০১. আপনি কি ভূত দেখেছেন

‘আপনি কি ভূত দেখেছেন স্যার? ইংরেজিতে যাকে বলে spirit, ghost, astral body মানে প্রেতাত্মার কথা বলছি, অশরীরী……..’

মিসির আলি প্রশ্নটির জবাব দেবেন কি না বুঝতে পারছেন না। কিছু মানুষ আছে যারা প্রশ্ন করে, কিন্তু জবাব শুনতে চায় না। প্রশ্ন করেই হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। কথার ফাঁকে-ফাঁকে আবার প্রশ্ন করে, আবার নিজেই জবাব দেয়। মিসির আলির কাছে মনে হচ্ছে তাঁর সামনের চেয়ারে বসে থাকা এই মানুষটি সেই প্রকৃতির। ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক। গোলাকার মুখে পুরুষ্ট গোঁফ। কুস্তিগির-কুস্তিগির চেহারা। কথার মাঝখানে হাসার অভ্যাস আছে। হাসার সময় কোনো শব্দ হয় না, কিন্তু সারা শরীর দুলতে থাকে। ওসমান গনি নামের এই মানুষটির প্রধান বৈশিষ্ট্য অবশ্য নিঃশব্দে হাসার ক্ষমতা নয়; প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর নিচের পাটির একটি এবং ওপরের পাটির দু’টি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। যে-যুগে রুট ক্যানালিং-এর মতো আধুনিক দন্ত চিকিৎসা শুরু হয়েছে, সে-যুগে কেউ সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধায় না। এই ভদ্রলোক বাঁধিয়েছেন। ধবধবে সাদা দাঁতের মাঝে ঝকঝকে তিনটি সোনালি দাঁত।

‘কথা বলছেন না কেন স্যার, ভূত কি কখনো দেখেছেন?’

‘জ্বি না।’

‘না-দেখাই ভালো। আমি একবার দেখেছিলাম, এতেই অবস্থা কাহিল। ঘাম দিয়ে জ্বর এসে গিয়েছিল। এক সপ্তাহের উপর ছিল জ্বর। পায়ের পাতা চুলকাত। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল—অ্যালার্জি। ডাক্তারদের কারবার দেখুন, আমি বললাম, ভূত দেখে জ্বর এসে গেছে। তার পরেও ডাক্তার বলে অ্যালার্জি। অ্যান্টি হিস্টামিন দিয়েছিল। অ্যান্টি হিস্টামিন কি ভূতের অষুধ, আপনি বলুন?’

মিসির আলি বললেন, ‘আজ আমার একটু কাজ ছিল। বাইরে যাব। আপনি বরং অন্য একদিন আসুন, আপনার গল্প শুনব।’

‘দশ মিনিট লাগবে স্যার। ভূতের গল্পটা বলেই চলে যাব। আমার সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস আছে, আপনি যেখানে যেতে চান আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। রিকন্ডিশান্ড মাইক্রোবাস। গত আগস্ট মাসে কিনেছি। দু’ লাখ পঁচিশ নিয়েছে।’

মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনি কি খুব অল্পকথায় আপনার ভূত দেখার গল্প বলতে পারবেন? যদি পারেন তাহলে বলুন, গল্প শুনব। খুব যে আগ্রহ নিয়ে শুনব তা না। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা ভূতের গল্প খুব আগ্রহ করে শোনে। আমার বয়স একান্ন। তার চেয়েও বড় কথা ভূত-প্রেতের ব্যাপারে আমার উৎসাহ কম।

‘আমারো কম। খুবই কম। গল্পটা বলে চলে যাই স্যার।’

‘আচ্ছা বলুন। আপনি কি এই গল্প শোনাতেই এসেছেন?’

‘দ্যাটস কারেক্ট স্যার। আপনার ঠিকানা পেয়েছি আমার ভাগ্নির কাছ থেকে। সে বইটই পড়ে। বই পড়ে তার ধারণা হয়েছে আপনি দারুণ বুদ্ধিমান। অনেক বড় বড় সমস্যা নাকি সমাধান করেছেন। তখন ভাবলাম, যাই, ভদ্রলোককে দেখে আসি বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ। গাধা টাইপের লোকের সঙ্গেও অবশ্যি কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। যাদের বুদ্ধি মাঝামাঝি, এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো আনন্দ নেই। আমি আসায় বিরক্ত হন নি তো?’

‘না, বিরক্ত হই নি। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে?’

‘না, কোনো সমস্যা নেই। প্রথম দিন ভূত দু’টাকে দেখে ভয় পেয়ে জ্বর হয়েছিল। এখন আর হয় না।’

‘প্রায়ই দেখেন?’

‘জ্বি-না। প্রায়ই দেখি না। ধরেন মাসে, দু’মাসে একবার।’

‘এরা আপনাকে ভয় দেখায়?’

‘না, ভয় দেখায় না। গল্পটা তাহলে বলি—’

‘সংক্ষেপ করে বলুন, আমার এক জায়গায় যেতে হবে।’

‘আপনি স্যার কোনো চিন্তা করবেন না। আমার মাইক্রোবাস আছে। গত আগস্ট মাসে কিনেছি। নাইনটিন এইটি মডেল……’

‘মাইক্রোবাসের কথা আগে একবার শুনেছি। ভূতের কথা কি বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।’

‘ও হ্যাঁ—আমার হচ্ছে স্যার বিরাট ফ্যামিলি। পাঁচ মেয়ে। সব ক’টার চেহারা খারাপ। মা’র মতো মোটা, কালো, দাঁত উঁচু। একটারও বিয়ে হয় নি। এদিকে আবার আমার ছোট বোনটি মারা গেছে—তার তিন মেয়ে এক ছেলে উঠে এসেছে আমার বাড়িতে। গোদের উপর বিষফোঁড়া। আমার মা, এক খালাও সঙ্গে থাকেন। বাড়িভর্তি মেয়ে। একগাদা মেয়ে থাকলে যা হয়, দিন-রাত ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় ভিসিআর। রোজ রাতে এরা দু’টা করে ছবি দেখে। আমার মা চোখে কিছুই দেখেন না, তিনিও ভিসিআর-এর সামনে বসে থাকেন। শব্দ শোনেন। শব্দ শুনেই হাসেন—কাঁদেন। গলার আওয়াজ শুনে বলতে পারেন কে শ্রীদেবী, কে রেখা। এই হল স্যার বাড়ির অবস্থা।’

মিসির আলি হতাশ গলায় বলেন, ‘আপনি মূল গল্পটা বলুন। আপনি অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলছেন।’

‘মূল গল্পটা তাহলে বলি। বাড়ির মেয়েগুলির যন্ত্রণায় আমি রাতে ঘুমাই ছাদের চিলেকোঠায়। ছোট্ট ঘর। খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে, শুধু বাথরুম নেই—এই একটা অসুবিধা। আমার আবার ডায়াবেটিস আছে, কয়েকবার প্রস্রাব করতে হয়। ছাদে প্রস্রাব করি। কাজের ছেলেটা সকালে এক বালতি পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। কাজের ছেলেটার নাম হল ইয়াসিন।’

‘প্লীজ, গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করুন।’

‘জ্বি স্যার, শেষ করছি। গত বৎসর চৈত্র মাসের ছয় তারিখের কথা। রাতে ঘুমাচ্ছি, প্রস্রাবের বেগ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্প ছিল। টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম। তখনি দেখি ঘরের কোণায় দু’টা ভূত। খুব ছোট সাইজ, লম্বায় এই ধরেন এক ফুটের মতো হবে। গজ-ফিতা দিয়ে মাপি নি। চোখের আন্দাজ। দু’-এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হতে পারে।’

‘তারা করছে কী?’

‘বই নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। একজনের হাতে সবুজ মলাটের ময়লা একটা বই, অন্যজন সেই বই কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। খিচ-খিচ, খিচ-খিচ করে কথা বলছে। আমি ওদের দিকে তাকাতেই কথা বন্ধ করে ফেলল। আমি তখনো ভয় পাই নি। কারণ হঠাৎ ঘুম ভেঙেছে তো, এরা যে ভূত এইটাই বুঝি নি। কাজেই ধমকের মতো বললাম, ‘এ্যাই, এ্যাই।’

‘তখন কী হল?’

‘ধমক শুনে হাত থেকে বই ফেলে দিল। তারপর মিলিয়ে গেল। তখন বুঝলাম, এরা ভূত। ছোট সাইজের ভূত। তখন ভয় লাগল। জ্বর এসে গেল।’

‘এই আপনার গল্প?’

‘জ্বি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন এখন উঠি।’

‘ইন্টারেস্টিং লাগছে না স্যার?’

‘জ্বি, ইন্টারেস্টিং।’

‘ভূত এত ছোট সাইজের হয়, তা-ই জানতাম না। একটার আবার থুতনিতে অল্প দাড়ি, ছাগলা দাড়ি।’

‘আসুন, আমরা উঠি।’

ওসমান গনি উঠলেন। মনে হল খুব অনিচ্ছায় উঠলেন। তাঁর আরো কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছা ছিল। মিসির আলি ঘরে তালা দিতে-দিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ওসমান গনির কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে—এই লোক তার ‘ছোট ভূতের গল্প বলার জন্য বারবার আসবে। নানানভাবে তাঁকে বিরক্ত করবে। একদল মানুষ আছে, যারা অন্যদের বিরক্ত করে আনন্দ পায়। ইনিও মনে হচ্ছে সেই দলের।

‘স্যার।’

‘বলুন।’

‘ভূতদের ঐ বইটা ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছি।’

‘খুব ভালো করেছেন। এই বই তালাবন্ধ থাকাই ভালো।’

‘একদিন আপনাকে দেখাতে নিয়ে আসব।’

‘কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের বইয়ে আমার আগ্রহ আছে। ভূতের বইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ নেই।

‘আমারও নেই। এই জন্যে ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছি। উল্টেও দেখি নি। তার উপর স্যার বইটা থেকে দুর্গন্ধ আসে। গো-মূত্রের গন্ধের মতো গন্ধ।

ভদ্রলোক আনন্দিত ভঙ্গিতে হাসলেন। মনে হচ্ছে বইটি থেকে গো-মূত্রের গন্ধ আসায় তিনি আনন্দিত। মিসির আলি মনে বিরক্তি চেপে রাখতে পারলেন না। কঠিন গলায় বললেন, ‘চলুন রওনা হওয়া যাক। আমার জরুরি কাজ আছে।’

‘জ্বি আচ্ছা। কাজের সঙ্গে আপোস নাই। আগে কাজ, তারপর অন্য কথা। আমি তাহলে কাল আসি?’

‘কাল আসার কি দরকার আছে?’

‘দরকার আছে স্যার। ভূতের গল্পটা ভালোমতো বলা হয় নাই। ওরা আমার সঙ্গে কী-সব কথাবার্তা বলে—একটা আছে ফাজিল ধরনের, আমাকে ডাকে ছোট মামা।’

‘ভাই শুনুন, আমার কাছে আসার আর দরকার নেই। আমি নিজে অসুস্থ। বিশ্রাম করছি।’

‘আপনি তো স্যার বিশ্রামই করবেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকবেন। আমি পাশে বসে গল্প বলব—’

‘আপনি দয়া করে আর আসবেন না। আমি একা-একা বিশ্রাম করতে পছন্দ করি।’

‘জ্বি আচ্ছা, আসব না। শুধু যদি স্যার আমাকে একটা উপদেশ দেন। কাগজে লিখে দেন, তাহলে খুব ভালো। উপদেশটা মানিব্যাগে রেখে দেব।’

মিসির আলি হতভম্ব গলায় বললেন, ‘কী উপদেশ?

‘লিখবেন—’ওসমান গনি, আপনার মৃত্যু হবে পানিতে ডুবে। খুব সাবধান। খুব সাবধান।’ এই লিখে আপনার নামটা সই করবেন।’

‘আমি আপনার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। এ-সব কথা আমি কেন লিখব?’

‘অকারণে লিখতে বলছি না স্যার। কারণ আছে। যে-ভূতটা আমাকে ছোট মামা ডাকে, সে আমাকে বলেছে—আমার মৃত্যু হবে পানিতে ডুবে। আমাকে সাবধান করে দিয়েছে। ভূতের কথা কে বিশ্বাস করে বলেন? কেউ বিশ্বাস করে না। আমিও করি না। এখন যদি আপনি দয়াপরবশ হয়ে লিখে দেন—’

‘দেখুন ওসমান গনি সাহেব—এ-জাতীয় কথা আমি কখনো লিখব না। চলুন, আমরা ঘর থেকে বের হই। আকাশের অবস্থা ভালো না—ঝড়-বৃষ্টি হবে।’

‘লেখাটা না দিলে আমি স্যার যাব না। লিখে দিলে আর কোনোদিন এসে বিরক্ত করব না। আমি স্যার এককথার মানুষ। মানিব্যাগটা খুললেই আপনার লেখাটা চোখে পড়বে। তখন সাবধান হয়ে যাব। পানির ধারেকাছে যাব না।’

‘এটা লিখে দিলে আপনি চলে যাবেন?’

‘জ্বি।’

‘আর কোনোদিন আসবেন না?’

‘বললাম তো স্যার, আমি এককথার মানুষ।’

‘বেশ, বসুন। লিখে দিচ্ছি।’

‘চা খেতে ইচ্ছা করছে। চিনি ছাড়া এক কাপ চা কি হবে?’

‘চা হবে না।’

‘আপনার কি প্যাড আছে স্যার? প্যাডে লিখে দিলে ভালো হয়।’

‘না, আমার প্যাড নেই।’

‘তাহলে নাম সই করে ঠিকানা লিখে দেবেন। আর টেলিফোন নাম্বার, যদি টেলিফোন থাকে।’

‘ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। টেলিফোন নেই।’

টেলিফোন না-থাকাই ভালো। বড়ই যন্ত্রণা। এমন সব আজেবাজে টেলিফোন আসে! এই পর্যন্ত আছাড় দিয়ে আমি ক’টা টেলিফোন ভেঙেছি বলুন তো স্যার?’

মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই নিন আপনার কাগজ। এখন চলুন, যাওয়া যাক। দয়া করে আবার এসে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’

‘স্যার থ্যাংকস। খুব উপকার করেছেন।

ওসমান গনি রাস্তায় নেমে বিস্মিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। কোনো মাইক্রোবাস দেখা যাচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, ‘আপনার মাইক্রোবাস কোথায়?’ ওসমান গনি খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘নতুন ড্রাইভার। বাস নিয়ে পালিয়ে গেছে বোধহয়। আপনি কী বলেন স্যার?’

মিসির আলি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। যে-চায়ের দোকানের সামনে মাইক্রোবাসটি দাঁড়িয়ে ছিল, সেই চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করা হল। সে বলল, তার দোকানের সামনে কখনোই কোনো মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে ছিল না।

ওসমান গনি চিন্তিত গলায় বললেন, ‘বিরাট সমস্যা হয়ে গেল। আমি এখন বাসায় যাব কী করে? আমার তো বাসার ঠিকানা মনে নেই।’

‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। বাসার ঠিকানা মনে নেই মানে?’

‘আমার কিছু মনে থাকে না। ও, আচ্ছা আচ্ছা, নোটবুকে ঠিকানা লেখা আছে। স্যার, আপনি আমাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিন। আর নোটবই দেখে ঠিকানাটা রিকশাওয়ালাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিন। কী যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম দেখুন তো!’

মিসির আলি নোটবই খুললেন। সেখানে প্রথমে বাংলা এবং পরে ইংরেজিতে লেখা—

‘ইনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
দয়া করে তাঁকে সাহায্য করুন। তাঁর বাসার ঠিকানা………….’

‘স্যার, ঠিকানাটা লেখা আছে না?’

‘আছে।’

‘পরের পৃষ্ঠায় ডায়াগ্রাম আছে। ডায়াগ্রাম দেখে রিকশাওয়ালাকে বুঝিয়ে দিন, ও নিয়ে যাবে।’

মিসির আলি নোটবই হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ-জাতীয় ঝামেলায় তিনি আগে পড়েন নি। ওসমাস গনি নিজেই রিকশা ডেকে আনলেন। তাঁকে বেশ উৎফুল্ল মনে হল। মিসির আলি রিকশাওয়ালাকে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে যেতে হবে। ওসমান গনি বললেন, ‘স্যার, তাহলে যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। কারো সঙ্গে কথা বলে আজকাল আরাম পাই না। এই জন্যেই ছাদের ঘরে একা-একা থাকি। বড় ভালো লাগল স্যার। তবে সব ভালো দিকের যেমন মন্দ দিক আছে—এটারও আছে। মাইক্রোবাসটা চুরি হয়ে গেল। বাসায় ফিরেও শান্তি নেই। থানা-পুলিশ করতে হবে।’

মিসির আলি বললেন, ‘আমি কি আসব আপনার সঙ্গে?’

ওসমান গনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না না না। কোনো প্রয়োজন নেই। এ-রকম আগেও হয়েছে, রিকশা করে চলে গেছি। আচ্ছা স্যার, যাই। আপনিও বাসায় চলে যান। রাত অনেক হয়ে গেছে। এত রাতে কোথাও যাওয়া ঠিক না। তা ছাড়া আমার মনে হয় আপনার আসলে কোথাও যাবারও কথা না। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্য বলেছেন—’কাজ আছে।’ বুদ্ধিমান লোকেরা এ-রকম করে। আপনি স্যার আসলেই বুদ্ধিমান।’ ওসমান গনি নিঃশব্দে গা দুলিয়ে হাসতে লাগলেন।

.

মিসির আলি ঘরে ফিরলেন খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে। বিভ্রান্তির অনেকগুলি কারণ। প্ৰথম কারণ—ওসমান গনিকে মানসিক রুগী বলে মনে হচ্ছে না। যে-মানুষ খুঁজে খুঁজে তার ঠিকানা বের করতে পারে, সে নোট বইয়ে লেখা পড়ে বাসায় ফিরে যেতে পারে না, তা হয় না।

লোকটি যে পাগল সাজার ভান করছে তাও না। যে ভান করবে, সে সারাক্ষণই করবে। আসল পাগলের চেয়ে নকল পাগল অনেক বেশি পাগলামি করে। মিসির আলি যে তাকে বিদেয় করবার জন্যে বলছেন-’তাঁর কাজ আছে’, এই ব্যাপারটি ওসমান গনির কাছে ধরা পড়েছে। নকল পাগল হলে তা সে কখনো স্বীকার করত না। চেপে যেত। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? রাতে ঘুমুতে যাবার সময় মিসির আলি বালিশের কাছে রাখা খাতায় পেনসিলে অস্পষ্টভাবে লিখলেন—

নাম : ওসমান গনি।

বয়স : পঞ্চাশের কাছাকাছি।

বিশেষত্ব : তিনটি সোনাবাঁধানো দাঁত। হাসেন কোনো রকম শব্দ না করে।

(১) কেন এসেছিলেন? বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

(২) অন্যরা দাবি করছে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি নিজে দাবি করছেন না।

(৩) তবে তিনি যে ভৌতিক গল্পের কথা বলছেন, তা মানসিক অসুস্থতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

(৪) লোকটি বিত্তবান বলেই মনে হল। কারণ তিনি যে-তেতলা বাড়ির কথা বললেন, সেই বাড়িটি তাঁর হওয়ারই সম্ভাবনা। নোটবইয়ের ঠিকানায় গুলশানের কথা লেখা। গুলশান বিত্তবানদের এলাকা।

(৫) ভদ্রলোকের হাতে পাথর-বসানো তিনটি আঙটি, ব্যবসায়ীরা সাধারণত পাথর-টাথরে বিশ্বাসী হয়। তিনি সম্ভবত একজন ব্যবসায়ী।

রাত এগারটা পাঁচ মিনিটে মিসির আলি বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন। কঠিন নিয়মে তিনি এখন নিজেকে বাঁধার চেষ্টা করছেন। ঘুম আসুক না-আসুক, রাত এগারটা বাজতেই বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়বেন। ঘুম আনানোর যে-সব প্রক্রিয়া আছে সেগুলি প্রয়োগ করবেন। তার পরেও যদি ঘুম না আসে কোনো ক্ষতি নেই। বিছানায় গড়াগড়ি করবেন। উঠবেন ভোর পাঁচটায়। ঘুম পাড়িয়ে দেবার কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি, কিন্তু ঘুম ভাঙানোর যন্ত্র আছে। তিনি দু’ শ’ ত্রিশ টাকা দিয়ে একটি অ্যালার্ম—ঘড়ি কিনেছেন। এই ঘড়ি ভোর পাঁচটায় এমন হৈচৈ শুরু করে যে, কার সাধ্য বিছানায় শুয়ে থাকে! বিজ্ঞানের এই সাফল্যের দিনে ঘুম আনার যন্ত্র বের হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অ্যালার্ম-ঘড়ি যে-হারে বিক্রি হয়, ঘুম-ঘড়িও সেই হারে বিক্রি হবে।

ঘুম আনানোর প্রক্রিয়াগুলি কাজ করছে না। মিসির আলি সাত শ’ ভেড়া গুনলেন। এই গুণন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের ক্লান্ত হয়ে যাবার কথা। ক্লান্ত হবার পরিবর্তে মস্তিষ্ক আরো উত্তেজিত হল। মনে-মনে গল্প বললেও নাকি ঘুম আসে। গল্প বলার সময় ভাবতে হয়, এক দল ঘুম-ঘুম চোখের শিশুরা গল্প শুনছে। মিসির আলি গল্প শুরু করলেন। সব গল্প শুরু হয় এইভাবে—এক দেশে ছিল এক রাজা। তাঁর গল্পটা একটু অন্য রকম হল—এক দেশে ছিল এক রানী। রানীর দুই রাজা। সুয়োরাজা এবং দুয়োরাজা। সুয়োরাজাটা বড়ই ভালো………।

কল্পনার শিশুদের একজন প্রশ্ন করল, ‘সুয়োরাজার নাম কি?’

‘সুয়োরাজার নাম হচ্ছে ওসমান গনি। মোটাসোটা একজন মানুষ, পঞ্চাশের মতো বয়স। হাতে তিনটা আঙটি। এর মধ্যে একটা আঙটি হচ্ছে নীলার। সুয়োরাজার তিনটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো…….’

কল্পনার শিশুটি বলল, ‘এ আবার কেমন রাজা?’

মিসির আলি বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। বাতি জ্বালালেন না, অন্ধকারেই বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে পানি ঢাললেন। বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন, যদিও তাঁর বর্তমান নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পদ্ধতিতে রাত এগারটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কোনো সিগারেট খাবার ব্যবস্থা নেই। তিনি একধরনের অস্বস্তি বোধ করছেন, একধরনের বিভ্রান্তি—যা ওসমান গনি নামের মানুষটি তৈরি করে গেছেন। মাথা থেকে বিভ্রান্তি তাড়াতে পারছেন না। স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে। বারান্দায় প্রচুর হাওয়া, আকাশ মেঘলা। শ্রাবণের ধারাবর্ষণ সম্ভবত শুরু হবে। তাঁর শীত-শীত লাগছে। জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সিগারেট পুড়তে পুড়তে একসময় তাঁর হাতেই নিভে গেল। তাঁর ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। দু’ শ’ ত্ৰিশ টাকায় কেনা অ্যালার্ম-ঘড়ি তাঁকে যথাসময়ে ডেকে তুলল।

তিনি হাতমুখ ধুলেন। কেরোসিন কুকারে চা বানিয়ে খেলেন। খানিকক্ষণ ফ্রী—হ্যান্ড একসারসাইজ করলেন। এও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পদ্ধতির অংশ। ডাক্তার বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন। পাথরের মতো মুখ করে বলেছেন, ‘মিসির আলি সাহেব, আপনার শরীরের কলকব্জা সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এটা কি আপনি জানেন?’

মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘জানি।’

‘আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে চান, না এখনি মরে যেতে চান?’

‘অল্প কিছুদিন বাঁচতে চাই।’

‘কতদিন?’

‘এই ধরুন এক বৎসর।’

মিসির আলি ভেবেছিলেন ডাক্তার বলবেন, এক বৎসর কেন? ডাক্তার সে-প্রশ্ন করলেন না, খসখস করে প্রেসক্রিপশনে একগাদা কথা লিখতে লাগলেন।

ভোরবেলা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে পনের মিনিট ফ্রী-হ্যান্ড একসারসাইজ হচ্ছে তার একটি। একসারসাইজের পর এক ঘন্টা প্রাতঃভ্রমণের ব্যাপার আছে। ডাক্তার সাহেব লিখে দিয়েছেন—ঝড় হোক, টাইফুন হোক, ভূমিকম্প হোক—এক ঘন্টা হাঁটতেই হবে।

এখন ঝড়, টাইফুন বা ভূমিকম্প কোনোটাই হচ্ছে না। টিপটিপ করে বৃষ্টি অবশ্যি পড়ছে। সেই বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বের হওয়া যায়। ছাতা মাথায় প্রাতঃভ্রমণ মন্দ নয়। সকালবেলা এই বেড়ানোটা তাঁর খারাপ লাগে না। বিচিত্র সব চরিত্র দেখা যায়। একদল মানুষ প্রাতঃভ্রমণকে প্রায় উপাসনার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। উপাসনার যেমন কিছু নিয়ম আছে, এদেরও আছে। আরেক দল আছে ‘খাদক’ জাতীয়। ভ্রমণের এক পর্যায়ে বিশাল টিফিন-ক্যারিয়ার খুলে হাউহাউ করে পরোটা-গোস্ত যেভাবে গিলতে থাকেন, তাতে মনে হয় তাঁদের সৃষ্টি করা হয়েছে খোলা মাঠে বসে গোস্ত-পরোটা খাবার জন্যে।

মিসির আলি বেরুবার মুখে বাধা পেলেন। গেটের কাছে আসতেই ত্ৰিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসী এক ভদ্রলোক এসে শীতল গলায় বললেন, ‘আপনি কি বেরুচ্ছেন?’

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’

‘কাল রাতে ওসমান গনি নামের কেউ কি আপনার কাছে এসেছিলেন?’

‘এসেছিলেন।’

‘ঐ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলব। আমি পুলিশের লোক। ইন্সপেক্টর অব পুলিশ। আমার নাম রকিবউদ্দিন।’

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, ‘ওসমান গনি কি মারা গেছেন?’

‘হ্যাঁ, মারা গেছেন। আপনি কী করে জানলেন?’

‘অনুমান করেছি। আমার অনুমানশক্তি ভালো।

‘অনুমানশক্তি ভালো থাকাই ভালো। আসুন, কথা বলি। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হোম মিনিস্টার নিজেই ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন। বেশিক্ষণ আমি আপনাকে বিরক্ত করব না। প্রাথমিকভাবে আধ ঘন্টার মতো কথা বলব। পরে আবার আসব।’

‘রকিবউদ্দিন সাহেব, এখন তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। এখন মর্নিং—ওয়াকে যাচ্ছি। এক ঘন্টা মর্নিং-ওয়াক করব। আপনাকে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।’

‘এক ঘন্টা অপেক্ষা করা সম্ভব নয়, আপনাকে এক্ষুণি কথা বলতে হবে।’

‘এমন কোনো আইন কি আপনাদের আছে যে পুলিশ যখন কথা বলতে চাইবে তখনি কথা বলতে হবে?’

‘আইনের বিষয় নয়, হোম মিনিস্টার নিজে বলেছেন। তিনি বিষয়টায় খুব আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’

‘আমি এই মুহূর্তে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কাজেই আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি আমার ঘরের চাবি দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আমার ঘরে অপেক্ষা করতে পারেন। তবে আপনার যদি ধারণা হয় আমি পালিয়ে যেতে পারি, তাহলে আপনি আমার সঙ্গেও আসতে পারেন।’

‘ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করব। আপনি দেরি করবেন না। দিন, ঘরের চাবি দিন।’

মিসির আলি চাবি দিয়ে গেট খুলে রওনা হলেন। রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে একবার পিছনে ফিরলেন। ইন্সপেক্টর সাহেব আগের জায়গায় চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোকের মুখ শ্রাবণ মাসের আকাশের চেয়েও মেঘলা।

বৃষ্টি জোরেসোরে পড়া শুরু করেছে। রাস্তায় নোংরা পানি। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ময়লা পানিতে ডুবিয়ে প্রাতঃভ্রমণে যাবার কোনো মানে হয় না—তবু মিসির আলি যাচ্ছেন। ঝড় হোক, টাইফুন হোক, ভূমিকম্প হোক—তাঁকে এক ঘন্টা হাঁটতে হবে। সকালের খোলা হাওয়া গায়ে লাগাতে হবে। এক বৎসর তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। দেখা যাক, ডাক্তারের উপদেশ মেনে কতদূর কি হয়।

আজ শরীর অন্যদিনের চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে। চোখ জ্বালা করছে, কোনো কিছুর দিকেই বেশি সময় তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হতে শুরু করেছে। শুধু শরীর নয়—মনও নষ্ট হতে শুরু করেছে। ওসমান গনির মৃত্যুসংবাদ তাঁকে বিচলিত করে নি। করা উচিত ছিল। খ্রিস্টানরা মৃত্যুসংবাদে গির্জায় ঢং-ঢং করে ঘন্টা বাজায়। নিয়মটা সুন্দর। সবাইকে জানিয়ে দেয়া—শোন, তোমরা শোন।! তোমাদের একজন চলে গিয়েছে—ঢং ঢং ঢং……

‘কেমন আছেন মিসির আলি সাহেব?’

মিসির আলি তাকালেন-অপরিচিত একজন মানুষ। অপরিচিত মানুষদের প্রশ্নের জবাব খুব অল্প কথায় দিতে হয়, কিন্তু মিসির আলি একটি দীর্ঘ বাক্য বললেন, ‘আমি ভালো না। শরীর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—মনও নষ্ট হচ্ছে। অপেক্ষা করছি ঘন্টার জন্যে, ঢং ঢং ঢং। ভাই যাই।’

অপরিচিত ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি এতটা অবাক হচ্ছেন কেন তাও মিসির আলি ধরতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *