খড় কুটো – বিমল কর
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৬৪ (মাঘ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ)
শ্রীবরেন গঙ্গোপাধ্যায়
কল্যাণীয়েষু
১
অন্ধকার আকাশের তলায় দেখতে-দেখতে একটি আলোর ময়ূর ফুটে উঠল। অবিকল সেই রকম কণ্ঠ, সেই পুচ্ছ। আলোয় ফুলকিগুলো যেন ভাসছিল। তারপর ওই আকৃতি তরল হয়ে ভাসমান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতন কাঠিন্য হারাতে শুরু করল। ময়ূরটির আকার যত বাড়ছিল, তার প্রত্যঙ্গগুলি ততই গলে যাচ্ছিল। কিছু, সোনালী তারা, কিছু রূপালী স্ফুলিঙ্গ আরও ওপরে উঠে আকাশের তারাদল প্রায় যেন স্পর্শ করল; কণ্ঠ এবং পুচ্ছ থেকে খচিত কণাগুলি নক্ষত্রচূর্ণের মতন বিক্ষিপ্ত হয়ে মাটিতে নেমে আসতে-আসতে নিবে যাচ্ছিল। শেষে, যখন আলোর ময়ূরটি অন্ধকারেই হারিয়ে গেল তখন কয়েকটি মাত্র রূপালী ফুল বৃষ্টির ফোঁটার মতন গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ল, মাঠের ঘাস স্পর্শ করার আগেই ছাই হয়ে গেল।
চারপাশে অফুরন্ত খুশীর গুঞ্জন ছিল; ক্রমশ মাঠে রোল উঠল। গলা ছেড়ে, হাততালি দিয়ে এই ময়ূরের বাজিকরকে সকলে বাহবা দিচ্ছিল। ততক্ষণে আকাশতলায় আবার অন্ধকারের যবনিকা ছড়িয়ে গেছে।
অমল প্রবল উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়েছে অনেকক্ষণ, অবশেষে সবাই থেমে গেলে সেও থেমে গেছে। তার মুগ্ধ উত্তেজিত চোখমুখ অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু গলার স্বরে তার রোমাঞ্চ বোঝা যাচ্ছিল। পাশে ভ্রমর। ভ্রমরকে বার বার সে বলছিল, “বিউটিফুল। আমি কখনও দেখি নি এ রকম। যে তৈরী করেছে, সে একজন আর্টিস্ট। কী রকম সুন্দর গলাটা করেছিল দেখেছ!”
ভ্রমর যেন তখনও আলোর ময়ূরটিকে চোখের মধ্যে কোথাও দেখতে পাচ্ছে। ঝিকমিক ঝিকমিক করে জ্বলছে ছবিটা। বিরিজমোহন প্রত্যেক বছর দেওয়ালিতে রাজ-ময়দানে এই রকম সুন্দর সুন্দর বাজি পোড়ানো দেখায়।
“গত বছরে একজোড়া রাজহাঁস দেখিয়েছিল। খুব সুন্দর।” ভ্রমর বলল।
লাউডস্পীকারের গলা ততক্ষণে পরের দ্রষ্টব্য বিষয়টি ঘোষণা করেছে। হিন্দীতেই বলা হচ্ছিল। বাজি পোড়ানোর আগামী খেলাটাই শেষ। ঠিক বোঝা গেল না কি নাম বললে, শুধু আটামল কোম্পানী আর বোম্বাই শব্দ দুটো কানে গেল।
রাজ-ময়দানের চতুর্দিকে লোক। মাঠ ঘিরে সব বসে আছে। উত্তরের দিকে রাজবাড়ির মহল। আলোর মালা পরানো প্রাচীন প্রাসাদ। গম্বুজের চুড়োয় তিনটি নীল তারা জ্বলজ্বল করছে। পূর্ব-পশ্চিমে গাছের সার, মস্ত মস্ত ঝাউ আর শিরীষ গাছ; অন্ধকারে নিস্তব্ধ, দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের দিকে স্ট্যান্ড; কাঠের তক্তা গ্যালারীর মতন করে পাতা। ব্যবস্থাটা স্থায়ী। খেলাধুলো হয় এই মাঠেই, ফলে স্ট্যাণ্ডটা রেখে দেওয়া হয়েছে।
অমলরা স্ট্যাণ্ডেই বসেছিল। ওদের পাশে মোহনচাঁদরা বাড়িসুদ্ধ লোক বসে আছে।
তার ওপাশে আছে যোশীরা। যোশীদের দিক থেকে একটি মেয়ে চেঁচিয়ে কি যেন বলল, ভ্রমরকে, হিন্দীতেই। ভ্রমর নীচু গলায় জবাব দিল।
অমল বলল, “কে?”
“পুষ্পা।”
“কি বলল?”
“এবারে মাঠে জোনাকি জ্বলবে।”
অমল বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে শুধোল, “কেন? হঠাৎ জোনাকি জ্বলবে কেন?”
“বাজি; জোনাকির বাজি দেখাবে এবার।”
অমল কল্পনা করতে পারল না, সেটা কি করে সম্ভব হবে। সারা মাঠ ভরে জোনাকি উড়বে নাকি? অথবা অন্যান্য বাজি পোড়ানো যেরকম দেখল, একটা মস্ত ফানুস কি হাউই আকাশে উড়ে গিয়ে তারপর ফেটে পড়বে, সারা আকাশ পিটপিট জোনাকি-আলোয় ছেয়ে যাবে! হর্ষ, রোমাঞ্চ ও অগাধ বিস্ময় নিয়ে অমল মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকল।
এই যে অদ্ভুত অদ্ভুত বাজি পোড়ানোর খেলা, এর একটা মাত্র অসুবিধে এই, একটা শেষ হলে অন্যটা শুরু হতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। যারা ব্যক্তি পোড়াবে, তারা তাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে, এটা আনে সেটা আনে, ব্যবস্থা পাকা করে নেয় সব—ফলে সময় যায় অনেকটা; কিন্তু যারা দেখে, তারা অধীর হয়ে পড়ে। অমল বুঝতে পারল না, মাঠে বাজি পোড়ানো হবে, অথচ কতক ছায়া-সদৃশ লোক আলো হাতে চারপাশে ছোটাছুটি করছে কেন?”
“আচ্ছা, মেসোমশাই সেই যে গেলেন, আর এলেন না?” অমল বলল। বাজি পোড়ানো দেখতে সে এত তন্ময় যে, আনন্দমোহনের কথা ভুলে গিয়েছিল।
ভ্রমর বলল, “বাবা বোধ হয় রাজবাড়ির দিকে বসে গল্প করছেন।”
“কৃষ্ণাও ত এল না।”
‘এসেছে ঠিক; ওর বন্ধুদের সঙ্গে এসেছে; বন্ধুদের সঙ্গেই বসে আছে।”
ভ্রমরের কথা শেষ হতে-না-হতেই মাঠের অন্ধকারে একটি আলো দপ করে উঠল, ঠিক মাঝ-মধ্যিখানটায়। তারপর চোখের পলকে মাটির অন্ধকার থেকে ফোয়ারার মতন আলোর ধারা উঠল; উঠল ত উঠলই, গাছের মাথা-সমান উঁচু হয়ে রঙমশালের তারার মতন, তুবড়ির ফুলের মতন ফরফর করে পুড়তে লাগল, জ্বলতে থাকল, নিবতে থাকল। আর সেই আলোর ফোয়ারা নিস্তেজ হয়ে আসতে না আসতেই, কী আশ্চর্য, মাঠের কোণে-কোণে, দূর ও কাছের গাছগুলির অন্ধকারে থোকা-থোকা জোনাকি জ্বলতে থাকল। এই এখানে জ্বলে, ওই ওখানে জ্বলে, কখনও ঘাসের মাথায় এক মুঠো জোনাকি দপ করে ফুটে ওঠে, কখনও দূরে শিরীষ অথবা ঝাউগাছের গোড়ায় জোনাকিদল নাচতে থাকে।
দেখতে-দেখতে চারপাশে যেন জোনাকির মেলা বসে গেল। টিপটিপ করে নীলাভ আলোর বিন্দুগুলি জ্বলছে নিবছে, পাক খাচ্ছে, নাচছে, বাতাসে ছিটকে আসছে, উঁচুতে উঠছে, মাটিতে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, একদল লোক যেন মাঠ ও গাছগাছালির কাছে গিয়ে অন্ধকারে জোনাকির পিচকিরি ছুঁড়ে মারছে, আর পলকে অন্ধকারের বসনে জোনাকি ধরে যাচ্ছে।
স্ট্যান্ড ডিঙিয়ে, বেড়া টপকে, মাঠের এ-পাশ ও-পাশ থেকে বাচ্চা-বাচ্চা, মেয়ে ও ছেলেরা, এমন কি কত বুড়োবুড়ীও মহানন্দে হই-হট্টগোল তুলে সেই জোনাকি কুড়োতে মাঠের মধ্যে গেল।
ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি চলতে থাকল সমানে। কত লোক হাসছে, গায়ে-গায়ে পড়ছে, ডাকছে নাম ধরে, আর ছেলেমানুষের মতন সেই জোনাকি ধরার খেলায় মত্ত হয়ে সারা মাঠ ছুটেছে।
অমলেরও ইচ্ছা হয়েছিল লাফ মেরে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। কিন্তু তার সামনে পিছনে যে অট্টরোল হুড়োহুড়ি, তার মধ্য দিয়ে পথ করে নেওয়া অমলের সাধ্যাতীত। ইচ্ছা এবং বাসনা সত্ত্বেও অমল বসে থাকল। বসে-বসে ওই আশ্চর্য ও চমৎকার দৃশ্যটি বিমুগ্ধ চিত্তে দেখতে লাগল।
অবশেষে মাঠ ও গাছভরা জোনাকিরা রাজ-ময়দান অন্ধকার করে আবার চলে গেল।
দেওয়ালির বাজি পোড়ানো শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভিড় জমেছিল বেশ। প্রথম দিকে ওরা কেউ উঠল না, বসে থাকল। যোশীদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা চলে যাবার সময় ভ্রমরকে বলল, হিম পড়ছে, বেশীক্ষণ আর বসে থেকো না।
হিম পড়ছিল। ভিড়ের মধ্যে বসে বাজি পোড়ানো দেখতে-দেখতে এখানকার শেষ কার্তিকের গায়ে-লাগা শীত তেমন অনুভব করা যায় নি। ভিড় পাতলা হয়ে এলে অমল বেশ ঠাণ্ডা লাগছে বুঝতে পারল। উঠল; বলল, “চলো।”
পাতলা রকমের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে অমল ভ্রমরের উষ্ণ হাত ধরে ধরেই হাঁটছিল। হাতে হাত ধরে থাকার মতন যদিও ভিড় নেই, তবু ভ্রমরকে লোকজন, অন্ধকার এবং কাঠকুটো পড়ে থাকা জায়গা দিয়ে একা-একা হেঁটে যেতে দিতে অমলের ইচ্ছে হল না। ভ্রমরের বাঁ পা একটু, ছোটো, মোটা গোড়ালিঅলা জুতো পরে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটে। দু-পায়ে যার সমান জোর নেই, তাকে হাতে ধরে নিয়ে যাওয়া উচিত, কোথাও কিছুতে পা বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারে।
মাঠের বাইরে টাঙার ভিড়। আনন্দমোহনকে দেখা যাচ্ছিল না; কৃষ্ণাকেও নয়। টমটম ভাড়া করে যে যার চলে যাচ্ছিল, অনেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে। মেলাভাঙা ভিড়ের মতনই দেখাচ্ছিল দৃশ্যটা।
“মেসোমশাই কোথাও নেই।” অমল যতটা সম্ভব চারপাশ দেখতে-দেখতে বলল; তার শীত করছিল এবার। জামার তলায় যদিও সোয়েটার আছে, তবু ঠাণ্ডা লাগছিল।
ভ্রমর দেখছিল একে-একে সবাই চলে যাচ্ছে, টাঙার দিকটা খালি হয়ে আসছে। বলল, “বাবা হয়ত গল্প করছেন, পরে যাবেন।”
“আমরা তা হলে বাড়ি ফিরি। কি বলো?”
মাথা নাড়ল ভ্রমর, বাড়ি ফেরাই ভাল।
টাঙা জুটিয়ে অমল ভ্রমরকে গাড়িতে তুলল, তারপর নিজে উঠে বসল।
“মোতি রোড; কালেজ—।” ভ্রমর টাঙাঅলাকে পথ বলে দিল। টাঙাঅলা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে লাগল।
এই জায়গাটা শহরের প্রায় প্রত্যন্ত। চওড়া রাস্তা, বেশ ছিমছাম; বাতি আছে দূর দূর; গাছগাছালি সার করে দু-পাশে দাঁড়িয়ে—ঘোড়ার গলার ঘন্টি বাজছিল ঝুমঝুম করে, মাঝে মাঝে পা দিয়ে ঘণ্টির মাথা টিপে গাড়ির ঘন্টি বাজিয়ে পথ করে নিচ্ছিল কোচোআন। রাস্তায় জটলা জটলা ভিড়, দু-চারজনের ছোট ছোট দলও আছে। বাজি পোড়ানো দেখে বাড়ি ফিরছে সবাই। হুস-হাস করে সাইকেল চলে যাচ্ছে, দু-একটি মোটর গাড়িও; বাকি যা যাচ্ছে সবই টমটম।
রাস্তায় এসে অমল প্রথমে স্পষ্ট করে কুয়াশা দেখতে পেল। এত কুয়াশা হয়েছে কখন কে জানে! হয়ত বহুক্ষণই এই রকম কুয়াশা জমে আছে, অমলের খেয়াল হয় নি। শীতটাও বেশ গায়ে লাগছে। মাথা হাত ঠাণ্ডা, কনকন করছিল। নাক এবং গলার মধ্যে জ্বালা-জ্বালা লাগল একটু। অমল পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল বার কয়েক।
“ঠাণ্ডা লাগল?” ভ্রমর শুধলো।
“না, লাগে নি। গলার মধ্যে চলকোচ্ছিল কেমন!”
“তখনই বলেছিলাম কোট নিতে মাফলার নিতে…” ভ্রমর বলল, “এখানে দেওয়ালির অনেক আগেই শীত শুরু হয়ে যায়।”
“এবারে কি বেশী শীত?”
“না। এই রকমই।”
“আমার কিন্তু ক’দিনের মধ্যে আজই যেন বেশী মনে হচ্ছে।”
ভ্রমর জলের ঢোক গেলার মতন শব্দ করে হাসল একটু। বলল, “আজ যে ঘরের বাইরে, তাই…।”
কথাটা হয়ত ঠিকই বলেছে ভ্রমর। অমল এখানে এসেছে আজ আট দিন; না, আট দিন নয়, ন’দিন। এসে পর্যন্ত সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকে নি; আজই যা দেওয়ালি আর বাজি পোড়ানো দেখতে বেরিয়েছে।
অমল বলল, “আমরা শহরের মধ্যে দিয়ে যাব না?”
“যাব। চকের পাশ দিয়ে চলে যাব।”
“তা হলে ত দেওয়ালি দেখতে পাব?”
“পাব।…আজ এরা খুব হইচই করে।”
“করুক, বছরে মাত্র একটা দিন। আমরাও করি; আমরা ত চার দিন ধরে করি, এরা সে জায়গায় একটা কি দুটো দিন।” অমল এমনভাবে বলল, যেন উৎসব করার ঢালাও অনুমতি দিয়ে রাখল লোকগুলোকে।
ভ্রমরের গায়ে পশমের একটা স্কার্ফ ছিল। নীল রঙের। অন্ধকারে ওটা কালো মনে হচ্ছিল। ভ্রমর অমলের দিকে একটু স্কার্ফ দিল। বলল, “এখানেও দুর্গা পুজো হয়।”
“এখানেও…! কারা করে?”
“বাঙালীরা।”
“বাব্বা, এত বাঙালী আছে এখানে?” অমল বেশ অবাক।
“অনেক নেই, একশো-ট্যাকশো আছে—। বাবাদের কলেজে আছে ক’জন, সারভে অফিসে জনাকয়েক, ডাক্তার আছে একজন, মিউজিয়ামে একজন…”
“পঁচিশজনও হল না।” অমল হাসল, “তুমি অঙ্কে একেবারে সরস্বতী।”
ভ্রমর যেন প্রথমে বুঝল না, পরে বুঝতে পেরে ঈষৎ অপ্রস্তুত হল। বলল, “আমি সকলের কথা বলি নি, ক’জনের কথা বললাম। কত আছে আরও, আমি চিনি না।”
রাস্তা এখানে সামান্য নিরিবিলি। ঘোড়ার কদম একই তালে শব্দ করছে, একই ধ্বনিতে তার গলার ঘণ্টা বাজছে। অন্ধকার ঘন করে বোনা, কুয়াশা কী গাঢ়, যেন ওদের আবৃত করে রেখেছে।
অমল বলল, “এমন জিনিস কিন্তু আমি দেখি নি কখনও। আমাদের মধুপুরাতেও বাজি পোড়ানো হয়, নন্বেঙ্গলীরা বেশ পয়সা খরচ করে—কিন্তু এরকম না। এখানের কাণ্ডকারখানাই আলাদা। রাজা-টাজার ব্যাপার…” সামান্য থামল অমল। আবার বলল, “মনে থাকবে। এত সুন্দর সব! তবে ওই জোনাকির বাজিটাই বেস্ট। ওআণ্ডারফুল। কি করে হয় বলো ত?”
সামান্য চুপ করে থেকে ভ্রমর বলল, “কি জানি! যারা বাজি তৈরী করে তারাই জানে।”
“আমি তুবড়ি তৈরী করতে পারি কিন্তু। ছেলেবেলায় দাদার সঙ্গে অনেক করেছি।”
“তুবড়ি করতে পুষ্পারাও পারে।” ভ্রমর যেন গলা চেপে হাসল।
অমল বুঝতে পারল। মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরকে দেখল, বলল, “ঠাট্টা করছ?”
“ঠাট্টা না; সত্যি সত্যি বললাম।”
গাড়িটা এবার শহরের এলাকায় এল। মনে হল, হঠাৎ যেন চোখের সামনে আড়াল সরে গেছে। অন্ধকারের মাথার চুল একরাশ আলোর চুমকির মতন দক্ষিণের দিকটা বিন্দু-বিন্দু আলোয় ঝিকমিক করছিল। অমল তাকিয়ে থাকল। একবার মুহূর্তের জন্যে মনে হল, গাড়িটা বোধ হয় ঘুরে ফিরে রাজবাড়ির পিছনের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে; পরে বুঝতে পারল, তারা শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছে।
ভ্রমর পিছু সরে গদির ওপর ভাল হয়ে বসল অবার। একটু বেশী রকম জড়োসড়ো হল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সে সামান্য গড়িয়ে গিয়েছিল। অমল তার পাশে। পিছনের গদিতে তারা পা-দানির দিকে মুখ করে বসে আছে। সামনের দিকে বসে টাঙাঅলা গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনের দিকটা স্বভাবতই বেশ মাটিমুখো। বসে থাকতে- থাকতে গড়িয়ে যেতে হয় গাড়ি ছুটলে।
“আমার কি রকম লাগছে জান?” অমল আবেগভরে বলল, “ঠিক যেন কোনো মস্ত বড় রেল স্টেশনের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। তুমি দেখেছ কখনও? আমি দেখেছি। অন্ধকার—একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার দিয়ে গাড়ি ছুটছে ত ছুটছেই, একরত্তি আলো নেই কোথাও, হঠাৎ এক সময় জানলা দিয়ে চোখে পড়ল দূরে একটা মিটমিটে আলো জলছে, তারপর দেখতে-দেখতে দুটো আলো হল, তিনটে হল, চারটে, ছ’টা, দশটা…বাড়তে-বাড়তে এক সময় দেখি অনেক আলো, মিটমিট করে জ্বলছে দূরে মালার মতন সাজানো…বিউটিফুল লাগে দেখতে।”
ভ্রমর রেলগাড়িতে যাবার কথা ভাবল। তার মনে পড়ল, এবার ছেলেবেলায় মা’র পাশে বসে কোথায় যেন যেতে-যেতে সে কয়েকটা আলো দেখেছিল, আলোগুলো তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছিল।
“আমি একবার আলেয়া দেখেছিলাম।” ভ্রমর বলল।
“আলেয়া! মার্শগ্যাস্…ওকে মার্শগ্যাস্ বলে।”
“কি?”
