আজ বাইশ বছর ধরে একাদিক্রমে একটি সাপ্তাহিক সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গে আমি যুক্ত আছি। মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে এ-সময়টাকে একটা যুগ বলেও ধরা যায়। বর্তমান বিজ্ঞান-শাসিত পৃথিবীতে স্থান এবং কালের সংকীর্ণতা ঘটলেও ঘড়ির কাটা যেমন অনাদিকাল থেকে অধুনা পর্যন্ত সেই একই নিয়মে ঘুরে চলেছে, যুগের আঙ্কিক হিসেবটার বেলাতেও তাই। এখনও যখন বারো মাসে বছর গোনা হয়, সাত দিনে সপ্তাহ হিসেব করা হয়, এবং ষাট মিনিটে ঘণ্টা নির্ধারিত হবার নিয়ম আছে—যুগের বেলাতেই বা সেই পুরনো আইনটা চলবে না কেন?
শুনেছি যুগ নাকি আবার বদলায়ও, যুগের অদল-বদল আদিযুগ থেকেই হয়তো চালু আছে। যদি সত্যিই তার অদল-বদল হয় তো এত মগতিতে যে, তার নিরিখ সমসাময়িক ব্যায়োমিটারে ধরবার মত কোনও সূক্ষ্ম যন্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয় নি। এ বদল ধরা একদিন হয়তো পড়বে তুলনামূলক ইতিহাসের কেতাবে—তাও বহুযুগ পরে। সুতরাং আমি এখানে আমার যে অভিজ্ঞতার কাহিনী আপনাদের বলব তা যুগ-বদলের কাহিনী তো নয়ই, যুগের ইতিহাসও নয়। এগুলো নিছক কাহিনী হিসেবে উপাদেয় বলেই বলব। আর তার কোনও তাত্ত্বিক মূল্য উদঘাটন করার চেষ্টাও যেন কেউ না করেন। তত্ত্ব এক জিনিস আর কাহিনী আর এক জিনিস। তত্ত্ব নিয়ে বচসার অবকাশ থাকে। পণ্ডিতেরা তত্ত্ব নিয়ে বৃহদাকার গ্রন্থ রচনা করে থাকেন। সে তত্ত্বের টীকাকার ব্যাখ্যাকার যারা, তত্ত্ব-কন্টকে তাদেরও রাত্রের ঘুম আর দিবসের বিশ্রাম বিঘ্নিত হয় বলে শুনেছি। আমি নিষ্কন্টক না হলেও নিরুপদ্রব শান্তির পক্ষপাতী। তার উপর নানা মতাবলম্বী লেখক-লেখিকাদের নিয়ে আমার কাজ চালাতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি যা লিখব পাঠকবর্গ তা নিছক কাহিনী বলে ধরে নিলেই আমি খুশী হব। তা সত্যই হোক আর অসত্যই হোক।
বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয়ে লিখে গেছেন-সদা সত্য কথা কহিবে। আদালতে সাক্ষীকে সাক্ষী দেবার আগে সত্য বই মিথ্যা বলিব না বলে শপথ নেবার রীতি আজও প্রচলিত আছে। স্বাধীন ভারত-রাষ্ট্রের প্রতীক ত্ৰিসিংহ মূর্তির সঙ্গে স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে—সত্যমেব জয়তে। চারিদিকে এত সত্যের ছড়াছড়ির মধ্যে আমি অসত্য কাল্পনিক কাহিনী শোনাব এত দুঃসাহস আমার নেই। তবুও বলে রাখা ভাল আমি একটু কমবেশী ভেজালেরই ভক্ত।
কিছু খাদ না থাকলে সোনা যেমন উজ্জ্বল হয় না, কিছু ভেজাল না থাকলে আমাদের আজকের সমাজ-জীবনে লোকে দু-পয়সা করে খেতে পারত না। খাঁটি তেল-ঘির স্বাদ আজকের দিনে আমরা ভুলেই গেছি। আমি তাই এই যুগকে বলতে চাই ভেজালের যুগ। সুতরাং আমার এই কাহিনীর মধ্যে কিছু ভেজাল যদি থেকে থাকে তো আমি নাচার।
