০১. আতাহারের পরনে পাঞ্জাবি

[সিলেটের মীরাবাজারের পুরানো শ্যাওলা ধরা দালানের একটা ঘর। মধ্যরাত্রি। পাঁচ-ছ বছর বয়েসী একটি শিশু বাবা-মার পাশে ঘুমুচ্ছে। বাইরে উথালি পাথাল জোছনা। সেই জোছনা বাড়ির ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে, পড়েছে শিশুটির মশারির ছাদে। মনে হচ্ছে আলোর ফুল ফুটে আছে। হঠাৎ শিশুটির ঘুম ভেঙে গেল। সে বিস্ময় এবং ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল জোছনার ফুলের দিকে। এক সময় বাবাকে ডেকে তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এটা কি? শিশুর বাবা ফুলের রহস্য ব্যাখ্যা করলেন–ভেল্টিলেটারে ফুলের নকশাকাটা। হয়ে মশারির ছাদে পড়েছে। ভয়ের কিছু নেই। শিশুর ভয় তারপরেও যায় না। তখন বাবা বললেন, হাত দিয়ে ফুলটা ধর, ভয় কেটে যাবে। শিশুটি সেই ফুল হাত দিয়ে ধরতে গেল। যতবারই ধরতে যায় ততবারই ফুল হাত গলে বের হয়ে যায়।
কবি–জোছনার ফুল ধরার গল্প। মহান বোধকে স্পর্শ করার আকাংক্ষার গল্প। জীবনকে দেখা এবং না দেখার গল্প।]

কবি উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলি আমার লেখা। পাঠক ক্ষমা সুন্দর চোখে গ্ৰহণ করেছেন। কবিতাগুলিও করবেন–এই অসম্ভব আশা নিয়ে বসে আছি। ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার অভ্যাস গেছে। খারাপ হয়ে
–হুমায়ূন আহমেদ ধানমণ্ডি, ঢাকা।

 

০১.

আতাহারের পরনে পাঞ্জাবি।

পাঞ্জাবিতে ইস্ত্রি নেই, দলমচা ভাব। সেটা কোন ব্যাপার না–নতুন জামাইদের ক্ষেত্রেই ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি বাধ্যতামূলক, সে নতুন জামাই নয়। সমস্যা একটাই–পাঞ্জাবির পেটের কাছে হলুদ দাগ। মনে হয় গোশত দিয়ে ভাত খাবার পর কেউ একজন হাত না ধুয়ে পাঞ্জাবিতে হাত মুছে ফেলেছে। পাঞ্জাবি বদলে অন্য কিছু পরার মত সময় আতাহারের নেই–তাকে অতি দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতে হবে। তার বাবা (অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার, বিদ্যাময়ী গার্লস হাইস্কুল), রশীদ আলি সাহেব এই মুহূর্তে বাথরুমে আছেন। তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছেন। কাগজ শেষ করে বাথরুম থেকে বের হবেন। মিনিট কুড়ি লাগার কথা। এই সময়ের ভেতর অতিহারের হাওয়া হয়ে যেতে হবে। তা না করতে পারলে ভয়াবহ সমস্যা হতে পারে। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ আগে রশীদ আলি সাহেবের সঙ্গে তাঁর পুত্রের দেখা হয়েছে। তিনি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন–খবরের কাগজেৱ জন্যে অপেক্ষা। কাগজ আসছে না, তিনি বাথরুমে ঢুকতে পারছেন ন্যা) এমন সংকটপূৰ্ণ মুহুর্তে আতাহার কি জন্যে যেন বারান্দায় এসেছে। বাবাকে দেখে গেল। রশীদ আলি কিছুক্ষণ ছেলের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে ধমকের গলায় বললেন, কি রে, তুই মনিকার ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েছিলি?

আতাহার সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি। যদিও সে যায়নি। সময় করে উঠতে পারেনি। বেকার যুকবদের নানান ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সময় বের করা তাদের পক্ষেই সবচে কঠিন। এই তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। বাবাকে সত্য কথাটা বলা গেল না।

রশীদ আলি বললেন, পয়েন্ট বাই পয়েন্ট সব লিখে এনেছিস তো?

আতাহার বলল, হুঁ।

রশীদ আলি বিরক্ত গলায় বললেন, হুঁ হুঁ বলে জবাব দিবি না। কিছু জিজ্ঞেস করলে পুরো একটা সেনটেন্সে জবাব দিবি। সব লিখে এনেছিস?

জ্বি, লিখে এনেছি।

কোন ঘরের আয়না ভাঙা, বাথরুমের কি অবস্থা, দেয়ালে দাগ আছে কি-না। সব লিখেছিস?

লিখেছি।

রশীদ আলি বাথরুমে ঢুকলেন। আতাহার ঢুকল নিজের ঘরে। হাতের কাছের পাঞ্জাবিটাই গায়ে ঢুকিয়ে দিল। তাড়াহুড়ার সময় সব কাজে ঝামেলা হয়। পাঞ্জাবি গায়ে দেবার পর দেখা যায় পাঞ্জাবিটা উল্টো হয়েছে। বোতামের ঘর চলে গেছে পিঠের দিকে। স্যান্ডেল দুপাটির ভেতর এক পাটি খুঁজে পাওয়া যায়, অন্যপাটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তার পরম সৌভাগ্য–পাঞ্জাবি উল্টো হয়নি। স্যান্ডেলের দুপাটিই খাটের কাছে আছে। শুধু পাঞ্জাবির পেটের কাছে হলুদ দাগ। থাকুক দাগ। চাঁদের মত সুন্দর জিনিসেও কলংক আছে–আর পাঞ্জাবিতে থাকবে না তা-কি হয়! চাঁদের শোভা তার কলঙ্ক। পাঞ্জাবির শোভা হলুদ দাগ।

একতলার বারান্দায় মিলির সঙ্গে দেখা। মিলির মুখ শুকনা। চোখ ডেবে গেছে। গলায় কমলা রঙের মাফলার। মনে হয়। আবার তার টনসিালের সমস্যা হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন তার টনসিল ফুলে থাকে। গলায় কমলা রঙের মাফলার জড়াতে হয়। মিলি বলল, তুই কি বেরুচ্ছিস না-কি ভাইয়া?

হুঁ।

নাশতা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

মিলি আতাহারের ছবছরের ছোট। সে আতাহারকে তুই করে বলে। তার ভাবভঙ্গি এ রকম যেন সে এ বাড়ির বড় মেয়ে। সংসার দেখেশুনে নেয়ার দায়িত্ব তার। আজ আবার সে শাড়ি পরেছে। মায়ের ছাপা শাড়ি পরেছে বলেই কি গলার স্বরে মা মা ভাব?

শাড়ির রঙের সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হয় কি? হলুদ শাড়ি যখন পরবে তখন গলার স্বর এক রকম, আকাশী নীল শাড়িতে অন্য রকম। পরীক্ষাটা করে দেখলে হয়। গবেষণামূলক একটা প্রবন্ধ হতে পারে। প্রবন্ধের শিরোনাম–দ্য ইফেক্ট অব কালার অন ইয়াং গার্লস ভয়েস।

ভাইয়া, তুই নাশতা-টাশত না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

আতাহার জবাব দিল না। জবাব দিয়ে নষ্ট করার মত সময় তার হাতে নেই। গেটের বাইরে এসে আতাহাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল–প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব নেয়া হয়েছে, না তাড়াহুড়ায় কিছু বাদ পড়ে গেছে? রুমাল পাওয়া গেল। এটা তেমন প্রয়োজনীয় না। তার সন্দি নেই যে নাকের সিকনি রুমালে ভরে পকেটে যত্ন করে রাখতে হবে। দেয়াশলাই পাওয়া গেল। এটা মোটামুটিভাবে জরুরি। একবার পকেটে সিগারেট থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র দেয়াশলাই-এর অভাবে সে সারারাত সিগারেট খেতে পারেনি।

মানিব্যাগ পাওয়া গেল প্যান্টের পকেটে। এটা অত্যন্ত আশার কথা। মানিব্যাগের সন্ধানে আবার বাড়িতে ঢুকতে হলে সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

মানিব্যাগ খুলে আতাহার এক ঝলক দেখে নিল–লাল রঙ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। তার মানে পঞ্চাশ টাকার নোট কোথাও লুকিয়ে আছে। বিরাট ভরসার কথা। আতাহার লম্বা লম্বা পা ফেলতে শুরু করল। সকালে নাশতা খাওয়া হয়নি। খিদে লাগছে। খিদের চেয়েও যা বড়–চায়ের পিপাসা হচ্ছে। দিনের প্রথম চা এখনো খাওয়া হয়নি। দিনের প্রথম চা পানের আনন্দ স্বগীয় আনন্দের কাছাকাছি।

চা—নাশতার জন্যে সবচে ভাল জায়গা হচ্ছে সাজ্জাদের কলাবাগানের বাসা। সাজ্জাদের ছোট বোন নীতু আতাহারকে দেখামাত্রই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকাবে, তারপরেও চা-নাশতা এনে দেবে। এবং কঠিন গলায় বলবে, মানুষের বাসায় গিয়ে চেয়ে চেয়ে চানাশতা খেতে আপনার লজ্জা লাগে না? নীতু এবারই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। প্রথম ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা মেয়েগুলি কঠিন কঠিন কথা বলে সবাইকে চমকে দিতে ভালবাসে, কাজেই নীতুর কোন কথাই ধর্তব্যের মধ্যে নয়। সমস্যা হচ্ছেন নীতুর বাবা হোসেন সাহেব। পৃথিবীর পাঁচজন বিরক্তিকর মানুষের তালিকা তৈরি হলে সেই তালিকাতেও তার নাম থাকার কথা। জগতের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে হোসেন সাহেব কিছু না কিছু জানেন। সেই জ্ঞান তিনি নিজের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। ছড়িয়ে দিতে চান। হাসি হাসি মুখে একঘেঁয়ে সুরে তিনি যখন জ্ঞান বিতরণ করেন তখন আতাহারের ইচ্ছা করে লোহার একটা শাবল দিয়ে ঠাস করে তাঁর মাথায় বাড়ি দেয়। সেটা সম্ভব হয় না বলে কৌতূহলী ভঙ্গি চোখে-মুখে ফুটিয়ে তাঁর যাবতীয় জ্ঞানের কথা শুনতে হয়। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য।

আশার কথা হচ্ছে আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন হোসেন সাহেব সাপ্তাহিক বাজার করতে যান। আজ তার সঙ্গে দেখা না হবার সম্ভাবনাই বেশি।

 

চৈত্র মাস। এই সকালেই চিড়চিড়ে রোদ উঠে গেছে। বাতাস দিচ্ছে বলে রোদটা অগ্রাহ্য করে হীটতে ভাল লাগছে। দুপুরের মধ্যে অবস্থা অন্য রকম হবে। দালান-কোঠা থেকে ভাপ বেরুতে থাকবে। সেই ভাপে থাকবে দালান কোঠার প্রাচীন গন্ধ। রাস্তার পিচ নরম হয়ে স্যান্ডেলের সঙ্গে উঠে আসতে থাকবে। সারাক্ষণ নাকে লাগবে পিচের ঝাঝালো টক টাইপ গন্ধ। আতাহারের মত মানুষ, রাস্তায় হাঁটাই যাদের প্রধান কর্ম তাদের জন্যে, চৈত্র মাসের দুপুর বড়ই দুঃসময়।

আতাহার রিকশা নেবে, না হেঁটে হেঁটে যাবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মানিব্যাগের অবস্থা ভাল না। রিকশা ভাড়ার যন্ত্রণায় যাওয়া ঠিক হবে না। এখন বাজছে আটাটা। হেঁটে যেতে যেতে নটার মত বাজাবে। তাতে একটা সুবিধা হবে–হোসেন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি বাজারে চলে যাবেন। সাড়ে আটটার মধ্যে তিনি বাজারে যান। সাবধানতার জন্যে আরো আধঘণ্টা হাতে থাকা ভাল।

 

হোসেন সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তার গায়ে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি। চোখে আঠারো ক্যারট সোনার চশমা। সোনালী ফ্রেমের ভেতর দিয়ে তার মায়া মায়া চোখ দেখা যাচ্ছে। তার সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে তিনি বউভাতের কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। আতাহারের বুক ধক করে উঠল। হোসেন সাহেব হাসিমুখে মধুর গলায় বললেন, কেমন আছ আতাহার?

জ্বি চাচা ভাল।

মুখ মলিন কেন?

হেঁটে এসেছি তো।

আপনি বাজারে যাননি?

হ্যাঁ যাব। তোমাকে পেয়ে ভালই হয়েছে, ঐ দিনের ডিসকাশনটা শেষ হয়নি। তুমি তাড়াহুড়া করে চলে গেলে, সূফীবাদের মূল ব্যাপারটা বলতে ভুলে গেলাম। আরাম করে বোস, আমি নীতুকে চা দিতে বলি।

আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে চাচা। আমার বড়বোন, যিনি আমেরিকায় থাকেন, তাঁর একটা ফ্ল্যাট আছে এলিফেন্ট রোডে। ঐ ফ্ল্যাটের ভাড়াটে তিন মাসের ভাড়া বাকি ফেলে চলে গেছে। যাবার আগে বাড়ির অনেক ক্ষতি করেছে। আমাকে এইসব দেখে বাবাকে রিপোট করতে হবে।

রিপোর্ট করে কি হবে? যা করতে হবে তা হল মামলা। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কি করতে হয়? আঙুল বাঁকা করতে হয়। যত বাক্য করবে তত ঘি উঠবে।

জি, তা তো বটেই।

আমাদের সমস্যা কি জান আতাহার–আমরা আঙুল বাঁকা করতে পারি না। মুখে খুব হৈ-চৈ করি কিন্তু আঙুল বাকা করি না। ভাড়াটে ক্ষতি করে চলে গিয়েছে এই নিয়ে আমরা খুব চেঁচামেচি করব। একে বলব, তাকে বলব। কি কি ক্ষতি করেছে তার লিস্ট করব। তা করতে গিয়ে আমাদের দম ফুরিয়ে যাবে। আসল কাজ আর করা হবে না। ঠিক না?

জ্বি চাচা, ঠিক। আপনি খুবই খাটি কথা বলেছেন।

আসল কাজের প্রতি আমাদের অনীহার কারণ জান আতাহার?

আতাহার মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজ দিনটা খারাপভাবে শুরু হয়েছে। একের পর এক প্যাঁচে জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা প্যাঁচ খোলামাত্র অন্য একটা প্যাঁচ। এখন যে প্যাঁচে পড়েছে তার থেকে খুব সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে তা মনে হচ্ছে না। দোয়া ইউনুস পাঠ করা যেতে পারে। ইউনুস নবী মাছের পেটে নির্বাসিত হয়ে এই দোয়া পাঠ করেছিলেন। মাছ দোয়ার তেজ সহ্য করতে না পেরে তাকে উগরে ফেলে দিয়েছিল। আতাহারের ক্ষেত্রেও কি তা হবে? হোসেন সাহেব তাকে উগরে ফেলে দেবেন? আতাহার দোয়াটা মনে করতে পারছে না। বাস এবং বেবীট্যাক্সির ড্রাইভারদের চোখের সামনে এই দোয়া লেখা থাকে। আতাহার অসংখ্য বার পড়েছে। এখন আর মনে পড়ছে না। সে তাকিয়ে আছে হোসেন সাহেবের দিকে। হোসেন সাহেব হাসিমুখে কথা বলছেন,

বুঝলে আতাহার, পশু এবং মানুষকে তুমি যদি দুটা ভাগে ভাগ কর তাহলে তুমি মজার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করবে। ব্যাপারটা সিস্টেমেটিক্যালি কর। এসো, একটা থািট এক্সপেরিমেন্ট করি। মনে মনে কলপনা করো। একটা শাদা পাতা নাও। একদিকে লিখে। মানুষ, একদিকে পশু, মাঝখানে লম্বা একটা দাগ দাও। দিয়েছ?

জ্বি।

ভেরী গুড। এখন নাম্ববারিং করা। এক দুই করে গো আপওয়ার্ড …

হোসেন সাহেব উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলেন। তার উৎসাহ বাধাপ্রাপ্ত হল। দরজার মুখে নীতুকে দেখা গেল।

নীতুও আজ শাড়ি পরেছে। আতাহার ভেবে পেল না— আজ কি কোন বিশেষ দিন–যে দিন সব বাচ্চা মেয়েকে শাড়ি পরতে হবে?

নীতুর মুখ কঠিন। তার গলার স্বরও হিমশীতল। হোসেন সাহেব বললেন, কি ব্যাপার মা?

তুমি বাজারে যাবে না?

যাচ্ছি তো। পশু এবং মানুষ বিষয়ক আমার ধারণাগুলি আতাহারকে বলছিলাম। ধারণাগুলি বলার সময় তুমি অনেক পাবে বাবা। ধারণা পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন যদি বাজারে না যাও, মাছ-টাছ কিছুই পাবে না। আজ ছুটির দিন না?

দ্যাটস রাইট। আজ ছুটির দিন তো বটেই।

তুমি বাজারে চলে যাও। আমি আতাহার ভাইকে আটকে রাখছি।

এটা মন্দ না।

চট করে বাজার সেরে এসো। এসে পশু এবং মানুষ বিষয়ক তোমার হাইপোথিসিস আতাহার ভাইকে বুঝিয়ে বল।

হোসেন সাহেব মেয়ের কথায় আস্বস্ত হলেন এবং অতিরিক্ত ব্যস্ততায় বাজারের দিকে রওনা হলেন। নীতু আতাহারের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার হাত থেকে আপনাকে বঁচিয়ে দিলাম। এখন আপনি ভালীয় ভালয় বিদেয় হয়ে যান।

নাস্তা খেয়ে তারপর যেতে হবে। নাস্তা খেয়ে আসিনি। বাসি রুটি-ভাজ্বি যা হোক একটা কিছু দে। আমি সাজ্জাদের ঘরে গিয়ে বসি। ওর ঘুম ভেঙেছে?

ভাইয়া বাড়িতে নেই।

কোথায় গেছে?

জানি না কোথায় গেছে। দুদিন ধরে তার কোন খোঁজ নেই।

দুদিন ধরে একটা মানুষের কোন খোঁজ নেই। আর তোরা বেশ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিস? আশ্চর্য তো!

আমরা কি করব? মাইকে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘোষণা দেব–সাজ্জাদ নামের একজন যুবক হারানো গিয়াছে? ভাইয়ার বাড়ি থেকে উধাও হওয়া তো আজ নতুন কিছু না। আপনি সেটা ভাল করেই জানেন।

তুই আমার উপর রাগ করছিস কেন? আমি তো তাকে ফুসলে-ফাসলে বাড়ি থেকে বের করিনি। আমি খুবই গৃহী ধরনের মানুষ। রাত আটটার পর সব সময় আমাকে বাসায় পাওয়া যায়।

নীতু গম্ভীর মুখে বলল, আপনি বসার ঘরে গিয়ে বসুন–আমি চা-নাশতা নিয়ে আসছি। হলুদ দাগ দেয়া পাঞ্জাবিটা কি ইচ্ছা করে পরেছেন? সবাইকে দেখানোর জন্যে যে আপনি আলাদা? অন্যদের মত পরিস্কার জাম-কাপড় পরেন না–নোংরা জামকাপড় পরেন?

আতাহার হাই তুলতে তুলতে বলল, সাজ্জাদ বাড়ি থেকে পালিয়েছে এই রাগ তুই আমার উপর চাপাচ্ছিস এটা ঠিক হচ্ছে না। উদ্দোর পিণ্ডি বুধের ঘাড়ে হলেও কথা ছিল। উদ্দোর পিণ্ডি একেবারে সুলায়মানের ঘাড়ে!

নীতু কিছু না বলে চলে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাশতা নিয়ে ঢুকল। যেন তার জন্যে নাশতা তৈরিই ছিল, নীতু শুধু নিয়ে এসেছে। আগুন-গরম পারাটা, ডিমভাজা, একটা বাটিতে গরুর মাংস। নীতু খাবার টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, চা খাবেন, না কফি খাবেন?

দুটাই খাব। প্রথমে এক কাপ চা, তারপর কফি। আর শোন নীতু, এক পারাটায় আমার হবে না। দুটা লাগবে।

পারাটা ভাজছে।

গুড। শোন নীতু, পৃথিবীর পাঁচটা শ্রেষ্ঠ মেয়ের তালিকা যদি কোনদিন করার চেষ্টা হয় তাহলে আমি খুব চেষ্টা করব তোর নাম ঢুকাতে।

শুনে খুশি হলাম।

দেশ ছেড়ে যাবার সময় পাঁচটা জিনিসের জন্য আমার খারাপ লাগবে। এক–বৃষ্টি, দুই–বর্ষার ব্যাঙের ডাক, তিন–বাশবনে জোছনা, চার–কালবোশেখি, পাঁচ–তুই।

আপনার সবই কি পাঁচটা পাঁচটা করে?