“এক রকম গ্যাস। জলো স্যাঁতসেঁতে ড্যাম্প জায়গায় এক রকম গ্যাস হয়…” অমল বলল, বলে হঠাৎ চুপ করে গেল, শহরের আলোকমালা কুয়াশার ঝাপসা থেকে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে তার দু-চোখের সবটুকু আগ্রহ কেড়ে নিল।
ভ্রমর আবার রেলগাড়ির কথা ভাবল। মা মারা যাবার পর সে অনেকবার রেলগাড়িতে রাত কাটিয়েছে, কিন্তু কোনো বড় স্টেশনে গাড়ি ঢুকতে দেখে নি। হয়ত সে ঘুমিয়ে থাকত, হয়ত তার জন্যে জানলার দিকের আসন থাকত না। কিংবা খেয়াল করে সে কোনোদিন দেখে নি।
“এরা কিসের বাতি জ্বালায়?” অমল আচমকা শুধলো, “আমাদের মতন তেলের, না মোমবাতির?”
“মোমবাতিই বেশী। কেউ কেউ বাদাম তেল দিয়েও দিয়া জ্বালায়।”
“রাজবাড়িতে ইলেকট্রিক জ্বালিয়েছিল।”
“বড়লোকরা জ্বালায়।”
“তোমরাও বাতি জ্বালাতে পারতে…” অমল হঠাৎ বলল, “সবাই যখন জ্বালায়।”
“আমরা!” ভ্রমর কেমন ইতস্তত করল, চুপ করে থাকল খানিক; শেষে বলল, “মা ভালবাসে না।”
অমল মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরকে দেখবার চেষ্টা করল। অন্ধকারে মুখটা ছায়া-ছায়া হয়ে আছে, নাক মুখ চোখ কিছুই দেখা যায় না স্পষ্ট করে, ধূসর ছবির মতনই দেখাচ্ছে ওকে।
টমটমের কোচোআন পায়ে করে এ-সময় ঘন্টি বাজালো। ধাতব মধুর ধ্বনি এই নির্জনে শব্দতরঙ্গ হয়ে ভাসছিল। মনে হল, ছুটন্ত ঘোড়াটা যেন আরও জোর কদম ফেলছে। গাড়িটা থেমে-আসা-দোলনার মতন দুলছিল। সামনের দিকে, চাকার ওপরে গাড়ির গা লাগিয়ে দুপাশে দুটি বাতি জ্বলছে। অতি মৃদু একটু আলোর আভা ভ্রমরের মাথার দিকে মাখানো আছে, কেমন একটা ছায়া ছুটছে রাস্তা ধরে।
অমলের শীত ধরেছিল এবার। সত্য বেশ হিম পড়ছে। গলা নাক চুলকে এখন কেমন জ্বালা-জ্বালা লাগছে। নাক টানল আবার অমল। আকাশভরা অমাবস্যা, তারা ফুটে আছে, কুয়াশার গুঁড়ো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেন।
“বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।” অমল বলল, “সর্দি ধরে গেল।”
ভ্রমর আরও একটু স্কার্ফ দিল অমলের কোল ঘেঁষে, হাত ঢেকে বসতে বলল মৃদু গলায়।
“তোমার শীত করছে না?” অমল শুধলো।
“করছে।”
“আমার হাত দুটো কনকন করছে। তোমার দেখি—” অমল হাত বাড়িয়ে ভ্রমরের একটি হাত ছুঁয়ে দেখতে গেল। দেখে অবাক হল। “তোমার হাত এত গরম কেন?”
“এই রকমই।”
অমল মনে করতে পারল না ভ্রমরকে নিয়ে রাজ-ময়দান থেকে বেরোবার সময় ওর হাত এত গরম লেগেছিল কি না! বোধ হয় লেগেছিল, তেমন খেয়াল করে নি। ভ্রমরের হাতের উল্টো পিঠ এবং মণিবন্ধ স্পর্শ করে অমল সঠিক ভাবে এই উষ্ণতার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল।
“তোমার জ্বর হয়েছে, ভ্রমর। হাত বেশ গরম।”
“না, জ্বর নয়—” ভ্রমর তাড়াতাড়ি বাধা দিল, “আমার এই রকমই হয়।”
“দেখি, তোমার কপাল দেখি—” অমল ভ্রমরের কপাল দেখার জন্যে হাত বাড়াল।
জ্বর যে, তাতে আর সন্দেহ হল না অমলের। জ্বর না হলে মানুষের গা এমন গরম হয় না। অমলের মনে হল, তার ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায় ভ্রমর যেন শীতে কেঁপে উঠল, জড়োসড়ো হল আরও।
খুব অন্যায় করছে ভ্রমর। অমল সামান্য উদ্বেগ বোধ করল। জ্বর গায়ে নিয়ে ঠাণ্ডায় হিমে বসে বসে বাজি পোড়ানো দেখল এতক্ষণ! কী রকম বোকা মেয়ে!
“দেওয়ালি দেখে দরকার নেই, বাড়ি ফিরে যাই।” অমল বলল, “টাঙাঅলাকে বাড়ি ফিরতে বলো।”
ভ্রমর বুঝি কুণ্ঠিত হল। “দেওয়ালি দেখবে না?”
“না, আর না।”
“খানিকটা দেখে যাও।”
“আমারও শীত করছে।” বলতে-বলতে অমল তার কোল থেকে স্কার্ফটুকু উঠিয়ে ভ্রমরের কোলে ঠেলে দিল। “গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নাও। তুমি একেবারে যা তা! এইভাবে জ্বর গায়ে ঠাণ্ডা লাগায়!”
শহরের মধ্যে গাড়ি এসে পড়েছিল। আলোয় আলো হয়ে আছে সামনেটা। কলরব ও উৎসবের গুঞ্জন কানে আসছিল। আকাশে হাউই উঠে তারা ফুল খসে পড়ছে। বোমা ফাটানোর শব্দ ভেসে আসছিল।
“কই, টাঙাঅলাকে বললে না কিছু?” অমল তাগাদা দিল।
ভ্রমর হিন্দীতে টাঙাঅলাকে পুবের পথ ধরে যেতে বলল। শহরের পাশ কাটিয়ে গেলে রাস্তা অল্প।
উদ্ভাসিত উজ্জ্বল ও উৎসবমুখর শহরটিকে পাশে রেখে টাঙা নিরিবিলি পথ ধরে এগিয়ে চলল।
“বাড়ি গিয়ে আমার জ্বরের কথা বলো না।” ভ্রমর বললে চাপা গলায়।
অমল অবাক হল। “কেন? জ্বর হলে কি তুমি লুকিয়ে রাখো?”
“সব সময় বলি না। মা পছন্দ করে না।”
“বাঃ! অসুখের আবার পছন্দ কি—?”
“কি জানি। মা আমার অসুখে শুনলে রাগ করে।” ভ্রমর যেন মুখে হাত চাপা দিয়ে বলছিল, কথাগুলো অস্পষ্ট ও অতি মৃদু শোনাচ্ছিল।
ভ্রমরকে যেন বোঝবার চেষ্টা করছে অমল, অপলকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছিল। এই রাস্তাটা নিতান্ত অন্ধকার নয়, বাতি আছে ঘন-ঘন, কাছাকাছি-বাড়ি থেকেও আলো এসে পড়ছিল। বাতাস বইছে এলোমেলো, আলোকসজ্জিত গৃহগুলির আলোর শিখা কাঁপছে।
“তোমার কি প্রায় অসুখ করে?” অমল শুধলো।
“করে। আগে করত না; আজকাল মাঝে-মাঝেই করে।”
“কি অসুখ?”
“কে জানে কি অসুখ?”
“ডাক্তার দেখাও না?”
“বেশী হলে দেখাই। বাবা বলেছিল আমায় জব্বলপুরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে।”
“জব্বলপর কত দূর?”
“অনেকটা। আমি জানি না। একশো মাইল দেড়শো মাইল হবে…”
“জব্বলপুরে মন্টুমামা থাকে।”
“তোমার মামা?”
“না, আমার কাকিমার ভাই। আমি একবার দেখেছি; আমাদের ওখানে গিয়েছিল, খুব মজার লোক।”
মামার কথা ভ্রমরেরও মনে পড়ল। মা মারা যাবার পর একবার মামা এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটার নাম মনে করতে পারল না ভ্রমর। চক্ৰধরপুর থেকে কিছুটা যেতে হয়। তখন ভ্রমর ছ’বছর কিংবা সাত বছরের মধ্যে। মামার মুখও মনে পড়ে না। মাথার মাঝখানে সিঁথি ছিল, গোঁফ ছিল, বুক পকেটে ঘড়ি থাকত। মামা রেলগাড়িতে উঠে লাল নীল ফ্ল্যাগ ওড়াত, হুইশল্ বাজাত। মামার কাছে এক-দেড় বছর ছিল ভ্রমর। তারপর মামা রেলে কাটা পড়তে বাবা তাকে নিয়ে এল আবার।
বাবার কাছে ফিরে এসে ভ্রমর দেখল, বাড়িতে দুজন মানুষ; হিমানী-মা আর কৃষ্ণা। বাবা যে হিমানী-মাকে বিয়ে করেছে ভ্রমর বাড়ি এসেই বুঝতে পেরেছিল। কৃষ্ণা তার বাবাকে বাবা বলত, হিমানী-মাকে মা বলত দেখেই ভ্রমর সব বুঝতে পেরেছিল। শুধু বুঝতে পারে নি কৃষ্ণা কি করে হিমানী-মা’র সঙ্গে এল।
পরে সবই বুঝতে শিখল ভ্রমর। তখন তারা যেখানে থাকত সেখানে ভ্রমরের মা’র এক বন্ধু ছিল। মাদ্রাজী বন্ধু। নাম ছিল দেবকী। কৃশ্চান সোসাইটির বাড়িতেই থাকত সিস্টার। দেবকীর কাছ থেকে ভ্রমর অল্পে-অল্পে জানতে পেরেছিল, হিমানী-মা কৃষ্ণাকে সঙ্গে করে এনেছে, কৃষ্ণার বাবা নেই, হিমানী-মা’র স্বামী মারা গেছে দু-বছর আগে। দেবকী সিস্টার তারপর ভ্রমরকে কোলের ওপর বসিয়ে অনেক করে বুঝিয়েছিল নানারকম কথা, বলেছিল; লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে বলেই বলছি ভ্রমর; তোমার মা-বাবার বিচার তুমি করো না; পরের বিচার করতে নেই। যীশু আমাদের কি বলেছেন জানো ত! আচ্ছা, বলছি তোমায়…। প্রভু বলেছেন, পরের বিচার করবার আগে নিজের কথা ভেবো। তোমার নিজের চোখে কুটো, তুমি পরের চোখের কুটো তুলতে যেও না।
ভ্রমরের তখন অত কথা বোঝার বয়স নয়, তবু, সে খানিকটা বুঝেছিল। কিন্তু তার মনে হত, কাবা ভাল কাজ করে নি। তার দুঃখ হত। সে ভাবত, হিমানী-মা এবং কৃষ্ণাকে আমি ভালবাসব। আর বাবাকেও ভালবাসব। কৃষ্ণার বাবা নেই এই দুঃখও সে অনুভব করত কখনও কখনও।
তারপর আজ কত বছর কেটে গেল। ভ্রমর তখন সাত কি আট বছরের ছিল, কৃষ্ণা চার বছরের, এখন ভ্রমর সতেরো বছরের মেয়ে, কৃষ্ণাও কত বড় হয়ে গেছে, বাবা রায়পুরে ছিল চার বছর, সেখান থেকে এখানের কলেজে চলে এল, হিমানী মা’র মাথার চুল পেকে উঠল, কত দিন কেটে গেল, তবু, ভ্রমর কেন ওদের তেমন করে ভালবাসতে পারল না!
“ভ্রমর, এবার আমি রাস্তা চিনতে পেরেছি।” অমল বলল।
ভ্রমর অন্যমনস্ক ছিল, শুনতে পায় নি। মুখ ফিরিয়ে তাকাল অমলের দিকে।
অমল হাত তুলে বাঁ দিকের মস্ত বাড়িটা দেখাল। বলল, “ওই ত কলেজ, কিছুটা এগিয়ে ডান হাতি রাস্তা ধরলে বাড়ি—। ঠিক কি না?”
“হ্যাঁ।” ভ্রমর মাথা নাড়ল আস্তে করে। তার কাঁপুনি লাগছিল খুব। শীত করছিল। চোখ করকর করছে। নিশ্বাসও গরম। আজ আবার তার জ্বর এল।
কলেজ পেরিয়ে এল টাঙাটা। রাস্তায় কারা যেন পোড়া ফানুস ফেলে চলে গেছে, তখনও জ্বলছিল। কিংবা ফানুসটা উড়তে-উড়তে আগুন ধরে গিয়ে এখানে এসে পড়েছে। কোচোআন ঘোড়ার লাগাম টান করে মোড় ঘুরে ডান হাতি পথ ধরল।
ভ্রমর বুকের কাছে স্কার্ফ জড়িয়ে যখন কাঁপুনি সইছিল তখন হঠাৎ কেমন অস্ফুট শব্দ করল।
অমল মুখ ফিরিয়ে তাকাল। “কি হল?”
ভ্রমর গলা আর বুকের কাছটায় কি যেন খুঁজছিল।
“কি হয়েছে?” অমল আবার শুধলো।
“লকেটটা পাচ্ছি না।” ভ্রমর উদ্বিগ্ন ও ভীত গলায় বলল।
“পাচ্ছ না? হারের লকেট?”
ভ্রমর বুঝতে পারছিল না তার গলার হার থেকে সোনার ক্রশটা কেমন করে কখন খুলে পড়ল? বড় ব্যস্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল ভ্রমর।
“লকেটটা কি আলগা ছিল?” অমলও ব্যস্ত হল একটু।
“ঢিলে ঢিলে ছিল।”
“তবে জামাকাপড়ের মধ্যে পড়েছে কোথাও। নামবার সময় খুঁজে দেখব।”
ভ্রমর তখনও লকেট খুঁজছিল। খুঁজতে-খুঁজতে চাপা গলায় বলল, “মাকে বলো না। হারিয়ে গেছে শুনলে আমায় বকবে।”
বাড়ির গেটের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়াল।
২
ভ্রমর ডাকছে শুনে অমল চোখ মেলে তাকাল। তার ঘুম ভাঙল; দেখল, রোদ এসে ঘর ভর গেছে, একটা চড়ুইপাখি ঘরময় ফরফর করে উড়ছে। ভেতর দিকের জানলার ওপাশে পরদা-ঘেঁষে ভ্রমরের মুখ দেখা গেল না। ঘরের দরজা বন্ধ; বাইরের দিকের উত্তরের জানলাটাও খোলা নয়। পুবের জানলার শার্সি একপাট ভেজানো, অন্য পাট খোলা; রোদ আসছে গলগল করে।
বেশ বলা হয়ে গেছে, অমল বুঝতে পারল। অন্য দিন ভ্রমর তাকে রোদ ওঠার সময় জাগিয়ে দেয়। আজ কি ভ্রমর তাকে ডাকতে বেলা করল, নাকি অনেকবার এসে ডাকাডাকি করেছে, অমল উঠছে না দেখে চলে গেছে শেষ পর্যন্ত? অমল সঠিকভাবে কিছু বুঝতে পারল না। তার মনে হল, ভ্রমর অত তাড়াতাড়ি চলে যায় না, অমল জেগে উঠলে জানলার ও-পাশে দাঁড়িয়ে দু-একটা কথা বলে।
বিছানা ছেড়ে উঠতে-উঠতে অমল ভাবল, সে ঘুমের মধ্যে ভ্রমরকে ডাকতে শুনেছে। আজ ভ্রমর তাকে ডাকতে আসে নি; জ্বর গায়ে বেচারী হয়ত এখনও বিছানায় শুয়ে আছে।
শার্ট গায়ে গলিয়ে পুরোহাতা পুলওভারটা পরে নিল অমল। বেশ ঠাণ্ডা। কালকের হিম খেয়ে সামান্য সর্দি মতন হয়েছে। উত্তরের জানলাটা অমল খুলে দিল, হিমভেজা শীতল বাতাসের স্পর্শ তার ভাল লাগল, দু-মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে এই সকালের ঠাণ্ডাটুকু মুখেচোখে মেখে নিল।
বাথরুমে যাবার সময় অমল অর্গানের শব্দ শুনতে পেল; বসবার ঘরে বসে কেউ অর্গান বাজাচ্ছে। নানা পথ ঘুরে অনুচ্চ ভাঙা-ভাঙা সুর ভেসে আসছে করিডোরে। হিমানীমাসিমা, ভ্রমর না কৃষ্ণা কে যে সকালবেলায় অর্গানে গিয়ে বসেছে অমল বুঝতে পারল না। যদি ভ্রমর হয়, অমল ভাবল, তবে তার শরীর ভাল আছে।
কাল বাড়ি ফেরার পর ভ্রমরের সঙ্গে আর দেখা হয় নি। ভ্রমর সোজা নিজের ঘরে শুতে চলে গিয়েছিল। রাত্রে খাবার সময়ও সে আসে নি। কৃষ্ণা বলল, মাথা ধরেছে ভ্রমরের। শুনে আনন্দমেসোমশাই বললেন, বাজি পোড়ানোর বারুদের গন্ধে বড় মাথা ধরে। অমল কিছু বলে নি; ভ্রমর তাকে যা-যা বলেছিল, জ্বর হবার কথা না-বলা, লকেট হারানোর কথা না-জানানো—সব নিষেধই মেনেছে। লকেটটা কি সত্যিই হারিয়ে গেল? কি করে হারাল, আশ্চর্য! ভ্রমর যদি জামার মধ্যে লকেটটা পেয়ে গিয়ে থাকে তবেই রক্ষে—নয়ত তাকে বকুনি শুনতে হবে। ভ্রমর লকেটটা পেয়েছে কিনা জানতে ইচ্ছে হল অমলের। দেখা না হওয়া পর্যন্ত সে কিছুই জানতে পারবে না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে আসার সময় অমল অর্গানের শব্দ আর শুনতে পেল না। সমস্ত বাড়ি সহসা খুব নিঃশব্দ হয়ে গেছে। করিডোর ছায়ায় ভরা; সামনের বাঁ দিকের ঘরে মোটা পরদা দুলছে। ও-ঘরে ভ্রমররা থাকে, ঘরে ভ্রমর আছে কিনা বোঝা গেল না। কোনো সাড়া শব্দ নেই কোথাও।
ঘরে এসে অমল মুখ মুছল, চুল আঁচড়ে নিল। মাথার ওপর এখন দুটো চড়ুইপাখি ভেন্টিলেটারের গর্তে বসে কিচমিচ করছে। বিছানার ওপর কুটো ফেলছে চড়ুই দুটো। অমল ঘর ছেড়ে চলে গেলে হয়ত ওরা আবার কুটোটা কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। আজ ক’দিন ধরে এই ঘরে ওরা একটা বাসা বাঁধার চেষ্টা করছে।
পাজামা সামান্য ঠিক করে নিল অমল। হাত ঘড়িটা তুলে নিয়ে বেলা দেখল। ইস্ আটটা প্রায় বাজে। কাল একেবারে মরার মত ঘুমিয়েছে। ঘড়িতে দম দিতে-দিতে অমল চায়ের জন্যে খাবারঘরের দিকে চলে গেল।
বেশ বেলা হয়ে যাওয়ায় খাবার টেবিল থেকে চায়ের ব্যবস্থা তুলে ফেলা হয়েছিল। ঘরে কেউ ছিল না। অমল কি করবে, কাকে ডাকবে ভাবছিল, এমন সময় হিমানীমাসির পায়ের শব্দ পেল।
হিমানী ঘরে এলেন। তাঁর গায়ে মেটে লাল রঙের গরম চাদর। পায়ের দিকে মাটি লেগেছে শাড়িতে। মিলের সরু পাড়অলা সাদা শাড়ি বা চিকনের সাদা শাড়ি ছাড়া হিমানীমাসিকে আর কিছু পরতে দেখে না অমল। বাইরে বেরুবার সময় সিল্ক পরেন, হয় পাড়ে সরু কাজ করা সাদা সিল্ক, না হয় খুব নরম রঙের ছাপা কোন শাড়ি। ওঁর রঙ আধ-ফরসা, বেশ মোটাসোটা চেহারা; মুখের গড়নটি গোল। মোটা চাপা নাক, ঠোঁটেরও খুঁত আছে, ওপর ঠোঁটের ডানদিকে সামান্য কাটা দাগ। হিমানীমাসীর মাথার পাশের চুলগুলি সাদা হয়ে এসেছে। সিদুঁর নেই মাথায়। অমলের প্রথম-প্রথম খুব খারাপ লেগেছিল। ওঁর চোখে চশমা থাকে সর্বক্ষণ, তবু অমল তাঁর গোল নিষ্প্রভ চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারে, হিমানীমাসি বেশ শক্ত স্বভাবের মানুষ। বড় গম্ভীর, বেশী কথা বলেন না।
অমল চায়ের জন্যে খাবার-টেবিলে চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছিল; হিমানী বললেন, “তুমি বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসো, কৃষ্ণা চায়ের জল নিয়ে যাচ্ছে।”
হিমানীমাসি যে অসন্তুষ্ট হয়েছেন বা বিরক্ত হয়েছেন এমন কিছু বোঝা গেল না। তবু নিজের কাছে নিজেই যেন একটু লজ্জা পেল অমল; বলল, “ঘুম ভাঙতে বড় দেরী হয়ে গেল আজ।”
হিমানী খাবারঘরের একপাশে চলে গিয়ে বড় মতন র্যাকে হাত দিলেন, বললেন, “সকালে উঠে বেড়ালে শরীর ভাল থাকবে।”
অমল আর কিছু বলল না। এই ঘর তার বড় স্যাঁতসেঁতে লাগছিল। আলো প্রায় নেই, রোদও ঢোকে না। বারান্দায় গিয়ে রোদে বসার জন্যে সে উঠে পড়ল।
বারান্দায় যাবার সময় অমল বসার ঘরের মধ্যে দিয়ে গেল। দেখল, অর্গানের ঢাকনা বন্ধ, ঘরে কেউ নেই। দরজা জানলায় নেটের কাজ-করা সুন্দর পর্দা, পাতলা আলো আসছে ঘরে, ছায়া জমে আছে হালকা। ডানদিকে ড্রয়ার, ড্রয়ারের মাথায় র্যাক, ফুল তোলা, র্যাকের ওপর লেসের ঢাকনা, ফুলদানি, ঘড়ি, একটি ধূসর ফটো এবং মার্বেল পাথরের কয়েকটা টুকটাক খেলনা সাজানো। ঘড়ির শব্দটা হঠাৎ যেন কানে গেল। ঘরের প্রত্যেকটি জানলার খড়খড়ি খোলা, শার্সি গুটানো; পরদাগুলো পরিচ্ছন্নভাবে টাঙানো রয়েছে। মধুর মৃদু এক গন্ধ আছে বাতাসে। বোধহয় ধূপ জ্বালানো হয়েছিল। বেতের সোফায় ভ্রমরের বেড়াল গা গুটিয়ে ঘুমোচ্ছে। সামনের দেওয়ালে দরজার মাথায় মেহগনি কাঠের সুন্দর যীশুমূর্তি, ক্রশবিদ্ধ যীশু। এই মূর্তিটার পায়ের তলায় স্কাইলাইটের আলো এসে পড়েছে। এবং আলোর কাছে দেওয়ালে গাঁথা ফুলের ডাঁটার মত দুটি পেতলের মোমদান।
মাথা ঘুরিয়ে অমল দেওয়ালের অন্য পাশে মেরীর বাঁধানো বড় ছবিটাও দেখল, কি মনে করে কাচের পাল্লা দেওয়া ছোট্ট শো-কেসের মধ্যে একটি রুপোর ক্রুশ, চিনেমাটির খেলনা ও কয়েকটি নকশা-করা সামগ্রী দেখল। মাথার ওপর চিনেমাটির ফুলদানি। ফুলদানিতে বাসীফুল তার চোখে পড়ল না। হিমানীমাসি ফুল বদলে দিয়েছেন।
বারান্দায় এসে দাঁড়াল অমল। ঘরদোরের ঝাপসা আলো থেকে বাইরে এসে তার চোখ মুহূর্তের জন্য যেন অত আলো সহ্য করতে পারল না। সে পলক ফেলল। অমল দেখল, সকালের রোদে সামনের সমস্ত কিছু ভেসে যাচ্ছে। বেলা হয়ে এসেছে বলে রোদ গাঢ় হয়ে আসছে, আলো বেশ ঘন এবং ঝকঝকে। সামনের বাগানের ফুলপাতার গায়ে রাতের হিম শুকিয়ে এল। সবুজ রঙটি বেশ উজ্জ্বল ও নির্মল। ফুলগুলি অতি মনোরম দেখাচ্ছিল। অমল এগিয়ে রোদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
জায়গাটা বাস্তবিকই খুব সুন্দর। তাদের বিহার, বিশেষ করে সে যেখানে থাকে, মধুপুরা এতটা সুন্দর নয়। ছোটনাগপুরে অনেক ভাল ভাল জায়গা আছে, লোকজন বেড়াতে আসে, অমল নিজেও রাঁচি-টাচি গিয়েছে, গিরিডিতে থেকেছে, তবু তার কাছে সি পি-র এই জায়গাটা আরও সুন্দর ও শুকনো লাগছে।
এখানে ভিড় ঘিঞ্জি হই-হই একেবারেই নেই, রাশি রাশি আড়ৎ, গুদোম, মাল-লরির বস্তা নামানো ওঠানো, অফিস কাছারি চোখে পড়ে না। খুব ছিমছাম, পরিষ্কার। এসে পর্যন্ত সে মাছি অথবা মশার উৎপাত দেখতে পেল না। এখানকার মাটি এবং গাছপালার চেহারাও কেমন আলাদা। শক্ত অটি সামান্য কালচে মাটি, কখনও কখনও পাথর মেশানো; তা বলে রুক্ষ চেহারা নয়। জায়গাটা পাহাড়ী। দেবদারু, গাছ অজস্র। শিরীষ এবং ঝাউ গাছও অনেক, শাল গাছও আছে। আরও অনেক গাছ দেখেছে অমল—নাম জানে না। তার সবচেয়ে সুন্দর লাগে ওই গাছগুলো দেখতে—কৃষ্ণচুড়ার মতন পাতা, সেই রকমই ডালপালা অনেকটা, তবে অনেক উঁচু, আর ছাতার মতন মাথাটা ছড়ানো। ঝুরির মতন লম্বা-লম্বা ডাঁটি ধরে, যা নাকি ফল নয়, ফুল। ফুলই হবে, কেননা পাতলা ডাঁটির গায়ে আলতা রঙের আঁশ-আঁশ সুতো জড়িয়ে থাকে। ভ্রমর বলছিল, সারা শীতকাল এখন ওই ফুল ফুটবে, বসন্তের শেষে সব ঝরে যাবে।
বারান্দার ওপর থেকে লাফ মেরে অমল বাগানে নেমে পড়ল। সবুজ ঘাস রোদের আভায় মসৃণ ও মোলায়েম দেখাচ্ছে। গাঢ় হলুদ গাঁদা ফুল ফুটেছে একপাশে, গোল-মতন কেয়ারি করা জায়গাটায় গোলাপ ঝাড়, অন্য পাশে মরসুমী ফুলের চৌকোনো খানিকটা জায়গা। গোলাপফুল ফুটে আছে কয়েকটা; শীতের বাতাস পেয়ে মরসুমী ফুলগুলি থোকা-থোকা ফুটে উঠছে। সাদা আর বেগুনী রঙ মেশানো জুঁই ফুলের মতন ফুলগুলোকে কি যেন বলে ভ্রমররা। নামটা মনে থাকে না। আর একটা ফুল, খইয়ের মতন ধবধবে সাদা আর ছোট-ছোট, গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুটে থাকে। তাকে এরা বলে ডিউ-ড্রপস্।
এই বাগানে অমলের খুব পরিচিত কয়েকটা গাছ রয়েছে, নয়ত সে বোকা হয়ে যেত তার মনে হতে পারত, জায়গাটা বুঝি বিদেশ। যেমন ওই কুলগাছ, কুলগাছটা ভরতি হয়ে ফুল ধরেছে। কুলতলার দিকে একেবারে সাদামাটা করবী গাছ কয়েকটা কৃষ্ণা একটা দোলনা টাঙিয়ে রেখেছে ওদিকে—শিরীষ গাছের ডালে।
অমল পায়চারি করতে-করতে দোলনার কাছেই যাচ্ছিল; ডাক শুনে ফিরে তাকাল। কৃষ্ণা ডাকছে।
অমল বারান্দার দিকে ফিরল।
বেতের গোল টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে কৃষ্ণা চেয়ারে বসে আছে। অমল অন্য একটা চেয়ার টেনে বসল।
“ওকি, তোমার মুখে কিসের দাগ ওটা?” অমল কৃষ্ণার ডান গালে কালশিরে পড়ে যাওয়ার মতন দাগ দেখে বলল।
সুজির প্লেট এগিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণা, দিয়ে ডিমের ওমলেটে গোলমরিচ ছড়িয়ে, দিচ্ছিল। বলল, “কীট কেটেছে।”
“কীট?” অমল প্রথমটায় কেমন বুঝতে পারে নি। পরে বুঝল। বুঝে হেসে ফেলল। “পোকা কামড়েছে?”
কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। কাপে চা ঢালতে-ঢালতে বলল, “রাতে কেটেছে কাল। দেওয়ালিতে কিজলা পোকা হয়। ডোরা ডোরা দেখতে।”
অমল মজা পাচ্ছিল। কৃষ্ণার কথা বলার ধরনটাই এইরকম, অর্ধেক হিন্দী মেশানো বাঙলা কথা বলবে। এ-বাড়ির সকলেই দু-পাঁচটা এইরকম কথা বলে, কিন্তু, কৃষ্ণা যেন বড় বেশী বলে। তার কারণ, কৃষ্ণার বন্ধুবান্ধবরা সকলেই প্রায় অবাঙালী। সে যে-স্কুলে পড়ে সেখানে নাকি মাথাগোনা বাঙালী মেয়ে। দিনের পর দিন এদিকে থাকতে-থাকতে, এদের সঙ্গে মিশতে-মিশতে এইরকম হয়ে গেছে কৃষ্ণা।
“ওষুধ দিয়েছ?” অমল সুজি খেতে-খেতে শুধলো।
“ডেটল লাগিয়েছি।”
“আমার কাছে অয়েন্টমেন্ট আছে। ভাল অয়েন্টমেন্ট। লাগিয়ে দিও, তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।”
কৃষ্ণা চায়ে দুধ চিনি মিশিয়ে এগিয়ে দিল। দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে একবার বারান্দাটা দেখে নিল। তারপর অমলের দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন কোনো অপরাধ করার আগে বলে নিচ্ছে। বলল, “আমি আধা কাপ খাই।”
“আধা কেন, পুরো কাপ খাও। চা কি কম আছে?”
“না।” কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। “মা দেখলে চিল্লাচিল্লি করবে। সকালে খেয়েছি কিনা?”
অমল হেসে ফেলল। হিমানীমাসির কাছে প্রশ্রয় নেই বে-নিয়মের। সকালে চায়ের টেবিলের পাট চুকলে দ্বিতীয়বার চা পাওয়া যায় না।
কৃষ্ণা অন্য পেয়ালায় চা ঢেলে নিল অর্ধেকটা। সতর্ক চোখে বারান্দাটা আরও একবার দেখে নিল।
“তুমি খাও, আমি গার্ড দিচ্ছি।” অমল হেসে বলল।
চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলল কৃষ্ণা। অমল হাসিমুখে ওকে দেখছিল। হিমানীমাসির মতনই মুখের গড়ন অনেকটা, তবে কৃষ্ণার চোখ দুটি পরিষ্কার। মোটা ভুরু, বড় বড় চোখ। গোলগাল চেহারা। রঙ কালো। অমল দেখেছে কৃষ্ণা শাড়ি পরে না। স্কার্ট ব্লাউজ, না হয় এদেশী মেয়েদের মতন কামিজ আর পা-আঁটো পাজামা; মাথার মাঝখানে সিঁথি করে দুপাশে দুটো বিনুনি ঝুলিয়ে রাখে।
“মেসোমশাই কোথায়?” অমল শুধলো।
কৃষ্ণা গায়ের গরম জামায় আলতো করে তার চিবুকে ঘষে নিল। “শহরে গেছে।”
শহরে গেছেন? অমলের কেন যেন অন্য রকম মনে হল। এখন তাঁর শহরে যাবার কথা নয়। সকালের এ-সময়টা হয় তিনি বাগানের পরিচর্যা করেন, নয় বই-টই পড়েন। কলেজের জন্য তৈরী হন। ভ্রমরের চিন্তাটাই সহসা অমলকে আবার উদ্বিগ্ন করল।
অমল বলল, “ভ্রমর কই? তাকে দেখছি না সকাল থেকে?”
“শুয়ে আছে। জ্বর।”
“জ্বর!”
“ওর হরদম বিমার হয়।” কৃষ্ণা গা করল না যেন। ভ্রমরের জ্বরজ্বালা সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ নেই।
“কতো জ্বর? খুব বেশী?” অমল জিজ্ঞেস করল।
কৃষ্ণা বলতে পারল না। সে জানে না কতটা জ্বর। সকালে ভ্রমর আগে ওঠে। আজি সে ঘুমোচ্ছিল। কৃষ্ণা উঠে দ্রমরকে ডাকতে গিয়ে দেখল, লেপের মধ্যে মুখ ঢেকে কুঁকড়ে ভ্রমর ঘুমোচ্ছে; ভ্রমর উঠল না; বলল, তার জ্বর হয়েছে।
অমলের খুব খারাপ লাগল। এ-বাড়ির কেউ ভ্রমরের অসুখ-বিসুখ চেয়ে দেখে না; গ্রাহ্য করে না যেন। মাসিমা অমলকে ভ্রমরের অসুখের কথা কিছু বললেন না। ভ্রমর ঠিকই বলেছিল, তার অসুখ শুনলে এরা সবাই অসন্তুষ্ট হয়।
চা খেতে-খেতে অমল এতক্ষণে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারল, আজ ভ্রমর তাকে সকালে উঠিয়ে দিতে আসে নি, ভ্রমর বিছানায় শুয়ে আছে বলে কৃষ্ণা তাকে চা করে দিতে এসেছে।
চোখ তুলে কৃষ্ণাকে দেখতে-দেখতে অমল ভাবল, ভ্রমর লকেটটা ফিরে পেয়েছে কিনা কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? সামান্য ভাবল। মনে হল, থাক, জিজ্ঞেস না করাই ভাল; কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে ভ্রমর অসুবিধেয় পড়বে।
মেসোমশাই শহরে ডাক্তারকে খবর দিতে গেছেন বলেই অমলের মনে হল। বলল, “মেসোমশাই ডাক্তারকে খবর দিতে গেছেন?”
“না।” কৃষ্ণা মাথা নাড়ল। সে জানে না; তেমন কোনো কথা সে শোনে নি।
এমন সময় বাগানের দিকে কাঠের ফটক খুলে লীলা এল। কৃষ্ণার বন্ধু। লেডিজ বাইসাইকেল-এ চেপে এসেছে। একটা পাক খেয়ে পলকে বারান্দার সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল। বেল বাজাতে-বাজাতে ডাকল কৃষ্ণাকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে কৃষ্ণা যেন ছুটে সিঁড়ির কাছে চলে গেল। অমল লীলাকে চেনে—প্রায় রোজই সে এ-বাড়িতে কৃষ্ণাকে ডাকতে আসে, কৃষ্ণার বন্ধু। অত্যন্ত চঞ্চল সপ্রতিভ মেয়ে। দোলনায় যখন দোলে মনে হয় দড়ি ছিঁড়ে শূন্য থেকে ছিটকে পড়বে; সাইকেল চালায় এত জোরে যে ভয় হয় হুড়মুড় করে কারো গায়ে গিয়ে পড়ল বুঝি। মেয়েটা নাকি দু-বার হাত ভেঙেছে। একদিন অমল ওর সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেছিল। বেশ ভাল খেলে লীলা। কৃষ্ণাদের স্কুলের প্লেয়ার।
লীলারা কাছেই থাকে। এ-বাড়ির পরের পরেরটায়। ওরা বুঝি দিল্লির লোক। লীলার বাবা এখানকার কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল। মেসোমশাই বলেন, এবার প্রিন্সিপ্যাল হবে, খুব কাজের লোক।
কৃষ্ণা এবং লীলা দুজনে কি বলাবলি করল। তারপর কৃষ্ণা বারান্দার দিকে ফিরল, তরতর করে চলে গেল। লীলা বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ভাইজী নমস্তে। বলে হাসল। অমলও হাসল। সামান্য পরেই কৃষ্ণাকে ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখল অমল।
তারপর দুই বন্ধু সাইকেলে চেপে চোখের পলকে উধাও। কয়েকটা পাখি ছিল বাগানে। একে অন্যের ডানায় ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর দিচ্ছিল, খাবারের দানা খুঁটে নিচ্ছিল মুখ থেকে। তারা কেউ গাঁদাফুলের ঝোপের দিকে চলে গেল, কেউ উড়ে কলাগাছের পাতার আড়ালে গিয়ে বসল। কাক ডাকছিল কোথাও। অমলের হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ল। মাকে চিঠি লিখতে হবে আজ। বউদিকেও চিঠি দিতে হবে। আসবার সময় বউদি বলেছিল, তোমার ভাল লাগবে না ও-সব জায়গা, দু-দিন পরেই পালিয়ে আসবে; তার চেয়ে বেনারসে দিদিমণির কাছে যাও, দু-মাস তবু থাকতে পারবে। বউদিকে লিখতে হবে, এই জায়গাটা অমলের খুব ভাল লাগছে। দু-মাস সে এখানে অনায়াসে থাকতে পারবে। শরীর সেরে গেলে ফেরার সময় অমল জব্বলপুর যাবে, মন্টুমামার কাছে ক’দিন থাকবে, তারপর বাড়ি ফিরবে। ততদিনে জানুয়ারি মাস পড়ে যাবে। মার্চ-এপ্রিল থেকে অমলের আবার তোড়জোড় শুরু, রেলের মেকানিক্যাল ওআর্কশপে তিন বছর ট্রেনিং নিতে হবে। বাবা বলেছেন, ভাল করে কোর্সটা শেষ করতে পারলে প্রসপেক্ট রয়েছে। অমলের ইচ্ছে, বাবার মতন সেও রেলের চাকরিতে থাকে, বাবার মতন অফিসার হয় একদিন।
বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনে অমল মুখ ফেরাল। হিমানীমাসি। তাঁর পিছনে এ-বাড়ির আয়া, কালো বেঁটে শক্ত সমর্থ দেখতে, বিদঘুটে নাম ওর, টিসরি আব্রাহাম। ভ্রমর বলে, ওরা সব মিশনারী পুয়োর হোমের মেয়ে, কে কোথাকার লোক বোঝা যায় না, মিশনারীরা মানুষ করেছে, তারপর বড় হয়ে যে যার রুজি-রোজগার করে বেঁচে আছে।
হিমানীমাসির পিছু পিছু আয়া একরাশ কাচা কাপড় এনেছিল বালতি করে, মাসির কথামতন বাগানের ঘাসে একে-একে মেলে দিতে লাগল।
অমল উঠল। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, ভ্রমরের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত। এতক্ষণ বসে না থেকে তার ভ্রমরের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। অমল নিজের বোকামি এবং গাফিলতির জন্যে গ্লানি বোধ করল।
ভ্রমরের ঘরে এসে আস্তে করে ডাকল অমল, তারপর পরদা সরিয়ে মুখ বাড়াল।
ভ্রমর বিছানায় বসে আছে; হাঁটু গুটিয়ে মুখ ঢেকে। বড়-বড় ফুল আঁকা লেপটা তার কোমর পর্যন্ত টানা। ঘরে রোদ এসেছে পর্যাপ্ত, অনেকখানি রোদ ভ্রমরের বিছানায় ও তার পিঠে ছড়িয়ে আছে। অমল ঘরে ঢুকল। পায়ের শব্দে মুখ তুলল ভ্রমর।
সারা রাতের জ্বরে মুখ যেন পুড়ে শুকিয়ে গেছে ভ্রমরের। চোখের চারপাশ টসটস করছিল, পাতলা ঠোঁট দুটিতে যাতনা মেশানো। ক্লান্ত অবসন্ন চোখ তুলে ভ্রমর অমলকে দেখল দু-পলক। তারপর অসুস্থ অবশ হাতে কোমর থেকে লেপ আরও একটু উঁচুতে তুলে নিল। নিয়ে কেমন বিব্রত ভঙ্গিতে এলোমেলো কাপড়টা গায়ে গুছিয়ে নিল।
অমল বিছানার দিকে দু-পা এগিয়ে গেল। একটা রাতে কী চেহারা হয়ে গেছে ভ্রমরের, কতদিনের কালি যেন তার মুখে গালে বসে গেছে, কপালে একরাশ উড়ো চুল, কাঁধের কাছে বিনুনি খুলে চুলগুলি ছড়িয়ে রয়েছে, মাথা কান ও গলার ওপর চুলের আঁশ উড়ছে যেন।
“খুব কান্ড করলে! দেখতে দেখতে এত জ্বর!” অমল হালকা করে বলার চেষ্টা করল।
ভ্রমর ততক্ষণে খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছে। সামান্য আড়ষ্ট হয়ে বসে বাঁ হাত দিয়ে চোখ মুখ কপাল থেকে উড়ো চুলগুলো সরাতে লাগল।
ঘরে দু-পাশে দুটি লোহার স্প্রিঙ্ দেওয়া খাট। কৃষ্ণার বিছানার দিকে এগিয়ে অমল ধার ঘেঁষে বসল। বলল, “এখন কেমন আছ?”
“জ্বর আছে।” ভ্রমর বলল নীচু গলায়, মুখ না তুলে।
“কত জ্বর?”
“জানি না।”
“জ্বরটা দেখ তবে। থার্মোমিটার দাও।” অমল সরাসরি ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে- ছিল। বাসী এলোমেলো বিছানায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে-থাকা রুগ্ণ কৃশ ভ্রমরের জন্যে তার বড় দুঃখ হচ্ছিল। ভ্রমরের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, এখনও তার বেশ জ্বর আছে। “থার্মোমিটার নেই বাড়িতে?” অমল শুধলো। সে যেন একটু অধৈর্ম হয়েছে।
“আছে। এ-ঘরে নেই।”
“কোথায় আছে বলল, আমি নিয়ে আসছি।”
ভ্রমর মুখ তুলল। তার চোখে কেমন ভীরুতা ও শঙ্কার ছায়া ভাসছিল। হয়ত কোনো কারণে সে জ্বর দেখতে চায় না। কি বলতে গেল, গলার স্বর উঠল না, ভেঙ্গে গেল। একটু অপেক্ষা করে গলা পরিষ্কার করে নিল ভ্রমর, বলল, “এখন থাক।”
“থাক্! বা রে! এখন থাকবে কেন? তুমি জ্বর দেখবে না?” অমল অবাক।
ভ্রমর ভাবল একটু। বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে কপালের চুল সরাল, বলল, “এখন আমি মুখটুখ ধুতে যাব।”
অমলের ভাল লাগল না। জ্বর নিয়ে ভ্রমর এত লুকোচুরি করে কেন? কিসের ভয় তার? কেউ কি ইচ্ছে করে অসুখ বাধায়? না লুকিয়ে রাখলেই অসুদ্ধ সারে!
ভ্রমর হাই তুলল। বিছানা ছেড়ে উঠবে যেন এইবার।
লকেটের কথাটা হঠাৎ মনে হল অমলের। ভ্রমরের চোখের দিকে তাকাল, বলল, “তোমার লকেটটা পেয়েছ?”
মাথা ডান পাশে কাত করে ভ্রমর বলল, “পেয়েছি।”
অমলের কোথায় যেন একটা দুশ্চিন্তা ভাসছিল। লকেট পাবার খবর শুনে সেই দুশ্চিন্তা সরে গেল। খুশী হয়ে অমল শুধলো, “কোথায় পেলে?”
“জামার মধ্যেই।” ভ্রমর অস্পষ্ট গলায় বলল। বলে পিঠের পাশ থেকে বালিশ সরাল। তার মনে হল, মা কাছাকাছি কোথাও রয়েছে, পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভ্রমর অস্বস্তির গলায় বলল, “এখন মুখটুখ ধুতে যাব। তুমি…”
অমল উঠল। এই ফাঁকে সে বাড়ির চিঠিগুলো লিখে ফেলবে ভাবল। বলল, “তুমি মুখ ধুয়ে এস, আমি ঘরে গিয়ে চিঠিটা লিখে ফেলি। তারপর এসে বসবোখন।”
ভ্রমর হঠাৎ বলল, “এখন না। বিকেলে—”
“বিকেলে?” অমল কথাটা বুঝল না।
ভ্রমর ইতস্তত করে বলল, “জ্বর হয়ে শুয়ে আছি, গল্প করলে মা বকবে। বিকেলে—”
“বিকেলে জ্বর থাকবে না?” অমল হেসে ফেলল।
“মা থাকবে না।”
“কোথায় যাবেন?”
“চার্চে। আজ রবিবার না!”
অমল দু-মুহূর্ত অন্যমনস্কভাবে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে কি ভাবল। বুঝতে পারল, ভ্রমর আজ চার্চে যাবে না; তার জ্বর। বাড়িসুদ্ধ আর সবাই চার্চে যাবে।
অমল আর কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বিকেলের রোদ থাকতে-থাকতেই হিমানীরা চলে গেলেন। চার্চ অনেকটা দূরে, মাইল পাঁচেক প্রায়। আনন্দমোহন গরম পোশাক ভেঙে পরেছেন আজ, কোটের বাটন-হোলে ফুল গুঁজেছেন; হিমানী সিল্কের হালকা-ছাপা শাড়ির ওপর গরম শাল নিয়েছেন, পাতা কেটে চুলে বাঁধার মতন করেই চুল বেঁধেছেন সযত্নে। কৃষ্ণা স্কার্ট ব্লাউজ আর গরম শর্ট কোট পরেছে, জুতো মোজা, বিনুনিতে রিবন বেঁধেছে ফুল করে। টাঙা এসেছিল, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার মতন—পরিচ্ছন্ন ফিটফাট হয়ে গোটা পরিবারটি চার্চে চলে গেল।
অমল বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল তখন ইংরেজী উপন্যাস, আনন্দমোহন আনিয়ে দিয়েছেন কলেজ লাইব্রেরী থেকে। হিমানীদের চলে যেতে দেখল অমল, টাঙাটা চলে গেলে সে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ফাঁকা চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
শীতের শেষবেলা দেখতে দেখতে মরে এল, আলো নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হল। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে পোশাক বদলে নিল অমল। গরম পুল- ওভারটা পরার সময় দেখল, বাইরে ছায়া জমেছে, পাতলা অন্ধকার ক্রমশ ঘন হয়ে এল।
ভ্রমর বোধ হয় অপেক্ষায় বসেছিল। অমল ঘরে ঢুকে দেখল, আয়া ঘর পরিষ্কার করে বিছানা পেতে চলে গেছে। ঘরটা মাঝারি ধরনের, দু-বোনের দুটি বিছানা দু-পাশে, পড়ার টেবিল একটা, গোটা-দুই চেয়ার; একপাশে কাঠের ছোট আলমারি, আলনায় দুই বোনের কাপড়জামা গোছানো, ড্রয়ারের মাথায় আয়না লাগানো, টুকটাক কিছু খুচরো জিনিস সাজানো রয়েছে।
অমল বলল, “দেখতে-দেখতে কেমন সন্ধে হয়ে এল। এখন যেন আরও তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে আসে।”
বিছানার ওপর অলসভাবে বসেছিল ভ্রমর। তার মুখ চোখ সকালের মতন অবসাদে ময়লা নয়, কালো শুকনো চুলগুলি আঁট করে বাঁধা, শাড়ি জামা গোছানো। তবু শুকনো ও মলিন ভাবটুকু মুখে পাতলা ছায়ার মতন লেগে আছে। মনে হচ্ছিল, ভ্রমর সকালের চেয়ে এখন অনেকটা ভাল।
ভ্রমর সামান্য গুছিয়ে বসল। তার পিঠের দিকের জানলা দিয়ে বাতাস আসছিল বলে গায়ের গরম চাদর ঘন করে জড়িয়ে নিল।
অমল বলল, “জ্বর দেখেছিলে?”
“না।” ভ্রমর ছোট করে জবাব দিল।
“না কি! তখন যে বললে—”
“সেরে আসছে!…এখন বেশী জ্বর নেই।”
“তবু জ্বর দেখা উচিত—” অমল এগিয়ে গেল, “কই, হাত দেখি—”
ভ্রমর সঙ্কোচ অনুভব করল বুঝি। বলল, “কাল সকালে আর জ্বর থাকবে না। তুমি বসো।”
অমল ভ্রমরের হাত স্পর্শ করে দেখল, কপালে হাত দিল। মনে হল, জ্বরটা কমছে। ভ্রমর চুপ করে বসে থাকল। এ-সময়, যখন অমল তার কপালে হাত রেখেছিল, তখন ভ্রমরের বুকের মধ্যে কেমন যেন ভার হয়ে আসছিল।
“জ্বর কম।” অমল বলল। বেশ বিচক্ষণ ডাক্তারের মতন তার ভাবভঙ্গি। জ্বর দেখা হয়ে গেলে অমল ভ্রমরের মুখোমুখি হয়ে তার পায়ের দিকে বসল। ভ্রমর আরও একটু পা গুটিয়ে নিল।
সামনে জানলা; অমল জানলার দিকে তাকিয়ে বাইরের সন্ধে দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “নতুন জায়গায় সন্ধেবেলা কেমন যেন লাগে, না ভ্রমর!…মন কেমন করে।”
ভ্রমর কথাটা বোঝবার জন্যে অমলের মুখ লক্ষ করল। ওকে অন্যমনস্ক, উদাস লাগল বুঝি। ভ্রমর ভাবল, বাড়ির জন্যে বোধ হয় অমলের মন কেমন করছে। বলল, “বাড়ির জন্যে মন খারাপ লাগছে!”
“বাড়ি! না, বাড়ির জন্যে নয়।” বলে অমল জানলা থেকে ঝোখ সরিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। এমরের মুখটি ছোট, কপাল সরু, গাল দুটি পাতার মতন, চিবুক একেবারে প্রতিমার ছাঁদ। রঙ শ্যামলা। ঘন টানা টানা ভুরুর তলায় কালো কালো ডাগর দুটি চোখ। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট। মানুষের মুখ দেখলে এত মায়া হয়—অমল জনত না। ভ্রমরের মুখ দেখে অমলের কেন যেন মনে হয়, এমন মুখ আর সে দেখে নি। ফুলের মত ভাল। সুন্দর, দুঃখী, শান্ত মুখ।
অমলের হঠাৎ কেন যেন মনে হল, ভ্রমরের জন্যেই তার মন কেমন করছে।
“বাড়িতে চিঠি লিখেছ?” ভ্রমর জিজ্ঞেস করল।
“উঁ! চিঠি! হ্যাঁ, লিখেছি। আজ রোববার, পোষ্টঅফিস বন্ধ।” বলে অমল কি ভেবে হাসি-ভরা মুখ করে বলল, “বাড়িতে থাকলে আজ দু-দুটো কাপড় পেতাম; খুব খাওয়াদাওয়া চলত।”
“কেন?”
“বা রে, আজ ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটায় কিছু পাওয়া যায়।” অমলের হঠাৎ বুঝি মনে হল ভ্রমর হয়ত ভাইফোঁটা বোঝে না। বলল, “ভাইফোঁটা কাকে বলে তুমি জানো?”
“দেখেছি।”
“তবে ত জানোই। কালীপুজোর পর পরই ভাইফোঁটা।” কালীপুজোর কথাতেই বোধহয় অমল কি ভেবে আচমকা বলল, “ভ্রমর, তুমি…তুমি খুব ভগবান বিশ্বাস করো, না—?”
ভ্রমর যেন কিছুক্ষণ কেমন অবাক হয়ে থাকল। তারপর ঘন চোখ তুলে বলল, “ভগবান বিশ্বাস না করলে পাপ হয়। যীশু ভগবানে বিশ্বাস রাখতে বলেছেন।”
বলে ভ্রমর অন্ধকারে দেওয়ালের দিকে তাকাল। যীশুর ছবি ছিল দেওয়ালে।
অমল অভিভূতের মতন বসে থাকল।
৩
সন্ধ্যাবেলায় বসার ঘরে আনন্দমোহন ও হিমানী বসেছিলেন। অমলরা এইমাত্র এসে বসল; বেড়াতে বেরিয়েছিল, সবে ফিরেছে।
আনন্দমোহন মাঝখানের সোফায় বসে; বিশ্রাম-সুখ উপভোগের শৈথিল্য তাঁর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে। নতুন ইলাস্ট্রেটেড উইক্লির পাতা ওলটাচ্ছিলেন অলসভাবে, অমলদের পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখলেন।
“কতদূর গিয়েছিলে?” আনন্দমোহন জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর ডান হাতের আঙলে সিগারেট পুড়ছিল।
প্রশ্নটা কাকে করা হল কেউ বুঝল না। অমল, ভ্রমর, কৃষ্ণা—তিনজনের যে কোনো একজনকে করা চলতে পারত। অমলই জবাব দিল, “এই কাছেই বেড়াচ্ছিলাম, রাস্তায়—।”
আনন্দমোহন সিগারেটের ছাই ফেলে একমুখ ধোঁয়া গলায় নিলেন। “এখানকার কিছু দেখলে? মিউজিআমে গিয়েছিলে?”
“না। যাব।”
“যাও একদিন, দেখে এসো। মিউজিআমটা ছোট, রিসেন্টলি হয়েছে; তবু দেখা উচিত। মুসলিম এজের কয়েকটা আর্ট-ওয়ার্ক আছে দেখার মতন—” কথাটা শেষ করে উনি ভ্রমরের দিকে তাকালেন। “তোরা এখানকার গাইড, ওকে কোথাও নিয়ে যাস না কেন?” হাতের কাগজটা নামিয়ে রেখে দিলেন সামনে।
ভ্রমর সামান্য তফাতে দেরাজের কাছে দাঁড়িয়েছিল। সোফায় আড়াল পড়ায় তার সামান্য বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো ভঙ্গিটা নজরে পড়ছিল না। ভ্রমর কথাটা শুনল, বাবার দিকে তাকিয়ে থাকল দু-পলক, কোনো জবাব দিল না।
“এখানে দেখার জিনিস নানারকম—” আনন্দমোহন অমলের দিকে তাকালেন আবার, যেন কি-কি দেখা দরকার তার বিবরণ দিচ্ছেন এমন গলা করে বললেন, “জল-চাঁদমারি দেখেছ? আমাদের এখানের ওল্ড প্যালেসে যাও একদিন, প্যালেস কম্পাউণ্ডের মধ্যে জু আছে একটা, ভ্যারাইটি অফ বার্ডাস্ দেখবে। এ ছাড়া, ওল্ড টাওয়ার—একশো দেড়শো বছরের পুরনো, ভেঙেচুরে জঙ্গল হয়ে পড়েছিল, আজকাল সারিয়ে-টারিয়ে বেশ করেছে। তা কম উঁচু নয়, দু-আড়াইশো সিঁড়ি; আমি বাবা উঠতে পারি নি, বয়স হয়ে গেছে, এখন কি আর…” আনন্দমোহন প্রবীণত্বের স্মিত হাসি হাসলেন।
ওঁর বয়স এখন পঞ্চাশ। চেহারায় আরও একটু বেশী মনে হয়। ছিপছিপে গড়ন, রঙ ময়লা। মাথার চুল কোঁকড়ানো, বেশীর ভাগই সাদা। মুখে লম্বা ধরনের, গালের হাড় চোখে পড়ে। নাকের ডগা একটু বেশী রকম মোটা ও ফোলা, ঠোঁট পুরু। চোখে ক্যারেট গোল্ডের চশমা। আনন্দমোহনকে সাদাসিধে সরল নির্বিরোধ শান্ত প্রকৃতির মানুষ বলেই মনে হয়।
“আমি জঙ্গল-চাঁদমারি দেখেছি।” অমল বলল।
“দেখেছ!…কেমন লাগল? ভাল নয়!…আমার, বুঝলে অমল, ওই জায়গাটা বেশ মনের মতন। কোয়্যাট, পিসফুল…। ওই জল-চাঁদমারি নিয়ে একটা গল্প আছে এখানে।”
জল-চাঁদমারির গল্প অমল ভ্রমরের কাছে শুনেছে। গল্পটার কথায় সে ভ্রমরের দিকে তাকাল। ভ্রমর এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে কেন বসছে না অমল বুঝতে পারল না। ওর অস্বস্তি হচ্ছিল। জ্বর থেকে উঠে ভ্রমর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিন-চারদিন কেটে গেল এখনও শরীরে জুত পাচ্ছে না। এক রাত্রির অসুখ তার অনেকখানি শক্তি শুষে নিয়েছে। ভ্রমরের শরীরের জন্যেই আজ অমল কাছাকাছি বেড়াচ্ছিল, দূরে কোথাও যায় নি। কৃষ্ণা তাই বিরক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে না বেড়িয়ে লীলাদের বড়ি চলে গিয়েছিল। অমল অস্বস্তি বোধ করে ভ্রমরকে বার কয়েক দেখল এখন। ভ্রমরের বসা উচিত, এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর পায়ে কষ্ট হয়; ওর বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
“চাঁদমারি হয় ডাঙায়—” আনন্দমোহন বললেন, “এখানে জল-চাঁদমারি কেন! গল্পটা যা বানিয়েছে এরা—”
“ভ্রমর আমায় বলেছে।” অমল বলল, “শীতকালে ওই ঝিলে অনেক পাখি আসত নানা দেশ থেকে, চাঁদনিরাতে নৌকো চড়ে রাজবাড়ির লোক আর সাহেব- মেমরা পাখি মেরে হাতের টিপ ঝালাত। একবার—”
একবার কি ঘটেছিল আনন্দমোহন অমলকে আর বলতে দিলেন না, নিজেই বললেন। শোনা গল্প অমল আরও একবার শুনল। শীতকালে রাজারাজড়াদের নেমন্তন্ন পেয়ে শিকারে আসত সাহেব-সুবোরা। বনজঙ্গলে শিকার চলত বাঘ ভাল্লুকের, আর ওই ঝিলে ছোট ছোট বোট ভাসিয়ে ওরা জ্যোৎস্না রাত্রে ফুর্তি করত, হাতের টিপ দেখাত, অকারণ আনন্দ পেতে ঘুমন্ত পাখিদের ওপর বন্দুকের ছররা গুলি চালাত। একবার বিশাল একঝাঁক অদ্ভূত পাখি, হিংস্র বন্য ভয়ঙ্কর বিহঙ্গরা তার শোধ নিল। পাঁচ-সাতশো পাখি জ্যোৎস্নাকিরণ আচ্ছন্ন করে এক শিকারী সাহেবের সারা গা কামড়ে-কামড়ে রক্তাক্ত করে মেরে ফেলল, মেমসাহেবের একটি চোখ ঠূকরে অন্ধ করে দিল। তারপর থেকেই ওই ঝিলে পাখি শিকার বন্ধ।
আনন্দমোহন গল্প শেষ করলেন যখন, তখন অমল জল-চাঁদমারির এখনকার অবস্থাটা মনে-মনে দেখছিল। ঝিলটা সত্যিই মস্ত বড়, ডাঙায় অজস্র গাছপালা, কোথাও কোথাও বেতঝোপ, জলে সবুজ ভেলভেটের মতন পুরু, শ্যাওলা, তিরতিরে পাতা, জলজ উদ্ভিদ, আর রাশি রাশি পদ্ম শালুক। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। শান্ত নিস্তব্ধ নির্জন হয়ে থাকে জায়গাটা।
“আমি সেদিন গিয়েছিলাম। এবারে এখনও পাখি আসে নি।” অমল বলল।
“শীত পড়ে গেছে, এইবার আসবে—” আনন্দমোহন বললেন, “তবে শুনেছি আগের মতন ভ্যারাইটি আর আসে না।” চলে-যাওয়া পাখিগুলোর জন্যে যেন সামান্য বেদনা অনুভব করলেন উনি, সামান্য থেমে কি ভাবতে-ভাবতে বললেন, “আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি, আমাদের বাঁকুড়ার দিকে ধানকাটা হয়ে যাবার পর শীতে এক- এক সিজন-এ বহু পাখি এসে যেত, মাঠে বসত, গাছপালায় থাকত, তারপর আবার উড়ে যেত দু-চার দিন পরেই। ওরা কোথায় যেত কে জানে, যাবার পথে আমাদের গ্রামট্রামের দিকে রেস্ট নিতে থামত বোধ হয়—” আনন্দমোহন হাসার মতন মুখ করলেন সামান্য।
ভ্রমর তখনও দাঁড়িয়ে আছে। অমল অধৈর্য হয়ে উঠছিল। হিমানী একপাশে বসে উল বুনে যাচ্ছেন, কৃষ্ণা বসে বসে কোলের ওপর ইলাস্ট্রেটেড উইকলি টেনে নিয় ছবি দেখছে।
“বুঝলে, অমল—” আনন্দমোহন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ বললেন, তাঁর গলার স্বর গাঢ় ও বিষণ্ণ শোনাচিছল, “এ-সব জায়গার ভাল সবই, ক্লাইমেট ভাল, কাজকর্ম করে সুখ আছে, কলেজে অল্প ছেলে, ওবিডিয়েন্ট…তবু আর ভাল লাগে না। বাঁকড়ের কথা বললাম না, সঙ্গে সঙ্গে মনটা কেমন হয়ে গেল, আমাদের সেই নিজের দেশ-বাড়ির কথা মনে পড়ছে।…এবার রিটায়ার করে চলে যাব। আর ক’টা বছর!”
“ভ্রমর, তুমি বসো।” অমল আচমকা বলল, অধৈর্য হয়ে। এমন চোখ করে তাকাল যেন সে অত্যন্ত বিরক্ত ও অস্থির হয়ে উঠেছে।
ভ্রমর পলকের জন্যে চোখে চোখ রেখে অমলকে দেখল। এগিয়ে এসে কোথাও বসল না।
“কি রে, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন—?” আনন্দমোহন ঘাড় পাশ করে ভ্রমরকে দেখলেন একবার, “বোস, বোস কোথাও।…আচ্ছা শোন, আমার ঘর থেকে সিগারেটের টিনটা নিয়ে আয়—”
ভ্রমর সিগারেট আনতে চলে গেল। যাবার সময় একবার অমলের দিকে তাকিয়ে- ছিল, যেন চোখে-চোখে বলে গেল, আ, ছটফট করো না, চুপ করে বসে থাক।
আনন্দমোহন আরও একটু অলসভাবে বসলেন, মাথার ওপর হাত তুলে আলস্য ভাঙলেন। বললেন, “মোহিতদাকে কতবার লিখেছি এই বেলা আমার জন্যে বাঁকড়ো টাউনের কাছেপিঠে একটু জমিজায়গা দেখে রাখতে—তা তোমার বাবা গা করে না। তার ধারণা আমি সারাটা জীবন বাইরে বাইরেই কাটাব।…বাঙালীর ছেলে কোন দুঃখে বিদেশে পড়ে থাকে, বাড়ি ফিরতে তার কত সাধ তা তোমার বাবা যদি বুঝত…!”
“আমরাও ত বিহারে থাকি।” অমল হাসিমুখ করে বলল।
“তোমাদের বিহার বাঙলা দেশ থেকে ক মাইল? গাড়িতে চেপে একবেলায় যাওয়া-আসা যায়। আমরা পড়ে আছি সাত আটশো মাইল দূরে।” বলে আনন্দমোহন একটু সময় চুপ করে মনে মনে কি ভাবলেন, তারপর হেসে ফেলে বললেন, “আজ কতকাল যে পোস্ত খাই নি তা যদি জানতে।”
হিমানী মুখ তুলে স্বামীকে দেখলেন একবার, কিছু বললেন না।
অমল হেসে ফেলল। তার বাবাও ঠিক এই রকম। খেতে বসে এক-একদিন হঠাৎ পোস্তর কথা মনে হলে মাকে বলেন, কই গো, একটু পোস্ত-টোস্ত করলে না। তুমিও ত বাঁকড়োর মেয়ে, পোস্ত খেতে ভুলে যাচ্ছ নাকি!
“বাবাও বলেন।” অমল বলল হাসির গলায়, “মাকে বলেন।”
ভ্রমর সিগারেটের টিন নিয়ে ফিরল। আনন্দমোহন হাত বাড়িয়ে টিনটা নিলেন। “বলবে বই কি! মোহিতদা আর আমি যখন কলেজে পড়তাম, কৃশ্চান কলেজে, তখন একবার ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে জয়েন্টলি একটা রিসার্চ পেপার করব, পোস্তর নিউট্রিশান সম্পর্কে…” বলতে বলতে আনন্দমোহন হোহো করে হেসে উঠলেন। অমলও হাসল। হিমানী মুখ তুললেন। কৃষ্ণাও তাকিয়ে থাকল। ভ্রমর ততক্ষণে একপাশে বসেছে।
তোমার মা—মানে রমাদিকে আমরা মেজদি বলতাম ঠাট্টা করে। জ্ঞান-উকিলের মেয়ে, জ্ঞান দিয়ে কথা বলত; বলত, বেশী পোস্ত খেলে কুষ্ঠ হয়। মাথায় কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছিল কথাটা।” বলতে-বলতে সহসা তিনি থেমে গেলেন। এবং পরে চকিতে একবার ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে থাকলেন।
আনন্দমোহন কলেজে কেমিস্ট্রি পড়নি। সিনিআর প্রফেসার। অমল বাবার কথা এ-সময় না ভেবে পারল না। বাবা বি. এস-সি. পড়তে পড়তে রেলের মেকানি- ক্যাল ট্রেনিংয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। জামালপুরে ছিলেন। অমলও বি. এস-সি-তে অ্যাডমিশান নিয়েছিল, কলেজে ঢুকতে না ঢুকতে অসুখ করল—টাইফয়েড, টানা দেড় মাস বিছানায়, তারপর শরীর কিছুটা সেরে উঠতে-উঠতে পুজো কাটল, বাবা ততদিনে অন্য ব্যবস্থা করে ফেলেছেন, মেকানিক্যাল অ্যাপ্রেনটিশসিপ অমল পাবে এই রকম একটা কথা পেয়ে যাওয়ায় আর কলেজে পাঠালেন না অমলকে। বরং অসুখের পর শরীর স্বাস্থ্য ভাল করতে, বাইরে থেকে কিছুদিন বেড়িয়ে আসতে এখানে পাঠিয়ে দিলেন।
সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছেন আনন্দমোহন। এক মুখ ধোঁয়া নিয়ে আস্তে আস্তে ঢোঁক গিলছিলেন। ঘরের আলো ধবধবে নয়; এ-বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই। বড় মতন একটা জাপানী বাতি জ্বলছিল, কাচের প্লেটের ওপর রাখা পেতলের পালিস করা টেবল-ল্যাম্প, বড় ফুলদানির মতন দেখতে অনেকটা, কাচের সরু চিমনি গলা তুলে আছে, গায়ে গোল ধবধবে সাদা ডোম। মোলায়েম আলোয় ঘর অর্ধেকটা আলো- কিত, বাকিটুকু ছায়া-ছায়া, ধূসর। আনন্দমোহনের ছায়া হিমানীর কাছাকাছি গিয়ে আকারহীন হয়ে পড়ে আছে। হিমানীর ছায়া অন্ধকারে মিশেছে। ভ্রমর ও কৃষ্ণার পায়ের তলায় অমলের মাথার ছায়াটুকু দেখা যাচ্ছিল।
ঘরটা খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আনন্দমোহন হয়ত তাঁর যৌবনের স্মৃতি দেখছিলেন, অথবা অন্য কোনো কথা ভাবছিলেন।
হিমানী বোনার কাঁটা কোলে রেখে বললেন, “ভ্রমর, তুমি ক’দিন কোনো উপাসনা গাও নি।”
ভ্রমর মা’র দিকে তাকাল। কৃষ্ণা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকায় চঞ্চল অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে হয়ত পড়ার নাম করে উঠে যেত, উপাসনার কথায় উঠতে পারল।
নীরবে ভ্রমর উঠল। শান্তভাবে গিয়ে অর্গানের কাছে বসল। হিমানী কোলের ওপর থেকে উলের গোলা ও কাঁটা সরিয়ে পাশে রাখলেন। গায়ের চাদর গুছিয়ে সোজা শক্ত ভঙ্গিতে বসলেন এবার। কৃষ্ণাও স্থির হয়ে বসল।
অর্গানের শব্দ উঠল খাদে। রিডের ওপর দু-হাতের আঙুল ফেলে ভ্রমর কোনো গানের সুর তোলার আগে অন্যমনস্কভাবে একটু, অর্গান বাজাল। অমল মুখ ঘুরিয়ে বসল অর্গানের দিকে। আনন্দমোহন হাতের সিগারেট নিবিয়ে ছাইদানে ফেলে দিলেন। সোজা হয় বসলেন।
সুর তুলে ভ্রমর গান শুরু করল; তিনি মহিমাতে সজ্জিত…সদা প্রভু সজ্জিত…।”
অমল এ-বাড়িতে এসে এই রকম গান প্রথম শুনছে। ভ্রমর তাকে বলেছে এ-সব গান তাদের প্রার্থনা সঙ্গীত। অন্য রকম উপাসনা সঙ্গীতও আছে—সেগুলো একেবারে বাঙলা—সবাই শুনেছে। তবে এই গানটা অন্যরকম, অদ্ভুত লাগে শুনতে। এ-গানের সুর অন্য গানের মতন নয়। মনে হয় যেন একটি স্থায়ী সুরে রয়েছে, বাঁধা সুর, শুধু, শব্দগুলি বদলে যাচ্ছে। অতি উচ্চে স্বর উঠছে না। প্রার্থনার মতনই আগাগোড়া গানটি গাওয়া হয়ে চলেছে। গানের পদগুলিও কেমন অদ্ভুত। ভ্রমর গাইছিল; “তোমার সিংহাসন অটল…হে সদাপ্রভু…চিরদিনের জন্য পবিত্রতা তোমার গৃহের শোভা।”
অর্গানের ঘন গভীর শব্দের সঙ্গে ভ্রমরের মিষ্টি চিকন গলার সুর মধুর হয়ে মিশে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ভ্রমর তার সর্বান্তঃকরণ দিয়ে এই উপাসনাটুকু গাইছে, তার সমস্ত হৃদয় সদাপ্রভুর মহিমার কাছে নিবেদিত।
হিমানী শান্ত নিশ্চল হয়ে বসে, আনন্দমোহন শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। কৃষ্ণা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসে, তার চোখ চঞ্চল। এই ঘরের আবহাওয়া আস্তে আস্তে কেমন পালটে গেল। এখন আর অন্য কিছু মনে পড়ছে না, ভ্রমরের মুখ আরও যেন করুণ, সুন্দর হয়ে উঠছে। অমলের ইচ্ছে হল ভ্রমরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওই গান একটু গায়, ‘মহিমায় সজ্জিত’ শব্দটা তার বড় ভাল লাগছিল। দরজার মাথায় মেহগনি কাঠের যীশুমূর্তির দিকে তাকিয়ে অমল সেখানে ঘরের ছায়া দেখল।
গান শেষ হল। উপাসনা শেষ করার মতই হিমানীর মৃদু গলায় ‘আমেন’ বললেন। ক্রশ আঁকলেন বুকে।
অনিন্দমোহন আবার ঢিলে-ঢালা হয়ে বসলেন। বললেন, “আর একটা গান গা— পুরনো সেই গানটা গা, অনেকদিন শুনি নি। এসো হৃদয় আবরি তোমা রাখি হে।”
কৃষ্ণা এবার উঠল। হিমানী জানলার খড়খড়ি শার্সি বন্ধ করে দিতে বললেন। বারান্দার দিকের সব ক’টি জানলার খড়খড়ি টেনে দিয়ে কৃষ্ণা বাইরের দরজাটাও বন্ধ করল, করে চলে গেল।
ভ্রমর অর্গানের রিডে আঙুল দিল আবার। গান শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে নীরবে বসে ছিল। নিশ্বাস নিচ্ছিল। আজকাল একটু গান গাইতে সে কেমন হাঁপিয়ে যায়। ঘরের আলো তার মুখে আলোছায়া মাখিয়ে রেখেছে।
সুরটা মনে করে নিতে একটু সময় নিল ভ্রমর, তারপর গানটা মাঝখান থেকে ধরল। এ-গানের সুর বাঁধা ঘাটে থাকল না, কখনও উঁচু পরদায় উঠছিল, কখনও খাদে নামছিল। ঘরের নিবিড় আবহাওয়ায় গানটি দেখতে-দেখতে কেমন আচ্ছন্ন অবস্থা করে আনল। ভ্রমরের গলার মধ্যে খুব মিহি করে যেন এক ধরনের কী পরদা লাগানো আছে, ঝিঁঝির শব্দের মতন কাঁপে, স্বরনালীর সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে। অমল কান করে শুনল ভ্রমর চড়ায় গলা তুলতে কষ্ট পাচ্ছে। তবু সবটুকু আবেগ দিয়ে ভ্রমর গাইছিল: “আঁখি-পাশে এসো নয়ন ভরিয়া তোমা দেখি হে, এসো আবরি সকল অঙ্গ জীবন সনে রাখি হে।”
অমল মুগ্ধ হয়ে গান শুনছিল, শুনতে-শুনতে সে ভ্রমরের কষ্টটুকুও অনুভব করছিল। ভ্রমরের বুকে কষ্ট হচ্ছে, তার মুখ কেমন শুকনো হয়ে এসেছে—অমল এইসব ভাবছিল।
গান শেষ হল। হিমানী উঠলেন। উলের গোল, কাঁটা হাতে নিয়ে বললেন, “তোমার গলা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যত্ন না নিলে কিছু থাকে না।”
ভ্রমর মুখ নীচু করল। যেন সে জানে, তার গলা খারাপ হয়ে গেছে। অক্ষমতার দুঃখটকু তার মুখে ও আচরণে প্রকাশ পেল।
“মন না দিলে কিছু হয় না। তোমার আজকাল কোনোদিকে মন নেই।” হিমানী বললেন, মুখের কোথাও বিরক্ত বা অসন্তোষ ফুটল না, শুধু গলার স্বর তাঁর অপছন্দ প্রকাশ করল।
হিমানী চলে গেলেন। অমল হিমানীমাসির ওপর ক্ষুদ্ধ হল। ভ্রমর কিছু খারাপ গায় নি। তাদের বাড়িতে রীতিমত গানবাজনার চর্চা হয়। বাবা মা দুজনেই গানের ভক্ত, দিদিরা ছেলেবেলা থেকে মাস্টার রেখে গান শিখেছে, বউদি রাঁচির মেয়ে—বাঙলা গান খুব ভাল গায়। অমল গান বোঝে, সুরও বোঝে। গানটা টপ্পার ঢঙে, ভ্রমর বেসুরো কিছু গায় নি। তবে তার শরীর দুর্বল থাকলে সে কি করে গলা তুলবে, মানুষের গলা ত আর গ্রামোফোনের রেকর্ড নয়, দম দিলেই বাজবে!
“আমার খুব ভাল লেগেছে।” অমল আনন্দমোহনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল। যেন হিমানীর কথার প্রতিবাদ করে সে মেসোমশাইকেই কথাটা শোনাল।
আনন্দমোহন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। অমলের কথা কানে যায় নি। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
“ভ্রমরের গলা খুব মিষ্টি।” অমল আবার বলল।
অস্ফুট শব্দ করলেন আনন্দমোহন। আস্তে করে মাথা নাড়লেন। কথাটা যেন তিনি জানেন। ভ্রমরের দিকে তাকালেন, মনে হল কোনো কিছু বলবেন, বলার জন্যে অপেক্ষাও করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বললেন না।
ভ্রমর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। অমলের কথায় সে রাগ করেছে কি করে নি বোঝা গেল না; চেয়ার সরিয়ে নীচু মুখে সে আস্তে-আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ঘর এখন ফাঁকা লাগছিল। নীরবে দুজনে বসে। অমল শীত ভাবটা অনুভব করল। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। গরম কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অমল কিছু বলব-বলব মুখ করে বসে থাকল।
“মেসোমশাই—” অমল এক সময় বলল।
আনন্দমোহন মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। অমলকে দেখছিলেন। মোহিতদার কথা তাঁর মনে পড়ছিল। অমলের মুখ তার বাবার মতন। একেবারে সেই রকম ছিমছাম মুখ বড় কপাল, জোড়া ঘন ভুরু চোখের কোণের দিকে পাতা দুটি জোড়া। মোহিতদার টিকোলো নাক ছিল, অমলের নাক অতটা টিকোলো না। থুতনিও ওর বাবার মতন, ছোট অথচ শক্ত। গায়ের রঙ আধ-ফরসা। মেজদির মতন ফরসা হয় নি। মেজদি এবং ভ্রমরের মা দুজনেই ফরসা ছিল। দূর সম্পর্কের বোন হলেও খুব বন্ধু ছিল। মেজদির ছেলেটি বেশ। সমস্ত মুখে ছেলেমানুষি মাখানো। নরম শান্ত স্বভাব।
“মেসোমশাই, ভ্রমরের কোন অসুখ করেছে।” অমল বলল খুব আচমকা; এমন কি সে যেন নিজেও ভাল করে জানতে পারল না কি বলেছে।
“অসুখ!” আনন্দমোহন অসতর্কভাবে বললেন, নিম্নস্বরে। তাঁর দৃষ্টি খানিকটা অপরিচ্ছন্ন।
“ও খুব উইক। একটুতেই হাঁফিয়ে পড়ে।” অমল যেন অত্যন্ত দায়িত্ববান হয়ে পড়ল হঠাৎ। ভ্রমরের অভিভাবকের মতন বলতে লাগল, “প্রায়ই জ্বর হয়। মাথা ঘোরে।”
“হ্যাঁ—” আনন্দমোহন মাথা নাড়লেন সামান্য, “খানিকটা অ্যানিমিক হয়ে পড়েছে। কি জানি, এ-রকম ভাল জায়গায় থাকে, তবু শরীর ভেঙে যাচ্ছে কেন! একজন ভাল ডাক্তার দিয়ে দেখাতে হবে।”
“জব্বলপর…”
“জব্বলপুর নাগপুরে যেখানে হোক নিয়ে যাব ওকে।…দেখি, এবার ক্রীশমাসের ছুটিতে…”
কথাটা আনন্দমোহন শেষ করলেন না আর।
অমল হিসেব করল। মাস দেড়েক প্রায়। ততদিনে অমলেরও যাবার সময় হয়ে যাবে। এ-সময় ভ্রমর যদি বাইরে যায় এ-বাড়ি অমলের ভাল লাগবে না। এক্সমাসের পর অমলও ফিরবে, তখন যদি ভ্রমররা যায়, জব্বলপুর হলে সবচেয়ে ভাল, তাহলে অমলও সঙ্গে যেতে পারবে। মন্টুমামার বাড়িতে সবাই মিলে উঠবে।
আনন্দমোহন আর কোনো কথা বলছেন না, তিনি অন্যমনস্ক, সিগারেট ধরিয়ে ইঁলাস্ট্রেটেড উইকলি আবার টেনে নিয়েছেন দেখে অমল এবার উঠল। ভ্রমরকে আজ কথাটা সে বলবে। অমল একটু গর্ব অনুভব করল, জেন সে একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছে।
অমল উঠে চলে যাচ্ছিল, আনন্দমোহন মৃদু, গলায় বললেন, “বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, ভ্রমরকে বলো সাবধানে থাকতে। ও কি-একটা টনিক খেত, সেটা খেয়ে যেতে বল।”
পোশাক পালটে অমল ট্রাউজারটা গুছিয়ে রাখছিল। রাখার সময় একা ঘরে গুনগুন করে গান গাইছিল। বাইরে খুব ঠাণ্ডা পড়ায় জানলাগুলো ভেজিয়ে দিয়েছে। ভ্রমর এসেছে অমল প্রথমে বুঝতে পারে নি। মুখ ফেরাবার পর ভ্রমরকে দেখতে পেল।
এ-সময় এক কাপ গরম দুধ বা কোকো খেতে হয়, হিমানীমাসির সংসারে নিত্যকর্মগুলি ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলে। ভ্রমর কোকো নিয়ে এসেছিল।
অমল গুনগুন করে যা গাইছিল তার সঙ্গে ভ্রমরের গাওয়া শেষ গানটির সুরের মিল ছিল, কথার নয়। গান থামিয়ে ভ্রমরকে দেখে অমল উজ্জ্বল মুখ করে হাসল। বলল, “কি, এই রকম সুর না?”
ভ্রমর বেশ অবাক হয়েছিল। অমলকে সে গুনগুন করে কখনো-সখনো সুর আওড়াতে শুনেছে, কিন্তু গান গাইতে শোনে নি। আজ অমল সত্যি সত্যিই গান গাইছিল। এবং ভ্রমরের মনে হল, অমল গান গাইতে জানে।
“তুমি যদি গানটা লিখে দাও আমি সবটা গেয়ে দিতে পারি।” অমল হেসে বলল, বলে এগিয়ে এসে ভ্রমরের হাত থেকে কোকোর কাপ নিল। “তোমার মতন অত ভাল করে গাইতে পারব না। তবে স্যার, চালিয়ে দেব ঠিক—” অমল উৎফুল্ল স্বরে হাসল। স্যার কথাটা বলে ফেলে সে যেন আরও মজা পেল।
অমলকে চোখে চোখে দেখল ভ্রমর। চোখ নামাল। বলল, “আমি কত গাইতে পারি!”
“পার না!” অমল চোখের পাতা বড় করে ঠাট্টা করল। বলল, “যা পার তাই বা কজন পারে!” বলে অমল কোকোর কাপে চুমুক দিল।
ভ্রমর দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে কমলা রঙের মিলের শাড়ি, গায়ে পুরোহাতা বুক-খোলা মেয়েদের সোয়েটার, গলার কাছে পুরু করে আঁচলটা জড়ানো। ভ্রমর বাড়িতে যে-চটি পরে তার বাঁ-পায়ের গোড়ালিও তার বাইরে বেরোবার জুতোর মতনই উঁচু, সব সময়ই তাকে চটি পায়ে দিয়ে থাকতে হয়, নয়ত কষ্ট পায় চলাফেরায়।
বসার ঘরে হিমানীমাসি ভ্রমরের গান শুনে যে-কথা বলেছিলেন তাতে তার মন খারাপ হবার কথা। অমল বুঝতে পারল, ভ্রমরের মনে কথাটা এখনও লেগে আছে, সে ভুলে যেতে পারে নি।
“তোমার গলা সত্যিই খুব ভাল, ভ্রমর। আমি বলছি।” অমল গলায় যথেষ্ট জোর দিয়ে বলল, তার কথার মূল্য অন্যে স্বীকার করবে কি করবে-না গ্রাহ্য করল না। “আমি বেট্ ফেলতে পারি।”
ভ্রমর অন্য কথা ভাবছিল। তখন তার গান ভাল না লাগায় মা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। মা চলে যাবার পর অমল বাবার কাছে অমন করে তার ভাল-লাগার কথাটা কেন বলল! বলা উচিত হয় নি। যদি মা শুনতে পেত! যদি বাবা মাকে বলে মা বেশ রাগ করবে। ভ্রমর বলল, “তখন বাবার কাছে তুমি ও-রকম করলে কেন?”
“ও-রকম—? কি রকম?”
“গান ভাল লেগেছে বলে চেঁচিয়ে উঠলে।”
‘বা রে…!” অমল ঘাড় দুলিয়ে বলল, “ভাল লাগলে বলব না!”
ভ্রমর আস্তে মাথা নাড়ল। “না। মা শুনলে খুব রাগ করত।”
“অমল কি একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ খেয়াল হল ভ্রমর দাঁড়িয়ে আছে, বসছে না। “তুমি বসো, আমি বলছি একটা কথা।”
ভ্রমর দাঁড়িয়ে থাকল। সে এখন বসে-বসে গল্প করতে পারবে না।
“বসো না। বলছি বসতে—। তুমি বড় জেদী মেয়ে, ভ্রমর। তখন বসার ঘরে সকলে বসল তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে!” অমল অসহিষ্ণু হয়ে বলল।
বাবা-মা সামনে থাকলে ভ্রমর কোনোদিন বসতে পারে না। তার কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মনে হয়, একসঙ্গে বসলে যেন সে বাবা-মা’র সঙ্গে এক হয়ে গেল। “আমার ভাল লাগে না।” ভ্রমর বলল মৃদু গলায়।
অমল অনেকটা কোকো একচুমুকে খেয়ে নিল। বলল, “তুমি বসো, তোমায় একটা নতুন খবর দেব।” খবরটা দেবার জন্যে অমল ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল অনেকক্ষণ থেকেই।
ভ্রমর এগিয়ে গিয়ে বিছানার ধার ঘেঁষে বসল। অমল তাকে কি বলবে বুঝতে পারল না।
“মেসোমশাইকে আজ বললাম—” অমল ক্যাম্বিসের হেলানো চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে-বসতে বলল।
ভ্রমর অবাক চোখ করে তাকাল। বাবাকে কি বলেছে অমল? কি বলতে পারে? অমল বড় ছটফটে, ভেবেচিন্তে কোনো কথা বলতে পারে না। ভ্রমর মনে- মনে উদ্বেগ বোধ করল।
“মেলোমশাইকে আজ আমি তোমার অসুখের কথা বললাম।” অমল বেশ বিজ্ঞজনোচিত গলা করে বলল।
ভ্রমর সচকিত হল, সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে, অমলের কথা যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। ডাগর দুটি চোখ তুলে অপলকে ভ্রমর তাকিয়ে থাকল।
“মেসোমশাই বললেন, এবার এক্সমাসের ছুটিতে তোমায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবেন। জব্বলপুর কিংবা নাগপুর।” বলতে-বলতে অমল থেমে গেল। ভ্রমরের মুখ দেখে তার গলার স্বর আর ফুটল না।
স্তব্ধ অসাড় হয়ে বসে আছে ভ্রমর। তার চোখের পাতা পড়ছে না। মুখ থমথম করছে। ভ্রমরের এই স্তব্ধতা অমলকে যেন আড়ষ্ট করে তুলল। তার সমস্ত সাহস এখন কেমন ফুরিয়ে এল, সামান্য ভয় পেল অমল। ভ্রমর কি রাগ করল? রাগের কি আছে অমল ভেবে পেল না।
“আমি ত মেসোমশাইকে বলেছি—” অমল এমনভাবে বলল যেন সে বোঝাতে চাইল, সে কোনও দোষ করে নি, অন্যায় করে নি, ভ্রমর কেন রাগ করবে! “তুমি মাসিমাকে বলতে বারণ করেছিলে, আমি বলি নি।”
এ-ঘরে আলোটা এমন জায়গায় আছে, এবং তার আলো এত অনুজ্জ্বল যে ভ্রমর সামান্য আড়াল করলে তার মুখ আলো পায় না। ভ্রমর অমলের চোখ থেকে মুখ সরিয়ে নিল। কিছু বলল না।
অমল ক্ষুব্ধ হল, তার দুঃখ হল। ভ্রমর অযথা রাগ করছে। অসুখ হলে বলব না, জ্বর হলে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখব না, শরীর দুর্বল হবে, রাস্তায় মাথা ঘুরবে, কথা বলতে হাঁপিয়ে পড়ব—তবু কাউকে কিছু বলব না—ভ্রমরের এই স্বভাব অমলের ভাল লাগে না। অমল বলল, “ভ্রমর, তোমার যদি সবসময় অসুখ হয় তুমি বাঁচবে কি করে!”
বাঁচব কি করে! মা’র কথা ভ্রমরের মনে পড়ল। হিমানী-মা’র মুখেই ভ্রমর শুনেছে, তার মা’র নাকি সবসময় অসুখ লেগে থাকত। আজকাল অসুখের কথা বললে হিমানী-মা রাগ করে কখনও-কখনও বলে ফেলে, ‘তুমি কি তোমার মা’র ধাত পাচ্ছ!’ এ-সব কথা ভ্রমরের ভাল লাগে না।
অমল অসহিষ্ণু হয়ে ডাকল, “ভ্রমর—”
ভ্রমর এবার মুখ ফেরাল। চাপা গলায় ধীরে-ধীরে বলল, “বাবাকে আর কি বলেছ?”
“বললাম যে: অসুখের কথা বলেছি। বলেছি তোমার জ্বর হয়, তুমি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছ, তুমি…”।
“বাবা কি বললেন?”
“বললেন, ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, তুমি যেন সাবধানে থাক, কি একটা ওষুধ আছে তোমার সেটা খেতে বললেন।” অমল থামল। সামান্য থেমে বলল, “মেসোমশাই তোমায় ডাক্তার দেখাতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন শীঘ্রি…।”
ভ্রমর নিশ্বাস ফেলল। অমল যেন কানে শুনতে পেল শব্দটা। তার ভাল লাগল না। দুঃখ পাবার মতন করে অমল বলল, “ভ্রমর, আমি…আমি একটা কথা জানি।”
জলের মতন ভিজে-ভিজে দুটি কালো চোখ তুলে ভ্রমর অমলের দিকে তাকাল।
অমল ঘাড় নীচু করল। বলল “তোমার নিজের মা নেই!…আমি তোমার মা’র নামও জানি।”
ভ্রমর নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে বসে থাকল। নিজের মা’র নামটি ভ্রমর এখন মনে করতে পারছিল। সুখতারা। তার মা’র নাম ছিল সুখতারা। দেবকীসিস্টার তাকে মা’র ছবি দেখাত, সিস্টারের কাছে মা’র ছবি ছিল। কোনো ছবিতেই মা’র হাসি- খুশী মুখ দেখে নি ভ্রমর।
৪
বাগানে কলাগাছের ঝোপের তলায় ছায়ায় অমল দুপুরে কাটাচ্ছিল। ক্যাম্বিসের একটা চেয়ার এনে পেতেছে বাগানে; খানিক রোদ, খানিকটা ছায়ায় গা ডুবিয়ে বসে আছে। ঘরে এ-সময়টা ভাল লাগে না, জানলা থেকে রোদ সরে যায়, ছায়া ভরে থাকে, স্যাঁতস্যাঁত করে দেওয়ালগুলো। দেখতে-দেখতে মাত্র ক’দিনের মধ্যেই কি- রকম শীত পড়ে গেল। পুরোপুরি শীতকাল হয়ে গেল এখানে। ঘরে থাকলে এই দুপুরে ঘুমোতে হবে; লেপ গায়ে টেনে একবার শুয়ে পড়লে ঘুম ভাঙবে অবেলায়। দুদিন এই রকম হয়েছে অমলের, বিকেল পড়ে গেছে যখন, তখন ঘুম ভেঙেছে। তাতে সারা শরীরে আলস্য ও জড়তা ভরে ছিল, রাত্রে ঘুম আসছিল না। একলা একটা ঘরে শুয়ে রাত্রে ঘুম না এলে কত রকম কথা ভাবতে হয়, শেষে ভয়-ভয় করে, নতুন জায়গা বলেই হয়ত নানা রকম শব্দ শুনতে পায়, কখনও গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে, কখনও কোনো পাখি কেঁদে উঠল, কখনও মনে হল ভ্রমর বুঝি বাথরুমে যেতে গিয়ে পা বেধে পড়ে গেল। বাড়ির কথাও ভীষণ মনে পড়ে, মনে হয় মা বুঝি তাকে দেখছে, দিদি ঠাট্টা করে বলছে—‘কি রে, কেমন বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিস, যা না দূরে বেড়াতে, মজা বোঝ।’ দাদা বউদিও তাকে বাড়িতে দেখতে না পেয়ে খুঁতখুঁত করছে।
দুপুরের ঘুমে কোন সুখ নেই দেখে এবং অমলের অভ্যাস নয় বলে সে আর ঘরে থাকছে না। স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা থেকে বাইরে এসে রোদ-ছায়ার মধ্যে বসে দুপর কাটাচ্ছে কাল থেকে। বেশ লাগে। আকাশে অফুরন্ত রোদ, নীল হয়ে আছে আকাশটা, সূর্য কোথায় টলে গেছে, আলোর খর ভাব মরে গেছে, কী মিষ্টি গরম থেকে গেছে রোদটা। এ-সময় মাথাটুকু বাঁচিয়ে, রোদে গা রেখে শুয়ে থাকতে খুব আরাম। আলস্য যেন সর্বাঙ্গ মজিয়ে রাখে, তন্দ্রা আসে, দু-চোখের পাতা জুড়ে আসে, কিন্তু অকাতর ঘুম আসে না।
অমল আজ চেয়ারে শুয়ে-শুয়ে তার মনোমতন দুপুরটুকু কাটাচ্ছিল। মাথার ওপর কলাগাছের পাতা মস্ত ছায়ার মতন বিছানো; গায়ে পায়ে রোদ ছড়িয়ে আছে, তাত লাগলে সে সামান্য সরে বসছে। ভ্রমরদের বাড়িটার মাথায় টালির ছাউনি, দুপুরের রোদ সেখানে মেটে-মেটে পোড়া রঙ ধরিয়েছে; প্রায়-নিস্তত্ব এই বাগানে মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে, অমলের সামনে কখনও ফরফর করে উড়ে এসে মাঠে বসছে। লীলাদের সেই ধবধবে সাদা পায়রা জোড়ার একটা সামান্য আগে এখানে এসেছিল, এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না।
হাতের বইটা মুড়ে ফেলল অমল। বাংলা বাইবেল। ভ্রমরের কাছ থেকে পড়তে নিয়েছিল। খানিকটা পড়েছে। ভাল করে কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। গল্প-গল্প যেটুকু, সেটুকু বুঝতে পারলেও এমন বেয়াড়া করে বাংলা লেখা যে, অমল অর্ধেক কথার মানেই ধরতে পারছিল না। মধুপুরার স্কুলে একবার দুই পাদ্রী বুড়ো এসেছিল। তারা ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেদের কাউকে মথির সুসমাচার, কাউকে লুক-লিখিত সুসমাচার দিয়েছিল। ছোট-ছোট কাগজও দিয়েছিল হাতে গুঁজে। অমল পেয়েছিল লুক। অমল লুক-এর সুসমাচার খানিক-খানিক পড়েছিল। এখনও তার সেই গল্পটা মনে আছে, এক নগরে এসে যীশু একজন কুষ্ঠ-রোগী ও একজন পক্ষাঘাত-রোগীকে সারিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুলে হেডমাস্টার- মশাই একদিন ইংরেজীর ক্লাসে ইংরেজী বাইবেল থেকে আবার ঠিক ওই গল্পটাই পড়ে শুনিয়েছিলেন। একটা কথা ছিল তার মধ্যে; “অ্যারাইজ, অ্যান্ড টেক আপ দাই কাউচ অ্যাণ্ড গো আনটু দাই হাউস।” কথাটা তার মনে আছে, কেননা, হেড- মাস্টারমশাইয়ের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর তারা কয়েকজন কৌতূহলবশে ও খেলা- চ্ছলে কথাটা সেদিন বার বার বলেছিল নিজেদের মধ্যে।
অমল বই মুড়ে কোলের ওপর রেখে হাই তুলল। আড়মোড়া ভেঙে সামনে তাকিয়ে থাকল। দুপুরটা একেবারে লালচে-হলুদ গাঁদাফলের মতন রঙ ধরে আছে, ঝিমঝিম করছে, ঠিক মনে হচ্ছে নিরিবিলিতে আকাশের কোলে গা গড়িয়ে নিচ্ছে। এখন সব চুপচাপ, সব শান্ত। বাগানে সবুজ ঘাসে কখনও দু-একটা ফড়িং, দু- চারটে চড়ুই নাচানাচি করছে। কোথাও বুঝি এ-বাড়ির কাক ও-বাড়ির কাকের সঙ্গে গল্প করছিল, তাদের কা-কা ডাক থেকে অমলের সেই রকম মনে হল। ভ্রমরের বেড়ালটাও ফুলবাগানের কাছে খানিক ঘোরাঘুরি করে বারান্দায় গিয়ে গা- গুটিয়ে ঘুমোত শুরু করেছে।
আকাশের দিকে তাকাল অমল। অনেক যেন উঁচুতে উঠে গেছে আকাশ, খুব গভীর দেখাচ্ছে; রোদের তলা দিয়ে অনেক গভীরে যেন আকাশ দেখছে। বিন্দু-বিন্দু, কালো ফোঁটা হয়ে চিল উড়ছে ওখানে। সাদা মতন একটুকরো মেঘ একপাশে দ্বীপের মতন পড়ে আছে, সেখানে চিল নেই, আকাশের নীল নেই।
আবার হাই উঠল অমলের। দুপুর ফুরিয়ে আসার বেলায় এ-রকম হয়, ঘুম পায়। চোখ জড়িয়ে আসছিল। চোখ বুজে অমল শুয়ে থাকল। শীতের বাতাস সহসা গা শিউরে দিল। বুকের ওপর দু-হাত জড়িয়ে, কোলে বাইবেল রেখে অমল শুয়ে থাকল। তার বোজা চোখের পাতার তার মধ্যে হঠাৎ ঝাপসা করে কেমন একটু স্বপ্ন মতন এল। এবং সেই স্বপ্ন ভেঙে যেতেই অমল চোখ মেলে দেখল, ভ্রমর তাকে ডাকছে : “এই—!”
ভ্রমরদের ঘরের জানলা দিয়ে হাতছানি দিয়ে সে ডাকছিল। কলাগাছের ঝোপ, অমল যেখানে বসে আছে, ভ্রমরদের ঘরের মুখোমুখি। অমল উঠল না। মুখ ফিরিয়ে নিল। ভ্রমরের ওপর অমল একটু রেগেছে। দুপুর বেলায় একা- একা বসে থাকলেও আলস্য এসে ঘুম পায় বলে অমল আজ বলেছিল, ‘তুমিও বাইরে রোদে গিয়ে বসবে চলো, গল্প করব।’ ভ্রমর মাথা নেড়েছিল, না, সে যাবে না। তার কাজ আছে।
ভ্রমর আবার ডাকল।
অমল মুখ ফেরাত না, কিন্তু সে গাঁদা-ঝোপের দিক থেকে মস্ত এক প্রজাপতিকে ঘাসের ওপর দিয়ে উড়ে-উড়ে আসতে দেখল। ঘন বেগুনী রঙের প্রজাপতিটা পায়ের কাছে এলে অমল তার ডানায় গোল-গোল দুটি চক্র দেখল, লালচে চক্র; প্রজাপতিটা ঘাসের ডগায়-ডগায় উড়ে ভ্রমরের জানলার দিকে এগিয়ে যাচিছল। অমল প্রজাপতি দেখার জন্যে মুখ ফেরাল, তারপর চোখে- চোখে সেই প্রজাপতিকে ধরে রাখতে গিয়ে একসময় আর প্রজাপতি দেখতে পেল না। দেখল, জানলায় ভ্রমর দাঁড়িয়ে আছে। হাত নেড়ে আর ডাকছে না ভ্রমর।
সামান্য বসে থেকে এবারে অমল উঠল। বই হাতে করে ভ্রমরের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “কি?”
ভ্রমর বুঝি খুব মনোযোগ দিয়ে অমলের মুখ দেখল। “ঘুমিয়ে পড়ে- ছিলে?”
“না। ঝিমনি এসেছিল।”
“কতক্ষণ ডাকছি—”
“কেন?”
“ঘরে এসো, বলছি।”
অমল ভ্রমরকে লক্ষ করে দেখল। ভ্রমরের চোখের পাতা ফোলা, গালে বালিশের ঝালরের দাগ পড়েছে। ঘুমোচ্ছিল ভ্রমর। যেন হাসি-হাসি ভাব লুকিয়ে সে তাকিয়ে আছে। অমল কলাঝোপের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। “চেয়ার পড়ে আছে।”
“আমি তুলিয়ে দেব। আয়াকে বলবো…।”
ভাবল অমল। তার রাগ পড়ে গিয়েছিল। অভিমান করতেও সাহস হল না। ভ্রমরই হয়ত এবার রাগ করে বসবে। বলল, “আসছি।” বলে অমল কলা- ঝোপের দিকেই এগিয়ে গেল।
বারান্দায় চেয়ার তুলে রেখে অমল ঘরে এল। আসার সময় বসার ঘরে এবং খাবার ঘরের মধ্য দিয়ে এল। হিমানীমাসির ঘরের দরজা ভেজানো। ঘুমোচ্ছন। মেসোমশাই কলেজে, কৃষ্ণা স্কুলে; এ-সময় প্রত্যেকটি ঘর নিঃশব্দ, গোটা বাড়ি নির্জন, নিঝুম হয়ে থাকে।
ভ্রমরের ঘরে এসে অমল দেখল, বিছানার ওপর ভ্রমর বসে আছে। মাথার দিকে বইপত্র ফাউন্টেনপেন ছড়ানো। ভ্রমর ঘরে বসে-বসে পড়াশোনা করে। সে গত বছর পরীক্ষা দিয়ে হাইস্কুল পরীক্ষা পাশ করেছে। ইন্টারমিডিয়েটের বইপত্র নিয়ে বাড়িতে বসে পড়ে। এখানকার কলেজে যায় না। তার ভাল লাগে না। কৃষ্ণাদের স্কুলের সঙ্গেই মেয়েদের কলেজ, ইন্টারমিডিয়েট ক্লাস পর্যন্ত পড়ানো হয়। অল্প কিছু মেয়ে। কিন্তু কলেজ অনেকটা দূর, হেঁটে বা সাইকেল চড়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব, টাঙা করে প্রত্যহ দু-বেলা আসা- যাওয়ারও অসুবিধে। তা ছাড়া, এই পড়াশোনা যখন শখের, তখন অকারণে কলেজ ছোটা কেন!
ঘরে ঢুকে অমল প্রথমে ভেবেছিল, ভ্রমর হয়ত তাকে একটা বিদঘুটে কোনো পড়ার কথা জিজ্ঞেস করবে। সেদিন যেমন জিজ্ঞেস করেছিল, ইনকিউ- বেশান পিরিআড কাকে বলে?…অমল জীবনে কখনও ও-রকম শব্দ শোনে নি। অবাক হয়ে বোবার মতন দাঁড়িয়ে থাকল। হোমসাইন্স একটা বাজে সাবজেক্ট। যা-তা একেবারে। শেষে বই দেখে তবে অমলকে বুঝতে হল। শরীরের মধ্যে রোগ এসে ঢোকার পর সম্পূর্ণভাবে রোগ-লক্ষণ ফুটে ওঠা পর্যন্ত যে সময়, তাকে বলে ইনকিউবেশন পিরিআড।
আজ ভ্রমর সে-সব কিছু জিজ্ঞেস করল না। দু-চারটে টুকরো কথার পর বলল, “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, তুমি চলে যাচ্ছ এখান থেকে, সুটকেস-টুটকেস নিয়ে। ঘুম ভেঙে গেল…” বলতে বলতে ভ্রমর হাসল। পাতলা দুটি ঠোঁট এবং গাল হাসির জলে ভিজে উঠল যেন, চোখ দুটি খুব মধুর দেখাল। “উঠে গিয়ে তাই দেখলাম।…” ভ্রমর এবার দুষ্টুমি করে তাকাল। তার দৃষ্টি যেন বলতে চাইল, দেখলাম সত্যিই তুমি চলে যাচ্ছ কি না!
অমল অবাক হয়ে ভাবল, একটু আগে সে-ও তন্দ্রার মধ্যে ভ্রমরকে দেখেছে। দুজনে একই স্বপ্ন দেখে নাকি?
“আমিও তোমায় দেখলাম—” অমল বলল, “তখন ঝিমুনি মতন এসেছিল, হঠাৎ দেখলাম তুমি…” বলতে-বলতে সে থেমে গেল।
ভ্রমর যেন বিশ্বাস করতে পারল না। “সত্যি!”
“সত্যি বলছি।”
“আমায় দেখলে?”
মাথা নাড়ল অমল। হাতের বাইবেল বইটা বিছানায় রাখল। বড় ভারী। ডিকশনারির মতন মোটা।
“স্বপ্ন?” ভ্রমর শুধলো।
“স্বপ্ন-টপ্নই হবে।”
“কি দেখলে?”
কি দেখেছিল অমল, ঠিক তা বলতে চাইছিল না। লুকোবার ইচ্ছে হওয়ায় সে অন্য কিছু বলতে গেল, কিন্তু গুছিয়ে নিতে পারল না। না পেরে বলল, “আমি তোমার বাইবেলটা পড়ছিলাম বলে ওই রকম দেখলাম।”
“কি দেখলে বলো? খালি…” ভ্রমর বায়না করার মতন ছেলেমানুষি সুর করল।
অমল মুশকিলে পড়ল। কথাটা তার বলতে ইচ্ছে করছে না। ভ্রমর শুনলে কষ্ট পাবে। অমল লুক-সমাচারের গল্পটা ভাবছিল বলে স্বপ্ন দেখেছে, ভ্রমর যেন কোথায় গেছে, তার সামনে মস্ত এক সাধুপুরুষ দাঁড়িয়ে, তাঁর পিঠের চারপাশে আলো, ভ্রমর হাত জোড় করে বসে আছে। কারা যেন বলছিল, ইনি যীশু, ইনি মানুষের রোগ তাপ নিবারণ করেন। ভ্রমরের খোঁড়া পা সারিয়ে দেবেন।
অমল ইতস্তত করে বলল, “আমি দেখলাম তুমি যীশুর কাছে গেছ।”
ভ্রমর কেমন হতবাক্ ও অভিভূত হল। অমলের চোখে চোখ রেখে অপলকে তাকিয়ে থাকল। মনে হল, সে যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
অমলের তখনও ভয় করছিল, সে ভাবছিল এর পরও যদি ভ্রমর জিজ্ঞেস করে, আমি তাঁর কাছে গিয়ে কি করছিলাম, তখন অমল কি বলবে! অমল মনে- মনে ঠিক করল, সে আর-কিছু জানাবে না, বলবে—ওই ত, আমি আর-কিছু দেখিনি।
কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর ভ্রমর দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলল। তার মুখ সামান্য সময়ের জন্যে খুব উদাস এবং অন্যমনস্ক ছিল। অমলকে সে দেখছিল না, ঘরের দেওয়ালে ছায়ার দিকে তাকিয়ে সে যেন অন্য কোনো জগতের কিছু দেখছিল, তারপর তার আবিষ্ট ভাব কেটে গেলে ভ্রমর নিশ্বাস ফেলল, অমলকে আবার দেখল চেয়ে চেয়ে।
ভ্রমর কি বলে বসবে ভেবে না পেয়ে অমল বুদ্ধিমানের মতন অন্য কথা পাড়ল। “তোমার ওই বাইবেল আমি কিছু বুঝতে পারি না। কি কটমটে বাংলা।”
“আমার কাছে আর-একটা বই আছে, স্টোরিস ফ্রম বাইবেল—!”
“গল্প?”
“বাইবেলের গল্প।”
“এ-সব গল্পই, না সত্যি সত্যি?”
“সত্যি।”
“যীশু কুষ্ঠ রোগীদের সারাতে পারতেন?” অমল সন্দেহ প্রকাশ করল।
“তিনি সব পারতেন।” ভ্রমর শাত গলায় বলল; তার কোথাও কোনো সন্দেহ নেই।
“কী জানি! আমার এ-সব বিশ্বাস হয় না।” অমল বলল, বলে একটু থেমে আবার বলল, “আমাদের ঠাকুর-দেবতারাও সবকিছু করতে পারতেন। তুমি সাবিত্রী- সত্যবানের গল্প জান?”
“জানি। আমি রামায়ণ মহাভারত পড়েছি। মা’র কাছে গল্পও শুনতাম ছেলেবেলায়। কত শুনেছি, ভুলে গেছি।”
অমল এক ধরনের লজ্জা অনুভব করল। তাড়াতাড়ি বলল, “যেশাস-এর গল্পও আমরা স্কুল থেকে শুনেছি। আমার খুব ভাল লাগে।”
“আমি তোমায় একদিন সবটা বলব।”
“বলো। কিন্তু…” অমল যা ভাবছিল, তা গুছিয়ে বলতে পারছিল না বলে কেমন বিব্রত হচিছল। শেষে বলল, “আগেকার দিনের লোকেরা নানারকম গল্প তৈরী করত। তারা জানত না বলে ভাবত, পৃথিবী বাসুকীর ফণার ওপর বসানো আছে। তারা বলত, ভগবান জল করলেন, স্থল করলেন, আকাশ করলেন…। আজকাল লোকে এ-সব বিশ্বাস করবে না। তুমি যদি বলো, আকাশের ওপর ভগবানরা থাকে, আমি বিশ্বাস করব না। গ্যালিলিও, তুমি গ্যালিলিওর কথা শুনেছ…?”
ভ্রমর মাথা নাড়ল, শুনেছে।
অমল বলল, “তবে! দূরবীনে আকাশ আকাশ।…তুমি কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে দেখে নেবে ত!”
ভ্রমর আহত হল না, রাগ করল না। বলল, “ভগবানকে পরীক্ষা করতে নেই যীশু বারণ করেছেন।…আর ভগবান আমাদের কাছেই আছেন। ভালবাসা, সেবা, দুঃখীর ওপর মমতা…; না থাক, তুমি কেমন মুখ করছ, আমি বলব না।”
অমল বাস্তবিকই কিছু করে নি, কিন্তু ভ্রমর কেমন লজ্জা পেল যেন, কিংবা বাধা পেল কোথাও; চুপ করে গেল। চোখ নীচু করে থাকল কয়েক দণ্ড, তারপর মুখ তুলে কৃষ্ণার বিছানার দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল, “যীশু নিজের জন্যে কিছু চান নি, সকলকে তিনি ভালবেসেছিলেন। তবু কত কষ্ট দিয়ে মানুষ তাঁকে মেরেছিল।…আমরা বড় নিষ্ঠুর। ভালবাসা জানি না।” বলতে-বলতে ভ্রমর এত তন্ময় হয়েছিল যে, সে তার ধরে-যাওয়া গলার স্বরও পরিষ্কার করল না।
অমল কথা বলল না। ভ্রমর যখন ভগবানের কথা বলে তখন তাকে অন্যরকম মনে হয়, পবিত্র, সরল এবং বিশ্বাসী। অমল ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু ভ্রমরকে এ-সময় যেন অনেক বড় বলে মনে হয়, যেন অনেক বেশী জানে ভ্রমর। নিজেকে বরং অমলের ছোট লাগে, তার তর্ক বা ঝগড়া করতে আর ইচ্ছে করে না। এখন অমলের মনে হল, ভ্রমর ঠিকই বলেছে, সমস্ত মানুষ যদি ভাল হত, আমরা সকলে সকলকে যদি ভালবাসতাম, তবে সবাই সুখী হত। ভ্রমরকে কেন হিমানী- মাসি ভালবাসে না, কেন কৃষ্ণা তার দিদিকে খুব ভালবাসে না? এ- বাড়ির সকলে যদি ভ্রমরকে ভালবাসত, তবে ভ্রমর দুঃখী হত না, তার অসুখ থাকত না। ভালবাসা পেলে অসুখ থাকে না—এই আশ্চর্য কথাটা অমলের মাথায় আসার পর সে নিজেই কেমন অবাক ও অন্যমনস্ক হয়ে থাকল।
ভ্রমর অন্য কথা পাড়ল। বলল, “তোমার কোটের বোতাম সেলাই করে দিয়েছি।”
অমল মুখ ফেরাল। ভ্রমরকে দেখল। জানলা দিয়ে পালানো দুপুরটা চোখে পড়ল। আলো আরো নিস্তেজ হয়ে গেছে; ঘরে বসে রোদ দেখা যাচ্ছিল না। বাইরে বাতাস বইতে শুরু করেছে দমকা, সরসর শব্দ হচ্ছিল। পড়ন্ত দুপুরে মনটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে আজকাল।
“আজ আমায় চকে যেতে হবে।” ভ্রমর বলল।
“চক?”
“বাজারে যাব, বাড়ির জিনিসপত্র কিনতে হবে।”
“কি জিনিস?”
“অনেক কিছু। মা লিখে দেবে।”
“মাসিমা যাবেন না?”
“মা বড় যায় না; আমি যাই। বরাবর। কৃষ্ণাও যায়। কৃষ্ণাও আজ যাবে না।”
“টাওয়ার আর দেখতে যাওয়া হচ্ছে না—তুমি রোজ দিন বদলাচ্ছ! কাল—”
“কাল হবে না; কাল রোববার। আমরা থাকব না।”
“পরশু, আমি যাবই।”
ভ্রমর হাসল। হাসিটা খুব স্নিগ্ধ এবং সকৌতুক।
অমল বুঝতে পারল না ভ্রমর হাসল কেন? বলল, “হাসলে যে!”
“কই—!”
“ইয়ার্কি হচ্ছে।”
“না, মোটেও না।”
“তবে?”
“টাওয়ার দেখা হয়ে গেলেই তোমার এখানকার সব দেখা হয়ে গেল। তারপর…?”
“কত বেড়াবার জায়গা রয়েছে, এমনি বেড়াব।” অমল বলল, বলেই তার মনে পড়ে গেল একদিন ভ্রমরকে সঙ্গে করে জল-চাঁদমারি যাবার কথা আছে। “একদিন তোমার সঙ্গে জল-চাঁদমারি যাবার কথা আছে, স্যার। সেবার আমি একলা গিয়েছিলাম।”
ভ্রমর বালিশের পাশ থেকে বইপত্র কলম গুছিয়ে তুলে নিতে লাগল। বলল, “তুমি যা ছটফটে ছেলে, টাওয়ার দেখা হয়ে গেলেই তখন আর এখানে দেখার কিছু থাকবে না, তোমার থাকতে ভাল লাগবে না, চলে যাবে।”
“চলে যাব!…কোথায় যাব?”
“জব্বলপুর। তোমার মণ্টুমামার কাছে।”
“হ্যাত্! মন্টুমামার কাছে অতদিন কে থাকে! আমি এখানেই থাকব—।”
বিছানা থেকে উঠতে-উঠতে ভ্রমর হেসে বলল, “সুটকেস-টুটকেস নিয়ে চলে যাবে না তবে!…আমার তখন এত খারাপ লাগছিল…” বলতে-বলতে ভ্রমর যেন খুব লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।
রাত্রে চক থেকে ওরা ফিরছিল। বেশী রাত করবে না করবে না করেও যখন চকবাজার থেকে টাঙায় উঠল তখন আটটা বাজে প্রায়। টুকটাক জিনিস কিনতে হয়েছে অনেক, সারা মাসের সাংসারিক খুচরো জিনিস। সাবান দু-দফা, টুথপেস্ট, মাথায় মাখার তেল, বিস্কুট, মাখন, আনন্দবাবুর জন্যে মনাক্কা আর সিগারেটের টিন, কৃষ্ণার রিবন, সাদা মোজা, কেডস জুতোর কালি, হিমানীর ক্রুশন সল্ট, আরও কত কি। মুখে মাখার ক্রীম আর গ্লিসারিন কিনতেই ভ্রমরের আধ ঘণ্টা গেল। স্টেশনারী দোকানের মালিক ভ্রমরকে বসিয়ে নানারকম গল্প জড়ল। বুড়ো লোক, ভ্রমরকে ‘বেটি বেটি’ করে আদর আপ্যায়ন করতে লাগল এত যে, অমলের মনে হল সারা রাতই বুঝি বসিয়ে রাখবে। সেখান থেকে কাপড়ের দোকান; কৃষ্ণার কামিজ হবে একটা—মাপ দোকানেই পড়ে আছে, কাপড় পছন্দ করে দিতে হল; ভ্রমর কৃষ্ণার জিনিস পছন্দ করতে সবসময় ভয় পায়, কি জানি, কৃষ্ণা যদি ঠোঁট ওলটায়। লংক্লথ নিতে হল খানিকটা, শেমিজ হবে মেয়েদের। তারপর অল্প কিছু, সবজি-টবজিও কিনতে হল।
বাজার থেকে বেরোতে-বেরোতে আটটা বাজল প্রায়। টাঙার সামনে গোল- মতন ঝুড়িতে মালপত্র। কয়েকটা খুচরো জিনিস বেতের টুকরিতে। চকবাজার বেশ গমগম করছিল, আলোয় ভরা, কাছেই একটা সিনেমা হাউস আছে, সেখানে হিন্দী বই হচ্ছিল। এদের গা-সওয়া শীত, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, গরম জামা পরে, র্যাপার চাপিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ অমলের মনে হল ডিসেম্বরের শুরুতেই জোর ঠাণ্ডা পড়ে গেছে।
চকবাজার ছাড়িয়ে আসতে শীতের কনকনে বাতাস ঝাপটা দিয়ে। গেল বেশ কুয়াশা চোখে পড়ল, ধোঁয়ার মতন জমে আছে। ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চোখ জ্বালা করে; কুয়াশায় সব কেমন ঠাণ্ডা লাগে, নাক মুখ শীতল হয়ে থাকে। অমল শখ করে পান কিনেছিল, নিজে খেয়েছে, ভ্রমরকেও খাইয়েছে। পানের অবশিষ্টটুকু তার মুখে ছিল। অমল এবার বলল, “একটা জিনিস কিনেছি, এবার খাব।”
চক ছাড়িয়ে এসে খুব বড় একটা তলাও-এর পাশ দিয়ে টাঙাটা চলছে। রাস্তায় তেমন একটা আলো নেই, এই অঞ্চলটা বাজারপট্টির প্রান্ত, ছোটখাট দোকান আছে, কোনোটাতে তুলে বিক্রি হয়, কোনোটাতে বা সাইকেল সারাই করে। মিটমিটে লণ্ঠন জ্বলিয়ে কোথাও কোনো ফলঅলাও বসেছিল চালার তলায়।
ভ্রমর আজ খুব সাবধান হয়ে বেরিয়েছে। গায়ে পুরো-হাতা শর্ট কোট। কালো রঙ কোটটার, গলার কাছে মস্ত কলার। পায়ে মোজা পরেছে। কোটের পকেটে স্কার্ফ রেখেছে মাথায় বাঁধবে বলে, এখনও বাঁধে নি।
অমল পকেট হাতড়ে কি যেন বের করতে লাগল।
ভ্রমর বলল, “অনেক দেরি হয়ে গেল, না—?”
“হবে না! তোমার দেখলাম পুরো বাজারটাই চেনা।” অমল ঠাট্টা করে বলল।
“বা রে, কতদিন ধরে যাচ্ছি আসছি—।”
“তুমি খুব কাজের মেয়ে।” অমল হাসল।
অমলের কোটের হাতা ধরে ভ্রমর আলগা একটু টেনে দিল। “ঠাট্ট!”
“ঠাট্টা কি, নিজের চোখেই দেখলাম।” অমল পকেট থেকে সেই জিনিসটা ততক্ষণে বের করে ফেলেছে।
“অন্য অন্য বারে কৃষ্ণা আসে। মা খুব কম। আমায় এই একটা কাজ বরাবর করতে হয়।…ওটা কি?” ভ্রমর অমলের হাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল।
“সিগারেট। আমি একটা সিগারেট খাব।” অমল গলায় জোর দিয়ে ঘোষণা করল।
ভ্রমর যেন স্তম্ভিত। বিশ্বাস করতে পারছিল না। অমলের হাতের দিকে অল্প সময় তাকিয়ে থেকে শেষে চোখ তুলে অমলের মুখ দেখতে লাগল। “কোথায় পেলে? কিনেছ?”
“তখন পান কিনছিলাম-না, দুটো কিনে ফেললাম। দেশলাইও কিনেছি।”
“তুমি সিগারেট খাও?” ভ্রমর অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলল।
“খাই না। আমি স্মোকার নই। তবে দু-চারটে খেয়েছি।” অমল দেশলাইয়ের ওপর খুব কায়দা করে সিগারেট ঠুকতে লাগল। বলল, “আমি প্রথম সিগারেট খাই ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময়, সরস্বতী পুজোর দিন। আমাদের স্কুলের নিয়ম, যারা টেন ক্লাসে উঠবে, তারা সেবারে সরস্বতী পুজো করবে। আমাদের সময় আমরাই লিডার।…সরস্বতী পুজোর দিন রাত্তির বেলা অমূল্য, ভানু-টানুরা মিলে আমায় সিগারেট খাইয়ে দিল। ওরা খেত মাঝে মাঝে। ওরা সিদ্ধিও খেত। তুমি কখনও সিদ্ধি খেয়েছ?”
“ভাঙ্?”
“হ্যাঁ, ভাঙ্। খাও নি?…আমি খেয়েছি। বিজয়ার দিন একবার বিজনদাদের বাড়িতে সিদ্ধি খেয়ে, ওরেব্বাস…কী হাসি…হাসতে হাসতে মরে যাই; তুমি যদি কখনও খাও, মনে হবে চলছি ত চলছি, সব ভোঁ-ভোঁ; আর একবার হাসতে শুরু করলে ননস্টপ হেসে যাবে…।” অমল খোলামেলা গলায় হই-হই করে বলে যাচ্ছিল, হাসছিল মহা ফুর্তিতে।
“সিগারেট, ভাঙ, গাঁজা—সব রকম নেশা করেছেন! কী ছেলে—!” ভ্রমর চোখ বেঁকিয়ে ছোট করে ধমক দিল।
আত্মকথায় অমল এত মত্ত হয়ে পড়েছিল যে, সিগারেটটা তার হাতেই ছিল, ধরানো হয় নি। এবার সচেতন হল। সিগারেট ঠোঁটের মধ্যে গুঁজে দিল। দিয়ে জিবের জল দিয়ে ডগাটা ভিজিয়ে নিল। একবার ঠোঁটে সিগারেট এঁটে গিয়ে তার ঠোঁট পড়ে গিয়েছিল। সিগারেট ধরাবার আগে আবার মুখ থেকে সেটা নামিয়ে নিল। বলল, “এই, বাড়িতে কিন্তু কাউকে বলবে না। মেয়েরা বাই নেচার বড্ড চুগলি কাটে।”
ভ্রমরের খুব হাসি পাচ্ছিল। হাসল না। গম্ভীর মুখ করে বলল, “সরস্বতী পুজোর পর আর সিগারেট খাও নি?”
খেয়েছে বইকি অমল, টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট আউটের পর খেয়েছে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা যেদিন শেষ হল সেদিন খেয়েছে, তারপর ওই রকম সব ফূর্তির দিনে মজা করে খেয়েছে। কলেজেও দু-একটা খেয়েছে কখনও, আনন্দ করে, দলে পড়ে। অমল সেই সব বৃত্তান্ত বলতে লাগল।
টাঙা ততক্ষণে জল-টাকি ছাড়িয়ে চলে এসেছে। রাস্তা একেবারে ফাঁকা, সাদা সাদা কুয়াশা ঝুলছে রেশমের মতন, আকাশে ফুটফুট করছে চাঁদ। জ্যোৎস্না এবং কুয়াশায় পথ যেন কাশফুলের মতন সাদা ও নরম হয়ে আছে। গাছ-গাছালির গায়ে চাঁদের কিরণ অবিরত সুধা ঢালছে। ঘোড়ার এবং গাড়ির ছায়া পড়েছে রাস্তায়, দীর্ঘ ছায়া, রাস্তা পেরিয়ে মাঠ দিয়ে ছায়াটা ছুটছে। ঘোড়ার গলায় ঘণ্টা বেজে চলেছে ঝুমঝুম করে, মাঝে মাঝে জীবটা ডেকে উঠছে।
অমল ভ্রমরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, ভ্রমর অমলকে সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছে। ওদের পায়ে ধবধবে জ্যোৎস্না পড়ে আছে, গাড়ির ছাদ থাকায় মুখ অথবা গা সরাসরি চাঁদের আলো পাচ্ছে না।
অনেকগুলো দেশলাইকাঠি নষ্ট করে অমল শেষ পর্যন্ত সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। হাতের আঙুলে এবং জিবের জলে সিগারেট চেপটে ভিজে কদাকার হয়ে গেছে। কিন্তু তেমন ধোঁয়াই আসছে না। ভ্রমরের কাছে কৃতিত্ব দেখাবার জন্যে অমল সেই বিস্বাদ সিগারেটই জোরে-জোরে টানছিল এবং প্রায়ই কেশে উঠছিল।
অনেকগুলো দেশলাইকাঠি নষ্ট করে অমল শেষ পর্যন্ত সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। হাতের আঙুলে এবং জিবের জলে সিগারেট চেপটে ভিজে কদাকার হয়ে গেছে। কিন্তু তেমন ধোঁয়াই আসছে না। ভ্রমরের কাছে কৃতিত্ব দেখাবার জন্যে অমল সেই বিস্বাদ সিগারেটই জোরে-জোরে টানছিল এবং প্রায়ই কেশে উঠছিল।
ঠাণ্ডা লাগায় ভ্রমর এবার মাথার ওপর স্কার্ফটা বেঁধে নিল। তার কান মাথা এবং গালের অনেকটা ঢাকা পড়ে গেলে অমল তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বারে! তোমায় বিউটিফুল দেখাচ্ছে!”
ভ্রমর কান করল না কথায়। বলল, “সিগারেট ফেলে দাও।”
“ফেলে দেব! বা! পয়সা দিয়ে কিনলাম।”
“খেতে পারছ না, কাশছ, তবু খাচ্ছ।”
“বেশ খেতে পারছি। এখানের সিগারেটগুলো কড়া।…শীতে বেশ জমছে।” বলে অমল বাঁ পকেট থেকে হাত বের করে কোটের কলার তুলে দিল। “ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে কিনা তাই কাশি-কাশি লাগছে।”
টাঙাঅলা এই সময় গুনগুন করে কি সুর ধরল। জলে একসঙ্গে দাঁড় ফেলার মতন শব্দ করে ঘোড়াটা সমস্ত শরীর নাচিয়ে-নাচিয়ে চলেছে। না, জলে দাঁড় ফেললে ঠিক এ-রকম শব্দ হয় না, কিন্তু অনেকটা এই রকমই। অমল ভাবল, কান পেতে শুনল, শুনতে-শুনতে বেশ যেন তন্ময় হল একটু।
ভ্রমর হঠাৎ নজর করে দেখল, তাদের পায়ের তলায় রাস্তা দিয়ে গাড়ির যে ছায়াটা ছুটছে, সেখানে তাদের কোনো চেহারাই নেই। কি ভেবে ভ্রমর একটা হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিল, তবু ছায়া পড়ল না।
মজার গলা করে ভ্রমর বলল, “এই, দেখেছ—”
অমল তাকাল। সিগারেটটা এবার সে নিজের থেকেই ফেলে দিল। জিব তেতো লাগছে, তামাক চলে গেছে মুখে। “কি?” অমল শুধলো।
“দেখছ, আমাদের ছায়াই পড়ছে না।” ভ্রমর হাত বাড়িয়ে পায়ের তলার পথ দেখাল। তার গলার স্বর লঘু চঞ্চল।
অমল দেখল এক পলক রাস্তাটা। বলল, “ডিরেক্ট লাইট ছাড়া কোনো অবজেক্টের শ্যাডো হয় না। আমরা লাইট পাচ্ছি না।” বলে অমল রগড় করে আবার বলল, “ফিজিক্স-টিজিক্স পড়লে না—রদ্দি হোমসাইন্স পড়ে বিদ্যের জাহাজ।”
“ইস্, তুমি কত বিদ্বান!”
“আমি ফিজিক্স পড়েছি। আমাদের কলেজের মধ্যে আমার হায়েস্ট মার্কস ছিল ফিজিক্সে।”
“গর্ব করো না।” ভ্রমর ঠোঁট চেপে হাসছিল।
“গর্ব!…তুমি বিশ্বাস করছ না! আমি প্রমিস করে বলতে পারি।…” অমল সামনের দিকে ঝুঁকে ভ্রমরের গায়ে হাত দিল, যেন এখুনি সে শপথ করে ফেলতে পারে।
ভ্রমর এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, “থাক্। তুমি খুব ভাল ছেলে।”
অমল অন্য কথা ভাবছিল। “বুঝলে ভ্রমর, আমার লেখাপড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। বি. এস-সি. পাশ করে আমি এম. এস-সি. পড়তাম। আজকাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পড়তে পারলে তোমার কী খাতির!” অমল আবেগবশে বলল।
“পড়লে না কেন?”
“বাবা! বাবা বললে মেকানিক্যাল অ্যাপ্রেন্টিসসিপ নিত…। আমারও এমন ব্যাড লাক্, হুট করে অসুখ হয়ে গেল কলেজে ঢুকেই, নয়ত বি. এস-সিটা পড়ে ফেলতাম।” অমলের গলায় প্রচ্ছন্ন আক্ষেপ ছিল।
ভ্রমর অমলের জন্যে সমবেদনা অনুভব করে বলল, “এও ত ভাল। তুমি ইঞ্জিনিয়ার হবে।”
“আমি ঠিক একদিন অফিসার হব।…চেষ্টা করলে মানুষ কি না হয় বল, সে সব পারে।”
টাঙাটা একটা ছোট পল্লী ছাড়িয়ে এবার ধু-ধু ফাঁকায় পড়ল। চারপাশে উঁচু-নীচু, মাঠ, দু-চারটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে, আর্দ্র জ্যোৎস্নায় চরাচর যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘোড়ার গলার ঘণ্টাটি ঝুমঝুম করে বেজে যাচ্ছে, কদমের শব্দ এবং চাকার শব্দ মিলে-মিশে একটি অদ্ভুত ধ্বনি বিস্তার করেছে, কোচোআন তার গানটি গেয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। রাস্তার পাশের দেবদারু গাছ শীতের বাতাসে কেমন শব্দ করছিল মাঝে মাঝে।
ওরা দুজনেই নীরব হয়ে বসে থাকল। এবং দুজনেই মাঠ-ঘাট ও জ্যোৎস্না দেখছিল।
“আমাদের গাড়িঅলা কি গান গাইছে ভ্রমর?” অমল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
“দোহা।”
“শুনেছি কথাটা…। এক রকম গান, না—?”
“হ্যাঁ। আমার এক বন্ধু ছিল আগে, আর্তি গুপ্তা। সে গাইত, খুব সুন্দর গাইত। আর্তিরা মিরাট চলে গেছে।”
অমল শীতের বাতাসে কেঁপে উঠল একটু। গরম কোটের কলার আরও ঘন করে গলায় জড়াল। বলল, “তুমি একটা গান গাও।”
“যাঃ!” ভ্রমর ভ্রূকুটি করল।
“যা কেন, গাও। শীত-টীত উড়ে যাবে।”
“রাস্তায় কেউ চেঁচিয়ে গান গায়!”
“কেন গাইবে না! গান হচ্ছে, কি যেন, আনন্দ। আনন্দ হলেই গায়। ও গাইছে কি করে!”
“ও দুঃখের গান গাইছে।” ভ্রমর মৃদু গলায় বলল। “ও কি বলছে জান? বলছে, আমার সারাটা দিন ক্ষেতীতে মাটি কেটে লাঙল দিয়ে কাটে, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলে বাড়ির লোক জিজ্ঞেস করে, আজ কতটা লাঙল দেওয়া হল? হায় ভগবান, আমায় কেউ জিজ্ঞেস করে না—তোমার ভজন-পূজন কতটুকু করলাম।”
অমল নীরবে কথাগুলো শুনল। ঘাড় ফিরিয়ে কোচোআনকে দেখল দু-দণ্ড। তারপর বলল, “ভ্রমর, সব সময় দুঃখ আমার ভাল লাগে না।”
ভ্রমর কিছু বলল না। সে সামনের জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে থাকল।
চুপচাপ কয়েক দণ্ড বসে থেকে অমল খুব অস্বস্তি বোধ করল। এবং অস্বস্তি কাটাতেই যেন তার অবশিষ্ট সিগারেটটা বের করল। এমনও হতে পারে যে এই দ্বিতীয় সিগারেটটা পকেটে নিয়ে বাড়ি ঢুকতে চায় না সে। এবারে খুব সাবধানে তিনটে কাঠিতেই অমল সিগারেট ধরাতে পারল। তারপর আস্তে- আস্তে টান দিল। সে আর কাশবে না।
অমলকে দেখল ভ্রমর। কিছু বলল না।
অমল বলল, “কই, একটা গান গাও! কী বিউটিফুল দেখাচ্ছে বলো ত! জ্যোৎস্না ধবধব করছে। তোমার ভাল লাগছে না?”
এক পাশে মাথা হেলালো ভ্রমর। তার ভাল লাগছে!
“তা হলে একটা গান গাও। ভাল লাগাই লাইফ।” অমল সানন্দে বলল।
“তুমি গাও।”
“আমি! বেশ, আমি গাইছি। তুমিও গাইবে। একসঙ্গে গাইব আমরা।”
ভ্রমরের চোখের পাতায় আবার হাসি ফুটল। ঠোঁট দুটি আভা পেল।
গান বেছে নিতে একটু সময় লাগল অমলের। সে যেটা জানে ভ্রমর জানে না; ভ্রমর যা জানে অমল জানে না। শেষে অমল একটা পুরনো দুজনেরই জানা গান বেছে নিল। সিগারেটটা ফেলে দিল, আধখানাও খাওয়া হয়নি। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে সে-ই প্রথম গানের কলি ধরল: “এই লভিনু সঙ্গ তবু সুন্দর হে সুন্দর…”
প্রায় অর্ধেকটা গান অমল একা গেয়ে ফেলার পর ভ্রমর তার শেষ সঙ্কোচ এবং আড়ষ্টতাটুকু হারিয়ে ফেলে অমলের গলায় গলা মিলিয়ে গাইল : “এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত, এই তোমারি মিলনসুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত…”
কোচোআন গান আর গাইছিল না। ঘোড়ার কদম ফেলার তালে তালে তার গলার ঘন্টা ঝুমঝুম ঝুমঝুম করে বেজে যাচ্ছিল। জ্যোৎস্নার কণাগুলি মাঠ ও বক্ষচয় থেকে তাদের চক্ষু, তুলে যেন ওই দুটি আনন্দিত তৃপ্ত যুবক- যুবতীকে দেখছিল।
গান শেষ হলে দুজনেই নীরবে বসে থাকল।
গাড়িটা বাড়ির কাছে এসে গেছে। অমল রুমাল বের করে যখন নাক মুছছিল, তখন তার হাতে সিগারেটের গন্ধ পেল। তার সন্দেহ হল, মুখে সিগারেটের গন্ধ আছে।
“এই, দেখ ত আমার মুখ দিয়ে গন্ধ বেরুচ্ছে কিনা!” অমল বলল, বলে ভ্রমরের মুখের সামনে ঝুঁকে মুখ হাঁ করল।
ভ্রমর মুখ আনল অমলের মুখের কাছে। লম্বা করে নিশ্বাস নিল। সিগারেটের গন্ধ পেল যেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে তামাকের ফিকে গন্ধ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়ে ভ্রমর তার ঘ্রাণ-চেতনায় অদ্ভুত একটি গন্ধ অনুভব করতে পারল। অমল মুখ হাঁ করেই ছিল, ভ্রমরের মুখ অমলের মুখের অত্যন্ত নিকটে, তার নাক অমলের ওষ্ঠ প্রায় স্পর্শ করে আছে। ভ্রমর দ্বিতীয়বার নিশ্বাস নিল, অত্যন্ত ধীরে-ধীরে, তার মনে হল, অমলের মুখ গলা বুক থেকে এমন একটি সুগন্ধ আসছে, যা সে আর কখনও কোথাও অনুভব করে নি। ভ্রমরের সমস্ত মুখ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল, চোখের কোণ জ্বালা করছিল, ঠোঁট দুটি কম্পিত হবার মতন সঙ্কুচিত হল ঈষৎ, তারপর ভ্রমর আর কিছু অনুভব করতে পারল না, কোনো সুখকর জীবন্ত মাদকতা ভরা ঘ্রাণ তার চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলল।
অমল মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “কী হল, গন্ধ আছে?”