দিনলিপি রাখার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিল না। স্মৃতি ও শ্রুতির উপর নির্ভর করেই এ কাহিনী রচিত। স্মৃতির পটে কিছু ঘটনা ধরা ছিল, অনেক হারিয়ে গেছে। সেই হারিয়ে যাওয়া ফাঁকগুলি ভরাবার জন্য কিছু ভেজালের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এ কাহিনীর পাঠকদের কাছে তাই আমার অনুরোধ, হাঁসের মত নীর থেকে ক্ষীরটুকু শুধু বেছে নেবেন, তাহলেই সত্যাসত্যের দ্বন্দ্ব ঘুচে যাবে। যাই হোক—
আমি যে গল্প বলতে যাচ্ছি তা নিছক গল্পই, বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল চরিত্রকে নিয়ে। একজন জলধরদা, সম্পাদক জলধর সেন। অপরজন শরৎচন্দ্র। সে গল্প এখন থাক, গল্পের ভূমিকাটি বলে নিই। বর্মণ স্ট্রীটে দেশ পত্রিকার দপ্তরটি ছিল একেবারে নিরিবিলি জায়গায়, নিত্য শনিবার সমবয়সী সাহিত্যিক বন্ধুরা সমবেত হতেন। জোড়া দেওয়া টেবিলের উপর খবরের কাগজ পেতে সের খানেক মুড়ি ঢেলে নারকলবাতাসা-ছোলা-চিনাবাদাম সহযোগে আড্ডা বসত, সঙ্গে চলত পত্রিকা দপ্তরের নিত্য অনুপান চা ও সিগারেট।
কথায় কথায় ভারতবর্ষ সম্পাদক জলধরদার প্রসঙ্গ উঠতেই আমার ছাত্রজীবনে তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বৃত্তান্ত বললাম।
আমি তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল হায়দ্রাবাদবাসী এক শিল্পীর সঙ্গে, নাম সুকুমার দেউস্কর। বিখ্যাত শিল্পী শশী হস-এর তিনি বংশধর। ইটালীতে কিছুকাল থেকে, সে-দেশের তেল রঙে প্রোট্রেট আঁকার যাবতীয় পদ্ধতিতে তিনি তখন সিদ্ধহস্ত।
রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলা সাহিত্যে মধ্যগগনের সূর্য, শরৎচন্দ্র নৈশগগনের একশ্চমোহস্তি।
শরৎচন্দ্রের জয়ন্তী উৎসব ঘটা করে করবার উদ্যোগ চলছে। শিল্পী বন্ধু সুকুমারদা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ভক্ত পাঠক, এই উপলক্ষে তিনি কাঠের উপর তেলরঙ দিয়ে শরৎচন্দ্রের একটি জবরদস্ত পোট্রেট একে আমায় বললেন–এই সময়ে কলকাতার কোনো পত্রিকায় ছবিটা ছেপে দাও।
মনে পড়ল ভারতবর্ষের কথা। শরৎচন্দ্র ভারতবর্ষের নিয়মিত লেখক, তাছাড়া সম্পাদক জলধর সেনের তিনি খুবই প্রিয়পাত্র। ছবিখানি হাতে করে সটান চলে এলাম কলকাতায়, একেবারে ভারতবর্ষের অফিসে।
এর আগে জলধরদাকে দূর থেকে শুধু চোখে দেখেছি, সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। একবার রবিবাসরের সভ্যদের রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আহ্বান করেছিলেন। সেই সময়ে বহু সাহিত্যিক সমাগম হয়েছিল, জলধরদাও এসেছিলেন।
ভারতবর্ষ অফিসে এসে সসঙ্কোচে ভয়ে ভয়ে জলধরদার কামরায় ঢুকলাম। প্রশান্ত মূর্তি জলধরদা অর্ধনিমীলিত চোখে ইশারায় সামনের চেয়ারটিতে বসতে বলেই জিজ্ঞাসা করলেন—অভিপ্রায়?
