তৃতীয় অনুবাক
প্রথম সূক্ত : যক্ষ্মনাশনম্
[ঋষি : ভৃগৃঙ্গিরা। দেবতা : যক্ষ্মনাশনম্। ছন্দ : জগতী, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ ]
প্রথম মন্ত্রঃ জরায়ুজঃ প্রথম উস্রিয়ো বৃষা বাতব্রজা স্তনয়ন্নেতি বৃষ্টা। সনো মৃড়াতি তন্থ ঋজুগগা রুজন য। একমোজস্ত্রেধা বিচক্ৰমে ॥ ১
বঙ্গানুবাদ— জরায়ু হতে উৎপন্ন (আমার ন্যায়) জীব, শরীর গ্রহণের নিমিত্ত। (জন্মহেতুভূতকর্মে আনন্দিত হয়ে থাকে; বায়ুবৎ সর্বত্র গতিশীল আদিজ্ঞানকিরণ-বিশিষ্ট অভীষ্ট বর্ষণকারী যে দেবতা মহত্তর করুণা বিতরণের সাথে আপন সত্তা জ্ঞাপন করিয়ে (আমাদের ন্যায় জীবের উদ্ধারের উদ্দেশে) জীব-সকাশে আগমন করেন, সেই অভীষ্টপ্রদ দেবতা আমাদের (আধিদৈবিক ইত্যাদি) দুঃখত্রয়কে নিবৃত্তি করে (আপন) অভিন্ন তেজকে ত্রিলোকে প্ৰকাশপূর্বক বিশেষভাবে ব্যাপ্ত রয়েছেন। (ভাবার্থ,আমরা সদাসর্বদা জন্মহৈতু-ভূত কর্ম-সম্পাদনেই নিরত থাকি। কিন্তু করুণানিদান ভগবান্ জ্ঞানকিরণ বিতরণে আমাদের ত্রিবিধ দুঃখনাশের জন্য সর্বদা প্রযত্নপর রয়েছেন, মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য) ১
মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা— অনুক্রমণিকায় দেখতে পাই, এই সূক্তের মন্ত্রগুলি বাতপিত্তশ্লেষ্মবিকার-জনিত রোগগুলির প্রতিকারার্থে বিনিযুক্ত হয়। দুর্দিন-নিবারণে এবং অতিবৃষ্টি নিবারণেও এই সূক্তের মন্ত্র কয়েকটির প্রয়োগ বিহিত রয়েছে। মুঞ্চশীর্ষক্ত্যা ইত্যাদি তৃতীয় মন্ত্রটি সর্বব্যাধি-নাশক বলে উক্ত আছে। এই সকল মন্ত্রের দ্বারা অভিষেক কার্য করলে সুফল প্রাপ্ত হওয়া যায়–প্রচলিত আছে। এখন প্রথম মন্ত্রের যে অর্থ ভায্যে প্রকাশিত, তার একটু আভায় দিচ্ছি। ভাষ্যকার বলেন,জরায়ুজঃ পদটি–বৃষা পদকে লক্ষ্য করছে। বৃষা শব্দের অর্থ সূর্য। তিনি অদিতির পুত্র, সুতরাং জরায়ুজ। এমতে, প্রথম উয়িঃ ও বাতব্রজা এই তিনটি পদও সূর্যেরই বিশেষণ। এইরকম সূর্য, তিনি মেঘ সকলকে গর্জন করিয়ে মহত্তর প্রকর্ষের সাথে আগমন করেন–ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের প্রথম মন্ত্রের এটাই মর্ম। সেই আদিত্য আমাদের দেহকে ত্রিদোষজনিত (বাত-পিত্ত-শ্লেষ্মর বিকারজনিত) রোগ নাশ করে সুখী করুন। অকুটিলগতি সেই সূর্য অভিন্ন তেজকে তিন প্রকার–অগ্নি বায়ু ও সূর্যরূপে পৃথিবী ইত্যাদি লোকত্রয় আক্রমণপূর্বক অধিপতিরূপে স্থিত আছেন। ভাষ্যানুসারে এটাই মন্ত্রের দ্বিতীয় পংক্তির মর্ম।–আমরা মন্ত্রটিকে অন্যভাবে গ্রহণ করি। আমরা জীব, নিয়তই কর্মের দ্বারা আবদ্ধ হচ্ছি। জন্মের পর আবার জন্ম হোক,আমাদের কর্মের এটাই যেন লক্ষ্য বলে মনে হয়। উচ্চগতি প্রাপ্তির আশা অতি অল্পই থাকছে; পরন্তু, নীচগতির দিকেই আমাদের কর্ম আমাদের আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই মন্ত্র সেই কর্মতত্ত্বের বিষয় ব্যক্ত করছে। একদিকে আমরা আমাদের বন্ধন-মূলক কর্মের প্রতি ধাবমান হচ্ছি, অন্যদিকে সেই করুণানিদান ভগবান্ আমাদের সাবধান করছেন। সংসার-সমরাঙ্গনে যেন এক বিষম সংগ্রাম চলেছে। আমরা বিপথে অগ্রসর হচ্ছি; ভগবান্ আমাদের ফেরাবার চেষ্টা করছেন।-মন্ত্রের উপসংহারের সাথে আরম্ভের সামঞ্জস্য কেমন সুন্দরভাবে রক্ষিত হয়েছে, লক্ষ্য করা যেতে পারে। সেই দেবতা–ঋজুগঃ অর্থাৎ অকুটিলগামী, সকলের প্রতি সমান অনুগ্রহ-পরায়ণ। আমাদের (জীবের) দুঃখত্রয় নিবৃত্তি করবার জন্য তিনি তাঁর অভিন্ন তেজের, সাথে ত্রিলোকে ব্যাপ্ত রয়েছেন। তাঁর করুণার পার নেই; তিনি নিয়ত সকলকে অনুগ্রহ করবার জন্য উন্মুখ। হয়ে আছেন। জীবের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) দুঃখত্ৰয় যাতে দূর হয়, তার প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিয়ত প্রধাবিত আছে। কিন্তু আমরা কর্মঘোরে এতই বিভ্রান্ত যে, তাঁর প্রতি ফিরেও চাইছি না। যে কর্মের দ্বারা শ্রেয়ঃ-সাধিত হয়, নিঃশ্রেয়স্ অধিগত হয়, তার প্রতি আমাদের আদৌ লক্ষ্য নেই। আমরা কেবলই কর্মের বন্ধনে দিন দিন আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হচ্ছি। এই মন্ত্র সেই পক্ষে আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন। ১।
.
দ্বিতীয় মন্ত্রঃ অঙ্গে অঙ্গে শশাচিষা শিশিয়াণং নমস্যন্তা হবিষা বিধেম। অঙ্কাৎসমঙ্কা হবিষা বিধেম যো অগ্রভীৎ পৰ্বাস্যা গ্রভীতা ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদ— সকল জীবের মধ্যে দীপ্তি (জ্যোতিঃ) রূপে বিদ্যমান আপনাকে, হে ভগবন্! স্তুতি নমস্কার ইত্যাদির দ্বারা আমরা পূজা করি, এবং হবনীয়দ্রব্যের দ্বারা (ভক্তিভাবে) আপনার পরিচর্যা করব (ঐরূপ পূজা ও পরিচর্যা করা আমাদের কর্তব্য); ভগবৎসম্বন্ধযুত অন্য সকল, দেবতাকেও (তার সাঙ্গোপাঙ্গরূপ দেবভাবসমূহকেও) হবনীয়ের দ্বারা আমরা অবশ্য পরিচর্যা করব (অর্থাৎ তাদেরও পরিচর্যা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য); জীবের আক্রমণকারী, জীবের বন্ধনহেতুভূত যে অসৎ-ভাব (অসত্য), জীবের কর্মসমূহকে ব্যেপে অবস্থিত আছে, তার নিবৃত্তির। জন্য তার নিবৃত্তিকারক দেবতাকে (দেবভাবকে) আহবনীয়ের দ্বারা আমরা অবশ্য পরিচরর্যা করব। ৮
(অর্থাৎ, তারও পরিচরর্যা করা অবশ্য কর্তব্য)। (ভাব এই যে, কেবল যে ভগবাকেই পূজা করব, তা নয়; পরন্তু ভগবৎসম্বন্ধি সকল দেবভাব সমূহেরই পরিচরর্যা করব। অসৎ-ভাব দূরীকরণের জন্য অসৎ-ভাব দূরীকরণে সমর্থ দেবতাকে অর্চনা করি) ॥ ২॥
মন্ত্রাৰ্থ–আলোচনা –এই মন্ত্রে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করবার আছে। প্রথম–সেই সর্বেশ্বরের পূজা ও পরিচর্যার বিষয়। দ্বিতীয়–তার যাঁরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তাদের পরিচর্যার বিষয়। তৃতীয়তার সাথে মিলনের পথে যারা বাধাস্বরূপ বিদ্যমান আছে, তাদের যিনি অপসারিত করতে পারেন, তার পরিচর্যার বিষয়। প্রথম যাঁর প্রসঙ্গ, তিনি অঙ্গে অঙ্গে শশাচিষা শিশিয়াণং। সকলেরই মধ্যে তিনি দীপ্তিরূপে জ্যোতিঃরূপে আত্মরূপে ব্যেপে আছেন। এখানেই বোঝা যায়, কার প্রতি লক্ষ্য আছে।…দ্বিতীয়ের ও তৃতীয়ের পরিচর্যার প্রসঙ্গে তারই সমীপস্থ হওয়ার পথ কিভাবে পরিষ্কৃত হয়, তা বোঝানো হয়েছে। ভগবৎ-বিভূতিগুলি তার অনুচর অন্তরঙ্গ অথবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলে নির্দেশ করতে পারি। তারাই দেবতা বা দেবভাব।…দেবভাবের সেবা করতে করতে, দেবত্বের অনুসরণ করতে করতে, মানুষ ভগবৎ-সামীপ্য লাভ করে।–ভাষ্যে যে অর্থ প্রকাশিত আছে, তার সাথে আমাদের অর্থের যে অল্প প্রভেদ রয়েছে, উপসংহারে সেই বিষয় একটু আলোচনা করছি। ভাষ্যের মত এই যে, সূর্যকে সম্বোধন করে এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে,-জ্বর ইত্যাদির পোষক রোগ এই পুরুষের শরীরের সন্ধিস্থানসমূহ আক্রমণ করে আছে। সেই রোগের নিবৃত্তির জন্য এই হবিঃ প্রদানে পূজা করা কর্তব্য। এখানে রোগকে (আক্রমণকারীকে) হবিঃ প্রদান করতে হবে, এইরকম ভাবই প্রধানতঃ প্রকাশ পায়। দেবতার সঙ্গে অপদেবতার পূজা আমাদের দেশে যে প্রচলিত আছে, এই অর্থেই তার সঙ্গতি দেখা যায়। জ্বরনাশক দেবতারও পূজা করা, আর জ্বরপ্রবর্ধক জুরাসুরেরও পূজা করা,–বোধ হয় এই কারণেই প্রবর্তিত হয়ে থাকবে….তবে আমরা যে লক্ষ্য রেখে অর্থ করে যাচ্ছি, তাতে সৎ ভিন্ন অসতের সেবা উপপন্ন হয় না, দেবভাব ভিন্ন অসুরভাবের সেবা সাধারণতঃ স্বীকার করা যায় না। ২।
.
তৃতীয় মন্ত্রঃ মুঞ্চ শীর্ষক্ত্যা উত কাস এনং পরুষ্পরুরাবিবেশা যো অস্য। যো অভ্ৰজা বাতজা যশ্চ শুম্মা বনস্পতীসচতাং পর্বতাংশ্চ। ৩
বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন্! শিরঃসম্বন্ধীয় রোগ হতে (মস্তকের বন্ধন হতে) এই দেহকে মুক্ত করুন; যে ক্ষয়কারক রোগ (অথবা সত্যনাশকারী যে কর্মপ্রভাব) এই দেহের সকল সন্ধিবন্ধনকে অধিকার করেছে, তা হতেও মুক্তিদান করুন; যে ব্যাধি (অথবা-বন্ধন) বায়ুবিকৃতিজাত (অথবা–রজোভাববিকৃতি হেতু উৎপন্ন), যে ব্যাধি (অথবা বন্ধন) পিত্তবিকারজনিত (অথবা সত্ত্ববিকৃতিজ), তা বৃক্ষসমূহকে বা পর্বতসমূহকে প্রাপ্ত হোক (অর্থাৎ, সেরূপ ব্যাধিতে বা বন্ধনে লোকসমাজ যেন কখনও আক্রান্ত না হয়)। (অন্তৰ্য্যাধি বহির্ব্যাধি উভয় ব্যাধিই বন্ধনহেতুভূত। তাই মন্ত্রে সর্বব্যাধি নাশের কামনা এবং সর্ববন্ধন ছেদনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাচ্ছে)। ৩৷৷
মন্ত্ৰাৰ্থ–আলোচনা –এই মন্ত্রে সাদাসিদাভাবে ব্যাধিমুক্তির প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে। এই পুরুষকে শিরোরোগ হতে মুক্ত করুন। এই পুরুষের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে শ্লেষ্ম প্রবেশ করেছে; এবং যে ক্ষয়কর কাশরোগে এই পুরুষ আক্রান্ত হয়েছে, তা হতে একে রক্ষা করুন। বাতপিত্তকফজনিত যে ব্যাধি, সে ব্যাধি বৃক্ষসমূহে এবং পর্বতসমূহে সমাবিষ্ট হোক। মন্ত্রের অর্থে, প্রথম দৃষ্টিতে এই ভাবই প্রাপ্ত হওয়া যায়। ভাষ্যেও এই ভাবের অর্থই প্রকাশিত দেখি। কিন্তু পূর্বাপর মন্ত্রের সাথে এই মন্ত্রের অর্থসঙ্গতি রক্ষার পক্ষে উদ্বুদ্ধ হয়ে, আমরা মন্ত্রে দুরকম অর্থ প্রকাশ করলাম। এক অর্থ–ভাষ্যের অনুসারী রইলো। অন্য অর্থ– আমাদের ব্যাখ্যায় পরিগৃহীত পন্থারই অনুগত হলো। তবে ভাব-পক্ষে আমাদের প্রকাশিত দুরকম ব্যাখ্যাতেই সমান অর্থ পাওয়া যাবে।–যেমন,-শীর্ষক্ত্যাঃ পদ। এর প্রকৃত অর্থ–শিরের (মস্তকের) সাথে যা ব্যাপ্য বা অবস্থিত অর্থাৎ সম্বন্ধবিশিষ্ট। এ থেকে শিরোরোগ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের বক্তব্য এই যে, অসৎ-ভাবের সমাবেশ-রূপ যে বন্ধন মস্তিষ্ককে ঘিরে থাকে, এই পদ তা-ই ব্যক্ত করছে। সেই বন্ধন হতে দেহকে মুক্ত করাই প্রধান মুক্তি।…আবার, কাসঃ পদটি। এর সাধারণ অর্থ–ক্ষয়কর কাসরোগ। কিন্তু বলা হয়েছে, যা সকল সন্ধিস্থলে প্রবিষ্ট হয়ে আছে। ক্ষয়কারী কাস-রোগে শরীরের সকল অঙ্গ-গ্রন্থি শিথিল করে। এক পক্ষে এই ভাবই আসে। অন্য পক্ষে, ক্ষয়রোগের ন্যায় ক্রমে ক্রমে আত্মধ্বংসকারী যে সকল সৎ-ভাববিনাশক অপকর্ম নিত্য নিত্য অনুষ্ঠান করে মানুষ নিজের সকল অঙ্গকে দিন দিন শিথিল করছে এবং সেই কর্মের দ্বারা সেই সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে দিন দিন দৃঢ়তর ও দৃঢ়তম বন্ধনপাশে আবদ্ধ করছে, এখানে যঃ কাসঃ অস্য পরুঃ পরুঃ আবিবেশ বাক্যে সেই ভাবই প্রকাশ পাচ্ছে। আবার, অজাঃ বাতজাঃ ও শুষ্ম পদে যদি যথাক্রমে কফ-পিত্ত-বাত ঐ তিন ধাতুকেই বোঝাচ্ছে মনে করি, তাতেও ঐ তিন ধাতুর বিকৃতির ভাব আসে না কি? ত্রি-ধাতুর সাম্যই স্বাস্থ্যাবস্থা।…এই দিকের এই অর্থ থেকেই গুণসাম্যের ভাব আসতে পারে। শ্লেষ্ম বা কফ-তমোভাবের দ্যোতক। বায়ুর দ্বারা রজোভাবের এবং পিত্তের দ্বারা সত্ত্বভাবের আভাষ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বস্তুতঃ, ব্যাধির ও রোগের উপমার মধ্য দিয়ে। এখানে পরমার্থতত্ত্ব বিবৃত আছে, পূর্বাপর ভাবসঙ্গতি-রক্ষায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এই সকল বিষয় বিবেচনা করে মন্ত্রের প্রার্থনার ভাবার্থ এইরকম নির্দেশ করতে পারি;-হে ভগবন্! আমার মস্তিষ্ককে কলুষ-চিন্তার সংশ্রব হতে মুক্ত রাখুন। আমার দেহজাত কর্মসমূহকে অসৎ সংশ্রব হতে পৃথক করে দিন। আমার অন্তরস্থিত সত্ত্ব রজঃ তমঃ তিন গুণের কোন গুণে যেন বৈষম্য উপস্থিত না হয়। আমি যেন আমার সকল প্রকার বন্ধন-মোচনে আপনার করুণার স্রোত উন্মুক্ত দেখি।–এটা অবশ্যই সুসঙ্গত প্রার্থনা ॥ ৩।
.
চতুর্থ মন্ত্রঃ শং মে পরস্মৈ গাত্রায় শমস্তুবরায় মে। শং মে চতুর্ভো অভ্যেঃ শমস্তু তন্বেত মম ॥ ৪৷
বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন্! আমার শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সূক্ষ্ম দেহে সুখ (মঙ্গল) হোক; আমার নিকৃষ্ট দেহে অর্থাৎ মেদমাংসবিশিষ্ট এই দেহে সুখ (মঙ্গল) হোক; আমার চতুরঙ্গে অর্থাৎ কর্মাকর্ম হেতু চতুর্বিধ দেহ-ধারণে সুখ (মঙ্গল) হোক; আমার স্থূলসূক্ষ্মাত্মক সকল প্রকার শরীরে সুখ (মঙ্গল) হোক। (ভগবানের অনুকম্পায় আমার স্থূলসূক্ষ্ম সকল শরীর সর্বকালে সুখস্বরূপ ব্রহ্মকে লাভ করুক–মন্ত্র এই ভাব প্রকাশ করছেন) ৪
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –বন্ধনই দুঃখ। বন্ধন-মোচনেই সুখ। বিবিধ কর্মে বিভিন্ন অঙ্গকে বিবিধ প্রকারে আবদ্ধ করে ফেলে। কর্মের দ্বারা যেমন শ্রেষ্ঠ অঙ্গ মস্তক আবদ্ধ হয়, কর্মের দ্বারা তেমন নিম্ন অঙ্গ হস্ত-পদ ইত্যাদি আবদ্ধ হয়ে থাকে। স্কুল-শরীর সম্বন্ধে যে ভাব, সূক্ষ্মশরীর সম্বন্ধেও সেই ভাব। কর্মের ফল ভোগ করবার জন্য প্রতি অঙ্গ কর্মের ডোরে আবদ্ধ থাকে। এখানে তাই প্রতি অঙ্গের প্রতি অবস্থার কথা সুখ-কামনা করা হয়েছে; প্রতি শরীরের প্রতি অবস্থান্তরের মঙ্গল-প্রার্থনা করা হয়েছে।–ভাষ্যকার দৈহিক ব্যাধিনাশের দিক থেকে অর্থ করেছেন; সে পক্ষে মন্ত্রটিকে দৈহিক ব্যাধিনাশমূলক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আধ্যাত্মিক ব্যাধি-নাশ-পক্ষে প্রার্থনামূলক বলে মন্ত্রটিকে গ্রহণ করেছি। তাতে দেহের ব্যাধি ও মনের ব্যাধি উভয় ব্যাধিরই শান্তিকামনা প্রকাশ পেয়েছে।–যেমন,-মন্ত্রে পরস্মৈ এবং অবরায় দুটি পদকে ভাষ্যকার দেহের সম্বন্ধে প্রযুক্ত বলে ঐ দুটি পদের যথাক্রমে পরস্তাৎ উপরি বর্তমানায় শিরোরূপায় এবং অবস্থা বর্তমানায় চরণ লক্ষণায় অঙ্গায় অর্থ গ্রহণ করেছেন। একে মস্তক বোঝাচ্ছে, অন্যে চরণ ইত্যাদি নিম্নাঙ্গকে বোঝাচ্ছে। আমরা পর পদে শ্রেষ্ঠ সূক্ষু অর্থ গ্রহণ করেছি। তাতে পরস্মৈ পদে সূক্ষ্ম শরীরকে–প্রাণকে–আত্মাকে বোঝাচ্ছে। আমাদের মতে, অবরায় পদে-নিকৃষ্ট শরীরকে অর্থাৎ মেদমজ্জামাংসভূত এই দেহকে বোঝাচ্ছে। সেই অনুসারে ঐ দুই পদের মর্ম হয় এই যে, আমার প্রাণ (আত্মা) শান্তিলাভ করুক,-আমার দেহ শান্তিলাভ করুক। কেবল মস্তক আর নিম্ন অঙ্গ ব্যাধিশূন্য হলে, কেবল দেহের (বহিরঙ্গের), সুখ হলে, প্রকৃত শান্তিলাভ হয় কি? প্রাণে অশান্তি থাকলে, দেহে সুখ থাকে কি? দেহে ও প্রাণে-শান্তি উভয়ই চাই। আমরা মনে করি, ঐ দুই পদে সেই ভাব পরিব্যক্ত আছে। শেষে দেখুন, মম তন্বে পদ। ভাষ্যের অর্থ–মধ্যশরীরায় সর্বসমষ্টিরূপায় শরীরায় বা। আমরা অর্থ করেছি–স্থূলসূক্ষ্মাত্মকে সর্বভাবাপন্নে দেহে। এখানে কর্মাকর্মের বিষয় মনে আসে। স্কুল-শরীর ও সূক্ষ্ম শরীর দুই দেহে জীবাত্মা কর্মাকর্মের সুখ-দুঃখ ভোগ করে। এখানে তাই প্রার্থনা করা হচ্ছে,-হে ভগব। কিবা আমার স্কুল-শরীর, কিবা আমার সূক্ষ্ম-শরীর,–আমার উভয় শরীরে আমি যেন শান্তি পাই। ফলতঃ ক্রমে ক্রমে যেন আমার উৎকর্ষ সাধিত হয়,-আমি যেন ক্রমে ক্রমে ভগবানকে প্রাপ্ত হই। এটাই এই মন্ত্রের প্রার্থনার মর্মার্থ। ৪
.
দ্বিতীয় সূক্ত : বিদ্যুৎ
[ঋষি : ভৃগ্বঙ্গিরা। দেবতা : বিদ্যুৎ। ছন্দ : জগতী, ত্রিষ্টুপ–বৃহতীগৰ্ভা পংক্তি]
প্রথম মন্ত্র: নমস্তে অস্তু বিদ্যুতে নমস্তে স্তনয়িত্নবে। নমস্তে অশ্মনে যেনা দূড়াশে অস্যসি। ১।
বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন্! আপনার জ্যোতীরূপ আমার নমস্কার প্রাপ্ত হোক, আপনার শব্দরূপ আমার নমস্কার প্রাপ্ত হাৈক, আপনার ব্যাপক-রূপ আমার নমস্কার প্রাপ্ত হোক। যে কারণে দুঃখভাগী জনে (আমাতে) দুঃখ প্রাপ্ত হয়, সেই কারণকে আপনি সর্বতোভাবে দূরে নিক্ষেপ করুন। ভাব এই যে,–ভগবান্ জ্যোতিঃরূপে, শব্দরূপে, ব্যাপ্তিরূপে সর্বত্র বিরাজমান রয়েছেন। আমাদের সর্বপ্রকার দুঃখনিবৃত্তির জন্য সর্বব্যাপী সেই ভগবাকে নমস্কার করি) ॥ ১।
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –সূক্তানুক্রমণিকায় লিখিত আছে,–অশনিপাত নিবারণের জন্য এই সূক্তের মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হয়ে থাকে; এবং এই মন্ত্রের সঙ্গে সোমদর্ভকুষ্ঠলোষ্ঠমঞ্জিষ্ঠা ইত্যাদি দ্রব্য গৃহক্ষেত্র ইত্যাদিতে নিখননে বিনিযুক্ত হয়। এই সূক্তের মন্ত্রের দ্বারা দেবতার উদ্দেশ্যে ঘৃতাহুতি প্রদান করলে, অশনি পাতের আশঙ্কা দূরীভূত হয়ে থাকে, গৃহে বজ্রপাত হয় না। এটাই প্রসিদ্ধি।–ভাষ্যানুসারে, এই মন্ত্রটিতে যেন বিদ্যুৎকে, বজ্রধ্বনিকে এবং মেঘকে নমস্কার করা হয়েছে। ভাষ্যের মতে, মন্ত্রের সম্বোধ্য পর্জন্য। পর্জনকে সম্বোধন করে যেন বলা হচ্ছে, হে পর্জন্য! তোমার বিদ্যুৎকে নমস্কার করি, তোমার ধ্বনিকে (গর্জনকে) পরে মিকার কার মন্ত্র ধ্বনি নমস্কার করি, তোমার মেঘকে নমস্কার করি। সেই নমস্কারের জন্য, যে জন তোমাকে স্তুতি-নমস্কার-হবিঃ প্রদান করে না, তার প্রতি তুমি বজ্র ত্যাগ করো। অর্থাৎ, আমরা যখন তোমার বিদ্যুৎকে, শব্দকে ও মেঘকে নমস্কার করছি, তখন তুমি আমাদের প্রতি তুষ্ট হও; এবং যে জন তোমার পূজা করে না, তাকে বজ্রাঘাতে বধ করো। ভাষ্যেরও এই অর্থ; পাশ্চাত্য-পণ্ডিতগণও এই অর্থই গ্রহণ করেন। বেদের সময় আদিম অসভ্য মনুষ্যগণ যে প্রকৃতির এক একটি ক্রিয়া দেখে বিস্মিত হয়ে তাদেরই পূজায় প্রবৃত্ত হতো, এই উপলক্ষে তথাকথিত পণ্ডিতগণ তা-ই প্রতিপন্ন করবার প্রয়াস পান।–আমাদের অর্থ কিন্তু সে পথ দিয়েই যায়নি, বরং বিপরীত ভাবই প্রকাশ করেছে। অসভ্য অবস্থার কথা কি বলব? এই মন্ত্রে দেখতে পাই, অতি সভ্য সমুন্নত আধ্যাত্মিক জগতে লব্ধপ্রবেশ জনের প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে। অপিচ, অধ্যাত্ম-দর্শনের অতি গুঢ়তত্ত্ব এই মন্ত্রে ব্যক্ত দেখি। আমরা দেখছি, এই মন্ত্রে প্রথমে ভগবানের স্বরূপ-শক্তির পরিচয় আছে। তিনি যে এই। সংসারে তিন ভাবে তিনরূপে অবস্থিত আছেন, এই মন্ত্রে তার আভাষ প্রাপ্ত হই।–প্রথম–এই মন্ত্রের সম্বোধন। সম্বোধন পর্জন্যকে কেন বলবো? পরন্তু পর্জনকে সম্বোধন হয়েছে মনে করতে গেলে অশ্মনে পদের মেঘ-অর্থই বা কেমন করে আনতে পারি? পর্জন্য ও মেঘ সমপর্যায়ভুক্ত। মেঘকে ডেকে কী বলা সঙ্গত হয়,–আমি তোমার এই বিদ্যুৎকে, বজ্রকে আর মেঘকে নমস্কার করি? যদি অশ্মনে পদের পরিবর্তে, তোমাকে বোঝাবার উপযোগী কোনও পদ থাকতো, বরং কতকটা অর্থ উদ্ধার করা যেতে পারতো। কিন্তু তা নেই। সুতরাং পর্জন্যকে সম্বোধন আমরা সঙ্গত বলে মনে করি না। আমরা বলি– এখনকার সম্বোধ্য–ভগবন।–প্রকাশরূপ, শব্দ-রূপ, আর ব্যাপ্তি-রূপ–এই তিন রূপে তিনি জগৎ ব্যেপে আছেন। তিনের মধ্যেই তাকে বিদ্যমান দেখি। এই তিন ভিন্ন অন্য রূপ থাকতে পারে না। এই তিনের মধ্যেই সকল রূপের সকল প্রকার অভিব্যক্তির বীজ নিহিত রয়েছে। বিশ্বরূপে যে বিশ্বনাথ বিদ্যমান, এই তিনের দ্বারাই তা প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম-জ্যোতিঃ। জ্যোতিঃই তার প্রকাশ-রূপ। বিদ্যুতে সেই জ্যোতির পরাকাষ্ঠা। তাই বলা হয়েছে বিদ্যুতে আমার নমস্কার সমর্পিত হোক। দ্বিতীয়–শব্দ। শব্দ তার এক অভিব্যক্তি। আবার শব্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শব্দ–অশনি। তাই প্রার্থনা করা হলো,–হে ভগবন্! আপনার স্তনয়িত্নবে (বজ্রনিনাদে, শব্দরূপে) আমার নমস্কার সমর্পিত হোক। তৃতীয় ব্যাপ্তি। তাই প্রার্থনা–তার ব্যাপক-রূপ লক্ষ্য করে। অনে পদের অর্থ, ভাষ্যেরই মতো, ব্যাপনশীলায়। এ সংসারে মেঘের–মেঘের উপাদান বাষ্পের সর্বব্যাপকতা প্রসিদ্ধ। অতএব প্রার্থনা করা হলো,-হে ভগবন্! আপনার ব্যাপক-রূপে গিয়ে আমার নমস্কার মিলিত হোক-ভাষ্যের মতে যেন দূড়াশে অস্যসি বাক্যের অর্থ–যারা তোমার পূজা করে না, তাদের প্রতি তোমার বজ্র (রোয) নিক্ষিপ্ত হোক। অর্থাৎআমরা তোমায় নমস্কার করছি; আর, তার ফলে, যারা নমস্কার করে না, তারা নিহত হোক। এ অর্থে, বড়ই স্বার্থপরতার, বড়ই নীচ অন্তঃকরণের, পরিচয় প্রকাশ পায়। বিশ্বপ্রেম বেদের মন্ত্রে এমন ভাব, পরের অনিষ্টসাধনের প্রার্থনা–কোথাও দেখা যায় না। হৃদয়ের অসৎ বৃত্তিসমূহকে এবং কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গকে, রূপকে রাক্ষস ইত্যাদি অভিধায়ে অভিহিত করে, বধ করার প্রার্থনা অনেক স্থলেই আছে বটে; কিন্তু হে ভগবন্! তারা তোমার উপাসনা করে না, সুতরাং তাদের প্রতি বস্ত্র নিক্ষেপ করো,–এমন ভাবের প্রার্থনা, এ পর্যন্ত তো কোথাও দেখিনি।…বরং এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবই ব্যক্ত দেখি। এ পক্ষে, আমাদের মতে,–আমাদের, জগতের সকলেরই–দুঃখের যে মূল কারণ, হে ভগবন! আপনি সেই কারণকে দূর করুন-এই প্রার্থনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে।–এখানে আর একটি ভাবের কথা অধ্যাহার করা যেতে পারে। মন্ত্রের শেষাংশে দুঃখের যে কারণ নাশ করবার প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে, সে কারণ কি রকমে নাশ পেতে পারে? আমরা মনে করি, মন্ত্রের প্রথমাংশে যে কর্মানুষ্ঠানের উপদেশ আছে, তা-ই সেই কারণ-দূরীকরণের উপায়। সেই যে নমস্কার, সেই যে ভগবানের পূজা,-তা-ই দুঃখনিবৃত্তির হেতুভূত। মন্ত্রের প্রথমাংশে তাই যেন উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তিনি যে জ্যোতীরূপে বিদ্যমান, তা জেনে তাকে নমস্কার করো। তিনি যে বাষ্পরূপে মেঘরূপে বিশ্ব ব্যেপে আছেন, তা বুঝে তাকে নমস্কার করো। তিনি যে শব্দরূপে বিদ্যমান, তা জেনে তাঁকে নমস্কার করে। তার পূজায় তার নমস্কারে–তার অর্চনায়, তাঁর ধ্যান-ধারণায়, সকল বিপদ দূরে যাবে।–এটাই তাৎপর্যার্থ। ১।
.
দ্বিতীয় মন্ত্রঃ নমস্তে প্ৰবতো নো যতস্তপঃ সমূহসি। মৃড়য়া নশুভ্যো ময়তস্তাকেভ্যস্কৃধি ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদ –বিপথগামিগণের ভয়প্রদাতা হে ভগবন্! আমার নমস্কার আপনাকে প্রাপ্ত হোক; তাতে, পাতকদাহক আপনার তেজঃ সংহত করুন; সর্বতোভাবে আমাদের এই দেহে (জীবনে) সুখ প্রদান করুন, আমাদের অপত্যগণের (সংসারের সকলের) মঙ্গল করুন; (অর্থাৎ এই নমস্কারের ফলে সংসারের মঙ্গল হোক)। হে ভগবন্! আমরা বিপথগামী হলে আপনি আমাদের সাবধান করে দিন। কেবলমাত্র আমাদের নয়, পরন্তু নিখিল জনগণের মঙ্গল-বিধান করুন। মন্ত্রে এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে) ২
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— ভাষ্যকারের মত এই যে, এই মন্ত্রেও পর্জনকে সম্বোধন করা হয়েছে। এর জন্য তিনি প্রবতো নপাৎ পদ দুটির অর্থ দুরকমে নিষ্পন্ন করে পরিশেষে ভাবে ঐ দুই পদে পর্জন্য অর্থ অধ্যাহার করে নিয়েছেন। তার প্রথম প্রকার অর্থের ভাব-যারা স্তুতি-নমস্কার হতে বিরত আছে, তাদের যিনি পালন করেন না; অর্থাৎ অসেবককে যিনি অশনিভয় প্রদর্শন করেন। তাঁর অন্য অর্থ–প্রগতের অর্থাৎ উপাসনাহীন জনের নিকট হতে তিনি বৃষ্টির পতন রোধ করে রাখেন; অনাবৃষ্টি-নিবন্ধন তারা কষ্ট পায়। ইত্যাদি।–যে পথে ভাষ্যকার প্রবতো নপাৎ শব্দে পর্জন্য অর্থ গ্রহণ করেন, সেই পথেই সাদাসিধাভাবে বিপথগামীদের ভয়প্রদর্শনকারী অর্থ-ই পাওয়া যায়। ভগবাকেই লক্ষ্য করে ঐ দুই পদ প্রযুক্ত হয়েছে।… এখন, প্রার্থনার বিষয় লক্ষ্য করুন। প্রথম প্রার্থনা, আপনার পাতক-দাহক তেজঃ সম্বরণ করুন। ভাব এই যে,–আমরা পাপী; পাপের জ্বালায় অহর্নিশি দগ্ধীভূত হচ্ছি, জ্বলে পুড়ে মরছি। আপনি সে জ্বালা নিবারণ করুন। দ্বিতীয় প্রার্থনা,–আমাদের এই দেহে সর্বতোভাবে সুখ উৎপাদন করুন। প্রথম মন্ত্রে দুঃখের কারণকে দূর করতে বলা হয়েছিল। এখানে সর্বতোভাবে সুখের প্রার্থনা প্রকাশ পেলো। সে সুখ-পরম, সুখ-নিঃশ্রেয়স-রূপ সুখ। এটাই আমরা মনে করি।-মন্ত্রের তৃতীয় প্রার্থনা (ভাষ্যের মতে)–আমাদের সন্তানসন্ততিগণকে সুখী করুন। আমরা ঐ স্থানে আর একটু প্রশস্ত ভাব গ্রহণ করি। মন্ত্রে তোকেভ্যঃ পদে শিশু বা ছেলে-মেয়ে অর্থ বোঝালেও, কেবল আপন সন্তান-সন্ততি অর্থ কেন করব? সর্বজনীন সকলের ভাব ঐ পদে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তার পর শিশু এই অর্থ আসায়, অজ্ঞজনমাত্রকে (জ্ঞানপক্ষে শিশু) মনে। be করা যেতে পারে। সে পক্ষে এই অংশের তাৎপর্য এই যে, আমাদের ন্যায় আর যারা অজ্ঞ আছে, এই জ্ঞানরাজ্যের শিশু আছে, তাদেরও মঙ্গলদান করুন। কুপথ হতে ফিরিয়ে সংসারের সকলের প্রতি করুণাবর্ষী ] হোন। আমরা মনে করি, এই সর্বজনীন প্রীতির ভাব এই মন্ত্রাংশে পরিব্যক্ত রয়েছে ৷৷ ২
.
তৃতীয় মন্ত্রঃ প্রবতো নপান্নম এবাস্তু তুভ্যং নমস্তে হেতয়ে তপুষে চ কৃন্মঃ। বিন্দু তে ধাম পরমং গুহা যৎ সমুদ্রে অন্তর্নিহিতাসি নাভিঃ ॥ ৩॥
বঙ্গানুবাদ –সৎ-মাৰ্গত্যাগীর অরক্ষক (অসন্মার্গগামীর সংহারক) হে ভগবন্! আপনাকে আমরা নমস্কার করছি; এই প্রকারে আপনার সকল বিভূতিকেই আমাদের নমস্কার প্রাপ্ত হোক; হননকারণ (দুষ্কৃতের নাশের জন্য) সন্তাপদানকারী আপনার আয়ুধকেও আমরা নমস্কার করি; (পরমার্থপ্রদ) শ্রেষ্ঠ প্রসিদ্ধ আপনার যে নিবাসস্থান, তা গুহাবৎ অপরের অনধিগম্য বলে আমরা জানছি; সেখানে, অন্তরিক্ষে প্রাণবায়ুর ন্যায় (দেহের মধ্যে নাভিচক্রের মতো) অদৃশ্যভাবে আপনি বিদ্যমান রয়েছেন। (ভগবান্ সর্বব্যাপী। কেবল সর্বব্যাপী নন; পরন্তু সকলেরই অপ্রত্যক্ষীভূত। একমাত্র সাধকই তার নিবাসস্থানের বিষয় অবগত আছেন। তা ব্যতীত অন্য কেউ অবগত নন। সেই ভগবাকে লক্ষ্য করে প্রার্থনাকারী বিবিধ প্রকারে নমস্কার করছেন। ভরসা, করুণাপ্রকাশপূর্বক করুণানিদান ভগবান্ যদি তার তত্ত্ব বিজ্ঞাপিত করেন অর্থাৎ জানিয়ে দেন) ৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— এই মন্ত্রে শেষাংশের ভাব বড়ই জটিল। যাই হোক, ভাষ্যকারের মতে, এই মন্ত্রেও পর্জন্যকে সম্বোধন আছে। সেই অনুসারে পর্জন্যকে দুবার এবং তার সম্বন্ধী অশনিকে একবার নমস্কার করা হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম পংক্তির এটাই মর্মার্থ। দ্বিতীয় পংক্তির বিদ্ম তে ধাম পরমং গুহা এই অংশের অর্থে, আমাদেরও মত আছে। ভাষ্যের শেষাংশ–যৎ সমুদ্রে অন্তর্নিহিতাসি নাভীঃ। এই অংশের অর্থ নিষ্কাশনের পক্ষে ভাষ্যকার এইরকম ভাবের অধ্যাহার করেছেন। সমুদ্রে পদে তিনি অন্তরীক্ষে অর্থ। গ্রহণ করেন। তাতে অন্তরীক্ষ মধ্যে নাভি এমন বাক্য দাঁড়ায়। তার ভাবে তিনি লিখেছেন,-যেমন। দেহমধ্যে নাভিচক্রে সকল নাড়ী আবদ্ধ আছে, সেইরকম পর্জন্যে সমস্ত মেঘমণ্ডল বদ্ধ আছে। সেই। অনুসারে তিনি ঐ অংশের অর্থে লিখেছেন, হে পর্জন্য! তুমি সেখানে স্থাপিত নাভি হও; অর্থাৎ, সমগ্র মেঘমণ্ডলের ধারকত্বহেতু নাভিচক্রবৎ তুমি অন্তরীক্ষের মধ্যে অবস্থিত আছ।–আমরা কিন্তু প্রবতোনপাৎ পদে (পূর্ব মন্ত্রের মতোই) ভগবাকে সম্বোধন করা হয়েছে বলে মনে করি। তিন বার নমস্কারে, প্রথমে সমষ্টিভাবে তাকে নমস্কার করা হয়েছে; তারপর, তাঁর বিভূতিসমূহকে এবং পরিশেষে তার তীব্র শাসন-শক্তিকে নমস্কার প্রকাশ পেয়েছে।…প্রার্থনা-পক্ষে ভাব প্রকাশ পেল,-হে অসৎ-মার্গগামীর প্রতি তীক্ষ্ণ দণ্ডধর! আপনার নিকট আমরা প্রণত হচ্ছি। কুপথ পরিত্যাগ করে আপনার নির্দিষ্ট পথে চলতে সঙ্কল্প করেছি। আমাদের প্রতি আর দণ্ড ধারণ করবেন না। আপনার অঙ্গীভূত সভাবসমূহকে আমাদের দ্বিতীয় নমস্কার। তারা এসে আমাদের সাথে মিলিত হোন। সৎপথানুবর্তিতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ে সত্ত্বভাব জেগে উঠুক। শেষ নমস্কার আপনার উগ্রভাবকে। সে যেন আর আমাদের দহন না করে। মন্ত্রের প্রথম পংক্তিতে আমরা এই ভাব এই অর্থই প্রাপ্ত হই।–মন্ত্রের দ্বিতীয় পংক্তিটিকে, একই সম্বন্ধ সূত্রে, দুই অংশে বিভক্ত করা যায়। প্রথমাংশের মর্ম,-ভগবানের ধাম নিগূঢ় গুহার ন্যায়;–অর্থাৎ সে ধাম যে কোথায়, কেউই সহজে তা জানতে পারে না। তাকে পেতে হলে, তার সেই ধামে পৌঁছাতে হলে বহু ধ্যান ধারণা-সাধনার প্রয়োজন। এই ভাব এই অংশে প্রকাশমান। শেষাংশের জটিলতার মধ্যে, একটি পদ পাই– অন্তর্নিহিতাসি। এতে মন্ত্রের লক্ষ্যস্থানীয় ভগবানের প্রতিই দৃষ্টি পড়ে। তিনি যে সকলের অভ্যন্তরে অদৃশ্যভাবে অবস্থিত আছেন, ঐ পদে সেই ভাব মনে আসে। সমুদ্রে নাভীঃ পদ দুটিতে–সেই যে তার সর্বত্র অদৃশ্যভাবে অবস্থান, সে কি রূপ–তা ব্যক্ত করছে। কিন্তু নাভিঃ ও সমুদ্রে এই দুই পদের সম্বন্ধ সন্ধান করে পাওয়া বড়ই কঠিন। আমরা তিনরকমে একই লক্ষ্য রেখে ঐ দুই পদের মর্মানুসন্ধানে প্রয়াসী হয়েছি। পুরাণে রূপকে বিষ্ণুর নাভিপদ্ম সংক্রান্ত ব্যাপার এবং সেই সঙ্গে অনন্ত মহাসমুদ্রের বিষয়ে আমরা লক্ষ্য করেছি। সমুদ্রের সে নাভিমূল যেমন সকলের অলক্ষ্য, ভগবানের অবস্থিতি-স্থানও সেইরকম নিগূঢ় তত্ত্বমূলক। অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন সাধক কেবল সে অবস্থা–সে সমুদ্রের সে নাভিপদ্ম দেখতে পান। অনেকে তা দেখতে পায় না। এই সকল ভাব এই অংশে ব্যক্ত আছে বলে মনে করতে পারি। ৩।
.
চতুর্থ মন্ত্রঃ যাং বা দেবা অসৃজন্ত বিশ্ব ইয়ুং কৃথানা অসনায় ধৃষ্ণুং। সা নো মৃড় বিদথে গৃণানা তস্যৈ তে নমো অস্তু দেবি ॥ ৪৷
বঙ্গানুবাদ –সৎ-বৃত্তিস্বরূপিণী হে দেবি! সকল দেবগণ (সত্ত্বসমষ্টিভূত জগৎপাতা) সাধুগণের রক্ষার নিমিত্ত যে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং পাপীগণের প্রতি প্রক্ষেপণের জন্য স্বতঃবর্ষী হিংসক (অসৎ-বৃত্তির নাশক) শরকে সৃষ্টি করেছেন; সেই তুমি, আমাদের সৎকর্মানুষ্ঠানে স্থূয়মান হয়ে, আমাদের সুখী করো; সেই কারণে, আমাদের নমস্কার তোমাকে প্রাপ্ত হোক। (ভাবার্থ-সাধুগণের পরিত্রাণের জন্য দেবীস্বরূপিণী সৎ-বৃত্তিসমূহকে এবং পাপীগণের দণ্ডদানের জন্য সংহাররূপিণী অসৎ-বৃত্তিকে দেবগণ সৃষ্টি করেছেন। আমরা সৎ-বৃত্তিসমূহ প্রার্থনা করি) ॥ ৪।
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— এই মন্ত্রটি একটু জটিল-ভাবাপন্ন। পূর্বের তিনটি মন্ত্রে পুরুষভাবে সম্বোধন ছিল। এখানে প্রকৃতিভাব এসে পড়লো। অর্থনিষ্কাষণে, ভাষ্যকারও সমস্যায় পড়লেন; আমাদেরও সমস্যা উপস্থিত হলো।–ভাষ্যকার বললেন,-এবার অশনিকে সম্বোধন করা হলো। তিনি সেই অনুসারে অর্থ নিষ্পন্ন করলেন,-হে অশনে! ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; অনভিমত (বিরুদ্ধপক্ষীয়) পুরুষের প্রতি নিক্ষিপ্ত হবার জন্য ধৃষ্ণু ইষু (প্রগম্ভ শর) সৃষ্ট হয়েছে। সেই যে তুমি অশনি, এই যজ্ঞে স্কৃয়মান হয়ে, তুমি আমাদের সুখী করো। হে দেবি! আমাদের নমস্কার সেই হেন তোমাকে প্রাপ্ত হোক। ভাষ্যে মন্ত্রের এই মর্মই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা কিন্তু এখানে অশনিকে পূজার বা অশনির সম্বোধনের ভাব গ্রহণ করলাম না। আমরা বুঝলাম, এখানে সৃষ্টপদার্থ দুপ্রকারের আছে। ক্রিয়াবাচক সৃজন্ত এবং কুর্বানা এই দুই পদের প্রয়োগে সেই দুরকম ভাব-ব্যক্তির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সুখপ্রাপ্তির জন্য মানুষ পূজা করে সভাবকে–দেবভাবকে। এটাই স্বাভাবিক। অসৎ-ভাবের বা অপদেবতার পূজা, তাদের দূরীকরণ বিহিত হতে পারে। কিন্তু সুখ-প্রাপ্তির কামনা যেখানে, দেবভাবের বা দেবতার পূজাই সেখানে সঙ্গত বলে মনে করি। এখানে মৃড় (সুখয়) পদ রয়েছে। সুতরাং সেইরকম পূজার ভাবই অধ্যাহৃত হচ্ছে। মন্ত্রে দেবি এই সম্বোধন আছে। দেবি–এই সম্বোধনের সার্থকতা উক্ত অর্থেই উপপন্ন হয়। দেবী-দীপ্তিদানাদিগুণবিশিষ্ট। এ অর্থে অশনি কখনই দেবী পর্যায়ভুক্ত হতে পারে না। অতএব, আমরা মনে করি, এ মন্ত্রের সম্বোধন দেবি পদ সৎ-বৃত্তি-স্বরূপিণী অন্তরস্থিতা দেবীকেই বোঝাচ্ছে।–এপক্ষে, এখানকার প্রার্থনার ভাব এই যে, –সেই দেবীরূপিণী সৎ-বৃত্তি এসে আমার হৃদয় অধিকার করুক। পাপীর দণ্ডকারণে যে শরনিক্ষেপ আবশ্যক হয়, তখন আর তার প্রক্ষেপের প্রয়োজন হবে না।….উপসংহারে এই সূক্তের মন্ত্রগুলি কি উদ্দেশে প্রযুও হয়, সেই পক্ষে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এই সূক্তের মন্ত্র চারটির দ্বারা শান্তিকর্ম করলে, বজভয় হতে মুক্তি পাওয়া যায়, কখনও দেবরোষে পড়তে হয় না। সেই পক্ষে মন্ত্রের যথা-প্রয়োগ হোক, সুফল। আসুক–এই-ই আকাঙ্ক্ষা। ৪
.
তৃতীয় সূক্ত : কুলপা কন্যা
[ঋষি : ভৃগ্বঙ্গিরা। দেবতা : বরুণ, যম। ছন্দ : অনুষ্টুপ]
প্রথম মন্ত্র: ভগবস্যা বর্চ আদিষধি বৃক্ষাদিব জং। মহাবুঃ ইব পর্বতো জ্যোক পিতৃধাস্তাং ১
বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন! মালী, যেমন পুষ্পিত বৃক্ষ হতে পুষ্পসমূহ চয়ন করে অন্যকে প্রদান করে, সেইরূপ সেই সৎ-বৃত্তিরূপিণী দেবী হতে ভাগ্য ও তেজঃ (গ্রহণ-পূর্বক) সর্বতোভাবে আপনি আমায় প্রদান করুন। আমার চিত্ত দৃঢ়মূল অচল পর্বতবৎ পিতৃলোক-সম্বন্ধী (ভগবৎ-সম্পৰ্কীয়) সত্ত্বভাবে চিরকাল (অবিচলিতভাবে) অবস্থিতি করুক। ভাবার্থ,–হে ভগবন্! আমরা যেন আপনার অনুগ্রহে সত্ত্বভাবের অধিকারী এবং পিতৃপদাঙ্কের অনুসারী হই) ॥১॥
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –এই সূক্তে চারটি মন্ত্র। এই মন্ত্র-কটি স্ত্রীর বা পুরুষের দুর্ভাগ্য-নিবারণের জন্য বিহিত। যে স্ত্রী কখনও পতির গৃহে আশ্রয় পায় না, যে স্ত্রীর প্রতি তার পতি বিরূপ ও বিরক্ত, এই মন্ত্রানুগত ক্রিয়ার ফলে, সে স্ত্রী পতির সুনয়নে পতিত হবে এবং পতিগৃহে আশ্রয় পাবে। এই রকমে এই মন্ত্রের প্রভাবে পুরুষেরও সৌভাগ্যোদয় ঘটবে। মন্ত্রের কার্যপ্রণালী কর্মীর আয়ত্তাধীন। কর্মী গুরু-পুরোহিতের দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করাতে হবে।এক্ষণে আমাদের আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণের কথা বলি। ভাষ্যের মতে মন্ত্রের অর্থ এইরকম–এই মন্ত্রের প্রভাবে এই অনভিমতা (অর্থাৎ পতির অমনোনীতা) স্ত্রীর ভাগ্য ও তৎ-হেতুভূত শারীরিক অসাধারণ তেজঃ প্রদত্ত হোক। পুষ্পিত বৃক্ষ হতে মানুষেরা যেমন পুস্পনিকর প্রদান করে; সেইরকম ভাবে এই নারী ভাগ্য ও তেজঃ প্রাপ্ত হোক। দৃঢ়মূল পর্বত যেমন আপন স্থান হতে বিচলিত হয় না, সেইরকম এই অতি দুর্ভাগা স্ত্রী চিরকাল পিতৃগৃহেই বাস করছে; পিতৃগৃহ হতে কখনও পতিগৃহে গিয়ে। পতির মুখ-দর্শনে এর সৌভাগ্য হলো না। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের এইরকম অর্থ ও এই রকম ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়।এবার আমাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দু চারটি কথা বলা যাক। মন্ত্রে একটি অস্যা পদ আছে। তা হতে ভাষ্যকার অনভিমতয়াঃ স্ত্রীয়াঃ অর্থ অধ্যাহার করেছেন। কিন্তু আমরা বলি, অস্যাঃ পদ পূর্ব-সম্বন্ধ দ্যোতক। তার বাংলা ভাব-ইহার। অর্থাৎ, পূর্বে যার কথা বলা হয়েছে, যার প্রসঙ্গ চলেছে, ঐ পদে তাকেই লক্ষ্য আছে। হঠাৎ এখানে পতি-পরিত্যাক্তা স্ত্রীকে কেন সন্ধান করে আনি? পূর্ব সূক্তের শেষ মন্ত্রে (এই মন্ত্রের অব্যবহিত পূর্বেই) দেবীর প্রসঙ্গ আছে। সেই দেবী যে সৎ-বৃত্তিরূপিণী দেবী, তা আমরা সেখানেই প্রতিপন্ন করেছি। আমরা বলি, এখানে অস্যাঃ পদে সেই দেবীকেই নির্দেশ করছে। কাকে সম্বোধন করে মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে, ভাষ্যে তার নির্দেশ নেই।…এই সকল কারণে, বিশেষতঃ বৃক্ষাদিব জং এই উপমার অর্থানুসরণে, আমরা এই মন্ত্রের সম্বোধনে ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আছে–মনে করি।-আমরা মনে করি, মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক।…তাই প্রার্থনা করা হলো,–হে ভগবন্! পুষ্পিত তরু হতে পুষ্প-সম্ভার চয়ন-পূর্বক মালী যেমন অপরকে প্রদান করে, সবৃত্তিরূপিণী দেবীর ঐশ্বর্য ও তেজঃ আপনি সেইরকম আমায় প্রদান করুন। পুষ্পিত তরুর পুষ্পসম্ভার দান-প্রাপ্তির প্রার্থনা–এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও সঙ্গত উপমাই হয়েছে।–মন্ত্রের দ্বিতীয়াংশের প্রার্থনা–দৃঢ়মূল পর্বতের ন্যায় অচল অটল হয়ে আমার চিত্ত সেই ভগবৎ-পাদপদ্মে (সত্ত্বভাবের মহাসমুদ্রে) চিরকাল অবিচলিত-ভাবে আশ্রয় গ্রহণ করুক।–এই সকল বিষয় বিবেচনা করলে, মন্ত্রে আমরা যে অর্থ গ্রহণ করলাম, সেই অর্থই সঙ্গত হয় ॥ ১।
.
দ্বিতীয় মন্ত্র: এষা তে রাজ কন্যা বধূনি ধূয়তাং যম। সা মাতুবধ্যতাং গৃহেহথো ভ্রাতুরঘো পিতুঃ ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদ— সংযম-মূল দ্যোতমান হে শুদ্ধসত্ত্ব-ভাব। সৎ-বৃত্তিরূপা আপনার এই কন্যা মনোরূপ-বরের পরিণীতা পত্নী হন; সেই বধূ পতিগৃহ হতে বিতাড়িত হয়েছেন (অর্থাৎ, মন আর সৎ-বৃত্তিকে পোষণ করতে চায় না, তাই তাকে দূরীভূত করেছে); এইভাবে বিতাড়িত হয়ে, সেই বধূ এখন আপন জননীর এবং ভ্রাতার এবং পিতার গৃহে (আশ্রয় নিয়ে সেখানেই) চিরতরে আবদ্ধ রয়েছে। (ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বভাব হতে নিঃসৃত যে সৎ-বৃত্তি, সে আমার অন্তঃকরণে স্থান-লাভ করেনি। অন্তঃকরণ হতে বিতাড়িত হয়ে সৎ-বৃত্তি সম্প্রতি উৎপত্তি-মূল ভগবানে বিলীন হয়ে আছে)। ২
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –মন্ত্রটি বিষম কুহেলিকা-পূর্ণ। পতিপরিত্যক্তা স্ত্রী যাতে পতিগৃহে পুনরায় আশ্রয় পায় এবং পতির প্রিয় হয়, সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রটির প্রয়োগ-বিধি আছে। তা থাকুক। কিন্তু মন্ত্রের নিগূঢ় তাৎপর্য কি, তা-ই অনুধাবনার বিষয়। ভাষ্যকার বলেন, এখানে রাজন্ পদে সোমকে সম্বোধন করা হয়েছে। যম তার বিশেষণ। মন্ত্রে বলা হয়েছে-হে রাজমান সোম! এই কন্যা বা স্ত্রী তোমার বধূ (জায়া); প্রথমে তুমি একে পরিগ্রহ করেছিলে। কিন্তু এক্ষণে দুর্ভাগ্যবশতঃ পতিগৃহ হতে (তোমার গৃহ হতে) সে নিঃসারিত হয়েছে। এই প্রকারে নিঃসারিত হয়ে, সে এখন আপন জননীর গৃহে, আপন ভ্রাতার গৃহে, এবং, আপন পিতার গৃহে চিরতরে আবদ্ধা রয়েছে। সে এমনই দুর্ভাগা যে, পিতৃমাতৃগৃহে তাকে চিরকাল (যাবজ্জীবন) বাস করতে হলো; সে আর কখনও পতিগৃহে প্রবেশ করতে পেলো না।–আমরা মনে করি, এই মন্ত্রের সম্বোধ্য– শুদ্ধসত্ত্বভাব রাজন্ পদ হতে এবং ঐ পদের প্রতিবাক্যে ভাষ্যকার যে,সোম শব্দ ব্যবহার করেছেন, তা হতে, আমরা ঐ সম্বোধন আমনন করতে পারি। সোম শব্দে যে শুদ্ধসত্ত্বভাবকে (ভক্তি প্রভৃতিকে) বোঝায়, তা আমরা পুনঃ পুনঃ প্রতিপন্ন করে আসছি। রাজন ও যম এই দুই পদই শুদ্ধসত্ত্বের প্রকৃত দ্যোতক। সত্ত্বভাবের ন্যায় দীপ্যমান (রাজমান) সংসারে আর কি আছে? সংযমসাধনার পক্ষেও সত্ত্বভাবই শ্রেষ্ঠ উপাদান। এষা পদে পূর্বমন্ত্রকথিত সৎ-বৃত্তিকেই লক্ষ্য করে। তে কন্যা অর্থাৎ তোমার কন্যা–অর্থাৎ সত্ত্বভাব থেকেই সৎ-বৃত্তির উৎপত্তি। সুতরাং সত্ত্বভাবকে সৎ-বৃত্তির পিতৃস্থানীয় বলা যেতেই পারে। এখন অবশিষ্ট রইলো-বধূঃ পদ। এখানে মনোরূপস্য বরস্য বাক্য অধ্যাহার করেছি। মন্ত্রের ঐ বধূঃ পদ, ঐ বরের সঙ্গে ভিন্ন অন্য বরের সাথে সম্বন্ধযুত হতে পারে না… বন্ধু পদের তাৎপর্য এই যে, পত্নী যেমন পতির সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়, সৎ-বৃত্তি সেইরকম প্রথমে এসে মনের সাথে মিলিত হয়। মানুষের প্রথম অবস্থায়, নবজীবনে, তরুণ মনে, প্রথমে সৎ-বৃত্তিরই স্বতঃ বিকাশ হয়। পরে ক্রমে, পারিপার্শ্বিক পাপ-প্রলোভনের মোহে পড়ে, নিজের অন্তরস্থিত সৎ-বৃত্তিকে মানুষ তাড়িয়ে দেয়। বড় সঙ্গও উপমা!–মন্ত্রের শেষাংশের ভাব,-পতি-পরিত্যক্তা বধূকে যেমন মাতৃগৃহে ভ্রাতৃগৃহে ও পিতৃগৃহে আশ্রয় নিয়ে দিনযাপন করতে হয়, সৎ-বৃত্তিকেও সেইরকম আপন উৎপত্তিস্থানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। এখানে মাতা, ভ্রাতা ও পিতা তিনটি পদ আছে। সৎ-বৃত্তির পিতা–শুদ্ধসত্ত্বভাব। তার জননী-পর্যায়ে হৃদয়কে মস্তিষ্ককে নির্দেশ করতে পারি। তার ভ্রাতা বলতে–সত্য, সরলতা, দয়া প্রভৃতি সৎ-গুণাবলিকে নির্দেশ করতে পারি। তখন, পতিগৃহ হতে বিতাড়িত হয়ে, যেখানে শুদ্ধসত্ত্বভাব আছে, সেখানে গিয়ে সে আশ্রয় গ্রহণ করে,-যেখানে দয়া, সত্য, সরলতা প্রভৃতি গুণের সমাবেশ আছে, সেখানে। গিয়ে সে বসতি করে, যে হৃদয়ে বা মস্তিষ্কে একটু জ্ঞান আছে–সেইখানে গিয়ে সে আবদ্ধ থাকে। বদ্ধতাং পদের সার্থকতা এই যে, সেই হৃদয়ে বা সেই মস্তিষ্কেই সে বদ্ধ থেকে যায়, বাহিরে এসে, পরিত্যাগকারীর কাছে এসে, সে আর আপন কর্মকারিতা প্রকাশ করে না।–এইভাবে আমরা মনে করি, মন্ত্র যে কার্ষে, যে ভাবেই প্রযুক্ত হোক, মন্ত্রের লক্ষ্য,-ভ্ৰমান্ধ মনকে সতর্ক করা ॥ ২॥
.
তৃতীয় মন্ত্রঃ এষা তে কুলপা রাজন্ তামু তে পরি দদ্মসি। জ্যোক্ পিতৃম্বাসাতা আ শীষ্ণঃ সমোপ্যাৎ ॥ ৩॥
বঙ্গানুবাদ –হে দ্যোতমান শুদ্ধসত্ত্ব! সৎ-বৃত্তিরূপা তোমার এই কন্যা কুলপবিত্ৰকারিণী (অর্থাৎ, সে কখনও ব্যাভিচারিণী বিপথগামিনী হয় না); অতএব, সৎ-বৃত্তিরূপা তোমার সেই কন্যাকে তোমারই আশ্রয়ে রক্ষা করো, সে চিরকাল পিতৃগৃহে (সত্ত্ব সম্বন্ধেই) বাস করুক; তাতেই তার মস্তক ভুলুণ্ঠিত হোক (অর্থাৎ, সেই অবস্থাতেই সে তোমাতে লীন হোক)। (ভাবার্থ,-মন হতে পরিত্যক্ত সেই সৎ-বৃত্তি উপায়ান্তর বিহীন হয়ে উৎপত্তিকারণ সত্ত্বভাবের সাথে লীন হয়ে আছে)। ৩৷৷
মন্ত্রাৰ্থ–আলোচনা –ভাষ্যে এ মন্ত্রেও সোমকে সম্বোধন আছে। ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের মর্মার্থ এই এ যে,-তোমার এই স্ত্রী পাতিব্ৰত্যের দ্বারা কুলের পালয়িত্রী। যেহেতু বিবাহকালে প্রথমতঃ তোমা কর্তৃক এই স্ত্রী পরিগৃহীত হয়েছিল, তুমি এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলেই এই কন্যা তোমাকে দান করা হয়। তোমার পর নিকট প্রত্যাখ্যাত হয়ে এক্ষণে সে চিরকালের জন্য পিতৃগৃহে বাস করছে। সেখানেই তার মস্তক ভূপতিত হতে চললো, অর্থাৎ সেই অবস্থাতেই তার মরণ নিকটে এলো। এ মতে, পত্নী-পরিত্যাগকারী কোনও পতিকে সম্বোধন করে যেন এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছিল, এটাই প্রতিপন্ন হয়। পাশ্চাত্য-পণ্ডিতগণ এই ব্যাখ্যারই অনুমোদন ও অনুসরণ করেন।–আমরা পূর্বাপর ভাব-সঙ্গতি রক্ষা-পক্ষে রাজ ও এ পদ দুটিতে যথাক্রমে সত্ত্বভাবকে ও সৎ-বৃত্তিকে লক্ষ্য করে এসেছি। মন যখন সৎ-বৃত্তির সংশ্রব পরিত্যাগ করে, তখন সৎ-বৃত্তি আর কোথায় যাবে? যে সৎ হতে এসেছিল, সে তখন সেই সতেই গিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানে সেই কথাই রূপকের আবরণে উপমার মধ্য দিয়ে পরিবর্ণিত হয়েছে। পতি যদি আপন পত্নীকে পরিত্যাগ করে, আর সে পত্নী যদি ব্যাভিচারিণী না হয়; তাহলে, তার পিতা তাকে আশ্রয় দেন,-পালন করেন; সে যদি আর স্বামিগৃহে আশ্রয় না পায়, তাহলে পরিশেষে পিতৃগৃহেই তার আয়ুঃ শেষ হয়। সাংসারিক এই নিত্যপরিদৃশ্যমান ব্যাপারের মধ্য দিয়ে, এখানে মনস্তত্ত্বের এক নিগূঢ় রহস্য ব্যক্ত করা। হয়েছে। …সৎ-বৃত্তি সত্ত্বভাবসস্তৃতা। যেখানে সত্ত্বভাব, সে তো গিয়ে সেখানে বিলীন হলো। এই অর্থেই পিতৃগৃহ-বাসের উপমা। সংসারী লোকের চক্ষে স্বামী-পরিত্যক্তা অবস্থায় পিতৃগৃহে নারীর জীবনযাপন বিসদৃশ দৃশ্য। তাতে তার মস্তক ভূলুণ্ঠিত হলো–ভাব আসে।…কিন্তু, তা হলেও, সে যখন আপন পাতিব্ৰত্য-ধর্ম অক্ষুণ্ণ রেখে, পতির ধ্যানে, পরমেশ্বরের পূজায়, জীবন যাপন করে; তার পারলৌকিক মঙ্গল অবিসম্বাদী। এখানে সেই আভাষই পাওয়া যায়। এ পক্ষে মন্ত্রের উপদেশ এই যে,–মানুষ! তুমি সৎ-বৃত্তিকে পরিত্যাগ করে যেও না। সে আশ্রয়বিহীন নয়। কিন্তু তাকে পরিত্যাগ করে তোমাকেই শেষে নিরাশ্রয় হতে হবে। এই মন্ত্রের ভাব উপলব্ধি করে, মানুষ যখন বলতে পারবে, হে দেবি! তুমি আমারই গৃহে থাকো, পিতৃগৃহে তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই–তখনই মন্ত্রের লক্ষ্য সিদ্ধ হবে ৷ ৩৷৷
.
চতুর্থ মন্ত্রঃ অসিতস্য তে ব্ৰহ্মণা কশ্যপস্য গয়স্য চ। অন্তঃকোশমিব জাময়োহপি নহ্যামি তে ভগম ॥ ৪
বঙ্গানুবাদ –হে আমার মন! তোমার দুষ্কৃতিকে, অসিত কশ্যপ ও গয় নামক মহর্ষি-ত্রয়ের প্রবর্তিত (অথবা–পাপ-কালিমা-নাশক, দণ্ড-নিবারণ-কারক এবং উন্মাৰ্গতাজনিত দোষপরিহারক) মন্ত্রের দ্বারা অপনোদন করছি; সেই মন্ত্রের দ্বারা, তোমার সৌভাগ্যকে নিত্যপরিবর্ধনশীল বিত্তকে (অথবা, অপত্য ইত্যাদিকে) নিগূঢ় স্থানে লুক্কায়িত রত্নের ন্যায় প্রকটিত করছি। (মন্ত্রশক্তি অব্যর্থ-ফলপ্রদায়িনী। হে মন! সেই মন্ত্রশক্তির প্রভাবে তোমার উৎকর্ষসাধন করছি।মন্ত্রটি এমনই আত্ম-উদ্বোধনমূলক)। ৪।
মন্ত্রাৰ্থ–আলোচনা –ভাষ্যে এ মন্ত্রে নারীকে সম্বোধন আছে। তাকে সম্বোধনে বলা হচ্ছে,–হে নারি! অসিত ঋষির, কশ্যপ ঋষির এবং গয় ঋষির মন্ত্রের দ্বারা, তোমার ভাগ্যের বাধা দূর করছি; গৃহের মধ্যে অবস্থিত ধনের ন্যায় তোমার সৌভাগ্য ও অপত্য ইত্যাদি প্রাপ্ত করছি। ভায্যে মন্ত্রার্থে সংক্ষেপতঃ এই ভাবই প্রকাশ পেয়েছে।–কেবল নারীকে কেন, ভাষ্যকারের অনুসরণেই আমরা বলতে পারি, মনকে অথবা সৎ-বৃত্তিকে (বরকে অথবা বধূকে) দুয়ের যে কোনটির সম্বোধনে মন্ত্রটি প্রযুক্ত হয়েছে–এমনও বলা যেতে পারে।…তাতে, দুয়ের একের সম্বোধনে প্রযুক্ত মনে করলে, উভয়ের যে কাউকে সম্বোধন-পূর্বক বলা যায়, মন্ত্রের দ্বারা তোমার ভাগ্যপরিবর্তন সাধিত করছি। আমাদের দৃষ্টিতে অবশ্য, মনঃ-সম্বোধনে মন্ত্রের প্রয়োগই অধিকতর সঙ্গত বলে প্রতীত হয়। পিতৃগৃহে বাসের উপমায় (পূর্ব মন্ত্র দ্রষ্টব্য) যদি খবভাব সৌভাগ্যহানির ভাব গ্রহণ করা যায়, তাতে মন্ত্রটি সৎ-বৃত্তির পক্ষে প্রযুক্ত হয়েছে মনে করলেও মনে করতে পারি। কিন্তু সে পক্ষে প্রথম তে পদটির সার্থকতা থাকে না। ভাষ্যকার ঐ তে পদটি গণনায় আনেননি। আমরা মনে করি, এখানে দুরকম বিষয় প্রখ্যাত হয়েছে। প্রথম–দুষ্কৃত-নাশ, দ্বিতীয়–সৌভাগ্য-লাভ। দুষ্কৃতি নাশ না পেলে, সৌভাগ্য কিভাবে আসবে? উভয়ের পারস্পরিক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। তাই দুটি তে পদের ব্যবহারে আমরা ঐ ভাব অধ্যাহার করছি। মন্ত্রের প্রভাবে, তোমার দুষ্কৃত (পত্নীত্যাগ-রূপ সৎ-বৃত্তির পরিত্যাগ) দূর হবে; আর তুমি সৌভাগ্য (পরমৈশ্বর্য) প্রাপ্ত হবে। হঠাৎ কোনও গুপ্তধন প্রাপ্ত হলে মানুষের যে আনন্দ হয়, মন্ত্রের প্রভাব, দুর্ভাগ্যের মধ্যে সৌভাগ্যের উদয়ে তুমি সেই আনন্দ লাভ করবে। অন্তঃকোশমিব উপমায় সেই ভাব প্রকাশ করছে।…মন্ত্রের নিগূঢ় শিক্ষা,-তোমার আপন অবস্থা তোমার আপন উদ্যমে পরিবর্তন করতে হবে। প্রস্তুত হও–প্রস্তুত হও।–মন্ত্রে অসিত, কশ্যপ এবং গয় এই তিনটি পদের দ্বারা ঐ তিন নামধেয় তিন জন ঋষির সংশ্রব সূচিত হয়। এ পক্ষে আমরা দুরকম অর্থ আমনন করলাম। মনে করতে হবে, ঐ সব নামে অনন্ত-সম্বন্ধ আছে। কালচক্রনেমির বিন্দুরূপে ঐ সকল মহাত্মা সংসারে আবির্ভূত হন এবং সংসার হতে তিরোহিত হন। –মশক্তি অব্যর্থ ফলপ্রদ। মন্ত্রশক্তির অনুধ্যানে আত্মজয়ী হও। এটাই এখানকার প্রার্থনার গুঢ় উপদেশ। ৪
.
চতুর্থ সূক্ত : পুষ্টিকর্ম
[ঋষি : অথর্বা। দেবতা : সিন্ধব, বায়ু, পতত্রিণ। ছন্দ : অনুষ্টুপ, পংক্তি]
প্রথম মন্ত্রঃ সং সং শ্রবন্তু সিন্ধবঃ সং বাতাঃ সং পতত্ৰিণঃ। ইমং যজ্ঞং প্রদিবো মে জুষাং সংম্রাব্যেণ হবিষা জুহোমি ॥ ১।
বঙ্গানুবাদ –হে জলাধিষ্ঠাত্রী সর্বাভীষ্টবর্ষণকারী স্নেহকারুণ্যরূপী (সর্বধারণক্ষম) দেবতা, (আপনারা) আমাদের প্রভূত মঙ্গল সাধন করুন। হে বায়ুর অধিষ্ঠাত্রী (সর্বত্রগমনশীল, সর্বব্যাপী) দেবতা! (আপনারা) আমাদের মঙ্গল (বিধান করুন); হে পতিত-উদ্ধারকারী দেবতা! আপনারা আমাদের সুখ প্রদান করুন। (অর্থাৎ ভগবানের সকল বিভূতিসমূহের অনুগ্রহে আমাদের সর্বপ্রকার শ্রেয়ঃ সাধিত হোক)। (ভাবার্থ-ভগবানের বিভূতিসমূহ আমাদের অনুকূল হোক এবং সর্বমঙ্গল বিধান করুক। অপিচ, তাদের অনুগ্রহে আমাদের সর্বরকম শ্রেয়ঃ সাধিত হোক) ১
অথবা, হে দেবভাবসমূহ! (আপনারা) সংসার-সমুদ্রে নিমজ্জিত জনগণের উদ্ধার সাধন করেন (অথবা ভগবৎ-অভিমুখী কিম্বা আপনাদের অনুগ্রহপ্রার্থী জনগণকে ত্বরায় ভগবানের সাথে সম্মিলিত করেন); (আপনারা) চঞ্চলচিত্ত জনের চিত্তস্থৈর্য বিধান করে ভগবানে সম্মিলিত করেন; (আপনারা) পতিত ও পতনোন্মুখ জনগণের (দুষ্কৃত দূর করে। তাদের মঙ্গল সাধন করেন (সকর্মনিরত করে উদ্ধার-সাধন করেন)। (ভাবার্থ–তাদের দুষ্কৃত দূর করে সৎকর্মপরায়ণ করুন)। ১
অথবা,
হে দেববিভূতিসমূহ! আপনারা জলচর প্রাণীদের, অন্তরীক্ষচারী জীবগণের এবং স্থাবর জঙ্গমাত্মক সকল প্রকার প্রাণীর সুখ ও মঙ্গল বিধায়ক হন। (ভাব এই যে ভগবান্ সকলেরই মঙ্গল বিধান করেন)। প্রাচীনগণের স্তুত্য দীপ্তিদানাদি গুণযুক্ত সেই আদিদেব (পূর্বোক্ত বিভূতি-সমূহ পরিবৃত হয়ে) প্রার্থনাকারী আমাদের এই অনুষ্ঠান-সমূহ প্রাপ্ত হোন। আমরা পবিত্র (তাঁর সমীপে নয়নসমর্থ) সত্ত্ব ইত্যাদি গুণের দ্বারা তাঁর সেবা করছি; (সত্ত্ব ইত্যাদির দ্বারা তাকে পাবার প্রার্থনা করছি)। ১।
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –নানা ভাবে এ মন্ত্রের নানারকম অর্থ অধ্যাহার করা যেতে পারে। এক অর্থে, মন্ত্রের প্রথমাংশে জলদেবতাকে, বায়ুদেবতাকে এবং বনদেবতাকে সম্বোধন করা হয়েছে, বলা যেতে পারে। আর এক অর্থে, ভগবানের বিভিন্ন বিভূতিগুলিকে আহ্বান করে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হয়েছে, বলতে পারি। আর এক অর্থে, ভগবান্ বিভিন্ন বিভূতিরূপে প্রকটিত হয়ে, বিভিন্ন জনের যে উদ্ধার সাধন করে থাকেন, মন্ত্রে তা-ই খ্যাপিত দেখি।–ভাষ্যানুসারে বোঝা যায়, সূক্তের অন্তর্গত এই মন্ত্রগুলি সর্বপুষ্টি-কর্মে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। সেই ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে, ভাষ্যকার মন্ত্রের প্রথমাংশের অর্থ করেছেন,স্যন্দনশীল নদীসমূহ আমাদের অনুকূলে প্রবাহিত হোক; গমনশীল বায়ু আমাদের অনুকূল থোক। অর্থাৎ, জল, বায়ু ও বন সর্বত্রবিহারী প্রাণিগণ আমাদের সহায় হোক। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের অর্থ, ভাষ্যকারের মতে,–পুরাতন দেবগণ আমাদের এই যজ্ঞের সমীপবর্তী হয়ে হবিঃ স্বীকার করুন। আমরা সংস্রবণীয় আজ্য ইত্যাদি হবিঃ অগ্নিতে নিক্ষেপ করছি। মন্ত্রের এই ব্যাখ্যাই অধুনা সাধারণ্যে প্রচলিত। বহির্যাজ্ঞিকের পক্ষে এমন প্রার্থনা এমন কামনা সঙ্গত হলেও, অন্তর্যাজ্ঞিকের-মুক্তিপ্রার্থী জনের পক্ষে, এ মন্ত্রে অন্যভাব প্রতিভাত।একটু বিবেচনা করে দেখলে বুঝতে পারা যায়, স্কুল-বস্তুর সাথে এ মন্ত্রের আদৌ সম্বন্ধ নেই। ব্যষ্টিভাবে সমষ্টিভূত ভগবানের বিভিন্ন বিভূতির সম্বোধনে সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকেই এই মন্ত্রে লক্ষ্য করা হয়েছে। অসীমকে সসীম মনের মধ্যে ধারণা করা যায় না; তাই তার বিভিন্ন রূপ ও বিভিন্ন আকৃতির কল্পনা করা হয়ে থাকে। অধিকারী অনুসারে বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিভূতির ধারণা করে নেয়।…মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের প্রদিবঃ পদের মর্মগ্রহণ একটু দুরূহ। সায়ণ, ঐ শব্দের অর্থ করেছেন,-পুরাতনা দেবাঃ। আমরা এই অর্থের কোনও সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারলাম না। নূতন ও পুরাতন–দেবতার এই পর্যায়-নির্দেশ বড়ই বিসদৃশ। বেদবাক্য নিত্য-সত্য-সনাতন বলে স্বীকার করলে, এমন স্তরনির্দেশে তার অপৌরুষেয়ত্বে বিঘ্ন ঘটে। তাই আমরা ঐ পদে দুই বিভিন্ন অর্থ নির্দেশ করেছি। প্রথম, পুরাতনৈঃ ঈড়িত স আদিদেবঃ; দ্বিতীয়, দীপ্তিদানাদিগুণযুও স জ্ঞানদেব যদ্বা অগ্রগামিনঃ দেবঃ। প্রথম অর্থে বোঝা যায়, সেই দেবতাকে যে কেবল আমরাই আরাধনা করছি, তা নয়; আমাদের পূর্ববর্তিগণপিতৃপিতামহ এবং তাঁদেরও পূর্ববর্তিগণ এই ভাবে অনন্ত অতীত কালে, অনন্ত অতীত জনগণ, তাদের পূজা করে গিয়েছেন। তারাও বলেছেন পুরাতন; আমরাও বলছি–পুরাতন, আমাদের পরবর্তিগণও বলবেন–পুরাতন। সুতরাং যিনি পুরাতনগণের ঔত্য, সেই পুরাণ-পুরুষ আদিদেবকেই ঐ প্রদিবঃ পদে লক্ষ্য করা হয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় অর্থে বোঝা যায়–আমাদের হৃদয়ে নিহিত দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত সেই জ্ঞানদেবতা আমাদের অনুষ্ঠানসমূহ দেবভাবসমূহ–ভগবৎসকাশে সংবাহিত করুন।–হে দেববিভূতিনিবহ অথবা হে দেবভাবনিবহ! আপনারা? আমাদের মঙ্গল বিধান করুন। সৎ-ভাব-সহযুত সৎকর্মসমূহ আপনাদের প্রদান করছি। আপনারা তা গ্রহণ করুন,–আমাদের পরমার্থসন্নিকর্ষলাভে সহায় হোন, এবং আমাদের ভগবানের সমীপে নিয়ে যান। প্রার্থনাপক্ষে মন্ত্রের এটাই মূল ভাব। ১।
.
দ্বিতীয় মন্ত্রঃ ইহৈব হবমা যাত ম ইহ, সংশ্রাবণা উতেমং বর্ধয়তা গিরঃ। ইহৈতু সর্বো যঃ পশুরস্মিন্ তিতু। যা রয়িঃ ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদ –হে দেবভাবনিবহ! আমাদের স্তুতির দ্বারা (প্রসন্ন হয়ে).আমাদের এই কার্যে (আমাদের হৃৎ-প্রদেশে) আগমন করুন (অধিষ্ঠিত হোন)। সুপণশীল (অভীষ্টবর্ষণশীল, আমাদের হৃদয়ে নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদির দ্বারা সম্বর্ধিত হয়ে) আপনারা এই কার্যে (অনুষ্ঠানকারী আমাদের হৃদয়ে) আগমন করুন (প্রতিষ্ঠিত হোন)। আমাদের উচ্চারিত এই স্তুতিমন্ত্রসমূহকে (আমাদের প্রদত্ত এই হবিকে) প্রবৃদ্ধ করুন (অর্থাৎ, আমাদের স্তুতিতে প্রসন্ন হয়ে আমাদের সমৃদ্ধিশালী করুন); হে দেবগণ! আমাদের ইহলোকসম্বন্ধি সমস্ত মঙ্গল আমাদের প্রাপ্ত হোক, অপিচ পরলোক-সম্বন্ধি কল্যাণ আমাদের প্রতি বর্ষিত হোক। (ভাবার্থ-হে দেবগণ! আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। আপনাদের অনুগ্রহে আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয়প্রকার মঙ্গল বিহিত হোক। অপিচ, আমাদের মোক্ষফল প্রদান করুন। মন্ত্রে এই প্রার্থনার ভাব দ্যোতিত হচ্ছে) ॥ ২॥
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –এ মন্ত্র সরল প্রার্থনামূলক। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন, দু এক স্থান ব্যতীত অন্য কোনও স্থলেই তার সাথে আমাদের মতানৈক্য নেই। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যায় প্রকাশ,হে দেবগণ! আমাদের আহ্বান শ্রবণ করে, আমাদের আহ্বানের উদ্দেশে, আপনারা আমাদের সমীপে আগমন করুন। অন্য সকল পরিত্যাগ করে কেবল আমার সমীপেই উপস্থিত থাকুন। আমাদের এই অনুষ্ঠানে আমরা সংস্রবণীয় ইত্যাদির দ্বারা হোম নিষ্পন্ন করি। হে দেবগণ! আমাদের কর্তৃক স্মৃয়মান হয়ে হবিপ্রদানকারী আমাদের প্রজা-পশু-অশ্ব ইত্যাদির দ্বারা সমৃদ্ধশালী করুন। আমাদের অনুগ্রহে লোকপ্রসিদ্ধ গো-অশ্ব-মহিষ ইত্যাদি এবং ধান্য-কনক ইত্যাদি আমাদের গৃহে আগমন করুক। ইত্যাদি। সায়ণ পশুঃ এবং রয়িঃ পদ দুটিতে যথাক্রমে গো-অশ্ব-মহিষ ইত্যাদি পশু ও ধান্য-কনক ইত্যাদিরূপ ধন অর্থ করেছেন। লৌকিক হিসাবে এমন অর্থ অসঙ্গত নয়; কিন্তু মোক্ষপ্রার্থী ভক্তসাধক ঐহিক সুখলাভের কামনা করেন না। তাঁদের পশু ইত্যাদি লাভের কামনা ইহলৌকিক মঙ্গলপ্রাপ্তি-শুদ্ধসত্ত্বলাভে, সৎকর্মের সম্পাদনে সাধিত হয়ে থাকে। তাই এখানে পশুঃ পদে আমরা ইহলৌকিক মঙ্গল অর্থ অধ্যাহার করেছি। রয়িং পদে পারলৌকিক মঙ্গল অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে। প্রার্থনাপক্ষে মন্ত্রের ভাব এই যে,-হে দেবভাবনিবহ! আপনারা প্রসন্ন হয়ে আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা সম্বর্ধিত হয়ে আমাদের হৃদয়ে আসন গ্রহণ করুন। আমাদের উচ্চারিত স্তুতিমন্ত্ৰসমূহ যাতে ভগবৎ-অনুসারী হয়, আপনারা তার বিধান করুন। অপিচ, আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধন করে আমাদের পরমার্থলাভে সহায় হোন। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উদয় হোক, আমরা সৎকর্মের সাধনে অনুপ্রাণিত হই, ফলে সংসারসমুদ্র তরে যাই।–আমরা মনে করি, মন্ত্রে এই প্রার্থনাই প্রকটিত রয়েছে। ২।
.
তৃতীয় মন্ত্রঃ যে নদীনাং সংস্রবন্তুৎসাসঃ সদমক্ষিতা তেভির্মে সর্বৈঃ সংস্ৰাবৈর্ধনং সং স্রাবয়ামসি ৷৷ ৩৷
বঙ্গানুবাদ –নদীগর্ভস্থিত এবং উৎস-উৎপন্ন (গিরিকর হতে উৎপন্ন) সলিলরাশি যেমন অবিচ্ছিন্ন-গতিতে প্রবাহিত হয় (অথবা নদী ও উৎস-সমূহ যেমন স্ব স্ব সলিলরাশি সাগরের অভিমুখে সংবাহিত করে), সেই রকম, হে দেবগণ! আমাদের সৎ-ভাব-সহযুত সৎকর্মনিবহকে ভগবানে সংযোজিত করুন (অথবা, ভগবানের সমীপে পৌঁছিয়ে দিন)। (ভাব এই যে,-হে দেব! আমরা যেন সৎ-ভাব-সহযুত সৎকর্মের প্রভাবে ভগবাকে প্রাপ্ত হই) ॥ ৩॥
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –এ মন্ত্রটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একটু সমস্যা-মূলক। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যায়ই সে সমস্যার অবতারণা হয়েছে। মন্ত্রের ব্যাখ্যা-ব্যপদেশে ভাষ্যকার বলেন,গঙ্গা ইত্যাদি নদীপ্রবাহ এবং গিরিকর-উদ্ভিন্ন নিঝর-সমূহ অবিরাম-গতিতে প্রবাহিত হয়; গ্রীষ্মকালেও তার ক্ষয় নেই। সেই জলপ্রবাহ ইত্যাদির দ্বারা আমরা গো-হিরণ্য ইত্যাদি ধন প্রাপ্ত হবে। অথবা জলপ্রবাহের অবিচ্ছিন্ন অবাধগতির ন্যায় আমরাও অবিচ্ছিন্নভাবে সমৃদ্ধিসম্পন্ন হবো।–মন্ত্রের এমন ব্যাখ্যাই সাধারণ্যে প্রচলিত। কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে, যে এক অতি উচ্চ উদার ভাব চিরলুক্কায়িত আছে, তার প্রতি এ পর্যন্ত কেউই লক্ষ্য করেননি।–জল প্রবাহের দ্বারা আমাদের ধনবৃদ্ধি করব–এমন উক্তি বড়ই সমস্যাপূর্ণ। এ থেকে সাধারণ-দৃষ্টিতে দূরকম অর্থ আমনন করা যেতে পারে। নদী ও সমুদ্রগর্ভে নানারকম ধনরত্ন লুক্কায়িত থাকে; সেই সকল ধনরত্নের আহরণে সমৃদ্ধ হবো–এই একরকম ভাব আসতে পারে। আর একরকম ভাব এই যে,-নদীর ও উৎসের জল অবিচ্ছেদে সংবাহিত করে সিঞ্চন করলে শস্য ইত্যাদি বৃদ্ধি হবে। আর তার দ্বারা আমাদের অভীষ্টপূরণ হবে। বহির্যাজ্ঞিকের পক্ষে, ঐহিকসুখপ্রয়াসী জনগণের পক্ষে, সংসারী, সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে, এমন ধনলাভের প্রার্থনা সঙ্গত বটে।–আমরা কিন্তু মনে করি, এ মন্ত্র দেরভাবসমূহকে সম্বোধন করে উচ্চারিত হচ্ছে। মন্ত্রের মধ্যে, আমাদের মতে যে কয়েকটি উপমা বিদ্যমান, তার বিশ্লেষণে মন্ত্রের নিগূঢ় ভাব হৃদয়ঙ্গম হবে।মন্ত্রে বলা হচ্ছে,-নদী ও উৎস-সমূহ যেমন আপন আপন সলিলরাশি সাগরের অভিমুখে সংবাহিত [. করে, সেইরকম হে দেবভাবনিবহ! আপনারা আমাদের সৎ-ভাব-সহযুত সৎকর্মনিবহকে ভগবানের নিকট সংবাহিত করুন। আমরা মনে করি, মন্ত্রের মধ্যে এই নিগূঢ় ভাবই প্রচ্ছন্ন রয়েছে ৷ ৩৷৷
.
চতুর্থ মন্ত্রঃ যে সর্পিষঃ সংস্রবন্তি ক্ষীরস্য চোদ্দকস্য চ। তেভির্মে সর্বৈঃ সংস্ৰাবৈর্ধনং সং বয়ামসি ॥৪॥
বঙ্গানুবাদ –সর্পণশীল জ্ঞানকিরণ, ক্ষরণশীল সত্ত্বভাব ইত্যাদি এবং দ্রবণশীল সৎকর্মনিবহ (ভক্তিভাব ইত্যাদি) আপনা-আপনিই ভগবৎ-অভিমুখী হয়। জ্ঞানকিরণ, সত্ত্বভাব এবং সকর্মনিবহ বা ভক্তি প্রভৃতির সাহায্যে আমাদের চতুর্বর্গের ফললাভরূপ অভীষ্ট সিদ্ধ হোক। (ভাবার্থ,-জ্ঞানের সত্ত্বভাব ইত্যাদির এবং সৎকর্মের প্রভাব সর্ববিদিত। অতএব, তাদের আনুকূল্যে আমি যেন চতুর্বর্গফলরূপ-ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ–অভীষ্টধন প্রাপ্ত হই। ৪।
মন্ত্ৰাৰ্থ–আলোচনা –পূর্ব-মন্ত্রের ন্যায় এ মন্ত্রটিও জটিলতাপূর্ণ। ভাষ্যে যে অর্থ প্রকাশিত, তা হতে বোঝা যায়,–সর্পি, ক্ষীর এবং উদক্ প্রভৃতি যে সকল আজ্য যজ্ঞকালে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয়, তারই অবয়ব (সারাংশ) নদীরূপে প্রবাহিত হয়ে থাকে। নদীসমূহ যেমন অবিচ্ছেদে সর্বদা প্রবাহিত হয়, সেইরকম আমরাও অবিচ্ছিন্নভাবে শস্য ইত্যাদির দ্বারা সমৃদ্ধ হতে থাকি। সাধারণভাবে মন্ত্রে এই অর্থই অধ্যাহৃত হয়। এক্ষণে আমাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দুচারটি কথা বলা যাক। মন্ত্রের অন্তর্গত সর্পিষঃ পদে আমরা সর্পণশীলস্য জ্ঞানকিরণস্য অর্থ আমনন করেছি। ধাতুগত অর্থের অনুসরণে ঐ অর্থই সঙ্গত।ক্ষীরস্য পদে আমরা ক্ষরণশীলস্য সত্ত্বভাবাদেঃ অর্থ আমনন করলাম। জ্ঞানের সঙ্গে সত্ত্বভাবের নিত্য-সম্বন্ধ। জ্ঞান হতেই সত্ত্বভাবের সৎ-ভাবসমূহের উৎপত্তি। ক্ষীর যেমন দুগ্ধের সারভূত; সৎ-ভাব ইত্যাদিও সেইরকম জ্ঞানের সারভূত। জ্ঞানের উদয় না হলে সৎ-অসৎ বিচারশক্তির উন্মেষ হয় না।উদকস্য পদের আমরা দ্রবণশীলস্য সৎকর্মনিবহস্য ভক্তিরসস্য অর্থ অধ্যাহার করেছি। এ-ও ধাতুগত অর্থের অনুসরণে সঙ্গত। প্রার্থনাপক্ষে, এ মন্ত্রে যে ভাব উপলব্ধ হয়, তা প্রকটিত করছি;–জ্ঞানকিরণ, সত্ত্বভাব ইত্যাদি এবং ভক্তিসহযুত সৎকর্মনিব, মুক্তিপ্রার্থীজনগণকে ভগবানের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। এ পক্ষে ঐ তিনের প্রভাব অপরিসীম। মুক্তিপ্রার্থীজন তাই আকুল কণ্ঠে বলছেন,হে দেব! আমরা চতুর্বর্গধনলাভের প্রয়াসী; আমাদের হৃদয়ে জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটাও, হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার করে দাও, ভগবানের কার্য– সকার্যসম্পাদনে প্রবৃত্তি আসুক। জ্ঞানের উদয়ে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হোক, সৎকার্যসম্পাদনে তৎপরতা লাভ করি। তা হলেই আমাদের পরমার্থসিদ্ধি হবে;–তাহলেই, আমরা আমাদের আরাধ্য-দেবতা-সকাশে, উপনীত হতে সমর্থ হবো। আমরা মনে করি, সর্বপুষ্টি-কর্মে প্রযুক্ত এই মন্ত্রটিতেও অ্যাধ্যাত্মিকভাবে এই ভাবই অভিব্যক্ত। ৪
.
পঞ্চম সূক্ত : শত্ৰুবাধনম
[ঋষি : চাতন। দেবতা : অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণ ইত্যাদি। ছন্দ : অনুষ্টুপ]
প্রথম মন্ত্রঃ যেহমাবস্যাংত রাত্ৰিমুদস্তুব্রাজমত্ৰিণঃ। অগ্নিস্তুরীয়ো যাতুহা সো অস্মভ্যমধি ব্ৰবৎ ॥ ১৷৷
বঙ্গানুবাদ –লোকপ্রসিদ্ধ সর্বসংহারক যে শত্রুগণ অমানিশাবৎ অন্ধ তমসাচ্ছন্ন হৃদয়কে, অপিচ স্বল্প-প্রদীপ্ত-হৃদয় ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়, দেবগণের অগ্রগামী পরমৈশ্বর্যশালী অগ্নিদেব (জ্ঞানদেবতা), সেই শত্রুসমূহকে বিনাশ করেন। শহন্তা সেই অগ্নিদেব, আমাদের এই পরিত্রাণের জন্য, (আমাদের অন্তর হতে) শত্রুবর্গকে বিদূরিত করুন। (ভাব এই যে,–জ্ঞানের প্রভার সর্বজনবিদিত। জ্ঞানের প্রভাবে আমাদের অন্তশত্রু বিনষ্ট হোক, আমাদের মায়ামোহ দূরে যাক; আমরা পরমার্থের সন্নিকর্ষলাভের অধিকারী হই) ॥১॥
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— এই সূক্তের মন্ত্রগুলির প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে দ্বেষ্যমারণার্থং অভিমন্ত্রিত সীসচূর্ণমিশ্ৰান্নপ্রদানং তত্রস্থাবরণসংস্পর্শনং..ইত্যাদি।–সে তো সাধারণ অর্থে। আমরা এই মন্ত্রে প্রধানতঃ দুটি ভাব উপলব্ধি করি। প্রথমতঃ–জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞানতারূপ শত্ৰুসকল বিধ্বস্ত হয়, দ্বিতীয়তঃ–শত্রুদমনের–অজ্ঞানতা-নাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানদেব প্রকাশিত হন। ফলতঃ, জ্ঞানোদয়ই অজ্ঞানতা নাশের মূলীভূত। ভাষ্যের অর্থে মন্ত্রের ভাবগ্ৰহণ পক্ষে বিষম অন্তরায় উপস্থিত হয়। এই পঞ্চম সূক্তের অনুক্রমণিকায় প্রকাশ, (আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি), দ্বেষ্যমারণ বা হিংসা নিবারণের জন্য সূক্তের মন্ত্রসমূহ প্রযুক্ত হয়ে থাকে। সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্রগুলির দ্বারা সীসচূর্ণমিশ্রিত অন্নসমূহ নিক্ষেপ করতে হবে, রোগাক্রান্ত ব্যক্তির গাত্র স্পর্শ করতে হবে এবং স্বয়ংছিন্ন বেনুষ্টির দ্বারা তাকে তাড়ন করতে হবে।–এই সূত্রেই ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ প্রকাশ করেছেন, এই স্থলে তার উল্লেখ করছি।অমাবস্যার রাত্রিতে যে সকল রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদি নীরোগ হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিগণের প্রতি হিংসার জন্য বিচরণ করে, তাদের নিবারণ করবার জন্য আত্মরক্ষামূলক রাশ্লোঘ্ন ইষ্টির অনুষ্ঠান করবে। অগ্নিদেব সেই সকল রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদি নিহত করেন। সুতরাং সেই অগ্নিদেব রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদিজনিত আমাদের ভয় নিবারণ করুন। ইত্যাদি.. রাএিকালে বিচরণশীল অসুরসংহারই কি কেবল অগ্নিদেবতার কার্য? এরকম অর্থে মন্ত্রে কোনও সৎ-ভাবের কল্পনা নিতান্ত দূরূহ। অমাবস্যাং রাত্রিং শব্দ দুটিতে আমরা অমানিশাবৎ অন্ধতমসাচ্ছন্নহৃদয়ং অর্থ আমনন করেছি। তাতে ভাব হয় এই যে,–ঘোরান্ধকার রজনীর ন্যায় যাদের হৃদয় অজ্ঞানতায় সমাচ্ছন্ন। অজ্ঞানতাই যে সকল অনর্থের মূল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।-ব্রাজং রাত্রিং পদ দুটির ভাষ্যকার অর্থ করেছেন,–ভ্ৰাজমানাং তারকাদিভিদ্দীপ্যমানাং রজনীং; আমরা অর্থ করলাম,-দীপ্তবৎ প্রতীয়মানং ন তু সম্যক্ প্রদীপ্তান্তরং। এ স্থলেও অজ্ঞানতার ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। জ্ঞানের জ্যোতি এখানে সম্যক্ বিচ্ছুরিত হয়নি। এখানে জ্ঞান-অজ্ঞানের দ্বন্দ্ব চলছে। মেঘের কোলে বিজলীর ন্যায় এক একবার জ্ঞানরশ্মি বিকাশ পাচ্ছে; আবার অমনি অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। নক্ষত্র-তারকা ইত্যাদি সম্যক্ জ্যোতিশীল নয়; কিন্তু তবুও তারা যেমন অন্ধকার রজনীতে অন্তরীক্ষে সঞ্চারিত হয়ে অন্ধকার-নাশের কিছুটা প্রয়াস পায়, জ্ঞানাঙ্কুর উগমের প্রথম অবস্থায়ও সেই ভাব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। নক্ষত্র ও তারকা ইত্যাদির ক্ষীণরশ্মি যেমন রজনীর গাঢ় অন্ধকার ভেদ করতে পারে না; স্ফুরণোন্মুখ জ্ঞানজ্যোতিও সেইরকম প্রথম অবস্থায় অজ্ঞানতিমির নাশ করে হৃদয় আলোকিত করতে সমর্থ হয় না। তখনও অন্তঃশত্ৰু-সমূহ সে হৃদয় আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করবার প্রয়াস পায়।ব্রাজং রাত্রিং পদ দুটিতে আমরা মনে করি, সেই ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। জ্ঞানলাভেই হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব জাগরিত হয়, শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবেই ভগবানের ঐশ্বর্যবিভূতি-সমূহ অধিগত হয়ে আসে। এই জন্যই জ্ঞানাগ্নি যাতুহা বিশেষণে বিশেষিত হয়েছেন।–মন্ত্রে অগ্নিদেবের একটি বিশেষণ আছে–তুরীয়। ঐ পদের নানা অর্থ কল্পিত হয়ে থাকে। সায়ণ ঐ পদের অর্থ করেছেন,–চতুর্থঃ অগ্নিঃ। এই প্রসঙ্গে একটি পৌরাণিক উপাখ্যানের অবতারণা হয়ে থাকে। সে মতে অগ্নি চারপ্রকার বৈতানিক, গার্হ্য, সংগ্রামিক ও আঙ্গিরস। ভাষ্যকারের মতে এস্থলে শেষোক্ত অগ্নির প্রতিই লক্ষ্য আছে। এ হিসাবেও তুরীয় পদে এক উচ্চ ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে, বুঝতে পারি। চতুর্থ অগ্নি অর্থাৎ পূর্ণ জ্ঞান। জ্ঞানের চরম সীমায় উঠতে পারলে, তখন আর শক্ৰভয় থাকে না। তুরীয় পদে এ ভাবও ব্যক্ত হতে পারে। তবে সাধারণভাবে–তুরীয়ঃ অর্থাৎ চতুর্থ অগ্নি বা আঙ্গিরস অগ্নি বললে কোনও বিশেষ ভাব উপলব্ধ হয় না, তাই আমরা তুরীয়ঃ পদে অঙ্গনাদিগুণযুক্ত, পরিত্রাতা, পরমৈশ্বর্যশালী অর্থ গ্রহণ করেছি।-মন্ত্রে আছে, ৪ অগ্নিদেব অজ্ঞান হৃদয়ের সকল শত্ৰু সংহার করেন; ভাব এই যে, আমরা অজ্ঞান-তিমিরে ডুবে আছি; কামক্রোধ ইত্যাদি রিপু শত্রুর ভীষণ আক্রমণে বিধ্বস্ত হচ্ছি, মায়ামমাহ প্রভৃতি এসে আমাদের অভিভূত করে ফেলছে। পুত্ৰকলত্রের বন্ধন, ঐশ্বর্যসম্পদের বন্ধন, নানা বন্ধন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তাই প্রার্থনা করছি,–হে জ্ঞানদেবতা! আপনি যাতুহা বলে সর্ববিদিত। আপনি এসে আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; হৃদয় জ্ঞানের কিরণে পোদ্ভাসিত হোক। অজ্ঞানান্ধকার দূরে যাক; মায়ামোহরূপ সংসার-বন্ধন টুটে যাক; সৎকর্মের প্রভাবে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হোক; সত্ত্বের প্রভাবে সৎ এসে হৃদয়-মন্দিরে আসন গ্রহণ করুন; আমরা সংসার-সমুদ্র তরে যাই; আত্মায় আত্ম-সম্মিলনে সমর্থ হই। এর চেয়ে তুরীয় প্রার্থনা আর কি হতে পারে? ॥ ১।
.
দ্বিতীয় মন্ত্রঃ সীসায়াধ্যাহ বরুণঃ সীসায়াগ্নিরুপাতি। সীসং ম ইন্দ্রঃ প্রাযচ্ছৎ তদঙ্গ যাতচাতনং ॥ ২॥
বঙ্গানুবাদ— স্নেহকারুণ্যরূপী বরুণদেব, (আমাদের মঙ্গলার্থ) স্নেহকারুণ্যাদি সত্ত্বভাব পোষণ : করেন; দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত জ্ঞানরূপী অগ্নিদেব (আমাদের মঙ্গলের জন্য) আমাদের (হৃদয়ে জ্ঞানকিরণরূপ) অভীষ্টফল বর্ষণ করেন; পরমৈশ্বর্যশালী ইন্দ্রদেব শত্রুনাশসামথ্য প্রদান করেন। হে মন! তাঁদের অংশভূত সেই সকল বিভূতি শত্রুনাশে সমর্থ। (অতএব, হে মন! শত্রুনাশের জন্য তাঁদের সেই বিভূতি সমূহ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করো)। ২।
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা –এ মন্ত্রে সরল প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পেয়েছে। ভগবানের বিভিন্ন বিভূতির, স্নেহকারুণ্যরূপী বরুণদেবের এবং জ্ঞানরূপী অগ্নিদেবের স্তুতি করতে করতে, শেষে সেই বিভূতি-সমূহের আধারভূত পরমৈশ্বর্যশালী আদিদেবতার প্রতি লক্ষ্য পড়েছে। ভেদভাব দূরীভূত হয়ে অভেদভাবের সঞ্চার হয়েছে।…ভাষ্যকারের মতে, এ মন্ত্রে প্রয়োগসাধন-দ্রব্যের বিষয় উক্ত হয়েছে। সূত্রপরিভাষার অনুসরণে সীসায় পদের তাই তিনি অর্থ করেছেন, নদীনেরূপায়। রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদির হিংসানিবারণে মন্ত্রে সীস নামক পদার্থের বৈশিষ্ট্য প্রখ্যাপিত হয়েছে। সীসকে জলের ও অগ্নির সম্মুখে স্থাপন করে এই মন্ত্রের প্রয়োগ-বিধি নিবদ্ধ আছে। এইভবে মন্ত্রপূত করে সীস-ধারণের বিধি দূর হয়। ভাষ্যকারের মতে, মন্ত্রের শেষাংশে সাধককে সম্বোধন করে বলা হয়েছে,-হে সাধক! দেবগণের প্রদত্ত, দ্বেষ ইত্যাদি নিরসনে সমর্থ এই সীস রক্ষঃ পিশাচ ইত্যাদির নাশ-সমর্থ। কিন্তু আমরা মন্ত্রটিকে মনঃসম্বোধন মূলক বলে মনে করি। ২।
.
তৃতীয় মন্ত্রঃ ইদং বিষ্কন্ধং সহত ইদং বাধতে অত্ৰিণঃ। অনেন বিশ্বাসসহে যা জানি পিশাচ্যাঃ ॥ ৩॥
বঙ্গানুবাদ –এই (পূর্বোক্ত) সীস (জ্ঞানকর্ম) শত্ৰুকৃত বিঘ্ন (জন্মকারণ) নিবারণ করে, শত্রুসমূহ (অন্তরস্থিত রিপুশত্রু) বিমর্দিত করে (অর্থাৎ, জ্ঞানের সাহায্যে জন্মগতি নিবারিত হয়)। (অতএব) জ্ঞানের দ্বারা (আমি) শকৃত (পিশিত-সঞ্জাত কর্মক্লেদরূপ) নিখিল উপদ্রব (দুঃখকারণ সমূহ) নিবারণ (নিবর্তিত) করব। (ভাব এই যে–অজ্ঞানই সকল অনর্থের মূল। জ্ঞানের প্রভাবে যখন আমরা শত্রুদমনে সমর্থ হবো, তখনই মোক্ষপথ সুগম হয়ে আসবে ৷ ৩৷৷
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— এ মন্ত্রটিও রক্ষপিশাচ ইত্যাদির হিংসা-নিবারণ-মূলক। ভাষ্যকারের মতে, মন্ত্রের অর্থ এই যে,-এই সীস রক্ষপিশাচ ইত্যাদিকৃত বিঘুজাত (গতিপ্রতিবন্ধক) নিবারণ করে। অপিতু এই সীস-দ্বারা রক্ষপিশাচ ইত্যাদি শত্রু নিহত হয়। অর্থাৎ, কেবল যে রক্ষপিশাচ ইত্যাদির কৃত উপদ্রব নিবারিত হয়,তা নয়; পরও বিঘ্ন-উৎপাদনকারী রক্ষপিশাচ ইত্যাদিও বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। অতএব, সেই রক্ষসমূহকৃত পীড়াকর উপদ্রব ইত্যাদি এই সীস-সাহায্যে আমি বিদূরিত করব। সাধারণতঃ মন্ত্রের এই অর্থই প্রচলিত আছে। আমাদের মতে, মন্ত্রের ভাব অন্যরূপ। এখন সাধকের হৃদয় জ্ঞানকিরণে প্রোদ্ভাসিত হয়েছে। তাই তিনি বলছেন,জ্ঞানের সাহায্যে আমি আমার অন্তঃশত্রুজনিত সমস্ত উপদ্রব নিবারণ করবো, আমি আমার জন্মগতি রোধ করবো, জ্ঞানের সাহায্যে ভগবানের সাথে মিলিত হবো। মনে এমনই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই মন্ত্রের অবতারণা।–এ মন্ত্রে কর্মের প্রভাব প্রখ্যাপিত বলে আমরা মনে করি।-মন্ত্রের অন্তর্গত বিষ্কন্ধং পদ আমরা জন্মকারণানি অর্থে গ্রহণ করেছি.আমরা পূর্বেই বলেছি,-কর্মের দ্বারা কর্মবন্ধন ছিন্ন করতে হবে।…মনে হতে পারে,সে এমন কোন্ কর্ম, যার দ্বারা কর্মবন্ধন ছিন্ন হয়? সে কর্ম আর কিছুই নয়; সে কর্ম সৎকর্ম, শোভন-কর্ম। সৎকর্মের অনুষ্ঠানেই হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়। কিন্তু তার মূলীভূত সেই জ্ঞান। …অর্থাৎ, জ্ঞানের উদয়ে কার্য ও কারণ উভয়ই নিরাকৃত হয়। কিন্তু কোন কর্ম বন্ধনজনক, আর কোন কর্মই বা বন্ধনমোচক? এর উত্তর-ফলাকাঙ্গারহিত কর্ম করতে পারলেই সকল বন্ধন টুটে যায়। যা কু বা অসৎকর্ম–সকাম কর্ম, তা-ই বন্ধনের হেতুভূত। আর, অজ্ঞানতাইসকাম-কর্মের জনয়িতা এবং জ্ঞানই নিষ্কাম-কর্মের প্রবর্তয়িতা।-মন্ত্রে তাই সাধক বলছেন,–অন্তরের যে রিপুশত্রুসমূহ জন্মগতির মূলীভূত, যাদের কর্মের প্রভাবে দুঃখকারণ সঞ্জাত হয়, জ্ঞানাগ্নির সাহায্যে-সৎকর্মের প্রভাবে সে শত্রু বিমর্দিত হয়। আমরা জ্ঞান-বলে শত্রু বিনাশ করে জন্মগতি রোধ করবো। ফলে, আমরা পরাগতি-লাভে সমর্থ হবো॥ ৩৷৷
.
চতুর্থ মন্ত্রঃ যদি নো গাং হংসি যদ্যশ্বং যদি পূরুষং। ত্বং ত্বা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসো অবীরহা ॥ ৪৷
বঙ্গানুবাদ— হে রিপুশত্রুগণ! যদি তোমরা কখনও আমাদের (সংযতচিত্ত জনের) শুদ্ধজ্ঞাননিবহকে, ব্যাপ্তরূপ সৎ-ভাবসমূহকে এবং পুরুষসামর্থোপেত সকর্মনিবহকে হিংসা করতে প্রবৃত্ত হও; (তাহলে), যাতে তোমরা আমাদের বীর্যসম্পন্ন জ্ঞানকর্ম সত্ত্বভাবসমূহকে বিনাশ করতে না পারো, সেইভাবে আমাদের হৃদয়নিহিত সুদৃঢ় দেবভাবসমূহের সাহায্যে তোমাদের বিমর্দিত করবো (অর্থাৎ, রিপুশত্রুগণ হৃদয়ে প্রচ্ছন্ন থেকে সময় সময় হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব ও চ জ্ঞানকর্মসমূহকে বিদূরিত করবার অর্থাৎ অজ্ঞানতায় সমাচ্ছন্ন করবার প্রয়াস পায়; সেই জন্য শুদ্ধসত্ত্ব ইত্যাদির দৃঢ়তা-সম্পাদনে তাদের মূলোচ্ছেদ করা কর্তব্য। এই মন্ত্রে সাধকের দৃঢ় সঙ্কল্পে প্রকাশ পেয়েছে)। ৪
মন্ত্ৰার্থ–আলোচনা— এ মন্ত্র সরল ভাবপূর্ণ। সাধক এখানে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ হয়েছেন। পুনঃ পুনঃ অজ্ঞানতায় লাঞ্ছিত হয়ে পুনঃ পুনঃ রিপুশত্রুর উৎপীড়নে উৎপীড়িত হয়ে, তিনি বুঝেছেন, অজ্ঞানতার ও রিপুশত্রুর নাশ ভিন্ন উপায়ন্তর নেই। তাই তিনি বলেছেন,-যা হবার হয়ে গিয়েছে; যে লাঞ্ছনা পাবার পেয়েছি; আর নয়! এখন দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ হলাম। আবার যদি কখনও তারা আমার হৃদয়-ক্ষেত্র আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়, তাহলে জ্ঞানের দ্বারা তাদের মূলোচ্ছেদ করবো।–ভাষ্যকারের অর্থে যে ভাব প্রকাশিত, তা বড়ই সমস্যাপূর্ণ। ভাষ্যকারের মতেও এ মন্ত্র শত্রুগণের সম্বোধন মূলক। রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদি শত্রুগণকে সম্বোধন করে এই মন্ত্রে বলা হয়েছে, যদি তোমরা আমাদের গো-অশ্ব-ভূত্য ইত্যাদিকে নিহত করতে উদ্যত হও; আমরা তোমাদের এই সীসের দ্বারা বিদ্ধ করে সংহার করবো। আমরা এমনইভাবে তোমাদের বিদ্ধ করবো যে, তোমরা আর আমাদের পুত্র-পশু ইত্যাদিকে হিংসা করতে না পারো। মন্ত্রের এই অর্থহ–এই ভাবই সাধারণ্যে প্রচারিত। এই ভাবেই এই মন্ত্রের উচ্চারণে রক্ষঃপিশাচ ইত্যাদিজনিত বিঘ্ন-নিরাকরণের উপদেশ আছে। আমরা দেখেছি, মন্ত্রের মধ্যে কয়েকটি সমস্যামূলক পদ আছে,গাং, অশ্বং ও পুরুষং। ঐ তিন পদেই যত সংশয় আনয়ন করেছে। গাং পদের সায়ণ অর্থ করেছেন গোজাতং। আমরা তার অর্থ করলাম, শুদ্ধজ্ঞাননিবহং। বেদের সর্বত্রই আমরা গাং পদের ঐ অর্থই অধ্যাহার করেছি। ঐ অর্থই যে সমীচীন, তা-ও সেই সেই স্থলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। হৃদয়ের শুদ্ধজ্ঞানই অজ্ঞানতায় সমাচ্ছন্ন হয়; আধ্যাত্মিক পক্ষে গাং শব্দের ঐ অর্থই সঙ্গত।–অশ্বং পদে, ভাষ্যকারের মতে অশ্ব নামধেয় পশু বোঝাচ্ছে। কিন্তু আমরা তার ব্যাপ্তরূপং সত্ত্বভাবং অর্থ আমনন করলাম। ব্যাপ্তাৰ্থক অ ধাতু থেকে অশ্বং পদ নিষ্পন্ন। মন্ত্রের পুরুষং পদের অর্থে সায়ণ বলেছেন,–অম্মদীয়ং ভৃত্যাদিরূপং পুরুষং। আমাদের মতে ঐ পদে পুরুষসামথোপেতং সকর্মনিবহং বোঝাচ্ছে। কর্মেই পৌরুষ সঞ্জাত হয়, কর্মী ব্যক্তিই পৌরুষসামর্থ্যসম্পন্ন। সৎকর্মের প্রভাবেই পৌরুষ অধিগত হয়ে থাকে।–এ পক্ষে মন্ত্রের ভাব এই যে,-কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রু সময় সময় হৃদয়ের সৎ-বৃত্তি সমূহকে বিধ্বস্ত করবার প্রয়াস পায়। হৃদয়ে দেবভাবসঞ্জাত হোক, জ্ঞান-কিরণ বিচ্ছুরিত হোক, সৎকর্মের অনুষ্ঠানে উদ্বুদ্ধ হই। তাহলেই সে সকল শত্রুকে বিমর্দিত করতে সমর্থ হবো।
আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে এই ভাবই পরিব্যক্ত রয়েছে। ৪