আগাম দলের তিনটি নৌকা ভাটার টানে তরতর করে নেমে এল, পুবের কেষ্টপুরের খাল-গেট পেরিয়ে, নোনা বিলের পাশ কাটিয়ে। তিনটি বাছাড়ি নৌকা। এল পুব থেকে। খাড়া পুব থেকে নয়। পূব-দক্ষিণ থেকে। দুটি এল পুরোখোঁড়গাছি থেকে। আর-একটি ধলতিতা গাঁয়ের।
আরও আসছে পেছনে পেছনে। তেঁতুলিয়া, সারাপুল, পুরোখোঁড়গাছি, ফতুল্লাপুর, ফরিদকাঠি, বীরপুর, তাবৎ পুব-উত্তর আর পুব-দক্ষিণ ঠেঙিয়ে আসছে যাবৎ মৎস্যজীবীরা। জেলে, কৈবর্ত, নিকিরি, চুনুরি, মালা সবাই আসছে। ওদিককার রাজবংশীরাও কালে কালে মাটি হারিয়ে মৎস্যজীবী হয়েছে। তারাও আসছে।
তাড়িয়ে নিয়ে আসছে দখনে বাওড়। যাকে বলে, সমুদ্রের ঝড়। এখন নোনা গাঙে নিদেন কাল। মিঠে গাঙে সুদিনের বান ডাকবে।
আরও আসবে। আশেপাশে কাছ-ঘেঁষাঘেঁষি, পুঁড়্যা, আতুড়ে, ইটিণ্ডে, দণ্ডিরহাট, শাঁখচুড়া, টাকি-সবখানে সব মাছমারার ঘরে সাজো-সাজো রব পড়েছে। সবাই আসবে। একে একে। ডাইনে রেখে গোপালপুরের বিল-জল-জংলা, সুদূর পশ্চিমে রেখে সন্দেশখালি, হাসনাবাদের তলা দিয়ে আসবে।
ইছামতী দিয়ে এসে, হাসনাবাদের তলা দিয়ে নৌক নামবে তরতর করে। একে বলে পথের প্যাঁচ। জলপথের ঘূর্ণি। কোথায় নামছে? না, মঠবাড়ি, দুলদুলি হয়ে একেবারে সাহেবখালির মুখে, ঝিল্পে আর রাইমঙ্গলের মোহনায়। সেখান থেকে খেল্যের গাঙ রেখে দক্ষিণে, ডাইনে পড়বে। শুলকুনি গাঙ, ভবানীপুর কালীনগর ভিড়িয়ে। এবার ওপর দিকে মনের চোখ খুলে তাকালে দেখা যাবে, সাপের মতো আঁকাবাঁকা কতগুলি জটা পাক দিয়ে, কিলবিলিয়ে উঠেছে চব্বিশ পরগনার উত্তরে। এতক্ষণ ইছামতীর ভাটার টানে নেমেছে। হাল না মারলে, তাও ভাতসলা থেকে এক ভাটায় আসা যাবে না এতদূর।
তারপরে ন্যাজাট। ন্যাজাট থেকে এবার উত্তর-পশ্চিম কোণাকুনি, উঠবে এক গোনে, অথাৎ এক জোয়ারে। জোয়ার আসবে রাইমঙ্গলের বুক ড়ুবিয়ে। এক জোয়ারে এখন ধরা যাবে সন্দেশখালি। আবার আর-এক গোন। মিনোখাঁ ঠেকতে ঠেকতে ঠিক এসে পড়বে কুলটির গেটে। তখন থামতে হবে। এখানে চিঠি দেবে না, মানে টিকেট দেবে না। তবে দেখবে কীসের নৌকা, রকম কী তার, উদ্দেশ্য কী। হাঁটা পথের মার আছে, জলপথের সব আটঘাট বাঁধা। কত নৌকা গেল আর এল, কী গেল। আর এল, সব হিসেব থাকে খাল-গেটের দপ্তরের খাতায়। গেট খোলার আগে গুনে দেখবে নৌকা। যদি মনে হয়, আরও নৌকা আসার সম্ভাবনা আছে। তবে রইল গেট বন্ধ। সব ছাড়া হবে। তবে। কে বারবার গেট খোলে আর বন্ধ করে। মাছমারাদের আসবার পথে একরােত কাটবে কুলটি গেটে। তখনও রাইমঙ্গল আর বিদ্যোধরীর ধাক্কায় চলতে হয়। বরং ভাটা পড়ে গেলে একটু ফ্যাসাদ। পরের রাত কাটবে কেষ্টপুরের খাল-গেটে। সেই হল আসল গেট। লোহার শিকল দিয়ে যাবৎ জলযাত্রীর রাস্তা বন্ধ। একে বলে চেন-গেট। শুধু আটকানো যায় না। তাকে, যে বসত করে জলের তলায়। ডাঙার রাজা-উজিরের যে ধার ধারে না।
কেষ্টপুরের খাল-গেট হল কুতঘাট। এখানে কুত হবে, অর্থাৎ নৌকার মাপ হবে। কত বড় নৌকা, কত গহিন তার খোল, কত মাল্লা তার দাঁড়ে, বৈঠার হালে। সেই মাপে যা সরকারের মর্জিতে সাব্যস্ত হবে, তত পয়সা দিয়ে কাটতে হবে টিকেট। জলে জমিনে ফারাক নেই, খোদার ওপরে যারা খোদগিরি করে, তারা জলের পথও আটকায়।
এবার আর ইছামতী নয়, রাইমঙ্গল নয়, তার উঠানামার সীমানা পার হয়ে এবার গঙ্গার টানাপোড়েনের মধ্যে। তখন আবার নৌকা চলবে ভাটায়।
কেষ্টপুরের খাল-গেট পেরোলেই একটু ঝটিকা মারবে নোনা বিল। কেষ্টপুরের গেট পার হয়ে এসে বাঁয়ে থাকবে বামনধোপা, ভঙ্গিড়কাটা খাল এসে মিশবে একটু দক্ষিণে মোচড় দিয়ে। তারপর পশ্চিমে, সোজা উলটোডাঙার দিকে। সরকারি নথিপত্রে ওটার নাম নিউক্যানেল। জেলে-মাঝিরা উলটোডাঙার খাল বলেই জানে। গোটা তিন দিন লাগবে বাগবাজারের খাল-গোটে আসতে।
তার আগে, কেষ্টপুরের খাল-গেট পেরিয়েই, নোনা বিলের কোণে আসতেই, দূরে শহরের সীমানা দেখা যাবে। আকাশের গায়ে সব ছককাটা দাগের মতো।
আগের দিনে অনেকে আসত আবার বেলেঘাটার খাল দিয়ে। যদি খবর থাকত গোট বন্ধ, তবে ওই বিদ্যোধরীরই সব বেনামি ফালিফ্যাকড়া ধরে নামত তরতর করে। করাচি নদী দিয়ে চলে আসত বেলেঘাটার খালে। করাচি নদীর নাম ছিল গাপাতলা, কোমরজল নদী। হালে গেছে মাজে। খুঁড়িগাছির পাশ দিয়ে, শহর কলকাতার পুব ঘেঁষে আসা যেত একেবারে বাগবাজারের গেটে। এখন খালে পড়ার অন্ধিসন্ধি মজে গিয়ে ওই রাস্তা বন্ধ।
কেষ্টপুরের টিকেট দিতে হবে। আবার বাগবাজারে। তবে গঙ্গা! অগতির গতি। যাবৎ জীবনের জীবন-মরণ ধনদৌলত, সব কিছু নিয়ে মোঠাকরুন বসে আছেন গাঙের তলায়।
আসছে, সবাই আসছে। এদিকে। দিনে রাতে আসছে। চোখ থাকলে, উপরে উঠে একবার পুবে নজর করলেই দেখা যাবে, কত আসছে। একে একে, সারি সারি, পাশাপাশি। দক্ষিণের একেবারে নাবাল থেকে পাল তুলে দিয়েছে সবাই জোয়ারের টানে। যে যেখান দিয়ে পারছে, গঙ্গায় আসছে। সবাই। গঙ্গার ঘোলা। কিন্তু মিঠে জলে। সব মৎস্যজীবীর ভাত-কাপড় যার কাছে আছে বাঁধা।
সমুদ্রের দু মাইল দূরের কথা। কানাচে তিষ্ঠোবার উপায় নেই। সাগরের দুই হ্যাঁকার দরকার হবে না। এক হ্যাঁকাতেই ঘুঙরো বান দেখিয়ে দেবে। নৌকাসুদ্ধ নিপাত করবে তলায়। তাই হুতোশে সবাই আগের থেকেই সরে আসছে উত্তর-পশ্চিমে। ডায়মন্ড হারবার পার হয়ে আর জাল রাখবার উপায় নেই।
খাল বিল নালা দিয়ে এসে, গঙ্গায় পড়ে, কেউ থাকবে কলকাতার তল্লাটে। দক্ষিণে থাকবে কেউ। কেউ আসবে উত্তরে, বারাকপুর-বরানগরের তল্লাটে, এপারে ওপারে সেই চন্দননগর-জগদ্দল, হুগলি-নৈহাটি, দূরে ত্ৰিবেণী পেরিয়ে।
সব ছেড়ে সবাই আসবে গঙ্গায়। নোনা জল যেখানে নেই। মাতামতি নেই দক্ষিণ বাওড়ের। পুব-দক্ষিণের সমস্ত নোনা জলের ঘাঁটি ছেড়ে, গঙ্গার মিঠে জলের স্রোতে, খুঁটি পুঁতে নৌকার বাসা বাঁধবে সবাই।
বসিরহাটের আরও উঁচুতেও নোনা জল আসে। মাছও থাকে। তবে মাছ বলে কথা। যেমন তার মর্জি, তেমনি জলের মর্জি। সে কারুর প্রজা নয়। খাজনা-টেকসোর ধার ধারে না। জল যদি এল তো, এমন এল তোমার ঘর-বাড়ি খেত-খামার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। না এল তো কাঁদলেও দুফোঁটা আসবে না।
মাছ আরও স্বাধীন। ঠাকরুন নদীকে ভাল না লাগলে মাতলায় যাবে। ইছামতীকে মনে না ধরলে, গঙ্গার মোহনায় যাবে ঝাঁক বেঁধে। মায় পাঁজি-পঞ্জিকার আঁক-কষা কথাকেও ঠেলে ফেলে মীনেশ্বরী চলাফেরা করে। পাঁজি লিখলে মাছের ভাগ দশ। হল গিয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচ। নয়তো একেবারে দেড়া কিংবা দ্বিগুণ, পনের থেকে কুড়ি ভাগ।
পাঁচু হুঁকো টানছে আর ভাবছে। দুনৌকা পুরোখোঁড়গাছির আর সে নিজে ধলতিতার। তিন নৌকা বাগবাজারের মোড়ে বাঁধা পড়েছে। আরও চার নৌক তাদের আগে আগেই এসেছে। সাত নৌকা পাশাপাশি বাঁধা রয়েছে। ভাটা পড়ে গেছে। জোয়ার আসবে রাত দুপোহর গেলে। তখন বাঁধন খুলে উত্তরে যাত্রা করতে হবে। সাত নৌকা, সাত গুণ হবে দেখতে দেখতে। গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘরে-ঘরে যাত্রা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে সব। আজকাল বলে পাকিস্তানের বর্ডার, সেইখান থেকে সব আসছে। এদিকে। না এসে উপায় কী! চিরকাল আসছে, আসবেও। জন্ম থেকে দেখা এই পথ। পেট থেকে পড়ে যাওয়া-আসা। এর পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সারা তল্লাট তার নখদর্পণে। কত গাঙ মাজে গেল চোখের সামনে। কত বিল হেজে গেল। কত খাল শুকিয়ে, নয়ানজুলির মতো সরু নালা হয়ে গেল। তার উপরে হাড়ে দুবো গজাবার মতো, মাঠের বুকে সরু দাগ ছাড়া কিছু চোখেই পড়ে না। আবার নতুন নতুন খাল কাটা হয়েছে। আসবার পথ বন্ধ থাকেনি। থাকলে এদিকের চলে না, ওদিকেরও বারোমেসে টোটা হয়ে যাবে। টোটা হল মন্বন্তর।
পাঁচুর বাপের বয়স হল তিন-কম পাঁচকুড়ি বছর। দশ-বছর গঙ্গা দেখেনি। বলে, আমরা সবসময় কলকেতা ঘেঁষে যেতুম না। বড় চোর-বাটপাড়ের ভয় ছেল। ত্যাখন মুক্তাপুরের খালে ছেল জল। এত গেট-ফেট ছেল না। খেল্যের গাঙ দে বেরিয়ে, হাড়োয়া খালের ভেতর দে বোদাইয়ের পাশে মালতী বিল। মালতী আর বারুতীর বিল। তার সঙ্গে মুক্তাপুরের খাল। সেই খাল দে ভাটপাড়ার উতোর বেলে গে একেবারে গঙ্গায় পড়তুম। তাপর রেল নাইন হয়ে খাল-মাল সব বুজে যেতে লাগল। রাস্তাও বদলে গেল। …
পাঁচুর বয়সও কম হল না। তিনি কুড়িতে ধরল প্ৰায়। তবু এখনও ফি বছর বর্ষায় গঙ্গায় আসার কামাই নেই। থাকলে চলে না। পেট তো আর আলাদা করে রাখা চলে না। আর পেটিও একলার নয়। দোকলা পেটও নয়। গুষ্টি পেট। এই বুড়ো বয়সে নিজের দেড়গণ্ডা কুচো। বড় ভাইয়ের একগণ্ডা। বড় ভাই মারা গেছে আজ সাত বছর। মানুষ যেমন শক্ত ছিল, তেমনি কুটকচালে ছিল ঠিক মাছের মতো। পালাবার উপায় ছিল না মাছের। জলের আঁকার দেখলে ঠাওর করতে পারত, বাঁক কোন দিকে। লোকে বলত গুণ জানে। সত্যি জানত। নাম ছিল নিবারণ দাস। আসলে জাতে মালো। লোকে বলত সাইদার নিবারণ।
টানের মরশুমে দশ-বিশ গণ্ডা জেলে-মালো জুটিয়ে, ত্রিশ চল্লিশটি নৌকা আর পঞ্চাশ-ষাটটি জাল নিয়ে, যে সকলের হয়ে সদারি করে দক্ষিণে নিয়ে যেত মাছ ধরতে, তাকে বলে সাইদার। দক্ষিণে যাওয়া হল সমুদ্রযাত্ৰা।
পুব তল্লাটে কোনও মালো নিবারণের মতো এতবার সমুদ্রে যায়নি। সাইদার নাম হয়ে গেছল সেই থেকে। পাঁচু তার তিন কুড়ি বয়সে কুল্যে বার পাঁচেক গেছে। সমুদ্রে। প্রতিবারেই নিবারণের সঙ্গে। সে মনে-প্ৰাণে বিশ্বাস করে, তার দাদা গুণিন ছিল। জলের কারসাজি যেমন বুঝত, তেমনি বনের কারসাজিও ঠাওর করত ঠিক।
প্রথম যে বারে নিয়ে গেল পাঁচুকে, যাবার পথে বলে রেখেছিল। আগে থেকে, দ্যাখ পাঁচু, টানের সমুদুর, তাকে বিশেষ ভয় নাই। কিন্তু খবোদার, ডাঙার দিকে চোখ ফেরাসনে। ডাঙার তুক, বড় তুক। নোঙর ফেলে বসে আছিস গালে হাত দোঁ। শুনতে পাবি, কে যেন ডাকছে ডাঙা থেকে। ফিরে তাকে দেখবি, মানুষ, মেইয়ে মানুষ। ভারী অবলা জীব, বড় বিপদে পড়ে তোকে ডাকছে, ওগো ভাল মানষের ছেলে, ও মাঝি, বাঁচাও গো! আমার কেউ নাই গো! দেখবি, একপিঠ চুল, ফুটফুটে মুখখানি, ডাগর-ডাগর চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। আহা! পুরুষ মানষের পান তো। আমনি তোর বুকের মধ্যে হাঁকপাঁক করে উঠবে। সাত তাড়াতাড়ি নোঙর তুলে, হাল মেরে ছুটে যাবি, কেমন তো?…কিন্তুন খবোদার। যাস তো ওই যাওয়াই শেষ যাওয়া। আর কোনওদিন ফিরে আসতে পাবিনে। ডাঙায় নেবে দেখবি, ওই অবলা জীব কালান্তক যম। অ্যাত্তি নাম্বা শরীল। গেরিমাটি রং, গায়ে কালো কালো ডোরা। ইনি হলেন দক্ষিণ রায়। সোঁদর বনের রাজা। ডাঙার যত তুক, সব ওয়ার। কত যে ওয়ার ছদ্মবেশ। হিসেবে কুলিয়ে উঠা দায়। রাতবিরেতে, নয়তো সৌন্দর বনের পাশে, নোঙর করলে, ওয়ার নাম নিতে নাই। দক্ষিণ রায়ের আর এক নাম বড় শেয়াল। ডেকে নে গে মুণ্ডু ধড়ছাড়া করে মড়মড় করে চিবুবে।
শুনে পাঁচুর বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠেছিল। দক্ষিণে যাওয়া বড় যাওয়া। কথায় বলে, যমের দুয়ার দক্ষিণে। সমুদ্রে যাবার রেজিস্ট্রি অফিস পেরুলেই তাঁর রাজ্য। ফিরে আসা না আসা তাঁর হাত। দয়া করলে রেহাই নেই। ছাড়লে নেই। কেউ মারার। ফি বছরে দু-একজন থেকে যায়। সবাই যে ডাঙায় যায়, তা নয়। সমুদ্রের গর্ভে ও যায় কেউ কেউ। সেটাই যায় বেশি। বিশেষ মাছ-মারারা।
কিন্তু বড় ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে কোনওদিন কোনও বিপদ-আপদ ঘটেনি পাঁচুর, সব বিপদ মাথায় করে আগলেছে। গুণিন মানুষ। সব অন্ধিসন্ধি জানা ছিল তো!
তবে অপদেবতা নিয়ে কথা। গুণিনের তিন দিন। তার এক দিন। বাগে পেলে সে ছাড়বে। না। ছাড়েওনি। সাত বছর আগে শেষবার গিয়েছিল নিবারণ সাইদার। আর ফেরেনি।
বুকটার মধ্যে টনটন করে উঠল। পাঁচুর। তিনি কুড়ি বয়সের বুড়ো হয়েছে। তবু বুকের মধ্যে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে ছেলেমানুষ পাঁচু। কাঁদছে ফোঁসফোঁস করে। চোখে জল নেই। মুখে ভাব নেই। কান্নার কোনও শব্দ নেই। বাগবাজারের এই খালের মোড়ে, বাঁধা পোস্তার গায়ে শুধু দক্ষিণা বাতাসের ঝাপটা লাগছে। দক্ষিণা বাতাসের ঝাপটা লাগছে। পাঁচুর বুকে। দাদার আত্মা আছে যে ওই বাতাসে। …শ্ৰীরামের মতো দাদা ছিল যে, তার চেয়ে বড়, অত বড় দোসর আর পাঁচুর কেউ ছিল না। ছিল। পিঠোপিঠি। কিন্তু হাতে ধরে সব শিখিয়েছে পাঁচুকে। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। সবখানে। রাগ হলে দু-ঘা দিয়েছে। সোহাগ হলে চুলের মুঠি ধরে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। আর খালি বলেছে, বানচত, খা। খা বানচত। বেশি রেগে গেলে, শালা-সুমুন্দি করতেও ছাড়েনি। যা মুখে এসেছে, তাই বলেছে।
তার ওপরে গুণিন মানুষ। বলবেই তো! সবাইকে বলত। ক্ষমতা কতা! সমুদ্রের পটা-জাল ধরে যখন টান দিত, সেই জালে আর কেউ ছোল ধরে থাকলে বুঝত, নিবারণের হাত পড়েছে। নইলে এত টানের জোর কার। জালের সঙ্গে যে বাঁশ ভাসে তাকে বলে ছোল। আর হক দিত কী! ডাকাতের গলায় কুক পাড়া তার কাছে কিছু নয়। সুন্দরবনের দক্ষিণ রায় মশাইও চমকে উঠতেন। শাঁখের শব্দের মতো সেই হাক শুনে সমুদ্রের হ্যাঁকাও থিতিয়ে যেত যেন। হলই বা টানের হ্যাঁকা! সাগরের তেজ কখনও কম নয়। সাত বছর আগে সেই মানুষ গেল দক্ষিণে। আর ফিরল না।