—শরৎবাবুর একটা রঙীন পোট্রেট এনেছি, একবার যদি দেখেন। খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে ছবিটি তার হাতে তুলে দিলাম।
ছবিটি হাতে নেওয়া মাত্রই জলধরদার চোখ-মুখের সেই প্রশান্ত ভাব নিমেষে একটা বিরক্তিমাখা অপ্রসন্নতায় ভরে উঠল। দুহাতে ছবির দুটো ধার ধরে একবার চোখের কাছে নিয়ে আসেন, আবার দুই হাত সটান সামনের দিকে প্রসারিত করে দূরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন। ভাবের অভিব্যক্তির আর কোন পরিবর্তন নেই। তার পরেই ছবিটাকে উল্টো করে ধরে কুঞ্চিত তন্ময়তায় কি যেন একটা খুঁজে বার করবার জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন। তাঁর দুই হাতের কবজিগত ছবিটা ততক্ষণে আমার উৎকণ্ঠিত মনে পরিণত হয়েছেমুঠোর নিষ্পেষণে কণ্ঠাগতপ্রায়।
অবশেষে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব মুখে এনে ছবিটা টেবিলের উপর ধপাস করে ফেলে জলধরদা বললেন—
না হে, ও আমার কম্মো নয়। আনুক হরিদাস, এ-সব শান্তিনিকেতনী আট ও-ই বুঝবে ভালো।
ক্ষীণ কণ্ঠে সভয়ে আমি বললাম-আজ্ঞে না। এটা শান্তিনিকেতনী আর্ট নয়, কন্টিনেন্টাল আর্ট। একেবারে মডার্ন ইটালিয়ান স্কুল।
গর্জন করে উঠলেন জলধরদা।–এসব ইস্কুলের ছেলে ছোকরাদের ছবি তা আমার কাছে এনেছ কেন? মৌচাক শিশুসাথীতে গেলেই তো পারতে?
বুঝলাম প্রতিবাদ করা বৃথা। আসুন হরিদাসবাবু, অর্থাৎ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র হরিদাস চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষ পত্রিকার অন্যতম কর্তা। তার কাছেই নিবেদন পেশ করা যাবে। ততক্ষণে জলধরদা আবার সেই সৌম্য শান্ত মূতিতে ফিরে গেছেন, সেই অর্ধনিমীলিত চোখ। নির্বিকার, নিরাসক্ত।
চুপচাপ বসেই আছি, আরও কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানি না। আমারও জেদ চেপে গেছে, একটা কিছু না করে আর নড়ছি নে। আসুন হরিদাসবাবু।
এমন সময় ছড়ি হাতে দীর্ঘাঙ্গ এক প্রৌঢ় ঘরে ঢুকেই বোমাফাটার মত চিৎকার করে উঠলেন—এ কী জলধরদা, আপনি বলেছিলেন এ-মাসেই আমার গল্পটা ছাপা হবে কিন্তু পত্রিকায় তো গল্পটা দেখলাম না?
চেয়ারে এলায়িত দেহটা ততক্ষণে খাড়া করে জলধরদা বললেন–তা আমার কি দোষ। ছাপবার জন্যে প্রেস-এ তো দিয়েছিলাম।
প্রেস-এ দিয়েছিলেন তা তো আমিও জানি। তবে ছাপা হল না কেন? গল্পের কোথাও অশ্লীলতা কিছুই তো ছিল না।
তা ছিল না, তবে ফুটকি ছিল, প্রেস-এ অতো ফুটকি নেই। হরিদাসকে বলে ফাউণ্ডিতে একপো ফুটকির অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এলেই ছাপা হবে।
শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত জলধরদার মুখাবয়বে আবার সেই তৃষ্ণভাব, নির্বিকার নিরাসক্ত। আগন্তুক ভদ্রলোক এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ঝিম মেরে গেলেন। কোথায় গেল সেই দাপট, কোথায় সেই আস্ফালন। মাজায় বাড়িখাওয়া কুকুরের মত কেঁউ-কেঁউ করে তিনি বললেন—ফুটকিগুলো কেটে দিলেই তো পারতেন।
জলধরদা যেন সমাধিস্থ অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বললেন, তোমাদের এই ফুটকি-রহস্যের আজও আমি কোন হদিস করতে পারলাম না। ওই ফুটকির মধ্যে কী যে অকথিত কথা থাকে তা তুমিই জানো আর জানে তোমার পাঠকরা। প্রিন্টার এসে গোল বাধায়, বলে ফুটকি নেই, ফুটকি চাই।।
আমার এই গল্পে এখানেই বাধা পড়ে গেল। আড়র এক বেরসিক বন্ধু আর অপেক্ষা করতে না পেরে বলে বসলেন-এ নিশ্চয় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়।
উত্তর দেবার আগেই সমস্বরে আর সবাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–আরে মশাই এ-যে সৌরীন মুখুজ্যে সে কি বলে দিতে হবে? বলে যান তারপর কি হল?
