০১. আকাশের দিকে তাকালে

আকাশের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়।

অবিকল দেশের মতো মেঘ করেছে। চারদিক অন্ধকার করে একটু পরেই যেন কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হবে। আনিস কফি খেতে যাচ্ছিল। আকাশ দেখে তার খানিকটা মন খারাপ হয়ে গেল। বড্ড নষ্টালজিক মেঘ।

এ্যাণ্ডারসন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পার্কিং লটের দিকে এগোচ্ছিল। আনিসকে দেখে থমকে দাঁড়াল, সরু গলায় বলল, এখনো বাড়ি যাও নি? প্রচণ্ড থাণ্ডারস্টর্ম হবে। ওয়েদার সার্ভিস স্পেশাল বুলেটিন দিচ্ছে।

কফি খেয়েই রওনা হব।

লিফট চাও? লিফট দিতে পারি।

না, লিফট চাই না।

এ অঞ্চলে ঝড় বৃষ্টি বড়ো একটা হয় না। সে জন্যেই সম্ভবত লোকজনদের ভয় একটু বেশি। দেখতে দেখতে ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করেছে। কফি হাউসে মোটেই ভিড় নেই। উইক-এণ্ডে এ-রকম থাকে না কখনো! মেয়েরা সেজোগুজে বসে থাকে। ছেলেরা আসে ডেটের কথা পাকাপাকি করতে।

আনিস কফির পেয়ালা নিয়ে বা দিকে এগিয়ে গেল। কফি হাউসের শেষ মাথায় চার-পাঁচটি ছোট-ছোট ঘর আছে। তিন নম্বর ঘরটি আনিসের খুব প্রিয়। দারুণ ভিড়ের সময়ও সেটি ফাঁকা থাকে। আজ পুরো কফি হাউস ফাঁকা, কিন্তু সেখানে এক জন বুড়ি বসে আছে।

আমি কি এখানে বসতে পারি?

বুড়ি সম্ভবত ঘুমুচ্ছিল। আনিসের কথায় নড়েচড়ে বসল।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

বসার পরই আনিসের মনে হল কাজটি ভাল হয় নি। আমেরিকান বুড়িগুলো কথা না বলে থাকতে পারে না। ভ্যাজর ভ্যাজার করে দশ মিনিটের মধ্যে মাথা ধরিয়ে দেয়।

তুমি ইণ্ডিয়ান নিশ্চয়ই।

না, আমি ইণ্ডিয়ান নই।

তুমি কি মালয়েশীয়ান?

না, আমি বাংলাদেশী।

সেটি কোথায়?

ইণ্ডিয়া ও বার্মার মাঝামাঝি একটা ছোট দেশ।

কত ছোট?

বেশ ছোট। নর্থ ডাকোটার অর্ধেক হবে।

বুড়ি খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল আনিসকে। দাম ফুরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করবে।

তুমি কি শুনেছি, সিভিয়ার থাণ্ডারস্টর্ম হবে। স্পেশাল বুলেটিন দিচ্ছে দুপুর থেকে।

হাঁ শুনেছি। খুবই খারাপ ওয়েদার।

তুমি কি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র?

না, আমি এখানকার এক জন টীচার।

কোন সাবজেক্ট?

কেমিস্ট্রি। পলিমার কেমিস্ট্রি।

আনিস বড়োই বিরক্তি বোধ করতে লাগল। বুড়িগুলির কৌতূহল সীমাহীন। এরা মানুষদের বড্ড বিরক্ত করতে পারে। বুড়িটি তার ব্যাগ থেকে সিগারেট বের করল। লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, তুমি কি এমিলি জোহানের নাম শুনেছ?

না। কে সে?

এখানকার এক জন বড়ো কবি। গত বৎসর রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড পেয়েছে।

না, আমি তার নাম শুনি নি। লিটারেচারে আমার তেমন উৎসাহ নেই।

বুড়ি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে তার হাত বাড়িয়ে দিল।

আমি এমিলি জোহান। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।

আনিস হকচকিয়ে গেল। বুড়ি থেমে থেমে বলল, সমস্ত কফি হাউস ফাঁকা, আর তুমি বেছে বেছে আমার এখানে বসতে এসেছ দেখে ভাবলাম হয়তো আমাকে চেন, গল্প করতে চাও। বুড়িদের সঙ্গে ইচ্ছে করে কে আর বসতে চায় বল?

আনিস ঠিক কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু একটা বলা উচিত।

তুমি কিন্তু তোমার নাম বল নি এখনো।

আমার নাম আনিস সাবেত। তোমার মতো বড়ো কবির সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল।

বুড়ি গলার স্বর নামিয়ে ফেলল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, মোটেই বড়ো কবি নই। রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড হচ্ছে একটা সস্তা ধরনের পুরস্কার। এখন পর্যন্ত কোনো বড়ো কবি রাইটার্স গিল্ড এওয়ার্ড পায় নি। আমি যখন পেলাম তখন এত মন খারাপ হল যে বলার নয়। বুঝতে পারলাম যে আমি এক জন সস্তা ধরনের কবি, থার্ড রেট।

বুড়ি উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে কি আমার আবার দেখা হবে?

আনিসের উত্তর দেবার আগেই সে থেমে থেমে বলল,

ওয়ান ফ্লিউ টু দা ইস্ট
ওয়ান ফ্লিউ টু দা ওয়েস্ট।
এ্যাণ্ড ওয়ান ফ্লিউ ওভার দা কাক্কুস নেস্ট!

আনিস অনেকক্ষণ বসে রইল একা একা! এখান থেকে বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে না, তবে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তা চোখে পড়ে। কত তফাৎ! ঝমোঝম শব্দ নেই, গাছের পাতার শনশনানি নেই, ব্যাঙ ডাকছে না। বোঝার কোনোই উপায় নেই যে বাইরে আকাশ অন্ধকার করে ঝড়ো হাওয়া বইছে।

এ্যাটেনশন প্লীজ এ্যাটেনশন প্লীজ। কফি হাউস দশ মিনিটের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এ্যাটেনশন প্লীজ।

কফি হাউস থেকে বেরিয়ে মনে হল বড্ড বোকামি হয়েছে। অনেক আগেই বাড়ি ফেরা উচিত ছিল। ভালো ঝড় হচ্ছে। লোকজন কোথায়ও নেই। পার্কিং লাট ধু ধু করছে। আনিস মেমোরিয়াল লাউঞ্জে চলে গেল। মেমোরিয়াল লাউঞ্জে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা আছে। একটি প্রকাণ্ড ভিক্টোরিয়ান পিয়ানো আছে। হট চকলেট এবং পেপসির দুটি ভেণ্ডিং মেশিন আছে। অবস্থা তেমন খারাপ হলে সেখানকার সোফায় আরাম করে রাত কাটান যাবে।

লাউঞ্জের শেষ প্রান্তে একটি ছেলে এবং খুবই অল্পবয়সী একটি মেয়ে জড়াজড়ি করে বসে ছিল। ছেলেটি এক হাত দিয়ে মেয়েটির জামার হুঁক খোলবার চেষ্টা করছে। মেয়েটি বাধা দেবার একটি ভঙ্গি করছে এবং খিলখিল করে হাসছে। আনিস না দেখার ভান করে ভেণ্ডিং মেশিনের দিকে এগোল। এই সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। এখানে এরকম হয় না কখনো। হাজারো দুর্যোগেও এদের ইলেকট্রিসিটি ঠিকই থাকে। মনে হচ্ছে মেয়েটি উঠে আসছে সোফা থেকে।

তোমার কাছে কি সিগারেট আছে?

আছে।

আমি কি তোমার একটি সিগারেট ধার নিতে পারি?

আনিস সিগারেট বের করল। মেয়েটি ফস করে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। বাদামী রঙের ঢেউ-খেলান চুল মেয়েটির। টানা টানা চোখ। লাইটারের আলোর জন্যেই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, আনিসের মনে হল মেয়েটির মুখ যেন এইমাত্র কেউ তুলি দিয়ে এঁকেছে।

সিগারেটের জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।

ছেলে-মেয়ে দুটি পিয়ানোর আড়ালে চলে গেল। মেয়েটি অনবরত হাসছে খিলখিল করে। হাসির ধরন কেমন অসংলগ্ন। নিশ্চয়ই প্রচুর বিয়ার খেয়েছে। আনিস লম্বা হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। ইলেকট্রিসিটি এখনো আসছে না। ট্রান্সমিশন লাইন কোথায়ও পুড়েটুড়ে গেছে বোধহয়। মেয়েটির চাপা গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।

আহ্‌ কী অসভ্যতা করছ? হাত সরাও প্লীজ।

আবার খিলখিল হাসি। তারপর দীর্ঘ সময় আর কিছুই শোনা গেল না। বাইরে ঝড়ের বেগ বাড়ছে। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আনিস শুয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

 

ঘুম যখন ভাঙল, তখন ঝড় থেমে গিয়েছে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে। মেমোরিয়েল ইউনিয়ন আলোয় ঝলমল করছে। ছেলেটি নেই, মেয়েটি টেবিলে পা তুলে বসে আছে এক এক।

তোমার কাছ থেকে কি আমি আরেকটি সিগারেট নিতে পারি?

আনিস একটি সিগারেট দিল। মেয়েটি সিগারেট ধরিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে?

না। কেন বল তো?

গাড়ি থাকলে তোমাকে একটা লিফটের জন্যে অনুরোধ করতাম।

সরি, গাড়ি নেই আমার।

তুমি থাক কোথায়?

টুয়েলভ এ্যাভিন্যু।

তোমার সঙ্গে আমি টুয়েলভ এ্যাভিন্যু পর্যন্ত হেটে হেটে যেতে পারি, কি বল?

তা পার।

আমার বড্ড মাথা ধরেছে। মেয়েটি বা হাতে তার কপাল টিপে ধরল। আনিস বলল, তোমার ছেলে বন্ধুটি কোথায়?

ও আমার বন্ধু হবে কেন? কোথায় গেছে কে জানে? ওর সঙ্গে বকবক করেই তো আমার মাথা ধরেছে।

বৃষ্টি নেই। কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তায় নেমেই মেয়েটি খুব সহজ ভঙ্গিতে আনিসের হাত ধরল।

তোমার এ্যাপার্টমেন্টে কি টাইনানল আছে?

আছে।

মনে হয় আমার জ্বর আসছে। দুটি টাইনানল এবং গরম কফি খেতে পারলে হত।

আনিস কথা বলল না। মেয়েটির সত্যি সত্যি জ্বর আসছে। হাত বেশ গরম।

আমি কি তোমার এ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে এক কাপ গরম কফি খেতে পারি? রাত বেশি হয় নি, তাই জিজ্ঞেস করছি।

হ্যাঁ, খেতে পোর।

আমাকে আরেকটা সিগারেট দাও।

মাথা ধরা তাতে আরো বাড়বে।

আমি তাতে কেয়ার করি না। আমি কোনো কিছুতেই কেয়ার করি না।

তা ভালো।

ভালো হোক, মন্দ হোক, আমি কেয়ার করি না।

বাসার সামনে এসে মেয়েটি থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, এত বড়ো বাড়ি! এটা তোমার?

ভাড়া দিয়ে থাকি। নিজের নয়।

আমি ভেবেছিলাম তুমি স্টুডেন্ট।

না, আমি স্টুডেন্ট নই।

আনিস টাইনানল নিয়ে এল। পানির বোতল আনল। মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার জ্বর আসছে। তোমার কাছে থার্মোমিটার আছে?

না, থার্মোমিটার নেই।

তোমার গাড়ি থাকলে ভালো হত, আমাকে পৌঁছে দিতে পারতে।

আমি আমার এক বন্ধুকে টেলিফোন করছি। সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।

আমি কি তোমার এখানে এক রাত থাকতে পারি? ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার।

আনিস চুপ করে রইল। মেয়েটি থেমে বলল, কি, থাকতে পারি?

তা পার।

আমাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দাও। আমার বড্ড খারাপ লাগছে।

শোবার এই ঘরটি চমৎকার করে সাজান। মেয়েটি খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখল অনেকক্ষণ। তারপর খানিক ইতস্তত করে বলল, তুমিও কি শোবে আমার সঙ্গে?

না।

আরো শোবার ঘর আছে?

হ্যাঁ।

মেয়েটি পায়ের জুতা খুলল। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা ছিল, স্কার্ফ খুলে মুখ মুছল। তারপর খুব সহজভাবে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যি তোমার ইচ্ছা! হলে আমার সঙ্গে শুতে পার। আমি কিছুই কেয়ার করি না।

নাম কি তোমার?

মালিশা।

শুভরাত্ৰি মালিশা।

মালিশা কোনো জবাব দিল না। আনিস ভ্রূ কুঞ্চিত করে ভাবল, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না। এইসব হোবো শ্রেণীর মেয়েদের ঘরে থাকতে দিতে নেই। হয়তো একটি প্রস্টিটিউট। শহরের নষ্ট মেয়েদের এক জন। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মন খারাপ হয় শুধু।

টিভিতে জনি কার্সন শো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট কার্টার দাঁত বের করে কী ভাবে হাসে, তাই দেখাচ্ছে। আহা মারি কোনো অভিনয় নয়, এতেই স্টুডিওর লোকজন হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে। চ্যানেল ফোরে লেট নাইট মুভি শুরু হল। অর্থাৎ রাত বেশি। হয় নি! একটা এখনো বাজে নি। আনিস কফি বানোল। ঘুমুতে যাওয়ার আগে কফি খাবার এই একটি বিশ্ৰী অভ্যাস তার আমেরিকায় এসে হয়েছে।

মালিশা কি কফি খাবে? সম্ভবত না। মেয়েটিকে থাকতে দেওয়া ভুল হয়েছে। ড্রাগস-ট্রাগস খেয়ে এসেছে কিনা কে বলবে? হয়তো রাতদুপুরে চেঁচামেচি শুরু করবে!

আনিস ঘুমুতে গেল অনেক রাতে। বাতি নেভাবার ঠিক আগের মুহূর্তে মনে হল, আজ সন্ধ্যায় যে মহিলা কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁর নাম মনে পড়ছে না। চমৎকার একটি নাম। খুব সম্ভবত এম দিয়ে শুরু হয়েছে। নামটি মনে না-আসা পর্যন্ত কিছুতেই ঘুম আসবে না। ছটফট করতে হবে বিছানায়। পুরনো সেই রোগ আবার দেখা দিচ্ছে। স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ঘাড়ের পাশের রাগ দুটি ফুলে উঠছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? শফিক তো অনেক দিন ধরে আছে এইখানে, এত রাত্রে টেলিফোন করাটা কি ঠিক হবে?

হ্যালো শফিক? জেগে ছিলে?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার?

আচ্ছা শোন, তুমি কি এখানকার কোনো মহিলা কবিকে চেন? বেশ বয়স ভদ্রমহিলার।

শফিক বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, কী ব্যাপার আনিস ভাই?

কোনো ব্যাপার না, এম্নি জিজ্ঞেস করছি। ভদ্রমহিলার নাম এম দিয়ে শুরু।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী জন্যে?

আনিস লাইন কেটে দিল। শফিক এখন নিৰ্ঘাত আবার টেলিফোন করবে। কাজেই এখন প্লাগ থেকে টেলিফোন খুলে রাখা উচিত।

আনিসের সারা রাত ঘুম হল না। ঘুম এল ভোরবেলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *