আদিপর্ব
।। অনুক্রমণিকা-ও পর্বসংগ্রহ-পর্বাধ্যায়।।
১। শৌনকের আশ্রমে সৌতি
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয়মুদীরয়েৎ ৷৷
-নারায়ণ, নরোত্তম নর (১) ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করে তার পর জয় উচ্চারণ করবে (২)।
কুলপতি মহর্ষি শৌনক নৈমিষারণ্যে দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞ করছিলেন। একদিন লোমহর্ষণের পুত্র পুরাণকথক সৌতি (৩) সেখানে বিনীতভাবে উপস্থিত হলেন। আশ্রমের মুনিরা তাকে প্রশ্ন করলেন, সৌতি, তুমি এখন কোথা থেকে আসছ, এতকাল কোথায় ছিলে ? সৌতি উত্তর দিলেন, আমি রাজর্ষি জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে ছিলাম, সেখানে কৃষ্ণদ্বৈপায়নরচিত বিচিত্র মহাভারতকথা বৈশম্পায়নের মুখে শুনেছি। তার পর বহু তীর্থে ভ্রমণ করে সমস্তপঞ্চক দেশে যাই, যেখানে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল। এখন আপনাদের দর্শন করতে এখানে এসেছি। দ্বিজগণ, আপনারা যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শুচি হয়ে সুখে উপবিষ্ট রয়েছেন, আমার কাছে কি শুনতে ইচ্ছা করেন আদেশ করুন—পবিত্র পুরাণকথা, না মহাত্মা নরপতি ও ঋষিগণের ইতিহাস? ঋষিরা বললেন, রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে বৈশম্পায়ন যে ব্যাসরচিত মহাভারতকথা বলেছিলেন আমার তাই শুনতে ইচ্ছা করি।
সৌতি বললেন, চরাচরগুরু হৃষীকেশ হরিকে নমস্কার করে আমি ব্যাসপ্রোক্ত মহাভারতকথা আরম্ভ করছি। কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। ব্যাসদেব এই মহাভারত সংক্ষেপে বলেছেন আবার সবিস্তারেও বলেছেন। কোনও কোনও ব্রাহ্মণ এই গ্রন্থ আদি থেকে, কেউ আস্তীকের উপাখ্যান থেকে, কেউ বা উপরিচরের উপাখ্যান থেকে পাঠ করেন।
মহাভারত রচনার পর ব্যাসদেব ভেবেছিলেন, কোন উপায়ে এই ইতিহাস শিষ্যদের অধ্যয়ন করাব? তখন ভগবান ব্রহ্মা তার কাছে আবিভূত হয়ে বললেন, তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনি তোমার গ্রন্থের লিপিকার হবেন। ব্যাস গণেশকে অনুরোধ করলে তিনি বললেন, আমি সম্মত আছি, কিন্তু আমার লেখনী ক্ষণমাত্র থামবে না। ব্যাস ভাবলেন, আমার রচনায় আট হাজার আটশ এমন কুটশ্লোক আছে যার অর্থ কেবল আমি আর আমার পুত্র শুক বুঝতে পারি, সঞ্জয় পারেন কিনা সন্দেহ। ব্যাস গণেশকে বললেন, আমি যা বলে যাব আপনি তার অর্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। গণেশ বললেন, তাই হবে। গণেশ সর্বজ্ঞ হলেও কুটশ্লোক লেখবার সময় তাকে ভাবতে হত, সেই অবসরে ব্যাস অন্য বহু শ্লোক রচনা করতেন। (৪)
রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন। ভগবান ব্যাস এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। উপাখ্যান সহিত এই মহাভারতে লক্ষ শ্লোক আছে। উপাখ্যানভাগ বর্জন করে ব্যাস চব্বিশ হাজার শ্লোকে এক সংহিতা রচনা করেছেন, পণ্ডিতগণের মতে তাই প্রকৃত মহাভারত। তা ছাড়া ব্যাস দেড় শ শ্লোকে সমস্ত পর্বের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত অনুক্রমণিকা-অধ্যায়ে দিয়েছেন। ব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন, আমি তাই বলব। পূর্বকালে দেবতারা তুলাদণ্ডে ওজন করে দেখেছিলেন যে উপনিষৎসহ চার বেদের তুলনায় একখানি এই গ্রন্থ মহত্ত্বে ও ভারবত্তায় অধিক, সেজন্যই এর নাম মহাভারত।
অনন্তর সৌতি অতি সংক্ষেপে মহাভারতের মূল আখ্যান এবং পর্বসংগ্রহ (অর্থাৎ প্রত্যেক পর্বের বিষয়সমূহ) বর্ণনা করলেন।
**
(১) বিষ্ণুর অংশস্বরূপ দেবতা বা ঋষি বিশেষ।
(২) অর্থাৎ পুরাণ-মহাভারতাদি বিজয়প্রদ আখ্যান পাঠ করবে।।
(৩) এঁর প্রকৃত নাম উগ্রশ্রবা, জাতিতে সূত এজন্য উপাধি সৌতি। সূতজাতির বৃত্তি সারথ্য ও পুরাণাদি কথন।
(৪) মহাভারতের সকল সংস্করণে এই আখ্যান নেই।
।। পৌষ্যপর্বাধ্যায়।।
২। জনমেজয়ের শাপ-আরুণি, উপমন্যু ও বেদ
সৌতি বললেন।–
পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয় তার তিন ভ্রাতার সঙ্গে কুরুক্ষেত্র এক যজ্ঞ করছিলেন এমন সময় সেখানে একটি কুকুর এল। জনমেজয়ের ভ্রাতারা তাকে প্রহার করলেন, সে কাঁদতে কাঁদতে তায় মাতার কাছে গেল। কুকুরী ক্রুদ্ধ হয়ে যজ্ঞস্থলে এসে বললে, আমার পুত্রকে বিনা দোষে মারলে কেন? জনমেজয় প্রভৃতি কোনও উত্তর দিলেন না। কুক্করী বললে, এ কোনও অপরাধ করে নি তথাপি প্রহৃত হয়েছে; তোমার উপরেও অতর্কিত বিপদ এসে পড়বে।
দেবশুনী সরমার এই অভিশাপ শুনে জনমেজয় অত্যন্ত চিন্তাকুল হলেন। যজ্ঞ শেষ হলে তিনি হস্তিনাপরে ফিরে এসে শাপমোচনের জন্য উপযুক্ত পুরোহিতের সন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে শুতশ্রবা ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নমস্কার করে বললেন, ভগবান, আপনার পুত্র সোমবাকে দিন, তিনি আমার পুরোহিত হবেন। শুতশ্রবা বললেন, আমার এই পুত্র সর্পীর গর্ভজাত, এ মহাতপস্বী ও বেদজ্ঞ, মহাদেবের শাপ ভিন্ন অন্য সমস্ত শাপ নিবারণ করতে পারে। কিন্তু এর একটি গূঢ় ব্রত আছে, কোনও ব্রাহ্মণ কিছু প্রার্থনা করলে এ তা অবশ্যই পূরণ করবে। যদি তুমি তাতে সম্মত হও তবে একে নিয়ে যাও। জনমেজয় ঋষিপুত্রকে নিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের বললেন, আমি এঁকে উপাধ্যায়রূপে বরণ করেছি, ইনি যা বলবেন তোমরা তা নির্বিচারে করবে। এই আদেশ দিয়ে জনমেজয় তক্ষশিলা প্রদেশ জয় করতে গেলেন। (১)
এই সময়ে আয়োদ ধৌম্য (২) নামে এক ঋষি ছিলেন, তার তিন শিষ্য-উপমন্যু, আরুণি ও বেদ।
তিনি তার পাঞ্চালদেশীয়
শিষ্য আরুণিকে আজ্ঞা দিলেন, যাও, তুমি আমার ক্ষেত্রের আল বাঁধ। আরুণি গুরুর আজ্ঞা পালন করতে গেলেন, কিন্তু আল বাঁধতে না পেরে অবশেষে শুয়ে পড়ে জলরোধ করলেন। আরুণি ফিরে এলেন না দেখে ধৌম্য তার অপর দুই শিষ্যের সঙ্গে ক্ষেত্রে গিয়ে ডাকলেন, বৎস আরুণি, কোথায় আছ, এস। আরুণি উঠে এসে বললেন, আমি জলপ্রবাহ রোধ করতে পেরে সেখানে শুয়ে ছিলাম, এখন আপনি ডাকতে উঠে এসেছি, আজ্ঞা করুন কি করতে হবে। ধৌম্য বললেন, তুমি কেদারখণ্ড (ক্ষেত্রের আল) বিদারণ করে। উঠেছ সেজন্য তোমার নাম উদ্দালক হবে। আমার আজ্ঞা পালন করেছ সেজন্য তুমি শ্ৰেয়োলাভ করবে এবং সমস্ত বেদ ও ধর্মশাস্ত্র তোমার অন্তরে প্রকাশিত থাকবে।
আয়োদ ধৌম্য আর এক শিষ্য উপমন্যুকে আদেশ দিলেন, বৎস, তুমি আমার গো রক্ষা কর। উপমন্যু প্রত্যহ গরু চরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এসে গুরুকে প্রণাম করতে লাগলেন। একদিন গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, বৎস, তুমি কি খাও ? তোমাকে বেশ স্থূল দেখছি। উপমনু বললেন, আমি ভিক্ষা করে জীবিকানির্বাহ করি। গুরু বললেন, আমাকে নিবেদন না করে ভিক্ষান্ন ভোজন উচিত নয়। তার পর থেকে উপমনু ভিক্ষাদ্রব্য এনে গুরুকে দিতেন। তথাপি তাকে পুষ্ট দেখে গুরু বললেন, তুমি যা ভিক্ষা পাও সবই তো আমি নিই, তুমি এখন কি খাও ? উপমন্যু বললেন, প্রথমবার ভিক্ষা করে আপনাকে দিই, তারপর আবার ভিক্ষা করি, তাতেই আমার জীবিকানির্বাহ হয়। গুরু বললেন, এ তোমার অন্যায়, এতে অন্য ভিক্ষাজীবীদের হানি হয়, তুমিও লোভী হয়ে পড়ছ। তারপর উপমন্যু একবার মাত্র ভিক্ষা করে আপনাকে দিই, তারপর আবার ভিক্ষা করি, তাতেই আমার জীবিকানির্বাহ হয়। গুরু বললেন, এ তোমার অন্যায়, এতে অন্য ভিক্ষাজীবীদের হানি হয়, তুমিও লোভী হয়ে পড়ছ। তারপর উপমনু একবার মাত্র ভিক্ষা করে গুরুকে দিতে লাগলেন। গুরু আবার তাকে প্রশ্ন করলেন, বৎস, তোমাকে তো অতিশয় স্থূল দেখছি, এখন কি খাও? উপমন্যু বললেন, আমি এইসব গরুর দুধ যাই। গুরু বললেন, আমার অনুমতি বিনা দুধ খাওয়া তোমার অন্যায়। উপমন্যু তার পরেও স্থূলকায় রয়েছেন দেখে গুরু বললেন, এখন কি খাও ? উপমন্যু বললেন স্তন্যপানের পর বাছুররা যে ফেন উদ্গার করে তাই খাই। গুরু বললেন, এই বাছুররা দয়া করে তোমার জন্য প্রচুর ফেন উদগার করে, তাতে এদের পুষ্টির ব্যাঘাত হয়; ফেন খাওয়াও তোমার উচিত নয়। গুরুর সকল নিষেধ মেনে নিয়ে উপমন্যু গরু চরাতে লাগলেন। একদিন তিনি। ক্ষুধার্ত হয়ে অর্কপত্র (আকন্দপাতা) খেলেন। সেই ক্ষার তিক্ত কটু রুক্ষ তীক্ষ্ম বস্তু খেয়ে তিনি অন্ধ হলেন এবং চলতে চলতে কূপের মধ্যে পড়ে গেলেন। সূর্যাস্তের পর উপমন্যু ফিরে এলেন না দেখে আয়োদ ধৌম্য বললেন, আমি তার সকল প্রকার ভোজনই নিষেধ করেছি, সে নিশ্চয় রাগ করেছে, তাকে খোঁজা উচিত। এই বলে তিনি শিষ্যদের সঙ্গে অরণ্যে গিয়ে ডাকলেন, বৎস উপমন্যু, কোথায় আছ, এস। উপমনু কূপের ভিতর থেকে উত্তর বিলেন, আমি অর্কপত্র ভক্ষণের ফলে অন্ধ হয়ে এখানে পড়ে গেছি। ধৌম্য বললেন, তুমি দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের স্তব কর, তারা তোমাকে চক্ষুম্মান করবেন। উপমনু স্তব করলেন। অশ্বিনীদ্বয় তার নিকট আবির্ভূত হয়ে বললেন, আমরা প্রীত হয়েছি, তুমি এই পূপ (পিষ্টক) ভক্ষণ কর। উপমন্যু বললেন, গুরুকে নিবেদন না করে আমি খেতে পারি না। অশ্বিনীদ্বয় বললেন, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে আমাদের স্তব করে পূপ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা গুরুকে নিবেদন না করেই খেয়েছিলেন উপমন্যু বললেন, আমি আপনাদের নিকট অনুনয় করছি, গুরুকে নিবেদন না করে আমি খেতে পারব না। অশ্বিনীদ্বয় বললেন, তোমার গুরুভক্তিতে আমরা প্রীত হয়েছি; তোমার উপাধ্যায়ের দন্ত কৃষ্ণ লৌহময় হবে, তোমার দন্ত হিরন্ময় হবে, তুমি চক্ষুষ্মান হবে এবং শ্ৰেয়োলাভ করবে। উপমন্যু চক্ষু লাভ করে গুরুর কাছে এলেন এবং অভিবাদন করে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। গুরু প্রীত হয়ে বললেন, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের বরে তোমার মঙ্গল হবে, সকল বেদ এবং ধর্মশাস্ত্রও তুমি আয়ত্ত করবে। উপমন্যুর পরীক্ষা এইরূপে শেষ হল।
আয়োদ ধৌম্য তার তৃতীয় শিষ্য বেদকে আদেশ দিলেন, তুমি আমার গৃহে কিছুকাল বাস করে আমার সেবা কর, তোমার মঙ্গল হবে। বেদ দীর্ঘকাল গুরুগৃহে থেকে তার আজ্ঞায় বলদের ন্যায় ভারবহন এবং শীত গ্রীষ্ম ক্ষুধা তৃষ্ণাদি কষ্ট সইতে লাগলেন। অবশেষে তিনি গুরুকে পরিতুষ্ট করে শ্রেয় ও সর্বজ্ঞতা লাভ করলেন। এইরূপে তার পরীক্ষা শেষ হল।।
**
(১) এই বৃত্তান্তের সঙ্গে পরবর্তী আখ্যানের যোগসূত্র স্পষ্ট নয়।
(২) পাঠান্তর-আপোদ ধৌম্য।
৩। উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক
উপাধ্যায়ের আজ্ঞা নিয়ে বেদ গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করলেন, তাঁরও তিনটি শিষ্য হল। তিনি শিষ্যদের বলতেন না যে এই কর্ম কর, বা আমার শুশ্রুষা কর। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানতেন সেজন্য শিষ্যদের কষ্ট দিতে চাইতেন না। কিছুকাল পরে জনমেজয় এবং পৌষ্য নামে আর এক রাজা বেদকে উপাধ্যায়ের পদে বরণ করলেন। একদা বেদ যাজন কার্যের জন্য বিদেশে যাবার সময় উতঙ্ক (১) নামক শিষ্যকে বলে গেলেন, আমার প্রবাসকালে গৃহে যে বিষয়ের অভাব হবে তুমি তা পূরণ করবে। উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। একদিন আশ্রমের নারীরা তাকে বললে, তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু উপাধ্যায় এখানে নেই; ঋতু যাতে নিষ্ফল না হয় তুমি তা কর। উতঙ্ক উত্তর দিলেন, আমি স্ত্রীলোকের কথায় এমন অকার্য করতে পারি না, উপাধ্যায় আমাকে অকার্য। করবার আদেশ দেন নি। কিছুকাল পরে বেদ ফিরে এলেন এবং সকল বৃত্তান্ত শুনে প্রীত হয়ে বললেন, বৎস উতঙ্ক, আমি তোমার কি প্রিয়সাধন করব বল। তুমি ধর্মানুসারে আমার সেবা করেছ, আমাদের পরস্পরের প্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তোমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। এখন তুমি স্বগৃহে যেতে পার।
উতঙ্ক বললেন, আমিই বা আপনার কী প্রিয়সাধন করব বলুন, আমি আপনার অভীষ্ট দক্ষিণা দিতে ইচ্ছা করি। বেদ বললেন, বৎস, এখন থাকুক না। কিছুকাল পরে উতঙ্ক পুনর্বার গুরুকে দক্ষিণার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বেদ বললেন, তুমি। বহুবার আমাকে দক্ষিণার কথা বলেছ, গৃহমধ্যে গিয়ে উপাধ্যায়ানীকে জিজ্ঞাসা কর কী দিতে হবে। তখন উতঙ্ক গুরু পত্নীর কাছে গিয়ে বললেন, ভগবতী, উপাধ্যায় আমাকে গৃহগমনের অনুমতি দিয়েছেন, আমি গুরুদক্ষিণা দিয়ে ঋণমুক্ত হ’তে চাই, আপনি বলুন কি দক্ষিণা দেব।
উপাধ্যায়পত্নী বললেন, তুমি রাজা পৌষ্যের কাছে যাও, তার ক্ষত্রিয়া পত্নী যে দুই কুণ্ডল পরেন তাই চেয়ে আন। চার দিন পরে পুণ্যক ব্রত হবে, তাতে আমি ওই কুণ্ডলে শোভিত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিবেশন করতে ইচ্ছা করি। তুমি আমার এই অভীষ্ট পূর্ণ কর, তাতে তোমার মঙ্গল হবে, কিন্তু যদি না কর তবে অনিষ্ট হবে।
উতঙ্ক কুণ্ডল আনবার জন্য যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি প্রকাণ্ড বৃষে আরূঢ় এক মহাকায় পুরুষকে দেখতে পেলেন। সেই পুরুষ বললেন, উতঙ্ক, তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষণ কর। উতঙ্ককে অনিচ্ছুক দেখে তিনি আবার বললেন, উতঙ্ক, খাও, বিচার ক’রো না, তোমার উপাধ্যায়ও পূর্বে খেয়েছেন। তখন উতঙ্ক বৃষের মলমূত্র খেলেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে সত্বর আচমন করে পৌষ্যের নিকট যাত্রা করলেন। পৌষ্য তাকে বললেন, ভগবান, কি আজ্ঞা বলুন। উতঙ্ক কুণ্ডল প্রার্থনা করলে রাজা বললেন, আপনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীর কাছে চেয়ে নিন। উতঙ্ক মহিষীকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে পৌষ্যকে বললেন, আমাকে মিথ্যা কথা বলা আপনার উচিত হয় নি, অন্তঃপুরে মহিষী নেই। পৌষ্য ক্ষণকাল চিন্তা করে বললেন, নিশ্চয় আপনি উচ্ছিষ্ট (এঁটো মুখে) আছেন, অশুচি ব্যক্তি আমার পতিব্রতা ভার্যাকে দেখতে পায় না। উতঙ্ক স্মরণ করে বললেন, আমি এখানে শীঘ্র আসবার জন্য দাঁড়িয়ে আচমন করেছিলাম সেজন্য এই দোষ হয়েছে। উতঙ্ক তখন পূর্বমুখে বসে হাত পা মুখ ধুলেন এবং তিনবার নিঃশব্দে ফেনশূন্য অনুষ্ণ হুদ্য জল পান করে দুবার মুখাদি ইন্দ্রিয় মুছলেন। তারপর তিনি অন্তঃপুরে গিয়ে মহিষীকে দেখতে পেলেন। উতঙ্কের প্রার্থনা শুনে মহিষী প্রীত হয়ে তাঁকে কুণ্ডল দিলেন এবং বললেন, নাগরাজ তক্ষক এই কুণ্ডল দুটির প্রার্থী, অতএব সাবধানে নিয়ে যাবেন।
উতঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে পৌষ্যের কাছে এলেন। পৌষ্য বললেন, ভগবান, সৎপাত্র সহজে পাওয়া যায় না, আপনি গুণবান অতিথি, আপনার সৎকার করতে ইচ্ছা করি। উতঙ্ক বলেন, গৃহে যে অন্ন আছে তাই শীঘ্র নিয়ে আসুন। অন্ন আনা হলে। উতঙ্ক দেখলেন তা ঠাণ্ডা এবং তাতে চুল রয়েছে। তিনি বললেন, আমাকে অশুচি অন্ন দিয়েছেন অতএব আপনি অন্ধ হবেন। পৌয্য বললেন, আপনি নির্দোষ অন্নের দোষ দিচ্ছেন এজন্য আপনি নিঃসন্তান হবেন। উতঙ্ক বললেন, অশুচি অন্ন দিয়ে আবার অভিশাপ দেওয়া আপনার অনুচিত, দেখুন না অন্ন অশুচি কি না। রাজা অন্ন দেখে অনুমান করলেন এই শীতল অন্ন কোনও মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তারই কেশ এতে পড়েছে। তিনি ক্ষমা চাইলে উতঙ্ক বললেন, আমার বাক্য মিথ্যা হয়। না, আপনি অন্ধ হবেন, কিন্তু শীঘ্রই আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আমাকে যে শপ দিয়েছেন তাও যেন না ফলে। রাজা বললেন, আমার ক্রোধ এখনও শান্ত হয়নি, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীততুল্য কিন্তু বাক্যে তীক্ষ্মধার ক্ষুর থাকে, ক্ষত্রিয়ের এর বস্তুত। আমি শাপ প্রত্যাহার করতে পারি না, আপনি অন্নের দোষ স্বীকার করেছেন অতএব আপনার শাপ ফলবে না। এই বলে তিনি কুণ্ডল নিয়ে চ’লে গেলেন।
উতঙ্ক যেতে যেতে পথে এক নগ্ন ক্ষপণক (২) দেখতে পেলেন, সে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হচ্ছে। তিনি কুণ্ডল দুটি ভূমিতে রেখে স্নানাদির জন্য জলাশয়ে গেলেন, সেই অবসরে ক্ষপণক কুণ্ডল নিয়ে পালিয়ে গেল। স্নান শেষ করে উতঙ্ক দৌড়ে গিয়ে ক্ষপণককে ধরে ফেললেন। সে তখনই তক্ষকের রূপ ধারণ করলে এবং সহসা আবির্ভূত এক গর্তে প্রবেশ করে নাগলোকে চ’লে গেল। উতঙ্ক সেই গর্ত দণ্ডকাষ্ঠ (ব্রহ্মচারীর যষ্টি) দিয়ে খুঁড়ে বড় করবার চেষ্টা করলেন। তাঁকে ক্লান্ত ও অকৃতকার্য দেখে ইন্দ্র তার বজ্রকে বললেন, যাও, ওই ব্রাহ্মণকে সাহায্য কর। বজ্র দণ্ডকাষ্ঠে অধিষ্ঠান করে গর্তটি বড় করে দিলে। উতঙ্ক সেই গর্ত দিয়ে নাগলোকে গেলেন এবং নানাবিধ প্রাসাদ হর্ম্য ক্রীড়াস্থানাদি দেখতে পেলেন। কুণ্ডল ফিরে পাবার জন্য তিনি নাগগণের স্তব করতে লাগলেন। তার পর দেখলেন, দুই স্ত্রী তাঁতে কাপড় বুনছে, তার কতক সুতো কাল কতক সাদা; ছয় কুমার স্বাদশ অর (পাখি)যুক্ত একটি চক্র ঘোরাচ্ছে; একজন সুদর্শন পুরুষ এবং একটি অশ্বও সেখানে রয়েছে। উতঙ্ক এই সকলেরও স্তব করলেন। সেই পুরুষ উতঙ্ককে বললেন, তোমার স্তবে প্রীত হয়েছি, কি অভীষ্ট সাধন করব বল। উতঙ্ক বললেন, নাগগণ আমার বশীভূত হ’ক পুরুষ বললেন, তুমি এই অশ্বের গুহাদেশে ফুকার দাও। উতঙ্ক ফুকার। দিলে অশ্বের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে সধূম অগ্নিশিখা নির্গত হয়ে নাগলোকে ব্যাপ্ত হল। তখন ভীত হয়ে তক্ষক তার বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এই নিন আপনার কুণ্ডল। কুণ্ডল পেয়ে উতঙ্ক ভাবলেন, আজ উপাধ্যায়ানীর পুণ্যক ব্রত, আমি বহু দূরে এসে পড়েছি, কি করে তার ইচ্ছা পূর্ণ করব? সেই পুরুষ তাকে বললেন, তুমি এই অশ্বে আরূঢ় হয়ে যাও, ক্ষণমধ্যে তোমার উপাধ্যায়ের গৃহে পৌঁছবে।
উপাধ্যায়ানী স্নান করে কেশসংস্কার করছিলেন এবং উতঙ্ক এলেন না দেখে তাঁকে শাপ দেবার উপক্রম করছিলেন, এমন সময় উতঙ্ক এসে প্রণাম করে কুণ্ডল দিলেন। তার পর তিনি উপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। উপাধ্যায় বললেন, তুমি যে দুই স্ত্রীকে বস্ত্র বয়ন করতে দেখেছ তারা ধাতা ও বিধাতা, কৃষ্ণ ও শ্বেত সূত্র রাত্রি ও দিন, ছয় কুমার ছয় ঋতু, চক্রটি সংবৎসর, তার দ্বাদশ অর দ্বাদশ মাস, যিনি পুরুষ তিনি স্বয়ং ইন্দ্র, এবং অশ্ব অগ্নি। তুমি যাবার সময় পথে যে বৃষ দেখেছিলে সে ঐরাবত, তার আরোহী ইন্দ্র। তুমি যে পুরীষ খেয়েছ তা অমৃত। নাগলোকে তোমার বিপদ হয় নি, কারণ ইন্দ্র আমার সখা, তার অনুগ্রহে তুমি কুণ্ডল আনতে পেরেছ। সৌম্য, তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি স্বগৃহে যাও, তোমার মঙ্গল হবে।
উতঙ্ক তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেবার সংকল্প করে হস্তিনাপুরে রাজা জনমেজয়ের কাছে গেলেন। জনমেজয় তখন তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন, মন্ত্রীরা তাকে ঘিরে আছেন। উতঙ্ক যথাবিধি আশীর্বাদ করে বললেন, মহারাজ, যে কার্য করা উচিত ছিল তা না করে আপনি বালকের ন্যায় অন্য কার্য করছেন। জনমেজয় তাঁকে সংবর্ধনা করে বললেন, আমি ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করে থাকি, আমাকে আপনি কি করতে বলেন ? উতঙ্ক বললেন, আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যে প্রাণহরণ করেছে সেই দুরাত্মা তক্ষকের উপর আপনি প্রতিশোধ নিন। সেই নৃপতির চিকিৎসার জন্য কাশ্যপ আসছিলেন, কিন্তু তক্ষক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আপনি শীঘ্র সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করুন এবং জ্বলিত অগ্নিতে সেই পাপীকে আহুতি দিন। তাতে আপনার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ হবে, আমিও প্রীত হব, কারণ সেই দুরাত্মা আমার বিঘ্ন করেছিল।
উতঙ্কের কথা শুনে জনমেজয় তক্ষকের উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন এবং শোকার্তমনে মন্ত্রিগণকে পরীক্ষিতের মৃত্যুর বিষয় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।
**
(১) আশ্বমেধিকপর্বে ৬-পরিচ্ছেদে উতঙ্কের উপাখ্যান কিছু অন্যপ্রকার।
(২) দিগম্বর সন্ন্যাসী বিশেষ।
॥ পৌলোমপর্বাধ্যায়॥
৪। ভৃগু-পুলোমা-চ্যবন-অগ্নির শাপমোচন
এ মহর্ষি শৌনক সৌতিকে বললেন, বৎস, আমি ভৃগুবংশের বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি, তুমি তা বল।
ও সৌতি বললেন, ব্রহ্মা যখন বরুণের যজ্ঞ করছিলেন তখন সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে মহর্ষি ভৃগুর জন্ম হয়েছিল। ভৃগুর ভার্যার নাম পুলোমা। তিনি গর্ভবতী হলে একদিন যখন ভৃগু স্নান করতে যান তখন এক রাক্ষস আশ্রমে এসে ভৃগুপত্নীকে দেখে মুগ্ধ হল। এই রাক্ষসেরও নাম পুলোমা। পূর্বে সে ভৃগুপত্নী পুলোমাকে বিবাহ করতে চেয়েছিল কিন্তু কন্যার পিতা ভূগুকেই কন্যাদান করেন। সেই দুঃখ সর্বদাই রাক্ষসের মনে ছিল। ভৃগুর হোমগৃহে প্রজ্বলিত অগ্নি দেখে রাক্ষস বললে, অগ্নি, তুমি বেদগণের মুখ, সত্য বল এই পুলোমা কার ভার্যা। এই সুন্দরীকে পূর্বে আমি ভার্যারূপে বরণ করেছিলাম কিন্তু ভৃগু অন্যায়ভাবে এঁকে গ্রহণ করেছেন। এখন আমি এঁকে আশ্রম থেকে হরণ করতে চাই। তুমি সত্য কথা বল।
অগ্নি ভীত হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, দানবনন্দন, তুমি পূর্বে এই পুলোমাকে বরণ করেছিলে কিন্তু যথাবিধি মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ কর নি। পুলোমার পিতা বরলাভের আশায় ভৃগুকেই কন্যাদান করেছিলেন। ভৃগু আমার সম্মুখেই এঁকে বিবাহ করেছেন। যাঁকে তুমি পূর্বে বরণ করেছিলে ইনিই সেই পুলোমা। আমি মিথ্যা বলতে পারব না।
তখন রাক্ষস বরাহের রূপ ধারণ করে পুলোমাকে হরণ করে মহাবেগে নিয়ে চলল। পুলোমার শিশু গৰ্ভচ্যুত হল সেজন্য তার নাম চ্যবন। সূর্যতুল্য তেজোময় সেই শিশুকে দেখে রাক্ষস ভস্ম হয়ে ভূতলে পড়ল, পুলোমা পুত্রকে নিয়ে দুঃখিত মনে আশ্রমের দিকে চললেন। ব্রহ্মা তার এই রোরুদ্যমানা পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিলেন। এবং পুলোমার অশ্রুজাত নদীর নাম বধূসরা রাখলেন। ভৃগু তার পত্নীকে বললেন, তোমার পরিচয় রাক্ষসকে কে দিয়েছিল? পুলোমা উত্তর দিলেন, অগ্নি আমার পরিচয় দিয়েছিলেন। তখন ভৃগু সরোষে অগ্নিকে শাপ দিলেন, তুমি সর্বভুক হবে। অগ্নি বললেন, তুমি কেন এরূপ শাপ দিলে ? আমি ধর্মানুসারে রাক্ষসকে সত্য কথাই বলেছি। তুমি ব্রাহ্মণ, আমার মাননীয়, সেজন্য আমি প্রত্যভিশাপ দিলাম না। আমি যোগবলে বহু মূর্তিতে অধিষ্ঠান করি, আমাকে যে আহুতি দেওয়া হয় তাতেই দেবগণ ও পিতৃগণ তৃপ্ত হন, অতএব আমি সর্বভুক কি করে হব?
অগ্নি দ্বিজগণের অগ্নিহোত্র ও যজ্ঞাদি ক্রিয়া থেকে অন্তর্হিত হলেন। তার অভাবে সকলে অতিশয় কষ্টে পড়ল, ঋষিরা উদবিগ্ন হয়ে দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে শাপের বিষয় জানালেন এবং বললেন, অগ্নির অন্তর্ধানে আমাদের ক্রিয়ালোপ হয়েছে; যিনি দেবগণের মুখ এবং যজ্ঞের অগ্রভাগ ভোজন করেন তিনি কি করে সর্বভুক হ’তে পারেন? ব্রহ্মা মিষ্টবাক্যে অগ্নিকে বললেন, হুতাশন, তুমি ত্রিলোকের ধারয়িতা এবং ক্রিয়াকলাপের প্রবর্তক, ক্রিয়ালোপ করা তোমার উচিত নয়। তুমি সদা পবিত্র, সর্বশরীর দিয়ে তুমি সর্বভুক হবে না, তোমার গুহ্যদেশে যে শিখা আছে এবং তোমার যে ক্রব্যাদ (মাংসভক্ষক) শরীর আছে তাই সর্বভুক হবে। তুমি তেজঃস্বরূপ, মহর্ষি ভৃগু যে শাপ দিয়েছেন তা সত্য কর এবং তোমার মুখে যে আহুতি দেওয়া হবে তাই দেবগণের ও নিজের ভাগরূপে গ্রহণ কর। অগ্নি বললেন, তই হবে। তখন সকলে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ নিজ স্থানে চ’লে গেলেন।
৫। রুরু-প্রমদবরা-ডুণ্ডুভ
ভৃগুপুত্র চ্যবনের পত্নীর নাম সুকন্যা, তাঁর গর্ভে প্রমতি জন্মগ্রহণ করেন। প্রমতির ঔরসে ঘৃতাচীর গর্ভে রুরু নামক পুত্র উৎপন্ন হন। এই রুরুর কথা এখন বলব।
স্থূলকেশ নামে খ্যাত সর্বভূতহিতে রত এক মহর্ষি ছিলেন। গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসূর সহিত সহবাসে মেনকা গর্ভবতী হন। সেই নির্দয়া নির্লজ্জা অপ্সরা নদীতীরে তার কন্যাসন্তানকে পরিত্যাগ করেন। মহর্ষি স্থূলকেশ দেবকন্যার ন্যায় কান্তিমতী সেই কন্যাটিকে দেখতে পেয়ে তাকে নিজের আশ্রমে এনে পালন করতে লাগলেন। এই কন্যা স্বভাবে রূপে গুণে সকল প্রমদার শ্রেষ্ঠ সেজন্য মহর্ষি তার নাম। রাখলেন—প্রমদবরা। রুরু সেই কন্যাকে দেখে মোহিত হলেন, তাঁর পিতা প্রমতির অনুরোধে স্থূলকেশও কন্যাদান করতে সম্মত হলেন।
কিছুদিন পরে বিবাহকাল আসন্ন হল। প্রমদবরা তার সখীদের সঙ্গে খেলা করতে করতে দুর্দৈবক্রমে একটি সুপ্ত সর্পের দেহে পা দিয়ে ফেললেন। সর্পের দংশনে প্রমদবরা বিবর্ণ বিগতশ্রী ও হতচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। স্থূলকেশ এবং অন্যান্য ঋষিরা দেখলেন পদ্মকান্তি সেই বালা নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছেন। প্রমতি ও বনবাসী অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ সেখানে এসে কঁদতে লাগলেন। শোকার্ত রুরু গহন বনে গিয়ে করুণস্বরে বিলাপ করতে করতে বললেন, যদি আমি দান তপস্যা ও গুরুজনের সেবা করে থাকি, যদি জন্মাবধি ব্রতপালন করে থাকি, কৃষ্ণ বিষ্ণু হৃষীকেশে যদি আমার অচলা ভক্তি থাকে, তবে আমার প্রিয়া এখনই জীবনলাভ করুন।
রুরুর বিলাপ শুনে দেবতারা কৃপান্বিত হয়ে একজন দূত পাঠালেন। এই দেবদূত রুরুকে বললেন, বৎস, এই কন্যার আয়ু শেষ হয়েছে, তুমি বৃথা শোক ক’রো। তবে দেবতারা একটি উপায় নির্দিষ্ট করেছেন, তা যদি করতে পার তবে প্রমাকে ফিরে পাবে। রুরু বললেন, হে আকাশচারী, বলুন সেই উপায় কি, আমি তাই করব। দেবদূত বললেন, এই কন্যাকে তোমার আয়ুর অর্থ দান কর, তা হলেই সে জীবিত হবে। রুরু বললেন, আমি অর্ধ আয়ু দিলাম, আমার প্রিয়া সৌন্দর্যময়ী ও সালংকারা হয়ে উত্থান করুন।
প্রমদবরার পিতা গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসু দেবদূতের সঙ্গে যমের কাছে গিয়ে বললেন, ধর্মরাজ, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে মৃতা প্রমদবরা রুরুর অর্ধ আয়ু নিয়ে বেঁচে উঠুক। যম বললেন, তাই হোক। তখন বরবর্ণিনী প্রমদবরা যেন নিদ্রা থেকে গাত্রোত্থান করলেন। প্রমতি ও স্থূলকেশ মহানন্দে বরকন্যার বিবাহ দিলেন।
রুরু অত্যন্ত কোপাম্বিত হয়ে সর্পকুল বিনষ্ট করবার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং যথাশক্তি সকলপ্রকার সর্পই বধ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ ডুণ্ডুভ (ঢোঁড়া সাপ) শুয়ে আছে। রুরু তখনই তাকে দণ্ডাঘাতে মারতে গেলেন। ডুণ্ডুভ বললে, তপোধন, আমি কোনও অপরাধ করি নি, তবে কেন আমাকে মারতে চান? রুরু বললেন, আমার প্রাণসমা ভার্যাকে সাপে কামড়েছিল, সেজন্য প্রতিজ্ঞা করেছি সাপ দেখলেই মারব। ডুণ্ডুভ বললে, যারা মানুষকে দংশন করে তারা অন্য জাতীয়, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে ডুণ্ডুভ বধ করতে পারেন না। রুরু জিজ্ঞাসা করলেন, ডুণ্ডুভ, তুমি কে ? ডুণ্ডুভ উত্তর দিলে, পূর্বে আমি সহস্রপাৎ নামে ঋষি ছিলাম। খগম নামে এক ব্রাহ্মণ আমার সখা ছিলেন, তার বাক্য অব্যর্থ। একদিন তিনি অগ্নিহোত্রে নিযুক্ত ছিলেন সেই সময়ে আমি বালসুলভ খেলার ছলে একটি তৃণনির্মিত সর্প নিয়ে ভয় দেখিয়েছিলাম, তাতে তিনি মূৰ্ছিত হন। সংজ্ঞা লাভ করে তিনি সক্রোধে বললেন, আমাকে ভয় দেখাবার জন্য তুমি যেমন নির্বিষ সর্প নির্মাণ করেছ, আমার শাপে তুমিও সেইরূপ হবে। আমি উদবিগ্ন হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে তাকে বললাম, আমি আপনাকে সখা জ্ঞান করে এই পরিহাস করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন, শাপ প্রত্যাহার করুন। খগম বললেন, যা বলেছি তা মিথ্যা হবে না, তবে আমার এই কথা শুনে রাখ—প্রমতির পুত্র রুরুর দর্শন পেলে তুমি শাপমুক্ত হবে। তুমি সেই রুরু, আজ আমি পূর্বরূপ ফিরে পাব।
ঋষি সহস্রপাৎ ডুণ্ডুভরূপ ত্যাগ করলেন এবং তেজোময় পূর্বরূপ লাভ করে। রুরুকে বললেন,
অহিংসা পরমোধর্মঃ সর্বপ্রাণভৃতাং স্মৃতঃ।
তস্মাৎ প্রাণভৃতঃ সর্বান্ ন হিংস্যা ব্রাহ্মণঃ কচিৎ।
ব্রাহ্মণঃ সৌম্য এবেহ ভবতীতি পরা শ্রুতিঃ।
বেদবেদাঙ্গবিৎ তাত সর্বভূতাভয়প্রদঃ।
অহিংসা সত্যবচনং ক্ষমা চেতি বিনিশ্চিত।
ব্রাহ্মণস্য পরো ধর্মো বেদানাং ধারণাপি চ।
ক্ষত্রিয়স্য হি যো ধর্মঃ স হি নেষ্যেত বৈ তব ৷৷
-সর্ব প্রাণীর অহিংসাই পরম ধর্ম; অতএব ব্রাহ্মণ কখনও কোনও প্রাণীর হিংসা করবেন না। বৎস, এইরূপ শ্রুতিবাক্য আছে যে ব্রাহ্মণ শান্তমূর্তি বেদবেদাঙ্গবিৎ এবং সর্ব প্রাণীর অভয়দাতা হবেন, তার পক্ষে অহিংসা, সত্যকথন, ক্ষমা ও বেদের ধারণাই পরম ধর্ম। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম তা তোমার গ্রহণীয় নয়।
তার পর সহস্রপাৎ বললেন, দণ্ডদান, উগ্রতা ও প্রজাপালন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম।পূর্বকালে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে সর্পসমূহ বিনষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তপোবলসম্পন্ন বেদবেদাঙ্গবিৎ দ্বিজশ্রেষ্ঠ আস্তীক ভীত সর্পগণকে পরিত্রাণ করেছিলেন।
রুরু সেই ইতিহাস জানতে চাইলে সহস্রপাৎ বললেন, আমি এখন যাবার ব্যস্ত হয়েছি, তুমি ব্রাহ্মণদের কাছে সব শুনতে পাবে। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রুরু তাঁকে চতুর্দিকে অন্বেষণ করে পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লেন, তারপর আশ্রমে ফিরে এসে পিতার নিকট সর্পযজ্ঞের বৃত্তান্ত শুনলেন।
॥ আস্তীকপর্বাধ্যায়॥
৬। জরৎকারু মুনি-কদ্রু ও বিনতা-সমুদ্রমন্থন
শৌনক বললেন, তুমি জনমেজয়ের সপর্যজ্ঞ ও আস্তীকের ইতিহাস বল।
সৌতি বললেন, আস্তীকের পিতার নাম জরৎকারু, তিনি মহাতপা ব্রহ্মচারী ঊর্ধরেতা পরিব্রাজক ছিলেন। একদিন তিনি পর্যটন করতে করতে দেখলেন, কতকগুলি মানুষ উশীর (বেনা) তৃণ অবলম্বন করে ঊর্ধ্বপাদ অধোমুখ হয়ে গর্তের উপর ঝুলছেন। জরৎকারুর প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, আমরা যাযাবর নামক ঋষি ছিলাম। জরৎকারু নামে আমাদের একটি পুত্র আছে, সেই মূঢ় কেবল তপস্যা করে, বিবাহ এবং সন্তান উৎপাদনের চেষ্টা তার নেই। আমরা অনাথ হয়ে বংশলোপের আশঙ্কায় পাপীর ন্যায় এই গর্তে লম্বমান রয়েছি। জরৎকারু বললেন, আপনারা আমারই পিতৃপুরুষ, বলুন কি করব? পিতৃগণ বললেন, বৎস, দারগ্রহণ ও সন্তান উৎপাদন কর, তাতেই আমাদের পরম মঙ্গল হবে। জরৎকারু বললেন, আমি নিজের জন্য বিবাহ বা ধনোপার্জন করব না, আপনাদের হিতের জন্যই দারগ্রহণ করব। যে কন্যার নাম আমার নামের সমান, যাকে তার আত্মীয়রা স্বেচ্ছায় দান করবে, তাকেই আমি ভিক্ষাস্বরূপ নেব।
জরৎকারু বিবাহার্থী হয়ে ভ্রমণ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে ধীর ও উচ্চ কণ্ঠে তিনবার কন্যা ভিক্ষা করলেন। তখন বাসুকি তার ভগিনীকে নিয়ে। এসে বললেন, দ্বিজোত্তম, আপনি একে গ্রহণ করুন। কন্যার নাম আর নিজের নাম এক জেনে জরৎকারু কে বিবাহ করলেন। আস্তীক নামে তাদের এক পুত্র হল, তিনিই সর্পগণকে ত্রাণ করেন এবং পিতৃগণকেও উদ্ধার করেন।
শৌনক বললেন, বৎস সৌতি, তোমার কথা অতি মধুর, আমরা আরও শুনতে ইচ্ছা করি। সৌতি বলতে লাগলেন –
পুরাকালে সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতির কদ্রু ও বিনতা নামে দুই সুলক্ষণা রূপবতী কন্যা ছিলেন, তারা কশ্যপের ধর্মপত্নী। কশ্যপ তাদের বর দিতে ইচ্ছা করলে কদ্রু বললেন, তুল্যবলশালী সহস্র নাগ আমার পুত্র হোক; বিনতা বললেন, আমাকে দুই পুত্র দিন যারা কদ্রুর পুত্রের চেয়েও বলবান ও তেজস্বী। কশ্যপ দুই পত্নীকেই অভীষ্ট বর দিলেন। যথাকালে কদ্রু এক সহস্র এবং বিনতা দুই ডিম্ব প্রসব করলেন। পাঁচ শ বৎসর পরে কর পুত্রের চেয়েও বলবান ও তেজস্বী। কশ্যপ দুই পত্নীকেই অভীষ্ট বর দিলেন। যথাকালে কদ্রু এক সহস্র এবং বিনতা দুই ডিম্ব প্রসব করলেন। পাঁচশ বৎসর পরে কদ্রুর প্রত্যেক ডিম্ব থেকে পুত্র নির্গত হল। নিজের দুই ডিম্ব থেকে কিছুই বার হল না দেখে বিনতা একটি ডিম্ব ভেঙে দেখলেন, তার মধ্যস্থ সন্তানের দেহের ঊর্ধ্বভাগ আছে কিন্তু নিম্নভাগ অপরিণত। সেই পুত্র ক্রুদ্ধ হয়ে মাতাকে শাপ দিলেন, তোমার লোভের ফলে আমার দেহ অসম্পূর্ণ হয়েছে, তুমি পাঁচ শ বৎসর কদ্রুর দাসী হয়ে থাকবে। অন্য ডিম্বটিকে অসময়ে ভেঙো না, যথাকালে তা থেকে পুত্র নির্গত হয়ে তোমার দাসীত্ব মোচন করবে। এই কথা বলে তিনি আকাশে উঠলেন এবং অরুণরূপে সূর্যের সারথি হলেন। গরুড়ও যথাকালে জন্মগ্রহণ করলেন এবং জননী বিনতাকে ত্যাগ করে ক্ষুধার্ত হয়ে আকাশে উড়লেন।
একদিন কদ্রু ও বিনতা দেখলেন, তাদের নিকট দিয়ে উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব যাচ্ছে। (১) অমৃতমন্থনে উৎপন্ন এই অশ্বরত্নের প্রশংসা সকল দেবতাই করতেন।
শৌনক অমৃতমন্থনের বিবরণ শুনতে চাইলে সৌতি বললেন।–একদা দেবগণ সুমেরু পর্বতের শিখরে বসে অমৃতপ্রাপ্তির জন্য মন্ত্রণা করছিলেন। নারায়ণ ব্রহ্মাকে বললেন, দেবগণ ও অসুরগণ একত্র হয়ে সমুদ্রমন্থন করুন, তা হলে অমৃত পাবেন। ব্রহ্মা ও নারায়ণের আদেশে নাগরাজ অনন্ত মন্দর পর্বত উৎপাটন করলেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে দেবতারা সমুদ্রতীরে গিয়ে বললেন, অমৃতের জন্য আমরা আপনাকে মন্থন করব। সমুদ্র বললেন, আমাকে অনেক মর্দন সইতে হবে, অমৃতের অংশ যেন আমি পাই।
দেবাসুরের অনুরোধে সাগরস্থ কূর্মরাজ মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করলেন, ইন্দ্র বজ দ্বারা পর্বতের নিম্নদেশ সমান করে দিলেন। তারপর মন্দরকে মন্থনদণ্ড এবং নাগরাজ বাসুকি (অনন্ত) কে রজু করে দেবাসুর সমুদ্র মন্থন করতে লাগলেন। অসুরগণ নাগরাজের শীর্ষদেশ এবং দেবগণ
পুচ্ছ
ধারণ করলেন। বাসুকির
মুখ
থেকে
ধূম
ও অগ্নিশিখার
সহিত
যে নিঃশ্বাসবায়ু নির্গত হল তা মেঘে পরিণত হয়ে পরিশ্রান্ত দেবাসুরের উপর জলবর্ষণ করতে লাগল। সমুদ্র থেকে মেঘগর্জনের ন্যায় শব্দ উঠল, মন্দরের ঘর্ষণে বহু জলজন্তু নিষ্পিষ্ট হল পর্বতের বৃক্ষসকল পক্ষিসমেত নিপতিত হল , বৃক্ষের ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে হস্তী সিংহ প্রভৃতি জন্তুকে দগ্ধ করে ফেললে। নানাপ্রকার বৃক্ষের নির্যাস, ওষধির রস এবং কাঞ্চনদ্রব্য সমুদ্রজলে পড়ল। সেই সকল রসমিশ্রিত জল থেকে দুগ্ধ ও ঘৃত উৎপন্ন হল।
তারপর মথ্যমান সাগর থেকে চন্দ্র উঠলেন এবং ঘৃত থেকে লক্ষ্মী, সুরা দেবী, শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও নারায়ণের ভূষণ কৌস্তুভ মণির উদ্ভব হল। সর্বকামনাপূরক পারিজাত এবং সুরভি ধেনুও উত্থিত হল। লক্ষ্মী, সুরা দেবী, চন্দ্র ও উচ্চৈঃশ্রবা দেবগণের নিকট গেলেন। অনন্তর ধন্বন্তরি দেব অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ ‘আমার আমার’ বলে কোলাহল করতে লাগল। তারপর শ্বেতবর্ণ চতুর্দন্ত মহাকায় ঐরাবত উত্থিত হলে ইন্দ্র তাকে ধরলেন। অতিশয় মন্থনের ফলে কালকূট উঠল, সধূম অগ্নির ন্যায় সেই বিষে জগৎ ব্যাপ্ত হল। ব্রহ্মার অনুরোধে ভগবান মহেশ্বর সেই বিষ কণ্ঠে গ্রহণ করলেন, সেই থেকে তার নাম নীলকণ্ঠ। দানবগণ অমৃত ও লক্ষ্মী লাভের জন্য দেবতাদের সঙ্গে কলহ করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনী মায়ায় স্ত্রীরূপ ধারণ করে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগণকে শ্রেণীবদ্ধ করে বসিয়ে কমণ্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগণের প্রতি ধাবিত হল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রূপ ধারণ করে অমৃত পান করলে, অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তার চক্র দিয়ে সেই দানবের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুণ্ড আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগল, তার কবন্ধ (ধড়) ভূমিতে পড়ল, সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হল। সেই অবধি চন্দ্ৰসুর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হল।
বিষ্ণু স্ত্রীরূপ ত্যাগ করে দেবগণের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘোর যুদ্ধ করলেন। দানবগণ পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল।
**
(১) পরবর্তী ঘটনা ৭-পরিচ্ছদে আছে।
৭। কদ্রু-বিনতার পণ—গরুড়-গজকচ্ছপ-অমৃতহরণ
একদিন উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখে কদ্রু বিনতা তর্ক করলেন, এই অশ্বের বর্ণ কী? বিনতা বললেন, শ্বেত; কদ্রু বললেন, এর পুচ্ছলোম কৃষ্ণ। অবশেষে এই পণ স্থির হল যে কাল তারা অশ্বটিকে ভাল করে দেখবেন এবং যার কথা মিথ্যা হবে তিনি অন্যের দাসী হবেন।
কদ্রু তার সর্পপুত্রদের ডেকে বললেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে ওই অশ্বের পুচ্ছে লগ্ন হও, যাতে তা কজ্জলবর্ণ দেখায়। যে সর্পরা সম্মত হল না, কদ্রু তাদের শাপ দিলেন, তোমরা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হবে। পরদিন প্রভাতে কদ্রু ও বিনতা আকাশপথে সমুদ্রের পরপারে গেলেন। উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ লোম দেখে বিনতা বিষগ্ন হলেন এবং কদ্রু তাকে দাসীত্বে নিযুক্ত করলেন।
এই সময়ে বিনতার দ্বিতীয় ডিম্ব বিদীর্ণ করে মহাবল গরুড় বহির্গত হলেন এবং অগ্নিরাশির ন্যায় তেজোময় বিশাল দেহ ধারণ করে আকাশে উঠে গর্জন করতে লাগলেন। তারপর তিনি সমুদ্রের পরপারে মাতার নিকট গেলেন। কদ্রু বিনতাকে বললেন, সমুদ্রের মধ্যে এক সুরম্য নাগালয় আছে, সেখানে আমকে নিয়ে চল। বিনতা কদ্রুকে এবং গরুড় তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা সর্পগণকে বহন করে নিয়ে চললেন। সূর্যতাপে পুত্ররা কষ্ট পাচ্ছে দেখে কদ্রু ইন্দ্রের স্তব করলেন, ইন্দ্রের আদেশে মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত হল। সর্প সকল হৃষ্ট হয়ে গরুড়ের পিঠে চড়ে এক রমণীয় দ্বীপে এল। তারা গরুড়কে বললে, আমাদের অন্য এক দ্বীপে নিয়ে চল যেখানে নির্মল জল আছে। গরুড় বিনতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদের আজ্ঞানুসারে আমাকে চলতে হবে কেন? বিনতা জানালেন যে, কদ্রু কপট উপায়ে তাকে পণে পরাজিত করে দাসীত্বে নিযুক্ত করেছেন। গরুড় দুঃখিত হয়ে সর্পদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলে আমরা দাসত্ব থেকে মুক্ত হ’তে পারি ? সর্পরা বললে, যদি নিজ বীর্যবলে অমৃত আনতে পার তবে মুক্তি পাবে।
গরুড় বিনতাকে বললেন, আমি অমৃত আনতে যাচ্ছি, পথে কি খাব ? বিনতা বললেন, সমুদ্রের এক প্রান্তে বহু সহস্র নিষাদ বাস করে, তুমি সেই নির্দয় দুরাত্মাদের খেয়ো, কিন্তু ব্রাহ্মণদের কখনও হিংসা ক’রো না। গরুড় আকাশমার্গে যাত্রা করে। নিষাদালয়ে উপস্থিত হলেন এবং মুখব্যাদান করে নিষাদগণকে গ্রাস করতে লাগলেন। এক ব্রাহ্মণ তার পত্নীর সঙ্গে গরুড়ের কণ্ঠে প্রবেশ করেছিলেন। দীপ্ত অঙ্গারের ন্যায় দাহ বোধ হওয়ায় গরুড় বললেন, দ্বিজোত্তম, তুমি শীঘ্র নির্গত হও, ব্রাহ্মণ পাপী হলেও আমার ভক্ষ্য নয়। ব্রাহ্মণ বললেন, তবে আমার নিষাদী ভার্যাকেও ছেড়ে দাও। গরুড় বললেন, আপনি তাকে নিয়ে শীঘ্র বেরিয়ে আসুন, যেন আমার জঠরানলে জীর্ণ না হন। ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক নির্গত হয়ে গরুড়কে আশীর্বাদ করে প্রস্থান করলেন।
তারপর গরুড় তার পিতা মহর্ষি কশ্যপের কাছে গেলেন। কশ্যপ কুশল প্রশ্ন করলে গরুড় বললেন, আমি মাতার দাসীত্ব মোচনের জন্য অমৃত আনতে যাচ্ছি, কিন্তু আমি প্রচুর খাদ্য পাই না, আপনি আমার ক্ষুৎপিপাসানিবৃত্তির উপায় বলুন।
কশ্যপ বললেন, বিভাবসু নামে এক কোপনস্বভাব মহর্ষি ছিলেন, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুপ্রতীক ধনবিভাগের জন্য বার বার অনুরোধ করতেন। একদিন বিভাবসু বললেন, যে ভ্রাতারা গুরু ও শাস্ত্র মানে না তারাই পরস্পরকে শত্রু ভেবে শঙ্কিত হয়; সাধুলোকে ধনবিভাগের প্রশংসা করেন না। তুমি আমার নিষেধ শুনবে না, ভিন্ন হয়ে ধনশালী হ’তে চাও, অতএব আমার শাপে তুমি হস্তী হও। সুপ্রতীকও জ্যেষ্ঠকে শাপ দিলেন, তুমি কচ্ছপ হও। বৎস গরুড়, ওই যে সরোবর দেখছ ওখানে দুই ভ্রাতা গজকচ্ছপ রূপে পরস্পরকে আক্রমণ করছে। তুমি ওই মহাগিরিতুল্য গজ এবং মহামেঘতুল্য কচ্ছপ ভোজন কর।
এক নখে গজ আর এক নখে কচ্ছপকে তুলে নিয়ে গরুড় অলম্ব তীর্থে গেলেন। সেখানকার বৃক্ষসকল শাখাভঙ্গের ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটি বিশাল দিব্য বটবৃক্ষ গরুড়কে বললে, আমার শতযোজন আয়ত মহাশাখায় বসে তুমি গজকচ্ছপ ভোজন কর। গরুড় বসবামাত্র মহাশাখা ভেঙে গেল। বালখিল্য মুনিগণ সেই শাখা তেকে অধোমুখে ঝুলছেন দেখে গরুড় সন্ত্রস্ত হয়ে চঞ্চদ্বারা শাখাটি ধরে ফেললেন এবং বহু দেশে বিচরণ করে অবশেষে গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন। কশ্যপ সেখানে তপস্যা করছিলেন। তিনি পুত্রের অনিষ্টবারণের জন্য বালখিল্যগণকে বললেন, তপোধনগণ, লোকের হিতের নিমিত্ত গরুড় মহৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছে, আপনারা তাকে অনুমতি দিন। তখন বালখিল্যগণ শাখা ত্যাগ করে হিমালয়ে তপস্যা করতে গেলেন। গরুড় শাখা মুখে করে বিকৃতস্বরে পিতাকে বললেন, ভগবান, মানুষবর্জিত এমন স্থান বলুন যেখানে এই শাখা ফেলতে পারি। কশ্যপ একটি তুষারময় জনশূন্য পর্বতের কথা বললেন। গরুড় সেখানে গিয়ে শাখা ত্যাগ করলেন এবং পর্বতশৃঙ্গে বসে গজকচ্ছপ ভোজন করলেন।
ভোজন শেষ করে গরুড় মহাবেগে উড়ে চললেন। অশুভসূচক নানাপ্রকার প্রাকৃতিক উপদ্রব দেখে ইন্দ্রাদি দেবগণ ভীত হলেন। বৃহস্পতি বললেন, কশ্যপ-বিনতার পুত্র কামরূপী গরুড় অমৃত হরণ করতে আসছে। তখন দেবতারা নানাবিধ অস্ত্র ধারণ করে অমৃতরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। গরুড়কে দেখে দেবগণ ভয়ে কম্পিত হয়ে পরস্পরকে অস্ত্রাঘাত করতে লাগলেন। বিশ্বকর্মা অমৃতের রক্ষক ছিলেন, তিনি গরুড়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভূপতিত হলেন। গরুড়ের পক্ষের আন্দোলনে ধূলি উড়ে দেবলোক অন্ধকারাচ্ছন্ন হলে, বায়ু সেই ধূলি অপসারিত করলেন। ইন্দ্রাদি দেবতাদের সঙ্গে গরুড়ের তুমুল যুদ্ধ হ’তে লাগল। পরিশেষে গরুড় জয়ী হলেন এবং স্বর্ণময় ক্ষুদ্র দেহ ধারণ করে অমৃতরক্ষাগারে প্রবেশ করলেন।
গরুড় দেখলেন, অমৃতের চতুর্দিকে অগ্নিশিখা জ্বলছে, তার নিকটে একটি ক্ষুরধার লৌহচক্র নিরন্তর ঘুরছে। তিনি তাঁর দেহ সংকুচিত করে চক্রের অরের অন্তরাল দিয়ে প্রবেশ করে দেখলেন, অমৃত রক্ষার জন্য দুই ভয়ংকর সর্প চক্রের নিম্নদেশে রয়েছে। গরুড় তাদের বধ করে অমৃত নিয়ে আকাশে এসে বিষ্ণুর দর্শন পেলেন। গরুড় অমৃতপানের লোভ সংবরণ করেছেন দেখে বিষ্ণু প্রীত হয়ে বললেন, তোমাকে বর দেব। গরুড় বললেন, আমি তোমার উপরে থাকতে এবং অমৃতপান না করেই অজর অমর হ’তে ইচ্ছা করি। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। তখন গরুড় বললেন, ভগবান, তুমিও আমার কাছে বর চাও। বিষ্ণু বললেন, তুমি আমার বাহন হও, আমার রথধ্বজের উপরেও থেকো। গরুড় তাই হবে বলে মহাবেগে প্রস্থান করলেন।
তখন ইন্দ্র তাকে বজ্রাঘাত করলেন। গরুড় সহাস্যে বললেন, শতক্রতু, দধীচি মুনি, তাঁর অস্থিজাত বজ, এবং তোমার সম্মানের নিমিত্ত আমি একটি পালক ফেলে দিলাম, তোমার বজ্রপাতে আমার কোনও ব্যথা হয় নি। গরুড়ের নিক্ষিপ্ত সেই সুন্দর পালক দেখে সকলে আনন্দিত হয়ে তার নাম দিলেন ‘সুপর্ণ। ইন্দ্র তার সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে বললেন, যদি তোমার অমৃতে প্রয়োজন না থাকে তবে আমাকে ফিরিয়ে দাও, কারণ তুমি যাদের দেবে তারাই আমাদের উপর উপদ্রব করবে। গরুড় বললেন, কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে আমি অমৃত নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আমি রাখব সেখান থেকে তুমি হরণ ক’রো। ইন্দ্র তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে গরুড় বললেন, মহাবল। সর্পগণ আমার ভক্ষ্য হ’ক। ইন্দ্র বললেন, তাই হবে। ও তার পর গরুড় বিনতার কাছে এলেন এবং সর্পভ্রাতাদের বললেন, আমি অমৃত এনেছি, এই কুশের উপর রাখছি, তোমরা স্নান করে এসে খেয়ো। এখন তোমাদের কথা রাখ, আমার মাতাকে দাসীত্ব থেকে মুক্ত কর। তাই হ’ক বলে সর্পরা স্নান করতে গেল, সেই অবসরে ইন্দ্র অমৃত হরণ করলেন। সর্পের দল ফিরে এসে ‘আমি আগে, আমি আগে’ বলে অমৃত খেতে গেল, কিন্তু না পেয়ে কুশ চাটতে লাগল, তার ফলে তাদের জিহ্বা দ্বিধা বিভক্ত হল।
৮। আস্তীকের জন্ম-পরীক্ষিতের মৃত্যুবিবরণ
শৌনক বললেন, কদ্রুর অভিশাপ (১) শুনে তাঁর পুত্রেরা কি করেছিল বল।
সৌতি বললেন – ভগবান শেষ নাগ (অনন্ত, বাসুকি) কদ্রুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি মাতার অভিশাপের পর নানা পবিত্র তীর্থে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁর কাছে এসে বললেন, তোমার কি কামনা তা বল। শেষ উত্তর দিলেন, আমার সহোদরগণ অতি মন্দমতি, তারা আমার বৈমাত্র ভ্রাতা গরুড়কে দ্বেষ করে। আমি পরলোকেও সহোদরদের সংসর্গ চাই না, সেজন্য তপস্যায় প্রাণ বিসর্জন দেব। ব্রহ্মা বললেন, আমি তোমার ভ্রাতাদের আচরণ জানি। ভাগ্যক্রমে তোমার ধর্মবুদ্ধি হয়েছে, তুমি আমার আদেশে এই শৈল-বন-সাগর-জনপদাদি-সমন্বিত চঞ্চল পৃথিবীকে নিশ্চল করে ধারণ কর। শেষ নাগ পাতালে গিয়ে মস্তক দ্বারা পৃথিবী ধারণ করলেন, ব্রহ্মার ইচ্ছায় গরুড় তার সহায় হলেন। পাতালবাসী নাগগণ তাকে বাসুকিরূপে নাগরাজপদে অভিষিক্ত করলেন।।
মাতৃপ্রদত্ত শাপ খণ্ডন লকরবার জন্য বাসুকি তাঁর ধার্মিক ভ্রাতাদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। নাগগণ অনেক প্রকার উপায় নির্দেশ করলেন কিন্তু বাসুকি কোনওটিতে সম্মত হলেন না। তখন এলাপত্র নামে এক নাগ বললেন, আমাদের মাতা যখন অভিশাপ দেন তখন আমি তার ক্রোড়ে বসে শুনেছিলাম-ব্রহ্মা দেবগণকে বলছেন, তপস্বী পরিব্রাজক জরৎকারুর ঔরসে বাসুকির ভগিনী (২) জরৎকারুর গর্ভে আস্তীক। নামে এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবেন, তিনিই ধার্মিক সর্পগণকে রক্ষা করবেন।।
তারপর বাসুকি বহু অন্বেষণের পর মহর্ষি জরকারুকে পেয়ে তাঁকে ভগিনী সম্প্রদান করলেন। সেই ধার্মিক তপস্বী বাসুকির প্রদত্ত রমণীয় গৃহে সস্ত্রীক বাস করতে লাগলেন। তিনি ভার্যাকে বললেন, তুমি কদাচ আমার অপ্রিয় কিছু করবে না, যদি কর তবে এই বাসগৃহ আর তোমাকে ত্যাগ করব। বাসুকির ভগিনী তাতেই সম্মত হলেন এবং শ্বেতকাকী(৩)র ন্যায় পতির সেবা করে যথাকালে গর্ভবতী হলেন। একদিন মহর্ষি তার ক্রোড়ে মস্তক রেখে নিদ্রা যাচ্ছিলেন এমন সময় সূর্যাস্তকাল উপস্থিত হল। পাছে সন্ধ্যাকৃত্যের কাল উত্তীর্ণ হয় এই আশঙ্কায় তিনি মৃদুস্বরে স্বামীকে জাগালেন। মহর্ষি বললেন, নিদ্রাভঙ্গ করে তুমি আমার অবমাননা করেছ, তোমার কাছে আর আমি থাকব না। আমি যতক্ষণ সুপ্ত থাকি ততক্ষণ সূর্যের অস্ত যাবার ক্ষমতা নেই। অনেক অনুনয় করলেও তিনি তার বাক্য প্রত্যাহার করলেন না, যাবার সময় পত্নীকে বলে গেলেন, ভাগ্যবতী, তোমার গর্ভে অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরম ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি আছেন।
যথাকালে বাসুকিভগিনীর বেদকুমার তুল্য এক পুত্ৰ হল। এই পুত্র চ্যবনতনয় প্রমতির কাছে বেদাধ্যয়ন করলেন। মহর্ষি জরৎকারু চ’লে যাবার সময় তার পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানকে লক্ষ্য করে ‘অস্তি’ (আছে) বলেছিলেন সেজন্য তাঁর পুত্র আস্তীক নামে খ্যাত হলেন।
শৌনক জিজ্ঞাসা করলেন, জনমেজয় তার পিতার মৃত্যুর বৃত্তান্ত জানতে চাইলে মন্ত্রীরা তাকে কি বলেছিলেন?
সৌতি বললেন, জনমেজয়ের মন্ত্রীরা এই ইতিহাস বলেছিলেন। অভিমন্যু-উত্তরার পুত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ কৃপাচার্যের শিষ্য এবং গোবিন্দের প্রিয় ছিলেন। ষাট বৎসর বয়স পর্যন্ত রাজত্ব করার পর দুরদৃষ্টক্রমে তার প্রাণনাশ হয়। তিনি প্রপিতামহ পাণ্ডুর ন্যায় মহাবীর ও ধনুর্ধর ছিলেন। একদা পরীক্ষিৎ মৃগয়া করতে গিয়ে একটি মৃগকে বাণবিদ্ধ করে তার অনুসরণ করলেন এবং পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে গহন বনে শমীক নামক এক মুনিকে দেখতে পেলেন। রাজা মৃগ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে মুনি। উত্তর দিলেন না, কারণ তিনি তখন মৌনব্রতধারী ছিলেন। পরীক্ষিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে একটা মৃত সর্প ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে তুলে মুনির স্কন্ধে পরিয়ে দিলেন। মুনি কিছুই বললেন , ক্রোধও প্রকাশ করলেন না। রাজা তখন নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।
শমীক মুনির শৃঙ্গী নামে এক তেজস্বী ক্রোধী পুত্র ছিলেন, তিনি তার আচার্যের গৃহ থেকে ফেরবার সময় কৃশ নামক এক বন্ধুর কাছে শুনলেন, রাজা পরীক্ষিৎ তার তপোরত পিতাকে কিরূপে অপমান করেছেন। শৃঙ্গী ক্রোধে যেন প্রদীপ্ত হয়ে এই অভিশাপ দিলেন, আমার নিরপরাধ পিতার স্কন্ধে যে মৃত সর্প দিয়েছে সেই পাপীকে সপ্ত রাত্রির মধ্যে মহাবিষধর তক্ষক নাগ দগ্ধ করবে। শৃঙ্গী তার পিতার নিকট গিয়ে শাপের কথা জানালেন। শমীক বললেন, বৎস, আমরা পরীক্ষিতের রাজ্যে বাস করি, তিনি আমাদের রক্ষক, তার অনিষ্ট আমি চাই না। তিনি ক্ষুধিত ও শ্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, আমার মৌনব্রত না জেনেই এই কর্ম করেছেন। পুত্র, তাকে অভিশাপ দেওয়া উচিত হয়নি। শৃঙ্গী বললেন, পিতা, আমি যদি অন্যায়ও করে থাকি তথাপি আমার শাপ মিথ্যা হবে না।
গৌরমুখ নামক এক শিষ্যকে শমীক পরীক্ষিতের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। গুরুর উপদেশ অনুসারে গৌরমুখ বললেন, মহারাজ, মৌনব্রতী শমীকের স্কন্ধে আপনি মৃত সর্প রেখেছিলেন, তিনি সেই অপরাধ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তার পুত্র ক্ষমা করেননি, তার শাপে সপ্ত রাত্রির মধ্যে তক্ষক আপনার প্রাণহরণ করবে। শমীক বার বার বলে দিয়েছেন আপনি যেন আত্মরক্ষায় যত্নবান হন।
পরীক্ষিৎ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি একটিমাত্র স্তম্ভের উপর সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করালেন এবং বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণকে নিযুক্ত করলেন। তিনি সেখানে থেকেই মন্ত্রীদের সাহায্যে রাজকার্য করতে লাগলেন, অন্য কেউ তার কাছে আসতে পারত না। সপ্তম দিনে কাশ্যপ নামে এক ব্রাহ্মণ বিষচিকিৎসার জন্য রাজার কাছে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে তক্ষক তাকে বললে, আপনি এত দ্রুত কোথায় যাচ্ছেন? কাশ্যপ বললেন, আজ তক্ষক নাগ পরীক্ষিৎকে দংশন করবে, আমি গুরুর কৃপায় বিষ নষ্ট করতে পারি, রাজাকে সদ্য সদ্য নিরাময় করব। তক্ষক বললে, আমিই তক্ষক, এই বটবৃক্ষে দংশন করছি, আপনার মন্ত্রবল দেখান।
তক্ষকের দংশনে বটবৃক্ষ জ্বলে গেল। কাশ্যপের মন্ত্রশক্তিতে ভস্মরাশি থেকে প্রথমে অঙ্কুর, তারপর দুটি পল্লব, তারপর বহু পত্র ও শাখাপ্রশাখা উদ্ভূত হল। তক্ষক বললে, তপোধন, আপনি কিসের প্রার্থী হয়ে রাজার কাছে যাচ্ছেন ? ব্রাহ্মণের শাপে তার আয়ু ক্ষয় পেয়েছে, আপনি তার চিকিৎসায় কৃতকার্য হবেন কিনা সন্দেহ। রাজার কাছে আপনি যত ধন আশা করেন তার চেয়ে বেশী আমি দেব, আপনি ফিরে যান। কাশ্যপ ধ্যান করে জানলেন যে পরীক্ষিতের আয়ু শেষ হয়েছে, তিনি তক্ষকের কাছে অভীষ্ট ধন নিয়ে চ’লে গেলেন।
তক্ষকের উপদেশে কয়েকজন নাগ তপস্বী সেজে ফল কুশ আর জল নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে গেল। রাজা সেই সকল উপহার নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন এবং অমাত্য-সুহৃগণের সঙ্গে ফল খাবার উপক্রম করলেন। তার ফলে একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট দেখে রাজা তা হাতে ধরে সচিবদের বললেন, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার দুঃখ বা ভয় নেই, শৃঙ্গীর বাক্য সত্য হ’ক, এই কীট তক্ষক হয়ে আমাকে দংশন করুক। এই বলে তিনি নিজের কণ্ঠদেশে এই কীট রেখে হাসতে লাগলেন। তখন কীটরূপী তক্ষক নিজ মূর্তি ধরে রাজাকে বেষ্টন করলে এবং সগর্জনে তাকে দংশন করলে। মন্ত্রীরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন। তার পর তারা দেখলেন, পদ্মবর্ণ তক্ষক আকাশে যেন সীমান্তরেখা বিস্তার করে চলেছে। বিষের অনলে রাজার গৃহ আলোকিত হল। তিনি বজ্রাহতের ন্যায় পড়ে গেলেন।
পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর রাজপুরোহিত এবং মন্ত্রীরা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তার শিশুপুত্র জনমেজয়কে রাজা করলেন। যথাকালে কাশীরাজ সুবর্ণ-বর্মার কন্যা বপুষ্টমার সঙ্গে জনমেজয়ের বিবাহ হল। তিনি অন্য নারীর প্রতি মন দিতেন না, পতিব্রতা রূপবতী বপুষ্টমার সঙ্গে মহানন্দে কালযাপন করতে লাগলেন।
**
(১) ৭-পরিচ্ছেদে।
(২) ইনিই মনসা দেবী।
(৩) টীকাকার নীলকণ্ঠ অর্থ করেছেন স্ত্রী-বক।
৯। জনমেজয়ের সর্পসত্র
মন্ত্রীদের কাছে পিতার মৃত্যুবিবরণ শুনে জনমেজয় অত্যন্ত দুঃখে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন, তার পর জলস্পর্শ করে বললেন, যে দুরাত্মা তক্ষক আমার পিতার প্রাণহিংসা করেছে তার উপর আমি প্রতিশোধ নেব। তিনি পুরোহিতদের প্রশ্ন করলেন, আপনারা এমন ক্রিয়া জানেন কি যাতে তক্ষককে সবান্ধবে প্রদীপ্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা যায়? পুরোহিতরা বললেন, মহারাজ, সৰ্পর্সত্র নামে এক মহাযজ্ঞ আছে, আমরা তার পদ্ধতি জানি।
রাজার আজ্ঞায় যজ্ঞের আয়োজন হতে লাগল। যজ্ঞস্থান মাপবার সময় একজন পুরাণকথক সূত বললে, কোনও ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞের ব্যাঘাত করবেন। জনমেজয় দ্বারপালকে বললেন, আমার অজ্ঞাতসারে কেউ যেন এখানে না আসে। অনন্তর যথাবিধি সর্পসত্র আরম্ভ হল। কৃষ্ণবসনধারী যাজকগণ ধূমে রক্তলোচন হয়ে সর্পগণকে আহ্বান করে অগ্নিতে আহুতি দিতে লাগলেন। নানাজাতীয় নানাবর্ণ অসংখ্য সর্প অগ্নিতে পড়ে বিনষ্ট হল।
তক্ষক নাগ আশ্রয়ের জন্য ইন্দ্রের কাছে গেল। ইন্দ্র বললেন, তোমার ভয় নেই, এখানেই থাক। স্বজনবর্গের মৃত্যুতে কাতর হয়ে বাসুকি তার ভগিনীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি তোমার পুত্রকে বল যেন আমাদের সকলকে রক্ষা করে। তখন জরকারু আস্তীককে পূর্ব ইতিহাস জানিয়ে বললেন, হে অমরতুল্য পুত্র, তুমি আমার ভ্রাতা ও আত্মীয়বর্গকে যজ্ঞাগ্নি থেকে রক্ষা কর। আস্তীক বললেন, তাই হবে, আমি নাগরাজ বাসুকিকে তাঁর মাতৃদত্ত শাপ থেকে রক্ষা করব।
আস্তীক যজ্ঞস্থানে গেলেন, কিন্তু দ্বারপাল তাকে প্রবেশ করতে দিলে না। তখন তিনি স্তুতি করতে লাগলেন—পরীক্ষিৎপুত্র জনমেজয়, তুমি ভরতবংশের প্রধান, তোমার এই যজ্ঞ প্রয়াগে অনুষ্ঠিত চন্দ্র, বরুণ ও প্রজাপতির যজ্ঞের তুল্য; আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়। ইন্দ্রের শত যজ্ঞ, যম রন্তিদেব কুবের ও দাশরথি রামের যজ্ঞ, এবং যুধিষ্ঠির কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রভৃতির যজ্ঞ যেরূপ, তোমার এই যজ্ঞও সেইরূপ; আমাদের প্রিয়জনের যেন মঙ্গল হয়। তোমার তুল্য প্রজাপালক রাজা জীবলোকে নেই, তুমি বরুণ ও ধর্মরাজের তুল্য। তুমি যমের ন্যায় ধর্মজ্ঞ, কৃষ্ণের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন।
আস্তীকের স্তুতি শুনে জনমেজয় বললেন, ইনি অল্পবয়স্ক হলেও বৃদ্ধের ন্যায় কথা বলছেন, এঁকে বর দিতে চাই। রাজার সদস্যগণ বললেন, এই ব্রাহ্মণ সম্মান ও বরলাভের যোগ্য, কিন্তু যাতে তক্ষক শীঘ্র আসে আগে সেই চেষ্টা করুন। আগন্তুক ব্রাহ্মণকে রাজা বর দিতে চান দেখে সপর্সত্রের হোতা চণ্ডভার্গবও প্রীত হলেন না। তিনি বললেন, এই যজ্ঞে এখনও তক্ষক আসে নি। ঋত্বিকগণ বললেন, আমরা বুঝতে পারছি তক্ষক ভয় পেয়ে ইন্দ্রের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তখন রাজার অনুরোধে হোতৃগণ ইন্দ্রকে আহ্বান করলেন। ইন্দ্র বিমানে চড়ে যজ্ঞস্থানে যাত্রা করলেন, তক্ষক তার উত্তরীয়ে লুকিয়ে রইল। জনমেজয় ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তক্ষক যদি ইন্দ্রের কাছে থাকে তবে ইন্দ্রের সঙ্গেই তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করুন।
ইন্দ্র যজ্ঞস্থানের নিকটে এসে ভয় পেলেন এবং তক্ষককে ত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। তক্ষক মন্ত্রপ্রভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে আকাশপথে যজ্ঞাগ্নির অভিমুখে আসতে লাগল। ঋত্বিগণ বললেন, মহারাজ, ওই তক্ষক ঘুরতে ঘুরতে আসছে, তার মহাগর্জন শোনা যাচ্ছে। আপনার কার্যসিদ্ধি হয়েছে, এখন ওই ব্রাহ্মণকে বর দিতে পারেন। রাজা আস্তীককে বললেন, বালক, তুমি সুপণ্ডিত, তোমার অভিপ্রেত বর। চাও। আস্তীক তক্ষকের উদ্দেশে বললেন, তিষ্ঠ তিষ্ঠতিষ্ঠ; তক্ষক আকাশে স্থির হয়ে রইল। তখন আস্তীক রাজাকে বললেন, জনমেজয়, এই যজ্ঞ এখনই নিবৃত্ত হ’ক, অগ্নিতে আর যেন সর্প না পড়ে। জনমেজয় অপ্রীত হয়ে বললেন, ব্রাহ্মণ, সুবর্ণ রজত ধেনু যা চাও দেব, কিন্তু আমার যজ্ঞ যেন নিবৃত্ত না হয়। রাজা এইরূপে বার বার অনুরোধ করলেও আস্তীক বললেন, আমি আর কিছুই চাই না, আপনার যজ্ঞ নিবৃত্ত হ’ক, আমার মাতৃকুলের মঙ্গল হ’ক। তখন সদস্যগণ সকলে রাজাকে বললেন, এই ব্রাহ্মণকে বর দিন।
আস্তীক তার অভীষ্ট বর পেলেন, যজ্ঞ সমাপ্ত হল রাজাও প্রীতিলাভ করে ব্রাহ্মণগণকে বহু অর্থ দান করলেন। তিনি আস্তীককে বললেন, তুমি আমার অশ্বমেধ যজ্ঞে সদস্যরূপে আবার এসো। আস্তীক সম্মত হয়ে মাতুলালয়ে ফিরে গেলেন।
সর্পগণ আনন্দিত হয়ে বর দিতে চাইলে আস্তীক বললেন, প্রসন্ন-চিত্ত ব্রাহ্মণ বা অন্য ব্যক্তি যদি রাত্রিতে বা দিবসে এই ধর্মাখ্যান পাঠ করে তবে তোমাদের কাছ থেকে তার যেন কোনও বিপদ না হয়। সর্পগণ প্রীত হয়ে বললে, ভাগিনেয়, আমরা তোমার কামনা পূর্ণ করব।
আস্তীকঃ সপত্রে বঃ পন্নগান যোহভ্যরক্ষত।
তং স্মরন্তং মহাভাগাঃ ন মাং হিংসিতুমহর্থ।
সর্পাপসৰ্প ভদ্রং তে গচ্ছ সর্প মহাবিষ।
জনমেজয়স্য যজ্ঞান্তে আস্তীকবচনং স্মর৷৷
আস্তীকস্য বচঃ শ্রুত্বা যঃ সপো ন নিবর্ততে।
শতধা ভিদ্যতে মূর্ধা শিংশবৃক্ষফলং যথা ৷৷ (১)
-হে মহাভাগ সর্পগণ, যিনি সর্পসত্রে তোমাদের রক্ষা করেছিলেন সেই আস্তীককে স্মরণ করছি, আমার হিংসা ক’রো না। সর্প, স’রে যাও, তোমার ভাল হ’ক; মহাবিষ সর্প, চ’লে যাও, জনমেজয়ের যজ্ঞের পর আস্তীকের বাক্য স্মরণ কর। আস্তীকের কথায় যে সর্প নিবৃত্ত হয় না তার মস্তক শিমুল (২) ফলের ন্যায় শতধা বিদীর্ণ হয়।
**
(১) সর্পভয়বারক মন্ত্র।
(২) শিংশ বা শিংশপার প্রচলিত অর্থ শিশুগাছ, কিন্তু ব্যাখ্যাকারগণ শিমুল অর্থ করেছেন।
।। আদিবংশাবতরণপর্বাধ্যায়।।
১০। উপরিচর বসু-পরাশর-সত্যবতী-কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
শৌনক বললেন, বৎস সৌতি, সর্পসত্রে কর্মের অবকাশে ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন প্রতিদিন যে মহাভারত পাঠ করতেন তাই আমরা এখন শুনতে ইচ্ছা করি। সৌতি বললেন, জনমেজয়ের অনুরোধে ব্যাসদেবের আদেশে তার শিষ্য বৈশম্পায়ন যে মহাভারতকথা বলেছিলেন তা আপনারা শুনুন। –
(১) চেদি দেশে উপরিচর বসু নামে পুরুবংশজাত এক রাজা ছিলেন। ইন্দ্র তাকে সখা গণ্য করে স্ফটিকময় বিমান, অম্লান পঙ্কজের বৈজয়ন্তী মালা এবং একটি বংশনির্মিত যষ্টি দিয়েছিলেন। উপরিচর অগ্রহায়ণ মাসে উৎসব করে সেই ষষ্টি রাজপুরীতে এনে ইন্দ্রপূজা করতেন। পরদিন তিনি গন্ধমাল্যাদির দ্বার অলংকৃত এবং কুসুম্ভ পুষ্পে রঞ্জিত বস্ত্রে বেষ্টিত করে ইন্দ্ৰধ্বজ উত্তোলন করতেন। সেই অবধি অন্যান্য রাজারাও এইপ্রকার উৎসব করে থাকেন। উপরিচর ইন্দ্রদত্ত বিমানে আকাশে বিচরণ করতেন সেই কারণেই তার এই নাম। তার পাঁচ পুত্র ছিল, তারা বিভিন্ন দেশে রাজবংশ স্থাপন করেন।
উপরিচরের রাজধানীর নিকট শুক্তিমতী নদী ছিল। কোলাহল নামক পর্বত এই নদীর গর্ভে এক পুত্র এবং এক কন্যা উৎপাদন করে। রাজা সেই পুত্রকে সেনাপতি এবং কন্যাকে মহিষী করলেন। একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা তার ঋতুস্নাতা রূপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ করে কামাবিষ্ট হলেন এবং স্থলিত শুক্র এক শ্যেনপক্ষীকে দিয়ে বললেন, তুমি শীঘ্র গিরিকাকে দিয়ে এস। পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণের ফলে শুক্র যমুনার জলে পড়ে গেল। অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্রহ্মশাপে মৎসী হয়ে ছিল, সে শুক্র গ্রহণ করে গর্ভিণী হল এবং দশম মাসে ধীবরের জালে ধৃত হল। ধীবর সেই মৎসীর উদরে একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী সন্তান পেয়ে রাজার কাছে নিয়ে এল। অপ্সরা তখনই শাপমুক্ত হয়ে আকাশ-পথে চ’লে গেল। উপরিচর ধীবরকে বললেন, এই কন্যা তোমারই হ’ক। পুরুষ সন্তানটি পরে মৎস্য নামে এক ধার্মিক রাজা হয়েছিলেন।
সেই রূপগুণবতী কন্যার নাম সত্যবতী, কিন্তু সে মৎস্যজীবীদের কাছে থাকত। সেজন্য তার অন্য নাম মৎস্যগন্ধা। একদিন সে যমুনায় নৌকা চালাচ্ছিল এমন সময় পরাশর মুনি তীর্থপর্যটন করতে করতে সেখানে এলেন। অতীব রূপবতী চারুহাসিনী মৎস্যগন্ধাকে দেখে মোহিত হয়ে পরাশর বললেন, সুন্দরী, এই নৌকার কর্ণধার কোথায় ? সে বললে, যে ধীবরের এই নৌকা তার পুত্র না থাকায় আমিই সকলকে পার করি। পরাশর নৌকায় উঠে যেতে যেতে বললেন, আমি তোমার জন্মবৃত্তান্ত জানি; কল্যাণী, তোমার কাছে বংশধর পুত্র চাচ্ছি, তুমি আমার কামনা পূর্ণ কর। সত্যবতী বললে, ভগবান, পরপারের ঋষিরা আমাদের দেখতে পাবেন। পরাশর তখন কুজঝটিকা সৃষ্টি করলেন, সর্বদিক তমসাচ্ছন্ন হল। সত্যবতী লজ্জিত হয়ে বললে, আমি কুমারী, পিতার বশে চলি, আমার কন্যাভাব দূষিত হলে কি করে গৃহে ফিরে যাব। পরাশর বললেন, আমার প্রিয়কার্য করে তুমি কুমারীই থাকবে। পরাশরের বরে মৎস্যগন্ধার দেহ সুগন্ধময় হল, সে গন্ধবতী নামে খ্যাত হল। এক যোজন দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত সেজন্য লোকে তাকে যোজন-গন্ধাও বলত।
সত্যবতী সদ্য গর্ভধারণ করে পুত্র প্রসব করলেন। যমুনার দ্বীপে জাত এই পরাশরপুত্রের নাম দ্বৈপায়ন (২), ইনি মাতার আদেশ নিয়ে তপস্যায় রত হলেন। পরে ইনি বেদ বিভক্ত করে ব্যাস নামে বিখ্যাত হন এবং পুত্র শুক ও বৈশম্পায়নাদি শিষ্যকে চতুর্বেদ ও মহাভারত অধ্যয়ন করান। তারাই মহাভারতের সংহিতাগুলি পৃথক পৃথক প্রকাশ করেন।
**
(১) এইখানে মহাভারতের মূল আখ্যানের আরম্ভ।
(২) এঁর প্রকৃত নাম কৃষ্ণ, দ্বীপে জাত এজন্য উপনাম দ্বৈপায়ন।
।। সম্ভবপর্বাধ্যায়।।
১১। কচ ও দেবযানী
জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশম্পায়ন কুরুবংশের বৃত্তান্ত আদি থেকে বললেন। ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ প্রজাপতি তাঁর পঞ্চাশটি কন্যাকে পুত্রতুল্য জ্ঞান করতেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা অদিতি থেকে বংশানুক্রমে বিবস্বান (সূর্য), মনু, ইলা, পুরূরবা, আয়ু, নহুষ ও যযাতি উৎপন্ন হন। যযাতি দেবযানী ও শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করেন।
ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্য যখন দেবাসুরের বিরোধ হয় তখন দেবতারা বৃহস্পতিকে এবং অসুররা শুক্রাচার্যকে পৌরোহিত্যে বরণ করেন। এই দুই ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, দেবগণ যে সকল দানবকে যুদ্ধে মারতেন শুক্র বিদ্যাবলে তাদের পুনর্জীবিত করতেন। বৃহস্পতি এই বিদ্যা জানতেন না, সেজন্য দেবপক্ষের মৃত সৈন্য বাঁচাতে পারতেন না। দেবতারা বৃহস্পতির পুত্র কচকে বললেন, তুমি অসুররাজ বৃষপর্বার কাছে যাও, সেখানে শুক্রাচার্যকে দেখতে পাবে। শুক্রের প্রিয়কন্যা দেবযানীকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তবে তুমি নিশ্চয় মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করবে। কচ শুক্রের কাছে গিয়ে বললেন, আমি অঙ্গিরা ঋষির পৌত্র, বৃহস্পতির পুত্র, আমাকে শিষ্য করুন, সহস্র বৎসর আমি আপনার কাছে থাকব। শুক্র সম্মত হলেন। গুরু ও গুরুকন্যার সেবা করে কচ ব্রহ্মচর্য পালন করতে লাগলেন। তিনি গীত নৃত্য বাদ্য করে এবং পুষ্প ফল উপহার দিয়ে প্রাপ্তযৌবনা দেবযানীকে তুষ্ট করতেন। সুগায়ক সুবেশ প্রিয়বাদী রূপবান মাল্যধারী পুরুষকে নারীরা স্বাভাবত কামনা করে, সেজন্য দেবযানীও নির্জন স্থানে কচের কাছে গান গাইতেন এবং তার পরিচর্যা করতেন।
এইরূপে পাঁচ শ বৎসর গত হলে দানবরা কচের অভিসন্ধি বুঝতে পারলে, একদিন কচ যখন বনে গরু চরাচ্ছিলেন তখন তারা তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কুকুরুকে দিলে। কচ ফিরে এলেন না দেখে দেবযানী বললেন, পিতা, আপনার হোম শেষ হয়েছে, সূর্য অস্ত গেছে, গরুর পালও ফিরেছে, কিন্তু কচকে দেখছি না। নিশ্চয় তিনি হত হয়েছেন। আমি সত্য বলছি, কচ বিনা আমি বাঁচব না। শুক্র তখন সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে কচকে আহ্বান করলেন। কচ তখনই কুকুরুদের শরীর ভেদ করে হৃষ্টচিত্তে উপস্থিত হলেন এবং দেবযানীকে জানালেন যে দানবরা তাকে বধ করেছিল। তার পর আবার একদিন কচকে হত্যা করলে এবং শুক্র তাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
তৃতীয় বারে দানবরা কচকে দগ্ধ করে তার ভস্ম সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রকে খাওয়ালে। কচকে না দেখে দেবযানী বিলাপ করতে লাগলেন। শুক্র বললেন, অসুররা তাকে বার বার বধ করছে, আমরা কি করব? তুমি শোক ক’রো না। দেবযানী সরোদনে বললেন, পিতা, বৃহস্পতিপুত্র ব্রহ্মচারী কর্মদক্ষ কচ আমার প্রিয়, আমি তাকেই অনুসরণ করব। তখন শুক্র পূর্বের ন্যায় কচকে আহ্বান করলেন। গুরুর জঠরের ভিতর থেকে কচ বললেন, ভগবান, প্রসন্ন হন, আমি অভিবাদন করছি, আমাকে পুত্র জ্ঞান করুন। অসুররা আমাকে ভস্ম করে সুরার সঙ্গে মিশিয়ে আপনাকে খাইয়েছে। শুক্র দেবযানীকে বললেন, তুমি কিসে সুখী হবে বল, আমার উদর বিদীর্ণ না হলে কচকে দেখতে পাবে না, আমি না মরলে কচ বাঁচবে না। দেবযানী বললেন, আপনার আর কচের মৃত্যু দুইই আমার পক্ষে সমান, আপনাদের কারও মৃত্যু হলে আমি বাঁচব না। তখন শুক্র বললেন, বৃহস্পতির পুত্র, তুমি সিদ্ধিলাভ করেছ, দেবযানী তোমাকে স্নেহ করে। যদি তুমি কচরূপী ইন্দ্র না হও তবে আমার সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ কর। বৎস, তুমি পুত্ররূপে আমার উদর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিও, গুরুর নিকট বিদ্যা লাভ করে তোমার যেন ধর্মবুদ্ধি হয়।
শুক্রের দেহ বিদীর্ণ করে কচ বেরিয়ে এলেন এবং নবলব্ধ বিদ্যার দ্বারা তাকে পুনর্জীবিত করে বললেন, আপনি বিদ্যাহীন শিষ্যের কর্ণে বিদ্যামৃত দান করেছেন, আপনাকে আমি পিতা ও মাতা জ্ঞান করি। শুক্র গাত্রোত্থান করে সুরাপানের প্রতি এই অভিশাপ দিলেন-যে মন্দমতি ব্রাহ্মণ মোহবশে সুরাপান করবে সে ধর্মহীন ও ব্রহ্মহত্যাকারীর তুল্য পাপী হবে। তার পর দানবগণকে বললেন, তোমরা নির্বোধ, কচ সঞ্জীবনী বিদ্যায় সিদ্ধ হয়ে আমার তুল্য প্রভাবশালী হয়েছেন, তিনি আমার কাছেই বাস করবেন।
সহস্র বৎসর অতীত হলে কচ স্বর্গলোকে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দেবযানী তাকে বললেন, অঙ্গিরার পৌত্র, তুমি বিদ্যা কুলশীল তপস্যা ও সংযমে অলংকৃত, তোমার পিতা আমার মাননীয়। তোমার ব্রতপালনকালে আমি তোমার পরিচর্যা করেছি। এখন তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, আমি তোমার প্রতি অনুরক্ত, তুমি আমাকে বিবাহ কর। কচ উত্তর দিলেন, ভদ্রে, তুমি আমার গুরুপুত্রী, তোমার পিতার তুল্যই আমার পূজনীয়, অতএব ও কথা বলো না। দেবযানী বললেন, কচ, তুমি আমার পিতার গুরুপুত্রের পুত্র, আমার পিতার পুত্র নও। তুমিও আমার পূজ্য ও মান্য। অসুররা তোমাকে বার বার বধ করেছিল, তখন থেকে তোমার উপর আমার প্রীতি জন্মেছে। তুমি জান তোমার প্রতি আমার সৌহার্দ্য অনুরাগ আর ভক্তি আছে, তুমি আমাকে বিনা দোষে প্রত্যাখ্যান করতে পার না।
কচ বললেন, দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। চন্দ্রনিভাননী, তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী, অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ কর যেন পথে আমার মঙ্গল হয়। মধ্যে মধ্যে ধর্মের অবিরোধে (১) আমাকে স্মরণ ক’রো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা ক’রো।
দেবযানী বললেন, কচ, যদি আমার প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান কর তবে তোমার বিদ্যা ফলবতী হবে না। কচ উত্তর দিলেন, তুমি আমার গুরুপুত্রী, গুরুও সম্মতি দেননি, সেজন্যই প্রত্যাখ্যান করছি। আমি ধর্মসংগত কথাই বলেছি, তথাপি তুমি কামের বশে আমাকে অভিশাপ দিলে। তোমার যে কামনা তাও সিদ্ধ হবে না, কোনও ঋষিপুত্র তোমাকে বিবাহ করবেন না। তুমি বলেছ, আমার বিদ্যা নিষ্ফল হবে; তাই হ’ক। আমি যাকে শেখাব তার বিদ্যা ফলবতী হবে। এই কথা বলে কচ ইন্দ্রলোকে প্রস্থান করলেন।
**
(১) অর্থাৎ প্রণয়িভাবে নয়, ভ্রাতৃভাবে।
১২। দেবযানী, শর্মিষ্ঠা ও যযাতি
কচ ফিরে এলে দেবতারা আনন্দিত হয়ে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখলেন, তার পর ইন্দ্র অসুরগণের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন। এক রমণীয় বনে কতকগুলি কন্যা জলকেলি করছে দেখে ইন্দ্র বায়ুর রূপ ধরে তাদের বস্ত্রগুলি মিশিয়ে দিলেন। সেই কন্যাদের মধ্যে অসুরপতি বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিলেন, তিনি ভ্রমক্রমে দেবযানীর বস্ত্র পরলেন।
দেবযানী বললেন, অসুরী, আমার শিষ্যা হয়ে তুই আমার কাপড় নিলি কেন? তুই সদাচারহীনা, তোর ভাল হবে না। শর্মিষ্ঠা বললেন, তোর পিতা বিনীত হয়ে নীচে বসে স্তুতিপাঠকের ন্যায় আমার পিতার স্তব করেন। তুই যাচকের কন্যা, আমি দাতার কন্যা।–
আদুম্বস্বু
বিদুম্বস্ব দ্রুহ্য কুপ্যস্ব
যাচকি।
অনায়ুধা সায়ুধায়া রিক্তা ক্ষুভ্যসি ভিক্ষুকি।
লপ্স্যসে
প্রতিযোধ্বারং
ন হি ত্বাং গণয়াম্যহম॥ (১)
——-
যাচকী, যতই বিলাপ কর, গড়াগড়ি দে, বিবাদ কর বা রাগ দেখা, তোর অস্ত্র নেই আমার অস্ত্র আছে। ভিক্ষুকী, তুই নিঃস্ব হয়ে ক্ষোভ করছিস। আমি তোকে গ্রাহ্য করি না, ঝগড়া করবার জন্য তুই নিজের সমান লোক পাবি।
দেবযানী নিজের বস্ত্র নেবার জন্য টানতে লাগলেন, তখন শর্মিষ্ঠা ক্রোধে অধীর হয়ে তাকে এক কূপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলেন এবং মরে গেছে মনে করে নিজের ভবনে চ’লে গেলেন। সেই সময়ে মৃগয়ায় শ্রান্ত ও পিপাসিত হয়ে রাজা যযাতি অশ্বারোহণে সেই কূপের কাছে এলেন। তিনি দেখলেন, কূপের মধ্যে অগ্নিশিখার ন্যায় এক কন্যা রয়েছে। রাজা তাকে আশ্বস্ত করলে দেবযানী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাকে সকুলোদ্ভব শান্ত বীর্যবান দেখছি, আমার দক্ষিণ হস্ত ধ’রে আপনি আমাকে তুলুন। যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার করে রাজধানীতে চ’লে গেলেন।
দেবযানীর দাসীর মুখে সংবাদ পেয়ে শুক্র তখনই সেখানে এলেন। তিনি কন্যাকে আলিঙ্গন করে বললেন, বোধ হয় তোমার কোনও পাপ ছিল তারই এই প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। দেবযানী বললেন, প্রায়শ্চিত্ত হ’ক বা না হ’ক, শর্মিষ্ঠা ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে আমাকে কি বলেছে শুনুন।-তুই স্তুতিকারী যাচকের কন্যা, আর আমি দাতার কন্যা–তোর পিতা যাঁর স্তুতি করেন। পিতা, শর্মিষ্ঠার কথা যদি সত্য হয় তবে তার কাছে নতি স্বীকার করব এই কথা তার সখীকে আমি বলেছি। শুক্র বললেন, তুমি স্তাবক আর যাচকের কন্যা নও, তুমি যাঁর কন্যা তাকেই সকলে স্তব করে, বৃষপর্বা ইন্দ্র আর রাজা যযাতি তা জানেন। যিনি সজ্জন তার পক্ষে নিজের গুণবর্ণনা কষ্টকর, সেজন্য আমি কিছু বলতে চাই না। কন্যা, ওঠ তাকে ক্ষমা করে নিজের গৃহে যাই, সাধুজনের ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ গুণ। ক্ষমার দ্বারা ক্রোধকে যে নিরস্ত করতে পারে সে সর্ব জগৎ জয় করে। দেবযানী বললেন, পিতা, আমি ও সব কথা জানি, কিন্তু পণ্ডিতরা বলেন নীচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল। অস্ত্রাঘাতে যে ক্ষত হয় তা সারে কিন্তু বাকক্ষত সারে না।
তখন শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে দানবরাজ বৃষপর্বার কাছে গিয়ে বললেন, রাজা, পাপের ফল সদ্য দেখা যায় না, কিন্তু যে বার বার পাপ করে সে সমূলে বিনষ্ট হয়। আমার নিস্পাপ ধর্মজ্ঞ শিষ্য কচকে তুমি বধ করিয়েছিলে, তোমার কন্যা আমার কন্যাকে বহু কটু কথা বলে কূপে ফেলে দিয়েছ। তোমার রাজ্যে আমরা আর বাস করব না। বৃষপর্বা বললেন, যদি আমার প্ররোচনায় কচ নিহত হয়ে থাকে। বা দেবযানীকে শর্মিষ্ঠা কটু কথা বলে থাকে, তবে আমার যেন অসদ্গতি হয়। আপনি প্রসন্ন হন, যদি চ’লে যান তবে আমরা সমুদ্রে প্রবেশ করব। শুক্র বললেন, দেবযানী আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার দুঃখ আমি সইতে পারি না। তোমরা তাকে প্রসন্ন কর।
বৃষপর্বা সবান্ধবে দেবযানীর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে বললেন, দেবযানী প্রসন্ন হও, তুমি যা চাইবে তাই দেব। দেবযানী বললেন, সহস্র কন্যার সহিত শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হ’ক, পিতা আমার বিবাহ দিলে তারা আমার সঙ্গে যাবে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের রোষ নিবারণের জন্য শর্মিষ্ঠা দাসীত্ব স্বীকার করলেন।
দীর্ঘকাল পরে একদিন বরবর্ণিনী দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও সহস্র দাসীর সঙ্গে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় রাজা যথাতি মৃগের অন্বেষণে পিপাসিত ও শ্রান্ত হয়ে আবার সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, রত্নভূষিত দিব্য আসনে সহাসিনী দেবযানী বসে আছেন, রূপে অতুলনীয়া স্বর্ণালংকারভূষিতা আর একটি কন্যা কিঞ্চিৎ নিম্ন আসনে বসে দেবযানীর পদসেবা করছেন। যযাতির প্রশ্নের উত্তরে দেবযানী নিজেদের পরিচয় দিলেন। যযাতি বললেন, অসুররাজকন্যা কি করে আপনার দাসী হলেন জানতে আমার কৌতুহল হচ্ছে, এমন সর্বাঙ্গসুন্দরী আমি পূর্বে কখনও দেখি নি। আপনার রূপ এঁর রূপের তুল্য নয়। দেবযানী উত্তর দিলেন, সবই দৈবের বিধানে ঘটে, এঁর দাসীত্বও সেই কারণে হয়েছে। আকার বেশ ও কথাবার্তায় আপনাকে রাজা বোধ হচ্ছে, আপনি কে? যযাতি বললেন, আমি রাজা যযাতি, মৃগয়া করতে এসেছিলাম, এখন অনুমতি দিন ফিরে যাব।
দেবযানী বললেন, শর্মিষ্ঠা আর এই সমস্ত দাসীর সঙ্গে আমি আপনার অধীন হচ্ছি, আপনি আমার ভর্তা ও সখা হন। যযাতি বললেন, সুন্দরী, আমি আপনার যোগ্য নই, আপনার পিতা ক্ষত্রিয় রাজাকে কন্যাদান করবেন না। দেবযানী বললেন, ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পরস্পরের সংসৃষ্ট, আপনি পূর্বেই আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমিও আপনাকে বরণ করেছি। দেবযানী তখন তার পিতাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, পিতা, এই রাজা যযাতি আমার পাণি গ্রহণ করে কুপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আপনাকে প্রণাম করছি, এঁর হস্তে আমাকে সম্প্রদান করুন, আমি অন্য পতি বরণ করব না।
শুক্র বললেন, প্রণয় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না তাই তুমি যযাতিকে বরণ করেছ। কচের শাপে তোমার স্ববর্ণে বিবাহও হ’তে পারে না। যযাতি, তোমাকে এই কন্যা দিলাম, এঁকে তোমার মহিষী কর। আমার বরে তোমার বর্ণসংকরজনিত পাপ হবে না। বৃষপর্বার কন্যা এই কুমারী শর্মিষ্ঠাকে তুমি সসম্মানে রেখো, কিন্তু এঁকে শয্যায় ডেকো না।
দেবযানী শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি তার রাজধানীতে গেলেন। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে তিনি অশোক বনের নিকট শর্মিষ্ঠার জন্য পৃথক গৃহ নির্মাণ করিয়ে দিলেন এবং তার অন্নবস্ত্রাদির উপযুক্ত ব্যবস্থা করলেন। সহস্র দাসীও শর্মিষ্ঠার কাছে রইল।
কিছুকাল পরে দেবযানীর একটি পুত্র হল। শর্মিষ্ঠা ভাবলেন আমার পতি নেই, বৃথা যৌবনবতী হয়েছি; আমিও দেবযানীর ন্যায় নিজেই পতি বরণ করব। একদা যাতি বেড়াতে বেড়াতে অশোক বনে এসে পড়লেন। শর্মিষ্ঠা তাকে সংবর্ধনা করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমার রূপ কুল শীল আপনি জানেন, আমি প্রার্থনা করছি আমার ঋতুরক্ষা করুন। যযাতি বললেন, তুমি সর্ব বিষয়ে অনিন্দিতা তা আমি জানি, কিন্তু তোমাকে শয্যায় আহ্বান করতে শুক্রাচার্যের নিষেধ আছে। শর্মিষ্ঠা বললেন,
ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি
ন স্ত্রীষু রাজন্, ন বিবাহকালে।
প্রাণাত্যযে
সর্বধনাপহাবে
পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি ॥
– |
মহারাজ, পরিহাসে, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জনে, বিবাহকালে, প্রাণসংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়, এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। (২) |
যযাতি বললেন, আমি রাজা হয়ে যদি মিথ্যাচরণ করি তবে প্রজারাও আমার অনুসরণ করে মিথ্যাকথনের পাপে বিনষ্ট হবে। শর্মিষ্ঠা বললেন, যিনি সখীর পতি তিনি নিজের পতির তুল্য, দেবযানীকে বিবাহ করে আপনি আমারও পতি হয়েছেন। পুত্রহীনার পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনার প্রসাদে পুত্রবতী হয়ে আমি ধর্মাচরণ করতে চাই। তখন যযাতি শর্মিষ্ঠার প্রার্থনা পূরণ করলেন।
**
(২) কর্ণপর্ব ১৬-পরিচ্ছেদে অনুরূপ শ্লোক আছে।
১৩। যযাতির জরা
শর্মিষ্ঠার দেবকুমারতুল্য একটি পুত্র হল। দেবযানী তাকে বললেন, তুমি কামের বশে এ কি পাপ করলে ? শর্মিষ্ঠা বললেন, একজন ধর্মাত্মা বেদজ্ঞ ঋষি, আমার কাছে এসেছিলেন, তারই বরে আমার পুত্র হয়েছে, আমি অন্যায় কিছু করি নি। দেবযানী প্রশ্ন করলেন, সেই ব্রাহ্মণের নাম গোত্র বংশ কি? শর্মিষ্ঠা বললেন, তিনি তপস্যার তেজে সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান, তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করবার শক্তি আমার ছিল না। দেবযানী বললেন, তুমি যদি বর্ণজ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ থেকেই অপত্যলাভ করে থাক তবে আর আমার ক্রোধ নেই।
কালক্রমে যদু ও তুর্বসু নামে দেবযানীর দুই পুত্র এবং দ্রুহু, অনু ও পুরু নামে শর্মিষ্ঠার তিন পুত্র হল। একদিন দেবযানী যযাতির সঙ্গে উপবনে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন, দেবকুমারতুল্য কয়েকটি বালক নির্ভয়ে খেলা করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, বৎসগণ, তোমাদের নাম কি, বংশ কি, পিতা কে? বালকরা যযাতি আর শমিষ্ঠার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, এই আমাদের পিতা মাতা। এই বলে তারা রাজার কাছে এল, কিন্তু দেবযানী সঙ্গে থাকায় রাজা তাদের আদর করলেন না, তারা কাঁদতে কাঁদতে শর্মিষ্ঠার কাছে এল। দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে বললেন, তুমি আমার অধীন হয়ে অসুর স্বভাবের বশে আমারই অপ্রিয় কার্য করেছ, আমাকে তোমার ভয় নেই। শর্মিষ্ঠা উত্তর দিলেন, আমি ন্যায় আর ধর্ম অনুসারে চ’লেছি, তোমাকে ভয় করি না। এই রাজর্ষিকে তুমি যখন পতিরূপে বরণ করেছিলে তখন আমিও করেছিলাম। যিনি আমার সখীর পতি, ধর্মানুসারে তিনি আমারও পতি।
তখন দেবযানী বললেন, রাজা, তুমি আমার অপ্রিয় কার্য করেছ, আর আমি এখানে থাকব না। এই বলে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে অশ্রুলোচনে শুক্রাচার্যের কাছে চললেন, রাজাও পিছু পিছু গেলেন। দেবযানী বললেন, অধর্মের কাছে ধর্ম পরাজিত হয়েছে, যে নীচ সে উপরে উঠেছে, শর্মিষ্ঠা আমাকে অতিক্রম করেছে। পিতা, রাজা যযাতি শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র উৎপাদন করেছেন আর দুর্ভাগা আমাকে দুই পুত্র দিয়েছেন। ইনি ধর্মজ্ঞ বলে খ্যাত, কিন্তু আমার মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন।
শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে অধর্ম করেছ আমার উপদেশ গ্রাহ্য করনি, অতএব দুর্জয় জরা তোমাকে আক্রমণ করবে। শাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি বহু অনুনয় করলে শুক্র বললেন, আমি মিথ্যা বলি না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে তোমার জরা অন্যকে দিতে পারবে। যযাতি বললেন, আপনি অনুমতি দিন, যে পুত্র আমাকে তার যৌবন দেবে সেই রাজ্য পাবে এবং পুণ্যবান কীর্তিমান হবে। শুক্র বললেন, তাই হবে।
যযাতি রাজধানীতে এসে জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে বললেন, বৎস, আমি শুক্রের শাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু যৌবনভোগে এখনও তৃপ্ত হইনি। আমার জরা নিয়ে তোমার যৌবন আমাকে দাও, সহস্র বৎসর পরে আবার তোমাকে যৌবন দিয়ে নিজের জরা ফিরিয়ে নেব। যদু উত্তর দিলেন, জরায় অনেক কষ্ট, আমি নিরানন্দ শ্বেতশ্মশ্রু লোলচর্ম দুর্বলদেহ অকর্মণ্য হয়ে যাব, যুবক সহচররা আমাকে অবজ্ঞা করবে। আমার চেয়ে প্রিয়তর পুত্র আপনার আরও তো আছে, তাদের বলুন। যযাতি বললেন, আত্মজ হয়েও যখন আমার অনুরোধ রাখলে না তখন তোমার সন্তান রাজ্যের অধিকারী হবে না।
তারপর যযাতি একে একে তুর্বসু দ্রুহু এবং অনুকে অনুরোধ করলেন কিন্তু কেউ জরা নিয়ে যৌবন দিতে সম্মত হলেন না। যযাতি তাদের এইরূপ শাপ দিলেন-তুর্বসুর বংশলোপ হবে, তিনি অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ জাতির রাজা হবেন, দ্রুহু কখনও অভীষ্ট লাভ করবেন না, তিনি অতি দুর্গম দেশে গিয়ে ভোজ উপাধি নিয়ে বাস করবেন; অনু জরান্বিত হবেন, তাঁর সন্তান যৌবনলাভ করেই মরবে, তিনি অগ্নিহোত্রাদি ক্রিয়াহীন হবেন।
যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার অনুরোধ শুনে তখনই বললেন, মহারাজ আপনার আজ্ঞা পালন করব, আমার যৌবন নিয়ে অভীষ্ট সুখ ভোগ করুন, আপনার জরা আমি নেব। যযাতি প্রীত হয়ে বললেন, বৎস, তোমার রাজ্যে সকল প্রজা সর্ব বিষয়ে সমৃদ্ধি লাভ করবে।।
পুরুর যৌবন পেয়ে যযাতি অভীষ্ট বিষয় ভোগ, প্রজাপালন এবং বহুবিধ ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগলেন। সহস্র বৎসর অতীত হলে তিনি পুরুকে বললেন, পুত্র, তোমার যৌবন লাভ করে আমি ইচ্ছানুসারে বিষয় ভোগ করেছি।
ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শামতি।
হবিযা কৃষ্ণবত্মেব ভুয় এবাভিবর্ধতে৷৷
যৎ পৃথিব্যাং ব্রীহিযবং হিরণ্যং পশবঃ স্ত্রিয়ঃ।
একস্যাপি ন পর্যাপ্তং তস্মাৎ তৃষ্ণাং পরিত্যজেৎ।।
– কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃতসংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পার। পৃথিবীতে যত ধান্য যব হিরণ্য পশু ও স্ত্রী আছে তা একজনের পক্ষেও পর্যাপ্ত নয়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করা উচিত।
তারপর যযাতি বললেন, পুরু, আমি প্রীত হয়েছি, তোমার যৌবন ফিরে নাও, আমার রাজ্যও নাও। তখন ব্রাহ্মণাদি প্রজারা বললেন, মহারাজ, যদু আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র, শুক্রের দৌহিত্র এবং দেবযানীর গর্ভজাত, তার পর আরও তিন পুত্র আছেন; এঁদের অতিক্রম করে কনিষ্ঠকে রাজ্য দিতে চান কেন? যযাতি বললেন, যদু প্রভৃতি আমার আজ্ঞা পালন করেনি, পুরু করেছে; শুক্রাচার্যের বর অনুসারে আমার অনুগত পুত্রই রাজ্য পাবে। প্রজারা রাজার কথার অনুমোদন করলেন।
পুরুকে রাজ্য দিয়ে যযাতি বনে বাস করতে লাগলেন এবং কিছুকাল পরে সুরলোকে চলে গেলেন। তিনি ইন্দ্রকে বলেছিলেন, দেবতা মানুষ গন্ধর্ব আর ঋষিদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তপস্যায় আমার সমান। এই আত্মপ্রশংসার ফলে তিনি ইন্দ্রের আজ্ঞায় স্বর্গচ্যুত হলেন। যযাতি ভূতলে না পড়ে কিছুকাল অন্তরীক্ষে অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমান ও শিবি এই চারজন রাজর্ষির সঙ্গে বিবিধ ধর্মালাপ করলেন। এঁরা যযাতির দৌহিত্র (১) অনন্তর যযাতি পুনর্বার স্বর্গলোকে গেলেন।
**
(১) এঁদের কথা উদ্যোগপর্ব ১৫-পরিচ্ছেদে আছে। সেখানে বসুমানকে বসুমনা বলা হয়েছে।
১৪। দুষ্মন্ত-শকুন্তলা
পুরুর বংশে দুষ্মন্ত (১) নামে এক বীর্যবান রাজা জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পৃথিবীর সর্ব প্রদেশ শাসন করতেন। তাঁর দুই পুত্র হয়, লক্ষণার গর্ভে জনমেজয় এবং শকুন্তলার গর্ভে ভরত। ভরতবংশের যশোরাশি বহুবিস্তৃত। একদা দুষ্মন্ত প্রভূত সৈন্য ও বাহন নিয়ে গহন বনে মৃগয়া করতে গেলেন। বহু পশু বধ করে তিনি একাকী অপর এক বনে ক্ষুৎপিপাসার্ত ও শ্রান্ত হয়ে উপস্থিত হলেন। এই বন অতি রমণীয়, নানাবিধ কুসুমিত বৃক্ষে সমাকীর্ণ এবং ঝিল্লী ভ্রমর ও কোকিলের রবে মুখরিত। রাজা মালিনী নদীর তীরে কন্ব মুনির মনোহর আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও শান্তভাবে বিচরণ করছে।
অনুচরদের অপেক্ষা করতে বলে দুষ্মন্ত আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ এবং বহুবিধ শাস্ত্রের আলোচনা করছেন। মহর্ষি কণ্বের দেখা না পেয়ে তার কুটীরের নিকটে এসে দুষ্মন্ত উচ্চকণ্ঠে বললেন, এখানে কে আছেন? রাজার, বাক্য শুনে লক্ষ্মীর ন্যায় রূপবতী তাপসবেশধারিণী একটি কন্যা বাইরে এলেন এবং দুষ্মন্তকে স্বাগত জানিয়ে আসন পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে সংবর্ধনা করলেন। তারপর মধুর স্বরে কুশল প্রশ্ন করে বললেন, কি প্রয়োজন বলুন, আমার পিতা ফল আহরণ করতে গেছেন, একটু অপেক্ষা করুন, তিনি শীঘ্রই আসবেন।
এই সুনিতম্বিনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে দুষ্মন্ত বললেন, আপনি কে, কার কন্যা, এখানে কোথা থেকে এলেন? কন্যা উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমি ভগবান কম্বের দুহিতা। রাজা বললেন, তিনি তো ঊর্ধরেতা তপস্বী, আপনি তার কন্যা কিরূপে হলেন ? কন্যা বললেন, ভগবান কন্ব এক ঋষিকে আমার জন্মবৃত্তান্ত বলেছিলেন, আমি তা শুনেছিলাম। সেই বিবরণ আপনাকে বলছি, শুনুন –
পূর্বকালে বিশ্বামিত্র ঘোর তপস্যা করছেন দেখে ইন্দ্র ভীত হয়ে মেনকাকে পাঠিয়ে দেন। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে তাকে অভিবাদন করে নৃত্য করতে লাগলেন, সেই সময়ে তার সূক্ষ্ম শুভ্র বসন বায়ু হরণ করলেন। সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। মেনকার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল , তিনি গর্ভবতী হলেন এবং একটি কন্যা প্রসব করেই তাকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে ইন্দ্রসভায় চ’লে গেলেন। সিংহব্যাঘ্রসমাকুল জনহীন বনে সেই শিশুকে পক্ষীরা রক্ষা করতে লাগল। মহর্ষি কন্ব স্নান করতে গিয়ে শিশুকে দেখতে পেলেন এবং গৃহে এনে তাকে দুহিতার ন্যায় পালন করলেন। শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষী কর্তৃক রক্ষিত সেজন্য তার নাম শকুন্তলা হল। আমিই সেই শকুন্তলা। শরীরদাতা প্রাণদাতা ও অন্নদাতাকে ধর্মশাস্ত্রে পিতা বলা হয়। মহারাজ, আমাকে মহর্ষি কন্বের দুহিতা বলে জানবেন।
দুষ্মন্ত বললেন, কল্যাণী, তোমার কথায় জানলাম তুমি রাজপুত্রী, তুমি আমার ভার্যা হও। এই সুবর্ণমালা, বিবিধ বস্ত্র, কুণ্ডল, নানাদেশজাত মণিরত্ন, বক্ষের অলংকার এবং মৃগচর্ম তুমি নাও, আমার সমস্ত রাজ্য তোমারই, তুমি আমার ভার্যা হও। তুমি গান্ধর্বরীতিতে আমাকে বিবাহ কর, এইরূপ বিবাহই শ্রেষ্ঠ।
শকুন্তলা বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমার পিতা ফিরে এলেই আপনার হাতে আমাকে সম্প্রদান করবেন। তিনিই আমার প্রভু ও পরম দেবতা, তাঁকে অবমাননা করে অধর্মানুসারে পতিবরণ করতে পারি না। দুষ্মন্ত বললেন, বরবর্ণিনী, ধর্মানুসারে তুমি নিজেই নিজেকে দান করতে পার। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে গান্ধর্ব বা রাক্ষস বিবাহ অথবা এই দুইএর মিশ্রিত রীতিতে বিবাহ ধর্মসংগত, অতএব তুমি গান্ধর্ব বিধানে আমার ভার্যা হও। শকুন্তলা বললেন, তাই যদি ধর্মসংগত হয় তবে আগে এই অঙ্গীকার করুন যে আমার পুত্র যুবরাজ হবে এবং আপনার পরে সেই পুত্রই রাজা হবে।
কিছুমাত্র বিচার না করে দুষ্মন্ত উত্তর দিলেন, তুমি যা বললে তাই হবে। মনস্কামনা সিদ্ধ হলে তিনি শকুন্তলাকে বার বার বললেন, সুহাসিনী, আমি চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাব, তারা তোমাকে আমার রাজধানীতে নিয়ে যাবে। এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং কন্ব শুনে কি বলবেন তা ভাবতে ভাবতে দুষ্মন্ত নিজের পুরীতে ফিরে গেলেন।
কণ্ব আশ্রমে ফিরে এলে শকুন্তলা লজ্জায় তার কাছে গেলেন না, কিন্তু মহর্ষি দিব্যদৃষ্টিতে সমস্ত জেনে প্রীত হয়ে বললেন, ভদ্রে, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আজ যে পুরুষসংসর্গ করেছ তাতে তোমার ধর্মের হানি হয় নি। নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে সকাম পুরুষের সকামা স্ত্রীর সঙ্গে যে মিলন তাকেই গান্ধর্ব বিবাহ বলে, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ঠ। শকুন্তলা, তোমার পতি দুষ্মন্ত ধর্মাত্মা এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার যে পুত্র হবে সে সাগরবেষ্টিতা সমগ্র পৃথিবী ভোগ করবে। শকুন্তলা কন্বের আনীত ফলাদির বোঝা নামিয়ে রেখে তার পা ধুইয়ে দিলেন এবং তার শান্তি দূর হলে বললেন, আমি স্বেচ্ছায় দুষ্মন্তকে পতিত্বে বরণ করেছি, আপনি মন্ত্রিসহ সেই রাজার প্রতি অনুগ্রহ করুন। শকুন্তলার প্রার্থনা অনুসারে কন্ব বর দিলেন, পুরুবংশীয়গণ ধর্মিষ্ঠ হবে, কখনও রাজ্যচ্যুত হবে না।
তিন বৎসর পরে (২) শকুন্তলা একটি সুন্দর মহাবলশালী অগ্নিতুল্য দ্যুতিমান পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র কম্বের আশ্রমে পালিত হ’তে লাগল এবং ছ বৎসর বয়সেই সিংহ ব্যাঘ্র বরাহ মহিষ হস্তী প্রভৃতি ধরে এনে আশ্রমস্থ বৃক্ষে বেঁধে রাখত। সকল জন্তুকেই সে দমন করত সেজন্য আশ্রমবাসীরা তার নাম দিলেন সর্বদমন। তার অসাধারণ বলবিক্রম দেখে কণ্ব বললেন, এর যুবরাজ হবার সময় হয়েছে। তার পর তিনি শিষ্যদের বললেন, নারীরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে নিন্দা হয়, তাতে সুনাম চরিত্র ও ধর্মও নষ্ট হ’তে পারে। অতএব তোমরা শীঘ্র শকুন্তলা আর তার পুত্রকে দুষ্মন্তের কাছে দিয়ে এস।
শকুন্তলাকে রাজভবনে পৌঁছিয়ে দিয়ে শিষ্যরা ফিরে গেলেন। শকুন্তলা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে অভিবাদন করে বললেন, রাজা, এই তোমার পুত্র, আমার গর্ভে জন্মেছে। কন্বের আশ্রমে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা স্মরণ কর, একে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত কর। পূর্বকথা স্মরণ হলেও রাজা বললেন, আমার কিছু মনে পড়ছে না, দুষ্ট তাপসী, তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার ধর্ম অর্থ বা কামের কোনও সম্বন্ধ হয় নি, তুমি যাও বা থাক বা যা ইচ্ছা করতে পার।
লজ্জায় ও দুঃখে যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে শকুন্তলা স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চক্ষু রক্তবর্ণ হল , ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, বক্র কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন, এই বালক তোমার আত্মজ, একে ত্যাগ করতে পার না।
তার ক্রোধ ও তেজ দমন করে বললেন, মহারাজ, তোমার স্মরণ থাকলেও প্রাকৃত জনের ন্যায় কেন বলছ যে মনে নেই? তুমি সত্য বল, মিথ্যা বলে নিজেকে অপমানিত ক’রো না। আমি তোমার কাছে যাচিকা হয়ে এসেছি, যদি আমার কথা না শোন তবে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে। আমাকে যদি পরিত্যাগ কর তবে আমি আশ্রমে ফিরে যাব, কিন্তু এই দুষ্মন্ত বললেন, তোমার গর্ভে আমার পুত্র হয়েছিল তা আমার মনে নেই। নারীরা মিথ্যা কথাই বলে থাকে। তোমার জননী মেনকা অসতী ও নির্দয়া, ব্রাহ্মণত্বলোভী তোমার পিতা বিশ্বামিত্র কামুক ও নির্দয়। তুমি নিজেও ভ্রষ্টার ন্যায় কথা বলছ। দুষ্ট তাপসী, দূর হও। শকুন্তলা বললেন, মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা। রাজা, তুমি ভূমিতে চল, আমি অন্তরীক্ষে চলি, ইন্দ্রকুবেরাদির গৃহে যেতে পারি। যে নিজে দুর্জন সে সজ্জনকে দুর্জন বলে, এর চেয়ে হাস্যকর কিছু নেই। যদি তুমি মিথ্যারই অনুরক্ত হও তবে আমি চ’লে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে না। দুষ্মন্ত, তোমার সাহায্য না পেলেও আমার পুত্র হিমালয়-ভূষিত চতুঃসাগরবেষ্টিত এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। এই বলে শকুন্তলা চ’লে গেলেন।
তখন দুষ্মন্ত অন্তরীক্ষ থেকে এই দৈববাণী শুনলেন-শকুন্তলা সত্য বলেছেন, তুমিই তার পুত্রের পিতা, তাকে ভরণপোষণ কর, তার নাম ভরত হ’ক। রাজা হৃষ্ট হয়ে পুরোহিত ও অমাত্যদের বললেন, আপনারা দেবদূতের কথা শুনলেন, আমি নিজেও ওই বালককে পুত্র বলে জানি, কিন্তু যদি কেবল শকুন্তলার কথায় তাকে নিতাম তবে লোকে দোষ দিত। তার পর দুষ্মন্ত তার পুত্র ও ভাষা শকুন্তলাকে আনন্দিত মনে গ্রহণ করলেন। তিনি শকুন্তলাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দেবী, তোমার সতীত্ব প্রতিপাদনের জন্যই আমি এইরূপ ব্যবহার করেছিলাম, নতুবা লোকে মনে করত তোমার সঙ্গে আমার অসৎ সম্বন্ধ হয়েছিল। এই পুত্রকে রাজ্য দেব তা পূর্বেই স্থির করেছি। প্রিয়ে, তুমি ক্রোধবশে আমাকে যেসব অপ্রিয় কথা বলেছ তা আমি ক্ষমা (৩) করলাম।
**
(১) বা দুষ্যন্ত।
(২) টীকাকার বলেন, মহাপুরুষগণ দীর্ঘকাল গর্ভে বাস করেন।
(৩) দুষ্মন্ত নিজের কটূক্তির জন্য ক্ষমা চাইলেন না।
১৫৷ মহাভিষ-অষ্টবসু-প্রতীপ-শান্তনু-গঙ্গা
দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরত বহু দেশ জয় এবং বহুশত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী হয়েছিলেন। তার বংশের এক রাজার নাম হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর নগর স্থাপন করেন। হস্তীর চার পুরুষ পরে কুরু রাজা হন, তার নাম অনুসারে কুরুজাঙ্গল দেশ খ্যাত হয়। তিনি যেখানে তপস্যা করেছিলেন সেই স্থানই পবিত্র কুরুক্ষেত্র। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষের নাম প্রতীপ, তাঁর পুত্র শান্তনু।
মহাভিষ নামে ইক্ষাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন, তিনি বহু যজ্ঞ করে স্বর্গে যান। একদিন তিনি দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সহসা বায়ুর প্রভাবে গঙ্গার সূক্ষ্ম বসন অপসৃত হল। দেবগণ অধোমুখ হয়ে রইলেন, কিন্তু মহাবিষ গঙ্গাকে অসংকোচে দেখতে লাগলেন। ব্রহ্মা তাকে শাপ দিলেন, তুমি মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ কর, পরে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। মহাভি, স্থির করলেন তিনি মহাতেজস্বী প্রতীপ রাজার পুত্র হবেন।
গঙ্গা মহাভিষকে ভাবতে ভাবতে মর্তে ফিরে আসছিলেন, পথিমধ্যে দেখলেন বসু নামক দেবগণ মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছেন। গঙ্গার প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, বশিষ্ঠ আমাদের শাপ দিয়েছেন—তোমরা নরযোনিতে জন্মগ্রহণ কর। আমরা মানুষীর গর্ভে যেতে চাই না, আপনিই আমাদের পুত্ররূপে প্রসব করুন, প্রতীপের পুত্র শান্তনু আমাদের পিতা হবেন। জন্মের পরেই আপনি আমাদের জলে ফেলে দেবেন, যাতে আমরা শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই। গঙ্গা বললেন, তাই করব, কিন্তু যেন একটি পুত্র জীবিত থাকে, নতুবা শান্তনুর সঙ্গে আমার সংগম ব্যর্থ হবে। বসুগণ বললেন, আমরা প্রত্যেকে নিজ বীর্যের অষ্টমাংশ দেব, তার ফলে একটি পুত্র জীবিত থাকবে। এই পুত্র বলবান হবে কিন্তু তার সন্তান হবে না।
রাজা প্রতীপ গঙ্গাতীরে বসে জপ করছিলেন এমন সময় মনোহর নারীরূপ ধারণ করে গঙ্গা জল থেকে উঠে প্রতীপের দক্ষিণ ঊরুতে বসলেন। রাজা বললেন, কল্যাণী, কি চাও? গঙ্গা বললেন, কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি তোমাকে চাই। রাজা বললেন, এ পরস্ত্রী আর অসবর্ণা আমার অগম্যা। গঙ্গা বললেন, আমি দেবকন্যা, অগম্যা নই। রাজা বললেন, তুমি আমার বাম উরুতে না বসে দক্ষিণ ঊরুতে বসেছ, যেখানে পুত্র কন্যা আর পুত্রবধূর স্থান। তুমি আমার পুত্রবধূ হয়ো। গঙ্গা বললেন, তাই তা হব, কিন্তু আমার কোনও কার্যে আপনার পুত্র আপত্তি করতে পারবেন না। প্রতীপ সম্মত হলেন।
গঙ্গা অন্তর্হিত হলে প্রতীপ ও তার পত্নী পুত্রলাভের জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। রাজা মহাভিষ তাদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করলেন, তার নাম হল শান্তনু। শান্তনু যৌবন লাভ করলে প্রতীপ তাকে বললেন, তোমার নিমিত্ত এক রূপবতী কন্যা পূর্বে আমার কাছে এসেছিল। সে যদি পুত্রকামনায় তোমার কাছে উপস্থিত হয়, তবে তার ইচ্ছা পূর্ণ ক’রো, কিন্তু তার পরিচয় জানতে চেয়ো না, তার কার্যেও বাধা দিও না। তার পর প্রতীপ তার পুত্র শান্তনুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে বনে প্রস্থান করলেন।
একদিন শান্তনু গঙ্গার তীরে এক দিব্যাভরণভূষিতা পরমা সুন্দরী নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, তুমি দেবী দানবী অপ্সরা না মানুষী? তুমি আমার ভার্যা হও। গঙ্গা উত্তর দিলেন, রাজা, আমি তোমার মহিষী হব, কিন্তু আমি শুভ বা অশুভ যাই করি তুমি যদি বারণ বা ভৎর্সনা কর তবে তোমাকে নিশ্চয় ত্যাগ করব। শান্তনু তাতেই সম্মত হলেন।
ভার্যার স্বভাবচরিত্র রূপগুণ ও সেবায় পরিতৃপ্ত হয়ে শান্তনু সুখে কালযাপন করতে লাগলেন। তার আটটি দেবকুমার তুল্য পুত্র হয়েছিল। প্রত্যেক পুত্রের জন্মের পরেই গঙ্গা তাকে জলে নিক্ষেপ করে বলতেন, এই তোমার প্রিয়কার্য করলাম। শান্তনু অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বলতেন না, পাছে গঙ্গা তাকে ছেড়ে চ’লে যান। অষ্টম পুত্র প্রসবের পর গঙ্গা হাসছেন দেখে শান্তনু বললেন, একে মেরো না, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? গঙ্গা বললেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার কাছে থাকাও আমার শেষ হল। গঙ্গা নিজের পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের এই বৃত্তান্ত বললেন –
একদা পৃথু প্রভৃতি বন্ধুগণ নিজ নিজ পত্নীসহ সুমেরু পর্বতের পার্শ্ববর্তী বশিষ্ঠের। তপোবনে বিহার করতে এসেছিলেন। বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে দেখে দ্য-নামক বসুর পত্নী তার স্বামীকে বললেন, আমার সখী রাজকন্যা জিতবতীকে এই ধেনু উপহার দিতে চাই। পত্নীর অনুরোধে দ্যু-বসু নন্দিনীকে হরণ করলেন। বশিষ্ঠ আশ্রমে এসে দেখলেন নন্দিনী নেই। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, যারা আমার ধেনু নিয়েছে তারা মানুষ হয়ে জন্মাবে। বসুগণের অনুনয়ে প্রসন্ন হয়ে বশিষ্ঠ বললেন, তোমরা সকলে এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবে, কিন্তু দু-বসু নিজ কর্মের ফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন। তিনি ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রবিশারদ, পিতার প্রিয়কারী এবং স্ত্রীসম্ভোগত্যাগী হবেন।
তার পর গঙ্গা বললেন, মহারাজ, অভিশপ্ত বসুগণের অনুরোধে আমি তাদের প্রসব করে জলে নিক্ষেপ করেছি, কেবল দু-বসু-যিনি এই অষ্টম পুত্র—দীর্ঘজীবী হয়ে বহুকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন এবং পুনর্বার স্বর্গলোকে যাবেন। এই বলে গঙ্গা নবজাত পুত্রকে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন।
১৬। দেবব্রত-ভীষ্ম-সত্যবতী
শান্তনু দুঃখিত মনে তার রাজধানী হস্তিনাপুরে গেলেন। তিনি সর্বপ্রকার রাজগুণে। মণ্ডিত ছিলেন এবং কামরাগবর্জিত হয়ে ধর্মানুসারে রাজ্যশাসন করতেন। ছত্রিশ বৎসর তিনি স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছিলেন।
একদিন তিনি মৃগের অনুসরণে গঙ্গাতীরে এসে দেখলেন, দেবকুমারতুল্য চারুদর্শন দীর্ঘকায় এক বালক শরবর্ষণ করে গঙ্গা আচ্ছন্ন করছে। শান্তনুকে কথায় মোহিত করে সেই বালক অন্তর্হিত হল। তাকে নিজের পুত্র অনুমান করে শান্তনু বললেন, গঙ্গা, আমার পুত্রকে দেখাও। তখন শুভ্রবসনা সালংকারা গঙ্গা পুত্রের হাত ধরে আবির্ভূত হয়ে বললেন, মহারাজ, এই আমার অষ্টমগর্ভজাত পুত্র, একে আমি পালন করে বড় করেছি। এ বশিষ্ঠের কাছে বেদ অধ্যয়ন করেছে। শুক্র ও বৃহস্পতি যত শাস্ত্র জানেন, জামদগ্ন্য যত অস্ত্র জানেন, সে সমস্তই এ জানে। এই মহাধনুর্ধর রাজধর্মজ্ঞ পুত্রকে তুমি গৃহে নিয়ে যাও।
দেবব্রত নামক এই পুত্রকে শান্তনু রাজভবনে নিয়ে গেলেন এবং তাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। রাজ্যের সকলেই এই গুণবান রাজকুমারের অনুরক্ত হলেন। চার বৎসর পরে শান্তনু একদিন যমুনাতীরবর্তী বনে বেড়াতে বেড়াতে অনির্বচনীয় সুগন্ধ অনুভব করলেন এবং তার অনুসরণ করে দেবাঙ্গনার ন্যায় রূপবতী একটি কন্যার কাছে উপস্থিত হলেন। রাজার প্রশ্নের উত্তরে সেই কন্যা বললেন, আমি দাস (১) রাজের কন্যা, পিতার আজ্ঞায় নৌকাচালনা করি। শান্তনু দাসরাজের কাছে গিয়ে সেই কন্যা চাইলেন। দাসরাজ বললেন, আপনি যদি একে ধর্মপত্নী করেন এবং এই প্রতিশ্রুতি দেন যে এর গর্ভজাত পুত্রই আপনার পরে রাজা হবে তবে কন্যাদান করতে পারি।
শান্তনু উক্তপ্রকার প্রতিশ্রুতি দিতে পারলেন না, তিনি সেই রূপবতী কন্যাকে ভাবতে ভাবতে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। পিতাকে চিন্তান্বিত দেখে দেবব্রত বললেন, মহারাজ, রাজ্যের সর্বত্র কুশল, তথাপি আপনি চিন্তাকুল হয়ে আছেন। কেন? আপনি আর অশ্বারোহণে বেড়াতে যান না, আপনার শরীর বিবর্ণ ও কৃশ হয়েছে, আপনার কি রোগ বলুন। শান্তনু বললেন, বৎস, আমার মহান্ বংশে তুমিই একমাত্র সন্তান, তুমি সর্বদা অস্ত্রচর্চা করে থাক, কিন্তু তোমার বিপদ ঘটলে আমার বংশলোপ হবে। তুমি শতপুত্রেরও অধিক সেজন্য আমি বংশবৃদ্ধির নিমিত্ত বৃথা পুনর্বার বিবাহ করতে ইচ্ছা করি না, তোমার মঙ্গল হ’ক এই কামনাই করি। কিন্তু বেদজ্ঞগণ বলেন, পুত্র না থাকা আর একটিমাত্র পুত্র দুই সমান। তোমার অবর্তমানে আমার বংশের কি হবে এই চিন্তাই আমার দুঃখের কারণ।
বুদ্ধিমান দেবব্রত বৃদ্ধ অমাত্যের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পিতার শোকের কারণ কি? অমাত্য জানালেন, রাজা দাসকন্যাকে বিবাহ করতে চান। দেবব্রত বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে নিয়ে দাসরাজের কাছে গেলেন এবং পিতার জন্য কন্যা প্রার্থনা করলেন। দাসরাজ সসম্মানে তাকে সংবর্ধনা করে বললেন, এরূপ শ্লাঘনীয় বিবাহসম্বন্ধ কে না চায়? যিনি আমার কন্যা সত্যবতীর জন্মদাতা, সেই উপরিচর রাজা বহুবার আমাকে বলেছেন যে শান্তনুই তার উপযুক্ত পতি। কিন্তু এই বিবাহে একটি দোষ আছে—বৈমাত্র ভ্রাতারূপে তুমি যার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে সে কখনও সুখে থাকতে পারবে না।
গাঙ্গেয় দেবব্রত বললেন, আমি সত্যপ্রতিজ্ঞা করছি শুনুন, এরূপ প্রতিজ্ঞা অন্য কেউ করতে পারে না—আপনার কন্যার গর্ভে যে পুত্র হবে সেই রাজত্ব পাবে। দাসরাজ বললেন, সৌম্য, তুমি রাজা শান্তনুর একমাত্র অবলম্বন, এখন আমার কন্যারও রক্ষক হলে, তুমিই একে দান করতে পার। তথাপি কন্যাকর্তার অধিকার অনুসারে আমি আরও কিছু বলছি শোন। হে সত্যবাদী মহাবাহু, তোমার প্রতিজ্ঞা কদাচ মিথ্যা হবে না, কিন্তু তোমার যে পুত্র হবে তাকেই আমার ভয়। দেবব্রত বললেন, আমি পূর্বেই সমগ্র রাজ্য ত্যাগ করেছি, এখন প্রতিজ্ঞা করছি আমার পুত্রও হবে না। আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করব, আমার পুত্র না হলেও অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে।
দেবব্রতের প্রতিজ্ঞা শুনে দাসরাজ রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, আমি সত্যবতীকে দান করব। তখন আকাশ থেকে অপ্সরা দেবগণ ও পিতৃগণ পুষ্পবৃষ্টি করে বললেন, এঁর নাম ভীষ্ম হল। সত্যবতীকে ভীষ্ম বললেন, মাতা, রথে উঠুন, আমরা স্বগৃহে। যাব। হস্তিনাপুরে এসে ভীষ্ম পিতাকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। সকলেই তার দুষ্কর কার্যের প্রশংসা করে বললেন, ইনি ভীষ্ম(২)ই বটেন। শান্তনু পুত্রকে বর দিলেন, হে নিস্পাপ, তুমি যতদিন বাঁচতে ইচ্ছা করবে তত দিন তোমার মৃত্যু হবে না, তোমার ইচ্ছানুসারেই মৃত্যু হবে।
**
(২) যিনি ভীষণ অর্থাৎ দুঃসাধ্য কর্ম করেন।
১৭। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য-কাশীরাজের তিন কন্যা
সত্যবতীর গর্ভে শান্তনুর দুই পুত্র হল, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবনলাভ করবার পূর্বেই শান্তনু গত হলেন, সত্যবতীর মত নিয়ে ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলশালী ছিলেন এবং মানুষ দেবতা অসুর গন্ধর্ব সকলকেই নিকৃষ্ট মনে করতেন। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাকে বললেন, তোমার আর আমার নাম একই, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর নতুবা অন্য নাম নাও। কুরুক্ষেত্রে হিরন্মতী নদীর তীরে দুজনের ঘোর যুদ্ধ হল , তাতে কুরুনন্দন – চিত্রাঙ্গদ নিহত হলেন। ভীষ্ম অপ্রাপ্তযৌবন বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে বসালেন।।
বিচিত্রবীর্য যৌবনলাভ করলে ভীষ্ম তার বিবাহ দেওয়া স্থির করলেন। কাশীরাজের তিন পরমা সুন্দরী কন্যার একসঙ্গে স্বয়ংবর হবে শুনে ভীষ্ম বিমাতার অনুমতি নিয়ে রথারোহণে একাকী বারাণসীতে গেলেন। তিনি দেখলেন, নানা দেশ থেকে রাজারা স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছেন। যখন পরিচয় দেবার জন্য রাজাদের নামকীর্তন করা হল তখন কন্যারা ভীষ্মকে বৃদ্ধ ও একাকী দেখে তাঁর কাছ থেকে সরে গেলেন। সভায় যে সকল হীনমতি রাজা ছিলেন তারা হেসে বললেন, এই পরম ধর্মাত্মা পলিতকেশ নির্লজ্জ বৃদ্ধ এখানে কেন এসেছে? যে প্রতিজ্ঞাপালন করে না তাকে লোকে কি বলবে? ভীষ্ম বৃথাই ব্রহ্মচারী খ্যাতি পেয়েছেন।
উপহাস শুনে ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হয়ে তিনটি কন্যাকে নিজের রথে তুলে নিলেন এবং জলদগম্ভীরস্বরে বললেন, রাজগণ, বহুপ্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে, কিন্তু ধর্মাদিগণ বলেন যে স্বয়ংবরসভায় বিপক্ষদের পরাভুত করে কন্যা হরণ করাই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। আমি এই কন্যাদের নিয়ে যাচ্ছি, তোমাদের শক্তি থাকে তো যুদ্ধ কর। রাজারা ক্রোধে ওষ্ঠ দংশন করে সভা থেকে উঠলেন এবং অলংকার খুলে ফেলে বর্ম ধারণ করে নিজ নিজ রথে উঠে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। সর্বশস্ত্রবিশারদ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে রাজারা পরাজিত হলেন, কিন্তু মহারথ শাম্বরাজ তার পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, থাম, থাম। ভীষ্মের শরাঘাতে শারে সারথি ও অশ্ব নিহত হল , শাম্ব ও অন্যান্য রাজারা যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে চ’লে গেলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম তিন কন্যাকে পুত্রবধূ, কনিষ্ঠা ভগিনী বা দুহিতার ন্যায় যত্নসহকারে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন।
ভীষ্ম বিবাহের উদযোগ করছেন জেনে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা (১) হাস্য করে তাকে বললেন, আমি স্বয়ংবরে শাম্বরাজকেই বরণ করতাম, তিনিও আমাকে চান, আমার পিতারও তাতে সম্মতি আছে। ধর্মজ্ঞ, আপনি ধর্ম পালন করুন। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে অম্বাকে শাম্বরাজ্যের কাছে পাঠালেন এবং অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন।
বিচিত্রবীর্য সেই দুই সুন্দরী পত্নীকে পেয়ে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। সাত বৎসর পরে তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন। সুহৃৎ ও চিকিৎসকগণ প্রতিকারের বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু আদিত্য যেমন অস্তাচলে যান বিচিত্রবীর্য ও সেইরূপ যমসদনে গেলেন।
**
(১) অম্বার পরবর্তী ইতিহাস উদযোগপর্ব ২৭-পরিচ্ছেদে আছে।
১৮। দীর্ঘতমা-ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম-অণীমাণ্ডব্য
পুত্রশোকার্তা সত্যবতী তার দুই বধূকে সান্ত্বনা দিয়ে ভীষ্মকে বললেন, রাজা শান্তনুর পিণ্ড কীর্তি ও বংশ রক্ষার ভার এখন তোমার উপর। তুমি ধর্মের তত্ত ও কুলাচার সবই জান, এখন আমার আদেশে বংশরক্ষার জন্য দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন কর, অথবা স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হও এবং বিবাহ কর, পিতৃপুরুষগণকে নরকে নিমগ্ন ক’রো না।
ভীষ্ম বললেন, মাতা, আমি ত্রিলোকের সমস্তই ত্যাগ করতে পারি কিন্তু যে সত্যপ্রতিজ্ঞা করেছি তা ভঙ্গ করতে পারি না। শান্তনুর বংশ যাতে রক্ষা হয় তার ক্ষত্রধর্মর্সম্মত উপায় বলছি শুনুন। পুরাকালে জামদগ্ন্য পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হলে ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, কারণ বেদে বলা আছে যে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীরই পুত্র হয়। উতথ্য ঋষির পত্নী মমতা যখন গর্ভিণী ছিলেন তখন তার দেবর বৃহস্পতি সংগম প্রার্থনা করেন। মমতার নিষেধ না শুনে বৃহস্পতি বলপ্রয়োগে উদ্যত হলেন, তখন গর্ভস্থ শিশু। তার পা দিয়ে পিতৃব্যের চেষ্টা ব্যর্থ করলে। বৃহস্পতি শিশুকে শাপ দিলেন, তুমি। অন্ধ হবে। উতথ্যের পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন, তার নাম হল দীর্ঘতমা। তিনি ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু গোধর্ম (১) অবলম্বন করায় প্রতিবেশী মুনিগণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ত্যাগ করলেন। দীর্ঘতমার পুত্রেরা মাতার আদেশে পিতাকে ভেলায়। চড়িয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন। ধর্মাত্মা বলি রাজা তাকে দেখতে পেয়ে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়ে গেলেন এবং মহিষী সুদেষ্ণাকে তার কাছে যেতে বললেন। অন্ধ বৃদ্ধ দীর্ঘতমার কাছে সুদেষ্ণা নিজে গেলেন না, তার ধাত্রীকন্যাকে পাঠালেন। সেই শূদ্রকন্যার গর্ভে কাক্ষীবান প্রভৃতি এগারজন ঋষি উৎপন্ন হন। তারপর রাজার নির্বন্ধে সুদেষ্ণা স্বয়ং গেলেন, দীর্ঘতমা তার অঙ্গ স্পর্শ করে বললেন, তোমার পাঁচটি তেজস্বী পুত্র হবে—অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্র সুহ্ম, তাদের দেশও এই সকল নামে খ্যাত হবে। বলি রাজার বংশ এইরূপে মহর্ষি দীর্ঘতমা থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।
তারপর ভীষ্ম বললেন, মাতা, বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য আপনি কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে অর্থ দিয়ে নিয়োগ করুন। সত্যবতী হাস্য করে লজ্জিতভাবে নিজের পূর্ব ইতিহাস জানালেন এবং পরিশেষে বললেন, কন্যাবস্থায় আমার যে পুত্র হয়েছিল তার নাম দ্বৈপায়ন, তিনি মহাযোগী মহর্ষি, চতুর্বেদ বিভক্ত করে ব্যাস উপাধি পেয়েছেন; তিনি কৃষ্ণবর্ণ সেজন্য তাঁর অন্য নাম কৃষ্ণ। আমার এই পুত্র জন্মগ্রহণ করেই পিতা পরাশরের সঙ্গে চ’লে যান এবং যাবার সময় আমাকে বলেছিলেন যে, প্রয়োজন হলে আমি ডাকলেই তিনি আসবেন। ভীষ্ম, তুমি আর আমি অনুরোধ করলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।
ভীষ্ম এই প্রস্তাবের সমর্থন করলে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করলেন। ক্ষণকালমধ্যে ব্যাস আবির্ভূত হলেন, সত্যবতী তাকে আলিঙ্গন এবং স্তনদুগ্ধে সিক্ত করে অমোচন করতে লাগলেন। মাতাকে অভিবাদন করে ব্যাস বললেন, আপনার অভিলাষ পূরণ করতে এসেছি, কি করতে হবে আদেশ করুন। সত্যবতী তার প্রার্থনা জানালে ব্যাস বললেন, কেবল ধর্মপালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার অভীষ্ট কার্য করব। আমার নির্দেশ অনুসারে দুই রাজ্ঞী এক বৎসর ব্রতপালন করে শুদ্ধ হন, তবে তারা আমার কাছে আসতে পারবেন। সত্যবতী বললেন, অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতা প্রসন্ন হন না, অতএব যাতে রানীরা সদ্য গর্ভবতী হন তার ব্যবস্থা কর, সন্তান হলে ভীষ্ম তাদের পালন করবেন। ব্যাস বললেন, যদি এখনই পুত্র উৎপাদন করতে হয় তবে রানীরা যেন আমার কুৎসিত রূপ গন্ধ আর বেশ সহ্য করেন।
সত্যবতী অনেক প্রবোধ দিয়ে তার পুত্রবধূ অম্বিকাকে কোনও প্রকারে সম্মত করে শয়নগৃহে পাঠালেন। অম্বিকা উত্তম শয্যায় শুয়ে ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয় বীরগণকে চিন্তা করতে লাগলেন। অনন্তর সেই দীপালোকিত গৃহে ব্যাস প্রবেশ করলেন। তার কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা ভয়ে চক্ষু নিমীলিত করে রইলেন। ব্যাস বাইরে এলে সত্যবতী প্রশ্ন করলেন, এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো? ব্যাস উত্তর দিলেন, এই পুত্র শতহস্তিতুল্য বলবান, বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং শতপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে। সত্যবতী বললেন, অন্ধ ব্যক্তি কুরুকুলের রাজা হবার যোগ্য নয়, তুমি আর একটি পুত্র দাও। সত্যবতীর অনুরোধে তার দ্বিতীয় পুত্রবধূ অম্বালিকা শয়নগৃহে এলেন কিন্তু ব্যাসের মূর্তি দেখে তিনি ভয়ে পাণ্ডবর্ণ হয়ে গেলেন। সত্যবতীকে ব্যাস বললেন, এই পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে পাণ্ডুবর্ণ হবে।
যথাকালে অম্বিকা একটি অন্ধ পুত্র এবং অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণ পুত্র প্রসব করলেন, তাদের নাম ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। অম্বিকা পুনর্বার ঋতুমতী হলে সত্যবতী তাকে আর এখবার ব্যাসের কাছে যেতে বললেন, কিন্তু মহর্ষির রূপ আর গন্ধ মনে করে অম্বিকা নিজে গেলেন না, অপ্সরার ন্যায় রূপবতী এক দাসীকে পাঠালেন। দাসীর অভ্যর্থনা ও পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাস বললেন, কল্যাণী, তুমি আর দাসী হয়ে থাকবে না, তোমার গর্ভস্থ পুত্র ধর্মাত্মা ও পরম বুদ্ধিমান হবে।
এই দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মগ্রহণ করেন। মাণ্ডব্য নামে এক মৌনব্রতী উবাহু তপস্বী ছিলেন। একদিন কয়েকজন চোর রাজরক্ষীদের ভয়ে পালিয়ে এসে মাণ্ডব্যের আশ্রমে তাদের অপহৃত ধন লুকিয়ে রাখলে। রক্ষীরা আশ্রমে এসে মাণ্ডব্যকে প্রশ্ন করলে, কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না। অন্বেষণের ফলে চোরের দল অপহৃত ধন সমেত ধরা পড়ল, রক্ষীরা তাদের সঙ্গে মাণ্ডব্যকেও রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজার আদেশে সকলকেই শূলে চড়ানো হল কিন্তু মাণ্ডব্য তপস্যার প্রভাবে জীবিত রইলেন। অবশেষে তাঁর পরিচয় পেয়ে রাজা ক্ষমা চাইলেন এবং তাকে শূল থেকে নামালেন, কিন্তু শূলের ভগ্ন অগ্রভাগ তাঁর দেহে রয়ে গেল। মাণ্ডব্য সেই অবস্থাতেই নানা দেশে বিচরণ ও তপস্যা করতে লাগলেন এবং শূলখণ্ডের জন্য অণী (২) মাণ্ডব্য নামে খ্যাত হলেন। একদিন তিনি ধর্মরাজের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ কর্মের ফলে আমাকে এই দণ্ড দিয়েছেন? ধর্ম বললেন, আপনি বাল্যকালে একটি পতঙ্গের পুচ্ছদেশে তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন, তারই এই ফল। অণীমাণ্ডব্য বললেন, আপনি লঘু পাপে আমাকে গুরুদণ্ড দিয়েছেন। সর্বপ্রাণিবধের চেয়ে ব্রাহ্মণবধ গুরুতর। আমার শাপে আপনি শূদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। আজ আমি এই বিধান দিচ্ছি—চতুর্দশ (২) বৎসর বয়সের মধ্যে কেউ কিছু করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না। অণীমাণ্ডব্যের অভিশাপের ফলেই ধর্ম দাসীর গর্ভে বিদুররূপে জন্মেছিলেন।
**
(১) পশুর তুল্য যত্র তত্র সংগম।
(২) অণী-শূলাদির অগ্রভাগ।
(৩) আর একটি শ্লোকে দ্বাদশ আছে।
১৯। গান্ধারী, কুন্তী ও মাদ্রী-কর্ণ-দুর্যোধনাদির জন্ম
ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু ও বিদুরকে ভীষ্ম পুত্রবৎ পালন করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র অসাধারণ বলবান, পাণ্ডু পরাক্রান্ত ধনুর্ধর, এবং বিদুর অদ্বিতীয় ধর্মপরায়ণ হলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, বিদুর শূদ্র-গর্ভজাত, একারণে পাণ্ডুই রাজপদ পেলেন।
বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করে ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দিলেন। অন্ধ পতিকে অতিক্রম করবেন না—এই প্রতিজ্ঞা করে পতিব্রতা গান্ধারী বস্ত্রখণ্ড ভাঁজ করে চোখের উপর বাঁধলেন।
বসুদেবের পিতা যদুশ্রেষ্ঠ নূরের পৃথা (১) নামে একটি কন্যা ছিল। শূর তার পিতৃম্বসার পুত্র নিঃসন্তান কুন্তিভোজকে সেই কন্যা দান করেন। পালক পিতার নাম অনুসারে পৃথার অপর নাম কুন্তী হল। একদা ঋষি দুর্বাসা অতিথি রূপে গৃহে এলে কুন্তী তাঁর পরিচর্যা করলেন, তাতে দুর্বাসা তুষ্ট হয়ে একটি মন্ত্র শিখিয়ে বললেন, এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে যে দেবতাকে আহ্বান করবে তাদের প্রসাদে তোমার পুত্রলাভ হবে। কৌতূহলবশে কুন্তী সূর্যকে ডাকলেন। সূর্য আবির্ভূত হয়ে বললেন, অসিতনয়না, তুমি কি চাও? দুর্বাসার বরের কথা জানিয়ে কুন্তী নতমস্তকে ক্ষমা চাইলেন। সূর্য বললেন, তোমার আহ্বান বৃথা হবে না, আমার সঙ্গে মিলনের ফলে তুমি পুত্র লাভ করবে এবং কুমারীই থাকবে। কুন্তীর একটি দেবকুমার তুল্য পুত্র হল। এই পুত্র স্বাভাবিক কবচ (বর্ম) ও কুণ্ডল ধারণ করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, ইনিই পরে কর্ণ নামে খ্যাত হন। কলঙ্কের ভয়ে কুন্তী তার পুত্রকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দিলেন। সূতবংশীয় অধিরথ ও তাঁর পত্নী রাধা সেই বালককে দেখতে পেয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন এবং বসুষেণ নাম দিয়ে পুত্রবৎ পালন করলেন। কর্ণ বড় হয়ে সকল প্রকার অস্ত্রের প্রয়োগ শিখলেন। তিনি প্রতিদিন মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত সূর্যের উপাসনা করতেন। একদিন ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্র কর্ণের কাছে এসে তার কবচ (২) প্রার্থনা করলেন। কর্ণ নিজের দেহ থেকে কবচটি কেটে দিলে ইন্দ্র তাকে শক্তি অস্ত্র দান করে বললেন, তুমি যার উপর এই অস্ত্র ক্ষেপণ করবে সে মরবে, কিন্তু একজন নিহত হলেই অস্ত্রটি আমার কাছে ফিরে আসবে। কবচ কেটে দেওয়ার জন্য বসুষেণের নাম কর্ণ ও বৈকর্তন হয়।
রাজা কুন্তিভোজ তাঁর পালিতা কন্যার বিবাহের জন্য স্বয়ংবরসভা আহ্বান করলে কুন্তী নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য দিলেন। পাণ্ডুর আর একটি বিবাহ দেবার ইচ্ছায় ভীষ্ম মদ্রদেশের রাজা বাহ্মীকবংশীয় শল্যের কাছে গিয়ে তার ভগিনীকে প্রার্থনা করলেন। শল্য বললেন, আমাদের বংশের একটি নিয়ম নিশ্চয় আপনার জানা আছে। ভালই হ’ক বা মন্দই হ’ক আমি কুলধর্ম লঙ্ঘন করতে পারি না। ভীষ্ম উত্তর দিলেন, কুলধর্ম পালনে কোনও দোষ নেই। এই বলে তিনি স্বর্ণ রত্ন গজ অশ্ব প্রভৃতি ধন বিবাহের পণ রূপে শল্যকে দিলেন। শল্য প্রীত হয়ে তার ভগিনী মাদ্রীকে দান করলেন, ভীষ্ম সেই কন্যাকে হস্তিনাপুরে এনে পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ দিলেন। দেবক রাজার শূদ্র পত্নীর গর্ভে ব্রাহ্মণ কর্তৃক একটি কন্যা উৎপাদিত হয়েছিল, তার সঙ্গে বিদুরের বিবাহ হল।
কিছুকাল পরে মহারাজ পাণ্ডু সসৈন্যে নির্গত হয়ে নানা দেশ জয় করে বহু। ধন নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে সেই সমস্ত ধন ভীষ্ম, দুই মাতা ও বিদুরকে উপহার দিলেন। তারপর তিনি দুই পত্নীর সঙ্গে বনে গিয়ে মৃগয়া করতে লাগলেন।
ব্যাস বর দিয়েছিলেন যে গান্ধারীর শত পুত্র হবে। যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন, কিন্তু দুই বৎসরেও তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হল না এবং কুন্তীর একটি পুত্র (যুধিষ্ঠির) হয়েছে জেনে তিনি অধীর ও ঈর্ষান্বিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে গান্ধারী নিজের গর্ভপাত করলেন, তাতে লৌহের ন্যায় কঠিন একটি মাংসপিণ্ড প্রসূত হল। তিনি সেই পিণ্ড ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাস এসে বললেন, আমার কথা মিথ্যা হবে না। ব্যাসের উপদেশে গান্ধারী শীতল জলে মাংসপিণ্ড ভিজিয়ে রাখলেন, তা থেকে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এক শ এক ভ্রণ পৃথক হল। সেই ভ্রণ গুলিকে তিনি পৃথক পৃথক ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখলেন। এক বৎসর পরে একটি কলসে দুর্যোধন জন্মগ্রহণ করলেন। তার পূর্বেই কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির জন্মেছিলেন, সে কারণে যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠ। দুর্যোধন ও ভীম একই দিনে জন্মগ্রহণ করেন।
দুর্যোধন জন্মেই গর্ধভের ন্যায় কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে গৃধ্র শৃগাল কাক প্রভৃতিও ডাকতে লাগল এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে ভীষ্ম বিদুর প্রভৃতিকে বললেন, আমাদের বংশের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র যুধিষ্ঠির তো রাজ্য পাবেই, কিন্তু তার পরে আমার এই পুত্র রাজা হবে তো? শৃগালাদি শ্বাপদ জন্তুরা আবার ডেকে উঠল। তখন ব্রাহ্মণগণ ও বিদুর বললেন, আপনার পুত্র নিশ্চয় বংশ নাশ করবে, ওকে পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। পুত্রস্নেহের যশে ধৃতরাষ্ট্র তা করলেন না। এক মাসের মধ্যে তার দুর্যোধন দুঃশাসন দুঃসহ প্রভৃতি একশত পুত্র এবং দুঃশলা নামে একটি কন্যা হল। গান্ধারী যখন গর্ভভারে ক্লিষ্ট ছিলেন তখন এক বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করত। তার গর্ভে যুযুৎসু নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করে।
**
(১) ইনি কৃষ্ণের পিসী।
(২) কর্ণের কবচ-কুণ্ডল-দানের কথা বনপর্ব ৫৬-পরিচ্ছেদে বিবৃত হয়েছে।
২০। যুধিষ্টিরাদির জন্ম-পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যু
একদিন পাণ্ডু অরণ্যে বিচরণ করতে করতে একটি হরিণমিথুনকে শরবিদ্ধ করলেন। আহত হরিণ ভূপতিত হয়ে বললে, কামক্রোধের বশবর্তী মূঢ় ও পাপাসক্ত লোকেও এমন নৃশংস কর্ম করে না। কোন্ জ্ঞানবান পুরুষ মৈথুনে রত মৃগ-দম্পতিকে বধ করে ? মহারাজ, আমি কিমিন্দম মুনি, পুত্রকামনায় মৃগরূপ ধারণ করে পত্নীর সহিত সংগত হয়েছিলাম। তুমি জানতে না যে আমি ব্রাহ্মণ, সেজন্য তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হবে না, কিন্তু আমার শাপে তোমারও স্ত্রীসংগমকালে মৃত্যু হবে।
শাপগ্রস্ত পাণ্ডু বহু বিলাপ করে বললেন, আমি সংসার ত্যাগ করে ভিক্ষু হব, কঠোর তপস্যা ও কৃচ্ছসাধন করব। শাপের ফলে আমার সন্তান উৎপাদন অসম্ভব, অতএব গৃহস্থাশ্রমে আর থাকব না। কুন্তী ও মাদ্রী তাকে বললেন, আমরা তোমার ধর্মপত্নী, আমাদের সঙ্গে থেকেই তো তপস্যা করতে পার, আমরাও ইন্দ্রিয়দমন করে তপস্যা করব। তার পর পাণ্ডু নিজের এবং দুই পত্নীর সমস্ত অলংকার ব্রাহ্মণদের দান করে হস্তিনাপুরে সংবাদ পাঠালেন যে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অরণ্যবাসী হয়েছেন।
পাণ্ডু তার দুই পত্নীর সঙ্গে নাগশত, চৈত্ররথ, কালকূট, হিমালয়ের উত্তরস্থ গন্ধমাদন পর্বত, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর এবং হংসকূট অতিক্রম করে শতশৃঙ্গ পর্বতে এসে তপস্যা করতে লাগলেন। বহু ঋষির সঙ্গে তার সখ্য হল। একদিন ঋষিরা বললেন, আজ ব্রহ্মলোকে মহাসভা হবে, আমরা ব্রহ্মাকে দেখতে সেখানে যাচ্ছি। সস্ত্রীক পাণ্ডু তাদের সঙ্গে যেতে চাইলে তারা বললেন, সেই দুর্গম দেশে এই রাজপুত্রীরা যেতে পারবেন না, তুমি নিরস্ত হও। পাণ্ডু বললেন, আমি নিঃসন্তান, স্বর্গের দ্বার আমার পক্ষে রুদ্ধ, সেজন্য আপনাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। আমি যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন-তপস্যা আর অনিষ্ঠুরতার দ্বারা দেব, ঋষি ও মনুষ্যের ঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি, কিন্তু পুত্রোৎপাদন ও শ্রাদ্ধদ্বারা পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্ত হ’তে পারি নি। আমি যে ভাবে জন্মেছি সেই ভাবে আমার পত্নীর গর্ভে যাতে সন্তান হ’তে পারে তার উপায় আপনারা বলুন। ঋষিরা বললেন, রাজা, আমরা দিব্য চক্ষুতে দেখছি তোমার দেবতুল্য পুত্র হবে।
পাণ্ডু নির্জনে কুন্তীকে বললেন, তুমি সন্তান লাভের জন্য চেষ্টা কর, আপকালে স্ত্রীলোক উত্তম বর্ণের পুরুষ অথবা দেবর থেকে পুত্রলাভ করতে পারে। কুন্তী বললেন, আমি শুনেছি রাজা ব্যুষিতাশ্ব যক্ষ্মা রোগে প্রাণত্যাগ করলে তার মহিষী ভদ্রা মৃতপতির সহিত সংগমে পুত্রবতী হয়েছিলেন। তুমিও তপস্যার প্রভাবে আমার গর্ভে মানস পুত্র উৎপাদন করতে পার। পাণ্ডু বললেন, ব্যুষিতাশ্ব দেবতুল্য শক্তিমান ছিলেন, আমার তেমন শক্তি নেই। আমি প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব বলছি শোন। পুরাকালে নারীরা স্বাধীন ছিল, তারা স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত, তাতে দোষ হত না, কারণ প্রাচীন ধর্মই এইপ্রকার। উত্তরকুরু দেশবাসী এখনও সেই ধর্মানুসারে চ’লে। এদেশেও সেই প্রাচীন প্রথা অধিককাল রহিত হয়নি। উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তার পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু দেখলেন, তার পিতার সমক্ষেই এক ব্রাহ্মণ তার মাতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বললেন, তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না, সনাতন ধর্মই এই, পৃথিবীতে সকল স্ত্রীলোকই গরুর তুল্য স্বাধীন। শ্বেতকেতু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আজ থেকে যে নারী পরপুরুষগামিনী হবে, যে পুরুষ পতিব্রতা পত্নীকে ত্যাগ করে অন্য নারীর সংসর্গ করবে, এবং যে নারী পতির আজ্ঞা পেয়েও ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনে আপত্তি করবে, তাদের সকলেরই জণহত্যার পাপ হবে। কুন্তী, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন থেকে আমাদের জন্ম হয়েছে তা তুমি জান। আমি পুত্রপ্রার্থী, মস্তকে অঞ্জলি রেখে অনুনয় করছি, তুমি কোনও তপস্বী ব্রাহ্মণের কাছে গুণবান পুত্র লাভ কর।
কুন্তী তখন দুর্বাসার বরের বৃত্তান্ত পাণ্ডুকে জানিয়ে বললেন, মহারাজ, তুমি অনুমতি দিলে আমি কোনও দেবতা বা ব্রাহ্মণকে মন্ত্রবলে আহ্বান করতে পারি। দেবতার কাছে সদ্য পুত্রলাভ হবে, ব্রাহ্মণের কাছে বিলম্ব হবে। পাণ্ডু বললেন, আমি ধন্য হয়েছি, অনুগৃহীত হয়েছি, তুমিই আমাদের বংশের রক্ষিত্রী। দেবগণের মধ্যে ধর্মই সর্বাপেক্ষা পুণ্যবান, আজই তুমি তাকে আহ্বান কর।
গান্ধারী যখন এক বৎসর গর্ভধারণ করেছিলেন সেই সময়ে কুন্তী মন্ত্রবলে ধর্মকে আহ্বান করলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতের উপর ধর্মের সহিত সংগমের ফলে কুন্তী পুত্রবতী হলেন। প্রসবকালে দৈববাণী হল -এই বালক ধার্মিকগণের শ্রেষ্ঠ, বিক্রান্ত, সত্যবাদী ও পৃথিবীপতি হবে, এবং যুধিষ্ঠির নামে খ্যাত হবে।
তার পর পাণ্ডুর ইচ্ছাক্রমে বায়ু ও ইন্দ্রকে আহ্বান করে কুন্তী ভীম ও অর্জুন নামে আরও দুই পুত্র লাভ করলেন। একদিন মাদ্রী পাণ্ডুকে বললেন, মহারাজ, কুন্তী আমার সপত্নী, তাকে আমি কিছু বলতে সাহস করি না, কিন্তু তুমি বললে তিনি আমাকেও পুত্রবতী করতে পারেন। পাণ্ড অনুরোধ করলে কুন্তী সম্মত হলেন এবং তার উপদেশে মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্মরণ করে নকুল ও সহদেব নামে যমজ পুত্র লাভ করলেন। মাদ্রীর আরও পুত্রের জন্য পাণ্ড অনুরোধ করলে কুন্তী বললেন, আমি মাদ্রীকে বলেছিলাম-কোনও এক দেবতাকে স্মরণ কর, কিন্তু সে যুগল দেবতাকে আহ্বান করে আমাকে প্রতারিত করেছে। মহারাজ, আমাকে আর অনুরোধ ক’রো না।
দেবতার প্রসাদে লব্ধ পাণ্ডুর এই পঞ্চ পুত্র কালক্রমে চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন, সিংহের ন্যায় বলশালী এবং দেবতার ন্যায় তেজস্বী হল। একদিন রমণীয় বসন্তকালে পাণ্ডু নির্জনে মাদ্রীকে দেখে সংযম হারালেন এবং পত্নীর নিষেধ অগ্রাহ্য করে তাঁকে সবলে গ্রহণ করলেন। শাপের ফলে সংগমকালেই পাণ্ডুর প্রাণবিয়োগ হল। মাদ্রীর আর্তনাদ শুনে কুন্তী সেখানে এলেন এবং বিলাপ করে বললেন, আমি রাজাকে সর্বদা সাবধানে রক্ষা করতাম, তুমি এই বিজন স্থানে কেন তাকে লোভিত করলে ? তুমি আমার চেয়ে ভাগ্যবতী, তাকে হৃষ্ট দেখেছ। আমি জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী, সেজন্য ভর্তার সহমৃতা হব। তুমি এই বালকদের পালন কর। মাদ্রী বললেন, আমি কামভোগে তৃপ্ত হইনি, অতএব পতির অনুসরণ করব। তোমার তিন পুত্রকে আমি নিজ পুত্রের ন্যায় দেখতে পারব না, তুমিই আমার দুই পুত্রকে নিজপুত্রবৎ পালন কর। এই বলে মাদ্রী পাণ্ডুর সহগমনকামনায় প্রাণত্যাগ করলেন।
২১। হস্তিনাপুরে পঞ্চপাণ্ডব-ভীমের নাগলোক দর্শন
পাণ্ডুর আশ্রমের নিকট যে সকল ঋষি বাস করতেন তার মন্ত্রণা করে পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃতদেহ এবং কুন্তী ও রাজপুত্রদের নিয়ে হস্তিনাপুরে গেলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোল, ভীমের পনেরো, অর্জুনের চোদ্দ এবং নকুল-সহদেবের তেরো। ঋষিরা রাজসভায় এলে কৌরবগণ প্রণত হয়ে সংবর্ধনা করলেন। ঋষিদের মধ্যে যিনি বৃদ্ধতম তিনি পাণ্ড ও মাদ্রীর মৃত্যুবিবরণ এবং যুধিষ্ঠিরাদির পরিচয় দিলেন এবং সভ্যস্থ সকলকে বিস্মিত করে সঙ্গিগণসহ অন্তর্হিত হলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর পাণ্ডু ও মাদ্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করলেন। ত্রয়োদশ দিনে শ্রাদ্ধাদি কৃত্য সম্পন্ন হল সকলে দুঃখিত মনে রাজপুরীতে ফিরে এলেন। তখন ব্যাস শোকবিহুলা সত্যবতীর কাছে এসে বললেন, মাতা, সুখের দিন শেষ হয়েছে, পৃথিবী এখন গতযৌবনা, ক্রমশ পাপের বৃদ্ধি হবে, কৌরবদের দুর্নীতির ফলে ধর্মকর্ম লোপ পাবে। কুরুবংশের ক্ষয় যেন আপনাকে দেখতে না হয়, আপনি তপোবনে গিয়ে যোগ অবলম্বন করুন। সত্যবতী তার পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে ব্যাসের কথা জানিয়ে বললেন, তোমরাও আমার সঙ্গে চল। তারপর তারা তিনজনে বনে গিয়ে ঘোর তপস্যায় দেহ ত্যাগ করে ইষ্টলোকে গেলেন।
পঞ্চপাণ্ডব তাদের পিতৃগৃহে সুখে বাস করতে লাগলেন। নানাবিধ ক্রীড়ায় ভীমই সর্বাধিক শক্তি দেখাতেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের মাথা ঠোকাঠুকি করিয়ে, জলে ডুবিয়ে এবং অন্যান্য প্রকারে নিগ্রহ করতেন। বাহুযুদ্ধে, গমনের বেগে বা ব্যায়ামের অভ্যাসে কেউ তাকে হারাতে পারত না। ভীমের মনে কোনও বিদ্বেষ ছিল না, তথাপি তিনি বালসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ধার্তরাষ্ট্রগণের অপ্রিয় হলেন।
দুর্যোধন গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে উদকক্রীড়ন নাম দিয়ে একটি সুসজ্জিত আবাস রচনা করলেন এবং সেখানে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য রাখিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানকার উদ্যানে সকলে খেলাচ্ছলে পরস্পরের মুখে খাদ্য তুলে দিতে লাগলেন, সেই সুযোগে পাপমতি দুর্যোধন ভীমকে কালকূট বিষ মিশ্রিত খাদ্য দিলেন। জলক্রীড়ার পর সকলে বিহারগৃহে বিশ্রাম করতে গেলেন, কিন্তু ভীম অত্যন্ত শ্রান্ত এবং বিষের প্রভাবে অচেতন হয়ে গঙ্গাতীরে পড়ে রইলেন, দুর্যোধন তাকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দিলেন।
সংজ্ঞাহীন ভীম জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে উপস্থিত হলেন। মহাবিষ সর্পগণ তাঁকে দংশন করতে লাগল, সেই জঙ্গম সর্পবিষে স্থাবর কালকূট বিষ নষ্ট হল। চেতনা পেয়ে ভীম তার বন্ধন ছিন্ন করে সর্প বধ করতে লাগলেন। তখন কতকগুলি সর্প নাগরাজ বাসুকির কাছে গিয়ে সংবাদ দিলে। বাসুকি ভীমের কাছে গিয়ে তাকে নিজের দৌহিত্রের দৌহিত্র, অর্থাৎ কুন্তিভোজের দৌহিত্র বলে চিনতে পেরে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন। বাসুকি বললেন, একে ধনরত্ন দিয়ে সুখী কর। একজন নাগ বললে, ধন দিয়ে কি হবে, যদি আপনি তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই কুমারকে রসায়ন পান করতে দিন। বাসুকির আজ্ঞায় নাগগণ ভীমকে রসায়নকুণ্ডের কাছে নিয়ে গেল। ভীম স্বস্ত্যয়ন করে শুচি হয়ে পূর্বমুখে বসলেন এবং এক নিঃশ্বাসে এক-একটি কুণ্ডের রস পান করে আটটি কুণ্ড নিঃশেষ করলেন। তার পর তিনি নাগদত্ত শয্যায় শুয়ে সুখে নিদ্রিত হলেন।
জলবিহার শেষ করে কৌরব (১) ও পাণ্ডবগণ ভীমকে দেখতে পেলেন না। ভীম আগেই চ’লে গেছেন মনে করে তারা রথ গজ ও অশ্বে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন। ভীমকে না দেখে কুন্তী অত্যন্ত উদবিগ্ন হলেন। বিদুর যুধিষ্ঠির প্রভৃতি সমস্ত নগরোদ্যানে অন্বেষণ করেও কোথাও তাকে পেলেন না। কুন্তীর ভয় হল হয়তো ক্রুর দুর্যোধন ভীমকে হত্যা করেছে। বিদুর তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, এমন কথা বলবেন না, মহামুনি ব্যাস বলেছেন আপনার পুত্রেরা দীর্ঘায়ু হবে।
অষ্টম দিনে ভীমের নিদ্রাভঙ্গ হল। নাগগণ তাকে বললে, রসায়ন জীর্ণ করে তুমি অযুত হস্তীর বল পেয়েছ, এখন দিব্য জলে স্নান করে গৃহে যাও। ভীম স্নান করে উত্তম অন্ন ভোজন করলেন এবং নাগদের আশীর্বাদ নিয়ে দিব্য আভরণে ভূষিত হয়ে স্বগৃহে ফিরে গেলেন। সকল বৃত্তান্ত শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, চুপ করে থাক, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা ক’রো না, এখন থেকে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। দুর্যোধন বিফলমনোরথ হয়ে মনস্তাপ ভোগ করতে লাগলেন। রাজকুমারদের শিক্ষার জন্য ধৃতরাষ্ট্র গৌতমগোত্রজ কৃপাচার্যকে নিযুক্ত করলেন।
**
(১) ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু দুজনেই কুরুবংশজাত সেজন্য কৌরব। তথাপি সাধারণত দুর্যোধনাদিকেই কৌরব এবং তাদের পক্ষকে কুরু বলা হয়।
২২। কৃপ-দ্রোণ-অশ্বত্থামা—একলব্য-অর্জুনের পটুতা
মহর্ষি গৌতমের শরদ্বান নামে এক শিষ্য ছিলেন, তার ধনুর্বেদে যেমন বুদ্ধি ছিল বেদাধ্যয়নে তেমন ছিল না। তাঁর তপস্যায় ভয় পেয়ে ইন্দ্র জানপদী নামে এক অপ্সরা পাঠালেন। তাকে দেখে শরদ্বানের হাত থেকে ধনুর্বাণ পড়ে গেল এবং রেতঃপাত হল। সেই রেতঃ একটি শরস্তম্ভে পড়ে দু ভাগ হল তা থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করলে। রাজা শান্তনু তাদের দেখতে পেয়ে কৃপা করে গৃহে এনে সন্তানবৎ পালন করলেন এবং বালকের নাম কৃপ ও বালিকার নাম কৃপী রাখলেন। শরদ্বান তপোবনে তাদের বৃত্তান্ত জানতে পেরে রাজভবনে এলেন এবং কৃপকে শিক্ষা দিয়ে ধনুর্বেদে পারদর্শী করলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধন প্রভৃতি এবং বৃষ্ণিবংশীয় ও নানাদেশের রাজপুত্রগণ এই কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে লাগলেন।
ভরদ্বাজ ঋষি গঙ্গোত্তর প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানকালে ঘৃতাচী অপ্সরাকে দেখে তার শুক্রপাত হয়। সেই শুক্র তিনি কলসের মধ্যে রাখেন তা থেকে দ্রোণ জন্মগ্রহণ করেন। অগ্নিবেশ্য মুনি দ্রোণকে আগ্নেয়াস্ত্র শিক্ষা দেন। পাঞ্চালরাজ পৃষত ভরদ্বাজের সখা ছিলেন, তাঁর পুত্র দ্রুপদ দ্রোণের সঙ্গে খেলা করতেন। পিতার আদেশে দ্রোণ কৃপীকে বিবাহ করলেন। তাঁদের একটি পুত্র হয়, সে ভূমিষ্ঠ হয়েই অশ্বের ন্যায় চিৎকার করেছিল সেজন্য তার নাম অশ্বত্থামা হল।
ভরদ্বাজের মৃত্যুর পর দ্রোণ পিতার আশ্রমে থেকে তপস্যা ও ধনুর্বেদ চর্চা করতে লাগলেন। একদিন তিনি শুনলেন যে অস্ত্রজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ ভৃগুনন্দন পরশুরাম তাঁর সমস্ত ধন ব্রাহ্মণদের দিতে ইচ্ছা করেছেন। দ্রোণ মহেন্দ্র পর্বতে পরশুরামের কাছে। গিয়ে প্রণাম করে ধন চাইলেন। পরশুরাম বললেন, আমার কাছে সুবর্ণাদি যা ছিল সবই ব্রাহ্মণদের দিয়েছি, সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দিয়েছি, এখন কেবল আমার শরীর আর অস্ত্রশস্ত্র অবশিষ্ট আছে, কি চাও বল। দ্রোণ বললেন, আপনি সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাকে দিন এবং তাদের প্রয়োগ ও প্রত্যাহরণের বিধি আমাকে শেখান। পরশুরাম দ্রোণের প্রার্থনা পূরণ করলেন। দ্রোণ কৃতার্থ হয়ে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে গেলেন, কিন্তু ঐশ্বর্যগর্বে দ্রুপদ তার বাল্যসখার অপমান করলেন। দ্রোণ ক্রোধে অভিভূত হয়ে হস্তিনাপুরে গিয়ে কৃপাচার্যের গৃহে গোপনে বাস করতে লাগলেন।
একদিন রাজকুমারগণ নগরের বাইরে এসে বীটা (১) নিয়ে খেলছিলেন। দৈবক্রমে তাদের বীটা কূপের মধ্যে পড়ে গেল, অনেক চেষ্টা করেও তারা তুলতে পারলেন না। একজন শ্যামবর্ণ পক্ককেশ কৃশকায় ব্রাহ্মণ নিকটে বসে হোম করছেন দেখে তারা তাকে ঘিরে দাঁড়ালেন। এই ব্রাহ্মণ দ্রোণ। তিনি সহাস্যে বললেন, ধিক তোমাদের ক্ষত্ৰবল আর অস্ত্রশিক্ষা, ভরতবংশে জন্মে একটা বীটা তুলতে পারলে না! তোমাদের বীটা আর আমার এই অঙ্গুরীয় আমি ঈষীকা (কাশ তৃণ) দিয়ে তুলে দেব, কিন্তু আমাকে খাওয়াতে হবে। যুধিষ্ঠির বললেন, কৃপাচার্য অনুমতি দিলে আপনি প্রত্যহ আহার পাবেন। দ্রোণ সেই শুষ্ক কূপে তার আংটি ফেললেন, তার পর একটি ঈষীকা ফেলে বীটা বিদ্ধ করলেন, তার পর আর একটি ঈষীকা দিয়ে প্রথম ঈষীকা বিদ্ধ করলেন। এইরূপে পর পর ঈষীকা ফেলে উপরের ঈষীকা ধরে বীটা টেনে তুললেন। রাজপুত্রেরা এই ব্যাপার দেখে উৎফুল্লনয়নে সবিস্ময়ে বললেন, বিপ্রর্ষি, আপনার আংটিও তুলুন। দ্রোণ তার ধনু থেকে একটি শর কূপের মধ্যে ছুড়লেন, তার পর আরও শর দিয়ে পূর্বের ন্যায় অঙ্গুরীয় উদ্ধার করলেন। বালকরা পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে দ্রোণ বললেন, তোমরা আমার রূপগুণ যেমন দেখলে তা ভীষ্মকে জানাও।
বিবরণ শুনে ভীষ্ম বুঝলেন যে এই ব্রাহ্মণই দ্রোণ এবং তিনিই রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু হবার যোগ্য। ভীষ্ম তখনই দ্রোণকে সসম্মানে ডেকে আনলেন। দ্রোণ বললেন, পাঞ্চালরাজপুত্র দ্রুপদ আর আমি মহর্ষি অগ্নিবেশ্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলাম, বাল্যকাল থেকে দ্রুপদ আমার সখা ছিলেন। শিক্ষা শেষ হলে চ’লে যাবার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, দ্রোণ, আমি পিতার প্রিয়তম পুত্র, আমি পাঞ্চালরাজ্যে অভিষিক্ত হলে আমার রাজ্য তোমারও হবে। তার এই কথা আমি মনে রেখেছিলাম। তার পর আমি পিতার আদেশে এবং পুত্রকামনায় বিবাহ করি। আমার পত্নী অল্পকেশী, কিন্তু তিনি ব্রতপরায়ণা এবং সর্ব কর্মে আমার সহায়। আমার পুত্র অশ্বত্থামা অতিশয় তেজস্বী। একদা বালক অশ্বত্থামা ধনিপুত্রদের দুধ খেতে দেখে আমার কাছে এসে কাঁদতে লাগল, তাতে আমি দুঃখে দিশাহারা হলাম। বহু স্থানে চেষ্টা করেও কোথাও ধর্মসঙ্গত উপায়ে পয়স্বিনী গাভী পেলাম না। অশ্বত্থামার সঙ্গী বালকরা তাকে পিটুলি গোলা খেতে দিলে, দুধ খাচ্ছি মনে করে সে আনন্দে নাচতে লাগল। বালকরা আমাকে উপহাস করে বললে, দরিদ্র দ্রোণকে ধিক, যে ধন উপার্জন করতে পারে না, যার পুত্র পিটুলি গোলা খেয়ে আনন্দে নৃত্য করে। আমার বুদ্ধিভ্রংশ হল পূর্বের বন্ধুত্ব স্মরণ করে স্ত্রীপুত্র সহ দ্রুপদ রাজার কাছে গেলাম। আমি তাকে সখা বলে সম্ভাষণ করতে গেলে দ্রুপদ বললেন, ব্রাহ্মণ, তোমার বুদ্ধি অমার্জিত তাই আমাকে সখা বলছ, সমানে সমানেই বন্ধুত্ব হয়। ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণ, রথী আর অরথী, প্রবলপ্রতাপ রাজা আর শ্রীহীন দরিদ্র—এদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না। তোমাকে এক রাত্রির উপযুক্ত ভোজন দিচ্ছি নিয়ে যাও।
দ্রোণ বললেন, এই অপমানের পর আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করে কুরুদেশে চ’লে এলাম। ভীষ্ম, এখন বলুন আপনার কোন্ প্রিয়কার্য করব। ভীষ্ম বললেন, আপনার ধনু জ্যামুক্ত করুন, রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দিন, এখানে সসম্মানে বাস করে সমস্ত ঐশ্বর্য ভোগ করুন। এই রাজ্যের আপনিই প্রভু, কৌরবগণ আপনার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। দ্রোণ বললেন, কুমারদের শিক্ষার ভার আমি নিলে কৃপাচার্য দুঃখিত হবেন, অতএব আমাকে কিছু ধন দিন, আমি সন্তুষ্ট হয়ে চ’লে যাই। ভীষ্ম উত্তর দিলেন, কৃপাচার্যও থাকবেন, আমরা তার যথোচিত সম্মান ও ভরণ করব। আপনি আমার পৌত্রদের আচার্য হবেন।
ভীষ্ম একটি সুপরিচ্ছন্ন ধনধান্যপূর্ণ গৃহে দ্রোণের বাসের ব্যবস্থা করলেন এবং পৌত্রদের শিক্ষার ভার তার হাতে দিলেন। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় এবং নানা দেশের রাজপুত্রগণ দ্রোণের কাছে শিক্ষার জন্য এলেন, সূতপুত্র কর্ণও তাঁকে গুরুরূপে বরণ করলেন। সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্জুনই আচার্যের সর্বাপেক্ষা স্নেহপাত্র হলেন।
নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য দ্রোণের কাছে শিক্ষার জন্য এলেন, কিন্তু নীচজাতি বলে দ্রোণ তাকে নিলেন না। একলব্য দ্রোণের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করে বনে চ’লে গেলেন এবং দ্রোণের একটি মৃন্ময়ী মূর্তিকে আচার্য কল্পনা করে। নিজের চেষ্টায় অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করতে লাগলেন।
একদিন কুরুপাণ্ডবগণ মৃগয়ায় গেলেন, তাদের এক অনুচর মৃগয়ার উপকরণ এবং কুকুরু নিয়ে পিছনে পিছনে গেল। কুকুর ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের কাছে উপস্থিত হল এবং তার কৃষ্ণ বর্ণ, মলিন দেহ, মৃগচর্ম পরিধান ও মাথায় জটা দেখে চিৎকার করতে লাগল। একলব্য একসঙ্গে সাতটি বাণ ছুড়ে তার মুখের মধ্যে পুরে দিলেন, কুকুর তাই নিয়ে রাজকুমারদের কাছে গেল। তারা বিস্মিত হয়ে একলব্যের কাছে এলেন এবং তার কথা দ্রোণাচার্যকে জানালেন। অর্জুন দ্রোণকে গোপনে বললেন, আপনি প্রীত হয়ে আমাকে বলেছিলেন যে আপনার কোনও শিষ্য আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে না, কিন্তু একলব্য আমাকে অতিক্রম করলে কেন? দ্রোণ অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে একলব্যের কাছে গেলেন, একলব্য ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রোণ বললেন, বীর, তুমি যদি আমার শিষ্যই হও তবে গুরুদক্ষিণা দাও। একলব্য আনন্দিত হয়ে বললেন, ভগবান, কি দেব আজ্ঞা করুন, গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নেই। দ্রোণ বললেন, তোমার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ আমাকে দাও। এই দারুণ বাক্য শুনে একলব্য প্রফুল্লমুখে অকাতরচিত্তে অঙ্গুষ্ঠ ছেদন করে দ্রোণকে দিলেন। তার পর সেই নিষাদপুত্র অন্য অঙ্গুলি দিয়ে শরাকর্ষণ করে দেখলেন, কিন্তু শর পূর্ববৎ শীঘ্রগামী হল না। অর্জুন সন্তুষ্ট হলেন।
দ্রোণের শিক্ষার ফলে ভীম ও দুর্যোধন গদাযুদ্ধে, অশ্বত্থামা গুপ্ত অস্ত্রের প্রয়োগে, নকুল-সহদেব অসিযুদ্ধে, যুধিষ্ঠির রথচালনায়, এবং অর্জুন বুদ্ধি বল উৎসাহ ও সর্বাস্ত্রের প্রয়োগে শ্রেষ্ঠ হলেন। দুরাত্মা ধার্তরাষ্ট্রগণ ভীম ও অর্জুনের শ্রেষ্ঠতা সইতে পারতেন না।
একদিন দ্রোণ একটি কৃত্রিম ভাস (২) পক্ষী গাছের উপর রেখে কুমারদের বললেন, তোমরা ওই পক্ষীকে লক্ষ্য করে স্থির হয়ে থাক, যাকে বলব সে শরাঘাতে ওর মুণ্ডচ্ছেদ করে ভূমিতে ফেলবে। সকলে শরসন্ধান করলে দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি গাছের উপর ওই পাখি দেখছ? এই গাছ, আমাকে আর তোমার। ভ্রাতাদের দেখছ? যুধিষ্ঠির বললেন যে তিনি সবই দেখতে পাচ্ছেন। দ্রোণ বিরক্ত হয়ে বললেন, সরে যাও, তুমি এই লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। দুর্যোধন ভীম প্রভৃতিও বললেন, আমরা সবই দেখছি। দ্রোণ তাদেরও সরিয়ে দিলেন। তার পর অর্জুনকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, আমি কেবল ভাস পক্ষী দেখছি। দ্রোণ বললেন, আবার বল। অর্জুন বললেন, কেবল ভাসের মস্তক দেখছি। আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে দ্রোণ বললেন, এইবারে শর ত্যাগ কর। তৎক্ষণাৎ অর্জুনের ক্ষুরধার শরে ভাসের ছিন্ন মুণ্ড ভূমিতে পড়ে গেল।
একদিন শিষ্যদের সঙ্গে দ্রোণ গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। তিনি জলে নামলে একটা কুম্ভীর (৩) তার জঙ্ঘা কামড়ে ধরলে। দ্রোণ শিষ্যদের বললেন, তোমরা শীঘ্র আমাকে রক্ষা কর। তার বাক্যের সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুন পাঁচ শরে কুম্ভীরকে খণ্ড খণ্ড করলেন, অন্য শিষ্যরা মূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রোণ প্রীত হয়ে অর্জুনকে ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র দান করে বললেন, এই অস্ত্র মানুষের প্রতি প্রয়োগ ক’রো না, যদি অন্য শত্রু তোমাকে আক্রমণ করে, তবেই প্রয়োগ করবে।
**
(১) পুলির আকার কাষ্ঠখণ্ড, গুলিডাণ্ডা খেলার গুলি।
(২) মোরগ অথবা শকুন।
(৩) মূলে ‘গ্রাহ’ আছে, তার অর্থ কুম্ভীর হাঙ্গর দুইই হয়।
২৩। অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন
একদিন ব্যাস কৃপ ভীষ্ম বিদূর প্রভৃতির সমক্ষে দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, কুমারদের অস্ত্রাভ্যাস সম্পূর্ণ হয়েছে, আপনি অনুমতি দিলে তারা নিজ নিজ শিক্ষা প্রদর্শন করবেন। ধৃতরাষ্ট্র হৃষ্ট হয়ে বললেন, আপনি মহৎ কর্ম সম্পন্ন করেছেন, আমার ইচ্ছা চক্ষুষ্মান লোকের ন্যায় আমিও কুমারগণের পরাক্রম দেখি।
ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞায় এবং দ্রোণের নির্দেশ অনুসারে বিদুর সমতল স্থানে বিশাল রঙ্গভূমি নির্মাণ করালেন এবং ঘোষণা করে সাধারণকে জানিয়ে শুভ তিথি-নক্ষত্রযোগে দেবপূজা করলেন। নির্দিষ্ট দিনে ভীষ্ম ও কৃপাচার্যকে অগ্রবর্তী করে ধৃতরাষ্ট্র সুসজ্জিত প্রেক্ষাগারে এলেন। গান্ধারী কুন্তী প্রভৃতি রাজপুরনারীগণ উত্তম পরিচ্ছদে ভূষিত হয়ে মঞ্চে গিয়ে বসলেন। নানা দেশ থেকে আগত দর্শকদের কোলাহলে ও বাদ্যধ্বনিতে সেই সভা মহাসমুদ্রের ন্যায় বিক্ষুব্ধ হল।
অনন্তর শুক্লকেশ দ্রোণাচার্য শুক্ল বসন ও মাল্য ধারণ করে পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে রঙ্গভূমিতে এলেন এবং মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের দিয়ে মঙ্গলাচরণ করালেন। দ্রোণ ও কৃপকে ধৃতরাষ্ট্র সুবর্ণরত্নাদি দক্ষিণা দিলেন। তার পর ধনু ও তৃণীর ধারণ করে। অঙ্গুলিত্র কটিবন্ধ প্রভৃতিতে সুরক্ষিত হয়ে রাজপুত্রগণ রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন, এবং যুধিষ্ঠিরকে পুরোবতী করে জ্যেষ্ঠানুক্রমে অস্ত্রপ্রয়োগ দেখাতে লাগলেন। তারা অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে নিজ নিজ নামাঙ্কিত বাণ দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন, রথ গজ ও অশ্ব চালনার, বাহুযুদ্ধের এবং খড়্গ-চর্ম (১) প্রয়োগের বিবিধ প্রণালী দেখালেন। তার পর পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত দুর্যোধন ও ভীম গদাহস্তে এসে মত্ত হস্তীর ন্যায় সগর্জনে পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। কুমারগণ রঙ্গভূমিতে কি করছেন তার বিবরণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে এবং কুন্তী গান্ধারীকে জানাতে লাগলেন। দর্শকদের একদল ভীমের এবং আর একদল দুর্যোধনের পক্ষপাতী হওয়ায় জনমণ্ডলী যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল, সভায় কুরুরাজের জয়, ভীমের জয়, এইরূপ কোলাহল উঠল। তখন দ্রোণ তার পুত্র অশ্বত্থামাকে বললেন, তুমি ওই দুই মহাবীরকে নিবারণ কর, যেন রঙ্গস্থলে ক্রোধের উৎপত্তি না হয়। অশ্বত্থামা গদাযুদ্ধে উদ্যত ভীম আর দুর্যোধনকে নিরস্ত করলেন।
মেঘমন্দ্রতুল্য বাদ্যধ্বনি বাদ্যধ্বনি থামিয়ে দিয়ে দ্রোণ বললেন, যিনি আমার পুত্রের চেয়ে প্রিয়, সর্বাস্ত্রবিশারদ, উপেন্দ্রতুল্য, সেই অর্জুনের শিক্ষা আপনারা দেখুন। দর্শকগণ উৎসুক হয়ে অর্জুনের নানাপ্রকার প্রশংসা করতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র দর্শকগণ উৎসুক হয়ে অর্জুনের নানাপ্রকার প্রশংসা করতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, ক্ষুব্ধ সমুদ্রের ন্যায় হঠাৎ এই মহাশব্দ হচ্ছে কেন? বিদুর বললেন, পাণ্ডুনন্দন অর্জুন অবতীর্ণ হয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কুন্তীর-তিন পুত্রের গৌরবে আমি ধন্য হয়েছি, অনুগৃহীত হয়েছি, রক্ষিত হয়েছি। অর্জুন আগ্নেয় বারুণ বায়ব্য প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ দেখালেন। তার পর একটি ঘূর্ণমান লৌহবরাহের মুখে এককালে পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করলেন, রজ্জ্বলম্বিত গোশৃঙ্গের ভিতরে একুশটি বাণ প্রবিষ্ট করলেন, খঙ্গ আর গদা হস্তে বিবিধ কৌশল দেখালেন।
অর্জুনের কৌশলপ্রদর্শন শেষ হয়ে এসেছে এবং বাদ্যরবও মন্দীভূত হয়েছে এমন সময় দ্বারদেশে সহসা বজ্রধ্বনির ন্যায় বাহ্বাস্ফোট (তাল ঠোকার শব্দ) শোনা গেল। দ্বারপালরা পথ ছেড়ে দিলে কবচকুণ্ডলশোভিত মহাবিক্রমশালী কর্ণ পদচারী পর্বতের ন্যায় রঙ্গভূমিতে এলেন এবং অধিক সম্মান না দেখিয়ে দ্রোণ ও কৃপকে প্রণাম করলেন। অর্জুন যে তাঁর ভ্রাতা তা না জেনে কর্ণ বললেন, পার্থ, তুমি যা দেখিয়েছ তার সবই আমি দেখব। এই বলে তিনি দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন যা যা করেছিলেন তাই করে দেখালেন। দুর্যোধন আনন্দিত হয়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, মহাবাহু, তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, তুমি এই কুরুরাজ্য ইচ্ছামত ভোগ কর। কর্ণ বললেন, আমি তোমার সখ্য চাই, আর অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে চাই। দুর্যোধন বললেন, তুমি সখা হয়ে আমার সঙ্গে সমস্ত ভোগ কর আর শত্রুদের মাথায় পা রাখ।
অর্জুন নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করে বললেন, কর্ণ, যারা অনাহূত হয়ে আসে।আর অনাহূত হয়ে কথা বলে, তারা যে নরকে যায় আমি তোমাকে সেখানে পাঠাব। কর্ণ বললেন, এই রঙ্গভূমিতে সকলেরই আসবার অধিকার আছে। দুর্বলের ন্যায় আমার নিন্দা করছ কেন, যা বলবার শর দিয়েই বল। আজ গুরুর সমক্ষেই শরাঘাতে তোমার শিরচ্ছেদ করব। তার পর দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন তার ভ্রাতাদের সঙ্গে কর্ণের সম্মুখীন হলেন, দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা কর্ণের পক্ষে গেলেন। ইন্দ্র ও সূর্য নিজ নিজ পুত্রকে দেখতে এলেন, অর্জুনের উপর মেঘের ছায়া এবং কর্ণের উপর সূর্যের কিরণ পড়ল। দ্রোণ কৃপ ও ভীষ্ম অর্জুনের কাছে গেলেন। রঙ্গভূমি দুই পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় স্ত্রীদের মধ্যেও দ্বৈধভাব উৎপন্ন হল।
কর্ণকে চিনতে পেরে কুন্তী মূৰ্ছিত হলেন, বিদুরের আজ্ঞায় দাসীরা চন্দন-জল সেচন করে তাঁকে প্রবুদ্ধ করলে। দুই পুত্রকে সশস্ত্র দেখে কুন্তী বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য কর্ণকে বললেন, এই অর্জুন কুরুবংশজাত, পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্র, ইনি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবেন। মহাবাহু কর্ণ, তুমি পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্র, ইনি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবেন। মহাবাহু কর্ণ, তুমি তোমার মাতা পিতার কুল বল, কোন্ রাজবংশের তুমি ভূষণ? তোমার পরিচয় পেলে অর্জুন যুদ্ধ করা বা না করা স্থির করবেন, রাজপুত্রেরা তুচ্ছকুলশীল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। কৃপের কথায় কর্ণ বর্ষাজলসিক্ত পদ্মের ন্যায় লজ্জায় মস্তক নত করলেন। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, অর্জুন যদি রাজা ভিন্ন অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চান তবে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করছি। দুর্যোধন তখনই কর্ণকে স্বর্ণময় পীঠে বসালেন, মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ লাজ পুষ্প স্বর্ণঘটের জল প্রভৃতি উপকরণে তাঁকে অভিষিক্ত করলেন।
এমন সময় কর্ণের পালকপিতা অধিরথ ঘর্মাক্ত ও কম্পিত দেহে যষ্টিহস্তে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে কর্ণ ধনু ত্যাগ করে নতমস্তকে প্রণাম করলেন, অধিরথ সসম্ভ্রমে তার চরণ আবৃত (২) করে পুত্রকে সস্নেহে আলিঙ্গন এবং তার মস্তক অশ্রুজলে অভিষিক্ত করলেন। ভীম সহাস্যে বললেন, সূতপুত্র, তুমি অর্জুনের হাতে মরবার যোগ্য নও, তুমি কশা হাতে নিয়ে কুলধর্ম পালন কর। কুকুর যজ্ঞের পুরোডাশ খেতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্য ভোগ করতে পার না। ক্রোধে কর্ণের ওষ্ঠ কম্পিত হ’তে লাগল। দুর্যোধন বললেন, ভীম, এমন কথা বলা তোমার উচিত হয় নি। দ্রোণাচার্য কলস থেকে এবং কৃপাচার্য শরস্তম্ব থেকে জন্মেছিলেন, আর তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে। কবচকুণ্ডলধারী সর্বলক্ষণযুক্ত কর্ণ নীচ বংশে জন্মাতে পারেন না। কেবল অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীই ইনি ভোগ করবার যোগ্য। যারা অন্যরূপ মনে করে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ক।
এই সময়ে সূর্যাস্ত হল। দুর্যোধন কর্ণের হাত ধরে রঙ্গভূমি থেকে প্রস্থান করলেন। পাণ্ডবগণ, দ্রোণ, কৃপ, ভীষ্ম প্রভৃতিও নিজ নিজ ভবনে চ’লে গেলেন। কর্ণ অঙ্গরাজ্য পেলেন দেখে কুন্তী আনন্দিত হলেন। যুধিষ্ঠিরের এই বিশ্বাস হল যে কর্ণের তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে নেই।
**
(১) চর্ম –ঢাল
(২) কর্ণ উচ্চজাতীয় এই সম্ভাবনায়।
২৪। দ্রুপদের পরাজয়-দ্রোণের প্রতিশোধ
দ্রোণাচার্য শিষ্যগণকে বললেন, তোমাদের শিক্ষা শেষ হয়েছে, এখন আমার দক্ষিণা চাই। তোমরা যুদ্ধ করে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে নিয়ে এস, তাই শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা। রাজকুমারগণ সম্মত হলেন এবং দ্ৰোণকে সঙ্গে নিয়ে সসৈন্যে পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করলেন।
দ্রুপদ রাজা ও তাঁর ভ্রাতৃগণ রথারোহণে এসে কৌরবগণের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। দুর্যোধন প্রভৃতির দর্প দেখে অর্জুন দ্রোণকে বললেন, ওরা দ্রুপদকে বন্দী করতে পারবে না। ওরা আগে নিজেদের বিক্রম দেখাক তার পর আমরা যুদ্ধে নামব। এই বলে তিনি নগর থেকে অর্ধ ক্রোশ দূরে ভ্রাতাদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
দ্রুপদের বাণবর্ষণে দুর্যোধনাদি ব্যতিব্যস্ত হলেন, তাঁদের সৈন্যের উপর নগরবাসী বালক বৃদ্ধ সকলে মিলে মুষল ও ষষ্টি বর্ষণ করতে লাগল। কৌরবদের আর্তরব শুনে যুধিষ্ঠিরকে তার ভ্রাতারা বললেন, আপনি যুদ্ধ করবেন না। এই বলে তারা রথারোহণে অগ্রসর হলেন। ভীম কৃতান্তের ন্যায় গদাহস্তে ধাবিত হয়ে পাঞ্চালরাজের গজসৈন্য অশ্ব রথ প্রভৃতি ধ্বংস করতে লাগলেন। তার পর অর্জুনের সঙ্গে দ্রুপদ ও তার ভ্রাতা সত্যজিতের ভীষণ যুদ্ধ হল। অর্জুনের সরাঘাতে সত্যজিতের অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট হল , সত্যজিৎ পলায়ন করলেন। তখন অর্জুন দ্রুপদের ধনু ও রথধ্বজ ছিন্ন এবং অশ্ব ও সারথিকে শরবিদ্ধ করে খঙ্গ-হস্তে লম্ফ দিয়ে তার রথে উঠলেন। পাঞ্চাল সৈন্য দশ দিকে পালাতে লাগল। দ্রুপদকে ধরে অর্জুন 0ভীমকে বললেন, দ্রুপদ রাজা কুরুবীরগণের আত্মীয়, তার সৈন্য বধ করবেন না, আসুন, আমরা গুরুদক্ষিণা দেব।
কুমারগণ দ্রুপদ আর তাঁর অমাত্যকে ধরে এনে দ্রোণকে দক্ষিণাস্বরূপ উপহার দিলেন। দ্রোণ বললেন, দ্রুপদ, আমি তোমার রাষ্ট্র দলিত করে রাজপুরী অধিকার করেছি, তোমার জীবনও শত্রুর অধীন, এখন পূর্বের বন্ধুত্ব স্মরণ করে কি চাও তা বল। তার পর দ্রোণ সহাস্যে বললেন, বীর, প্রাণের ভয় ক’রো না, আমরা ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। তুমি বাল্যকালে আমার সঙ্গে খেলেছিলে, সেজন্য তোমার প্রতি আমার স্নেহ আছে। অরাজা রাজার সখা হ’তে পারে না, তোমাকে আমি অর্ধ রাজ্য দিচ্ছি, যদি ইচ্ছা কর তবে আমাকে সখা মনে করতে পার। দ্রুপদ বললেন,শক্তিমান মহাত্মার পক্ষে এমন আচরণ আশ্চর্য নয়, আমি প্রীত হয়েছি, আপনার চিরস্থায়ী প্রণয় কামনা করি। তখন দ্রোণাচার্য তুষ্ট হয়ে দ্রুপদকে মুক্তি দিলেন।
গঙ্গার দক্ষিণে চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত দেশ দ্রুপদের অধিকারে রইল, দ্রোণাচার্য গঙ্গার উত্তরে অহিচ্ছত্র দেশ পেলেন। মনঃক্ষুগ্ন দ্রুপদ পুত্রলাভের জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।
২৫। ধৃতরাষ্ট্রের ঈর্ষা
এক বৎসর পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ধৈর্য স্থৈর্য অনিষ্ঠুরতা সরলতা প্রভৃতি গুণে যুধিষ্ঠির তাঁর পিতা পাণ্ডুর কীর্তিও অতিক্রম করলেন। বৃকোদর (১) ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখতে লাগলেন। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়োগে পটুতা লাভ করলেন। সহদেব সর্বপ্রকার নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলেন। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও অতিরথ (যিনি অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন) এবং চিত্রযোধী (বিচিত্র যুদ্ধকারী) নামে খ্যাত হলেন। অর্জুন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ বহু দেশ জয় করে নিজেদের রাজ্য বিস্তার করলেন।
পাণ্ডবদের বিক্রমের খ্যাতি অতিশয় বৃদ্ধি পাচ্ছে শুনে ধৃতরাষ্টের মন দুষিত হল, দুশ্চিন্তার জন্য তাঁর নিদ্রার ব্যাঘাত হ’তে লাগল। তিনি মন্ত্রিশ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ কণিককে বললেন, দ্বিজোত্তম, পাণ্ডবদের খ্যাতি শুনে আমার অসূয়া হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সন্ধি বা বিগ্রহ কি কর্তব্য তা বলুন, আমি আপনার উপদেশ পালন করব।
রাজনীতি বিষয়ক বিবিধ উপদেশের প্রসঙ্গে কণিক বললেন, মহারাজ, উপযুক্ত কাল না আসা পর্যন্ত অমিত্রকে কলসের ন্যায় কাঁধে বইবেন, তার পর সুযোগ এলেই তাকে পাথরের উপর আছড়ে ফেলবেন। যাঁকে দারুণ কর্ম করতে হবে তিনি বিনীত হয়ে হাস্যমুখে কথা বলবেন, কিন্তু হৃদয়ে ক্ষুরধার থাকবেন। মৎস্যজীবী যেমন বিনা অপরাধে মৎস্য হত্যা করে, সেইরূপ পরের মর্মচ্ছেদ ও নিষ্ঠুর কর্ম না করে বিপুল ঐশ্বর্যলাভ হয় না। কুরুরাজ, আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ; নিজেকে রক্ষা করুন, যেন পাণ্ডবরা আপনার অনিষ্ট না করে; এমন উপায় করুন যাতে শেষে অনুতাপ করতে না হয়।
**
(১) যার উদরে বৃক বা জঠরাগ্নি আছে, বহুভোজী।
।। জতুগৃহপর্বাধ্যায়।।
২৬। বারণাবত-জতুগৃহদাহ
পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য দুর্যোধন তার মাতুল সুবলপুত্র শকুনি ও কর্ণের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, পিতা, পুরবাসিগণ আপনাকে আর ভীষ্মকে অনাদর করে যুধিষ্ঠিরকেই রাজা করতে চায়। আপনি অন্ধ বলে রাজ্য পাননি, পাণ্ডু পেয়েছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুর পুত্ররাই যদি বংশানুক্রমে রাজ্য পায় তবে আমাদের বংশ অবজ্ঞাত হয়ে থাকবে। আপনি কৌশল করে পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করুন, তা হলে আমাদের আর ভয় থাকবে না।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পাণ্ডু যেমন প্রজাদের প্রিয় ছিলেন যুধিষ্ঠিরও সেইরূপ হয়েছেন, তার সহায়ও আছে, তাকে আমরা কি করে নির্বাসিত করতে পারি? ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর কৃপ তা সমর্থন করবেন না। দুর্যোধন বললেন, আমি অর্থ আর সম্মান দিয়ে প্রজাদের বশ করেছি, অমাত্যগণ এবং ধনাগারও আমাদের হাতে। ভীষ্মের কোনও পক্ষপাত নেই, অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষে আছেন, দ্রোণও পুত্রের অনুসরণ করবেন, কৃপও তার ভাগিনেয়কে ত্যাগ করবেন না। বিদুর আমাদের অর্থে পুষ্ট হয়েও গোপনে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী, কিন্তু তিনি একলা আমাদের বাধা দিতে পারবেন না। আপনি আজই পঞ্চপাণ্ডব আর কুন্তীকে বারণাবতে পাঠান।
ধৃতরাষ্ট্রের উপদেশ অনুসারে কয়েকজন মন্ত্রী পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে বললেন, বারণাবত অতি মনোরম নগর, সেখানে পশুপতির উৎসব উপলক্ষ্যে এখন বহু লোকের সমাগম হয়েছে। এইপ্রকার বর্ণনা শুনে পাণ্ডবদের সেখানে যাবার ইচ্ছ হল। ধৃতরাষ্ট্র তাদের বললেন, বৎসগণ, আমি শুনেছি যে বারণাবত অতি রমণীয় নগর, তোমরা সেখানে উৎসব দেখে এবং ব্রাহ্মণ ও গায়কদের ধনদান করে কিছুকাল আনন্দে কাটিয়ে এস। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় এবং নিজের অসহায় অবস্থা বুঝে সম্মত হলেন এবং ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতির আশীর্বাদ নিয়ে মাতা ও ভ্রাতাদের সঙ্গে যাত্রা করলেন।
দুর্যোধন অতিশয় হৃষ্ট হলেন এবং পুরোচন নামক এক মন্ত্রীর হাত ধরে তাকে গোপনে বললেন, তুমি ভিন্ন আমার বিশ্বাসী সহায় কেউ নেই, তুমি দ্রুতগামী রথে আজই বারণাবতে যাও এবং শণ, সর্জরস (ধুনা) প্রভৃতি দিয়ে একটি চতুঃশাল (চকমিলান) সুসজ্জিত গৃহ নির্মাণ করাও। মৃত্তিকার সঙ্গে প্রচুর ঘৃত তৈল বসা জতু (গালা) মিশিয়ে তার দেওয়ালে লেপ দেবে এবং চতুর্দিকে কাষ্ঠ তৈল প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ এমন করে রাখবে যাতে পাণ্ডবরা বুঝতে না পারে। তুমি সমাদর করে পাণ্ডবদের সেখানে বাসের জন্য নিয়ে যাবে এবং উত্তম আসন শয্যা যান প্রভৃতি দেবে। কিছুকাল পরে যখন তারা নিশ্চিন্তমনে নিদ্রামগ্ন থাকবে তখন দ্বারদেশে অগ্নিদান করবে। পুরোচন তখনই দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে বারণাবতে গেলেন।
বুদ্ধিমান বিদুর দুর্যোধনের ভাবভঙ্গী দেখে তার দুষ্ট অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ম্লেচ্ছভাষা জানতেন। যুধিষ্ঠিরের যাত্রাকালে বিদুর অন্যের অবোধ্য ম্লেচ্ছভাষায় তাকে বললেন, শত্রুর অভিসন্ধি যে জানে সে যেন বিপদ থেকে নিস্তারের উপায় করে। লৌহ ভিন্ন অন্য অস্ত্রেও প্রাণনাশ হয়। অগ্নিতে শুষ্ক বন দগ্ধ হয় কিন্তু গর্তবাসীর হানি হয় না। মানুষ শজারুর ন্যায় গর্তপথে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। যে লোক নক্ষত্র দ্বারা দিঙনির্ণয় করতে পারে এবং পথ চিনে রাখে সে নিজেকে এবং আরও পাঁচজনকে বাঁচাতে পারে। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, বুঝেছি।
পথে যেতে যেতে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, বিদুর তোমাকে অবোধ্য ভাষায় কি বললেন আর তুমিও বুঝেছি বললে, এর অর্থ কি? যুধিষ্ঠির বললেন, বিদুরের কথার অর্থ—আমাদের ঘরে আগুন লাগবে, পালাবার জন্য সকল পথই যেন আমরা চিনে রাখি।
পাণ্ডবগণ বারণাবতে এলে সেখানকার প্রজারা জয়ধ্বনি করে সংবর্ধনা করলে, তাঁরাও ব্রাহ্মণাদি চতুবর্ণের অধিবাসীর গৃহে গিয়ে দেখা করলেন। পুরোচন মহাসমাদরে তাদের এক বাসভবনে নিয়ে গেলেন এবং আহার শয্যা প্রভৃতির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে দশ রাত্রি বাসের পর তিনি পাণ্ডবদের অন্য এক ভবনে নিয়ে গেলেন, তার নাম ‘শিব, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা অশিব। যুধিষ্ঠির সেখানে গিয়ে ঘৃত বসা ও লাক্ষার গন্ধ পেয়ে ভীমকে বললেন, নিপুণ শিল্পীরা এই গৃহ আগ্নেয় পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত করেছে, পাপী পুরোচন আমাদের দগ্ধ করতে চায়। ভীম বললেন, যদি মনে করেন এখানে অগ্নিভয় আছে তবে পূর্বের বাসস্থানেই চলুন। যুধিষ্ঠির তাতে সম্মত হলেন না, বললেন, আমরা সন্দেহ করছি জানলে পুরোচন বলপ্রয়োগ করে আমাদের দগ্ধ করবে। যদি পালিয়ে যাই তবে দুর্যোধনের চরেরা আমাদের হত্যা করবে। আমরা মৃগয়ার ছলে এই দেশের সর্বত্র বিচরণ করে পথ জেনে রাখব এবং এই জতুগৃহের ভূমিতে গর্ত করে তার ভিতরে বাস করব, আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দও কেউ শুনতে পাবে না।
সেই সময়ে একটি লোক এসে নির্জনে পাণ্ডবদের বললে, আমি খনন কার্যে নিপুণ, বিদুর আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের যাত্রার পূর্বে তিনি ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করেছিলেন তা আমি জানি, এই আমার বিশ্বস্ততার প্রমাণ। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাত্রিতে পুরোচন এই গৃহের দ্বারে আগুন দেবে। এখন আমাকে কি করতে হবে বলুন। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি বিদুরের তুল্যই আমার হিতার্থ, অগ্নিদাহ থেকে আমাদের রক্ষা কর। দুর্যোধনের আদেশে পুরোচন এই ভবনে অনেক অস্ত্র এনে রেখেছে, এখান থেকে পলায়ন করা দুঃসাধ্য। তুমি গোপনে আমাদের রক্ষার উপায় কর। খনন পরিখায় ও গৃহমধ্যে গর্ত করে এক বৃহৎ সুরঙ্গ প্রস্তুত করলে এবং তার প্রবেশের পথে কপাটে লাগিয়ে ভূমির সমান করে দিলে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। পুরোচন গৃহের দ্বারদেশেই বাস করতেন সেজন্য সুরঙ্গের মুখ আবৃত করা হল। পাণ্ডবরা দিবসে এক বন থেকে অন্য বনে মৃগয়া করতেন। এবং রাত্রিকালে সশস্ত্র ও সতর্ক হয়ে সুরঙ্গের মধ্যে বাস করতেন।
এইরূপে এক বৎসর অতীত হলে পুরোচন স্থির করলেন যে পাণ্ডবদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, এখন আমাদের পলায়নের সময় এসেছে, আমরা অন্ধকারে আগুন দিয়ে পুরোচনকে দগ্ধ করব এবং অন্য ছ জনকে এখানে রেখে চ’লে যাব। একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণভোজন করালেন, অনেক স্ত্রীলোকও এল, তারা যথেচ্ছ পানভোজন করে রাত্রিতে চ’লে গেল। এক নিষাদ-স্ত্রী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে খেতে এসেছিল, সে পুত্রদের সঙ্গে প্রচুর মদ্যপান করে মৃতপ্রায় হয়ে গৃহমধ্যেই নিদ্রামগ্ন হল। সকলে সুষুপ্ত হলে ভীম পুরোচনের শয়নগৃহে, জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। প্রবল বায়ুতে জতুগৃহের সর্বদিক জ্বলে উঠল, অগ্নির উত্তাপে ও শব্দে নগরবাসীরা জেগে উঠে বলতে লাগল, পাপিষ্ঠ পুরোচন দুর্যোধনের আদেশে এই গৃহদাহ করে পাণ্ডবদের বধ করেছে। দুবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, যিনি নির্দোষ পাণ্ডবগণকে শত্রুর ন্যায় হত্যা করিয়েছেন। ভাগ্যক্রমে পাপাত্মা পুরোচনও পুড়ে মরেছে। বারণাবতবাসীরা জ্বলন্ত জতুগৃহের চতুর্দিকে থেকে এইরূপে বিলাপ করে রাত্রিযাপন করলে।
পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী অলক্ষিত হয়ে সুরঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। নিদ্রার ব্যাঘাতে এবং ভয়ে তারা চলতে পারলেন না। মহাবল ভীমসেন কুন্তীকে কাঁধে এবং নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির-অর্জুনের হাত ধরে বেগে চললেন। বিদ্যুরের। একজন বিশ্বস্ত অনুচর গঙ্গার তীরে একটি বায়ুবেগসহ যন্ত্রযুক্ত পতাকাশোভিত নৌকা (১) রেখেছিল। পাণ্ডবগণকে গঙ্গার অপর পারে এনে বিদুরের অনুচর জয়োচ্চারণ করে চ’লে গেল।
নৌকা থেকে নেমে পাণ্ডবরা নক্ষত্র দেখে পথনির্ণয় করে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পরদিন সন্ধ্যাকালে তারা হিংস্রপ্রাণিসমাকুল ঘোর অরণ্যে উপস্থিত হলেন। কুন্তী প্রভৃতি সকলে তৃষ্ণায় কাতর হওয়ায় ভীম পদ্মপুটে এবং উত্তরীয় ভিজিয়ে জল নিয়ে এলেন। সকলে ক্লান্ত হয়ে ভূমিতে নিদ্রামগ্ন হলেন, কেবল ভীম জেগে থেকে নানাপ্রকার চিন্তা করতে লাগলেন।
রাত্রি প্রভাত হলে বারণাবতবাসীরা আগুন নিবিয়ে দেখলে পুরোচন পুড়ে মরেছেন। পাণ্ডবদের খুঁজতে খুঁজতে তারা নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের দগ্ধ দেহ পেয়ে স্থির করলে যে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব নিহত হয়েছেন। তারা সুরঙ্গ দেখতে পেলে না, কারণ খনক তা মাটি দিয়ে ভরিয়েছিল। হস্তিনাপুরে সংবাদ গেলে ধৃতরাষ্ট্র বহু বিলাপ করলেন এবং কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদির অন্ত্যেষ্টির জন্য বারণাবতে লোক পাঠালেন। তার পর জ্ঞাতিগণের সঙ্গে ভীষ্ম ও সপুত্র ধৃতরাষ্ট্র নিরাভরণ হয়ে একবস্ত্রে গঙ্গায় গিয়ে তর্পণ করলেন। সকলে রোদন করতে লাগলেন, কেবল বিদুর অধিক শোক প্রকাশ করলেন না।
**
(১) সর্ববাতসহাং নাবং যন্ত্রযুক্তাং পতাকিনীম্।
।। হিড়িম্ববধপর্বাধ্যায়।।
২৭। হিড়িম্ব ও হিড়িম্বা-ঘটোৎকচের জন্ম
কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদি যেখানে নিদ্রিত ছিলেন তার অনতিদূরে শালগাছের উপর হিড়িম্ব নামে এক রাক্ষস ছিল। তার বর্ণ বর্ষার মেঘের ন্যায়, চক্ষু পিঙ্গল, বদন দংষ্ট্রাকরাল, কেশ ও শ্মশ্রু রক্তবর্ণ, আকার ভয়ংকর। পাণ্ডবদের দেখে এই রাক্ষসের মনুষ্যমাংস খাবার ইচ্ছা হল , সে তার ভগিনী হিড়িম্বাকে বললে, বহু কাল পরে আমার প্রিয় খাদ্য উপস্থিত হয়েছে, তার গন্ধে আমার লালা পড়ছে, জিহ্বা বেরিয়ে আসছে। আজ নরম মাংসে আমার ধারাল আটটি দাঁত বসাব, মানুষের কণ্ঠ ছেদন করে ফেনিল রক্ত পান করব। তুমি ওদের বধ করে নিয়ে এস, আজ আমরা দুজনে প্রচুর নরমাংস খেয়ে হাততালি দিয়ে নাচব।
ভ্রাতার কথা শুনে হিড়িম্বা গাছের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে পাণ্ডবদের কাছে এসে দেখলে সকলেই নিদ্রিত, কেবল একজন জেগে আছেন। ভীমকে দেখে সে ভাবলে, এই মহাবাহু সিংহস্কন্ধ উজ্জ্বলকান্তি পুরুষই আমার স্বামী হবার যোগ্য। আমি ভ্রাতার কথা শুনব না, ভ্রাতৃস্নেহের চেয়ে পতিপ্রেমই বড়। কামরূপিণী হিড়িম্বা সুন্দরী সালংকারা নারীর রূপ ধারণ করে যেন লজ্জায় ঈষৎ হেসে ভীমসেনকে বললে, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন? এই দেবতুল্য পুরুষরা এবং এই সুকুমারী রমণী যাঁরা ঘুমিয়ে রয়েছেন এঁরা কে? এই বনে আমার ভ্রাতা হিড়িম্ব নামক রাক্ষস থাকে, সে আপনাদের মাংস খেতে চায় সেজন্য আমাকে পাঠিয়েছে। আপনাকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি, আপনি আমার পতি হন। আমি আকাশচারিণী, আপনার সঙ্গে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করব। ভীম বললেন, রাক্ষসী, নিদ্রিত মাতা ও ভ্রাতাদের রাক্ষসের কবলে ফেলে কে চ’লে যেতে পারে? হিড়িম্বা বললে, এঁদের জাগান, আমি সকলকে রক্ষা করব। ভীম বসলেন, এঁরা সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন, আমি এখন জাগাতে পারব না। রাক্ষস বা যক্ষ গন্ধর্ব সকলকেই আমি পরাস্ত করতে পারি। তুমি যাও বা থাক বা তোমার ভ্রাতাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
ভগিনীর ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে হিড়িম্ব দ্রুতবেগে পাণ্ডবদের কাছে আসতে লাগল। হিড়িম্বা ভীমকে বললে, আপনারা সকলেই আমার নিতম্বে আরোহণ করুন, আমি আকাশপথে আপনাদের নিয়ে যাব। ভীম বললেন, তোমার ভয় নেই, মানুষ বলে আমাকে অবজ্ঞা ক’রো না। হিড়িম্ব এসে দেখলে, তার ভগিনী সুন্দরী নারীর রূপ ধরে সূক্ষ্ম বসন, অলংকার এবং মাথায় পুলের মালা পরেছে। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, তুই অসতী, এদের সঙ্গে তোকেও বধ করব। এই বলে সে পাণ্ডবদের দিকে ধাবিত হল। ভীম বললেন, রাক্ষস, এঁদের জাগিয়ে কি হবে, আমার কাছে এস। তোমার ভগিনীর দোষ কি, ইনি নিজের বশে নেই, শরীরের ভিতরে যে অনঙ্গদেব আছেন তারই প্রেরণায় ইনি আমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন। তার পর ভীম আর হিড়িম্বের ঘোর বাহুযুদ্ধ আরম্ভ হল। পাছে ভ্রাতাদের নিদ্রাভঙ্গ হয় সেজন্য ভীম রাক্ষসকে দূরে টেনে নিয়ে গেলেন, কিন্তু যুদ্ধের শব্দে সকলেই জেগে উঠলেন।
কুন্তী হিড়িম্বাকে বললেন, বরবর্ণিনী, সুরকন্যাতুল্য তুমি কে? এই বনের দেবতা, অঙ্গরা? হিড়িম্বা নিজের পরিচয় দিয়ে জানালে যে ভীমের প্রতি তার অনুরাগ হয়েছে। অর্জুন ভীমকে বললেন, আপনি বিলম্ব করবেন না, আমাদের যেতে হবে। উষাকাল আসন্ন, সেই রৌদ্র মুহুর্তে রাক্ষসরা প্রবল হয়। ওই রাক্ষসটাকে নিয়ে খেলা করবেন না, ওকে শীঘ্র মেরে ফেলুন। তখন ভীম হিড়িম্বকে তুলে ধরে ঘোরাতে লাগলেন এবং তার পর ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট করে বধ করলেন।
অর্জুন বললেন, আমার মনে হয় এখান থেকে নগর বেশী দূরে নয়, আমরা শীঘ্র সেখানে যাই চলুন, দুর্যোধন আমাদের সন্ধান পাবে না। ভীম বললেন, রাক্ষসজাতি মোহিনী মায়ার বলে শত্রুতা করে, হিড়িম্বা, তুমিও তোমার ভ্রাতার পথে যাও। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি স্ত্রীহত্যা ক’রো না, এ আমাদের অনিষ্ট করতে পারবে না। হিড়িম্বা কুন্তীকে প্রণাম করে করজোড়ে বললে, আর্যা, আমি স্বজন ত্যাগ করে। আপনার এই বীর পুত্রকে পতিরূপে বরণ করেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি বাঁচব না, আমাকে মুগ্ধা ভক্তিমতী ও অনুগতা জেনে দয়া করুন। আপনার পুত্রের সঙ্গে আমাকে মিলিত করে দিন। আমি ওঁকে নিয়ে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করব, তার পর আবার এনে দেব, আমাকে বিশ্বাস করুন। আমাকে মনে মনে ভাবলেই আমি উপস্থিত হব।
যুধিষ্ঠির বললেন, হিড়িম্বা, তোমার কথা অসংগত নয়, কিন্তু তোমাকে এই নিয়ম পালন করতে হবে। ভীম স্নান আহ্নিক করে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন এবং সূর্যাস্ত হলেই আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। ভীম হিড়িম্বাকে বললেন, রাক্ষসী, শোন, যত দিন তোমার পুত্র না হয় তত দিনই আমি তোমার সঙ্গে থাকব। হিড়িম্বা সম্মত হয়ে ভীমকে নিয়ে আকাশপথে চ’লে গেল।
কিছুকাল পরে হিড়িম্বার একটি ভীষণাকার বলবান পুত্র হল , তার কর্ণ সূক্ষাগ্র, দন্ত তীক্ষ্ম, ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ, কণ্ঠস্বর ভয়ানক। রাক্ষসীরা গর্ভবতী হয়েই সদ্য প্রসব করে। হিড়িম্বার পুত্র জন্মাবার পরেই যৌবনলাভ করে সর্বপ্রকার অস্ত্রপ্রয়োগে দক্ষ হল। তার মাথা ঘটের মত এবং চুল খাড়া সেজন্য হিড়িম্বা পুত্রের নাম রাখলে ঘটোৎকচ। কুন্তী ও পাণ্ডবদের প্রণাম করে সে বললে, আমাকে কি করতে হবে আজ্ঞা করুন। কুন্তী বললেন, বৎস, তুমি কুরুকুলে জন্মেছ, তুমি সাক্ষাৎ ভীমের তুল্য এবং পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তুমি আমাদের সাহায্য ক’রো। ঘটোৎকচ বললে, প্রয়োজন হলেই আমি উপস্থিত হব। এই বলে সে বিদায় নিয়ে উত্তর দিকে চ’লে গেল।
পাণ্ডবরা জটা বল্কল মৃগচর্ম ধারণ করে তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে চললেন। যেতে যেতে পিতামহ ব্যাসের সঙ্গে তাদের দেখা হল। ব্যাস বললেন, আমি তোমাদের সমস্ত বৃত্তান্ত জানি, বিষণ্ণহয়ো না, তোমাদের মঙ্গল হবে। যত দিন আমার সঙ্গে আবার দেখা না হয় তত দিন তোমরা নিকটস্থ ওই নগরে ছদ্মবেশে বাস কর। এই কথা বলে ব্যাস পাণ্ডবগণকে একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে রেখে এলেন।
৷৷ বকবধপর্বাধ্যায় ৷৷
২৮। একচক্রা-বকরাক্ষস
পাণ্ডবগণ একচক্রা নগরে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে বাস করতে লাগলেন। তারা ভিক্ষা করে যা আনতেন, কুন্তী সেই সমস্ত খাদ্য দু ভাগ করতেন, এক ভাগ ভীম একাই খেতেন, অন্য ভাগ অপর চার ভ্রাতা ও কুন্তী খেতেন। এইরূপে বহুদিন গত হল। একদিন যুধিষ্ঠিরাদি ভিক্ষা করতে গেছেন, কেবল ভীম আর কুন্তী গৃহে আছেন, এমন সময় তারা তাদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আর্তনাদ শুনতে পেলেন। কুন্তী অন্তঃপুরে গিয়ে দেখলেন, ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী পুত্র ও কন্যার সঙ্গে বিষগ্নমুখে রয়েছেন। ব্রাহ্মণ বলছিলেন, ধিক মানুষের জীবন যা নল-তৃণের ন্যায় অসার, পরাধীন ও সকল দুঃখের মূল। ব্রাহ্মণী, আমি নিরাপদ স্থানে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দুবুদ্ধিবশত তোমার স্বর্গস্থ পিতামাতার এই গৃহ ছেড়ে যেতে চাওনি, তার ফলে এখন এই আত্মীয়নাশ হবে। যিনি আমার নিত্যসঙ্গিনী পতিব্রতা ধর্ম-পত্নী তাকে আমি ত্যাগ করতে পারি না, আমার বালিকা কন্যা বা পুত্রকেও ছাড়তে পারি না। যদি আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিই তবে তোমরাও মরবে। হায়, আমাদের গতি কি হবে, সকলের এক সঙ্গে মরাই ভাল।
ব্রাহ্মণী বললেন, তুমি প্রাকৃত জনের ন্যায় বিলাপ করছ কেন? লোকে নিজের জন্যই পত্নী ও পুত্রকন্যা চায়। তুমি থাক, আমি যাব, তাতে আমার ইহলোকে যশ এবং পরলোকে অক্ষয় পুণ্য হবে। লোকে ভার্যার কাছে যা চায় সেই পুত্রকন্যা তুমি পেয়েছ, তোমার অভাবে আমি তাদের ভরণপোষণ করতে পারব না। ভূমিতে মাংস পড়ে থাকলে যেমন পাখিরা লোলুপ হয় তেমনই পতিহীনা নারীকে সকলে কামনা করে, দুরাত্মা পুরুষরা হয়তো আমাকে সৎপথ থেকে বিচলিত করবে। এই কন্যার বিবাহ এবং পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা আমি কি করে করব? আমার অভাবে তুমি অন্য পত্নী পাবে, কিন্তু আমার পক্ষে অন্য পতি গ্রহণ ঘোর অধর্ম। অতএব আমাকে যেতে দাও।
এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীকে আলিঙ্গন করে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। তখন তাদের কন্যাটি বললে, একদিন আমাকে তো ছাড়তেই হবে, বরং এখনই আমাকে যেতে দাও, তাতে তোমরা সকলে নিস্তার পাবে, আমিও অমৃতলোক লাভ করব। বালক পুত্রটি উৎফুল্ল নয়নে কলকণ্ঠে বললে, তোমরা কেঁদো না, আমি এই তৃণ দিয়ে সেই রাক্ষসকে বধ করব।
কুন্তী জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের দুঃখের কারণ কি বলুন, যদি পারি তো। দূর করতে চেষ্টা করব। ব্রাহ্মণ বললেন, এই নগরের নিকট বক নামে এক মহাবল রাক্ষস বাস করে, সেই এদেশের প্রভু। আমাদের রাজা তার রাজধানী বেত্ৰকীয়গৃহে থাকেন, তিনি নির্বোধ ও দুর্বল, প্রজারক্ষার উপায় জানেন না। বক রাক্ষস এই দেশ রক্ষা করে, তার মূল্যস্বরূপ আমাদের প্রতিদিন একজন লোককে পাঠাতে হয়, সে প্রচুর অন্ন ও দুই মহিষ সঙ্গে নিয়ে যায়। বক সেই মানুষ মহিষ আর অন্ন ভোজন করে। আজ আমার পালা, আমার এমন ধন নেই যে অন্য কোনও মানুষকে কিনে নিয়ে রাক্ষসের কাছে পাঠাই। অগত্যা আমি স্ত্রী পুত্র কন্যাকে নিয়ে তার কাছে। যাব, আমাদের সকলকেই সে খেয়ে ফেলুক।
কুন্তী বললেন, আপনি দুঃখ করবেন না, আমার পাঁচ পুত্রের একজন রাক্ষসের কাছে যাবে। ব্রাহ্মণ বললেন, আপনারা আমার শরণাগত ব্রাহ্মণ অতিথি আমাদের জন্য আপনার পুত্রের প্রাণনাশ হ’তে পারে না। কুন্তী বললেন, আমার পুত্র বীর্যবান। মন্ত্রসিদ্ধ ও তেজস্বী, সে রাক্ষসের খাদ্য পৌছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু আপনি কারও কাছে প্রকাশ করবেন না, কারণ মন্ত্রশিক্ষার জন্য লোকে আমার পুত্রের উপর উপদ্রব করবে। কুন্তীর কথা শুনে ব্রাহ্মণ অতিশয় হৃষ্ট হলেন। এমন সময় যুধিষ্ঠিরাদি ভিক্ষা নিয়ে ফিরে এলেন। ভীম রাক্ষসের কাছে যাবেন শুনে যুধিষ্ঠির মাতাকে বললেন, যাঁর বাহুবলের ভরসায় আমরা সুখে নিদ্রা যাই, যাঁর ভয়ে দুর্যোধন প্রভৃতি বিনিদ্র থাকে, যিনি জতুগৃহ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন, সেই ভীমসেনকে আপনি কোন্ বুদ্ধিতে ত্যাগ করছেন ? কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠির, ভীমের বল অযুত হস্তীর সমান, তার তুল্য বলবান কেউ নেই। এই ব্রাহ্মণের গৃহে আমরা সুখে নিরাপদে বাস করছি, এঁর প্রত্যপকার করা আমাদের কর্তব্য।
রাত্রি প্রভাত হলে ভীম অন্ন নিয়ে বক রাক্ষস যেখানে থাকে সেই বনে গেলেন। এবং তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মহাবেগে ভীমের কাছে এসে দেখলে, ভীম অন্ন ভোজন করছেন। বক বললে, আমার অন্ন আমার সম্মুখেই কে খাচ্ছে, কোন্ দুর্বুদ্ধির যমালয়ে যেতে ইচ্ছা হয়েছে? ভীম মুখ ফিরিয়ে হাসতে হাসতে খেতে লাগলেন। রাক্ষস দুই হাত দিয়ে ভীমের পিঠে আঘাত করলে, কিন্তু ভীম গ্রাহ্য করলেন না। রাক্ষস একটা গাছ নিয়ে আক্রমণ করতে এল। ভীম ভোজন শেষ করে আচমন করে বাঁ হাতে রাক্ষসের নিক্ষিপ্ত গাছ ধরে ফেললেন। তখন দুজনে বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল, ভীম বক রাক্ষসকে ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট করে বধ করলেন। রাক্ষসের চিৎকার শুনে তার আত্মীয় পরিজন ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভীম তাদের বললেন, তোমরা আর কখনও মানুষের হিংসা করবে না, যদি কর তবে তোমাদেরও প্রাণ যাবে। রাক্ষসরা ভীমের আদেশ মেনে নিলে। তারপর ভীম রাক্ষসের মৃতহে নগরের দ্বারদেশে ফেলে দিয়ে অন্যের অজ্ঞাতসারে ব্রাহ্মণের গৃহে ফিরে এলেন। নগরবাসীরা আশ্চর্য হয়ে ব্রাহ্মণের কাছে সংবাদ নিতে গেল। ব্রাহ্মণ বললেন, একজন মন্ত্রসিদ্ধ মহাত্মা আমাদের রোদনে দয়ার্দ্র হয়ে আমার পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে অন্ন নিয়ে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তিনিই তাকে বধ করে সকলের হিতসাধন করেছেন।
৷৷ চৈত্ররথপর্বাধ্যায় ৷৷
২৯। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত-গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ
কিছুকাল পরে পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে অন্য এক ব্রাহ্মণ অতিথি রূপে উপস্থিত হলেন। ইনি বিবিধ উপাখ্যান এবং নানাদেশের আশ্চর্য বিবরণের প্রসঙ্গে বললেন, পাঞ্চালরাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর হবে। পাণ্ডবগণ সবিশেষ জানতে চাইলে তিনি এই ইতিহাস বললেন।
দ্রোণাচার্যের নিকট পরাজয়ের পর দ্রুপদ প্রতিশোধ ও পুত্রলাভের জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হলেন। তিনি গঙ্গা ও যমুনার তীরে বিচরণ করতে করতে একটি ব্রাহ্মণবসতিতে এলেন। সেখানে যাজ ও উপযাজ নামক দুই ব্রহ্মর্ষি বাস করতেন। পাদসেবায় উপযাজকে তুষ্ট করে দ্রুপদ বললেন, আমি আপনাকে দশ কোটি গো দান করব, আপনি আমাকে এমন পুত্র পাইয়ে দিন যে দ্রোণকে বধ করবে। উপযাজ সম্মত হলেন না, তথাপি দ্রুপদ তাঁর পরিচর্যা করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে উপযাজ বললেন, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যাজ শুচি অশুচি বিচার করেন না, আমি তাকে ভূমিতে পতিত ফল তুলে নিতে দেখেছি। ইনি গুরুগৃহে বাসকালে অন্যের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করতেন। আমার মনে হয় ইনি ধন চান, আপনার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন। যাজের প্রতি অশ্রদ্ধা হলেও দ্রুপদ তার কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন। যাজ সম্মত হলেন এবং উপযাজকে সহায়রূপে নিযুক্ত করলেন।
যজ্ঞ শেষ হলে যাজ দ্রুপদমহিষীকে ডেকে বললেন, রাজ্ঞী, আসুন, আপনার দুই সন্তান উপস্থিত হয়েছে। মহিষী বললেন, আমার মুখপ্রক্ষালন আর স্নান হয়নি, আপনি অপেক্ষা করুন। যাজ বললেন, যজ্ঞাগ্নিতে আমি আহুতি দিচ্ছি, উপযাজ মন্ত্রপাঠ করছেন, এখন তা থেকে অভীষ্টলাভ হবেই, আপনি আসুন বা না আসুন। যাজ আহুতি দিলে যজ্ঞাগ্নি থেকে এক অগ্নিবর্ণ বর্মমুকুটভূষিত খড়্গধনুর্বাণধারী কুমার সগর্জনে উখিত হলেন। পাঞ্চালগণ হৃষ্ট হয়ে সাধু সাধু বলতে লাগল, আকাশবাণী। হল —এই রাজপুত্র দ্রোণবধ করে রাজার শোক দূর করবেন। তারপর যজ্ঞবেদী থেকে কুমারী পাঞ্চালী উঠলেন, তিনি সুদর্শনা, শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিতকৃষ্ণকেশী, পীনপয়োধরা, তার নীলোৎপলতুল্য সৌরভ এক ক্রোশ দূরেও অনুভূত হয়। আকাশবাণী হল -সর্ব নারীর শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা হ’তে ক্ষত্রিয়ক্ষয় এবং কুরুবংশের মহাভয় উপস্থিত হবে। দ্রুপদ ও তার মহিষী এই কুমার-কুমারীকে পুত্রকন্যা রূপে লাভ করে অতিশয় সন্তুষ্ট হলেন। ধৃষ্ট (প্রগম্ভ) ও দ্যুম্ন (দ্যুতি, যশ, বীর্য, ধন-সমন্বিত এই কারণে কুমারের নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন হল। শ্যাম বর্ণের জন্য এবং আকাশবাণী অনুসারে কুমারীর নাম কৃষ্ণা হল। দৈব অনিবার্য এই জেনে এবং নিজ কীর্তি রক্ষার জন্য দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে স্বগৃহে এনে অস্ত্রশিক্ষা দিলেন।
এই বৃত্তান্ত শুনে পাণ্ডবগণ বিষগ্ন হলেন। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমরা এই ব্রাহ্মণের গৃহে বহুকাল বাস করেছি, এদেশে যে রমণীয় বন-উপবন আছে তাও দেখা হয়েছে, এখন ভিক্ষাও পূর্বের ন্যায় যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তোমরা ভাল মনে কর তবে পাঞ্চাল দেশে চল। পাণ্ডবগণ সম্মত হলেন। এই সময়ে ব্যাস পুনর্বার তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। নানা বিচিত্র কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, কোনও এক ঋষির একটি পরমা সুন্দরী কন্যা ছিল, পূর্বজন্মের কর্মদোষে তার পতিলাভ হয় নি। তার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব এসে বললেন, অভীষ্ট বর চাও। কন্যা বার বার বললেন, সর্বগুণান্বিত পতি কামনা করি। মহাদেব বললেন তুমি পাঁচ বার পতি চেয়েছ, এজন্য পরজন্মে তোমার পাঁচটি ভরতবংশীয় পতি হবে। সেই দেবরূপিণী কন্যা কৃষ্ণা নামে দ্রুপদের বংশে জন্মেছে, সেই তোমাদের পত্নী হবে। তোমরা পাঞ্চালনগরে যাও, দ্রুপদকন্যাকে পেয়ে তোমরা সুখী হবে।
পাণ্ডবরা পাঞ্চালদেশে যাত্রা করলেন। এক অহোরাত্র পরে তারা সোমাশ্রয় তীর্থে গঙ্গাতীরে এলেন। অন্ধকারে পথ দেখবার জন্য অর্জুন একটি জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আগে আগে চললেন। সেই সময়ে গন্ধর্বরাজ স্ত্রীদের নিয়ে গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে এসেছিলেন। পাণ্ডবদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, প্রাতঃসন্ধ্যার পূর্বকাল পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি যক্ষ-গন্ধর্ব-রাক্ষসদের, অবশিষ্ট কাল মানুষের। রাত্রিতে কোনও মানুষ, এমন কি সসৈন্য নৃপতিও, যদি জলের কাছে আসে তবে ব্রহ্মজ্ঞগণ নিন্দা করেন। আমি কুবেরের সখা গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ, এই বন আমার, তোমর দূরে যাও। অর্জুন বললেন, সমুদ্রে, হিমালয়ের পার্শ্বে, এবং এই গঙ্গায় দিনে রাত্রিতে বা সন্ধ্যায় কারও আসতে বাধা নেই। তোমার কথায় কেন আমরা গঙ্গার পবিত্র জল স্পর্শ করব না? তখন অঙ্গারপর্ণ পাণ্ডবদের প্রতি অনেকগুলি বাণ ছুড়লেন। অর্জুন তাঁর মশাল আর ঢাল ঘুরিয়ে সমস্ত বাণ নিরস্ত করে দ্রোণের নিকট হতে প্রাপ্ত প্রদীপ্ত আগ্নেয় অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। গন্ধর্ব-রাজের রথ দগ্ধ হয়ে গেল, তিনি অচেতন হয়ে অধোমুখে পড়ে গেলেন, অর্জুন তাঁর মাল্যভূষিত কেশ ধরে টানতে লাগলেন গন্ধর্বের ভার্যা কুম্ভীনসী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহাভাগ, আমি আপনার শরণাগত, রক্ষা করুন, আমার স্বামীকে মুক্তি দিন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অর্জুন গন্ধর্বকে ছেড়ে দিলেন।
গন্ধর্ব বললেন, আমি পরাজিত হয়েছি, নিজেকে আর অঙ্গারপর্ণ (১) বলব না। আমার বিচিত্র রথ দগ্ধ হয়েছে, আমার এক নাম চিত্ররথ হলেও আমি দগ্ধ হয়েছি। যে মহাত্মা আমাকে প্রাণদান করেছেন সেই অর্জুনকে আমার চাক্ষুষী বিদ্যা দান করছি। রাজকুমার, তুমি ত্রিলোকের যা কিছু দেখতে ইচ্ছা করবে এই বিদ্যাবলে তা দেখতে পাবে। আমি তোমাকে আর তোমার প্রত্যেক ভ্রাতাকে একশত দিব্যবৰ্ণ বেগবান গন্ধর্বদেশীয় অশ্ব দিচ্ছি, এরা প্রভুর ইচ্ছানুসারে উপস্থিত হয়। অর্জুন বললেন, গন্ধর্ব, তুমি প্রাণসংশয়ে যা আমাকে দিচ্ছ তা নিতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। গন্ধর্ব বললেন, তুমি জীবন দিয়েছ, তার পরিবর্তে আমি চাক্ষুষী বিদ্যা দিচ্ছি। তোমার আগ্নেয় অস্ত্র এবং চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব আমাকে দাও।
অর্জুন গন্ধর্বের প্রার্থনা অনুসারে চাক্ষুষী বিদ্যা ও অশ্ব নিলেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দান করে সখ্যে আবন্ধ হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, আমরা বেদজ্ঞ ও শত্রুদমনে সমর্থ, তথাপি রাত্রিকালে আমাদের ধর্ষণ করলে কেন? গন্ধর্ব বললেন, তোমাদের অগ্নিহোত্র নেই, ব্রাহ্মণকে অগ্রবর্তী করেও চল না, সেজন্য আমি তোমাদের ধর্ষণ করেছি। হে তাপত্য, শ্ৰেয়োলাভের জন্য পুরোহিত নিয়োগ করা কর্তব্য। পুরোহিত থাকলে কোনও রাজা কেবল বীরত্ব বা আভিজাত্যের প্রভাবে রাজ্য জয় করতে পারেন না। ব্রাহ্মণকে পুরোভাগে রাখলেই চিরকাল রাজ্যপালন করা যায়।
**
(১) যার পর্ণ বা বাহন জ্বলন্ত অঙ্গার তুল্য।
৩০। তপতী ও সংবরণ
অর্জুন প্রশ্ন করলেন, তুমি আমাকে তাপত্য বললে কেন ? তপতী কে? আমরা তো কৌন্তেয়। গন্ধর্বরাজ এই ত্রিলোকবিশ্রুত উপাখ্যান বললেন।
যিনি নিজ তেজে সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করেন সেই সুর্যের এক কন্যার নাম তপতী, ইনি সাবিত্রীর কনিষ্ঠা। রূপে গুণে তিনি অতুলনা ছিলেন। সূর্যদেব এমন কোনও পাত্র খুঁজে পেলেন না যিনি তপতীর উপযুক্ত। সেই সময়ে কুরুবংশীয় ঋক্ষপুত্র সংবরণ রাজা প্রত্যহ উদয়কালে সূর্যের আরাধনা করতে লাগলেন। তিনি ধার্মিক, রূপবান ও বিখ্যাত বংশের নৃপতি, সেজন্য সূর্য তাকেই কন্যা দিতে ইচ্ছা করলেন। একদিন সংবরণ পর্বতের নিকটস্থ বনে মৃগয়া করতে গেলে তার অশ্ব ক্ষুৎপিপাসায় পীড়িত হয়ে মরে গেল। সংবরণ পদব্রজে বিচরণ করতে করতে এক অতুলনীয় রূপবতী কন্যা দেখতে পেলেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু সেই কন্যা মেঘমধ্যে সৌদামিনীর ন্যায় অন্তর্হিত হলেন। রাজা কামমোহিত হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন, তখন তপতী আবার দেখা দিয়ে বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, উঠুন, মোহগ্রস্ত হবেন না। সংবরণ অস্পষ্ট বাক্যে অনুনয় করে বললেন, সুন্দরী, তুমি আমাকে ভজনা কর নতুবা আমার প্রাণবিয়োগ হবে। তুমি প্রসন্ন হও, আমি তোমার বশংগত ভক্ত। তপতী বললেন, আপনিও আমার প্রাণ হরণ করেছেন। আমি স্বাধীন নই, আমার পিতা আছেন। আপনি তপস্যায় তাঁকে প্রীত করে আমাকে প্রার্থনা করুন। এই বলে তপতী চ’লে গেলেন।
সংবরণ পুনর্বার মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। অমাত্য ও অনুচরগণ অন্বেষণ করে রাজাকে দেখতে পেলেন এবং তার মাথায় পদ্মসুরভিত শীতল জল সেচন করলেন। রাজা সংজ্ঞালাভ করে মন্ত্রী ভিন্ন সকলকেই বিদায় দিলেন এবং সেই পর্বতেই উর্ধ্বমুখে কৃতাঞ্জলি হয়ে পুরোহিত বশিষ্ঠ ঋষিকে স্মরণ করতে লাগলেন। দ্বাদশ দিন অতীত হলে বশিষ্ঠ সেখানে এলেন। তিনি যোগবলে সমস্ত জেনে কিছুক্ষণ সংবরণের সঙ্গে আলাপ করে ঊর্ধ্বে চ’লে গেলেন। সূর্যের কাছে এসে বশিষ্ঠ প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, বিভাবসু, আপনার তপতী নামে যে কন্যা আছে তাকে আমি মহারাজ সংবরণের জন্য প্রার্থনা করছি। সূর্য সম্মত হয়ে তপতীকে দান করলেন, বশিষ্ঠ তাকে নিয়ে সংবরণের কাছে এলেন। সংবরণ তপতীকে বিবাহ করলেন এবং মন্ত্রীর উপর রাজ্যচালনার ভার দিয়ে সেই পর্বতের বনে উপবনে পত্নীর সঙ্গে বার বৎসর সুখে বাস করলেন।
সেই বার বৎসরে তার রাজ্যে একবিন্দু বৃষ্টিপাত হল না, স্থাবর জঙ্গম এবং সমস্ত প্রজা ক্ষয় পেতে লাগল, লোকে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পুত্ৰকসত্র ছেড়ে দিকে দিকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে বিচরণ করতে লাগল। বশিষ্ঠ মুনি সংবরণ ও তপতীকে রাজপুরীতে ফিরিয়ে আনলেন, তখন ইন্দ্র আবার বর্ষণ করলেন, শস্য উৎপন্ন হল। অর্জুন, সেই তপতীর গর্ভে কুরু নামক পুত্র হয়। তুমি তারই বংশে জন্মেছ সেজন্য তুমি তাপত্য।
৩১। বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, শক্তি, ও কল্মষপাদ-ঔর্ব-ধৌম্য
অর্জুন বশিষ্ঠের ইতিহাস জানতে চাইলে গন্ধর্বরাজ বললেন।-বশিষ্ঠ ব্রহ্মার মানস পুত্র, অরুন্ধতির পতি এবং ইক্ষাকু কুলের পুরোহিত। কান্যকুব্জরাজ কুশিকের পুত্র গাধি, তার পুত্র বিশ্বামিত্র। একদা বিশ্বামিত্র সসৈন্যে মৃগয়ায় গিয়ে পিপাসিত হয়ে বশিষ্ঠের আশ্রমে এলেন। রাজার সকারের নিমিত্ত বশিষ্ঠ তার কামধেনু নন্দিনীকে বললেন, আমার যা প্রয়োজন তা দাও। নন্দিনী ধূমায়মান অন্নরাশি, সূপ (দাল), দধি, ঘৃত, মিষ্টান্ন, মদ্য প্রভৃতি ভক্ষ্য ও পেয় এবং বিবিধ রত্ন ও বসন উৎপন্ন করলে, বশিষ্ঠ তা দিয়ে বিশ্বামিত্রের সৎকার করলেন। নন্দিনীর মনোহর আকৃতি দেখে বিস্মিত হয়ে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠকে বললেন, আপনি দশ কোটি ধেনু বা আমার রাজ্য নিয়ে আপনার কামধেনু আমাকে দান করুন। বশিষ্ঠ সম্মত হলেন না, তখন বিশ্বামিত্র সবলে নন্দিনীকে হরণ করে কশাঘাতে তাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। নন্দিনী বললে, ভগবান, বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের কশাঘাতে আমি অনাথার ন্যায় বিলাপ করছি, আপনি তা উপেক্ষা করছেন কেন? বশিষ্ঠ বললেন, ক্ষত্রিয়ের বল তেজ, ব্রাহ্মণের বল ক্ষমা। কল্যাণী, আমি তোমাকে ত্যাগ করি নি, যদি তোমার শক্তি থাকে তবে আমার কাছেই থাক।
তখন সেই পয়স্বিনী কামধেনু ভয়ংকর রূপ ধারণ করে হম্বা রবে সৈন্যদের বিতাড়িত করলে। তার বিভিন্ন অঙ্গ থেকে পহ্মব দ্রবিড় শক যবন শবর পৌ কিরাত সিংহল বর্বর খশ পুলিন্দ চীন হুন কেরল ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সৈন্য উৎপন্ন হয়ে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদলকে বধ না করেও পরাজিত করলে। বিশ্বামিত্র ক্রদ্ধ হয়ে বশিষ্ঠের প্রতি বিবিধ শর বর্ষণ করলেন, কিন্তু বশিষ্ঠ একটি বংশদণ্ড দিয়ে সমস্ত নিরস্ত করলেন। বিশ্বামিত্র নানাপ্রকার দিব্যাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করলেন কিন্তু বশিষ্ঠের ব্রহ্মশক্তিযুক্ত যষ্টিতে সমস্ত ভস্মীভূত হল। বিশ্বামিত্রের আত্মগ্লানি হল , তিনি বললেন,
ধিগবলং ক্ষত্রিয়বলং ব্রহ্মতেজোবলং বলম।
বলাবলং বিনিশ্চিতা তপ এব পবং বলম ॥
-ক্ষত্রিয় বলকে ধিক, ব্রহ্মতেজই বল। বলাবল দেখে আমি নিশ্চিত জেনেছি যে, তপস্যাই পরম বল।
তার পর বিশ্বামিত্র রাজ্য ত্যাগ করে তপস্যায় নিরত হলেন।
কল্মষপদ নামে এক ইক্ষাকুবংশীয় রাজা ছিলেন। একদিন তিনি মৃগয়ায় শ্রান্ত তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে চলছিলেন। সেই পথে বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ পুত্র শক্তিকে আসতে দেখে রাজা বললেন, আমার পথ থেকে সরে যাও। শক্তি বললেন, ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেওয়াই রাজার সনাতন ধর্ম। শক্তি কিছুতেই সরে গেলেন না দেখে রাজা তাকে কশাঘাত করলেন। শক্তি ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দিলেন, তুমি নরমাংসভোজী রাক্ষস হও। কল্মষপাদকে যজমান রূপে পাবার জন্য বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। অভিশপ্ত কল্মষপাদ যখন শক্তিকে প্রসন্ন। করবার চেষ্টা করছিলেন সেই সময়ে বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামে এক রাক্ষস রাজার শরীরে প্রবিষ্ট হল।
এক ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ বনমধ্যে রাজাকে দেখে তার কাছে মাংস ও অন্ন চাইলেন। রাজা তাকে অপেক্ষা করতে বলে স্বভবনে গেলেন এবং অর্ধরাত্রে তার প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে পাচককে সমাংস অন্ন নিয়ে যেতে আজ্ঞা দিলেন। পাচক জানালে যে মাংস নেই। রাক্ষসাবিষ্ট রাজা বললেন, তবে নরমাংস নিয়ে যাও। পাচক বধ্যভূমিতে গিয়ে নরমাংস নিলে এবং পাক করে অন্নের সহিত ব্রাহ্মণকে নিবেদন করলে। দিব্যদৃষ্টিশালী ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, যে নৃপাধম এই অভোজ্য পাঠিয়েছে সে নরমাংসভোজী হবে।
শক্তি এবং অরণ্যচারী ব্রাহ্মণ এই দুজনের শাপের ফলে রাক্ষসাবিষ্ট কল্মষপাদ কর্তব্যজ্ঞানশূন্য বিকৃতেন্দ্রিয় হলেন। একদিন তিনি শক্তিকে দেখে বললেন, তুমি যে শাপ দিয়েছ তার জন্য প্রথমেই তোমাকে খাব। এই বলে তিনি শক্ট্রিকে বধ করে ভক্ষণ করলেন। বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় কল্মষপাদ বশিষ্ঠের শতপুত্রের সকলকেই খেয়ে ফেললেন। পুত্রশোকাতুর বশিষ্ঠ বহু প্রকারে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যু হল না। তিনি নানা দেশ ভ্রমণ করে আশ্রমে ফিরে আসছিলেন এমন সময় পিছন থেকে বেদপাঠের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বশিষ্ঠ বললেন, কে আমার অনুসরণ করছে? এক নারী উত্তর দিলেন, আমি অদৃশ্যন্তী, শক্রির বিধবা পত্নী। আমার গর্ভে যে পুত্র আছে তার বার বৎসর বয়স হয়েছে, সেই বেদপাঠ করছে। তার বংশের সন্তান জীবিত আছে জেনে বশিষ্ঠ আনন্দিত হয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে আশ্রমের দিকে চললেন।
পথিমধ্যে কল্মষপাদ বশিষ্ঠকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে খেতে গেলেন। বশিষ্ঠ তাঁর ভীতা পুত্রবধূকে বললেন, ভয় নেই, ইনি কল্মষপাদ রাজা। এই বলে তিনি হুংকার করে কল্মষপাদকে থামিয়ে তার গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাকে শাপমুক্ত করলেন এবং বললেন, রাজা, তুমি ফিরে গিয়ে রাজ্যশাসন কর, কিন্তু আর কখনও ব্রাহ্মণের অপমান ক’রো না। কল্মষপাদ বললেন, আমি আপনার আজ্ঞাধীন হয়ে দ্বিজগণকে পূজা করব। এখন যাতে পিতৃ-ঋণ থেকে মুক্ত হ’তে পারি তার উপায় করুন, আমাকে একটি পুত্র দিন। বশিষ্ঠ বললেন, তাই দেব। তার পর তারা লোকবিখ্যাত অযোধ্যাপুরীতে ফিরে এলেন। বশিষ্ঠের সহিত সংগমের ফলে রাজমহিষী গর্ভবতী হলেন, বশিষ্ঠ তার আশ্রমে ফিরে গেলেন। দ্বাদশ বৎসরেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হল না দেখে মহিষী পাষাণখণ্ড দিয়ে তার উদর বিদীর্ণ করে পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্রের নাম অশ্মক, ইনি পৌদন্য নগর স্থাপন করেছিলেন।
বশিষ্ঠের পুত্রবধূ অদৃশ্যস্তীও একটি পুত্র প্রসব করলেন, তার নাম পরাশর। একদিন পরাশর বশিষ্ঠকে পিতা বলে সম্বোধন করলে অদৃশ্যন্তী সানয়নে বললেন, বৎস, পিতামহকে পিতা বলে ডেকো না, তোমার পিতাকে রাক্ষসে খেয়েছে। পরাশর ক্রুদ্ধ হয়ে সর্বলোক বিনাশের কংকল্প করলেন। তখন পৌত্রকে নিরস্ত করবার জন্য বশিষ্ঠ এই উপাখ্যান বললেন।
পুরাকালে কৃতবীর্য নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি তাঁর পুরোহিত ভৃগুবংশীয়গণকে প্রচুর ধনধান্য দান করতেন। তার মৃত্যুর পর তার বংশধর ক্ষত্রিয়দের অর্থাভাব হল , তারা ভার্গবদের কাছে প্রার্থী হয়ে এলেন। ভার্গবদের কেউ ভূগর্ভে ধন লুকিয়ে রাখলেন, কেউ ব্রাহ্মণদের দান করলেন, কেউ ক্ষত্রিয়গণকে দিলেন। একজন ক্ষত্রিয় ভার্গবদের গৃহ খনন করে ধন দেখতে পেলেন, তাতে সকলে ক্রুদ্ধ হয়ে ভার্গবগণকে বধ করলেন। ভার্গবনারীগণ ভয়ে হিমালয়ে আশ্রয় নিলেন, তাঁদের মধ্যে এক ব্রাহ্মণী তাঁর ঊরুদেশে গর্ভ গোপন করে রাখলেন। ক্ষত্রিয়রা জানতে পেরে সেই গর্ভ নষ্ট করতে এলেন, তখন সেই ব্রাহ্মণীর উরু ভেদ করে মধ্যাহ্নসূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান পুত্র প্রসূত হল তার তেজে ক্ষত্রিয়গণ অন্ধ হয়ে গেলেন। তারা অনুগ্রহ ভিক্ষা করলে ব্রাহ্মণী বললেন, তোমরা আমার ঊরুজাত পুত্র ঔর্বকে প্রসন্ন কর। ক্ষত্রিয়গণের প্রার্থনায় ঔর্ব তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। তার পর পিতৃগণের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ঘোর তপস্যা করতে লাগলেন। ঔর্বকে সর্বলোকবিনাশে উদ্যত দেখে পিতৃগণ এসে বললেন, বৎস, ক্রোধ সংবরণ কর। আমরা স্বর্গারোহণের জন্য উৎসুক ছিলাম, কিন্তু আত্মহত্যায় স্বর্গলাভ হয় না, সেজন্য স্বেচ্ছায় ক্ষত্রিয়দের হাতে মরেছি। আমরা ইচ্ছা করলেই ক্ষত্রিয়সংহার করতে পারতাম। তার পর পিতৃগণের অনুরোধে ঔর্ব তার ক্রোধাগ্নি সমুদ্রজলে নিক্ষেপ করলেন। সেই ক্রোধ ঘোটকীয় (১) মস্তকরূপে অগ্নি উদ্গার করে সমুদ্রজল পান করে।
বশিষ্ঠের কাছে এই উপাখ্যান শুনে পরাশর তাঁর ক্রোধ সংবরণ করলেন, কিন্তু তিনি রাক্ষসসত্র যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, তাতে আবালবৃদ্ধ সকল রাক্ষস দগ্ধ হ’তে লাগল। অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও মহাক্রতু রাক্ষসদের প্রাণরক্ষার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন। পুলস্ত্য (২) বললেন, বৎস, যারা তোমার পিতার মৃত্যুর বিষয় কিছুই জানে না সেই নির্দোষ রাক্ষসদের মেরে তোমার কি আনন্দ হচ্ছে? তুমি আমার বংশনাশ ক’রো না। শক্তি শাপ দিয়েই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিলেন। এখন তিনি তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে দেবলোকে সুখে আছেন। পুলস্ত্যের কথায় পরাশর তার যজ্ঞ শেষ করলেন।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, কল্মষপাদ কি কারণে তার মহিষীকে বশিষ্ঠের নিকট পুত্রোৎপাদনের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন? গন্ধর্বরাজ বললেন, রাজা কল্মষপাদ যখন রাক্ষসরূপে বনে বিচরণ করছিলেন তখন এক ব্রাহ্মণ ও তার পত্নীকে দেখতে পান। রাজা সেই ব্রাহ্মণকে খেয়ে ফেলেন, তাতে ব্রাহ্মণী শাপ দেন, স্ত্রীসংগম করলেই তোমার মৃত্যু হবে। যাঁকে তুমি পুত্রহীন করেছ সেই বশিষ্ঠই তোমার পত্নীতে সন্তান উৎপাদন করবেন। এই কারণেই কল্মষপাদ তার মহিষীকে বশিষ্ঠের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
অর্জুন বললেন, গন্ধর্ব, তোমার সবই জানা আছে, এখন আমাদের উপযুক্ত পুরোহিত কে আছেন তা বল। গন্ধর্বরাজ বললেন, দেবলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধৌম্য উৎকোচক তীর্থে তপস্যা করছেন, তাকেই পৌরোহিত্যে বরণ করতে পার। অর্জুন প্রীতমনে গন্ধর্বরাজকে আগ্নেয় অস্ত্র দান করে বললেন, অশ্বগুলি এখন তোমার কাছে থাকুক, আমরা প্রয়োজন হলেই নেব। তার পর তারা পরস্পরকে সম্মান দেখিয়ে নিজ নিজ অভীষ্ট স্থানে প্রস্থান করলেন। পাণ্ডবগণ ধৌম্যের আশ্রমে গিয়ে তাকে পৌরোহিত্যে বরণ করলেন এবং তার সঙ্গে পাঞ্চালীর স্বয়ংবরে যাবার ইচ্ছা করলেন।
**
(১) বড়বা।
(২) ইনি রাবণ প্রভৃতির পূর্বপুরুষ।
৷৷ স্বয়ংবরপর্বাধ্যায় ৷৷
৩২। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
পাণ্ডবগণ তাঁদের মাতাকে নিয়ে ব্রহ্মচারীর বেশে স্বয়ংবর দেখবার জন্য যাত্রা করলেন। পাঞ্চালযাত্রী বহু ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাদের পথে আলাপ হল। ব্রাহ্মণরা বললেন, তোমরা দেবতুল্য রূপবান, হয়তো দ্রুপদকন্যা কৃষ্ণা তোমাদের একজনকে বরণ করবেন। দ্রুপদের অধিকৃত দক্ষিণ পাঞ্চালে এসে পাণ্ডবরা ভার্গব নামক এক কুম্ভকারের অতিথি হলেন এবং ব্রাহ্মণের ন্যায় ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবিকানির্বাহ করতে লাগলেন।
দ্রুপদের ইচ্ছা ছিল যে অর্জুনকেই কন্যাদান করবেন। অর্জুনকে যাতে পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে তিনি এমন এক ধনু নির্মাণ করালেন যা নোয়ানো দুঃসাধ্য। তা ছাড়া তিনি শূন্যে একটি যন্ত্র স্থাপিত করে তার উপরে লক্ষ্য বস্তুটি রাখলেন। দ্রুপদ ঘোষণা করলেন, যিনি এই ধনুতে গুণ পরাতে পারবেন এবং যন্ত্র অতিক্রম করে শর দ্বারা লক্ষ্যভেদ করবেন তিনি আমার কন্যাকে পাবেন। এই ঘোষণা শুনে কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধনাদি এবং বহু দেশ থেকে রাজা ও ব্রাহ্মণরা স্বয়ংবর-সভায় এলেন। দ্রুপদ তাদের সেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। নগরের পূর্বোত্তর দিকে সমতলভূমিতে বিশাল সভা নির্মিত হল তার চতুর্দিক বাসভবন, প্রাচীর, পরিখা, দ্বার ও তোরণে শোভিত। বিচিত্র চন্দ্রাতপে আবৃত সভাস্থান চন্দনজল ও অগুরুধূপে সুবাসিত করা হল। আগন্তুক রাজারা কৈলাস-শিখরের ন্যায় উচ্চ শুভ্র প্রাসাদে পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা করে সুখে বাস করতে লাগলেন।
রাজারা অলংকার ও গন্ধদ্রব্যে ভূষিত হয়ে সভাস্থলে নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হলেন। নগরবাসী ও গ্রামবাসীরা দ্রৌপদীকে দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে মঞ্চের উপরে বসল, পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বসে পাঞ্চালরাজের ঐশ্বর্য দেখতে লাগলেন। অনেকদিন ধরে নৃত্য গীত ও ধনরত্নদান চলল। তার পর ষোড়শ দিনে দ্রৌপদী স্নান করে উত্তম বসন ও সর্বালংকারে ভূষিত হয়ে কাঞ্চনী মালা ধারণ করে সভায় অবতীর্ণ হলেন। দ্রুপদের কুলপুরোহিত যথানিয়মে হোম করে আহুতি দিলেন এবং স্বস্তিবাচন করিয়ে সমস্ত বাদ্য থামিয়ে দিলেন। সভা নিঃশব্দ হলে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভার মধ্যদেশে নিয়ে এলেন এবং মেঘগম্ভীর উচ্চস্বরে বললেন, সমবেত ভূপতিগণ, আমার কথা শুনুন। এই বাণ, ওই লক্ষ্য। ওই যন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে পাঁচটি বাণ চালিয়ে লক্ষ্য বিদ্ধ করতে হবে। উচ্চকুলজাত রূপবান ও বলবান যে ব্যক্তি এই দুরূহ কর্ম করতে পারবেন, আমার ভগিনী কৃষ্ণা তার ভার্যা হবেন—এ কথা আমি সত্য বলছি।
তার পর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভাস্থ রাজগণের পরিচয় দিলেন, যথা—দুর্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, কর্ণ, শকুনি, অশ্বত্থামা, ভোজরাজ, বিরাটরাজ, পৌণ্ড্রক বাসুদেব, ভগদত্ত, কলিঙ্গরাজ, মদ্ররাজ শল্য, বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন প্রভৃতি, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, শিশুপাল, জরাসন্ধ এবং আরও বহু রাজা।
কুণ্ডলধারী যুবক রাজারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বলতে লাগলেন, দ্রৌপদী আমারই হবেন। মত্ত গজেন্দ্র এবং ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায় পঞ্চ পাণ্ডবকে দেখে কৃষ্ণ চিনতে পারলেন এবং বলরামকে তাদের কথা বললেন। বলরামও তাদের দেখে আনন্দিত হলেন। অন্যান্য রাজা ও রাজপুত্রপৌত্রগণ দ্রৌপদীকে তদগতচিত্তে নিরীক্ষণ করছিলেন, তারা পাণ্ডবদের দেখতে পেলেন না। যুধিষ্ঠির ও তার ভ্রাতারা সকলেই দ্রৌপদীকে দেখে কন্দর্পণে আহত হলেন। অনন্তর রাজারা সদর্পে লক্ষ্যভেদ করতে অগ্রসর হলেন, কিন্তু তারা ধনুতে গুণ পরাতেও পারলেন না, ধনুর আঘাতে তারা ভূপতিত হলেন, তাদের কিরীট হার প্রভৃতি অলংকার ছড়িয়ে পড়ল।
তখন কর্ণ সেই ধনু তুলে নিয়ে তাতে গুণ পরিয়ে শরসন্ধান করলেন। পাণ্ডবগণ এবং আর সকলে স্থির করলেন, কর্ণ নিশ্চয় সিদ্ধিলাভ করবেন। কিন্তু কর্ণকে দেখে দ্রৌপদী উচ্চস্বরে বললেন, আমি সূতজাতীয়কে বরণ করব না। কর্ণ সূর্যের দিকে চেয়ে সক্রোধে হাস্য করে স্পন্দমান ধনু পরিত্যাগ করলেন।
তার পর দমঘোষের পুত্র চেদিরাজ শিশুপাল ধনুতে গুণ পরাতে গেলেন, কিন্তু না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। মহাবীর জরাসন্ধেরও ওই অবস্থা হল , তিনি উঠে নিজ রাজ্যে চ’লে গেলেন। মদ্ররাজ শল্যও অক্ষম হয়ে ভূপতিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকে অর্জুন উঠে দাঁড়ালেন। কেউ তাকে বারণ করলেন, কেউ বললেন, শল্য প্রভৃতি মহাবীর অস্ত্রজ্ঞ ক্ষত্রিয়রা যা পারলেন না একজন দুর্বল ব্রাহ্মণ তা কি করে পারবে। ব্রাহ্মণরা বললেন, ‘আমরা হাস্যাস্পদ হ’তে চাই না, রাজাদের বিদ্বেষের পাত্র হ’তেও চাই না। আর একজন বললেন, এই শ্রীমান যুবার গতি সিংহের তুল্য, বিক্রম নাগেন্দ্রের তুল্য, বোধ হচ্ছে এ কৃতকার্য হবে। ব্রাহ্মণের অসাধ্য কিছু নেই, তারা কেবল জল বা বায়ু বা ফল আহার করেও শক্তিমান।
ধনুর কাছে গিয়ে অর্জুন কিছুক্ষণ পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে রইলেন, তার পর ধনু প্রদক্ষিণ করে বরদাতা মহাদেবকে প্রণাম এবং কৃষ্ণকে স্মরণ করে ধনু তুলে নিলেন। তার পর তাতে অনায়াসে গুণ পরিয়ে পাঁচটি শর সন্ধান করে যন্ত্রের ছিদ্রের। মধ্য দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন। লক্ষ্য বিদ্ধ হয়ে ভূপতিত হল। অন্তরীক্ষে ও সভামধ্যে তুমুল কোলাহল উঠল, দেবতারা অর্জুনের মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন, সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ তাদের উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন, রাজারা লজ্জিত হয়ে হায় হায় বলতে লাগলেন, বাদ্যকারগণ তূর্যধ্বনি করলে, সূতমাগধগণ স্তুতিপাঠ করতে লাগল। দ্রুপদ অতিশয় আনন্দিত হলেন। সভায় কোলাহল বাড়তে লাগল, নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির তাদের বাসভবনে চ’লে গেলেন।
বিদ্ধ লক্ষ্যৎ প্ৰসমীক্ষা কৃষ্ণা
পার্থ শত্রুপ্রতিমং নিরীক্ষ্য।
স্বভ্য়স্তরূপাপি নবেব নিত্যং
বিনাপি হাসং হসতীব কন্যা।
মদাদৃতেহপি স্খলতীব ভাবে
বার্চা বিনা ব্যাহবতীৰ দৃষ্টা।
-লক্ষ্য বিদ্ধ হয়েছে দেখে এবং ইন্দ্রতুল্য পার্থকে নিরীক্ষণ করে কুমারী কৃষ্ণা হাস্য না করেও যেন হাসতে লাগলেন। বহুবার দৃষ্ট হলেও তার রূপ দর্শকদের কাছে নূতন বোধ হল। বিনা মত্ততার তিনি যেন ভাবাবেশে স্খলিত হ’তে লাগলেন, বিনা বাক্যে যেন দৃষ্টি দ্বারাই বলতে লাগলেন।
দ্রৌপদী স্মিতমুখে নিঃশঙ্কচিত্তে সেই সভাস্থিত নৃপতি ও ব্রাহ্মণগণের সমক্ষে অর্জুনের বক্ষে শুক্ল বরমাল্য লম্বিত করলেন। তার পর দ্বিজগণের প্রশংসাবাক্য শুনতে শুনতে অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সভা থেকে নির্গত হলেন।
৩৩। কর্ণ-শল্য ও ভীমার্জুনের যুদ্ধ-কুন্তী-সকাশে দ্রৌপদী
রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, আমাদের তৃণের ন্যায় অগ্রাহ্য করে পাঞ্চালরাজ একটা ব্রাহ্মণকে কন্যাদান করতে চান, আমরা দুরাত্মা দ্রুপদ আর তার পুত্রকে বধ করব। আমাদের আহ্বান করে এনে উত্তম অন্ন খাইয়ে পরিশেষে অপমান করা হয়েছে। স্বয়ংবর ক্ষত্রিয়ের জন্য, তাতে ব্রাহ্মণের অধিকার নেই। যদি এই কন্যা আমাদের কাকেও বরণ না করে তবে তাকে আগুনে ফেলে আমরা চ’লে যাব। লোভের বশে যে আমাদের অপ্রিয় কাজ করেছে সেই ব্রাহ্মণকে আমরা বধ করতে পারি না, দ্রুপদকেই বধ করব।
রাজারা আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছেন দেখে দ্রুপদ শান্তির কামনায় ব্রাহ্মণদের শরণাপন্ন হলেন। ভীম একটা গাছ উপড়ে নিয়ে অর্জুনের পাশে দাঁড়ালেন, অর্জুনও ধনুর্বাণ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। ব্রাহ্মণরা তাদের মৃগচর্ম আর করঙ্ক নেড়ে বললেন, ভয় পেয়ো না, আমরা যুদ্ধ করব। অর্জুন সহাস্যে বললেন, আপনারা দর্শক হয়ে এক পাশে থাকুন, আমি শত শত শরে এই ক্রুদ্ধ রাজাদের নিবৃত্ত করব। অনন্তর রাজারা এবং দুর্যোধনাদি ব্রাহ্মণদের দিকে ধাবিত হলেন, কর্ণ অর্জুনকে এবং শল্য ভীমকে আক্রমণ করলেন। অর্জুনের আশ্চর্য শরক্ষেপণ দেখে কর্ণ বললেন, বিপ্রশ্রেষ্ঠ, তুমি কি মূর্তিমান ধনুর্বেদ, না রাম, না বিষ্ণু? অর্জুন বললেন, আমি একজন ব্রাহ্মণ, গুরুর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছি। এই বলে অর্জুন কর্ণের ধনু ছেদন করলেন। কর্ণ অন্য ধনু নিলেন, তাও ছিন্ন হল। নিজের সকল অস্ত্র বিফল হওয়ায় কর্ণ ভাবলেন, ব্রহ্মতেজ অজেয়, তখন তিনি বাইরে চ’লে গেলেন। শল্য আর ভীম বহুক্ষণ মুষ্টি আর জানু দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন, অবশেষে ভীম শল্যকে তুলে ভূমিতে নিক্ষেপ করলেন। ব্রাহ্মণরা হেসে উঠলেন। রাজারা বললেন, এই দুই যোদ্ধা ব্রাহ্মণ বিশেষ প্রশংসার পাত্র, আমাদের যুদ্ধ থেকে বিরত হওয়াই উচিত। এঁদের পরিচয় পেলে পরে আবার সানন্দে যুদ্ধ করব। কৃষ্ণ সকলকে অনুনয় করে বললেন, এঁরা ধর্মানুসারেই দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। তখন রাজারা নিবৃত্ত হয়ে চ’লে গেলেন।
ভীম ও অর্জুন তাদের বাসস্থান কুম্ভকারের কর্মশালায় এসে আনন্দিত-মনে কুন্তীকে জানালেন যে, তারা ভিক্ষা এনেছেন। কুটীরের ভিতর থেকেই কুন্তী বললেন, তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর। তার পর দ্রৌপদীকে দেখে বললেন, আমি অন্যায় কথা বলে ফেলেছি। তিনি দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে বললেন, পুত্র, তোমার দুই ভ্রাতা দ্রুপদ রাজার এই কন্যাকে আমার কাছে এনেছে, আমি প্রমাদবশে বলেছি-সকলে মিলে ভোগ কর। যাতে এঁর পাপ না হয় তার উপায় বল। যুধিষ্ঠির একটু চিন্তা করে বললেন, অর্জুন, তুমি যাজ্ঞসেনীকে (১) জয় করেছ, তুমিই এঁকে যথাবিধি বিবাহ কর। অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমাকে অধৰ্মৰ্ভগী করবেন না, আগে আপনার, তার পর ভীমের তার পর আমার, তারপর নকুল-সহদেবের বিবাহ হবে। দ্রৌপদী সকলকেই দেখছিলেন, পাণ্ডবরাও পরস্পরের দিকে চেয়ে দ্রৌপদীর প্রতি আসক্ত হলেন। যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের মনোভাব বুঝলেন, তিনি ব্যাসের কথা স্মরণ করে এবং ভ্রাতাদের মধ্যে পাছে ভেদ হয় সেই ভয়ে বললেন, ইনি আমাদের সকলেরই ভার্যা হবেন।
এমন সময় কৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে এলেন এবং যুধিষ্ঠির ও পিতৃস্বসা কুন্তীর পাবন্দনা করে বললেন, আমি কৃষ্ণ, আমি বলরাম। কুশলপ্রশ্নের পর যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা এখানে গোপনে বাস করছি, বাসুদেব, তোমরা জানলে কি করে ? কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, মহারাজ, অগ্নি গুপ্ত থাকলেও প্রকাশ পায়, পাণ্ডব ভিন্ন অন্য কার এত বিক্রম? ভাগ্যক্রমে আপনারা জতুগৃহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ধৃতরাষ্ট্রের পাপী পুত্রদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি। আপনাদের সমৃদ্ধিলাভ হ’ক, আপনারা গোপনে থাকনেব। এই বলে কৃষ্ণ-বলরাম তাদের শিবিরে প্রস্থান করলেন।
ভীমার্জুন যখন দ্রৌপদীকে নিজেদের আবাসে নিয়ে আসছিলেন তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের পিছনে ছিলেন। কুম্ভকারের গৃহের চতুর্দিকে নিজের অনুচরদের রেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। সন্ধ্যাকালে কুন্তী ভিক্ষান্ন পাক করে দ্রৌপদীকে বললেন, ভদ্রে, তুমি আগে দেবতা ব্রাহ্মণ আর আগন্তুকদের অন্ন দাও, তারপর যা থাকবে তার। অর্ধ ভাগ ভীমকে দাও। অবশিষ্ট অংশ যুধিষ্ঠিরাদি চার ভ্রাতার, তোমার আর আমার জন্য ভাগ কর। দ্রৌপদী হুষ্টচিত্তে কুন্তীর আজ্ঞা পালন করলেন। পাণ্ডবদের ভোজনের পর সহদেব ভূমিতে কুশশয্যা পাতলেন, তার উপরে নিজ নিজ মৃগচর্ম বিছিয়ে পঞ্চ ভ্রাতা শুয়ে পড়লেন। কুন্তী তাঁদের মাথার দিকে এবং দ্রৌপদী পায়ের দিকে শুলেন। কুশশয্যায় এইরূপে পায়ের বালিশের মতন শুয়েও দ্রৌপদীর মনে দুঃখ বা পাণ্ডবদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব হল না। পাণ্ডবরা শুয়ে শুয়ে অস্ত্র রথ হস্তী প্রভৃতি সেনাবিষয়ক আলোচনা করতে লাগলেন। অন্তরাল থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন সমস্তই শুনলেন এবং ভগিনীকে দেখলেন। তিনি রাত্রিকালেই দ্রুপদকে সকল বৃত্তান্ত জানাবার জন্য সত্বর চ’লে গেলেন। এ বিষগ্ন দ্রুপদ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, কৃষ্ণা কোথায় গেল? কোনও হীনজাতি তাকে নিয়ে যায় নি তো? আমার মস্তকে কর্দমাক্ত চরণ কে রাখলে? পুষ্পমালা কি শ্মশানে পড়েছে? অর্জুনই কি লক্ষ্যভেদ করেছেন?
**
(১) দ্রুপদের এক নাম যজ্ঞসেন।
৷৷ বৈবাহিকপর্বাধ্যায় ৷৷
৩৪। দ্রুপদ-যুধিষ্ঠিরের বিতর্ক
ধৃষ্টদ্যুম্ন যা দেখেছিলেন আর শুনেছিলেন সমস্তই দ্রুপদকে জানিয়ে বললেন, সেই পঞ্চবীরের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তারা নিশ্চয় ক্ষত্রিয়। আমাদের আশা পূর্ণ হয়েছে, কারণ, শুনেছি পাণ্ডবরা অগ্নিদাহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দ্রুপদ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তার পুরোহিতকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পুরোহিত গিয়ে বললেন, রাজা পাণ্ডু দ্রুপদের প্রিয় সখা ছিলেন। দ্রুপদের ইচ্ছা তার কন্যা পাণ্ডুব পুত্রবধূ হন, অর্জুন তাকে ধর্মানুসারে লাভ করুন।
যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় ভীম পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে পুরোহিতকে সংবর্ধনা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, পাঞ্চালরাজ তার কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে জাতি কুল শীল গোত্র কিছুই নির্দেশ করেন নি। তার পণ অনুসারে এই বীর লক্ষ্যভেদ করে কৃষ্ণাকে জয় করেছেন। অনুতাপের কোনও কারণ নেই, তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এমন সময় দ্রুপদের একজন দূত এসে বললে, রাজা দ্রুপদ তার কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে বরপক্ষীয়গণকে ভোজন করাতে চান। অন্ন প্রস্তুত, কাঞ্চনপদ্মচিত্রিত উত্তম অশ্বযুক্ত রথও এনেছি, আপনারা কৃষ্ণাকে নিয়ে শীঘ্র চলুন।
পুরোহিতকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে পাণ্ডবগণ, কুন্তী ও দ্রৌপদী পাঞ্চাল-রাজভবনে এলেন। বরপক্ষের জাতি পরীক্ষার জন্য দ্রুপদ বিভিন্ন উপহার পৃথক পৃথক সাজিয়ে রেখেছিলেন, যথা—একস্থানে ফল ও মাল্য, অন্যত্র বর্ম চর্ম অস্ত্রাদি, অন্যত্র কৃষির যোগ্য গো রঞ্জু বীজ প্রভৃতি, অন্যত্র বিবিধ শিল্পকার্যের অস্ত্র এবং ক্রীড়ার উপকরণ। দ্রৌপদীকে নিয়ে কুন্তী অন্তঃপুরে গেলেন। সিংহবিক্রম বিশালবাহু মৃগচর্মধারী পাণ্ডবগণ জ্যেষ্ঠানুক্রমে পাদপীঠযুক্ত শ্রেষ্ঠ আসনে উপবিষ্ট হলেন, ঐশ্বর্য দেখে তারা বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। পরিষ্কৃত-বেশধারী দাসদাসী ও পাচকগণ, স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে অন্ন পরিবেশন করলে, পাণ্ডবগণ যথেচ্ছা ভোজন করে তৃপ্ত হলেন। তার পর তারা অন্যান্য উপহার-সামগ্রী অগ্রাহ্য করে যেখানে যুদ্ধোপকরণ ছিল সেখানে গেলেন। তা লক্ষ্য করে দ্রুপদ রাজা, তার পুত্র ও মন্ত্রিগণ নিঃসন্ধেহ হলেন যে এঁরা কুন্তীপুত্র।
যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, মহারাজ, নিশ্চিন্ত হন, আমরা ক্ষত্রিয়, পদ্মিনী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে যায় আপনার কন্যাও তেমন এক রাজগৃহ থেকে অন্য রাজগৃহে গেছেন। দ্রুপদ বললেন, আজ পুণ্যদিন, অর্জুন আজই যথাবিধি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, আমারও বিবাহ করতে হবে। দ্রুপদ বললেন, তবে আমার কন্যাকে তুমিই নাও, অথবা অন্য কাকে উপযুক্ত মনে কর তা বল। তখন যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী আমাদের সকলের মহিষী হবেন এই কথা আমার মাতা বলেছেন। আমাদের এই নিয়ম আছে, রত্ন পেলে একসঙ্গে ভোগ করব, এই নিয়ম ভঙ্গ করতে পারি না। দ্রুপদ বললেন, কুরুনন্দন, এক পুরুষের বহু স্ত্রী হ’তে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর বহু পতি শোনা যায় না। তুমি ধর্মজ্ঞ ও পবিত্রস্বভাব, এমন বেদবিরুদ্ধ লোক বিরুদ্ধ কার্যে তোমার মতি হল কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম, তার গতি আমরা বুঝি না, প্রাচীনদের পথই আমরা অনুসরণ করি। আমি অসত্য বলি, না, আমার মনও অধর্মে বিমুখ, আমার মাতা যা বলেছেন তাই আমার অভিপ্রেত।
দ্রুপদ, যুধিষ্ঠির, কুন্তী, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি সকলে মিলে বিবাহ সম্বন্ধে বিতর্ক করতে লাগলেন, এমন সময় ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন। সকল বৃত্তান্ত তাকে জানিয়ে দ্রুপদ বললেন, আমার মতে এক স্ত্রীর বহু পতি হওয়া লোকবিরুদ্ধ বেদবিরুদ্ধ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, সদাচারী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কি করে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভার্যায় উপগত হবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, পুরাণে শুনেছি গৌতমবংশীয়া জটিলা সাতজন ঋষির পত্নী ছিলেন; মুনিকন্যা বাক্ষরি দশ পতি ছিল, তাদের সকলেরই নাম প্রচেতা। মাতা সকল গুরুর শ্রেষ্ঠ, তিনি যখন বলেছেন তোমরা সকলে মিলে ভোগ কর, তখন তার আজ্ঞা পালন করাই ধর্ম। কুন্তী বললেন, যুধিষ্ঠিরের কথা সত্য, আমি মিথ্যাকে অত্যন্ত ভয় করি, কি করে মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব? ব্যাস বললেন, ভদ্রে, তুমি মিথ্যা থেকে মুক্তি পাবে। পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম, যদিও সকলের পক্ষে নয়। এই বলে ব্যাস দ্রুপদের হাত ধরে অন্য এক গৃহে গেলেন।
৩৫। ব্যাসের বিধান-দ্রৌপদীর বিবাহ
ব্যাস দ্রুপদকে এই উপাখ্যান বললেন। -পুরাকালে দেবতারা নৈমিষারণ্যে এক যজ্ঞ করেন, যম তার পুরোহিত ছিলেন। যম যজ্ঞে নিযুক্ত থাকায় মনুষ্যগণ মৃত্যুহীন হয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগল। দেবতারা উদবিগ্ন হয়ে ব্রহ্মার কাছে গেলে তিনি আশ্বাস দিলেন, যজ্ঞ শেষ হলে যম নিজ কার্যে মন দেবেন, তখন আবার মানুষের মরণ হবে। দেবতারা যজ্ঞস্থানে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে তারা গঙ্গার জলে একটি স্বর্ণপদ্ম দেখতে পেলেন। ইন্দ্র সেই পদ্ম নিতে গিয়ে দেখলেন, একটি অনলপ্রভা রমণী গঙ্গার গভীর জলে নেমে কঁদছেন, তার অশ্রুবিন্দু স্বর্ণপদ্ম হয়ে জলে পড়ছে। রোদনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে রমণী ইন্দ্রকে বললেন, আমার পিছনে পিছনে আসুন। কিছুদূর গিয়ে ইন্দ্র দেখলেন, হিমালয়শিখরে সিদ্ধাসনে বসে এক সুদর্শন যুবা এক যুবতীর সঙ্গে পাশা খেলছেন। তারা খেলায় মত্ত হয়ে তাকে গ্রাহ্য করছেন। না দেখে দেবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই বিশ্ব আমারই অধীন জেনো, আমিই এর ঈশ্বর। যুবা হাস্য করে ইন্দ্রের দিকে চাইলেন, ইন্দ্র স্থাণুর ন্যায় নিশ্চল হয়ে গেলেন। পাশা খেলা শেষ হলে সেই যুবা ইন্দ্রের সঙ্গিনীকে বললেন, ওকে নিয়ে এস, আমি ওর দর্প দূর করছি। সেই রমণীর স্পর্শমাত্র ইন্দ্র অবশ হয়ে ভূপতিত হলেন। তখন যুববরূপী মহাদেব বললেন, ইন্দ্র, আর কখনও দর্প প্রকাশ ক’রোনা। তুমি তো অসীম বলশালী, ওই পর্বতটি উঠিয়ে গহ্বরের ভিতরে গিয়ে দেখ। ইন্দ্র গহ্বরে প্রবেশ করে দেখলেন, তার তুল্য তেজস্বী চার জন পুরুষ সেখানে রয়েছেন। ইন্দ্রকে ভয়ে কম্পমান দেখে মহাদেব বললেন, গর্বের ফলে এরা এই গহ্বরে রয়েছে, তুমিও এখানে থাক। তোমরা সকলেই মনুষ্য হয়ে জন্মাবে এবং বহু শত্রু বধ করে আবার ইন্দ্রলোকে ফিরে আসবে।
তখন পূর্ববর্তী চার ইন্দ্র বললেন, ধর্ম বায়ু ইন্দ্র ও অশ্বিদ্বয় আমাদের মানুষীর গর্ভে উৎপাদন করবেন। বর্তমান ইন্দ্র বললেন, আমি নিজ বীর্যে একজন পুরুষ সৃষ্টি করে তাকেই পঞ্চম ইন্দ্ররূপে পাঠাব। মহাদেব তাতে সম্মত হলেন এবং সেই লোকবাঞ্ছিতা শ্রীরূপিণী রমণীকে মনুষ্যলোকে তাদের ভার্যা হবার জন্য আদেশ দিলেন। এই সময়ে নারায়ণ তার একটি কৃষ্ণ এবং একটি শুক্ল কেশ উৎপাটন করলেন। সেই দুই কেশ যদুকুলে গিয়ে দেবকী ও রোহিণীর গর্ভে প্রবিষ্ট হল। শুক্ল কেশ থেকে বলদেব এবং কৃষ্ণ কেশ থেকে কেশব উৎপন্ন হলেন।
এই উপাখ্যান শেষ করে ব্যাস দ্রুপদকে বললেন, মহারাজ, সেই পাঁচ ইন্দ্রই পাণ্ডবরূপে জন্মেছেন এবং তাদের ভার্যারূপে নির্দিষ্টা সেই লক্ষীরূপিণী রমণীই দ্রৌপদী হয়েছেন। আমি আপনাকে দিব্য চক্ষু দিচ্ছি, পাণ্ডবদের পূর্বমূর্তি দেখুন। দ্রুপদ দেখলেন, তারা অনল ও সূর্যতুল্য প্রভাবান দিব্যরূপধারী, তাদের বক্ষ বিশাল, দেহ দীর্ঘ, মস্তকে স্বর্ণকিরীট ও দিব্য মাল্য, দেবতার সর্বলক্ষণ তাদের দেহে বর্তমান। দ্রুপদ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে ব্যাসকে প্রণাম করলেন। তখন ব্যাস এক ঋষিকন্যার কথা (১) বললেন যাঁকে মহাদেব বর দিয়েছিলেন—তোমার পঞ্চপতি হবে। ব্যাস আরও বললেন, মানুষের পক্ষে এরূপ বিবাহ বিহিত নয়, কিন্তু এঁরা দেবতার অবতার, মহাদেবের ইচ্ছায় দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হবেন।
তার পর যুধিষ্ঠিরাদি স্নান ও মাঙ্গলিক কার্য শেষ করে বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে বিবাহ সভায় এলেন। যথানিয়মে অগ্নিতে আহুতি দেবার পর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করলেন। পরবর্তী চার দিনে একে একে অন্য ভ্রাতাদেরও বিবাহ সম্পন্ন হল। প্রত্যেক বার পুনর্বিবাহের পূর্বে ব্রহ্মর্ষি ব্যাস দ্রৌপদীকে এই অলৌকিক বাক্য বলতেন-তুমি আবার কুমারী হও।
পতিশ্বশুরতা (২) জ্যেষ্ঠে পতিদেবরতানুজে।
মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যস্ত্রিয়ং ত্রিতয়ং ত্ৰিষু ৷
-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পাঞ্চালীর পতি ও ভাশুর হলেন, কনিষ্ঠ সহদেব পতি ও দেবর হলেন, এবং মধ্যবর্তী তিন ভ্রাতা প্রত্যেকে পতি ভাশুর ও দেবর হলেন।
পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলন হওয়ায় দ্রুপদ সর্ববিধ ভয় থেকে মুক্তিলাভ করলেন। কুন্তী তার পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করলেন,
জীবসুরবীবসুভদ্রে বহুসৌখ্যসমন্বিতা।
সুভগা ভোগসম্পন্না যজ্ঞপত্নী পতিব্রতা।
পৃথিব্যাং যানি রত্নানি গুণবন্তি গুণান্বিতে।
তান্যাপুহি ত্ব কল্যাণি সুখিনী শবদ্যায়াং শতম।
যথা চ ত্বভিনন্দমি বধ্বদ্য ক্ষোমসংবৃতাম।
তথা ভূয়োভিনন্দীষ্যে জাতপুত্রাং গুণান্বিতাম।
– ভদ্রে, তুমি দীর্ঘজীবী বীরপুত্রের প্রসবিনী হও, বহু সুখ লাভ কর, সৌভাগ্যবতী ভোগসম্পন্ন এবং যজ্ঞে পতির সহধর্মিণী হও। গুণবতী কল্যাণী, পৃথিবীতে যেসকল গুণসম্পন্ন রত্ন আছে তা তুমি লাভ কর, শত বৎসর সুখে থাক।
পাণ্ডবদের বিবাহের সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ বহু মণিমুক্তা ও স্বর্ণাভরণ, মহার্ঘ বসন, সালংকারা দাসী, অশ্ব গজ প্রভৃতি উপহার পাঠালেন।
**
(১) ২৯-পরিচ্ছেদে আছে।
(২) এখানে শ্বশুর অর্থে ভ্রাতৃশ্বশুর বা ভাশুর।
৷৷ বিদুরাগমনপর্বাধ্যায়৷৷
৩৬। হস্তিনাপুরে বিতর্ক
পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন এবং দুর্যোধনাদি লজ্জিত ও ভগ্নদর্প হয়ে ফিরে এসেছেন জেনে বিদুর প্রীতমনে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, ভাগ্যক্রমে কুরুকুলের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন, দুর্যোধনই দ্রৌপদীকে পেয়েছেন। তিনি আনন্দিত হয়ে বললেন, কি সৌভাগ্য! এই বলে তিনি দুর্যোধনকে আজ্ঞা দিলেন, দ্রৌপদীর জন্য বহু অলংকার নির্মাণ করাও এবং তাঁকে নিয়ে এস। বিদুর প্রকৃত ঘটনা জানালে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যুধিষ্ঠিরাদি যেমন পাণ্ডুর প্রিয় ছিলেন তেমন আমারও প্রিয়। তারা কুশলে আছেন এবং শক্তিশালী মিত্র লাভ করেছেন এজন্য আমি তুষ্ট হয়েছি। বিদুর বললেন, মহারাজ, এই বুদ্ধিই আপনার চিরকাল থাকুক।
বিদুর চ’লে গেলে দুর্যোধন ও কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, শত্রুর উন্নতিকে আপনি স্বপক্ষের উন্নতি মনে করছেন। এখন আমাদের চেষ্টা করা উচিত যাতে পাণ্ডবদের শক্তিক্ষয় হয়, যেন তারা আমাদের গ্রাস করতে না পারে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমারও সেই ইচ্ছা, কিন্তু বিদুরের কাছে তা প্রকাশ করতে চাই না। তোমরা কি কর্তব্য মনে কর তা বল। দুর্যোধন বললেন, আমরা চতুর ও বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা পাণ্ডবদের মধ্যে ভেদ জন্মাব, দ্রুপদ রাজাকে বিস্তর অর্থ দিয়ে বলব তিনি যেন যুধিষ্ঠিরকে ত্যাগ করেন অথবা নিজ রাজ্যেই তাঁকে রাখেন। দ্রৌপদীর অনেক পতি, তাকে অন্য পুরুষে আসক্ত করাও সুসাধ্য। আমরা চতুর লোক দিয়ে ভীমকে হত্যা করাব, সে মরলে তার ভ্রাতাদের তেজ নষ্ট হবে।
কর্ণ বললেন, তুমি যেসব উপায় বললে তাতে কিছু হবে না। পূর্বে তুমি গুপ্ত উপায়ে পাণ্ডবদের নিগৃহীত করবার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু কৃতকার্য হওনি। তারা যখন অসহায় বালক ছিল এবং এখানেই বাস করত তখনই কিছু করতে পারনি। এখন তারা শক্তিমান হয়েছে, বিদেশে রয়েছে, কৌশলপ্রয়োগে তাদের নির্যাতিত করা অসম্ভব। তাদের মধ্যে ভেদ ঘটানোও অসাধ্য, যারা এক পত্নীতে আসক্ত তাদের ভিন্ন করা যায় না। দ্রুপদের বহু ধন আছে, ধনের লোভ দেখালে তিনি পাণ্ডবদের ত্যাগ করবেন না। আমার মত এই – পাঞ্চালরাজ যত দিন দুর্বল আছেন, পাণ্ডবরা যত দিন প্রচুর অশ্বরথাদি এবং মিত্র সংগ্রহ করতে না পারে, যে পর্যন্ত কৃষ্ণ যাদববাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের সাহায্যার্থে না আসেন, তার মধ্যেই তুমি বলপ্রয়োগ কর। আমরা বিপুল চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে দ্রুপদকে পরাজিত করে সত্বর পাণ্ডবদের এখানে নিয়ে আসব।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কর্ণ, তুমি যে বীরোচিত উপায় বললে তা তোমারই উপযুক্ত, কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এই বলে তিনি ভীষ্মদিকে ডেকে আনালেন। ভীষ্ম বললেন, পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার রুচিকর নয়, আমার কাছে ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু দুইই সমান। দুর্যোধন যেমন এই রাজ্যকে পৈতৃক মনে করে, পাণ্ডবরাও সেইরূপ মনে করে। অতএব অর্ধরাজ্য পাণ্ডবদের দাও। দুর্যোধন, তুমি কুরুকুলোচিত ধর্ম পালন কর। ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কুন্তী জীবিত আছেন। যেদিন শুনেছি তারা পুড়ে মরেছেন সেদিন থেকে আমি মুখ দেখাতে পারিনা। লোকে পুরোচনকে তত দোষী মনে করে না যত তোমাকে করে।
দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহাত্মা ভীষ্মের যে মত আমারও তাই। আপনি বহু ধনরত্ন দিয়ে দ্রুপদের কাছে লোক পাঠান, সে গিয়ে বার বার বলবে যে তার সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হওয়ায় আপনি আর দুর্যোধন অতিশয় প্রীত হয়েছেন। তার পর পাণ্ডবদের এখানে আনবার জন্য দুঃশাসন ও বিকর্ণ (১) সুসজ্জিত সৈন্যদল নিয়ে যান। পাণ্ডবরা এখানে এসে প্রজাদের সম্মতিক্রমে পৈতৃক পদে অধিষ্ঠিত হবেন এবং আপনি নিজের পুত্রের তুল্যই তাদের সমাদর করবেন।
কর্ণ বললেন, মহারাজ, যে ভীষ্ম-দ্রোণ আপনার কাছে ধন মান পেয়ে আসছেন এবং সর্ব কর্মে আপনার অন্তরঙ্গ, তারা আপনার হিতকর মন্ত্রণা দিলেন না এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি আছে। যদি আপনাদের ভাগ্যে রাজ্যভোগ থাকে তবে তার অন্যথা হবে না, যদি না থাকে তবে চেষ্টা করেও রাজ্য রাখতে পারবেন না। আপনি বুদ্ধিমান, আপনার মন্ত্রণাদাতারা সাধু কি অসাধু তা বুঝে দেখুন। দ্রোণ বললেন, কর্ণ, তুমি দুষ্টস্বভাব সেজন্য আমাদের দোষ দিচ্ছ। আমি হিতকর কথাই বলেছি, তার অন্যথা করলে কুরুকুল বিনষ্ট হবে।
বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনার বন্ধুরা হিতবাক্যই বলবেন, কিন্তু আপনি যদি শোনেন তবে বলা বৃথা। ভীষ্ম ও দ্রোণের চেয়ে বিজ্ঞ এবং আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ নেই এঁরা ধর্মজ্ঞ অপক্ষপাতী। বলপ্রয়োগে পাণ্ডবদের জয় করা অসম্ভব। বলরাম আর সাত্যকি (২) যাঁদের সহায়, কৃষ্ণ যাঁদের মন্ত্রণাদাতা, দ্রুপদ যাঁদের শ্বশুর এবং ধৃষ্টদ্যুম্নাদি শ্যালক, তারা যুদ্ধে কি না জয় করতে পারেন? আপনি দুর্যোধন কর্ণ আর শকুনির মতে চলবেন না, এরা অধার্মিক দুর্বুদ্ধি কাণ্ডজ্ঞানহীন।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ আর বিদুর হিতবাক্যই বলেছেন। যুধিষ্ঠিরাদি যেমন পাণ্ডুর পুত্র তেমন আমারও পুত্র। অতএব বিদুর, তুমি গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব কুন্তী আর দ্রৌপদীকে পরম সমাদরে এখানে নিয়ে এস।
বিদুর নানাবিধ ধনরত্ন উপহার নিয়ে দ্রুপদের কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন; তিনি, ভীষ্ম, এবং অন্যান্য কৌরব আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনার প্রিয়সখা দ্রোণ আপনাকে গাঢ় আলিঙ্গন জানিয়েছেন। এখন পঞ্চপাণ্ডবকে যাবার অনুমতি দিন। কুরুকুলের নারীগণ পাঞ্চালীকে দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে আছেন।
**
(১) দুর্যোধনের এক ভ্রাতা।
(২) যদুবংশের বীর বিশেষ।
৷৷ রাজ্যলাভপর্বাধ্যায়৷৷
৩৭। খাণ্ডবপ্রস্থ-সুন্দ-উপসুন্দ ও তিলোত্তমা
বিদুরের কথা শুনে দ্রুপদ বললেন, আপনার প্রস্তাব অতি সংগত, কিন্তু আমার কিছু বলা উচিত নয়। যদি যুধিষ্ঠিরাদি ইচ্ছা করেন এবং বলরাম ও কৃষ্ণ তাতে মত দেন তবে পাণ্ডবগণ অবশ্যই যাবেন। কৃষ্ণ বললেন, এঁদের যাওয়াই উচিত মনে করি, এখন ধর্মজ্ঞ দ্রুপদ যেমন আজ্ঞা করেন। দ্রুপদ বললেন, পুরুষোত্তম কৃষ্ণ যা কালোচিত মনে করেন আমিও তাই কর্তব্য মনে করি। অনন্তর পাণ্ডবগণ দ্রোণ, কৃপ, বিকর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে সুসজ্জিত হস্তিনাপুরে মহা আনন্দে প্রবেশ করলেন। দুর্যোধনের মহিষী এবং অন্যান্য বন্ধুগণ লক্ষীরূপিণী দ্রৌপদীকে অতি আদরের সহিত গ্রহণ করলেন। গান্ধারী তাকে আলিঙ্গন করেই মনে করলেন, এই পাঞ্চালীর জন্য আমার পুত্রদের মৃত্যু হবে। তার আদেশে বিদুর শুভনক্ষত্রযোগে কুন্তী ও দ্রৌপদীকে পাণ্ডুর ভবনে নিয়ে গেলেন এবং সর্ব বিষয়ে তাদের সাহায্য করতে লাগলেন। কিছুকাল পরে ভীষ্ণের সমক্ষে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তোমরা অর্ধ রাজ্য নাও এবং খাণ্ডবপ্রস্থে বাস কর, তা হলে আমাদের মধ্যে আর বিবাদ হবে না।
পাণ্ডবগণ সম্মত হলেন। তারা কৃষ্ণকে অগ্রবর্তী করে ঘোর বনপথ দিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে গেলেন এবং সেখানে বহু সৌধসমন্বিত পরিখা-প্রাকার-বেষ্টিত উপবন-সরোবরাদি-শোভিত স্বর্গধামতুল্য এক নগর (১) স্থাপন করলেন। পাণ্ডবদের সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বলরাম ও কৃষ্ণ দ্বারবতী (২) তে ফিরে গেলেন।
ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে সুখে বাস করতে লাগলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ তাঁদের কাছে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে নিজের রমণীয় আসনে বসিয়ে যথাবিধি অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। তাঁর আদেশে দ্রৌপদী বসনে দেহ আবৃত করে এলেন এবং নারদকে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নারদ তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, এখন যেতে পার। দ্রৌপদী চ’লে গেলে নারদ পাণ্ডবগণকে নিভৃতে বললেন, পাঞ্চালী একাই তোমাদের সকলের ধর্মপত্নী, এমন নিয়ম কর যাতে তোমাদের মধ্যে ভেদ না হয়। তার পর নারদ এই উপাখ্যান বললেন।
পুরাকালে মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশজাত দৈত্যরাজ নিকুম্ভের সুন্দ উপসুন্দ নামে দুই পরাক্রান্ত পুত্র জন্মেছিল। তারা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল এবং একযোগে সকল কার্য করত। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে ত্রিলোকবিজয়ের কামনায় তারা বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলে। দেবতারা ভয় পেয়ে নানাপ্রকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের তপোভঙ্গ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুন্দ-উপসুন্দ বিচলিত হল না। তার পর ব্রহ্মা বর দিতে এলে তারা বললে, আমরা যেন মায়াবিৎ অস্ত্রবিৎ বলবান কামরূপী এবং অমর হই। ব্রহ্মা বললেন, তোমরা ত্রিলোকবিজয়ের জন্য তপস্যা করছ, সে কারণে অমরত্বের বর দিতে পারি না। তখন তারা বললে, তবে এই বর দিন যে ত্রিলোকের স্থাবরজঙ্গম থেকে আমাদের কোনও ভয় থাকবে না, মৃত্যু যদি হয় তো পরস্পরের হাতেই হবে। ব্রহ্মা তাদের প্রার্থিত বর দিলেন। তারা দৈত্যপুরীতে গিয়ে বন্ধুবর্গের সঙ্গে ভোগবিলাসে মগ্ন হল এবং বহু বৎসর ধরে নানাপ্রকার উৎসব করতে লাগল। তার পর তারা বিপুল সৈন্যদল নিয়ে দেবলোক জয় করতে গেল। দেবগণ ব্রহ্মার বরের বিষয় জানতেন, সেজন্য স্বর্গ ত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে পালিয়ে গেলেন। সুন্দ-উপসুন্দ ইন্দ্রলোক এবং যক্ষ, রক্ষ, খেচর, পাতালবাসী নাগ, সমুদ্রতীরবাসী ম্লেচ্ছ প্রভৃতি সকলকেই জয় করলে এবং আশ্রমবাসী তপস্বীদের উপরেও অত্যাচার করতে লাগল।
দেবগণ ও মহর্ষিগণের প্রার্থনায় ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে আদেশ দিলেন, তুমি এমন এক প্রমদা সৃষ্টি কর যাকে সকলেই কামনা করে। বিশ্বকর্মা ত্রিলোকের স্থাবরজঙ্গম থেকে সর্বপ্রকার মনোহর উপাদান আহরণ করে এক অতুলনীয়া রূপবতী নারী সৃষ্টি করলেন। জগতের উত্তম বস্তু তিল তিল পরিমাণে মিলিত করে সৃষ্ট এজন্য ব্রহ্মা তার নাম দিলেন তিলোত্তমা। তিনি আদেশ দিলেন, তুমি সুন্দ-উপসুন্দকে প্রলুব্ধ কর। তিলোত্তমা যাবার পূর্বে দেবগণকে প্রদক্ষিণ করলে। ঘুরতে ঘুরতে তিলোত্তমা যে দিকে যায়, তাকে দেখবার জন্য সেই দিকেই ব্রহ্মার একটি মুখ নির্গত হল এইরূপে তিনি চতুর্মুখ হলেন। ইন্দ্রেরও সহস্র নয়ন হল। শিব স্থির হয়ে ছিলেন সেজন্য তাঁর নাম স্থাণু।
সুন্দ-উপসুন্দ বিন্ধ্যপর্বতের নিকট পুষ্পিত শালবনে সুরাপানে মত্ত হয়ে বিহার : করছিল এমন সময় মনোহর রক্তবসন পরে তিলোত্তমা সেখানে গেল। সুন্দ তার ডান হাত এবং উপসুন্দ বাঁ হাত ধরলে। ভ্রুকুটি করে সুন্দ বললে, এ আমার ভার্যা, তোমার গুরুস্থানীয়া। উপসুন্দ বললে, এ আমার ভার্যা, তোমার বধূস্থানীয়া। তার পর তারা গদা নিয়ে যুদ্ধ করে দুজনেই নিহত হল। দেবগণ ও মহর্ষিগণের সঙ্গে ব্রহ্মা সেখানে এসে তিলোত্তমাকে বললেন, সুন্দরী, তুমি আদিত্যলোকে বিচরণ করবে, তোমার তেজের জন্য কেউ তোমাকে ভাল করে দেখতে পারবে না।
উপাখ্যান শেষ করে নারদ বললেন, সর্ববিষয়ে মিলিত ও একমত হয়েও তিলোত্তমার জন্য দুই অসুর পরস্পরকে বধ করেছিল, অতএব তোমরা এমন উপায় কর যাতে দ্রৌপদীর জন্য তোমাদের বিচ্ছেদ না হয়। তখন পাণ্ডবগণ এই নিয়ম করলেন যে দ্রৌপদী এক একজনের গৃহে এক এক বৎসর বাস করবেন, সেই সময়ে অন্য কোনও ভ্রাতা যদি তাঁদের দেখেন তবে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বৎসর বনবাসে যেতে হবে।
**
(১) এই নগরকেই পরে ইন্দ্রপ্রস্থ বলা হয়েছে।
(২) দ্বারকা।
৷৷ অর্জুনবনবাসপর্বাধ্যায়৷৷
৩৮। অর্জুনের বনবাস-উলূপী, চিত্রাঙ্গদা ও বর্গা-বভ্রুবাহন
একদিন কয়েক জন ব্রাহ্মণ ইন্দ্রপ্রস্থে এসে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, নীচাশয় নৃশংস লোকে আমাদের গোধন হরণ করছে। যে রাজা শস্যাদির ষষ্ঠ ভাগ কর নেন অথচ প্রজাদের রক্ষা করেন না তাঁকে লোকে পাপাচারী বলে। ব্রাহ্মণের ধন চোরে নিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিকার কর। অর্জুন ব্রাহ্মণদের আশ্বাস দিয়ে অস্ত্র আনতে গেলেন, কিন্তু যে গৃহে অস্ত্র ছিল সেই গৃহেই তখন দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠির বাস করছিলেন। অর্জুন সমস্যায় পড়ে ভাবলেন, যদি ব্রাহ্মণের ধনরক্ষা না করি তবে রাজা যুধিষ্ঠিরের মহা অধর্ম হবে, আর যদি নিয়মভঙ্গ করে তার ঘরে যাই তবে আমাকে বনবাসে যেতে হবে। যাই হ’ক আমি ধর্ম পালন করব। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঘরে গেলেন এবং তার সম্মতিক্রমে ধনুর্বাণ নিয়ে ব্রাহ্মণদের কাছে এসে বললেন, শীঘ্র চলুন, চোরেরা দূরে যাবার আগেই তাদের ধরতে হবে।
অর্জুন রথারোহণে যাত্রা করে চোরদের শাস্তি দিয়ে গোধন উদ্ধার করে ব্রাহ্মণদের দিলেন এবং ফিরে এসে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, আজ্ঞা দিন, প্রায়শ্চিত্তের জন্য বনে যাব। যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে বললেন, তুমি আমার ঘরে এসেছিলে সেজন্য আমি অসন্তুষ্ট হইনি, জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠ এলে দোষ হয় না, তার বিপরীত হলেই দোষ হয়। অর্জুন বললেন, আপনার মুখেই শুনেছি—ধর্মাচরণে ছল করবে না। আমি আয়ুধ স্পর্শ করে বলছি, সত্য থেকে বিচলিত হব না। তার পর যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা নিয়ে অর্জুন বারো বৎসরের জন্য বনে গেলেন, অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভিক্ষু পুরাণপাঠক প্রভৃতিও তার অনুগমন করলেন।
বহু দেশ ভ্রমণ করে অর্জুন গঙ্গাদ্বারে এসে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তিনি স্নানের জন্য গঙ্গায় নামলে নাগরাজকন্যা উলূপী তাকে টেনে নিয়ে গেলেন। অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে উলূপী বললেন, আমি ঐরাবত-কুলজাত কৌরব্য নামক নাগের কন্যা, আপনি আমাকে ভজনা করুন। আপনার ব্রহ্মচর্যের যে নিয়ম আছে তা কেবল দ্রৌপদীর সম্বন্ধে। আমার অনুরোধ রাখলে আপনার ধর্ম নষ্ট হবে না, কিন্তু আমার প্রাণরক্ষা হবে। অর্জুন উলূপীর প্রার্থনা পূরণ করলেন। উলূপী তাকে বর দিলেন, আপনি জলে অজেয় হবেন, সকল জলচর আপনার বশ হবে। (১)
উলূপীর কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নানা তীর্থ পর্যটন করলেন, তার পর মহেন্দ্র পর্বত দেখে সমুদ্রতীর দিয়ে মণিপুরে এলেন। সেখানকার রাজা চিত্ৰবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন তাঁর পাণিপ্রার্থী হলেন। রাজা অর্জুনের পরিচয় নিয়ে বললেন, আমাদের বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পুত্রের জন্য তপস্যা করলে মহাদেব তাকে বর দিলেন, তোমার বংশে প্রতি পুরুষের একটিমাত্র সন্তান হবে। আমার পূর্বপুরুষদের পুত্রই হয়েছিল, কিন্তু আমার কন্যা হয়েছে, তাকেই আমি পুত্র গণ্য করি। তার গর্ভজাত পুত্র আমার বংশধর হবে—এই প্রতিজ্ঞা যদি কর তবে আমার কন্যাকে বিবাহ করতে পার। অর্জুন সেইরূপ প্রতিজ্ঞা করে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন এবং মণিপুরে তিন বৎসর বাস করলেন। তার পর পুত্র হলে। চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন করে পুনর্বার ভ্রমণ করতে গেলেন।
অর্জুন দেখলেন, অগস্ত্য সৌভদ্র পৌলম কারন্ধম ও ভরদ্বাজ এই পঞ্চতীর্থ তপস্বিগণ বর্জন করেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করে তিনি জানলেন যে এইসকল তীর্থে পাঁচটি কুম্ভীর আছে, তারা মানুষকে টেনে নেয়। তপস্বীদের বারণ না শুনে অর্জুন সৌভদ্র তীর্থে স্নান করতে নামলেন। এক বৃহৎ জলজন্তু তার পা ধরলে। অর্জুন তাকে সবলে উপরে তুলে আনলে সেই প্রাণী সালংকারা সুন্দরী নারী হয়ে গেল। সে বললে, আমি অপ্সরা বর্গা, কুবেরের প্রিয়া। আমি চার সখীর সঙ্গে ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলাম, ফেরবার সময় আমরা দেখলাম এক রূপবান ব্রাহ্মণ নির্জন স্থানে বেদাধ্যয়ন করছেন। আমরা তাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করলে তিনি শাপ দিলেন, তোমরা কুম্ভীর হয়ে শতবর্ষ জলে বাস করবে। আমরা অনুনয় করলে তিনি বললেন, কোনও পুরুষশ্রেষ্ঠ যদি তোমাদের জল থেকে তোলেন তবে নিজ রূপ ফিরে পাবে। পরে নারদ আমাদের দুঃখের কথা শুনে বললেন, তোমরা দক্ষিণ সাগরের তীরে পঞ্চতীর্থে যাও, অর্জুন তোমাদের উদ্ধার করবেন। সেই অবধি আমরা এখানে আছি। আমাকে যেমন মুক্ত করেছেন সেইরূপ আমার সখীদেরও করুন। অর্জুন অন্য চার অপ্সরাকে শাপমুক্ত করলেন।
সেখান থেকে অর্জুন পুনর্বার মণিপুরে গেলেন এবং রাজা চিত্ৰবাহনকে বললেন, আমার পুত্র বভ্রুবাহনকে আপনি নিন। তিনি চিত্রাঙ্গদাকে বললেন, তুমি এখানে থেকে পুত্রকে পালন কর, পরে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে আমার মাতা ভ্রাতা প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দলাভ করবে। যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করবেন তখন তোমার পিতার সঙ্গে যেয়ো। সুন্দরী, আমার বিরহে দুঃখ ক’রো না।
তার পর অর্জুন পশ্চিম সমুদ্রের তীরবর্তী সকল তীর্থ দেখে প্রভাসে এলেন। সেই সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ সেখানে এসে অর্জুনকে রৈবতক পর্বতে নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণের আদেশে সেই স্থান পূর্বেই সুসজ্জিত করা হয়েছিল এবং সেখানে বিবিধ খাদ্য ও নৃত্যগীতাদির আয়োজন ছিল। অর্জুন সেখানে সুখে বিশ্রাম করে স্বর্ণময় রথে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। শত সহস্র দ্বারকাবাসী স্ত্রী পুরুষ তাকে দেখবার জন্য রাজপথে এল। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক (২) বংশীয় কুমারগণ মহা সমাদরে তাঁর সংবর্ধনা করলেন।
**
(১) ১৪-পরিচ্ছেদে ইরাবান সম্বন্ধে পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
(২) যদুবংশের বিভিন্ন শাখা।
৷৷ সুভদ্রাহরণপর্বাধ্যায়৷৷
৩৯। রৈবতক-সুভদ্রাহরণ-অভিমন্যু-দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র
কিছুদিন পরে রৈবতক পর্বতে বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়দের মহোৎসব আরম্ভ হল। বহু সহস্র নগরবাসী পত্নী ও অনুচরদের সঙ্গে পদব্রজে ও বিবিধ যানে সেখানে এল। হলধর মত্ত হয়ে তার পত্নী রেবতীর সঙ্গে বিচরণ করতে লাগলেন। প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, অঙ্কুর, সারণ, সাত্যকি প্রভৃতিও স্ত্রীদের নিয়ে এলেন। বাসুদেবের সঙ্গে অর্জুন। নানাপ্রকার বিচিত্র কৌতুক দেখে বেড়াতে লাগলেন।
একদিন অর্জুন বসুদেবকন্যা সালংকারা সুদর্শনা সুভদ্রাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে সাহাস্যে বললেন, বনবাসীর মন কামে আলোড়িত হল কেন? ইনি আমার ভগিনী সুভদ্রা, সারণের সহোদরা, আমার পিতার প্রিয়কন্যা। যদি চাও তো আমি নিজেই পিতাকে বলব। অর্জুন বললেন, তোমার এই ভগিনী যদি আমার ভার্যা হন তবে আমি কৃতার্থ হব; কিন্তু এঁকে পাবার উপায় কি? কৃষ্ণ বললেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে স্বয়ংবর বিহিত, কিন্তু স্ত্রীস্বভাব অনিশ্চিত, কাকে বরণ করবে কে জানে। তুমি আমার ভগিনীকে সবলে হরণ কর, ধর্মজ্ঞগণ বলেন এরূপ বিবাহ বীরগণের পক্ষে প্রশস্ত। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের সম্মতি আনালেন।
অর্জুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে কাঞ্চনময় রথে মৃগয়াচ্ছলে যাত্রা করলেন। সুভদ্রা পূজা শেষ করে রৈবতক পর্বত প্রদক্ষিণ করে দ্বারকায় ফিরছিলেন, অর্জুন তাঁকে। সবলে রথে তুলে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে চললেন। কয়েকজন সৈনিক এই ব্যাপার দেখে কোলাহল করতে করতে সুধর্মা নামক মন্ত্রণাসভায় এসে সভাপালকে জানালে, সভাপাল যুদ্ধসজ্জার জন্য মহাভেরী বাজাতে লাগলেন। সেই শব্দ শুনে যাদবগণ পানভোজন ত্যাগ করে সভায় এসে মন্ত্রণা করলেন এবং অর্জুনের আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য উদ্গ্রীব হলেন।
সুরাপানে মত্ত বলরাম সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর পরিধানে নীল বসন, কণ্ঠে বনমালা। তিনি বললেন, ওহে নির্বোধগণ, কৃষ্ণের মত না জেনেই তোমরা গর্জন করছ কেন? তিনি কি বলেন আগে শোন তার পর যা হয় ক’রো। তার পর তিনি কৃষ্ণকে বললেন, তুমি নির্বাক হয়ে রয়েছ কেন? তোমার জন্যই আমরা অর্জুনকে সম্মান করেছি, কিন্তু সেই কুলাঙ্গার তার যোগ্য নয়। যার সকুলে জন্ম সে অনুগ্রহণ করে ভোজনপাত্র ভাঙে না। সুভদ্রাকে হরণ করে সে আমাদের মাথায় পা দিয়েছে, এই অন্যায় আমি সইব না, আমি একাই পৃথিবী থেকে কুরুকুল লুপ্ত করব। সভাস্থ সকলেই বলরামের কথার অনুমোদন করলেন। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন যা করেছেন তাতে আমাদের বংশের অপমান হয় নি, বরং মানবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা ধনের লোভে কন্যা বিক্রয় করব এমন কথা তিনি ভাবেন নি, স্বয়ংবরেও তিনি সম্মত নন, এই কারণেই তিনি ক্ষত্রধর্ম অনুসারে কন্যা হরণ করেছেন। অর্জুন ভরত-শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছেন, তিনি যুদ্ধে অজেয়, এমন সুপাত্র কে চায়? আপনারা শীঘ্র গিয়ে মিষ্টবাক্যে তাকে ফিরিয়ে আনুন, এই আমার মত। তিনি যদি আপনাদের পরাজিত করে স্বভবনে চ’লে যান তবে আপনাদের যশ নষ্ট হবে, কিন্তু মিষ্ট কথায় ফিরিয়ে আনলে তা হবে না। আমাদের পিতৃম্বসার পুত্র হয়ে তিনি শত্রুতা করবেন না।
যাদবগণ কৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে অর্জুনকে ফিরিয়ে আনলেন, তিনি সুভদ্রাকে বিবাহ করে এক বৎসর দ্বারকায় রইলেন, তার পর বনবাসের অবশিষ্ট কাল পুষ্করতীর্থে যাপন করলেন। বার বৎসর পূর্ণ হলে অর্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন। দ্রৌপদী তাকে বললেন, কৌন্তেয়, তুমি সুভদ্রার কাছেই যাও, পুনর্বার বন্ধন করলে পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। অর্জুন বার বার ক্ষমা চেয়ে দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিলেন এবং সুভদ্রাকে রক্ত কৌষেয় বসন পরিয়ে গোপবধূর বেশে কুন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কুন্তী পরম প্রীতির সহিত তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। সুভদ্রা দ্রৌপদীকে প্রণাম করে বললেন, আমি আপনার দাসী। দ্রৌপদী তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, তোমার স্বামীর যেন শত্রু না থাকে।
সৈন্যদলে বেষ্টিত হয়ে যদুবীরগণের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরাম নানাবিধ মহার্ঘ যৌতুক নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন। অনেক দিন আনন্দে যাপন করে সকলে ফিরে গেলেন, কেবল কৃষ্ণ রইলেন। তিনি যমুনাতীরে অর্জুনের সঙ্গে মৃগয়া করে মৃগ-বরাহ মারতে লাগলেন।
কিছুকাল পরে সুভদ্রা একটি পুত্র প্রসব করলেন। নির্ভিক ও মনমান (ক্রোধী বা তেজস্বী) সেজন্য তাঁর নাম অভিমন্যু হল। জন্মকাল থেকেই কৃষ্ণ এই বালকের সমস্ত শুভকার্য সম্পন্ন করলেন। অর্জুন দেখলেন, অভিমন্যু শৌর্যে বীর্যে কৃষ্ণেরই তুল্য। দ্রৌপদীও যুধিষ্ঠির ভীমাদির ঔরসে পাঁচটি বীর পুত্র লাভ করলেন, তাঁদের নাম যথাক্রমে প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন।।
৷৷ খাণ্ডবদাহপর্বাধ্যায়৷৷
৪০। অগ্নির অগ্নিমান্দ্য-খাণ্ডবদাহ-ময় দানব
একদিন কৃষ্ণ ও অর্জুন তাদের সুহৃবর্গ ও নারীগণকে নিয়ে যমুনায় জলবিহার করতে গেলেন। তারা যমুনার তীরবর্তী বহুপ্রাণিসমাকুল মনোহর খাণ্ডব বন দেখে বিহারস্থানে এলেন এবং সেখানে সকলে পান ভোজন নৃত্য গীত ও বিবিধ ক্রীড়ায় রত হলেন। তার পর কৃষ্ণ ও অর্জুন নিকটস্থ এক মনোরম স্থানে গিয়ে মহার্ঘ আসনে বসে নানা বিষয় আলোচনা করতে লাগলেন। এমন সময়ে সেখানে এক ব্রাহ্মণ এলেন, তার দেহ বিশাল, বর্ণ তপ্তকাঞ্চনতুল্য, শ্মশ্রু পিঙ্গলবর্ণ, মস্তকে জটা, পরিধানে চীরবাস। তিনি বললেন, আমি বহুভোজী ব্রাহ্মণ : কৃষ্ণার্জুন, তোমরা একবার আমাকে প্রচুর ভোজন করিয়ে তৃপ্ত কর। আমি অগ্নি, অন্ন চাই না, এই খাণ্ডব বন দগ্ধ করতে ইচ্ছা করি। তক্ষক নাগ সপরিবারে এখানে তাকে, তার সখা ইন্দ্র এই বন রক্ষা করেন সেজন্য আমি দগ্ধ করতে পারি না। তোমরা উত্তম অস্ত্রবিৎ, তোমরা সহায় হলে আমি খাণ্ডবদাহ করব, এই ভোজনই আমি চাই।
এই সময়ে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে এই পূর্ব-ইতিবৃত্ত বললেন।—শ্বেতকি নামে এক রাজা নিরন্তর যজ্ঞ করতেন। তার পুরোহিতদের চক্ষু ধূমে পীড়িত হওয়ায়। তারা আর যজ্ঞ করতে চাইলেন না। তখন রাজা মহাদেবের তপস্যা করতে লাগলেন। মহাদেব বর দিতে এলে শ্বেতকি বললেন, আপনি আমার যজ্ঞে পৌরোহিত্য করুন। মহাদেব হাস্য করে বললেন, আমি তা পারি না। পরিশেষে মহাদেবের আজ্ঞায় দুর্বাসা শ্বেতকির যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। সেই যজ্ঞে অগ্নিদেব বার বৎসর ঘৃতপান। করেছিলেন, তার ফলে তার অরুচি রোগ হল। তিনি প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার কাছে গেলে ব্রহ্মা সহাস্যে বললেন, তুমি খাণ্ডববন দগ্ধ করে সেখানকার প্রাণীদের মেদ ভক্ষণ কর, তা হলেই প্রকৃতিস্থ হবে। অগ্নি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে গেলেন, কিন্তু শতসহস্র হস্তী শুণ্ড দ্বারা এবং বহুশীর্ষ নাগগণ মস্তক দ্বারা জলসেচন করে অগ্নি নির্বাপিত করলে। সাত বার চেষ্টা করে বিফল হয়ে অগ্নিদেব আবার ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, নর ও নারায়ণ ঋষি অর্জুন ও কৃষ্ণরূপে জন্মেছেন এবং এখন খাণ্ডববনেই আছেন, তারা তোমার সহায় হলে দেবতারাও বাধা দিতে পারবেন না।
অর্জুন অগ্নিকে বললেন, ভগবান, আমার কাছে দিব্য বাণ অনেক আছে কিন্তু তার উপযুক্ত ধনু এখন সঙ্গে নেই, কৃষ্ণও নিরস্ত্র। আপনি এমন উপায় বলুন যাতে ইন্দ্র বর্ষণ করলে আমি তাকে নিবারণ করতে পারি। তখন অগ্নিদেব লোকপাল বরুণকে স্মরণ করলেন এবং বরুণ উপস্থিত হলে তার কাছ থেকে চন্দ্রপ্রদত্ত গাণ্ডীব (১) ধনু, দুই অক্ষয় তৃণীর, এবং কপিধ্বজ রথ চেয়ে নিয়ে অর্জুনকে দিলেন এবং কৃষ্ণকে একটি চক্র ও কৌমোদকী নামক গদা দিলেন। কৃষ্ণার্জুন দুই রথে আরোহণ করলে অগ্নি খাণ্ডববন দগ্ধ করতে লাগলেন। পশু পক্ষী চিৎকার করে পালাতে গেল, কিন্তু অর্জুনের বাণে বিদ্ধ হয়ে অগ্নিতে পড়ল, কোনও প্রাণী নিস্তার পেলে না। অগ্নির আকাশস্পর্শী শিখা দেখে দেবতারা উদবিগ্ন হলেন। ইন্দ্রের আদেশে মেঘ থেকে সহস্রধারায় জলবর্ষণ হ’তে লাগল, কিন্তু অগ্নির তেজে তা আকাশেই শুখিয়ে গেল। এই সময়ে নাগরাজ তক্ষক কুরুক্ষেত্রে ছিলেন। তক্ষকপত্নী তার পুত্র অশ্বসেনকে গিলে ফেলে বাইরে আসবার চেষ্টা করলে অর্জুন তাঁর শিরচ্ছেদন করলেন। তখন। ইন্দ্র বায়ু বর্ষণ করে অর্জুনকে মোহগ্রস্ত করলেন, সেই সুযোগে অশ্বসেন মুক্ত হল। অগ্নি কৃষ্ণ ও অর্জুন তাকে শাপ দিলেন, তুমি নিরাশ্রয় হবে। ইন্দ্র তাকে বঞ্চিত করেছেন এই কারণে অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শরজালে আকাশ আচ্ছন্ন করলেন। ইন্দ্র ও অর্জুনের তুমুল যুদ্ধ হ’তে লাগল। অসুর গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষস প্রভৃতি কৃষ্ণার্জুনকে হারাবার জন্য উপস্থিত হল , কিন্তু অর্জুনের শরাঘাতে এবং কৃষ্ণের চক্রে আহত হয়ে সকলেই বিতাড়িত হল। ইন্দ্র বজ্র নিয়ে এবং অন্যান্য দেবগণ নিজ নিজ অস্ত্র আক্রমণ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণার্জুনের অস্ত্রাঘাতে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হল। অবশেষে ইন্দ্র মন্দর পর্বতের একটি বিশাল শৃঙ্গ উৎপাটিত করে অর্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনের বাণে পর্বতশৃঙ্গ সহস্রখণ্ড হয়ে খাণ্ডববনে পড়ল, অসংখ্য প্রাণী নিহত হল।
দেবগণের পরাজয় দেখে ইন্দ্র আনন্দিত হয়ে কৃষ্ণার্জুনের প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন মহাগম্ভীরশব্দে এই অশরীরিণী দৈববাণী হল বাসব, তোমার সখা তক্ষক দগ্ধ হননি, তিনি কুরুক্ষেত্রে আছেন। অর্জুন আর বাসুদেবকে কেউ যুদ্ধে জয় করতে পারে না, তারা পূর্বে নর-নারায়ণ নামক দেবতা ছিলেন। দৈববাণী শুনে ইন্দ্রাদি দেবগণ সুরলোকে চ’লে গেলেন, অগ্নি অবাধে খাণ্ডববন দগ্ধ করে প্রাণিগণের মাংস রুধির রসা খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। এই সময়ে ময় নামক এক অসুর তক্ষকের আবাস থেকে বেগে পালাচ্ছে দেখে অগ্নি তাকে খেতে চাইলেন। কৃষ্ণ তাকে মারবার জন্য চক্র উদ্যত করলেন, কিন্তু ময়ের কাতর প্রার্থনায় এবং অর্জুনের অনুরোধে নিরস্ত হলেন। অগ্নি পনের দিন ধরে খাণ্ডববন দগ্ধ করলেন। তক্ষকপুত্র অশ্বসেন, নমুচির ভ্রাতা ময় দানব এবং চারটি শাঙর্গক পক্ষী, এই ছটি প্রাণী ছাড়া কেউ জীবিত রইল না।
মন্দপাল নামে এক তপস্বীর সন্তান ছিল না। তিনি মৃত্যুর পর পিতলোকে স্থান পেলেন না, দেবগণ তাঁকে বললেন, আপনার পিতৃঋণ শোধ হয়নি, আপনি পুত্র উৎপাদন করে তবে এখানে আসুন। শীঘ্র বহু সন্তান লাভের জন্য মন্দপাল শাঙর্গক পক্ষী হয়ে জারিতা নাম্নী শাঙর্গিকার সঙ্গে সংগত হলেন। জারিতার গর্ভে চারটি ব্রহ্মবাদী পুত্র উৎপন্ন হল। খাণ্ডবদাহের সময় তারা ডিম্বের মধ্যেই ছিল, মন্দপালের প্রার্থনায় অগ্নি তাদের মারলেন না। মন্দপাল তার চার পুত্রকে নিয়ে জারিতার সঙ্গে অন্যত্র চ’লে গেলেন।
অনন্তর ইন্দ্র দেবগণের সঙ্গে এসে কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, তোমাদের আশ্চর্য কর্ম দেখে আমি প্রীত হয়েছি, বর চাও। অর্জুন ইন্দ্রের সমস্ত অস্ত্র চাইলেন। ইন্দ্র বললেন, মহাদেব যখন তোমার উপর প্রসন্ন হবেন তখন তোমাকে সকল অস্ত্র দেব। কৃষ্ণ বর চাইলেন, অর্জুনের সঙ্গে যেন তার চিরস্থায়ী প্রীতি হয়। ইন্দ্র বর দিয়ে সদলে চ’লে গেলেন। অগ্নি কৃষ্ণার্জুনকে বললেন, আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি, এখন তোমরা যেখানে ইচ্ছা যেতে পার। তখন কৃষ্ণ অর্জুন ও ময় দানব তিনজনে রমণীয় নদীকূলে গিয়ে উপবেশন করলেন।
** (১) টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেন, গাণ্ডী বা গণ্ডারের পৃষ্ঠবংশ (মেরুদণ্ড) দিয়ে প্রস্তুত। সেজন্য গাণ্ডীব নাম।