আমি দেখলাম প্রতিবাদ করা বৃথা। তাছাড়া আমার গল্প তো সেই লেখককে নিয়ে নয়, আমার গল্পের নায়ক সেই ছবি, তাও আবার শরৎচন্দ্রের। শরৎচন্দ্রের সেই অয়েল-কালার পোট্রেট-এর কি দশা, অথবা দুর্দশাই হল সেই কথাই বলছি।
টেবিলের উপর পড়ে থাকা শরৎচন্দ্রের উপর ফুটকি সাহিত্যিকের ততক্ষণে নজর পড়েছে। মুহুর্তের মধ্যে ছবিটা টেনে নিয়ে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন করলেন–এ কী জলধরদা, শেষে কি বুড়ো বয়সে চরিত্তির খোয়াবেন? এ-সব উগ্র আধুনিক আর্ট আপনার টেবিলে?
না হে, ওটা শরৎচন্দ্র। এই ছোকরা এনেছে ছাপবার জন্যে। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সোজা করে ধরলে মনে হয় আকাশের সাদা মেঘ, উল্টো করে ধরলে আমাদের মেছুয়াবাজারের পাকা দাড়িওয়ালা বুড়ো কলিমুদ্দি দপ্তরীর চেহারাটা ভেসে ওঠে। শরৎচন্দ্র যে এর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছেন খুজে পেলাম না। তাছাড়া বুড়ো হয়েছি, চোখের দৃষ্টিও কমে এসেছে।
বলা বাহুল্য শরৎচন্দ্রের সাদা চুল এ-ছবির অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছিল।
এর পরে আর আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সমীচীন নয়। যদিও এই ছবি প্রসঙ্গে দুই সাহিত্যিকের মন্তব্যে কৌতুকবোধ করছিলাম এবং এই রঙ্গমঞ্চে হরিদাসবাবুর আবির্ভাব হলে আরও কিছু নতুন মন্তব্য শোনাতে পারতাম। কিন্তু আর অপেক্ষা করা যায় না। এদিকে বেলা তখন বারোটা পার। স্নান-খাওয়া কিছুই হয় নি। বিকেল চারটার গাড়িতে আবার আমায় শান্তিনিকেতনে ফিরে যেতে হবে। সন্তর্পণে ছবিটা প্রবীণ সাহিত্যিকের হাত থেকে উদ্ধার করে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়তে মুড়তে আর অধিককাল অপেক্ষা করার অসুবিধার কথা জানিয়ে বিদায় চাইলাম।
নিমেষে জলধরদার করুণাঘন দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ হল। সহানুভূতিমাখা কণ্ঠে বললেন—সে কী, সেই ভোরে রওনা হয়ে স্টেশন থেকে সোজা এসেছ, কই, সে কথা এতক্ষণ বলে নি কেন?
কথা বলতে বলতে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে কোটের এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে একটা আধুলি টেনে বার করেই বেয়ারাকে হাঁক দিলেন—যা দৌড়ে যা, কচুরি আর ভালো ভালো সন্দেশ নিয়ে আয়।
অতি কষ্টে নানা অজুহাত দেখিয়ে জলধরদাকে নিবৃত্ত করলাম। বুঝলাম আত অভুক্ত হতাশ চেহারাটা ওকে ব্যথা দিয়েছে। ছবিটা বগলদাবা করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই জলধরদা অনুনয়ের সুরে বললেন–কিছু খেয়েদেয়ে হরিদাসের জন্য আর একটু অপেক্ষা করে গেলে হত না? ও আজকালকার ছেলে, ছবিটা ওর হয়তো পছন্দ হত।
ইতিমধ্যে আগন্তুক সাহিত্যিক আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন–তুমি ত শান্তিনিকেতনের ছেলে। জলধরদার ইচ্ছে রোববাবুর নাম করে রামানন্দ চাটুজ্যেকে ধরে ছবিটি প্রবাসীতে ছেপে দাও। তবেই রগড় জমবে।
হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন জলধরদা। বয়েস হয়েছে, আক্কেল হল না? রসিকতারও তো একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে।
জলধরদার গর্জন শুনতে শুনতে আমি ততক্ষণে রাস্তায় নেমে পড়েছি।
আমার কথা শেষ হতেই একজন প্রশ্ন করলেন-ছবিটা কি শেষ পর্যন্ত আর ছাপাই হয় নি?
