০১. অশ্রু ঝরার দিনে

জীবন যেখানে যেমন – আরিফ আজাদ
প্রথম প্রকাশ – একুশে বইমেলা ২০২১

.

কোনো উৎসর্গপত্র নয়, তবু এই পৃষ্ঠায় দুটো কথা লিখতে ইচ্ছে হলো। ল্যাপটপে কিংবা ফোনে দেদারসে বাংলা লিখি, কিন্তু এই বাংলা লেখাটাকে যিনি আমার জন্য জলবৎ তরলং করে দিয়েছেন তার নিপুণ সৃষ্টিশৈলীর মাধ্যমে, অভ্রের প্রতিষ্ঠাতা সেই মেহেদি হাসান ভাইকে কখনো কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। এখানে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং এক-আকাশ ভালোবাসা জানিয়ে রাখলাম।

.

প্রকাশকের অনুভূতি

মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। গল্পের ধারাভাষ্য যেহেতু জীবনের অলিগলি থেকে উঠে আসে এবং যাপিত জীবনের মানুষগুলোই গল্পের মূল উপকরণ, সুতরাং গল্পকে ঘিরে মানুষের রয়েছে দুর্নিবার কৌতূহল।

তবে সব গল্পই যে মানুষের কথা বলে তা কিন্তু নয়। সব গল্প সত্য এবং সুন্দরের কথাও বলে না। কিছু গল্প মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। আবার কিছু গল্প পড়ে মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়। কোনো কোনো গল্প মানুষকে বিচ্যুত করে দেয় তার স্বাভাবিক জীবনপ্রক্রিয়া থেকে। দুনিয়ায় যেমন আলোর একাধিপত্য কিংবা অন্ধকারের একক স্থায়িত্ব বিরাজ করে না, ঠিক তেমনই সব গল্প থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় না, কোনো কোনো গল্প অন্ধকারের পথও চিনিয়ে দেয়। তবে আমরা আঁধারের যাত্রী নই। যেখানেই অন্ধকারের ঘনঘটা, আলো হাতে সেখানেই আমাদের সরব উপস্থিতি।

স্বনামধন্য লেখক আরিফ আজাদ একজন আলোর ফেরিওয়ালা। বিশ্বাসের দর্শন দিয়ে লেখালেখির জগতে পা রাখা এই লেখক এবার হাজির হয়েছেন জীবনের কিছু গল্প নিয়ে। জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্পগুলোকে লেখক তুলে এনেছেন তার শৈল্পিক রং-তুলিতে। আলো থেকে ফুরিত হওয়া সেই অসাধারণ গল্পগুলো যেমন জীবনের কথা বলে, তেমনই জীবনে রেখে যায় বিশ্বাসী মূল্যবোধের গভীর এক ছাপ।

জীবন যেখানে যেমন নিরেট গল্পের একটি বই। তবে কেবল গল্পের বই বলে একে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক তার পাঠকদের জন্য রেখে গিয়েছেন চিন্তার কিছু খোরাক। পাঠকের ভাবুক মন যদি সেগুলোয় নিবিষ্ট হয়, আমরা আশা করতে পারি, গল্পের পাশাপাশি তারা জীবনের কিছু উপকারী পাঠ কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হবে। লেখক আরিফ আজাদ তার লেখনীশক্তির মুন্সিয়ানায় গল্পগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। এ কারণে প্রতিটি গল্পই হয়ে উঠেছে সুখপাঠের এক বিশাল আধার। এ বইতে পাঠকসমাজ নতুন এক আরিফ আজাদকে আবিষ্কার করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলতে হচ্ছে, লেখক নিজস্ব বানান ও ভাষারীতি অনুসরণ করে থাকেন। ফলে বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের অচেনা রূপ দেখে তারা বিভ্রান্ত হবেন না–এই কামনা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য আর সুন্দরের পথে অবিচল রাখুন। আমিন।

প্রকাশক
সমকালীন প্রকাশন

.

লেখকের অনুভূতি

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প-পাগল। যেখানেই গল্পের গন্ধ পেয়েছি, সেখানেই ডুবিয়ে দিয়েছি চোখ। গল্প পড়তে, গল্প শুনতে আমার দুর্নিবার আগ্রহ। আমার মনে পড়ে শৈশবের কথা। জোছনাভরা রাতে উঠোনে মাদুর পেতে আমরা গোল হয়ে বসতাম। আমাদের মাঝে কখনো গল্প-কথক হিশেবে থাকতেন আমার দাদি, কখনো বা আমার জেঠু। মাঝেমধ্যে বাবাকেও পাওয়া যেতো। তারা পুরোনো দিনের রাজা-রানির গল্প, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, জ্বীন-ভূতের গল্প বলে আসরে মোহ সৃষ্টি করতেন। কোনো কোনো গল্প শুনে বিষাদে ছেয়ে যেতো আমাদের মন। আবার কোনো কোনো গল্প শুনে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যেতো ভয়ে। গল্প আমাদের মাঝে যে অনুভূতিই তৈরি করুক–গল্প শোনার ব্যাপারে আমরা ছিলাম একেবারে নাছোড়বান্দা।

সেই থেকে হয়তো–গল্প আমার জীবনের একটা অনুষঙ্গই হয়ে দাঁড়ালো। মানুষকে গল্প শোনাবার এক তীব্র আকর্ষণ, সুতীব্র বাসনা আমার মাঝেও প্রবল হয়ে ওঠে। আমার লেখা প্রথম বই প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ সম্ভবত সেই আগ্রহ আর বাসনার এক যৌথ সম্মিলন। সাজিদ সিরিজে আমার আলোকপাতের বিষয়গুলো অনেক বেশি কাঠখোট্টা। সেই কাঠখোট্টা বিষয়বস্তুকে গল্পাকারে উপস্থাপনের ভূতুড়ে চিন্তা নেহাত গল্প-পাগল না হলে কি সম্ভব হতো?

প্রচলিত আছে–সাহিত্য হলো সমাজের দর্পণ। একটা সমাজ কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেই সমাজের মানুষগুলো কী ভাবছে, কীভাবে ভাবছে, সেই সমাজের তরুণেরা কোন পথে আছে, জোয়ানরা কীভাবে দিন পার করছে, বৃদ্ধরা কীভাবে ছিলো, সভ্যতা বিনির্মাণে সেই সমাজের অবদান কততখানি–সাহিত্যের মাঝে এসব কিছুরই দেখা মেলে। কারণ, সাহিত্য ধারণ করে সময়কে আর সাহিত্যিকেরা সময়কে বন্দী করে যান কাগজের ফ্রেমে।

বলা বাহুল্য, বাংলা সাহিত্য হিশেবে আমরা যা পড়ি বা পড়ে এসেছি, তাতে যদিও বা সময়ের একটা চিত্র ফুটে উঠেছে, কিন্তু নিদারুণভাবে যা অনুপস্থিত থেকে গেছে। তা হলো–এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষের জীবনাচার। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ যে ধর্মমতে বিশ্বাসী, যে ধর্মবিশ্বাস এখানে বহুযুগ ধরে শেকড় গেড়ে আছে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়–সেই জীবনাচার, সেই বিশ্বাসের বিষয়বস্তু আমাদের বাংলা সাহিত্যসমাজে স্থান পায়নি।

সাহিত্য কল্পনানির্ভর, কিন্তু কল্পনার সূত্রপাত হয় বাস্তবতা থেকে। চারপাশের মানুষের জীবনাচার, জীবনপদ্ধতিই হলো সাহিত্যের মূল নিয়ামক। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের সাহিত্যসমাজে আমাদের চারপাশের সেই জীবনাচার, সেই জীবনপদ্ধতি অনেকাংশেই ব্রাত্য।

মানুষকে প্রেম-ভালোবাসা শেখাতে ব্যস্ত থাকা আমাদের সাহিত্যিক সমাজ কোনোদিন এই জীবনাচার, এই জীবনপদ্ধতির ভেতরে ঢুকে দু’কলম লিখবার তাড়না কেন যে অনুভব করেন না, সেটাই বড় আশ্চর্যের।

আরেকটা ব্যানোর কথা বলি–এদেশে মোটা দাগে যাদের আমরা সাহিত্যিক বলে চিনি, তাদের কাছে ইসলামি জীবনাচার সমৃদ্ধ যে সাহিত্য, সেই সাহিত্য কখনোই ‘বাংলা সাহিত্য’ নয়, সেটাকে তারা বলেন ‘ইসলামি সাহিত্য। কেবল ইসলামি অনুষঙ্গ, ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে গেলেই সেই সাহিত্যকে তারা ধরে-বেঁধে বাংলা সাহিত্যের গণ্ডি থেকে বের করে দিচ্ছেন!

অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন স্বরস্বতী পূজোর বন্দনা করে কোনো গল্প লেখে কিংবা বুদ্ধদেব বসু যখন মহাভারতের পথে নামক বই লেখে অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরভাবে ফুটে ওঠে সমাজতন্ত্রের সুর–তখন কিন্তু আমরা তাদের বাংলা সাহিত্য থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিই না। আমরা বলি না, ওটা ‘হিন্দু সাহিত্য কিংবা কমিউনিস্ট লিটারেচার’, আমরা বরং তাদের আরো মহান, আরো উদার হিশেবে গণ্য করি। কেবল সাহিত্যের মধ্যে ইসলামি দর্শন ঢুকলেই আমাদের যাবতীয় আপত্তি–ওটা বাংলা সাহিত্য নয়, ওটা ইসলামি সাহিত্য।

বাংলা সাহিত্যের দুনিয়া থেকে এই খবরদারির অবসান কবে হবে?

এই খবরদারির অবসানের একটা রাস্তা আমি চিনি–অনেক বেশি ইসলামি জীবন-দর্শন নির্ভর সাহিত্য রচনা করা এবং সেই সাহিত্যগুলোকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধে ছড়িয়ে দেওয়া। সাহিত্যের মাঝে এতোদিন যেখানে অবাধ মেলামেশার কথা থাকতো, আমরা সেটাকে হালাল মেলামেশার গল্প দিয়ে ঢেকে দেবো। ইসলামি জীবনাচারের সকল অনুষঙ্গ নিয়ে আমরা গল্প লিখবো, কবিতা লিখবো, লিখবো উপন্যাস। তাহলেই, আমাদের এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো একদিন বিশাল ঢেউ হয়ে সমুদ্রের কূলে আছড়ে পড়বে আর সেই ধাক্কার রেশ বিস্তৃত হবে অনেকদূর, ইন শা আল্লাহ।

বলা যায়, এমন একটা চিন্তা থেকেই জীবন যেখানে যেমন গল্পের বইটির সূত্রপাত। ইসলামি জীবনদর্শন নিয়েও যে গল্প লেখা যায়, ইসলামকে উপজীব্য করেও যে রচনা করা যায় সাহিত্য–এই বোধটা জাগ্রত করবার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াসের নাম জীবন যেখানে যেমন৷

বইতে বেশ অনেকগুলো গল্প রয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি গল্পগুলোকে গতানুগতিকতার আবহ থেকে যথাসম্ভব দূরে রেখে এমন এক ধারা তৈরি করতে যা একজন গল্প-পাঠককে যেমন গল্পের আনন্দ দেবে, অন্যদিকে ইসলামি জীবনাচারের ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তুলবে।

জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে গল্প লিখবার চেষ্টা করেছি। গল্পে কখনো পিতা, কখনো সন্তান, কখনো স্বামী, আবার কখনো নিরেট বন্ধু হিশেবে জীবনকে দেখাতে চেয়েছি। জীবনের নানা দিকের গল্প যেহেতু আছে, তাই গল্পগ্রন্থটির নামকরণ করেছি জীবন যেখানে যেমন৷ সাজিদ সিরিজের বাইরে এটাই আমার প্রথম একক মৌলিক গল্পগ্রন্থ।

প্রথম কাজ হিশেবে এতে ভুলত্রুটি থেকে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ভুলগুলো একান্ত আমার নিজস্ব ভেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবার এবং সেগুলো সংশোধন করবার সুযোগ পাবো–এটাই কাম্য। গল্পগুলো কতোখানি গল্প হয়ে উঠেছে কিংবা বইটি সাহিত্যমানে কতোখানি উত্তীর্ণ সেই আলাপ বোদ্ধ মহলের জন্য তোলা থাকুক। মহান রাব্বল আলামিনের কাছে করজোড়ে ফরিয়াদ–তিনি যেন আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের কাজগুলোকে অনন্ত জীবনে নাজাতের অসিলা বানিয়ে দেন। আমিন।

আরিফ আজাদ।
.

সূচিপত্র

  1. অশ্রু ঝরার দিনে
  2. এই প্রেম, ভালোবাসা
  3. আসমানের আয়োজন
  4. চাওয়া না-চাওয়া
  5. এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা
  6. জীবনের রকমফের
  7. হিজল বনের গান
  8. বিশ্বাস
  9. সুখ
  10. বোধ
  11. বাবাদের গল্প
  12. টু-লেট
  13. মহীয়সী
  14. সফলতা সমাচার

০১. অশ্রু ঝরার দিনে

জোছনা প্লাবিত রাতের ধবধবে শাদা আকাশ। কোথাও যেন ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস আশ্চর্যরকম ভারী। চাঁদের আলোতে নদী পাড়ের বালিগুলো রুপো চূর্ণের মতো ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। থেকে থেকে কানে আসছে কিছু পাতি শেয়ালের ডাক। এসবের বাইরে পুরো দুনিয়াজুড়ে যেন গা ছমছমে নীরবতা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দের বালাই নেই।

জোছনার জোয়ার ভেদ করে, গ্রামীণ মেঠো পথের ধুলো উড়িয়ে, বুনো ফুলের বুনো গন্ধকে পাশ কাটিয়ে দুজন মানুষ গন্তব্যে ফিরছে। দুজন বলা কি ঠিক? ওদের সাথে তো আরও একজন আছে। চাদরে মোড়ানো বরফ-শীতল আস্ত একখানা শরীর–নড়চড়বিহীন। তাকেও কি গোনায় ধরা যায়? জীবনের সম্ভাব্য সকল পাঠ চুকিয়ে যে পাড়ি জমিয়েছে অন্য জগতে, এই জগতের বাসিন্দাদের তালিকায় তার নাম উঠানো উচিত হবে?

মাঝে মাঝে বলদগুলো চেঁচিয়ে উঠছে। গোঙানি উঠলেই তাদের পিঠে বসে যাচ্ছে শাদু মিয়ার বেতের বাড়ি। এই জোছনা মুখরিত রাতে, অরণ্যের এই সরু পথ চিনে চলতে বলদগুলোর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু পথ চলতে আজ তাদের রাজ্যের অনীহা। কে জানে, চাদরে মুড়ানো ওই যে নিথর শরীর, তার ভারে হয়তো তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বারংবার। এ ভার বয়ে নিয়ে যাওয়া কি এতোই সোজা?

সত্যিই কি সোজা নয়? যদি নাই বা হবে, শহিদুলের কোলের ওপর ওই নিথর শরীরখানা, ওভাবে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে কীভাবে? যে পাথুরে শরীরের ভার বইতে বলদেরা অপারগ, তার ভার কতো সহজেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শহিদুল। তার কোলে কেমন নিবিড় নিশ্চিন্তে পড়ে আছে ওই দেহখানা। শহিদুলেরও যেন কোনো ক্লান্তি নেই। সেও নিরাবেগ, নিশ্চল, নিশ্চপ।

কথা শুরু করে শাদু মিয়া। এই ঘন গহিন অরণ্যের মাঝে, যেখানে বন্য জন্তুরাও বেঘোর ঘুমে অচেতন, সেখানে কতোক্ষণই বা আর চুপচাপ পথ চলা যায়? অন্তত শাদু মিয়ার মতন মুখরা মানুষের পক্ষে এতোক্ষণ মুখ বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়।

‘তা ভাইজান, পোলাডা মরলো কেমন কইরা?’

মরে গেছে? সংবিৎ ফিরে পায় শহিদুল। সত্যিই মরে গেছে? তার ফুটফুটে আদরের সন্তান, যার মাত্র চার মাস হলো বয়স, সে কি মরে গেছে? তুলতুলে হাতখানা ধরে কতো আদরই না করতো শহিদুল! দেখতে ভারি সুন্দর হয়েছিলো ছেলেটা! সেদিন ডাক্তার বললো, আপনার ছেলের বয়স কতো?

‘চার মাস’, অস্ফুটে জবাব দিয়েছিলো শহিদুল।

ডাক্তার যেন বিশ্বাস করলো না তার কথা। মুখ তুলে, চশমার পাতলা কাঁচের ভেতর দিয়ে ভালো করে আরেকবার দেখল বাচ্চাটাকে। এরপর বললো, ‘বাচ্চার ডেভলপমেন্ট তো খুবই ভালো। দেখে মনে হচ্ছে এক বছর বয়স।

অমন আদুরে চেহারা ছিলো যে, কেউ কোলে না নিয়ে থাকতে পারতো না। তুলতুলে শরীর। সবটা ছাড়িয়ে, তার মুখের হাসিটা ছিলো ভুবনভোলানো। চোখে চোখ রেখে, মুখখানা খানিক বাঁকিয়ে যখন সে হাসতো, শহিদুলের মনে হতো, জগতের সকল সরলতা, মুগ্ধতা আর বিস্ময় যেন তার চেহারায় এসে মাখামাখি। করছে। তার নিটোল চাহনির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা মানবজনম। কিন্তু, একেবারে হঠাৎ করে, সেদিন প্রচণ্ড জ্বর উঠলো তার। চোখমুখ ফুলে বিপন্ন অবস্থা। ডাক্তার জানাল তার আমাশয় হয়ে গেছে। সাধারণ আমাশয় নয়, রক্ত আমাশয়। কতো যত্ন-খেয়াল, কতো আদর আর আলিঙ্গনের কাড়াকাড়ি তার মাঝেও ছেলেটার এমন একটা রোগ হয়ে গেলো? তারপর, তারপর একদিন অকস্মাৎ, একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে খিচুনি এসে কাহিল করে দিলো তাকে। হাসপাতালে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, ততোক্ষণে সে আর বেঁচে নেই।

বেঁচে নেই! কতো সহজেই হয়ে গেলো বলা! অথচ, শহিদুলের কাছে সে ছিলো তারা ঝলমলে এক পৃথিবী। যেদিন তার জন্ম হয়, যে ভোরবেলায়, কতো কাণ্ডই না সেদিন করেছিলো শহিদুল। তার পাগলামোতে হাসপাতালের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে যায়। কেউ কেউ বলেছিলো, ‘পাগল! হ্যাঁ, পাগলই তো। কতো বছর, ঠিক কতো বছর পরে শহিদুলের ঘর আলো করে এই রত্নখানি এসেছে, তা কি এই মানুষগুলো জানে? আল্লাহর কাছে কতো করজোড় মিনতি, কতো আকুল প্রার্থনা, ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এই ফল, তা কি কেউ বুঝবে?

হেলেদুলে এগিয়ে চলছে শাদু মিয়ার বলদ-গাড়ি। শহিদুল নিরুত্তর। শাদু মিয়া শহিদুলের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। তার বুকের ভেতর কালবোশেখির যে তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে–সেটা শাদু মিয়ার অজানা নয়। সন্তান হারানোর শোকের সাথে শাদু মিয়াও সবিশেষ পরিচিত। তার ছোটো মেয়ে পারুল, সবে হাঁটতে শিখেছিল কেবল। এক দুপুরে, কোন ফাঁকে যে সে পুকুরতলায় চলে গিয়েছিল, তা আজও রহস্য। অতটুকুন মেয়ে, গুটিগুটি পায়ে অতটুকু পথ পাড়ি দিয়ে সোজা পুকুরে গিয়ে পড়বে আর সারাবাড়ির কেউ তাকে একটিবারের জন্যও দেখবে না–তা কি কম আশ্চর্যের ব্যাপার! সারাদিন খুঁজে খুঁটেও পারুলের হদিস মিললো না। পরে, সন্ধ্যের আগে আগে আস্ত পারুল ভেসে উঠলো পুকুরের মাঝে। পারুলের মৃত্যু নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা, অনেক লোক-গল্পের অবতারণা হয় মানুষের মুখে মুখে। সময় গড়িয়ে যায়, কেবল নেভে না শাদু মিয়ার বুকের দহন। ছোট্ট পারুলের সোনাবরণ চাহনিটা যেন আজও সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে শাদু মিয়ার চোখের সামনে ভাস্বর হয়ে আছে। অতএব, শাদু মিয়া বোঝে সন্তানহারা পিতৃহৃদয়ের যাতনা।

যাত্রী হিশেবে শহিদুলের সাথে আরও একজন আছে। মিনু; শহিদুলের স্ত্রী। সেও নিরুত্তর। নিষ্পলক। তার চোখের দৃষ্টি কোথায়, কোন দিগন্তে গিয়ে যে স্থির হয়ে গেলো, তা কেউ জানে না। যে জঠর ভেদ করে একদিন এসেছিল প্রাণের ফোয়ারা, সেই ফোয়ারা আজ ফুরিয়ে গেছে। নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে শূন্য দিগন্তে। মিনুর বুক ফেটে কান্না আসে, কিন্তু সে কাঁদতে পারে না। অশুরাও আজ পলাতক চোখ থেকে। নিদারুণ অবসাদে ভেঙে আসে শরীর, বিপন্ন বিষাদে ক্ষতবিক্ষত সে, কাতর আর্তনাদে গুঙিয়ে ওঠে মন, তবু আজ যেন কাঁদতে মানা। আজ কি কাঁদবার দিন?

পাথরের মূর্তির মতন বসে থাকে সেও। জোছনা রাঙানো রাতের আকাশ, বুনো ফুলের মনোহর গন্ধ, মাঝে মাঝে ডাহুকের ডাক–এ সবকিছু জুড়ে মিনুর কতো মুগ্ধতা! কিন্তু, শোক আর শখের লড়াইয়ে আজ শোকটাই জয়ী। এই তারাভরা রাত, অরণ্যের অসামান্য সৌন্দর্য–কোনোকিছুতেই আজ মিনুর মুগ্ধতা নেই।

তখন আকাশ ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে। ভোরের সোনারঙা রোদ এসে পাতায় পাতায় জাগিয়ে তুলেছে শিহরণ। ঘুম ভেঙেছে পাখ-পাখালির। তাদের মুখরিত কলরব চারদিকে তৈরি করেছে ব্যস্ততার আবহ। সবুজ ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ওপর রোদের ছোঁয়া এসে লাগায় সেগুলো স্বর্ণরেণুর মতন ঝলমল করে উঠলো। ভোর হয়েছে।

জালাল মাস্টারের বাড়িতে শোক যাপনের একটা আগাম প্রস্তুতি নেওয়া ছিলো, কেবল আনুষ্ঠানিক যাত্রা পর্বটাই বাকি। শহিদুলদের আগমনে যেন সমস্ত শোক আছড়ে পড়লো বাড়িটার প্রশস্ত উঠোনে। বাড়ির মহিলারা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হায় হায় রব উঠলো আকাশে-বাতাসে। শহিদুলের মা, পাথর হয়ে বসেছিলেন উঠোনের এক কোণে। শহিদুলের কোলে চাদরে মুড়ানো নিথর শরীরটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনিও। বুক চাপড়ে কান্না-বিজড়িত গলায় বলতে লাগলেন, এ কী হলো রে ব্যাটা তোর! এ কী হলো!’

শোকের মাতমে জালাল মাস্টারের বাড়ি তখন আচ্ছন্ন। শোকে মুহ্যমান মানুষগুলোর চেহারায় ভর করেছে ঘন বিষাদের কুয়াশা। রোদের তীব্রতাও এই কুয়াশা কাটাতে পারে না। একখানা মাদুরে আলতো করে শহিদুল শুইয়ে দিলো তার কোলে থাকা নিথর শরীরটাকে। তারপর, আস্তে আস্তে অনাবৃত করলো তার চেহারা। যখন চাদরের আবরণ ভেদ করে প্রস্ফুটিত হলো সন্তানের অবয়ব, শহিদুল, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। জমানো শোকের ভার আর সইতে পারল না সে। সন্তানের অনড় দেহটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল সারা দেহ।

এখনো পাথর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনু। মাদুরে শোয়ানো সন্তানের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চেহারায় নেমে এসেছে কালবোশেখির সমস্ত ঘন কালো মেঘ। তার অসহায় চাহনি, ব্যথাতুর চোখে সে যেন শেষ বারের মতন দেখে নিচ্ছে বুকের মানিককে।

‘রাক্ষসী!’ বিপুল জনতার স্রোতে একটা রব উঠেছে বটে! ও-বাড়ির আলেয়ার মা, যাকে সবাই রাঙা মা বলে ডাকে, তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে এই শব্দ। মুহূর্তে জনতার সকল মনোযোগ, সকল আকর্ষণ যেন এই একটি শব্দকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। এ-কান ও-কান থেকে সাত-পাঁচ-দশ কান হয়ে গেলো। সবার তীক্ষ্ণ তীর্যক দৃষ্টি এসে পড়লো উঠোনের অন্য পাশে, জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেচারি মিনুর ওপর।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো শহিদুলের মা। আলেয়ার মায়ের মুখোচ্চারিত শব্দটাকে দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে লুফে নিয়ে, সেই শব্দটাকে পুনরায় বাতাসে গুঞ্জরিত করে দেওয়ার কাজটা খুব ভালোমতোই করতে পারলেন তিনি। আরও বহুগুণ শোকে যেন ভেঙে পড়লেন আলেয়ার মায়ের আঁচলে। কান্না আর ক্ষোভের দারুণ সংমিশ্রণে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ঠিক কইছেন, বুজান। বউ নয়, এ সাক্ষাৎ রাক্ষসী। আমার ছেলেডার জীবনটারে তামা তামা কইরে দিলো এই পোড়ামুখী। আমার ছেলে, সংসার সব তছনছ কইরা দিলো গো, বু। আমার সব শেষ। শেষমেশ আমার নাতিডারেও খাইলো এই জল্লাদী।

অপলক তাকিয়ে আছে মিনু। কোন শোক সামাল দেবে সে? পুত্র-বিয়োগের শোকে কাতর হবে, নাকি অসহায় আর্তনাদে আর্তচিৎকার করে উঠবে তার দিকে ধেয়ে আসা অপবাদের অপমানে? মুহূর্তে এই অপবাদের সুর বাতাসের গতিতে হুড়মুড় করে ছড়িয়ে পড়লো বাড়িময়। সবার কাছে একটি ছোট্ট শিশুর মৃত্যু ঘটনার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শহিদুলের বউয়ের রাক্ষসী হয়ে ওঠার গল্পটাই। চারিদিক থেকে ভেসে আসতে লাগলো চি-চিৎকার! মহিলারা মুখে কাপড় দিয়ে বলছে, ‘রাক্ষসীই বটে! পুরুষেরা ধি-ধিক্কার করছে শহিদুলকে। এমন অপয়া, অলক্ষুণে মেয়ের সাথে কেন সে ঘর সংসার করছে, তা-ই উপস্থিত জনতা বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

কাহিনির নেপথ্য কারণ আরও পেছনে, আরও গভীরে। ছেলের বউ হিশেবে মিনু কখনোই শহিদুলের মায়ের পছন্দের তালিকায় থাকতে পারেনি। নেহাত শহিদুল এবং তার বাবার পছন্দের বলেই মিনু এ বাড়ির বউ হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু মিনুর কপালের লিখন যে অন্য! যে সন্ধ্যায় শহিদুল মিনুকে ঘরে তুলে আনে, ঠিক ওই রাতেই শহিদুলের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। একেবারে হঠাৎ মৃত্যু যাকে বলে! সে রাতেও বেশ কানাকানি, বেশ কথা চালাচালি হয়েছিলো কারও কারও মাঝে। ‘আইজকার দিনেই এমনডা ঘইটলো?’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো আশপাশের চাচি-জেঠিরা। সভ্যতার সম্ভাব্য সকল আলো থেকে দুরে, এমন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঝে এমন একটা ঘটনা থেকে যে নানান ডালপালা গজাবে, তা তো জানা কথাই। জালাল মাস্টারের বাড়িতেও–ই হলো। তবে শহিদুলের অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসা, অপরিসীম প্রেম আর সুষম শিক্ষার কারণে সেদিন সেই গুঞ্জন খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ঘটনার সেখানেই সরল সমাপ্তি ছিলো না। তাদের বিয়ের এক মাসের মধ্যে একটা দুধেল গাভি হঠাৎ বিকারে ধড়ফড়াতে ধড়ফড়াতে মারা গেলো। বর্ষার ভারী বর্ষণে সেবার শহিদুলদের চাষের দু-বিঘা জমি ফসল সমেত অথৈ পানির তলায় তলিয়ে গেলো। ঘটনা যখন এই, তখন কি আর পড়শিদের বুঝতে বাকি থাকে কিছু? সন্দেহের সকল সংঘবদ্ধ তির ধেয়ে এলো মিনুর দিকেই। ও মেয়েটাই অপয়া। ওর জন্যই এমন গেরস্ত ঘরের আজ এই দুর্গতি।

শহিদুল বাধ্য হয়ে মিনুকে শহরে তুলে আনে। মাকে কতো অনুনয়-বিনয় করেছিলো তার সাথে শহরে এসে থাকতে; কিন্তু তিনি রাজি হননি। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি ছেড়ে তিনি দূর প্রবাসে গিয়ে থাকবেন, এ তো স্বপ্নেরও অতীত। কল্পনারও বাইরে। অতএব, শহিদুল মিনুকে নিয়েই শহরে সংসার পেতেছিলো। ‘মিনু অপয়া’–এমন কুসংস্কারে শহিদুল কখনোই কর্ণপাত করেনি। ধর্মীয় শিক্ষা তার যথেষ্টই আছে। মিনুরও ধর্মীয় শিক্ষার কমতি নেই। তাই গ্রামের সরল মানুষের গরল ভাবনা তাদের দূরত্বের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি কখনোই।

শহিদুলের মা মিনুকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘দ্যাখ দ্যাখ, রাক্ষসীর দিকে তাকায়ে দ্যাখ। এক ফোঁটা জল নাই চোক্ষে। এক ফোঁটা কান্দনের আলামত নাই। শ্বশুররে খাওনের পর নিজের পোলাডারেও খাইলো ডাইনিটা। ও আল্লাহ, তুমি আমার বাপটারে বাঁচাও। এই রাক্ষসীর কবল থেইকা তুমি আমাদের মুক্তি দাও গো, মাবুদ।

মিনু তার সেই ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত, অসহায় চাহনি নিয়ে শহিদুলের মুখের দিকে তাকায়। আশা করে, শহিদুল হয়তো এখনই ফোঁস করে উঠবে। ভেস্তে দেবে অপবাদের সমস্ত পসরা। কিন্তু আজ! আজ শহিদুলও যেন পরাজিত। কিংবা সকলের সংঘবদ্ধ তিরস্কারের কাছে অপাঙক্তেয়। আজ পাড়া-পড়শির দিন। আজ দিনটাই শহিদুলের মায়ের। দীর্ঘ দিনের জমানো ক্লেদ, জিঘাংসা এবং রোষের সমস্তটাই যেন আজ প্রবল উৎসাহে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জনতার যৌথ জনরোষের কাছে আজ শহিদুল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। অথচ তাকেই আজ খুব বেশি দরকার মিনুর। খুব বেশি প্রয়োজন।

সে রাতে পরপর দুটো ঘটনা ঘটে গেলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, শহিদুল তালাক দেয় মিনুকে এবং ওই রাতেই পাশের বাড়ির তরফদারের মেয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় শহিদুল। শোকসন্তপ্ত বাড়িটাতে শোকের আবহকে পাশ কাটিয়ে, প্রতিশোধের চরম জিঘাংসাই যেন প্রথম এবং প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আর মিনু? শাদু মিয়ার বলদ-গাড়ি তো ছিলই। ও রাতেই সে জালাল মাস্টারের ভিটে মাড়িয়ে পাড়ি জমায় দূরের পথে। তারাভরা রাত… সমস্ত পত্র-পল্লবে যেন জোছনার মেলা বসেছে। দূরে কোথাও ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে মাঝে মাঝে। থেমে থেমে শেয়ালের আওয়াজ আসছে কানে। এ সবকিছুকে ঘিরে মিনুর একরাশ মুগ্ধতা, আবার কোনো মুগ্ধতাই যেন নেই।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে শহিদুল শহরে ফিরবে। খুব বেশি ছুটি নেই তার। নতুন বউকে এ বাড়িতেই রেখে যেতে হবে। শহিদুলের মায়ের সাথে তার গড়ে উঠেছে দারুণ সখ্য। শাশুড়ি তাকে চোখে হারায় যেন। বেরুনোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শহিদুল দেখল, মিনু তার লাগেজখানা ফেলে গেছে। যা গায়ে ছিলো, ওটুকুতেই প্রস্থান করেছে মেয়েটা। শশব্যস্ত হয়ে শহিদুল লাগেজখানা খুলে বসল। লাগজের ভেতরে ছোট্ট একখানা প্যাঁচানো চিরকুট। দ্বিগুণ উৎসাহ এবং কৌতূহলী হয়ে সেটা মুখের ওপর ধরে পড়তে লাগলো শহিদুল–

‘ভাববেন না আবেগ দিয়ে আপনার কাছে নিজের ভুলের ফিরিস্তি লিখতে বসেছি। আপনার কাছে জবাবদিহির আর কোনো অধিকার কিংবা দরকার, কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। কারণ, এই চিঠি যখন লিখছি, তখন আপনার সাথে আমার জাগতিক সকল সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেছে। তবু, নিজের অবস্থানটা বলে যেতে না পারলে। শান্তি পাচ্ছিলাম না। একটা অপবাদ মাথায় নিয়ে এভাবে প্রস্থান করবো, তা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম বলেই এই লেখাটুকুর অবতারণা।

ছেলেটা আমার ছিলো। আপনারও। দুজনের। তাকে তো আমিই দীর্ঘ নয় মাস পেটে ধারণ করেছি। আমার রক্ত-মাংস চুষে সে বেড়ে উঠেছিল। আস্তে আস্তে। সে যখন অস্তিত্বে এলো, যেদিন তার আগমনের সংবাদ আমরা পেলাম, মনে পড়ে কতো বিচিত্র উল্লাসে, কতো সুখ আর স্বপ্নের মাঝে আমরা ডুব দিয়েছিলাম? আমার নাড়ি ছিঁড়ে যখন সে বেরোয়, জানেন, একটিবারের জন্য আমার মনে হয়েছিলো, বোধকরি আমি আর বাঁচব না। তখন আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। মায়ের মুখটা না দেখেই যদি মরে যাই, কেমন যেন একটা অতৃপ্তি রয়ে যাবে মনে। কিন্তু, পরক্ষণে যখন আমাদের সন্তানের কথা মনে এলো, যখন মনে হলো যে আমার শরীরে বেড়ে উঠছে অন্য আরেক আমি, সে বেঁচে থাকলেই আমার বেঁচে থাকা হবে, তখন মনে হলো–না! এমন মৃত্যুতে ভয় কীসের? এ যে বীরাঙ্গনার মৃত্যু!

যখন বাবুটা এলো পৃথিবীতে, আমাদের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে? তাকে ঘিরে কতো যত্ন, কতো খেয়াল আমাদের। গভীর রাতে যখন সে কান্না করে উঠতো, আমি মুহূর্তে জেগে যেতাম। তাকে শান্ত করতে আমার সে কী কসরত! . কখনো আপনাকে ডেকে তুলিনি। জাগাইনি। বিরক্ত করিনি। আমিই সামলেছি। যখন তার আমাশয় ধরা পড়ে, একেবারে কাহিল হয়ে ওঠে সে, সেই স্মৃতিগুলো আমি কখনোই ভুলবো না।

আপনি, আপনার মা এবং আপনার আশপাশে সবার অভিযোগ, সন্তানের মৃত্যুতে কেন আমার চোখে একফোঁটা পানি নেই। প্রশ্নটা নিজের প্রতি আমারও। পরে মনে হলো, ওর জন্য যা কাঁদার, তা তো আমি জায়নামাযেই কেঁদেছি। আর কোনো জল যে আমার চক্ষু-কোটরে অবশিষ্ট নেই। কোত্থেকে আসবে?

আমি কাঁদিনি। বিলাপ করিনি। বুক চাপড়াইনি। কেবল পাথর হয়ে ছিলাম। আমার এরূপ কাণ্ডকারখানা দেখে আপনাদের মনে অনেক প্রশ্ন দানা বেঁধেছে, অনেক কৌতূহল জেগে উঠেছে, অনেক সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। আপনাদের প্রশ্নোন্মুখ চেহারা, কৌতূহলোদ্দীপক অভিমূর্তি আমাকে কাঁদাতে পারেনি। কেন জানেন? অনেকদিন আগে আমি একটি হাদিস জেনেছিলাম। সম্ভবত এমন দিনের জন্যই ওটা আমার চোখে পড়েছিলো এবং আমি ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সেটা পড়েছিলাম সেদিন। হাদিসটি শুনুন–

যখন আল্লাহর কোনো বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করে ফেললে?’

ফেরেশতারা বলে, ‘জি।

তখন আল্লাহ আবার বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার প্রাণ-কণাটাকে ছিনিয়ে আনলে?’

ফেরেশতারা আবার বলে, ‘জি।

আল্লাহ বলেন, তখন আমার বান্দা কেমন আচরণ করেছে?

ফেরেশতারা বলে, আপনার বান্দা ধৈর্য ধরেছে আর বলেছে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি এবং তার কাছেই পুনরায় ফিরে যাবো।

ফেরেশতাদের কাছ থেকে বান্দার ধৈর্যের এমন চমৎকার বর্ণনা শুনে মহামহিম আল্লাহ তখন বলেন, ‘আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করো, এবং সেই বাড়ির নাম দাও–প্রশংসিত বাড়ি৷

আমি বিশ্বাস করি, আমার সন্তান আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। তার সাথে আমার সাময়িক একটা বিচ্ছেদ ঘটেছে বটে, কিন্তু জান্নাতে, সেই প্রশংসিত বাড়ির উঠোনে, সবুজ দূর্বাঘাসের ওপর শিশির আচ্ছাদিত পথে আমি তার হাত ধরে হাঁটবো, ইন শা আল্লাহ। আমার মানিকের সাথে এমন সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে হলে, জগৎ আমাকে। যতই রাক্ষসী, অপয়া, অলুক্ষুণে বলুক, তাতে কি আমার বিচলিত হওয়া চলে?

ভালো থাকুন আপনি। আপনার আগামীর দিনগুলো সুন্দর হোক। আপনার জন্য আমার অফুরন্ত দুআ।

রাত নেমে এসেছে। বাইরে ঝিঁঝিপোকার অবিশ্রান্ত চিৎকার। তারও দূরে, কোথাও থেকে যেন বুনো শেয়ালের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে বাতাসে। আর, প্রকৃতির কোথাও যেন এক গভীর গোঙানি। কোথা থেকে ধেয়ে আসছে এই গোঙানির সুর? শহিদুলের বুকের গহিন থেকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *