ব্যাচেলার – উপন্যাস – নিমাই ভট্টাচার্য
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কিছু কেনাকাটা করে রাস্তা পার হয়ে বন্ড স্ট্রিট টিউব স্টেশনে ঢুকতে গিয়েই মুখোমুখি দেখা। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বললাম, আপনি?
দেবব্রত হাসতে হাসতে বললো, আমি তো বহুদিনই এখানে। আপনি কবে এলেন?
প্রায় দুসপ্তাহ হতে চললো। এবার তো ফেরার পালা।
সে কি? এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাবেন?
ফেরার পথে কয়েক জায়গায় স্টপওভার করব বলে পরশুই রওনা হচ্ছি।
অজস্র যাত্রী আসা-যাওয়া করছেন। দেবব্রত আমার হাত ধরে একটু পাশে সরে গিয়ে বললো, পরশু যাওয়া হচ্ছে না।
একটু আগেই রিজার্ভেশন করে এলাম।
দ্যাটস নাথিং। ক্যানসেল করে দিলেই হবে। তারপর হাসতে হাসতে বললো, এতকাল পরে দেখা হলো আর আমার হাতের রান্না না খাইয়েই ছাড়ব?
আমি বললাম, খেলে রঞ্জনার হাতের রান্নাই খাব।
রঞ্জনা তো এখানে আসেনি। ও দিল্লিতেই…
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমার হাতে টুকিটাকি কয়েকটা প্যাকেট। তাছাড়া বন্ড স্ট্রিট-টিউব স্টেশনে দাঁড়িয়ে কথা বলাও অসম্ভব। দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছেন?
হোটেলে।
কোনো হোটেলে? সেই স্ট্রান্ড…
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, হোটেলে আসবেন?
আপনি থাকবেন?
থাকব। আজ আর কোথাও বেরুচ্ছি না।
দেবব্রত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, সেকি? লন্ডনে এসে সন্ধেবেলা হোটেলে শুয়ে কাটাবেন?
কি করব? কদিন এত পরিশ্রম করতে হয়েছে যে আজ আর একটু রেস্টনা নিয়ে পারছি না।
কোনো পুরনো বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন নেই?
ছিল কিন্তু তাকে বললাম কাল যাব।
কিন্তু আমি এলে তো আপনার বিশ্রাম হবে না।
হাসতে হাসতে বললাম, পরিশ্রমও হবে না।
দেন আই অ্যাম কামিং। এই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই আসছি।
আসুন। গল্প করা যাবে।
আমি তর তর করে নিচে নেমে গেলাম। দেবব্রত অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ভিড়ে মিশে গেল।
.
ঠিক পনের বছর আগেকার কথা। নেহরুর সঙ্গে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছি লন্ডনে। তাছাড়া প্রথমবার লন্ডন দেখছি। বেশ চঞ্চল। প্রায় উত্তেজিত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মার্লবোরা হাউসেই কাটাই। মাঝে মাঝে সময় পেলেই রাস্তার ওপাশে গিয়ে সেন্ট জেমস প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাই আর মনে মনে ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কয়েকটা পাতা উল্টে যাই। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের কত অবিস্মরণীয় চরিত্র এখানে বাস করেছেন। সপ্তম হেনরি, ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, এলিজাবেথ, মেরী। প্রথম চার্লস ফঁসির মঞ্চে চড়ার আগে এই সেন্ট জেমস প্যালেসের চার্চেই মহামতি যীশুর নাম স্মরণ করে ঈশ্বরের কাছে তার শেষ প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আমাদের কোহিনূর মাথায় নিয়ে এখানেই শপথ নিয়েছে সপ্তম এডওয়ার্ড, পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ ও আজকের রানী এলিজাবেথ দ্য সেকেন্ড। এই সেন্ট জেমস প্যালেসের এক ব্যালকনি থেকেই রাজার মৃত্যু সংবাদ প্রথম ঘোষণা করা হয়, দ্য কিং ইজ ডেড! লং লিভ দ্য কিং! এখনও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের পরিচয় পত্রে লেখা থাকে অ্যাম্বাসেডর টু দ্য কোর্ট অব সেন্ট জেমস! অথবা অন্য কোনো জার্নালিস্টের সঙ্গে গল্প করি। একটু বেশি সময় পেলে ল্যাংকাস্টার হাউস পেরিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের আশেপাশে অহেতুক ঘোরাফেরা করি। বাকিংহাম প্যালেসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি কিন্তু যতটা ভালো লাগবে আশা করেছিলাম, তা লাগে না। সেন্ট জেমস প্যালেস, মার্লবোরা হাউস বা অন্যান্য রাজপ্রাসাদের মতো বাকিংহাম প্যালেস দেখে ইতিহাস মনে পড়ে না; তবে সামনের ভিক্টোরিয়ার পাথরের মূর্তিটা দেখতে ভালো লাগে। ইতিহাসের অনেক স্মৃতি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রথমবার বিলেত দেখতে এসে সব কিছুর সঙ্গে ইতিহাস আর মনের ছবি মিলিয়ে নিতে গিয়ে কোথাও ভালো লাগে, কোথাও দুঃখ পাই। বিকেলে নিউজ পাঠাবার পরই হোটেলে আসি। স্নান করি। কালো স্যুট-টাই পরে আবার বেরিয়ে পড়ি। রিসেপসন, কটেল, ডিনার। রোজই কিছু না কিছু থাকে। শুরু হয়েছে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের প্রেস রিসেপসন দিয়ে। কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই সাংবাদিকদের সম্মানে ব্রিটিশ প্রাইম মিনিস্টারের পার্টি। মার্লবোরা হাউসের পিছনের গার্ডেনের প্রবেশ পথে স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার নিজ হাতে তুলে দেন ড্রিঙ্ক। হুইস্কি, জিন, ব্রান্ডি, বিয়ার। তারপর কোনোদিন অস্ট্রেলিয়া হাউসে আর ঘানা হাইকমিশনে, কোনোদিন স্যাভয় বা ক্লারিজ হোটেলে। অথবা কেনসিংটন গার্ডেনে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের বাড়িতে স্কচের গেলাস হাতে নিয়ে কাশ্মীরী কার্পেট বা ইন্দ্রাণী রহমানের ওডিসি নাচের আলোচনা থেকে আয়ুব সিকিউরিটি কাউন্সিল ডিঙিয়ে একেবারে ভারতীয় সমাজতন্ত্রে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের ডিপ্লোম্যাটরা। এসব শেষ হলেও ছুটি পাই না। কোনো না কোনো আড়ডায় আটকে পড়ি। তারপর হোটেলের রিসেপসনে এসে ঘরের চাবির জন্য হাত বাড়িয়ে সামনের বড় ঘড়িটার দিকে নজর পড়ে। দু চার পেগ হুইস্কি পেটে থাকলেও চমকে উঠি। দুটো! আড়াইটে!
ছটা দিন এভাবেই কেটে গেল। পরের দিন সকালে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারের বাড়িতে মস্কো বন প্যারিসের ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে নেহরু ঘন্টা দুই আলাপ-আলোচনা করলেন। তারপর প্রবাসী কয়েকজন ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের নানা সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। প্রাইম মিনিস্টারের সম্মানে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের লাঞ্চের সময় নেহরু নিজেই কয়েকজন সাংবাদিকের কাছে এসে বললেন, ডু ইউ নো আই উইল বী মিটিং আওয়ার স্টুডেন্টস অ্যাট ফোর-পাঁচটায় নয়।
প্রাইম মিনিস্টারের প্রোগ্রাম চেঞ্জ হওয়ায় আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হোয়াই দিস চেঞ্জ, স্যার?
নেহরু হাসতে হাসতে বললেন, ভয় নেই, নট সাইনিং এনি এগ্রিমেন্ট উইথ পাকিস্তান অ্যাবাউট কাশ্মীর।
আমরাও হাসলাম।
নেহরু এবার বললেন, কিছু বন্ধুবান্ধব দেখা করতে আসবেন বলেই পাঁচটার বদলে চারটার সময় স্টুডেন্টদের সঙ্গে মীট করব।
পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে। ভারি মজা হয়েছিল ঐ মিটিং-এ।
প্রথমে নেহরু একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। কিছু উপদেশ। শেষে একটি অনুরোধ, তোমাদের অনেকেরই জ্ঞান, বুদ্ধি দেশের কাজে নিয়োজিত হলে ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষের কল্যাণ হবে। নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের একটু ক্ষতি স্বীকার করেও দেশে ফিরে যেতে অনুরোধ করব।
এরপর শুরু হলো ছাত্রদের প্রশ্ন, নেহরুর উত্তর। নানা বিষয়ে নানা প্রশ্ন। দু চারজন ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করলেন, অনেকেই দেশে গিয়ে চাকরি না পেয়ে ফিরে এসেছেন।
নেহরু বললেন, সবাইকে চাকরি দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে ইন্ডিয়া ইজ ভেরি ফাস্ট ডেভলপিং ইন্টু এ মডার্ন নেশন এবং সেজন্য সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজির ছাত্রদের আমাদের বেশি দরকার।
সঙ্গে সঙ্গে একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মিঃ প্রাইম মিনিস্টার, একটি প্রশ্ন করতে পারি?
নেহরু হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ইয়েস, মিঃ ইয়াংম্যান।
স্যার, আমি ইলেকট্রনিসের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স পড়ছি কিন্তু আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক্সের বিশেষ উন্নতি হয়নি বলে আমরা অনেকেই বেশ চিন্তিত।
নেহরু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোমরা চাকরি পাবেই কিন্তু বাইচান্স যদি না পাও তাহলে আই উইল অ্যাপয়েন্ট ইউ অ্যাজ মাই ইলেকট্রনিক্স অ্যাডভাইসার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি থামার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আই অ্যাম সিওর ইউ উইল নট প্রমোট মী টু বী মিনিস্টার অব ইলেকট্রনিক্স।
আবার হাসি।
হাসতে হাসতেই নেহরু জবাব দিলেন, ভুল করে তোমাকে মন্ত্রী করলেও আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি প্রথম সুযোগেই তোমাকে ড্রপ করব।
হাসিতে ফেটে পড়লেন সবাই।
আরো কত জনের কত রকমের প্রশ্ন! লন্ডনের আবহাওয়াই এমন যে কেউই কিছু মনে করেন না।
স্যার, দেশে ফিরে যাবার সময় যদি বিদেশিনী স্ত্রীকে নিয়ে যাই?
চেয়ারে নয়, টেবিলের উপর বসে হাসতে হাসতে প্রাইম মিনিস্টার বললেন, যদি কেন, নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে কিন্তু সঙ্গে কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ আর স্কচের বোতল নিয়ে যেতে ভুল না। ইন্ডিয়াতে ও দুটোরই বড় অভাব।
হাসি।
স্যার! দশ বছর এখানে থাকার পর দেশে ফিরে গেলে সব শহরই নোংরা মনে হবে। আমাদের শহরগুলোর কি উন্নতি করা যায় না?
আমি সব কিছু করে গেলে তুমি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে কি করবে?
হাসি।
স্যার। চিৎকার করল একটা ছেলে, ডু ইউ থিংক উই উইল গেট ব্যাক অকুপায়েড ক্যাশমীর?
ফিরে না পেলে ফিরিয়ে নেব।
সভার শেষে ছাত্রছাত্রীরা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে প্রাইম মিনিস্টারকে ঘিরে ধরলেন। অটোগ্রাফ দিতে দিতে নেহরু টুকটাক ঠাট্টা করতে করতে হঠাৎ ইন্ডিয়ান হাই-কমিশনারের দিকে ফিরে বললেন, ক্যান ইউ ফাইন্ড আউট মাই ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টার?
পনের বছর আগেকার কথা হলেও আমার সব কিছু মনে আছে। কিছু ভুলিনি। হাই কমিশনার নিজে খোঁজখবর করে ছেলেটিকে ভিড়ের মধ্যে থেকে নিয়ে এলেন প্রাইম মিনিস্টারের সামনে। প্রাইম মিনিস্টার ওর সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলতে বলতে এগুতে গিয়ে সামনে কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে দেখে বললেন, তোমাদের ক্যামেরায় কি ফিল্ম নেই যে, আমার ইলেকট্রনিক্স মিনিস্টারের সঙ্গেও আমার একটা ছবি তুলছ না?
পরের দিন লন্ডনের বহু মর্নিং পেপারেই এই ছবিটা ছাপা হয়েছিল। দিল্লিতে ফিরে আসার পর দেখেছিলাম, জেনেছিলাম ভারতবর্ষের নানা কাগজেও এই ছবি ছাপা হয়েছে।
.
দেবব্রত চৌধুরীকে সেই প্রথম দেখি কিন্তু সেদিন আলাপ হয়নি। সুযোগ হয়নি। তাছাড়া হাতে সময় ছিল না।
পরের দিন নেহরু দিল্লির পথে কায়রো রওনা হলেন। আমি গেলাম না, থেকে গেলাম। তিন চার দিন পরে এক সাংবাদিক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে হোবর্ন টিউব স্টেশনে দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা। প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয়। নেহরুর ঐ মিটিং-এ দূর থেকে ভালো লেগেছিল, সাক্ষাৎ পরিচয়ে আরো অনেক বেশি ভালো লাগল।
উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, লন্ডনে কতদিন থাকবেন?
বললাম, ইচ্ছে আছে আরো দিন পনের থাকার, তবে আগেও ফিরে যেতে পারি।
না না, আগে ফিরে যাবেন কেন? এত দূর দেশে এসে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার কোনো মানে হয় না।
তা ঠিক কিন্তু চাকরি আছে যে।
দেবব্রত চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, জার্নালিজমের মতো সুখের চাকরি আছে নাকি?
আমি হাসলাম। টিউব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশি তর্ক করা যায় না। আমি স্ট্রান্ড কন্টিনেন্টালে আছি। কাল বিকেলের দিকে আসুন গল্পগুজব করার পরে নিচের তলার ইন্ডিয়া ক্লাবের রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে মাছ-ভাত খাওয়া যাবে।
প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না আমার আমন্ত্রণ। আচ্ছা আসব।
আমি বললাম, গুড নাইট।
গুড নাইট।
.
নোট বই-পেন্সিল আর টাইপ রাইটার নিয়ে ঘুরছে কত শহর-নগর গ্রাম-গঞ্জ। ঘুরছি স্বদেশে বিদেশে। দেখছি কত মানুষ, মিশছি বহুজনের সঙ্গে। কাউকে ভালো লাগে, কাউকে লাগে না। টাইপ রাইটার খটখট করে নিউজ টাইপ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে যাই অধিকাংশ মানুষকে। সামান্য মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্মৃতি একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় কিন্তু তারপর ভুলে যাই। মুছে যায় সব স্মৃতি। হঠাৎ কদাচিৎকখনও দু-একজনের দেখা পাই যারা আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে। নেহরুর মিটিং-এ ওই কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেবব্রত চৌধুরী আমাকে মুগ্ধ করেছিল। অনেক ছেলে-মেয়ের বুদ্ধি থাকে, চালাক হয়, স্মার্ট হয় কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে একটা মাধুর্য? আপন বৈশিষ্ট্য? বড় কম। সর্বত্রই। বিশেষ করে লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় ছেলেমেয়েদের মধ্যে আরো কম।
.
টেলিফোনের বেল বাজতেই রিসিভার তুলোম। রিসেপসন থেকে মেয়েটি বললল, স্যার, মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।
ডু প্লীজ সেন্ড হিম টু মাই রুম।
একটু পরেই দরজায় নক করার আওয়াজ হলো। দরজা খুলেই বললাম, আসুন, আসুন।
দেবব্রত ঘরে না ঢুকেই বললো, আমাকে তুমি বলাটাই বোধহয় বেশি সমীচীন হবে, তাই না?
আগে ভিতরে আসুন। তারপর…
ঘরে যখন ডাকছেন তখন ঘরের মতো করে নেওয়াই কি ঠিক নয়?
ইলেকট্রনিক্স ছাড়াও আপনি কি টেম্পলস ইন-এ ব্যারিস্টারি পড়ছেন?
দেবব্রত আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ইন ফ্যাকট, দাদা আমাকে ব্যারিস্টার করতেই চেয়েছিলেন।
ইলেকট্রনিক্স পড়ছে কি বাবার অনুরোধে নাকি নিজের ইচ্ছায়?
আমার বাবা নেই। আমার খুব ছেলেবেলায় উনি মারা যান।
কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আর কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, মা আছে তো?
না, তিনিও নেই।
দেবব্রত অত্যন্ত সহজভাবে বললেও আমার মুখ থেকে হাসির শেষ রেশটুকুও উবে গেল। মিনিটখানেক বোধহয় মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর আলতো করে ওর একটা হাত ধরে খুব নিচু গলায় বললাম, বসুন।
দু-চার মিনিট দুজনেই চুপ করে বসে রইলাম। তারপর দেবব্রতই প্রথম কথা বললো, বাবা মা না থাকা নিঃসন্দেহে দুঃখের কিন্তু দাদা আমার সব অভাব দুঃখ ভুলিয়ে দেন।
দাদা বুঝি আপনাকে খুব ভালোবাসেন?
দেবব্রত হাসল। ভালোবাসেন বললেই দাদার ভালোবাসা বোঝান যায় না। আমার দাদার মতো দাদা বোধহয় আর কেউ পায়নি, পাবে না। উনি আবার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, হি ইজ সিম্পলি ইউনিক।
দাদার কথা বলতে বলতে ওর সারা মখখানা আনন্দে, গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাবা-মা নেই বলে সামান্যতম দুঃখের চিহ্ন সে মুখে দেখলাম না। একটু বিস্মিত হলাম। চন্দ্র-সূর্যের মতো বাবা মার অভাব নাকি অপূরণীয়। এতকাল এই কথাই শুনে এসেছি, জেনে এসেছি কিন্তু আজ দেবব্রতকে দেখে বুঝলাম, না তা নয়। হিমালয়ের বুক চিরে গঙ্গা বেরিয়ে এসেছে। তার দুধারে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির, তীর্থক্ষেত্র। সে চির পবিত্র। সুখে-দুখে আনন্দ-উৎসবে জীবনে-মরণে গঙ্গার অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু গোদাবরী কাবেরী, নর্মদা-সিন্ধুও কম পবিত্র নয়। ওদের, দুধারেও অসংখ্য বিগ্রহের মন্দির আছে, আছে তীর্থক্ষেত্র।
গঙ্গা তীরে বাস করতে করতে আমরা অনেকেই ভুলে যাই গোদাবরী কাবেরী নর্মদা-সিন্ধুও সমানভাবে পবিত্র কিন্তু একথা জানতে হলে…
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দেবব্রত বললে, গোদাবরী কাবেরীর দেখা পাওয়া চাই।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন কিন্তু সবাই তো দেখা পায় না।
ঠিক, কিন্তু আমি পেয়েছি। গোদাবরী কাবেরী নয়, মানস সরোবর পেয়েছি।
হঠাৎ অবিশ্বাস্য মনে হলো, বলেন কি?
বিলিভ মী, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।
শুনেছি, পড়েছি ভগবতী দেবীকে পেয়েছিলেন বলে বিদ্যাসাগর মশাইকে কোনো বিগ্রহের পূজা করতে হয়নি। দেবব্রত কি বিদ্যাসাগরের মতোই ভাগ্যবান?
সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে বললাম, নিন।
থ্যাঙ্কস। আমি সিগারেট খাই না।
তাহলে হোয়াট ক্যান আই অফার ইউ?
কিছু দরকার নেই।
খেতে যাবার তো এখনও অনেক দেরি।
বেশ তো গল্প করছি। আমার কিছু লাগবে না।
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আই ক্যান অফার ইউ এ ড্রিঙ্ক।
আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
দিল্লি বা কলকাতা হলে চাকফি খেতে খেতে গল্প করা যেতো কিন্তু এখানে এক কাপ চায়ের চাইতে এক পেগ হুইস্কি অফার করা অনেক সহজ।
দেবব্রত হাসল, তা ঠিক।
আপনি ড্রিঙ্ক করেন কি?
করি না বললে মিথ্যা বলা হবে, তবে খুব কম। কদাচিৎ, কখনও আর কি।
শেষ পর্যন্ত দু গেলাস হুইস্কি নিয়েই দুজনে শুরু করলাম গল্প করতে।
কোথায় লেখাপড়া করেছেন?
দিল্লিতে।
সে কি! আপনি দিল্লির ছেলে?
হ্যাঁ, তাই বলতে পারেন। দাদা তো দিল্লিতেই থাকেন।
বরাবরই দিল্লিতে? আপনার বাবাও দিল্লিতে থাকতেন?
শুধু বাবা কেন, আমার গ্রান্ড ফাদারও দিল্লিতে জীবন কাটিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ যোগাযোগ নেই?
না, একেবারেই নেই। তবে দাদার সঙ্গে দুএকবার হুগলিতে গেছি।
হুগলিতে বুঝি আপনাদের আদি বাড়ি ছিল?
হ্যাঁ।
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার হেড কোয়ার্টার্স কলকাতা থেকে দিল্লি আনার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বাঙালী পরিবার বাংলাদেশ থেকে দিল্লিতে চলে আসেন।
আমাদের ফ্যামিলি কিন্তু গভর্নমেন্ট মুভ করার জন্য দিল্লি আসে না।
তবে?
সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং টু।