হয়েছিল বাতায়ন পত্রিকায়, শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর। ছবিটা তারিফও পেয়েছিল খুব।
গল্প বলতে বলতে কখন যে টেবিলের মুড়ি-নারকল সাবাড় হয়ে গেছে টেরও পাই নি। অক্ষেপ জানিয়ে বললাম-–জলধরদার কচুরি-সন্দেশ খাওয়া হল না আর সেই গল্প বলতে গিয়ে মুড়ি-নারকল থেকে বঞ্চিত হলাম।
ফল হল। আড্ডাধারী বন্ধুদের মধ্যে একজন সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা মুড়ি-তেলেভাজা তৎসহ আরেক প্রস্থ চায়ের জন্য বেয়ারার হাতে টাকা দিয়েই প্রশ্ন করলেন
আচ্ছা, জলধরদা যে কানে খুবই কম শুনতেন সে-কথা তো আপনি বললেন না?
অবাক হয়ে বললাম—কই আমি তো তার কোন পরিচয় পাই নি।
বন্ধুটি মৃদু হেসে বললেন—এখন বুঝতে পারছি লোক বিশেষে তিনি কানে কম শুনতেন। সেটাই ছিল তাঁর ট্যাকটিক। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বলছি।
সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম আরেকটি গল্পের গন্ধ পেয়ে। বন্ধুবর বললেন–
আমি তখন আশুতোষ কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, কলেজ মাগাজিনে একটা গল্প লিখে সুনাম হয়েছে। ক্লাসের বন্ধুরা উৎসাহ দিয়ে বললেনামকরা কাগজে তুই লেখ, নিশ্চয় ছাপা হবে। একদিন কলেজের পর সাইকেলটা নিয়ে সোজা গেলাম ভারতবর্ষ অফিসে জলধরদার কাছে। একটি গল্প দিয়েই চলে এলাম। একমাস যায়, দুমাস যায় তৃতীয় মাসও গেল। গল্পের আর কোন পাত্তা নেই। চতুর্থ মাসে আবার সাইকেলে করে ভারতবর্ষ অফিসে। জলধরদার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-চার মাস আগে একটা গল্প দিয়েছিলাম, সেটা কি আপনার মনোনীত হয় নি?
জলধরদা টেবিলের উপর ঝুকে পড়ে ডান কানের পিঠে হাত রেখে বললেন–
কি বললেন? শরীর? সঙ্গমে এসে পড়েছি। এখন মহাসমুদ্রে বিলীন হলেই হয়।
বুঝলাম, আমার প্রশ্ন শুনতে পান নি। তাই আরেকটু গলা চড়িয়ে আমার লেখার কুশল প্রশ্ন করলাম।
–লেখা? লেখা-টেখা সব এখন বন্ধ। বয়েস হয়েছে, চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। নতুন লেখায় আর হাত দিতে পারছি না।
বন্ধু বললেন–আপনারাই বলুন, এরপর গল্প সম্বন্ধে আর কি প্রশ্ন করা চলে? নতুন লেখকদের প্রতিষ্ঠা লাভের একমাত্র চাবিকাটি সহিষ্ণুতা। আমিও তাই আর তৃতীয়বার ট্রাই না করেই নমস্কার জানিয়ে বিদেয় হলাম। পরের মাসেই দেখি গল্পটি ছাপা হয়েছে।
সবাই সমস্বরে হেসে উঠলাম। জলধরদার ট্যাকটিক-এর বলিহারি। নতুন লেখকদের কেন গল্প অমনোনীত করেছেন এই প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাবার এক মোক্ষম উপায়। মুড়ি-তেলেভাজা এসে গেছে, আমিই সর্বাগ্রে সক্রিয় হয়ে সৎকারে লেগে গেলাম। জোড়া টেবিলের পূর্বপ্রান্তে এতক্ষণ যে সাহিত্যিকবন্ধুটি নীরবে বসে এইসব খোশগল্প শুনে যাচ্ছিলেন তিনি একজন কবি, বয়সে আমাদের মধ্যে তরুণতম। এবার তিনি মুখ খুললেন।
-শুধু জলধরদাকে এই ট্যাকটিকসের জন্য দোষ দিলে চলবে কেন। এরকম ট্যাকটিকস্ আরও একজন সম্পাদককে এবং হালফিলের সম্পাদককে আমি নিতে দেখেছি।
সবিস্ময়ে আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকালাম। অর্থাৎ কে তিনি?
কবি বন্ধু বললেন–বেশী দিনের কথা নয়। তখন আমি দু-একটা কবিতা লিখলেও ছোট গল্পই বেশী লিখতাম। কোন একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদকের দপ্তরে একটি গল্প পাঠিয়ে দু মাস বাদে সম্পাদকের অফিসে খোঁজ নিতে গিয়েছি। সেই আমার প্রথম সম্পাদকের কাছে যাওয়া, তাই দুরুদুরু বক্ষে গল্পর কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি টেবিলের ওপরে কাগজের ঠোঙায় রাখা একগাদা পানের মধ্যে থেকে দুটি পান মুখে পুরলেন, পকেট থেকে জদার কৌটো বার করে এক খাবলা মুখে ফেলে সেই যে ধ্যানস্থ হয়ে জাবর কাটতে লাগলেন আর স্পীক-টি নট।
আবার জিজ্ঞাসা করলাম—আমার দুমাস আগের দেওয়া গল্পটা?
ধ্যানীবুদ্ধের মত দক্ষিণ হস্ত তুলে বরাভয়ের মুদ্রা দেখিয়েই আবার তিনি গালভরতি পান জর্দার রস উপভোগে মগ্ন হলেন। আবার প্রশ্ন, আবার সেই হস্ত প্রসারণ। ট্রামের মান্থলি টিকিট দেখালে কনভাকটার যেমন হাত তুলে আশীর্বাদের মুদ্রা দেখিয়ে জানায় ঠিক হ্যায়, এও তেমনি, ততক্ষণে আমার মেজাজ তিরিক্ষি। আমারও জেদ চেপে গেল, একটা কিছু উত্তর না নিয়ে ছাড়ছি নে। আবার বললাম, গল্পটার কি করলেন বলুন।
এবারে সম্পাদক মহাশয়ের ধ্যান ভাঙ্গল। বুঝলেন, এ ছোকরা সহজে নড়বার পাত্র নয়। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে উঠলেন, বারান্দায় গেলেন, পানের পিক ফেললেন, ঘরে এসে খানিকটা জল খেয়ে বললেন–
পিক্ সেই ফেললেনই। সবে দুমাস হয়েছে, আরও একমাস যাক তখন জানতে পারবেন।
বিনা বাক্য ব্যয়ে চলে এলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই পত্রিকা অফিসের পিয়ন বাড়ির দরজায়। হাতে একটা খাম। আমার সেই গল্প আর তার সঙ্গে সম্পাদকের এক দীর্ঘ পত্র।
আমাদের মধ্যে একজন বললেন–সেই ছাপানো চিঠি তো? যাতে লেখা থাকে-রচনাটি অমনোনীত হওয়ায় দুঃখের সহিত ফেরত পাঠাঁইতে হইল। আশাকরি ভবিষ্যতে আপনার সহানুভূতি হইতে বঞ্চিত হইব না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবিবন্ধু বললেন–ঠিক তা নয় তবে তার কাছাকাছি। সম্পাদকের স্বহস্ত লিখিত সেই চিঠির মোদ্দা কথাটা হচ্ছে গল্প লেখা কস্মিনকালেও আমার দ্বারা হবে না। কবিতাতেই নাকি আমার স্বাভাবিক ফুতি তাই কবিতাই যেন আমি লিখি। তারপর আর কোনদিন গল্প লিখি নি।
গল্প শুরু করেছিলাম শরৎচন্দ্র ও জলধরদাকে নিয়ে। কিন্তু প্রস্তাবনা করতে গিয়ে কথায় কথায় কোথায় এসে পড়েছি। গল্পটা শুনেছিলাম সেদিনের আড্ডাতেই আমাদের এক কথা সাহিত্যিক বন্ধুর মুখে। শরৎচন্দ্র একবার জলধরদাকে কি রকম জব্দ করেছিলেন। আজ থাক। গল্পটা বারান্তরে আপনাদের শোনাব।