হুঁ। পাঁচ হচ্ছে ম্যাজিকেল নায়ার। কোন মেয়েকে যদি কখনো পাঁচটা গোলাপ দেয়া যায় তাহলে সে জন্মের মত কেনা হয়ে যায়। পারাটা তো নীতু অসাধারণ হয়েছে। বিষ্ণু দের কবিতার চেয়েও ভাল হয়েছে। প্রায় ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে গেছে। খেতে মায়া লাগছে। ক্লাসিক পর্যায়ের জিনিস ভক্ষণ করা যায় না।

ভক্ষণ করা না গেলে করবেন না। আপনাকে তো জোর করে ভক্ষণ করাচ্ছি না।

নীতু, তুই কোন রাশির জাতক বল তো?

কেন?

আমার মনে হচ্ছে তুই লিব্রা। লিব্রারা যে কোন সহজ কথায় একটা প্যাঁচ ধরে। খবরদার, তুই বিয়ে করবি না। বিয়ে করলে তোর স্বামীর সঙ্গে তুই ত৬৫ দিন ঝগড়া করবি। লিপ ইয়ারে করবি ত৬৬ দিন।

কাজের মেয়ে ধোয়া ওঠা পারাটা নিয়ে ঢুকল। নীতু আতাহারের প্লেটে পারাটা তুলে দিতে দিতে বলল, আপনি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তা তো জানতাম না!

সাজ্জাদ তোকে কিছু বলেনি?

ভাইয়ার সঙ্গে আমার কোন কথা হয় না। যাচ্ছেন কোথায়?

হলুদ চামড়ার দেশ–জাপানে।

জাপানে গিয়ে আপনি কি করবেন?

জাপানের আকাশে-বাতাসে ইয়েন উড়ছে। খাবলে খাবলে তাই ধরব। ভিসা পাওয়াই শুধু সমস্যা। সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে।

সমাধানটা কি?

সাংস্কৃতিক এক দল যাচ্ছে জাপানে। আমি ওদের সঙ্গে তবলাবাদক হিসেবে যাচ্ছি। ওরা ফিরে আসবে, আমি থেকে যাব।

পারাটা কি আরেকটা দেব?

না। দিলে লোভে পড়ে খেয়ে ফেলব। অত খাওয়া উচিত হবে না। চা দে, কফি দে। চা-কফি খেয়ে বিদেয় হই।

আপনার মা কেমন আছেন?

ভাল।

উনার কেবিন নাম্ববার কত? আমি একবার উনাকে দেখতে যাব।

আনিলাকি থারটিন-কে দুই দিয়ে গুণ করলে যত হয় তত।

উনার শরীর এখন কেমন?

ভাল।

ভাল হলে হাসপাতালে কেন?

হাসপাতালে যারা বাস করছে তাদের মধ্যে ভাল।

জাপান কবে যাচ্ছেন?

খুব শিগগির। তবে জাপানে যাই আর মালয়েশিয়াতে যাই–তোর পারাটার কথা মনে থাকবে।

আতাহার সিগারেট ধরালো। নীতু কঠিন গলায় বলল, সিগারেট ধরাবেন না আতাহার ভাই। কতবার আপনাকে বলেছি আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না।

গন্ধ সহ্য করতে তোকে কে বলছে? আমি তো বসে বসে তোর মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়ব না। চলে যাব। এই সিগারেট হচ্ছে ফর দ্য রোড।

কফি তো খাননি। বানানো হচ্ছে।

তাহলে সিগারেট ফেলতে হবে। সিগারেট হাতে নিয়ে কফি খেতে দেব না।

সিগারেট ছাড়া কফি খাওয়ার মধ্যে কোন মজা আছে? দরকার নেই। আমার কফির। বিদায়। আর শোন নীতু, তুই একটু খাওয়া-দাওয়া কর। তুই যে হারে রোগা হচ্ছিস, কিছুদিন পর তোর আর ছায়া পড়বে না।

আতাহার উঠে দাঁড়াল। নীতুর ইচ্ছা হল বলে, ঠিক আছে। সিগারেট ফেলতে হবে না। কফি খেয়ে যান। বলতে গিয়েও নীতু বলল না। কথাগুলি গলার কাছে শক্ত বরফের দলার মত আটকে রইল। তাঁর আত্মসম্মান অতি তীব্র। সে মরে গেলেও নিজের কাছে ছোট হতে পারবে না। আতাহার ঠিক এগারো দিন পর তাদের বাড়িতে এসেছে। সে যে এইভাবে দিনক্ষণের হিসাব রাখে। তাও সে কোনদিন আতাহারকে জানাতে পারবে না। আজ যে আতাহার আসবে তাও সে জানত। ভোরে ঘুম ভেঙেই তার মনে হয়েছে আতাহার ভাই আসবে। কেন তার এরকম মনে হয়েছে তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে, যখন তার মনে হয়। আতাহার ভাই আসবে, তখন সে আসে। একবার রাত এগারোটার সময় তার এ রকম মনে হল। সে অতি দ্রুত চুল বেঁধে, শাড়ি পরল। তারপর বসার ঘরে বসে রইল। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। আতাহার ভাই সত্যি সত্যি রাত সাড়ে এগারোটার সময় উপস্থিত।

এইসব কথা কাউকে বলা যাবে না। তার আগে সে বিষ খেয়ে মরে যাবে। বিষ খেয়ে মরা নীতুর কোন কথার কথা না। বিষ তার কাছে আছে। সত্যি আছে। তার বইপত্র যে বুক শেলফে আছে সেই শেলফের তিন নম্বর তাকে বই-এর পেছনে লুকানো আছে। নীতুর ধারণা, খুব বেশিদিন শিশিটা লুকিয়ে রাখতে হবে না।

আতাহার চলে যাবার পরপরই নীতু বাথরুমে ঢুকল। সে দিনের মধ্যে কয়েকবার শুধুমাত্র কাদার জন্যে বাথরুমে ঢুকে। তার অনেক গোপন দুঃখ-কষ্টের একটা হচ্ছে সে কালো। যতটুকু কালো হলে মারা মেয়েদের শ্যামলা বলেন–সে তার চেয়েও কালো। নীতুর ধারণা, যত দিন যাচ্ছে তার গায়ের রঙ ততই কালো হচ্ছে। কালো মেয়েদের আলাদা কিছু সৌন্দর্য থাকে। তাদের চোখ সুন্দর হয়, ঠোঁট সুন্দর হয়, হাসি সুন্দর হয়। তাই সবই অসুন্দর। নীতু আয়নার সামনে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না।

 

এক সময় বাড়ি-ঘরের সুন্দর সুন্দর নাম হত–সুরভি, কদম্ব, নীলাঞ্জন। এখন ইংরেজ্বি নামের চল হয়েছে। মনিকার এপার্টমেন্ট হাউসের নাম Elephant Park Apartments. বাংলা করলে কি হয়–হাতি-বাগান ঘরবাড়ি। এপার্টমেন্টের ভাল বাংলা কি ভাবতে ভাবতে আতাহার রিসিপশনের দিকে এগোলো। রিসিপশনে ছোকরা মতন একজন বসে। তার গায়ে শাদা ড্রেস, মনে হয় নেভীতে কাজ করে। বুক পকেটে নাম লেখা–রইছুদ্দিন।

রইছুদ্দিন বিশ্ৰীভাবে তাকাচ্ছে। আতাহার আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল। তাতে তেমন উপকার হল না। রইছুদ্দিন সন্দেহভাজন লোকদের দিকে যে দৃষ্টিতে তাকানোর নিয়ম সেই দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আতাহারের ধারণা, হলুদ দাগ পরা পাঞ্জাবির কারণে ব্যাপারটা ঘটছে। হলুদ দাগ ছাড়াও পাঞ্জাবিতে আরো কিছু ত্রুটি আছে। সাইজে খাটো। আজকাল লম্বা পাঞ্জাবির চল হয়েছে। পাঞ্জাবির ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে যত নামবে ততই উত্তম। মনে হয় হাতি-বাগান ঘরবাড়িতে হলুদ দাগ দেয়া খাটো পাঞ্জাবি পরে কেউ আসে না।

কাকে চান?

আতাহার লক্ষ্য করল কাকে চান প্রশ্নটা করা হয়েছে তার দিকে না তাকিয়ে। সন্দেহভাজন মানুষের দিকে লোকজন বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঠিকই, কিন্তু কথা বলার সময় অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলে। আতাহার হাই তুলতে তুলতে বলল, কাউকে চাই না। আটতলায় আমাদের একটা এপার্টমেন্ট আছে 7/C, ভাড়া ছিল। ভাড়াটে বিদায় করা হয়েছে। আমি যাচ্ছি ইন্সপেকশনে। ভাড়াটে কি কি ক্ষতি করে গেছে তার লিস্ট করতে হবে। নোটবই এবং কলম নিয়ে এসেছি। নোটবই, কলম দেখতে চান?

রইছুদ্দিনের চোখে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল। নোটবই এবং কলম দেখে সে তাকে আটতলায় যেতে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এই এপার্টমেন্ট হাউসের সিকিউরিটি সিস্টেম খুব কঠিন। একটা মাছিও যদি কোন ফ্ল্যাটে যেতে চায় তাকেও ইন্টারকমে অনুমতি নিতে হবে। এটা আতাহারের কথা না–আতাহারের বাবা রশীদ সাহেবের কথা। তিনি এ জাতীয় কথা বলে ভজিয়ে-ভাজিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন। যাকে ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন সে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ফ্ল্যাট নিল। কিছুই তার পছন্দ হয় না। নানান প্যাঁচালের কথা বলে।

লিফট নষ্ট হলে আটতলায় উঠব কিভাবে? আমার আবার হার্টের সমস্যা?

রশীদ সাহেব বললেন, লিফট, নষ্ট হবে কেন? জার্মান ওনাডা কোম্পানীর লিফট। পৃথিবীর সেরা। তাও একটা না, দুটা।

কারেন্ট যখন থাকবে না। তখন?

আটতলা বেশি উঁচু হয়ে যায়।

উঁচুই তো ভাল। যত উঁচুতে উঠবেন তত ফ্রেস বাতাস। মশা-মাছির উপদ্রব নেই। তাছাড়া সিকিউরিটি সিস্টেম দেখবেন না? এত কড়া সিকিউরিটি সিস্টেম বাংলাদেশের কোন এপার্টমেন্ট হাউসে নেই।

ভদ্রলোক মুখে এমন ভঙ্গি করলেন যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি রশীদ সাহেবের কথা বিশ্বাস করলেন না। কাজেই রশীদ সাহেবকে সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যাখ্যা করতে হল। দীর্ঘ ব্যাখ্যার পর তিনি বললেন–বুঝলেন ভাই সাহেব, একটা মাছি যদি কোন ফ্লাটে যেতে চায় তাকেও আগে ইন্টারকমে অনুমতি নিতে হবে। এমন অবস্থা।

ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত নিতান্তই অনাগ্রহের সঙ্গে ফ্ল্যাট নিলেন এবং ভাড়া দেয়ার ব্যাপারেও অসীম অনাগ্রহ দেখাতে লাগলেন। চারমাস ভাড়া বাকি পড়ে গেল। তাগাদা দেয়ার দায়িত্ব পড়ল আতাহারের উপর। আতাহার তখন হাড়ে হাড়ে বুঝল সিকিউরিটি সিস্টেম কাকে বলে। সে আসে, ইন্টারকমে ভাড়াটে ভদ্রলোক বলে দেন–দেখা হবে না। দারোয়ানরা তখন আর তাকে উঠতে দেয় না। শুকনো মুখে বাড়িতে ফিরতে হয়। শুকনো মুখে, কারণ রশীদ সাহেবের নিয়ম হচ্ছে একজনের রাগ তাৎক্ষণিকভাবে অন্যজনের উপর ঢেলে দেয়া। ভাড়াটের রাগ পুরোটাই তার উপর আসবে এই ভেবেই মুখ শুকনো।

কি রে, ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল?

না।

না মানে কি? ফ্ল্যাটে ছিল না?

ছিল, দেখা করল না। দারোয়ন উঠতে দিল না।

তুই ফ্ল্যাটের মালিক, তোকে ফ্ল্যাটে উঠতে দিল না?

আমি তো ফ্ল্যাটের মালিক না। বড় আপা মালিক।

এইসব আইনের কথা তো দারোয়ান বুঝবে না।

বুঝিয়ে বললে বুঝবে না কেন? তুই হচ্ছিস একটা ছাগল, রামছাগল। এই জন্যেই কেউ তোকে পাত্তা দেয় না। মুখের মধ্যে সব সময় একটা চোর চোর ভাব। যা আমার সামনে থেকে। আর শোন, এখন থেকে দাড়ি কামাবি না। দাড়ি ছেড়ে দে। রামছাগলের মত। থুতনিতে কয়েকগাছা দাড়ি না হলে তোকে মানাবে না।

আতাহার পিতৃআজ্ঞা পালন করেছে। দাড়ি কামানো বন্ধ রেখেছে। থুতনিতে কয়েকগাছা দাড়ির বদলে সারামুখময় দাড়ি গজিয়ে গেছে। কাউকে কাউকে দাড়িতে মানায়। তাকে মানাচ্ছে না। দাড়ি রাখার পরেও মুখ থেকে চোর চোর ভাবটা যায় নি। বরং সামান্য বেড়েছে, সেই সঙ্গে অন্য কিছুও যুক্ত হয়েছে। সেই অন্য কিছু–শুভ না, অশুভ ধরনের। এপার্টমেন্টের ছোকরা যে কারণে গোড়া থেকেই তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। সে তাকে 7/C ফ্ল্যাটে যেতে দেবে না, বলাই বাহুল্য। বাবার আরো কিছু কঠিন কথা শুনতে হবে। রিটায়ার করার পর কোন মানুষই তার বেকার ছেলেপূলে সহ্য করতে পারে না। এটা দোষের কিছু না, এটাই স্বাভাবিক। আতাহার তাতে কিছু মনে করে না। তবে রশীদ সাহেব ইদানীং যে ব্যঙ্গ-বিদ্রািপ শুরু করেছেন তা সহ্য করা কঠিন। দীর্ঘদিন মেয়ে স্কুলে যেসব পুরুষ মাস্টারি করে তাদের স্বভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কি করে যেন ঢুকে যায়। তারা স্বাভাবিকভাবে কথাই বলতে পারে না।

 

আতাহার পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে বলল, এই যে দেখুন চাবি নিয়ে এসেছি, প্রমাণস্বরূপ যে ফ্ল্যাটটা আমাদের। তাছাড়া আমি আগেও অনেকবার এসেছি। আপনার সঙ্গেও আমার দেখা হয়েছে। তখন আমার দাড়ি ছিল না। মাস তিনেক হল দাড়ি রেখেছি। চেহারা বদলে গেছে বলে আপনি চিনতে পারছেন না। দয়া করে দাড়ি ছাড়া আমাকে কলপনা করুন। চিনতে পারবেন। এখন কি আমি যাব উপরে?

যান।

এপার্টমেন্ট হাউসের ছোকরা কঠিন চোখে তাকাচ্ছে। এর বোধহয় রসবোধ নেই। রসিকতা ধরার ক্ষমতা বিবর্জিত মানুষ। রসিক মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করে কোন আরাম নেই। রসবোধহীন মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করাতেই বেশি আনন্দ।

 

সব লিফটেই বাথরুমের মত আয়না থাকে। এই লিফটে নেই। সুন্দর ছিমছাম লোহার ঘর। কয়েকটি বাতি জ্বলছে, নিভছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। আতাহারের কাছে মনে হল এক্সস্ট ফ্যান, কারণ গায়ে বাতাস লাগছে না। এই ফ্যানের কাজ সম্ভবত লোহার ঘর থেকে দুষিত বাতাস বের করে দেয়া।

লিফট তিন তলায় থামল, দরজা খুলে গেল। লিফটের খোলা দরজার সামনে উনিশ-কুড়ি বছরের এক তরুণী। সে লিফটের ভেতর আতাহারকে দেখে ইতঃস্তত করছে–উঠবে কি উঠবে না। লোহার এই ঘরে দাড়িগোঁফ ওয়ালা এই যুবকের সঙ্গে ভ্ৰমণ করা কি ঠিক হবে? মেয়েটি শেষ পর্যন্ত উঠল। নিজেকে যথাসম্ভব এক কোণায় নিয়ে গেলো। হিংস্র জন্তুর সঙ্গে ভ্রমণের সময় এ জাতীয় সাবধানত মানুষ নিয়ে থাকে। আতাহারের ইচ্ছা করছে দাঁত-মুখ খিচিয়ে ঘ্যাও জাতীয় কোন শব্দ করে মেয়েটাকে ভয় দেখাতে। মজিদ থাকলে অবশ্যই এই কাজটা করত। কোন না কোন ভাবে ভয় দেখাতোই। আতাহার নিরীহ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। এক পলকের জন্যেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এতেও কাজ হবে। ভয় পাবে। মেয়েদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেও তারা ভয়ে অস্থির হয়। মেয়েটা তাকে অপমান করেছে। লিফটে তাকে দেখে প্রায় আঁৎকে ওঠার ভঙ্গি করেছে। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাব করেছে, কাজেই মেয়েটার শাস্তি প্রাপ্য। সাধারণ শাস্তি। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা। মেয়েটার নাম কি? নাম জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? নাম নিশ্চয়ই বলবে না। ধরা যাক তার নাম বেহুলা। লোহার ঘরে যেহেতু দেখা, সেহেতু বেহুলা নামটাই মানানসই। লিফট থেকে নেমে যাবার সময় সে কি বলবে–বেহুলা! আনন্দময় কিছু সময় তোমার সঙ্গে কাটলো। তোমাকে ধন্যবাদ?

লিফট থেকে নামার সময় আতাহার বেহুলার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বেহুলা তাতে যে ভাবে চমকালো সেও এক দর্শনীয় দৃশ্য। মেয়েটা যাচ্ছে কোথায়? ছাদে? তিন তলা থেকে উঠেছে। ছাদে যাচ্ছে। ভরদুপুরে ছাদে যাবে কেন?

আতাহার কয়েক মুহুর্ত ব্যয় করল মন স্থির করতে। সে কি করবে—আপার ফ্ল্যাটের দরজা খুলবে, না ছাদে গিয়ে মেয়েটিকে আরেকবার চমকে দেবে? ছাদে যাবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করল। বেহুলার জন্যে এতটা ঝামেলা করা ঠিক হবে না।

 

তালা খুলে আতাহার ঘরে ঢুকেই প্রথম যে কাজটা করল তা হচ্ছে–গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলল। ফাঁকা ফ্ল্যাট। এই ঘরে উদ্দোম হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কারো কিছু বলার নেই।

ভাড়াতে কি কি ক্ষতি করেছে তার লিস্ট করতে হবে। তেমনি কোন ক্ষতি করেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্লাস্টিক পেইন্টের দেয়ালে প্রচুর আঁকি-বুকি আছে। সে তো থাকবেই–বাচ্চ-কাচ্চা থাকবে। আর তারা দেয়ালে ছবি আঁকবে না তা হয় না। শিশুর কাছে দেয়াল হচ্ছে খাতার বড় একটা শাদা পাতা। সেখানে সে তো ছবি আঁকবেই।

দুটি বাথরুমের একটির কমোডের ঢাকনা ভাঙা। এমন কিছু ভয়াবহ ব্যাপার না। শোবার ঘরের জানালার কপাট খুলে এসেছে। ভাড়াটে টানাটানি করে খুলেছে এরকম মনে করার কোন কারণ নেই। আগেই নিশ্চয় খোলা ছিল।

রান্নাঘরের অবস্থা অবশ্যি শোচনীয়। রান্নাঘরের সবই ভাঙা। মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙা হয়েছে। ভাড়াটের মনে হয় রান্নাঘরের উপরই রাগটা বেশি ছিল। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট নোটবুকে লেখাও সম্ভব না। ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে ছবি তুলে রাখা যেতে পারে। রান্নাঘরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই আতাহারের ক্লান্তি বোধ করল। চায়ের পিপাসা পেল।

দুটার মত বাজে। বাসায় ফিরে খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুম দিতে ইচ্ছা করছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির পূর্ণ বিবরণ না নিয়ে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। আজ ছুটির দিন–বাবা বারান্দায় অতি বিরক্ত ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। ছুটির দিন না হয়ে অন্যদিন হলে–এই সময়ে এসএসসি পরীক্ষাখীনিদের সেকেন্ড ব্যাচের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। রিটায়ার্ড হেড মাস্টার সাহেব তিন ব্যাচে ছাত্রীদের ইংরেজী শেখান। তিনটা থেকে পাঁচটা এক ব্যাচ, পাঁচটা থেকে সাতটা সেকেন্ড ব্যাচ, সাতটা থেকে নয়টা লাস্ট ব্যাচ। এক এক ব্যাচে পনেরোজন করে ছাত্রী। প্রত্যেককে দিতে হয় পাঁচশ করে। মাসে কুড়ি হাজার টাকার মত রোজগার। মন্দ কি?

আতাহার নোটবই বের করল। বল পয়েন্ট কালি ছাড়ছে না। নতুন কলম, আসার পথে কিনে আনা। নোটবইটাও নতুন। নীল রঙের প্লাস্টিকের মলাটে সুন্দর একটা খাতা। এরকম সুন্দর একটা খাতার শুরুটা হবে–ক্ষতির বিবরণ দিয়ে? প্রথম পৃষ্ঠায় একটা কবিতা থাকাটাই কি বাঞ্ছনীয় নয়? লিফট নিয়ে একটা কবিতা। লিফট হচ্ছে এমন একটা ঘর যা বড়ই অস্থির। ক্লান্তিহীনভাবে উঠা-নমা করছে। আতাহার শোবার ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে এলিয়ে পড়ল। বুকের নিচে বালিশ থাকলে উপুড় হয়ে লিখতে আরাম হত। নিজের টাকািপয়সা হলে সে বেশ কিছু কবিতা লেখার বালিশ নেবে। বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন মাপের বালিশ। ভেলভেটের কাভার। একেক বালিশের একেক রঙ–নেভীরু, স্বকাই বু, রেড, পার্পল, মেজেন্টা, ভায়োলেট। সে আবার উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ না দিয়ে কবিতা লিখতে পারে না। মজিদ তাকে ঠাট্টা করে ডাকে–উপুড় কবি। সে নিজে হচ্ছে চিৎ কবি। সে নাকি চিৎ হয়ে আকাশের দিকে না তাকিয়ে কবিতার লাইন গোছাতে পারে না।

আতাহার নেটবুকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে—

কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা।
লোহার তৈরি ছোট্ট একটি ঘর।
বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগ নেই।
ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে।
নামছে আর উঠছে।
মানুষ ক্লান্ত হয়—
এ ঘরের কোন ক্লান্তি নেই।
এ রকম একটা ঘরেই বোধহয় বেহুলার বাসর হয়েছিল।
নিশ্চিছদ্ৰ লোহার একটা ঘর।
কোন সাপ সেখানে ঢুকতে পারবে না।
হিসহিস করে বলতে পারবে না, পাপ করো। পৃথিবীর সব আনন্দ পাপে।
পুণ্য আনন্দহীন। উল্লাসহীন।
পুণ্য করবেন আকাশের ফিরিশতারা।
কারণ পুণ্য করার জন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে।
লোহার সেই ঘরে ঢোকার জন্যে সাপটা পথ খুঁজছিলো।
সেই ফাঁকে বেহুলা তাঁর স্বামীকে বললেন, কি হয়েছে, তুমি এত ঘামছ কেন?
আর তখন একটা সুতা সাপ ঢুকে গেল।
ফিসফিস করে কোন একটা পরামর্শ দিতে গেলো।
বেহুলা সেই পরামর্শ শুনলেন না বলেই কি লখিন্দরকে মরতে হল?

তার সঙ্গে আমার দেখা কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে।
ঘরটা শুধু ওঠে। আর নামে।
আমি তাকে বলতে গেলাম–আচ্ছা শুনুন, আপনার কি মনে হচ্ছে না
এই ঘরটা আসলে আমাদের বাসর ঘর?
আপনি আর কেউ নন, আপনি বেহুলা।
যেই আপনি ভালবেসে আমাকে কিছু বলতে যাবেন
ওম্নি একটা সুতা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দেবে।
আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। দয়া করে কিছু বলবেন না।

কবিতা শেষ করেই আতাহারের ঘুম পেয়ে গেলো। সব সময় এরকম হয়। এমন ক্লান্তি লাগে। এ জন্যেই কবিতা লেখার জন্যে তার বালিশ দরকার। কবিতা শেষ হবে–বুকের নিচ থেকে বালিশ টেনে মাথার নিচে দিয়ে লম্বা ঘুম। আজ বালিশ নেই। শক্ত মেঝেতে মাথা রেখেই তাকে ঘুমাতে হবে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঠাণ্ডা মেঝে, ভাঙা জানোলা দিয়ে আরামদায়ক হাওয়া আসছে–আতাহার ঘুমিয়ে পড়ল। সে ঘুমুলো সন্ধ্যা পর্যন্ত।

ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর ক্ষীণ রেখা মেঝেতে এসে পড়েছে। পিন পিন করছে রাজ্যের মশা। আটতলায় মশা উঠতে পারে না, এই তথ্য তারা ভুল প্রমাণ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তারা লিফট ব্যবহার করে আটতলায় উঠে এসে কবির রক্তপান করেছে।

আতাহার ঘর বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। ব্লইছুদিন এখনো আছে। সব কিছু দিকেই সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আতাহারের দিকে তাকিয়ে তার ভুরু কুঁচকে গেল। আতাহার এগিয়ে গেল। এমন ভঙ্গিতে এগোল যেন অতি পরিচিত কোন বন্ধুর হাসিমুখ দেখৈ এগুচ্ছে।

ভাইসাহেব, আমাকে চিনছেন তো? সেভেন সি। ফ্ল্যাট দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টানা একটা ঘুম দিলাম। এখন ফ্রেস লাগছে।

রইছুদ্দিনের ভুরু আগে থেকেই কুঁচকে ছিল, এখন আরো কুঁচকে গেল। আতাহার গলার স্বর নামিয়ে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, তিনতলার ঐ মেয়েটার নাম কি? শ্যামলা মত, লম্বা, লালচে ধরনের চুল।

ইশরাত আপা।

ও আচ্ছা, ইশরাত আপা। উনাকে আমার ধন্যবাদ দিয়ে দেবেন। বলবেন খুব শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।

রইছুদ্দিন তাকিয়ে আছে। আতাহার রওনা হয়েছে রাস্তার দিকে। কোথায় যাবে এ ব্যাপারে সে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

জাপানের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নেয়া দরকার। জাপান-বাংলা সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্যে সাংস্কৃতিক দল কবে যাত্রা করছে জানা দরকার। দলের নেতা ময়না ভাই অতিশয় ধুরন্ধর ব্যক্তি। তাঁর কাছে নিয়মিত হাজিরা দেয়া দরকার। নয়ত শেষ মুহুর্তে দেখা যাবে তবলাবাদক হিসেবে অন্য কেউ চলে গেছে।

ময়না ভাইকে রাত এগারেটার আগে কখনো পাওয়া যায় না। তার বেশ কয়েকটা আডিডার জায়গা আছে। তার কোনটাতে কখন থাকবেন তা কেউ বলতে পারে না। তাকে পেতে হলে সব কাঁটা আস্তানায় একবার করে ঢু মারতে হবে। সবচে কাছের আস্তানা হল–বিজয় নগরে সিনেমার অফিস পাড়া।

আতাহারের শরীর ঝিমঝিম করছে। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। ময়না ভাইয়ের সন্ধানে যাবার আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে। নানরুটি-শিক কাবাব খাওয়া যায়। সস্তার দোকানোর নানরুটি এবং শিক কাবাব উপাদেয় হয় এবং অনেকক্ষণ পেটে থাকে–হজম হতে চায় না।

 

আতাহারের ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন। ময়না ভাইকে নিউ মুভিজের অফিস ঘরে পাওয়া গেল। টেবিলে পা তুলে চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। শুকনো মুখে অফিসের পিওন বসে আছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। চোখ ঈষৎ লাল। ময়না ভাই সিগারেট খান না, কিন্তু আজ তার ঠোটে সিগারেট। সবই খুব ভাল লক্ষণ। ময়না ভাই মদের ঘোরে যখন থাকেন তখন খুব ভাল থাকেন। সবার সঙ্গে অতি মধুর ব্যবহার করেন। আতাহারকে দেখে ময়না ভাই ধমক দিয়ে উঠলেন, তোর ব্যাপারটা কি রে আতা? একেবারে দেখি ফ্লাওয়ার অব ড়ুমুর হয়ে গেছিস? তুই আমার পিছে ঘুরবি, না। আমি তোর পিছে পিছে ঘুরব?

ময়না ভাই মহা বিরক্ত হয়ে সিগারেটে টান দিলেন। আতাহার হাসল। তিনি বললেন, খবরদার, দাঁত কেলিয়ে হাসবি না।

জাপানের ব্যাপারটা কিছু হয়েছে ময়না ভাই?

অবশ্যই হয়েছে। হবে না মানে? আমার নাম ময়না। যা ধরি ছাড়ি না। আঠারো জনের দল যাবে। এর মধ্যে তোকে নিয়ে সাতজন হচ্ছে ফলস। তোরা টোকিওতে গিয়ে যার যার পথ ধরবি।

ভিসা কবে হবে?

পনেরো তারিখে ভিসার জন্যে কাগজপত্র জমা দিব। তোর পাসপোর্ট হয়েছে?

না।

এখনো পাসপোর্ট হয়নি। আর তুই দাঁত কেলিয়ে হাসছিস? তিনদিনের ভেতর পাসপোর্ট বের করে আমাকে দিয়ে যাবি।

আচ্ছা।

একেকজন আমার জান ফানা করে দিচ্ছে আর তোর কোন হুঁস নেই। গরাজটা কার? তোর না আমার?

আমার।

বোস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

আতাহার বসল। ময়না ভাই আক্ষেপের গলায় বললেন, লোকজন আমাকে বলে–মানুষ পাচারের যন্ত্র। অথচ কেউ বুঝে না। আমি করছি দেশের সেবা। বেকার যুবক পার করে দিচ্ছি, তার হার্ড ফরেন কারেন্সি পাচ্ছে। দেশের উন্নতি হচ্ছে। আমি যা করছি তার নাম দেশসেবা। ঠিক কি-না?

ঠিক তো বটেই।

এটা তো তুই হাসিমুখে বললি–ঠিক তো বটেই। আবার আড়ালে গিয়ে বলবি শালা ফটিকাবাজ। বললেও কিছু যায় আসে না। আমি নিজের মত কাজ করি। যার যা ইচ্ছা আমাকে বলুক। যার ইচ্ছা শালা বলুক। তুই কিছু খাবি, আয়। মুখ শুকনা লাগছে।

কিছু খাব না। ময়না ভাই।

তোর মত বেকার যুবকদের শুকনা মুখ যখন দেখি তখন মনটা খারাপ হয়। ধান্দাবাজ্বি করে তোদের বিদেশে নিয়ে যাই। অন্যায় যা করি হিউমেনিটারিয়ান গ্রাউন্ডে করি। যাই হোক, শোন, চার লাখ টাকার জোগাড় করা। পারহেড আমি সাত করে নিচ্ছি। তোর অবস্থা তো জানি। তোর জন্যে চার। বাকি তিন জাপান গিয়ে দিবি। ভাবিস না। টাকাটা আমার পকেটে যাচ্ছে–খরচপাতি আছে। টাকা যা নেই। সবটাই খরচ হয়ে যায়। কাল রাতে বাসায় ভাত খেয়েছি কি দিয়ে জানিস?

কি দিয়ে?

ডালের চচ্চড়ি আর টেংরা মাছের ঝোল। ঢাকা শহরের যে রিকশাওয়ালা তার বাড়িতেও এরচে ভাল রান্না হয়। যাই হোক, আমার কোন কমপ্লেইন নাই। রিজিকের মালিক আল্লাহপাক। আল্লাহপাক যদি আমার জন্যে টেংরা মাছের ব্যবস্থা করেন–আমার তো করার কিছু নেই। ঠিক না?

জ্বি, ঠিক তো বটেই।

এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা জোগাড় করা। সবাই দিয়ে ফেলেছে, শুধু তুই বাকি।

চার লক্ষ টাকা আমি পাব কোথায় ময়না ভাই?

তুই কোথায় পাবি সেটা আমি কি জানি? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নে। জাপানে গিয়ে মাসে দেড় লাখ থেকে দুলাখ টাকা চোখ বন্ধ করে কামাবি। সাত বছরের মাথায় কোটিপতি। শুরুর ইনভেস্টমেন্ট সেই তুলনায় কিছুই না। চার জোগাড় করতে পারবি না?

মনে হয় না।

গাধামি করিস না। এই সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না। চান্স অব লাইফ টাইম। তোকে স্নেহ করি বলেই সুযোগটা দিলাম–আচ্ছা যা, তিন লাখ ব্যবস্থা করা। তোর শুকনা মুখ দেখে মায়া লাগছে। বাকিটা জাপানে চাকরি করে শোধ দিস। দুই পারবি না?

পারব।

গুড। এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা দিয়ে যাস। কবিতা লিখছিস তো?

হুঁ।

ভেরী গুড। সুকুমার বৃত্তির চর্চা রাখবি। টাকাটাই জগতের সব না। আসল হল আত্মা। আরেকটা উপদেশ দেই, মন দিয়ে শোনা–ফস করে জাপান যাবার আগে বিয়ে করে বসবি না। বউ নিতে পারবি না, কিছু হবে না–মাঝখান দিয়ে বেড়াছেড়া হয়ে যাবে। বরং জাপানে গিয়ে দেখেশুনে একটা জাপানি মেয়ে বিয়ে করতে পারিস। হাউস ওয়াইফ হিসেবে জাপানি মেয়ের তুলনা নেই। অসাধারণ। স্বামীর সুখের জন্য এরা জীবন দিয়ে দেয়। তাদের যতই অত্যাচার করা হোক, মুখে পুতুলের মত হাসি লেগেই থাকে।

ময়না ভাই উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখলেন। তার আড়ার স্থান বদলানোর সময় হয়েছে। তিনি এখন অন্য কোথাও যাবেন।

বাসায় যাব।

বাসায় যাবি তো বটেই–বাসাটা কোথায় বল, তোকে নামিয়ে দিয়ে যাই।

শ্যামলী লিংক রোড।

একেবারে উল্টো দিক। যাই হোক, চল নামিয়ে দিয়ে যাই।

ময়না ভাই ভাঙা লঙ্কর একটা মাইক্রোবাসে চলাফেরা করেন। মাইক্রোবাস ভাঙা হলেও তার জানালায় বাহারী পর্দাঁ। বাইরের কেউ গাড়ির ভেতরে কি হয় দেখতে পারে না। তার প্রয়োজন আছে–মদ্যপানের ব্যাপারটা ময়না ভাই বেশির ভাগ সময় গাড়িতে সারেন। চলন্ত অবস্থায় মদ্যপানের মজাই নাকি অন্য রকম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *