০১. আমাদের এই দুর্গাপুজো

দিওতিমা – দেবারতি মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: অগষ্ট ২০১৮

তাকে,
যার সঙ্গে আমি সারাজীবন গৃহযুদ্ধে
ব্যাপৃত থাকার পরিকল্পনা নিয়েছি…

এক

”আমাদের এই দুর্গাপুজো প্রতিটা বাঙালি, না শুধু বাঙালি নয়, বাংলাভাষা, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মানুষের আত্মার সঙ্গে জড়িত। মা দুর্গা যেমন আমাদের প্রত্যেকের আত্মার আত্মীয়, তেমনই দুর্গাপুজো বাংলার সবচেয়ে বড়ো উৎসব, হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজির প্রধান মরশুম, তাদের জীবিকাও বটে।” ছেলেটা দম নিতে একমুহূর্ত থামল।

ছেলেটার পরনে চকরাবকরা শার্ট আর ফুটিফাটা জিন্স, হাতে একটা বেশ বড়মাপের উল্কি দৃশ্যমান।

মাথার চুলগুলো হলদেটে রং করা, হাওয়ায় উড়ছে ফুরফুর করে।

বক্তৃতা থামিয়ে ছেলেটা সম্ভবত পরখ করতে চাইল, সামনে বসে থাকা মানুষগুলো তার এই ভারী ভারী কথাগুলো বুঝছে কিনা। না বুঝলে অবশ্য কোনো চাপ নেই, তার কাছে সবরকম বক্তৃতার স্টক থাকে। গুরুগম্ভীর, মাঝারি, হালকা, ছ্যাবলা। শুধু বিষয় আর অডিয়েন্স বুঝে একটু নেড়েচেড়ে এক চামচ আবেগ মিশিয়ে পরিবেশন করলেই হল।

”মাটির তাল দিয়ে যারা প্রবল নিষ্ঠায়, মমতায় নিখুঁত প্রতিমার আকার দেন, অক্লান্ত পরিশ্রমে যারা ডাকের সাজে বা বিভিন্ন গ্রাম বাংলার শিল্পে অপরূপা করে তোলেন মা-কে, তাদের এবং তাদের পরিবারের আশা নিরাশার অনেকটা জুড়ে থাকেন মা দুর্গা। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বা রাজ্যের অধিকার নেই সেই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করার, আমাদের জীবিকানির্বাহে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর।” মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ইকো হওয়া মাইক শক্ত করে ধরে গলার শির ফুলিয়ে ছেলেটা এবার বলল।

তারপর সামান্য দম নিয়ে চেঁচাল, ”কি ভাইসব, আমি ঠিক বলছি তো?”

”ঠিক বলছে মানে! বেড়ে বলছে! গলাটা কী সুন্দর কাঁপাচ্ছে দেখেছিস? মা দুগগা যে আমার আত্মীয়, আমি জানতামই না মাইরি! নাহ, এবার থেকে আমি পাঁচশো টাকা বেশি নেব।” বেশ তৃপ্ত চোখে আমার দিকে তাকালো আত্মারামদা, রঘুবীর জ্যাঠার ছেলে।

আমি বিরক্ত মুখে মাঠের ওপর বসে ঘাস ছিঁড়ছিলাম, ”তোর আত্মীয় কেন হতে যাবে মা দুর্গা? বলল আত্মার আত্মীয়, আর তুই শুনছিস আত্মারামের আত্মীয়? আজব বুদ্ধু দেখছি!”

”অ! আত্মার আত্মীয় মানে কী রে গোবর? এই আত্মাটা কে?” আত্মারামদা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায়।

আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল, ”দ্যাখ আত্মারামদা, তোকে কিন্তু এই শেষবারের মতো বলছি, আমায় গোবর বলে ডাকবি না। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে। অফিসের অনেকেই এদিকটায় থাকে, কারুর কানে কথাটা একবার উঠলে আমি কি লেভেলের প্যাঁক খাব বলতো?”

আত্মারামদা অমনি ঠান্ডা আইসক্রিম হয়ে গেল, ”আচ্ছা আচ্ছা, আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, চটছিস কেন ভাই? তুই হলি গিয়ে আমাদের গর্ব। আমি সব জায়গায় তোর কত গুণগান করি জানিস?” আত্মারামদা আমায় গলাতে চেষ্টা করল।

আমি কিছু বললাম না, তোম্বা মুখে স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একবছরও হয়নি এখনো নতুন চাকরির, একদিকে কাজকর্ম শিখতে হচ্ছে, অন্যদিকে অফিসের নানারকম হালহকিকত, পলিটিক্স। আর্ট কলেজে ক্লাসে বসে বা স্টেশন চত্বরে বসে খেয়ালখুশি মতো বন্ধুরা মিলে আঁকা একরকম, আর অফিসে ডেডলাইনের খাঁড়া সামনে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে দেখতে আঁকা আরেকরকম।

তার ওপর এখন সব অফিসেই কর্পোরেট স্টাইলে হাতে আঁকার চেয়ে গ্রাফিক্সের কারিকুরির ওপর বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এটা আবার আমাদের সাবেকি কোর্সে আমরা তেমনভাবে করায়ত্ত করিনি। ফলে নতুনভাবে জানতে হচ্ছে অনেক কিছু। ফিরতে ফিরতে রোজ প্রায় সাড়ে ন-টা দশটা হয়ে যায় রাতে।

ভাবলাম রবিবার, এই একটা ছুটির দিন, বাড়িতে একটু ল্যাদ খাব, কোথায় কী, বাবা হিড়হিড় করে টানতে টানতে আত্মারামদার সঙ্গে পাঠালেন এখানে। কি, না, সারা রাজ্যের পুরোহিত ব্রাহ্মণরা আজ বিপন্ন, সবাই এককাট্টা না হলে অনর্থ নেমে আসবে।

ছুটির দিন, নিদেনপক্ষে একটা ভালো সিনেমাও তো দেখতে পারতাম ঘরে বসে!

আসার আগে আজ সকালে মিনমিন করে বলার চেষ্টাও করেছিলাম একবার, ”আমি গিয়ে কী করব বাবা ? আমি কি পুজো-টুজো করি? করবও না কোনোদিন।”

বাবা তখন ঠাকুরবাড়িতে বসে মা মঙ্গলচণ্ডীর আরাধনায় মগ্ন।

আমাদের এই ঠাকুরবাড়ি আসলে হাওড়ার নটবর ভট্টাচার্য রোডের ওপরে প্রায় দুশো বছরের পুরোনো পারিবারিক মন্দির। আমাদের বসতবাড়িও এই মন্দিরের সঙ্গে লাগোয়া। আসলে মন্দিরটা এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে গোটা অঞ্চলের সবাই বাইরে থেকেই ঢুকতে পারে। ঠাকুরবাড়ির পাশের ছোট গলি দিয়ে ভেতর দিকে গিয়ে বাড়িতে ঢোকার দরজা। আমাদের বাড়ি এ চত্বরে চণ্ডীবাড়ি নামেই পরিচিত বেশি।

আমার বক্তব্য শুনে বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছিলেন। কপালে জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের লম্বাটে তিলক, চোখ রক্তবর্ণ। অনিদ্রা বা অন্য কোনো কারণে নয়, মা চণ্ডীর আরাধনায় বসে মা-কে ডাকতে ডাকতেই নাকি আবেগে বাবার চোখে জল চলে আসে।

বাবার বর্ণনায় আমি বিশদে যাচ্ছি না, ছবি বিশ্বাসের জমিদারের ভূমিকায় বা জাঁদরেল রক্ষণশীল গৃহকর্তার ভূমিকায় অভিনয় করা এমন প্রচুর বাংলা সিনেমা আছে, সেগুলোর যে-কোনো একটা দেখে নিলেই আমার বাবার ধরন- ধারণ, কথা বলার ভঙ্গি, তাকানো, সবকিছুর একটা ওপর ওপর ধারণা হয়ে যাবে। সিনেমার ছবি বিশ্বাসের মতো আমার বাবাও সবসময় গরদের ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া আর কিছু পরেন না, পরিষ্কার উপবীত সবসময় দৃশ্যমান থাকে তাঁর পাঞ্জাবির ফাঁক দিয়ে। চুল সবসময় ব্যাকব্রাশ করা থাকে, মুখে আত্মাভিমানের ছাপ স্পষ্ট।

বাবার নীরব দৃষ্টির সামনে আমি আরও একবার কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিলাম, ”না মানে আমি তো পুজো করি না।”

 ক্লাসিক সিনেমা ‘সপ্তপদী’ তে একটা বিখ্যাত দৃশ্য ছিল। ছেলে উত্তমকুমার চিঠি লিখে পরম ধার্মিক বাবা ছবি বিশ্বাসকে জানাচ্ছেন,

”বাবা আমি রীনা ব্রাউনকে ভালোবাসি। ওর জন্য খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছি, আমি ওকে বিয়ে করব।’

চিঠিটা পড়তে পড়তে সিনেমাতে ছবি বিশ্বাসের মুখটা যেমন মধ্যযুগীয় কাপালিকের মতো হয়ে গিয়েছিল, ভ্রূদুটো সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো হয়ে গিয়ে কপালের ভাঁজের মধ্যে প্রায় মিশে গিয়েছিল, চোখের মণিদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল বাইরে, আমার কথা শুনে বাবারও ঠিক তেমনটাই হল।

ঠান্ডা গলায় বাবা বললেন, ”পুজো করো না মানে?”

আমি বিশেষ বিচলিত হলাম না। বাবার এই অভিব্যক্তি অতিনাটকীয় অভিব্যক্তি আমাকে প্রায়ই ছোটবড় কারণে প্রত্যক্ষ করতে হয়। আমি একইভাবে অধোবদন হয়ে তাকিয়ে রইলাম মাটির দিকে।

বাবা কিছুক্ষণ সেইভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ”পুজো করো না, করবেও না কোনোদিন? কেন সন্ধ্যাহ্নিক, গায়ত্রী মন্ত্র জপ করো না?” বলেই ধমকে উঠলেন, ”তবে শো পিসের মতো গায়ে পৈতেটা রেখেছ কেন, সেটাকেও নর্দমায় ফেলে দাও!”

 ”না ওই পুজো বলছি না, মানে পুরোহিত হয়ে তো কোনো পুজোয় পুরুতগিরি আর …!” আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম।

 বাবা আমায় কথা শেষ করতে দিলেন না, সিরোস্ট্র্যাটাস মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বজ্রের মতো গর্জে উঠলেন, ”পুরুতগিরি! এ আবার কী ভাষা শিখছ তুমি রূপ! ভুলে যেও না, আমরা আন্দুলের বিখ্যাত ভটচাজ পরিবার। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সকলেই এই পেশায় যুক্ত ছিলেন। আর কুলীন ব্রাহ্মণদের পৌরোহিত্য এক ঐতিহ্যবাহী পেশা। বংশমর্যাদা কি ভুলে গেলে নাকি একেবারে? ছি ছি! তোমার কাছ থেকে এমন ভাষা আমি আশা করিনি।”

 এখন আত্মারামদা-র পাশে খোলা মাঠে বসে বিন্দাস বাদাম চিবোচ্ছিলাম কিন্তু সকালের ওই চিত্রনাট্যের কথা মনে পড়তেই চোখের পলকে মনে হল আমি যেন একশো বছর পিছিয়ে গেলাম।

সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, আমাদের বাড়িতে ঢুকলে যে কেউই একশো বছর বা তারও পেছনে হঠাৎ করে চলে গেছে বলে ভুল করে।

এমনিতে আমাদের ভট্টাচার্য পরিবার অনেক প্রাচীন বংশ, প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের আসল বাড়ি হাওড়ার আন্দুলে, তাই সবাই আমাদের আন্দুলের ভট্টাচার্য নামেই চেনে।

কয়েক প্রজন্ম আগের এক পূর্বপুরুষ আন্দুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ি করেছিলেন এই নটবর ভট্টাচার্য রোডে, তার নামেই রাস্তার নাম হয়েছে পরবর্তীকালে।

এই ব্যাপারে ছোটকাকা আমাকে একদিন একটা গল্প শুনিয়েছিল। জানিনা সেটা কতটা সত্যি আর কতটা অতিরঞ্জিত।

প্রায় হাজার বছর আগে বাংলার এক রাজা আদিশূর কনৌজের কোলঞ্চ নামে এক রাজার কাছে কোনো এক যজ্ঞের জন্য সর্বজ্ঞানী পাঁচজন ব্রাহ্মণ বাংলায় পাঠাবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন যে বাংলায় ব্রাহ্মণ ছিল না তা নয়, তবে তাঁরা সম্ভবত কনৌজের ব্রাহ্মণদের মতো অতটা ব্যুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু কনৌজের কোলঞ্চ রাজা সেই অনুরোধ রাখেননি, গুরুত্বই দেননি আদিশূরের দূতকে। তাতে আদিশূর ক্ষিপ্ত হয়ে বাংলা থেকে প্রায় সাতশো ব্রাহ্মণকে গোরুর গাড়ির পিঠে চড়িয়ে উত্তরপ্রদেশ পাঠিয়ে দেন। ব্যাপারটা অনেকটা, আপনি কি মনে করেন, আমার রাজ্যে বামুনের অভাব? দেখুন, আমার কত বামুন! নিন, ঠ্যালা সামলান!

এই কাহিনি মনে পড়লেই আমার ছোটকাকার কৌতুকভরা মুখটা মনে পড়ে যায়।

তখন আমি কত ছোট, তবু স্পষ্ট মনে আছে পুরোটা। ছোটকাকা আমাদের দোতলার ঝুলবারান্দায় একটা আরামকেদারায় বসে হেসে হেসে বলছে, ”তখন তো কোলঞ্চ রাজা পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী আর যাই হোক, ব্রাহ্মণদের কোনোভাবেই আক্রমণ বা লাঞ্ছনা করা যেত না। তখন কোলঞ্চ রাজা কী আর করেন, নিজের রাজ্য থেকে পাঁচজন কৃতি ব্রাহ্মণকে পাঠালেন বাংলাদেশে। সেই পাঁচজন ব্রাহ্মণ বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করলেন, তাঁরা এবং তাঁদের বংশই পরিচিত হলেন কুলীন ব্রাহ্মণ নামে। আমরা সেই পাঁচজন ব্রাহ্মণের একজনের বংশধর। বুঝলি?”

আমি তখন ক্লাস সিক্স কী সেভেন।

প্রশ্ন করেছিলাম, ”তার মানে আমরা কুলীন? আমাদের ইতিহাস বইতে লেখা আছে, রাজা বল্লাল সেন কুলীন প্রথা চালু করেছিলেন। কুলীন প্রথা কী ছোটকাকা?”

”সেটা তো অন্য প্রসঙ্গ হয়ে গেল। যাই হোক, জিজ্ঞেস করলি যখন সংক্ষেপে বলে দিই। কুলীন একটা জঘন্য প্রথা ছিল। বাংলায় একটা সময় পাল বংশ শাসন করত জানিস তো? পালেরা ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। পাল বংশের পর সেন বংশের রাজারা এসে হিন্দু ধর্মকে আবার প্রোমোট করতে থাকেন। তখনই নিয়ম হয়, ব্রাহ্মণকন্যাদের শুধুমাত্র কুলীন পাত্রর সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে। মানেটা বুঝতে পারলি? বাংলাদেশে হাজার হাজার ব্রাহ্মণ, কিন্তু কুল রাখতে গেলে তাদের বংশের মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে কুলীন ব্রাহ্মণ বংশে। এদিকে কুলীন ব্রাহ্মণ তো সংখ্যায় অনেক কম, সেই কনৌজ থেকে আসা পাঁচ ব্রাহ্মণের শাখাপ্রশাখা। এত কুলীন ছেলে কোথায় পাওয়া যাবে?” ছোটকাকা যেন আমাকেই প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল।

”তাহলে?”

”তাহলে আবার কী। পাত্রী প্রচুর, পাত্র কম। অতএব কুল রাখতে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোকে সত্তর, আশি বছরের বুড়ো হয়ে মরতে যাওয়া কুলীন ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া শুরু হল। একে তখন নয়-দশ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিতে হত, নাহলেই সমাজ একঘরে করে দেওয়ার ভয় দেখাত, অন্যদিকে কুলীন প্রথা। একেকটা কুলীন ব্রাহ্মণের হু হু করে বউয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকল। একটা আশি বছরের বুড়ো, তার পঞ্চাশটা বউ। বুড়ো কিছুই করে না, সারাবছর শুধু শ্বশুরবাড়িগুলোতে খেয়েদেয়ে সেবাযত্ন নিয়ে বেড়ায়, বিয়ের সময় যৌতুক নেয়, আবার বিয়ে করে। তারপর বুড়ো মরলে আবার তার সঙ্গে জ্যান্ত সহমরণে যেতে হয়।” ছোটকাকা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, ”শোন, বড়দা যতই আমাদের কৌলীন্য নিয়ে গর্ব করুক, সবসময় মনে রাখবি, আমাদের পূর্বপুরুষরাই এইসব করেছে, হাজার হাজার মেয়েকে এইভাবে কষ্ট দিয়েছে, চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে সতী করেছে। তাই কোনোদিনও ব্রাহ্মণ বলে গর্ব করবি না, বুঝলি? জাত টাত কিস্যু নয়। মানুষ নিজের কাজের ভিত্তিতে শ্রদ্ধা অর্জন করে।”

আমি ঘাড় নেড়েছিলাম। তখন আমি কিশোর, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা শুনে ভয়ে মনের ভেতরটা কেমন যেন হচ্ছিলো।

”যাই হোক, যেটা বলছিলাম। তুই তো জানিসই, আমাদের আসল দেশ ছিল আন্দুলে। সেখানে ১৬৫৭ সাল থেকে আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। সে সাবেক আটচালা মন্দির, বিশাল ঠাকুরদালান, একেবারে হইহই রইরই কাণ্ড। সেভাবেই চলে আসছিল। হঠাৎ গোল বাধল প্রায় দুশো বছর আগে। আমাদের বংশের এক ছেলে বিয়ে করে বসলেন কায়স্থ এক মেয়েকে। ব্যাস, তাই নিয়ে ভাইদের মধ্যে চরম বিবাদ সৃষ্টি হল। তখন আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, মানে তোর বাবারও আর কি, তিনি আন্দুলের বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে এসে সংসার পাতলেন এখানে। যে বংশে অব্রাহ্মণ গৃহবধূ থাকবে, সেখানে আবার পুজো কি? তিনি এখানে এসে নতুন করে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো শুরু করলেন।” ছোটকাকা চোখ বন্ধ করে বলেছিল, ”তার মানে, আমাদের এই বাড়ির পুজো তো দুশো বছরের, কিন্তু আমাদের আদি বাড়ি, ওই আন্দুলের পুজো প্রায় চারশো বছরের পুরোনো। ঘটে ঢুকল কিছু?”

আমি মাথা নেড়েছিলাম, ”বাব্বা! একটা বিয়ের জন্য পুরো বাড়ি থেকেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন উনি?”

ছোটকাকা তখন মিটিমিটি হেসেছিল, ”তোমার পিতৃদেব, মানে আমার শ্রদ্ধেয় দাদাটিও কিন্তু ওইরকম। দেখিস বাবা, দুম করে কোনো বিয়ে টিয়ে করে বসিস না যেন! আমি তখন বাঁচাতে পারব কিনা জানিনা, দাদা কিন্তু কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে।”

অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

ভাগ্যের পরিহাস এমনই, সত্যিই ছোটকাকা এমন পরিস্থিতি এলেও বাঁচাতে পারবে না। যে মানুষটা আমাদের বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ছিল, এই সব জাতপাতে পাত্তাই দিত না, সে-ই আজ আর নেই।

ফলে দিন দিন সময় এগোচ্ছে, কিন্তু আমাদের বাড়িটা প্রাগৈতিহাসিক যুগেই পড়ে রয়েছে।

আর এখন তো বাবা ঠাকুরদার প্রতিষ্ঠা করা এই অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের দণ্ডমুণ্ড প্রেসিডেন্ট, ছোটোকাকার অবর্তমানে বাবার ওপরে কথা বলার কারুর সাধ্যও নেই, কাজেই ক্রমশ এইসব বেড়েই চলেছে।

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে পৈতেয় গিঁট পাকাচ্ছিলাম, তারপরই চমকে উঠে ছেড়ে দিলাম।

আমার খুড়তুতো বোন টিকলি আমাকে একটা সহজ উপায় বাতলে দিয়েছে, ”দাদাভাই, তুই মাঝেমাঝেই মনে করবি জেঠুমণি তোর পাশে অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাহলেই দেখবি ভটচাজ বাড়ির আদর্শে ঘা লাগানো কোনো কাজ তুই আর কখনো করতে পারবি না।”

টিকলির কথাটা মনে হওয়া মাত্রই আমার যেন মনে হল, একটু দূরে বাঁ হাতে যে তেঁতুল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা যেন বাবার মতোই কড়া চোখে তাকিয়ে আমার পৈতেয় গিঁট পাকানো দেখছে আর তিরতির করে কাঁপছে।

আমি পলকে চোখ নামিয়ে নিলাম। পৈতের কোনো অযত্ন বাবা দেখতে পারেন না।

হঠাৎ আত্মারামদার ডাকে আমি আবার মাঠে ফিরে এলাম, আত্মারামদা বলল, ”না! ঝন্টুর গলায় কিন্তু জোশ আছে যাই বল গোব … ইয়ে রূপ, পার্টিপলিটিক্স করে করে গা গরম করা লেকচার দিতে শিখে গেছে বেশ!”

 আমি একঝলক মঞ্চের দিকে তাকালাম। ঝন্টু বলে ছেলেটা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম ”কে বলতো ছেলেটা? কোনোদিনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

 ”তুই হলি গিয়ে ভালো ছেলে, তুই দেখবি কী করে? ও তো বালিটিকুরির নেতা, বেশ নাম করেছে। সঙ্গে আবার প্রোমোটারিতেও হাত পাকাচ্ছে। তোদের দোকানের জগদীশকাকা, ওর ভাইপো হয় তো।” আত্মারামদা নাক খুঁটতে খুঁটতে বলল।

”জগদীশকাকার ভাইপো পার্টি করে?” আমি এবার অবাক হলাম, ”পার্টির লোক আমাদের এই সভায় কী করছে? ও-ও কি পুজো করে নাকি?”

”ধুস!” আত্মারামদা আমার বোকা বোকা প্রশ্নে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ”কী যে বলিস তুই! পুজো করতে যাবে কেন! এখন কোনো পোতিবাদই পার্টি না ধরে হয় না, পার্টি ছাড়া পোতিবাদ করলে তাতে কেউ পাত্তাও দেয়না। সেইজন্যই তো জগদীশকাকা ওকে নিয়ে এসেছে। ঝন্টুর কড়ক কড়ক লেকচারে সব একেবারে শুয়ে পড়বে দ্যাখ না!”

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। যে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আমার বাবা, সেই সংগঠনের সভায় কাউকে বক্তৃতা দিতে বাইরে থেকে আনা হয়েছে নিশ্চয়ই বাবার অগোচরে নয়।

বাবা এইরকম সস্তা ছেলে দিয়ে বক্তৃতা দেওয়াচ্ছেন?

হাওড়া জেলার শ্রদ্ধেয় শাস্ত্রী মশাই ওরফে বসন্ত ভট্টাচার্যর শেষে এই হাল?

কী যেন নাম মেয়েটার? ডিওডোরেন্ট না কি যেন!

আমি বললাম, ”ওই ডিওডোরেন্ট বলে মেয়েটা কোথায় থাকে রে আত্মারামদা?”

”ডিওডোরেন্ট? সেটা আবার কে?” আত্মারামদা হাঁ।

”আরে, যার জন্য এত কিছু। যে পুজো করবে বলে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন ফাইল করেছে, কী যেন নাম?”

”অ ! ওই ফুলনদেবীর কথা বলছিস? এক মিনিট।” আত্মারামদা টুক করে ওর ঝোলা থেকে আজকের খবরের কাগজ বের করল, তারপর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছবি দেওয়া মেয়েটার নামটা বানান করে পড়ল, ”দিওতিমা। দিওতিমা বিশ্বাস।”

হ্যাঁ হ্যাঁ। দিওতিমা। এরকম অদ্ভুত কারুর নাম হয় বলে শুনিনি কখনো। অবশ্য অব্রাহ্মণ এবং মেয়ে হয়ে দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করবে, এবং সেটায় বাগড়া দেওয়াতে কোর্টে গিয়ে সমস্ত পুরোহিতদের জন্য লাইসেন্স আনার দাবিই বা কে কবে শুনেছে!

আমার কাল সন্ধেতে বাড়িতে সংগঠনের আলোচনায় বাবার গর্জন মনে পড়ল, ”এত বড় স্পর্ধা! আমাদের মতো পোড় খাওয়া ব্রাহ্মণদের শেষে পুজো করার পরীক্ষায় পাশ করে লাইসেন্স পেলে তবে পুজো করার অনুমতি দেওয়া হবে? কোথাকার কে একটা বাচ্চা মেয়ে এইসব বলে লোকজনকে উসকোচ্ছে, আর মিডিয়াও মজা দেখছে! না না রঘুবীর, সরকার কোনো স্টেপ নেওয়ার আগেই কোমর বেঁধে নামো। এ চলতে পারেনা।”

আমি একবার খবরের কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখলাম মেয়েটাকে। বয়স আমারই মতো হবে, চাপা গায়ের রং, ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল, শান্ত অথচ স্পষ্ট দৃপ্ত চোখের চাউনি।

ইতিমধ্যে সভা ভেঙে গেছে। আত্মারামদা একটা বিশাল হাই তুলে উঠে দাঁড়াল, ”নাহ! যাই। নামাবলিটা গিয়ে কাচতে হবে। কাল আবার ঘোষপাড়ায় সত্যি নারাণের পুজো আছে। ভালো বাড়ি, মালকড়ি বেশ দেয়। গেলবার তো টাকার সঙ্গে কি ভালো একটা রুপোর থালা গেলাস দিয়েছিল, বাজারের বসাকের দোকানে বেচে সাড়ে তিন হাজার টাকা পেয়েছিলাম।”

আমি আত্মারামদার দিকে তাকালাম, ”সত্যি নারাণ নয়, ওটা সত্যনারায়ণ আত্মারামদা! পুজো করে খাচ্ছিস, উচ্চারণগুলো অন্তত ঠিকঠাক কর। আর পুজোর জিনিস বেচে দেওয়া, ছি ছি, লোকে শুনলেই বা কী ভাববে। তোর মতো ভুলভাল পাবলিকদের জন্যই ওই দিওতিমা কেস করেছে, যে যা খুশি ভুলভাল মন্ত্র পড়বে, দেশে কোনো আইনকানুন নেই নাকি। এরকম করলে পুরুতদের উপর মানুষের আস্থা থাকবে কী করে, সত্যিই তো!”

”আইনকানুন আবার কিসের ভাই? তোরও কি ওই হাওয়া লাগল নাকি? ওরে ধর্মবীর চক্কোত্তির নাতি আমি, রঘুবীর চক্কোত্তির ছেলে, ওইটেই আমার সাটিরফিকেট, ওইটেই আমার লাইসেন্স, বুঝলি গোবর?” কথাটা বলেই আত্মারামদা হাওয়া হয়ে গেল।

সেদিন আর বেশিদিন চলবে না অশিক্ষিত আত্মারাম, আমি ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে হাঁটা লাগালাম, তামাম ব্রাহ্মণ চূড়ামণি বসন্ত ভট্টাচার্য যখন এতটা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তোমাদের হাল তো ছেড়েই দিলাম!

দুই

ক্যালেন্ডার যতই বলুক এটা সেপ্টেম্বরের প্রথম, ট্রেনে করে যাওয়ার সময় রেল লাইনের দু-ধারে যতই স্নিগ্ধ কাশফুল চোখে পড়ুক, গরমে টেকা যেন দায় হয়ে উঠছে এই পচা ভ্যাপসা গরমে!

আমার আবার চিরকালই ঘাম হয় বেশি, আর ভিড় বাসের মধ্যে এই ঘটাং ঘটাং করে যেতে যেতে পিঠের কাছটা কুর্তিটা যেন ভিজে সপসপ করছে।

চুলের পনিটেলটা আলগা হয়ে এসেছিল, আমি কোনোমতে বাসের হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক অবিন্যস্ত হয়ে পড়া চুলগুলোকে চুড়ো করে মাথার ওপরে নিয়ে এসে বাঁধলাম।

রাস্তাঘাটে কিছু ছেলে আছে দেখেছি, মেয়েরা চলাফেরা বা বসার মাঝে একটু অসাবধান হলেই নির্লজ্জভাবে তাকিয়ে থাকে।

এখনো সেটাই হল।

সামনে বসে থাকা ছেলেটা হেডফোনে দিব্যি গান শুনছিল, যেই আমি হাতদুটো তুলে চুলটা বাঁধতে গেছি, অমনি চোখ তুলে ড্যাবড্যাব করে আমার ঘামে ভিজে ওঠা বগলের আশপাশ দেখতে লাগল। এক ঝলকের জন্য নয়, তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।

আমার মাথাটা গেল ধাঁ করে গরম হয়ে। একে তো মিনিবাস, সামনের প্রতিবন্ধী সিটে বেহায়ার মতো বসে আছে, সামনে আমার পাশেই একজন বৃদ্ধা কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে বসতে দেওয়ার সহবৎ তো দূরে থাক, কানের দুদিকে দুটো হেডফোন গুঁজে যেন সংগীতের উচ্চমার্গে বিচরণ করছে। এদিকে ঝাড়ি মারতে আর চোখ দিয়ে নোংরামো করতে কোনো আলস্য নেই।

আমি চোখটা সরু করে বাইরের দিকে তাকিয়ে মুখটাকে যতটা সম্ভব হিংস্র করলাম, তারপর মুখ ঘুরিয়ে সোজা ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে গলার স্বরটাকে ধারালো ছুরির মতো মিহি করলাম, ”কী দেখছ ভাই?”

ছেলেটা মুহূর্তে ঠান্ডা বেগুনভাজার মতো মিইয়ে গিয়ে চোখটা ঘুরিয়ে নিল, ”কী-কিছু না তো! কী বলছেন আপনি?”

আমি ওর আপনি আজ্ঞেটাকে কিক দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে বললাম, ”কোনোদিনও মেয়ে দেখো নি, না কোনোদিনও বগল দেখোনি, কোনটা?”

ছেলেটা আমার তেরিয়া মার্কা কথায় আরও ভেবলে গেল, ”আমি কিছু করিনি দিদি।”

এবার আমি আমার গলাটাকে দুম করে সি শার্পে নিয়ে গেলাম, ”কিছু করোনি তো, তখন থেকে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে রয়েছ কেন? আচ্ছা করে ধোলাই দেব নাকি?”

আজকাল বাসে ট্রেনে লোকজন কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে না সাহায্য করতে, তবু আমার এই রণরঙ্গিণী মূর্তির মাহাত্ম্যেই হয়তো বেশ কিছু লোক গুনগুন করতে শুরু করল, ”কি হে ভাই, এই বয়সেই এইসব অসভ্যতামি শিখে ফেলেছ?”

”কানটা ধরে দু-ঘা দিননা দিদি, কেওড়ামি বেরিয়ে যাবে।”

”সত্যি আজকালকার ছেলেগুলো যে কি …!”

অন্য সময় হলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ চালিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন আমি আর কথা বাড়ালাম না। ছেলেটার দিকে একটা রঘু ডাকাত মার্কা দৃষ্টি দিয়ে নেমে পড়লাম। হাতে অনেক কাজ। এখানে ঝুলে গেলে চাপ আছে। আজ অফিসটা কামাই যখন করেছি, সবগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে।

কিন্তু যখন বেশি তাড়া থাকে, তখনই বেশি দেরি হয়, বরাবর দেখেছি। এখনো তাই হল।

গলির মুখে ঢুকতে যাচ্ছি, রাস্তার পাশে নিবারণকাকার চায়ের দোকানে বসে থাকা তিনটে ছেলে আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। আলগোছে বিশ্রী হলদেটে রং করা চুলগুলো ঠিক করে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে।

তিনটে ছেলেরই বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের ভেতর।

মাঝখানে যে রয়েছে, তার হাবভাব দেখেই বোঝা যায় সে-ই দলের পান্ডা। মুখে কিছু একটা চ্যুইং গাম চিবোচ্ছে, পরনের গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা ছেঁড়াখোঁড়া প্যান্টটা একবার টেনে তুলে ঠিকঠাক করে একদম আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল, ”নমস্কার ম্যাডাম, আপনিই দিওতিমা বিশ্বাস তো? আমি ইয়ে … বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশন থেকে আসছি, আমার নাম ঝন্টু মল্লিক।”

আমার ধারণা ছিল, পশ্চিমবঙ্গের এই পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে গেলে পুরোহিত হতে হয়, মানে একমাত্র পুরোহিতরাই এই সংগঠনের সদস্য হতে পারেন।

এই লোফারমার্কা ছেলেটা পুরোহিত?

আমি আপাদমস্তক ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম, ”হ্যাঁ আমিই দিওতিমা। বলুন কী ব্যাপার?”

”হে হে, বলার তো অনেক কিছুই আছে ম্যাডাম!” কুতকুতে চোখে ঝন্টু মল্লিক কান এঁটো করে হাসল, ”এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর সব কিছু বলা যায়? একটু যদি আমাদের সঙ্গে কোথাও বসেন, বড্ড ভালো হয়।”

”আমি আপনাদের চিনি না জানিনা, হঠাৎ করে কোথাও বসতে যাব কেন!” আমি ভ্রূ কুঁচকোলাম, ”যা বলার এখানেই বলুন।”

ঝন্টু পেছন ফিরে একটা স্যাঙাতের দিকে তাকাল, তারপর একটু সরে গিয়ে নিবারণকাকার উদ্দেশ্যে গলা চড়াল, ”ও কাকা, চারটে চা দাও, দুধ চিনি এলাচ, একদম কড়া করে!”

এই গলিটা বেশ সরু, গলির মুখেই একটা বাচ্চাদের স্কুল। এই দুপুর পেরিয়ে বিকেল হওয়ার সময়টা স্কুল ছুটি হওয়ার সময়। স্কুলের ছোটো ছোটো বাচ্চা, তাদের মায়েরা, সঙ্গে রিকশা, স্কুল ভ্যানের প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ, সব মিলিয়ে ভীষণ সরগরম এখন গলিটা।

আমি প্রায় রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, একটা স্কুটি হড়বড়িয়ে সামনে এসে পড়ায় বাধ্য হয়েই আমাকে নিবারণকাকার দোকানের দিকে সরে আসতে হল।

নিবারণকাকা আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দুধ ফোটাতে লাগল। ছোট থেকেই নিবারণকাকা আমাকে দেখছে। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যখন বাজারে যেতাম, ফেরার পথে নিবারণকাকার দোকানে এক কাপ চা খাওয়া আর মিনিটদশেক গল্পগুজব করা ছিল বাবার অভ্যেস। আমার জন্য ওইসময়টা বরাদ্দ হত শক্ত টোস্ট বিস্কুট। তখন টোস্ট বিস্কুট বাড়িতে আসত না, তাই মুখে দিলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া বিস্কুটটার জন্য আমার নিবারণকাকার দোকানে আসতে আমি মুখিয়ে থাকতাম।

তখন এইসব রেস্টুরেন্ট, কফি শপ কোথায়! ওইটুকু ছোট ছোট পথচলার মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকত অপার আনন্দ।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে অতীতের স্মৃতিচারণ বন্ধ করে নিবারণকাকার দিকে তাকালাম, ”ভালো আছ নিবারণকাকা?”

নিবারণকাকা সামান্য হাসল। তারপর ছেলেগুলোর চোখ বাঁচিয়ে আমাকে ইশারা করে বোধহয় বলতে চাইল, ”মাথা গরম করিস না। ছেলেগুলো সুবিধের নয়।”

আমার কর্মকাণ্ডের জের তার মানে বাজার পেরিয়ে এই নিবারণকাকার দোকানেও এসে পৌঁছেছে, আমি ভাবলাম।

ঝন্টু মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ”বলুন?”

”আজ কি আপনার ডিউটি ছিল না?” ঝন্টু মাখন স্বরে জিজ্ঞেস করল।

”না। আজ ছুটি নিয়েছিলাম। একটা কাজ ছিল।” আমি বিরস কণ্ঠে বললাম।

ঝন্টু মুখ দিয়ে একটা চুকচুক করে শব্দ করল, ”এহ, নতুন চাকরি, এর মধ্যেই এত ছুটি নিচ্ছেন ম্যাডাম?”

আমি এবার কড়া গলায় বললাম, ”দেখুন আমার না তাড়া আছে। একটু তাড়াতাড়ি বলুন কী বলবেন।”

ঝন্টু আমার দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিল, ”আহা, এত তাড়া কিসের! এখন তো সবে বিকেলবেলা। মাসিমা এর মধ্যেই চিন্তা করা শুরু করবেন বুঝি? অবশ্য একটামাত্র মেয়েই তো ওঁর সম্বল, চিন্তা তো করবেনই!”

আমি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, ”কিছু কাজের কথা আছে কি আপনার? নাহলে আমি এবার উঠব।”

মুহূর্তে ঝন্টুর মুখ থেকে ভালোমানুষির মুখোশটা খসে পড়ল, ”কাজের কথাই তো বলছি ম্যাডাম। কত কী মাল্লু লাগবে বলুন, তারপর আপনার কেসটা উইথড্র করে নিন। অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন এরই মধ্যে, এখন ক্লোজ করে দিলেও আমরা ঠিক সালটে নেব। নাহলে …” ঝন্টু বিশ্রী হাসল, ”মাসিমা আপনার জন্য চিন্তা করতে করতে হয়তো কেওড়াতলায় চলে যাবেন তবু আপনি ফিরবেন না, হে হে!”

রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এই ঝন্টু মল্লিক পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশন থেকে এসেছে। কী ভাষা মুখের! অন্য কেউ হলে আমি সপাটে একটা চড় লাগাতাম। কিন্তু নেহাত বিষয়টা এখন কোর্টের বিচারাধীন, তাই অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম, ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে হাঁটতে উদ্যত হলাম।

ঝন্টু বলল, ”আরে চা-টা না খেয়েই চলে যাচ্ছেন কেন! বসুন বসুন, অত রাগলে চলে! এখনো তো কিছুই দেখেননি!”

আমি পেছনে না ফিরে হনহন করে হাঁটছিলাম। স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলাম এইটা ভেবে যে কোথায় বাস করছি আমরা! দিনে দুপুরে পাড়ার মোড়ে মস্তান এসে থ্রেট করছে, তাও আবার আমার নিজের পাড়ায়।

নিবারণকাকা পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ করল না! আসলে সবাই নিজেরটা আগে বোঝে। রাগে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল।

সূর্য ধীরে ধীরে ঢলছে পশ্চিমদিকে। দূরের পাখিগুলো উড়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে, খুঁজে নিচ্ছে নিজেদের বাসা। তাদের কিচিরমিচির শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে ইলেকট্রিকের তারগুলো, থিরথির করে নড়ে উঠছে গাছের পাতা।

সেদিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ে গেল মাসকয়েক আগের সেই দিনটার কথা।

সেই প্রচণ্ড অপমানিত হওয়ার দিনটা।

গলাটা কেমন শুকিয়ে উঠল, কিন্তু কোনোকালেই বাইরে বেরনোর সময় আমার সঙ্গে জল থাকে না। রাস্তার একপাশের টিউব ওয়েলে গিয়ে আঁজলা ভরে জল নিয়ে ঘাড়ে, মাথায়, মুখে ঝাপটা দিতে লাগলাম।

মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, পুরোহিতদের লাইসেন্স আমি চালু করবই! এইসব অযোগ্য লোকেদের হাতে সাধারণ মানুষ বেশিদিন আর প্রতারিত হতে পারে না। এই ঝন্টু, মন্টু, রন্টু এরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।

তিন

অন্যবার পুজো এগিয়ে আসতে থাকলে মনটাও কেমন অজানা আনন্দে ভরে উঠতে থাকে। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে একটা খুশির আমেজ দুধের ওপরের সরের মতো আলতোভাবে ভেসে থাকে, ব্যস্ততার মাঝেও সেই ঘন সরের স্বাদ একটা আনন্দের রেশ রেখে যায়।

কিন্তু এইবার এতসব ডামাডোলে মনটা যেন খিঁচিয়ে আছে। পুজো আসছে জেনেও যেন সেই উচ্ছ্বাসটা মনের মধ্যে টের পাচ্ছি না।

অনেকদিন পর ক্যানভাসে একটা ছবি আঁকছিলাম। রবিবার, ছুটির দিন। আগে শনিবার রবিবার আলাদা করে কিছু মনে হত না, কিন্তু অফিস শুরু হওয়ায় ছুটির দিনগুলোর একেকটা মুহূর্ত খুব দামি মনে হয়। ইচ্ছে করে গরমকালের দুপুরের ঠাকুমার বানানো চালতার আচারের মতো তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাই, দুম করে শেষ না হয়ে যায়!

একটা সাদা রঙের ঘোড়া আঁকছিলাম। পক্ষীরাজ নয়, এমনিই সাধারণ ঘোড়া। তার দুধসাদা চামড়ার ওপর রোদ-কাদার প্রলেপে কেমন একটা ধূসর আস্তরণ পড়েছে, পায়ের খুরে ক্লান্তির ছাপ।

তবু সে অনমনীয়। দূরে সূর্য অস্তগামী, কমলা রং ঈষৎ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আকাশে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঘোড়াটা ছুটে চলেছে দূরের দিগন্তে, আলো নেভার আগে তাকে গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে।

আঁকতে আঁকতে ভাবছিলাম, ঘোড়াটা কি জানে ওর গন্তব্য কোথায়? ঠিক কোনখানে পৌঁছলে শেষ হবে ওর পথচলা? জানেনা। তবু সে ছুটে চলেছে। মানুষও তাই। কী তার লক্ষ্য, কী তার গন্তব্য, ঠিকমতো না জেনেই শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছুটে চলে অনির্দিষ্ট অভিমুখে। এরই নাম জীবন। এরই নাম সংগ্রাম। যারা রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নাকে মুখে গুঁজে ছোটে অফিসে, তারাও এই সংগ্রামে শামিল, যারা বাড়িতে থেকে সংসারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য প্রাণপাত করে, তারাও।

তবে সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু মানুষ আছে, যারা এই ইঁদুরদৌড়ে নাম লেখাতে চায় না, প্রথা ভেঙে বাঁচতে চায় নিজের ফর্মুলায়। আর সমাজ তখন উঠে পড়ে লাগে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করতে। দাগিয়ে দেয়, ”ও ওরকম কেন? ছি ছি, পরিবারের মান সম্মান সব ডোবাল!” এই সব বলে। সেই ভীষণ চাপ কেউ সহ্য করতে পারে, কেউ পারে না।

এই যে দিওতিমা বলে মেয়েটা, সমাজের এতবড় ট্যাবুর বিরুদ্ধে একা লড়াই করে যাচ্ছে, কতরকম টিপ্পনী, বাধার সম্মুখীন হয়তো হতে হচ্ছে ওকে। আমার হঠাৎ করেই মেয়েটার কথা মনে পড়ল। যতদূর বুঝছি, মেয়েটা কারুর কথায় দমে যাওয়ার পাত্রী নয়, তবু এত মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তো সকলের থাকেনা।

যেমন ছিল না ছোটকাকার।

ছোটকাকার কথা মনে পড়তেই আমার হাতের তুলি যেন শ্লথ হয়ে এল, হাত ক্রমশ জোর হারিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে লাগল। আমি তুলিটাকে সাবধানে প্যালেটের ওপর নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম উত্তরের জানলার দিকে।

আমার এই দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় আমাদের ঠাকুরবাড়ি ঢোকার দরজাটা। প্রতিবার পুজোর আগে বাবা দরজাটা রং করান, এবারেও আজ সকাল থেকে সেই পর্ব চলছে। তবে এবার ইচ্ছা করেই বাবা রংটা পালটে দিচ্ছেন। ঠাকুরবাড়ির দরজাটা ছিল লাল রঙের, এবার তাতে সবুজ প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে।

আমার দেখতে দেখতে মনে পড়ল, আগে সবুজ রঙেরই ছিল দরজাটা। এই লাল রংটা আমার ইচ্ছেতে করিয়েছিলেন বাবা, পৈতের ঠিক আগে। আমার পৈতে হয়েছিল ক্লাস সিক্সে পড়তে, এগারো বছর বয়সে। তখন গোটা বাড়িতেই অনেক রদবদল আনা হয়েছিল।

আমি তখন সুবোধ বালক। বাবা যা করতে বলেন তাই করি। মনে বিরক্তি এলেও চটজলদি গিলে ফেলি। উপনয়ন অনুষ্ঠান মেটার পরে পরেই বাবা আমাদের বাড়ির পেছন দিকের পুকুরে ভোরবেলা নিয়ে গিয়ে আমাকে শিখিয়েছিলেন, ”একবার ডুব দিয়ে নাভি পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে প্রথমে আচমন করবে। তারপর ‘ওঁ নমো নারায়ণায়’ বলে চারদিকে জল দিয়ে মোটামুটি এক হাত মাপের বৃত্ত এঁকে জল শুদ্ধ করে নেবে।” বলার সঙ্গে বাবা নিজেও জলে নেমে সেটা করে দেখাচ্ছিলেন, ”তারপর বলবে,

ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী

নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু!”

নাকঝাড়ার শেষ ধাপে মানুষ যেমন জোরে চাপ দেয়, তেমনি ‘কুরু’ কথাটার উপর জোর দিয়ে বাবা পরম ভক্তিভরে স্নান মন্ত্র শেষ করলে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”আচমন করে মন্ত্র শুরু করতে বললে, আচমন কি বাবা?”

বাবা আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন, ”যেকোনো শুভকাজ করার আগে দেহ মন শুদ্ধ করাই হল আচমন রূপ। তোমাকে যে বিষ্ণুমন্ত্র শিখিয়েছি মনে আছে?”

আমাকে তার গত কয়েক দিন আগে থেকে প্রচুর মন্ত্র শেখানো হয়েছিল, আমি সেগুলোর মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে বলেছিলাম,

 ”ওঁ অপবিত্র পবিত্রোবা সর্বাবস্থা গতোহপি বা

 য সরেত পুন্ডরিকাক্ষং স বাহ্যঅভ্যন্তরে শুচি।।

এইটা বাবা?”

বাবার মুখ ভোরের সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠেছিল, ”বাহ, এই না হলে আমার ছেলে মঙ্গলরূপ!” তারপর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বুকে, ”সংস্কৃত উচ্চারণ এমনভাবে করবে, যেন মানুষের মনে তা দৃঢ়ভাবে গিয়ে গেঁথে যায়। এই যে মন্ত্রটা তুমি উচ্চারণ করলে, এর অর্থ হল, শরীর কিংবা শরীরের মধ্যে অবস্থিত মন, এই দুটির কোনোটিও যদি অপবিত্র হয়, তবে শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করলেই বাহ্য ও অন্তরে শুদ্ধ হওয়া যায় বুঝেছ রূপ?”

এগারো বছরের আমি তখন লম্বা ঘাড় দুলিয়েছিলাম। তারপর বাবা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ডানহাতটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, ”ডান হাতের তালুকে এইরকমভাবে গোরুর কানের মতো করবে, একটা মাষকলাই ডুবতে পারে ততটা জল নিয়ে ওঁ বিষ্ণু মন্ত্রটা বলতে বলতে জলটা খাবে। তারপর,” বাবা বুড়ো আঙুলটার পেছন দিকটা ঠোঁটের দুপাশে ঠেকিয়ে বলছিলেন, ”এইরকম করে স্পর্শ করে তারপর হাত ধুয়ে নেবে। পুরোটাই করবে পবিত্র মনে। শুধু মন্ত্র উচ্চারণ করলেই হয়না, মনটাকে শুদ্ধ রাখতে হয়।”

আচ্ছা, বাবা যে সংগঠনের বক্তা হিসেবে ওই ঝন্টুকে এগিয়ে দিচ্ছেন, ওর কি মনটা শুদ্ধ?

আমি দেখতে পেলাম পবন মিস্ত্রী রঙের ব্রাশ দিয়ে ওপর থেকে নীচ অবধি বুলিয়ে দিচ্ছে কাঁচা রঙের প্রলেপ।

আমি ঘরের মধ্যে তুলি দিয়ে আঁকছি, পবন মিস্ত্রী বাইরে। আসলে আমরা দুজনেই শিল্পী, দুজনের মধ্যেই রয়েছে সৃজনশীল সত্তা, একেকজনের প্রকাশ একেকরকমভাবে।

ছোটকাকাও শিল্পী ছিল। টুং টাং সুরগুলো একত্র করে কেমন ফুটিয়ে তুলত একটা মায়াভরা গান।

ছোটকাকা আসলে একদম অন্যরকম ছিল। একসময়ে প্রেসিডেন্সির চোখধাঁধানো ছাত্র, সোনার মেডেলও পেয়েছিল। মা-র মুখে শুনেছিলাম, ছোট থেকেই নাকি ছোটকাকা ছিল তুখোড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী। আমাদের এই ভট্টাচার্য বাড়ি বনেদিয়ানার গুরুভারে খ্যাত হলেও বাবা বা মেজোকাকা পড়াশুনোয় তেমন নজরকাড়া ছিলেন না।

বাবাকে তো ছোটবেলাতেই পরিস্থিতির চাপে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল, ঠাকুরদা হঠাৎ মারা যাওয়াতে ব্যবসায় যে অপার শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাতে বাবা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাবা কর্মোদ্যমী পুরুষ, বছরদশেকের মধ্যে একইসঙ্গে ব্যবসা এবং পুরোহিত সংগঠন, দুটোকেই কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফেলেন।

ওদিকে মেজোকাকা, মানে টিকলির বাবা, বরাবরই নির্বিরোধী, লেখাপড়া থেকে শুরু করে উদ্যম, সবেতেই সাধারণ। তাঁকে নিয়ে কারুর আশা-নিরাশা কিছুই ছিল না, পড়াশুনোর পাট চুকলে দাদার হাত ধরে ব্যবসায় বসে পড়বেন, তা একরকম নির্ধারিতই ছিল।

মেজোভাইকে ব্যবসায় সহকারী হিসেবে নিলেও ছোটভাই তাড়াতাড়ি ব্যবসায় আসুক, তা বাবা চাননি। ততদিনে বাবা এই ভট্টাচার্য বাড়ির অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল না যে ছোটকাকা পড়া শেষ করেই ব্যবসায় ঢুকুক। বরং বাবা চেয়েছিলেন ছোটকাকা আরও পড়ুক।

কিন্তু বাবা চাইলেই তো আর সবকিছু হয় না! ছোটকাকার ঈশ্বরপ্রদত্ত মেধা থাকলেও তাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিল বেহালা। আমাদের তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে বসে যখন বেহালায় তিনি করুণ সুরের মূর্ছনা তুলতেন, সারা বাড়ি যেন স্তব্ধ হয়ে যেত, মনে হত তানসেনের মতো ছোটকাকার সুরলহরীতে এখুনি বুঝি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে।

তখন আমি ছোট হলেও সেই অনবদ্য ঝঙ্কার বেশ মনে আছে।

পেছনে চুড়ির রিনরিনে শব্দতে আমার চিন্তার তাল কেটে গেল। পেছন ফিরে দেখি, মা। আমার কিছু শার্ট গুছিয়ে রাখছেন হ্যাঙ্গারে, হালকা গলায় বললেন, ”রূপ, বুধোর মা-কে এবার পুজোয় কিন্তু একটা আলাদা করে কাপড় দিবি, বুঝলি?”

আমি মোটা ব্রাশটাকে জলে ধুতে ধুতে বললাম, ”কেন? তুমি তো দেবেই মাসিকে। তা ছাড়া পুজোয় মন্দিরে যে শাড়িগুলো প্রণামীতে আসবে, সেখান থেকেও তো তুমি প্রতিবছর …!”

”সে তো আমি দেব। তোকে বুধোর মা ছোট থেকে যে গড়েপিটে মানুষ করল, তুই প্রথমবার চাকরি পেয়ে ওকে কিছু দিবি না?” মা বললেন, ”গরিব মানুষ, তোর কাছ থেকে একটা কাপড় পেলে কত খুশি হবে বল তো?”

আমি হাসলাম। উঠে গিয়ে পেছন থেকে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম, ”তা মাদার টেরিজা, আপনি কী নেবেন পুজোতে?”

”আমি আবার কী নেব!” মা হেসে ফেললেন, ”এক গাদা শাড়ি আছে আমার, তাছাড়া পুজোয় তো আর আমাদের ঠাকুর দেখার ব্যাপার নেই যে নতুন শাড়ি ভাঙব। সেই তো ঠাকুরদালানেই দিনরাত ভোগ, জোগাড়! শুধুশুধু পয়সা নষ্ট করিস না তো! বরং টিকলি আর মেজোকাকিমাকে …।”

আমি এবার চটে গেলাম, ”তোমাকে যখনই কিছু বলি, তুমি কখনো হ্যাঁ বলতে পারো না বলো? এইজন্য তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। পুজোর জোগাড় করবে তো কী আছে, রাতে আমি তোমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাব। তুমি কি শাড়ি নেবে বলো।”

মা মুখ টিপে হাসলেন, ”কী শাড়ি তুই দিবি বল, তাই নেব।”

”কী শাড়ি!” আমি এবার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, শাড়ির সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই সামান্য। ভেবেটেবে বললাম, ”সিল্কের শাড়ি?”

”সিল্ক আবার কোনো কথা হল! কত রকমের সিল্ক আছে জানিস? পিওর সিল্ক, তসর সিল্ক, গিচা সিল্ক !” মা গড়গড় করে নামতা শুরু করতেই আমি থামিয়ে দিলাম, ”বুঝেছি বুঝেছি। আমি ওই … ইয়ে … পিওর সিল্কই দেব। তুমি কবে আমার সঙ্গে দোকানে যাবে বলো। তখনই টিকলি আর কাকিমারটাও তুমি পছন্দ করে দেবে।”

মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আর বাবা? বাবাকে নিয়ে যাবিনা?”

আমি ভ্রূ কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বাবাকে নিয়ে মার্কেটিং এ যাব? মা-র মাথা ঠিক আছে তো?

আমি আবার আঁকায় মন দিতে দিতে বললাম, ”খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই, হুহ!”

”অমন বলে না রূপ। উনি তোর বাবা, কত ভালোবাসেন তোকে, ছোট থেকে তোর কিছুর অভাব অপূর্ণ রাখেননি উনি, আর সেখানে প্রথম চাকরি পেয়ে বাবাকে কিছু দিবি না?”

”দেব না কোথায় বললাম!” আমি বিড়বিড় করলাম, ”তোমাকে টাকা দিয়ে দেব, তুমি কিনে নিয়ে আসবে। মিটে গেল।”

”আমার কতদিনের ইচ্ছে ছিল আমি তুই আর তোর বাবা একদিন একসঙ্গে সারাদিন কলকাতা ঘুরব, কেনাকাটা করব, খাওয়াদাওয়া করব, তারপর গড়ের মাঠে কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরব।” মা এসে আমার কাঁধে আলতো হাত রেখে বাইরের দিকে উদাস চোখে একটা নিশ্বাস ফেললেন, ”এজন্মে বোধ হয় আর সেটা হল না!”

”হবেও না।” আমি কেটে কেটে বললাম ”তোমার অপদার্থ সন্তানকে নিয়ে বসন্ত ভট্টাচার্য প্রকাশ্যে বেরোবেন? বাবা! পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টবাবুর সম্মান ধুলোয় লুটোপুটি খাবে তো তাহলে!”

”এভাবে বলিস না।” মা ক্ষুণ্ণ হলেন, ”তোকে উনি অপদার্থ কবে বললেন রূপ?”

”সবকিছু মুখে বলতে হয় না মা! আচার আচরণেও বোঝা যায়। ওঁর কাছে কেউ টাকা তৈরির মেশিন না হলেই, কেউ সারাদিন পুজোআচ্চা নিয়ে পড়ে না থাকলেই সে অপদার্থ, নিষ্কর্মা। যেমন আমি।”

আজ পর্যন্ত মা আর আমার নিভৃত কথোপকথনে কখনো বাবার বিরুদ্ধে মা-কে আমি কিছু বলতে শুনিনি, অথচ এই মা-ই যে বাবাকে আমার অনুপস্থিতিতে আমার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলেন, তাও আমি জানি।

মায়েরা বোধ হয় এমনই হয়!

এখনো সেটাই হল। মা বাবার পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আমার ফোন বাজল।

আমি ঝুঁকে পড়ে ফোনটা হাতে নিতে মা বললেন, ”কে?”

আমি চাপা গলায় ”হিটলার” বলে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাবার জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এল, ”মঙ্গলরূপ, আমি আজ একটা টিভি চ্যানেলে যাচ্ছি কথা বলতে। আশা করি এর ফলে জটিলতা অনেকটাই কমে যাবে। কাল তোমাকে একবার ওই দিওতিমা বলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করতে হবে। জগদীশকে ফোনটা দিচ্ছি, ও তোমায় সব বুঝিয়ে বলছে।”

আমি হাঁ হাঁ করে বলতে গেলাম, ”ক-কাল কী করে হবে, কাল তো আমার অফিসে একটা জরুরি …!”

কিন্তু ততক্ষণে রিসিভার চলে গেছে জগদীশকাকার কাছে।

জগদীশকাকা আমাদের পারিবারিক হার্ডওয়্যার ব্যবসার ডানহাত বলা চলে। হাওড়া ময়দানের ওপরে ভট্টাচার্য পরিবারের ক্লাসিক হার্ডওয়্যার এখন আর নেহাত একটা দোকান নেই, রীতিমতো ব্র্যান্ড। খুচরো পেরেক থেকে শুরু করে বিশাল বিশাল রড, সিমেন্ট, সবকিছুর এ-তল্লাটের একচেটিয়ে ডিলার আমরা। আর এই প্রকাণ্ড ব্যবসার কাণ্ডারি যেমন আমার বাবা, সারথি তেমনই এই জগদীশকাকা। আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক কাকাকে দেখছি। অব্রাহ্মণ হলেও পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের যাবতীয় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডও কাকা দেখেন।

জগদীশকাকার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, গায়ের রং একসময় বেশ পরিষ্কার থাকলেও দিনরাত লোহালক্কড়ের ধান্দায় থেকে থেকে ময়লাটে হয়ে গেছে, চোখদুটো কুতকুতে ধরনের। কথা খুব কম বলেন, শোনেন অনেক বেশি। তুখোড় ব্যবসাবুদ্ধি।

ফোনটা ধরেই জগদীশকাকা মোলায়েম গলায় বললেন, ”কে রূপ?”

আমি বেজার গলায় বললাম, ”হ্যাঁ বলুন।”

”রূপ, ওই মেয়েটাকে ভালোভাবে বোঝাতেই হবে। ঝন্টু গিয়েছিল, কোনো লাভ হয়নি।” জগদীশকাকা নরম গলায় বলতে লাগলেন, ”আসলে তোমরা এখনকার দিনের লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়ে, ওইসব জোরজার করে কিছু হয় নাকি? তুমি একটু গিয়ে ভালো করে বোঝাও। আজ বসন্তদা টিভি চ্যানেলে গিয়ে যা বলবেন, তাতেই অবশ্য ওর মনোবল অর্ধেক ভেঙে যাবে, সেই অবস্থায় গিয়ে তুমি কেসটা তুলে নেওয়ার জন্য বোঝাবে। বাচ্চা মেয়ে, রাজি হয়ে যাবে।”

রাগে আমি কিছু বলতে পারলাম না। কালই আত্মারামদা বলছিল ওই ঝন্টু নাকি জগদীশকাকারই কীরকম ভাইপো।

তা কাকা হঠাৎ তাঁর নিজের ভাইপো ছেড়ে আমার ওপর নির্ভর করতে শুরু করলেন কেন!

 ”কাল আমার অফিসে খুব জরুরি একটা কাজ আছে কাকা, আপনি প্লিজ বাবাকে একটু …!” আমি থেমে গেলাম, কারণ ওপাশে ফোন ইতিমধ্যে পিঁ পিঁ শব্দ তুলে কেটে গেছে।

আমার হতাশ মুখ দেখে মা বললেন, ”কী হয়েছে? কী বলছেন তোর বাবা?”

”কী আর বলবে! দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে সত্তর বছর হল, কিন্তু এই বসন্ত ভটচাজ কাউকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেবে না।” চেঁচিয়ে কথাটা বলে বিরক্তিতে রাগে আমি মোটা তুলিটা দিয়ে এতক্ষণ ধরে আঁকা সাধের ঘোড়াটার ওপর আড়াআড়ি কালো দাগ টেনে দিলাম।

চার

আমি ওইপ্রান্তে ‘হ্যালো’ শুনেই বললাম, ”ছবিদাদু, আজ সন্ধেবেলা তোমাকে এক জায়গায় যেতে হবে আমার সঙ্গে। ফ্রি থাকবে কিন্তু।”

ছবি দাদু বললেন, ”সে না হয় যাব। তোর মা ফোন করেছিল একটু আগে। বলল, চায়ের দোকানে তোকে নাকি কারা হুমকি দিয়েছে?”

আমি মুখ দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করে বললাম, ”ধ্যুত! মা-র সবেতেই বাড়াবাড়ি। হুমকি না ছাই, তিনটে লোফার ছেলে এসে একটু মাস্তানি দেখালেই সেটা হুমকি হয়ে গেল? লোকজন তেমনই। নিবারণকাকা আসল সময়ে কোনো প্রতিবাদ করল না, এখন মা-র কানে কথা তোলার বেলায় ঠিক আছে। ওসব ছাড়ো তো! আমি তোমাকে অন্য একটা কারণে ফোন করেছি।”

দাদু বললেন, ”বল।”

”দুর্গাপুজোর সাবেক নিয়মের যে বইটা আমায় দিয়েছিলে, তাতে দেখলাম, বালিগ্রামের নাম রয়েছে। এই বালি কি আমাদের উত্তরপাড়ার বালি নাকি?”

”তা তুই কী ভাবলি! বালিদ্বীপ না বলিভিয়া, কোনটা?” দাদু মিটিমিটি হাসলেন ও-প্রান্ত থেকে।

”না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বালি এত পুরোনো জায়গা নাকি!”

”এত কথা তো ফোনে বলা যাবে না, তুই আয়, পুরোটা বলব’খন। আজই আয় অফিসফেরত।”

”আজ হবেনা, বললাম না?” আমি মনে করিয়ে দিলাম, ”একটা টিভি চ্যানেলে যাব আজ।”

”টিভি চানেল? এই যে বললি তুই ওসব করবি না? তোকে তো বলেছি, মিডিয়ার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ওরা যখন নামিয়ে দেবে তখন তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

”এটা এমনি কোনো স্কুপ নয় দাদু, এখানে ওই পুরোহিতদের পাণ্ডাও আসছে। আমিও ভেবে দেখলাম। আমার বক্তব্যটাও জনসাধারণের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা উচিত। তাতে সমর্থনটা তো পাব।” আমি এক মুহূর্ত থামলাম, ”ওরা আমার সমর্থনে বলার জন্য আরও একজনকে চেয়েছে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে।”

”আমি?” দাদু বিড়বিড় করলেন, ”সেরেছে! আমি ভাবলাম সন্ধেবেলা একটু…।”

”সন্ধেবেলা তুমি আমার সঙ্গে যাবে, ব্যস! বালিঘাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি তোমাকে নিয়ে আসব।” উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিলাম আমি।

সত্যি, যার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্কটুকুও নেই, তার ওপর কত জোর খাটাই আমি। যে আমার কেউ হয়না, সে কেমনভাবে মনোবল জোগাচ্ছে আমায় প্রতিনিয়ত। এদিকে আমার নিজের মা কিনা ক্রমাগত বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে।

পরক্ষণেই নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম আমি। মা তো আসলে ভালোর জন্যই বারণ করছে আমাকে। সেই ফেব্রুয়ারি মাসে যখন ঠিক করেছিলাম পাড়ার বারোয়ারি ক্লাবের সরস্বতী পুজোটা আমিই করব, কই তখন তো বাধা দেয়নি! বরং উৎসাহই দিয়েছিল। আসলে মা-র কাছে এখন আমার নিরাপত্তা সবচেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সত্যিই! এখনো ভাবলে আশ্চর্য লাগে। এই বছরের সরস্বতী পুজোই যেন আমার মনের মোড় অনেকটা ঘুরিয়ে দিল। পেছন ফিরে তাকালে স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের কথা। আর মনে পড়লেই নিজের অজান্তে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আমার, মনে হয় লন্ডভন্ড করে দিই চারদিক।

আজ পর্যন্ত সেদিনের মতো অপমানিত আমি কোনোদিন হইনি।

পাড়ার কচিকাঁচাদের নিয়ে ঠিক করেছিলাম সরস্বতী পুজো করব। চাকরি পাওয়ার আগে ক-টা টিউশনি করতাম, সেইসব বাচ্চাদের নিয়েই। আমাদের বাড়ির পাশেই একফালি মাঠ। সেখানেই চাঁদোয়া খাটিয়ে বানানো হয়েছিল ছোট্ট প্যান্ডেল। সাত-আট বছরের ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন উৎসাহভরে থার্মোকোল কেটে কেটে বানিয়েছিল শোলার বাড়ি। ছোটো থেকে ছবিদাদুর কাছে শিখে মন্ত্র ছিল আমার কণ্ঠস্থ, ঠিক করেছিলাম আমিই পুজো করব বাগদেবীর।

সকাল থেকে সব আয়োজন যখন শেষ, আমি পুজো করতে বসব, ঠিক সেই মুহূর্তেই রে রে করে এসে চড়াও হয়েছিল ক-টা ছেলে। আমাদের কোনো কথা বলার সুযোগই দেয়নি, বাচ্চাগুলোকে ঠেলে ফেলে ফুল, মালা, কেটে রাখা ফল, সব ছত্রাকার করতে করতে হিসহিসে গলায় বলে চলেছিল ওরা, ”ইশ! খুব শখ না! মেয়েছেলে, পুজো করবে। আহ্লাদ কত!”

আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, ”একি, তোমরা ফুলগুলো ছিঁড়ছ কেন? আমরা তো পুজো করছি, কারুর কোনো ক্ষতি তো করিনি।”

সামনের ছেলেটা এসে উদ্ধতভাবে বলেছিল, ”কতবার বারণ করা হয়েছে কাল থেকে তোদের? অরূপদার লোক এসে বলে যায়নি এসব বাঁদরামি বন্ধ করতে? ছ্যাবলামি হচ্ছে, অ্যাঁ? ঠাকুর দেবতা নিয়ে ছ্যাবলামি?”

”আমরা তো পুজো করছি, দিদি তো কিছু করেনি …।” আমার ক্লাস টু-তে পড়া ছাত্র টুপাই কথাটা শেষ করার আগে ছেলেটা ওর ঘাড় চেপে ধরেছিল, ”এই শালা, চার আনা চার আনার মতো থাক। নইলে পিটিয়ে এক আনা করে দেব।”

কাল থেকে কানাঘুষো শুনছিলাম, স্থানীয় এম এল এ’র নাকি ঘোরতর আপত্তি আছে আমি পুজো করাতে।

কিন্তু, সেই আপত্তির শোধ যে এমনভাবে তুলবে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

তবু আমি চোখে চোখ রেখেছিলাম, ”আপনাদের অরূপদা তো দারুণ লোক! পাড়ার মোড়ে যখন স্কুলের মুখ না দেখা গুন্ডাগুলো সরস্বতী পুজোর নাম করে বাড়ি বাড়ি চাঁদা লুটে সেই টাকায় নাম কা ওয়াস্তে পুজো করে আর মদ-মাংস সাঁটায়, সেইসময় আপনাদের অরূপদা আপত্তি করেন না কেন? ওঁর নিজের লোক বলে?”

তুই তুই করা ছেলেটার মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গিয়েছিল, সে বোধ হয় ঠিক করতে পারছিল না ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে গালাগাল শুরু করবে কিনা, তার মধ্যেই পাশ থেকে আরেকটা ছেলে এগিয়ে এসেছিল।

সে ওদেরই দলের, কিন্তু একটু ভদ্রসভ্য। বলেছিল, ”দেখুন দিদি, কাল থেকে তো এম এল এ স্যার বারণ করে পাঠাচ্ছিলেন, তবু আপনি পুজো করতে যাচ্ছিলেন কেন? যা খুশি তাই করলেই হল? একটা কোনো নিয়ম নেই? আপনি কি পুরুত, অ্যাঁ? আপনি ব্রাহ্মণ? এগুলো কি ইয়ার্কি বলুন তো?”

আমি আর একটা কথাও বলিনি সেদিন। দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করেছিলাম ওদের দৌরাত্ম্য।

সেদিন ওই আট-দশটা বাচ্চার মুহূর্তে নিভে যাওয়া মুখ আর আমার ওই অপমানের কথা ভাবলেই আমার শরীরে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো হয়তো ভুলে গেছে, কিন্তু আমি ভুলিনি।

ভুলিনি এক সেকেন্ডের জন্যেও।

তারপরেই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম এর শেষ দেখে ছাড়ব। সমাজ যদি আমাকে উঠে দাঁড়াতে না দেয়, আইনের পথে উঠে দাঁড়াব আমি।

যত বাধা আসে আসুক, হাল আমি কিছুতেই ছাড়ব না।

পাঁচ

টিকলি বলল, ”দাদাভাই, তুই তো কাল ওই মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে যাবি। সাড়ে ছ-টা থেকে ‘এখন বাংলা’ চ্যানেলে ও আসবে, একটা আলোচনাসভা হবে। শুনবি?”

আমি আমার ঘরের বিছানায় শুয়েছিলাম। বাবার ফোনটার পর থেকে রবিবারের মুডটাই কেমন নষ্ট হয়ে গেছে। কাল অফিসে দিব্যেন্দুদা আর আমার একটা জরুরি মিটিং ছিল। সব কিছুর দফারফা।

তিরিক্ষি স্বরে আমি বললাম, ”ধুর! আমি শুনে কী করব। আমার ওইসব ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুই যা তো!”

টিকলি একটু নিভে গেল। তবু বলল, ”না জেঠুমণি আর ওই মেয়েটা সামনাসামনি কথা বলবে তো, তাই বলছিলাম। আজ পুরোটা শুনে একটা আইডিয়া হলে তোর সুবিধা হবে।”

আমি এবার মনে মনে অবাক হলাম। বাবা এখন ওই মেয়েটার সঙ্গেই টিভি শো-তে কথা বলতে গিয়েছেন? তবু কাল আমাকে আবার যেতে হবে কেন? বসন্ত ভট্টাচার্যের হালহকিকত কিচ্ছু বোঝা যায় না। সবসময় কেমন একটা কূটনৈতিক চিন্তাভাবনা।

এই ধরনের কৌশলী কর্মকাণ্ডগুলো পুরোপুরি বাবার হতেই পারে না, নির্ঘাত জগদীশকাকা এই চালগুলো চালছেন। সেইজন্যই কাকা বললেন, ”আজ মেয়েটার অর্ধেক মনোবল ভেঙে যাবে।”

মানে বাবা আজ মেয়েটাকে প্রকাশ্যে ল্যাজেগোবরে করবেন।

আমি বললাম, ”তুই শিওর? বাবা আর ওই মেয়েটা একটাই শো-তে আসছে? না আলাদা আলাদা চ্যানেলে?”

”নারে।” টিকলি বলল, ”আমি দেখেছি। দুজনেই যাচ্ছে ‘এখন বাংলা’ চ্যানেলের ‘এই মুহূর্তে’ টক শো-তে।” ও ঝুঁকে পড়ে আমার ঘরের দেওয়ালঘড়িটা দেখল, ”সাড়ে ছ-টা বাজছে প্রায়। তুই কি যাবি? নাহলে আমি চললাম নীচে।” কথাটা বলে টিকলি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল।

আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে শুয়ে রইলাম।

যতই মুখে রাগ দেখাই, কাল আমাকে কথা বলতে যেতেই হবে। তার চেয়ে এখন টক শো-টা শুনলে হয়তো কাল প্রশ্ন করতে বা বুঝতে সুবিধা হবে। এই ক-দিন খবরের কাগজে বিষয়টা নিয়ে প্রচুর চর্চা হলেও আমি হেডলাইন ছাড়া খুব একটা কিছু পড়িনি।

আগ্রহই হয়নি।

একটু পরে নীচের বৈঠকখানায় যখন গিয়ে ঢুকলাম, তখন অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেছে।

টিকলি, মা, মেজোকাকিমা, তিনজনেরই উৎসুক চোখ টিভির পর্দায়।

সঞ্চালক হাসি হাসি মুখে বসে আছেন, পাশেই বসে আছেন আমার বাবা, ডানদিকে আরও দুজন ভারিক্কি ব্যক্তি।

সঞ্চালকের অন্যপাশে রয়েছে খবরের কাগজে ছবি দেখা সেই মেয়েটা। আমি দেখেই চিনতে পারলাম।

সাধারণ একটা কুর্তি পরে বসে আছে। চাপা রঙ, চুলটা পেছনে চুড়ো করে বাঁধা। মুখে তিলমাত্র প্রসাধন নেই, শুধু চোখের তলায় সামান্য কাজল।

তবে, চোখদুটোয় জ্বলজ্বল করছে দৃঢ় প্রত্যয়, মুখের পেশিগুলো দেখলেই বোঝা যায় এ’মেয়ে সহজে মাথা নোয়াবার নয়।

সঞ্চালক ততক্ষণে বলতে শুরু করেছেন, ”নমস্কার। আপনারা দেখছেন ‘এখন বাংলা এই মুহূর্তে’। আজ আপনাদের সামনে আমরা নিয়ে এসেছি এখনকার জ্বলন্ত একটি বিষয়কে। যে খবর আপনারা গত কয়েকদিন ধরে কাগজে, টিভিতে, রেডিওতে, সব জায়গায় পড়ছেন, শুনছেন, দেখছেন। আর যে মানুষটি একা ব্যতিক্রমীভাবে স্রোতের বিপরীতে হেঁটে ঝড় তুলেছেন বাংলা সমাজব্যবস্থায়, প্রত্যেকের মনেই তুলে দিয়েছেন যুক্তিসম্মত প্রশ্ন, আনতে চাইছেন ভীষণরকম একটা বদল, সেই মানুষটি আজ আমাদের সঙ্গে।”

সঞ্চালক হাসিহাসি মুখে মেয়েটার দিকে তাকালেন, ”দিওতিমা বিশ্বাস। থাকেন উত্তরপাড়ায়, চাকরি করেন রাজ্য সরকারি দপ্তরে। দিওতিমা, আপনাকে অনেক অভিনন্দন আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য।”

মেয়েটা স্মিত মুখে হাতজোড় করে নমস্কার করল।

টিকলি ফিসফিস করল, ”মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন খেলোয়াড় খেলোয়াড় মনে হচ্ছে দ্যাখো। কোনো লাবণ্য নেই। এ হঠাৎ পুজো করতে চাইছে কেন?”

মেজোকাকিমা সোয়েটার বুনছিলেন উলকাঁটাতে, বুনতে বুনতেই বললেন, ”হ্যাঁ, একটা দাপট আছে মুখের মধ্যে।”

আমি লক্ষ্য করলাম, হাসলেও মেয়েটার মুখভঙ্গি একটুও কোমল হল না।

”এ ছাড়া আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন তিনজন মান্যগণ্য ব্যক্তি।” সঞ্চালক এবার বাবার দিকে ফিরলেন, ”আছেন শ্রী বসন্ত ভট্টাচার্য, যাকে আপনারা অনেকেই হাওড়ার শাস্ত্রীমশাই নামে চেনেন। বসন্ত ভট্টাচার্য অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।”

আমি আড়চোখে দেখলাম, মা-র মুখটা কেমন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। স্বামীকে পর্দায় দেখার রোমাঞ্চ মা-র অভিব্যক্তিতে ঠিকরে বেরোচ্ছে।

বাবা স্বভাবসুলভ গম্ভীরভাবে মৃদু মাথা দোলালেন।

”রয়েছেন সংস্কৃত কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট পুরোহিত শ্রী বিরুপাক্ষ কৃত্যতীর্থ মহাশয়।” সঞ্চালক একে একে প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয় করালেন, ”আপনাদের সবাইকে আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমরা অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

”আহা, ওইটুকু মেয়ে তর্কে পারবে এত বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে?” মা অস্ফুটে বলে উঠলেন, ”এ আবার কি অসম আলোচনা রে বাবা!”

”প্রথমেই আমরা চলে যাব দিওতিমা-র কাছে। দিওতিমা সম্প্রতি আপনি কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন এই মর্মে, যে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদেরও পুজো, বিয়ে এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে দেওয়া হোক। আপনি এও দাবি করেছেন যে, পৌরোহিত্য করার জন্য চালু করা হোক এক যোগ্যতা-নির্ণায়ক পরীক্ষা, যাতে উত্তীর্ণ হলেই তবেই দেওয়া হোক পৌরোহিত্যের ছাড়পত্র। তাই তো?”

”হ্যাঁ।” দিওতিমা সংক্ষেপে মাথা নাড়ল।

”কিন্তু, আপনার কি মনে হয় না যে হিন্দুধর্মে পুজোর মতো এক স্পর্শকাতর বিষয়ে আমরা বংশকৌলীন্যে সুলক্ষণযুক্ত মানুষদেরই পুরোহিত হিসেবে গ্রহণ করে থাকি? মহিলারা পুরোহিত হলে কি একটু হলেও সেই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে ঘা লাগবে না?” সঞ্চালক গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন।

”প্রচলিত কথাটাই তো আপেক্ষিক।” শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শুরু করল দিওতিমা, ”মানুষই কোনো অভ্যাসের প্রচলন করে, মানুষই সেটার পরিবর্তন করে। আমাদের সমাজ প্রথম থেকেই ছিল পুরুষতান্ত্রিক। এই যে ধর্ম, শাস্ত্র, সামাজিক প্রোটোকল সবকিছুই তৈরি করেছে কোনো না কোনো পুরুষ। পুরুষই বেঁধে দিয়েছে নারীর কী করা উচিত, কী করা অনুচিত। আগেকার দিনে নারী ঘরের বাইরে বেরোত না, কূপমণ্ডূক জীবনযাপন করত। সেইযুগের পরিপ্রেক্ষিতে নারীকে পুরুষনির্ভর জীবন কাটাতে শেখানো হল। একটা মেয়ে জন্মানোর পরেই তার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত, তুমি মেয়ে, তোমার একমাত্র কাজ হল শ্বশুরবাড়ি গিয়ে স্বামী ও তার পরিবারের সেবা করা, তাঁদের বংশধরকে গর্ভে ধারণ করা। তোমার নিজের কোনো পরিচয় নেই, তোমার নিজের কোনো শক্ত খুঁটি নেই, তুমি আজীবন কখনো পিতা, কখনো স্বামী, কখনো পুত্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। তুমি মেয়ে বলে পড়াশুনো শিখবে না, তুমি মেয়ে বলে যেখানে সেখানে যেতে পারবে না, তুমি মেয়ে বলে তোমাকে ঘোমটা বা পর্দার আড়ালে থাকতে হবে।” দিওতিমা একটানা বলে ঈষৎ থামল, ”এটা হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্টান বলে নয়। সব ধর্মে, সব দেশেই নারীরাই লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত হয়েছে। যে-কোনো যুদ্ধ, বিদ্রোহ, প্রতিহিংসার বলি তাদেরকেই হতে হয়েছে। যুগ এখন পালটেছে। এখন মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে বাইরের জগতে বেরোচ্ছে, পড়াশুনো শিখছে, চাকরি করছে, সব ক্ষেত্রেই তাঁরা সমান পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। তাহলে, পুজোতেই বা তারা অধিকার পাবে না কেন? বেদে যে গৃহ্যসূত্র রয়েছে, তাতে কোথাও বলা নেই যে বিবাহদান বা পৌরোহিত্য একমাত্র পুরুষের অধিকার।”

দিওতিমার পাশে বসে থাকা অধ্যাপক ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবার মুখ খুললেন, ”বলার প্রশ্নও নেই। কারণ, বেদে লোপামুদ্রা, অপালা, পৌলমী-র মতো অনেক মহিলা-ঋষি ছিলেন। তাঁরা মন্ত্রদর্শনও করতেন। হাজার বছর আগে যদি তাঁরা মহিলা হয়ে পুজো করতে পারেন, মানুষ তাঁদের মেনে নিতে পারে, এখন পারবে না কেন?”

ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ভদ্রলোক বেশ সৌম্যদর্শন, দেখলেই একটা শ্রদ্ধা জেগে ওঠে।

আমি মায়েদের দিকে সমর্থনের ভঙ্গিতে তাকালাম, ”ঠিকই তো বলছেন ইনি। গার্গী, মৈত্রেয়ী এঁরা সবাই তো বেদের সময় ঋষি ছিলেন!”

টিকলি কোনো কথা না বলে ইশারায় চুপ করে শুনতে বলল।

মেজোকাকিমা মাথা নাড়লেন, ”মেয়েটা ভালো বলে কিন্তু!”

সঞ্চালক এবার বাবার দিকে ফিরলেন, ”মাননীয় শাস্ত্রীমশাই, আমরা সকলেই জানি, অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আপনি প্রথম থেকে বাধা দিয়ে আসছেন। এর আগেও আপনি ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন, মহিলারা পুরোহিত হলে আপনারা বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবেন। আমি আপনাকে এখন আপনার বক্তব্য জানাতে অনুরোধ করছি।”

বাবা গম্ভীরমুখে বললেন, ”মেয়েরা যে পৌরোহিত্য করতে পারেন, এমন বিধান কোন শাস্ত্রে দেওয়া আছে? উপনয়নের মাধ্যমে হিন্দু বালকদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে দীক্ষিত করা হয়। তাদের ব্রহ্মোপদেশ শিক্ষা দেওয়া হয়। মনুস্মৃতিতে স্পষ্ট বলা আছে, উপনয়নের পরেই তারা ব্রহ্মচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। মেয়েদের কি উপনয়ন হয়? মেয়েরা কি উপবীত, মানে পৈতে ধারণ করতে পারেন? যাদের উপবীতই নেই, তাঁরা প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করবেন কি করে? বলপূর্বক সবকিছু করলেই তো হল না, সব কিছুর একটা নিয়মরীতি আছে।”

দিওতিমা এবার বলল, ”উপনয়নের সময় শরীরে যজ্ঞোপবীত ধারণ করা হয়। সেটাকেই আমরা পৈতে বলি। এই পৈতে আসলে হল তিনটে পবিত্র সুতো যা দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক। যেখানে তিনজন দেবীর আরাধনা করা হচ্ছে, সেখানে কি করে কোনো নারী উপনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন?”

”এটা কোনো কথা হল?” বাবা এবার বেশ গর্জে উঠলেন, ”নারীদের কোনো নিজস্ব গোত্র আছে? বিবাহের আগে পরে তাঁদের গোত্র পরিবর্তন হয়। নারীদের আবার পৈতে কি?”

ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, দিওতিমা স্মিত হেসে তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, ”মাননীয় শাস্ত্রীমশাই, আপনার এই আলোচনায় আসার আগে আরেকটু পড়াশুনো করে আসা উচিত ছিল।”

আকস্মিক এই কথাটা শুনে বাবার মুখটা মুহূর্তে রক্তাভ হয়ে গেল।

টিকলি বলল, ”দেখেছ জেঠিমা, মেয়েটা কীরকম বদমেজাজি! এতবড় একটা মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেনা!”

মা কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন টিভির দিকে।

দিওতিমা ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, ”আর্যযুগে নারী পুরুষ প্রত্যেকেই উপবীত ধারণ করতেন। উপনয়নে তখন দুজনের সমান অধিকার ছিল। মহাকবি পাণিনি পর্যন্ত মহিলা অধ্যাপক আচার্যনির দীক্ষা এবং উপনয়নের কথা লিখে গিয়েছেন। কেন আপনি স্মৃতিচন্দ্রিকা পড়েননি?”

বাবা-র স্তম্ভিত মুখ উপেক্ষা করে দিওতিমা একটা সংস্কৃত স্তোত্র আবৃত্তি করতে আরম্ভ করল,

”পুরাকল্পে তু নারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনমিষতে।

অধ্যাপনঞ্চ বেদনাং সাবিত্রীবচনং তথা।।

এর অর্থ পুরাকল্পে নারীদের শুধু উপবীত ধারণই নয়, বেদ অধ্যাপনা, সাবিত্রী পাঠ সবকিছুরই প্রচলন ছিল। ভণ্ড পৌরাণিক পুরোহিতরা পুরুষতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে এরপর নারীদের শাস্ত্রপাঠ বন্ধ করে দেয়, তারপর ধীরে ধীরে সতীদাহ, বাল্যবিবাহের মতো জঘন্য সব প্রথা চালু হতে থাকে কালের অপভ্রংশে। নাহলে, আমাদের হিন্দু ধর্মের মতো ক-টা ধর্মে এতজন নারী ঋষি ছিলেন? আর আপনি প্রণব মন্ত্র উচ্চারণের কথা বলছেন? কক্ষিবান ঋষির কন্যা ঘোষা ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩৯ থেকে ৮১ নম্বর সুক্তের দ্রষ্টা ছিলেন, ঋষিকা বাক ছিলেন বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা, আর আপনি বলছেন মহিলারা মন্ত্রোচ্চারণই করতে পারবেন না! যুগ কি এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে?”

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে টিভির এ-পাশ থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, বাবা এতটাই অপমানিত হয়েছেন যেকোনো কথা বলতে পারছেন না। অহমিকার কঠোর আবরণ ভেদ করে বাবা-র কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারছিলাম বেশ।

সঞ্চালক এবার বললেন, ”ধন্যবাদ আপনাকে দিওতিমা, এত সুন্দরভাবে বিষয়টি আমাদের বোঝানোর জন্য। আমি এবার যাব বিশিষ্ট পুরোহিত শ্রী বিরুপাক্ষ কৃত্যতীর্থ মহাশয়ের কাছে। কৃত্যতীর্থ মশাই, আপনি কী মনে করেন এই ব্যাপারে? কোনো মহিলা পৌরোহিত্য করলে আপনি কি মেনে নেবেন?”

বিরুপাক্ষ কৃত্যতীর্থ ধীরে ধীরে বললেন, ”দেখুন, আমি বড় হয়েছি রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন মেয়েদের বেদ পাঠের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পর থেকেই তাঁরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকেন। মেয়েদের দূরে সরিয়ে রাখা ছিল তাঁর ঘোরতর অপছন্দ। তাই আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা সারদা মঠে পুজো করেন ওখানকার সন্ন্যাসিনীরাই। এমনকী, শ্রী শ্রী মা-ও একসময় পুজো করেছেন। কাজেই, বারোয়ারি পুজোয় মেয়েরা পৌরোহিত্য করতেই পারেন। ট্র্যাডিশন তো কখনো নিয়ম হতে পারেনা।”

”তার মানে আপনি বলতে চাইছেন পিতৃদত্ত অধিকারে যারা পৌরোহিত্য করেন, সেই কুলীন ব্রাহ্মণরা যোগ্য নন?” আমার বাবা তীক্ষ্নগলায় বললেন।

”দেখুন শাস্ত্রীমশাই, আপনি প্রবীণ মানুষ। আপনার সঙ্গে তর্ক করার ধৃষ্টতা আমার নেই।” নম্রভাবে বললেন বিরুপাক্ষ কৃত্যতীর্থ, ”সব ব্রাহ্মণই যে পুজো করার জন্য অযোগ্য, সে-কথা বলার মতো অর্বাচীন আমি নই। কিন্তু, আপনি বলুন তো, প্রত্যেকেই কি যোগ্য? আমরা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করি, মন্ত্র যদি নির্ভুলভাবে উচ্চারণ করা যায় তবেই তা ভগবানের কাছে পৌঁছয়। আজকাল তো দেখি এমন অনেকে পুজো করছেন যাঁরা ভালো করে মন্ত্রই উচ্চারণ করতে পারেন না, তাঁদের উচ্চারণ শুনে সাধারণ মানুষও ভুলপথেই পুষ্পাঞ্জলি দিচ্ছেন। এঁরা কি সত্যিই যোগ্য?”

”তার মানে আপনি বলছেন, পুরুষ, মহিলা, বৈশ্য, শূদ্র, লিঙ্গ এবং জাতিনির্বিশেষে যে কেউ পৌরোহিত্য করতে পারেন? দিওতিমা বিশ্বাসের জনস্বার্থ মামলার দ্বিতীয় দাবি তো ওটাই, যাকে খুশি তাকে পুজো করতে দিতে হবে। এটা কি আদৌ কোনো কথা হল! পুরোহিত পদটার কোনো সম্মান থাকবে না?” বাবা বললেন।

”সম্মান কি শুধুই পৈতৃক অধিকারে পেতে হয়?” দিওতিমা এবার বলে উঠল, ”নিজের কর্ম, নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে পাওয়া যায় না? একজন ব্রাহ্মণপুত্র চরিত্রহীন, লম্পট হয়েও সে পুজো করবে? আর একজন শূদ্রসন্তান সৎ, পণ্ডিত এবং সমস্ত ব্যুৎপত্তি অর্জন করেও পিছিয়ে থাকবে? এটা কেমন নীতি? আর তাছাড়া প্রাচীন বৈদিক যুগে জাত নির্ধারিত হত তাঁর নিজের কর্মের মাধ্যমে। কোনো মানুষ অধ্যাপনা করলে ব্রাহ্মণ, তাঁর ছেলে ব্যবসা করলে বৈশ্য হতেন। তারপর থেকে আস্তে আস্তে পৈতৃক অধিকারে জাত নির্ধারণ শুরু হয়েছিল। পুরোহিত তো ঈশ্বর আর সাধারণ মানুষের মাধ্যম। সাধারণ মানুষের আকুতি, বার্তা, অর্চনা তিনি পৌঁছে দেন ঈশ্বরের কাছে মাধ্যম হিসেবে। সেই মাধ্যম যদি খারাপ হয়, অযোগ্য হয়, মানুষ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবে কী করে?”

আমি শুনতে শুনতে চমকে উঠলাম। দিওতিমা-র কথাগুলো হুবহু আমাকে ছোটকাকার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ছোটকাকাও ঠিক এটাই বলতো, ”পদবিতে নয়, কর্মে ব্রাহ্মণ হতে চেষ্টা কর রূপ!”

সঞ্চালক বললেন, ”অর্থাৎ আপনার মামলার দ্বিতীয় দাবি অনুযায়ী আপনি চাইছেন সরকার একটা পরীক্ষা চালু করুক, যাতে যে কেউ বসে উত্তীর্ণ হলেই পুরোহিত হতে পারেন, তাই তো?”

”ঠিক তাই।” দিওতিমা সায় দিল, ”আমার লড়াইটা শুধু নারীর অধিকার নিয়ে নয়, লিঙ্গ, জাতি নির্বিশেষে যোগ্যতার অধিকার নিয়ে। শ্রমবিভাজন যোগ্যতার নিরিখেই হওয়া উচিত। তাই আমি আপিল করেছি, যেকোনো পুজোয় পৌরোহিত্য করার জন্য পরীক্ষা নেওয়া হোক, তাতে পাশ করলে তবে পুজো করার লাইসেন্স দেওয়া হোক। তাতে আমরা মেয়েরাও নিজেদের প্রমাণ করতে পারব, আর এতে ব্রাহ্মণদেরও এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাঁরাও নিশ্চয়ই নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন।”

দিওতিমার শেষ বাক্যে ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে আমার আত্মারামের মুখটা মনে পড়ে গেল।

সত্যি, আত্মারামকে যদি এখন পুরোহিত হওয়ার পরীক্ষায় বসতে হয়?

অন্য কিছু তো ছেড়েই দিলাম, ব্যাটা ‘পুরোহিত’ বানান ঠিকঠাক লিখতে পারবে আদৌ?

ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ”আজ থেকে কয়েক দশক আগে বিদুষী অধ্যাপিকা গৌরী ধর্মপাল কলকাতার এক বিবাহবাসরে পৌরোহিত্য করে বিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে তখন অনেক বিতর্কও হয়েছিল। তখনই উনি আমাকে বলেছিলেন, উচ্চগ্রামে সঠিক স্বরে উচ্চারিত হলে তবেই মন্ত্র ফলপ্রসূ হয়। পুরোহিতকে যে পুরুষ হতেই হবে, এমন কথা বেদ-এর কোথাও বলা নেই। সেই সঙ্গে একথাও বলা নেই যে, পুরোহিতকে ব্রাহ্মণ হতে হবে, ভারতীয় হতে হবে। পৌরোহিত্য করতে গেলে যেটা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, সেটা মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ এবং অর্থ বুঝে মন্ত্রোচ্চারণ।” বৃদ্ধ অধ্যাপক সামান্য থেমে বললেন, ”জানিনা দিওতিমা-র এই আপিলে সরকার কী পদক্ষেপ নেবেন, তবু আমরা যদি যোগ্য ব্যক্তির কদর করতে শুরু করি, তাতে ক্ষতি কী!”

কতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসেছিলাম জানিনা, হঠাৎ টিকলি গায়ে ঠ্যালা দিল, ”এই দাদাভাই, ‘এই মুহূর্তে’ তো কখন শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন সিরিয়াল দেখবো। তুইও কি দেখবি নাকি!”

আমি চমকে উঠে দেখলাম, চ্যানেল কখন পালটে গেছে, এখন একটা মেগা সিরিয়াল শুরু হচ্ছে।

আমি ঘাড় নেড়ে বৈঠকখানা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। মাথাটা এখনো কেমন ভোঁ ভোঁ করছে।

আমার জগদীশকাকার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল। ”বসন্তদা তো মেয়েটাকে ল্যাজেগোবরে করে দেবেন!”

এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে বাবার মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তি আজ মেয়েটার সামনে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন। আর সেখানে আমি যাব মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে!

আমার অবস্থা বুঝেই কিনা জানিনা, কাছাকাছি কোথায় একটা ছাগল যেন করুণসুরে ডেকে উঠল।

ছয়

সকালবেলা উঠে তৈরি হচ্ছি, মা মুখ ভার করে এসে বলল, ”দ্যাখ, আজকেও কাগজে তোকে নিয়ে খবর হয়েছে।”

সে তো হবেই। কাল তো ওই পুরোহিতদের পান্ডার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছি।” আমি বললাম।

কালকের পর মেজাজটা অনেকটা ফুরফুরে লাগছে আমার। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি, ওই অ্যাসোসিয়েশন ছাড়া বেশিরভাগ লোকই আমাকে আস্তে আস্তে সমর্থন করতে শুরু করেছেন, যুক্তি দিয়ে মানতে চেষ্টা করছেন পরিবর্তনটা।

এটাই তো চেয়েছিলাম আমি!

মা টানটান করে কাগজটা মেলে ধরল, ”ছবিও বেরিয়েছে।”

আমি স্নান করে বেরিয়ে সবে গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ছিলাম। আজ বুধবার, শ্যাম্পু করেছি। আগে যখন টিউশনি করতাম সারাদিনই বাড়িতে থাকতাম, ফলে এইসব দিনক্ষণ দেখে শ্যাম্পু করার ঝক্কি ছিল না, যেদিন মনে হত, করে নিতাম। বাড়িতে থাকার ফলে চুল নোংরাও হত না তেমন, ওই সপ্তাহে একদিনই যথেষ্ট ছিল। তার ওপর বাড়ির জল বেশি খরচ করা মানে পাম্পের বিলও হু হু করে ওঠা। আমাদের একটা সুবিধে, গলির মুখেই কর্পোরেশনের জলের লাইন, সেখান থেকে একবার দু-বালতি ধরে আনলেই হত। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর এখন আর তা হওয়ার জো নেই। রোজ রাস্তাঘাটে চুল এত নোংরা হয়, সপ্তাহে অন্তত দুদিন শ্যাম্পু করতেই হয়। তাও আমার চুল ছোট বলে রক্ষা।

এমনিতে আমি বেজায় অলস মানুষ, বাবা দুম করে মারা যাওয়ার জন্য অনেক ছোট থেকে টিউশনি, দোকান-হাট করতে হয় বলে লোকে ভাবে বুঝি আমি খুব পরিশ্রমী। আসলে মোটেই তা নয়। পেটের দায়ে খাটতে হয় ঠিকই, কিন্তু যেটুকু কুঁড়েমি করা সম্ভব আমি ঠিক করে নিই।

আমি গামছাটাকে ভালো করে দু-হাত ঝাপটে ঝাড়লাম। এইভাবে ঝাড়ার একটা সুবিধা আছে। গামছার মধ্যে লেগে থাকা সামান্য জলবিন্দুগুলোও নষ্ট হয়না, সেগুলো শীতের কুয়াশার মতো গিয়ে পড়ে আমাদের একচিলতে বারান্দার টবগুলোয়।

টবের তুলসী, লংকাগাছের পাতাগুলো মুহূর্তে এই মৃদু ধারাস্নানে কেমন কেঁপে উঠল।

আমি লঘুচালে বললাম, ”ভালোই তো। তুমি তো সেলিব্রিটি হয়ে গেছ মা। তোমার মেয়ের রোজ কাগজে ছবি বেরোয়।”

”ইয়ার্কি মারিস না।” মা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”একটা ভালো কাজ করে নাম কুড়নো আর একটা বাজে কাজ করে সবার আলোচনার পাত্র হওয়ার মধ্যে যে পার্থক্যটা আছে সেটা নিশ্চয়ই বুঝিস। বারবার ছবি বেরোলে পরে কোনো ভালো পাত্র পাব? তোর এই কাজের জন্য সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে।”

”ঢি ঢি?” আমি অবাক চোখে তাকালাম এবার, ”ঢি ঢি পড়ার মতো কী কাজ আমি করলাম সেটাই তো বুঝছি না! কালকের শো-টা দেখেছ তুমি?”

”না দেখিনি। দেখার ইচ্ছেও নেই। কী ঢি ঢি পড়ছে, সেটা বুঝলে কি আর তুই এগুলো করতিস? মায়ের বারণ শুনতিস। অর্ধেক লোক তো কিছু বোঝেনা, তাদের অন্যরা যা বোঝাচ্ছে তাই বুঝছে। মিউনিসিপ্যালিটিতেও নাকি খবরটা গিয়ে পৌঁছেছে। লোকে কি ভাবছে বল তো? একেই সেই সরস্বতী পুজোর পর থেকে সবাই কেমনভাবে দেখে আমাদের।” মা গজগজ করল।

”কী আশ্চর্য, লোকে কী ভাবছে সেটাও যদি আমরাই ভাবি তাহলে লোকে কি ভাববে মা?”

”এত কিছুর পর খেটেখুটে একটা চাকরি পেলি, সেটাও যদি চলে যায় আমাদের কী গতি হবে ভেবেছিস একবারও? আমাদের তো কোনো মামা কাকা দাদা নেই যে কিছু হলে তোকে বাঁচাবে।” মা অধৈর্য হয়ে উঠল, ”বেশ তো ভালো ছিলি, হঠাৎ তোর মাথায় কে এই পোকা ঢোকাল? নিশ্চয়ই ওই ছবিজ্যাঠা, তাই না?”

এবার আমার বিরক্ত লাগল, ”সবসময় অন্যকে দোষারোপ কোরোনা তো মা! দাদুকে দোষ দিচ্ছ কেন? দাদুর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। ভুলে যেও না দাদু আমার পড়াশুনোয় কত হেল্প করেছে। আমি যা করছি আমার নিজের ইচ্ছেতেই করছি। আর চাকরিটাও আমি দাদুর পড়ানোর জন্যই পেয়েছি।”

”তা এখন এইসব করার দরকারটা কি তোর? কে পুজো করছে, কে পুজো করছে না তা নিয়ে আমরা কী করব! তোর বাবা চলে যাওয়ার পর যখন আমাদের না খেতে পাওয়ার দশা হয়েছিল, তখন কি কেউ দেখতে এসেছিল?” মা তিনশো তিয়াত্তর নম্বর বার সেই একই কথাগুলো বলতে শুরু করল।

”দ্যাখো মা, সমাজের বিপরীতে গিয়ে কিছু করতে গেলেই বেশিরভাগ মানুষ তোমার বিরুদ্ধে চলে যাবে, কারণ কনভেনশন ভাঙার সাহস বা ক্ষমতা সবার থাকে না। এইজন্যই রামমোহন, বিদ্যাসাগর কিংবা মার্টিন লুথার, সবাইকেই সমাজের বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। আমাকেও হচ্ছে।”

”তুই কি নিজেকে বিদ্যাসাগর রামমোহন ভাবছিস নাকি?” মা খিঁচিয়ে উঠল, ”সমাজ পালটানো অত সহজ নয়। তার জন্য টাকার জোর লাগে, ক্ষমতাও লাগে। আমাদের কোনটা আছে?”

বিরক্তির শিখরে পৌঁছে আমি আর তর্ক না করে চুপ করে গেলাম।

সত্যি, আজ যখন চুপ করে বসে ভাবি কিংবা অফিস যাওয়া আসার পথে বাসে ট্রেনে একা বসে থাকি, ভাবি এগুলোর কি আদৌ কোনো দরকার ছিল? অভাবের সংসারে খেটেখুটে একটা ছোটখাট সরকারি চাকরি পেলাম, এবার তো দিব্যি পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে কাটিয়ে দিতে পারতাম। টুকটাক সেভিংস, বছর কয়েকের মধ্যে মোটামুটি বাড়িটাকে মেরামত করে বিয়ে। তারপর নিজস্ব সংসার।

আর পাঁচজনের মতো।

পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাই, তাতে আমি থিতু হতাম ঠিকই, কিন্তু আমার ইচ্ছেটা মিটত না। পুজো করার ইচ্ছে আমার আজ থেকে নয়, প্রায় জ্ঞান হওয়া ইস্তক। আমরা থাকি হুগলির উত্তরপাড়ার কাছের মফসসল মাখলায়। মূল উত্তরপাড়ার সঙ্গে তফাত শুধু একটা স্টেশন চত্বরের হলেও আমাদের দিকটা অনেকাংশেই অনুন্নত। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, সংস্কৃতি সবেতেই উত্তরপাড়ার থেকে পিছিয়ে। তাই একটু বড় হতেই স্কুল, কোচিং সবকিছুর জন্যই রেললাইন পেরিয়ে আমাকে যেতে হত উত্তরপাড়ায়।

আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। বাড়ির পাশেই বাবার ছোট একটা স্টেশনারি দোকান ছিল, বিশাল স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও আমাদের তিনটি প্রাণীর ভালোই চলে যেত। ছোটবেলায় স্কুলে দিয়ে আসত বাবা, আবার দুপুরবেলা ছুটির সময় নিয়েও আসত।

ছুটির সময়ের সেই কাঠি আইসক্রিম, দু-টাকার আমচুর, আলুকাবলির মধ্যে বাবা এখনো আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে।

বাবা মারা যেতে ছোটখাট একটা বজ্রপাত হয়েছিল বাড়িতে। বড়বাজার থেকে দোকানের জন্য মাল আনতে গিয়ে বাসের তলায় পড়ে গিয়েছিল বাবা, বাসের ভারী ভারী চাকাগুলো মুহূর্তে পিষে দিয়েছিল বাবার শরীর।

সঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আমার শৈশবও।

বাবা-মা’র দুদিকের আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী প্রথম কিছুদিন সমবেদনায় পাশে থাকলেও সময়ের নিয়মে আস্তে আস্তে তারা ফিরে গিয়েছিল নিজেদের জীবনে।

মা ছিল খন্যানের গ্রামের মেয়ে, পুরোদস্তুর গৃহবধূ। কিন্তু পেট বড়ো বালাই। সেই মা-কেও এত বড় বিপদে পড়ে বেরতে হল রোজগারের আশায়।

দোকানটা ভাড়া দিয়ে প্রথম কয়েক বছর এদিক সেদিক অসীম পরিশ্রম করেছিল মা। লোকাল অফিসগুলোতে রান্না করা থেকে শুরু করে অসুস্থ লোকের বাড়িতে আয়ার কাজ করা, কি না করেনি! অবশেষে দু-তিন বছর পর পার্টির লোকেদের বদান্যতায় কাছের এক নার্সিং হোমে আয়ার কাজ পেয়ে অবস্থা কিছুটা চলনসই হয়েছিল।

ছোট থেকেই রেললাইনের ওপারে গঙ্গার ধারের ছবিদাদুর বাড়িতে আমি সুযোগ পেলেই চলে যেতাম। আমাদের সঙ্গে ওঁদের বাড়ির পরিচয়টা খুবই সামান্য অজুহাতে, যতদূর মনে পড়ে কোনো এক অনুষ্ঠানবাড়িতে গিয়ে।

ছবিদাদু উত্তরপাড়ার বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, উত্তর কলকাতার একটা কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, ওঁর স্ত্রী প্রণতিদিদিমাও শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মহিলা।

দুই পরিবারের অবস্থাতে আকাশ পাতাল তফাত হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে যেন আমি নিঃসন্তান ওই দম্পতির খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলাম। স্কুলশেষে চলে যেতাম দাদুর বাড়ি, দিদিমা যত্ন করে বসিয়ে খাওয়াতেন আমায়। তারপর দাদুর কাছে পড়াশুনো করতাম। পাঠ্য বই যত না বেশি পড়তাম, তার চেয়ে বেশি শুনতাম দেশবিদেশের জানা অজানা গল্প।

ওদিকে মা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করত। নার্সিং হোমে কোনোদিন ডে শিফট, কোনোদিন নাইট শিফট থাকত। ডিউটি সেরে ক্লান্ত অবস্থায় আমাকে দাদুর বাড়ি থেকে নিয়ে আসত বাড়িতে।

এভাবেই আমার বড় হয়ে ওঠা।

মাঝে মাঝে যখন পেছন ফিরে তাকাই, অবাক বিস্ময়ে ভাবি, আমাদের এই এঁদো গলির ভেতরে জন্মে ছবিদাদুর বাড়িতে আমার অত সুন্দর একটা কৈশোর পাওয়াটা যেন একটা রূপকথা। আজ দাদুদের সান্নিধ্যে না গেলে আমিও হয়তো এই কলোনির মানুষগুলোর মতোই যা চলছে চলুক এই ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত হয়ে পড়তাম।

ব্যতিক্রমী হিসেবে কিছু ভাবার চিন্তাটাই লুপ্ত হয়ে যেত আমার!

ছবিদাদু ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক। বৈদিক শাস্ত্রে তাঁর এমন অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল, ওঁদের পারিবারিক দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে সত্যনারায়ণ সবেতেই উনি পৌরোহিত্য করতেন। আর আমি ওইটুকু বয়স থেকে দাদুর একপাশে বসে অবাক বিস্ময়ে আর মুগ্ধতায় লক্ষ করতাম দাদুর জলদমন্দ্র স্বরের নির্ভুল মন্ত্রোচ্চারণ।

মনে হত দাদু তখন যেন কোন হিমালয় থেকে আসা ঋষি হয়ে গেছেন।

এভাবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুজো, মন্ত্র, বেদ এগুলো কখন যেন আমার নিশ্বাসে ঢুকে গিয়েছিল। একদিকে অভাবের সংসারের তাড়না আমাকে রুক্ষ, মেজাজি করে তুলছিল, অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্য হিসেবে গড়ে উঠছিল সাংস্কৃতিক দিকগুলো, ছবি দাদুর তত্ত্বাবধানে।

দাদুর বাড়িতে থেকে প্রচুর বই পড়তাম, ফলে সাধারণ জ্ঞান বেশ ভালো হয়েছিল আমার। সঙ্গে দাদুর পড়ানো তো ছিলই। সংস্কৃত নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে বছর দুয়েকের মধ্যেই তাই রাজ্যসরকারের এই মাঝারিমাপের চাকরিটা জোটাতে পেরেছি আমি। দাদু অবশ্য তাতে ঠিক খুশি হননি। তিনি চান, আমি আরো পড়ি, তারপর কলেজে পড়াই। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।

সত্যি কথা বলতে আমার জীবনের সবটাই সুন্দর করে গড়ে দিয়েছেন ছবিদাদু।

মা সবই জানে, তবু কিনা সেই দাদুকেই … !

মা কখন ঘর থেকে চলে গিয়েছিল আমি খেয়ালই করিনি, এখন হঠাৎ আবার ফিরে এসে আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিয়ে বলল, ”খেতে দিয়েছি। আর আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস অফিস থেকে, কিছু কাজ আছে।”

দাদুকে নিয়ে কিছু বললে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। মা-র ওপর রাগে তখনও আমার শরীরটা গনগন করছিল, ঠিক এইসময় ফোন বেজে উঠল।

আমি স্মৃতি রোমন্থন ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম, ঝটিতি ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলাম, ”হ্যালো?”

প্রথমে কিছু শোনা গেল না।

একে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর আমি বুঝে পাই না লোকজন ফোন করে বোবা হয়ে যায় কেন! অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি আরও জোরে বললাম, ”আরে কে বলছেন বলুন না, হ্যালো?”

ওদিক দিকে একটা ইতস্তত করা পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ”ইয়ে হ্যালো, আ-আমি কি মিস বিশ্বাস, মিস দিওতিমা বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছি?”

”হ্যাঁ কথা বলছেন।” আমি কথাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুর করে বললাম, ”আমি কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে পারি?”

”ইয়ে, আমি মঙ্গলরূপ ভট্টাচার্য বলছি। আপনার সঙ্গে কি একটু দেখা করা যেতে পারে? খুব দরকার আসলে।”

সাত

”শুনুন আমাকে পি আই এল শেখাবেন না। কে বলেছে আপনাকে সরকারি কর্মচারীরা পি আই এল ফাইল করতে পারেনা? অবশ্যই পারে, তার জন্য অফিসের পারমিশন নিতে হয়। আমিও নিয়েছি।” কমলালেবুর কোয়ার মতো চোখের নীচের দিকে মোটা করে কাজল টানা দিওতিমা একটা টিভি মিডিয়ার নতুন রিপোর্টারকে প্রায় ধমকে দিল।

ছোকরা রিপোর্টারটাও বেয়াড়া, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখন থেকে বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করে চলেছে, অন্য কোনো মিডিয়াকে কাছে আসার সুযোগই দিচ্ছে না। এখন টেরিয়া হয়ে একপেশে হেসে স্মার্টনেস দেখিয়ে বলল, ”কিন্তু ম্যাডাম, পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশন বলছে আপনার ওই পিলের কোনো মূল্যই নেই যেহেতু আপনি সুপ্রিমকোর্টে ফাইল করেননি!”

দিওতিমা এবার সরু চোখে রিপোর্টারটার দিকে তাকাল, ”পিল আবার কি? কনট্রাসেপটিভ পিলের কথা বলছেন নাকি?”

আশপাশের ভিড়ে মুহূর্তে একটা হাসির মৃদু হুল্লোড় উঠল।

ছেলেটা এবার কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে গেল।

দিওতিমা কোমরে হাত দিয়ে বলল, ”পি আই এল এর ফুল ফর্ম কী বলুন তো?”

ছেলেটা এবার অন্যমনস্ক হয়ে ওর ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলতে উদ্যত হল কিন্তু দিওতিমা ওর হাতে ধরে থাকা নোটবুকটাকে টোকা দিয়ে বলল, ”এই যে, হ্যাঁ আপনাকে বলছি।”

ছেলেটা এবার কথা ঘোরাতে লাগল, ”না ইয়ে, সে ঠিক আছে, পি আই এল করেছেন, সে আর এমন কী ব্যাপার …!”

দিওতিমা ঠান্ডা চোখে বলল, ”পি আই এল হল পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন। মানে জনস্বার্থ মামলা। আর সেটা যে শুধু সুপ্রিমকোর্টেই ফাইল করা যায় সেটা শুধু সুপ্রিমকোর্ট নয়, দেশের যেকোনো হাইকোর্টে করা যায়। আর দেশের যেকোনো নাগরিক সেটা করতে পারেন। জনসাধারণের কল্যাণের স্বার্থে। এবার থেকে রিপোর্টারি করতে এলে একটু তৈরি হয়ে আসবেন, কেমন?”

টিভি চ্যানেলের ছোকরা রিপোর্টারটা মিইয়ে যাওয়া আলুভাজার মতো দাঁত বের করে হাসল, ”বটেই তো ম্যাডাম, বটেই তো। আসলে আইনের অত জানিনা তো! তবে আমাদের চ্যানেলই কিন্তু এক্সক্ল্যুসিভলি আপনার নিউজটা প্রথম কভার করেছিল, প্রাইম টাইমে আপনার শো-টাও। তারপরেই তো সব মিনিস্টাররা এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। আর কাল তো মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন কমিটি গঠন করে…।”

দিওতিমা ক্রমাগত তেল দেওয়াতে ভিজল না, বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিল, ”দেখুন, আমার যা বক্তব্য এর আগে আমি অনেকবার বলে দিয়েছি। আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?”

আরও কিছু রিপোর্টারের খুচরো প্রশ্নগুলোকে মোটামুটি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দিওতিমা হাঁটা লাগালো কোর্টের ক্যান্টিনের দিকে।

 দূর থেকে এতক্ষণ ধরে দেখেশুনে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, মা ব্যাগে গ্লুকোজের জল ভরে দিয়েছিলেন।

সেটা বের করে কিছুটা ঢকঢক করে খেয়ে যেন শরীরে কিছুটা বল পেলাম।

অফিস ছুটি নিয়ে এসে শেষে এই আগুনের গোলার সঙ্গে আমায় কথা বলতে হবে? তাও এমনি কোনো কথা নয়, রীতিমতো কনভিন্স করতে হবে?

 ভাবতেই আমার কেমন পেটটা গুড়গুড় করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বাবার উপর রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল।

উহ, এই বসন্ত ভট্টাচার্য পুজো পুজো করে মনে হয় একবছরও আমাকে চাকরিটা করতে দেবে না।

আজ সকালেও ভেবেছিলাম ঠিক এদিক সেদিক করে কাটিয়ে দেব, খামোখা কি একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাব?

তার ওপর টিভিতে কাল যা নমুনা দেখেছি!

আমি অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।

 হঠাৎ হেডুর আগমন, ”শোনো রূপ, জগদীশ কাল তো তোমায় সবই বলেছে। ব্যাপারটা আর ভালো দিকে যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই শুনেছ, কাল কীভাবে বেইজ্জত হতে হয়েছে আমাকে। টিভি চ্যানেলটা পুরো সাজানো লোকেদের নিয়ে এসেছিল, পুরো ইস্যুটাকে অন্যরকম মাত্রা দেওয়ার জন্য। ইয়োলো জার্নালিজমের চূড়ান্ত নিদর্শন! আমার খুব ভুল হয়েছিল কাল ওখানে যাওয়াটা।”

আমার কালকে টিভিতে দেখা বাবা-র হতভম্ব হয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়ে গেল। ওইটুকু মেয়ে যে বাবাকে এমনভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে, সেটা উনি হজম করতে পারছেন না।

না পারাটাই স্বাভাবিক।

”একেই আমাদের দলের মধ্যে এই নিয়ে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তার ওপর হুট করে বিধানসভায় বিল উঠে গেলে আমাদের পক্ষে ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। আজ তুমি হাইকোর্ট চলে যাও। দেখো, মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে।”

 ”হাইকোর্ট?” আমি অবাক, জগদীশকাকা মেয়েটার সঙ্গে হাইকোর্টে দেখা করতে হবে একবারও বলেননি।

তাই দেখে বাবা আরও জোরে বলেছিলেন, ”হ্যাঁ হাইকোর্ট। এতে এত অবাকের কি আছে? আমাদের গোটা কম্যুনিটি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে, এতবড়ো বিপদ, আর তোমাকে সেই প্রথম দিন থেকে দেখছি কোনো গা-ই করছ না ব্যাপারটায়। আরে গোটা ওয়েস্ট বেঙ্গলে সব জায়গা মিলিয়ে প্রায় আটত্রিশ হাজার সাতশো জন পুরোহিত আমাদের অর্গানাইজেশনের মেম্বার, ধুম করে সরকার লাইসেন্স ছাড়া পুজো করা বাতিল এইরকম কিছু বিল পাশ করে দিলে মুহূর্তের মধ্যে কত লোক সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়বে ভেবে দেখেছ? সামনেই দুর্গাপুজো। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কি জবাবদিহি করব আমি?”

 আমি ঢোঁক গিলে বলেছিলাম, ”হাইকোর্ট গিয়ে কী করতে হবে আমায়?”

 ”ওই যে ওই মেয়েটা, তার সঙ্গে গিয়ে একটা পরিষ্কার আলোচনা করো। কী চাইছে সে, পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের হাত আছে কিনা, মতলবটা কী। সেদিনের একটা পুঁচকে মেয়ে কিনা …! ” বাবা চোখ সরু করেছিলেন, ”আমি অন্য কাউকেও পাঠাতে পারতাম, সুদেব তো যাওয়ার জন্য মুখিয়েই আছে, রঘুবীরের ছেলে আত্মারামও বেশ চালাকচতুর, কিন্তু আমি ঠিক করেছি এখন থেকে তোমাকে অল্প অল্প করে দলের কাজ দেব, যাতে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট পোস্ট সামলাতে তোমার কোনো অসুবিধে না হয়।”

 অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট এখন দিওতিমা বিশ্বাস নামের বাবার ভাষায় একটা পুঁচকে মেয়ের সামনে বসে কলকল করে ঘামছে।

 হাইকোর্টের ক্যান্টিনে বেশ ভিড়। কেউ কেউ তো মাটিতে বসেই ঝোলা থেকে গুড় রুটি বের করে চিবুচ্ছে। কোন দূরের গ্রাম থেকে এসেছে হয়তো! আমাদের দেশে আর যারই অভাব থাকুক না কেন, বছরের পর বছর ধরে চলা মামলার কোনো অভাব নেই। ন্যায্য বিচারের আশায় কত মানুষ ঘটিবাটি বেচে দিয়েও মামলা চালাচ্ছে।

 এইসব দেখলেই কেন জানিনা আমি খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। সেই সানি দেওলের হাত মুঠো করে বলা বিখ্যাত ‘তারিখ পে তারিখ’ ডায়লগটা মনে পড়ে যায়। এমনিতেই অবশ্য টেনশন ডিপ্রেশন আমার চিরকালের সঙ্গী। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন প্রতিটা পরীক্ষার ঠিক আগে বমি করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।

 এখনো আমাকে সেই ভয়টাই ভীষণভাবে চেপে ধরছে, ঠেসে ধরছে যেন মনের দেওয়ালের একটা কোণে, তবু আমি প্রাণপণে শান্ত থাকার চেষ্টা করছি, কথা সাজিয়ে নিচ্ছি ঠিকমতো।

 দিওতিমা মেয়েটার অবশ্য এতদিকে হুঁশ নেই, সে বিশাল বড় একটা অমলেটে কাঁটাচামচ ঢুকিয়ে মুখের মধ্যে পুরছে, লংকা চিবিয়ে ফেলেছে বোধ হয়, চোখ দুটো ছলছল করছে।

নাকটা সুরুৎ করে একবার টেনে নিয়ে বলল, ”অ! আপনি বসন্ত চৌধুরীর লোক?”

 আমি ওর দিকে তাকালাম। মেয়েটার নাকের সামনেটা ঝালে কেমন লাল হয়ে উঠেছে।

ইতস্তত করে বললাম, ”ব-বসন্ত চৌধুরী কেন হবে, তিনি তো সিনেমা করতেন। আমার বাবার নাম বসন্ত ভট্টাচার্য। আর আমি মঙ্গলরূপ।”

 ”ওয়েট!” দিওতিমা এবার মুখে আরেকটা বিশাল টুকরো ঢোকাতে গিয়েও থেমে গেল, আঙুল তুলে বলল, ”আপনিই তার মানে সেই গোবর?”

 আমার এবার খুব রাগ হল, তার সঙ্গে মাথাটাও গরম হয়ে গেল। ইচ্ছে হল বাবাকে নিয়ে এসে দেখাই, বাবা এই অ্যাসোসিয়েশন করে করে হেদিয়ে মরছেন, আর দলেরই কেউ এইরকমভাবে আমার সম্মান প্রকাশ্যে ধুলোয় লুটিয়ে দিচ্ছে।

 গোবর নামটা কে লিক করল বাইরে? আমি বললাম, ”গোবর মানে?”

 ”না কিছু না। আপনি কাল সন্ধেবেলা ফোন করার পর খোঁজ নিয়ে জানলাম। ওসব ছাড়ুন।” আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিওতিমা বলল, ”ওমলেট খাবেন?”

 ”না।” আমি মাথা নাড়লাম, ”আমি বাইরে কিছু খাইনা।”

 ”অ! তবে বলুন কী চান। শুনুন আপনাদের ওই সুদেব না কে, আমাকে আবার ফোন করেছিল, বলছিল ভালো ক্যাশ দেবে, আমি যেন এখানেই চেপে যাই। কিন্তু ওসব টিকি ওলা ভণ্ডদের আমি পাত্তা দিই না।” দিওতিমা ঠোঁটটাকে বাঁদিকে বেঁকিয়ে বলল, ”টাক টিকি দাড়ি, এই তিনটে মানেই বজ্জাতের হাঁড়ি। আপনাদের ভণ্ডামি ঘোচাতে আমি একাই একশো, বুঝেছেন?”

 আমি চট করে নিজের অজান্তেই আমার হালকা সবুজ দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলাম, কেশে টেশে বললাম, ”ম্যাডাম, আপনি নিজে পুজো করতে চাইছেন খুব ভালো কথা, করুন। কারুর অসুবিধা নেই। সেদিনই তো কাগজে পড়লাম, একজন অধ্যাপিকা বিয়ে পর্যন্ত দিচ্ছেন। তাতে তো কেউ বারণ করেনি। এখন আর ওসব কড়াকড়িও নেই। মানুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। কিন্তু এত লোকের ভাত মারাটা কি আপনার ঠিক? বলুন তো?” বাবার শিখিয়ে দেওয়া অনুযায়ী আমি প্রথমে টুকে খেলা শুরু করলাম।

মনে মনে অবশ্য চিন্তা করছিলাম, এর সঙ্গে লড়তে গিয়ে বাবা কী সব বেনোজল সেধে সেধে ঘরে ডেকে আনছেন! পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার হয়ে কিনা সুদেব ঘুষ অফার করছে? ছি ছি।

 ”এত লোকের ভাত মারা মানে?” দিওতিমা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে আমার মনে হল কাঁটাচামচটা অমলেট থেকে উঠে এবার আমার চোখে চলে আসবে সটান, ”তার মানে আপনি বলতে চাইছেন চোরেদের ভাত মারা যাবে বলে তাদের চুরি করলে জেলে পাঠানো উচিত নয়, কিংবা পকেটমারদের খাওয়া জুটবে না বলে তাদের নির্দ্বিধায় পকেট কাটতে দেওয়া উচিত!”

 ”ছি ছি আমি তা বলব কেন!” আমি জিভ কাটলাম। এখন বুঝতে পারছি এই মেয়ে গত কয়েকদিন ধরে সবক-টা মিডিয়ার কী করে প্রাইম নিউজে রয়েছে।

 ”পুরোহিত বামুনদের সঙ্গে আপনি চোর, পকেটমারদের তুলনা করছেন? মানে, করতে পারছেন? পু-পুরোহিতরা হলেন ব্রিজ, মানে হল সেতু … যারা মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক …।” আমি আহত গলায় বললাম।

 ”থামুন!” ভেবেছিলাম আমার মুখচোখ দেখে বুঝি দিওতিমা এবার একটু নরম হবে, কিন্তু সেই আশায় গরম জল ঢেলে দিয়ে দিওতিমা মুখ বেঁকিয়ে বলল, ”ক্লাস সিক্সে পড়তে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গিয়েছিলাম, রথের সময়। ভিড়ের সময় একটা টিকি ওলা ওড়িয়া পুরুত আমার প্রাইভেট পার্টসে হাত দিয়েছিল, বুঝলেন? ছোট ছিলাম, হাঁদাও ছিলাম। তাই কিছু বলতে পারিনি। এখন হলে ঘুরিয়ে এমন একটা রদ্দা দিতাম না…!”

 দিওতিমা বাঁ-হাতটা ওপরে তুলে আমার দিকেই বুঝি নিয়ে আসতে যাচ্ছিল, আমি কোনোমতে হাঁ হাঁ করে থামিয়ে টামিয়ে বললাম, ”দেখুন একজনকে দেখে জেনারেলাইজ করা কি ঠিক? মানে সবাই কি একরকম হয়?”

”একজ্যাক্টলি!” দিওতিমা টেবিলে একটা ছোট্ট ঘুষি ঠুকল, ”সবাই একরকম হয়না বলেই দেয়ার শুড বি অ্যান এলিজিবিলিটি টেস্ট, রাইট? দুনিয়াশুদ্ধু সব্বাইকে পাবলিক সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা দিতে হয়, ডাক্তাররা দেয়, উকিলরা দেয়, সরকারি কর্মীরা দেয়, বেসরকারী কর্মীরা দেয় আর আপনারা শুধু ভগবানের সঙ্গে আমাদের কানেকশন করান, তাও আবার মোটা ঘুষ নিয়ে, সেইজন্য কিছুই পরীক্ষা টরিক্ষা দেবেন না, সেটা তো হতে পারে না, না! আর কে বলল আপনাকে, মেয়েরা পুজো করতে গেলে কেউ বারণ করবে না? বারণ করার লোক প্রচুর আছে, বুঝলেন? বলে কিনা তুমি মেয়ে, পুজো করতে পারবে না। তুমি অব্রাহ্মণ, তুমি পুজো করতে পারবে না। কোন শাস্ত্রে লেখা আছে? কাল আমার টিভি শো-টা দেখেননি? আপনার বাবাও তো এসেছিলেন।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি। আমি বলছিলাম এই তো কাগজে পড়লাম একজন অধ্যাপিকা … !”

”আরে ওসব কাগজে পড়া খবর রাখুন দিকি! ক-টা ক্লাব দুর্গাপুজোর পুরুত হিসেবে মেয়ে বা অব্রাহ্মণ নেবে বলতে পারেন? আমি উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। একটা ক্লাবও নেবে না। সবদিক থেকে ভালো, যোগ্য পুরোহিত হলেও না। কারণ চলে আসা কনভেনশন।” দিওতিমা চোখ কুঁচকোল, ”আর তা ছাড়া, এটা তো আমি ভালোই করছি। যোগ্য লোকেরাই পুরোহিত হবেন, মানুষের রেসপেক্ট পাবেন, পুজোটাও ভালো হবে। এতে আপনাদের যে কেন এত ফাটছে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না!” ঝন্টু না কে, এসে হুমকি দিচ্ছে। এত সাহস?

”না মানে এত হাজার মানুষ তাহলে মুহূর্তের মধ্যে উপার্জনহীন হয়ে পড়বেন।” আমি মিনমিন করলাম।

”কেন? তার মানে আপনারা এটা আগে থেকেই ধরে নিচ্ছেন যে তারা পাশ করতে পারবেন না? যাদের একটা করে সংস্কৃত শব্দ শুনে মানুষ সেটাই উচ্চারণ করে পুষ্পাঞ্জলি দেয়, তাঁদের যদি পরীক্ষায় সামান্য কিছু স্তোত্রের মানে কিংবা সংস্কৃত শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা…।”

”কী যে বলেন!” আমি এবার না হেসে পারলাম না, ”অর্ধেক লোক কখনো স্কুলেই যায়নি আর তারা নাকি…!”

”তবেই চিন্তা করুন। যারা স্কুলেই যায়নি, তাদের হাত ধরে আমরা ভুলভাল মন্ত্র পড়ে, তাদের পাপী কামভর্তি মনের চ্যানেল দিয়ে আমরা নাকি ভগবানের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করি! হুহ!” অদ্ভুত মুখব্যাদান করল দিওতিমা।

”স্কুল যায়নি মানেই কি তারা খারাপ? পুঁথিগত বিদ্যে না থাকলেই তার মন পাপে ভর্তি থাকবে? এটা কেমন কথা হল? শিক্ষিত লোক খারাপ হয় না? কামুক হয় না?” আমি বললাম।

দিওতিমা এবার আমার দিকে ভালো করে দেখল, ”হু, আপনাকে যতটা ভেবেছিলাম, ততটা গোবর আপনি নন। এই কথাটা ঠিকই বলেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতাই সব নয়। কিন্তু সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়েই যদি আমাদের পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয়, তার মানে বাই ডিফল্ট আমি ধরে নেব ঠাকুর সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বোঝেননা। সেক্ষেত্রে ভুল মন্ত্র বললে ঠাকুরের কাছে আমার প্রার্থনা সঠিকভাবে পৌঁছবে কী করে?” কথাটা শেষ করেই ও উঠে পড়ল।

ওমলেট শেষ। রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। এবার বেরোবে।

আমি এরপর আর কী বলব বুঝতে পারলাম না, এই মেয়ে কারুর কথা শোনার পাত্রী নয়, সেটা পরিষ্কার।

তবু বাবার মুখটা মনে পড়তেই তড়বড়িয়ে উঠে বললাম, ”না আপনি প্লিজ একবার ভাবুন, এতগুলো মানুষের রুটিরুজি! একটু ঠান্ডা মাথায় …।”

”যা করছি ভালোর জন্যই করছি বুঝলেন?” দিওতিমা টেবিল থেকে অল্প মৌরি তুলে চিবোতে চিবোতে বলল, ”আপনার ওই কমল মিত্র বাবাকে গিয়ে বলে দেবেন গুন্ডা বা ক্যাবলা কোনোদিক দিয়েই আমাকে কাবু করা যাবেনা। পুরুতদের লাইসেন্স আমি শুরু করবই।” কথাক-টা বলে মেয়েটা ঝড়ের বেগে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি কী করব বুঝতে না পেরে থতমত মুখে বসে রইলাম।

হঠাৎ মনে হল গুন্ডা বা ক্যাবলা কোনোদিক দিয়েই নাকি ওকে কাবু করা যাবেনা, তা গুন্ডাগিরি না হয় ঝন্টু করেছে, কিন্তু ক্যাবলা বলতে কার কথা বলল?

কে জানে কার কথা বলল!

এই দিওতিমা বলে মেয়েটার গায়ে কেমন যেন জুঁই ফুলের গন্ধ। ফুল আমি খুব একটা চিনি না, কিন্তু ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে যখন কৃষ্ণনগরে মামারবাড়ি যেতাম, তখন বাড়ির সামনের এই জুঁই ফুলের গাছটা আমার খুব ভালো লাগত। ভোরবেলা গাছের নীচটা সাদা সাদা জুঁই ফুলে একদম মাখামাখি হয়ে থাকত, আর গন্ধে যেন ম-ম করত গোটা বাড়ি।

মেয়েটা কি জুঁই ফুলের গন্ধ, এমন কোনো ফ্লোরাল পারফিউম মেখেছে?

চারপাশের হাজারো কোলাহল আর চেঁচামেচির মাঝে আমি খাঁটি নির্ভেজাল একটা ক্যাবলার মতোই হাইকোর্টের ক্যান্টিনে বসে রইলাম।

আট

 ”কলকাতা যাদের সম্পত্তি ছিল, সেই বিখ্যাত সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশের একজন পুরুষ, নাম রত্নেশ্বর রায় প্রথম আমাদের এই উত্তরপাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন।” ছবিদাদু চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন।

আমি উড পেনসিলের পেছনের অংশটা আনমনে চিবোচ্ছিলাম, দাদুর গল্পের মতো করে বলা ইতিহাসটাকে মনে মনে কল্পনা করছিলাম, ”কলকাতায় অত বড়ো সম্পত্তি ফেলে রত্নেশ্বর এখানে কেন এসেছিলেন দাদু?”

”কোথায় যেন পড়েছিলাম, জোব চার্নক কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে রত্নেশ্বর রায়দের গঙ্গা স্নানে অসুবিধা হচ্ছিল। উত্তরপাড়ার দক্ষিণদিকে বালি তখন বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম, তার ওপর ব্রাহ্মণপ্রধান। রত্নেশ্বর ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। বালি গঙ্গা নদীর পশ্চিমদিকে বলে উনি হয়তো বেনারসের মতো তীর্থস্থানের সঙ্গে সাদৃশ্য পেয়েছিলেন। উত্তরপাড়া তখন বালিরই একটা অংশ বুঝলি, মাঝখানে ছিল শুধু ওই বালিখাল। বালি গ্রামের উত্তরদিকে বলে নাম হয়েছিল উত্তরপাড়া।” দাদু চোখ বন্ধ করলেন।

আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম।

সন্ধেবেলা, কাছেই উত্তরপাড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

নীচের ঘরে প্রণতিদিদিমা সন্ধে দিচ্ছেন, সেই শঙ্খধ্বনিও আসছে কানে।

আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ল মা আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ”তখন তো এত বাড়িঘর ছিল না, বলো দাদু!”

”বাড়িঘর! ধুস!” দাদু হাসলেন, ”উত্তরপাড়ার বেশিরভাগ জায়গাই তখন ছিল বনজঙ্গল, জলাভূমি। তুলনায় বালি অনেক বর্ধিষ্ণু। তুই জিজ্ঞেস করছিলি না, বালি প্রাচীন গ্রাম কিনা? অনেক প্রাচীন। প্রথমে সপ্তগ্রামের দিকটায় রমরমা ছিল, বুঝলি! বিশাল বিশাল নৌকো, ব্যবসাবাণিজ্য তখন ওদিক দিয়েই হত। পরে সরস্বতী নদী মজে যাওয়ায় এদিকটা উন্নত হতে থাকে। তবু এই উত্তরপাড়ায় তখন জেলে, মালা, কৈবর্তরা অনেকেই থাকত যারা সন্ধের পর নদীতে বড় বড় বজরায় হামলা করে ডাকাতি করত।”

”ডাকাতি!” আমি অবাক হয়ে গেলাম, ”উত্তরপাড়ার লোকেরা ডাকাতি করত!”

”আহা সবাই ডাকাত হতে যাবে কেন!” দাদু মুখ থেকে পানের ছিবড়েটা ফেললেন পিকদানিতে, ”কেউ কেউ করত। তারপর তো রত্নেশ্বর রায় এসে বসবাস আরম্ভ করলে অনেক ভদ্রপরিবার এদিকে এসে থাকতে শুরু করেন। উত্তরপাড়ার জমিদাররা রত্নেশ্বরেরই উত্তরপুরুষ।”

”আর কোন্নগর? সেটাও জঙ্গলে ঢাকা ছিল?”

”ধুর! কোন্নগর অনেক পুরোনো।” দাদু আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলেন, ”কবি বিজয়রাম সেন তীর্থমঙ্গলে লিখেছেন—

ডাহিনেতে কোন্নগর বামে আগরপাড়া।

সুকচরে আসিয়া দামায় দিল সাড়া।

দেওয়ানজীর গ্রাম সেই অপূর্ব বসতি।

বালির ঘাটেতে নৌকা গেল শীঘ্রগতি।”

”বুঝলাম।” আমি উঠে দাঁড়ালাম, ”এইটাই কনফিউশন ছিল। এবার যাই। অনেকক্ষণ এসেছি। আরও দেরি হলে মা গজগজ করবে।”

”আজ কিন্তু কোনো লাভ হল না তোর।” দাদু মনে করিয়ে দিলেন, ”খালি বালি-উত্তরপাড়ার ইতিহাস জেনে গেলি, শাস্ত্র পড়লি না। শূদ্ররা পুজো করবে চাইছিস, এদিকে কাজের কাজ তো কিছুই করলি না।”

 ”আর কাজের কাজ! ওই অ্যাসোসিয়েশনের পান্ডা কাজের কাজ করতে দিলে তো! সেদিন টিভিতে নাকানিচোবানি খাওয়ার পর একবার গুন্ডা পাঠাচ্ছে, একবার ইমোশনালি হ্যারাস করছে! কেউ স্রোতের উলটোদিকে হাঁটতে গেলেই মানুষ আদাজল খেয়ে পেছনে পড়ে যায়।” আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম, ”দাদু আর একটা প্রশ্ন আছে।”

 ছবিদাদু ওঠার উপক্রম করছিলেন। অন্ধকার নেমে গেছে, দাদুর এখন বই পড়ার সময়। টানা রাত অবধি বই পড়বেন।

আমার কথায় চোখ তুলে তাকালেন, ”কী প্রশ্ন?”

”এই যে তুমি বললে আমি শূদ্রদের পুজো করার অধিকার পাওয়ার জন্য লড়ছি। সেদিন আমি টিভিতেও তো বললাম, শূদ্রদের পুজো করার অধিকার আলাদা করে চাইতে হবে কেন? ভগবদগীতাতেই তো বলা আছে যে,

পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।

তদহং ভক্ত্যপহৃতমশ্নমি প্রযতাত্মনঃ।।

অর্থাৎ শ্রীভগবান বলছেন, ”যে পত্র অর্থাৎ তুলসীপাতা, পুষ্প, কল, জল আমাকে ভক্তিভরে প্রদান করে, আমি সেই ভক্তের ভক্তির উপহার গ্রহণ করি। কই সেই ভক্ত ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়, বৈশ্য না শূদ্র সেই ব্যাপারে তো কিছু বলা নেই।”

দাদু সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলেন, ”কোন শালার ব্যাটা বলেছে যে শূদ্ররা পুজো করতে পারবে না? ওরে ব্রাহ্মণরা তো বাংলার আদি অধিবাসীই নয়, ওরা খ্রিস্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতক নাগাদ উত্তর ভারত থেকে আসতে শুরু করেছিল। মোটামুটি অষ্টম শতকে বাংলায় ব্রাহ্মণ প্রচুর বেড়ে যায়। পাল রাজারাও ওদের খুব সমাদর করতে শুরু করেন। তো পঞ্চম শতকের আগে তাহলে পুজোআচ্চা কারা করত বাংলায়?” দাদু আমার দিকে প্রশ্নটা যেন ছুঁড়ে দিলেন।

”ব্রাহ্মণরা বহিরাগত!” আমি হতবাক, ”তার মানে এই রাঢ়ি, বারেন্দ্র এইসব ব্রাহ্মণদের ভাগগুলো …!”

”কান্যকুব্জ থেকে বাংলার রাজার অনুরোধে পাঁচজন ব্রাহ্মণ এসেছিলেন বাংলায়। ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, শাণ্ডিল্য, বাৎস্য, আর সাবর্ণ। এই পাঁচগোত্রের ব্রাহ্মণ বাংলায় এসে রাণীর চান্দ্রায়ণ ব্রতয় পৌরোহিত্য করলেন, তারপর এখানেই থেকে গেলেন। এইভাবে কুলীন ব্রাহ্মণদের বংশবিস্তার বাংলায় শুরু হল।” দাদু বললেন।

”হুম বুঝলাম। তবে দাদু, আমি শুধুমাত্র শূদ্রদের পুজো করার অধিকার চাওয়ার জন্য কিন্তু লড়ছি না।” আমার আজ দুপুরে হাইকোর্টে পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের ওই ক্যাবলা ছেলেটার কথাগুলো মনে পড়ে গেল, ”ব্রাহ্মণ শূদ্র যিনিই পুজো করছেন তাঁর যোগ্যতাটা যাচাই করাটাও কিন্তু আমার লক্ষ্য।”

”মানে তুই জাতপাতকে সমর্থন করছিস?” দাদু জিজ্ঞেস করলেন।

”মোটেই নয়। শুধু জাত কেন যে কোনোরকম বিভাজনের নামে সমাজকে ভাগ করারই বিরুদ্ধে আমি। কিন্তু আপাতত আমার লক্ষ্য পৌরোহিত্য সত্যিকারের ব্রাহ্মণরাই যেন করেন। মানে যারা চরিত্রে, যোগ্যতায়, মননে ব্রাহ্মণ, শুধু বংশকৌলিন্যে নয়। সেই যে কবীরের একটা দোঁহা তুমি বলেছিলে,

জাত-পাঁত পুছে না কোই,

হরকো ভজে সো হরকা হোই”

”যাই করিস। মাথাটা ঠান্ডা কর। ওটাই সাফল্যের মূলমন্ত্র। মেজাজটা একটু কমা।” আমি বেরিয়ে আসছিলাম, দাদু পেছন থেকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন।

আমি হেসে হাত নেড়ে হাঁটা শুরু করলাম। বেশ দেরি হয়ে গেল। গিয়ে আবার রান্না করতে হবে। মা-র ঘুষঘুষে জ্বর হচ্ছে ক-দিন, শরীরটা ভালো নেই। কাজেও বেরোতে দিইনি তাই।

মনে মনে আমি ঠিকই করে রেখেছি, সুস্থ হয়ে উঠলেও আর বেরোতে দেব না। আমি যখন চাকরি পেয়ে গেছি, শুধু শুধু মা আর কষ্ট পাবে কেন?

বিশ্রী গরম। তার ওপরে আজ অফিসে সারাদিন পাওয়ার কাট, ভ্যাপসা আবহাওয়ার জন্য মাথাটা এখনো বেশ ধরে আছে। যার জন্য এত আয়োজন, সেই পুজোতে মনে হচ্ছে ঢালবে ভালোই।

উত্তরপাড়া স্টেশনের ক্রসিং পেরিয়ে ধীরেসুস্থে হাঁটছিলাম। কাল আবার কোর্টে যেতে হবে, একটা সি এল নষ্ট হবে। নতুন চাকরি, ছুটিছাটা একদমই নেই, কিন্তু কিছু করার নেই। আগের দিন কোনো কাজই হল না, মাঝখান থেকে ওই ছেলেটা, কী নাম যেন, মঙ্গলরূপ বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিল। তবে, একটা ব্যাপার ঠিক, ছেলেটা মিনমিনে হলেও আর যাই হোক ওই ঝন্টু বা ওর স্যাঙাতগুলোর মতো অসভ্য নয়। বেশ শান্তশিষ্ট, ভদ্র। বোঝাই যাচ্ছিল, সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে, আমার কাছে এসে তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে।

মাখলা জায়গাটা কিছুটা ছড়ানো ছিটনো। একদিকে কিছু দোকানপাট, অন্যদিকে বিড়লা রোড সোজা চলে গেছে হিন্দমোটরের দিকে। বড়ো রাস্তাটা সারাক্ষণ অটো আর টোটোর দৌরাত্ম্যে এমন ব্যস্ত হয়ে থাকে যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটাচলা করলেই দুর্ঘটনা ঘটবে।

একটা বড়ো গর্ত থেকে কোনোরকমে পা বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গলির মুখে ঢুকতে যাচ্ছি, দেখি বিনি। ঢোলা একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে, এই গরমেও ওড়নাটা গলায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো।

”কিরে, তোর গরম টরম লাগছে না নাকি?” আমি বললাম।

বিনি আমার ছোটবেলার পাড়াতুতো বন্ধু হলেও অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। আমি হাজার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকি, আর ও কলেজ শেষের পর বাড়ি থেকে বেরোয় না বললেই চলে।

ওদের বাড়ির প্রচুর পয়সা, কিন্তু শিক্ষা নেই, মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখাটাই নাকি ওদের আভিজাত্য!

”ওমা দিও! দাঁড়া দাঁড়া, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।” বিনির গোল গোল চোখগুলো যেন আর গোল হয়ে পুরো বিষ্টুদার দোকানের রসগোল্লা হয়ে গেল, আমার কাছে সরে হাত ধরে টিপল, ”তুই তো এখন সেলিব্রিটি রে!”

বিনিকে অনেকদিন পর দেখে ভালো লাগলেও এইবার আমার বিরক্ত লাগল। দুমদাম ছেলে মেয়ে যেই হোক, এসে গায়ে হাত দিলে হেব্বি ঝাঁট জ্বলে যায় আমার।

মুখের কথা মুখেই বলো না বাপু! টেপাটেপি কেন?

আর বিনির এই ভিতু ভিতু ফিসফাস করে বলা ন্যাকামি আর গেল না। আমি হাতটা আলগোছে সরিয়ে নিলাম, ”কেন কী করলাম আমি সেলিব্রিটি হওয়ার মতো?”

হাতটা সরিয়ে নিতে বিনি একটু মুখটা ভার করল, ”উফ, তোর সঙ্গে না গল্প করে সুখ নেই। একরকম রয়ে গেলি!” পরক্ষণেই আবার চোখ গোল গোল করল, ”কী করলি কী বলছিস! সব কাগজে এখন প্রথম পাতায় তোর ছবি, আর তুই বলছিস কী করলি?”

আমি এবার হাসলাম, ”কিছুই এখনো করিনি রে, একটা অধিকারের জন্য লড়াই চালাচ্ছি এই আর কী!”

”না রে, কী সাহস তোর! এত বড়ো বড়ো জায়গায় বক্তব্য রাখছিস গুছিয়ে। আমাকে তো কাল হাওড়া থেকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল, আমি টুক করে জানিয়ে দিয়েছি, খবরের কাগজে সকালবেলা যার ছবি বড়বড় করে দেখেছেন, সে আমার ছোট্টবেলার বান্ধবী। হি হি।” বিনি মুখ টিপে হাসল।

”হঠাৎ এই প্রসঙ্গ এল কেন?” আমি ভ্রূ কুঁচকোলাম।

”আরে ছেলের চার মাসি, দুই পিসি একসঙ্গে এসেছিল, একজন বলছে তোমার রুটি গোল হয় তো? একজন বলছে সেলাই কেমন পারো? বড়োপিসি যে, সে আবার বলছিল, পুজোর জোগাড় পারো তো? তখনই শুনিয়ে দিয়েছি।” বিনির চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, ”সবাই তো অবাক!”

আমি ক্লান্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম।

আগে হলে সঙ্গে সঙ্গে অনেক তর্ক শুরু করতাম, ইদানীং কালে যেন কেমন ক্লান্তি আসে, মনে হয় এই বিনির মতো মেয়েরা কোনোদিনও শুধরোবে না, এরা পরাধীন থাকতে আসলে ভালোবাসে।

এদের জন্যই মেয়েরা চিরকাল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থেকে যাবে।

”লজ্জা করে না তোর? একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে গোল রুটি হয় কিনা, চাটনি টক হয় কিনার মতো বোগাস প্রশ্নের উত্তর দিতে?” আমি রেগেমেগে বললাম।

”কী করব বল।” বিনির মুখ ম্লান হয়ে গেল, ”তোর মতো লেখাপড়ায় তো অত ভালো ছিলাম না। তার ওপর বাড়িতে সবাই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমার জন্য বোনেরও বিয়েটা হচ্ছে না।”

আমি ওকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলাম, ”তুই কবে হাওড়া যাচ্ছিস দেখতে?”

বিনি অবাক, ”আমি? হাওড়া যেতে যাব কেন হঠাৎ? আগে সব কিছু ঠিক হোক বিয়ের …।”

”কেন তোরই তো যাওয়া উচিত।” আমি ভ্রূ ওপরে তুলে বললাম, ”তোকেই যখন বিয়ের পর গিয়ে থাকতে হবে, তখন ওদের বাড়িটা কেমন, কটা বাথরুম, শ্যাওলা পড়া না পরিষ্কার, কমোড না ইন্ডিয়ান, এসব দেখে আসবি না?”

বিনির চোখ বড় বড় হয়ে যেতে আমি আবার বললাম, ”ভুল বলছি কি? তোদের এত পয়সা, তবু গিয়ে শ্বশুরবাড়ির গুষ্টির সেবা করবি। আর ছেলেটা তো বিয়ের পর তোদের বাড়ি থাকতে আসবে না, তুইই নিশ্চয়ই হ্যাংলার মতো ছুটবি থাকতে!” শেষ দিকে অজান্তেই আমার গলাটা বিদ্রূপাত্মক হয়ে উঠল।

”থাম দিও! তোর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাওয়াই আমার অন্যায় হয়েছে।” বিনি ঝঙ্কার দিয়ে আমায় থামিয়ে দিল, ”মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে থাকার জন্য ছোটেনা বুঝলি, শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েদের লক্ষ্মী করে নিয়ে যায়। এতে হ্যাংলামির কিছু নেই।”

”বটেই তো।” আমি আলতো মুখ বেঁকালাম, ”সেই লক্ষ্মীকে আবার পুড়িয়ে মেরেও ফেলে মাঝেমধ্যে।”

”তোর সঙ্গে কেন যে পাড়ার কোনো মেয়ে কথা বলে না সেটা আজ আবার বুঝলাম। এত বিশ্রী কথাবার্তা তোর, কে আগ বাড়িয়ে অপমানিত হতে আসবে?” রাগে বিনির নাকের পাটা ফুলছিল, ”এই বিয়ের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা, পাকা দেখা এগুলোও এক একটা আনন্দ, তোর মতো খেটে মরা মেয়েরা সেসবের মর্ম বুঝবে না।”

পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়েও এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল বিনি, ”আর এইরকম নর্দমার মতো মুখের ভাষা নিয়ে তুই নাকি পুজো করবি! হু! সস্তা পাবলিসিটির জন্য হেদিয়ে মরছিস আবার বড়ো বড়ো কথা বলছিস! সেই সরস্বতী পুজোর দিন থেকেই দেখছি তুই একটা বাজে মেয়ে হয়ে গিয়েছিস।”

বিনি চলে গেলেও আমি কিছুক্ষণের জন্য এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে সামনে এগোতে পারছিলাম না।

একবার মনে হল সোজা গিয়ে বিনিকে টেনে দুটো থাপ্পড় কষাই।

নার্সারি থেকে একসঙ্গে পড়ে আমাকে এই চিনল? আমি সস্তা পাবলিসিটি চাইছি?

 কিন্তু তারপর নিজেকে সংবরণ করলাম। বিনি যে কথাগুলো আজ রাগের মাথায় আমাকে বলে ফেলেছে, সেগুলো আসলে আমার আড়ালে পাড়ার মেয়ে-বউদের রোজকার আলোচনা। কিন্তু আমি তো বিনিকে ভালোর জন্যই বলছিলাম, ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তো বলিনি।

আর কতকাল মেয়েদের সেজে গুজে পুঁটলি হয়ে বসতে হবে পাত্রপক্ষের সামনে? আর কতদিন একইরকম ভাবে বড়ো করেও মেয়ের বাবা-মা ছেলের বাড়ির সামনে নীচু হয়ে থাকবে?

 শালা মেয়েরা নিজেরাই চায়না যে ছেলেমেয়ে সমান হোক। আমি তো কোনো পুরুষবিদ্বেষী নই, আমি শুধুমাত্র চাই ছেলেমেয়ে সমান অধিকার পাক। আর বিনি এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল!

বিস্ময়টা কেটে যেতেই রাগে আমি রাস্তায় পড়ে থাকা একটা নুড়িকে জোরে লাথি কষিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

নয়

”অপদার্থ!” বাবা জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে চাইলেন, ”সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরলে। সারাদিন কোনো পাত্তা নেই, ফোনও তুলছ না। তোমার আশায় থেকে থেকে আমি অল্টারনেট কোনো স্টেপও নিলাম না। আর এখন ডিনার টেবিলেও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছ। তোমায় দিয়ে যদি একটা কাজ হয় কখনো। তোমার বড় হওয়ার, একটা প্রকৃত লিডার হবার কোনো মানসিকতাই নেই। সেই টিপিকাল চাকরি করা ভৃত্যসুলভ বাঙালি!”

রাতে খেতে বসেও শান্তি নেই, বাবার ফায়ারিং চলবেই।

আমার পাশেই টিকলি বসে রয়েছে, আর উলটোদিকে মেজোকাকা। তিনিও নিশ্চুপ। মেজোকাকিমা তরকারির বাটিগুলো এক এক করে নিয়ে এসে রাখছেন টেবিলে।

কাকিমাকে সাহায্য করছে আমাদের বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে থাকা দানুকাকা। দানুকাকা আর দানুকাকার ছেলে নন্তু আমাদের বাড়িতেই থাকে। দানুকাকার দেশের বাড়ি এই হাওড়ারই ভেতর দিকের কোনো একটা গ্রামে। নন্তু ছেলেটা পড়াশুনোয় বেশ ভালো, এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। ওদের গ্রামের স্কুলেই পড়ে, এখান থেকে যাতায়াত করে।

মা থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত বাড়ছিলেন, মৃদু স্বরে বললেন, ”খেয়ে নিয়ে কথা বললে হয় না?”

”না হয় না।” বাবা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ”এই খেয়ে নিয়ে, ঘুমিয়ে নিয়ে, এত কিছু ‘নিয়ে’র জন্যই তোমার ছেলেটা আর মানুষ হচ্ছে না!”

আমি মাথা নীচু করে বসেছিলাম, এক হাতে গরম ভাত নাড়াচাড়া করছিলাম আর অন্য হাতে ফোনে খুটখাট করছিলাম।

দিওতিমা নামটা আমি জীবনে প্রথম শুনেছি, কিন্তু নামটা আসলে অনেক পুরোনো। নেট ঘেঁটে দেখলাম দিওতিমা আসলে প্রাচীন গ্রিসের মান্টিনিয়া নগরীর বিখ্যাত এক দার্শনিকের নাম। নামটা উইকিতে পড়ামাত্র যেন সেই জুঁই ফুলের গন্ধটা আবার পেলাম।

”কী করছ বলোতো তুমি ফোনে তখন থেকে?” বাবা তেতো গলায় গর্জে উঠলেন, ”কী বলল সেটা কী বলবে গুছিয়ে?”

আমি কাঁচুমাচু মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে তাকালাম, ”নেগোশিয়েশন বা কোনোরকম মিটমাটের প্রশ্নই নেই। মেয়েটা ভীষণ জেদি। পরিষ্কার বলে দিল পুরোহিতদের লাইসেন্স ও চালু করবেই।”

”লাইসেন্স চালু করেই ছাড়বে? বটে?” বাবা সরু চোখে তাকালেন, ”তোমাকে যা যা বলতে বলেছিলাম বলেছিলে?”

আমি ঘাড় নাড়লাম, ”সব। কোনো লাভ হয়নি।” তারপরেই আমার ওই কথাটা মনে পড়ে গেল, ”আচ্ছা একটা কথা। রবিবার মঞ্চে যে বক্তৃতা দিচ্ছিল তার নাম ঝন্টু তো?”

”হ্যাঁ, কেন? হঠাৎ?” বাবা তাকালেন।

”আমার মনে হয় ওইসব পার্টির লোকেদের এর মধ্যে ঢোকানোটা উচিত হয়নি।” প্রথম পাতে নিমপাতা-বেগুন ভাজা খেতে খেতে আমি মুখটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখছিলাম, ”ঝন্টু নাকি হুমকি দিয়েছে মেয়েটাকে। এরা সব কিছুতে গুন্ডাবাজি করে ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করতে চায়। সুদেবদা আবার ফোন করে টাকা অফার করেছে পিছিয়ে আসার জন্য। এটা জানাজানি হলে তো তোমারই ইমেজ খারাপ হবে, না! ঝন্টু জগদীশকাকার ভাইপো বলে হয়তো জগদীশকাকা ওকে কিছু বলছেন না, কিন্তু ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে বলে তো মনে হয় না।”

বাবা চুপ করে গেলেন, কিছু বললেন না।

ভাতে ঘন মুগের ডাল ঢেলে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, ”মেয়েটার সম্পর্কে সব ডিটেইলস জোগাড় করো তো। কোথায় থাকে, কী করে, বাড়িতে কে কে আছে। বাড়ি তো বোধ হয় উত্তরপাড়ায়, কালই চলে যাও। সন্ধের মধ্যে জানাও আমায়।”

এইবার আমি আবার মিনমিন করলাম, ”আজ অফিস যেতে পারিনি। কাল তো আমাকে অফিস যেতেই হবে। নতুন চাকরিতে এত ছুটি …।”

”কে করতে বলেছে তোমায় চাকরি?” বাবা আবার রেগে গেলেন, ”তুমি কি এগুলো আমার সঙ্গে শত্রুতা করার জন্য করছ? ভটচাজ বাড়ির একমাত্র ছেলে তুমি, এত বড় ব্যবসা, এত বড় অ্যাসোসিয়েশন, কে দেখবে এগুলো আমার পরে? তখনই পইপই করে বলেছিলাম ফাইন আর্টস নিয়ে না পড়ে কমার্স নিয়ে পড়তে, তাহলে ব্যবসারও সুবিধে হত। শুনলে না। ফাইন আর্টস নিয়ে পড়লে। তাও ঠিক আছে, কিন্তু এখন চাকরিবাকরি এসব কী!” গর্জে উঠলেন বাবা, ”ডিট্টো ছোটন তৈরি হচ্ছে! ভেবো না এইসব বাঁদরামি আমি সহ্য করব। বসন্ত ভট্টাচার্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না, সে নিজের ছেলে হোক আর যেই হোক!”

কোনো মানুষ যতই শান্ত হোক, যতই ভিতু হোক, একেক সময় তারও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। আমি কারুর ক্ষতি করছি না, খারাপ কাজ করছি না, শুধু নিজের ভালোলাগাটুকুকে নিয়ে বাঁচতে চাইছি, তাতে এত প্রবলেম কেন লোকজনের? সারাক্ষণ যার তার সামনে অপমান?

আমার আর পোষাল না, সবে নিমপাতা মাখা ভাতটা শেষ করেছিলাম, সেই তেতোমুখেই চেয়ারটা সজোরে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

দুমদাম করে ঘরে চলে আসার সময়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বাবা আমার এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে অবাক হয়ে গেছেন। থতমত মুখে দেখছেন আমার চলে যাওয়া।

আসলে যে যাই-ই বলুক, আমি মনে মনে কষ্ট পেলেও বাইরে তার কোনো প্রতিফলন দেখাইনা।

তাই আমার রাগ দেখতেও লোকে অভ্যস্ত নয়।

বিরক্ত লাগছে। আর ছোটকাকার ওপর বাবার কিসের এত রাগ বুঝি না। বাবার মতো বৈষয়িক না হলেই সবাই খারাপ? ক্রিয়েটিভিটির কোনো দাম নেই? অন্যসময় হলে আমার চোখে জল চলে আসত, কিন্তু এখন এল না, আমার ঘরের সাবেক আমলের পালঙ্কের একপাশে জানলায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি চুপ করে।

একটু পরেই কাঁধে কার স্পর্শ, চেয়ে দেখি মা। পেছনে টিকলিও রয়েছে।

মা নরম গলায় বললেন, ”খাওয়ার টেবিল থেকে এইভাবে উঠে আসতে হয়? ছি ছি।”

দুনিয়ার ওপর আমার যত রাগ, যত মেজাজ সব আমি এই একটা মানুষের ওপর দেখাই।

”ছাড়ো তো!” ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম, ”ছি ছি টা আমাকে না করে টেবিলে বসে থাকা ওই কাপালিককে করো, কাজে দেবে।”

”এ কী ভাষা রূপ!” মা-র চোখে মুখে অবিশ্বাস, ”বাবাকে কেউ কাপালিক বলে?”

টিকলিও হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার মুখের এমন ভাষা সম্ভবত ও প্রথম শুনল।

কিন্তু আমি দমলাম না, ”থামো তো মা! আমার আঁকতে ভালো লাগে, আমি নিজের যোগ্যতায় সরকারি আর্ট কলেজে চান্স পেয়েছিলাম। এখন নিজেরই যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছি, এবং আমার কাজ নিয়ে আমি যথেষ্ট খুশি। কিন্তু বাবার জন্য আমাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে? আমার কোনো নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকতে পারে না?

মা বললেন, ”দ্যাখ! তোর দিক থেকে তুই একদম ঠিক। কিন্তু তোর বাবা আসলে এই অ্যাসোসিয়েশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ভয় পান। জগদীশদা, সুদেবেরও তো বয়স হচ্ছে। তুই শক্ত হাতে হাল না ধরলে কতরকমের মতলব নিয়ে লোকে যে আজকাল আসে! এই তো রঘুবীরের ছেলেটা দিনরাত কেমন …!”

”তুমি একটা থ্রি পর্যন্ত পড়ে পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়া ছেলের সঙ্গে আমার তুলনা করছ?” আমি আরও রেগে যাচ্ছিলাম, ”আত্মারাম আর আমি এক হলাম?”

মা বললেন, ”আহা আমি সেটা বলিনি। আসলে অ্যাসোসিয়েশনের …!”

”আরে চুলোয় যাক এই অ্যাসোসিয়েশন। ওই দিওতিমা বলে মেয়েটা তো ঠিকই বলছে, ক-টা পুরোহিত ভালো মন নিয়ে পুজো করে বলো তো? সব শালা নিজের ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত, তাদের আদৌ প্রণামী নেওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে? তুমি আত্মারামের কথাই ধরো না, চুল্লুবাজ অশিক্ষিত। কেন ও শুধু শুধু ভক্তি পাবে মানুষের থেকে? ভারতের এত হাজার মন্দিরের ক-টা পুরোহিত সত্যিই চরিত্রের দিক দিয়ে শুদ্ধ বলো তো?”

 টিকলি এতক্ষণে মুখ খুলল, ”এভাবেই তো চলে আসছে দাদাভাই!”

 ”চলে অনেক কিছুই আসে। সময়ের সঙ্গে সেগুলো পালটাতেও হয়।” আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম নিজের অজান্তেই আমি যেন বিপক্ষ অর্থাৎ ওই দিওতিমা বলে মেয়েটার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি।

আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, ”আর বাবা যদি ভেবে থাকে এইরকম ভাবে আমার চাকরির বারোটা বাজাবে, আমি সেটা কিন্তু কিছুতেই মেনে নেব না মা। আমার আঁকতে ভালো লাগে, নিজের যোগ্যতায় আমি এই ফার্মে আর্টিস্ট হিসেবে কাজ পেয়েছি। এখন বাবা যদি চান ছোটকাকার মতো আমিও …!” আমি বলতে বলে ঠোঁট কামড়ালাম।

 ”চুপ কর রূপ!” মা এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ”অনেক বেশি কথা বলছিস আজকাল! মুখে লাগাম টানতে শেখ।”

আমি চুপ করে গেলাম। উত্তেজনার বশে একটু বেশিই কিছু বলে ফেলেছি।

”তোরা সবকিছু আমাকে শুনিয়ে কি মজা পাস? আমি কি তোদের সবার রাগ মেটানোর জন্য রয়েছি?” অস্ফুটে কথাটা বলে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

টিকলিও বলল, ”এসব কী বলছিস তুই দাদাভাই!”

আমার তাণ্ডব মুহূর্তে স্তিমিত হয়ে এল।

প্রত্যেক পরিবারেই এমন কিছু বিষয় থাকে, যা নিয়ে কেউ কথা তোলে না, সবার মনের মধ্যেই ঘুরপাক খেলেও প্রত্যেকে সযত্নে সেটাকে এড়িয়ে যায়।

আমাদের এই ভট্টাচার্য পরিবারে ছোটকাকাও তেমনই এক স্পর্শকাতর বিষয়।

আগেই বলেছি, ছোটকাকা ছিল এই পরিবারের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সন্তান। কিন্তু প্রেসিডেন্সি থেকে সোনার মেডেল নিয়ে বেরনোর পর বাবা যখন তাঁকে বাইরে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠানোর তোড়জোড় করছেন, সেই সময় ছোটকাকা দুম করে ঘোষণা করলেন তিনি আর পড়বেন না।

বাবা তখন অবাক হয়ে বলেছিলেন, ”ছোটন তুই আর পড়বি না? এখন থেকেই দোকানে বেরোবি? কেন তোর এত ভালো মাথা, আরও পড়। আমি আর খোকন তো আছিই।”

”না দোকানেও বেরবো না। যাদবপুরের একটা মিউজিক কোয়্যারে কিছুদিন ভায়োলিন বাজালাম। ভাবছি ওখানেই ফুল টাইম বাজাব।” আলগোছে উত্তর দিয়েছিলেন ছোটকাকা।

সম্ভবত তিনি কল্পনাও করতে পারেননি তাঁর আপাতনিরীহ এই পরিকল্পনায় বাড়িতে কত বড় অশান্তির ঝড় বয়ে যেতে পারে। আমি তখন ছোট, এসব কোনো কিছুই আমার তেমন মনে নেই। কিন্তু পুরোটাই ঠাকুমার মুখে এতবার শুনেছিলাম যে শুনতে শুনতে কখন যেন মনে হতে শুরু করেছিল যে সত্যিই আমার চোখের সামনে ঘটেছে পুরো চিত্রনাট্যটা।

বাবা কিছুক্ষণ নাকি কথা খুঁজে পাননি, হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলেছিলেন, ”তুই … তুই বেহালা বাজাস!”

”হ্যাঁ। বাজাই। কেন তোমাদের সবাইকে যে আগের মাসে আমাদের অনুষ্ঠানে যেতে বললাম, মনে নেই? কেউই তো গেলে না।” ছোটকাকা হাত উলটে বলেছিলেন।

বাবা সাতকাজে থাকা মানুষ, ছোট ভাইয়ের কি না কি অনুষ্ঠান, তিনি সময় করে উঠতে পারেননি, সময় থাকলেও সম্ভবত সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। প্রেসিডেন্সির সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র চোখধাঁধানো চাকরি বা আরও পড়াশুনো করবে সেটাই স্বাভাবিক, সেসব ছেড়ে যে কেউ বেহালা বাজানোর মতো একটা অকিঞ্চিৎকর কাজে সময় নষ্ট করতে পারে, তার চেয়েও বড় কথা, বেহালা বাজানোকে পেশা হিসেবে নিতে পারে, সেটা ছিল বাবার কল্পনারও বাইরে।

সেই শুরু হল। প্রথমে বোঝানো, তর্ক-বিতর্ক, মনোমালিন্য। তারপর তিক্ততা, ঝগড়া। ঠাকুমা দুই ছেলেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। দুই ভাই-ই অসম্ভব জেদি।

শেষের দিকে বাবা ছোটকাকার সঙ্গে আর কথাই বলতেন না। খালি তির্যক মন্তব্য, পরোক্ষ বিদ্রুপ, এভাবেই চলছিল।

বাবার ক্রমাগত উপহাসে ছোটকাকা বাড়িতে সবার সঙ্গে বসে একসঙ্গে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতেনও না, তবু নিজের লক্ষ্য থেকে তিনি একচুলও নড়েননি। দিনরাত পড়ে থাকতেন বেহালা নিয়ে যাদবপুরের ওই কোয়্যারে।

আজ যখন পুরোনো কথাগুলো মনে করি, ভাবি এত শক্ত মানুষ যিনি সবকিছুর প্রতিকূলতায় অত অনমনীয় ছিলেন, হঠাৎ করে তাঁর কি মতিভ্রম হল?

আমি থেমে গেলাম।

ঘড়ির কাঁটায় মধ্যরাত, বারোটা ছুঁই ছুঁই। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুলাম। চোখেমুখে জল দিলাম ভালো করে।

ছোটকাকার আমি খুব ন্যাওটা ছিলাম, পায়ে পায়ে ঘুরতাম ছোটবেলায়। কাকা আমাকে পাশে বসিয়ে একেকটা সুর তুলতেন, লিখতেন খাতায়।

শেষদিনও হয়তো আমায় পাশে বসিয়েই সুইসাইড নোটটা লিখেছিলেন গান লেখার খাতায়।

একটুও টের পাইনি আমি। বুঝতেই পারিনি, আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ছোটকাকার নিথর দেহটা ঝুলবে কড়িকাঠ থেকে।

আজও ছোটকাকা তার সেই সুর নিয়ে আমার মনের ভেতর থিতিয়ে থাকা পলির মাঝে অদৃশ্য চড়ার মতো রয়েছেন। সেখানে নিস্তব্ধ রাতে নৌকো এসে নোঙর ফেলে, দাঁড় টানার শব্দ হয় ছপাছপ!

আর আমি চোখ বুজে সেই পৃথিবীর আলো না দেখা সুর আর বিষাদের তরঙ্গগুলো নিয়ে খেলা করতে থাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *