০১. আকাশচুমুক পাহাড়

অর্জুন ও চারকন্যা – তিলোত্তমা মজুমদার

প্রথম সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০১৩

শ্রীমতী ভারতী চক্রবর্তী,
আমার মাকে

ঋণ

বুদ্ধদেব বসু, ইরাবতী কার্বে এবং নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী—যাঁদের মহাভারত বিষয়ক প্রবন্ধগুলি এই উপন্যাস রচনার সহায়ক।

এক

যতদূর চোখ যায়, আকাশচুমুক পাহাড়। ভারী মনোরম। আর সেই পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ বন। পাহাড়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে বোঝার উপায় নেই যে, ওই ঘন বনের আড়ালে আছে লোকালয়। ওখানে নাগ এবং গরুড় উপজাতির বাস।

নাগ এবং গরুড়েরা একসঙ্গে থাকে না। বহু বছর ধরে তারা পরস্পরের শত্রু। অনেককাল আগে এই পাহাড় অঞ্চলে দক্ষ নামে এক রাজা ছিল। দক্ষরাজার দুই মেয়ে। তাদের নাম কদ্রু ও বিনতা। মহামুনি কশ্যপের সঙ্গে রাজা দুই মেয়েরই বিয়ে দিল।

বোন হলে কী হবে, দুই বোনের মধ্যে একটুও ভাব ছিল না। বিশেষ করে কদ্রু ছিল ভারী ডানপিটে। ছোটবেলা থেকে সে সাপ ধরে বেড়ায়। তাদের পালে, পোষে। একটুও ভয় পায় না। গাছ-গাছড়া বনজঙ্গল বিষয়ে তার খুব আগ্রহ। সে নির্ভয়ে বনে বনে বেড়ায়। পশু-পাখিদের নজর করে। এমনি করে দেখতে দেখতে গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ সম্পর্কে সে অনেক কিছু জানতে পারল। পশুপাখিদের অসুখ করলে তারা নিজেরাই গাছের ফুল পাতা খায়। প্রকৃতিগত ক্ষমতাবলেই তারা সেইসব চিনে নেয়। কদ্রু সব দেখেশুনে অনেক লোকের অসুখ সারিয়ে তুলল। কশ্যপ মুনি খুশি হয়ে কদ্রুর প্রশংসা করতে লাগল। কদ্রু যেহেতু সাপ ভালবাসে, তাই কশ্যপ মুনি তাকে সাপের বিষ থেকে যে-ওষুধ হয়, তার প্রণালী শিখিয়ে দিল।

বিনতা শান্তশিষ্ট। ঘরকন্নার কাজ নিয়ে থাকতেই সে ভালবাসে। মেয়েরা শান্ত ও গৃহকর্মনিপুণ হলে লোকের ভাল লাগে। তাই বিনতা সবার তারিফ পেত। তার মতো লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না— এমনটি ভেবে বিনতা ভারী খুশি ছিল। কিন্তু কদ্রু তার বনবেড়ানো, সাপখেলানো স্বভাবের জন্য কোথায় নিন্দার ভাগী হবে তা নয়, উলটে স্বামীর কাছে বেশি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রশংসা পাচ্ছে, কদ্রুর ওষুধে সুস্থ হয়ে লোকে ধন্য ধন্য করে বলছে— যেমন মহাজ্ঞানী কশ্যপ, তেমনি কদ্রু তাঁর যোগ্য বউ। কেউ বলছে— পশু-পাখিদের তিনি কত ভালবাসেন। আর সাপেদের কেমন আদর করেন দেখেছ? যেন নিজের ছেলেপিলে।

লোকে ভক্তিতে, ভালবাসায় কদ্রুকে আর দক্ষরাজার মেয়ে বা কশ্যপ মুনির বউ না বলে নাগ-মা বলে ডাকতে লাগল। রাজার ডানপিটে মেয়ে হওয়ায় কদ্রুর অস্ত্রশিক্ষায় কোনও বাধা ছিল না। ছোটখাটো যুদ্ধের মোকাবিলা সে করতে পারত। দিকে দিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েরা সাধারণত ঘরের কাজ করে। সন্তানের জন্ম দেয়, লালন-পালন করে। তারই মধ্যে কেউ যদি একটু অন্যরকম হয়, কোনও বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে— কিছু নিন্দেমন্দ জুটলেও একদিন লোকে শতমুখে তার প্রশংসা করে বটে।

কদ্রুকে দেখে বিনতার ভারী ঈর্ষা হল। সে তা প্রকাশ করল না ঠিকই। কিন্তু মনে মনে জ্বলতে লাগল।

কশ্যপ মুনি কিন্তু তার দুই স্ত্রীকেই ভালবাসে। তারা দু’জনেই গর্ভবতী হল। দু’চারদিনের তফাতে দু’জনেরই একজোড়া করে ছেলে হল। বিনতার মন ঈর্ষাকাতর ছিল বলেই কিনা কে জানে, তার একটি ছেলে হল বিকলাঙ্গ। সে কাঁদতে লাগল। কশ্যপ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “দুঃখ কোরো না। বরং সুস্থ সন্তানকে ভাল করে মানুষ করো। দেখো, তোমার এই বিকলাঙ্গ ছেলে দেবশিশুর মতো। কী গায়ের রং! কী চোখ! সূর্যদেব ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন বলেই মানুষের কাজে লাগে এমন করে গড়েননি। আমি ওর নাম দিলাম অরুণ। আর তোমার এই ছেলে, শারীরবিদ্যার যতটুকু জ্ঞান আমার আছে, তাতে বলি, একে যত্ন কোরো, দেখো, এর মাথার আকার, শরীরের গড়ন, এর তীক্ষ্ণ নাক, তীব্র চোখ— সবকিছুই ঈঙ্গিত দেয়, এ শুধু মহাজ্ঞানী নয়, মহাবীর হবে। তুমি দুঃখ কোরো না।”

বিনতা স্বামী কশ্যপকে আর কিছু বলল না। এক রাত্রে, আকাশে চাঁদ উঠেছে, বনে জ্যোত্স্না ফুটেছে, পাপিয়া পিয়া পিয়া ডাকছে, পশুরা জ্যোৎস্নার রং-লাগা ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে বনের শোভা দেখছে, বিনতা অরুণকে বুকে তুলে ভাবল, যাব কী যাব না। বলব কী বলব না। অবশেষে সে দুয়োর খুলে, ছেলে কোলে কদ্রুর দরজায় এসে দাঁড়াল। কদ্রু দুই ছেলেকে দুধ খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, দুয়োর এঁটে দীপের আলোয়, কশ্যপের লেখা আয়ুর্বেদশাস্ত্র পড়ছিল। ভূর্জগাছের বাকলে তৈরি বই। পুঁইগাছের ফলের রসে বাঁশের কলম ডুবিয়ে লেখা। প্রথম প্রথম সে খেলাচ্ছলে সব করত। এখন জ্ঞানের নেশায় সে বুঁদ। বিনতা আস্তে ডাকল, “কদু, কদু!”

“কে?” কদ্রু দরজার দিকে তাকাল। কশ্যপের তপোবনে কোনও ভয় নেই। আর কদ্রু ভয় পাওয়ার মেয়েও নয়। কদু সম্বোধনেই সে বুঝেছে বিনতা এসেছে। অভ্যাসবশেই সে বলল— কে! বিনতা বলল, “আমি। বিনি।”

কদ্রু দোর খুলে বলল, “আয়।”

বিনতা ছেলে কোলে, কদ্রুর ছেলেরা যেখানে ঘুমোচ্ছে, তার পাশে বসে পড়ল। কদ্রু কোনও কথা না বলে পুঁথি পড়তে লাগল। সারা দিনে দু’বোনের কথাটি নেই। কদ্রুর সাপ কোনওভাবে আঙিনায় কি বিনতার রান্নাঘরে ঢুকে পড়লে বিনতা সঙ্গে সঙ্গে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়ে তাকে মেরে ফেলে। কদ্রু চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তখন। সেই বিনতা এমন নিশুতি রাতে কোনও দরকারেই যে এসেছে, তা বুঝতে কদ্রুর দেরি হল না। সে কোনও কৌতূহলও দেখাল না। যে এসেছে সে নিজেই বলুক তার আসার কারণ।

কিছুক্ষণ বিনতা কিছুই বলল না। শুকনো পাতা পুরু করে বিছিয়ে তার উপর তুলোর আস্তরণ দিয়ে কদ্রুর পুরনো কাপড়ে ঢাকা বিছানায় তার বাছারা শুয়ে আছে। ঘরের কোণে সারি সারি ছোট ছোট ঝাঁপি। ওতে কদ্রুর পোষা সাপ। দু’টি বড় তোরঙ্গ। তাতে কদ্রুর গাছ-গাছড়া। ওষুধ। শিশুর মল-মূত্র, সাপের আঁশটে গন্ধ, গাছপাতার বাস মিলেমিশে কদ্রুর ঘরের বাতাসে সৌরভী নেই। বিনতা পারতপক্ষে এ ঘরে আসে না। তার নিজের ঘর পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। পাথরের দেওয়ালে গোবরমাটির প্রলেপ মসৃণ। এ ঘরে তা কোথাও খসে পড়েছে। এই অগোছাল কটুগন্ধী ঘরে কশ্যপ কীভাবে সুখে কদ্রুকে আদর করে, বিনতা ভেবে পেল না। নিজের সাজানো-গোছানো ঘরখানির গর্বে সে বলল, “তোর ঘর ভারী নোংরা।”

কদ্রু বলল, “হুঁ।”

“মুনি নিশ্চয় এ ঘরে ঘেন্নায় কুঁকড়ে থাকেন আর কোনওক্রমে কাজ সেরে নিজের ঘরে চলে যান।”

“আমার তো মনে হয় তিনি বেশ স্বচ্ছন্দেই এ ঘরে সময় কাটান। তাঁর নিজের ঘরে তো সারাক্ষণ শিষ্যদের ভিড়। এ ঘরেই তিনি আমার সঙ্গে নানান আলোচনা করেন।”

“তাঁর বুঝি প্রাণ যায়।”

“জ্ঞানের চর্চা মানুষকে এমনই বিমোহিত করে রাখে যে, গলিত শবের পাশে বসেও সে তা অনায়াসে করতে পারে।”

“আসলে সবই কপাল রে কদু।”

“এর জন্য কপাল কীসের?”

“তুই যেমন খুশি ঘুরে বেড়াস, গেরস্থালিতে তোর মন নেই। তবু মুনি তোকে কত ভালবাসেন।”

“তুই রাজার মেয়ে বিনি, মহর্ষির বউ। গাঁয়ের বধূর মতো পুকুরঘাটে পতিনিন্দা তোকে মানায় না।”

“নিন্দা তো করিনি।”

“মহর্ষি স্বামী আমাদের দু’জনের প্রতিই মনোযোগী। আমি এত পেলাম তুই অত পেলি— এসব ভাবা উচিত নয়।”

“আমি কপালের কথা বলছিলাম। কত গোসেবা করি, কত পা টিপে দিই মুনির, সেই সেবার তিনি তীর্থে গেলেন, তুই রইলি তোর খেয়াল নিয়ে,আমিই তো গেসলুম তাঁর সঙ্গে তাঁকে রেঁধেবেড়ে দিতে, পূজার আয়োজন করতে। যাবার পথে কত কষ্ট করেছি। পায়ে কাঁটা ফুটেছে। রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়েছি। এমন জায়গা ছিল যেখানে শুকনো কাঠ জোটেনি। ভিজে কাঠ জ্বেলে ভাত রাঁধতে গিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হয়েছি। তা এত কষ্টের ভাগী আমি, পুণ্যের ভাগ তো পেলাম না।”

“পুণ্য কি ওমনি সাদা চোখে বোঝা যায়? জীবন যখন ফুরিয়ে আসবে, তখন ওসবের মাপামাপি হবে। আর আমি যে তপোবনে থেকে গেসলুম, তা কি এমনি? স্বামী ঋষির শিষ্যদের কে খেতে দিত? কে তাদের পড়াত? গোরু-ছাগলের যত্ন নিত কে? তুই যা পারিস তাই করেছিস। আমি যা পারি, মহর্ষি তারই ভার আমাকে দিয়েছেন। তাতে তোর যদি পুণ্য না হয়, আমারও হয়নি।”

“তাই যদি হবে তবে তোর দুটো সুস্থ ছেলে হল, আর আমার হল বিকলাঙ্গ? কদু, সত্যি করে বল, আমাকে তুই ওষুধ করিসনি? কে জানে, কোন খাবারে কী বিষ দিয়েছিস, তাই আমার বাছা এমন অপুষ্ট। তুই কোনওকালে আমাকে দু’চোখে দেখতে পারিস না।”

“আর তুই আমায় বড্ড ভালবাসিস তাই না? শোন বিনি, আমি ওষুধ করলে তোর দু’টি ছেলেই এমনি হত। একই গর্ভে একজনের বিষ লাগবে, আরেকজনের লাগবে না, তা তো হয় না। তা ছাড়া আরও শুনে রাখ বিনি। আয়ুর্বেদের জ্ঞান নেবার আগে আমাকে মুনির কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে, কারও ক্ষতিকল্পে ওষুধ প্রয়োগ করব না। যদি তা করি, সেই মুহূর্তে আমি সব ভুলে যাব। দ্বিতীয়ত, তোর ছেলেরা আমার প্রিয় স্বামীর ছেলে, তাই তারা আমারও ছেলে। আমি তাদেরও ভালবাসি। প্রয়োজনে বুকের দুধ খাওয়াতেও রাজি আছি।”

“হ্যাঁ। আমি মরলেই তো তোর ষোলোআনা সুখ।”

“এর মধ্যে তোর মরণ আসে কী করে?”

“আমি না মরলে আমার বাছাকে তুই দুধ দিতে যাবি কেন?”

“কী কথায় কী কথা! মরুক তোর শত্তুর।”

বিনতা মনে মনে বলল, তোর চেয়ে বড় শত্রু আমার আর কে! মর তুই! কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করল না। দীপ নিভু নিভু হয়ে এসেছিল। কদ্রু একটি কাঠি দিয়ে সলতে উসকে দিল। বাইরে পাখি ডাকল। আরও দূরে হিংস্র জন্তুর গর্জন। ঝাঁপিতে সম্পুটে সাপগুলো ফোঁসফোঁস করে উঠল। বিনতা ভাবতে লাগল, সে বুঝি ভুল করল। এই ঝগড়ার উদ্দেশ্যে সে তো আসেনি। কিন্তু কদ্রুর সুস্থ ফুটফুটে ছেলেদের দেখে তার গায়ে জ্বালা ধরেছে। তারও একটি ছেলে অপুষ্টাঙ্গ হলে ঝাল মিটত। সে বলল, “তা আমার মরণ যদি না চাস, আমার অরুণকে ভাল করে দে কদু।”

“সে কী কথা! সে যে অসম্ভব!”

বিনতা কেঁদে কেঁদে বলল, “কদু! আমার দুরু! আমার প্রিয় বোন! লোকে বলে তোর জাদুকরী ক্ষমতা। তুই নাগ-মা। তুই নিজেই বললি আমার ছেলে তোরও ছেলে। তোর ওকে সারিয়ে তোলা উচিত নয়? ও মারা গেলে আমিও যে বাঁচব না!”

“আরে! এ বলে কী!” কদ্রু আর্তনাদ করে উঠল, “আমি যদি তা পারতাম, তোকে কি বলতে হত? মহর্ষি নিজেও তা পারেন না। এমনকী কচ; যে কিনা মরা মানুষ বাঁচাতে পারে, সেও এই অঙ্গহারা শিশুর হাত-পা গজিয়ে দিতে পারে না। ভুবনজোড়া খ্যাত যে বৈদ্য কচ— সে যা পারে না, মহামুনি কশ্যপ যা পারেন না, তা পারবে সামান্য কদ্রু? আরে, লোকের পেটজ্বালা, বুকজ্বালা, কফ, পিত্ত, আমাশা কি পেটে পাথর, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, এমনকী ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো সম্ভব। বাড়তি হাত-পা কি মাংসপিণ্ড থাকলেও তা কেটেকুটে সারিয়ে দেওয়া যায়। তাই বলে কি অঙ্গ গজিয়ে দেওয়া যায়? দৈত্যকুলের গুরু এমনকী কচেরও গুরু শুক্রাচার্য মরা-হাজা প্রাণী বাঁচিয়ে তোলে তা শুনেছি। কিন্তু অঙ্গহীনকে পূর্ণাঙ্গ করেছে এমনটা শুনিনি।”

বিনতা হাঁ করে শুনছিল। এবার বলল, “তার মানে তুই করবি না?”

কদ্রু বলল, “আরে, করা সম্ভবই নয়। এতক্ষণ কী বোঝালাম তবে?”

“লোকে তবে কেন তোকে ধন্যি মানে? কেন বলে কদ্রু সব পারে? কেন তাকে দেবীর মতো দেখে?”

“লোকে অল্পেই বড় ভালবাসে বিনি।”

“আমি মনে রাখব দুরু। শিশুবেলায় আমি আর তুই একসাথে কত খেলেছি! সেই মায়াও তোর মনে রেশ রাখেনি কদু। তুই নিষ্ঠুর। তুই হিংসুটে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

আরও কিছু এলোমেলো কথা বলে, কদ্রুকে কখনও দুরু কখনও কদু বলে বিনতা চলে গেল। ঘরে যে আরেকটা ছেলেকে একলা শুইয়ে রেখে এসেছে, সে কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। ঋষি ওই ছেলের নাম রেখেছে গরুড়। গুরুভার যে বহন করতে পারে।

এই ঘটনার দিন কয়েক পরে অরুণ মারা গেল। সন্তান, সে যেমনই হোক, তার মৃত্যু হলে শোক তো হবেই। মহামুনি কশ্যপ থেকে আরম্ভ করে তপোবনে সবাই খুব কষ্টে রইল ক’দিন। রাজা দক্ষ বনে এসে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “মা, দুঃখ করিস না। তার আর সামান্য পাপের ফল পাবার ছিল। এই রোগ-ভোগে তার পাপ ধুয়ে-মুছে গিয়েছে। এবার সে চিরকালের জন্য স্বর্গের ঠিকানা পেল।”

তখন সবে পুবদিগন্তে সূর্য উঠছে। আকাশের প্রান্তে তার লাল আভা। দক্ষ বলল, “ওই চেয়ে দেখ, ওই সে অরুণ।”

ক্রমে সবারই দুঃখ ফিকে হয়ে এল। গরুড়কে বুকে নিয়ে বিনতার শোক খানিক কমল বটে, তবে সেই কথাটি সে ভুলতে পারল না। তার মনে লেগে রইল— কদ্রু চাইলে ছেলেটাকে সারিয়ে তুলতে পারত। চাইলে তাকে বাঁচাতে পারত। অলীক ধারণা আর সন্দেহ বিনতার মনে বিষ জমাতে লাগল। ছেলে গরুড়ের বোল ফুটল কী ফুটল না, বিনতা তাকে শেখাতে শুরু করল— ওই যে কদ্রুর ছেলেরা, ওরা তোর শত্রু। আর ওই যে তোর সৎ মা কদ্রু, ও তোর ভাইকে মেরেছে।

এই গোপন বিষ মন্ত্রণার কথা কেউ জানতে পারল না। সময় হলে কশ্যপ মুনি ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বসে দুই বউকে ডেকে বলল, “তোমাদের ছেলেরা কোন বিদ্যা পেলে তোমরা খুশি হও?”

কদ্রু বলল, “আমার ছেলেরা ভিষক বৈদ্য হোক— দিকে দিকে মৃতসঞ্জীবক হিসেবে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ুক, এই আমার ইচ্ছা।”

কশ্যপ বলল, “তাই হবে। কদ্রু, আমি আরও কঠোর তপস্যা করব ঠিক করেছি। অনেকদিনের জন্য হিমালয়ের নির্জনে বসবাস করব। আমার শিষ্যদের পড়াবার ভার তোমাকে দিলাম। সেই সঙ্গে তোমার দুই ছেলে কুরুবিন্দ আর ইরাবৎকেও তুমিই বড় করবে। শিক্ষা দেবে। তপস্যা শেষ হলে আমি দুই আয়ুর্বেদজ্ঞ ছেলেকে নিয়ে যাব মহাচার্য কচের কাছে। কচ তাদের আরও কিছু শেখাবে। আর বিনতা, তুমি কী চাও?”

বিনতা বলল, “স্বামী, তুমিই যদি না থাকো, আমার ছেলেকে উপযুক্ত বিদ্যা শেখাবার মতো কেই বা তপোবনে রইল। তুমি বলেছিলে, আমার ছেলে জ্ঞানী এবং বীর দুই-ই হবে। যদি বিষ্ণু স্বয়ং ওর শিক্ষার ভার নেন, তবে আমার তৃপ্তি হয়।”

“তাই হবে।”

মহামুনি কশ্যপ ছেলে গরুড়কে নিয়ে স্বর্গদেশে গেলে বিষ্ণু সব শুনে বলল, “বেশ তো। আমি শেখাব একে। তবে আমি যা শেখাব, তাই শিখতে হবে। আমার ইচ্ছাই একে মেনে নিতে হবে।”

কশ্যপ সম্মত হয়ে তপস্যা করতে গেল। গরুড় বিষ্ণুর আশ্রয়ে অস্ত্রবিদ্যা শিখছে, রথচালনা শিখছে, বায়ুযান তৈরি এবং চালানোও সে শিখতে লাগল। এদিকে কদ্রু কশ্যপের আশ্রম খুব ভালভাবেই পরিচালনা করছে। দিনে দিনে তার শিষ্যদের, এমনকী তার দুই ছেলেকে লোকে কাশ্যপ না বলে নাগ-মায়ের ছেলে নাগ বলেই ডাকতে লাগল। কশ্যপের বর্তমানেই তার কুলে এক নতুন নারী পরিচয়ের কুল সূচিত হল। সরাসরি কদ্রুর নাম নেই বলে সমাজে কোনও আপত্তি উঠল না। লোকে ভালবেসে তাকে নাগ-মা বলত, ভালবেসেই তার সন্তান ইরাবৎ ও কুরুবিন্দ বা শিষ্যদের নাগ নামে ডাকতে লাগল।

মহর্ষি কশ্যপের শিষ্যসংখ্যা বরাবরই বেশি। হবে নাই বা কেন? শুধু মহাজ্ঞানী বলেই নয়। কশ্যপ উদার মনের মানুষ। বিদ্যার্থীর জাতিগোত্র তার কাছে গৌণ। মেধা এবং শেখার আগ্রহ থাকলে সে সবাইকেই শেখায়। কিছু মুনি এর জন্য কশ্যপকে নিন্দে করে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে। সমাজে বর্ণ প্রকৃতিগত, জাতি জন্মগত কিন্তু শ্রেণি কাজের ওপর নির্ভর করে। বিদ্যা নির্ধারণ করে কোন কাজ কতখানি মর্যাদার, কোন শ্রেণির যোগ্য। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কিছু জন অবশ্য জন্মগত জাতিগোত্রকে অর্জিত বিদ্যারও উপরে জায়গা করে দিচ্ছে। একজন অর্জিত বিদ্যাবলে যে-সম্মান ও ক্ষমতা পেল, মোহবশে সেই সম্মান ও ক্ষমতাও সে পরবর্তী সন্তান-সন্ততির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করিয়ে দিতে চায় তার যোগ্যতা বিচার না করেই। অধিকাংশ ঋষি তার সমর্থক। কিন্তু কশ্যপ নয়। তাই কশ্যপের শিষ্যসংখ্যা বেশি। লোকে বলে, কশ্যপ অগতির গতি।

এতে বিনতার হয়েছে অসুবিধা। কদ্রু টোল সামলায়। সাপখোপ গাছ-গাছালির যত্ন করে, আর সময় পেলেই পুঁথি লেখে। আর বিনতাকে এতগুলো পেটের ব্যবস্থা করতে হয়। শিষ্যরা অনেক কাজ করে দেয়। কাঠ কেটে আনে। ফল-ফুল তুলে আনে। তপোবন ও আশ্রম পরিষ্কার করে। গোরুর যত্ন নেয়। তবু বিনতার মনে হয়, কদ্রুকে রাঁধতে-বাড়তে হয় না, সে আছে রানির মতো। আর বিনতা যেন দাসী। স্বামী কাছে নেই, ছেলে কাছে নেই, তার মনে হয়, এই সুযোগে কদ্রু তাকে দিয়ে ঝিয়ের কাজ করিয়ে নিচ্ছে।

সারা দিনে দু’জনের কথা হয় সামান্যই। কদ্রু যদি বলে— আজ ভাতে করলা সেদ্ধ দিস; বিনতা ওল সেদ্ধ করে রাখে। পোষা সাপকে খাওয়াবে বলে কদ্রু ইঁদুর ধরে আনতে বলল শিষ্যদের, বিনতা সঙ্গে সঙ্গে বারণ করল, বলল, ইঁদুরে সব ধান খেয়ে ফেলে। কদ্রু ব্যাঙ আনতে বলল। ব্যাঙ দেখে বিনতা ওয়াক তুলতে লাগল। ব্যাঙের ফোলা পেট আর ফুলো গাল দেখলে আজকাল তার গা গুলোয়। স্বর্গের নাম-করা ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবাদের মধ্যে একটি একদিন তপোবনের লাগোয়া জমিতে এসে পড়েছিল। কদ্রু বলল— আহা! ঘোড়ার লেজটি কী সুন্দর কালো কুচকুচে! যেন দশখানা কালনাগিনী।

বিনতা বলল— মোটেই না। আমি পষ্ট দেখেছি, লেজ তো নয়, যেন চাঁদের বুড়ির সাদা রেশম চুল।

একই ঘোড়ার লেজ একজন দেখে কালো কুচকুচে, আরেকজন দেখে সাদা ধবধবে। তা কেমন করে হবে? আসলে দু’বোন কেউ কাউকে দেখতে পারে না বলে ঘোড়ার লেজ বিষয়েও তারা একমত হয় না।

গরুড় মাঝে-মধ্যে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। বিনতা মনে করিয়ে দেয়-ওই কদ্রু, ওই তোর ভাইকে মেরেছে। আমাকে খাটায় যেন আমি ওর দাসী।

গরুড় বলে, “ভাইকে কীভাবে মারল মা?”

“না বাঁচালে তো মারাই হল বাছা। কত কাঁদলাম, কত হাতে পায়ে ধরলাম, বললাম দয়া কর, দয়া কর, তুই আমার আপন বোন। আমাকে ধাক্কা মেরে বাইরে বার করে দিল। বলল মর তুই। মরুক তোর ছেলেরা।” বিনতা ছেলের কাছে মিথ্যে নালিশ করে চোখের জল ফেলতে লাগল। গরুড় তা বুঝতেও পারল না। কোনও ছেলে কেন মাকে অবিশ্বাস করবে? সে বলল, “বাবা এর বিহিত করল না?”

বিনতা বলল, “তাঁকে তো আমি কিছু জানাইনি। নিজের বোনের বিরুদ্ধে কী করে বলব? চিৎ হয়ে থুতু ফেললে নিজের গায়েই পড়বে যে।”

গরুড় এখন বড় হয়েছে। লেখাপড়া শিখেছে। সে জানে, কোনও বৈদ্যই বিকলাঙ্গ শিশুকে নিখুঁত করে তুলতে পারবে না। কিন্তু তাই বলে সৎ মা কেন মাকে লাঞ্ছনা করবে? কেন মৃত্যুকামনা করবে ছেলেদের তারা বৈনতেয় বলেই? কেন তার মা দাসীর মতো খাটবে? গরুড়ের বয়স এখন চোদ্দো। সে যুদ্ধবাজ। যে কোনও যান চালাতে দক্ষ। স্বয়ং বিষ্ণু তার বায়ুযানের চালক হিসেবে গরুড়কে নিযুক্ত করার কথা ভাবছে। সে ফিকির খুঁজতে লাগল। একদিন বনে ইরাবৎ আর কুরুবিন্দকে পেয়ে সে গাছের সঙ্গে তাদের বেঁধে ফেলল। বলবান যুদ্ধপারদর্শী গরুড়কে তারা বাধাও দিতে পারল না। তারাও চোদ্দো হল। কিন্তু ভেষজবিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই শেখেনি। ইরাবৎ বলল, “ভাই গরুড়, এ তোমার কী ব্যবহার! শত্রুরাই কেবল এই আচরণ করে।”

গরুড় বলল, “তোরা তো আমার শত্রুই। আমার জন্মশত্রু! আমাকে যাতে আর ভাই বলতে না পারিস তার ব্যবস্থা করছি।”

সে ধারাল ছুরি নিল হাতে। “সাপের ছেলে সাপ” বলতে বলতে একে একে দুই ভাইয়ের জিভ টেনে দু’ফালা করে দিল। তাদের যন্ত্রণাকাতর গোঙানি শুনে অন্য আশ্রমিকেরা এসে দেখে বীভত্স দৃশ্য! দুই ভাইয়ের মুখ থেকে রক্ত পড়ছে। তারা প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছে যন্ত্রণায়। ততক্ষণে গরুড় পালিয়েছে। সোজা চলে গিয়েছে বিষ্ণুলোকে।

ছেলেরা দুই ভাইকে ধরাধরি করে আশ্রমে নিয়ে এল। কদ্রু তাদের শুশ্রূষায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেদের কাছে সব কথাই সে জানতে পারল। কপালে হাত চাপড়ে সে সখেদে কেবল বলল, “হায়! কী ভুল করেছি! গরুড় যখন যুদ্ধবিদ্যা শিখছিল, তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল। বিদ্যাধারীরও বলহীন হলে চলে না। শুধু আত্মরক্ষার জন্য হলেও এদের যুদ্ধবিদ্যা শেখানো আমার উচিত ছিল। আমারই বোকামিতে আমার বাছারা আর কোনও দিন কথা বলতে পারবে না।”

শিষ্যরা রাগে ফুঁসছিল। তারা এক-একজন এক-একখানা সাপ হাতে নিয়ে বলল, “গুরুমা, আমরা তোমার ছেলে। তুমি চিরকাল কুরুবিন্দ এবং ইরাবতের সমান স্নেহ করেছ আমাদের। ভাইয়ের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিশোধ নেব আমরা। লোকে তোমাকে বলে নাগ-মা, আমাদের বলে নাগ। এই সাপ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা মা গো। প্রতিশোধ না নিয়ে আমাদের বিশ্রাম নেই।”

কদ্রুর মন দুঃখে ভরে গেল। সে দেখল, কেমন করে ঈর্ষার আগুন নির্যাতনী বিষ হয়ে ওঠে, সেই বিষ আবার সৃষ্টি করে প্রতিশোধের বহ্নি। সে বিনতাকে কিছুই বলল না। একসময় ইরাবৎ এবং কুরুবিন্দের জিভের ক্ষত শুকিয়ে গেল। কিন্তু সেই ক্ষত আর শুকোল না যা সৎ ভাইদের সম্পর্কের মধ্যে ছিল। এরপর কদ্রু তার নাগকুলকে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছিল যতটুকু তার জানা ছিল। ক্রমে তাদের কেউ কেউ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। শিখে এল আরও বড় যুদ্ধবিদ্যা। ইরাবৎকে রাজা করে দক্ষের অর্ধেক রাজত্ব নাগেরা শাসন করতে লাগল, অপর অর্ধেক রইল গরুড়ের। আর কখনও তাদের সদ্ভাব হয়নি। জন্ম জন্ম ধরে সেই শত্রুতা কেবল বেড়েছে। নাগদের এক অংশ কুরুবিন্দর বংশ তক্ষক নাগেরা ইন্দ্রের বন্ধু। তবু গরুড়ের হাত থেকে বাঁচতে তারা কেউ কেউ খাণ্ডবপ্রস্থের বনে বাস করে। বনচারী দানবদের সঙ্গেও তাদের ভাব-সাব আছে। কিন্তু গরুড়দের সঙ্গে আর বিরোধ গেল না। রক্তের সম্পর্কে শত্রুতা বাসা বাঁধলে তা আর সারে না। নাগ আর গরুড় মুখোমুখি হলে যুদ্ধ করবেই। সুযোগ পেলেই ক্ষতি করবে এ ওর। না হলে নাগেরা শান্তিপ্রিয় জাতি। কুলধর্ম অনুসারে তারা আয়ুর্বেদ শেখে, যুদ্ধও শেখে। কুলমাতা কদ্রুর অনুসরণে মেয়েরাও শেখে এইসব। একজন নারীর নামে একটি বংশ তৈরি হয়েছে, উদার কশ্যপ তা মেনেও নিয়েছে, অনেক ঋষির তা ভাল লাগল না। তারা নাগকুলকে জাতি না বলে উপজাতি বলে খাটো করে দিল।

নাগরাজ্য এখন কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের মধ্যে তারা সমঝোতা রক্ষা করে চলে। গরুড়কুলের শক্তি বিপুল। নিজেরা একজোট হলে তবে গরুড়দের প্রতিরোধ করা যাবে, নাগরা তা বুঝতে পারে। আত্মরক্ষার জন্য তারা নানা উপায় খুঁজে নিয়েছে। গরুড়দের মতো তাদের বায়ুযান নেই বলে গগনবাহী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে পাহাড়ে গুহা তৈরি করে, প্রাকৃতিক গুহা ব্যবহার করে, এমনকী সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মাটির তলায় রীতিমতো বাসযোগ্য ব্যবস্থা করে রেখেছে তারা। কোন সুড়ঙ্গের মুখ যে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, নাগজাতীয় লোক ছাড়া আর কেউ তা জানে না। এত বছরে এই সুড়ঙ্গ পারদর্শী নাগ ও বনবাসী খাণ্ডবপ্রস্থের নাগদের মধ্যেও আচারগত পার্থক্য ঘটে গিয়েছে।

নাগগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা যার, সেই কৌরব্য নাগের মেয়ে উলূপীর ভারী মনখারাপ। প্রথম রাজা ইরাবতের বা ঐরাবতের নাম নিয়ে এখানকার গোষ্ঠীপ্রধানরা নিজেদের ঐরাবত বলে পরিচয় দেয়। উলূপী ঐরাবত কৌরব্য নাগের মেয়ে।

একটি ঝরনার ধারে বড় পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে উলূপী। পায়ের পাতা ছুঁয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। জলের কলকলানি শুনে মনে হয় যেন কচি কুসুম পাতার মতো রাঙা পাতলা সুন্দর পা দু’খানি ভিজিয়ে দিতে পেরে এই ঝরনার জল খুব খুশি। এর নাম শ্বেতনাগিনী। পাহাড়ের উঁচুতে, যেখানে মেঘের চাদর পরে, বরফের মুকুট মাথায় দিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন নগরাজ, সেখান থেকে, যেন অশেষ জলরাশি দেবতার আশীর্বাদের মতো নাচতে নাচতে, উচ্ছ্বাসের ফেনা ছড়াতে ছড়াতে, পাথর শরীরে ঘষে তাকে ক্ষইয়ে দিতে দিতে নেমে আসছে ভুঁইয়ে। এক-এক জায়গায় আছড়ে পড়ছে উন্মাদিনীর মতো, অনেকদিন পর ভালবাসার মানুষের দেখা পেলে যেমন তার বুকে ঝাঁপ দেয় মেয়েরা।

শ্বেতনাগিনীর ধারে এই জায়গাটি উলূপীর ভারী প্রিয়। তার আনন্দ হলে এখানে আসে, দুঃখ হলেও। আনন্দে ঝরনার জলে শরীর ভিজিয়ে দেয়। তার উত্তাল যৌবনের উষ্ণতায় শ্বেতনাগিনীর হিমজলও যেন বাষ্প হয়ে ওঠে। দুঃখ হলে, উলূপী খুব একটা কাঁদে না, উদাস হয়ে থাকে, জল ছুঁয়ে থাকে, যেমন শোকেতাপে মানুষ ধরে থাকে, ছুঁয়ে থাকে প্রিয়জনকে।

উলূপী সাজেনি। তার একরাশ চুলের খোঁপাটি বাঁধনহারা অবস্থায় আধভাঙা। গায়ে অল্প সোনার গয়না। কিন্তু এতেই যেন উলূপী ভুবনমোহিনী। ডালিম ফলে যখন পাক ধরে, হালকা সবুজের ওপর লালের আভা লেগে যে অপরূপ রং, উলূপীর তেমনি। সুন্দর তার মুখ, সুন্দর তার শরীর। সারা নাগরাজ্য, সারা গরুড়রাজ্য খুঁজে উলূপীর মতো সুন্দর মেয়ে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কপাল দেখো মেয়ের!

প্রিয় বন্ধুরা তাকে ঘিরে আছে। জয়া বলল, “আর কতকাল এভাবে উদাস হয়ে থাকবি লূপী? তুই কথা বলিস না, হাসিস না, সাজতে ভুলেছিস। ঘোড়ায় চাপতে কত ভালবাসতি, ঘোড়াশালে তারাও তোর পায়ের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে আছে। সেদিন ভিষকাচার্য রুদ্র নাগ বলছিলেন, সঞ্জীবন মণির প্রয়োগ শিখতে তাঁর কাছে তোর যাবার কথা। তিনিও তোর পথ চেয়ে আছেন। মহারাজ কৌরব্যর মনে সুখ নেই।”

চন্দ্রা বলল, “তাকে তোর এত মনে পড়ে লূপী? একটু ভুলতে পারিস না? চল, আমরা আগামী পূর্ণিমায় চাঁদের উৎসব করি। নাচব, গান গাইব, সে বেশ মজা হবে।”

“তোকে কিন্তু তির ছুড়ে আগুন জ্বালানোর খেলাটা দেখাতে হবে লূপী। অনেকদিন দেখাসনি।” শুভা বলল।

জয়া বলল, “শুধু আগুন কেন, একশো তির ছুড়ে মণ্ডল তৈরি করতেও উলূপীর মতো কেউ পারে না।”

চন্দ্রা বলল, “সুড়ঙ্গ স্থাপত্যেও আমাদের লূপী সবার চেয়ে ভাল। এ তল্লাটে আমাদের লূপীর যোগ্য পুরুষ কেউ নেই। থাকলে বলতাম, অমন উদাসী হয়ে না থেকে আবার বিয়ে কর।”

উলূপীর বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। উন্নত বুক দু’টিতে ঢেউ লাগল যেন। সে বলল, “আবার বিয়ে করতে আমারও ইচ্ছে করে রে চন্দ্রা। বাবা যার সঙ্গে বিয়ে দিল তার সঙ্গে ভাল করে চেনাশুনো হওয়ার আগেই গরুড়রা তাকে মেরে ফেলল। সে তো কারও ক্ষতি করেনি। শুধু, শিকার করতে করতে আনমনে নাগসীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল। তাই বলে প্রাণে মেরে ফেলবে? এত শত্রুতা? আমি যদি সঙ্গে থাকতাম, কিছুতে তার প্রাণ যেত না।”

শুভা বলল, “প্রতিশোধ নিবি না?”

“প্রতিশোধ?” উলূপী অন্যমনা হল। বলল, “আমার প্রতিশোধস্পৃহা হচ্ছে না। নাগ-গরুড়ের যুগান্তরী শত্রুতায় কত নাগ মরেছে। কত গরুড়ও মরেছে। কার জন্য কোমর বেঁধে প্রতিশোধ নিতে গিয়েছি? সে যে আমার কাছে বিশেষ হয়ে ওঠার আগেই চলে গেল। প্রেম কী, তা বোঝার আগেই একা হয়ে গেলাম। যদি তার জন্য আমার মনে প্রেম থাকত, আমি হয়তো প্রতিশোধের জন্য উন্মাদ হয়ে যেতাম। আমার কথা থাক, তার বাপ? তার ভাই অশ্বসেন? তারাও তো দিব্যি এই মরণ মেনে নিয়েছে।”

শুভা বলল, “আমরা যদি সব নাগেরা এক হয়ে গরুড়দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম তো ওদের নিকেশ করে দিতাম।”

“জাতশত্রু নিকেশ করা অত সহজ নয় শুভা।”

চন্দ্রা বলল, “রাখ তো। ওসব রাজার ভাবনা। আমরা কেন ওসব গুরু বিষয়ে ভাবতে যাই! আমরা ভাবব লূপীকে নিয়ে। লূপীর দুঃখে আমার চোখ ফেটে জল আসে। আচ্ছা লূপী, তুই বললি তোর প্রেম জাগেনি তার জন্য। তবে কেন তুই এমন উদাস? এমন কাতর?”

উলূপী বলল, “আমি উদাস কারণ আমার একা লাগে। শরীরে, মনে। আমার মনে এমন মুখ নেই যাকে ভেবে আমার শরীর উত্ফুল্ল থাকবে। মনে হবে সার্থক এই জীবন। রাতে ঘুম আসে না। সারা শরীরে কামজ্বর। আমার পাগল পাগল লাগে। একটা দৃঢ় অথচ মসৃণ শরীর চাই আমি তখন। যে আমাকে জড়িয়ে ধরবে, আমার জিভের মূল পর্যন্ত চুমু খাবে, আমাকে নিয়ে ঝড়ের নৌকার মতো উথাল-পাথাল করবে, আছড়ে ফেলবে আমাকে যেমন বালুতটে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের ফেনা আর পরম সুখে বিদ্ধ করবে আমাকে বার বার, বার বার। সারা রাত্রি। সারা দিন। শ্বেতনাগিনীর জলে নাইতে এসে আমি যখন বসন খুলব, তোরা আদরের দাগ দেখে শিউরে উঠবি। বলবি এ কী! এ কী! আর শ্বেতনাগিনীর জল আদরের দাগে আদর করে ছুটে যাবে নদীর সঙ্গে মিশে, কত দূর— কত দূর সেই সাগরের কাছে!”

জয়া বলল, “আহা রে! আহা রে! লূপী, আমাদের লূপী, তোর কথা শুনে আমার পুরুষটার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। তাকে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।” সে উলূপীকেই জড়িয়ে ধরে। গালে গাল চেপে বলে, “লূপী, তোর এত আছে! এত! ঈশ্বর তোর ইচ্ছে পূর্ণ করবে, ঠিক করবে, তুই দেখিস!”

জয়া উলূপীর গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। শুভা বলল, “লূপী, তোর কি আর কোনও পুরুষকে পছন্দ হয়? বল তুই। আমরা তোর বিয়ের উদ্যোগ নেব।”

উলূপী নীরবে মাথা নাড়ল। নেই। কাউকেই তার মনে ধরেনি। কাউকেই দেখে মনে হয়নি— এই তো! এরই জন্য আমার জীবন, আমার মরণ! হ্যাঁ, প্রাণের পুরুষকে উলূপী সব দিতে পারে। সব। সব। প্রাণ পর্যন্ত। কিন্তু সে কোথায়? সে কে?

শুভা চিন্তিত স্বরে বলল, “তা হলে? একটা ছেলেও যদি তোর থাকত!”

চন্দ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “রাখ তো! ঠানদিদির মতো কথা বলিস না। এমনিতেই তোদের শাশুড়িরা সবসময় আওড়াচ্ছে, পছন্দমতো ক্ষেত্রে উলূপী বীজ নিলেই তো পারে। ছেলে পাবার জন্য সহবাস শাস্ত্রের মতে একটুও অন্যায় নয়।”

শুভা বলল, “ঠিকই তো। ভুল কী! হস্তিনাপুরের দুই বিধবা রানি অম্বিকা-অম্বালিকার বেলায় কী হল? তাদের কথা সবাই জানে। অম্বালিকার ছেলে পাণ্ডু। আর অম্বিকার ছেলে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র।”

“আরে কথা সেটা নাকি? একটা মেয়ে মা হয়ে গেল, আর সব শেষ? তার প্রেমের খিদে থাকে না? শরীরের ইচ্ছে থাকে না?”

“তা থাকবে না কেন? তবে কিছু না থাকার চেয়ে একটা ছেলে থাকলে বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়।”

জয়া বলল, “বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন বেঁচে থাকার ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা থাকলে এই শ্বেতনাগিনীও বেঁচে থাকার কারণ হতে পারে। আমাদের ঝাঁপিতে পোষা সাপগুলোই বা অবলম্বন হিসেবে মন্দ কী!”

শুভা রেগে গেল। মুখ লাল করে বলল, “তাই বলে ছেলে কিছুই নয়? সব্বাই অমনি ছেলে-ছেলে করে হেদিয়ে মরছে?”

চন্দ্রা বলল, “সে হল উত্তরাধিকারের যন্ত্রণা। শুভা, লোকে ধনসম্পত্তি যা বানায়, মরার সময় সঙ্গে তো নিয়ে যেতে পারবে না, ছেলে ভোগ করবে, এই সান্ত্বনা নিয়ে মরে। আসলে এই পৃথিবী ভোগ করার জন্য নিজেকেই রেখে যেতে চায়। যদি এরকম রেওয়াজ থাকত সমাজে যে, বিয়ের পরে ছেলেরাই শ্বশুরবাড়ি যাবে, মেয়েরা বাবা-মায়ের ধনসম্পত্তি সামলাবে, তা হলে সবাই ‘ছেলে দাও ছেলে দাও’ করার বদলে ‘মেয়ে দাও মেয়ে দাও’ বলে ভগবানের কান ঝালাপালা করে দিত।”

শুভা আহত গলায় বলল, “এ কেমনধারা কথা? বাত্সল্য মানুষের সহজাত বোধ। যার ধন নেই, তারও কেন তবে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জাগে!”

“তার সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জাগে। পাখির মতো, বাঘের মতো, হাতির মতো, কীট-পতঙ্গের মতো। তারা ছেলে চায় না।”

শুভা কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকল। চন্দ্রার কথা সে যেন ধরেও ধরতে পারছে না। এবার সে রণে ভঙ্গ দেবার গলায় বলল, “সে না হয় হল। আমাদের লূপী যদি আবার বিয়ে করতে রাজি থাকে তবে…!”

শুভার কথা শেষ হল না। জয়া বলল, “রাজি থাকলেই তো হল না। যোগ্য লোক পাওয়া চাই।”

উলূপী বলল, “যার প্রেম আছে, যে উদার, যে ভিতু নয়, যে জানে শাস্ত্রে স্বামীহারা মেয়ের আবারও বিয়েতে নিষেধ নেই এবং শুধু জানে না, এই বিধান মেনে নেবার মতো মনের জোর যার আছে, তেমন পুরুষ এ তল্লাটে কই জয়া? যদি থাকত, আমার এই ভরা জোয়ারের মধু ঢালা ঢেউগুলো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে বুঝেও কি কেউ এগিয়ে আসত না? সবাই জানে, কৌরব্য নাগের মেয়ে উলূপীর বিয়ে হয়েছিল। ক’দিন যেতে না যেতেই তার বরকে চিরশত্রু গরুড়েরা মেরে ফেলেছে।”

শুভা বলল, “তেমন মানুষ তোর ঘরেই আছে লূপী।”

“কার কথা বলছিস?”

“কেন? অশ্বসেন? তুই কি তার ইচ্ছা বুঝিসনি?”

“অশ্বসেন?”

“হ্যাঁ রে হ্যাঁ। সে আমার বর প্রত্যুষ নাগের কাছে মনের কথা খুলে বলেছে।”

চন্দ্রা আর জয়া চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল। এক ঝলক হাড় কাঁপানো বাতাস বয়ে গেল। ঝরনার অন্য পারে একটি হরিণ আর হরিণী জল খেতে এল। ওরা ভয় পায় না। এই মেয়ের দলকে পশুপাখিরা চিনে গিয়েছে।

শুভা মুখে হাসি মেখে বলল, “অশ্বসেন বলেছে, লূপী চাইলে ওকে ছেলে দেবে। এমনকী বিয়েও করতে পারে।”

উলূপী রাগে গনগনে হয়ে গেল। তার খোঁপা খুলে চুল এলো হয়ে গেল। নাকের পাটা ফুলে উঠল। গাল দু’টি পাকা ডালিম ফল। চোখে আগুন হেনে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সে বলল, “অশ্বসেন? অশ্বসেন? সে লোভী। কামুক। কাপুরুষ। তোরা কি জানিস সে তার ভাইয়ের দেহ আনতেও যায়নি এই ভয়ে যে, পাছে আবার গরুড়ের আক্রমণে সে মরে! জানিস, সে আমাকে লুকিয়ে দেখে, লুকিয়ে পিছু নেয়, আমার শোবার ঘরের জানালায় উঁকি দেয়? আমি অবাক হব না, যদি এখনও, এখানেও সে কোনও গাছের আড়ালে লুকিয়ে আমাদের কথা শোনে। শোনে তো শুনুক। আমি অশ্বসেনকে পুরুষ বলেই মনে করি না।”

উলূপী হাঁপাতে লাগল উত্তেজনায়। শুভা তিক্ত হেসে বলল, “প্রাণের ভয় আমাদের সবার আছে লূপী। তোর বর বোকা ছিল, তাই সাবধান হয়নি। অশ্বসেন তোকে লুকিয়ে দেখে কারণ তোকে ভয় পায়।”

চন্দ্রা কঠিন মুখে প্রশ্ন করল, “কেন? ভয় পায় কেন?”

“কারণ সবাই লূপীকে ভয় পায়। তুই-ও পাস।”

“না। ভয় পাব কেন? আশ্চর্য!”

“পাস। স্বীকার করিস না। আমি তো পাই। আমি চাইলে তোকে একটা চড় কষিয়ে দিতে পারি।”

“আমিও তোকে পাল্টা দেব।”

“তা দিবি। কিন্তু লূপীকে পারব না। কারণ লূপী কৌরব্য রাজার মেয়ে। নাগগোষ্ঠীতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজা। আর অশ্বসেনের কথা ভেবে দেখ। লূপী রূপে গুণে এমনই অধরা যে, পুরুষরা তাকে ভয় করে। লুকিয়ে প্রেমের তৃষ্ণা মেটানো ছাড়া অশ্বসেনের উপায় কী!”

“তা হলে তো চামচিকেই হয়ে ওঠে চাঁদের সবচেয়ে বড় প্রেমিক। যে নাকি জ্যোৎস্নার আলোতেও মুখ লুকোয়।”

চন্দ্রার কথায় ব্যঙ্গ ফুটে উঠল। সে বলে চলল, “হ্যাঁ। লূপীকে আমরা চড় মারব না কারণ মর্যাদাবোধ। তোর মতো কেঁচকি মাছও যদি রাজার মেয়ে হত, এই মর্যাদা পেত।”

“কী! আমি কেঁচকি মাছ?” শুভা কেঁদে ফেলল। “তোর মুখে বড় ধার চন্দ্রা। আমি কি লূপীকে ভালবাসি না? ওর ভালর জন্যই অশ্বসেনের কথা তুলেছি। দোষটা কী করেছি? আর আমি তোদের সঙ্গে আসব না রে! কেঁচকি মাছ রুই-কাতলার দলে মিশতে যাবেই বা কেন!”

জয়া এবার সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করল। উলূপীও একটু স্বাভাবিক হয়েছে। সে এসে শুভার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদিস না শুভা। বন্ধুরা কত কী বলে। ওসব ধরতে নেই। চল, চন্দ্রার কথামতো আমরা এই পূর্ণিমায় চাঁদের উৎসব করি। তোকে আগুনবাণের খেলাও দেখাব।”

উলূপী আবার উদাস হয়ে চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “শুধু শরীরের জন্যই কোনও পুরুষকে নিতে আমার মনে কোনও বাধা নেই। শুধু সন্তানের জন্য নিতেও বাধা নেই। কিন্তু তুই বল শুভা, প্রেম না থাক, ভাললাগা থাকবে না? শ্রদ্ধা থাকবে না? বাছবিচার থাকবে না? শুধু শিশ্নটি আছে বলেই একটা লোক পুরুষ হয়ে উঠবে? যার দৃষ্টি আমার গায়ে পড়লে একশো পা ওয়ালা কেন্নো বাইছে মনে হয়, মনে হয় একলক্ষ কৃমিকীট আমার গলায় বুকে পিঠে— যে চোরের আচরণ করে— শুধু একটা ছেলে চাই বলে, শুধু আমার শরীর একটা শরীরের জন্য মরছে বলে, তাকেই নিয়ে শুয়ে পড়ব? এর চেয়ে যে গঙ্গাদ্বারে মরণঝাঁপ দেওয়া ভাল। শরীর-মন দুই জুড়োবে। আত্মহত্যার পাপও ধুয়ে যাবে গঙ্গায়।”

বড় করুণ উলূপীর স্বর। বড় গভীর। যেন শত শত পাপড়ি খুলছে বিষাদের পদ্ম। শুভা আবার কেঁদে ফেলল। বলল, “কেমন করে আমি এত জানব বল।”

উলূপী বলল, “আজ তো জানলি।”

জয়া শুভার পিঠে হাত রাখল। তারও চোখে জল এসেছে। সে এখন গর্ভবতী। পেটে বাচ্চা এলে মেয়েদের মন ভারী নরম হয়ে যায়। একমাত্র চন্দ্রা কঠিন মুখ করে বসে আছে। চন্দ্রা চাঁদমুখী নয়। একটু পুরুষালি বরং। কোনও ছেলেই এখনও তাকে পছন্দ করেনি। লুকিয়ে খবর সংগ্রহে চন্দ্রার জুরি নেই। সে পুরুষের বেশ পরলে মেয়ে বলে কেউ চিনতেই পারবে না। এরই মধ্যে চন্দ্রা নাগলোকে চরচক্রের অন্যতম। কঠিন মুখে ভাবতে ভাবতে সে আত্মগত স্বরে বলল, “আমাদের লূপীর যোগ্য পুরুষ পৃথিবীতে মাত্র দু’জন।”

সবাই চন্দ্রার দিকে তাকাল। চন্দ্রা বন্ধুদের মুখ নিরিখ করে বলল, “কৃষ্ণ আর অর্জুন।”

“কৃষ্ণ! সেই কংসকে মেরে বিখ্যাত কৃষ্ণ!”

“অর্জুন! সেই কঠিন লক্ষ্য ভেদ করে যে পাঞ্চালের রাজকন্যাকে পেয়েছিল আর ভাগ করে নিল চার ভাইয়ের সঙ্গে?”

“সেই অর্জুন। সেই কৃষ্ণ। তা কৃষ্ণ এখান থেকে অনেক দূরে। একেবারে সাগরপারে দ্বারকায়। কিন্তু অর্জুন? সে আমাদের খুব কাছে এখন।”

“খুব কাছে? কোথায়?”

“গঙ্গাদ্বারে।”

“এই তো তার বিয়ে হল। নতুন বউ ফেলে তীর্থে এল কেন সে?” শুভা অবাক। উলূপী কথা বলছে না। জয়া প্রশ্ন করছে। যে-গঙ্গাদ্বারে আত্মবিসর্জন দেবে বলছিল উলূপী, সেই গঙ্গাদ্বারে অর্জুন? ভাবতে পারছে না যেন!

অর্জুন আর কৃষ্ণ— বিবাহিত অবিবাহিত সব মেয়ের মনে তাদের সম্পর্কে ঔত্সুক্য। তাদের কাহিনি দিকে দিকে ছড়িয়েছে। তার মধ্যে কৃষ্ণ সম্পর্কে নারীঘটিত অতিরঞ্জনের শেষ নেই। বৃন্দাবনে পরের বউ রাধারানির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছিল কৃষ্ণ। শুধু রাধা নয়, আরও সব গোপবালারাও নাকি কৃষ্ণ বলতে পাগল ছিল। তরুণ কৃষ্ণ যেমন কংস রাজাকে মেরেছে, প্রচণ্ডপ্রতাপ জরাসন্ধকে কয়েকবার যুদ্ধে হারিয়েছে, অসুর যে কত মেরেছে তার ঠিক নেই, এরই মধ্যে সে বেশ ক’টা বিয়েও করেছে। তবু মেয়েরা তাকে দুশ্চরিত্র ভাবে না, এমনই সে মনোমোহন। আর অর্জুন? তার বীরগাথা লোকের মুখে মুখে ফেরে। এমন মানুষ সম্পর্কে কৌতূহল হবেই তো।

চন্দ্রা বলল, “খবর যা শুনেছি, গঙ্গাদ্বারে অর্জুনের আসার কারণ ওই বিয়ে।”

“কীরকম?”

“বড় ভাইয়ের অধিকারে পাঞ্চালীর প্রথম বছর যুধিষ্ঠিরের। নারদ মুনির বিধানে, এক ভাইয়ের রতিসুখের সময় অন্য কোনও ভাই এসে পড়লে তাকে বারো বছরের জন্য ব্রহ্মচর্য নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বনবাসে থাকতে হবে।”

“কী সর্বনেশে নিয়ম। এখনও কি ত্রেতা যুগ চলছে নাকি?”

“হ্যাঁ। ত্রেতা যুগ না হলেও শর্ত-টর্ত সব সেই পুরনো দিনের মতো। এক বাড়িতে থাকলে কোনও ভাইয়ের চোখে কিছু পড়ে যেতেই পারে। আর অর্জুন তেমনই কিছু করেছে।”

“অর্জুন? অর্জুন!”

“হ্যাঁ। ঠিক কী হয়েছে জানি না। তবে অর্জুন শুনেছি অত্যন্ত ধার্মিক এবং এক কথার মানুষ। বীরপুরুষের যেমন হওয়ার কথা। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল জোড়া যার খ্যাতি, সে কি সাধারণ হতে পারে? তাই ভাবছিলাম, চল, আমরা সবাই মিলে গঙ্গাদ্বারে যাই। দেখে আসি কেমন সেই অর্জুন।”

জয়া দেখল, উলূপীর মুখ রাঙা। চোখ দু’টি কোন অপরূপ কল্পনায় মেদুর। তার বুক টনটন করে উঠল প্রিয় সখীর জন্য। আহা! এত রূপ এত গুণ থাকতেও মেয়েটা কী একা! কী শূন্য! আর অর্জুনের কপাল দেখো। কী অনায়াসে অধিকার ছেড়ে দিল! কী অনায়াসে শর্ত মেনে সব ফেলে চলে এল! নারীর অধিকার ছেড়ে দিতে দেবতারাও পারে না। আর এই অর্জুন! হোক, দেখা হোক দু’জনার। অর্জুন ও উলূপীর। হয়তো নিয়তির এই ইচ্ছা। হয়তো এ জন্যই গঙ্গাদ্বারের কথা উলূপীর মনে এসেছে। গঙ্গাদ্বার শুনে চন্দ্রার মনে পড়েছে অর্জুনের কথা। এসবই যে দৈবী মনে হয়। দেখা হোক, অর্জুন ও উলূপীর দেখা হোক। এক বিরহী পুরুষ আশ্রয় নিক প্রেমভিক্ষু রমণীর বুকে।

জয়া, চন্দ্রা, শুভা আর উলূপী আলোচনায় বসল। আর কিছু হোক না হোক, মহাবীর মহানায়ক মহাখ্যাত অর্জুনের দর্শন তো হবে! গর্ভবতী জয়া যাবে না। সে বলল, “আমি তাকে এখানেই দেখব।”

শুভা বলল, “কী করে?”

“উলূপীর সঙ্গেই সে আসবে। আসবেই।”

দুই

গঙ্গাদ্বার। এই সেই জায়গা যেখানে গঙ্গা নবযৌবনবতীর চাপল্য উচ্ছ্বাস সংহত করে ভরাযৌবন জ্ঞানী রমণীর মতো বয়ে চলেছে। গঙ্গাদ্বার পাহাড়ের পায়ের কাছে। এমনকী এ জায়গাকে হিমালয় পর্বতমালার জানুতলও বলা যেতে পারে।

গঙ্গাদ্বারে পাহাড়ের অভাব নেই। সমতল আর পাহাড়ের সন্ধি হয়েছে বলে এখানে খোলা সমান তট অনেকখানি পাওয়া যায়। নীচের দিকে বনে ঘেরা পাহাড়গুলো ঘন সবুজ। একেকটি গাছ যেন লম্বা হতে হতে পাহাড়ের চূড়া ছাড়িয়ে যেতে চায়। বড় বড় পাথরের গায়ে প্রাগৈতিহাসিক শ্যাওলার ছোপ।

গঙ্গাদ্বার থেকে উপরের দিকে গেলে নাগদেশ, গরুড়রাজ্য ছাড়িয়ে আরও উপরে প্রথমে হালকা হয়ে আসে বড় গাছের সংখ্যা। শুরু হয় ছোট ছোট পাতাওয়ালা মাঝারি গাছের জঙ্গল। আরও উঠলে সেই জঙ্গলও ফুরিয়ে আসে। ইতস্তত ঝোপঝাড়, তাদের রঙিন পাতা আর সরু সরু বাঁশের ঝাড় পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ পাহাড়গুলি একেবারে তৃণলতাহীন হয়ে পড়ে। কেবল বিশাল রুক্ষ পাথরের গা। তারা ভীষণ কিন্তু সুন্দর। হিম হাওয়ার ছুরিতে তাদের গা কেটে কেটে প্রকৃতি অপরূপ কারুকাজ করে রাখে। আরও দূরে আরও উঁচুতে সাদা ঝকঝকে বরফ। ঊষা অরুণের আলোয় মনে হয় সোনায় মোড়া পাহাড়। বেলা বাড়লে, সূর্যের কড়া রোদ্দুর পড়ে রুপোর মতো ঝকঝক করে। আকাশ এত গভীর নীল যে, মনে হয় একটু পরেই সব অন্ধকার হয়ে আসবে। এখানে মহাঋষিরা তপস্যা করে। এই দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের অন্য পারে স্বর্গ। সাধারণ মানুষ সেখানে যেতে পারে না। পারে মহাঋষি, মহাবীর, মহাধার্মিক।

এইসব পাহাড়চূড়ায় বরফের উৎস থেকে নেমে এসেছে কত না নদী। এ ওকে জড়িয়েছে, সে তাতে লীন হয়েছে। জলধারা বিপুল করে মিলেছে কেউ গঙ্গায়। তার জল পুণ্য। তার পাড় পুণ্য। তাকে ছুঁয়ে বয়ে চলা হাওয়া পুণ্য।

অর্জুন সেই পুণ্যের কাছে এসেছে। বারো বছর! তিনভাগের একভাগ পার করেছে সে কঠোর সংযমে, যজ্ঞ, ব্রত, সাধনার শৃঙ্খলিত আত্মশাসনে। আরও আট বছর। সদ্য তরুণ থেকে যুবক হয়ে যাবে সে তখন। আর বারো বছরে সে কেমন হবে? সেই মেয়ে? যজ্ঞের আগুনে জন্ম যার, যার আগুনের মতো রূপ এবং তেজ, যার অপরূপ সুন্দর পদ্মপাপড়ির মতো চোখের দৃষ্টিতে আছে চারিত্রিক দার্ঢ্যের ছটা! কেমন হবে সে? সেই খরতর? সেই দীপ্র?

এক অসহনীয় ব্যথায় অর্জুনের বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। হাহাকার নয়। হাহাকার অর্জুনের স্বভাবে নেই। শুধু অস্ত্রচালনায় নয়। বীরধর্ম সে মনে গ্রহণ করেছে। কর্তব্যে অবিচল হতে সে জানে। সত্যকে ধর্ম বলে মেনে নিতেও সে শিখেছে। যার দাদা যুধিষ্ঠির, ধর্মের প্রতীক, তাকে ধর্ম আপনি বাঁধে। আর বাঁধে বিষাদ। নিজের মনের অতলে অর্জুন চাপ চাপ বিষাদ পেল। মনের তুঙ্গে জমাট মেঘের মতো ওই বিষাদই। তা যে শুধু এই বারো বছরের ব্রহ্মচর্যকল্পে, তা নয়। কী এক অগাধ তৃষ্ণা, কোন আকণ্ঠ পিপাসা তাকে তাড়িত করে। পীড়ন করে গোপন গূঢ় প্রশ্ন যা তার উচ্চারণের ঊর্ধ্বে মনে হয়। কী তা? কী চায় অর্জুন? সে দেখেছে, সে যখন অস্ত্র নিয়ে থাকে, অস্ত্রচালনা শিখছে, অভ্যাস করছে, সাফসুতরো করছে, কোনও প্রতিযোগিতা কোনও লড়াই বা যুদ্ধ— এই বিষাদ সে টের পায় না। অর্জুনের অস্ত্রকে বিষাদও বুঝি ভয় পায়।

আর একজন আছে। যার কথা ছোটবেলা থেকে কুন্তী মায়ের মুখে শুনেছে অর্জুন। যে থাকলে বিষাদ পালায়। যার কাছে থাকলে মন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কোনও বাধা রাখতে ইচ্ছে করে না। যে ছুঁয়ে থাকলে মনে হয় শান্তি, মনে হয় শক্তি, মনে হয় আর কিছুই চাই না এই ছোঁয়াটুকু পেলে। যাকে সে প্রথম দেখল, যেদিন পাঞ্চালীর স্বয়ম্বর সভা ছিল। ধৃষ্টদ্যুম্ন পরিচয় দিচ্ছিল। ইনি কৃষ্ণ!

কৃষ্ণ! সেই কৃষ্ণ! শিশুকাল থেকে বিস্ময়চূড়ামণি।

কৃষ্ণ স্বয়ম্বর সভায় কেবল অতিথি ছিল। মালার প্রত্যাশী নয়। অর্জুন তার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। এত রাজা-রাজড়া, বীর, মহাবীর— এত সাজগোজ আড়ম্বরের প্রতিযোগিতার মধ্যে কৃষ্ণ অনন্যসাধারণ হয়ে ছিল সারাক্ষণ। পুরুষ এত সুন্দর হয়? এত আকর্ষণীয়? কী মায়া ওই দু’চোখে! কী মাধুর্য ওই হাসিতে! ভুরুর ভঙ্গিতে বুদ্ধির কী অপূর্ব দ্যোতনা! কালো তার রং, তবু সে যেন সবার চেয়ে উজ্জ্বল। শরীরের গঠন যেমন দৃঢ় তেমন মসৃণ। কিন্তু সবচেয়ে যা বেশি, তা হল তার আকর্ষণী ক্ষমতা। কৃষ্ণের থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছিল না অর্জুনের। সে পাঞ্চালীকেও তেমন করে দেখেনি যেমন অভিনিবেশে কৃষ্ণকে দেখেছিল।

অনেক মহাঋষি, তপস্বী দেখেছে অর্জুন। অনেক বীর, মহাবীর দেখেছে। হস্তিনাপুরে সুদর্শন পুরুষের কোনও অভাব নেই। কিন্তু কী বীর, কী তপস্বী— কেউ কৃষ্ণ নয়। কৃষ্ণ বীর শুধু নয়, তপস্বীও নয় শুধু। কৃষ্ণ শুধু দেবতা নয়, শুধু মানব বা দানবও নয়। কৃষ্ণর তুলনা কৃষ্ণ নিজে। মাথার চুল থেকে নখের ডগা পর্যন্ত রূপে, গুণে, বুদ্ধিতে, মোহন ক্ষমতায়!

অর্জুনের ইচ্ছে করে, কৃষ্ণের কাছে যায়। তার মনে হয়, খুব ভাল থাকবে সে কৃষ্ণের সান্নিধ্যে। কিন্তু সঙ্কোচ হয়। কতটুকুই বা পেয়েছে সে কৃষ্ণকে। স্বয়ম্বর সভার পর ওই তো সামান্য ক’টা দিন! কৃষ্ণ তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। ভাই তো আমরা আছিই। তুমি জেনো অর্জুন, তুমি আর আমি অভিন্ন।’

কী গম্ভীর মধুর কণ্ঠ! যে পুরুষকে, এমনকী অর্জুনের মতো বীর ক্ষত্রিয় তরুণকে এমন মুগ্ধ করে দিতে পারে, মেয়েদের তো সে পাগল করে তুলবেই। ঊষার যেমন সূর্যকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই, সন্ধ্যার যেমন সূর্যের রঙে রাঙা না হয়ে উপায় নেই— তেমনি কৃষ্ণকে দেখে মোহিত হওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। রমণীমোহন নাম রটবে না তার?

শুধু অর্জুন কেন, যুধিষ্ঠির ভীমসহ তারা পাঁচ ভাই-ই কৃষ্ণকে ভালবেসে ফেলেছে। কুন্তীর প্রিয় তো সে ছিলই। কুন্তী বলেছে, “মনে রাখিস, কৃষ্ণ তোদের সত্যিকারের বন্ধু। তোদের সহায়। তার অপ্রিয় হয়, এমন কিছু করিস না।” তারা পাঁচ ভাই মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে শুধু মায়ের কথা বলেই নয়। কুন্তীর বুদ্ধি, মনোবল, দূরদৃষ্টি তাদের পাথেয়। কৃষ্ণ কুন্তীর বাপের বাড়ির লোক। যদু বংশের মেয়ে কুন্তীর ভাই বসুদেবের ছেলে এই কৃষ্ণ। যদু-বৃষ্ণি-অন্ধক গোষ্ঠীতে কৃষ্ণ এখনই প্রধান পুরুষ। এই তরুণ বয়সেই। কৃষ্ণর সহায়তা মানে সমস্ত যদুকুলের আনুকূল্য পাবে তারা।

সবই ঠিক আছে। কৃষ্ণর স্বীকৃতি, আত্মীয়তা। কুন্তীর নির্দেশ। তবু, সোজা কৃষ্ণর কাছে গিয়ে বলা যায়, ভাই, আমার মন ভাল নেই, তাই তোমার কাছে চলে এলাম! না। অর্জুন অন্তত পারবে না এমন উদ্বেল হতে। সে পারে না। তার আবেগ অত্যন্ত সংযত। কৃষ্ণই একমাত্র, যে তার জমাট আবেগে আলোড়ন তুলেছে। তবু অর্জুন সময় নিতে চায়। লোকে বলে, এমনকী কুন্তী পর্যন্ত বিশ্বাস করে, কৃষ্ণ চিন্তার তরঙ্গ অনুভব করতে পারে। পৃথিবীতে খুব কম লোকের এই ক্ষমতা আছে। যেমন আছে মহর্ষি ব্যাসের। যদি তা সত্যি হয়, অর্জুন শীঘ্রই তা হলে কৃষ্ণর দেখা পাবে।

সে মন সংহত করে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়াল। অর্জুন বিবাহিত, কিন্তু আজও সে কুমার। গঙ্গার পারে সে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করবে ঠিক করেছে। তার সঙ্গী ব্রাহ্মণেরা তার আয়োজন করছে। চারপাশে যে ঘন বন, সেখানে ফল-ফুলের কোনও অভাব নেই। আশেপাশে যে পাহাড়ি গ্রাম, সেখান থেকে চাল, ডাল, আনাজ তো আসেই। সেইসঙ্গে দই, দুধ, ঘি, যবাগু— সবই পাওয়া যায়। এখানকার গোরুর দুধ যেমন ঘন, তেমনি মিষ্টি। তবে গাঁয়ের মানুষগুলো সেরকম মিশুকে নয়। তাদের কালো মুশকো চেহারা। হাসলেও যেন মনে হয় গিলে খেতে আসছে। অনার্য রাক্ষসদের মধ্যে অনেকেই এখন মানুষের মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বনের মধ্যে অপরিষ্কার জীবনও তারা আর চায় না। জঙ্গল ঘেঁষা ছোট ছোট গ্রামে চাষ করে। পশু শিকার করে। গোরু-ভেড়া পালন করতেও শিখেছে। অমিশুক হলে কী হয়, ব্যবসা মন্দ বোঝে না।

এত সুন্দর জায়গা দেখে অর্জুন এখানে সুদৃশ্য আশ্রম বানিয়েছে। থাকবে ক’দিন। বাড়ি ছেড়ে বেরনোর পর ঘোরাঘুরি তো কম করেনি। বারো বছর কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া এ ভ্রমণের আর সব উদ্দেশ্যই গৌণ। খানিক পুণ্য অর্জন করে নেবে। কিছু শিখতে পেলে শিখবে। তবু অর্জুন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চলতে চায়। প্রতিটি দিনই কোনও না কোনও অর্থবহ কাজে কাটিয়ে দিতে চায়। না হলেই অস্থিরতা। শূন্যতা। না হলেই বিষাদ।

অর্জুনের আশ্রম আর লোকজন দেখেই গাঁয়ের লোকেরা বুঝেছিল, এরা বড় ঘরের কেউ। সোজা এসে বিক্রিবাটার কথা পেড়েছিল। অর্জুন জানে, অর্জুন দেখেছে, এরা ছল-চাতুরী জানে না। মনে আর মুখে এক। বারণাবত থেকে পালিয়ে যাবার সময় হিড়িম্বা রাক্ষসী ভীমসেনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ভীমেরও যাতে তাকে ভাল লাগে, তাই বেশ সেজেগুজে চলে এসেছিল সে। আর যেভাবে কুন্তীকে অকপটে বলেছিল— তোমার এই ছেলেটিকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। ওকে না পেলে বাঁচব না… তাতেই বোঝা যায় এরা সরল। নগরের জটিল পরিবেশে এই সারল্য সম্ভব নয়। তার সাজ দেখেও বোঝা যাচ্ছিল, একেবারে আনাড়ির হাত। তবু তাকে ভারী সুন্দর লাগছিল একটাই কারণে। তার কোনও অস্বচ্ছতা বা দেখানেপনা ছিল না। প্রেম আর সরলতা দিয়ে হিড়িম্বা ভীমের মন জয় করেছিল, আর কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরের অনুমতি আদায় করেছিল।

অর্জুন গঙ্গার জলের স্বচ্ছতায় মুগ্ধ হয়ে রইল। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। কোকিল ডাকছে। আরও কত সব পাখির গান আজ ভোরের আকাশে। বসন্ত এল। যদিও এই গঙ্গাদ্বারে বসন্তেও হাওয়ায় হিমভাব আছে। যোগাভ্যাস করেছে একটু আগেই, তাই অর্জুনের খুব শীত করছে না। হালকাভাবে উত্তরীয় জড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ, অনুচর, ভৃত্য, সূপকার— সবাই মোটা পশমের চাদর জড়িয়ে ঘোরাফেরা করছে। এতসব ঠাকুর চাকর তল্পিতল্পা নিয়ে আসতে চায়নি অর্জুন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের আদেশ। কী আর করা যাবে! বেশ ক’দিন তো গেল। এবার অর্জুন অল্পে অল্পে লোক ফিরিয়ে দেবে। ওদেরও তো ঘর-সংসার বউ-বাচ্চা আছে।

অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করার পক্ষে বসন্তকাল খুব ভাল সময়। অর্জুন একবার যজ্ঞের আয়োজন দেখে নিল। ধীরে ধীরে হেঁটে চলল অদূরে পাহাড়ের দিকে। নদীর পাড়ে বড় বড় পাথরের আড়াল। নিরালায় স্নানতর্পণ করার পক্ষে বেশ ভাল জায়গা। সে হিমগলা কোমর-জলে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। কিন্তু বারবার চোখ খুলে যাচ্ছে তার। মন দিতে পারছে না। অর্জুনের অনুভূতি প্রখর। কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে, কেউ তাকে নজর করছে। কে হতে পারে! দুর্যোধন কোনও গুপ্ত শত্রু পাঠাল? অতর্কিতে আঘাত করবে? কার এত সাহস, অর্জুনকে মারে! অর্জুনের মৃত্যু এত সহজ নয়। হয়তো কোনও গাঁয়ের লোক। হয়তো নদীতে জল নিতে কি নাইতে আসা মেয়েরা। কৌতূহলে অর্জুনকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে!

অর্জুন এবার তর্পণে মন দিল।

তিন

অর্জুনকে দেখছিল উলূপী। দেখছিল চন্দ্রা, শুভা। তারা চোখ ফেরাতে পারছিল না। এই সেই অর্জুন! এই! কী রূপবান এই পুরুষ! উলূপীর সারা শরীর কেমন করে উঠল।

অর্জুন যখন পাড়ে দাঁড়িয়েছিল, ভাবছিল, তখন থেকে তিন বন্ধু তাকে দেখছে। নাগরাজ্য থেকে একটি সুড়ঙ্গপথ এই গঙ্গাদ্বার পর্যন্ত এসেছে। প্রায় নদী ঘেঁষে তার মুখ। খুব উঁচু নয়, এমন ঘোড়ায় চেপে এই সুড়ঙ্গপথে চলে আসা যায়। তবে মাথা তোলার উপায় নেই। শরীর ঝুঁকিয়ে ঘোড়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় একেবারে।

আরও ভাল করে দেখবে বলে, ঘোড়ার রাশ চন্দ্রার হাতে দিয়ে উলূপী খানিকটা এগিয়ে এল। হঠাৎ কী মনে হল, শুভাকে বলল, “তুই ফিরে যা। পাতালে আমাদের উপাসনার ঘরে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের আয়োজন করে রাখ। দেখিস, কিছু যেন বাদ না পড়ে।”

শুভা বলল, “তুইও কি অগ্নিহোত্র করবি?”

উলূপী জবাব দিল না। চন্দ্রা শুভাকে ইশারা করল। শুভা ফিরে গেল। উলূপী তাকিয়ে রইল অর্জুনের দিকে। তার চোখের পাতা পড়ছে না। সে কেন এসেছে, কী করবে সব ভুলে যাচ্ছে। অর্জুনের কালো শরীর যেন বিশ্বকর্মার নিজের হাতে গড়া। উলূপী জানত না অর্জুন এমন কালো। আর কালো বলেই যেন আরও মন টানে। অথচ অর্জুন শব্দের অর্থ সাদা। সত্যাশ্রয়ী অর্জুনের মন অপাপবিদ্ধ অমলিন বলেই অর্জুন নাম তাকে মানায়। অস্ফুটে এ নাম উচ্চারণ করতেই উলূপীর শরীরে শিহর লাগল। কী দৃঢ় অথচ মসৃণ ওই শরীর। স্বচ্ছ জলের মধ্যে অর্জুনের সর্বাঙ্গ দেখতে পাচ্ছে উলূপী। আর তার সারা শরীর কেঁপে উঠছে। অর্জুনের চুল, ভ্রূ পল্লব, চোখ, চোখের পাতা, নাক, গাল, কান, কানের লতি, ঠোঁট, অর্জুনের কণ্ঠ— যেখানে উঁচু হয়ে আছে পৌরুষদৃপ্ত অস্থি, তার হাত দু’টি, হাতের পেশির অপরূপ বিন্যাস, তার কষ্টিপাথরের মতো মসৃণ চেতানো বুক, তার মেদহীন সামান্য রোমশ পেট, চাঁদের মতো নাভি, আর… আর… তার ভিজে কাপড়ের নিচে ফুটে ওঠা দৃঢ় ঊরু, চওড়া পিঠ, পশ্চাৎ, শিশ্ন— ওঃ! ভগবান! কী করবে উলূপী! ওই বুক দেখে তার বুক টনটন করছে, ওই ঠোঁট দেখে তার ঠোঁট পানের পিপাসা হচ্ছে, ইচ্ছে করছে ভিজে লতি দুটি থেকে চুষে চুষে নেয় জল, ইচ্ছে করছে কামড়ে ধরে গলার ওই হাড়, নিজের কঠিন কাতর স্তন চেপে ধরে ওই অসম্ভব সম্ভব পিঠে, মুখ রাখে নাভিতে, শিশ্নে, অতিকায় মাছ হয়ে অর্জুনকে বুকে তুলে ভেসে চলে যায়।

উলূপীর পাগল পাগল লাগছে। সে মরে যাবে, অর্জুনকে না পেলে মরে যাবে। সে চেয়েছিল এমন পুরুষ, যাকে দেখে সে আত্মহারা হয়ে যাবে। অর্জুন যে সেই পুরুষ! একদিন, অন্তত একরাত্রি, অন্তত একবার তুমি আমাকে নাও অর্জুন, আমার সর্বস্ব নাও।

উলূপী থরথর করে কাঁপছে। চন্দ্রা তাকে জড়িয়ে ধরল। নিচু স্বরে বলল, “কী হয়েছে?”

উলূপী নিজের দু’টি স্তনে চন্দ্রার হাত রেখে বলল, “দেখ চন্দ্রা, এই স্তন কী উন্মুখ! অর্জুন আমার চন্দ্রা। অর্জুন আমার।”

চন্দ্রা উলূপীকে আরও শক্ত করে ধরল। উলূপী বলল, “তার ওই সুন্দর সুগঠিত শক্তিধর হাত একবার সে রাখবে না এই স্তনে?”

“রাখবে।”

“তার ওই অপরূপ ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরবে না আমার স্তনবৃন্ত?”

“ধরবে।”

“ওই যে দু’টি সুডৌল দীর্ঘ দৃঢ় পা, ওই শক্ত বুক দিয়ে একবার পিষে ফেলবে না আমাকে?”

“ফেলবে।”

“আঃ আঃ! চন্দ্রা! কত না মধুর সেই যন্ত্রণা যখন তার তীব্র সবল শিশ্ন প্রবেশ করবে আমার তৃষ্ণার্ত যোনিতে! ওঃ চন্দ্রা! আমি মরব! আমি মরব চন্দ্রা।”

“তুই মরেছিস লূপী।”

“চল ওকে বেঁধে নিয়ে যাই।”

“অর্জুনকে? পাগল!”

“হ্যাঁ। চন্দ্রা। ও যুদ্ধ করবে না। বাধাও দেবে না। ও যে মহা বীর। ও কখনও মেয়েদের সঙ্গে লড়ে?”

অর্জুনের চোখ বন্ধ ছিল। কে যেন এক টুকরো কালো কাপড়ে তার মুখ ঢেকে দিল। দু’জোড়া কোমল অথচ সবল হাত তার দু’টি হাত দু’দিকে ধরে বলল, “সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ো না অর্জুন। তোমার যোগ্য কাজ হবে না সেটা। চুপচাপ চলো আমাদের সঙ্গে। আমরা তোমার কোনও ক্ষতি করব না।”

নারীকণ্ঠ! এরা কারা? দস্যু? লুটেরা? অর্জুন শুনেছে, হিমালয়ের পাকে পাকে বিস্ময় ও রহস্য। এখানকার মানুষ, গাছ, প্রাণী— সমস্তই বিচিত্র। আশ্চর্য। হতে পারে নারীই এখানে দস্যু। বিস্মিত অর্জুন একটু মজা পেল। ক’টা মেয়ে। দু’জন? তিনজন? এক দল? একটা গোটা বাহিনী? অর্জুন পরোয়া করে না। বিশেষত কোনও নারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কি বলপ্রয়োগের কথা তার দুঃস্বপ্নেও আসে না! সে বুঝতে পারছে না এরা কী চায়! তার মুখ মাথা ঢেকেই বা দিল কেন? সে কি বন্দি?

অর্জুনের তর্পণ শেষ হয়েছিল। সে দেবতাদের প্রণাম জানাচ্ছিল। এরপর অগ্নিহোত্রে বসার কথা ছিল তার। যজ্ঞ সম্পন্ন না করে সে কথা বলবে কী করে? যা হবে, দেখা যাবে। সে চন্দ্রা ও উলূপীর নির্দেশমতো চলতে লাগল। ঘোড়ায় চাপল। নিচু হল। একটি ঘোড়ায় অর্জুন, একটিতে চন্দ্রা ও উলূপী। অর্জুনের দেশে কেউ সরাসরি ঘোড়ার পিঠে চাপে না। ঘোড়া ব্যবহার হয় রথ টানার জন্য। যারা ভাষা ও সংস্কৃতিহীন— তারা ঘোড়ার পিঠে চাপে এমন মনে করা হয়। যেমন দস্যুর দল। পরস্ব অপহরণ যাদের পেশা। তবে ছোটবেলায় তারা গোরু ঘোড়া হাতি— সবেতেই আরোহণ করে দক্ষতা প্রমাণ করার চেষ্টা করত। বাল্যের অভ্যাসে বন্ধ চোখেও দৃষ্টির অনুমানে ঘোড়ার পিঠে ভারসাম্য রক্ষা করতে লাগল সে। শরীর মিশিয়ে ফেলতে হয়েছে ঘোড়ার পিঠে। অর্জুনের আগে-আগে রয়েছে দুই নারী। তারা অর্জুনকে সোজা নিয়ে গেল তাদের মাটির তলার কক্ষে। উপাসনার ঘরে। জয়া আর শুভা যজ্ঞের সব আয়োজন করে রেখেছে। উলূপী অর্জুনের মুখের ঢাকা খুলে দিল। অর্জুন, যজ্ঞের আয়োজন দেখে পূজায় বসল। তাকে একলা রেখে উলূপী, শুভা আর চন্দ্রা বেরিয়ে এল। জয়া রইল দুয়ারের বাইরে। যদি অর্জুনের কিছু প্রয়োজন হয়।

উলূপী চন্দ্রাকে বলল, “অর্জুনের আশ্রমে খবর দে চন্দ্রা। না হলে লোকে অযথা দুর্ভাবনা করবে। জানাবি, সে সুস্থ আছে। অল্পদিনের মধ্যেই ফিরে যাবে।”

চন্দ্রা চলে গেল। শুভা গেল অর্জুনের বিশ্রাম ও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে। আর উলূপী গেল কৌরব্য নাগের কাছে। বলল, “বাবা, কথা আছে।”

কৌরব্যের পোষা সাপটি তার হাত জড়িয়ে ছিল। সে তাকে সম্পুটে রেখে দিল। উলূপী পোষে দুধগোক্ষুর। গোখরো সাপ দিয়ে বানানো তার নাগপাশ বাণ অত্যন্ত শক্তিশালী।

কৌরব্য নাগ সভা ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে আলোচনার ঘরে এল। পুঁথিপত্রে ভরা এ ঘর কৌরব্য এবং উলূপীর পাঠশালও বটে। উলূপী শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর এই ঘরে একলা এলেই কৌরব্যর বুক হু হু করে। উলূপীও অনেকদিন পর এ ঘরে এল। তার মন আনন্দে ভরে গেল। সে বলল, “বাবা, আমি অর্জুনকে নিয়ে এসেছি। সে আমাদের অতিথি।”

কৌরব্য নাগ মহা বিস্ময়ে বলল, “অর্জুনকে নিয়ে এসেছিস? কোন অর্জুন? তৃতীয় পাণ্ডব? পার্থ? সেই মহাবীর অর্জুন— ত্রিভুবনে এক কৃষ্ণ ছাড়া যার তুলনীয় বীর আর কেউ নেই? নাকি অন্য কেউ? অন্য কোনও অর্জুন?”

“তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। সে তৃতীয় পার্থ। মহাবীর অর্জুন।”

কোথা থেকে, কীভাবে অর্জুনকে নিয়ে এসেছে, বাবাকে বলল উলূপী। কৌরব্য নাগ মহা বিস্ময়ে বলল, “কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে তুই তাকে ধরে আনলি মা?”

“বাবা, শাস্ত্রে তো স্বামীহারার আবার বিয়ে করায় বাধা নেই। তুমি তোমার একলা দুঃখী মেয়েকে অর্জুনের হাতে তুলে দাও।”

“মা রে! তোর কষ্ট আমি বুঝি। এই তোর অল্প বয়স। তোর কথা ভেবে ভেবে রাতে আমার ঘুম হয় না। কিন্তু কী করব তা ভেবে পাই না। অর্জুনকে বেছে নিয়েছিস তুই, আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু অর্জুন কি রাজি হবে? যতদূর শুনেছি সে ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেরিয়েছে।”

“সে ভার আমার বাবা। আমি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাব।”

“বেশ। আমি রাজি। কিন্তু মা, আচারে ব্যবহারে জ্ঞানে বুদ্ধিতে শীলতায় গুণে, রূপে, আমি জানি, আমার মেয়ে অনন্যা। অর্জুনের যোগ্য মেয়ে তুই। তবু, মনে রাখিস, বংশ, কুল, জাতি, পিতা এবং নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোনও আচরণ যেন করে ফেলিস না। নিজের প্রিয় ঘোড়াকেও যেমন লাগাম পরিয়ে চালনা করতে হয়, নিজের পোষা সাপেরও যেমন বিষদাঁত ভেঙে দিতে হয়, তেমনি নিজের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।”

উলূপী বলল, “আমি তোমার উপদেশ মনে রাখব বাবা। এমন কোনও কাজ আমি করব না যা অর্জুনের অপ্রিয়। এমন কোনও কাজ আমি করব না যা আমাদের কুলের পক্ষে বা তোমার পক্ষে বা আমার পক্ষে মর্যাদাহানিকর।”

কৌরব্য জিজ্ঞেস করল, “অর্জুন এখন কোথায়? তাকে সসম্মানে বসতে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।”

“সে পাতালঘরে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করছে। জয়া আর শুভা তার দেখাশোনা করছে। যজ্ঞ শেষ হলেই আমি আগে তার কাছে যাব। সে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, কেন তাকে এভাবে নিয়ে এলাম। আমি সব বলব।”

“বেশ। যদি সে রাজি হয়, বিয়েতে মত দেয়, আমি আজই অগ্নি সাক্ষী করে তোদের বিয়ে দেব। তবে, আমি চাই না কোনও আড়ম্বর হোক। পাঁচকান হোক। যত বীরই হোক, অর্জুন আমাদের স্বজাতি নয়। এই যুক্তিতে কেউ কেউ বাধা দিতে পারে।”

“কত আড়ম্বর করে তো একবার বিয়ে দিলে বাবা। সইল না। আড়ম্বর আমিও চাই না। তা ছাড়া আমি তার কাছে একটি দিন মাত্র চাইব। তার জন্য ঢাকঢোলের দরকার কী!”

উলূপী মাটির তলার ঘরে গিয়ে যজ্ঞ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যজ্ঞের ধোঁয়ায় ঘর ভরে উঠেছে। সম্পুটের সাপেরা ছটফট করছে। যজ্ঞ শেষ হতেই উলূপী আর জয়া পথ দেখিয়ে অর্জুনকে পাতালের ঘর থেকে বাইরে নিয়ে চলল। অনেক ভেবেই উলূপী মাটির তলায় যজ্ঞ করিয়েছে। যজ্ঞের ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে এলে লোকের কৌতূহল বাড়ত।

বাইরে এসে অর্জুন দেখতে পেল কী সুন্দর এক দেশে সে পৌঁছে গিয়েছে। চারদিকে ঘন সবুজ বন। গাছে গাছে আগুনের মতো ফুল ফুটে আছে। পাখির গানে আকাশ মুখর। ফুলের গন্ধে পাগল ভোমরা এলোমেলো উড়ছে। একটি আশ্চর্য সুন্দর ঝরনা সাদা গোখরো সাপের মতো এঁকেবেঁকে নেমে আসছে কোন উঁচু থেকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কাঠের বাড়ি। তাতে অপূর্ব কারুকাজ। অদূরে ঢালু চারণক্ষেত্র। তাতে যে-গোরু ছাগল ভেড়া ঘোড়া চরছে তারা পরিষ্কার, স্বাস্থ্যে ভরপুর। তাদের শাবকরা প্রাণচঞ্চল। বোঝা যায় তারা মায়ের দুধ যথেষ্ট খেতে পায়। কোথাও কোনও আবর্জনা নেই। ঝগড়া-বিবাদ নেই। এমনকী সাপেরাও এখানে নির্ভয়, নিশ্চিন্ত। এ কোন দেশ?

অর্জুন দেখল এক পরমাসুন্দরী মেয়ে তার দিকে অপলক চেয়ে আছে। সুন্দরী কিছু কম দেখেনি অর্জুন। বিশেষত, তার বউ, পাঞ্চালীর মতো সুন্দরী আর কে আছে! তবু, অর্জুনের মনে হল, এই মেয়েটির মতো আর কেউ নয়। এর মধ্যে এমন এক সতেজ ভাব, যা কেবল প্রথম বর্ষার জলে ভেজা তরুণ আমগাছের শাখায় আর ঘন পল্লবে লেগে থাকে। অর্জুনের বুকের তলায় যে-বিষাদ বিক্ষোভ ধিকিধিকি কষ্ট দিচ্ছিল, তার ওপর শান্তি নেমে এল। সে বলল, “ওগো রূপসী মেয়ে, কে তুমি? আমিই বা কোথায়? আমাকে এখানে আনা হয়েছে কেন? আমি শত্রুর দেশে আছি, নাকি বন্ধুর দেশে? এমন মনোরম শান্তিপূর্ণ দেশের রাজা কে?”

উলূপী বলল, “ঐরাবত নাগের বংশে কৌরব্য নাগ এ দেশের রাজা। এ হল নাগরাজ্য। তুমি নিশ্চয়ই জানো নাগ-মা দক্ষকন্যা কদ্রু আমাদের আদি মাতা আর কশ্যপ মুনি আমাদের আদি পিতা। আমি কৌরব্য নাগের মেয়ে উলূপী। এই যে দেখছ শান্তিপূর্ণ দেশ, এ দেশে কিন্তু শান্তি থাকে না সবসময়। তুমি নিশ্চয়ই নাগদের চিরশত্রু গরুড়দের কথা জানো। তারা সুযোগ পেলেই আমাদের লোককে মেরে ফেলে। আমাদের শস্য ও সম্পদ নষ্ট করে। তুমি কিন্তু ভেবো না অর্জুন, আমাদের শত্রু বিনাশ করার জন্য তোমাকে আমরা এনেছি। আসলে কী হয়েছে জানো? ত্রিভুবনের সেরা বীর অর্জুন গঙ্গাদ্বারে এসেছেন শুনে আমি তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি দাঁড়িয়েছিলে গঙ্গাপাড়ে। তারপর তুমি জলে নামলে। স্নান-তর্পণ করলে। তোমাকে দেখে আমার শরীর-মন আকুল হয়ে উঠল। পাছে তোমার সঙ্গী ব্রাহ্মণরা এটা ওটা বিধান দেখিয়ে আমাদের মিলনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাই তোমাকে একেবারে তুলে নিয়ে নিজের দেশে এলাম। এই যে সুন্দর দেশ, এখানে যে আরও কত রমণীয় জায়গা আছে, তোমাকে দেখাব আমি। তেমনই কোনও সুন্দর জনহীন জায়গায়, খোলা আকাশের নীচে, পাহাড়ের কোলে আমাদের মিলন হোক অর্জুন।”

আর পাঁচটা ছেলের মতো অর্জুনও শুনেছে নারী রহস্যময়ী। মেয়েদের নাকি মনের তল পাওয়া যায় না। কোনও কিছু যদি তারা চায়, তবে ভাব দেখায় যেন চায় না। ইচ্ছাকে অনিচ্ছার রূপে প্রকাশ করাই তাদের ধরন। আবার এটাও সরল সত্যি বলে ধরা যাবে না। তা হলে আর গোল পাকল কোথায়! মেয়েরা সম্মতিতে অসম্মতির ভাব দেখায় ঠিকই, কিন্তু অনিচ্ছেকে ইচ্ছে বলবে না একটিবারও। তার ওপর, মেয়ে যদি হয় বুদ্ধিমতী, শাস্ত্রবিশারদ এবং ব্যক্তিত্বময়ী, তবে তো কথাই নেই। তাদের দু’রকমের মানেওয়ালা কথার রহস্য বুঝতেই প্রাণ যাবে। পাঞ্চালীকে এখনও পায়নি অর্জুন। তবু অল্প কিছুদিন দেখেছে তো! নারী রহস্যময়ী— এই প্রবাদ যেন সার্থক তার ক্ষেত্রে।

উলূপী রাজার মেয়ে। তার কথা, আচরণ, তার ব্যক্তিত্বের বিভা— সবকিছুতেই তার শিক্ষা, তার জ্ঞান ও গুণ প্রকাশ পায়। কিন্তু কই, উলূপীকে তো একটুও দুর্বোধ্য লাগছে না অর্জুনের। তার মনে হল, এই উদার আকাশ, এই নিবিড় প্রাকৃতিক সাহচর্য, বহুজনসমাগমে জটিল সমাজনীতির বাইরেকার এই পার্বত্য দেশে মনের সৌন্দর্য আর দেহের সৌন্দর্য বুঝি একাকার হয়ে যায়। জ্ঞান এবং সারল্য পরস্পর বৈরী হয়ে যায় না। উলূপীর সরল আত্মনিবেদন ভারী ভাল লাগল অর্জুনের। ভীমসেনের বউ হিড়িম্বার কথা আবারও তার মনে পড়ল। উলূপী আরও অনেক বেশি পরিশীলিত। রাক্ষস জাতির সঙ্গে এই নাগজাতি বা গরুড়দের ধর্ম বা আচরণে পার্থক্য অনেক। তবু, সরলমনা হিড়িম্বা আর উলূপীর অকপট আত্মনিবেদন একাকার মনে হল অর্জুনের। উলূপীকে এক কথায় না বলতে তার মন চাইল না। তা ছাড়া এও তো ঠিক, অর্জুন এই তরুণ বয়সে বড় বঞ্চিত, বড় কাতর। এক স্বয়মাগতা পরমাসুন্দরী মেয়ের কামনা তাকেও সহজেই সকাম করে তুলছে। সে কী করবে, কী বলবে ভেবে পেল না। দূরের শ্বেতনাগিনী ঝরনার দিকে তাকিয়ে রইল উদাস চোখে। তারপর বলল, “সে যে হবার নয় উলূপী।”

হৃদয়ের উদ্বেল অবস্থা এখন সংযত রেখেছে উলূপী। সে শান্তভাবে বলল, “কেন অর্জুন? আমি নিজে তোমাকে চেয়েছি। আমার কোনও স্বামীও নেই যে, ধর্মত তার কাছেই আমার কামনা প্রকাশ করার কথা।”

অর্জুন বলল, “বাধা তোমার নয় রূপসী। কী সুন্দর তোমার মুখ। কী সরস তোমার ঠোঁট দু’টি। পাকা বেলফলের মতো অপরূপ দুটি স্তনের আভাস যে কোনও গভীর অনুভূতিসম্পন্ন পুরুষকে পাগল করে দেবে। আর তোমার সত্তার মধ্যে যে-বিভা, তা কেবল সুশিক্ষা এবং সুরুচি থেকেই আসে। বাধা তোমাকে নিয়ে নয়। বাধা আমাকে নিয়ে। আমি যে বারো বছরের জন্য ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা নিয়েছি।”

উলূপীর মুখ ম্লান হল। যেন রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড়ে ছায়া ফেলল ভাসমান মেঘ। অর্জুনের বুক টনটন করে উঠল। তার ইচ্ছে হল, এখুনি এই মেয়েকে সাপটে বুকে টেনে নেয়। চুমুতে চুমুতে মুছে দেয় তার ম্লানিমা। সে তাড়াতাড়ি বলল, “না না। আমি একথা বলছি না যে, যা করলে তোমার আনন্দ হবে তা আমি করতে চাই না। উলূপী, এমন কোনও উপায়ের কথা কি তোমার মনে আসছে, যাতে তোমারও ইচ্ছে পূর্ণ হল আর আমারও ধর্ম নষ্ট হল না? তোমার কারণে যদি আমি ধর্মচ্যুত হই, তবে লোকে তো তোমারও নিন্দা করবে। আমি তা চাই না।”

উলূপী হাসল। সে এখন শান্ত। স্থিতধী। সে বুঝেছে অর্জুন তাকে গ্রহণ করতে অসম্মত নয়। তাতেই তার অর্ধেক পাওয়া হয়েছে। সে বলল, “হ্যাঁ। উপায় জানি আমি অর্জুন। তুমি নিরুদ্বেগ থাকো। তোমার সম্মান বা সুনাম নষ্ট হয়, এমন কিছুই আমি করব না। এখন চলো, তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আগে কিছু খাও। তারপর আমরা উপায় আলোচনা করব। যদি তুমি সেই উপায় মেনে নাও, তোমাকে আমার বাবা কৌরব্য নাগের কাছে নিয়ে যাব। তিনি অপেক্ষা করছেন। তোমার সম্মতি পেলে তিনি আমাকে তোমার হাতে সমর্পণ করবেন।”

অর্জুন বলল, “চলো।”

উলূপী অর্জুনের কাছে কাছে রইল যতক্ষণ না তার খাওয়া শেষ হয়। একে নবীন তরুণ, তার ওপর যোদ্ধা, ভাল করে না খেলে শরীর টিকবে কেন! উলূপী, শুভা, জয়া সবাই তা জানে। যখন অস্ত্রচালনা অভ্যাস করে, তাদেরই কত খিদে পায়! মনে হয় যা পায়, গোগ্রাসে খায়! আর অর্জুন তো পুরুষ মানুষ। তার ওপর কতকাল ধরে তীর্থে তীর্থে ঘুরছে। কুন্তীর তত্ত্বাবধানে, কি পাঞ্চালীর যত্নে পাওয়া খাবারের যে-স্বাদ, পথচলতি অবস্থায় ঠাকুরের রান্নায় কি তা পাওয়া যায়?

খুব যত্নে অল্প অল্প করে খাচ্ছিল অর্জুন। তার মুখ প্রসন্ন। কোনও তাড়াহুড়ো নেই, আগ্রাসী ভাব নেই, ডালে-ভাতে-ঝোলে আঙুল মাখামাখি হয়ে যায়নি। গ্রাস তোলবার সময় মুখের হাঁ বিশ্রী হয়ে উঠছে না। চিবুনোর সময় চাকুম-চুকুম শব্দ হচ্ছে না। খাবার ধরন যতখানি চারু হলে উলূপীর ভাল লাগে, অর্জুন তার চেয়েও বেশি।

একেবারে ছোট্টবেলা থেকে বিভিন্ন পরিবেশে থেকেছে অর্জুন। শৈশবে ছিল বনে। বাবা পাণ্ডু, দুই মা কুন্তী মাদ্রী আর যত ঋষি তাপসের সঙ্গে দিন কাটত তাদের পাঁচ ভাইয়ের। তারপর এল হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। পাণ্ডু নেই। মাদ্রীও সহমরণে গিয়েছে। একা কুন্তী পাঁচ ছেলেকে বুকের পাঁজর করে রাখত সবসময়। তা ছাড়াও বহু স্নেহযত্ন পেয়েছে অর্জুন। ভীষ্ম তাকে প্রাণাধিক ভালবাসে। বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কৃপাচার্য্য। কে নয়? আর সে যে দ্রোণাচার্য্যের নয়নমণি তাও সবাই জানে। দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা তাদেরই বয়সী। দুর্যোধন তাকে তাতিয়ে দেবার জন্য বলত, “তোর বাপ তোকে ভালবাসে কম, আর ওই মুখচোরা কালো কুচকুচে অর্জুনকে বেশি।”

অশ্বত্থামা খুব রেগে যেত একথায়। যখন ছোট ছিল কাঁদতে কাঁদতে দ্রোণাচার্য্যর কাছে গিয়ে বলত— বাবা, ওরা বলে তুমি অর্জুনকেই বেশি ভালবাসো। তাই নিয়ে কত মজা করে ওরা।

একটু বড় হতে ওই একই কথায় সে গম্ভীর হয়ে যেত। অশ্বত্থামা মস্ত বীর। মস্ত পণ্ডিত। অর্জুনের সঙ্গে সে সবসময় বন্ধুর মতোই আচরণ করেছে। তবু অর্জুন জানে, অশ্বত্থামা মনে মনে দুর্যোধনের সুহৃদ, পাণ্ডবদের নয়। হস্তিনাপুর ভাগ হওয়ার সময় দ্রোণ, কৃপ বা অশ্বত্থামা— কেউই ইন্দ্রপ্রস্থে চলে আসেনি। আর অশ্বত্থামা চিরকাল সন্দিহান ছিল এই ভেবে যে, দ্রোণ কিছু বেশি শিখিয়ে দিল বুঝি অর্জুনকে। এই সন্দেহ এত সংক্রামক যে, অর্জুনেরও একদিন মনে হল, দ্রোণাচার্য্য বুঝি নিজের ছেলের জন্য কিছু বিদ্যা লুকিয়ে রেখেছে। কিছুদিন সে-ও তক্কে তক্কে ছিল। একদিন যুযুত্সু তাকে দুঃখ করে বলল, “জানো ফাল্গুনী, আমিও তো রাজার ছেলে। কিন্তু আমার মা দাসী বলে আমাকে সবসময় আমার আচরণ সংযত রেখে প্রমাণ দিতে হয় আমি পরিশীলিত। দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুর্মুখ প্রকাশ্যে অপকর্ম করলেও তাদের আভিজাত্যে দাগ পড়ে না, আমার কিন্তু অসদাচরণের স্বাধীনতা নেই। ভাইদের ভালবাসাও আমি পাই না সেভাবে। তোমরা পাণ্ডুর ছেলে হয়ে আমাকে যেটুকু ভালবেসেছ, ধৃতরাষ্ট্রর ছেলেরা তা বাসেনি। বিদুরও তো দাসীর ছেলে। তবু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ভাই বলে তাঁকে কত ভালবাসেন!”

যুযুৎসুর জন্য অর্জুনের কষ্ট হয়েছিল। তার চেয়েও বেশি, সে হঠাৎ বুঝেছিল, আভিজাত্যের মোড়কে সেও নীচ আচরণ করছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঈর্ষায় মন ভরে উঠেছে তার। অনেকক্ষণ ভেবেছিল অর্জুন সেদিন। বসনপ্রান্তে লেগে থাকা চোরকাঁটার মতো একটি একটি করে বেছে তুলেছিল সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঈর্ষা। পুত্রের প্রতি পিতার স্নেহ শিষ্যর প্রতি গুরুর স্নেহকে যদি ছাপিয়ে যায় তবে দোষের কিছু নেই। স্নেহবশে দ্রোণ যদি অশ্বত্থামাকে কিছু বেশি দেয়, আর অর্জুনের দুঃখ থাকবে না। সে শিখে নেবে। জেনে নেবে। একলব্য পেরেছিল, সে কেন পারবে না? তার ঈর্ষা চলে গিয়েছিল। গুরুর প্রতি সন্দেহ উপড়ে তুলে মনে শান্তি পেয়েছিল সে। দ্রোণ তাকে অনেক দিয়েছে। গুরুপুত্র অশ্বত্থামা যতখানি বন্ধুত্বপূর্ণ, তাতেই অর্জুন খুশি। শুধু অর্জুন যখন দ্রোণের কাছ থেকে ব্রহ্মশির অস্ত্র পেল, তখন একেবারে ক্ষেপে গেল অশ্বত্থামা। দ্রোণকে সরাসরি বলে বসল, “দুর্যোধন ঠিক বলে। অর্জুনকেই তুমি বেশি ভালবাসো।”

অর্জুনের কথায় দুর্বল হয়ে যেরকম একলব্যর বুড়ো আঙুলটাই গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসেছিল দ্রোণাচার্য্য, ঠিক তেমনই, ছেলেকেই বেশি ভালবাসে তা প্রমাণ করার জন্য, খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও, ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে দিল। আসলে এতখানিই ভালবাসে দ্রোণ অর্জুনকে যে, ছেলের কাছেও পুত্রস্নেহের পরীক্ষা দিতে হয় আর শিষ্যর কাছে রাখতে হয় স্নেহের প্রমাণ।

কিন্তু জীবনসংগ্রামও তো দেখছে অর্জুন। ছোটবেলা থেকে বুঝছে জ্ঞাতিশত্রুতা কী। ভীমসেনকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিল দুর্যোধন। প্রবল প্রাণশক্তি ভীমের তাই বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু বারণাবতের জতুগৃহ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল যখন তারা, একেবারে দীন ভিক্ষুকের মতো দিন কাটছিল— জীবনের বিচিত্র রূপ দেখতে দেখতে, যা আসে, যতটুকু পায়, তাকেই গ্রহণ করে তৃপ্ত হওয়ার শিক্ষা অর্জুন পেয়ে গিয়েছে। তাই, উলূপীর এই যত্ন সে মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করছে। কে জানে, কাল সে কোথায় কীভাবে থাকবে, যত্ন দূরের কথা, আহার জুটবে না, এমন দশাও হতে পারে।

এই তৃপ্তি এই প্রসন্নতাই অর্জুনের মুখখানা ভারী নরম করে রেখেছে এখন। যা দেখে উলূপীর ভাল লাগছে। এমনিতেও, অর্জুন মহাযোদ্ধা হলেও, তার মুখে বা শরীরে কোমল লাবণ্যের এতটুকু অভাব নেই। কচি, নরম, শান্ত মুখখানি দেখলে কে বলবে, এর হাতে অস্ত্র থাকলে দেব দানব মানব যক্ষ রক্ষ সবার বিরুদ্ধে এ অপ্রতিরোধ্য? সে যদি এখন বীণা বাজায়, দিব্যি মানিয়ে যাবে, যেমন কিনা বাঁশি বাজালে মানিয়ে যায় কৃষ্ণকে, শুনেছে উলূপী। তার বুক ভরে উঠল আশ্চর্য মায়ায়। পুরুষ যতই প্রবল হোক, কোনও কোনও সময়, তার দিকে চেয়ে স্ত্রীলোকের মনে যে-বাত্সল্য জাগে, উলূপীর মনেও সেই মায়া। এমনটি তার আগে কখনও হয়নি। এই নতুনতম অনুভূতিতে তার মন কানায় কানায় ভরে উঠল। হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে উলূপী অর্জুনের চেয়ে বয়সে একটু বড়। কিন্তু এখন, এই যে অনুভব, তা কেবল বড়-ছোটর বিচারে হয় না। এ হল মেয়েদের নিজস্ব মর্মানুভূতি!

এই সবের মধ্যে উলূপী মনে মনে যুক্তি সাজিয়ে তুলছিল। একবার আড়ালে গিয়ে অর্জুনের সঙ্কটের কথা জয়াকে জানিয়েছে। জয়া পুঁথিপত্র পড়ে, ভাবে। জয়া বুদ্ধিমতী। শান্ত। শুভার মতো বোকাটেও নয় আবার চন্দ্রার মতো রাগী বা তীক্ষ্ণবাক নয়। জয়া শোনামাত্র বলেছে, “মনে রাখিস, অর্জুন ক্ষত্রিয় বীর। শরণাগতের প্রাণ বাঁচানো তার ধর্ম বটে।”

অর্জুনের খাওয়া হয়ে গেলে পর উলূপী বলল, “এইবার আমি উপায়ের কথা বলব অর্জুন।”

অর্জুন বলল, “বেশ। শুনি তোমার উপায়। কীভাবে আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারি?”

উলূপী বলল, “দেখো, তোমার ব্রহ্মচর্যের কারণ আমি জানি। এক পাঞ্চালী দ্রৌপদীকে তোমরা পাঁচ ভাই বিয়ে করেছ বলে পারিবারিক শৃঙ্খলা এবং সম্পর্কের সততা রক্ষার জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে কঠোর বিধি তৈরি করতে হয়েছে। শর্ত ভাঙলে যা কিছু সংযম সে হবে পাঞ্চালীর ক্ষেত্রে। আর কারও ক্ষেত্রে তা হবে কেন? তোমাদের মধ্যে একমাত্র ভীমসেন, যার দ্রৌপদী ছাড়াও হিড়িম্বা বউ আছে। কিন্তু যতদূর শুনেছি, বউয়ের সঙ্গে যে-নিত্য সহবাস সম্পর্ক থাকার কথা, হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের তা নেই। অন্য কোনও বধূগমনের অবকাশ যেহেতু এখনও পর্যন্ত নেই, তাই শর্তে যে-ব্রহ্মচর্যের কথা বলা হচ্ছে, তা একজনেরই জন্য। তোমাদের কোনও ভাইয়েরই একেবারে নিজস্ব বউ থাকলে, আর ব্রহ্মচর্য নিলে, বউয়ের প্রতি অধর্ম করা হবে না? এ তো খুবই স্বাভাবিক যে, তোমরা প্রত্যেকেই আরও দু’-পাঁচটি বিয়ে করবে। সাধারণ গুণহীন পুরুষই তা করে। আর তোমরা হলে শৌর্য বীর্য খ্যাতির চূড়ায়। তোমাদের মতো পুরুষ মেয়ের স্বামী হোক, কোন বাবা তা না চায়? তা, সেইসব বউরা যখন কুন্তীর সংসারে আসবে, তখন যদি কোনও ভাইয়ের ক্ষেত্রে এমন দুর্ঘটনা ঘটে যায়, সে নিশ্চয়ই শর্ত মানবে, কিন্তু মানবে শুধু দ্রৌপদীর জন্য। অন্য বউ কেন তার মধ্যে পড়বে? তা হলে তো উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে চেপে বসবে, তাই না? অর্জুন, তুমি তো সন্ন্যাস জীবনের প্রস্তুতি হিসেবে ব্রহ্মচর্য নাওনি। তুমি গৃহী ক্ষত্রিয়। সংযমের শর্ত পালন করছ মাত্র।”

একটানা এতখানি কথা বলে উলূপী একটু থামল। অর্জুন কী ভাবছে, তাও বোঝা দরকার।

অর্জুন অবশ্য খুব মন দিয়েই উলূপীর কথা শুনছিল। একটুও বাধা দেয়নি। কোনও প্রশ্নও করেনি। কথাগুলো তার ভালও লাগছিল। তার পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা চোখে ঝিকমিক করছে মুগ্ধতা। কী সুন্দর ঝরঝর তরতর করে কথা বলে মেয়েটা! ওই দূরের ঝরনার মতো। কথাও তো বাচালের বকবকানি নয়। রীতিমতো যুক্তিসঙ্গত এবং এমন এক বিধান সাপেক্ষে যুক্তি, যা স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এবং নারদ মুনি বানিয়েছে। উলূপী নিজে যা চায়, তাকে ধর্মসম্মত করে তুলতে অকাট্য যুক্তি দিচ্ছে, কিন্তু একবারের জন্যও অর্জুনকে কোনও লোভের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে না। মেয়েরা যদি চায়, বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েরা, পুরুষকে উত্যক্ত, উত্তপ্ত করতে তারা কতখানি পারে, তা কি অর্জুন জানে না? কত মহা মহা ঋষি, যাদের তপস্যার ফলে কত মহাশক্তি লাভ হয়, কত তাদের সংযম, কত আচারনিষ্ঠ তারা— সেইসব প্রণম্য ঋষিরা পর্যন্ত বিচলিত হয়েছে যখন উর্বশী, রম্ভা, ঘৃতাচী বা মেনকা সব ছোট ছোট বসন পরে, কখনও বা প্রায় নগ্ন হয়ে নেচে-কুঁদে তাদের ধ্যান ভাঙিয়েছে।

অবশ্য স্বর্বেশ্যারা যা করে, ঘরের মেয়েরা তেমন করে না। নেচে মন ভোলায় না। কিন্তু ঠিক যেমন করে তাকালে, যেমন করে দাঁড়ালে পুরুষের চোখ টানা যায়, তা অনেকেই জানে। অশ্বত্থামা কৌতুকে বলত, মেয়েদের কটাক্ষ নাকি অর্জুনের আগ্নেয় বাণের চেয়েও বেশি আগুন জ্বালতে পারে।

উলূপী এসব কিছুই করেনি। কটাক্ষেও তাকায়নি। নিজের শরীরের উঁচুনিচু প্রকট করার চেষ্টাও করেনি। এ থেকে বোঝা যায়, উলূপী স্পষ্টবাক ও ঋজু। প্রলুব্ধ করার চেয়ে প্রস্তাব করতেই সে পছন্দ করে। সে এমন কিছু করতে চায় না, যাতে তার চরিত্রের দৃঢ়তা কম পড়ে। আর সে যদি প্রলোভনের পথ নিত, অর্জুনের পা হড়কে যেত পিচ্ছিলতায়, তাতে অর্জুনেরও দৃঢ়তার যে-অভাব প্রমাণ হত, উলূপীর তা ভাল লাগত না নিশ্চয়ই। অর্জুন এইসব বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে উলূপী কতখানি পরিশীলিত। সূক্ষ্ম যুক্তির বিশ্লেষণে কতখানি পারঙ্গম। এমনকী তার কর্তব্যবোধ প্রশংসনীয়। অর্জুনের ঈপ্সিত অনারব্ধ অগ্নিহোত্র যজ্ঞের আয়োজন পর্যন্ত উলূপী করে রেখেছিল। এ পর্যন্ত উলূপী এমন কোনও কথা বলেনি যাতে তাকে বাচাল মনে হয়। এমন কোনও কাজ করেনি যাতে অর্জুন তাকে পছন্দ করতে না পারে। এমনকী উলূপী অর্জুনের দেখা আর পাঁচটা মেয়ের মতোও নয়। যেভাবে সুড়ঙ্গপথে ঘোড়ায় চেপে তারা এল, যেমন অবলীলায় সাপের সঙ্গে থাকে, তাতে অর্জুন ভালই বুঝতে পারছে, নাগ-মা কদ্রু যেমন অনন্য নারী ছিল, তার উত্তরাধিকারী উলূপীও তেমনই বিশেষ।

তবু এখনও কিছু বোঝাপড়া বাকি বলে অর্জুনের মনে হয়। খুব জরুরি সেইসব। উলূপী যেমন খোলা হাওয়ার মতো, স্বচ্ছ জলের মতো, অর্জুন যদি তেমনি হত, তবে সরাসরি প্রসঙ্গ তুলতে পারত। কিন্তু অর্জুনের চাপা স্বভাব। প্রগ্লভ তো নয়ই। বরং সে স্বল্পবাক। অত্যন্ত জরুরি বোধ না করলে সে নিজের মত পর্যন্ত দেয় না। যুধিষ্ঠিরকে সে গুরুর মতো, বাবার মতো মানে। ভীমসেনকে অবশ্য অগ্রজ বলে তেমন পাত্তা দেয় না। তারা দু’ভাই সমবয়সি বন্ধু হয়ে উঠেছে। অর্জুনকে ভীম পাগলের মতো ভালবাসে। শুধু ভীমসেনই বা কেন, বাকি ভাইরাও অর্জুনকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। কুন্তীর শিক্ষাই এমন। পাঁচভাই এক থাকো। ভালবাসো। পৃথিবীর কোনও কিছুর বিনিময়ে তোমাদের সম্পর্ক যেন না ভাঙে। এমনকী ত্রিভুবনের সেরা সুন্দরী শক্তিমতী ব্যক্তিত্বশালিনী যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালীর জন্যও নয়!

পাঁচ ভাইয়ের সম্পর্ক আমৃত্যু অটুট থাকবে, এই দীক্ষা অর্জুনের। এই ধর্ম। এই লক্ষ্য। তার সমস্ত সিদ্ধান্ত, সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধর্ম নিহিত।

প্রধানত কোন কোন জিনিস পঞ্চপাণ্ডবকে লড়িয়ে দিতে পারে পরস্পরের বিরুদ্ধে? প্ররোচনা, রাজ্য-সম্পদ এবং নারী।

এজন্যই, একমাত্র এজন্যই, যাজ্ঞসেনীকে বিলিয়ে দিয়েছে অর্জুন। পাঞ্চালী কেবল অর্জুনের নয়। অর্জুনও শুধু দ্রৌপদীর হয়ে থাকবে না। নিজেকেও বিলিয়ে দিতে হবে তার। পাঞ্চালীর ব্যক্তিত্ব অনতিক্রমণীয়, আকর্ষণ অমোঘ, পাঞ্চালীর অধিকারবোধ অতি সূক্ষ্ম এবং তীব্র। শুধুমাত্র যাজ্ঞসেনীর স্বামীত্বও অর্জুনের পক্ষে কম সমস্যার নয়। তাই সে নিজেকে বিলিয়ে দেবে। শুধু কি বিলিয়ে দেওয়া? ত্যাগ স্বীকার নয়?

না। আর ভাবতে চাইল না অর্জুন। চিন্তা বহু দূর যেতে পারে। এবং চিন্তাই চিন্তার প্রতিপক্ষ।

আপাতত অর্জুন নিজের ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হতে চাইল। এই মেয়ে, মহারমণী উলূপী, তার ব্রহ্মচর্যের আংশিকতা সম্পর্কে যে-যুক্তি দিচ্ছে তা ধর্মত সঠিক। কারণ তা সত্য। তাই, অর্জুন বুঝতে পারছে, আর বেশি দেরি নেই। সে উলূপীর সঙ্গে চিরবন্ধনে জড়িত হতে যাচ্ছে। সে জড়িত হতে চাইছে। সে তো নিজেই চেয়েছিল এমন যুক্তি, যা তার এবং উলূপীর মিলন চরিতার্থ করবে। আহা! কী সুন্দর এই মুহূর্ত! এক মহাধার্মিক, মহাবীর, পরমসুন্দর পুরুষ আর এক মহাধার্মিক, মহাজ্ঞানী, পরমসুন্দরী নারী ধর্মের জটিল গোলকধাঁধায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে সঙ্গম করবে বলে। পশুর মতো নয়, কীটপতঙ্গের মতো নয়, কামাতুর চালাকিতে নয়, নয় ইতর বলাত্কারে— নয় পুত্রলোভাতুরতায়— নারী ও পুরুষের চিরন্তন মিলনের আকাঙ্ক্ষা, যৌন ইচ্ছা— তাকে এর চেয়ে বেশি ধর্মসম্মত মর্যাদা দেওয়া আর কি সম্ভব ছিল!

অর্জুন মুগ্ধ। কিন্তু সতর্কও। প্রেমাবেশে, মুগ্ধতায়, যৌন টানে, সে এমন কিছু করে ফেলবে না তো যা তার ভাইদের থেকে তাকে সরিয়ে দেবে? না। অর্জুন তা করতে পারে না। এই বারো বছরে যদি পুণ্য কিছু আহরণ করতে পারে, তা সে ভাইদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে। যদি শক্তি বাড়াতে পারে, শিখতে পারে নতুন বিদ্যা, পেয়ে যায় নতুন অস্ত্র— সব ব্যবহার করবে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যের কল্যাণে। আ-আ-আঃ! বড় মায়া হয়! মায়ায় বুক টনটন করে! অর্জুন জানে, সে বীরশ্রেষ্ঠ, অর্জুন জানে, তাকে ছাড়া যুধিষ্ঠির সম্পূর্ণ অসহায়!

না। অর্জুন এমন কোনও বন্ধনকে প্রশ্রয় দেবে না যা তাকে ভাইদের থেকে আলাদা করে দিতে পারে। তার মনে আছে, হিড়িম্বা যখন ভীমসেনের প্রেম চাইল, সে অনার্য রাক্ষসী হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির বিয়েতে মত দিয়েছিল। কুন্তীও। তবে যুধিষ্ঠির হিড়িম্বাকে শর্ত দিয়ে বলেছিল— প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে ভীমকে ফিরিয়ে দিয়ে যেয়ো।

যুধিষ্ঠির ভীমের সুরক্ষার কথা যেমন ভেবেছিল, তেমনই, প্রথম নারীগমনে যে-আবেশ মন আচ্ছন্ন করে, নিজেদের থেকে দূরে রেখে, সেই আচ্ছন্নতা প্রগাঢ় হতে দিতেও সে চায়নি। ভীমও এমন কিছু চায়নি, যাতে তাকে ভাইদের থেকে দূরে যেতে হয়। সে বলেছিল, হিড়িম্বার একটা ছেলে হলেই সে আর সব কাজে মন দেবে আগের মতোই।

কে না জানে, নারীদেহের পূর্ণ অভিজ্ঞতা, যৌনসঙ্গমের প্রথম অভিজ্ঞতা একজন পুরুষের শরীরে-মনে কী বিপুল পরিবর্তন এনে দেয়! একজন পুরুষের পক্ষে তা নবজন্ম! একজন নারীর পক্ষেও। তবু, কোনও মেয়ে কী করে বুঝবে, নারীশরীর পুরুষের কাছে ঠিক কী, কতখানি! এই অদম্য অমোঘ টানের কাছে পুরুষ কতখানি অসহায়!

অর্জুন চুপ করে আছে দেখে উলূপী বুঝতে পারছে, সে চিন্তামগ্ন। আর সেটাই স্বাভাবিক। তাই উলূপী এতটুকু বিরক্ত করেনি অর্জুনকে। মতামত দেবার জন্য তাড়া দেয়নি। সে ধৈর্য ধরে আছে। এই ধৈর্য সুন্দর। এই অপেক্ষা রমণীয়। সে বলল, আমায় সঙ্গম করো, আর চেনা নেই, জানা নেই, আগুপিছু ভাবা নেই, অর্জুন বসন খুলে ঝাঁপ দিল— এমন ইতর আচরণ উলূপীর কাম্য নয়। এমন ইতরমনা পুরুষও সে চায় না। কাম এক কলা বটে। তাকে বরণ করে নিয়েই সুখ। হরণ করে নয়।

অর্জুন তার সুন্দর দুই চোখ পরিপূর্ণ মুগ্ধতায় উলূপীর মুখের ওপর রাখল। অদূরেই একটি চন্দন গাছের ডালে একঝাঁক পাহাড়ি ময়না এসে বসল। মৌটুসীরা বনফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠে ছাগলছানা লাফালাফি করছে। মাত্র এক-দু’দিন আগে জন্মেছে যে-বাছুরগুলো, তাদের ফুর্তির সীমা নেই। এমন জোর ছুটছে যেন বনহরিণ। কামিনীর ডাল জড়িয়ে আছে দু’টি সাপ।

অর্জুন বলল, “যেমন সুন্দর দেখতে তুমি উলূপী, তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত তোমার কথা। যে-যুক্তি তুমি দিয়েছ, ত্রিভুবনের সবাই যাকে মানে, সেই কৃষ্ণও বোধহয় এই যুক্তি গ্রহণ করতেন। তবু, এরপরেও কিছু কথা থেকে যায়।”

উলূপী বলল, “তোমার মনে যে-ভাবনা চলছে তা বলে দাও অর্জুন। আমি তোমাকে চেয়েছি, চাইব সারাজীবন, তা সত্যি। কিন্তু আমি চাই না, আমার কারণে তুমি এমন কোনও কিছু করো, যাতে তোমার পশ্চাত্তাপ হয়। তা হলে যেমন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না, তেমনি তুমি পশ্চাত্তাপে পুড়ে যাচ্ছ, এ-ও আমি সইতে পারব না। আমি মরে যাব অর্জুন। তার চেয়ে ভাল, মনের কথা খুলে বলা।”

অর্জুন বলল, “দেখো উলূপী, ব্রহ্মচর্যের ধর্ম হল প্রবৃত্তি সংযম। তুমি সঠিক ব্যাখ্যা করেছ। আমার ব্রহ্মচর্য সন্ন্যাসের জন্য নয়, শর্তপালনের জন্য। তাই সেই ব্রহ্মচর্যও পালিত হবে শর্তসাপেক্ষে। কিন্তু ব্রহ্মচর্য মানে শুধু প্রবৃত্তি সংযম তো নয়। তীর্থ ভ্রমণ, যাগযজ্ঞ করে পুণ্য সঞ্চয় তার অঙ্গ। এমনকী মায়াবন্ধন কাটিয়ে চলাও কি ব্রহ্মচারীর ধর্ম নয়?”

উলূপী হাসল। অর্জুনের সংশয়ের কারণ সে বুঝেছে। পাছে এই সংশয় অর্জুনের সম্মতিকে নেতির দিকে নিয়ে যায়, তাই উলূপী বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে আমার হও অর্জুন। আর হওয়াই উচিত তোমার। কারণ তুমি ক্ষত্রিয়। শরণাগত আর্তজনকে রক্ষা করাই তো ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। তোমাকে যদি না পাই অর্জুন, এ জীবন আর রাখব না। গঙ্গাদ্বারে, ঠিক যেখানে তুমি স্নান করছিলে আর আমি দু’চোখ ভরে তোমাকে দেখছিলাম, সবসময় ছায়ার মতো যে আমার সঙ্গে থাকে সেই চন্দ্রা ছিল আমার সঙ্গে, আমি তোমাকে দেখতে দেখতে এমনই আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম অর্জুন যে, চন্দ্রা আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে সামলে রাখছিল যাতে টলে পড়ে না যাই, সেই জায়গায়, অর্জুন, তোমাকে না পেলে ঠিক সেই জায়গায় আমি গঙ্গার পুণ্য জলে আত্মবিসর্জন দেব। তুমি আমাকে বাঁচাবে না? অর্জুন? যদি আমার সঙ্গে মিলনে তোমার ব্রহ্মচর্যের শর্ত পালনে কোনও ত্রুটি হয়ে যায়, যদি বা কোনও অধর্ম ঘটে, এই যে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করে তুমি আমাকে বাঁচাচ্ছ, তাতেই সেই অধর্ম ছাপিয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে।”

অর্জুন আরও একবার মুগ্ধ হল উলূপীর কথায়। উলূপী বলতে লাগল, “আর বন্ধনের যে-শঙ্কা তুমি করছ অর্জুন, তা যাতে এতটুকু না থাকে, তাই আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, আমি তোমার কাছে মাত্র একটি রাত্রি চাইছি। এরপর, যদি আমাকে ভাল লাগে তোমার, যদি তুমি আর ক’টা দিন স্বেচ্ছায় থাকো, আমি ধন্য হব। কিন্তু বাঁধব না তোমাকে। মেয়েদের যে স্বাভাবিক ইচ্ছা, সন্তান পাবার ইচ্ছা, তার জন্যও তোমাকে আটকাব না। আর যদি তোমার-আমার মিলনে আমি গর্ভবতী হই, পুত্রমুখ দেখানোর ছলেও তোমাকে আমি থেকে যেতে বলব না। অর্জুন, তুমি যে ত্রিভুবনের মঙ্গল সাধন করার জন্য জন্মেছ, এই নাগরাজ্যের সামান্য মেয়ে উলূপীর আঁচল ধরে বসে থাকার জন্য নয়, তা উলূপী বোঝে।”

অর্জুনের মন মুগ্ধ ছিলই। উলূপীর কথায় তা যেমন নিঃশঙ্ক হল, তেমনি, উলূপীর আর্তিতে তা ভিজে উঠল। অর্জুন মহাধনুর্ধর, মহাবীর। কিন্তু তার মনের কোমল ভাব বীরপনার সঙ্গে সঙ্গে পাথর হয়ে যায়নি। শুধু কোমলই বা কেন, অর্জুনের বোধ অতি সূক্ষ্ম। অতি শৈল্পিক। এ কারণেই অর্জুন এত বেশি কর্তব্যপরায়ণ!

অর্জুনের সূক্ষ্মভাব আরও পরিষ্কার হয়ে যায় একই মায়ের পেটের ভাই ভীমসেনের সঙ্গে তার তুলনা করলে। বীরত্বের দিক দিয়েও, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র ভীমই অর্জুনের কাছাকাছি। কিন্তু ভীমসেনের বীরত্ব দেখানোর মধ্যে একরকম দানবীয় ভাব আছে। মাথা গুঁড়িয়ে দিল, হাত-পা টেনে ছিঁড়ে ফেলল, তুলে আছাড় মারল। অর্জুন কখনও এরকম করতে পারবে না। যুদ্ধের ধরনে কোনও বীভত্সভাব নেই বলেই তো অর্জুনের আরেক নাম বীভত্সু। এই নাম অর্জুন পছন্দ করে। আর ভীমসেনের এমন কোনও তকমার পরোয়াই নেই। জমিয়ে খেতে ভালবাসে বলে রান্নাতেও ভীমের খুব আগ্রহ। বেশ ভাল রাঁধে ভীম। অর্জুনের রান্নায় একটুও আগ্রহ নেই। সে গান ভালবাসে। ভীমসেনের অনেক রকমসকমই অর্জুনের বিপরীত। ভীম খায় গাদা গাদা, হাম-হাম করে। অর্জুন খায় পরিমাণ মতো। তার খাবার ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয়েছিল উলূপী।

উলূপীর যুক্তিতে আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়ে অর্জুন বলল, “তবে তাই হোক অনিন্দ্যসুন্দরী উলূপী। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তোমার ইচ্ছার সঙ্গে আমার ইচ্ছা মিলেমিশে যাক। তুমি হরণ করো আমার কৌমার্য।”

আনন্দে উলূপীর চোখে জল এল। অর্জুন বলল, “তবে আমার গঙ্গাদ্বারের আশ্রম কুটিরে কাউকে যে কিছু বলে আসা হয়নি।”

উলূপী চোখের জল মুছে বলল, “তার ব্যবস্থা আমি করেছি অর্জুন। খবর দিয়েছি, তুমি ক’দিন এখানে থাকবে।”

“ধন্য তোমার কর্তব্যজ্ঞান উলূপী। কিন্তু সুন্দরী, আমি যদি সম্মত না হতাম? তুমি কি এতই নিশ্চিত ছিলে যে, আমি রাজি হব?”

“না অর্জুন। তা কি হওয়া যায়, বলো? তোমার কীর্তি শুনে তোমাকে আর পাঁচজনের মতো আমিও শ্রদ্ধা করেছি। তাই তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম। অর্জুন, লোকে বলে কৃষ্ণর মতো সুপুরুষ ত্রিভুবনে কেউ নেই।”

“তা সত্যি উলূপী। কৃষ্ণ শুধু রূপে নয়, জ্ঞানে গুণে বুদ্ধিতে প্রেমে— সব মিলেই সে অনন্য। সে সেরা। সে আমাদের ভাই। আমাদের বন্ধু।”

“হ্যাঁ। আমাদের শত্রু বিনতার বংশধর গরুড়দের সঙ্গে কৃষ্ণর খুব ভাব। আমি তাঁকে দেখিনি। কিন্তু অনুমান করতেও পারি না, তোমার চেয়ে সুন্দর আর কেউ কীভাবে হয়! কীভাবে তা সম্ভব!”

“তুমি কৃষ্ণকে দেখোনি, তাই বলছ। তার সঙ্গে আমার কোনও তুলনাই হয় না।”

“আমার কাছে তুমিই সেরা অর্জুন। তোমাকে দেখার পর নাগরাজ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত খুব অল্প সময়ে নিয়েছিলাম। তোমার সম্মতি পাব কি পাব না ভাবতে যদি বসতাম, তবে হয়তো এই দুঃসাহসী কাজ করতেই আমি পারতাম না। আর এ-ও তো ঠিক অর্জুন, আমি যা পেতে চেয়েছি, তাতেই মন সঁপেছি। অন্য কিছু ভাবতে চাইনি। আর যদি তুমি সম্মত নাও হতে, এই নাগরাজ্য এমন কী খারাপ যে, তুমি দু’দিনের অতিথি হয়েও থাকতে না?”

“না গো সুমুখী, তোমাদের দেশ অতি মনোরম।”

উলূপী অর্জুনকে বাবা কৌরব্য নাগের কাছে নিয়ে চলল। জয়া, শুভা, চন্দ্রা আড়াল থেকে সবই শুনছিল। তারা পাতালঘরে বিয়ের আয়োজন করতে লাগল। অতি কাছের এবং বিশ্বস্ত দু-চারজনকে ডেকে, উলূপীর তিন বন্ধুকে রেখে, আগুন এবং নাগমায়ের সাক্ষ্যে কৌরব্য নাগ মহা আনন্দে অর্জুনের সঙ্গে উলূপীর বিয়ে দিল।

চার

সখীরা আজ উলূপীকে ফুলের সাজে সাজিয়ে দিল। জয়া বলল, “লূপী, অর্জুনকে দেখেই আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। আর আজ, তোর কোমল অনিন্দ্য শরীর সেই অর্জুনের ছোঁয়ায় সার্থক হবে। আজ তোর শরীরে এমন কিছু থাকা উচিত নয় যাতে অর্জুন এতটুকু বাধা পায়। কিংবা ব্যথা পায়।”

জয়া উলূপীর সামান্য সোনার গয়না একটি একটি করে খুলতে লাগল। আর শুভা পরিয়ে দিতে লাগল ফুলের মুকুট, ফুলের দুল, হার, বালা। কাপড়ের কাঁচুলির পরিবর্তে তারা গেঁথেছে বনফুলের কাঁচুলি। তাই দিয়ে উলূপীর নরম, গোল, দৃঢ় স্তন দু’টি ঢেকে দিল। দুই স্তনে, হাতের পাতায়, পিঠে, ঊরু এবং পায়ের পাতায় কুমকুমের আল্পনা এঁকে দিয়েছে চন্দ্রা। এমনকী নাভিগর্তের চারপাশে এঁকেছে নাগচক্র। কোমর থেকে জানু পর্যন্ত প্রায় স্বচ্ছ এক বসন পরানো হল উলূপীকে। এতে সে ফুটে উঠল আরও নজরকাড়া হয়ে। তার ওপরেও পড়ল ফুলমালার আবরণ।

পাছে ফুলে কীট থাকে এবং সেই কীট প্রিয় সখীকে কামড়ে দেয়, তাই, সমস্ত ফুল একটি একটি করে বেছেছিল চন্দ্রা আর শুভা। জয়ার তত্ত্বাবধানে মালা গাঁথা হয়েছে। কত বড় ও বিখ্যাত হস্তিনার রাজার ছেলে অর্জুন, তিন ভুবনের সেরা বীর, তার পছন্দ কেমন, এখনও জানা হয়নি। জয়া তাই তার মালা গাঁথার দক্ষতা উজাড় করে দিয়েছে। সে হাসতে হাসতে বলল, “বুঝলি লূপী, পেটের বাচ্চাটার জন্য একটা জুতসই নাম খুঁজছিলাম। সে নাম পেয়েছি।”

“কী নাম রে জয়া?” শুভা শোনার আগ্রহে চাইল। শুভাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আজ তারাও সেজেছে বেশ করে। আজ তাদের অতি আনন্দের দিন।

জয়া বলল, “ছেলে হলে নাম দেব অর্জুনমাল্য, মেয়ে হলে অর্জুনমালিকা। ভাল না?”

“খুব ভাল।” শুভা ও চন্দ্রা হেসে উঠল। উলূপী হাসল সলাজে। আজ তার অভিলাষ পূর্ণ হতে চলেছে, আজ তো সে-ই অর্জুনমালিকা! তার গর্ভে অর্জুনের সন্তান আসবে কি? এলে কী নাম রাখবে সে? উলূপী লাজুকলতা মেয়ে নয়। তবু, এই মুহূর্তে এক মধুর লজ্জার আবেশ তাকে ঘিরে রইল। এই মধুস্বাদ উলূপী আগে পায়নি। তার মনে হল, সে বদলে যাচ্ছে। অর্জুনকে দেখার পর থেকে, তার সঙ্গে কথা বলে, বিয়ের অতি অনাড়ম্বর পর্বও যে একনিষ্ঠতার সঙ্গে পালন করল অর্জুন— তা উপলব্ধি করে, উলূপী কীরকম হয়ে যাচ্ছে। কীরকম? ঠিক বোঝা হয়নি তার। অস্তাচলগামী সূর্যের রাঙা আলোর ছটা লেগে আছে আকাশে আকাশে। পর্বতের মাথায় মাথায়। অতি উঁচু গাছগুলির মগডালে। এই মুহূর্তে, অর্জুনকে ভেবে উলূপী যেমন লজ্জায় রাঙা, তেমনি রঙ লেগেছে জগতে। সেইদিকে চেয়ে উলূপীর মনে হল, যে-উদগ্র কামনার শাস্তি বিষাক্ত সাপের ছোবলের মতো তার শরীরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তাতে নেমে আসছে শান্তি।

ফুলের সাজে সেজে উলূপীর ভাবে বিভোর মূর্তি তিন বন্ধু মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। শুভা বলল, “এ জগতে আমাদের লূপীর মতো সুন্দরী আর কেউ নেই।”

জয়া বলল, “রূপের সঙ্গে জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তা যোগ হলে, এমন সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। আমাদের লূপীও কি তাই নয়?”

চন্দ্রা বলল, “লূপী যেন আজ বনদেবী।” সে দু’হাতে উলূপীর গাল ছুঁল, বলল, “এই গালে আজ ফাল্গুনী চুমু দেবে। সার্থক হবে আমাদের লূপীর ফাল্গুন।”

সে উলূপীর দুই স্তনে হাত রাখল, বলল, “এই স্তনে যখন কুমকুমের ফুল আঁকছিলাম, তখন স্তনের অন্তরালে যে-হৃদয়, তাতে ধ্বনিত হচ্ছিল জিষ্ণু নাম। ত্রিভুবন জয় করার ক্ষমতা রাখে যে জিষ্ণু অর্জুন, এই স্তন আজ তার হাতের পরশের জন্য উন্মুখ। চেয়ে দ্যাখ তোরা, ওই দূরের বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়াই কি আজ উলূপীর স্তন হয়ে ওঠেনি?”

উলূপীর দুই করতল ধরে সে বলল, “এই হাত নাগ শাসন করতে পারে, এ হাত সাপ পালন করতে পারে, এই হাত জানে সেবা জানে ওষুধ-বিষুধ, এই হাত মাটির তলায় সুড়ঙ্গের নকশা আঁকে অতি দক্ষতায়, ঘোড়া চালনা করে যে কোনও যোদ্ধার মতো, এই হাত অস্ত্রনিপুণ, তবু, এই হাত তার কোমলতা ও মসৃণতা হারায়নি। এই হাত আজ স্পর্শ করবে, আদর করবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীরকে। পৃথা মায়ের তিন নম্বর ছেলেটা আজ ব্রহ্মচর্য ভাঙবে। কৌমার্য নিবেদন করবে আমাদের লূপীকে।”

আর ক’দিন পরেই পূর্ণিমা। পাহাড়ের মাথায় যখন চাঁদ উঠল বড় করে, বসন্তদূতী ডেকে ডেকে পাগল করে দিল মিলনপিয়াসী জগৎ, তখন তিন বন্ধু তাদের প্রিয় সখীকে নিয়ে চলল মিলনকুঞ্জে। বনের নির্জনতায় এই কুঞ্জ সাজিয়েছে কৌরব্য নাগের ফুলবাগানের মালিরা। এই নাগলোকে গোটা বনই ফুলের বাগান। প্রকৃতির দান এই বিচিত্র গাছ ফুল ফল আর পাখি। প্রকৃতি যা দেয়, মানুষ তার যত্ন করে। এই নাগদেশের মালিরাও বনে বনে ঘুরে গাছের যত্ন করে। কোথায় কত ফুল ফুটছে, কোথায় কোন বিরল প্রজাতির গাছ জন্মাচ্ছে— সব তারা জানে।

বৃন্দাবনে কিশোর কৃষ্ণ যেমন কুঞ্জে রাধারানির সঙ্গে মিলত, তেমনি এই কুঞ্জ। আজ, অন্য এক কৃষ্ণ মিলবে নাগরমণীর সঙ্গে। শোভন দূরত্বে এই কুঞ্জ রক্ষা করছে নাগযোদ্ধার দল। যদি হঠাৎ কোনও গরুড় আক্রমণ করে বসে! অর্জুন মহাবীর। তার ওপর সে ইন্দ্রের ঔরসে পাণ্ডু ও পৃথার ছেলে। তৃতীয় পাণ্ডব। তার সঙ্গে গরুড়ের শত্রুতা নেই। কিন্তু জটিল রাজনীতি জানা আছে বলেই কৌরব্য নাগ নিরাপত্তা সম্পর্কে উদাসীন হতে পারেনি। অর্জুন যখন অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকবে, তখন যদি অতর্কিতে কোনও ক্ষতি করে দেয় গরুড়রা তার, আর যদি কৃষ্ণ, ভীষ্ম বা যুধিষ্ঠিরকে গিয়ে মিথ্যা করে বলে— নাগরাই এই ক্ষতির জন্য দায়ী?

অন্তত প্রথম রাত্রি নির্বিঘ্ন হোক। প্রথম সঙ্গমের মুহূর্ত হোক পরম রমণীয়। কিন্তু এই কুঞ্জ সাজাতে গিয়ে, এই পাহারার ব্যবস্থা করতে গিয়ে যা হল, অর্জুনের সঙ্গে উলূপীর বিয়ের কথা পুরোপুরি গোপন রাখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *