০১. আবু জাফর শামসুদ্দিন

শ্যামল ছায়া

 ভূমিকা

আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। উনিস শ একাত্তর সনের পাঁচই মে তাঁকে দেশপ্রেমের অপরাধে পাক আর্মি গুলী করে হত্যা করে। সে সময় আমি আমার ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বরিশালের এক গ্রামে লুকিয়ে আছি। কী দুঃসহ দিনই না গিয়েছে! বুকের ভেতর কিলবিল করছে ঘৃণা, লকলক করছে প্রতিশোধের আগুন। স্বাধীনতাটাধীনতা কিছু নয়, শুধু ভেবেছি, যদি একবার রাইফেলের কালো নলের সামনে ওদের দাঁড় করাতে পারতাম। ঠিক একই রকম ঘৃণা, প্রতিশোধ গ্রহণের একই রকম তীব্র আকাঙক্ষণ সেই অন্ধকার দিনের অসংখ্য ছেলেকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তাদের যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, কোনো সহায় সম্বল ছিল না, কিন্তু শ্যামল ছায়ার জন্যে গাঢ় ভালোবাসা ছিল। আমার শ্যামল ছায়া সেই সব বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
— হুমায়ূন আহমেদ

০১. আবু জাফর শামসুদ্দিন

নৌকা ছাড়তেই রূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল।

এ অঞ্চলে বৃষ্টি-বাদলার কিছু ঠিক নেই। কখন যে হুঁড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে, আবার কখন যে সব মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ ঝকঝকে হয়ে উঠবে, কেউ বলতে পারে না।

আমি নৌকার ভেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লাম। বেশ শীত করছে। ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাপন লাগে। নৌকা চলছে মন্থর গতিতে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। এত বড়ো নৌকা কী জন্যে নিয়েছে কে বলবে। পানসির মতো আকৃতি। দাঁড় টেনে একে নিয়ে যাওয়া কি সোজা কথা?

এখন বাজছে নটা। রাত দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছান এ নৌকার কর্ম নয়। গুণ টেনে নিয়ে গেলে হয়তো হবে। কিন্তু গুণটা টানবে কে? আমি নেই এর মধ্যে, ভিজে গুণের দড়ি নিয়ে দৌড়ান। আমাকে দিয়ে হবে না। সাফ কথা।

বৃষ্টি দেখছি ক্রমেই বাড়ছে। বিলের মধ্যিখানে বৃষ্টির শব্দটা এমন অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আবার বাতাসে হিত হিত আওয়াজ উঠছে। প্যাচা ডাকার মতো। ভয় ধরে যায় শব্দ শুনে। ছেলেবেলায় এক বার এরকম শব্দ শুনে এমন ভয় পেয়েছিলাম। মানসাপোতার বিলে মাঝি দিক ভুল করেছে। চারদিকে সীমাহীন জল। বড়োরা সবাই ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করছে। তাদের হৈচৈ-এ ঘুম ভেঙে শুনেছি সেই বিচিত্র হঅ হঅ আওয়াজ। আজও সেই শব্দে ভয় ধরল। কে জানে কেন। আমি কি কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা করছ?

কুটকুট করে মশার কামড় খাচ্ছি। এই বিলের মধ্যে আবার মশা কোথেকে আসে? হাত-পা আর মুখে অল্প কিছু কেরোসিন তেল মেখে নিলে হত। সবাই দেখি তাই করে। হুমায়ূন ভাইও করেন। মশার উৎপাত থেকে বাঁচা যায় তাহলে। কেরোসিন মাখতে ইচ্ছে হয় না। আমার। কি জানি বাবা চামড়ার কোনো ক্ষতিই করে। কিনা। হয়তো গাল-টাল কলসে কয়লা হয়ে পড়বে। এর চেয়ে মশার কামড় অনেক ভালো। হাণ্ডেড টাইমস বেটার।

হুমায়ূন ভাইও দেখি আমার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছেন। তাঁর ধারণা, আমি ঘুমিয়ে রয়েছি। মাথার নিচে থেকে নিঃশব্দে বালিশটা নিয়ে নিলেন। বেশ লোক যা হোক! মজিদ বা আনিস হলে আমি গদাম করে একটা ঘুষি মারতাম। পরিষ্কার একটা হাতের কাজ দেখতে পেত। চালাকি পেয়েছ, না? বালিশ ছাড়া আমি শুয়ে থাকতে পারি না। অনেকেরই দেখি মাথার নিচে কিছু নেই, কিন্তু কেমন ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকায়। আমি পারি না।

বৃষ্টির তো বড়ো বাড়াবাড়ি দেখছি। ঝড়টড় এলে বিপদ। সাঁতার যা জানি, তাতে তিন মিনিটের বেশি ভেসে থাকা যাবে না। নৌকা ড়ুবলে মার্বেলের গুলির মতো তলিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। অবশ্যি সেটাও খুব একটা মন্দ ব্যাপার হবে না। ওমা, হাসি আসছে কি জন্যে বা! সবাইকে চমকে দিয়ে হেসে উঠব নাকি?

হুমায়ূন ভাই দেখি উঠে বসেছেন। মশা কামড়াচ্ছে বোধ হয়। কিংবা কোনো কারণে ভয় লাগছে। ভয় পেলেই এ রকম অস্থিরতা আসে। মজিদ বলল, কি হুমায়ূন ভাই, ঘুম হল না?

এই ঝড়-বৃষ্টিতে ঘুম আসে নাকি? তাছাড়া টেনশনের সময় আমার ঘুম হয় না।

এক দফা চা খেলে কেমন হয়? বানাব নাকি?

বাতাসের মধ্যে চুলা ধরাবে কী করে?

হাসান মিয়া ধরাতে পারবে। ও হাসা, লাগি মেরে নৌকা দাঁড় করাও গো। চা না খেলে জুত হচ্ছে না। এহা-হে, তুমি তো ভিজে একেবারে আলুর দাম হয়ে গেছ হাসান আলি।

ভিজে আলুর দাম হয়ে যাওয়াটা আবার কী রকম! এরকম উল্টোপাল্টা কথা শুধু মজিদই বলতে পারে। এক দিন আমাকে এসে বলছে, জাফর, যা পরিশ্রম করেছি–একেবারে টমেটো হয়ে গেছি। পরিশ্রমের সঙ্গে টমেটোর কী সম্পর্ক কে জানে।

নৌকার খুঁটি গেড়ে বসে আছে। এতক্ষণে তাও নৌকার দুলুনিতে বেশ একটা ঝিমুনির মতো এসেছিল, সেটুকুও গেছে। ঘনঘন চা খেয়ে কী আরাম যে পায় লোকে, কে জানে। আনিস দেখি। আবার সিগারেটও ধরিয়েছে। নতুন খাওয়া শিখেছে। তো, তাই যখন-তখন সিগারেট ধরান চাই। আবার ধোঁয়া ছাড়ার কত রকম কায়দা। নাক-মুখ দিয়ে। হাসি লাগে দেখে। মজিদ বলল, আনিস, আমাকে একটা ট্রাফিক পুলিশ দাও দেখি। আরে বাবা, সিগারেটের কথা বলছি।

বুঝেছি। বুঝেছি, তোমার এইসব ঢং ছাড় দেখি।

বৃষ্টির বেগ মনে হয় একটু কমেছে। হা-হা করে বাতাস বইছে ঠিকই। মজিদ বলল, জাফর মড়ার মতো ঘুমুচ্ছে, দেখেছেন হুমায়ূন ভাই!

হেঁটে অভ্যেস নেই তো, টায়ার্ড হয়ে পড়েছে।

টায়ার্ড না হাতি, জাফর হচ্ছে কুম্ভকর্ণের ভাতিজা। হেভি ফাইটিং-এর সময়ও দেখবেন মেশিনগানের ওপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।

সবাই হেসে উঠল হো-হো করে। আমার বেশ মজা লাগছে। আনিস বলল, এক কাজ করি, জাফরের কানের কাছে মুখ নিয়ে মিলিটারি মিলিটারি বলে চিৎকার করে উঠি। দেখি জাফর কী করে। মজিদ বলল, দাঁড়া, চায়ের পানি ফুটুক, তারপর।

ওদের কথাবার্তা এমন ছেলেমানুষী, হাসি লাগে আমার। কী মনে করেছে। ওরা। মিলিটারি মিলিটারি শুনে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ব নাকি? সরি, এতটা ভয় আমার নেই। আচমকা শুনলে একটু দিশাহারা হব হয়তো, এর বেশি না। সোনাতলায় এক বার মিলিটারির সামনে পড়ে গেলাম না? আমি আর সতীশ ধানক্ষেতে রাইফেল লুকিয়ে একটু এগিয়েছি, অমনি মুখোমুখি। ভাগ্য ভালো-দলের আর কেউ ছিল না। আমাদের সঙ্গে। আট-দশটা জোয়ান ছেলে একসঙ্গে দেখলে কি আর রক্ষা ছিল? দু জন ছিলাম বলেই বেঁচেছি। সতীশ অবশ্যি দারুণ ভয় পেয়েছিল। নারকেলের পাতার মতো কাঁপতে শুরু করেছে। আমি নিজেও হকচকিয়ে গিয়েছি। ছ জন মিলিটারি ছিল সব মিলিয়ে, যেমন চেহারা তেমন স্বাস্থ্যু। তারা জানতে চাইল, কোন বাড়িতে কচি ডাব পাওয়া যাবে। আমরা ওদের খাতির করে আজিজ মল্লিকের বাড়ি নিয়ে গেলাম। সতীশ গাছে উঠে কাদি কাদি ডাব পেড়ে নামাল। তারা মহাখুশি। এক টাকার একটা নোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল সতীশের দিকে। সতীশ সেই নোট হাতে নিয়ে বত্রিশ দাঁতে হেসে ফেলল-–যেন সাত রাজার ধন হাতে পেয়েছে।

প্ল্যান করেছিলাম, রাতের অন্ধকারে এক হাত নেব। কিন্তু ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল না। দুপুরের রোদ একটু কমতেই রওনা হয়ে গেল।

বৃষ্টি বোধ করি একেবারেই থেমে গেল। চা বানান হচ্ছে শুনছি। ওদের মিলিটারি মিলিটারি বলে চেঁচিয়ে ওঠার আগেই উঠে পড়ব। কিনা ভাবছি, তখনি অনেক দূরে কোথায় হই হই শব্দ পাওয়া গেল। নিমিষের মধ্যে আমাদের নৌকার সাড়া-শব্দ বন্ধ। চায়ের পানি ফোটার বিজ বিজ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো আওয়াজ নেই। হাসান বলল, নৌকা আসন্তাছে। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল শরীরে। ধ্বক করে উঠল বুক।

কিসের নৌকা, কাদের নৌকা-কে জানে? মিলিটারিরা অবশ্যি স্পীডবোট ছাত্ম নড়াচড়া করে না। তা ছাড়া রাতের বেলা তারা ঘাঁটি ছেড়ে খুব প্রয়োজন ছাড়া নড়ে না। তবে রাজাকারের উপদ্রব বেড়েছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য লুটপাট করা। এই পথে শরণার্থীদের নৌকা মেঘালয়ের দিকে যায়। সে সব নৌকায় হামলা করলে টাকা-পয়সা গয়না-টয়না পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অল্পবয়সী সুশ্ৰী মেয়েও পাওয়া যায়। দূরের নৌকা দেখলাম স্পষ্ট হয়েছে। সেখান থেকে ভয় পাওয়া গলায় কে যেন হাক দিল, কার নৌকা গো?

আমাদের নৌকা থেকে মজিদ চেঁচিয়ে বলল, তোমার কার নৌক?

ব্যাপারীর নৌকা। মাছ যায়।

শুনে পেটের মধ্যে হাসির বুদবুদি ওঠে। ব্যাপারী মাছের চালান দেয়ার আর সময় পেল না। আর মাছ নিয়ে যাচ্ছে এমন জায়গায়, যেখানে দেড় টাকায় একএকটা মাঝারি সাইজের রক্তই পাওয়া যায়। হুমায়ূন ভাইয়ের গম্ভীর গলা শোনা গেল, এই যে মাছের ব্যাপারী, নৌকা আন এদিকে।

কী আশ্চৰ্য, এই কথাতেই নৌকার ভেতর থেকে বহুকণ্ঠের কান্না শুরু হয়ে গেল! ছোট ছোট ছেলেমেয়ের গলার আওয়াজও আছে। এই বাচ্চাগুলি এতক্ষণ কী করে চুপ করে ছিল তাই ভাবি। নৌকার ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। মজিদ বলল, ভয় নাই ব্যাপারী, নৌকা কাছে আন।

আপনারা কী করেন?

ভয় নাই, আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। আস এদিকে, কিছু খবর নেই।

মুক্তিবাহিনী, মুক্তিবাহিনী! আনন্দের একটা হাল্লা। উঠল। নৌকা দুটিতে। অনেক কৌতূহলী মুখ উঁকি মারল। এরা হয়তো আগে কখনো মুক্তিবাহিনী দেখে নি, শুধু নাম শুনেছে। মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় কৌতূহলী মুখগুলি দেখতে ভালো লাগে।

নমস্কার গো বাবাসকল। আমার নাম হরি পাল। কাসুন্দিয়ার জগৎ পালের নাম তো জানেন। আমি জগৎ পালের ছোট ভাই। আমার আর জ্যাঠার পরিবার আছে। এই নৌকায়। মোট একুশ জন।

হরি পাল লোকটা বাক্যবাগীশ। কথা বলেই যেতে লাগল। দেখতে পাচ্ছি, তার ঘনঘন তৃপ্তির নিঃশ্বাস পড়ছে। নৌকার ভেতরের ছেলেমেয়েগুলির কৌতূহলের সীমা নেই। ক্রমাগত উঁকিঝুকি দিচ্ছে। এদের মধ্যে একটি মেয়ের চেহারা এমন মনকাড়া যে চোখ ফেরান যায় না। আমি বললাম, ও খুকি, কী নাম তোমার?

খুকি জবাব দেবার আগেই হরি পাল বলল, এর ডাকনাম মালতী। ভালো নাম সরোজিনী। আর এর বড়ো যে, তার নাম লক্ষ্মী। ভালো নাম কমলা। ও মালতী, বাবুরে নমস্কার দে। মালতী ফিক করে হেসে ফেলল। হরি পালকে চা খেতে দেওয়া হল এক কাপ। এত তৃপ্তি করে সে বোধ হয় বহু দিন চা খায় নি। খাওয়া শেষে ভোঁস ভোঁস করে কেঁদে ফেলল। তাদের কাছে আমাদের একটিমাত্র জিজ্ঞাসা ছিল–শিয়ালজানী খালে কোনো নৌকা বাঁধা দেখেছে। কিনা। আমাদের একটি দল সেখানে থাকার কথা। কিন্তু হরি পাল বা হরি পালের মাঝি, কেউই সে-কথা বলতে পারল না।

 

হাসান আলি নৌকা ছেড়ে দিল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দাঁড় পড়ছে। হরি পালদের নৌকাকে পেছনে ফেলে এগচ্ছি, হঠাৎ শুনলাম ইনিয়েবিনিয়ে সে–নৌকা থেকে কে একটি মেয়ে কাঁদছে। হয়তো তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে, হয়তো তার ছেলেটিকে বেঁধে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। নিস্তব্ধ দিগন্ত, বিস্তৃত জলরাশি, আকাশে পরিষ্কার চাঁদ-এ সবের সঙ্গে এই করুণ কান্না কিছুতেই মেলান যায় না। শুধু শুধু মন খারাপ হয়ে যায়।

এগারটা বেজে গেছে। দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছান অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্যি তা নিয়ে কাউকে খুব চিন্তিতও মনে হচ্ছে না। আনিস দেখি আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। মজিদ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। হাসান আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড় টানছে। আমি বললাম, হাসান আলি, দুটোর মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?

হাসান আলি জবাব দিল না। বিশ্ৰী স্বভাব তার। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভান করবে যেন শুনতে পায় নি। যখন মনে করবে। জবাব দেওয়া প্রয়োজন, তখনি জবাব দেবে, তার আগে নয়। আমি আবার বললাম, কী মনে হয়। হাসান আলি, দুটোর মধ্যে রামদিয়া পৌঁছব?

কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই জাতীয় লোক নিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল। আমি তো সহ্যও করতে পারি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দিই রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় এক বাড়ি-হারামজাদা ছোটলোক! কিন্তু রাগ সামলাতে হয়। কারণ লোকটা দারুণ কাজের। এ অঞ্চলটা তার নিখাদপণে। নিকষ অন্ধকারে মাঝে মাঝে আমাদের এত সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মনে হয়েছে ব্যাটা বিড়ালের মতো অন্ধকারেও দেখতে পায়। খাটতে পারে যন্ত্রের মতো। সারা রাত নৌকা চালিয়ে কিছুমাত্র ক্লান্ত না হয়ে বিশ-ত্রিশ মাইল হেঁটে মেরে দিতে পারে। আবু ভাই হাসান আলির কথা উঠলেই বলতেন, দি জায়েন্ট।

কিন্তু এই এক তোষ, মুখ খুলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে শূন্যদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করে যাবে। প্রথম প্রথম মনে হত হয়তো কানে কম শোনে। ও আল্লা, শেষে দেখি এক মাইল দূরের ঝিঝি পোকার ডাকটিও বুঝি তার কান এড়ায় না। কুড়ালখালির কাছে এক বার-আমাদের সমস্ত দলটি নৌকায় বসে! আবু ভাই সে-সময় বেঁচে। তিনি এক ন্যাংটো বাবার গল্প করছেন, আমরা স্বাই হো-হো করে হাসছি। এমন সময় হাসান আলি বলল, লঞ্চ আসতাছে, উঠেন সবাই পাড়ে উঠেন।

আমরা কান পেতে আছি। কোথায় কী-বাতাসের হুঁস হুঁস শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। আনিস বলল, যত সব বোগাস! তারপর কী কী হল? আবু ভাই ললেন, গল্প পরে হবে, এখন উঠে পড় দেখি; হাসান আলি যখন শব্দ শুনেছে, তখন আর ভুল নেই।

সেবার সত্যি সত্যি দুটি স্পীডবোট বাজারে এসে ভিড়েছিল। হাসান আলির কথা না শুনলে গোটা দলটো মারা পড়তাম।

আমার অবশ্যি সে রকম মৃত্যুভয় নেই। তবু কে আর বেঘোরে মরতে চায়? আমাদের মধ্যে মজিদের ভয়াটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি। কোনো অপারেশনে যাওয়ার আগে কুরআন শরীফ চুমু খাওয়া, নফল নামাজ পড়া, ডান পা আগে ফেলা–এক শ পদের ফ্যাকরা। গলায় ছোটখাটো ঢোলের আকারের এক তাবিজ। কোন পীর সাহেবের দেওয়া, যা সঙ্গে থাকলে অপঘাতে মরবার বিন্দুমাত্র আশঙ্কাও নেই। ভাবলেই হাসি পায়।

এ-রকম ছেলে দলে নেওয়া ঠিক নয়। এতে অন্যদের মনের বল কমে যায়। তবে হ্যাঁ, আমি এক শ বার স্বীকার করি, অপারেশন যখন শুরু হয় তখন মজিদের মাথা থাকে সবচেয়ে ঠাণ্ডা। এক তিল বেতাল নেই। আর এইম পেয়েছে কি, তিনটি ওলীর মধ্যে তার দুটি গুলী যে টার্গেটে লাগবে এ নিয়ে আমি হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি। আমাদের টেনিং দেওয়াতেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার সুরুজ মিয়া। আমরা ডাকতাম বুডা ওস্তাদ। বুডা ওস্তাদ প্রায়ই বলতেন, মজিদ ভাইয়ের হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেব। আহু কী হাত–কী নিশানা, জিতা রাহ।

মজিদের মতো ছেলের এতটা ভয় থাকা কি ঠিক? মজিদ। যদি এ-রকম ভয় পায় তো আমরা কী করি? এক রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি সে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি হতভম্ব। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে মজিদ?

কিছু হয় নাই।

খুব করে চেপে ধরায় বলল, সে স্বপ্নে দেখেছে এক বুড়ো লোক এসে তাকে বলছে–আব্দুল মজিদ, তোমার গলায় কি গুলী লেগেছে? এতেই কান্না। শুনে এমন রাগ ধরল। আমার। ছিঃ ছিঃ এ কী ছেলেমানুষী ব্যাপার! আমি অবশ্যি কাউকে বলি নি।

পরবর্তী এক সপ্তাহ সে কোথাও বেরল না। হেন-তেন কত অজুহাত। আসল কারণ জানি শুধু আমি। কত বোঝালাম–স্বপ্ন তো আর কিছুই নয়, অবচেতন নের চিন্তাই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু মজিদের এক কথা।–তার সব স্বপ্ন নাকি ফলে যায়। এক বার নাকি সে স্বপ্নে দেখিছিল তার ছোট বোন পানি পানি করে চিৎকার করছে, আর সেই বোনটি নাকি ক দিন পরই অ্যাক্সিডিন্টে মারা গেছে। মরবার সময় পানি পানি করে অবিকল যেমন স্বপ্নে দেখেছিল। তেমনি ভঙ্গিতে চেঁচিয়েছে। কী অদ্ভুত যুক্তি!

মৃত্যুর জন্যে ভয় পাওয়াটা একটি ছেলেমানুষী ব্যাপার নয় কি? আমার তাই মনে হয়। যখন সত্যি সত্যি মৃত্যু তার শীতল হাত বাড়াবে, তখন কী করব জানি না, তবে খুব যে একটা বিচলিত হব, তাও মনে হয় না।

তা ছাড়া আমার মৃত্যুতে কারো কিছু আসবে–যাবে না। আমার জন্যে শোক করবার মতো প্রিয়জন কেউ নেশ। লীয়-স্বজনরা চোখের পানি ফেলবে, চেঁচিয়ে কাঁদবে, বন্ধু-বান্ধবরা মুখ কালে; করে বেড়াবে, তবেই না মরে সুখ।

শুনেছি বিলেতে নাকি অনেক ধনী বুড়োবুড়ি বিশেষ এক সংস্থার কাছে টাকা রেখে যায়। এইসব বুড়োবুড়ির কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। সেই বিশেষ সংস্থাটি বুড়োবুড়ির মৃত্যুর পর লোক ভাড়া করে আনে। অদ্ভুত ব্যবস্থা। সত্যি এ-রকম কিছু আছে, না। শুধুই গালগল্প? আমাদের দেশে এ-রকম থাকলে আমিও আগেভাগেই লাক ভাড়া করে আনতাম। তারা সুর করে কাঁদতে বসত–ও জাফর, জাফর র, তুমি কোথায় গেলা রে? এই কথা মনে উঠতেই দেখি হাসি পাচ্ছে। আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। আনিস বলল, কী হয়েছে, এত হাসি–

এমনি হাসছি।

হঠাৎ হাসান আলি ভয়-পাওয়া গলায় বলল, লঞ্চের আওয়াজ আসে।

আমার বুক ধ্বক করে উঠল। তার মানে হচ্ছে, আমিও ভয় পাচ্ছি। সেই ভয়, যা যুক্তি-তর্ক মানে না, হঠাৎ করে এসে আমাদের অভিভূত করে ফেলে। হুমায়ূন ভাই বললেন, নৌকা ভেড়াও হাসান আলি।

ছপ ছপ দাঁড় পড়ছে। আনিস এবং মজিদ দুজনেই দুটি বৈঠা তুলে নিয়েছে। আমরা এখনো লঞ্চের শব্দ শুনি নি, তবে হাসান আলি যখন শুনেছে, তখন আর ভুল নেই।

সাড়াশব্দ শুনে মজিদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে হকচকিয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমি বললাম মজিদ, তোমার শ্বশুর সাহেব আসছেন, উঠে বস।

কে শ্বশুর, কার কথা বলছ?

হুমায়ূন ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তামাশা রাখ, জাফর। হাসান আলি এখনো শুনতে পাচ্ছ?

হাসান আলি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর হাসিমুখে বলল, না, আর শবদ পাই না।

খবর পাওয়া গেছে, এই অঞ্চলে কিছু দিন ধরেই একটি স্পীডবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্ষার পানিতে খালবিলগুলি যেই একটু ভরাট হয়েছে, আমনি নামিয়েছে স্পীডবোট। নৌকা করে আমাদের আরো এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। অবশ্যি রামদিয়া পর্যন্ত কী ভাবে যাব, তা ঠিক করবে। হাসান আলি। আমাদের রাত দুটোর আগে রামদিয়া পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তার। হাসান আলি বলল, হাটাপথে যাওন লাগিব। অল্প কিছু প্যাক-কাদা আছে, কিন্তু উপায় সুর কী!

মজিদ বলল, কিয় মাইল পথ?

আট-নয় মাইল।

আমার শেয়ালের মতো খিদে লেগেছে, হাঁটা মুশকিল।

আনিস বলল, শেয়ালের মতো খিদেটা কী রকম জিনিস?

অর্থাৎ মুরগি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

মজিদ হোহো করে হেসে ফেলল।

নৌকা থেকে বেরিয়ে এসে দেখি চাঁদ ড়ুবে গেছে। কিন্তু খুব পরিষ্কার আকাশ। অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে। নক্ষত্রের আলোয় আবছাভাবে সব নজরে আসে। আনিস বলল, দশ মাইল হাঁটা সহজ কর্ম না। হুমায়ূন ভাই অনুমতি দিলে আরেক দফা চা হোক, কী বলেন?

বেশ তো, চা চড়াও।

হাসান আলি, আদা আছে তোমার কাছে? একটু আদা–চা হোক, গলাটা খুসখুসি করছে। জাফর, তুমিও খাবে নাকি হাফ কাপ?

না, চা খেলে ঘুম হয় না। আমার।

ঘুমুবার অবসরটা পাচ্ছ কই?

ঘুমুবার অবসর সত্যি নেই। তবু অভ্যেসটা তো আছে। হুমায়ূন ভাই দেখি নৌকার ছাদে উঠে বসেছেন। গুনগুন করছেন নিজ মনে। কোন গানটা টিউন করছেন, কে জানে। ঠিক ধরতে পারছি না। আহে, চমৎকার লাগছে। আড়াল থেকে শুনতে বেশ লাগে। অনুরোধ করতে গেলেই সেরেছে। গাইবেন না কিছুতেই। তাঁর কাছ থেকে গান শোনবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, এমন একটা ভাব দেখান যে, তিনি কী করছেন তার দিকে তোমার একটুও নজর নেই। হ্যাঁ, এইবার গান শোনা যাচ্ছে–

শ্যামল ছায়ায় নাই-বা গেলে
না না না নাই-বা গেলে

না না বলবার সময় বেশ কায়দা করে গলা ভাঙছে তো! শুনতে খুব ভালো লাগছে। শান্ত হয়ে আছে বিল। বিলের পানি দেখাচ্ছে কালো আয়নার মতো। কালো আয়নাটা আবার কী? কি জানি কী। তবে কালো আয়নার কথা মনে হয়। আকাশে অসংখ্যা তারা উঠেছে। তারাগুলির জলে ছায়া পড়া উচিত। কী আশ্চর্য, ছায়া পড়ছে না তো! আকাশে যখন খুব তারা ওঠে, তখন নাকি দেশে আকাল আসে। মজিদ বলল, সাংঘাতিক খিদে লেগেছে। খালি পেটে চা খাওয়াটা কি ঠিক?

হুমায়ূন ভাই গান থামিয়ে বললেন, খালি পেটে চা না খেতে চাইলে গোটা দুই ডিগবাজি খেয়ে নাও মজিদ। এ ছাড়া আর কোনো খাদ্যদ্রব্য নেই।

আনিস আবার এই শুনেই ফ্যাফ্যা করে হাসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে এত হাসির কী আছে? হুমায়ূন ভাই আবার গুনগুন শুরু করেছেন। তাঁর বোধহয় মন –টন বিশেষ ভালো নেই। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন না। এমনি তিনি অবশ্যি শুধু! ফুর্তিবাজ ছেলে। আমার উপর রাগ করেছেন কি?

আজ ভোরে তাঁর সঙ্গে আমার খানিকটা মন কষাকষি হয়েছে। বিস্তু আমি অন্যায় কিছু বলি নি। শুধু বলেছি, মেথিকান্দার এ অপারেশনের দায়িত্ব হুঁমায়ূন ভাইয়ের নিয়ে কাজ নেই। এতে কী মনে করেছেন তিনি? তাঁর প্রতি আস্থা মই আমার? তিনি ঠিকই মনে করেছেন। এমন দুর্বল লোকের এ-রকম, এ্যাসাইনমেন্টের নেতৃত্ব পাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের সাব-সেক্টরে সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড কী মনে করে এটা করলেন কে জানে!

দালাল হাজী মারার ব্যাপারটাই দেখি না কেন। এই লোক কম করে হলেও গোটা ত্ৰিশেক মানুষ মারিয়েছে। হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে একাকার করেছে। মিলিটারি ক্যাপ্টেনের পিছে পিছে কুকুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। সে যখন হলদিয়ার বাজারে ধরা পড়ল আমাদের হাতে, আমি বললাম, গাছের সঙ্গে বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে শেষ করে দি। গ্রামের লোকদের একটা শিক্ষা হোক, ভবিষ্যতে আর কেউ দালালী করবার সাহস পাবে না। হুমায়ূন ভাই মাথা নাড়েন। ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চান এ্যারেক্ট করে। পাগল নাকি! সেই শেষ পর্যন্ত গুলী করে মারতে হল। হুমায়ূন ভাই সেই দৃশ্যও দেখবেন না। তিনি নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আরে বাবা, তুমি তো মেয়েমানুষ নও। নাচতে নেমেছ, এখন আবার ঘোমটা কিসের? You have to be cruel, only to be kind—আবু ভাই বলতেন সব সময়। আহ, মানুষের মতো মানুষ ছিলেন আবু ভাই। আবু ভাইয়ের লাশ নিয়ে যখন আসল, তখন বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর পায়ে চুমু খাই। আবু ভাইয়ের মতো মানুষগুলি এত অল্প আয়ু নিয়ে আসে কেন? যুদ্ধ শেষ হলে আবু ভাইয়ের মেয়েটিকে দেখতে যাব। তাকে কোলে নিয়ে বলব–। কী বলব তাকে?

হুমায়ূন ভাই দেখি উত্তেজিত হয়ে নেমে আসছেন। ছাদ থেকে। কী ব্যাপার, মোটর লঞ্চের আলো দেখা যায় নাকি? আনিস চা ছাকতে ছাকতে বলল, কী ব্যাপার হুমায়ূন ভাই?

কিছু না। অনেকগুলি উল্কাপাত হল। একটা তো প্রকাণ্ড!

উল্কাপাত শুনেছি খুব অশুভ ব্যাপার। আমার মা বলতেন অন্য কথা। তিনি নাকি কোথায় শুনেছেন উল্কাপাতের সময় কেউ যদি তার গোপন ইচ্ছাটি সশব্দে বলে ফেলে, তাহলে সে ইচ্ছা পূৰ্ণ হয়। এক মজার কাণ্ড হল এক দিন। জ্যামিতি বই হারিয়ে ফেলেছি। সন্ধ্যাবেল বসে আছি বারান্দায়। আকাশের দিকে চোখ। উল্কাপাত হতে দেখলেই বলব, জ্যামিতি বইটা যেন পাই।

কোথায় গেল সে-সব দিন। মায়ের মুখ আর মনেই পড়ে না। এক দিন কথায় কথায় অবনী স্যার আমাদের ক্লাসে বললেন, যে-সব ছেলের মনে মায়ের চেহারার কোনো স্মৃতি নেই, তারা হল সবচে অভাগা। আমি চোখ বুজে ক্লাসের ভেতরেই স্বায়ের চেহারা মনে আনতে চেষ্টা করলাম। একটুও মনে পড়ল না। সেই যে পড়ল না, পড়লাই না। এখনো পড়ে না। স্বপ্নেও যে এক-আধা দিন দেখব, সে উপায়ও নেই। আমার ঘুম এমন গাঢ়-স্বপ্নটপ্লের বালাই নেই। দূর ছাই!

নেমে পড়েছে সবাই। ওরে বাবা রে, কী কাদা! কোমর পর্যন্ত তলিয়ে যাবার দাখিল! হাসান আলি আরেকটু হলে গুলীর বাক্স নিয়ে নদীতে পড়ত। লাইটমেশিনগানটা সবাই মিলে চাপিয়েছে আমার কাঁধে। নামেই লাইট, আসলে মেলা ওজন। আকাশে গুডগুড মেঘ ডাকছে আবার। বৃষ্টি নামলেই গেছি।–মজিদের ভাষায় একেবারে পাটেটো চিপস হয়ে যাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *