০১. অন্ধকার ঘরের চারপাশটা

নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
NEMESIS by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০

.

সপ্তদশ মুদ্রণের ভূমিকা :

আমার প্রথম মৌলিক উপন্যাস নেমেসিস প্রকাশিত হয়েছে আজ থেকে এগারো বছর আগে, ২০১০ সালে। প্রকাশ হবার পর থেকে সময় যতই গড়াচ্ছে বইটির পাঠকপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। নিঃসন্দেহে লেখক হিসেবে এটা আমার জন্য সুখকর। কখনও ভাবিনি প্রথম মৌলিক উপন্যাসটি এতদিন পরও পাঠক আগ্রহভরে পড়বে। এ জন্যে পাঠকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারাই আমাকে বাধ্য করেছিল নেমেসিস-এর সিকুয়েল কন্ট্রাক্ট লেখার জন্য, আবার তারাই এই সিরিজটির নামকরণ করেছে ‘বেগ-বাস্টার্ড’ সিরিজ হিসেবে কোনো সিরিজের বেলায় এমনটি ঘটেছে বলে অন্তত আমার জানা নেই।

সিরিজ হলেও আমি সব সময় চেষ্টা করেছি প্রতিটি গল্প ভিন্ন আমেজে উপস্থাপন করতে-সিরিজের গত্বাধা নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চাইনি কখনও। সেজন্যে এই এটি কখনও মার্ডার মিস্ট্রি, কখনও বা পলিটিক্যাল কন্সপিরেসি খৃলার, বিশুদ্ধ ক্রাইম-ফিকশন, ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির গল্প থেকে এসপিওনাজ খৃলারও হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতেও আমি এ ধারা অব্যাহত রাখবো। সিরিজের সিরিজের ষষ্ঠ বইটি এ বছরেই বেরুবে।

নেমেসিস আমার প্রথম মৌলিক উপন্যাস হিসেবেই কেবল নয়, বাংলায় মৌলিক গ্লারকে শক্তপোক্ত একটা ভিত্তি তৈরি করতেও সাহায্য করেছে। মৌলিক গ্লারের নতুন এই অধ্যায়ের সৃষ্টিতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তাই এই বইটির নতুন মুদ্রণ হলেই আমার অন্য রকম একটি অনুভূতি হয়। যেমনটা হচ্ছে এখন।

প্রিয় পাঠক, আপনারা সবাই ভালো থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।

– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
আগস্ট, ২০২১
ঢাকা

.

উত্সর্গ :

যাকে আমি পাইনি…
আমার বাবা মরহুম মোহাম্মদ বদরুদ্দিন
এবং
যাকে আমি পেয়েছিলাম…
আমার বড়চাচা মরহুম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন

.

অধ্যায় ১

অন্ধকার ঘরের চারপাশটা তার কাছে একটু একটু করে উদ্ভাসিত হতে লাগল। ঠিক কতোক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝতে পারছেন না। আজকাল গাঢ় ঘুম হয় না বললেই চলে। শরীর যখন সচল ছিল কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়তেন। আজ তিনি গাছের মতোই অচল; ছবির মতো স্থির; কিন্তু ঘুম তার কাছে দূর্লভ হয়ে গেছে। স্লিপিং পিল ছাড়া ঘুম আসে না। কয়েক ঘণ্টা আগে হাউজ-নার্স ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিয়ে গেলে একটা ঘোর ঘোর ভাব এসে ভর করেছিল দুচোখের পাতায়।

পাশের ঘর থেকে পরিচিত একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দটিই তার স্বল্পদৈর্ঘের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। খুব ক্ষীণ হলেও কানে বেশ পীড়া দিচ্ছে। সেটা। ইদানিং তার ইন্দ্রিয়গুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর হয়ে উঠেছে। নিঃশব্দের মধ্যেও অনেক শব্দ শুনতে পান। এমন অনেক কিছু বুঝতে পারেন যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। চারপাশের অনেক কিছুই তার কাছে এখন নতুন মাত্রায় উপস্থিত হয়। কোনো ঘটনা ঘটার আগেই তিনি টের পেয়ে যান। ঠিক এ রকম একটি অনুভূতি এখন তার হচ্ছে।

অবশ্য কখনও কখনও তার মনে হয় সন্দেহবাতিকতায় ভুগছেন হয়তো। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বুঝি, কিংবা পুরোটাই তার বিভ্রান্তি। হেলুসিনেশন? তিনি কোনো উপসংহারে আসতে পারেন না।

নারী কণ্ঠটা খুবই পরিচিত। পুরুষ কণ্ঠটা চেনার চেষ্টা করলেন। তাদের উচ্ছ্বাসের প্রকাশ তাকে ঈর্ষাকাতর করে তুলল, কিন্তু অনেক দিন পর, তিনি বেশ অবাক হয়েই টের পেলেন, উত্থান ঘটেছে। এ রকম নিশ্চল-নিথর দেহে এতো তীব্র আর অস্বাভাবিক উত্থান ঘটলো বলে তিনি বিস্মিতই হলেন। মানুষ খুবই বিচিত্র। মস্তিষ্কের চেয়ে তার শরীর কোনো অংশে কম বিচিত্র নয়। বিগত এক বছরে এই প্রথম এ রকমটি হলো। সেটাও কি না এ রকম অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে!

নারী কণ্ঠটা এখন বেশ তুঙ্গে উঠে গেছে। পুরুষটি অনেক বেশি সচেতন আর সতর্ক; নিজের সমস্ত আবেগ দমিয়ে রেখেছে সে। চোরেরা একটু বেশিই সতর্ক থাকে, কথাটা যেন তার আড়ষ্ট ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে প্রায় উচ্চারিত হয়েই যাচ্ছিল।

একটু পর আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। হয়ে গেছে। তিনি ভাবতে লাগলেন তারা এখন কী করছে। এ রকম সময় তিনি কি করতেন? একটা। সিগারেট ধরাতেন। নয়তো একেবারে চুপ মেরে পড়ে থাকতেন বিছানায়। আর গোলর? সঙ্গে সঙ্গে আরো অসংখ্য মুখ তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ইচ্ছে করেও তিনি সেইসব মুখ কোনোভাবেই সরাতে পারলেন না। একেকটা মুখ একেকটা দৃশ্যের অবতারণা করছে।

আফিয়া, মিতুল, শর্বরী, রিমি, মেরি, ইরা…! মাথাটা ঝাঁকিয়ে এইসব নাম আর দৃশ্যগুলো বিদায় করতে চাইলেন, কিন্তু সেই সাধ্য তার নেই। এখন আর ইচ্ছেমতো নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াতে পারেন না। আজকাল তার কাছে সবচাইতে ভয়ঙ্কর মুহূর্ত হলো এটিই। স্মৃতির উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ যে কতো কম সেটা এই অবস্থায় না এলে হয়তো কখনই বুঝতেই পারতেন না।

আজকাল শৈশবের কথা খুব মনে করতে চান, কিন্তু সেই স্মৃতি এতোটাই ঝাপসা হয়ে গেছে যে, সেটা আরো বেশি পীড়াদায়ক ঠেকে তার কাছে। অথচ কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই তিক্ত আর নষ্ট স্মৃতিগুলো অযাচিতভাবে এসে পড়ে।

আরেকটা শব্দ তার চিন্তায় ব্যঘাত ঘটালো-টয়লেট ফ্লাশ করা হচ্ছে। কে করছে?

পুরুষ আর নারী কণ্ঠের মৃদু ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে এখন। তারা কথা। বলছে। এসবের পরে কথা বলার কোনো মানে হয় না। তিনি নিজে এ রকম মুহূর্তে কোনো কথা বলতেন না। পর পর কয়েকটা সিগারেট শেষ করে ঘুমিয়ে পড়তেন অথবা নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় চলে এলে লিখতে বসে যেতেন।

নারী-পুরুষের ফিসফিসানিটা এখনও চলছে। চাপা কণ্ঠে কী নিয়ে যেন কথা বলছে তারা। আস্তে আস্তে তার হাতের পশম কাটা দিয়ে উঠল। শরীরে এক ধরণের অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। আজকাল এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ ভয়ে থাকেন। প্রায়ই মনে হয় তার চারপাশের মানুষজন তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। তার এই সন্দেহটা কি সম্পূর্ন অমূলক?

খ্যাচ করে একটা শব্দ হলে তার ইন্দ্রিয় আবারো সজাগ হয়ে উঠল। এই ঘরের জমিনটা যেন তার নিজের শরীর। কেউ এখানে পদার্পণ করলে তিনি টের পেয়ে যান। এখনও তার সে-রকম অনুভূতি হচ্ছে। অন্য কেউ হলে এই সামান্য শব্দ নিয়ে মাথা ঘামাতো না-একটা বেড়াল কিংবা বাতাসের ঝাঁপটা। অথবা সবটাই তার বিভ্রান্তি। না কি হেলুসিনেশন? তার সবচাইতে প্রিয় শব্দ। এই শব্দটাকে তিনিই জনপ্রিয় করেছেন।

মানুষের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। খুবই মৃদু। একেবারে কাছ থেকে! তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন না। এটা তার পক্ষে সম্ভবও নয়। পুরো শরীরের মধ্যে ডানহাতটাই সচল আছে, বামহাতটা থেরাপি করার পর এখন সামান্য নড়াচড়া করতে পারেন। অনেকের কাছে এটি অলৌকিক একটি ব্যাপার। এর ফলে তার লেখালেখিতে কোনো ছেদ পড়েনি, বরং আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তার লেখার পরিমাণ বেড়ে গেছে। আগে হাতে লিখলেও এখন ল্যাপটপে লেখেন। হাতে লিখতে গেলে বেশিক্ষণ লিখতে পারেন না। টাইপিংয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। ইদানিং বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারা দিনই লেখালেখি করেন তিনি।

ঘরে কোনো বাতি জ্বলছে না। আজ পূর্ণিমা। দক্ষিণের বেলকনির স্লাইডিং ডোরটা খোলা থাকায় বাইরের জ্যোৎস্না ঘরে ঢুকে পড়েছে। এ রকম জ্যোত্সা সব সময়ই তার ভালো লাগে, কিন্তু আজকে তার কাছে এটা অসহ্য লাগছে।

হঠাৎ জ্যোত্সার সেই মৃদু আলোয় আবছায়া এক মূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়াল। কালো পোশাকের কারণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মুখটা দেখার জন্যে চোখ কুচকালেন তিনি কিন্তু চশমা ছাড়া যে এই স্বল্প আলোতে কিছু দেখবেন না সেটা বুঝে ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে।

সব মেনে নিয়েছেন এ রকম একটি ভঙ্গি করে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন এ রকম মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করেছেন-চূড়ান্ত পরিণতির সময় একেবারে স্বাভাবিক আর স্থির থাকবেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বেঁচে থাকার জন্যে কোনোরকম পাগলামী করবেন না। অন্তিম মুহূর্তটি প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার সাথে গ্রহণ করবেন।

“কে?” অলৌকিকভাবে কথাটা উচ্চারণ করলেন। দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকার ফলে কণ্ঠটা ফ্যাসূফেসে শোনালো। বিস্ময়করভাবেই তার সামনে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি চমকালো না বলে তিনি অবাকই হলেন।

দ্বিতীয়বার কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে।

এক সেকেন্ড। দুই সেকেন্ড। তিন সেকেন্ড।

একেবারেই নড়ছে না।

তিনিও অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এবার আস্তে করে কাছে এসে লেখকের মুখ চেপে ধরল সে। লেখকের ডানহাত লোকটার কব্জি ধরে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে, অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, কিন্তু লেখকের শক্তিহীনতার জন্যে তাতে কোনো প্রতিরোধ তৈরি হলো না।

আরেকটা হাত দিয়ে অজ্ঞাত লোকটি সজোরে লেখকের বুকের বামদিকে, ঠিক যেখানটায় বছরখানেক আগে ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছে, ঘুষি চালাল।

লেখক নিজে থেকে নয়তো ঘুষির কারণে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললেন। ঘন অন্ধকারে তার সমস্ত জগত ঢেকে গেল নিমেষে। সেই গাঢ় অন্ধকারে শৈশবের কথা ভাবার চেষ্টা করলেন তিনি। শেষ মুহূর্তে কিছু সুন্দর দৃশ্য দেখতে চাইলেন। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। খুব সম্ভবত আরেকটা ঘুষি তার বুকের বামদিকে করা হয়েছে, কিন্তু তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। কেবল বুঝতে পারলেন, পুরো বুকটা চেপে আসছে চারপাশ থেকে। যেন দু-হাতে কেউ তার বুকটা সজোরে চেপে ধরেছে।

কয়েক সেকেন্ড পর তার শরীরটা উধাও হয়ে গেল। শুধু মস্তিষ্কটা কাজ করছে এখন। তিনি বুঝতে পারছেন মৃত্যু তাকে আলিঙ্গণ করছে। এই অভিজ্ঞতাটি কেমন সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছেন, নিজের সৃষ্ট অনেক চরিত্রের মৃত্যুদৃশ্য নির্মাণ করতে যেয়ে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু এখন তার যে অনুভূতি হচ্ছে সেটা বর্ণনাতীত। অনির্বচনীয়! এই অভিজ্ঞতা পৃথিবীর কেউই বর্ণনা করে যেতে পারে না।

কতোক্ষণ লাগবে?

ব্যাপারটা দ্রুত শেষ হয়ে গেলে তার মুক্তি ঘটবে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি শেষ হচ্ছে না। শৈশবের একটা ছবি ভাবার চেষ্টা করলেন। আসছে না। নিজের এই অবস্থা ভুলে সুন্দর কোনো মুহূর্ত স্মরণ করার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বুঝতে পারলেন সত্যের কোনো মূল্য নেই। অন্তত এই মুহূর্তে তার কাছে সত্যের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন একটা সুন্দর মুহূর্তের। সে-রকম কোনো সুন্দর সুখস্মৃতির জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন তিনি।

অবশেষে ছবিটা ভেসে উঠল । কিন্তু খুব বেশি সময় কি আছে?

একটা সরু খালে দুটো বাচ্চা ছেলে ডিঙ্গি নৌকায় করে শাপলা ফুল তুলছে আর একে অন্যের দিকে পানি ছুঁড়ে মারছে…

*

ঠিক একই সময়ে, ভিটা নুভা অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তার ফুটপাতে অল্পবয়সি এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি রাস্তার ওপারে ভিটা নুভার ছয় তলার কর্নার ফ্ল্যাটের বেলকনির দিকে। গভীর মনোযোগের সাথে কী যেন দেখছে সে। ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে যে কেউ সন্দেহ করবে। সত্যি বলতে, ছেলেটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।

রাত প্রায় দুটো। পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে। শহর কখনও ঘুমায়–ঢাকার জন্যে এ কথাটি প্রযোজ্য নয়। এক কোটি লোকের এই শহর মাঝরাতের দিকে প্রায় ভুতুরে শহরে পরিণত হয়। যদিও এর আসল এবং অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে নিঝুম রাতেই। সেটা নিশাচরেরাই ভালো জানে।

প্রশস্ত রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা নয়, দুয়েকটা ভারি যানবাহন আর পুলিশের টহল গাড়ি আসছে যাচ্ছে। আধঘণ্টা আগে স্থানীয় থানার একটি টহল গাড়ি এই রাস্তায় টহল দিয়ে গেছে। আরেকবার এখান দিয়ে গাড়িটা যাবে। আজকের রাতের ডিউটি শেষ করে একটু পরে থানায় ফিরে যাবে এ পথ দিয়েই।

চার্লি ফোরের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ আরেকটা বিশেষ সিগারেট ধরাল। কাটাবন থেকে সন্ধ্যার দিকে উপঢৌকন হিসেবে পেয়েছে। রাতের ডিউটি দিতে তার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু পুলিশের চাকরি করলে ভালো-মন্দ বলে কিছু থাকতে নেই। যে লোককে এই চাকরিটা পাইয়ে দেবার জন্যে দেশের জমিজমা বেচে নগদ দুই লাখ টাকা দিয়েছিল তাকে যদি এখন হাতের কাছে পেতো…

“গাড়ি থামাও!” গর্জে উঠল এলাহী। পিকআপ ভ্যানের ভেতরে বসে থাকা তিনজন কনস্টেবল আর ড্রাইভার চম্‌কে উঠল।

“কি হইছে, স্যার?” পাশে বসে থাকা ড্রাইভার ওয়াদুদ বলল।

“আরে, আগে গাড়িটা থামাও।” বলেই সে রাস্তার ডানদিকে ইঙ্গিত করল। ড্রাইভার দৃশ্যটি দেখার আগেই তাদের গাড়ি বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে।

খ্যাচ্‌ করে গাড়ি ব্রেক করার যে শব্দ হলো তাতে করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি একটুও চমকালো না। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক আচরণ। এলাহী নিজের পিস্তলটা হোলস্টার থেকে বের করে হাতে নিয়েই ক্ষান্ত হলো না, সেফটি লটাও খুলে ফেলল। এক অজানা আশঙ্কা তার ষষ্ঠইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তুলেছে। ইন্সপেক্টর ভ্যানের পেছনে বসা তিনজন কনস্টেবলকে ইশারা করলে তারাও পুলিশ বাহিনীতে সদ্য বিতরণ করা অত্যাধুনিক মার্ক ফোর রাইফেল নিয়ে ভ্যান থেকে নেমে পড়ল। তাদের তিনজনের কেউই এখন পর্যন্ত এই অস্ত্রব্যবহার করেনি। তাদের অভিজ্ঞতা বলতে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্যবহার করা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। এখন এই নতুন অস্ত্র তাদেরকে দেয়া হলেও ফায়ারিং প্র্যাকটিসে পাঁচটি গুলি করা ছাড়া সত্যিকারের কোনো অ্যাকশনে ব্যবহার করা হয়নি। আজকেও যে করা হবে তার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছে না।

একটা নিরীহ মাল।

তিনজন কনস্টেবল আর পিস্তল হাতে উদ্যত এক ট্রিগারহ্যাপি ইন্সপেক্টরকে মোকাবেলা করা তার পক্ষে কখনও সম্ভব হবে না।

এলাহী পিস্তলটা নিচু করে রেখে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করল তিনজন কনস্টেবল। তারা যখন মাত্র দশ গজ দূরে তখনই ছেলেটা তাদেরকে দেখতে পেল। ছয় তলার বেলকনির দিকে এমনভাবে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল যে এতোক্ষণ কিছুই খেয়াল করেনি। পুলিশ দেখেই ভড়কে গেল সে। সব দুষ্কৃতিকারীই পুলিশ দেখলে ভড়কে যায়।

“অ্যাই ছেলে, এতো রাতে এখানে…” এলাহী বাক্যটি শেষ করার আগেই ছেলেটি তাদেরকে অপ্রস্তুত করে আচমকা দৌড় দিল।

এলাহী ছেলেটার পেছন পেছন দৌড়ে গেল না। আটত্রিশ বছর বয়সে তার ভুড়ির অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এই ছোকরার পেছনে দৌড়ে সে কুলাতে পারবে না।

“শালারে ধরো,” হতভম্ব তিন কনস্টেবল, যারা অফিসারের উপস্থিতিতে নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত নয়, এলাহী তাদেরকে নির্দেশ দিল।

কনস্টেবল তিনজন নিজেদের ভারি রাইফেলটা কোনোরকম সামলে নিয়ে ছেলেটার পেছনে ছুটলো। ইতিমধ্যে ছেলেটা বেশ দূরে চলে গেছে।

এলাহী ভ্যানে উঠতে উঠতে ড্রাইভারকে বলল, “ওয়াদুদ, জলদি চলো।”

গাড়ির ইঞ্জিন চালুই ছিল, মুহূর্তে ছুটতে শুরু করল সেটা।

*

পানির ঝাঁপটা মুখে এসে লাগতেই অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতিতে আক্রান্ত হলেন তিনি। এই দম বন্ধ অবস্থায়, সুতীব্র যন্ত্রণায় এ রকম অনুভূতি তার কাছে স্বর্গের মতো মনে হচ্ছে। মনেপ্রাণে তিনি চাচ্ছেন মৃত্যু যেন দ্রুত গ্রাস করে তাকে।

শৈশবের ছবিটা মিইয়ে গিয়ে একে একে অসংখ্য ছবি ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। কোনোটা সুখের, কোনোটা সুতীব্র দুঃখের, আবার কোনোটা অনুশোচনার। সবই জীবনের অংশ।

বুকটা আরো চেপে এল। এখন তার মনে হচ্ছে সমস্ত প্রাণটা মুখ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। বমি করার মতো একটা অনুভূতি হলো। আমি কি বমি করছি?

এ ক-দিন তিনি নিজেকে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বলে মনে করেছিলেন, আজকের এই ঘটনায় তার সেই ধারণার অবসান হয়েছে। এই একটা সুখস্মৃতি তাকে শেষবারের মতো কিছুটা হলেও শান্তি দিল, কিন্তু এই মুহূর্তের সব কিছুই খুব বেশি ক্ষণিকের। একটা মুখ ভেসে উঠতেই তার সব শান্তি তিরোহিত হয়ে গেল নিমেষে।

কতো মায়াবী মুখটা! একসময় এই মুখটি তাকে কিভাবেই না আন্দোলিত করতো। মুখটার করুণ অভিব্যক্তি তাকে পীড়িত করল। কতো গল্প জড়িয়ে আছে একে নিয়ে! এই মুখটা এক সময় তাকে অনুপ্রেরণা দিতো। জাগিয়ে তুলতো। এক নজর দেখার জন্যে ছুটে আসতে পারতেন বহু দূর থেকে, কিন্তু এখন! মুখটার মলিনতা, বিমর্ষতা তাকে মৃত্যুর চেয়েও

সুতীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। তিনি এ থেকে পরিত্রাণ চান। মৃত্যুর কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গিয়ে এ থেকে নিষ্কৃতি চান।

লেখক মারা গেছে কি না নিশ্চিত হবার জন্যে ঘাতক লেখকের মুখ থেকে তার বামহাতটা সরিয়ে একটু ঝুঁকে এল। লেখকের চোখদুটো বন্ধ। নিস্তেজ শরীরটায় কোনো প্রাণ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। বুকের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল শ্বাসপ্রশ্বাসে আন্দোলিত হচ্ছে না সেটা।

কিন্তু হঠাৎ করেই যেন এই জড়বৎ মৃতদেহের মুখটা ক্ষণিকের জন্যে সজীব হয়ে উঠল। তবে এতো অল্প সময়ের জন্যে যে ঘাতককে তেমন কিছু করতে হলো না।

লেখক শেষ যে কথাটি বললেন সেটা এই পৃথিবীর কেউই হয়তো বুঝতে পারবে না। এ রকম মুহূর্তে এটাকে নিছক অসংলগ্ন কোনো কথা বলেই মনে হবে। তিনি ছাড়া এ ঘরে একমাত্র যে ব্যক্তিটি আছে কথাটা নিশ্চয় তাকে উদ্দেশ্য করেও নয়। খুনি নিজেও কথাটা শুনে প্রথমবারের মতো একটু চমকে উঠল।

“…আমাকে ক্ষমা করে দিও!”

.

অধ্যায় ২

আধো আলো অন্ধকার একটি ঘর। রকিংচেয়ারে একজন মানুষ বসে আছেন। তার চোখে ঘুম নেই। সিভাস রিগালের প্রভাবে একটু ঝিমুনি এলে চোখদুটো কেবল বন্ধ করেছিলেন, তা-ও দশ মিনিটের বেশি হবে না।

একটা ফোনের জন্যে অপেক্ষা করছেন। একজন বিজনেস টাইকুন হিসেবে রাত-বিরাতে অনেক ফোনই তাকে রিসিভ করতে হয়, এটা তার জন্যে নতুন কিছু নয়, তবে অনেক সময় নির্দিষ্ট কলটি আসতে দেরি করে আর তখনই তার মেজাজ বিগড়ে যায়, মনে নানা রকম আশঙ্কা হতে থাকে। আজকের ফোনটাও দেরি করছে। বলা যায় খুব বেশিই দেরি করছে। এখন ভোর চারটা। শীতের দিন বলে বাইরে তাকালে মনে হবে রাত একট কি দুটো বাজে। তিনি জানেন শীতের দিনে রাত একটা আর ভোর তিনটা চারটার মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য থাকে না।

খুব তেষ্টা পেলে চোখ খুললেন। সামনে রাখা সিভাস রিগালের প্রায় খালি হওয়া বোতলটা একটু ঝুঁকে হাতে তুলে নিলেন।

আছে, এখনও একটু আছে।

গ্লাসে না ঢেলে সরাসরি বোতল থেকেই বাকিটা শেষ করে ফেললেন।

সিভাস রিগাল পাকস্থলীতে পড়তেই শরীরটা একটু চাঙ্গা হয়ে গেল। মুখটাও বিস্বাদ লাগছিল এতোক্ষণ, সেই ভাবটাও কেটে গেল মুহূর্তে। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চাটতেই তার সেলফোনটা বেজে উঠল।

প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। অপরিচিত একটি টিঅ্যান্ডটি নাম্বার। একটু অবাক হলেন তিনি। বুঝতে পারলেন না রিসিভ করবেন কি না। অবশেষে কলটা রিসিভ করলেও নিজে থেকে কিছু বললেন না। এটাই তার স্বভাব। ফোন করেছো তুমি, তুমিই আগে নিজের পরিচয় দেবে।

ওপাশ থেকে যে কণ্ঠটা শুনতে পেলেন সেটা তাকে খুবই বিস্মিত করল। কিন্তু নিজের এক্সপ্রেশন লুকিয়ে রাখার মধ্যেই অর্ধেক সফলতা নিহিত থাকে–আজীবন এই কথাটা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছেন তাই ফোনের ওপর পাশের ব্যক্তিটি কোনোভাবেই বুঝতে পারল না তিনি বেশ অবাকই হয়েছেন।

“সি ই এ সিদ্দিকী বলছেন?” কণ্ঠটা কর্তৃত্বপরায়ণ। এ রকম কর্তৃত্ব ফলায় বড় আমলা, সামরিক বাহিনীর অফিসার আর পুলিশের লোকেরা। প্রথম দুটি দল এতো রাতে তাকে ফোন করবে সেই সম্ভাবনা একেবারেই কম। অতএব এটা যে পুলিশের সেটা বুঝে নিতে মাত্র দু-সেকেন্ড সময় লাগল তার।

“কেন, কি হয়েছে, তিনি নিজের পরিচয়টা নিশ্চিত করলেন না, সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

ওপাশের লোকটি খুব তাড়ায় আছে, সে-ও সরাসরি আসল কথায় চলে এল। “আপনার ছেলে ইরামকে আমরা অ্যারেস্ট করেছি।”

সিদ্দিকীসাহেব একটু অবাক হলেন। শেষবার যখন ইরামের ঘরে উঁকি মেরেছিলেন তখনও দেখেছেন তার ছেলে ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে। সেটা অবশ্য রাত এগারোটার দিকে-এখন থেকে পাঁচ ঘণ্টা আগে।

“কি করেছে সে, কোত্থেকে অ্যারেস্ট করেছেন?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

শেষরাতে গ্রেফতার হওয়া ছেলের বাবা হিসেবে লোকটার কণ্ঠস্বর বেশ স্বাভাবিক-ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ ভাবলো। “ধানমণ্ডি থেকে। আর বাকিটা শুনতে হলে আপনাকে যে একটু থানায় আসতে হবে, স্যার…” এলাহী কেন স্যার সম্বোধন করল বুঝতে পারল না। এখনও সে মধ্যবিত্তের জি হুজুর’সুলভ মনোভাব পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। লোকটার শীতল আর রাশভারি কণ্ঠ তাকে দিয়ে স্যার বলিয়ে নিয়েছে।

“…এক্ষুণি ধান-”

কথাটা শেষ করার আগেই সিদ্দিকীসাহেব ফোনটা রেখে দিলেন। তাকে এখন আরেকটা জায়গায় ফোন করতে হবে। এতো রাতে এ রকম এক হোমরাচোমরাকে ফোন করার জন্যে তিনি মোটেও ইতস্তত বোধ করলেন না। তার মতো ধনীদের সেবা করতে পারলে এইসব ক্ষমতাবানেরা ধন্য হয়ে যায়।

তার এই ফোনের সিমে খুব বেশি নাম্বার নেই। হাতেগোনা কয়েকটা নাম্বারই এতে সংরক্ষিত আছে।

রিং হচ্ছে। একবার…দু-বার…তিনবার…

রাতের এ রকম সময় কেউ ফোনের কাছে বসে থাকবে সে আশা তিনি করেন না। বিশেষ দরকার না হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন, কিন্তু এখন অপেক্ষা করা যাবে না।

.

লাইনটা কেটে গেলে এলাহী কী করবে বুঝতে পারল না। সে কি আবার ফোন করবে?

ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে ফোনটা বুকের কাছে কিছুক্ষণ ধরে রাখল। তারপর ফোনটা রেখে হুঙ্কার দিল সে, “জলিল, এক কাপ চা দিতে এতোক্ষণ লাগে?”

অনেক ধকল গেছে। এই আধপাগলা ছেলেটা বেশ ভুগিয়েছে। আধমাইল দৌড়ে অবশেষে দম ফুরিয়ে নিজে থেকে ফুটপাতে বসে না পড়লে তাকে ধরা যেতো কি না সন্দেহ। তার তিনজন কনস্টেবল রাইফেল সামলাবে না দৌড়াবে এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে অবশেষে যে দৌড় দিয়েছে সেটা দেখলে কার্টুন ছবির কথাই বেশি মনে পড়ে যায়।

আর এই ছেলেটা! উফ! আস্ত একটা গজব। কিছুতেই মুখ খুলছে না। কয়েকদিন আগে ধানমণ্ডি এলাকায় এক বাড়িতে ডাকাতি হবার সময় এলাহী ঘটনাচক্রে সেই বাড়ির সামনে দিয়ে টহল দিতে গিয়ে এ রকমই এক ছেলেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। তারপরের ঘটনা পত্রিকায় বড় বড় শিরোনাম হয়ে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে। আজকের ঘটনাটাও এলাহী সে-রকম কিছু বলে সন্দেহ করছে। তবে ছেলেটা এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি। এলাহী আরেকটা টহল দল থেটাকে পাঠিয়েছে ভিটা নুভা নামের অ্যাপার্টমেন্টে, যেটার দিকে ছেলেটা তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছিল।

বেশ দামি একটা টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরে আছে, ডাকাত দলের সদস্য বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এলাহী জানে, আজকাল নেশাগ্রস্ত অনেক বড়লোকের ছেলে নেশার টাকা জোগাড় করার জন্যে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এলাহী এই ছেলেটাকে নিয়ে গভীর সন্দেহ করছে। ছেলেটার সঙ্গে মোবাইল ফোন কিংবা মানিব্যাগ নেই। কোনো এক অজ্ঞাত ড্রাগ নিয়েছে সে-এ ব্যাপারেই কেবল নিশ্চিত। বাকি সবকিছুই বেখাপ্পা ঠেকছে তার কাছে। এইমাত্র ফোনে ছেলেটার বাবার সঙ্গে যে কথা হলো সেটা আরো বেশি বেখাপ্পা লাগছে। এই হারামজাদা কোনো কথাই বলেনি, অল্প একটু টর্চার করার পর অবশেষে তার বাবার ফোন-নাম্বার আর নামটা বলেছে কেবল। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে বড়লোকের নাম। দীর্ঘ নাম থাকে তাদের। ছোট নামের কোনো বড়লোকের দেখা আজ পর্যন্ত সে পায়নি।

তার ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলে এলাহীর মনে হলো সিদ্দিকীসাহেব হয়তো ফোন করেছেন। কিছুক্ষণ আগে কথা বলার মাঝখানে যান্ত্রিক কারণে লাইনটা কেটে গিয়েছিল তাহলে।

ফোনটা তুলে নিতেই যে কণ্ঠটা শুনতে পেল সেটার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। কণ্ঠটা শুনেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। এ রকম প্রায়ই হয়ে থাকে। তার রাত জাগার তিক্ততা আরো বেড়ে গেল। এখন পুরো ঘটনাটি তাকে বলতে হবে। ক্লান্তির কারণে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও তাকে এই অপ্রিয় কাজটি করতেই হবে। যতোটুকু সম্ভব সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল।

সব শুনে ওপাশ থেকে ওসি আলী হোসেন সাহেব ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললেন, “কী যে করেন না। একটা ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল আর অমনি তাকে ধরার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন?”

“না, মানে, সন্দেহজনক ছিল, স্যার, এলাহী ব্যাখ্যা করতে চাইল।

“এতো দিন ধরে ধানমণ্ডি থানায় আছেন, বোঝেন না? বড়লোকের পোলাপান, রাতে হয়তো মাগি-টাগি খুঁজতে বের হয়েছিল।”

ওসির মুখে ‘মাগি’ শব্দটা শুনে একটু লজ্জা পেল এলাহী।

“আমাদের হোম মিনিস্টারকে এতো রাতে ঐ লোক ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়েছে। বুঝুলেন?”

“জি, স্যার, এলাহী কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

“সি ই এ সিদ্দিকী নিজেই হয়তো আসতে পারেন…একটাই তো সন্তান। খুব ভালো ব্যবহার করবেন। ঠিক আছে?”

“জি, স্যার।”

ফোনটা রেখে দেয়া হলেও এলাহী কিছু সময়ের জন্যে উদাস হয়ে থাকল। আরেকটা বাঘের বাচ্চার গায়ে হাত দিয়েছে সে।

চা দেয়া হলে অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে গেল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে একটা গালি দিল মনে মনে, বড়লোকের মায়রে আমি…

ঠিক তখনই থানার বাইরে একটা দামি পোর্শে গাড়ি এসে থামল। এলাহীর সামনের জানালা দিয়ে থানার প্রবেশপথটি দেখা যায়, যে-ই এখানে প্রবেশ করুক, জানালা দিয়ে দেখতে পায় সে।

এই রকম দামি গাড়ির সাথে সে পরিচিত। বিশেষ করে গত বছর দূর্নীতি বিরোধী অভিযানের সময় এক ধানমণ্ডি থানা এলাকায়ই ত্রিশটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়েছিল। আর এলাহী নিজেই করেছে দশটি গাড়ি। পোর্শে… হামার…ভভভা…বিএমডব্লিউ…কোটি কোটি টাকা দামের একেকটা গাড়ি। বৈধভাবে সারা জীবনে সে এক কোটি টাকা কামাতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।

এলাহী চেয়ার ছেড়ে উঠে রিসেপশন রুমে চলে এল।

সি ই এ সিদ্দিকী আটদশ জন ধনীর মতোই দেখতে। এইসব ধনীদের গায়ের রঙ কালো হোক আর সাদা হোক, একধরণের জেল্লা জেল্লা ভাব থাকে। তাদের পোশাক স্পষ্টতই অন্যদের চেয়ে তাদেরকে আলাদা করে রাখে।

সিদ্দিকী সাহেবের বয়স হবে পঞ্চান্ন কি ষাট। মাথার সব চল পেকে গেলেও কলপ দেয়া আছে বোঝা যায়। ক্লিন শেভ করা। কপালের সামনের দিকে হেয়ার লাইন অনেকটা পিছু হটে গেছে। গায়ে তার দামি নাইটড্রেস। যেমনটি নাটক-সিনেমায় দেখা যায়। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো লোকটার চোখে ঘুমের কোনো লেশমাত্রও নেই। মনে হয় জেগেই ছিলেন।

বাবা রাত জেগে মদ খাচ্ছিল আর ছেলে রাস্তায় রাস্তায় খুঁজছিল মাগি।

এলাহী অবশ্য অন্য কিছুও ভাবছে। এই ছেলেটা কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিল, এলাহী এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে এখন আর এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনো উপায় নেই।

রিসেপশন রুমে ঢুকেই তিনি একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করতে গেলে এলাহী এগিয়ে এসে বলল, “আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম…” এবার বেশ সচেতনভাবেই স্যার সম্বোধনটা এড়াতে পারল সে।

সিদ্দিকী সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন। এলাহী প্রস্তুত ছিল না। বড়লোকেরা ছোটখাট পুলিশ অফিসারকে পাত্তা দেয় না। তাদের সাথে সম্পর্ক থাকে পুলিশের আইজি কিংবা কোনো মিনিস্টারের। সে একটু থতমত খেয়ে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরল।

“এলাহী নেওয়াজ। ইন্সপেক্টর।”

সিদ্দিকী সাহেব ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, “থানার ইনচার্জ কে?”

“আলী হোসেন সাহেব। উনি ওসি। এখন ডিউটিতে নেই,” বলল এলাহী।

“আমার ছেলে কোথায়?” সিদ্দিকী সাহেব হাতটা ছেড়ে দিয়ে জানতে চাইলেন।

‘লকাপে।”

কথাটা শুনে লোকটা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। “বসুন।”

একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল এলাহী।

সিদ্দিকী সাহেব চেয়ারে বসতেই আরেকজন লোক এসে হাজির হলো। এই সাত সকালেও কালো কোটটা পরতে ভুলে যায়নি।

“কে, ডিউটি অফিসার কে?” চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল লোকটা।

সিদ্দিকী সাহেব অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, “রফিক উল্লাহ্!”

সিদ্দিকী সাহেবকে দেখতে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আচরণ বদলে গেল লোকটার। “স্যার, আপনি? আপনি না এলেও তো হোতো।”

লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে এলাহীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

পাশের একটা চেয়ারে তাকে বসার ইশারা করলেন সিদ্দিকী সাহেব। “অস্থির হবে না। তেমন কিছু না। তোমার আসার কোনো দরকার ছিল না।” লোকটা কিছু বলতে যাবে তখনই সিদ্দিকী সাহেব হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে এলাহীকে বললেন, “তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?”

“হ্যাঁ, অভিযোগ কি?” উকিল লোকটি সিদ্দিকী সাহেবের কথার প্রতিধ্বনি করল।

এলাহী কটমট চোখে উকিলের দিকে তাকিয়ে সিদ্দিকী সাহেবের দিকে ফিরে বলল, “না, মানে, ফিফটি ফোর-এ আটক করেছি। রাস্তায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করছিল, স্যার,” কথাটা বলেই মনে মনে জিভ কাটল এলাহী। আবারো মুখ ফসূকে স্যার বলে ফেলেছে।

উকিল ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই আবারো সিদ্দিকী সাহেব বলতে লাগলেন, “ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে?” বোঝাই যাচ্ছে। সময়ক্ষেপন করতে চাচ্ছেন না।

এলাহী একটু ভেবে বলল, “কিছু করতে হবে না। নিয়ে যেতে পারেন।”

“ধন্যবাদ, আপনাকে।” সিদ্দিকী সাহেব উঠে দাঁড়ালে একজন কনস্টেবলকে ইশারা করল এলাহী, কিছুক্ষণ পরে ইরামকে দুজন কনস্টেবল ধরে নিয়ে এল। তার বাম চোখের নিচে আঘাতের চিহ্ন। সেখানে তাকিয়ে রইলেন সিদ্দিকী সাহেব। ইরাম অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ।

সিদ্দিকীর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারল এলাহী। “দৌড়ে পালিয়েছিল। ধস্তাধস্তির সময় একটু…”।

হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন সিদ্দিকী সাহেব। “ঠিক আছে। আমরা তাহলে যাই, না কি?”

“একটা কথা বলি, আপনাকে?” এলাহী আচম্‌কা কথাটা বলল। যদিও এর জন্যে তার কোনো পূর্ব প্রস্ততি ছিল না।

“বলুন,” সিদ্দিকী সাহেব তার উকিলকে ইশারা করলে ভদ্রলোক ইরামকে নিয়ে পোর্শে গাড়িতে গিয়ে উঠল। সিদ্দিকী সাহেব আর দশজন বাবার মতো পিতৃত্ব বোধের কোনো উকট বহিপ্রকাশ ঘটালেন না।

“আমার মনে হয় আপনার ছেলে নেশা করে।”

সিদ্দিকী সাহেব এই প্রশ্নেও কোনো রকম অবাক হলেন না। একটু চুপ থেকে বললেন, “হ্যাঁ, করে।”

“কি নেশা করে সেটা কি আপনি জানেন?” কথাটা বলেই এলাহীর মনে হলো এই প্রশ্নটি না করলেই বোধহয় ভালো হোতো।

সিদ্দিকী সাহেব এবার কোনোরকম সময় না নিয়েই আস্তে করে বললেন, “এল এস ডি।”

“কি!?” এলাহী কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল।

“একটা ভয়ংকর নেশা। এ দেশে খুব কমই পাওয়া যায়।” বলেই তিনি গটগট করে চলে গেলেন এমন ভঙ্গিতে যেন তিনিই ঠিক করে দিলেন আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।

এলাহী নেওয়াজ দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল ভোর সাড়ে চারটা বেজে গেছে।

.

অধ্যায় ৩

টহল গাড়ি থেটার নেতৃত্বে আছে সাব-ইন্সপেক্টর সমীর দাস। একটু আগে ওয়াকিটকিতে ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ তাকে ধানমণ্ডির ভিটা নুভা নামের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং চেক করে আসতে বলেছে। তেমন কিছু না। কয়েক সপ্তাহ আগে এই এলাকায় এ রকম একটি বিল্ডিংয়ে ডাকাতি হয়েছিল। এলাহী নেওয়াজ আজ একটু আগে ভিটা ভার সামনে থেকে এক ছেলেকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার সময় অ্যারেস্ট করেছে। ইন্সপেক্টর সাহেবের সন্দেহ ভিটা নুভায় কিছু একটা হলেও হতে পারে। সমীর জানে গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে বলে এলাহী তাকে পাঠিয়েছে এই বিল্ডিংটা একটু চেক করে দেখার জন্য।

সমীর দাসকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে ভিটা নুভার ছয় তলার কর্নার ফ্ল্যাটটার দিকে ছেলেটা লক্ষ্য রাখছিল। ঐ ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু দেখে এলেই হবে। তার সঙ্গে আছে পাঁচজন কনস্টেবল। যদি কোনো ডাকাতির ঘটনা হয়ে থাকে সেজন্যে তাদের এই বড় দলটি পাঠানো হয়েছে। এলাহী নিজেই আসতে পারতো। কিন্তু ছেলেটাকে ধরতে গিয়ে থানার খুব কাছে চলে এসেছিল বলে সে থানাতেই চলে গেছে, সমীরকে পাঠিয়েছে ব্যাপারটা একটু দেখে আসতে।

সমীর অবশ্য সেরকম কোনো কিছুর আশঙ্কা করছে না। সাধারণত কোনো এলাকায় বড়সড় ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেলে মাসখানে ‘বন্ত আর তেমন কোনো ঘটনা ঘটে না। হয়তো এলাহীও তা জানে, এজন্যেই খামোখা একটা কাজে সময় নষ্ট করতে চায়নি, বেগাড় খাটুনি খাটতে পাঠিয়েছে তাকে। তারপরও একটু কনফার্ম হতে হবে।

ভিটা নুভার সামনে এসে গাড়িটা থামলে সমীর ছয় তলার কর্নার ফ্ল্যাটের বেলকনির দিকে তাকাল। বাইরে থেকে অবশ্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তাকে ফ্ল্যাটে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হতে বলেছে এলাহী নেওয়াজ। কিন্তু এই অসময়ে, প্রায় ভোর বেলায় এই কাজটা করতে গেলে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যে খুবই বিরক্ত হবে সেটা নিশ্চিত। সেধে সেধে লোকজনের গালি খাওয়া আর কি!

সমীর গাড়ি থেকে নেমে একজন কনস্টেবলকে ডাকলো।

“রহিম? টর্চটা দাও।”

এক কনস্টেবল লম্বা একটি টর্চ সমীরের হাতে দিলে সে ভিটা নুভার ছয় তলার কর্নার ফ্ল্যাটের বড় বড় দুটি বেলকনি আর একটি জানালার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল। একটি জানালা আর বেলকনি অন্ধকার, কিন্তু ডান দিকের বেলকনি দিয়ে মৃদু ডিম লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে।

সমীর সেই বেলকনিতে টর্চের আলো ফেলল।

যদিও সে জানে এটাতে তেমন কোনো কাজ হবে না। খালি খালি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদেরকে বিরক্ত করা। তার উদ্দেশ্য খুব পরিস্কার। ইন্সপেক্টর এলাহী যে ছেলেটাকে গ্রেফতার করেছে সে না কি এই ফ্ল্যাটের বেলকনির দিকেই তাকিয়ে ছিল। ঘরের বাসিন্দাদের কেউ যদি আলো দেখে জানালা দিয়ে উঁকি দেয় তো নিচ থেকেই কাজটা সেরে নেবে, কষ্ট করে ছয় তলার ফ্ল্যাটে যাবার কোনো দরকার নেই।

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

সমীর এবার কনস্টেবলদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। “চলো, একটু দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে দেখি।”

.

তিন মাস ধরে চলা এই অভিসারে কোনো সমস্যা হয়নি। নির্বিঘ্নে একেকটা রাত কেটে গেছে প্রবল সুখের আবেশে। দু’জনের এই উদ্দাম মিলনের আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এই ব্যাপারটি নিয়েই তারা একটু চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে ইদানিং। তবে আশা একটাই, খুব জলদিই এই অবস্থার অবসান ঘটবে।

পূর্বপরিকল্পনা মতোই সব হচ্ছিল। ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু জানতে পারেনি। আজকের রাতটা তারা দারুণভাবে কাটিয়েছে। একে অন্যেকে তীব্রভাবে ভালোবাসতে বাসতে হারিয়ে গিয়েছিল তারা। সুখের আবেশে গাঢ় ঘুমে দু’জনে ঢলে পড়েছে মাঝরাতে। কী যেন একটা শব্দ হতেই বর্ষার ঘুম ভেঙে গেল।

বিছানার পাশে ছেলেটাকে দেখতে না পেয়ে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে তাকাল সে। দরজার নিচ দিয়ে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। চোখ দুটো কচলে ঘরের চারপাশে তাকাল। ছেলেটা কোথাও নেই। বুকটা কেঁপে উঠল তার। উঠে বসল সে। এমনিতেই হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে তার বুক ধরফর করে ওঠে, এখন সেটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে তার দু’চোখ সয়ে এলেও ছেলেটাকে দেখতে পেল না। এক অজানা অশংকায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

বিছানা থেকে উঠে যে খুঁজে দেখবে সেই শক্তি পর্যন্ত লোপ পেয়ে গেল। বর্ষার। টের পেল নিশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে বুক ভরে দম নিয়ে যে-ই না বিছানা থেকে নামতে যাবে অমনি একটা শব্দে চমকে উঠল সে।

দক্ষিণ দিকের বেলকনির স্লাইডিং ডোরটা খুলে একটা ছায়ামূর্তি চুপিসারে ঘরে ঢুকছে। প্রচণ্ড ভয়ে বর্ষার গলা শুকিয়ে গেল।

.

ভিটা নুভার নাইটগার্ড আসলাম মেইন গেটের বক্সের ভেতরে বসে আরাম করে দুচোখ একটু বন্ধ করেছিল মাত্র। পঁচিশ বছরের যুবক আসলাম ছয় মাস কুয়েতে কাজ করেছে, তারপর জন্ডিসে আক্রান্ত হলে ঐ দেশের সরকার তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। গ্রামের বাড়ির জমিজমা বেঁচে দিয়ে বিদেশ গিয়েছিল। ফিরে এসে একেবারে চোখে অন্ধকার দেখে। তার গ্রামেরই এক লোক এই চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছে তাকে।

থাকা খাওয়া ফ্রি। বেতন তিন হাজার টাকা। তারপরেও আসলাম কুয়েত যাবার স্বপ্ন দেখে। প্রচুর টাকা কামাবে, গ্রামের বাড়িটা পাকা করবে, লোকজন তার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাবে তখন। তোমার দিকে যদি লোকে ঈর্ষার চোখেই না তাকাল তাহলে কিসের সুখ!

রাতের এই ডিউটিটা তার প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো। এখন, এই দু’বছরের চাকরি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট একটা কাজ। শুধু বসে বসে রাত জাগা। তাকে অবশ্য প্রতি রাতে ডিউটি করতে হয় না। তারা দুজন এ কাজটি করে। মহব্বত নামের অন্য আরেকটি ছেলে আছে। তার ডিউটি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

হঠাৎ মেইন গেটে এমন জোরে শব্দ হলো যে বক্সে বসে ঝিমুতে থাকা আসলাম চমকে টুল থেকে পড়েই যাচ্ছিল। তার বুকটা ধরফর করে উঠল। খুব দ্রুত ধাতস্থ হয়ে বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা কি।

“কে?” খুবই দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল সে।

কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব এল না, দরজায় আরো জোরে আঘাত করা হলো।

“আরে ভাই, কে?” এবার একটু জোরেই কথাটা বললে দরজায় আঘাতের শব্দটা থেমে গেল। তারপরই একটা কণ্ঠ বলল, “আমরা পুলিশ, গেট খোেল।” পাঁচজন কনস্টেবলের একজন জবাব দিল।

“পুলিশ?” আসলাম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আরে ব্যাটা, গেট খোল,” অন্য একজন কনস্টেবল অধৈর্য হয়ে বলল।

আসলাম এবার আর কোনো প্রশ্ন না করেই গেটটা খুলে দিল। পাঁচ ছয়জন পুলিশকে এক সঙ্গে দেখে ভড়কে গেল সে।

“সালামালাইকুম, স্যার,” বলল আসলাম।

.

বর্ষার মুখ দিয়ে অস্ফুটভাবে বের হয়ে এল : “কে!?”

কথাটা শুনে চমকে উঠল ছেলেটা। “আমি!” বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল সে। তার আচরণ খুবই অস্বাভাবিক। কপালে রীতিমতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। বর্ষা ভালো করে তাকিয়ে দেখল ছেলেটার হাতও কাঁপছে।

চাপা কণ্ঠে ছেলেটা তাকে বলল, “আস্তে!” কথাটা বলেই বিছানার প্রান্তে বসল সে।

“কী হয়েছে?”

“পুলিশ!”

“কী!” বর্ষার সারা দেহের রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল মুহূর্তে।

“রাস্তা থেকে পুলিশ বেলকনিতে টর্চের আলো ফেলে কী যেন দেখছে,” চাপা কণ্ঠে বলল ছেলেটা। তাকে বেলকনির স্লাইডিং ডোরের কাছে নিয়ে গিয়ে পর্দা একটু ফাঁক করে দেখালে ভয়ে অসাড় হয়ে গেল বর্ষা।

ভুরু কুঁচকে বর্ষা ছেলেটার দিকে তাকাল। “তুমি ঘুম থেকে উঠলে কখন? বেলকনিতে কি করছিলে?”

“ঘুম ভেঙে গেছিল। একটু সিগারেট খাওয়ার জন্য…”

শেষ রাতে পুলিশের এই আগমন তাদেরকে জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর একটি পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। প্রায় দশ মিনিট তারা নিশ্চুপ বিছানার উপর বসে রইল। এক একেকটি সেকেন্ডকে যন্ত্রণাকাতর কয়েক ঘণ্টা বলে মনে হলো তাদের কাছে। তবে ভাগ্য ভালো, তেমন কিছু আর হলো না । রাস্তা থেকে তিন-চারজন পুলিশ তাদের এই ফ্ল্যাটের দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন দেখে চলে গেল।

দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রী বর্ষা। বহুল আলোচিত আর প্রচারিত একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে গত চার বছর আগে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তখন বর্ষার বয়স ছিল মাত্র একুশ। সবে ছোট পর্দায় নায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা এক তরুণী। কেবল লেখকের নিজের মেয়েরই সমবয়সি নয়, আক্ষরিক অর্থেই তার বান্ধবী ছিল সে।

আজ প্রায় এক বছর আগে লেখকের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে আর আট মাস আগে এক স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন তিনি।

বর্ষা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না পুলিশ কেন এতো রাতে তাদের ফ্ল্যাটের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। তাদের বেলকনিতে টর্চের আলো ফেলবে। কেউ কি তাদের এই ব্যাপারটা জেনে গেছে? অসম্ভব। তারা বেশ সতর্ক আর সজাগ। কিন্তু তাদের সব হিসেব পাল্টে দিয়েছে পুলিশের এই আগমন।

ভাগ্য ভালো পুলিশ অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকেনি। কী যে অঘটন ঘটে যেতে কথাটা ভাবতেই বর্ষার গা শিউরে উঠল। রাতের সমস্ত উত্তেজনা আর অভিসার তিরোহিত হয়ে এখন কেবল আশঙ্কা আর অনুশোচনা হচ্ছে।

বর্ষা টয়লেটে ঢুকলে ছেলেটা নিজের টেনশন দূর করার জন্যে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে আরেকটা সিগারেট ধরাল কিন্তু কয়েক টান দেয়ার পরই মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল তার। অর্ধেকটা খাওয়ার পরই বেলকনির দিকে ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় এসে বসল সে।

টয়লেট থেকে বের হয়ে এল বর্ষা। টেনশনে থাকলে মেয়ে মানুষ কি ঘন ঘন টয়লেটে যায়? মনে মনে বলল ছেলেটি।

বর্ষা এখন পাতলা একটি নাইটি পরে আছে। এটা তাদের অভিসারের পোশাক। ঘুমানোর আগে তাদের প্রথম মিলনের পর এই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সমস্ত আনন্দটাকে মাটি করে দিয়েছে। বর্ষাকে টয়লেট থেকে বের হতে দেখে আবারো উত্তেজনা অনুভব করছে ছেলেটা। বিছানা থেকে উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল ড্রেসিংটেবিলের সামনে।

“উফ। এসব এখন আর ভালো লাগছে না। ছাড়ো তো,” অনেকটা বিরক্ত হয়েই বর্ষা বলল, কিন্তু ছেলেটা তাতে একটুও দমে গেল না। বর্ষার কাঁধে মুখ ঘষতে শুরু করল।

ছেলেরা কী করে টেনশনে থেকেও এসব করার মতো মুডে থাকে ভেবে পেল না সে।

“অতো চিন্তা কোরো না তো।”

“তোমার কি মনে হয়, পুলিশ টর্চের আলো ফেলছিল কেন?”

“মনে হয় অন্য কোনো ফ্ল্যাটে খোঁজ করতে গিয়ে ভুলে এখানে আলো ফেলেছে।”

“অন্য ফ্ল্যাটেই বা কেন টর্চ দিয়ে আলো ফেলবে?” ব্যাখ্যাটা বর্ষার পছন্দ হলো না।

“তাতো জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আমাদের নিয়ে নয়। বাদ দাও তো। যদি তেমন কিছু হোতো পুলিশ বাইরে থেকে টর্চের আলো ফেলে চলে যেতো না। এই ফ্ল্যাটে আসতো।”

“তারপরও আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

“কিন্তু আমার খুব উত্তেজনা লাগছে।”

“টয়লেটে গিয়ে মথায় পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করে আসো, একটু মুচকি হেসে বলল বর্ষা।

ছেলেটা আয়নায় তাকিয়ে বর্ষার হাসিটা দেখতে পেয়ে একটু উফুল্ল হলো। আরো বেশি জড়িয়ে ধরে বলল, “কাকতালীয় ব্যাপার, ডালিং। ভয় পেয়ো না।”

“আমাকে সাহস দিচ্ছো! তোমার অবস্থা তো আমার চেয়েও খারাপ।”

কথাটা আমলে না নিয়ে বর্ষার ডান স্তন মুঠোতে পুরে ফেলল সে। বর্ষা এবার আর কোনো বাধা দিল না। নাইটির সামনের বোতাম খুলে ফেললে ছেলেটার হাত নাইটির ফাঁক গলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

মিনিট খানেক পরে তারা দুজন আবার বিছানায়। আবারো দু’জনের শরীর দু’জনকে গ্রাস করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। বর্ষার গলায় আর বুকে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে ছেলেটা। তারপর আচমকাই বিরতি। বর্ষা টের পেল অন্ধকারে তার প্রেমিক কাগজের মতো কিছু একটা ছিঁড়ে বিছানার এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বুঝতে পেরে মুচকি হেসে দ্বিতীয়বারের মতো প্রস্তুত হলো সে।

এবার তারা দুজনে সচেতনভাবেই কোনো রকম শব্দ করল না। যদিও পাশের ঘরে লেখক তাদের এই শব্দ শোনার মতো অবস্থায় নেই। তিনি এখন। সব কিছুর উর্ধ্বে।

.

“আমি তো উল্টাপাল্টা কিছু দেখতাছি না, স্যার,” সমীর দারোগাকে বলল ভিটা নুভার নাইটগার্ড আসলাম।

সমীর ছয় তলার বেলকনির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “ওখানেই তাহলে জায়েদ রেহমান থাকেন, এটা কোনো প্রশ্ন ছিল না, অনেকটা আপন মনে বিড় বিড় করেই কথাটা বলল। “ইন্টারকমের জবাব দিচ্ছে না কেন?” জানতে চাইল সমীর। অবশ্য এর জবাব সে নিজেও জানে। এতো ভোর বেলায় কে বসে আছে ফোন ধরার জন্যে?

“ঘুমায়া আছে,” আসলাম খুব সহজ করে বলল। “তারা তো দেরি কইরা ঘুম থেইকা ওঠে।”

“ঠিক আছে। তুমি চোখকান খোলা রেখো।” কথাটা বলেই সে তার দলবল নিয়ে চলে গেল।

“হালার পুলিশের কি কুনো কাম নাই, খালি বেহুদা কাজকারবার।” পুলিশের দলটি চলে গেলে আসলাম অনেকটা জোরেই বলল কথাটা।

.

প্রথমে ভেবেছিল ফোনটা বাজছে, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল ইন্টারকমে রিং হচ্ছে।

সবেমাত্র তাদের দ্বিতীয়বারের মতো মিলনপর্ব শেষ হলে ছেলেটা চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল আর মেয়েটা একপাশ ফিরে চেষ্টা করছিল ঘুমাতে।

ইন্টারকমে রিং হলে তারা দু’জনে আবারো ভীষণভাবে চমকে যায়। কী করবে ভেবে না পেয়ে ইন্টারকমের জবাব দেয়নি।

.

অধ্যায় ৪

এলাহী নেওয়াজ নিজের চেয়ারে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিল। গাঁজার নেশা আর সারা রাত জেগে থাকার ক্লান্তিতে গাঢ় ঘুম এসে লেগেছে দু’চোখে।

“স্যার, ঘুমিয়ে গেছেন না কি?” সমীর দারোগা তার টেবিলের সামনে এসে বলল। এলাহীর কোনো সাড়া শব্দ নেই। “স্যার!” এবার বেশ জোরে, প্রায় চিৎকার দেবার মতো করে বললে এলাহীর বুকটা ধরফর করে উঠল। চমকে উঠে দেখতে পেল সমীর দাসকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিছুটা ধাতস্থ হলো সে।

“স্যার, সব ঠিক আছে,” সমীর বলল।

“কি ঠিক আছে?”

“ভিটা নুভায়। ওখানে কোনো সমস্যা নেই, স্যার।”

এবার বুঝতে পারল এলাহী। আধঘণ্টা আগে সমীরকে ভিটা নুভায় পাঠিয়েছিল। “আচ্ছা,” বলল সে। একটু চুপ থেকে প্রশ্ন করল, “অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে সব ঠিক আছে তো?”

সমীর একটু কাচুমাচু করল। “না, মানে, ভেতরে তো যাইনি। ইন্টারকমে চেষ্টা করেছি, কেউ ধরেনি।”

এলাহীর চোখ দুটো কুঁচকে গেল। “বলো কি! তাহলে সব আর ঠিক থাকল কেমনে?”

সমীরও রাত জেগে ক্লান্ত। এ কথার কোনো জবাব দিল না। মাথা নিচু করে রাখল।

এলাহী চেয়ারে সোজা হয়ে বসল এবার। “ইন্টারকমে জবাব দেয়নি মানে, নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে!?”

সমীর চোখ তুলে তাকাল। “ঘুমিয়ে আছে সবাই। এই ভোর বেলায় কে আর ইন্টারকমের জবাব দেয়ার জন্যে জেগে থাকবে?”

এলাহী একটু ভিরমি খেলো। এই ছেলে তো ঠিকই বলেছে। ইন্টারকমে জবাব না দেয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এলাহী বুঝতে পারল সে অতিমাত্রায় সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। এটা হলো চোরবাটপারদের সাথে থাকার কুফল। সব কিছুতেই সন্দেহ করা তার বাতিক হয়ে গেছে। তার এই স্বভাবটি বদলাতে হবে। এটা কোনো সুস্থ মানুষের লক্ষণ নয়। ইদানীং সে নিজের বউয়ের অগোচরে তার মোবাইল ফোন চেক করে দেখে। মনের মধ্যে কেবল সন্দেহ আর অবিশ্বাস। কিন্তু পরক্ষণেই সি ই এ সিদ্দিকীর ছেলের কথাটা মনে পড়তেই তার সন্দেহের ব্যাপারটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

“ঠিক আছে, তুমি যাও।” সমীরকে বিদায় করে দিল সে। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ।

.

বর্ষা খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। পুলিশ তাদের অ্যাপার্টমেন্টে কেন ফোন করল? ব্যাপারটা কি? বার বার পুলিশ আসছে কেন? অজানা আশঙ্কায় রক্ত হিম হয়ে এল তার। কেউ কি বুঝে ফেলেছে? অসম্ভব! তারা এতো বেশি সতর্ক যে, এই বাড়িতে যে দুজন কাজের মানুষ আর একজন নার্স আছে তারাও কিছু বুঝতে পারেনি।

এই অ্যাপার্টমেন্টটা দুটো ফ্ল্যাটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে, ফলে এর প্রবেশ দরজা দুটো। একটা ব্যবহার করা হলেও অন্যটা বন্ধ রাখা হয়। তবে সাত-আট মাস আগে স্ট্রোকের পর লেখক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে সেই দরজাটা খোলা হয়েছে আবার। এটি দিয়ে প্রবেশ করলে যে ঘরটা প্রথমে পড়ে সেটা আগে ড্রইংরুম থাকলেও এখন এটাকে বর্ষা তার বেডরুম হিসেবে ব্যবহার করে। লেখকের সাথে তার থাকা হয় না। তার পক্ষে পক্ষাঘাগ্রস্ত একজন মানুষের সাথে রাত কাটানো সম্ভব নয়। লেখককে দেখাশোনা করার জন্যে নিয়োজিত আছে একজন সার্বক্ষণিক নার্স। সেই নার্স থাকে লেখকের ঘরের ঠিক পাশেই। আগে লেখক যে ঘরে লেখালেখির কাজ করতেন এখন সেখানেই তিনি থাকেন-থাকেন মানে, মরার মতো পড়ে থাকেন।

বর্ষার ঘর এই ফ্ল্যাট থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, তবে এই ঘরের ডান দিকের দেয়ালের পেছনেই রয়েছে লেখকের ঘরটি।

বর্ষা আর তার প্রেমিকের চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। বেচারা টেনশন দূর করার জন্যে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। বর্ষার চেয়ে সে আরো বেশি চিন্তিত, তবে ভাব করছে একটুও ভয় পায়নি। বর্ষার কাছে নিজের পৌরুষ জাহির করার চেষ্টা করছে সে। একটু আগেই ফজরের আজান হয়েছে। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে এখন।

নিচের রাস্তায় একটা গাড়ি থামার শব্দ শুনতে পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বেলকনির স্লাইডিং ডোরের পর্দার আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করল বর্ষা।

যে দৃশ্য সে দেখতে পেল সেটা তার হৃদস্পন্দনকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামিয়ে দিল। হারিয়ে ফেলল নড়াচড়ার শক্তি।

.

এলাহী নেওয়াজের দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এলেও চোখ দুটো টেনে টেনে ভিটা নুভার পাঁচ তলার কর্নার ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল। পুলিশের জিপটা একটু আগে ভিটা নুভা’র সামনে এসে থেমেছে। ফজরের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। পথে হাতেগোনা কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। নামাজ পড়েতে যাচ্ছে তারা। একটু পরে এই এলাকার অনেক লোকে জগিং করতে বের হবে। অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে এলাহীর তেমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। কিন্তু এমনও তো হয়, বাইরে থেকে সব ঠিকঠাক-ভেতরে অন্য কিছু। এর আগের ডাকাতির ঘটনাটি এ রকমই ছিল।

এলাহী সিদ্ধান্ত নিলো অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে না গিয়ে সে কোনোভাবেই নিশ্চিত হবে না। এখন ভোর হয়ে গেছে। এই সকালে কাউকে ঘুম থেকে ওঠালে খুব বেশি অন্যায় হবে না। এখন তো অনেকে ঘুম থেকে উঠেও গেছে।

দারোয়ান ছেলেটা আবারো পুলিশের আগমনে শুধু অবাকই হলো না, তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। এই অ্যাপার্টমেন্টে এমন কি হয়েছে যে একটু পর পর পুলিশ আসছে?

এলাহী তার তিন জন কনস্টেবলের দুজনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল, একজনকে রাখল গেটের বাইরে।

“ঐ ফ্ল্যাটের লোকজনকে এখান থেকে কেমনে ফোন করা যায় রে?” এলাহী জিজ্ঞেস করল দারোয়ান ছেলেটাকে।

“ইন্টারকম দিয়া করা যায়, স্যার,” ছেলেটা জবাব দিল।

“ফোন কর।”

কয়েক বার রিং হলেও কেউ ধরল না। এলাহী নেওয়াজ আবারো ইশারা করল রিং করার জন্যে।

রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না।

“স্যার, ধরছে,” দারোয়ান রিসিভারটা এলাহীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“হ্যালো।” নারী কণ্ঠটা খুবই কাঁপা আর ভীত।

“আমরা ধানমণ্ডি থানা থেকে এসেছি,” বলল এলাহী।

“কি জন্যে?” কণ্ঠটা আরো ভয়ার্ত শোনাচ্ছে এখন।

ডাকাত দলের লোকজন মহিলাকে পিস্তল ঠেকিয়ে কথা বলাচ্ছে। ডাকাতির সময় এ রকম ঘটনা হতেই পারে। এলাহীর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ডানা পাখা মেলতে শুরু করল। গাঁজার নেশা খুব গাঢ় হতে শুরু করেছে। “আপনার অ্যাপার্টমেন্টে কোনো সমস্যা হয়েছে কি, ম্যাডাম?”

“সমস্যা?”

“মানে কোনো রকম-”

মহিলা তার কথা শেষ করতে দিল না। “না। না। কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে।”

এলাহীর সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। মহিলা এতো তাড়াহুড়ার ভাব করছে কেন? “ঠিক আছে, আমরা আপনার ফ্ল্যাটে একটু আসতে চাইছি।”

“কেন?” সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা প্রতিবাদের সুরে বলল মহিলা।

“একটু দেখার জন্যে। কোনো সমস্যা না হলে তো ভালোই। আপনাদের ডিস্টার্ব করবো না। শুধু এসে দেখে যাবো।”

“আমি বুঝতে পারছি না, আপনারা খামোখা কেন আমাদেরকে এতো সকালে বিরক্ত করবেন? আপনারা কি জানেন না লেখক জায়েদ রেহমান এই ফ্ল্যাটে থাকেন। উনি খুব অসুস্থ।”

“জানি, ম্যাডাম। আর সেজন্যেই তো একটু চেক করে

এলাহী কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারল না। টেলিফোনের অপরপ্রান্ত থেকে চাপা একটা আর্তনাদ শোনা গেল। আরেকটা মেয়েলী কণ্ঠ!

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আর কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না এখন। এলাহীও সেই জবাবের অপক্ষোয় নেই। রিসিভারটা রেখে সোজা লিফটের দিকে ছুটে চলল দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে।

লিফটটা যখন ছয় তলার দিকে উঠে যাচ্ছে এলাহী টের পেল তার হৃদপিণ্ডটা রীতিমতো লাফাচ্ছে। সেই সাথে এও মনে হচ্ছে, খুব ধীর গতিতে উঠছে লিফটটা।

চারতলায় পৌঁছাতেই এলাহীর কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল শীতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে। সে বুঝতে পারছে বিরাট একটা সমস্যা হয়েছে। তার আশঙ্কাই সত্যি হতে যাচ্ছে। ঘটনা খুবই খারাপ। খুব খারাপ!

.

অধ্যায় ৫

শীতের দিনে ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতে বেগ’র কোনো বেগ পেতে হয় না। বিগত তিন বছর ধরে সে ভোর বেলায় নিয়মিত জগিং করে আসছে। ভার্জিনিয়ায় ট্রেনিং নিতে যখন গেল তখন থেকেই এই অভ্যাস। তার রুমমেট ছিল এক আমেরিকান তরুণ। আপাত দৃষ্টিতে তাকে বিট জেনারেশনের একজন মনে হলেও স্বাস্থ্য সচেতন এক যুবক। যৌন জীবন আরো বেশি সক্ষম আর দীর্ঘস্থায়ী করতেই না কি সে জগিং করে। শরীরটাকে ফিট রাখে। বেগ অবশ্য এ রকম কোনো কারণে নয়, তার পেশা এ রকম ফিটফাট থাকাটা দাবি করে। সেই আমেরিকান তরুণ এখন এফবিআই’র উদীয়মান কর্মকর্তা। সে-ই তাকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে জগিং করতে নিয়ে যেতো। পুরো একটি বছর এ রকম করতে করতে জগিং করাটা তারও অভ্যাস হয়ে গেছে। কেবল শরীর খারাপ থাকলে এর ব্যত্যয় ঘটে। বৃষ্টিতেও তার জগিং চলে সীমিত পরিসরে। এক নাগারে দু’তিন মাইল না দৌড়ালে এখন ম্যাজ ম্যাজ করে তার শরীর।

ধানমণ্ডির আট নাম্বারের লেকের সামনে ফুচকার যে ভ্রাম্যমান দোকানটা আছে সেখানে এসে হাপিয়ে গেল সে। ব্যক্তিগত একটা কারণে তার মনমেজাজ ভালো নেই তাই দৌড়াতে দৌড়াতে প্রতিদিনকার চেয়ে অনেক বেশি পথ জগিং করে ফেলেছে। রাশান কালচার সেন্টারের সামনে আসতেই বিপরীত দিকের ফুটপাতে বসে পড়ল বেগ।

কোমরে বেল্টের সাথে লাগানো ক্যান থেকে পানি খেয়ে নিলো। দম ফুরিয়ে এখন হাফাচ্ছে। এক দু’মিনিটেই শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক হয়ে যাবে। সারাটা শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে তার। গায়ের টি-শার্টটা ভিজে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে। ট্রাউজারের কিছু অংশ পর্যন্ত ভিজে একাকার। সব সময়ই এ রকমটি হয়। এটাই জগিংয়ের উদ্দেশ্য। তোমার শরীর যতোক্ষণ না ঘেমে উঠবে, বুঝবে জগিং হয়নি। রবার্ট অ্যালান জিমারম্যান, সেই আমেরিকানটি তাকে সব সময় এ কথা বলতো।

ক্যানের অবশিষ্ট কিছু পানি দিয়ে মুখটাও ভিজিয়ে নিলো। ঘামে ভিজে যাওয়া মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে হাতের স্পোর্টস ঘড়িটায় দেখল সকাল ৬টা ২০মিনিট।

রাশান কালচার সেন্টারের মূল প্রবেশ পথের ডান দিক থেকে একটা পরিচিত গাড়ি আসতে দেখে অবাকই হলো সে। গাড়িটা তার সামনে এসে থেমে গেলে সিটি হোমিসাইডের সহকারী ইনভেস্টিগেটর জামান বের হয়ে এল।

বেশি দিন হয়নি ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছে ছেলেটি। খুবই কর্মঠ। এখনও বিয়ে করেনি, ফলে রাতের ডিউটি তার ভাগেই বেশি পড়ে। এটাকে তারা বলে অনলাইন ডিউটি। একটা ফোনের সামনে সারাটা রাত বসে থাকা। খুব কমই ইমার্জেন্সি কল আসে। তারপরেও কাজটার গুরুত্ব অনেক। ছেলেটার রাত জাগার অভ্যাসের কারণে এই ডিউটিতে তাকে রাখা হয়।

জেফরি বেগ বসে থেকেই বলল, “কী ব্যাপার?” তার নিশ্বাস এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

“ধানমণ্ডি থানায় একটা ঘটনা ঘটেছে,” বলল জামান। “হোমিসাইডকে প্রাথমিক তদন্ত করা জন্য বলা হয়েছে, স্যার।”

“ঘটনা কি?”

“লেখক জায়েদ রেহমান মারা গেছেন।”

বিস্মিত হলো বেগ। কেউ মারা গেলে পুলিশের কি? স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে তো পুলিশকে মাথা ঘামাতে হয় না, সে যতো বড় ভিআইপি-ই হোক না কেন। এই ছেলেটা বলছে, লেখক জায়েদ রেহমান মারা গেছেন। খুন হয়েছেন বলছে না কেন? যদি বলতে খুন হয়েছে বেগ মোটেও অবাক হোতো না। হোমিসাইডে ঢোকার পর এ রকম কথা শুনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অবশ্য জামান ভুল করেও খুন না বলে মারা গেছে বলতে পারে।

“কখন?” ছোট্ট করে জানতে চাইল সে।

“মনে হয় বেশিক্ষণ আগে নয়। আমরা কনফার্ম হয়েছি এইমাত্র। এক ঘন্টা আগে,” গাড়িতে উঠতে উঠতে জামান বলল। সে আগে বেগকে ওঠার জন্যে পেছনের সাইড দরজাটা খুলে দিয়ে নিজে বসল ড্রাইভারের পাশে।

“তুমি বলছো মারা গেছে, খুন হননি। তাহলে আমাদের দরকার পড়ল কেন?” বেগ ধীর কণ্ঠে বলল।

“স্যার, আসলে কেউ বুঝতে পারছে না, উনি মারা গেছেন না কি খুন হয়েছে। এজন্যেই হোমিসাইডকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ফারুক স্যার আপনার মোবাইলে কল করে পাননি। আমাকে বললেন আপনাকে বাড়ি থেকে তুলে ক্রাইমসিনে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমি তো জানি আপনি এই সময় এখানে জগিং করেন।”

“আচ্ছা,” বেগ ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামালো না। ঘটনাস্থলে গিয়েই দেখবে কী হয়েছে। আগেভাগে মাথা খাঁটিয়ে লাভ নেই। হত্যার ঘটনা সব সময়ই জটিল।

“ব্যাপারটা কি সবাই জানে?” বেগ জিজ্ঞেস করল।

জামান বুঝতে পারছে সবাই বলতে আসলে মিডিয়ার কথাই বলা হচ্ছে। “না, এখনও জানে না, স্যার।”

“ভালো।” মিডিয়ার ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। সব সময়ই কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তারা। ঝামেলা বাধানো তাদের প্রধান কাজ। তদন্ত করার সময় তাদের প্রচারণা আর রিপোর্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগে না। “আমাদের ইউনিট কি ওখানে পৌঁছে গেছে?”

“হ্যাঁ, বাকিরা অনেক আগেই চলে গেছে।”

“জায়েদ রেহমান তো একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, না?” বেগ বলল।

“হ্যাঁ। আপনি চেনেন না কি?” জামান জানতে চাইল।

“হাঁ, চিনি। একবার একটা কাজে গিয়েছিলাম।” একটু চুপ থেকে আবার বলল, “আগে আমার বাড়িতে চললো। জামা কাপড় পাল্টে নিতে হবে। এই ফাঁকে তুমি ফটোগ্রাফার আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমকে ওখানে পাঠিয়ে দাও। ওদের বলে দাও আমি না আসা পর্যন্ত কেউ যেন কোনো কিছু স্পর্শ না করে। মোবাইল এভিডেন্স টিমকেও রেডি হতে বলে দাও। আর ঐ অ্যাপার্টমেন্টের কেউ যাতে বাইরে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করো। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবো।”

“নাস্তা করবেন না?” জামান জানতে চাইল।

“না। কাজ শেষ করে করবো।” জামানের দিকে তাকিয়ে বেগ বলল, “তুমি নাস্তা করেছো?”

“না, স্যার।”

“তাহলে আমারা দুজনেই একসাথে নাস্তা করছি।”

“এখন করবেন না কি পরে?” জানতে চাইল জামান।

“আমারা একসাথেই নাস্তা করবো।”

“দেরি হয়ে যাবে না?”

“মনে হচ্ছে খুব বেশি সময় লাগবে না,” বেগ হেসে বলল।

কিন্তু তার ধারণাই নেই কতো সময় লাগতে পারে। দিনটা তার জন্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিভিন্ন করণে। দীর্ঘ দিন পর সকালের নাস্তা ছাড়াই একটা দিন পার করতে যাচ্ছে সে। তাদের গাড়িটা ভিটা নুভার সামনে আসতেই বেগ দেখতে পেল গেটের সামনে কোনো জটলা নেই। সব কিছুই স্বাভাবিক। সকাল সাতটা। রাস্তায় অল্প কিছু যানবাহন আর লোকজন রয়েছে। পুরো শহরটা জেগে উঠছে আস্তে আপ্তে। জগাররা জগিং করতে বের হচ্ছে, আর যারা আগেভাগে বের হয়েছিল তারা ফিরতে শুরু করেছে এখন।

ভালো, মনে মনে বলল বেগ।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে জামান পুরো ঘটনাটা যতোদূর সম্ভব বেগকে বলেছে : ইন্সপেক্টর এলাহী মাঝরাতে টহলগাড়িতে করে ঐ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে যাবার সময় এক তরুণকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা থেকে শুরু করে সবই সংক্ষেপে বলে গেল সে।

ছেলেটাকে অবশ্য ধরতে পারেনি ইন্সপেক্টর। পালিয়ে গেছে। থানায় ফিরে এসে এলাহী সাহেবের মনে সন্দেহ হলে একজন সাব ইন্সপেক্টরকে পাঠায় ভিটা নুভায়। কিন্তু এতেও যখন এলাহী সষ্ট হতে পারে না তখন থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভিটা নুভায় যায়। বাইরে থেকে সব কিছু ঠিক থাকলেও ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক নিশ্চিত হবার জন্য পার্কিং এরিয়ার ইন্টারকম থেকে লেখক জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্টে কল করে। রিসিভার তুলে নিয়েছিলেন লেখকের স্ত্রী। তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একটা নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনে ইন্সপেক্টর ছুটে যায় অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর। ওখানে গিয়ে লেখক জায়েদ রেহমানকে নিজের শয্যায় মৃত অবস্থায় পায় সে।

পরে জানতে পারে লেখকের হাউজনার্স ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে লেখকের মলমূত্র পরিস্কার করার জন্য ঘরে ঢুকতেই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেয়ে ভড়কে যায়। পঞ্চাশোর্ধ মহিলা বেশ শক্তসামর্থ্য হলেও নিজের আর্ত চিৎকার থামতে সক্ষম হয়নি। আর সেই চিৎকারই ইন্সপেক্টর এলাহীকে ঘটনাস্থলে টেনে নিয়ে আসে।

লেখকের মুখে একটা বালিশ চাপা দেয়া ছিল। অভিজ্ঞ হাউজনার্স ভড়কে গেলেও সেই বালিশটা সরিয়ে দেখেনি। মহিলা তার দীর্ঘ নার্সিং জীবনে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে অনেকবারই মোকাবেলা করেছে। সে জানে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলে আলামত সংগ্রহের জন্যে লাশের সুরতহাল অবিকৃত রাখতে হয়। অবশ্য লেখকের স্ত্রীকে মহিলা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার আগেই পুলিশ এসে হাজির হয় তাদের অ্যাপার্টমেন্টে।

মহিলা শুধুমাত্র লেখকের নাড়িস্পন্দন পরীক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করেনি। তার অবশ্য এ কাজটা করার কোনো দরকার ছিল না। দীর্ঘ কর্মজীবনে সে অনেক লাশ দেখেছে। লেখকের বরফের মতো ঠাণ্ডা আর ফ্যাকাশে হাতটা ধরতেই মহিলা বুঝতে পেরেছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি মারা গেছেন।

পুরো বাড়িতে লেখক, তার স্ত্রী আর দুই বছরের সন্তান ছাড়াও দু’জন কাজের লোক আর একজন হাউজনার্স থাকে। লেখকের স্ত্রী অন্য একটা ঘরে ঘুমান। বাড়িতে কারো ঢোকা কিংবা বের হবার কথা জানা যায়নি। কেউ বলেওনি।

“অ্যাপার্টমেন্টের অন্য অ্যালোটিরা কি জানে জায়েদ রেহমান মারা গেছেন?” জামানকে জিজ্ঞেস করল বেগ।

গাড়িটা ভিটা নুভায় প্রবেশ করল। ওখানকার দারোয়ান আসলামের জায়গায় এখন গেট নিয়ন্ত্রণ করছে ধানমণ্ডি থানার এক কনস্টেবল। সে-ই গেটটা খুলে তাদের গাড়িটা ঢুকতে দিল। গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে পুলিশের চিনতে অসুবিধা হয়নি, এটা সিটি হোমিসাইডের গাড়ি। জামান নিজেই ডাইভ করছে। গাড়িটা পার্ক করে সে বেগের প্রশ্নের জবাব দিল। “জানে, তবে তাদের সবাইকে আপাতত মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। তাদেরকে জানানো হয়েছে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এটা শুনে ভয়ে চুপ মেরে আছে সবাই।”

“ভালো,” মুচকি হেসে ছোট্ট করে বলল বেগ। মুখ বন্ধ রাখার ভালো ব্যবস্থা এটা।

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে জামান বলল, “খুব বেশি লোক এখানে থাকে, না স্যার।”

বেগ কিছু বলল না। পার্কিং এলাকার দিকে তার চোখ। এলাকাটি বেশ বড়। নিজেই দরজা খুলে বের হয়ে এল সে।

ছয় তলার অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরটার পুরোটাই পাকিংএরিয়া, দারোয়ানদের ছোট ছোট দুটো ঘরও আছে সেখানে।

“স্যার, এই দিকে আসুন,” জামান লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল।

.

অধ্যায় ৬

সারা রাতে এক মিনিটের জন্যেও সি ই এ সিদ্দিকী ঘুমাতে পারেননি।

জরুরি যে ফোনটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সেটা এসেছে অনেক দেরিতে কিন্তু সে কারণে নয়, তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে একমাত্র সন্তান ইরামকে ভোরবেলা থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার ঘটনায়।

পুরো ব্যাপারটায় তিনি বিরক্ত এবং যারপরনাই হতাশ। এই ছেলেকে কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারেন না। আজ দু’বছর ধরে মারাত্মক এক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে ইরাম। সিদ্দিকী সাহেব ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন, মা মরা এই ছেলেটার দেখাশোনা করে সিদ্দিকী সাহেবের এক বিধবা খালাতো বোন। বড়িতে সাত জন কাজের লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে বার বার এই ছেলেটা কিভাবে বাইরে চলে যায় সেটা সিদ্দিকী সাহেবের কাছে একটা রহস্যই বটে। তিন তিনবার তাকে রিহ্যাবে ভর্তি করিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তার স্মার্ট ছেলে তিনবারই কড়া নিরাপত্তার মধ্য থেকে পালিয়েছে।

প্রথমবার যখন পালাল তখন ভাগ্য ভালো ছিল। দুঘণ্টার মধ্যেই তাকে ধরে ফেলা সম্ভব হয়েছিল পুলিশের কল্যাণে। দ্বিতীয়বার তাকে খুঁজে বের করতে আড়াই দিন লেগে যায়। সিদ্দিকী সাহেবের ঘনিষ্ঠ লোক অমূল্য বাবুর কারণে সেবার তাকে ধরা হয় বনানীতে তার মায়ের কবরের সামনে থেকে। কাকতালীয়ভাবে ঐদিনটি ছিল তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।

কিন্তু মাসখানেক আগে যখন পালাল তখন বাপের ঘাম ঝরিয়ে ছেড়েছে। পুরো একটা সপ্তাহ তাকে পাওয়া যায়নি। তৃতীয় দিনের মাথায় পুলিশের কথামতো পত্রিকায় ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিলে কয়েক দিন পর তার সন্ধান পাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য বিজ্ঞাপনে পুরস্কার হিসেবে যে টাকার কথা ছিল সেটা মোটা অঙ্কের ছিল না। সিদ্দিকী সাহেবের জন্য অবশ্য মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না, কিন্তু তিনি ভালো করেই জানেন, এতে করে লোভী আর অপহরণকারীদেরকেই প্রলুব্ধ করা হবে। খুব সতর্কতা অবলম্বন করেই বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং পুরস্কারের টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল :

মানসিক ভারসাম্যহীন এক ছেলে। এতিমখানা থেকে পালিয়েছে।

রাঙামাটি থেকে এক আর্মি অফিসার তাকে পাকড়াও করে বিজ্ঞাপনে দেয়া এতিমখানার নাম্বারে ফোন করলে ফোনটা আসলে ধরেছিল অমূল্য বাবু।

সিদ্দিীকি সাহেবের স্মার্ট ছেলে রাঙামাটিতে এক শিব মন্দির খুঁজতে বেরিয়েছিল। একটা বইতে এ সম্পর্কে আজগুবি কিছু কাহিনী পড়ে তার ভেতর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা চাপে।

বই, মনে মনে বললেন সি ই এ সিদ্দিকী। তার আরেকটা নেশা। অমূল্য বাবু ঘরে ঢুকতেই তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।

তার সব কর্মচারীর মতো অমূল্য বাবু কখনই তাকে সালাম কিংবা নমস্কার দেয় না। মৃদুভাষী এই লোক প্রতিদিন সকালে মৌব্রত পালন করে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেও সকাল দশটার আগে কোনো রকম কথাবার্তা বলে না। তবে আজ সেই ব্রত বজায় রাখা সম্ভব হবে না।

তাকে দেখে সিদ্দিকী সাহেব অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। এই লোক হচ্ছে তার সমস্ত মুশকিল আসান। মাঝে মাঝে তার মনে হয় অমূল্য বাবুর মধ্যে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা আছে বুঝি। এখন পর্যন্ত কোনো কাজে ব্যর্থ হয়নি এই লোক। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে আছে সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। এটা বন্ধুত্ব কিংবা মালিক-কর্মচারী সম্পর্কের অনেক উর্ধ্বে।

অমূল্য বাবু কোনো কথা না বলে সিদ্দিকী সাহেবের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।

তারা বসে আছে সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ির স্টাডিরুমে। এটা এক রকমের অফিসঘরই। এখান থেকে তিনি তার ব্যবসায়ি সাম্রাজ্য পরিচালনা করে থাকেন। দিন এবং রাতের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটিয়ে দেন তিনি। গতকাল রাত বারোটার পর ঢাকা ক্লাব থেকে ফিরে এসে এ ঘরেই আছেন। মাঝে ভোরবেলায় অল্প সময়ের জন্য একটু বাইরে যেতে হয়েছিল-ধানমণ্ডি থানায়।

সিদ্দিকী সাহেব বুঝতে পারছেন না অমূল্য বাবুর মৌনতা তিনি নিজে ভাঙবে কি না। একটু সময় চুপ করে থাকলেন এই আশায়, বাবু হয়তো নিজেই নিজের ব্রত ভাঙবে।

তাই হলো। “থানায় কি রেকর্ড আছে?” নম্রকণ্ঠে জানতে চাইল অমূল্য বাবু।

ইরামের গ্রেফতার হওয়া এবং থানা থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনার সব ঘটনাই অমূল্য বাবু জানে। তার উকিল রফিকউল্লাহ থানা থেকে অমূল্য বাবুর বাড়ি গিয়ে সব বলে এসেছে। অমূল্য বাবু তখনও নিজের মৌনতা ভঙ্গ করেনি। কেবল চুপচাপ শুনে গেছে। আর একতরফাভাবে পুরো ঘটনা বলতে গিয়ে রফিকউল্লাহর মনে হয়েছিল এরচেয়ে বিরক্তিকর কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। যেন মরা কোনো লাশের কানে কানে ঘটনাটা বলে যাচ্ছে সে।

এ কেমন লোক! কোনো রকম কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নও করল না! অমূল্য বাবুর বাড়ি থেকে বের হবার সময় রফিকউল্লাহ ভেবেছিল।

“না। খান নিজে ফোন করে ব্যাপারটা মিটমাট করেছে,” সিদ্দিকী সাহেব বললেন। এই খান হলো বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফরহাদ খান।

বাবু কিছু বলল না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে বলল, “এখন কি করতে চাচ্ছেন?”

“দেশের বাইরে পাঠাতে চাইছি,” কথাটা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন তিনি।

“কোথায়?”

“কোথায় পাঠাবো সেটা বড় কথা নয়, কতো দ্রুত পাঠানো যাবে সেটাই হলো সমস্যা।”

অমূল্য বাবু একটু ভাবলো। “কবে পাঠাতে চাচ্ছেন?”

“আজই। পারলে এক্ষুণি।”

গাড়িতে করে আসার সময়ই বাবু ভেবে রেখেছিল সম্ভাব্য কি করা যেতে পারে। “ঠিক আছে।” অমূল্য বাবু কথাটা এমনভাবে বলল যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

সিদ্দিকী সাহেব এই ছোট্ট কথাটা শুনে যে স্বস্তি পেলেন সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যেন তিনি নিজেও জানেন অমূল্য বাবু সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। অনেকটা নির্ভার হয়ে বললেন, “তাহলে এখন কি করতে হবে?”

“আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি একদম স্বাভাবিক থাকুন। আমি দেখছি।”

সিদ্দিকী সাহেব এমনভাবে তাকালেন যেন আরো কিছু জানতে চাইছেন তিনি।

“ইরামকে বিদেশের কোনো রিহ্যাবে অ্যাডমিট করিয়ে দেবো। ইউরোপ-আমেরিকায় এখন পাঠানো যাবে না। সময় লাগবে। বোম্বেতে একটা ভালো রিহ্যাব আছে। প্রেয়ারহল। ওখানে ভর্তি করানো যাবে। আমি ব্যবস্থা করছি।”

“বোম্বে? ওকে, ফাইন। আজ কখন ফ্লাইট ধরতে পারবো?” সিদ্দিকী সাহেব জানতে চাইলেন।

একটু চুপ করে রইল অমূল্য বাবু। যেন মনে মনে হিসেব করে নিচ্ছে। “…দেখি কতো তাড়াতাড়ি করা যায়। আশা করছি বিকেলের মধ্যেই সম্ভব হবে।”

সিদ্দিকী সাহ্বে এতোটা আশা করেননি। অতীতের অজস্রবারের মতোই আরেকবার অমূল্য বাবুর কাছ থেকে ম্যাজিকের মতো সমাধান পাচ্ছেন তিনি। “ওকে, দ্যাটস গুড। অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি আপনার যা যা লাগবে তা যেন দিয়ে দেয়।”

উঠে দাঁড়াল অমূল্য বাবু। দরজার কাছে থেমে ফিরে তাকাল সে। “ইরাম এখন কোথায়?”

সিদ্দিকী সাহেব ছাদের দিকে চোখ তুললেন। স্বল্পভাষী লোকের সংস্পর্শে এসে তিনিও প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন।

বিকেলের আগপর্যন্ত সামলে রাখুন।”

কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে কাচুমাচ বোধ করলেন সিদ্দিকী সাহেব। যেন তার গাফলতির জন্য মৃদু ভত্সনা করা হয়েছে।

অমূল্য বাবু নিজের মৌনতা ভাঙার জন্য একটুও অনুতপ্ত হলো না, কারণ দিনটা আর সব দিনের মতো স্বাভাবিক নয়। আজ তাকে অনেক ফোন করতে হবে। অনেক কাজ করতে হবে।

.

অধ্যায়

ভিটা নুভা অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলার দুটো ইউনিট নিয়ে থাকেন লেখক জায়েদ রেহমান। দুটো ইউনিটকে এক করে চমৎকার একটা ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ভেতরের ডেকোরেশন করেছে দেশের সবচাইতে নামী এক স্থপতি। পাঁচ বছর আগে জায়গাটা কিনে নেন, পরে ডেভেলপারকে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়েছেন তিনি। নিজের জন্য একটা রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন।

ভিটা নুভা-অ্যাপার্টমেন্টের এই নামটি লেখক নিজে দিয়েছেন। হেনরি ওয়ার্ডসওর্থ লংফেলোর কাব্যগ্রন্থ ভিটা নুভা’র নামানুসারে এ নাম রেখেছেন তিনি, যার মানে নতুন জীবন। আক্ষরিক অর্থে এখানে চলে আসাটা তার জন্যে তা-ই ছিল।

চার বছর আগে লেখক তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়ে এখানে ওঠেন। দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করার আগে একবছর লিভ টুগেদার করেছেন এই ফ্ল্যাটেই।

দুবছর বয়সি এক ছেলে আর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে এখানে তিনি বসবাস করে আসছেন আজ চার বছর ধরে। সারা জীবন রহস্য করে যাওয়া লোকটি আজ হঠাৎ করে মারা গেলে আরো বড় একটি রহস্য তৈরি হয়েছে তার মৃত্যুকে ঘিরে। পুলিশকে এখন খুঁজে বের করতে হবে এটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু না কি হত্যাকাণ্ড।

একজন সেলিবৃটি হওয়ায় সিটি হোমিসাইডকে প্রাথমিক তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদেরকে আগে বের করতে হবে এটা হত্যা না কি স্বাভাবিক মৃত্যু। যদি হত্যা হয়ে থাকে তবে নিশ্চিতভাবে তাদের উপরেই এই হত্যার তদন্ত কাজটি দেয়া হবে।

সিটি হোমিসাইডের উদীয়মান ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ বিশেষ বিশেষ হোমিসাইড কেসগুলো দেখাশোনা করে। আমেরকিার এফবিআই যে প্রশিক্ষণ নেয়, জেফরিরও রয়েছে ঠিক সেই প্রশিক্ষণ। এজন্যে তাকে ডিপার্টমেন্টে একটু ঈর্ষার চোখে দেখা হয়। তবে এই সুযোগটি সে পেয়েছে নিজ যোগ্যতার বলেই। রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে তাকে অর্জন করতে হয়েছিল ভার্জিনিয়ার টিকেট। এক বছরের প্রশিক্ষণে জেফরি বেশ ভালো করেছে। এটা তার ইন্ট্রাক্টরের দেয়া মূল্যায়ন রিপোর্টে উল্লেখ আছে। এফবিআই’র সাথে যোগাযোগ থাকায় দুয়েকটি আন্তর্জাতিক কেসও সে বেশ সফলতার সাথে সমাধা করেছে।

গত বছরের একটি বহুল আলোচিত ঘটনা তাকে একজন গোয়েন্দা হিসেবে দেশে ছোটখাট পরিচিতি এনে দিয়েছে। পত্রিকাগুলো তার ডাক নাম দিয়েছে জেফরি হোমস বলে। এটা জেফরির একদম অপছন্দ। শব্দটা ডিটেক্টিভদের জন্য ক্লিশে পরিণত হয়েছে।

অবশ্য তার নিজের ডিপার্টমেন্টে তাকে অনেকেই জেফবিআই বলে ডাকে জেফরি বেগ দ্য ইনভেস্টিগেটরের সংক্ষিপ্ত রূপ।

অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরটা বহুমূল্যবান আসবাব দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটা লেখকের দ্বিতীয় স্ত্রী বর্ষার রুচির বহিপ্রকাশ। বিদেশি জিনিসের প্রতি যার রয়েছে দূর্বার আকর্ষণ।

বেগ সরাসরি ক্রাইম সিনে চলে এল।

বিশাল ঘরটা দেখে হল রুম বলেই মনে হচ্ছে। এই ঘরটা বিশেষভাবে বানানো হয়েছে লেখকের ফরমায়েশে।

ঘরে ঢুকেই জেফরি বেগ দেখতে পেল একটা মেডিকেল বেডের চারপাশে তিন চারজন পুলিশ ঘিরে রয়েছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাকে ঢুকতে দেখে পুলিশের দলটি নিজেদের মধ্যে কথা বলা থামিয়ে বিছানার কাছ থেকে সরে যেতেই লেখকের নিথর-নিষ্প্রাণ দেহটি জেফরির গোচরে এল। মুখে এখনও বালিশটা অবিকৃত অবস্থায়ই আছে।

একজন পুলিশ বেশ আগ্রহভরে তার দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল। “স্যার, আমি ধানমণ্ডি থানার ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ।”

এখানে আসার পথেই জামানের কাছ থেকে বেগ জানতে পেরেছে ধানমণ্ডি থানার ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজের কল্যাণে এই ঘটনাটি উদঘাটিত হয়েছে। বেগ প্রশংসার সুরে বলল, “ও, আপনিই তাহলে এলাহী নেওয়াজ! ওয়েল ডান,” বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল ইন্সপেক্টরের দিকে।

এলাহী বেশ গর্বিতভাবে হাত মেলাল জেফরি বেগের সাথে।

“জেফরি বেগ,” নিজের পরিচয় দিয়ে বলল সে।

“জানি, স্যার, আপনাকে আমি চিনি।”

“আচ্ছা,” বলেই আনমনা হয়ে গেল সে। তার নজর এখন মেডিকেল বেড়ে পড়ে থাকা মৃতদেহের দিকে। ইন্সপেক্টর এলাহী মৃতের মুখ থেকে বালিশটা সরিয়ে দিল।

চোখ দুটো এখনও খোলা অবস্থায় আছে। বলা ভালো কোটর থেকে দুটো যেন ঠিকরে বের হবার চেষ্টা করছে।

মুখটা একটু খোলা। লেখকরে আধ বোজা দৃষ্টি তার বাম দিকে ফেরানো। মাথাটা সেদিকেই কাত হয়ে আছে। ডান হাতটা বুকের বাম পাশে রাখা। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়তো বুকটা চেপে ধরেছিলেন।

দুয়েকটা মাছি লেখকের মুখের চারপাশে ভন ভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যটা বীভৎস্য। যতো সময় গড়াতে থাকে ততোই ভয়ংকর হতে শুরু করে লাশ। এমন কি মৃতের নিকটজনেরাও তখন ভয় পেতে শুরু করে। তাদের কাছে আর মনে হয় না এটা তাদেরই ঘনিষ্ঠজনের মৃতদেহ।

একটা কটু গন্ধ নাকে এল বেগের। লাশ পচতে শুরু করেছে। এই গন্ধটি বাড়তে থাকবে। এক সময় অসহ্য ঠেকবে। বোঝাই যাচ্ছে মধ্যরাতে মারা গেছেন। অথবা খুন!

গল্পটা বলার জন্যে অনেকটা মুখিয়ে ছিল এলাহী নেওয়াজ তবে বেগের মধ্যে সে রকম কোনো আগ্রহ দেখতে না পেয়ে হতাশই হলো সে। চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে বেগ। তার কাছ থেকে গল্প শোনার ব্যাপারে যে তার মনোযোগ নেই সেটা বুঝতে পেরে চুপসে গেল এলাহী।

“গ্লাভস নিয়ে আসো,” বেগ জামানকে বললে সে পাশের ঘরে চলে গেল। ঐ ঘরে ফাইন্ডার ইউনিটের লোকজন এসে নিজেদের সরঞ্জাম গোছগাছ করছে।

“আপনি খুব ভালো কাজ করেছেন। পরে আপনার সাথে কথা বলবো,” এলাহীকে বলল বেগ।

“স্লামালেকুম, স্যার।” এলাহী ঘর থেকে বের হয়ে আসার সময় মনে মনে ভাবলো জেফরি বেগের ধর্মটা কি? এর আগে এই প্রশ্নটি তার মনে উদয় হয়নি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই কথাটা মনে পড়ল।

বেগের পূর্ণ মনোযোগ এবার নিথর দেহটার দিকে। হাতে গ্লাভস পরে নিলো এই ঘরে যাতে কোনো লোকের আঙুলের ছাপ পড়ে। ঘর থেকে সবাইকে বের হয়ে যেতে বলে দিলে জামান সবাইকে চলে যেতে বলল, রয়ে গেল কেবল সে নিজে।

লাশের শরীরে এমন কোনো চিহ্ন নেই যে এটাকে হত্যাকাণ্ড বলে মনে করা যাবে। নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে আছে-আট মাস ধরেই এভাবে পড়ে আছে মি. রেহমান। মুখটা হা করা। চোখ দুটো আধ বোজা। এটা কোনো অদ্ভুত ব্যাপার নয়। যদিও দেখতে খুব ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।

জায়েদ রেহমানের পরনে আছে একটা ফতুয়া জাতীয় নাইটড্রেস আর পাজামা। শীতকাল বলে মোটা একটা কম্বলও রয়েছে গায়ে। সেটা বুকের নিচে নামানো।

“স্যার, উনার ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছিল এক বছর আগে,” পাশ থেকে জামান আস্তে করে বলল। আরেকটু উৎসাহী হয়ে উঠল সে, “সার্জারির পর হার্ট অ্যাটাক হয়। শরীরের অবস্থা এমনিতেও খুব একটা ভালো ছিল না।”

“তোমার ধারণা এটা নেচারাল ডেথ?” বেগ লাশের দিকে তাকিয়েই বলল।

“সেটা কি করে বলি? লাশের মুখের উপর বালিশ চাপা দেয়া ছিল।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জেফরি বেগ লাশের একেবারে সামনে চলে গেল। ফতুয়ার বুকের দিকটা একটু ফাঁক করে ওপেন হার্ট সার্জারি করার জায়গাটা দেখল। কমপক্ষে চৌদ্দ ইঞ্চির মতো দীর্ঘ একটা কাটা দাগ। বেশ স্পষ্ট। বুকের ঠিক মাঝখানে। নাভির দু’ইঞ্চি উপরে থেমে গেছে, আর শুরু হয়েছে গলার দু’ইঞ্চি নিচ থেকে।

বুকের বাম দিকে, যেখানে হৃদপিণ্ডটা থাকে, ঠিক সেখানে দুই ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চির মতো ছোট্ট একটা বৃত্ত। চামড়ার উপর আবছা নীলচে একটা ছোপ। লেখক বেশ ফর্সা বলে এটা বোঝা যচ্ছে। তার গায়ের রঙ কালো কিংবা শ্যাম বর্ণের হলে হয়তো এটা খালি চোখে ধরা পড়তো না।

ময়নাতদন্ত করবে যে তাকে বলে দেবে এটা খতিয়ে দেখতে।

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে লাশের সেই জায়গাটার এবং ঘরের ভেতরর কয়েকটা ছবি তুলে নিলো জেফরি। কাজটা জামানকে দিয়েও করানো যেতো, কিন্তু বেগ এই কাজটা নিজেই করতে চায়। জামান ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। এ রকম দৃশ্যের সাথে সে বেশ পরিচিত।

ছবি তোলা শেষ করে জামানের দিকে তাকাল সে। “অন্য ঘরগুলোর কি অবস্থা?”

“আনটাচ আছে,” জবাব দিল জামান। একটু ভেবে বেগ আবার বলল, “ভদ্রমহিলা কোন্ ঘরে থাকেন?”

“ভেতরের ঘরে।”

“উনি কোথায়?”

“লিভিংরুমে। এই অ্যাপার্টমেন্টের সবাইকে ওখানে জড়ো করে রাখা হয়েছে,” জামান বলল। সে জানে কথাটা শুনে বেগ খুশি হবে।

“গুড।” কথাটা বলেই ঘরের চারপাশে আরেকবার তাকাল। নিজের মোবাইলটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

জামান জানে এখন সে কি করবে। ক্রাইমসিনের অবিকৃত অবস্থা তদন্তের জন্য খুবই জরুরি। কারণ এই অবস্থা খুব বেশিক্ষণ অবিকৃত থাকে na।

মোবাইলটা মুখের কাছে ধরল। “লাশের বাম বুকে একটা লালচে ছোপ আছে…পোস্টমর্টেমে এটা দেখতে হবে…আর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই…ঘরটা বিশ বাই পঁচিশ…আনুমাণিক…একটা দরজা…পূর্ব দিকে…জানালা চারটা…দক্ষিণ দিকে একটা বেলকনি…স্লাইড ডোর…ভিকটিমের অবস্থান উত্তর-পূর্ব দিকে…মেডিকেল বেডে…” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল সে। “বেলকনির কাঁচের স্লাইড ডোর আর জানালাগুলো বন্ধ…ঘরে এসি আছে…”

ঘরের এক কোণে একটা কফি টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় একটি ল্যাপটপ দেখেতে পেল, ল্যাপটপটাতে এখনও কানেকশান দেয়া আছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল সেটা চালু অবস্থায়ই রয়েছে। “একটা ল্যাপট আছে…এখনও সেটা চালু রয়েছে।”

বেলকনির স্লাইড ডোরের কাছে গিয়ে থেমে গেল বেগ। স্লাইড ডোরটা খোলার প্রয়োজন নেই। কাঁচের মধ্য দিয়েই দেখতে পাচ্ছে নিচের মেইন রোডটা। “…ঘরে আর কিছু নেই-” কথাটা বলেই থেমে গেল। তার চোখ গেল ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা বাক্স আকৃতির জিনিসের দিকে। একটু কাছে এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারল সেটা কি।

“…ঘরে একটা আইপিএস আছে।” রেকর্ডিং করা থামিয়ে দিয়ে বেগ ভাবলো এই তথ্যটা হয়তো কোনো কাজেই লাগবে না। তারপরও অভ্যাশবশত তথ্যটা নিতে ভুল করল না সে। খুঁটিনাটি সব তথ্য নেয়াই ভালো। তবে একটা খুনের সাথে আইপিএস’র সম্পর্ক থাকবে কিভাবে সেটা বেগ নিজেও ভেবে পেল না। তবে পরে যখন সব জানতে পারবে তখন এ কথাটা ভেবে খুবই বিস্মিত হবে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ।

মোবাইলটা বন্ধ করে জামানের দিকে ফিরল এবার। “মিসেস রেহমানের ঘরটা কোথায়?”

“এখনই যাবেন?”

“হ্যাঁ।আর এই ঘরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমকে কাজ করতে শুরু করে দিতো বলো। বেলকনির স্লাইড ডোরটা ভালো করে যেন চেক করে দেখে।” মিসেস রেহমানের ঘরের দিকে যেতে যেতে বেগ আরো বলল, “প্রসিডিংগুলো কি করেছো?”

“জি, স্যার। এই ভবনের সব লোককে বলে দিয়েছি বাইরে যেন না বের হয়। এই ঘরে যারা কাল রাতে ছিল তাদের সবাইকে লিভিংরুমে রেখে দিয়েছি। পুরো এলাকা সিল করা আছে। নাইটগার্ডদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।”

লিভিংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় বেগ লক্ষ্য করল এক যুবতী মেয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে সোফায় বসে আছে। লেখকের তরুণী স্ত্রী, বুঝতে পারল সে। আরো কয়েকজন আশেপাশে আছে। আর আছে পুলিশের লোক। তারা সবাই সম্ভ্রমের সাথে বেগ আর জামানকে পথ করে দিল।

মিসেস রেহমানের শোবার ঘরটা বেশ বড়। প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো বেগ। বিছানা ছাড়া ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিল আর টিভি আছে। আর কিছু নেই। আশ্চর্য!

এই বাড়ির জৌলুশের তুলনায় এটা একেবারেই বেমানান।

“এটাই কি ভদ্রমহিলার শোবারঘর?” জামানকে জিজ্ঞেস করল।

“জি স্যার।”

“কিন্তু ঘরটা খুব বেশি ফাঁকা, আসবাব তেমন নেই।” অনেকটা আপন মনে বিড়বিড় করে বলল সে। “আচ্ছা, জায়েদ সাহেব প্যারালাইজড হবার আগে কি এই ঘরে ঘুমাতেন?”

জামানের এটা জানা নেই। সে মাথা নেড়ে জবাব দিল।

“বাড়ির কাজের লোকদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।”

“এক্ষুণি?”

“হ্যাঁ।”

ঘরে একটাই দরজা। দক্ষিণে একটা জানালা আর বেলকনি। একটা কটু গন্ধ আছে ঘরে। গন্ধটা কিসের বেগ খুব সহজেই বুঝতে পারল।

“স্যার।”

বেগ পেছনে ফিরে দেখল জামান ফিরে এসেছে।

“আরেকটা বেডরুম আছে, কিন্তু ভদ্রমহিলা ওটা আর এখন ব্যবহার করেন না। এটাই উনি ব্যবহার করেন।”

“আচ্ছা।” বেগ অ্যাটাচ বাথরুমের ভেতর ঢুকলো।

বাথরুমটা খুবই পরিস্কার আর স্বাস্থ্যকর। একেবারে আধুনিক একটি টয়লেট। চমৎকার বেসিন আর কমোডের পাশাপাশি একটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা আছে মাঝারি আকারের বাথটাব। বাথরুমে ঢুকে পড়লে জামান বুঝতে পারল না সেও ভেতরে ঢুকবে কি না। বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল সে। এক মিনিট পরেই বেগ বের হয়ে এল। তার মুখে কোনো কথা নেই। ভাবছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যেন।

বেগের ভাবসাব দেখে জামানের কাছে মনে হচ্ছে ইন্সপেক্টর এলাহী কাকতালীয়ভাবে একটা স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় ঢুকে পড়ে পুরো পরিস্থিতিটাকে জটিল করে তুলেছে। লেখক জায়েদ রেহমান খুন হননি। একটাই খটকা : মৃত লেখকের মুখের উপর বালিশ দেয়া ছিল।

জেফরি বেগ আয়নায় নিজের চল ঠিক করে বেডের চারপাশটা ভালো করে দেখতে লাগল। এই ঘরের গন্ধটার উৎস খুঁজছে। কোথাও নেই। বিছানার পাশে যে জানালাটা আছে সেটার স্লাইড-ডোর খুলে নিচের মেইন রোডের দিকে তাকাল। এই ঘরের একটা বেলকনি আছে, বিশাল স্লাইড ডোরটা একপাশে টেনে দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল সে।

যা ভেবেছিল তাই। এখানে পাওয়া গেল গন্ধের উসটা। হাঁটু ভেঙে বসে বেলকনির মেঝেতে পড়ে থাকা সেই ছোট্ট বস্তুটা ভালো করে দেখে পেছনে ফিরে জামানের উদ্দেশ্যে বলল, “এভিডেন্স ব্যাগ নিয়ে আসো।”

স্বচ্ছ পাস্টিকের ছোট ছোট চারকোণা ব্যাগগুলো এভিডেন্স সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মুখ ক্লিপের মতো আর্টকে রাখা যায় খুব সহজে। এদেশের অনেক পণ্যে এই সব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। জামান যে ব্যাগগুলো নিয়ে এল সেটা দেখে কান পরিস্কার করা কটন-স্টিকের ব্যাগ বলেই মনে হবে।

গ্লাভ পরা হাত দিয়ে ছোট্ট জিনিসটা ব্যাগে ভরে জামানের হাতে দিয়ে দিল বেগ। কোনো কথা না বলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল জামান।

উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল বেগ। ডান দিকে লেখক জায়েদ রেহমানের ঘরের যে বেলকনিটা আছে সেটা দেখতে পেল। পাশাপাশি দুটো ঘর; পাশাপাশি দুটো বেলকনি। স্থপতিরা যাকে বলে হ্যান্ডশেক বেলকনি। জেফরি অবশ্য নিশ্চিত নয় দু’জন মানুষ এখান থেকে হাত মেলাতে পারবে কি না।

আবারও ঘরের ভেতর বিছানার কাছে ফিরে এল সে, তার সাথে সাথে জামানও। জেফরি বেগের মনোযোগ ব্যাঘাত হবে এই ভয়ে জামান কিছুই বলছে না। বিছানার ডান পাশে উপুড় হয়ে কী যেন খুঁজতে শুরু করল বেগ। জামান অবশ্য ভেবে পাচ্ছে না সেটা কি। দেয়াল থেকে খাটের এই অংশটার দূরত্ব দুই ফুটের মতো হবে।

সিলভার রঙের ছোট্ট দুটো কাগজের টুকরোর মতো জিনিস পড়ে আছে। খাটের এখানটায়। অবিবাহিত হলেও এই জিনিসটা বেশ ভালো করেই চেনে জেফরি বেগ। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ছোট্ট এই জিনিসটা তাকে পুরো ঘটনাকে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিচ্ছে এখন। কিছুক্ষণ আগেও নাস্তা করেনি বলে যে ক্ষিদের ভাবটা ছিল সেটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। জেফরি বেগ এই তদন্তে পুরোপুরি ঢুকে পড়েছে। এ রকম একটা ক্ল আর এভিডেন্স থাকলে ম্যাজিকের মতোই সে রহস্য উদঘাটন করতে পারবে সে বিশ্বাস তার রয়েছে। জামানের কাছ থেকে আরেকটা এভিডেন্স ব্যাগ হাতে নিয়ে খুব সাবধানে সিলভার রঙের ছোট্ট জিনিস দুটো ব্যাগের ভেতর ভরার সময় জামানও সেটা দেখতে পেল। জেফরির মতো সেও চিনতে পারল সেটা। একটু লজ্জা বোধ করল সে। কারণ সেও অবিবাহিত।

“মিসেস রেহমানের সাথে কথা বলতে হবে,” জামানকে বলল সে।

*

সদ্য স্বামী হারানো মহিলাদের মতো লাগছে না মিসেস রেহমানকে। একটু বিপর্যস্ত কিন্তু যতোটা হলে মৃতের বাড়ির আত্মীয়স্বজন আড়ালে-আবডালে এ কথা বলবে না যে, মহিলার হৃদয় পাষাণ, স্বামীর প্রতি যথেষ্ট টান নেই, ততোটা ভেঙে পড়েননি। দূরের আত্মীয় মারা গেলে যতোটুকু শোক শোক ভাব না করলেই চলে না মহিলার মধ্যে সেরকম পরিমিত শোক দৃশ্যমান। বেগের কাছে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা স্বামী হারানোর চেয়ে অজ্ঞাত এক আশঙ্কায়ই যেন বেশি ঘাবড়ে আছেন। তবে সে এও জানে, তার ধারণা ভুল হতে পারে। আবেগ প্রকাশের বেলায় সবাই এক রকম হয় না। লিভিংরুমের সোফায় মিসেস রেহমানের সাথে কথাবার্তা বলতে শুরু করল সে।

“আপনি তাহলে নিজের ঘরেই ছিলেন?” বেগ জানতে চাইল মিসেস রেহমানের কাছে।

মহিলা মাথা নিচু করে রেখেছে। সে অবস্থায়ই মাথা নেড়ে সায় দিল।

“ঘুমাচ্ছিলেন?” আবারো একইভাবে মাথা নেড়ে জবাব দিল ।

একটু সময় নিয়ে আচমকা বেগ বলল, “স্মোক করেন?”

চমকে উঠে মহিলা মুখ তুলে তাকাল। যেন সদ্য বিধবার সাথে নির্মম রসিকতা করেছে সে। “আমাকে বলছেন?”

“জি,” বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলল সে।

মহিলা অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “না। আমার ওসব বদ অভ্যাস নেই।”

“ভালো। আমারও নেই।” আরো স্বাভাবিকভাবে বলল বেগ। মহিলার বিরক্তিটাকে আমলেই নিলো না।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামান জম্পেশ একটা জিজ্ঞাসাবাদের আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে জেফরি বেগ সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। “ঠিক আছে, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আসলে এ রকম মুহূর্তে আপনাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছিলাম না, নিতান্তই অফিসিয়াল কারণে দুয়েকটা তথ্য জেনে নিলাম। আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। আপনার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই।”

মহিলা এমনভাবে বেগের দিকে তাকালেন যেন বুঝতে পারছেন না এটা নতুন কোনো ঠাট্টা কি না। পুলিশ সম্পর্কে আগের যেসব ধারণা তার ছিল তার সাথে এটা একেবারেই যাচ্ছে না। যেখানে তাকে সন্দেহ করে আক্রমণাত্মকভাবে জেরা করা হবে বলে আশঙ্কা করেছিল সেখানে কি না এই ইনভেস্টিগেটর ভদ্রভাবে শোক প্রকাশ করছে!

মহিলাকে বিস্ময়ের মধ্যে রেখেই জেফরি বেগ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জামান এতোটাই হতভম্ব যে নড়তে পারল না। কয়েক সেকেন্ড পর ধাতস্থ হতেই তাড়াহুড়া করে বেগের পেছন পেছন দৌড়ে গেল সে।

লেখকের ঘরে ঢুকলো বেগ, তার পেছন পেছন অনেকটা দৌড়ে চলে এল জামান। “স্যার, মহিলাকে আর কিছু-”

বেগ তার কথার মাঝখানে বাধা দিল হাত তুলে। থেমে ঘুরে তাকাল সে। “মোবাইল এভিডেন্স ভ্যান এসেছে?”

থতমত খেয়ে জামান বলল, “ফোন করে দেখছি।”

কিন্তু তাকে আর ফোন করতে হলো না। লেখকের ঘরে হলুদ রঙের ওভারঅল পরা এক লোককে ঢুকতে দেখেই বুঝে গেল মোবাইল এভিডেন্স ভ্যান এরইমধ্যে এসে পড়েছে।

“স্যার,” লোকটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল জামান।

“ঠিক আছে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি এখানকার সবার আঙুলের ছাপ নিয়ে রাখবে। আর ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমকে খুঁজে দেখতে বলবে কিছু পাওয়া যায় কি না। বিশেষ করে জায়েদ রেহমান এবং মিসেস রেহমানের ঘরে একটু বেশি চেক করতে বলবে। তুমি নিজে থেকে কাজটা তদারকি কোরো।”

“এখানে আপনার কাজ শেষ?”

“আপাতত।” কথাটা বলেই জেফরি বেগ ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। ক্ষিদেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। খুব দ্রুত কাজ সেরে নাস্তা করে নিতে হবে। তার হাতে যে আলামতগুলো আছে তাতে করে কাজটা খুব দ্রুত করতে পারবে বলে মনে করছে সে। তার পকেটে থাকা ছোট্ট দুটো আলামত এই হত্যারহস্য উন্মোচন করে দেবে। একেবারে ম্যাজিকের মতো, মনে মনে বলল জেফরি বেগ।

.

অধ্যায়

মোবাইল এভিডেন্স ভ্যান আদতে একটি বড়সড় মাইক্রোবাস। অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত এই গাড়িটি ঢাকা সিটি হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ। প্রায় তিন কোটি টাকা দামের এই গাড়িতে রয়েছে একটি মিনি ফরেনসিক ল্যাব। তাৎক্ষণিকভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে শুরু করে ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত করা যায় এই ভ্রাম্যমান ল্যাবে। মাত্র তিন মাস আগে এটি কেনা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এটির সর্বোত্তম ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি। জেফরি বেগ এই ভ্যান কেনার ব্যাপারে বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছিল। ফলে ডিপার্টমেন্টের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা তার ঈর্ষাকাতর শত্রুরা ইদানিং আড়ালে আবডালে বলে বেড়াচ্ছে খামোখাই এতগুলো টাকা গচ্চা দেয়া হয়েছে। কথাটা জেফরি বেগের কানেও গেছে। সে পাত্তা দেয়নি। অপেক্ষা করেছে এটির সর্বোত্তম ব্যবহারের দিনটির জন্য। লিফটে করে নিচের পার্কিংলটে যাবার সময় তার মনে ক্ষীণ আশা উঁকি দিল, হয়তো আজকের দিনটাই হতে পারে সেই দিন।

সাদা রঙের অ্যাম্বুলেন্সসদৃশ্য গাড়িটা অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ডফ্লোরের পার্কিংলটে লিফটের পাশেই পার্ক করা আছে। এর পেছনের ডাবলডোরের একটা পাল্লা খোলা। ভেতরে ফরেনসিক টিমের প্রধান সাবের কামাল এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট-অ্যানালিসিস টিমের এডলিন ডি কস্তা বসে আছে। টিমের বাকি সদস্যরা আগেই এখানে এসে গেছে। তারা এখন জায়েদ রেহমানের ঘরের বিভিন্ন স্থানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ডিএনএ থাকতে পারে এ রকম বস্তু সংগ্রহ করে যাচ্ছে।

জেফরি বেগকে দেখে সাবের কামাল হাত তুলে হ্যালো জানালেও এডলিন ডি কস্তা কম্পিউটার মনিটর থেকে একটুও চোখ তুলল না। এই মেয়েটি জেফরির উপস্থিতিতে আড়ষ্ট হয়ে যায়। কারণটা আন্দাজ করতে পারে বেগ, কিন্তু সেও ব্যাপারটা না বোঝার ভান করে। টিনএজারদের মতো আচরণ করছো মেয়ে, মনে মনে বলল জেফরি।

“কিছু পেলেন?” গাড়ি থেকে নেমে সাবের জানতে চাইল।

পকেট থেকে দুটো এভিডেন্স ব্যাগ বের করে তুলে ধরল বেগ। “এই হলো তোমার চাবি। এখন এটা দিয়ে কি ভোলা যাবে সেটা বের করার দায়িত্ব তোমাদের।”

ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে ভালো করে দেখল সাবের কামাল। সিলভার রঙের কাগজের টুকরো দুটো দেখে আস্তে করে শিষ বাজিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল বেগের দিকে।

“এটাই আসল চাবি। এটাতে খুব সম্ভবত আঙুলের ছাপ আছে।”

“অবশ্যই আছে,” বেশ জোর দিয়ে বলল সাবের। “এই জিনিস কেউ পা দিয়ে খোলে না। আমি নিশ্চিত, দু’হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর স্পষ্ট ছাপ থাকবে।”

“আমার একটা হলেই চলবে,” কথাটা বলে বেগ আড়চোখে এডলিনের দিকে তাকালে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। যেন কিছুই হয়নি এ রকম একটা ভান করে আবারও কম্পিউটার মনিটরে নজর দিল মেয়েটি।

সাবের প্লাস্টিকের ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। সিলভার রঙের কাগজের টুকরোর ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে নিলো বেগ। “এটা তোমার জন্য নয়।”

“তা ঠিক। আমি তো এসব ব্যবহার করি না। আমার বউ পিল খায়।” অশ্লীল কথা বলতে পারঙ্গম সাবের কামাল নারী সহকর্মীর সামনে এ রকম একটি সুযোগ হাতছাড়া করল না।

এডলিন কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলেও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে যথারীতি। যেন দিন-দুনিয়ার কোনো বিষয় নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। তার চেয়ে অনেক জটিল আর জরুরি কাজ চোখের সামনে আছে।

নারী সহকর্মীর সামনে বেফাঁস কথা বলার জন্য সাবেরের দিকে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকাল বেগ।

“সরি, বস্।”

“নিজের কাজ করো,” অন্য একটা এভিডেন্স ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে বলল বেগ।

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে ভ্যানের ভেতর তার ছোট্ট ল্যাবে বসে পড়ল সে। তার কাছে যে আলামতটি আছে সেটা থেকে ডিএনএ টেস্ট করা যায় কি না খতিয়ে দেখবে এখন-আধখাওয়া সিগারেটের ফিল্টার। ওটাতে নির্ঘাত মুখের লালা লেগে আছে। তবে নিশ্চিত হবার জন্য একটা ছোটখাট কেমিক্যাল টেস্ট করতে হবে তাকে। একটু পর জায়েদ রেহমানের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঘরের অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে ডিনএনএ স্যাম্পলও সংগ্রহ করতে হবে এলিমিনেশন প্রসেসের জন্য।

জেফরি বেগ এডলিনের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। সুন্দরি মেয়েরা কতোটা অবলীলায়ই না চারপাশকে অবজ্ঞা করে থাকতে পারে!

“এডলিন?” ভ্যানের ভেতর উঁকি মেরে বলল সে।

যেন এইমাত্র তাকে দেখতে পেয়েছে এ রকম একটা ভান করে এডলিন ডি কস্তা মুখে জোর করে হাসি এঁটে বলল, “গুডমর্নিং, স্যার।”

“গুডমর্নিং। কী করছেন?”

“কিছু না। সার্চ-ইঞ্জিনটা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম।”

এই মেয়েটা অভিনয়ে গেলে ভালো করবে, ভাবলো বেগ। প্রশ্নটা করার আগে আড়চোখে তাকিয়ে বেগ মনিটরটা দেখেছে। এই মেয়ে হরোস্কপিক সফটওয়্যারটি ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। এ রকম সফটওয়্যার মোবাইল এভিডেন্স ভ্যানে থাকা শক্তিশালী কম্পিউটারে ইনস্টল করা ছোটখাট বে-আইনী কাজের মধ্যে পড়ে। অবশ্য বিজ্ঞানের ছাত্রি হয়ে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে মাতামাতি করাটা বে-আইনী কাজের মধ্যে পড়ে কি না ভাবলো জেফরি বেগ।

সিলভার রঙের কাগজের টুকরোর এভিডেন্স ব্যাগটা এডলিনের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। “এটা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতে হবে। কতোক্ষণ লাগবে?”

“এটা কী?” ব্যাগটা হাতে নিয়ে এডলিন জানতে চাইল।

বেগকে আর কষ্ট করে বিব্রতকর কথাটা বলতে হলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে সাবের কামাল গুরুগম্ভীরভাবে বলল, “কনডমের প্যাকেট।”

“কী?” এডিলিনের মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেল।

“কনডম চেনেন না?!” সাবের কামাল এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন কনডম প্রতিদিন ভাতের সাথে খাওয়া ডালজাতীয় জিনিস। এডলিনকে বিব্রত হতে দেখে সাবের কামাল আরো উৎসাহী হয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি বাধা দিল জেফরি বেগ।

“সাবের!”

“সরি, বস্।” জিভ কেটে নিজের কাজে মন দিল সাবের। তার ঠোঁটে এখনও দুষ্টুমিভরা হাসি লেগে আছে।

নিজের বিব্রত হওয়া ভাবটা আবারো দক্ষ অভিনয়ের সাহায্যে সামলে নিতে পারল এডলিন। “স্যার, এটা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। কিন্তু ডাটা-ব্যাঙ্ক থেকে প্রিন্টটার ম্যাচিং বের করতে অনেক সময় লাগবে।”

এভিডেন্স ভ্যানে একটি অত্যাধুনিক স্ক্যানার রয়েছে যার সাহায্যে খুব দ্রুত যেকোনো বস্তুর উপর থেকে আঙুলের ছাপ নেয়া যায়। আগে এই কাজটি করতে অনেক সময় লাগতো।

“ঠিক আছে। আপনি আগে প্রিন্টটা নেয়ার চেষ্টা করুন। কাজ হলে আমাকে ফোন করবেন।”

“আপনার নাম্বারটা…?” একটু ইতস্তত করে বলল এডলিন।

“আমার নাম্বার আপনার কাছে নেই?”

“না, স্যার,” দূর্বল কণ্ঠে বলল এডলিন।

কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকালো বেগ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ডিপার্টমেন্টের সবার কাছেই তার নাম্বার রয়েছে। এই মেয়েটা আসলে নার্ভাস হয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।

আবারো সাবের কামাল ঢুকে পড়ল তাদের মধ্যে। “আমার কাছে আছে।”

“ঠিক আছে, তাহলে ওর কাছ থেকে নিয়ে…” কথাটা শেষ করল না। “…সাবের, তুমিই আমাকে ফোন দিও।”

মেজাজটা একটু খারাপ হয়ে গেল বেগের। আর কিছু না বলে সোজা চলে গেল ভিটা নুভার প্রধান দরজার সামনে।

মেইন গেট দিয়ে বের হবার সময় গেটের দায়িত্বে থাকা পুলিশ স্যালুট দিল তাকে। পুরো অ্যাপার্টমেন্টটা সিল করে দেয়া আছে দেখে খুশি হলো সে। আরো কিছুটা সময় এ রকম থাকবে। তারপর খুন না স্বাভাবিক মৃত্যু সেটা নিশ্চিত হবার পর এই অবস্থা তুলে নেয়া হবে।

রাস্তাটা পেরিয়ে ওপার থেকে পুরো ছয় তলা ভবনটি দেখে নিলো জেফরি বেগ। ইন্সপেক্টর এলাহী এখান থেকেই অজ্ঞাত এক তরুণকে সন্দেহজনকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। ছেলেটাকে ধরতে পারলে অনেক কিছু জানা যেতো-কেন এতো রাতে এখানে এসেছিল, কারা কারা ছিল তার সাথে। ফুটপাতের বন্ধ চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে জেফরি বেগ ভিটা নুভার ছয় তলার জায়েদ রেহমানের ঘরের বেলকনি আর জানালার দিকে তাকাল। এখান থেকে লেখকের স্ত্রীর শোবার ঘরের জানালা আর বেলকনিটাও দেখা যায়। পাশাপাশি তাদের অবস্থান। ঐ ছেলেটা এখান থেকে কি দেখছিল?

মোবাইল এভিডেন্স ভ্যানে এইমাত্র যে আলামত দুটো দিয়ে এসেছে সেটা যদি ঠিকঠাক উদঘাটন করা যায় তো এই রহস্যটা মুহূর্তেই সমাধান করা যাবে।

একটা কিছু যেন তার সামনে এসে আচমকা উদয় হলো। জেফরি বেগ একটু চমকে ভিটা নুভার ছয় তলা থেকে চোখ সরিয়ে আনতেই দেখতে পেল তার ঠিক সামনে এইমাত্র একটা মোটরসাইকেল এসে থেমেছে।

ফ্রল্যান্স সাংবাদিক এবং লেখক দিলান মামুদ।

এ মুহূর্তে কোনো সাংবাদিককে দেখে খুশি হবার কথা নয় কিন্তু দিলান মামুদকে দেখে খুশি হলো বেগ। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটা দিন এই দিলান মামুদ পশ্চিমা বিশ্বের অসাধারণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল বিশাল একটি অপারেশন। ঘটনাক্রমে জেফরি বেগও জড়িয়ে পড়েছিল সেই অপারেশনে। সেই থেকে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সূচনা।

অনেক দিন পর দিলানকে দেখে খুশি হলেও মনের গহীনে একটা আশঙ্কাও উঁকি মারছে জেফরি বেগের : সাংবাদিকরা কি তবে জেনে গেছে?

“এতো সকালে আপনি এখানে?” বেগ বলল।

“দাঁড়ান দাঁড়ান। প্রশ্নটা আসলে আমার। আপনি এতো সকালে এখানে কি করছেন?” পাল্টা জানতে চাইল দিলান মামুদ।

জেফরি বেগ বুঝতে পারল না কী বলবে। দিলান মামুদের সাথে তার যে সম্পর্ক তাতে করে মিথ্যে বলাটা অনুচিত হবে। বোকার মতো কাজই হবে সেটা। আবার এই মুহূর্তে লেখক জায়েদ রেহমানের মৃত্যুর খবর জানাতে চাচ্ছে না সে। সাংবাদিক আর মিডিয়ার লোকজন আরো এক-দেড় ঘণ্টা পর জানলেই সে খুশি হবে। নইলে এই তদন্ত কাজে ঝামেলা তৈরি হবে।

সম্ভবত দিলান মামুদ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। এটা তো লেখক জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্ট, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ।

“তার কি কিছু হয়েছে?”

বেগ হেসে ফেলল। এখন আর না বলে উপায় নেই। “মাঝরাতে মারা গেছেন।”

দিলান মামুদ মোটেও অবাক হলো না। “মারা গেছে?” মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল সে। ভিটা নুভার দিকে তাকিয়ে জেফরির দিকে ফিরল। “তো, বিখ্যাত ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ এতো সকালে এখানে কি বিখ্যাত লেখকের জন্য শোক প্রকাশ করতে এসেছে? আমি জানতাম না আপনি তার বইয়ের একজন পাঠক!” মুখে মুচকি হাসি দিলানের।

“ব্রাদার, সেলিব্রেটি মানুষ। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও একটু খতিয়ে দেখতে হয়।”

“আপনার কাছে কি মৃত্য বলেই মনে হচ্ছে, না কি…“

“আরেকটু নিশ্চিত হতে হবে,” বেগ বলল।

হাতটা বাড়িয়ে দিল দিলান মামুদ। “ওকে, তদন্ত করতে থাকুন। আমি যাই। সারা রাত ঘুমাইনি। এখন খুব ক্লান্ত লাগছে।”

হাতটা ধরেই বেগ জানতে চাইল, “পার্টি ছিল না কি?”

“না। ডক্টর জেডের ওখানে ছিলাম। গতকাল তো পূর্ণিমা ছিল।”

ডক্টর জেড। জেড থিওরির প্রবক্তা এই রহস্যময় লোকটির সাথে এখনও বেগের সাক্ষাত হয়নি। দেশ-বিদেশের একটা নির্দিষ্ট মহলে তাকে নিয়ে এক ধরণের মিথ আর গালগল্প চালু রয়েছে। অনেকেই তাকে সবজান্তা বলে অভিহিত করে থাকে। আবার তাকে ভণ্ড আর শয়তান বলার লোকও কম নেই। বেগ অবশ্য বিশ্বাস করে না মানুষের পক্ষে সবজান্তা হওয়া সম্ভব। তবে লোকটি যে সাধারণ কেউ নয় সেটা মানতেই হবে। দিলান মামুদ হলো সেই রহস্যময় জ্ঞানী ডক্টর জেডের একনিষ্ঠ ভক্ত।

“দিলান, একটা অনুরোধ করবো।”

“বলতে হবে না। আমি জানি। এই খবরটা কাউকে বলবো না, তাই তো?” বলেই হেসে ফেলল সে।

“ঠিক।” বেগ অবাক হলো। এই দিলান মামুদও কি ডক্টর জেডের সাথে মিশতে মিশতে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী উঠছে না কি? “ধন্যবাদ।”

“ঐ লেখককে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করে যান। পরে কথা হবে।” বলেই মোটরসাইকেলটা ছুটে গেল ফাঁকা রাস্তা দিয়ে।

অপসৃয়মান মোটরসাইকেলটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জেফরি বেগ। এতোক্ষণ মাথার মধ্যে তদন্ত বিষয়ক যেসব জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা ক্ষণিকের জন্য চাপা পড়ে গিয়েছিল। বাউন্ডুলের মতো জীবন যাপন করা দিলান মামুদকে দেখলে তার খুব ঈর্ষা হয়। জেফরি বেগ খুবই নিয়মের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ। এ রকম একটা অনিয়মের জীবনের জন্য মাঝেমধ্যেই সে লালায়িত হয়ে ওঠে।

মোবাইল ফোনের বিপ হলে পকেট থেকে সেটা বের করে হাতে তুলে নিলো।

এডলিন।

কলটা রিসিভ না করে কেটে দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে ভিটা মুভার পার্কিংলটে থাকা এভিডেন্স ভ্যানের সামনে চলে এল বেগ।

ভ্যানের পেছনের দরজা এখনও খোলা, এডলিন একাই বসে আছে। সাবের কামাল নেই। জেফরি জানে সাবের জায়েদ রেহমানের ফ্ল্যাটে গেছে নয়তো আশেপাশেই কোথাও সিগারেট ফুঁকছে। কাজের সময় এই লোক ঘন ঘন সিগারেট খায় কিন্তু এভিডেন্স ভ্যানে থাকা বহুমূল্যবান আর সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি থাকার কারণে এর ভেতরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।

বেগকে দেখেই এডলিন রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে বলল, “স্যার, দুটো প্যাকেটেই বুড়ো আঙুলের প্রিন্টটা বেশ ভালোমতোই পাওয়া গেছে। তবে একটাতে একটু বেশি ভালো অবস্থায় আছে। আমি সেটাই ডিজিটাইজ করেছি। নব্বই পার্সেন্টেরও বেশি রিকভার করা গেছে।”

খবরটা শুনে খুশি হলো বেগ। “গুড। এখন কি ডাটা-ব্যাঙ্কের সাথে ম্যাচ করে দেখা যাবে?”

“স্যার, সাড়ে আটকোটি ফাইল। সার্চ করতে অনেক সময় লাগবে। কমপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা,” এডলিন বলল। “আমারা বরং হেড অফিসে গিয়ে?”

“অতো সময় লাগবে না,” বলল বেগ। “ন্যারো-ডাউন করুন।”

“অপশনগুলো কি হবে?” এডলিন জানতে চাইল।

বেগ একটু সময় নিলো ভাবার জন্য।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডাটা-ব্যাঙ্ক হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের এমন একটি মূল্যবান সম্পদ যা কি না অনেকটা বিনা পয়সায় পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগে সারা দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ ডিজিটাল ফর্মেটে। সেই ডাটা-ব্যাঙ্কটি তৈরি করতে হাজার হাজার মানুষের লক্ষ-লক্ষ শ্রমঘণ্টা লেগেছে, ব্যয় হয়েছে কয়েক শ’ কোটি টাকা। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ষাট ভাগই ভোটার। সে হিসেবে এই ডাটা-ব্যাঙ্কে দেশের ষাট শতাংশ লোকের সমস্ত তথ্য ছবিসহ ডিজিটাইজ করা আছে।

এটার সঠিক ব্যবহার এখনও হয়ে ওঠেনি। মাত্র পাঁচ মাস আগে এই ডাটা-ব্যাঙ্কটি তারা হাতে পায়। এটার সার্চ-ইঞ্জিন সফটওয়্যারটিও বিনা মূল্যে আমেরিকার এফবিআই’র কাছ থেকে সহযোগীতার নর্দশন হিসেবে পেয়েছে নতুন গঠন করা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট। এখানেও ছিল জেফরি বেগের ভূমিকা। ভার্জিনিয়াতে এফবিআই’এর অধীনে ট্রেনিং নেবার কল্যাণে ওখানকার কিছু কর্তাব্যক্তির সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এ রকম একটি উন্নতমানের সফটওয়্যার উপহার হিসেবে পেয়েছে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট।

“মিস্ এডলিন,” বেগ বলল।

“জি, স্যার?”

ভ্যানের ভেতর উঠে এসে এডলিনের পাশের টুলের উপর বসে পড়ল সে। লক্ষ্য করল মেয়েটি এখন আর নার্ভাস হচ্ছে না। তার মধ্যে দৃঢ় একটা ভাব চলে এসেছে। কিন্তু বেগ টের পেল তার নিজের ভেতরে অজ্ঞাত এক কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে।

“জেন্ডার-ওয়াইজ সার্চ করুন। শুধুমাত্র পুরুষ,” বলল বেগ।

চোখেমুখে রহস্য মেখে জেফরির দিকে তাকিয়ে বলল সে, “শুধু পুরুষ!”

মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ।

“ঠিক আছে।” মোনানিসার চেয়েও দুর্বোধ্য হাসি তার ঠোঁটে।

তার মানে আট কোটির জায়গায় ফাইলের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় সোয়া চার কোটিতে। যেহেতু এ দেশের নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান।

“বয়সের রেঞ্জ হবে…বিশ থেকে পঞ্চাশ।”

এডলিন কি-বোর্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এবার ফাইলের সংখ্যা কমে এল পৌনে দুই কোটিতে।

“শুধুমাত্র ঢাকা সিটির মধ্যে থাকুন। এখানে ম্যাচিং না পেলে আমরা রেঞ্জ আরেকটু বাড়াবো।”

আবারো কি-বোর্ডে টাইপ করার শব্দ শোনা গেল। এখন ফাইলের সংখ্যা এক লাফে কমে গিয়ে দাঁড়াল প্রায় বিশ লাখে।

“স্যার, ফাইল অনেক কমে গেছে। এখন মনে হচ্ছে না বেশি সময় লাগবে,” এডলিন প্রশংসার সুরে বলল।

মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ। “উমমম…এক কাজ করুন। বয়সের রেঞ্জটা রি-অ্যারেঞ্জ করে বিশ থেকে পাঁচচল্লিশ করে দিন।”

খটাখট টাইপ করার শব্দ হলো আবারও সেই সঙ্গে কমে এল ফাইলের সংখ্যা।

“কততক্ষণ লাগতে পারে এখন?”

মিস্ এডলিন মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি বেগের দিকে তাকালে বেগ বুঝতে পারল তাদের মধ্যে মাত্র এক ফুটের ব্যবধান। সকাল সকাল ইমার্জেন্সি কল পেয়ে ছুটে এলেও তার সাজসজ্জা বেশ পরিপাটি। চুল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছে বেগ। শরীর থেকে হালকা যে পারফিউমের গন্ধটা ভেসে আসছে সেটা আরো বেশি মোহনীয়। রেবাও ঠিক এই পারফিউমটা ব্যবহার করতো। কতো দিন তার গন্ধ নেয়া হয় না!

বেগ বুঝতে পার, এতোক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু চমকে উঠে সামলে নিলো নিজেকে। এডলিনের ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি। মেয়েরা কি না তাকিয়েও দেখতে পায়?

“আমাদের ডাটা-ব্যাঙ্কের ফাইলগুলো বর্ণানুক্রমে রয়েছে। আঙুলের ছাপটি যে লোকের তার নাম যদি প্রথম দিককার কোনো অক্ষর দিয়ে হয়ে থাকে তবে অনেক জলদি ম্যাচিং বের করা যাবে। সুতরাং যেকোনো সময় ম্যাচিং হতে পারে। তবে সবগুলো ফাইল ব্রাউজ হতে…ত্রিশ মিনিট লাগবে।” এডলিন এখন আর স্যার সম্বোধন করছে না।

বেগ বুঝতে পারল এই মেয়ের সংস্পর্শে এসে সে নিজেই এখন নাভাস বোধ করছে। তাড়াতাড়ি ভ্যান থেকে নেমে গেলে তার দিকে তাকাল এডলিন।

“ম্যাচিং হলে আমাকে ডাকবেন।”

“ঠিক আছে।” এবারও স্যার বলল না মেয়েটি।

ব্যাপারটা বেগও লক্ষ্য করেছে। তার নাভাস ভাবটা আরো বেড়ে গেল। ভ্যান থেকে কয়েক পা বাড়াতেই জামানের মুখোমুখি হলো সে।

“স্যার, পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ কখন নিয়ে যাবো?”

“আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।”

“আপনি কি আবারো দেখবেন?”

“না। তবে লাশ নিয়ে যাবার পর রেহমান সাহেবের ফ্ল্যাটে আবার যাবো। আরো কিছু জিনিস দেখতে হবে,” বলল বেগ।

“তাহলে আমরা কি এখন এখানেই থাকব, না কি নাস্তা করে আসবো?”

“একটু ওয়েট করো। ডাটা-ব্যাঙ্ক সার্চ করা হচ্ছে। দেখি কি পাওয়া যায়।”

“অনেক সময় লাগবে তো।”

জেফরি বেগ মাথা নেড়ে বলল, “আশা করছি দশ-বিশ মিনিটের বেশি-”

কথাটা শেষ করতে পারল না সে, ভ্যানের ভেতর থেকে এডলিনের মিষ্টি কণ্ঠটা ডেকে উঠল। “স্যার! ম্যাচিং পাওয়া গেছে!”

এতোটা দ্রুত হবে আশা করেনি জেফরি বেগ। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল ভ্যানের ভেতর। তার পেছন পেছন জামান।

কম্পিউটারের পর্দায় একটা ফাইল ভেসে উঠেছে। ছবি আর বিস্তারিত তথ্য সহ একটি ডকুমেন্ট ফাইল। স্ক্যান করা আঙুলের ছাপের সাথে এই ডক-ফাইলের ব্যক্তির আঙুলের ছাপের প্রায় পঁচানব্বই পার্সেন্ট ম্যাচিং হয়েছে। অসাধারণ!

ছবিটা ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক সুদর্শন যুবকের। ছবির নিচে তার নাম, বাবা-মার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বারসহ যাবতীয় তথ্য রয়েছে। লোকটির নাম ইংরেজি ‘এ’ আদ্যক্ষরে হওয়াতে অসম্ভব দ্রুতগতিতে সার্চের ফল পাওয়া গেছে। জামান আর বেগ একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

“এডলিন। আমাকে এই পেজটার একটি কালার প্রিন্ট বের করে দিন,” বেগ বলল প্রচণ্ড বিস্ময় আর উত্তেজনার সাথে।

.

“স্যার, এখন কী করবেন?” ভ্যান থেকে জামান আর বেগ বের হয়ে পার্কিংলটের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তারা দু’জনেই কম্পিউটার প্রিন্টআউটটা ভালো করে দেখেছে কয়েক বার।

“ফোন করো,” জামানের দিকে তাকিয়ে বলল বেগ।

নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে প্রিন্টআউট থেকে নাম্বারটা নিয়ে কল করল জামান।

“রিং হচ্ছে, স্যার,” জামানের চোখ দুটো চক চক করে উঠল।

ঠিক সেই সময়েই জেফরি বেগ ব্যাপারটা টের পেল। তার সমস্ত গা শিউরে উঠল যেন।

“স্যার, লাইন কেটে দিয়েছে!” হতাশ হয়ে বলল জামান। কানে ফোন চেপে রাখার কারণে ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। কেবল দেখল জেফরি বেগ ডান দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বলছে।

অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখানে।

.

অধ্যায় ৮

ভিটা নুভার ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি বেগ আর জামান। এভিডেন্স ভ্যানটা পার্কিংলটের যেখানে পার্ক করা আছে তার ডানে মাত্র পাঁচ গজ দূরে সেটা অবস্থিত। ঘোরানো সিঁড়িটা নিচের পার্কিংলটে এসে থেমেছে। বাইরে থেকে কেবলমাত্র মেঝেতে নেমে আসা আটটি ধাপ দেখা যায়। সিঁড়ির বাকি অংশ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলে গেছে ছয়তলা পর্যন্ত।

জামান কিছু বলতে যাবে কিন্তু বেগ তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। এইমাত্র ডাটা-ব্যাঙ্ক থেকে তারা যে লোকের ফাইলটা পেয়েছে সেই লোকের মোবাইল ফোনে কল করলে তিন বার রিং হতেই লাইন কেটে দেয়া হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ঠিক তখনই তিন তিনটি ফোন রিংয়ের শব্দ তারা খুব কাছ শুনতে পায়। বেগ একদম নিশ্চিত রিঙের শব্দটি এসেছে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ির ভেতর থেকে।

বেগ আরেকবার জামানকে ফোন করার জন্য ইশারা করলে সে কোনো কথা না বলে ডায়াল করল।

যা ভেবেছে তাই। রিং হবার স্পষ্ট শব্দ শোনা গেল ফায়ারস্কেপ সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের ভেতর থেকে।

একটা আক্ষেপে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল জেফরি বেগের। তাড়াহুড়া করে চলে আসার কারণে সঙ্গে করে পিস্তলটা নিয়ে আসা হয়নি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার এ রকম একটি ভুল করল সে। যদিও তার ট্রেনিংয়ে সব সময় সঙ্গে পিস্তল রাখার কথা বলা হয়েছে তারপরও এই ভুলটা করায় সে যারপরনাই বিরক্ত। ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি আজকের ঘটনায় পিস্তলের প্রয়োজন হবে।

কোনো কথা না বলে জামানকে ব্যাকআপে থাকার জন্য ইশারা করে এগিয়ে গেল সে। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে এবং গেটে পুলিশ আছে। সেই ভরসায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জেফরি বেগ।

এভিডেন্স ভ্যানের ভেতর থেকে এডলিন ডি কস্তা পুরো ব্যাপারটা দেখে ভয়ে স্থির হয়ে আছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সে কখনও পড়েনি। একেবারে ঘটনাস্থলে…?

বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে পড়ল জেফরি বেগ।

ভেতরটায় কোনো বাতি নেই। আধো-আলো-অন্ধকার। উপরের দিকে ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারল কেউ একজন তার মাথার কিছুটা উপরে পেঁচানো সিঁড়ির একটি ধাপে বসে আছে। হাতে এখনও মোবাইল ফোনটা ধরা। জ্বল জ্বল করতে থাকা ডিসপ্লের আলোতে লোকটার চেহারা ভুতুরে দেখাচ্ছে। তবে লোকটা এখনও জেফরি বেগের উপস্থিতি টের পায়নি। সম্ভবত মোবাইল ফোনের রিংটোন বন্ধ করতে ব্যস্ত আছে।

“মি. আলম! একদম নড়বেন না!” বেশ দৃঢ়ভাবে বলল জেফরি বেগ।

.

অধ্যায় ৯

ঘটনা খুব দ্রুত পাল্টে গেছে। লেখক জায়েদ রেহমান মারা গেছেন না কি খুন হয়েছেন সে রহস্যের সমাধানই শুধু হয়নি, স্বয়ং হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে। আর এসবই ঘটেছে বেশ দ্রুত গতিতে।

ব্যাপারটা নব-প্রতিষ্ঠিত হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের জন্য গৌরবের একটি মুহূর্ত। প্রচুর টাকা খরচ করে শ্বেতহস্তি কেনার মতো বিলাসিতা যে করা হয়নি সেটা বুঝিয়ে দেবার সময় এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা তদারকি কাজে নিয়োজিত পার্লামেন্টারি কমিটি কয়েক দিন আগেও এই ডিপার্টমেন্টের কাজের ব্যাপারে উষ্ম প্রকাশ করেছিল। তারা না কি যথেষ্ট কাজ করছে না। এর প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ খবরটা শুনে বেশ ফুর্তির মেজাজে আছে। নিজের ডেস্কে বসে পেপারওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে মনের আনন্দে।

মাত্র দশ মিনিট আগে ঘটনাস্থল থেকে টেলিফোন করে তাকে জানানো হয়েছে খবরটা। টিভি চ্যানেল আর পত্রিকাগুলো এ রকম একটি খবর কিভাবে লুফে নেবে সেটা ভেবে বেশ মজা পাচ্ছে সে। আজকে কমপক্ষে চারটা টিভি চ্যানেলে তার ইন্টারভিউ যাবে। সে না চাইলেও এটা হবে। অবশ্য দুয়েকটা পত্রিকাও তার ইন্টারভিউ নিতে চাইবে, তবে ফারুক আহমেদ সেটা অধীনস্তদের উপর ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে।

নিজের সেলফোনটা বেজে উঠলে পেপারওয়েটটা রেখে কলার আইডির দিকে চোখ যেতেই নড়েচড়ে উঠল মহাপরিচালক। হোমমিনিস্টার! অবাক হয়ে আপন মনে বলল ফারুক সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল কলটা।

“স্লামালাইকুম, স্যার,” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল সে। “ধন্যবাদ স্যার…জি, স্যার…গ্রেফতার করা হয়েছে…না, ভদ্রমহিলাকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি…আমি অবশ্য এক্ষুণি বলতে যাচ্ছিলাম সেটা…হ্যাঁ, হা…তাতো নিশ্চয়..স্যার, নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন…জি, জি…এখনও জানানো হয়নি…ঠিক আছে, স্যার…স্লামালেকুম, স্যার…”

কলটা শেষ হতেই তার খুশির ভাব আরো বেড়ে গেল। স্বয়ং হোমমিনিস্টার তাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে মিনিস্টার সাহেব নিজেও এ ঘটনা জানতে পেরে খুশি।

সুখবরটা পাওয়া মাত্র নিজের এপিএস’কে হোমমিনিস্টারের দপ্তরে ফোন করে জানাতে বলেছিল ফারুক আহমেদ। এ রকম একজন সেলিবৃটির মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে প্রশাসনের সবাই তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে হোমমিনিস্টার সেই সকাল থেকেই এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কারণ লেখক জায়েদ রেহমানের দেশের বাড়ি তার নিজের জেলায়। স্থানীয় রাজনীতির ব্যাপার আছে এখানে। কিন্তু ফারুক আহমেদ অবাক হচ্ছে লেখকের যুবতী স্ত্রীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়ায়। স্বয়ং হোমমিনিস্টার মহিলাকে গ্রেফতার করতে বলছেন!

মন্ত্রী নিজে না বললেও কিছুক্ষণ পর ফারুক আহমেদ নিজেও এটা বলে দিতো তার টিমকে। তারচেয়েও বড় কথা মহিলা এবং তার প্রেমিক প্রবরটিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য খুব তাগাদা দিলেন মন্ত্রী মহোদয়। মিডিয়াকেও জানাতে বলে দিয়েছেন তিনি। ব্যাপারটা নিয়ে একটু খটকার সৃষ্টি হলেও ফারুক আহমেদ খুব একটা আমলে নিলো না। একটা নাম্বার ডায়াল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের একজনকে ফোন করবে এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *