০১০. খুবই গোপনীয় একটি ব্যাপার

১০

“আমি আপনাকে যেটা বলতে চাই, রাচেল, প্রেসিডেন্ট বললেন, “সেটা হলো খুবই গোপনীয় একটি ব্যাপার, সেটা আপনার সাম্প্রতিক নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্সের বাইরে একদম।”

রাচেনের মনে হলো এয়ারফোর্স ওয়ান-এর দেয়ালগুলো চেপে ধরছে তাকে। প্রেসিডেন্ট তাকে উড়িয়ে নিয়ে এসে এই ওয়ালপ আইল্যান্ডে এনে, নিজের প্লেনে আমন্ত্রণ জানিয়ে, নিজের হাতে কফি ঢেলে, তাকেই কিনা বলছে যে, তিনি রচেলকে তার বাবার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধা পাবার জন্যে ব্যবহার করবেন। আর এখন কিনা তিনি তাকে একটি গোপনীয় তথ্য দিতে চাচ্ছেন। জাখ হার্নি ওপরে ওপরে যত আন্তরিক আর বিনয়ীই হোন না কেন, রাচেল সেক্সটন বুঝতে পারলো লোকটার সম্পর্কে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু অজানাই রয়ে গেছে। এই লোকটা খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।

“দুই সপ্তাহ আগে,” প্রেসিডেন্ট তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাসা একটি জিনিস আবিষ্কার করেছে।”

শব্দটার অর্থ বুঝতে চেলের একটু সময় লাগলো। নাসার একটি আবিষ্কার? সাম্প্রতিক গোয়েন্দা রিপোর্ট মতে এই এজেন্সিটা এখন আর তেমন কিছু করতে পারছে না। অবশ্য, আজকাল নাসার আবিষ্কার মানে তারা কিছু কম বাজেটের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

“আরো কিছু বলার আগে,” তিনি বললেন, “আমি জানতে চাই, আপনি আপনার বাবার নাসা সম্পর্কে বাতিকগ্রস্ততার কথা কিছু বলবেন কিনা।”

রাচেল কথাটা বুঝতে পারলো। আমি আশা করতে পারি, আপনি আমাকে এখানে আমার বাবার নাসা বিরুদ্ধ কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডেকে আনেননি।”

তিনি হেসে উঠলেন, “একেবারেই না। আমি অনেকদিন সিনেটে ছিলাম, তাই জানি সেজউইক সেক্সটনকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”

“আমার বাবা একজন সুবিধাবাদী লোক, স্যার। বেশিরভাগ সফল রাজনীতিবিদদের মতোই। আর দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো নাসা নিজে একটি সুবিধা হিসেবে তার কাছে ধরা দিয়েছে। ইদানীংকালের নাসার ভুলত্রুটিগুলো এতোটাই অসহায়রকমের যে, কেউ হাসবে না হয়তো কাঁদবে– যে উপগ্রহটা কক্ষপথে ছেড়ে দেয়া হলো, সেটা আর কোনো খবর পাঠাতে পারছে না। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বাজেট দশগুন বেড়ে যাওয়াতে সদস্য দেশগুলো এমনভাবে পিছু হটে গেছে যে ডুবন্ত জাহাজ থেকে ইঁদুরের দল লাফিয়ে পড়ছে। বিলিয়ন ডলারের অপচয় হয়েছে। আর সেক্সটন সেই ঢেউয়ের ওপর সওয়ার হয়েছেন– এমন একটি ঢেউ, যা তাঁকে ১৬৮০ পেনসেলভিনিয়া এক্সির উপকূলে পৌঁছে দিতে পারবে।

“আমি মানছি,” প্রেসিডেন্ট বললেন, “নাসা একটি চলন্ত দূর্বিপাক। প্রতিবারই আমি যখন তাদেরকে ফিরিয়ে দেই, তারা আমাকে আরেকটা কারণ দেখিয়ে দেয় তাদের বাজেট কাটছাট করার জন্য।

রাচেল একটা ফাঁক পেয়ে গেলো। তারপরও, স্যার, আমি কি পড়িনি যে, আপনি গত সপ্তাহে তাদেরকে আরো তিন বিলিয়ন ডলার জরুরি ভতুর্কি দিয়ে আরেকবার রক্ষা করেছেন?”

প্রেসিডেন্ট মিটিমিটি হাসলেন। “আপনার বাবা এতে খুশিই হয়েছেন, তাই না?”

“অনেকটা নিজের ঘাতকের কাছে অস্ত্র পাঠিয়ে দেবার মত।”

“লাইভলাইন অনুষ্ঠানে তাঁর কথা কি আপনি শুনেছেন? ‘জাখ হার্নি হলেন মহাশূন্য আসক্ত আর ট্যাক্স দাতারা তার অভ্যাসের খোরাক জোগাচ্ছেন।”

“কিন্তু আপনারা তার কথাটাকে ঠিক বলেই তো প্রমাণ করে যাচ্ছেন, স্যার।”

হার্নি মাথা নাড়লেন। “আমি এ ব্যাপারটা লুকাব না যে, আমি নাসার একজন ভক্ত। সব সময়ই আমি তাই ছিলাম, আমি স্পেস রেস যুগের একজন সন্তান– স্পুটনিক, জন গ্লেন, এ্যাপোলো ১১– আর আমি কখনও এটা প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হইনি যে, আমাদের স্পেস প্রোগ্রাম দেশের গর্ব। আমার মতে, নাসা’তে কর্মরত নারী-পুরুষের ইতিহাসের আধুনিক অগ্রপথিক। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করে, ব্যর্থতা মেনে নেয়, সবার সমালোচনা সহ্য করে পুনরায় কাজে লেগে পড়ে।”

রাচেল নিরব রইল, আঁচ করতে পারলো প্রেসিডেন্টের শান্তশিষ্ট আচরণ একটু বদলে গেছে, তার বাবার বিরামহীন নাসা বিরোধী কথাবার্তায় ক্ষেপে আছেন তিনি। রাচেল ভাবতে লাগলো নাসা আসলে কী আবিষ্কার করেছে।

“আজ,” হার্নি বললেন, তাঁর কণ্ঠে উত্তেজনা। “আমি আপনার নাসা সম্পর্কিত ধারণাটা একটু বদলে দিতে চাই।”

রাচেল কিছু না বুঝতে পেরে তাঁর দিকে তাকালো। “ইতিমধ্যেই আপনি আমার ভোট পেয়ে গেছেন, স্যার। আপনার এখন দেশের বাকি লোকদের ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া দরকার।”

“সেটাই আমি চাই।” তিনি হেসে কফিতে চুমুক দিলেন। “আর আমি সে ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাইছি।” একটু থেমে তিনি রাচেলের দিকে ঝুকলেন। “খুবই ভিন্ন একটি পথে।”

এবার রাচেল বুঝতে পারলো জাখ হার্নি তার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকেই নজর রাখছেন, যেমন কোনো শিকারী তার শিকারের ওপর নজর রাখে, যাতে সেটা পালাতে না পারে। দুঃখের বিষয় হলো, রাচেল পালাবার কোনো পথ দেখতে পেলো না।

“আমার ধারণা, প্রেসিডেন্ট দুজনের মগেই কফি ঢেলে বললেন, “আপনি নাসার ইওএস প্রকল্পটির কথা শুনেছেন?”

রাচেল সায় দিলো। “আর্থ অবজারভেশন সিটেম। আমার বিশ্বাস আমার বাবা এটা এক বা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন।”

সত্য হলো রাচেলের বাবা প্রায় সব সময়ই এটা উল্লেখ করে থাকেন। এটা হলো নাসার সবচাইতে ব্যয়বহুল আর বিতর্কিত একটি প্রকল্প– পাঁচটি স্যাটেলাইটের একটি স্থাপনা, যা মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর পরিবেশ বিশ্লেষণ করে: ওজনস্তরের ক্ষয় হওয়া, মেরু অঞ্চলের বরফ গলা, বৈশ্বিক উষ্ণতা, রেইনফরেস্টের বিলুপ্ত হওয়া। এখান থেকে উপাত্ত নিয়ে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে ভাল ফলদায়ক হবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ইওএস প্রকল্পটি ব্যর্থতায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। নাসার অন্য অনেক প্রজেক্টের মতই এই প্রজেক্টটাও শুরু থেকে ব্যয়বহুল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে জাখ হার্নির বেশ কোনোঠাসাও হয়েছেন। তিনি কংগ্রেস থেকে অনুমোদন করিয়ে ইওএস প্রকল্পে ১.৪ বিলিয়ন ডলার জুগিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি, ক্রমাগত লাঞ্চিং ব্যর্থতা, কম্পিউটার গোলযোগ, আর নাসা’র সংবাদ সম্মেলন ছাড়া অন্য কোনো ফলপ্রসু কাজ হয়নি। এ ব্যাপারে একমাত্র লাভ হয়েছে কেবল সিনেটের সেক্সটনের। যিনি ভোটারদেরকে বোঝাতে পেয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট তাদের মূল্যবান ট্যাক্সের পয়সা কীভাবে এসব ফালতু কাজে ঢেলে নষ্ট কছেন।

প্রেসিডেন্ট তাঁর মগে একটু চিনি ঢেলে নিলেন। “এটা খুব অবাক করার মত হতে পারে, নাসার আবিষ্কারটা ইওএস’র মাধ্যমেই হয়েছে।”

রাচেল এবার খেই হারিয়ে ফেললো। ইওএস যদি সাম্প্রতিক এই সাফল্য পেয়েই থাকে, তবে নাসা নিশ্চিতভাবেই সেটা ঘোষণা করত, তাই নয়কি? তার বাবা তো ইওএসকে মিডিয়াতে ক্রুশবিদ্ধ করেছেন, তাই স্পেস এজেন্সি ভাল খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবহার করবে।

“আমি ইওএস’এর আবিষ্কারের ব্যাপারে কিছুই শুনিনি,” রাচেল বললো।

“আমি জানি। নাসা এই সুসংবাদটি আরো কিছুদিন নিজেদের কাছেই রাখতে চায়।”

রাচেল সন্দেহ করলো, “আমার অভিজ্ঞতা বলে, স্যার, নাসা’র জন্য কোনো খবরই সুসংবাদ, নয়।” রাচেলের এনআরও’তে একটা জোক প্রচলিত রয়েছে যে, নাসা তাদের কোনো বিজ্ঞানী পাদ দিলেও সংবাদ সম্মেলন করে থাকে।

প্রেসিডেন্ট সুরু তুললেন। “আহ, হ্যাঁ। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি পিকারিংয়ের একজন শিষ্যের সাথে কথা বলছি। সে কি এখনও নাসা’র ব্যর্থতা নিয়ে গজগজ করে থাকে?”

“তার কাজ হলো নিরাপত্তা নিয়ে, স্যার। তিনি সেটা খুব গুরুত্বের সাথেই দেখেন।”

“খুব ভাল মতই দেখে সেটা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, একই রকম দুটো এজেন্সি হলেও তারা একে অন্যের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রাখে না।”

উইলিয়াম পিকারিংয়ের অধীনে কাজ করতে গিয়ে রাচেল জানতে পেরেছে যে, যদিও নাসা এবং এনআরও স্পেস সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, কিন্তু তাদের দর্শন পুরোপুরি বিপরীত মেরুর। এনআরও হলো প্রতিরক্ষা এজেন্সি আর তারা সব কিছুই গোপন রাখে। অথচ নাসা তার যেকোন ধরণের কর্মকাণ্ডই প্রচার করে বেড়ায়– এজন্যে প্রায়শই, পিকারিং জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেন। নাসা’র কিছু উন্নতমানের প্রযুক্তি– হাই রেজুলেশন লেন্স সমৃদ্ধ স্যাটেলাইট টেলিস্কোপ, দূরপাল্লার যোগাযোগ সিস্টেম এবং রেডিও ইমেজিং যন্ত্রপাতি শত্রুভাবাপন্ন দেশের কাছে নিজেদের গোয়েন্দা কার্যক্রমকে উন্মোচিত করে ফেলে। বিল পিকারিং প্রায়ই বলেন যে, নাসার লোকজনের রয়েছে বড়সড় মাথা, তার চেয়ে বড় তাদের মুখ।

তাছাড়া অন্য যে কারণটা রয়েছে সেটা হলো, এনআরও’র স্যাটেলাইটগুলো নাসাই উৎক্ষেপণ করে থাকে, সাম্প্রতিককালে নাসা’র ব্যর্থতা সরাসরি এনআরও’কে সমস্যায় ফেলে দেয়। ১৯৯৮ সালের ১২ই আগস্টের ব্যর্থতার চেয়ে অবশ্য বড় ব্যর্থতা আর হয় না। নাসার টাইটান ৪ রকেট লাঞ্চিংয়ের চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে তার মধ্যে থাকা সব কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল–১.২ বিলিয়ন ডলারের এনআরও’র স্যাটেলাইট, ছদ্মনাম ভোরটেক্স-টু। মনে হয় পিকারিং এটা কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না।

“তো, নাসা কেন এই ব্যাপারটা নিয়ে জনসম্মুখে কিছু বলছে না?” রাচেল বললো। “এই মুহূর্তে তাদের তো এ রকম ভাল খবরই ব্যবহার করা উচিত।”

“নাসা চুপ আছে,” প্রেসিডেন্ট বললেন, “কারণ আমি তাদেরকে এরকম করতে আদেশ করেছি।”

রাচেল অবাক হয়ে গেলো, সে কি ভুল শুনছে। প্রেসিডেন্ট কেন এরকম হারিকিরি করছেন, সেটা সে বুঝতে পারলো না।

“আবিষ্কারটা,” প্রেসিডেন্ট বললেন। “আমরা বলতে পারি…অবিশ্বাস্য রকমের।”

রাচেলের অস্বস্তি হলো। গোয়েন্দা বা ইন্টেলিজেন্স জগতে অবিশ্বাস্য কথাটা খুব কম সময়ই ভাল সংবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো সমস্যা কি হয়েছে?”

“না, কোনো সমস্যা নেই। ইওএস যা আবিষ্কার করেছে, তা এক কথায় দারুণ।”

রাচেল চুপ মেরে গেলো।

“ধরুন, আমি আপনাকে বললাম যে, নাসা এমন একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছে যার গুরুত্ব অপরিসীম…দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা…তবে কি সেটা আমেরিকানদের মূল্যবান অর্থের সদ্ব্যবহার হিসেবে ধরা হবে?”

রাচেল কল্পনাও করতে পারছিল না।

প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়ালেন। “আসুন, একটু হাটাহাটি করি?”

১১

রাচেল এয়ারফোর্স ওয়ানের গ্যাংওয়েতে প্রেসিডেন্ট হার্নির সাথে হাটছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই তার মনে হলো মার্চের বাতাস পরিষ্কার করে দিচ্ছে তার মনটা। এখন প্রেসিডেন্টের কথা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁর দাবিটা আগের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

নাসা এমন একটি আবিষ্কার করেছে যাতে আমেরিকানদের প্রতিটি ডলারেরই সদ্ব্যবহার হয়েছে?

রাচেল কেবলমাত্র একটা আবিষ্কারের কথাই ভাবতে পারলো, যেটা এ ধরণের গুরুত্ব বহন করতে পারে, আর সেটা হলো নাসার হলিগ্রেইল– অপার্থিব জীবের সাথে যোগাযোগ করা। কিন্তু রাচেল এও জানত যে এরকম হলিগ্রেইলের সন্ধান পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব।

একজন ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক হিসেবে রাচেল তার কর্মক্ষেত্রের বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে বিরামহীনভাবেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়-অপার্থিব জীবদের সাথে সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি সরকার আড়াল করছে কিনা। শিক্ষিত বন্ধুদের কাছ থেকে বহু ধরণের তত্ত্ব শুনে থাকে সে-বহির্জগতের প্রাণীদের ভূপাতিত মহাকাশযান সরকারের গোপন কোনো বাঙ্কারের লুকিয়ে রাখা, অপার্থিবজীবের শবদেহ বরফে সংরক্ষণ করা, এমনকি কিছু বেসামরিক লোককে বহিজীবেরা অপরহণ করে নিয়ে গিয়ে অপারেশনও করেছে গবেষণার জন্য।

এসবই বাজে কথা, অবশ্যই। কোনো বহিজীব নেই। কোনো লুকানোর ব্যাপারও নেই।

ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিতে সবাই জানে এবং বোঝে, বেশিরভাগ অপার্থিবজীব দর্শন এবং তাদের কর্তৃক অপহৃত হবার কাহিনীগুলো উর্বর কল্পনাপ্রসূত অথবা টাকা কামানোর ধান্দাবাজি। যখনই কোনো বিশ্বাসযোগ্য ইউএফও’র ছবির প্রমাণ পাওয়া যায়, অদ্ভুতভাবেই সেটা কোনো ইউএস মিলিটারি বিমানঘাঁটির কাছেই ঘটে, যারা উন্নতমানের গোপন এয়ার ক্রাফটের উড্ডয়ন পরীক্ষা করে থাকে। লকহিড যখন তাদের নতুন জেট ফাইটার, যার নাম স্টিলথ বোম্বার, এর পরীক্ষা করতে শুরু করলো, এডওয়ার্ড এয়ারফোর্স ঘাঁটির আশেপাশে ইউএফও’র দর্শনের ঘটনাও পঞ্চাশগুন বেড়ে গেলো।

“আপনার চোখে সন্দেহের আভাস দেখতে পাচ্ছি,” প্রেসিডেন্ট বললেন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে।

তাঁর কণ্ঠটা শুনে রাচেল চমকে উঠলো। সে তাকালো, বুঝতে পারলো না কী বলবে। “তো…” সে ইতস্তত করলো। আমার ধারণা, স্যার, আমরা কোনো বর্হিজীবের মহাকাশযান।

অথবা ক্ষুদে সবুজ রঙের মানুষদের কথা বলছি না?”

প্রেসিডেন্টকে দেখে মনে হলো নীরবে তিনি মজা পাচ্ছেন। “রাচেল, আমার মনে হয়, আপনি এই আবিষ্কারটাতে কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর চেয়েও বেশি কৌতূহলের বিষয় খুঁজে পাবেন।”

রাচেল এটা শুনে স্বস্তি পেলো যে, নাসা প্রেসিডেন্টের কাছে কোনো বৰ্হিজীবের গল্প বিকানোর চেষ্টা করছে না। তারপরও, তার কথাটাতে গভীর রহস্য রয়েছে। “তো,” সে বললো, “নাসা যাই খুঁজে পাক না, সময়টা একেবারেই সুবিধাজনক বলে আমার মনে হচ্ছে।”

হার্নি থেমে গেলেন। “সুবিধাজনক? কীভাবে?”

কীভাবে? রাচেলও থেমে গিয়ে তার দিকে তাকালো। “মি: প্রেসিডেন্ট, নাসা বর্তমানে জীবন মরণ সমস্যায় আছে, এর বিশাল বাজেটের যথার্থতা সম্পর্কে সবাই এখন সন্দিহান, আর আপনি এটার পেছনে অর্থ ঢালার জন্য বিরামহীনভাবেই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। একটা জবরদস্ত আবিষ্কার, এ মুহূর্তে নাসা এবং আপনার নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিশাল সুবিধা এনে দেবে। আপনার সমালোচকরা, সময়টার ব্যাপারে খুবই সন্দেহ পোষণ করবে।”

“তো…আপনি আমাকে একজন মিথ্যাবাদী অথবা বোকা, কোনোটা বলবেন?”

রাচেলের মনে হলো তার গলায় গিট লেগে গেছে। আমি আপনাকে অশ্রদ্ধা করতে চাইনি, স্যার। আমি কেবল–”

“রিলাক্স।” হার্নির মুখে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি। তিনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। “নাসার প্রধান যখন আমাকে খবরটা দিলেন, আমি সেটা আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, আমি তাকে ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্য রাজনৈতিক চালবাজি বলে অভিযুক্ত করেছিলাম।”

রাচেলের মনে হলো তার গলার গিটটা একটু আলগা হয়ে গেছে।

সিঁড়ির শেষ মাথায় নেমে হার্নি থেমে তার দিকে তাকালেন। “একটা কারণেই আমি নাসা’কে তাদের এই আবিষ্কারটার কথা একটু চেপে যেতে বলেছি, সেটা হলো তাদেরকে রক্ষা করার জন্য। এই আবিষ্কারের গুরুত্বটা নাসার ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এটা চাঁদের। মাটিতে মানুষের অবতরণের ঘটমাকেও ম্লান করে দেবে। যেহেতু, আমাদের সবাই এটাকে নাজুক খবর বলে মনে করছি, তাই আমি চাইছি নাসা’র উপাত্তগুলো ডাবল চেক করে তারপর পৃথিবীবাসীকে জানাই।”

রাচেল চমকে গেলো। “নিশ্চিতভাবেই আপনি আমার কথা বলছেন না, স্যার?”

প্রেসিডেন্ট হাসলেন। “না, এটাতো আপনার নিজের ক্ষেত্র নয়। তাছাড়া, আমি ইতিমধ্যেই সরকারের বাইরের লোকদের দিয়ে সেটা যাচাই করে ফেলেছি।”

রাচেলের স্বস্তি ভাবটা আবারো নতুন এক রহস্যে হারিয়ে গেলো। “সরকারের বাইরে, স্যার? আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যবহার করেছেন? এরকম গোপনীয় ব্যাপারে?”

প্রেসিডেন্ট সায় দিলেন অপরাধীর মতন। “আমি একটি বহিরাগত টিমকে পাঠিয়েছি– চার জন বেসামরিক বিজ্ঞানী– নাসার কেউ নন, কিন্তু খুবই নামী-দামী ব্যক্তি তারা। তারা তাঁদের নিজেদের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই সিদ্ধান্তে আসবেন। আট-চল্লিশ ঘণ্টা আগেই তারা নিশ্চিত করেছে যে, নাসা’র আবিষ্কারটাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।”

এবার রাচেল মুগ্ধ হলো। প্রেসিডেন্ট খুব সতর্কভাবেই এগিয়েছেন, এটাকেই বলে হার্নির চাল। বাইরের লোক নিযুক্ত করে– যারা নাসা’র আবিষ্কারটাকে নিশ্চিত করলে কোনো ভাবেই লাভবান হবেন না– হার্নি আবারো নিজেকে সুরক্ষার আবরণে ঢেকে এগোচ্ছেন। যাতে। সমালোচক এবং বিশেষ করে সিনেটর সেক্সটনের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন।

“আজ রাত আটটা বাজে,” হার্নি বললেন, “আমি হোয়াইট হাউজ থেকে একটা প্রেস কনফারেন্স করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে চাই এই খবরটা।”

রাচেল বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলো। সত্যি বলতে কী, হার্নি তাকে এখনও আসল কথাটাই বলেনি। “এই আবিষ্কারটা আসলে কি?”

প্রেসিডেন্ট হাসলেন, “আপনি আজকে বুঝতে পারবেন যে ধৈর্য একটি ভালো গুণ। এই আবিষ্কারটা এমন কিছু যা আপনি নিজেই দেখতে পাবেন। আমরা কাজ শুরু করার আগে, আমি চাই আপনি পরিস্থিতিটা পুরোপুরি বুঝে নেন। নাসার প্রধান আপনাকে সেটা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনার যা জানার দরকার তা তিনিই বলে দেবেন। তার আগে, আপনার ভূমিকা কী হবে, সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।”

রাচেল প্রেসিডেন্টের চোখে একটা অকথিত ড্রামার আভাস পেল। তার মনে পড়ে গেলো পিকারিংয়ের সতর্কবাণীটার কথা, হোয়াইট হাউজের অন্য কোনো মতলব রয়েছে। মনে হচ্ছে, পিকারিং যথারীতি আবারো সঠিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

হার্নি কাছেই একটা এয়ারপ্লেন হ্যাঙ্গারের দিকে এগোলেন, “আমার সঙ্গে আসুন,” তিনি বললেন।

রাচেল দ্বিধাগ্রস্তভাবে তার পিছু পিছু এগোলো। তাদের সামনের ভবনটার কোনো জানালা নেই, আর এটার দরজা সিল মারা। একমাত্র প্রবেশদ্বার মনে হয় পাশের একটা ছোট্ট দরজা। প্রেসিডেন্ট দরজার একটু আগে এসে থেমে গেলেন।

“আমার দৌড় এ পর্যন্ত,” দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন। “আপনি সেখানে। যাবেন।”

রাচেল দিখন্বিত হলো, “আপনি আসছেন না?”

“আমাকে হোয়াইট হাউজে ফিরে যেতে হবে। একটু পরেই আমি আপনার সাথে কথা বলব। আপনার কাছে কি সেলফোন রয়েছে?”

“অবশ্যই, স্যার।”

“সেটা আমাকে দিন।”

রাচেল ফোনটা বের করে তাঁর হাতে দিলো, ধরে নিলো তাতে কোনো নম্বর ঢুকিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে পকেটে ভরে নিলেন।

“এবার আপনি ধরাছোঁয়ার বাইরে, প্রেসিডেন্ট বললেন। “আপনার কাজটা হবে গোপনে। আপনি এখন থেকে আমার অথবা নাসার প্রধানের অনুমতি ছাড়া কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। বুঝেছেন?”

রাচেল তাকিয়ে রইল। প্রেসিডেন্ট কি এইমাত্র আমার সেলফোনটা চুরি করলেন?

“নাসা প্রধান আপনাকে এই আবিষ্কারের ব্যাপারে বৃফ করার পর তিনি আমার সাথে আপনাকে নিরাপদ একটি চ্যানেলের মাধ্যমে যোগযোগ করিয়ে দেবেন। খুব শীঘ্রই আপনার সাথে কথা হচ্ছে। গুড লাক।”

রাচেল হ্যাঙ্গারের দরজার দিকে তাকিয়ে টের পেলো তার ভেতরে অস্বস্তিটা বেড়ে গেছে।

প্রেসিডেন্ট হার্নি তার কাঁধে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে হাত রেখে দরজার দিকে ইঙ্গিত করলেন। “আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই, রাচেল, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করে পস্তাবেন না।”

আর কোনো কথা না বলে তিনি পেইভ হকের দিকে এগিয়ে গেলেন, যেটাতে চড়ে রাচেল এসেছে। তিনি ওটাতে উঠতেই সেটা উড়ে চলে গেলো। তিনি আর ফিরেও তাকালেন না।

১২

ওয়ালপ হ্যাঙ্গারের ফাঁকা জায়গাটাতে রাচেল সেক্সটন দাঁড়িয়ে রইল। সামনের অন্ধকারের দিকে পিট পিট করে তাকালো সে। তার মনে হলো সে অন্য পৃথিবীতে এসে পড়েছে। ভেতর থেকে ঠাণ্ডা আর রহস্যময় বাতাস তেড়ে আসছে, যেনো ভবনটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

“হ্যালো?” সে ডাক দিলো, তার কণ্ঠটা একটু কেঁপে উঠলো। সব নিরব-নিথর।

একটু ভয়ে ভয়ে সে ভেতরের দিকে এগোল। তার দৃষ্টি শক্তি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। আস্তে আস্তে সেটা কেটে গেলো।

“মিস সেক্সটন, তাই না?” একগজ দূরেই এক লোকের কণ্ঠ কোনো গেলো।

রালে লাফিয়ে, ঘুরে দেখলো কে কথা বলছে। “হ্যাঁ, স্যার।” একটা অস্পষ্ট অবয়ব তার সামনে এগিয়ে এলো।

রাচেল ভালো করে তাকাতেই দেখতে পেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত চোয়ালের নাসা’র সুট পরা এক তরুণ। তার শরীর খুবই সুঠাম আর পেশীবহুল।

কমান্ডার ওয়েন লুসিজিয়ান, লোকটা বললো। “আপনাকে চমকে দিয়ে থাকলে, দুঃখিত, ম্যাম। এখানটায় খুবই অন্ধকার। আমি এখনও বে দরজাটা খুলিনি।” রাচেল কিছু বলার আগেই লোকটা আবার বলতে শুরু করলো, “আপনার পাইলট হতে পারলে আমার জন্য সম্মানের ব্যাপার হবে।

“পাইলট?” রাচেল লোকটার দিকে চেয়ে রইলো। একজন পাইলটকে পাঠানো হয়েছে।

“আমার সাথে তো নাসার প্রধানের দেখা হবার কথা।”

“হ্যাঁ, ম্যাম। আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে বলা হয়েছে, এক্ষুণি।”

কথাটা শুনে তার মনে খটকা লাগলো। মনে হচ্ছে তার ভ্রমণ পর্বটা এখনও শেষ হয়নি। “নাসা প্রধান কোথায় আছেন?” রাচেল জানতে চাইলো, তাকে ঘাবড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

“সেটা আমার জানা নেই,” পাইলট জবাব দিলো। “আমরা আকাশে ওড়ার পরই তাঁর কাছ থেকে ঠিকানাটা পাবো।”

রাচেলের মনে হলো লোকটা সত্যি বলছে। বোঝাই যাচ্ছে, পিকারিং আর তাকেই কেবল অন্ধকারে রাখা হয়নি এ ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট এই ব্যাপারটা বেশ কড়াভাবেই গোপন রেখেছেন। আর রাচেল এটা ভেবে বিব্রত হলো যে, প্রেসিডেন্ট কত স্বাচ্ছন্দে আর দ্রুতই তাকে ‘ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। আধঘণ্টার মধ্যেই আমার সব রকম যোগাযোগ কেড়ে নেয়া হয়েছে আর আমার ডিরেক্টর এও জানেন না আমি এখন কোথায়।

রাচেল বুঝতে পারলো সে চাক বানা চাক, এই ভ্রমণটা তাকে করতেই হবে। একমাত্র প্রশ্নটা হলো কোথায় যাচ্ছে তারা।

পাইলট দেয়ালের একটা বাক্স খুলে বোতাম চাপতেই স্লাইডিং দরজাটা খুলে গেলো প্রচণ্ড শব্দ করে। ভেতরে একটা বিশাল যন্ত্রদানবকে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

রাচেলের মুখ হা হয়ে গেলো। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করে।

একটা বিশাল, ভয়ঙ্কর দেখতে, কালো জেট ফাইটার প্লেন। এরকমটি রাসেল এর আগে কখনও দেখেনি।

ঠাট্টা করছেন, সে বললো।

“প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে সচরাচর এমনটিই হয়, ম্যাম, কিন্তু এফ-১৪ টমক্যাট খুবই নির্ভরযোগ্য ক্রাফট।”

এর ডানায় মিসাইল রয়েছে।

পাইলট রাচেলকে ক্রাফটার সামনে নিয়ে গেলো। সে দুটো ককপিটের দিকে ইঙ্গিত ক’রে বললো, “আপনি বসবেন পেছনে।”

“সত্যি?” সে তার দিকে চেয়ে শক্ত করে হাসলো। “আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আমাকে এটা চালাতে দেবেন।”

.

পোশাকের উপর থার্মাল সুটটা পরার পর, রাচেল ককপিটে উঠে বসলো। সে কোনো মতে সংকীর্ণ আসনে বসে পড়লো।

“নাসার মনে হয় পাছা-মোটা কোনো পাইলট নেই?” সে বললো।

পাইলট তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। সে রাচেলের মাথায় একটা হেলোমেট পড়িয়ে দিলো।

“আমরা অনেক ওপর দিয়ে উড়বো,” সে বললো, “আপনার অক্সিজেনের দরকার আছে।” সে একটা অক্সিজেন মাস্ক তার হেলেমেটের সাথে লাগিয়ে দিতে উদ্যত হলো।

‘আমি পারবো,”বলে রাচেল সেটা নিয়ে নিলো।

“অবশ্যই, ম্যাম।”

মাস্কটা ভালোমত লাগলো না, অস্বস্তি লাগলো তার।

কমান্ডার দীর্ঘ সময় ধরে চেয়ে রইলো তার দিকে, দেখে মনে হচ্ছে খুব মজা পাচ্ছে।

“ভুল হয়েছে কি?” রাচেল জানতে চাইলো।

“মোটেই না ম্যাম।” মনে হলো একটা চাপা হাসি লুকাতে চাইছে সে। “হ্যাক স্যাক আপনার সিটের নিচে আছে। এতে দ্রুত ছোটার সময় বেশিরভাগ লোকই বমি করে ফেলে।”

“আমি ঠিক থাকবো,” রাচেল তাকে আশ্বস্ত করলো, “আমি বমি করবো না।”

পাইলট কাঁধ ঝাঁকালো। “নেভি সিলদের অনেকেই এরকম বলে থাকে, আর আমাকে তাদের উগলানো বস্তুগুলো পরিষ্কার করতে হয় ককপিট থেকে।”

সে দুর্বলভাবে মাথা নাড়লো। চমৎকার।

“যাবার আগে কোনো প্রশ্ন আছে কি?”

রাচেল তার মুখ থেকে মাউথ পিসটা সরিয়ে বললো, “এটা আমার রক্তপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। দীর্ঘ ফ্লাইটে আপনারা এটা কি করে পরে থাকেন?”

পাইলট ধৈর্যের সাথে হাসলো। “আসলে, ম্যাম, আমরা এটা সাধারণত উল্টো করে তো আর পরি না।”

রানওয়েতে দাঁড়িয় ইনজিনটা গোঙাতে শুরু করলো। রাচেলের মনে হলো একটা বন্দুক থেকে বুলেট বের হবার জন্য অপেক্ষা করছে। পাইলট ইনজিনটা আরো বাড়িয়ে দিলে সেটা ভীষণ জোরে শব্দ করতে লাগলো। ব্রেকটা ছাড়তেই রাচেল পেছনের দিকে ধাক্কা খেল। জেটটা রানওয়ে দিয়ে ছুটতেই, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আকাশে উঠে গেলো। বাইরে, পৃথিবীটা যেন ছোট হয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।

প্লেনটা আকাশের অভিমুখে ছুটতেই রাচেল চোখ বন্ধ করে ফেললো।

.

টমক্যাটটা ৪৫০০০ ফিট উঁচুতে উঠে গেলে রাচেলের বমি বমি লাগতে শুরু করলো। সে তার চিন্তাভাবনাগুলো অন্যত্র নিক্ষেপ করতে চাইলো। নয় মাইল নিচে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, রাচেলের আচমকা মনে হলো বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছে সে।

সামনের দিকে, পাইলট রেডিওতে কারো সাথে কথা বলছে। কথা শেষ হলে পাইলট রেডিওটা রেখে টমক্যাটটাকে একেবারে বাম দিকে ঘুরিয়ে নিলো। প্লেনটা এখন একেবারে খাড়াখাড়ি আছে, তাই রাচেলের আবারো বমি বমি ভাব হলো। অবশেষে প্লেনটী আবারো এক রেখায় চলে এলো।

রাচেল আর্তচিৎকার করলো যেনো।”ধন্যবাদ সতর্ক করে দেয়ার জন্য।”

“আমি দুঃখিত ম্যাম, আমি এইমাত্র নাসা’র প্রধানের কাছ থেকে আপনাকে কোথায় নামাতে হবে সেই গোপন তথ্যটা পেয়েছি।”

“আমাকে অনুমান করতে দিন,” রাচেল বললো। “উত্তর দিকে?”

মনে হলো পাইলট দ্বিধান্বিত। “আপনি সেটা কি করে জানলেন?”

রাচেল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কম্পিউটার ট্রেইন্ড পাইলটকে ভালবাসতেই হবে।

“এখন নটা বাজে, আর সূর্যটা আমাদের ডানে রয়েছে, সুতরাং আমরা উত্তর দিকেই যাচ্ছি।”

পাইলট কিছুক্ষণ পর্যন্ত কিছুই বললো না। “হ্যাঁ, ম্যাম, আমরা উত্তর দিকেই যাচ্ছি।”

“উত্তর দিকে আমরা আর কত দূর যাবো?”

পাইলট কী যেন একটা দেখে নিলো। “আনুমানিক তিন হাজার মাইল।”

রাচেল সোজা হয়ে বসলো। “কী?” সে আতকে উঠে বললো, “এটা তো চার ঘণ্টার ফ্লাইট!”

“আমাদের বর্তমান গতিতে, হ্যাঁ, তাই,” সে বললো, “একটু সাবধান, আটোসাটো হয়ে বসুন, প্লিজ।”

রাচেল কিছু বলার আগেই পাইলট জেটটা এমন গতি ছোটালো যে নিজের সিটের পেছনে সেঁটে রইলো সে। এক মিনিটের মধ্যেই তাদের গতি বেড়ে দাঁড়ালো ঘণ্টায় ১৫০০ মাইল।

রাচেলের এবার বমি বমি ভাবটা আরো তীব্র হলো। সেটা যেননা সে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠটা প্রতিধ্বনিত হলো। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, রাচেল, আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে আপনি পাবেন না।

গোঙাতে গোঙাতে রাচেল তার সিটের নিচ থেকে হ্যাঁক-স্যাকটা তুলে নিলো। রাজনীতিবিদের কখনও বিশ্বাস করতে নেই।

১৩

সিনেটর সেজউইক সেক্সটন পাবলিক ট্যাক্সি খুব একটা পছন্দ করেন না। তারপরও মাঝে মাঝে তাঁকে সেটা ব্যবহার করতে হয়। মে ফ্লাওয়ার ক্যাবটা তাঁকে হোটেল পারদুতে নামিয়ে দিলো, এটা তিনি নিজের পরিচয় লুকাতে ব্যবহার করেছেন।

হোটেলের এই নিচ তলাটা, যেখানে গাড়ি পার্ক করা হয়, সেটা ফাঁকা দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। কেবলমাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ধুলো মলিন গাড়ি সিমেন্টের পিলারের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। সেক্সটন হাঁটতে হাঁটতে হাত ঘড়িটা দেখে নিলেন।

১১টা ১৫ মিনিট। পারফেক্ট।

যে লোকটার সাথে সেক্সটন সাক্ষাত করবে সে সময়ের ব্যাপারে একেবারে নিখুঁত।

সেক্সটন সাদা রঙের ফোর্ড উইন্ডস্টার মিনি ভ্যানটা দেখতে পেলেন ঠিক সেই জায়গায়, তাদের প্রতিটি মিটিংয়ের সময়ই গাড়িটা যেখানে থাকে– গ্যারাজের পেছনে। সেক্সটন এই লোকটার সাথে উপরের তলায় একটা সুটে দেখা করতেই বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি। নিশ্চিত করে সতর্কতার ব্যাপারটা বোঝেন। এই লোকটার বন্ধুরা এসব নিয়ে হেলাফেলা করতে চায় না।

সেক্সটন ভ্যানটার সামনে দিয়ে যাবার সময় এক ধরণের অতিপরিচিত রোমাঞ্চ অনুভব করেন, প্রতিটি মিটিংয়ের সময়ই এরকমটি তার হয়। নিজেকে জোর করে সহজ রাখার চেষ্টা করলেন, কাঁধ দুটো সহজ করে ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রবল উত্তেজনায় প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলেন। ড্রাইভারের আসনে বসা কালো চুলের লোকটা একটুও হাসলো না। লোকটার বয়স। প্রায় সত্তর হবে। কিন্তু তাঁর ভাবসাব খুবই রাফ এ্যান্ড টাফ আর সেনাবাহিনীর মতই কঠোর, দয়া-মায়াহীন।

“দরজাটা বন্ধ করুন,” লোকটা বললো, তার কণ্ঠ কঠিন।

সেক্সটন তাই করলেন, লোকটার অতি অহংকারী ভাবসাব সহ্য করলেন, হাজার হোক, এই লোকটা যাদের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা অনেক অনেক টাকা পয়সা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেসবের অনেকটাই বর্তমানে সেক্সটনের পেছনে ঢালা হচ্ছে যাতে করে তিনি পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী অফিসটার অধিকর্তা হতে পারেন। এইসব মিটিংয়ের উদ্দেশ্য যতোটা না কৌশল নির্ধারণী, তার চেয়েও বেশি ভঁকে এটা মনে করিয়ে দেয়া যে, সিনেটর তাদেরকে কতো বেশি সুবিধা দেবেন সেটা বুঝিয়ে দেয়া। এইসব লোক তাদের বিনিয়োগের বিশাল রিটার্ন প্রত্যাশা করছে। রিটার্ন, সেক্সটনকে মানতেই হলো, দাবি হিসেবে খুবই সাহসী; তারপরও এটা সত্য যে, অবিশ্বাস্য হলেও, সেক্সটন একবার ওভাল অফিসে বসতে পারলেই তাদের দাবিটা মেটানো কোনো ব্যাপারই না।

“আমার ধারণা, সেক্সটন বললেন, তিনি বুঝে গেছেন এই লোকটার সাথে কীভাবে কাজের কথা শুরু করতে হয়, “আরেকটা কিস্তি দেয়া হয়েছে, তাই না?”

“হ্যাঁ। আর যথারীতি, আপনি সেটা আপনার ক্যাম্পেইনের ফান্ড হিসেবেই কেবল ব্যবহার করবেন। আমরা খুব খুশি যে, ভোটের যুদ্ধে আপনি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন, আর তাতে করে বোঝা যাচ্ছে, আপনার ক্যাম্পেইন ম্যানেজার টাকাগুলো সঠিকভাবেই খরচ করছেন।”

“আমরা খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছি।”

“ফোনে আপনাকে যেমনটি আমি বলেছি,” বৃদ্ধলোকটা বললো। “আমি আরো তিন জনকে আপনার সাথে আজ রাতে মিটিং করতে রাজি করিয়েছি।”

“চমৎকার।” সেক্সটন ইতিমধ্যেই সময়টা খালি রেখে দিয়েছে।

বৃদ্ধলোকটা সেক্সটনের হাতে একটা ফোল্ডার এগিয়ে দিলো। এখানে তাদের সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। এটা পড়বেন। তারা চায় আপনি তাদের বিষয়টা ভালো করে বুঝুন। খুব নির্দিষ্ট করে। তারা জানতে চায়, আপনি তাদের প্রতি সমব্যথি কিনা। আমার উপদেশ থাকবে, আপনি তাদের সাথে আপনার নিজের বাড়িতে মিটিংটা করুন।”

“আমার বাড়িতে? কিন্তু আমি তো সাধারণত দেখা করি—”

“সিনেটর, এই ছয় জন লোক যেসব কোম্পানি চালায়, সেগুলো আপনার সাথে দেখা করা বাকি লোকদেরকে সংস্থান করে থাকে। এরা হলেন রাঘব বোয়াল। তারা খুবই উদ্বিগ্ন আছে। তারা আরো বেশি পেতে চায়, সেজন্যে আরো বেশি দিতেও প্রস্তুত। তাদেরকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে আমি আপনার সাথে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছি। তাদের দরকার একটু ব্যক্তিগত পরিবেশের আবহ।”

সেক্সটন খুব দ্রুতই সায় দিলেন। “অবশ্যই। আমি আমার বাড়িতেই মিটিংটার ব্যবস্থা করতে পারব।”

“অবশ্যই তারা একেবারে গোপনীয়তা চাইবে।”

“যেমনটি চাই আমি।”

“গুড লাক,” বৃদ্ধ লোকটা বললো, “আজ রাতে যদি সবকিছু ভালমত হয়ে যায়, তবে এটাই হবে আপনার শেষ মিটিং। এইসব লোক একাই আপনার ক্যাম্পেইনের সব কিছু জোগান দিতে পারবে।”

সেক্সটন এই কথাটা খুব পছন্দ করলেন। তিনি বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসী হাসি দিলেন, “ভাগ্য সহায় থাকলে, বন্ধু আমার, নির্বাচনের সময় আসবেন, আমরাই বিজয়ী হবো।”

“বিজয়ী?” বৃদ্ধলোকটি সামনের দিকে ঝুঁকে সেক্সটনকে বললো, “আপনাকে হোয়াইট হাউজে পাঠানোটা হলো বিজয়ের প্রথম ধাপ, সিনেটর। আমি মনে করি, সেটা আপনি কখনও ভুলবেন না।”

১৪

ঘোয়াইট হাউজ এ বিশ্বের সবচাইতে ছোট প্রেসিডেন্ট ভবন। লম্বায় মাত্র ১৭০ ফুট আর প্রস্থে ৮৫ ফিট, এর সর্বমোট আয়তন ১৮ একরের মত। স্থপতি জেমস্ হোবান বাক্সের মতো দেখতে পাথরের একটি ভনব নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যার ছাদটা হবে একটু ফোলা। সারি সারি পিলারের প্রবেশদ্বার থাকার কথা ছিল। যদিও এটা মৌলিক নয়, তারপরও নক্সাটা একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বাছাই করা হয়েছিল। আর বর্তমান নক্সাটা বিচারক ‘আকর্ষণীয়, অভিজাত এবং স্বাচ্ছন্দ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জাখ হার্নি সারে তিন বছরেরও বেশি সময় থাকার পরও এটাকে নিজের বাড়ি বলে মনে করতে পারেননি। এই মূহুর্তে, তিনি পশ্চিম-উইংগের দিকে যেতে যেতে এক ধরণের অদ্ভুত অনুভূতিতে আক্রান্ত হলেন। তার পা দুটো পুরু কার্পেটের ওপরে একেবারে ওজনহীন বলে মনে হলো।

প্রেসিডেন্টকে আসতে দেখে হোয়াইট হাউজের কিছু কর্মচারী সেদিকে তাকালো। হার্নি তাদের সবাইকে হাত নেড়ে ইশারা করে প্রত্যেকের নাম ধরে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। তাদের জবাবটা যদিও ভদ্রোচিত, তারপরও তাতে জোর করে হেসে থাকার ব্যাপার আছে।

“শুভ সকাল, মি: প্রেসিডেন্ট।”

“কেমন আছেন, স্যার?”

“গুড ডে স্যার।”

প্রেসিডেন্ট তার অফিসের দিকে যেতেই পেছনে ফিসফিসানির শব্দটা শুনতে পেলেন। হোয়াইট হাউজের ভেতরে এক ধরণের চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে হার্নির মনে হচ্ছে তিনি ক্যাপ্টেন ব্লাই– একটি ডুবন্ত জাহাজের নাবিকদের নির্দেশ দিচ্ছেন, যারা বিদ্রোহ করার জন্য মুখিয়ে আছে।

প্রেসিডেন্ট তাদের দোষ দেন না। তার স্টাফরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আসন্ন নির্বাচনের জন্য কাজ করে গেলেও আচকাই মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হোঁচট খেয়ে পড়েছেন।

খুব জলদিই তারা বুঝতে পারবে, হার্নি মনে মনে বললেন। আর আমি আবার বীর হিসেবে আবির্ভূত হবে।

নিজের কর্মচারীদের কাছে বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখাটা তার কাছে ভালো লাগছে না। কিন্তু গোপনীয়তার দরকার রয়েছে। আর গোপনীয়তার ব্যাপারে হোয়াইট হাউজ হলো ফুটো হওয়া জাহাজের মত।

হার্নি ওভাল অফিসের বাইরে বৈঠকখানার এসে তাঁর সহকারীকে হাত নেড়ে কুশল জানালেন। “ডোলোরেস, তোমাকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে।”

“আপনাকেও, স্যার।” মেয়েটি তার সাদামাটা পোশাকের দিকে তাকিয়ে বললো।

হার্নি তার কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে বললেন, “আমি চাই তুমি একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করো।”

“কার সাথে, স্যার?”

“হোয়াইট হাউজের সমস্ত কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের সাথে।”

তার সহকারী চোখ তুলে তাকালো। “আপনার পুরো স্টাফ, স্যার? একশ পঞ্চান্ন জনের সবাইকে?”

“ঠিক তাই।”

“সবাইকে একসাথে, স্যার?”

“কেন নয়? চারটা বাজে ঠিক করো।”

সহকারী মাথা নাড়লো। “ঠিক আছে স্যার। আর মিটিংটা কিসের জন্য…?”

“আজ আমেরিকার জনগণের কাছে আমি একটি ঘোষণা দেবো। আমি চাই সেটা আমার স্টাফরা আগে শুনুক।”

সহকারীর মুখে আচমকা একটা ভাবনার ছাপ দেখা গেলো, সে চাপা কণ্ঠে বললো,

“স্যার, আপনি কি নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন?”

হার্নি হাসিতে ফেটে পড়লেন। “আরে না, ভোলোরেস। আমি লড়াইয়ের জন্য চাঙ্গা হচ্ছি বলতে পারো!”

মেয়েটা সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হলো। মিডিয়ার রিপোর্টে তো বলছে প্রেসিডেন্ট হার্নি নিজেকে নির্বাচন থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বললেন, “ডোলোরেস, তুমি আমার জন্য এ কয় বছর চমৎকার কাজ করেছে, আর তুমি আমার জন্য সামনের চার বছরও চমৎকার কাজ করবে। আমরাই হোয়াইট হাউজে থাকছি। কসম খেয়ে বলছি।”

সহকারীকে দেখে মনে হলো সে বিশ্বাস করতে চাইছে। “খুব ভালো স্যার। আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি, চারটা বাজে।”

.

ওভাল অফিসে ঢুকে তাঁর পুরো স্টাফদেরকে ছোট্ট ঘরটাতে গাদাগাদি করে থাকতে দেখে জাখ হার্নি না হেসে পারলেন না। যদিও এই বিখ্যাত অফিসটা অনেক বছর ধরেই অনেক নামে পরিচিত–লু, ডিকের ডেন, ক্লিন্টনের শোবার ঘর– কিন্তু হার্নির প্রিয় হলো ‘পতঙ্গ ফাঁদ নামটা। এটাই বেশি উপযুক্ত বলে মনে হয়। ওভাল অফিসে আসা প্রত্যেক আগন্তুকেরই বিভ্রম ঘটে। ঘরের সাদৃশ্যপূর্ণ, মসৃণ দেয়াল, ধোকা খাওয়ার মত দরজা, এর সবটাই একজন অভ্যাগতকে বিমূঢ় করে ফেলে, যেনো তাদেরকে চোখ বেঁধে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায়শই, কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রেসিডেন্টের সাথে মিটিং শেষ করে ক্রোসেটের দিকে রওনা হয়ে থাকে। কখনও কখনও হার্নি অতিথিকে থামিয়ে দেন, আবার কখনও তিনি চেয়ে চেয়ে মজা দেখেন, নির্ভর করে মিটিংটা কীরকম হলো তার ওপর।

হার্নি সবসময়ই বিশ্বাস করেন ওভাল অফিসের সবচাইতে আধিপত্যমূলক বস্তুটা হলো জমকালো আমেরিকান ঈগলটা, ঘরের কার্পেটে সেটা নক্সা করা আছে। জলপাই গাছের ডাল আর ডান পায়ে একগাছি তীর ধরা। বাইরের খুব কম লোকেই জানে যে শান্তিকালীন সময়ে, ঈগলটার মুখ থাকে বাম দিকে– জলপাই গাছের ডালের দিকে। কিন্তু যুদ্ধের সময়, ঈগলটার মুখ রহস্যজনক কারণে থাকে ডান দিকে– তীরের দিকে। এই খবরটা কেবল জানে প্রেসিডেন্ট এবং হাউজ কিপারদের প্রধান। এই রহস্যজনক ঈগলের রহস্যের পেছনের সত্যটা হার্নি খুঁজে পেয়েছিলেন, হতাশাজনক হলেও সেটা খুবই পার্থিব; বেসমেন্টের এক গুদাম ঘরে দ্বিতীয় ঈগলটার কার্পেট রাখা থাকে, আর হাউজ কিপার সেটা ঝাড়ামোছা কেবল রাতের বেলায়ই সারেন।

এখন হার্নি শান্তিকালীন ঈগলটার দিকে তাকিয়ে এই ভেবে হাসলেন যে, সম্ভবত তিনি কার্পেটটা বদল করবেন, এইমাত্র শুরু করতে যাওয়া সেজউইক সেক্সটনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্মানে।

১৫

ইউএস ডেল্টা ফোর্স হলো একমাত্র ফাইটিং স্কোয়াড যাদের কাজকর্ম পুরোপুরিভাবে প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের ফলে আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে থাকে।

প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশ ২৫ (পিডিডি ২৫) অনুমোদন করে যে, ডেল্টা ফোর্সের সৈনিকেরা সবধরণের আইনী জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত, কেবলমাত্র ১৮৭৬ লোজ কমিউট্যাটাস এ্যাক্টই তাদের জন্য প্রযোজ্য। সাংবিধানিক ফৌজদারী দণ্ডাদেশ, কেউ যদি ব্যক্তিগত লাভের কারণে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে, অথবা অননুমোদিত গোপন অপারেশন করলে। ডেল্টা ফোর্স সদস্যরা সিএজি নামক একটি বিভাগের সহযোগী সদস্য। এরা গোপন অপারেশন চালিয়ে থাকে। ডেল্টা ফোর্স সৈনিকেরা প্রশিক্ষিত খুনি-স্পেশাল ওয়েপেন এ্যান্ড টেকনিক বা SWAT অপারেশনে অভিজ্ঞ, জিম্মি উদ্ধার, ঝটিকা আক্রমণ বা অভিযান, এবং ছদ্মবেশি বা গোপন শত্রুর বিনাশ সাধন করা।

যেহেতু ডেল্টা ফোর্সের মিশনগুলো বেশিরভাগই অতি গোপনে হয়ে থাকে, তাই প্রচলিত চেইন অব কমান্ডের ব্যাপারটা এখানে একটু পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এটাকে ডাকা হয় ‘মোনোকাট ব্যবস্থা বলে– একক নিয়ন্ত্রণে একজন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকে যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সেই নিয়ন্ত্রকের থাকতে হবে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা। তাদের নিয়ন্ত্রকের পরিচয় যেমন গোপন থাকে, তেমনি তাদের অপারেশনও হয় একেবারে গোপনে। একবার মিশন সমাপ্ত হয়ে গেলে, ডেল্টা ফোর্সের সৈনিকেরা সে ব্যাপারে আর মুখে কিছু বলে না– একে অন্যের সাথেও না, এমনকি তাদের কমান্ডিং অফিসারের সাথেও না।

ওড়ো। মারো। ভুলে যাও।

ডেল্টা দলটি এখন ৮৩তম প্যারালালে আস্তানা গেঁড়েছে। তারা উড়ছেও না লড়াইও করছে না। কেবল নজরদারী করছে।

ডেল্টা-ওয়ানকে মানতেই হলো যে, এই মিশনটা এ পর্যন্ত করা তার মিশনের মধ্যে সবচাইতে অন্যরকম মিশন। কিন্তু অনেক আগেই সে শিখেছিল যে কোনো কিছুতে অবাক হতে নেই। গত পাঁচ বছর ধরে সে মধ্যপ্রাচ্যে জিম্মি উদ্ধারে জড়িত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্ত রে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রসী গ্রুপগুলোকে পাকড়াও করার কাজ করেছে, এমনকি এ পৃথিবীর কিছু বিপজ্জনক নারী-পুরুষকে কৌশলে সরিয়ে দেয়ার কাজও করেছে সে।

এইতে, গতমাসেই, তার ডেল্টা দলটি একটি মাইক্রোবোট ব্যবহার করে দক্ষিণ আমেরিকার এক ড্রাগ ম্রাটকে প্রাণঘাতি হৃদরোগ ঘটিয়েছে। একটি মাইক্রোবোটের সঙ্গে চুলের মত পাতলা সূচযুক্ত করে তাতে ভাসোকোনক্টর ডোজ দিয়ে ডেল্টা-টু মাইক্রোবোটটাকে ঐ ড্রাগ সম্রাটের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ঘুমন্ত লোকটার কাঁধে মশার কামড়ের মত সূচ ফুটিয়ে কৃত্রিম হার্ট এ্যাটাক ঘটাতে সক্ষম হয়। লোকটা প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় জেগে উঠে। কিন্তু লোকটার বউ ডাক্তারকে খবর দেবার আগেই ডেল্টা দলটি নিজেদের জায়গায় ফিরে এসেছিলো।

ঘরের কোনো দরজা, জানালা ভাঙার দরকার হয়নি।

স্বাভাবিকবাবেই মৃত্যু হয়েছে।

এটা সুন্দর একটি কাজ।

আরো সাম্প্রতিক সময়ে, আরেকটি মাইক্রোবোট একজন বিখ্যাত সিনেটরের অফিসে গিয়ে আস্তানা গাড়ে এবং সিনেটরের সাথে এক মেয়ের যৌনকর্মের রগরগে ছবি তুলে আনে।

এখন, এই তাঁবুতে ব’সে ব’সে নজরদারী করে দশদিন পার করে ডেল্টা-ওয়ান মিশন শেষ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো।

লুকিয়েই থাকো।

অবস্থানটা দেখতে থাকো।

ভেতরে এবং বাইরে। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রককে জানাও।

ডেল্টা-ওয়ান কখনও কোনো মিশনে গিয়ে আবেগী না হবার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। কিন্তু এই মিশনটা, তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে, যখন থেকে সে এটার সম্পর্কে শুনেছে। বৃফিংটা ছিল অদৃশ্য কারো কাছ থেকে– প্রত্বিটি ধাপই নিরাপদ ইলেকট্রনিক চ্যানেলে বলা হয়েছে।

এই মিশনের নিয়ন্ত্রককে ডেল্টা ফোর্স কখনও দেখেনি।

ডেল্টা-ওয়ান তার ডিহাইড্রেটেড প্রোটিন খাবার খেতে যখন প্রস্তুত হয়েছে, ঠিক তখনি তাদের পাশে রাখা যোগাযোগ যন্ত্রটা বিপ করতে শুরু করলো। সে খাবার খাওয়া থামিয়ে দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলো। বাকি দুজন নীরবে চেয়ে রইল।

“ডেল্টা-ওয়ান,” সে বললো।

শব্দ দুটি মূহুর্তেই ভয়েস রিকগনিশন সফটওয়্যারের ভেতরে, যেটা যন্ত্রটার ভেতরে রয়েছে, চিহ্নিত হয়ে গেলো। প্রতিটা শব্দ তারপর একটি সংকেতে বদলে গিয়ে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অন্য প্রান্তে চলে যাবে। ঐ প্রান্তেও একইভাবে, একই রকম আরেকটি যন্ত্র কাজ করছে। নাম্বারগুলো যান্ত্রিকভাবে অনুবাদিত হয়ে পুনরায় শব্দে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা উচ্চারিত হবে সিনথেসাইজ একটি কণ্ঠে। সর্বমোট ধীরগতি বা দেরি হবে আশি মিলি সেকেন্ড।

“কন্ট্রোলার বলছি, অন্যপ্রান্ত থেকে লোকটা বললো, যন্ত্রটার রোবটের মত কণ্ঠ ভৌতিক কোনোল– অমানবীয় আর আদিভৌতিক। “তোমার অপারেশনের অবস্থা কি?”

“পরিকল্পনা মতই সব হচ্ছে, ডেল্টা-ওয়ান জবাব দিলো।

“চমৎকার। আমার কাছে নতুন খবর রয়েছে। খবরটা আজ রাত আটটা বাজে জনসাধারণকে জানান হবে।”

ডেল্টা-ওয়ান নিজের ঘড়িটা দেখলো। আর মাত্র আট ঘন্টা বাকি আছে। তার এখনকার কাজটা খুব জলদিই শেষ হয়ে যাবে। সেটাই আনন্দের কথা।

“আরেকটা ঘটনা ঘটেছে,” কন্ট্রোলার ললো, “আরেকজন নতুন খেলোয়াড় মাঠে প্রবেশ করেছে।”

“কে সে?”

ডেল্টা-ওয়ান শুনে গেলো। মজার এক জুয়া। “আপনি কি মনে করছেন তাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে?”।

“তাকে খুব গভীরভাবে নজরদারী করার দরকার রয়েছে।”

“যদি কোনো সমস্যা হয়?”

“তোমাদের আগে যে আদেশ আছে সেরকমই করবে।”

১৬

রাচেল সেক্সটন প্রায় এক ঘণ্টা ধরে উত্তরদিকে উড়ে চলেছে। পুরো ভ্রমনটায় সে কোনো নতুন স্থলভাগের দেখা পায়নি, কেবল পানি আর পানি।

রাচেলের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। তার বয়স তখন সাত। বরফের উপর স্কেটিং করতে গিয়ে বরফের নিচে পানিতে পড়ে গিয়েছিলো। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে মরতে বসেছিলো সে। কিন্তু তার মা’র শক্ত হাত দুটো তাকে সেখান থেকে টেনে তুলে তার জীবনটা বাঁচিয়েছিলো। তখন থেকেই রাচেলের মনে হাইড্রোফোবিয়া বা পানি ভীতি শুরু হলো– খোলা পানি দেখলেই তীব্র আতংক সৃষ্টি হয়, ঠাণ্ডা পানিতে আরো বেশি। আজ, কেবলই উত্তর আটলান্টিকের জলরাশি। আর সেটাই তার পুরনো ভীতিটাকে ফিরিয়ে এনেছে।

গৃনল্যান্ডের একটা ঘাটির কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত রাচেল কিছুই বুঝতে পারেনি, কতদূর তারা এসে পড়েছে। আমি আর্কটিক বৃত্তের ওপরে আছি? এটা ভেবে তার অস্বস্তিটা আরো বেড়ে গেলো। তারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নাসা পেয়েছেটা কি? আস্তে আস্তে তাদের নীচে নীল বর্ণটাতে সাদা সাদা ছোপে ভরে গেলো। হাজার হাজার সাদা গুটি যেনো।

হিমশৈল।

রাচেল হিমশৈল এর আগে মাত্র একবারই জীবনে দেখেছে, ছয় বছর আগে তার মা তাকে আলাস্কাতে ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। রাচেল অসংখ্য বিকল্প জায়গার কথা। প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু তার মা রাজি হননি। “রাচেল, লক্ষীটি আমার,” তার মা বলেছিলেন, “এই পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশই পানিতে ঢাকা, আজ হোক কাল হোক এর সাথে খাপ খাইয়ে তোমাকে চলতেই হবে।” মিসেস সেক্সটন একজন নিউ ইংল্যান্ডবাসী, তিনি নিজের সন্তানকে খুবই শক্তিশালী করে বড় করতে চাইতেন।

সেই ভ্রমণটাই রাচেলের সাথে তার মার শেষ ভ্রমণ ছিল।

ক্যাথারিন ওয়েন্টওর্থ সেক্সটন। রাচেলের মন গভীর বেদনায় আক্রান্ত হলো। তার মা’র সাথে তার শেষ কথা হয়েছিল ফোনে। থ্যাংকস গিভিংয়ের সকালে।

“আমি দুঃখিত মা,” রাচেল বলেছিল, তুষারাবৃত ওহারা বিমান বন্দর থেকে সে বাড়িতে ফোন করেছিল। “আমি জানি আমাদের পরিবার থ্যাংকস গিভিংয়ের দিনে কখনই আলাদা থাকেনি। মনে হচ্ছে আজই এটা প্রথম হতে যাচ্ছে।”

রাচেলের মা’র কথা শুনে মনে হলো আশাহত হয়েছেন। “তোমাকে খুবই দেখতে ইচ্ছে করছে।”

“আমারও, মা। তুমি আর বাবা যখন টার্কি খাবে তখন ভেবে নিও আমিও এয়ারপোর্টে ব’সে সেটা খাচ্ছি।”

ফোনে একটা বিরতি নেমে এলো। “রাচেল, কথাটা আমি তোমাকে বলতে চাইনি, কিন্তু তোমার বাবা বলেছে তার অনেক কাজ, তাই সে কয়েক সপ্তাহ তার ওযাশিংটনের সুটেই থাকবে।”

“কি?” রাচেলের বিস্ময়টা সঙ্গে সঙ্গে রাগে বদলে গেলো। “কিন্তু আজতো থ্যাংকস গিভিং দিবস। সিনেটের কোনো অধিবেশন নেই! আর ওখান থেকে মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। তার অবশ্যই তোমার সাথে থাকা উচিত।”

“আমি জানি। সে বলে সে নাকি ক্লান্ত– ভ্রমণ করা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই সে ঠিক করেছে এই সপ্তাহান্তটা কিছু জমে থাকা কাজ করে কাটাবে।”

কাজ? রাচেল সন্দেহ প্রকাশ করলো। মনে হচ্ছে সিনেটর অন্যকোন মেয়ের সাথেই মজে আছেন, কাজে নয়। তার এই দুরাচার, কয়েক বছর ধরেই চলছে। মিসেস সেক্সটন বোকা নন। তিনি সবই বোঝেন। অবশেষে, মিসেস সেক্সটন অনোন্যপায় হয়ে নিজের কষ্ট চেপে, চোখ বন্ধ করে রাখলেন। যেনো দেখেও দেখছেন না। যদিও রাচেল তার মাকে তালাকের কথা বলেছিল, কিন্তু ক্যাথারিন সেক্সটন সে কথায় যাননি। তিনি এক কথার মানুষ। মৃত্যুই কেবলমাত্র আমাদেরকে আলাদা করবে, রাচেলকে তিনি বলেছিলেন। তোমার বাবা আমাকে তোমার মত এক আশীর্বাদ দিয়েছে– আর সেজন্যে তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তার কৃতকর্মের জন্য একদিন ওপরওয়ালার কাছে জবাব দেবে সে।

রাচেল বিমান বন্দরে দাঁড়িয়ে রেগে মেগে বলেছিল, “কিন্তু, তার মানে তো থ্যাংকস গিভিং-এর দিনে তুমি একাই থাকবে!” তার মনে হলো তার বাবার এই কাজটি করা অন্তত তার মত মানুষের জন্যও নিচু একটি কাজ।

“তো …” মিসেস সেক্সটন বললেন, তার কণ্ঠে হতাশা, “আমি তো আর এত সব খাবার দাবার নষ্ট করতে দিতে পারি না। আমি আমার খালার বাসায় চলে যাচ্ছি। সে সব সময়ই আমাদেরকে থ্যাংকস গিভিংয়ের দাওয়াত দিয়ে থাকে। এখনই তাকে আমি ফোন করছি।”

রাচেলও নিজেকে একটু অপরাধী ভাবলো। “ঠিক আছে। আমি খুব জলদিই বাড়িতে ফিরছি। তোমাকে ভালবাসি মা।”

“ভাল থেকো, লক্ষীটি।”

সেই রাতেই, রাচেলের ট্যাক্সিটা রাত ১০টা ৩০ মিনিটে সেক্সটনের সুটের সামনে এসে থামলো। রাচেল জানতো উল্টাপাল্টা কিছু হয়েছে। নিচে তিনটা পুলিশের গাড়ি। কয়েকটা সাংবাদিকের গাড়িও ছিল। বাড়ির সব বাতি জ্বালানো। রাচেলের বুক ধরফর করে উঠলো।

একজন পুলিশ তার কাছে এলো। লোকটা কিছু না বললেও রাচেল জানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে।

“পঁচিশ নাম্বার সড়কটা বরফে ঢাকা ছিলো। আপনার মা’র গাড়িটা রাস্তা থেকে পিছলে নিচে পড়ে গেছে। আমি দুঃখিত, উনি ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।

রাচেলের শরীরটা অসাড় হয়ে গিয়েছিলো। তার বাবা বাড়ি ফিরেই লিভিং রুমে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে সবাইকে জানাচ্ছেন যে, তাঁর স্ত্রী পরিবারের সাথে থ্যাংকস গিভিংয়ের ডিনার সেরে আসার পথে মারা গেছেন।

রাচেল সব দেখছিলো।

“আমি যদি এই সপ্তাহান্তে তার সাথে বাড়িতে থাকতে পারতাম, হয়তো এমন দুর্ঘটনা হোতো না।”

এ কথাটা এক বছর আগেই ভাবা উচিত ছিলো, রাচেল তীব্র যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলেছিলো।

সেই থেকে রাচেল তার বাবাকে এক রকম ছেড়েই দিলো, যেটা তার মা জীবিত অবস্থায় করতে পারেনি। সিনেটর অবশ্য এটা খেয়ালই করেননি। তিনি আচকাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। নিজের বৌয়ের এই ঘটনাকে ব্যবহার করে পার্টির মনোনয়ন পর্যন্ত বাগিয়ে নিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য।

***

এফ-১৪ এর বাইরে দিনের আলো ফিকে হয়ে আসছে। এখন আর্কটিকে পড়ন্ত শীতকাল– ক্রমাগত অন্ধকারের সময়। রাচেল বুঝতে পারলো সে এমন একটা জায়গায় এসে পড়েছে, যেখানে রাতই স্থায়ী।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই, সূর্যটা উধাও হয়ে গেলো। দিগন্তে হারিয়ে গেলো সেটা। তারা এখনও উত্তর দিকেই ছুটছে। আকাশে অর্ধ চন্দ্র দেখা যাচ্ছে।

অবশেষে, রাচেল অস্পষ্ট একটি স্থল ভাগের দেখা পেলো। কিন্তু সেটা পাহাড় পর্বতের এলাকা।

“পাহাড়?” রাচেল জিজ্ঞেস করলো, দ্বিধাগ্রস্তভাবে। “গৃনল্যান্ডের উত্তরে পাহাড় আছে নাকি?”

“দেখে তো তাই মনে হয়,” পাইলটও অবাক হয়ে বললো। ফাইটারটা নিচের দিকে নামতে শুরু করলে নিজেকে ওজনহীন মনে হলো রাচেলের।

এসময়েই রাচেল সেটা দেখতে পেলো। এমন একটা দৃশ্য যা সে জীবনে কখনও দেখেনি। প্রথমে তার মনে হয়েছিল চাঁদের আলো বোধ হয় কোনো প্রতারণা করছে তার চোখের সাথে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না। প্লেনটা যতোই নিচে নামতে লাগলো দৃশ্যটা ততোই পরিষ্কার হতে শুরু করলো।

আরে এটা আবার কি?

তাদের নিচে সমতল জায়গাটাতে লম্বা দাগ দেয়া … যেনো কেউ রঙ দিয়ে দাগ দিয়েছে। দাগ দুটো সমান্তরালভাবে ভূমির শেষপ্রান্ত, সমুদ্র পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। এটা আসলে বরফের উপরে একটা রানওয়ে। তাদের বিমানটা বোধহয় এখানেই নামবে। রাচেল ভয় পেয়ে গেলো।

“আমরা বরফের ওপর ল্যান্ড করবো?” সে জানতে চাইলো।

পাইলট কোনো জবাব দিলো না। সে প্লেনটা নিয়ন্ত্রণেই বেশি মনোযোগী। প্লেনটা বরফের সাথে সংস্পর্শে আসতেই রাচেলের পেটটা গুলিয়ে উঠলো আবার। কিন্তু প্লেনটা ঠিক মতোই বরফের ওপর ল্যান্ড করতে পারলো।

টমক্যাটটার গতি কমে গেলো। রাচেল একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। জেটটা আরো একশ গজ এগিয়ে গিয়ে অবশেষে থামলো।

ডান দিকের দৃশ্যটা আর কিছুই না, সু বরফের দেয়াল। চাঁদের আলোতে কি করছে, বাম দিকের দৃশ্যটা বেশি চেনা। সীমাহীন বরফ আর বরফ। তার মনে হলো সে একটা মৃত গ্রহে এসে পড়েছে। বরফের রাশির মধ্যে প্রাণের কোনো চিহ্নই নেই।

এরপরই রাচেল শব্দটা শুনতে পেলো। দূর থেকে আরেকটা ইনজিনের শব্দ কোন যাচ্ছে। তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। যন্ত্রটা এবার দেখা গেলো। সেটা বরফ কাটার একটা ট্রাক্টর।

ট্রাক্টরটা জেটের ঠিক পাশেই এসে থামলো। কাঁচের দরজাটা খুলে গেলে একটা মই বেয়ে এক লোক নিচে নেমে এলো। লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা পোশাকে ঢাকা।

লোকটা এফ-১৪র পাইলটকে সংকেত দিলো। পাইলট তার কথা মতো ককপিটের হাচটা খুলে ফেললো।

ককপিটটা খুলে যেতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে রাচেলের কাঁপুনি লেগে গেলো। হাড়ের মধ্যে মুহূর্তেই কামড়ে ধরলো।

আরে ঢাকনাটা বন্ধ করুন!

“মিস সেক্সটন?” লোকটা তাকে ডাকলো। তার বাচনভঙ্গী আমেরিকান। “নাসা’র পক্ষ থেকে আমি আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি।”

রাচেল ঠাণ্ডায় কাঁপছিলো। লক্ষ কোটি ধন্যবাদ।

“দয়া করে হেলোমেটটা খুলে ওখান থেকে নেমে আসুন। আপনার কি কোনো প্রশ্ন। রয়েছে?”

“হ্যাঁ,” রাচেল চিৎকার করে বললো। “আমি আসলে কোথায় আছি?”

১৭

মারজোরি টেঞ্চ– প্রেসিডেন্টের সিনিয়র উপদেষ্টা– হাড্ডিসার এক মহিলা। তার ছয় ফুটের দেহখাঁচাটা গিট আর প্রত্যঙ্গের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ। মুখটা জন্ডিসের রোগীর মতো, গায়ের চামড়াটা যেনো পার্চমেন্ট পেপার, তাতে কেবল দুটো ফুটো রয়েছে, আবেগহীন দুটো চোখ, একান্ন বছর বয়সে তাকে দেখায় সত্তরের মতো।

টেঞ্চকে ওয়াশিংটনের রাজনীতির অঙ্গনে দেবী হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়। বলা হয়ে থাকে তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা অসাধারণ। এক দশক ধরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরো অব ইন্টলিজেন্সে থেকে যে গবেষণা আর বিশ্লেষণ খুবই তীক্ষ্ণ আর মারাত্মক হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে আসছে সেটা টেঞ্চের জন্যই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে টেঞ্চের অতি শীতল ব্যবহার খুব কম লোকেই দুয়েক মিনিটের বেশি সহ্য করতে পারে। মারজোরি টেঞ্চের আশীর্বাদ হলো তার সুপার কম্পিউটার তুল্য মস্তিষ্ক। তাসত্ত্বেও, প্রেসিডেন্ট জাখ হার্নিকে তাকে সহ্য করতে খুবই বেগ পেতে হয় তার অতি উন্নাসিকতার জন্য; তার বুদ্ধি আর কঠোর পরিশ্রম জাখ হার্নিকে সাবলীলভাবে কাজ করে যেতে সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে তার কৃতিত্বে কেউ ভাগ বসাতে পারে না।

“মারজোরি,” প্রেসিডেন্ট বললেন, “আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?” তিনি তাকে বসতে বললেন না। সচরাচর যে সামাজিকতা দেখানো হয়, সেটা এই মহিলার ক্ষেত্রে দেখানোর কোনো দরকার নেই। তার যদি বসার দরকার হয়, সে নিজেই বসে পড়বে কিছু না বলে।

“দেখছি, আপনি স্টাফদেরকে আজ চারটা বাজে বৃফ করার জন্য ব্যবস্থা করেছেন।” সিগারেট খাওয়ার কারণে তার গলা ফ্যাসফ্যাসে। “চমৎকার।”

টেঞ্চ একটু পায়চারী করলো। মারজোরি টেঞ্চ হলো সেই স্বল্প সংখ্যক লোকদের একজন, যে নাসা’র আবিষ্কারটার খবর জানে। তার পরিকল্পনায়ই তো প্রেসিডেন্ট নিজের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে থাকেন।

“আজকের সিএনএন’র বির্তকটা একটা বাজে হবে,” টেঞ্চ একটু কেশে বললো। “সেক্সটনকে মোকাবিলা করার জন্য আমরা কাকে পাঠাচ্ছি?”

হার্নি একটু হাসলো। “একজন জুনিয়র ক্যাম্পেইন মুখপাত্রকে।” আগ্রাসী শিকারীর কাছে বড় কিছু ঠেলে না দেয়াটা পুরনো একটা কৌশল।

“আমার মাথায় একটা ভাল বুদ্ধি এসেছে,” টেঞ্চ তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকেই মোকাবেলা করতে দিন।”

জাখ হার্নির মাথায় একটা ধাক্কা লাগলো। “আপনি?” আরে সে ভাবছেটা কী? “মারজোরি, আপনি তো মিডিয়ায় এভাবে মোকাবেলা করেন না। তাছাড়া, এটা মাঝ দুপুরের টিভি শো। আমি যদি আমার সিনিয়র উপদেষ্টাকে পাঠাই, তাহলে অর্থটা কী দাঁড়াচ্ছে? এতে মনে হবে আমরা ঘাবড়ে গেছি, ভড়কে গেছি।”

“একদম ঠিক।”

হার্নি তার দিকে তাকালেন, টেঞ্চ যাই ভাবুক না কেন তাকে সিএনএন’র শোতে হাজির হতে দেয়া যাবে না। কেউ মারজোরি টেঞ্চের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে যে, সে পর্দার অন্তরালেই কাজ করে। টেঞ্চ দেখতে ভীতিকর এক মহিলা– এমন ধরণের মুখ নয় যে, একজন প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্য পাঠানোর জন্য তাকে ব্যবহার করবে।

“আমি এই সিএনএন বিতর্কটাতে অংশ নিচ্ছি,” সে আবারো বললো। এবার সে জিজ্ঞেস করলো না, শুধু জানিয়ে দিলো যেনো।

“মারজোরি,” প্রেসিডেন্ট এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। “সেক্সটন যে দাবি করে হোয়াইট হাউজ ভীত হয়ে পড়েছে, সেটা আপনার অংশগ্রহণে প্রমাণিত হয়ে যাবে। এতে জলদি আমাদের বিগ-গানদেরকে পাঠানোর অর্থ হবে আমরা খুবই মরিয়া হয়ে গেছি।”

টেঞ্চ শান্তভাবে মাথা নেড়ে একটা সিগারেট ধরালো। “যতো বেশি মরিয়া ভাব আমরা। দেখাবো, ততই ভালো।”

পরবর্তী ষাট সেকেন্ড ধরে মারজোরি টেঙ্ক প্রেসিডেন্টকে বোঝাতে সক্ষম হলো কেন তাকেই সিএনএন-এর বিতর্কে পাঠানো উচিত। টেঞ্চের বলা শেষ হলে প্রেসিডেন্ট তার দিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

আরেকবার, মারজোরি টেঞ্চ নিজেকে একজন রাজনৈতিক জিনিয়াস হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হলো।

১৮

মিলনের বরফের শৈলভূমিটা উত্তর মেরুর সবচাইতে বৃহৎ ভাসমান বরফের অংশ। এটা আর্কটিকের ৮২তম প্যারালাল-এর সর্ব উত্তরে অবস্থিত। মিলনে বরফের সমতল ভূমিটা প্রস্থে ৪ মাইল আর পুরুত্বের দিক থেকে তিনশ ফুটেরও বেশি।

এখন, রাচেল ট্রাক্টরে উঠে বসতেই সে বাড়তি পার্কা বা সোয়েটার এবং হাত মোজার জন্য কৃতজ্ঞ হলো। ট্রাক্টরের বসার জায়গাটাতেও উত্তাপ দেবার ব্যবস্থা আছে। বাইরে, এফ ১৪ জেটটার ইনজিন গোঙাতে শুরু করলো বরফের রানওয়ের ওপর।

রাচেল সেটার দিকে তাকালো। প্লেনটা চলে যাচ্ছে?”

ট্রাক্টরের ড্রাইভার উঠে বসে মাথা নাড়ল। “কেবলমাত্র বিজ্ঞানী আর নাসার সাপোর্ট টিমের সদস্যদেরকেই ঐ স্থানে যাবার অনুমতি রয়েছে।”

এফ-১৪ জেটটা আকাশে মিলিয়ে যেতেই রাচেলের আচমকাই খুব হতাশ লাগলো।

“আমরা আপনাকে নাসার প্রধানের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, উনি অপেক্ষা করছেন, লোকটা বললো।

রাচেল সীমাহীন বরফের রাজ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবলো নাসার প্রধান এই নরকে করছেনটা কী।

“একটু ধরে বসুন,” নাসা’র লোকটা চিৎকার করে বললো। ট্রাক্টরটা একটা বিশাল বরফের দেয়ালের সামনে এসে পড়েছে।

রাচেল সেটা দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

“রক এন রোল!” ড্রাইভার ট্রাক্টরটা সোজা ঐ দেয়াল বেয়ে ওঠাতে লাগলে রাচেল চিৎকার করে উঠল।ট্রাক্টরের দাঁতযুক্ত চাকা বরফ খামচে ধরে ঢাল দেয়ালটা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। গাড়িটা যেনো দেয়াল বেয়ে উঠছে। রাচেল নিশ্চিত ছিল তারা পেছনের দিকে হেলে পড়বে, কিন্তু তাদের ক্যাবিনটা বিস্ময়করভাবে আনুভূমিকই রইল। ড্রাইভার বললো, “এটার আসল নক্সাটা করা হয়েছিল মঙ্গলের পাথ ফাইন্ডারের জন্য। কী দারুণ কাজ করে?”

রাচের হতভম্ব হয়ে বললো, “একদম ঠিক কথা।”

এবার রাচেল সামনে আরো উঁচু ধাপ দেখতে পেল।

“এটাই হলো মিলনে হিমবাহ, পাহাড়টা দেখিয়ে ড্রাইভার বললো।

“আর কতদূর?” রাচেল তার সামনে বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না।

“আরো দুই মাইল।”

রাচেলের মনে হলো খুব বেশি দূর। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এত জোড়ে যে মনে হচ্ছে তাদের ট্রাক্টরটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

“এটা হলো কাটাবাটিক ঝড়,” ড্রাইভার চিৎকার করে বললো। “এতে অভ্যস্ত হয়ে যান?” সে বাখ্যা করে বললো যে কাটাবাটিক মানে– এটা একটা গৃক শব্দ– নিচের দিকে তেড়ে আসা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ভারি বাতাস এটা। হিমবাহ বেয়ে এমনভাবে নীচে নেমে আসে যেনো কোনো নদী ধেয়ে আসছে। এটা হলো পৃথিবীর একমাত্র জায়গা, যেখানে নরকও জমে বরফ হয়ে যায়!” ড্রাইভার বললো।

কয়েক মিনিট পর রাচেল দূরে একটা অস্পষ্ট আকৃতি দেখতে পেলো। সাদা বাক্সের মতো কিছু বরফের মধ্যে জেগে উঠেছে। চোখ দুটো কচলে নিলো। এটা আবার কি…?

বড় বড় এস্কিমোরা সেখানে থাকে, অহং” লোকটা ঠাট্টা করে বললো।

রাচেল স্থাপনাটা কেমন সেটা বোঝার চেষ্টা করলো। এটা দেখে মনে হচ্ছে হিউস্টন। এ্যাস্ট্রোডমকে যেনো উল্টে দেয়া হয়েছে।

“নাসা এটা দেড় সপ্তাহ আগে তৈরি করেছে, সে বললো। “বহুস্তর বিশিষ্ট প্রসারণশীল প্লেক্সিপলিসরবেইট। টুকরোগুলো বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত করে পুরো জিনিসটা বরফের ওপরে তার এবং পিস্টন দিয়ে গেঁথে রাখা হয়েছে। দেখতে মনে হয় বিশাল একটি তাঁবু। কিন্তু এটা আসলে নাসার প্রটোটাইপ, বহনযোগ্য আবাস, যা একদিন মঙ্গলগ্রহে ব্যবহার করার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। আমরা এটাকে বলি হ্যাবিস্ফেয়ার’।”

“হাবিস্ফেয়ার?”

“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছেন?”

রাচেল মুচকি হেসে সামনের অনটার দিকে তাকালো। “নাসা মঙ্গলে এখনও যেতে পারে নি বলে আপনারা এটাকে এখানে এনে ব্যবহার করছেন?”

লোকটা হাসলো। “আসলে আমার পছন্দ ছিল তাহিতিতে, কিন্তু ভাগ্যই এই জায়গাটা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ট্রাক্টরটা বনের পাশে ছোট্ট একটা দরজার সামনে এসে থামলে দরজাটা খুলে গেলো। ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বের হয়ে আসছে। বেশ মোটাসোটা একটা লোক এগিয়ে আসল তাদের দিকে, সে পরে রয়েছে কালো সোয়েটার, তাতে করে তাকে একটা ভালুকের মতই দেখাচ্ছে। আইস রোভার নামক ট্রাক্টরটার কাছে চলে এলো সে।

রাচেলের কোনো সন্দেহ নেই লোকটা কে : নাসা প্রধান লরেন্স এক্সট্রম।

ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসলো। “উনার সাইজ দেখে বোকা বনে যাবেন না, লোকটা আসলে পুষি বিড়াল।”

বাঘের মতো বিড়াল, রাচেল ভাবলো। এ বলে তার সুনাম রয়েছে যে, তার স্বপ্নের পথে কেউ বাধা হয়ে দেখা দিলে সে তার মাথাটা চিবিয়ে খায়।

রাচেল যখন আইস রোভার থেকে নামলো তখন বাতাস তাকে প্রায় উড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলো। সে তার কোটটা শরীরের সাথে জড়িয়ে নিলো, ভবনের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

মাঝ পথেই নাসার প্রধান তার মুখোমুখি হলো। বিশাল আকৃতির হাত মোজাসমেত হাত বাড়িয়ে দিলো সে।”মিস সেক্সটন। এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ।

রাচেল মাথা নাড়ল। বাতাসের মধ্যে চিৎকার করে বললো, “সত্যি বলতে কী স্যার, আমার কিছুই করার ছিলো না।”

.

হিমবাহের আরো হাজার খানেক মিটার উপরে, ডেল্টা-ওয়ান ইনফারেড দূরবীন দিয়ে নাসা’র প্রধান আর রাচেল সেক্সটনকে দেখতে লাগলো।

১৯

নাসা প্রধান লরেন্স এক্সট্রম একজন দৈত্যাকার ব্যক্তি। রুক্ষ্ম আর রূঢ়, অনেকটা রাগান্বিত ঈশ্বরের মত। তার সোনালি ছিটযুক্ত চুল আর্মি কাট করে কাটা, নাকটা কন্দযুক্ত। এই মুহূর্তে তার কঠিন চোখ দুটো অনেক রাত না ঘুমানোর ফলে চুপসে আছে। এ্যারোস্পেস কৌশলবিদ এবং অপারেশন উপদেষ্টা হিসেবে নাসার দায়িত্ব পাবার আগে পেন্টাগনে কর্মরত ছিল সে। এক্সট্রম কোনো মিশনে নামলে সেটা নিয়ে জানবাজি রেখে লড়াই করার সুনাম রয়েছে তার।

রাচেল সেক্সটন লরেন্স এক্সট্রম এর পেছনে পেছনে হ্যাবিস্ফেয়ারের ভেতরে ঢুকতেই তার মনে হলো যে একটা ভৌতিক, ঈষদচ্ছ পথ দিয়ে যাচ্ছে। ভেতরের ফ্লোরটা অবশ্য কঠিন বরফের। সেটার ওপর রাবারের কার্পেট বিছানো। তারা একটা খাট ও কেমিক্যাল টয়লেজ সজ্জিত কক্ষ অতিক্রম করলো।

সৌভাগ্যের বিষয় হলো হ্যাবিফেয়ারের ভেতরটা বেশ উষ্ণ। যদিও বাতাসে একটা উৎকট গন্ধ আছে, যেটার সঙ্গে যোগ হয়েছে গাদাগাদি করে থাকা মানুষের শরীরের গন্ধ। আশেপাশে একটা জেনারেটর ঘঘর করছে। এটাই তবে এই জায়গার ইলেক্ট্রক পাওয়ারের উস।

মিস সেক্সটন”, এক্সট্রম বললো, “আপনাকে শুরু থেকে সব বলা দরকার, রাচেলকে পেয়ে তার কণ্ঠে আমুদে ভাব নেই। “আপনি এখানে এসেছেন কারণ প্রেসিডেন্ট চেয়েছেন আপনি এখানে আসুন। জীখ হার্নি আমার ব্যক্তিগত একজন বন্ধু, এবং নাসার বিশ্বস্ত সমর্থক। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। তার কাছে ঋণী। তাকে আমি বিশ্বাসও করি। আমি তাঁর সরাসরি। কোনো আদেশের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলি না, আমার মনঃপুত না হলেও কোনো অস্পষ্টতা যাতে না থাকে তাই বলি, এ ব্যাপারে সাবধান থাকবেন, আপনাকে এখানে জড়ানোটা প্রেসিডেন্টের অতিউৎসাহে হয়েছে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

রাচেল কেবল তাকিয়ে রইল। আমি ৩০০০ মাইল উড়ে এসেছি এই রকম আতিথেয়তার জন্য? এই লোকটা মার্থা স্টুয়ার্টের মতো নয়। আপনাকে সম্মান করেই বলছি,” সে পাল্টা বললো, “আমিও প্রেসিডেন্টের আদেশের শিকার। আমাকে এখানে আসার উদ্দেশ্যটা পর্যন্ত বলা হয়নি। আমি কেবল বিশ্বাস করেই এখানে এসেছি।”

“বেশ ভাল,” এক্সট্রম বললো। “তাহলে আমি খোলাখুলিই বলি।”

“আপনি সেটা শুরু থেকেই করছেন।”

রাচেলের কঠিন জবাব মনে হলো নাসা প্রধানকে দমিয়ে দিলো। তার পদক্ষেপ একটু ধীরগতি হয়ে গেলো। সে তার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে তারপর সাপের মত ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো।

“বুঝেছি,” এক্সট্রম আবার শুরু করলো, “আপনি এখানে এসেছেন নাসার অতি গোপনীয় একটা প্রজেক্টে, আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও। আপনি কেবল এনআরও’র একজন সদস্যই না, যার ডিরেক্টর নাসার লোকদেরকে অনাথ এতিম বাচ্চাদের মত অসম্মান করে থাকে, বরং আপনি তার কন্যা, যার ব্যক্তিগত মিশন হলো আমার এজেন্সিটাকে ধ্বংস করা। এটা হবে এখন নাসার সবচাইতেম উজ্জ্বল দিন। আমার লোকজন অনেক সমালোচনা সহ্য করেছে, আর তারা এই মুহূর্তটা তাদের গৌরবজনক বিজয় হিসেবেই পালন করবে। আপনার বাবার সন্দেহ আর আক্রমণের জন্য আমাদেরকে বাধ্য হয়েই বেসামরিক বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞ এমনকি যে লোক আমাদের ধ্বংস করতে চায় তার মেয়েকে পর্যন্ত এখানে আনতে হয়েছে।”

আমি আমার বাবা নই, রাচেল চিৎকার করে বলতে চাইলো, কিন্তু এখন নাসার প্রধানের সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্ক করার সময় নয়। “আমি এখানে কেন্দ্রবিন্দু হবার জন্য আসিনি, স্যার।”

এক্সট্রম চোখ বড় বড় করে তাকালো। “আপনি অবশ্য এটার বিকল্পও খুঁজে পাবেন না।”

মন্তব্যটা তাকে খুব বিস্মিত করলো। যদিও প্রেসিডেন্ট হার্নি তাকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, কিন্তু পিকারিং তাকে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। “আমি জানতে চাই আমি এখানে কিজন্যে এসেছি?” রাচেল জানতে চাইলো।

“আপনি এক আমি দু’জনেই। আমার কাছে সেই তথ্যটা নেই।”

“কী বললেন?”

“প্রেসিডেন্ট আমাকে কেবল বলেছেন, আপনি এখানে আসার পর আমাদের আবিষ্কারের ব্যাপারে আপনাকে যেনো বৃফ করি। এখানে আপনার ভূমিকা কী হবে সেটা আপনি এবং তার মধ্যেকার ব্যাপার।”

“তিনি বলেছেন আপনার ইওএস এটি আবিষ্কার করেছে।”

এক্সট্ৰম পাশ ফিরে তার দিকে চেয়ে রইল। “আপনি ইওএস প্রজেক্ট সম্পর্কে কতটা পরিচিত?”

“ইওএস হলো নাসা’র পাঁচটি স্যাটেলাইটের একটি স্থাপনা যা পৃথিবীকে বিভিন্ন দিক থেকে নিরীক্ষ বা পর্যবেক্ষণ করে থাকে– সমুদ্র, ভৌগলিক ফাটল বিশ্লেষণ, মেরু অঞ্চলের বরফ গলা পর্যবেক্ষণ, তেলের খনি সন্ধান করা–”

“চমৎকার, এক্সট্রম বললো বটে কিন্তু মনে হলো সে মোটেও সন্তুষ্ট হয়নি। “আপনি কি ইওএস এর নতুন স্থাপনা সম্পর্কে কিছু জানেন? এটাকে বলে পিওডিএস।”

রাচেল মাথা ঝাঁকাল। পোলার অরবিটিং ডেনসিটি স্ক্যানার অর্থাৎ পিওডিএসকে বৈশ্বিক উষ্ণতা মাপার জন্য তৈরি করা হয়েছে। “আমি যেটা বুঝি, পিওডিএস দিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফের ঘনত্ব আর কঠিনত্ব মাপা হয়?”

“বলতে পারেন, সেরকমই। এটা দিয়ে বিশাল একটি এলাকার ঘনত্ব মাপা হয়, সেখানকার সবচাইতে নরম অংশটাও বের করা যায়– বরফের স্তরে ফুটো, আভ্যন্তরীণ উষ্ণতাকেই নির্দেশ করে।”

রাচেল এ ধরণের ভূগভৃন্থ আলট্রাসাউন্ডের ব্যাপারে অবগত আছে। এনআরও’র স্যাটেলাইটও একই রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের গণকবর। সন্ধানের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো। যাতে করে প্রেসিডেন্ট নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে জাতিগত নিধন যজ্ঞ সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়েছে।

দু সপ্তাহ আগে, এক্সট্রম বললো, “পিওডিএস এখানে এমন ঘনত্বের একটি স্থানকে চিহ্নিত করেছে যা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত বলে মনে হয়েছে। এটার বরফ পৃষ্ঠের দু’শত ফুট নিচে, কঠিন একটি বস্তু নিখুঁতভাবে আটকে আছে। হিসাব মতে, সেটার ব্যস দশ ফিট হবে।”

“পানির আধার?” রাচেল জিজ্ঞেস করলো।

“না। তরল কিছু না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই বস্তুটা তার চারপাশের বরফের তুলনায় খুব বেশিই শক্ত।”

রাচেল চুপ রইল কিছুক্ষণ। “তো … এটা তাহলে শিলাখণ্ড অথবা অন্য কিছু?”

এক্সট্রম মাথা নাড়লো। “সেরকমই!”

রাচেল কথাটা কোনোর জন্য অপেক্ষা করলো। কিন্তু সেটা বলা হলো না। আমি এখানে এসেছি কারণ নাসা বরফের মধ্যে বিশাল একটা পাথরখণ্ড খুঁজে পেয়েছে?

এক্সট্রমকে খুবই আনন্দিত মনে হলো। “পাথরটা ওজন আট টনেরও বেশি হবে। সেটা দুইশত ফুট শক্ত বরফের নিচে আঁটকে আছে। তার মানে জিনিসটা প্রায় তিনশ বছর ধরে ওখানে ছিলো।”

রাচেল দীর্ঘ করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ক্লান্ত বোধ করলো। “আমার মনে হয় পাথরটার ওখানে থাকার যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে, আর এনিয়ে এতো গোপনীয়তার কী আছে?”

“নিশ্চয়ই কিছু আছে,” এক্সট্রম বললো, “পিওডিএস যে পাথরটা খুঁজে পেয়েছে সেটা একটা উল্কাপিণ্ড।”

রাচেল একদম থেমে গিয়ে নাসা প্রধানের দিকে চেয়ে রইল। “উল্কাপিণ্ড?” তার মধ্যে যেনো হতাশা দেখা গেলো। এই আবিষ্কারটা নিয়ে নাসা আর অকর্মা সব লোকজন এভাবে উঠে পড়ে লেগেছে? হার্নি সাহেব ভাবছেনটা শী? মানতে হবে উল্কাপিণ্ড এ পৃথিবীর বিরলতম পাথর, কিন্তু নাসা’তো সবসময়ই এসব আবিষ্কার করে চলেছে।

“এই উল্কাপিণ্ডটি সবচাইতে বড়, আমাদের আগেরগুলো থেকে,” এক্সট্রম তার পাশেই দাঁড়িয়ে বললো। “আমাদের বিশ্বাস এই উল্কাপিণ্ডটি সপ্তদশ শতকে পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিলো। মানে এই আর্কটিক সাগরে। সেখান থেকে এটা মিলনের হিমবাহতে এসে পড়েছে। আর বিগত তিন শত বছর ধরে তুষার পাতের ফলে এতো নিচে চলে গেছে।”

রাচেল বিরক্ত হলো। এই আবিষ্কারে কোনো ইতরবিশেষ হলো না। তার মনে এই আশংকা দানা বাঁধতে শুরু করলো যে, চাপের মুখে থাকা নাসা আর হোয়াইট হাউজ মরিয়া হয়ে অতি প্রচারটা করছে, আর সেটার সাক্ষী হতে এসেছে সে।

“আপনাকে খুব বেশি মুগ্ধ মনে হচ্ছে না,” এক্সট্রম বললো।

“আমি আসলে…অন্যরকম কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম।”

এক্সট্রম চোখ কুচকে বললো, “এই রকম বিশাল আকৃতির উল্কাপিণ্ড পাওয়াটা বিরল ব্যাপার, মিস সেক্সটন। খুব কমই এরকম জিনিস আমাদের কাছে রয়েছে।”

“আমি বুঝতে পারছি–”

“উল্কাপিণ্ডটির আকার দেখে কিন্তু আমাদের এই বিস্ময় নয়।”

রাচেল তার দিকে তাকালো।

“অনুমতি দিলে, আমি শেষ করতে পারি,” এক্সট্রম বললো, “এই উল্কাপিণ্ডটির অন্যরকম বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আর কোনো উল্কাপিণ্ডে এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, সেটা ছোটই হোক আর বড় হোক। সে সামনের পথটার দিকে তাকালো। আপনি আমার সাথে একটু আসুন, আমি আপনাকে এমন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যে এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি যোগ্য।”

রাচেল দ্বিধাগ্রস্ত হলো। “নাসার প্রধানের চেয়েও বেশি যোগ্যসম্পন্ন কেউ?”

এক্সট্রম তার দিকে স্থির চেয়ে রইল। “বেশিই যোগ্য, মিস সেক্সটন, যেহেতু, তিনি একজন সিভিলিয়ান। আমার ধারণা ছিলো, আপনি যেহেতু একজন পেশাদার ডাটা বিশ্লেষক তাই আপনি হয়তো নিরপেক্ষ কোনো উৎস থেকেই আপনার ডাটা সংগ্রহ করতে বেশি পছন্দ করবেন।”

দুশে। রাচেল মনে মনে বললো।

রাচেল নাসা প্রধানের সঙ্গে করিডোরের শেষ মাথায় এসে পড়লো, সেখানে ভারি একটা কালো কাপড়ের পর্দা টানানো রয়েছে। কাপড়ের ওপাশে রাচেল মানুষের কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেলো। শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো, যেনো সেটা বিশাল একটা জায়গা।

কোনো কথা না বলে নাসা প্রধান পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিলে ভেতর থেকে তীব্র আলো রাচেলের চোখ ঝলসে দিলো। চোখটা কচলে ভালো করে সামনের দিকে তাকাতেই রাচেল দেখতে পেলো বিশাল একটা ঘর। সে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

“হায় ঈশ্বর,” সে চাপা কণ্ঠেই বললো, “এটা কোনো জায়গা?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *