পড়ে মুখে মুখে অনুবাদ করে যাবে আর আমি লিখে নেব। তবসুমের বিয়ের বেশ কিছুদিন পর থেকে আমি রোজ সন্ধ্যায় তার কাছে যেতে থাকি। তবসুমের উচ্চারণে মান্টোর গালিবকে নতুন করে আবীস্কার করতে থাকি এবং বাধ্য লিপিকরের মতো একটা হারানো, অপ্রকাশিত উপন্যাস বাংলায় লিখতে থাকি।
তবসুমের বলা মান্টোর উপন্যাসের অনুবাদ লিখতে লিখতে আমি একসময় বুঝে যাই, মির্জা গালিবকে নিয়ে আমি কখনও উপন্যাস লিখতে পারব না।
এরপর আপনারা যা পড়বেন, তা মির্জা গালিবকে নিয়ে মান্টোর উপন্যাসের অনুবাদ। মাঝে মাঝে আমি ও তবসুম ফিরে আসতেও পারি।