০০৭. ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ

ভলিউম ৭ – ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর, ১৯৮৯

০১.

গোধূলি বেলায় উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো অদ্ভুত গোঙানি!

ওই, ফিসফিস করে বললো মুসা আমান। শুরু হলো আবার!

হারভে র‍্যাঞ্চের কাছে একটা উঁচু শৈলশিরার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে তিন গোয়েন্দা। কয়েক শো ফুট দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তটরেখা।

আবার শোনা গেল গোঙানি। যেন কোনো দানবের দীর্ঘশ্বাস, লম্বিত, কাঁপা, ভয়াল।

ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল মুসার শিরদাঁড়া বেয়ে। কাজে আসে না বলে দোষ দেয়া যায় না র‍্যাঞ্চের শ্রমিকদের।

হয়তো লাইটহাউস থেকে আসছে, নিচু কণ্ঠে বললো রবিন। আসার পথে যেটা দেখে এলাম। ফগহর্ন।

মাথা নাড়লো কিশোর। আমার তা মনে হয় না। ফগহর্নের শব্দ ওরকম নয়। তাছাড়া এখন কুয়াশা নেই, ফগহর্ন বাজাবে কেন?

তাহলে কি…, বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।

কিশোর তার জায়গায় নেই। উঠে শৈলশিরার ডান পাশ ধরে ছুটতে শুরু করেছে। তাকে অনুসরণ করলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। পর্বতের ওধারে হারিয়ে গেছে সূর্য, আবছা বেগুনী আলো এখন উপত্যকায়।

পঞ্চাশ গজমতো এসে থেমে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। আবার সেই গোঙানি। কানের পেছনে হাত রেখে ভালো করে শুনলো শব্দটা।

চোখ বড় বড় করে মুসা বললো, কিশোর, কি করবো?

জবাব দিলো না কিশোর। হঠাৎ ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো, উল্টোদিকে একশো গজ দূরে এসে থামলো।

এই কাজই করবো নাকি খালি আমরা। পাশে এসে বললো রবিন। পাহাড়ের ওপরে খালি হাঁটাচলা? গোয়েন্দাপ্রধানের কাণ্ড দেখে মুসার মতোই সেও অবাক হয়েছে।

এবারও জবাব দিলো না কিশোর। কান পেতে শুনলো গোঙানির আওয়াজ। শব্দটা থেমে যাওয়ার পর ঘুরলো রবিনের দিকে। বললো, না, নথি, পরীক্ষাটা শেষ করলাম।

কিসের পরীক্ষা? জিজ্ঞেস করলো মুসা। হাঁটলাম আর দৌড়ালাম তো শুধু, আর কি করলাম?

 বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শব্দটা শুনলাম, ব্যাখ্যা করলো কিশোর। মনে মনে জ্যামিতি..মানে, কতগুলো কল্পিত রেখা এঁকেছি। শব্দটা কোত্থেকে আসে তার একটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেছি। রেখা এঁকেছি মোট তিনটে। যেখানে সবগুলো এক জায়গায় ক্রস করেছে, শব্দটা সেখান থেকেই আসে।

বুঝে ফেললো রবিন। ঠিক বলেছে ও, মুসা। একে বলে ট্রাইঅ্যাঙ্গুলেশন। এঞ্জিনিয়াররা হরদম এই পদ্ধতি কাজে লাগায়।

বুঝেছো তাহলে, বললো কিশোর। নিখুঁত ভাবে করতে পারিনি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।

কিসের উদ্দেশ্য? কিশোরের সহজ ইংরেজিও এখন হীব্রু ভাষা বলে মনে হচ্ছে মুসার কাছে। কি বের করতে চাইছো?

শব্দটা কোথা থেকে আসে। পর্বতের ওই গুহা থেকে। হেনরি ফিগারোর গুহা।

এটা তো জানিই আমরা, নিরাশ মনে হলো মুসাকে। মিস্টার হারভেই বলেছেন।

মাথা নাড়লো আবার কিশোর। তাতে কি হয়েছে? ভালো গোয়েন্দা কক্ষণো অন্যের কথায় নির্ভর করে না। নিজে তদন্ত করে যাচাই করে দেখে। অন্যের চোখে দেখা আর নিজের চোখে দেখার মাঝে অনেক ফারাক। গাল চুলকে নিলো। শিওর হলাম, শব্দটা হেনরি ফিগারোর গুহা থেকেই আসে। এখন জানতে হবে গোঙানিটা কিসের, আর…

তাকে থামিয়ে দিলো সেই বিচিত্র আওয়াজ। ঘন ছায়া নামছে উপত্যকায়। গুঁড়ি মেরে যেন এগিয়ে আসছে অন্ধকারের দানব। শব্দটা শুনে এইবার গোয়েন্দা প্রধানও কেঁপে উঠলো।

ঢোক গিললো মুসা। খাইছে, কিশোর! মিস্টার হারভে আর শেরিফ গুহাটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। কিছু পাননি।

হয়তো কোনো ধরনের জানোয়ার, রবিন বললো।

জানোয়ারের মতো কি লাগছে? প্রশ্ন করলো কিশোর। আর, মি হারভে বা শেরিফ কোনো অস্বাভাবিক জন্তুর পায়ের ছাপও পাননি। ভালো করেহ জানো, ওঁরা দুজনেই অভিজ্ঞ শিকারী, দক্ষ ট্র্যাকার।

অস্বাভাবিক জন্তু? অস্বস্তি বোধ করছে মুসা।

এমন কোনো জন্তু, যার নাম শুনেনি মানুষ। মুসার দিকে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান, চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কে জানে, হেনরি ফিগারোও এসবের কারণ হতে পারে!

আঁতকে উঠলো মুসা। আল্লাহরে! বলো কি, কিশোর? ভূত-টুত তো বিশ্বাস করি না আমরা, করি?

তুমি করো, হাসলো কিশোর। কিন্তু ভূতের কথা বলছি না আমি।

তাই তো বললে। হেনরি ফিগারো মারা গেছে একশো বছর আগে, প্রতিবাদ করলো রবিন। তার ভূত না হলে আর কি?

জবাব দেয়ার সুযোগই পেলো না কিশোর। ঠিক ওই সময় উপত্যকা ছাড়িয়ে ওপাশের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লাল আলোয়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠলো যেন সমস্ত এলাকা।

কী, কিশোর? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

 মাথা নাড়লো কিশোর। জানি না।

বিস্ফোরণের আওয়াজ পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। একে অন্যের দিকে তাকালো তিন কিশোর।

নার্ভাস ভঙ্গিতে আঙুল মটকালো. রবিন। বোধহয় নেভি! ওই যে যাদের নৌবহর দেখলাম। নিশ্চয় চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এ প্র্যাকটিস করছে।

নিষ্প্রাণ হাসি হাসলো মুসা। ঠিকই বলেছো। বছরে দুবার এখানে এসে প্র্যাকটিস করে ওরা। খবরের কাগজে পড়েছি। নির্জন দ্বীপগুলোয় আস্তানা গেড়ে গোলাগুলির মহড়া চালায়।

হা, কিশোর বললো। কালকের পেপারেও ছিলো। নাইট ফায়ারিং, প্র্যাকটিস। চলো, র‍্যাঞ্চে। এই উপত্যকার কথা আরও জানতে হবে।

দ্বিতীয়বার বলতে হলো না রবিন আর মুসাকে। পেছনে, পাহাড়ের নিচে রেখে এসেছে সাইকেল, সেদিকে রওনা হলো।

হঠাৎ, উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে শোনা গেল.পাথর পড়ার ভারি শব্দ, সেই সাথে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

.

০২.

শব্দটা মিলিয়ে গেল গোঙানি উপত্যকার-মোনিং ভ্যালির বাংলা নাম রেখেছে কিশোর– ওপর দিয়ে।

ওটা তো গুহা থেকে আসেনি! বলে উঠলো মুসা।

না। একমত হলো কিশোর। মানুষের চিৎকার!

 বিপদে পড়েছে, যোগ করলো রবিন। চলো তো দেখি।

তটরেখা আর পর্বতের মাঝের উপত্যকা থেকে এসেছে শব্দটা। পর্বতের নাম ডেভিল মাউনটেইন, কারণ, দুদিকের দুটো চূড়া দূর থেকে দেখায় কল্পিত শয়তানের শিঙের মতো।

দৌড় দিলো তিন গোয়েন্দা। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে অনেকগুলো পাথর। জমা হয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়, ধুলো উড়ছে এখনও।

আআহ! যন্ত্রণায় কাতরালো কেউ।

সবার আগে লোকটার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মুসা। ধূসর চুল মানুষটার, কোমরের নিচের অংশ পাথরের তলায়। ব্যথায় মুখ বিকৃত। চুপ করে। শুয়ে থাকুন, বলে কিশোরের দিকে ফিরলো মুসা। মনে হচ্ছে পা-টা ভেঙেছে।

লোকটার পরনে পুরনো কাউবয় পোশাক। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে। কোনোমতে বললো, আ-আমি হারভে র‍্যাঞ্চে কাজ করি। মিস্টার হারভেকে গিয়ে বলো, কাউকে এখানে পাঠিয়ে দিতে। প্লীজ!

হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালো তিন গোয়েন্দা। আরেকটা দুর্ঘটনা! আহত হলো মিস্টার হারভের আরেকজন শ্রমিক!

.

হারভে দম্পতির সঙ্গে দুই হপ্তার ছুটি কাটাতে র‍্যাঞ্চে এসেছিলো মুসা। র‍্যাঞ্চটার নতুন মালিক মিস্টার হারভে। বিখ্যাত একজন রোডিয়ো-রাইডার, মুসার বাবা। মিস্টার রাফাত আমানের সঙ্গে অনেকগুলো ওয়েস্টার্ন ছবিতে কাজ করেছেন। জন্তুজানোয়ার, বিশেষ করে ঘোড়ার খেলা দেখাতেন। সেই কাজ ছেড়ে জমানো টাকা দিয়ে কিছুদিন আগে এই র‍্যাঞ্চ কিনে শেষ জীবনটা কাটাতে এসেছেন এখানে। নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো র‍্যাঞ্চটার মেরামত সবে শেষ করে এনেছেন, এই সময় শুরু হলো গণ্ডগোল।

মোনিং ভ্যালির নামকরণ হয়েছে প্রাচীন ইণ্ডিয়ানদের একটা রোমাঞ্চকর লোককাহিনী আর পুরনো স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকদের নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। গুজব রটতে শুরু করেছে এখনঃ পঞ্চাশ বছর নীরব থাকার পর আবার জেগে উঠেছে মোনিং ভ্যালি, গোঙাতে আরম্ভ করেছে। র‍্যাঞ্চ শ্রমিকদের তাড়ানোর  জন্যে যেন গোঙানিই যথেষ্ট নয়, তাই ঘটতে শুরু করেছে দুর্ঘটনা।

প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটে কিছু দিন আগে। দুজন শ্রমিক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলো মোনিং ভ্যালির কাছ দিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ এক অদ্ভুত গোঙানি শুনে চমকে উঠলো তাদের ঘোড়া, ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে দিলো দৌড়। এর জন্যে তৈরি ছিলো না লোক দুজন। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। একজনের হাত ভাঙলো, আরেকজনের হাড়গোড় ঠিক থাকলেও শরীরের নানা জায়গা ছিলেছুলে গেল। দুজনেই র‍্যাঞ্চে ফিরে এলো। জানালো, ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। উপত্যকায়। তার কয়েকদিন পরে, কোনো কারণ ছাড়াই রাত দুপুরে উন্মাদ হয়ে গেল যেন র‍্যাঞ্চের গরুর পাল। নানারকম অঘটন ঘটিয়ে ছাড়লো। তারপর এক সন্ধ্যায় উপত্যকার ওদিকে বেড়াতে গিয়ে নাকি বিরাট এক দানব দেখে এলো আরেক শ্রমিক। কসম খেয়ে বললো, ডেভিল মাউনটেইনের গোড়ায় হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে বেরিয়েছে দানবটা। তার দিন কয়েক পরে, কাউকে কিছু না। জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল দুজন শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে এসে শেরিফ জানালেন, তাদেরকে সানতা কারলায় দেখা গেছে, কিন্তু অনেক শ্রমিকই বিশ্বাস করলো না। তার কথা।

দিন কয়েক র‍্যাঞ্চে থেকেই মুসা বুঝে গেল, ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। হারভে দম্পতি। ফিগারোর গুহায় অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, রহস্যময় কিছুই পাওয়া যায়নি, রহস্যেরও সমাধান হয়নি। ইণ্ডিয়ান লোককাহিনী আর ভূতের পেছনে তাড়া করার উপায় নেই, কাজেই কোনো সাহায্য করতে পারলেন না। শেরিফ। তিনি, এবং হারভে দুজনেই বিশ্বাস করেন, ভূত-ফুত সব বাজে কথা, নিশ্চয় কোনো সহজ ব্যাখ্যা আছে এসবের। কিন্তু বুঝতে পারছেন না, সেটা কী।

কিশোরকে ছাড়া হবে না, বুঝে, হারভে দম্পতির অনুমতি নিয়ে তাকে আর রবিনকে আসার জন্যে খবর পাঠালো মুসা। বাড়িতে জরুরি কাজ ফেলে ছুটে এসেছে দুজনে। এরকম একটা রহস্যের কথা শোনার পর কি আর স্বস্তিতে কাজ করা যায়? অন্তত কিশোর পাশার পক্ষে সম্ভব নয়। আর মুসা নেই, কিশোর থাকবে না, একলা কি আর মন টেকে রবিনের? গোল্লায় যাক জরুরি কাজ, বলে সোজা। রওনা হয়ে পড়লো দুজনে।

ক্যালিফোরনিয়া উপকূলে রকি বীচ থেকে একশো মাইল উত্তরে, আর। আধুনিক হলিডে রিসোর্ট সানতা কারলার মাইল দশেক দূরে এই হারভে র‍্যাঞ্চ। পার্বত্য অঞ্চল। বড় বড় পাহাড়-পর্বত, গুহা, গভীর গিরিখাত, অসংখ্য উপত্যকা আর একধারে প্রশান্ত মহাসাগর এখানে। মুসা এসেছিলো চুটিয়ে ঘোড়ায় চড়তে, সাঁতার কাটতে আর মাছ ধরতে কোনোটাই করা হলো না। জড়িয়ে পড়লো। জটিল রহস্যে, দুই দোস্তকেও ডেকে আনলো।

ভূতের আসর হয়েছে এই উপত্যকায়, বিড়বিড় করলো আহত লোকটা। আসাই উচিত হয়নি…ওই গোঙানি, গোঙানিই যতো নষ্টের মূল!

না, দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নেভির ফায়ারিঙের শব্দে কেঁপে উঠে ওই পাথরের ধস নেমেছে।

আমি বলছি সেই গোঙানি!

ওসব কথা পরে হবে, বললো মুসা। কিশোর, আগে…

তার কথা শেষ হলো না। কাছেই ডেকে উঠলো ঘোড়া। ফিরে চেয়ে দেখলো ছেলেরা, তিনজন ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে। তাদের একজন রাশ ধরে টেনে আনছে চতুর্থ আরেকটা ঘোড়াকে-পিঠে আরোহী নেই; যে লোকটা পড়ে ব্যথা পেয়েছে বোধহয় তারই ঘোড়া। দলের আগে আগে রয়েছেন মিস্টার হারভে।

তোমরা এখানে? কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। লম্বা, ইস্পাতকঠিন দেহ, গায়ে উজ্জ্বল লাল শার্ট, পরনে রঙচটা নীল জিনসের প্যান্ট, পায়ে হাই-হীল কাউবয় বুট। রোদেপোড়া তামাটে চামড়া। চেহারায় উৎকণ্ঠার ছাপ।

আহত লোকটাকে কিভাবে পেয়েছে জানালো ছেলেরা।

বেশি ব্যথা পেয়েছো, পোরটিকো? লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন মিস্টার হারভে।

হাড্ডি ভেঙে গেছে! বললো পোরটিকো। সব ওই ভূতের কারবার.. গুহার ভূত! আমি আর এখানে থাকছি না!

আমার ধারণা, কিশোর বললো। ফায়ারিঙের শব্দে ধস নেমেছে।

সেটা সম্ভব, মাথা দোলালেন মিস্টার হারভে।

আহত লোকটার গায়ের ওপর থেকে পাথর সরিয়ে ফেলা হলো। দুজন লোক গিয়ে র‍্যাঞ্চের ট্রাক নিয়ে এলো। সাবধানে তাতে তোলা হলো পোরটিকোকে। তারপর রওনা হলো সানতা কারলায়, হাসপাতালে।

তিন গোয়েন্দা ফিরে চললো তাদের সাইকেলের কাছে।

 র‍্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে পুরোপুরি আঁধার হয়ে গেল। মোট পাঁচটা বাড়িঃ শ্রমিকদের থাকার জন্যে একটা বাংকহাউস, একটা বড় গোলাঘর, একটা ছোট গোলাঘর, একটা রান্নাঘর, আরেকটা মূল বাড়ি। ওই বাড়িটা দোতলা। কাঠের বড় বড় বীম রয়েছে, অ্যাডোব আছে, আর বাড়ি ঘিরে রয়েছে চওড়া, ছাউনিওয়ালা বারান্দা। দিনের বেলায়ও সেখানে ছায়া থাকে, ঠাণ্ডা থাকে। জানালার যেখানেই সুযোগ পেয়েছে লতিয়ে উঠেছে আঙুর লতা। বাড়ির চারপাশে রক্তলাল বোগানভিলিয়ার ছড়াছড়ি। পাঁচটা বাড়ির চারপাশে তৈরি হয়েছে বেড়া দেয়া কয়েকটা কোরাল।

রান্নাঘরের কাছে লোকের হোট ঘোট জটলা। দুর্ঘটনার কথা আলোচনা, করছে। নিচু কণ্ঠ, চেহারায়.ভয় আর রাগের মিলিত ছাপ।

মূল বাড়িতে ঢুকতে যাবে, অন্ধকার থেকে শোনা গেল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ।

কোথায় ছিলে তোমরা? জানতে চাইছে র‍্যাঞ্চের ফোরম্যান ডেভিড কোহেন।

বারান্দায় মৃদু নড়াচড়া। আলোয় বেরিয়ে এলো কোহেন। দেহের তুলনায়। মুখটা ছোট, খাড়া নাক, রোদে পোড়া চামড়া। গেছিলে কোথায়? আবার জিজ্ঞেস করলো সে। জায়গা ভালো না। হারিয়ে যেতে যদি?

পাহাড়-পর্বত অনেক দেখা আছে আমাদের, মিস্টার কোহেন, জবাব দিলো কিশোর। ভাববেন না।

আরেক কদম এগোলো ফোরম্যান। তোমরা কি করতে গিয়েছে, শুনলাম। গোঙায় কিসে, জানতে। দেখো, জায়গাটা ভালো না। বাচ্চাদের জন্যে আরও খারাপ। ওই গুহার ধারেকাছে যাবে না।

ছেলেরা কিছু বলার আগেই বাড়ির একটা দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ছোটখাটো একজন মহিলা। ধূসর চুল। রোদে পুড়ে তামাটে হয়েছে এককালের লালচে চামড়া। গালের গোলাপি আভাও আর নেই এখন, হাত-পায়ের মতোই। তামাটে। কি আজেবাজে বকছো, ডেভিড? ধমক দিয়ে বললেন মিসেস হারভে। ওরা বাচ্চা নয়। আমার বিশ্বাস, অনেকের চেয়ে বুদ্ধিশুদ্ধিও বেশিই রাখে।

মোনিং ভ্যালি ভালো জায়গা নয়, মিনমিন করে বললো কোহেন।

তুমিই তো বাচ্চা ছেলের মতো কথা বলছো। ভূতের ভয়ে কাবু। গুহাটাকে ভয় পাও!

ভয় পাই না আমি! আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো কোহেন। তবে সত্যকে কিছু না বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সারা জীবন এখানে কাটালাম, জানেনই। সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি মোনিং ভ্যালির গল্প। তখন বিশ্বাস করতাম না, এখন করি।

যত্তোসব ফালতু কথা! কুসংস্কার! বললেন বটে মিসেস; কিন্তু গলায় জোর। নেই। বোঝা যাচ্ছে, তিনিও শিওর নন। কণ্ঠের উৎকণ্ঠা ঢাকতে পারলেন না।

কিশোর জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার কোহেন, গোঙানির কারণটা বলতে পারবেন?

দ্বিধা করলো ফোরম্যান। না। কেউ জানে না। আমিও অনেক খুঁজেছি, কিছু পাইনি। মানে. দেখিনি! শেষ শব্দটার ওপর বিশেষ জোর দিলো সে। আবছা অন্ধকারে চকচক করে উঠলো তার চোখ। ইণ্ডিয়ানরা বলে কেউ নাকি দেখতে পায় না। ভূ…, শুধরে নিয়ে বললো। বুড়ো মানুষটাকে!

.

০৩.

ডেভিড! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে।

পরোয়া করলো না. কোহেন। আমি ওই গল্প বিশ্বাস করি না। কিন্তু আজব ঘটনা তো ঘটছে গুহায়। অস্বীকার করতে পারেন? আবার গোঙাতে শুরু করেছে। গুহাটা, কেউ জানে না, কেন। কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না। বুড়ো মানুষটা না হলে আর কে?

বলে আর দাঁড়ালো না ফোরম্যান। বারান্দা থেকে নেমে সোজা বাংকহাউসের দিকে হাঁটা দিলো।

সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস হারভে। সবার মনেই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে! ডেভিডের মতো সাহসী লোক আমি কমই দেখেছি, তারই যখন এই অবস্থা…ওরকম করে কখনও কথা বলেনি।

আমাদেরকে বুড়ো মানুষটার কথা শোনালো কেন? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। কিশোর।

জোর করে উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে হাসলেন মিসেস হারভে। বোধহয় ও টায়ারড। সারাদিন এতো বেশি পরিশ্রম করতে হয়.. তো, তোমাদের খিদে পায়নি? দুধ আর বিস্কুট চলবে?

নিশ্চয়ই, তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মুসা।

আরামদায়ক লিভিংরুমে বসে খাচ্ছে ছেলেরা। সুদৃশ্য ইনডিয়ান কার্পেটে ঢাকা মেঝে, পুরনো আমলের আসবাবপত্র। মস্ত এক ফায়ারপ্লেস এক দিকের দেয়ালের প্রায় সবটা জুড়ে রয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শিকার করা হরিণ, ভালুক আর পার্বত্য সিংহের মাথা।

ওই বুড়ো মানুষটা কে? মিসেস হারভেকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। আরেকটা বিস্কুট তুলে নিলো।

ও কিছু না। ইনডিয়ানদের উপকথা। অনেক আগে স্প্যানিশরা যখন এলো, তখনকার ইনডিয়ানদের মাঝে একটা গল্প চালু ছিলো। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে একটা খাড়িতে নাকি কালো, চকচকে, একটা দানব থাকে।

চোখ মিটমিট করলো মুসা। কোহেন যে বললো: কেউ দেখেনি? দেখেই যদি থাকবে, জানলো কি করে কালো আর চকচকে! আর দানবকে মানুষই বা বলা কেন?

তাহলেই বোঝো, হাসলেন মিসেস হারভে। কোনো যুক্তি নেই। গল্প গল্পই।

দানবকে মানুষ বলে বোধহয় শ্রদ্ধা করে, কিশোর বললো। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘকে স্থানীয় লোকেরা সম্মান করে বলে বড় মিয়া। ভয়ে। তাদের বিশ্বাস, ওরকম করে ডাকলে বাঘ তাদের কিছু বলবে না! ওসব কুসংস্কার। যারা বলে তাদের কেউ কি বাঘের পেটে যায় না?

আগের কথার খেই ধরে রবিন জিজ্ঞেস করলো, স্প্যানিয়ার্ডরা কি বলতো?

অনেক আগের কথা তো, বললেন মিসেস হারভে। তখনকার। স্প্যানিয়ার্ডরাও ওই ইনডিয়ানদের চেয়ে কিছু কম ছিলো না, কুসংস্কার ছিলো ওদের মাঝেও। মুখে বলতো বিশ্বাস করে না, কিন্তু উপত্যকার ধারেকাছেও যেতো না। হেনরি ফিগারো অবশ্য ওসব পরোয়া করতো না। সে গুহার ভেতরেও ঢুকতো।

হেনরি ফিগারোর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন? অনুরোধ করলো কিশোর।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন মিস্টার হারভে। সঙ্গে বেঁটে, রোগাটে একজন লোক। চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা। ছেলেরা আগেই পরিচিত হয়েছে তার সঙ্গে। প্রফেসর হারকসন। তিনিও এই র‍্যাঞ্চে মেহমান।

এই যে, ছেলেরা, বললেন প্রফেসর। শুনলাম রহস্যময় মোনিং ভ্যালিতে গিয়েছিলে।

রহস্য না কচু! মুখ বাঁকালেন মিস্টার হারভে। অতি সাধারণ ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দেখছে সবাই। কোনো র‍্যাঞ্চে কি দুর্ঘটনা ঘটে না, ওরকম হাত-পা ভাঙে না?

কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো, প্রফেসর বললেন। আসলে, অশিক্ষিত তো ওরা। ভাবছে, না জানি কি! ভয় পেয়ে গেছে।

কারণটা জানলেই ওদের এই ভয় ভেঙে যেতো। আজকের ঘটনায় আরও লোক হারাবো, চলে যাবে। কোনো কিছুর লোভ দেখিয়েই ধরে রাখতে পারবো না। ছেলেগুলোও বুঝতে পারছে, ভূতের কাণ্ড নয়। নেভির গানফায়ারিঙের জন্যেই ধস নেমেছে। অথচ বোকা:গাধাগুলোকে বোঝানো যাচ্ছে না। আমি শিওর, সহজ কোনো ব্যাখ্যা আছে ওই গোঙানির।

সেটা কি? প্রশ্ন করলেন মিসেস হারভে।

নাক টানলেন মিস্টার হারভে। পুরনো সুড়ঙ্গগুলোর ভেতর দিয়ে জোরে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় ওরকম শব্দ হয়।

হাতের বিস্কুটটা খেয়ে শেষ করলো কিশোর। আপনি আর শেরিফ নাকি ঢুকেছিলেন গুহায়? ভালোমতো দেখেছিলেন?

এমাথা-ওমাথা কিছুই বাকি রাখিনি। ভূমিকম্পে ধস নেমে কিছু কিছু সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু যেগুলোতে ঢোকা যায়, সব কটাতে ঢুকেছি।

নতুন কোনো অদল-বদল চোখে পড়েছে?

অদল-বদল? ভ্রূকুটি করলেন মিস্টার হারভে। না তো। কি বোঝাতে চাইছো?

গোঙানি শুরু হয়েছে মাত্র এক মাস আগে থেকে। পঞ্চাশ বছর পর। বাতাসের কারণেই যদি হয়ে থাকবে, এতোদিন বন্ধ থাকলো কেন? হতে পারে, সুড়ঙ্গের ভেতরে কিছু একটা বদলে দেয়া হয়েছে, যার ফলে আবার শুরু হয়েছে শব্দ।

ভালো বলেছো তো! নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠেলে পেছনে সরালেন প্রফেসর। চমৎকার যুক্তি! রক, বুদ্ধি আছে ছেলেগুলোর। মনে হচ্ছে এ রহস্যের সমাধান করেই ফেলবে।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন, আওয়াজটা সন্ধ্যায় হয় কিংবা রাতে হয়, দিনের বেলা হয় না। কেন? তারমানে শুধু বাতাস নয়, আরও কোনো ব্যাপার আছে। আরেকটা ব্যাপার, গত এক মাসে রাতে যতো দিন ঝড়ো বাতাস বয়েছে, রোজই কি ওই শব্দ শোনা গেছে?

না, যায়নি, আগ্রহী হয়ে উঠছেন মিস্টার হারভে। ঠিকই বলেছো। শুধু বাতাসের কারণে হলে, বাতাস বইলেই ওই শব্দ হতো। তা যখন হয় না, আরও কোনো কারণ নিশ্চয় আছে।

হেসে বললেন প্রফেসর, কি জানি, হয়তো হেনরি ফিগারোই এর জন্যে দায়ী। রাতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয়।

ঢোক গিললো মুসা। আপনিও বলছেন, স্যার? কিশোরও একথা বলেছে।

ভূত বিশ্বাস করো নাকি তুমি, ইয়াং ম্যান? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।

না, মাথা নাড়লো কিশোর।

আমিও না, বললেন প্রফেসর। অনেকের ধারণা, বিশেষ করে এখানকার স্প্যানিশদের, দরকারের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে হেনরি ফিগারো। অনেক রিসার্চ করেছি আমি। জোর গলায় বলতে পারবো না যে সে বেরোবে।

রিসার্চ?

উনি ইতিহাসের প্রফেসর, বুঝিয়ে বললেন মিসেস হারভে। সানতা কারলায় বছরখানেক যাবত আছেন, ক্যালিফৈার্নিয়ার ইতিহাস নিয়ে স্পেশাল রিসার্চ করছেন। স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, ওর ধারণা, মোনিং ভ্যালির রহস্য ভেদ করতে পারবেন প্রফেসর।

যদিও এখনও কিছুই করতে পারিনি, স্বীকার করলেন প্রফেসর। হেনরি। ফিগারোর কথা শুনতে চাও? ওর চমকপ্রদ জীবন নিয়ে একটা বই লিখছি আমি।

শোনালে তো খুবই ভালো হয়, স্যার! সামনে ঝুঁকে বসলো রবিন।

আমিও শুনতে চাই, কিশোর বললো।

চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। শোনালেন হেনরি ফিগারোর বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চকর কাহিনীঃ

ক্যালিফোর্নিয়ার শুরুতে আজকের এই হারভে র‍্যাঞ্চছিলো র‍্যাঞ্চো ফিগারোর একটা অংশ। স্প্যানিশ সেটলাররা তখন সবে আসতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে। সবার আগে এসেছিলো ফিগারো পরিবার, স্পেনের রাজার কাছ থেকে জমির দখল সত্ত্ব নিয়ে। বিশাল এলাকা জুড়ে বসেছিলো তারা। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলে তখন ইংরেজদের ভিড়, দলে দলে এসে উপনিবেশ গড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় স্প্যানিশরা তেমন করে দল বেঁধে আসেনি; আসতো একজন, দুজন করে। ফলে কয়েক পুরুষ ধরে র‍্যাঞ্চো ফিগারোর সীমানার কোনো রদবদল হলো না।

তারপর হঠাৎ করেই পুব থেকে সেটলাররা দলে দলে আসতে শুরু করলো ক্যালিফোর্নিয়ায়। আস্তে আস্তে হাতছাড়া হতে লাগলো ফিগারোদের জমি, জবর দখল হয়ে যেতে লাগলো। মেকসিকো যুদ্ধের পর ক্যালিফোর্নিয়া যোগ হয়ে গেল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। তখন আরও বেশি আমেরিকান সেটলার চলে এলো এই এলাকায়, বিশেষ করে ১৮৪৯ সালের ঐতিহাসিক গোল্ড রাশ-এর পর। ১৯০০ সাল নাগাদ ফিগারোদের প্রায় সমস্ত জমিই হাতছাড়া হয়ে গেল, শুধু ছোট একটা অংশ বাদে, তার মধ্যে পড়লো হারভে র‍্যাঞ্চ আর ওই অভিশপ্ত মোনিং ভ্যালি।

ফিগারোদের শেষ বংশধরের নাম হেনরি ফিগারো। দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসী, বেপরোয়া এক তরুণ, আমেরিকানদের দুচোখে দেখতে পারতো না। তাদেরকে চোর-ডাকাত মনে করতো। ফিগারোদের টাকার গরমও আর নেই তখন, ক্ষমতাও শেষ। প্রতিশোধের আগুন সব সময় দাউদাউ করে জ্বলতো তরুণ, হেনরির মনে। ভাবতো, যে করেই হোক আবার তার পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি নিজের দখলে। আনবে। বেশ কিছু পুরনো স্প্যানিশ আর মেকসিকান পরিবার তখনও ছিলো ক্যালিফোর্নিয়ায়, তাদেরকে দলে টানার চেষ্টা করলো সে.। আমেরিকানদের বিরোধিতা করে হয়ে গেল আউট-ল, পর্বতের গভীরে ঘাঁটি করলো। স্প্যানিশদের কাছে হয়ে গেল এক নতুন রবিন হুড, আর আমেরিকানদের কাছে ডাকাত।

তাকে ধরার জন্যে অনেক চেষ্টা করলো আমেরিকানরা, পারলো না। এই অঞ্চলের পাহাড়-পর্বত সব চেনা হেনরির, কোথায় কখন লুকিয়ে থাকে বুঝতেই পারলো না কেউ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগঃ করের টাকা চুরি, ট্যাক্স কালেকটরদের ভয় দেখিয়ে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়া, আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন অফিসে চড়াও হয়ে তাদের টাকা লুটপাট, স্প্যানিশ-ভাষী ক্যালিফোর্নিয়ানদের সাহায্য করা আর আমেরিকানদের আতঙ্কিত করে রাখা।

তবে, বছর দুই পরে ১৯০৮ সালে সানতা কারলার শেরিফের হাতে ধরা পড়ে গেল সে। বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে আদালতে। বিচারে ফাসীর আদেশ হলো। তার। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। যা-ই হোক, ফাঁসীর দুই দিন আগে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল হেনরি। আদালতের ছাতে উঠে, লাফিয়ে পাশের আরেকটা ছাতে গিয়ে পড়লো। সেখান থেকে লাফ দিয়ে নামলো তার বিখ্যাত কালো ঘোড়ার। পিঠে-ঘোড়াটাকে তার জন্যেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো সেখানে।

পালানোর সময় গুলিতে আহত হলো হেনরি। পেছনে তাড়া করে এলো শেরিফ আর তার দলবল। সোজা পর্বতের দিকে ছুটলো হেনরি, মোনিং ভ্যালিতে গিয়ে ঢুকে পড়লো একটা গুহায়। শেরিফের জানামতে যতোগুলো সুড়ঙ্গমুখ ছিলো, ওই গুহা থেকে বেরোনোর, সব বন্ধ করে দেয়া হলো। ভেতরে ঢুকলো না কেউ, কিংবা ঢোকার সাহস করলো না। বাইরে পাহারায় রইলো। শেরিফ মনে করলো, হেনরি আহত, ক্ষতের যন্ত্রণা তো আছেই, তার ওপর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাহিল হয়ে এক সময় না এক সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

দিনের পর দিন বসে রইলো ওরা, হেনরি বেরোলো না। সারাক্ষণ গুহার ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত গোঙানি কানে এসেছে ওদের। অবশেষে তার লোকদের গুহায় ঢোকার আদেশ দিলো শেরিফ। নিজেও ঢুকলো। গুহা আর যতোগুলো সুড়ঙ্গ চোখে পড়লো সবগুলোতে খুঁজলো, চার দিন ধরে, হেনরিকে পেলো না। বেরিয়ে এসে আশপাশের এলাকায় তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। না জীবন্ত হেনরি, না তার লাশ, না তার কাপড়-চোপড়। ঘোড়া, পিস্তল, টাকা, কিচ্ছু পেলো না।

এরপর আর কেউ দেখেনি হেনরিকে। কেউ কেউ বলে, তাকে পালাতে সাহায্য করেছিলো তার প্রেমিকা নোরিটা। গোপন সুড়ঙ্গ পথে গুহায় ঢুকে বের করে নিয়ে এসেছিলো আহত মানুষটাকে। দুজনেই পালিয়ে চলে গেছে দক্ষিণ আমেরিকায়। আবার কেউ বলে, তার স্প্যানিশ-ভাষী বন্ধুরা তাকে বের করে এনে। বছরের পর বছর ধরে তাদের র‍্যাঞ্চে লুকিয়ে রেখেছিলো, আজি এখানে কাল ওখানে করে করে।

তবে বেশির ভাগেরই ধারণা, গুহা থেকে বেরোয়নি হেনরি। এমন জায়গায় লুকিয়েছিলো, আমেরিকানরা খুঁজেই পায়নি। তারপর থেকে অনেক বছর পর্যন্ত, ওই এলাকায় কোনো চুরি-ডাকাতি বা খুনখারাপ হলে আর আসামী ধরা না পড়লে সব দোষ চাপিয়ে দেয়া হতো হেনরির ঘাড়ে। অন্ধকার রাতে নাকি তার কালো ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরোয় সে। যে গুহাটায় থাকতো, সব সময় সেটার ভেতর থেকে শোনা যেতো বিচিত্র গোঙানির আওয়াজ।

তারপর, উপসংহার টানলেন প্রফেসর। হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল, গোঙানি। স্প্যানিশ-ভাষীরা বলে, এখনও নাকি ওই গুহার ভেতরেই রয়েছে হেনরি ফিগারো। তাদের বিশেষ প্রয়োজনের সময় নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। এখনও আছে!

কি করে থাকে? রবিনের জিজ্ঞাসা।

দেখো, বললেন প্রফেসর। অনেক রিসার্চ করেছি আমি, অনেক খোঁজখবর করেছি হেনরি ফিগারোর। অনেক কিছু জেনেছি। তার মধ্যে ভুল তথ্যও অনেক আছে। এই যেমন ধরো, ওর যতো পুরনো ছবি আছে, সবগুলোতে দেখা যায়। পিস্তলের খাপ কোমরের ডান দিকে ঝোলানো, অথচ আমি শিওর সে বাইয়া।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। কিংবদন্তীতে অনেক সময়ই ভুল। তথ্য থাকে। বিশেষ করে এধরনের বিখ্যাত মানুষদের সম্পর্কে।

ঠিক বলেছো, তর্জনী নাচালেন প্রফেসর। অফিশিয়াল রেকর্ড বলে, পালানোর দিনই রাতে গুহার ভেতরে মারা গিয়েছে হেনরি। ভালোমতো খুঁটিয়ে পড়েছি আমি সমস্ত রেকর্ড, গবেষণা করেছি। পরিষ্কার বুঝেছি গুলির আঘাত মারাত্মক ছিলো না। তখন তার বয়েস ছিলো আঠারো বছর। কাজেই, এখনও তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়!

.

০৪.

কি বাজে বকছো! প্রায় ফেটে পড়লেন মিস্টার হারভে। তারমানে একশোর কাছাকাছি তার বয়েস। ওরকম বয়সের একজন লোক ওভাবে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ায় কি করে?

পারে, পারে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন প্রফেসর। শুনলে অবাক হবে, রাশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে, ককেসাস পর্বতমালার উপজাতীয় লোকেরা একশো বছর বয়েসেও ঘোড়ায় চড়ে, লড়াই করে।

তা ঠিক, স্যার,বললো কিশোর।

কিংবা এমনও হতে পারে, বললেন প্রফেসর। হেনরির কোনো বংশধর আছে। ছেলে, কিংবা নাতি। হেনরির ইচ্ছা পূরণ করতে এসেছে।

কিছুটা বিমনা মনে হলো মিস্টার হারভেকে। হ্যাঁ, তা হতে পারে। আমাদের। আগে যারা ছিলো, তারা মোনিং ভ্যালির কাছে যেতো না। কিন্তু আমি ঠিক করেছি ওখানে একটা কোরাল বানাবো। হয়তো হেনরির ছেলে বা নাতি চায় না গুহার ঐতিহ্য নষ্ট হোক।

হ্যাঁ, এটাই জবাব! চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস হারভে। রক, মনে আছে, র‍্যাঞ্চের পুরনো কয়েকজন মেকসিকান শ্রমিক বিরক্ত হয়েছিলো? কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। তারা চায়নি; মোনিং ভ্যালিতে কোরাল উঠুক। তারপর থেকেই তো, শুরু হলো গোঙানি।

মনে আছে। ওরাই প্রথম গেছে। কালই দেখা করবো আমি শেরিফের সাথে। হেনরির কোনো বংশধর আছে কিনা খোঁজখবর নিতে বলবো।

একটা ছবি দেখাচ্ছি, পকেট থেকে ছোট একটা ফটোগ্রাফ বের করে দিলেন। প্রফেসর।

হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো ছবিটা। ছিপছিপে এক তরুণের ছবি। কালো চোখের তারায় যেন আগুনের ঝিলিক, গর্বিত মুখ। চওড়া কানা আর উঁচু চূড়ওয়ালা, কালো ভ্যাকুয়েরো সমব্রেরো হ্যাট মাথায়। গায়ে খাটো কালো। জ্যাকেটের নিচে কালো উঁচু কলারের শার্ট, পরনে কালো আঁটো প্যান্ট, নিচের দিকটা ছড়ানো। পায়ে কালো চকচকে পয়েন্টেড বুট। ক্যামেরায় তোলা জীবন্ত হেনরির ছবি নয়, একটা পেইন্টিঙের ফটোগ্রাফ।

সব সময়ই কি কালো পরতো? জানতে চাইলো রবিন।

সব সময়, জবাব দিলেন প্রফেসর। শোকের চিহ্ন। তার পরিবার আর দেশের জন্যে শোক করতো।

চোরের আবার দেশপ্রেম! সাধারণ একটা ডাকাত ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। ব্যাটা, ক্ষোভ ঢেকে রাখতে পারলেন না আমেরিকান র‍্যাঞ্চার। বলেই বুঝলেন, কথাটা খারাপ হয়ে গেছে। হেসে সামাল দিলেন। বসে বসে কিচ্ছা শুনলে র‍্যাঞ্চ চলবে না, অনেক কাজ আছে আমার। আজ রাতেই সেগুলো সারতে হবে। ছেলেদের দিকে তাকালেন। তোমরা নিশ্চয় খুব টায়ারড। কাল খাটাবো তোমাদেরকে। মুসার বাবা বলে দিয়েছে, কি করে র‍্যাঞ্চ চালাতে হয় তার ছেলেকে যেন শিখিয়ে দিই।

মোটেই টায়ারড নই আমি, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। তোমরা?

আমিও না, রবিন বললো।

আমিও না, প্রতিধ্বনি করলো যেন মুসা।

সবে তো সন্ধ্যা হয়েছে, বললো কিশোর। আকাশও ভালো। সুন্দর রাত। র‍্যাঞ্চের আশপাশে ঘুরে দেখতে চাই। রাতের বেলা নাকি এখানকার সৈকতে নানা রকম সামুদ্রিক জীব উঠে আসে। দেখার সুযোগ কে ছাড়ে?

রাতের বেলা…, মিসেস হারভে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।

নিশ্চয়ই, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন মিস্টার হারভে। দেখতে এসেছে, দেখবে। ঘুমিয়ে কাটানোর জন্যে তো নিজের বাড়িই আছে, র‍্যাঞ্চে কেন?

বেশ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন মিসেস হারভে। তবে দশটার বেশি দেরি। করবে না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি আমরা এখানে।

আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ওখানে তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে এলো।

বাইরে বেরিয়েই নির্দেশ দিলো কিশোর, মুসা, গোলাঘর থেকে এক বাণ্ডিল দড়ি নিয়ে এসো। রবিন, তুমি গিয়ে আমাদের চক আর টর্চ আনো। আমি সাইকেলগুলো পরীক্ষা করে দেখি, কোনো গোলমাল আছে কিনা।

গুহায় যাচ্ছি নাকি আমরা? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

হ্যাঁ। গোঙানির রহস্য ভেদ করতে হলে গোঙানি উপত্যকায়ই যেতে হবে।

গুহায় ঢুকবে? শুকনো গলায় বললো মুসা। এই রাতে না গিয়ে দিনে গেলে হতো না?

না। রাতের বেলায়ই গোঙানি শোনা যায়। আর গুহার ভেতরে দিন-রাতের তফাৎ কি? সব সময়ই অন্ধকার, এক রকম। আজ গোঙাতে শুরু করেছে গুহাটা, কাল হয়তো থেমে যাবে। তারপর আবার কয় দিন অপেক্ষা করতে হবে ঠিক আছে? যাও।

কয়েক মিনিট পর সাইকেল চালিয়ে র‍্যাঞ্চের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো তিন কিশোর। মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে দড়ির বাণ্ডিল। সরু একটা কাঁচা রাস্তা ধরে চললো ওরা।

র‍্যাঞ্চটা সাগরের কিনারে বটে, কিন্তু বেরোলেই সাগর চোখে পড়ে না। কয়েক মাইল পর্যন্ত আড়াল করে রেখেছে উপকূলের পাহাড়। চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন পাথুরে পাহাড়ের উঁচু চূড়াগুলো। সবুজ ওক গাছগুলোকে এখন দেখাচ্ছে ফ্যাকাশে শাদা, কেমন যেন। ভূতুড়ে। সাইকেল চালাতে চালাতে ছেলেদের কানে এলো বিচিত্র শব্দ, চারণক্ষেত্রে অস্থির হয়ে উঠেছে গরুর পাল। নাক দিয়ে শব্দ করছে ঘোড়া, চঞ্চল।

হঠাৎ, কোনো রকম জানান না দিয়েই শুরু হলো গোঙানি, ছড়িয়ে পড়লো সারা উপত্যকায়।

চমকে উঠলো রবিন আর মুসা।

 গুড, বললো কিশোর। থামেনি। আজ চলবে মনে হচ্ছে।

নীরবে সাইকেল থেকে নামলো তিনজনে, স্ট্যাণ্ডে তুললো। উঁচু শৈলশিরায় উঠে তাকালো চন্দ্রালোকিত উপত্যকার ওধারে হেনরি ফিগারোর কালো গুহামুখের দিকে।

কিশোর, বলে উঠলো রবিন। কি যেন নড়ছে!

আমি খুটখাট শুনছি, মুসা বললো।

হ্যাঁ, মাথা দোলালো কিশোর। আসলে কল্পনা করছে। এরকম জায়গায় এই পরিবেশে স্বাভাবিক জিনিসকেও অস্বাভাবিক লাগাটা স্বাভাবিক, শুরু হলো তার লেকচার। অতি সাধারণ জিনিসও চমকে দেবে। আতঙ্কিত করে তুলবে। ওসব আলোচনা এখন থাক। রবিন, টর্চগুলো আরেকবার পরীক্ষা করো।

পরীক্ষা করলো রবিন। দড়ির বাণ্ডিলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কাঁধে ঝোলালো মুসা। যার যার চক নিয়ে পকেটে ভরলো। কিশোরের শাদা চক, মুসার নীল, রবিনের সবুজ।

এসব এলাকার পুরনো গুহাগুলো খুব বিপজ্জনক, বললো কিশোর। সুড়ঙ্গের কোথায় যে চোরাখাদ লুকিয়ে থাকে বোঝা মুশকিল। পা ফেলেছে কি ধপাস, এক্কেবারে তলায়। দড়ি ছাড়া তোলা প্রায় অসম্ভব। সেজন্যেই দড়ি নিয়েছি।

চক দিয়ে চিহ্ন আঁকতে আঁকতে যাবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

নিশ্চয়।

 চলো। গেলে আর দেরি করে লাভ নেই।

হ্যাঁ, চলো।

ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো ওরা, উপত্যকায়।

আবার সেই অদ্ভুত গোঙানি ঢেউ তুললো যেন রাতের শান্ত নীরবতায়।

গুহার কাছাকাছি চলে এলো ওরা। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে গায়ে। লাগলো। হাঁ করে থাকা কালো সুড়ঙ্গমুখের কাছে এসে টর্চ জ্বাললো কিশোর, ঠিক এই সময় কানে এলো চাপা শব্দ।

কিসের? চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।

বাড়ছে শব্দটা, জোরালো হচ্ছে। উপত্যকার চারপাশেই ঘিরে আছে পাহাড়, সেগুলোতে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুললো। ফলে বোঝা গেল না ঠিক কোনখান থেকে আসছে। মনে হচ্ছে, চার পাশ থেকেই হচ্ছে শব্দ।

ওই দেখো! ওপর দিকে হাত তুলে জোরে চিৎকার করে উঠলো মুলা।

ডেভিল মাউনটেইনের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে বিশাল এক পাথর, ওটার ধাক্কায় ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মতো ঝরতে আরম্ভ করেছে অসংখ্য ছোট পাথর।

সরো! আবার চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

পাথরটা ওদের ওপরই পড়বে মনে হচ্ছে। এক লাফে পাশে সরে গেল রবিন।

কিশোর দাঁড়িয়েই রইলো, যেন জমে গেছে। চেয়ে রয়েছে পাথরটার দিকে। তার ওপরেই এসে পড়বে।

.

০৫.

ঝাঁপ দিলো মুসা। কিশোরকে নিয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ধুড়ুম করে পড়লো। পাথরটা। গুহামুখের কাছ থেকে সরতে আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই ভর্তা হয়ে যেতো গোয়েন্দাপ্রধান।

এই, এই তোমাদের কিছু হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

না, আমার কিছু হয়নি, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দিলো মুসা। কিশোর?

খুব ধীরে ধীরে উঠলো কিশোর। কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়লো। চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এ-জগতে নেই সে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম বিড়বিড় করে বললো। হয় এরকম। আশ্চর্য এক মানসিক প্রতিক্রিয়া। সাময়িক ভাবে পঙ্গু করে দেয় শরীরকে। শিকার ধরার আগে ছোট ছোট জানোয়ারকে এভাবেই সম্মোহিত করে ফেলে বিশাল সাপ…

আরে ধ্যাত্তোর! রাখো তোমার লেকচার! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা। বলি, ঠিকঠাক আছে? না ভেঙেছে কিছু?

ফিরেও তাকালো না কিশোর। চাঁদের আলোয় আলোকিত ডেভিল মাউনটেইনের ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে, চোখে পলক পড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে অনেক আলগা পাথর আছে ওখানে, আনমনে বললো সে। পাহাড়ের ঢালও খটখটে শুকনো। এখানে ওভাবে পাথর গড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। বহু জায়গার পাথরই বোধহয় আলগা করে দিয়েছে নেভির কামান।

তিনজনেই এগোলো বিশাল পাথরটার দিকে। সুড়ঙ্গমুখের কয়েক গজ দূরে। মাটিতে বসে গেছে।

দেখো, দাগ; পাথরটা দেখিয়ে বললো রবিন। কিশোর, কেউ ঠেলে ফেলেনি তো?

কিছু দাগ আছে, ভালোমতো পাথরটা দেখে সোজা হলো কিশোর। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

পড়ার সময় ঘষা খেয়েছে, মুসা বললো। দাগ তো হবেই।

ওপরে কিন্তু কাউকে দেখিনি আমরা, বললো রবিন।  

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দেখিনি। দেখা দিতে চায়নি বলেই হয়তো। দেখিনি।

ফিরে গিয়ে দেখবো নাকি আবার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

না। আরও সাবধান থাকতে হবে আমাদের। গুহার ভেতরে অবশ্য সে-ভয় নেই। অন্তত মাথার ওপর পাথর খসে পড়বে না।

গুহায় ঢুকলো তিনজনে। কিশোর আগে আগে রয়েছে। দেয়ালে আশ্চর্যবোধক আর একটা তীর চিহ্ন আঁকলো রবিন। সুড়ঙ্গমুখের কাছেই।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, লম্বা অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ সোজা ঢুকে গেছে। ডেভিল মাউনটেইনের গভীরে। মসৃণ দেয়াল। ছাত মুসার মাথার চেয়ে সামান্য উঁচুতে। কিশোর আর রবিন তার চেয়ে বেঁটে, ফলে হাঁটতে অসুবিধে হলো না কারোই।

চল্লিশ ফুট মতো সোজা এগিয়ে গেল পথটা। শেষ মাথায় বিরাট এক গুহা।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে দেখলো ছেলেরা। যেমন বড় ঘর, তেমনি উঁচু তার ছাত। আবছা দেখা যাচ্ছে ওপাশের দেয়াল।

আরিব্বাবা! বললো রবিন। এতো বড় গুহা আর দেখিনি। কেমন যেন শূন্য, দূরাগত শোনালো তার কথাগুলো।

হাল্লো! চেঁচিয়ে বললো মুসা।

হাল্লো.. হাল্লো…হাল্লো-ও-ও-ও-ও-ও! প্রতিধ্বনি হলো।

হেসে উঠলো মুসা। রবিনও। মজা পেয়ে দুজনেই হাল্লো হাল্লো শুরু করলো। গুহাটাও যেন রসিকতা শুরু করলো তাদের সঙ্গে।

কিশোর ওদের সঙ্গে যোগ দিলো না। টর্চের আলোয় গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছে। ডাকলো, এই, দেখে যাও।

ওদের বায়ে, দেয়ালে কালো একটা ছোট ফোকর। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ। ওরকম আরও অনেকগুলো ফোকর দেখতে পেলো ওরা। কমপক্ষে দশটা সুড়ঙ্গ ঢুকেছে গিয়ে পর্বতের ভেতরে।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। কোনটা দিয়ে যাবো?

 সব কটা ফোকরই প্রায় একরকম। মুসার সমান উঁচু, চার ফুট চওড়া।

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। মনে হচ্ছে সারা পর্বতের তলায়ই ছড়িয়ে আছে সুড়ঙ্গ।

এ-জন্যেই বোধহয় ফিগারোকে খুঁজে পায়নি শেরিফ। এতো সুড়ঙ্গ, কয়টাতে খুঁজবে? ওরা একদিকে গেলে ফিগারো আরেক দিকে সরে গেছে। লুকিয়ে থেকেছে।

হতে পারে।

 এই গুহা আর সুড়ঙ্গ তৈরি হলো কিভাবে? অবাক হয়ে দেখছে মুসা।

পানি, বললো রবিন। বইয়ে পড়েছি। নানারকম পাথর দিয়ে তৈরি হয় এসব পর্বত। কিছু পাথর শক্ত, কিছু নরম। পানিতে ক্ষয় হয়ে, কিংবা গলে গিয়ে ধুয়ে চলে যায় নরম পাথরগুলো, শক্তগুলো থেকে যায়। ফাঁকগুলোতে তৈরি হয়েছে সুড়ঙ্গ। কোটি কোটি বছর লেগেছে এসব হতে। অনেক অনেক আগে এই এলাকার বেশির ভাগ অঞ্চলই পানির তলায় ছিলো।

তবে সব সুড়ঙ্গই যে প্রাকৃতিক, কিশোর বললো। তা নয়। মানুষেও বানিয়েছে কিছু। হয়তো হেনরি ফিগারোর লোকেরা।

কিংবা মাইনাররা। সোনার লোভে খুঁড়েছে।

এক ফোকর থেকে আরেক ফোকরে আলো সরাচ্ছে মুসা। কোনটা থেকে শুরু করবো?

সবগুলো দেখতে হলে তো কয়েক মাস লেগে যাবে।

কাজেই সবগুলোতে দেখা যাবে না, বললো কিশোর। শুধু যেটা থেকে গোঙানি আসে সেটায়। প্রত্যেকটা ফোকরের কাছে গিয়ে কান পাতবো। যেটা থেকে শোনা যাবে…

কিশোর! বাধা দিলো রবিন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেনি? গুহায় ঢোকার পর থেকে আর শুনছি না!

স্থির দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলো তিনজনে। রবিন ঠিকই বলেছে। কবরের নীরবতা গুহার মধ্যে। কোনো শব্দ নেই।

এর মানে কি? মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি।

এর পর আরও দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। গোঙানি শোনা গেল না।

পাথর পড়ার পর থেকেই আর আওয়াজটা শুনিনি, রবিন বললো।

হ্যাঁ, বললো কিশোর। এতো বেশি উত্তেজিত ছিলাম, খেয়ালই করিনি কখন থেমে গেছে।

কি করবো এখন? মুসার প্রশ্ন।

শুরু হতে পারে আবার, আশা করলো কিশোর। মিস্টার হারভে বলেছেন আওয়াজটা অনিয়মিত, নির্দিষ্ট সময় পর পর শুরু হয় না। না হোক, ইতিমধ্যে যে কটা সুড়ঙ্গ পারি দেখে ফেলি আমরা। ১৭৬

মুসা আর রবিন রাজি। এই দুঃসহ অন্ধকারে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে যা-ই হোক কিছু একটা করা ভালো। একটা সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে চক দিয়ে দেয়ালে চিহ্ন এঁকে দিলো রবিন।

সাবধানে এগোলো ওরা। অন্ধকারের কালো চাদর ফুঁড়ে বেরোচ্ছে যৈন টর্চের আলো। তিরিশ ফুট মতো এগিয়েই শেষ হয়ে গেল সুড়ঙ্গটা। সামনে দেয়াল নয়, পাথর পড়ে বন্ধ হয়েছে।

গুহায় ফিরে এলো ওরা।

পাশাপাশি চারটে সুড়ঙ্গে ঢুকে দেখলো। ঢোকার আগে অবশ্যই মুখের কাছে চক দিয়ে চিহ্ন এঁকে রাখলো। কোনোটা দিয়েই বেশি দূরে এগোতে পারলো না। পাথর পড়ে পথ বন্ধ।

অযথা সময় নষ্ট করছি, অবশেষে বললো কিশোর। এক কাজ করা যাক। তিনজনে একসঙ্গে না ঢুকে আলাদা আলাদা সুড়ঙ্গে ঢুকি। তাতে সময় বাঁচবে, দেখাও হবে বেশি। ভোলা সুড়ঙ্গ যে-ই দেখতে পাবো, ফিরে এসে অপেক্ষা করবো। এখানে অন্য দুজনের জন্যে।

তিনজনে ঢুকে পড়লো তিনটে সুড়ঙ্গে।

কিশোর যেটাতে ঢুকলো, শুরুতে সেটা প্রাকৃতিকই মনে হলো। অল্প কিছু দূর। পর্যন্ত তারপর চোখে পড়লো কড়ি-বরগা আর থাম। মাইন শ্যাফট। খনির কাজে খোঁড়া হয়েছিলো। সাবধানে এগিয়ে গেল আরও কয়েক গজ।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। সামনে বন্ধ। পাথরের স্তূপ। পড়ে থাকা একটা পাথর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার। এখানকার অন্যান্য পাথরের চেয়ে আলাদা। তুলে নিয়ে ওটা পকেটে রেখে দিলো, পরে ভালোমতো দেখার জন্যে।

এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। কিশোর! রবিন! জলদি এসো!

.

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে রবিন তখন আরেকটা গুহায় ঢুকেছে। এটাও প্রথম গুহাটার মতোই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। এটাতেও প্রথমটার মতোই অসংখ্য সুড়ঙ্গমুখ। ফেরার জন্যে সবে ঘুরেছে, এই সময় কানে এলো মুসার চিৎকার। দিলো দৌড়।

কিশোরও দৌড় দিয়েছে। আচমকা অন্ধকার থেকে কি যেন একটা এসে পড়লো তার ওপর। চিত হয়ে পাথুরে মেঝেতে পড়ে গেল সে। তার গলায় খামচি মারার চেষ্টা করলো কয়েকটা আঙুল।

বাঁচাও! বাঁচাও! আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলো একটা কণ্ঠ।

রবিন! আরে আমি, কিশোর।

ঢিল হলো আঙুলগুলো। একে অন্যের ওপর টর্চের আলো ফেললো ওরা।

আমি ভাবছিলাম, কিসের গায়ে জানি পড়লাম! বললো রবিন।

আমিও তাই ভেবেছি। মুসার চিৎকারে চমকে গিয়ে…চলো, চলো।

মুসা যে-সুড়ঙ্গে ঢুকেছে সেটাতে ঢুকলো দুজনে। এ-পর্যন্ত যে-কটাতে ঢুকেছে ওরা, সবগুলোর চেয়ে এটা লম্বা মনে হলো। সামনে টর্চের আলো নাচছে। মুসার হাতে।

এই যে, আমি এখানে, ডাকলো সে।

আরেকটা বড় গুহায় এসে ঢুকলো কিশোর আর রবিন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। চেহারা ফ্যাকাশে। টর্চের আলো ফেলেছে বা দেয়ালে।

ওখানে…ওখানে কি যেন দেখলাম! কালো! চকচকে!

 রবিন আর কিশোর আলো ফেললো। কিছুই দেখলো না।

আমি শিওর দেখেছি, জোর দিয়ে বললো মুসা। ঢুকে প্রথমে আওয়াজ শুনলাম। লাইট ফেলে দেখি..ওটা! ওই দেয়ালের কাছে। বিরাট। হাত থেকে টর্চ পড়ে গিয়েছিলো আমার। আবার তুলে আলো ফেলে দেখলাম, নেই!

সন্দেহ জাগলো রবিনের। কল্পনা করেছে। বেশি নার্ভাস হলে হয় এরকম। আলাদা হওয়া উচিত হয়নি আমাদের।

দেয়ালটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। নিচু হয়ে কি দেখলো। মুসা ভুল দেখেনি, রবিন। দেখে যাও।

দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন আর মুসা। পাথুরে মেঝেতে বড় বড় দুটো দাগ। পায়ের ছাপ। টর্চের আলোয় চকচক করছে।

কি…, কেঁপে গেল রবিনের গলা। কি ওগুলো, কিশোর?

 ভেজা ভেজা লাগছে, জবাব দিলো কিশোর। পানি।

খাইছে! জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজালো মুসা।

সমস্ত মেঝেটায় আলো ফেলে ফেলে দেখলো কিশোর। আর ছাপ নেই। ছাতে আলো ফেললো। খটখটে শুকনো।

পানির চিহ্নও তো দেখছি না। এলো কোত্থেকে? বললো সে। মুসা ঠিকই বলেছে। কিছু একটা দাঁড়িয়ে ছিলো ওখানে। ভেজা ছাপ রেখে গেছে।

এতো বড়? রবিন বললো। দু-তিন ফুটের কম লম্বা হবে না।

বড়, ভেজা, চকচকে। দেখে মনে হয়…

দানবের! কিশোরকে কথা শেষ করতে দিলো না মুসা।

বুড়ো মানুষটা! বললো রবিন।

পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা। চোখে অস্বস্তি। দানবে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাহলে ছাপগুলো কার?

তীব্র আলো এসে পড়লো তিনজনের গায়ে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন ওরা।

আলোর পেছনে থেকে শোনা গেল খসখসে কণ্ঠ, কি, হচ্ছে কি এখানে?

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো একটা মূর্তি। সামান্য কুঁজো, বাঁকা পিঠ। শাদা। ধবধবে লম্বা চুল-দাড়ি, উসকো-খুসকো, বহুদিন ওগুলোতে চিরুনি কিংবা নাপিতের কাঁচি লাগেনি।

হাতে লম্বা নলওয়ালা পুরনো আমলের রাইফেল।

০৬.

কালো সুড়ঙ্গমুখগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো বুড়ো মানুষটা।

অনেক ভেতরে ঢুকেছে ওগুলো, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর। সহজেই হারিয়ে যাবে ওর মধ্যে ঢুকলে।

দুষ্টুমি করে একটা লাল চোখ টিপলো বুড়ো। চিনি তো জায়গাগুলো, ভালো করেই চিনি। পঞ্চাশ বছর ধরে আছি, মুণ্ডু কাটা যায়নি একবারও। শত্রুর সঙ্গে কতো লড়াই করলাম।

মুণ্ডু কাটা যায়নি? চোখ মিটমিট করলো মুসা। ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই, করেছেন? এখানে?

 রাইফেলটা নাড়লো বুড়ো। ইনজুনস! ইনজুনসদের অনেক গল্প শোনাতে পারি তোমাদেরকে। সারা জীবন ওদের সাথে এখানে কাটালাম। লোক ভালো ওরা, তবে খুব খারাপ শত্রু। দুবার মুৎ প্রায় গিয়েছিলো আমার। ইউটি আর অ্যাপাচিদের দেশে গিয়ে। ভীষণ পাজি ওই অ্যাপাচিরা। কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছি।

এখন আর এখানে কোনো ইনডিয়ান নেই, স্যার, ভদ্রভাবে বললো কিশোর। আর আমরাও সুড়ঙ্গে ঢুকে হারাবো না।

কিশোরের ওপর স্থির হলো বুড়োর দৃষ্টি, যেন এই প্রথম তার ওপর চোখ পড়লো। এখন? না, এখন আর ইনজুনসরা নেই। তা তোমরা কি পাগল? এই গুহায় ঢুকতে সাহস করেছো? নতুন নাকি? কণ্ঠস্বর অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। চোখের বন্য দৃষ্টিও কোমল হয়েছে।

রবিন জবাব দিলো, হ্যাঁ, স্যার, রকি বীচ থেকে।

মিস্টার হারভের র‍্যাঞ্চে উঠেছি, মিস্টার..? জিজ্ঞাসু চোখে লোকটার দিকে। তাকালো কিশোর।

ডিন মারটিন, নাম বললো বুড়ো। ডিন বলে ডাকবে আমাকে। তো, হারভের ওখানে, আঁ? ভালো লোক ওরা। বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চিৎকার। শুনলাম। তোমাদেরই কেউ?

হ্যাঁ, স্যার, বললো কিশোর। তবে হারিয়ে গিয়ে সাহায্যের জন্যে চেঁচাইনি। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন দেয়ালে, দাগ দিতে দিতে এসেছি।

তাই? বুদ্ধি আছে। আরও একশো বছর আগে জন্মানো উচিত ছিলো। তোমাদের, আরামে কাটাতে পারতে। তা এখানে কি করছো?

কিসে গোঙায় দেখতে এসেছি, রবিন বললো।

আমরা ঢুকতেই থেমে গেল, বললো মুসা।

হঠাৎ কুঁকড়ে গেল লোকটা। চোখে ভয় ফুটলো ৭ পরিবর্তনটা এতোই প্রকট, ছেলেদের মনে হলো অন্য একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে এখন। আগের বুড়ো নয়। গোঙানি, না? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। লোকে বলে, হেনরি ফিগারো ফিরে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি না। গোঙান ওই ভদ্রলোক, বুড়ো মানুষটা। বুঝেছো? থামলো এক মুহূর্ত। ভয়ে ভয়ে তাকালো এদিক-ওদিক। শ্বেতাঙ্গরা এই এলাকায় আসার আগে থেকেই আছেন তিনি। সময়, বা বয়েস তাঁর কাছে কিছুই নয়। তিনি আছেন, থাকবেন। বাঁচতে চাইলে, তাঁকে রাগাতে না চাইলে আর কক্ষণো এখানে ঢুকো না। আমি ঢুকি বটে, কিন্তু গোঙানির কারণ। জানার চেষ্টা করি না। শেরিফ আর তার লোকেরাও তাঁকে ভয় পেতো। ওদের সবাইকেই ধরেছেন তিনি! ঢুকতে বারণ করে দেবে। এখানকার শেরিফও যেন না ঢোকে। ঢুকলে সবাইকে ধরবেন তিনি, কাউকে ছাড়বেন না।

ভীত চোখে কিশোরের দিকে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু সে তাকালো। না। চেয়ে আছে বুড়োর দিকে। ভাবছে কি যেন। তাঁকে আপনি কখনও দেখেছেন, মিস্টার মারটিন? বুড়ো মানুষটাকে? এই গুহায়?

তাঁকে? দ্রুত চারপাশে তাকালো মারটিন। এসো আমার সঙ্গে, বাইরে দিয়ে আসি। খবরদার, এখানে ঢুকে আর কখনও চিল্লাবে না। তিনি সহ্য করবেন না।

মাথা কাত করলো কিশোর হা, বেরোনো যায় এখন কি অনেক কিছুই দেখলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন। এখানে সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়।

বৈদ্যুতিক লণ্ঠনটা তুলে নিলো বুড়ো। ছেলেদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো গুহার বাইরে, উপত্যকায়। সঙ্গে সঙ্গে চললো, একেবারে সাইকেলের কাছে পৌঁছে দেবে। কান খাড়া রেখেছে কিশোর। কিন্তু গোঙানি আর শোনা গেল না।

ডিন মারটিনকে ধন্যবাদ দিলো ছেলেরা, গুড নাইট জানালো।

তোমরা খুব ভালো ছেলে, চালাক, বললো মারটিন। তবে বুড়ো মানুষটা তোমাদের চেয়ে, চালাক, সবার চেয়েই চালাক। তোমরা সাবধানে থাকবে। হারভেকেও হুঁশিয়ার করে দেবে। বলবে, বুড়ো মানুষটা সবার ওপরই চোখ রাখছেন। খনখনে হাসি হাসলো সে।

চাঁদের আলোয় কাঁচা সড়ক ধরে সাইকেল চালিয়ে চলেছে তিন গোয়েন্দা। এখনও যেন কানে বাজছে বুড়োর হাসি। হঠাৎ থেমে গেল কিশোর।

ধাঁই করে হ্যাণ্ডেল আরেক দিকে ঘুরিয়ে দিলো মুসা, অল্পের জন্যে কিশোরের সাইকেলের ওপর পড়লো না।

রবিনও ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো। কি ব্যাপার?

কাজ শেষ হয়নি এখনও, বলতে বলতেই আবার সাইকেল ঘোরালো কিশোর।

র‍্যাঞ্চে ফিরে গেলেই ভালো, বললো রবিন।

আমিও তাই বলি, তাড়াতাড়ি বললো মুসা।

কোনো কাজে হাত দিলে শেষ না করে ছাড়ে না তিন গোয়েন্দা, ঘোষণা করলো যেন কিশোর।

কিন্তু ভোটে হেরে যাবে, রবিন বললো। দুজন আর একজন।।

ঠেকানো গেল না কিশোরকে। প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। তারপর নীরবে অনুসরণ করলো। জোরে জোরে প্যাডেল করে চলে এলো কিশোরের পাশে।

পথের মোড়ে ছায়ায় এসে থামলো কিশোর। ভালো করে দেখে বললো, অল ক্লীয়ার। এসো।

এবার কি করতে হবে? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

আপাতত সাইকেলগুলো লুকাতে হবে। তারপর হেঁটে যাবো। চুপে চুপে।

চুপে চুপে হেঁটে কোথায় যাবো? জানতে চাইলো মুসা।

একটু আগে দেখলাম, এই পথটা ডেভিল মাউনটেইনের পাশ ঘুরে সাগরের দিকে গেছে। সাগরের দিক থেকে ঢোকার আর কোনো পথ আছে কিনা দেখবো।

 পাহাড়ের ছায়া পথের ওপর। কিশোরের পিছু পিছু চললো রবিন আর মুসা। চাঁদের আলোয় পাহাড় আর পাথরের বিচিত্র সব ছায়া পড়েছে উপত্যকায়, দেখলে কেমন যেন গা ছমছম করে। পথের ধারে কখনও গাছপালা, কখনও পাথরের চাঁই। কখনও বা সরু গিরিপথের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে পথটা।

তিনটা প্রশ্ন, হাঁটতে হাঁটতে বললো কিশোর। আমরা ঢোকার পরই কেন বন্ধ হয়ে গেল গোঙানি? বাতাস তো আগাগোড়া একই রকম বইছে। তারমানে শুধু বাতাসের কারণে হয় না শব্দ।

অন্য কিছু? রবিন বললো।

হ্যাঁ।

কী? জানতে চাইলো মুসা।

আমাদের ওপর চোখ রেখেছে এমন কিছু কিংবা কেউ। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ডিন মারটিন আমাদেরকে গুহা থেকে বের করে দেয়ার জন্যে এতো ব্যস্ত হলো কেন?

বার বার তার বদলে যাওয়া ভালো লাগেনি। শেষ দিকে কেঁপে গেল রবিনের গলা।

হ্যাঁ,আনমনা হয়ে গেল কিশোর, ক্ষণিকের জন্যে। এক আজব বুড়ো! মনে হলো, দুজন ভিন্ন লোক ভিন্ন সময়ে বাস করছে। অভিনয়ই করলো কিনা কে জানে!

আমাদের ভালোই হয়তো চেয়েছে, তাই বের করে দিয়েছে, মুসা বললো। দেখলে না, বুড়ো মানুষের কথা বলার সময় কেমন ভয় ফুটলো চোখে। দানবটাকে দেখেছেও বোধহয়।

হয়তো। তিন নম্বর প্রশ্নটা হলো, কালো চকচকে যে জিনিসটা তুমি দেখলে। কি দেখেছো? কোনো সন্দেহ নেই আমার, পানিতে ভিজে ছিলো বলেই ছাপগুলো পড়েছে। পর্বতের ভেতরে কোথাও হ্রদ-টদ কিংবা খাড়ি যেমন থাকতে পারে, তেমনি পারে সাগর থেকে গুহায় ঢোকার কোনো গোপন পথ। সেটাই দেখতে চলেছি।

 আর কিছু দূর এগোতেই সামনে লোহার গেট চোখে পড়লো। পথটা ওখানে। শেষ। তার পরে পাহাড়ের প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে ডানে-বাঁয়ে নেমে গেছে দুটো সরু পথ। অনেক নিচে ঢেউয়ের ফেনা শাদা রেখা সৃষ্টি করেছে চাঁদের আলোয়। গেট ডিঙিয়ে এসে পাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো ছেলেরা।

ডালে যাবো, গুহাটা ওদিকেই, বললো কিশোর। পর্বতারোহীদের মতো। কোমরে দড়ি বেঁধে নেবো।-মুসা, তুমি আগে যাবে, আমি থাকবো পেছনে। সারি দিয়ে এগোবো। পথ যেখানে বেশি খারাপ একজন একজন করে পেরোবো। প্ল পিছলালেও অন্য দুজনে যাতে তাকে টেনে তুলতে পারি।

দ্রুতহাতে কোমরে দড়ি বেঁধে নিলো ওরা। সরু পথ ধরে আগে আগে চললো মুসা। নিচে বড় বড় পাথরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কালো, পাথরগুলো রুপোলি দেখাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। মাঝে মাঝে পথ এতো নিচে নেমে যাচ্ছে, আছড়ে ভাঙা ঢেউয়ের পানির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে। তিনবার থামতে হলো। পথ এতো খারাপ ওসব জায়গায়, একজন একজন করে পেরোতে হলো।

শেষ দিকে প্রায় খাড়া ভাবে সোজাসুজি নেমে গেছে পথটা। নিচে ছোট এক টুকরো সৈকত, ঝকঝকে শাদা বালি। এখন নির্জন। তবে লোকজন যে আসে, সাঁতার কাটে, পিকনিক করে, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিয়ারের খালি টিন, ফান্টা-কোকাকোলার বোতল, খাবারের বাক্স পড়ে আছে এদিক-ওদিক।

ভালোমতো চোখ রাখবে, বললো কিশোর। ফোকর-টোকর থাকতে পারে।

ঢালের গোড়ার কাছটায় ঘন হয়ে জন্মে আছে ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে বড় জাতের গাছ, কোনো কারণে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়েছে ওগুলোর। ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় পাথরের চাই।

টর্চের আলো ফেলে দেখছে ওরা। বিশেষ করে চাঁইগুলোর পেছনে।

আমার মনে হয় না এখানে কিছু আছে, মুসা বললো।

তাহলে কোথায় আছে? প্রশ্ন করলো রবিন।

কি জানি! কেউ তো বলেনি, এদিকেও সুড়ঙ্গমুখ আছে। আমরা আন্দাজ করছি। থেকে থাকলেও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

থাকলে কাছাকাছিই কোথাও আছে। কারণ, পথটা শেষ হয়েছে এখানেই। ৪. ঠিকই বলেছো, মুখ খুললো কিশোর। রবিন, তুমি আমার সাথে এসো। ডান দিকে খুঁজবো। মুসা, তুমি বয়ে যাও।

পানির কিনারের পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে শ্যাওলায়। তাতে কামড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক-গুগলি। ওগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটার সময় খুব সাবধান হতে হচ্ছে রবিন আর কিশোরকে।

অবশেষে এমন একটা জায়গায় এসে থামলো, আর এগোনোর উপায় নেই। তাহলে পানিতে নামতে হবে। হতাশ হয়ে ঘুরতে যাবে এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার। এই, পেয়েছি!

ভেজা পাথরগুলো কোনোমতে পেরিয়ে এসে সৈকতে নেমেই দৌড় দিলো রবিন আর কিশোর। বাঁ দিকের প্রায় শেষ মাথায় চ্যাপ্টা বড় একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মস্ত দুটো পাথরের চাঁইয়ের মাঝে টর্চের আলো ফেলেছে। ছোট একটা মুখ, পানি থেকে বড়জোর ফুট খানেক ওপরে।

এই, শুনছো? কান পাতলো মুসা। আবার শুরু হয়েছে।

অন্য দুজনও শুনলো।

গোঙানিটা আসছে খোলা সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। মৃদু শব্দ, যেন পর্বতের অনেক, গভীর থেকে আসছে।

আরেকটু এগিয়ে মুখের ভেতরে আলো ফেললো মুসা। কালো, ভেজা, সরু পথ। সোজা চলে গেছে সুড়ঙ্গ, শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছে না।

.

০৭.

খাইছে রে! কি অন্ধকার! বললো মুসা।

কিছু দূর গিয়েই বোধহয় শেষ হয়ে গেছে, রবিন অনুমান করলো।

না দৃঢ় কণ্ঠে বললো কিশোর। নিশ্চয় ওই গুহায় যাওয়া যায় এটা দিয়ে। নইলে গোঙানি শুনতে পেতাম না।

দেখে কিন্তু তা মনে হয় না, মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।

ঝুঁকে ভেতরে তাকালো কিশোর। ঢোকা যাবে। সাবধান থাকতে হবে। আরকি। রবিন, তুমি যাও। যে রকম সরু ওটা, তোমার জন্যেই সহজ। কোমরে। দড়ি বেঁধে নামো, আমরা দড়ি ধরে রাখছি।

আমি? একা! তিনজনে একসাথে যাওয়া যায় না?

বোকামি হবে। এরকম অচেনা সুড়ঙ্গে একলা গেলেই ভালো। আমরা বাইরে থাকছি। তুমি কোনো বিপদে পড়লে দড়ি ধরে টেনে বের করে আনতে পারবো। তিনজন একসাথে বিপদে পড়লে তিনজনেই মরবো।

হ্যাঁ, সিনেমায় দেখেছি, মুসা বললো। ওই যে, জেলখানা থেকে পালায়, ওসব ছবিতে। অচেনা সুড়ঙ্গে আগে একজনকে পাঠায়। ও গিয়ে দড়িতে একবার হ্যাঁচকা টান দিলে বাইরের ওরা বোঝে, বিপদে পড়েছে, কিংবা নিরাপদ নয়; তাড়াতাড়ি দড়ি ট্রেনে লোকটাকে বের করে নিয়ে আসে।

 তুমিও একবারই টেনো, রবিনকে বললো কিশোর। টেনে বের করে নিয়ে আসবো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোমরে শক্ত করে দড়ি বেঁধে নেমে পড়লো রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো।

ভেতরে খুব ঠাণ্ডা। অন্ধকার তো বটেই। ছাত এতো নিচু, উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দেয়াল ভেজা, সবুজ শ্যাওলায় পিচ্ছিল। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে একটা জন্তুর মতো এগিয়ে চললো সে, সাবধানে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে। অনেক কাকড়া আছে ভেতরে। টর্চের আলো পড়লেই বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়া নেড়ে তাড়াহুড়ো করে গিয়ে ঢুকছে ভেজা পাথরের আড়ালে।

তিরিশ ফুট মতো এগিয়ে হঠাৎ ওপরে উঠে গেছে ছাত। উঠে দাঁড়ালো রবিন। সামনে এখনও ভোলা সুড়ঙ্গ। বাধা নেই। ছাত উঁচু হয়েছে, দেয়াল দুদিকে সরে গিয়ে মাঝখানটা চওড়া হয়েছে, কোণাকুণি উঠে গেছে পথটা। ভেজা, নয় আর, শুকনো।

কিশোর! মুসা! চেঁচিয়ে বললো সে। ঠিকই আছে সব। এসো।

ওরা দুজনও তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

বেশ শুকনো তো এখানে, বললো মুসা।

 জোয়ারের পানি উঠতে পারে না, তাই, কিশোর বললো।

এগিয়ে চললো ওরা। প্রতি দশ ফুট পর পর চিহ্ন আঁকছে কিশোর। চল্লিশ ফুট পর, বড় একটা গুহা পাওয়া গেল। দেয়ালে এতো বেশি ফোকর, যেন মৌমাছির বিরাট এক বাসা। কোনটা দিয়ে ঢুকবে?

পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা।

 আবার সেই সমস্যা, মুসা বললো।

পাহাড়টার তলায় সুড়ঙ্গ ছাড়া যেন আর কিছু নেই, নিরাশ হয়ে মাথা নাড়লো রবিন। কোনটায় ঢুকবো?

গুহা, কিংবা ফোকরগুলোর দিকে বিশেষ নজর নেই কিশোরের। কান পেতে রয়েছে। শব্দ কই?

তাই তো! মুসার দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো রবিন। নেই!

না, নেই! মুসাও মাথা নাড়লো।

আমি সুড়ঙ্গে ঢোকার পর থেকেই কিন্তু শুনিনি, রবিন বললো।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালো কিশোর। আমরা ঢুকলেই বন্ধ হয়ে যায়। আশ্চর্য! একবার নয়, দুবার ঘটলো একই ঘটনা। কাকতালীয় আর বলা যায় না।

কি বলতে চাইছো? অবাক মনে হলো মুসাকে। আমরা ঢুকলেই কিছু একটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে? তাতে থেমে যাচ্ছে গোঙানি?

হতে পারে।

আরও একটা ব্যাপার হতে পারে, বললো রবিন। ফুকলেই আমাদের কাউকে দেখে ফেলছে। নিজেই প্রশ্ন তুললো আবার, কিন্তু কিভাবে?

মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। হয়তো…

শোনা গেল শব্দটা। মৃদু, বহুদূর থেকে আসছে। ঘোড়ার খুরের খটাখট।

ঘোড়া! চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।

মাথা ঘুরিয়ে শুনছে কিশোর। গুহার দেয়ালের ভেতর দিয়ে যেন আসছে শব্দটা। মনে হচ্ছে…পর্বতের অনেক গভীর থেকে আসছে!

রবিন বললো, হেনরি ফিগারোর গুহা থেকে…

উঁহু! ওটা এখন আমাদের বাঁয়ে। সোজাসুজি ঢুকেছি আমরা, পাহাড়ের দিকে মুখ করে আছি। তুমি যেদিকের কথা বলছো, সেদিকে কোনো সুড়ঙ্গ নেই, দেখো।

সব চেয়ে ভালো হয়, এখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলে, মুসা বলে উঠলো।

 চলো, বেরিয়েই যাই। সেই ভালো।

পেছন ফিরে প্রায় দৌড়ে চললো ওরা। সুড়ঙ্গের সরু মাথাটার কাছে আগে পৌঁছলো মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এগোলো। পেছনে রবিন আর কিশোর।

বেরিয়ে এলো সুড়ঙ্গ থেকে।

এখন কি করবো? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

এক রাতে যথেষ্ট হয়েছে, জবাব দিলো কিশোর। র‍্যাঞ্চে ফিরে যাবো।

দুই সহকারীর মনের কথা বলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। সানন্দে ফিরে চললো ওরা। কোমড়ে দড়ি বেঁধে উঠে চললো বিপজ্জনক পাহাড়ী পথ বেয়ে। নিরাপদেই উঠে এলো ওপরে।

আগে রয়েছে কিশোর। গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো কিশোর। তার পিঠের ওপর এসে পড়লো মুসা। কি ব্যাপার?

জবাব দিলো না কিশোর। চেয়ে রয়েছে ডেভিল মাউনটেইনের দুই চূড়ার দিকে, একই রকম দেখতে চূড়া দুটো, যেন জমজ।

কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

ধীরে ধীরে বললো কিশোর, কি যেন নড়তে দেখলাম ওখানে…

শোনা গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ। খটখট খটাখট খট-খট…

আবার! গুঙিয়ে উঠলো রবিন।

গুহার মধ্যে এই শব্দই শুনেছিলাম না? মুসা বললো।

তাই তো মনে হয়, বললো কিশোর। পাহাড়ের কোনো ফাটল দিয়ে ঢুকেছিলো শব্দটা।

গেটের কাছে একটা ঘন ঝোপে লুকিয়ে পড়লো ওরা।

এগিয়ে আসছে খুরের আওয়াজ। বড় একটা কালো ঘোড়া দেখা গেল, পর্বতের ঢালের পথ ধরে। দুলকি চালে চলে গেল ছেলেদের কয়েক ফুট দূর দিয়ে।

মানুষ কই? রবিনের প্রশ্ন।

ধরবো নাকি? মুসা বললো।

না। ঘোড়াটার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। দেখি, কি করে?

ঝোপের ভেতরেই বসে আছে ওরা।

হঠাৎ আঙুল তুলে দেখালো মুসা। ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে আসছে একজন, মানুষ। কাছে এলে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলো ওরা। লম্বা, বাদামী চামড়া, চোখা নাক। ডান গালে একটা কাটা দাগ। বা চোখের ওপর কালো পট্টি।

পট্টিটা দেখলে? ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

আর গালের কাটা, যোগ করলো রবিন।

আমি দেখেছি ওর স্যুট, কিশোর বললো। বিজনেস স্যুট। মনে হলো কোটের নিচে পিস্তলও আছে।

এবার তাহলে যেতে পারি আমরা? মুসা বললো।

হ্যাঁ। দারুণ কাটলো সময়।

সাইকেলের কাছে আসতে আসতে বার বার পেছনে ফিরে তাকালো ওরা। কিন্তু আর কিছু চোখে পড়লো না।

তবে, সাইকেল চালিয়ে মোনিং ভ্যালি পেরোনোর সময় আবার রাতের নীরবতা ভাঙলো সেই আজব গোঙানি।

.

০৮.

চোখেমুখে রোদ লাগতে ঘুম ভাঙলো মুসার। চোখ মেলে তাকালো। অপরিচিত লাগলো ঘরটা। কোথায় রয়েছে? বাইরে ঘোড়া নাক টানলো, একটা গরু হাম্বা করে উঠলো। মনে পড়লো তার, হারভে র‍্যাঞ্চের দোতলায় একটা বেডরুমে শুয়েছে। ওপরের বাংক থেকে ঝুঁকে নিচে তাকালো, কিশোরের বাংকের দিকে। সে কি করছে দেখার জন্যে। গোয়েন্দাপ্রধান নেই।

এক লাফে উঠে বসতে গিয়ে ছাতে আথা ঠুকে গেল মুসার। উফ করে উঠলো।

ওধারের বাংক থেকে সাড়া দিলো রবিন। হাত তুলে জানালা দেখালো।

জানালার কাছে বুদ্ধদেবের মতো আসন করে বসেছে কিশোর, গায়ে ওরকমই একটা চাদর জড়ানো। তার সামনে মেঝেতে বিছানো কাগজের বড় একটা শীট, ওটার ওপর চারটে বই। পেন্সিল দিয়ে অনেকগুলো লাইন টেনেছে কাগজটাতে।

হাঁ করে চেয়ে রইলো মুসা। বুঝতে পারলো, বই দিয়ে মোনিং ভ্যালির একটা মডেল বানিয়েছে কিশোর। পেন্সিল দিয়ে এঁকেছে সুড়ঙ্গমুখ।

এক ঘন্টা ধরে বসে আছে ওভাবে, রবিন জানালো।

খাইছে! দশ মিনিটও পারবো না আমি! মাঝে মাঝে তাদের তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি। বন্ধুটির আচার-আচরণ খুবই অবাক করে মুসা আর রবিনকে।

ধ্যান ভাঙলো অবশেষে। কথা বললো কিশোর পাশা। গোঙানি উপত্যকার সঠিক টপোগ্রাফিকেল অ্যারেঞ্জমেন্ট নির্ণয়ের চেষ্টা করলাম। জায়গাটার ফিজিকাল প্যাটার্নের মধ্যেই রয়েছে রহস্যের চাবিকাঠি।

গ্রীক বললে!

ও বোঝাতে চাইলো, বুঝিয়ে দিলো রবিন। জায়গাটার গঠনের ওপর নির্ভর করছে রহস্যের সমাধান।

এরকম সহজ করে বললেই পারতো।

মুসার কথায় কান দিলো না কিশোর। গোঙানি উপত্যকার আসল রহস্য, আমরা ঢুকলেই কেন ওটার গোঙানি বন্ধ হয়ে যায়? কাল রাতে দুবার ঘটেছে। ঘটনাটা। অথচ আমরা ফেরার সময়ও আবার শুরু হলো, একটা খবরের কাগজ দেখালো। নতুন করে গোঙানি শুরু হওয়ার রিপোর্ট বেরিয়েছে এটাতে। শেরিফের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। শেরিফ বলেছেন, কারণটা জানা যাচ্ছে না তার আরেকটা কারণ, কেউ গুহায় ঢুকলেই নাকি ওই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। কাগজটা নামিয়ে, রাখতে রাখতে বললো, আমি এখনও শিওর, কাকতালীয় কোনো ব্যাপার নয় ওটা।

হয়তো তোমার অনুমানই ঠিক, রবিন বললো। এমনভাবে ঘটেছে, যেন। আমাদের ওপর কেউ চোখ রেখেছিলো।

তো, তোমার মডেল কিভাবে সাহায্য করছে আমাদের? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

বই দিয়ে বানানো মডেলটার দিকে তাকালো কিশোর। কাল রাতে যতো জায়গায় গিয়েছি, সবগুলো জায়গায় চিহ্ন দিয়েছি এখানে। দুবার দুদিক দিয়ে ঢুকেছি, দুবারই গোঙানি বন্ধ হয়ে গেছে। রবিন ঠিকই বললো, যেন আমাদের ওপর কেউ চোখ রেখেছিলো।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। আমরা ঢাকার আগেই দেখে ফেলছিলো আমাদের।

হ্যাঁ। আর এই মডেলটা বানিয়ে বুঝলাম, যতো জায়গায়ই গিয়েছি আমরা, আমাদের দেখেছে। ডেভিল মাউনটেইনের চূড়া থেকে।

তাহলে তো হয়েই গেল, বললো মুসা। মিস্টার হারভেকে গিয়ে বলবো একথা। চূড়া থেকে ধরে ফেলা হবে লোকটাকে।

না, মুসা, মাথা নাড়লো কিশোর। লোকটাকে ধরা এতো সহজ নয়। ওপর থেকে দেখে সে। ধরতে আসছে বুঝতে পারলেই পালাবে।

তাহলে…, শুরু করলো রবিন।

কিভাবে…, একই সময় বললো মুসা।

নজর রাখবো আমরা, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। গুহায় আসলে কি ঘটছে জানার চেষ্টা করবো। তারপর জানাবো সবাইকে।

গুহায় কি ঘটছে কিছুই জানি না আমরা, মুসা বললো। জানি?

না। তবে একটা প্ল্যান করেছি আমি। একটা সূত্র পেয়েছি।

 পেয়েছো? কি?

কাল রাতে গুহার ভেতর এটা পেয়েছি, বলে পাথরের টুকরোটা বের করে। দেখালো কিশোর। একসময় খুনিতে ঢোকার পথ ছিলো ওই সুড়ঙ্গ। পাথর পড়ে। যেখানে বন্ধ হয়েছে, ওখানে পেয়েছি।

বাংক থেকে নেমে গিয়ে পাথরটা হাতে নিলো রবি দেখলো। তুলে দিলো। মুসার হাতে।

কি এটা, কিশোর? মুসা বুঝতে পারছে না। আমার কাছে তো পিছলা একটা পাথর ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

জানালার কাঁচে ঘষা দাও ওটা দিয়ে।

কী? আরও অবাক মুসা। তাতে কি হবে…

দিয়েই দেখো না।

বাংক থেকে নেমে গিয়ে কাঁচে ঘষা দিলো মুসা। কেটে গেল কাঁচ। শিস দিয়ে উঠলো মুসা।

কিশোর! চেঁচিয়ে বললো রবিন। তারমানে…

হীরা, কথাটা শেষ করে দিলো কিশোর। হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়। আনকাট ডায়মণ্ড। বড় বটে, কিন্তু জাত ভালো নয়, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল স্টোন সম্ভবত। তবে এটা হীরা।

হেনরি ফিগারোর গুহাটা হীরার খনি? পাথরটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস। করতে পারছে না রবিন। এখানে, এই ক্যালিফোর্নিয়ায়?

গুজব তো রয়েছে। হয়তো…

বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর। দরজায় থাবা দিয়ে জোরে জোরে ডাকলেন। মিসেস হারভে, এই ছেলেরা, জলদি ওঠো। নাস্তা দেয়া হয়েছে।

খাবারের কথা শুনে পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। এতোক্ষণ বুঝতেই পারেনি। ওরা, কতোটা খিদে পেয়েছে। কাপড় পরে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এলো। র‍্যাঞ্চের বিরাট রান্নাঘরে। ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন মিস্টার হারভে আর প্রফেসর হারকসন।

বাহ্, মন্তব্য করলেন প্রফেসর। মোনিং ভ্যালির রহস্যও দেখি তোমাদের খিদে কমাতে পারেনি।

বড় বড় পাত্রে করে খাবার এনে রাখছেন মিসেস হারভে।

খাওয়া শুরু করলো ছেলেরা।

কাজটাজ করবে কিছু আজ? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার হারভে।

নিশ্চয় করবে, ওদের হয়ে জবাব দিলেন মিসেস হারভে। উত্তরের মাঠে যাবে না খড় কাটতে? ওদেরও নিয়ে যাও।

ভালো বলেছো। খড় কাটা শেষ হলে ম্যাভারিক জড়ো করবো. সাহায্য করতে পারবে।

র‍্যাঞ্চ জীবনের ওপর মোটামুটি পড়াশোনা আছে রবিনের। ম্যাভারিক মানে জানে। পশুর মূল পাল হতে সরে যাওয়া গরু ছাগল-ভেড়াকে বলে ম্যাভারিক।

তো, কাল রাতে সৈকতে কেমন লাগলো? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। কি কি দেখলে?

চমৎকার, জবাব দিলো কিশোর। এক আজব বুড়োর সঙ্গে দেখা হলো। নাম বললো ডিন মারটিন। লোকটা কে, স্যার?

ডিন মারটিন আর তার বন্ধু কার্ল বেইরি ছিলো প্রসপেকটরস, বললেন মিস্টার হারভে। যৌবনে সমস্ত পশ্চিম ছুঁড়ে বেরিয়েছে সোনা রূপা আর হীরার সন্ধানে।

অনেক বছর আগে, এখানে এসেছিলো দুজনে, মিসেস হারভে বললেন। তখন গুজব ছিলো, এই অঞ্চলে সোনা পাওয়া গিয়েছে। আসলে যায়নি, কিন্তু ডিন। আর কার্ল আশা ছাড়েনি। খোঁজ চালিয়েই যাচ্ছে। পর্বতের ঢালে একটা ছাউনি তুলে থাকে। তাদের ঘরে কারও যাওয়া পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে র‍্যাঞ্চের কাজকর্ম করে দিয়ে তার বিনিময়ে খাবার নেয় আমাদের কাছ থেকে।

এখানে ওদেরকে সবাই চেনে, জানালেন প্রফেসর।

অনেক গল্প জানে মারটিন, আর বলতেও পারে, হাসলেন মিস্টার হারভে। খেয়ালি লোক,গল্পগুলোও বেশির ভাগ বানানো কিংবা রঙ চটানো। যেমন, শুরুতেই বলবে, ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে ফাঁইট করেছিলো। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে।

মিথ্যে বলে? মুখ ভরতি খাবার চিবাতে চিবাতে বললো মুসা।

মিস্টার হারভে জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে পেছনের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলো ফোরম্যান ডেভিড কোহেন। থমথমে চেহারা। বললো, পেদ্রো পড়ে ছিলো মোনিং ভ্যালিতে।

পেদ্রো? উদ্বিগ্ন হলেন মিস্টার হারভে।

কাল রাতে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে। সারারাত ওখানেই পড়ে ছিলো।

 কেমন আছে ও? মিসেস হারভেও উদ্বিগ্ন হলেন।

ডাক্তার বললো ঠিক হয়ে যাবে। সানতা কারলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এখুনি যাচ্ছি দেখতে! লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন মিস্টার হারভে।

শ্রমিকেরা ভীষণ ভয় পেয়েছে, জানালো কোহেন। আরও দুজন বলেছিলো, এখানে আর কাজ করবে না। পেদ্রো বলেছে, মোনিং ভ্যালিতে নাকি কি নড়তে দেখে দেখার জন্যে যায়। হঠাৎ গোঙানি শুনে ভয় পেয়ে যায় ঘোড়াটা। পেদ্রোকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে ছুটে পালায়। সারা শরীর জখম হয়েছে বেচারার গোড়ালি মচকে গেছে।

পরস্পরের দিকে তাকালেন মিস্টার এবং মিসেস, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

কিশোর জিজ্ঞেস করলো, ঘোড়াটা কি কালো? রড়?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো ফোরম্যান। নাম ব্ল্যাকি। খুব ভালো জানোয়ার। আজ সকালে কোরালে ফিরেছে। একা। তখনই.পেদ্রোর খোঁজ শুরু করলাম।

কেন, কাল রাতে তোমরা ঘোড়াটাকে দেখেছিলে? তীক্ষ্ণ হলো মিস্টার হারভের দৃষ্টি।

হ্যাঁ, স্যার। পিঠে লোক ছিলো না।

র‍্যাঞ্চের নিয়ম জানো? আরোহী ছাড়া কোনো ঘোড়া দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে রিপোর্ট করতে হয়। তোমাদের তা-ই করা উচিত ছিলো। তাহলে কাল রাতেই পেদ্রোকে হাসপাতালে পাঠানো যেতো।

নিয়মটা জানতাম না, স্যার। তা-ও এসে জানাতাম, যদি খালি ঘোড়া দেখতাম। ওটার পেছনে একজন লোককে দৌড়ে যেতে দেখেছি। ভাবলাম, ওই লোকটাই বুঝি ঘোড়ার সওয়ারি। লম্বা, ডান গালে কাটা দাগ, চোখে পটি।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মিস্টার হারভে। ওরকম চেহারার কাউকে তো চিনি।

লম্বা, চোখে পট্টি? ভুরু কোঁচকালেন প্রফেসর। শুনে সুবিধের লোক মনে হচ্ছে না। তবে নিশ্চয় হেনরি ফিগারো নয়। ফিগারো লম্বা নয়, আর চোখে পট্টিও লাগাতো না।

দরজার দিকে এগোলেন মিস্টার হারভে। ডেভিড; শ্রমিকদের গিয়ে ঠাণ্ডা করো। পেদ্রোকে দেখে উত্তরের মাঠে চলে আসবো আমি। আর লোকটার কথাও জানিয়ে আসবো শেরিফকে।

স্যার, উঠে দাঁড়ালো কিশোর। শহরে গেলে আমাকেও নিয়ে যান। রকি বীচে যাবো।

কেন, কিশোর? মিসেস হারভে বললেন, আজই যাবে কেন? আর কটা। দিন থাকো না।

চলে আসবো আবার। আমাদের ডুবুরির পোশাকগুলো আনতে যাবো। কাল রাতে সৈকতের ওদিকে কয়েকটা স্পট দেখেছি। ভালো ভালো অনেক নমুনা পাওয়া যাবে, বুঝেছি। ইসকুলের ম্যারিন বায়োলজিতে ভালো নম্বর তুলতে পারবো।

হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে রবিন আর মুসা। ম্যারিন বায়োলজি ওন্দের বিষয় নয়। কিন্তু কিছু বললো না। কোনো কারণ ছাড়া যে মিথ্যে বলে না কিশোর, জানা হয়ে গেছে এতোদিনে।

কিন্তু রকি বীচে তো আজ যেতে পারবো না…

যেতে হবে না, স্যার। আমি বাসে চলে যাবো।

বেশ। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

রবিন আর মুসার দিকে চেয়ে হাসলেন মিসেস হারভে। পালের গোদাই তো চলে গেল। সময় কাটাবে কি করে? যে ঝামেলা বাধলো, মিস্টার হারভে আজ র‍্যাঞ্চের কাজ দেখানোর সময় পাবেন না।

দেখি, ব্যবস্থা একটা করে নেবো সময় কাটানোর, রবিন বললো।

দুই সহকারীকে ইশারা করে বেডরুমে চলে এলো কিশোর। রবিন আর মুসা। এলে বললো, আমি চলে গেলে তোমরাও সানতা কারলায় যাবে। বড় দেখে এক ডজন মোম কিনবে। আর তিনটে মেকসিকান সমব্রেরো হ্যাট। কোথায় যাচ্ছো। জানতে চাইলে মিসেস হারভেকে যা হোক একটা কিছু বলে দেবে।

হ্যাট দিয়ে কি হবে? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

দরকার আছে, এখন বলার সময় নেই। রবিন তারপর পাবলিক লাইব্রেরিতে যাবে। ডেভিল মাউনটেইন আর মোনিং ভ্যালির সমস্ত ইতিহাস জানার চেষ্টা করবে।

ঠিক আছে, জানলাম। কিন্তু তুমি রকি বীচে যাচ্ছো কেন?

বললাম না, স্কুবা ইকুইপমেন্ট আনতে। তোমাদেরগুলোও নিয়ে আসবো। আর লজ অ্যাঞ্জেলেসে গহনার দোকানে গিয়ে দেখিয়ে আনবো হীরাটা।

 নিচে থেকে ডাকলেন মিস্টার হারভে, কিশোর, তোমার হয়েছে?

দ্রুত নেমে এলো তিনজনে। পিকআপ ট্রাকে মিস্টার হারভের পাশে ব্যাগ নিয়ে উঠে বসলো কিশোর। ওর চলে যাওয়া দেখছে রবিন আর মুসা। ডুবুরির। পোশাক দিয়ে কি করবে গোয়েন্দাপ্রধান, কিছুই বুঝতে পারছে না দুজনে।

যেচে এসে রান্নাঘরে মিসেস হারভেকে সাহায্য করলো রবিন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মহিলাটি পটিয়ে তার লাইব্রেরি কার্ডটা ধার নিয়ে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে সাইকেল নিয়ে সানতা কারলায় চললো সে আর মুসা।

দেখো, সাবধানে যেও! পেছন থেকে ডেকে বললেন মিসেস হারভে।

 মহিলা সত্যি খুব ভালো, চলতে চলতে বললো মুসা।

হ্যাঁ, হাসলো রবিন। জোর করে খাবার তুলে দেন তো পাতে…

আরে না, সেজন্যে না। আসলেই ভালো…

 কথা বলতে বলতে চলেছে দুজনে। উপত্যকার ভেতর দিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে, কখনও বা দূর দিয়ে ঘুরে গেছে পথ। তিন দিক থেকে ঘিরে রয়েছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বাদামী পর্বতের সারি, আরেক ধারে সাগর। কড়া রোদ। সাগরের তীরে বাতাস বেশ ঠাণ্ডা, সরে গেলেই ভীষণ গরম। প্রতিটি পাহাড়ের চূড়া খটখটে শুকনো, আর্দ্রতার লেশমাত্র নেই। সানতা-কারলা নদীর ওপরে চওড়া ব্রীজ। নিচে নদীর বুকে শাদা বালি, পানি নেই। গরমে শুকিয়ে গেছে। ভেজা মৌসুমে কিছু কিছু তৃণলতা জন্মেছিলো, জীবন ধারণের প্রচণ্ড চেষ্টায় সেগুলো এখন ধুকছে।

ধীরে ধীরে উঠে চলেছে পথ। স্যান মেটিও গিরিপথে ঢুকলো ওরা। দুর্গম পথ, মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ মোড়। চালানোর চেয়ে সাইকেল ঠেলে নেয়া সহজ। তা-ই করলো দুজনে। বাঁয়ে পর্বতের খাড়া ঢাল, ডানে হাঁ করে রয়েছে যেন কালো। গিরিখাত। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য।

অনেকক্ষণ পর ঘামতে ঘামতে গিরিপথের বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা।

খাইছে! দেখো দেখো! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

থমকে দাঁড়ালো রবিন। বিপুল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।

এ-রকম দৃশ্য খুব কমই দেখেছে ওরা। ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে পর্বতের ঢাল, ছোট একটা পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে মিশেছে। তার ওপারে ছড়ানো তৃণভূমি, ঘন নীল প্রশান্ত মহাসাগরকে গিয়ে ছুঁয়েছে। এক ধারে সানতা কারলা শহর, ঝলমল করছে রোদে। দূর থেকে ঘরগুলোকে দেখাচ্ছে বিশাল এক সবুজ চাঁদরের মাঝে দেশলাইয়ের রঙিন বাক্সের মতো। সাগরের পানিতে নানারকম জাহাজ, নৌকা চলাচল করছে। আর, বহুদুরে, পার্বত্য চ্যানেল আইল্যাণ্ডস যেন ভেসে আছে। সাগরের ওপর।

 দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে দুজনে। পেছনে শোনা গেল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। প্রায় একই সঙ্গে ঘুরলো ওরা। জোরে ছুটে আসছে মস্ত এক কালো ঘোড়া। রূপার কাজ করা লাগাম, চ্যারো জিনটাতেও রূপার কাজ। জিনের ধাতব পোমেল হর্ন-এ রোদ চমকাচ্ছে।  

পাথর হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। পা নড়াতে পারছে না। ওদের দিকেই ছুটে আসছে ঘৌড়াটা। পিঠে আসীন ঘোড়সওয়ারের ছোট্ট শরীর, মাথায় কালো সমব্রেরো হ্যাট, কালো চোখের নিচে নাক-মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে, গায়ে কালো খাটো জ্যাকেট, পরনে কালো আঁটো প্যান্টের নিচের ঢোলা অংশ উড়ছে চকচকে বুটের ওপর। হাতের পুরনো পিস্তলটা তাক করে ধরেছে ছেলেদের দিকে।

হেনরি ফিগারো!

.

০৯.

অনেক দেরিতে আতঙ্কিত ছেলেদুটোকে চোখে পড়লো যেন ঘোড়াটার। হঠাৎ ব্রেক, কষে থামলো, সামনের দুই পা শূন্যে তুলে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়লো।

ঘোড়াটাকে সামলালো আরোহী। হাতের পিস্তল নাচিয়ে ছেলেদের বললো, ভিভা ফিয়েসতা! একটানে নামিয়ে দিলো মুখের কালো কাপড়। এক কিশোর, দুষ্টুমি ভরা চেহারা। ফিয়েসতা দেখতে এসেছো? এসো। বলেই ঘোড়ার লাগাম; ধরে টানলো। খটাখট করে চললো হাইওয়ে ধরে, সানতা কারলার দিকে।

কি বললো ব্যাটা? সেদিকে তাকিয়ে বললো মুসা।

 ভিভা ফিয়েস্তা। ওই তোমরা ঈদ মোবারক বলো না, অনেকটা ওরকম। আজ বোধহয় সানতা কারলায় ফিয়েসতা হচ্ছে। ভালোই হলো। অনেক দিন থেকে দেখার শখ।

ফিয়েসতার জন্যে ওরকম পোশাক পরেছে! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তাদেরই বয়েসী একটা ছেলে এভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে গেল, মেনে নিতে পারছে না।

ফিয়েসতায় গেলে ওরকম অন্তত আরও দশটা হেনরি ফিগারোকে দেখতে পাবে, বাজি ধরে বলতে পারি।

থাকুক। কোনো কানাগলিতে ওদের সামনে পড়তে চাই না আমি।

আবার সাইকেলে চাপলো ওরা। নেমে চললো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। প্যাডাল ঘোরানোর দরকারই পড়লো না। তীব্র গতিতে নেমে চলে এলো শহরের কিনারে। পাহাড় ওখানে শেষ।

 প্যাডাল করে চললো ওরা। দুধারে বাড়িঘর, গলফ খেলার মাঠ, বড় বড় সপিং সেন্টার।

 পথে একটা লোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, লাইব্রেরিটা শহরতলীতে। চলে এলো ওরা ওখানে। সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানে রেখে হেঁটে এগোলো সানতা কারলার প্রধান সড়ক ইউনিয়ন স্ট্রীট ধরে। বেশি দূর যেতে পারলো না। ব্যারিয়ার দিয়ে বুক করে দিয়েছে পুলিশ, ফিয়েসতা প্যারেডের জন্যে। ব্যারিয়ারের ওধারে ইতিমধ্যেই সারি দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে লোকে, প্যারেডে অংশ নিতে এসেছে যারা। বেশির ভাগেরই পরনে পুরনো আমলের স্প্যানিশ পোশাক, চোখ ধাঁধানো রঙ। আনন্দঘন পরিবেশ। ও তাড়াতাড়ি কেনাকাটা সেরে নিলো দুই গোয়েন্দা। পথের ধারে ছোট একটা দোকানেই পাওয়া গেল মোম আর খড়ের তৈরি সমব্রেরো হ্যাট। তারপর ছুটে এলো আবার পথের মোড়ে, ব্যারিয়ারের কাছে, প্যারেড দেখার জন্যে।

শুরু হলো প্যারেড। ধিড়িম ধিডিম বেজে উঠলো ড্রাম, সেই সাথে পাল্লা দিলো যেন ট্রাম্পেটের কড়া, মিষ্টি চিৎকার।

ব্যাণ্ডের পর এলো ফ্লোট। ফুলে ফুলে সাজানো। সুন্দরী মেয়েরা রয়েছে তাতে, আর নানারকম বিচিত্র পোশাক পরা পুরুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের এক অসাধারণ মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে ফ্লোটগুলোতে। প্রথম ফ্লোটটা তৈরি হয়েছে ফাদার জুনিপাররা সেরা-র সম্মানে। ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে পুরনো যতোগুলো চমৎকার মিশন রয়েছে, তার বেশির ভাগেরই প্রতিষ্ঠাতা এই মহৎ ফ্রানসিসকান মিশনারি। আরেকটাতে দেখানো হয়েছে, মেকসিকানদের কাছ থেকে সানতা কারলা দখলের পর সেখানে আমেরিকান পতাকা উত্তোলন করছেন জন, সি. ফ্রেমন্ট। আরেকটাতে রয়েছে হেনরি ফিগারো (এই রকম চরিত্রের একজন লোক সত্যি ছিলেন। তাঁর নাম জ্যাসপার ওরটেগা জেসাস ডি ডেলগাডো ওয়াই ক্যাবরিলো)। পাঁচজন সেজেছে হেনরি ফিগারোর সাজে, তার মাঝে সেই ছেলেটাকেও দেখতে পেলো দুই গোয়েন্দা, গিরিপথে যে তাদেরকে চমকে দিয়েছিলো।

এলো অশ্বারোহী মাউন্টেড পুলিশ বাহিনী। ঘোড়াগুলো অপূর্ব। ওরকম একটা ঘোড়ার মালিক হতে না পারায় আফসোস হলো মুসার। প্যালোমিনো জাতের, প্রায় সোনালি গায়ের রঙ, যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে শরীর থেকে।

তাদের পেছনে এলো পুরনো আমলের ঘোড়ায়-টানা গাড়ির বহর, ওয়াগন, স্টেজকোচ, এইসব। সব শেষের ফ্লোটটা গোল্ড রাশ (স্বর্ণ-সন্ধান) যুগের প্রতিচ্ছবি।

মুসার হাত খামচে ধরলো রবিন। দেখো দেখো।

পাশের দুজন লোককে দেখালো সে। একটা খচ্চরের পাশে হাটছে। জানোয়ারটার পিঠে চাপিয়েছে খাবার, বেলচা, গাঁইতি, আর খনি খোঁড়ার অন্যান্য সরঞ্জাম। দুজনের একজনকে চেনে ওরাঃ বুড়ো ডিন মারটিন।

আরেকজন নিশ্চয় তার দোস্ত, মুসা বললো। কার্ল বেইরি।

এই ফ্লোটটা দেখে বেশ মজা পেলো জনতা। এমনভাবে সেজেছে মারটিন আর বেইরি, একেবারে আসল প্রসপেকটরের মতো দেখাচ্ছে। খনিতে কাজ করার উপযোগী.পুরনো পোশাকে বালি লেগে রয়েছে, যেন এই মাত্র বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে। মাথা উঁচু করে আগে আগে হাঁটছে মারটিন, সামান্য খোঁড়াচ্ছে, বাতাসে উড়ছে তার শাদা লম্বা দাড়ি। পেছনে বেইরি। লম্বা, রোগাটে, বয়স মারটিনের। মতোই, তবে দাড়ির বদলে তার রয়েছে শাদা মস্ত গোঁফ। 

ব্যাণ্ড বাজছে, ফ্লোট চলেছে শহরের প্রধান সড়ক ধরে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে জনতা। হাসি-আনন্দে মুখর। এতোই তন্ময় হয়ে দেখছে দুই গোয়েন্দা, লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথাই ভুলে গেল। একটা লোকের ওপর চোখ পড়তে চমকে উঠলো মুসা। ফিসফিস করে বললো, রবিন!

রবিনও দেখলো। কয়েক ফুট দূরে সেই লোকটা। লম্বা, গালে কাটা দাগ, চোখের ওপর পট্টি। প্যারেডে মনোযোগ নেই তার। উসখুস করছে। তারপর যেই একটু ফাঁক পেলো, ইউনিয়ন স্ট্রীট পেরিয়ে দ্রুত চলে গেল ওপাশে।

এসো, বলেই তার পেছনে ছুটলো রবিন।

বিশ ফুট দূরে দেখা গেল লোকটাকে। দ্রুতপায়ে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থেমে সামনের কি যেন দেখছে।

কারও কিছু নিয়েছে, রবিন বললো।

কার?

দেখছি না। তুমি দেখছো কাউকে?

চোখের ওপর হাত এনে রোদ আড়াল করে, মাথা উঁচু করে দেখলো মুসা।, কাউকে দেখছি না।

লাইব্রেরির চত্বরে পৌঁছলো লোকটা। দরজার দিকে এগোলো।

ওখানে ঢুকছে কেন? অবাক হলো রবিন।

উঁচু ডাবল ডোর দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। পেছনে ছুটে গেল ছেলেরা। ভেতরে ঢুকেই থেমে গেল ফিয়েসতার দিনে আজ লাইব্রেরি প্রায় নির্জন। অথচ লোকটাকে চোখে পড়লো না।

বিরাট হলঘর। অসংখ্য বুকশেলফের মাঝে মাঝে হাঁটাচলার জন্যে ফাঁক.। ওখানে সেই লোকটা। বাইরে বেরোনোর দুটো দরজা দিয়েই বেরিয়ে দেখলো ওরা। দুটো গলি, কোনোটাতেই দেখা গেল না লোকটাকে।

পালিয়েছে, হতাশ হয়ে বললো মুসা।

আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমাদের। তাহলে একজন পেছন দিয়ে যেতে পারতাম, আরেকজন সামনে দিয়ে।

চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। এখন আর ভেবে লাভ নেই। চলো, তোমার রিসার্চ সেরে নাও।

আবার লাইব্রেরিতে ঢুকলো দুজনে। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো রবিন, লোকাল হিস্টরির বইগুলো কোনখানে পাওয়া যাবে। হলের পাশের ছোট একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন মহিলা। জানালেন, ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের ওপর স্পেশাল কিছু বইও আছে ওখানে।

ছোট ঘরটায় সবে ঢুকেছে দুজনে, একটা হাত পড়লো মুসার কাঁধে। বাহ, আমাদের গোয়েন্দারা দেখছি!

পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর হারকসন। ভারি পাওয়ারের কাঁচের ওপাশে একটা চোখ টিপলেন। বিশেষ কিছু জানতে এসেছো?

হ্যাঁ, স্যার, জবাব দিলো মুসা। মোনিং ভ্যালি সম্পর্কে।

গুড, গুড, উৎসাহ দিলেন প্রফেসর। আমিও সেজন্যেই এসেছি। সুবিধে হলো না। সত্যিকার ইতিহাস বলতে কিছু নেই, অধিকাংশই উপকথা, রূপকথা কিংবা কিংবদন্তী। …তারপর, ফিয়েসতায় গিয়েছিলে?

গিয়েছিলাম! যা সুন্দর সুন্দর ঘোড়া না?

অতি চমৎকার একটা উৎসব।…যাই। এখানে বসে থেকে আর লাভ নেই। তা, যাচ্ছ কিভাবে?

সাইকেল নিয়ে এসেছি, স্যার, রবিন জানালো।

 বেশ। দেখা হবে, চলি, বলে ঘুরলেন প্রফেসর।

স্যার? এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো রবিন, একটা লোককে দেখেছেন? চোখে কালো পট্টি?

মাথা নাড়লেন প্রফেসর। না তো। কাল রাতে যাকে দেখেছিলে?

হ্যাঁ, মুসা বললো।

এখানে, এই শহরে? চিন্তিত মনে হলো প্রফেসরকে। না, দেখিনি।

প্রফেসর বেরিয়ে গেলে, কাজে বসলো দুই গোয়েন্দা। গোটা চারেক বই পেলো, যেগুলোতে মোনিং ভ্যালির উল্লেখ আছে। তবে নতুন কিছু জানা গেল না। শেষে ছোট আরেকটা বই খুঁজে পেলো রবিন। পাতাগুলো, হলদে হয়ে এসেছে, কুঁচকানো। তাতে রয়েছে উপত্যকাটার পুরো ইতিহাস, একেবারে ১৯৪১ সাল। পর্যন্ত। ভুল তাকে ভুল জায়গায় ছিলো বইটা, সে-কারণেই বোধহয় খুঁজে পাননি প্রফেসর।

মিসেস হারভের কার্ড দেখিয়ে বইটা ধার নিলো রবিন। বাইরে বিকেলের রোদ তখনও বেশ চড়া, প্যারেড মাত্র. শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে লোকেরা। মোম, বই আর হ্যাঁটের প্যাকেট সাইকেলের ক্যারিয়ারে রেখে চড়ে বসলো দুই গোয়েন্দা। র‍্যাঞ্চে ফিরে চললো।

নামার সময় তো আরামেই নেমেছে, ওঠার সময় কষ্ট হলো। শেষে গিরিপথের কাছাকাছি এসে আর পারলো না। সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগলো।

কিছুদূর উঠে বিশ্রাম নিতে বসলো। তাকালো চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এর দিকে। আলো কম। দূরে এখন আবছা দেখা যাচ্ছে দ্বীপগুলো।

ইস, যদি যেতে পারতাম ওখানে! মুসা বললো।

 শুনেছি, ওখানেও তৃণভূমি আছে। কাউবয়েরা গরু চরায়।

দ্বীপের কিনারে নোঙর করে আছে নেভির নৌ-বহর।

সানতা কারলার দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। শব্দ কানে এলো ছেলেদের, ফিরলো না, ওরা তাকিয়ে রয়েছে সাগরের দিকে। হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলো। প্রচণ্ড গতিতে আসছে গাড়িটা।

লাফিয়ে উঠে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো দুজনে। গাড়ির দুই চাকা রাস্তায়, দুই চাকা রাস্তার বাইরে। সোজা তাদের দিকেই আসছে।

এক ধাক্কায় রবিনকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও সরে গেল মুসা। ধাঁ করে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল গাড়িটা, নাক ঘুরিয়ে উঠে পড়লো রাস্তায়। চলে যাচ্ছে।

গা বাঁচাতে গিয়ে বেশি সরে গেছে দুজনে। ঢালের কিনারে। তাল সামলাতে পারলো না। পিছলে, গড়িয়ে পড়তে লাগলো ঢাল বেয়ে। নিচে গভীর খাদ।

.

১০.

গড়িয়ে পড়ছে মুসা। চোখা পাথর আর কাঁটাগাছে লেগে কেটেছিলে যাচ্ছে চামড়া। পাগলের মতো থাবা মারছে, আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে গাছের গোড়া, পাথর। হাত পিছলে যাচ্ছে। গাছ যেটাও বা ধরতে পারছে, তার ভর রাখার মতো শক্ত নয়, উপড়ে যাচ্ছে। আর ফুট চারেক পরেই ঢাল শেষ, তার পরে শূন্যতা। বাঁকা হয়ে থাকা বড় একটা গাছের ওপর আছড়ে পড়লো সে, সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো গাছের কাণ্ড। হউফ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত গাছ ধরে ঝুলে রইলো সে। জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তারপর লক্ষ্য করলো, সে একা। চেঁচিয়ে ডাকলো, রবিন!

সাড়া নেই। নিচে নিঃসীম কালো খাদ হাঁ করে রয়েছে।

রবিন! আরও জোরে ডাকলো।

বাঁয়ে মৃদু নড়াচড়া। ঘন ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি দিলো রবিনের মুখ। আমি..আমি ভালোই আছি। দুর্বল কণ্ঠস্বর। কার্নিশের মতো বেরিয়ে আছে…কিন্তু পা নাড়াতে পারছি না!

চেষ্টা করো। খুব আস্তে।

অপেক্ষা করছে মুসা।

নড়ছে ঝোপটা। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, হ্যাঁ, পারছি এবার। ভাঙেনি। গায়ের নিচে বেকায়দা ভাবে চাপা পড়েছিলো। ব্যথা করছে খুব।

ক্রল করে উঠতে পারবে?

জানি না। ওপর দিকে তাকাতেই ভয় লাগছে, যা খাড়া!

পড়লে একেবারে… কেঁপে উঠলো মুসার গলা, কথাটা শেষ হলো না।

চেঁচালে কেমন হয়? কেউ না কেউ শুনতে পাবে।

শুরু করো। কিন্তু চিৎকার, বেরোলো না মুসার গলা দিয়ে, শুধু খসখস শব্দ। আসলে চিৎকার করলোই না। সবে মুখ খুলেছে, এই সময় ওপরে ঢালের কিনারে দেখতে পেলো একটা মুখ। নিচে উঁকি মারছে। গালে কাটা দাগ, চোখে পট্টি।

পুরো দশ সেকেণ্ড চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো দুজনে। তারপর সরে গেল। মুখটা। দৌড়ে যাওয়া পদশব্দ, গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার আওয়াজ, মেটাল। বাধানো পথে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। চলে গেল গাড়িটা।

ওটার এঞ্জিনের আওয়াজ মিলাতে না মিলাতেই অন্য গাড়ির শব্দ শোনা গেল।

চেঁচাও! বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলো মুসা।

পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হলো দুজনের চিৎকার। ওপরে ব্রেক কষার শব্দ হলো। ভারি জুতোর আওয়াজ। দুটো মুখ উঁকি দিলো ঢালের কিনারে।

খানিক পরেই নেমে এলো মোটা দড়ি। কোমরে কয়েক প্যাঁচ দিয়ে মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখলো মুসা। টেনে ওপরে তুলে নেয়া হলো তাকে।

রবিনও উঠে এলো। ভাঙা পা-টা দেখলো ভালো করে। মনে হলো, চমকেছে। দড়ি ফেলেছে যে লোকটা, সে ট্রাক ড্রাইভার। জানালো, হারভে র‍্যাঞ্চের দিকেই যাচ্ছে। ছেলেরা কোথায় যাবে শুনে নিজে থেকেই লিফট দেয়ার কথা। বললো। মিনিট পনেরো পরে সাইকেল সহ র‍্যাঞ্চের গেটে নামিয়ে দিয়ে গেল তাদেরকে। ড্রাইভারকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে, হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা।

ঘর থেকে বেরিয়ে দুজনকে দেখে থমকে গেলেন মিসেস হারভে। সর্বনাশ! কি হয়েছে? এরকম অবস্থা কেন?

বলতে গিয়ে পায়ে রবিনের আলতো লাথি খেয়ে চুপ হয়ে গেল গলা।

বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়েছি, রবিন বললো। ঢলে গড়িয়ে পড়লাম, গিরিপথের কাছে। পায়ে ব্যথা পেয়েছি। একজন ট্রাক ড্রাইভার তুলে এনে নামিয়ে দিয়ে গেল।

দেখি, পা-টা? এগিয়ে এলেন মিসেস হারভে।

র‍্যাঞ্চের মহিলারা সাধারণত নার্সিঙের কাজে ওস্তাদ, এসব শিখতে হয়। তাদের। মিসেস হারভেও ব্যতিক্রম নন। টিপেটুপে দেখে বললেন, সামান্য মচকেছে। ডাক্তার কিংবা ওষুধ লাগবে না, তবে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে রবিনকে। বারান্দায় একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দিয়ে গিয়ে লেমোনেড নিয়ে এলেন।

মুসা আমান, তুমি কাজ করতে যাও, বললেন তিনি। মিস্টার হারভে এখনও ফেরেননি। সামনের কোরালের ঘোড়াগুলোকে খড় খাওয়াও গিয়ে।

যাচ্ছি।

চেয়ারে পা তুলে দিয়ে, আরাম করে ছায়ায় বসে লেমোনেড খেতে খেতে মুসার দিকে চেয়ে হাসছে রবিন। রোদের মধ্যে কাজ করে ঘেমে সারা হচ্ছে গোয়েন্দাসহকারী। রবিনের হাসি দেখলো, কিন্তু মন খারাপ করলো না। কাজ করতে ভালোই লাগছে তার। পেশীতে জোর বাড়ছে।

সাপারের আগে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের পুরনো ট্রাকটা এসে থামলো র‍্যাঞ্চ হাউসের বাইরে। ড্রাইভিং সীটে বোরিস, পাশে বসে আছে কিশোর। নামলো সে। মালপত্র নামাতে তাকে সাহায্য করলো মুসা। স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো ছাড়াও ছোট আরেকটা রহস্যময় প্যাকেট রয়েছে, ভেতরে কি বুঝতে পারলো না সে। গোলাঘরে রাখা হলো মালগুলো।

বোরিস না খেয়ে যেতে পারবে না, বলে দিলেন মিসেস হারভে।

বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান লোকটার চওড়া কাঁধ আর হাতের পেশীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালেন মিস্টার হারভে। ভাবলেন, এরকম একজন লোক র‍্যাঞ্চে থাকলে খুব সাহায্য হতো।

র‍্যাঞ্চে কাজ করতে আপনার কেমন লাগে, বোরিস? জিজ্ঞেস করলেন। তিনি। আপনাকে পেলে দশজনকে ছেড়ে দিতে পারতাম।

আপনাদের লোক দরকার, কিশোর গিয়ে বলেছে, জানালো বোরিস। কয়েক হপ্তার জন্যে আমাকে, আর আমার ভাই রোভারকে এখানে কাজ করতে দিতে রাজি আছেন মিস্টার রাশেদ পাশা।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে মিস্টার হারভে বললেন, তার বোধহয় দরকার হবে না। গোলমালটা সাময়িক, শীঘ্রি সব ঠিক হয়ে যাবে। পেদ্রো বলেছে সে ভয় পায়নি। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে শ্রমিকদের বোঝাবে বলে দিয়েছে।

তাই বলেছে বুঝি? খুব ভালো, বললেন মিসেস হারভে।

মুখ কালো করে ফেললেন মিস্টার হারভে। কিন্তু ওর ফিরতে সময় লাগবে। আর এর মাঝে আবার কোনো অঘটন ঘটে গেলে কাউকে রাখা যাবে না। শেরিফও কিছু করতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেনরি ফিগারোর কোনো ছেলেটেলে ছিলো না। পট্টিওয়ালা লোকটা কে, তা-ও জানতে পারেনি।

এতো উতলা হচ্ছো কেন? সান্ত্বনা দিলেন প্রফেসর। ব্যাখ্যা একটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আসল কারণটা জেনে ওদেরকে জানাতে পারলেই ভয় দূর হয়ে যাবে। টাইম লাগবে আরকি; এই যা।

জানা যে যাবে, এ-ব্যাপারে শিওর হতে পারলেও হতো, বললেন মিস্টার হারভে।

আলোচনা চললো।

 খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়ে ট্রাকে গিয়ে উঠলো বোরিস।

প্রফেসরও বেরোলেন। ইউনিভারসিটিতে যাবেন, একটা ক্লাস নিতে হবে। মিস্টার হারভের অনেক কাজ জমে রয়েছে র‍্যাঞ্চে। তিনিও গেলেন।

তিন গোয়েন্দা চলে এলো নিজেদের বেডরুমে।

 দরজা বন্ধ করলো রবিন।

এখন কি করা? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

পাথরটা কি হীরা? জানতে চাইলো রবিন।

হাসলো কিশোর। হীরাই। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মণ্ড। দাম খুবই কম। কোথায় পেয়েছি শুনে চোখ কপালে তুললল লস অ্যাঞ্জেলেসের এক ডায়মণ্ড এক্সপার্ট।

বিশ্বাসই করতে চায় না। ওর ধারণা, ওটা আফ্রিকান পাথর। কয়েকটা টেস্ট করবে। রেখে দিয়েছে পাথরটা। বলেছে, টেস্ট সেরেই এখানে ফোন করবে।

খাইছে!

মোম আর হ্যাট এনেছো?

এনেছি, বললো মুসা।

আর মোনিং ভ্যালির ওপরে লেখা একটা বই, রবিন বললো।

সানতা কারলায় যাওয়ার শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা কিশোরকে জানালো। দুজনে।

গাড়িটার নম্বর দেখেছো?

সময় পেলাম কোথায়? মুসা বললো। তবে নম্বর প্লেটটা দেখেছি এক পলক, নীল আর শাদা।

হুমম। মনে হচ্ছে নেভাডার রেজিস্ট্রেশন। গাল-কাটা লোকটা এসে তাকিয়েছিলো তোমার দিকে, না?

আমরা মরেছি কিনা দেখতে এসেছিলো হারামজাদা, রেগে গেল মুসা। মেরে ফেলতো। অন্যান্য গাড়ি আসতে দেখে পালিয়েছে।

হয়তো নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। শহরে প্রফেসরের সঙ্গেও দেখা হয়েছে, না?

ডিন মারটিন আর কার্ল বেইরির সঙ্গেও। তিনজনই গিয়েছিলো, রবিন মনে করিয়ে দিলো।

গিরিপথটা এখান থেকে দূরে নয়, যুক্তি দেখালো কিশোর। র‍্যাঞ্চের কেউ গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারে, তাতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না।

তা ঠিক।

তবু, নেভাডার লাইসেন্স প্লেট, আরেকবার ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। এখানে কারও গাড়ি…সবারই ক্যালিফোর্নিয়ার রেজিস্ট্রেশন।

আমাদের অচেনা কারও কথা বলছো? মুসার প্রশ্ন।

হতেও পারে, বললো রবিন। পট্টিওয়ালাকেই তো আমরা চিনি না।

হু, মাথা দোলালো কিশোর। চলো, কাজ শুরু করি। আমি চট করে বইটা উল্টে নিই। তোমরা গিয়ে স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো চেক করো। ট্যাংকগুলো কোনো কিছুতেই জড়িয়ে নেবে, যাতে দেখে কেউ চিনতে না পারে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলে নিও। মোমের প্যাকেট, হ্যাট, আর আমি যে পোঁটলাটা এনেছি, ওটাও নিও।

তোমার উদ্দেশ্যটা কি?

যেতে যেতে বলবো। হাতঘড়ি দেখলো কিশোর। জলদি করতে হবে। নইলে সূর্য ডোবার আগে মোনিং ভ্যালিতে পৌঁছুতে পারবো না। আজ রাতেই হয়তো রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারবো।

আধঘন্টা পর গোলাঘরে ঢুকলো কিশোর। হাতের বইটা নাড়লো। জবাব বোধহয় পেয়েছি, ঘোষণা করলো সে। এতে বলছে, পঞ্চাশ বছর আগে ডেভিল মাউনটেইনে খনির বেশির ভাগ শ্যাফট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সোনাদানা কিছু। পায়নি, তাই বন্ধ করেছে। সেই সময়ই বন্ধ হয়ে যায় গোঙানি।

তারমানে ওগুলোর কোনোটা নতুন করে ভোলা হয়েছে? রবিন বললো। আর ওটা দিয়ে বাতাস পাস করে বলেই শব্দ হয়।

সে-রকমই তো মনে হয়। তবে প্রশ্ন আছে। যাকগে, তোমরা রেডি?

রেডি, বললো মুসা।

 বেশ। হ্যাট পরো। আমাকে একটা দাও। পরে এখান থেকে বেরোবো।

চটের বস্তায় ট্যাংকগুলো জড়িয়ে নিয়েছে। হ্যাট পরে মালপত্র নিয়ে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। সাইকেলে চাপলো। ক্যারিয়ারে ভারি বোঝা, ঝাঁকুনি লাগলেই মাতালের মতো টলছে, বেশ কায়দা করে ব্যালান্স রাখতে হচ্ছে। সাবধানে হ্যাণ্ডেল ধরে রেখে প্যাডাল ঘোরালো ওরা।

ব্যথায় আঁউক করে উঠলো রবিন।

কি হলো? পায়ে খুব লাগছে? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। কিশোর, তোমরা যাও। আমি বোধহয় পারবো না। থেকেই যাই।

চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো কিশোর। না থাকতে হবে না, রবিন। তোমার ওই মচকানো পা সুবিধেই করে দিলো। ফাঁকি দেয়া সহজ হবে।

ফাঁকি? ভুরু কোঁচকানো মুসা।

ওই যে মিলিটারি ক্লাসিক পদ্ধতিঃ ক্যাম্পের আগুন আর গাছের কাণ্ড, দেখতে লাগে কামানের মতো, খুব সহজ ব্যাখ্যা দিলো কিশোর, যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না মুসা। রবিন, তোমার ইকুইপমেন্ট খুলে রেখে এসো। বোঝ না থাকলে সাইকেল চালাতে কষ্ট হবে না।

চেষ্টা করে দেখলো রবিন। চালাতে পারলো। গেটের দিকে এগোলো তিনজনে। বারান্দা থেকে হাত নাড়লেন মিসেস হারভে। বেশি দেরি করো না কিন্তু। সাবধান থেকো।

র‍্যাঞ্চের বাইরে এসেই মুখ ঘোরালো ওরা, মোনিং ভ্যালির দিকে চললল। সেই লোহার গেটটার কাছে পৌঁছে থামলো। সাইকেল আর মালপত্র লুকানো ঘন ঝোপের ভেতরে।

শোনো, কিশোর বললো। গুহায় ঢুকবো আমরা। এমনভাবে, যাতে কেউ দেখে না ফেলে।

বুঝলাম, কান চুলকালো মুসা। গোঙানি-ব্যাটাকে অবাক করে দেবো।

ঠিক। আমার ধারণা, এই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছে আমাদের ওপর।

 কি করে ফাঁকি দেবো ওকে? রবিনের প্রশ্ন।  

পানির নিচ দিয়ে যাবো। ইকুইপমেন্টগুলো কেন আনলাম? হিসেব করে দেখেছি, এখন জোয়ার। সৈকত আর গুহামুখটা পানির তলায়।

 তাতে কি ওরা দেখবে না?

দাঁত বের করে হাসলো গোয়েন্দাপ্রধান। ডিকয় পদ্ধতির নাম শুনেছো? তা-ই ব্যবহার করবো। আর্মিরা ব্যবহার করে। রাতে ক্যাম্পের আগুন জ্বেলে রেখে অন্ধকারে চুপি চুপি কেটে পড়ে।

তোমার কথাবার্তা..

মুসাকে কথা শেষ করতে দিলো না কিশোর। ডেভিল মাউনটেইনের চূড়ায় বসে বাঁ-দিকের পথের নিচের অংশ দেখা যায় না, বুঝতে পেরেছি। ওখান দিয়েই নামবো।

 গেট ডিঙালো ওরা। তারপর বাঁয়ের পথ ধরে চললো। চূড়াটা চোখের আড়াল হতেই বললো কিশোর, থামো। কাঁধ থেকে বোঝা নামালো। খুলতে শুরু করলো রহস্যময় পোঁটলাটা।

আরি! এ-তো দেখি খালি পুরনো কাপড়? মুসা বললো।

এরকম কাপড়ই তো পরে আছি আমরা! রবিনও অবাক।

সে-জন্যেই তো এনেছি। ভেতরে লতাপাতা ঢুকিয়ে মানুষ বানাবো। নাও, শুরু করো। তারপর শুইয়ে রাখবো।

দেখতে দেখতে দুটো ডামি তৈরি হয়ে গেল। মুসা আর কিশোরের

গলার ওপর সমব্রেরো ফেলে রাখলে মনে হবে মাথায় পরেছে! ধীরে ধীরে। বুঝতে পারছে মুসা।

হ্যাঁ, বললো কিশোর। দূরে, পাহাড়ের চূড়া থেকে তা-ই মনে হবে। রবিন। থাকছে এখানে। মাঝেসাঝে নড়াচড়া করবে। ওখান থেকে যে চোখ রাখছে, সে ভাববে আমরাই। সন্দেহ করবে না।

ডামিগুলো পথের ওপর রাখা হলো। পাশে বসে রইলো রবিন। পর্বতের চূড়া থেকে যে-ই থাকুক, মনে করবে, তিনিটে ছেলে ঢালের কিনারে হেলান দিয়ে বসে সাগর দেখছে।

ঢালের আড়ালে থেকে সরু পথ বেয়ে নিচের সৈকতে নামতে লাগলো, কিশোর আর মুসা। নিচে একটা সুবিধেজনক জায়গায় এসে ডুবুরির পোশাক পরে নিলো। পিঠে বাঁধলো এয়ার-ট্যাংক।

ঢেউয়ের জোর আজ কম, বললো কিশোর। সাঁতরাতে সুবিধেই হবে। আমাদের।

পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না, বললো দক্ষ সাঁতারু মুসা। ডুবুরির পোশাক পরে পানির তলায় ডুব দেয়া তার ভারি পছন্দ।

আমার আরেকটু বেশি লাগতে পারে।

এখন কথা হলো, নিচ দিয়ে পুরোটা পথ যাওয়া যাবে কিনা।

অসুবিধে নেই। ভেসে উঠবো। ডিকয় সাজিয়ে দিয়ে এসেছি। এদিকে নজর রাখার কথা ভাববে না কেউ।

ব্রীদিং টিউব ঠিক করে, মুখে মাউথপীস এঁটে পানির দিকে চললো ওরা। পানিতে নেমে হারিয়ে গেল ঢেউয়ের তলায়।

১১.

কব্জিতে বাঁধা কম্পাস দেখে দেখে এগিয়ে চলেছে কিশোর। পেছনে মুসা। শুধু সাঁতরানো ছাড়া আর কিছু করতে হচ্ছে না তাকে, ফলে পাথরের খাঁজে, আশেপাশে সাগর-জীবনের ওপর নজর দিতে পারছে।

ছুটাছুটি করছে নানারকম মাছ। একটা হ্যাঁলিবাট, পাথরের রঙের সঙ্গে মিশে ছিলো। মুসা দেখতে পায়নি। প্রায় হাত দিয়ে ফেলেছে পাথরে, এই সময় ছিটকে উঠলো মাছটা, চমকে দিলো তাকে। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে সাঁতরে চলে গেল।

 মিনিট দুই পর থেমে মুখ ফেরালো কিশোর। ইশারায় হাতঘড়ি দেখিয়ে, গুহার দিকে দেখালো। বুঝলো মুসা। তার মানে এবার গুহার দিকে ফেরার নির্দেশ দিচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান।

আবার আগে চললো কিশোর। তার একেবারে গায়ের কাছে রয়েছে মুসা। তাই, কিশোর যখন হঠাৎ থেমে গেল, তার পায়ের ওপর এসে ধাক্কা খেলো সে।

অবাক হয়েছে মুসা। মাউথপীসের মধ্যেই গুঙিয়ে উঠলো। কেন ওভাবে থেমে গেল কিশোর? ইশারায় বাঁয়ে দেখালো গোয়েন্দাপ্রধান।

কিশোরের হঠাৎ থেমে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো মুসা। বড় জোর তিরিশ ফুট দূরে কালো কি যেন একটা নড়ছে। বড়, লম্বা, কালো একটা সিগারের মতো দেখতে। হাঙর হতে পারে, কিংবা খুনী তিমি।

ধক করে উঠলো মুসার বুক। তবে ঘাবড়ালো না। ড্রাইভিঙের বিশেষ ট্রেনিং রয়েছে ওদের, দক্ষ ওস্তাদের কাছে শিক্ষা নিয়েছে। হাঙর হলে কি করতে হবে জানা আছে। অস্বাভাবিক যে কোনো নড়াচড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাঙরের, দেখতে ছুটে আসে। ছুরি বের করলো দুজনেই। যতোটা সম্ভব কম নড়াচড়া করে সরে যেতে লাগলো পাথরের কাছে, নিরাপদ কোনো খাজ দেখলে তার মধ্যে ঢুকে যাবে।

ছায়াটার ওপর থেকে ক্ষণিকের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না মুসা। না, হাঙর বলে তো মনে হচ্ছে না? পেট মোচড়ানি নেই, শরীরের কোথাও সামান্যতম বাঁকা হচ্ছে না, সোজাসুজি এগিয়ে চলেছে। সাধারণ হাঙরের তুলনায় বড়। আবার খুনী তিমির চেয়ে ছোট।

 মুসার কাঁধ ছুঁয়ে ইঙ্গিতে হাঙর কিনা জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মাথা নাড়লো, মুসা। দুজনেই দেখলো, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ছায়াটা, মিলিয়ে গেল গভীর পানির দিকে।

আবার সাঁতরে চললো দুজনে। পানির নিচে পাথরের ছড়াছড়ি আর ঢেউই বলে দিলো ওদেরকে, পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে গেছে। সাবধানে ভেসে উঠলো। মাত্র কয়েক ফুট দূরে সুড়ঙ্গমুখটা।

মাউথপীস খুলেই আগে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, কি ছিলো ওটা?

বুঝলাম না। হাঙর না, তিমি না, কোনো জীবের মতোই লাগলো না। কিশোর, আমার ভয় লাগছে। গিয়ে বোধহয় শেরিফকে সব জানানো উচিত।

 ভয় কি? ছায়াটা তো চলেই গেছে। দুজনেই যখন দেখেছি, চোখের ভুল। হতে পারে না। আর চোখের ভুল যখন নয়, ওটা ভূতপ্রেতও কিছু নয়।

কিন্তু…, বলতে দ্বিধা করছে মুসা।

দেখো, বোঝালো কিশোর। এতোটা এসে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয়, না। দড়ি বেঁধে নিলো কোমরে। একটা মাথা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ধরে রাখো। আমি ঢুকছি।

ডুব দিলো আবার কিশোর।

সূর্য ডোবে ডোবে। গোধূলির ছায়া নামছে। দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো মুসা। দুটো হ্যাঁচকা টান পড়তেই মুখে মাউথপীস লাগিয়ে সে-ও ডুব দিয়ে এগিয়ে গেল। কালো মুখটার দিকে।

 ঢেউ কম, ফলে ফেনাও কম। স্রোত নেই। ওয়াটারপ্রুফ ফ্ল্যাশলাইট জ্বাললো সে। ঢুকে পড়লো সুড়ঙ্গে। হাত-পায়ে ভর দিয়ে এগোনোর চেয়ে সাঁতরে চলা অনেক সহজ। দ্রুত কমে আসছে পানির গভীরতা। চওড়া জায়গাটায় চলে এলো, যেখান থেকে বাঁকা হয়ে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে চলে এলো মুসা। বড় গুহাটায় ঢুকলো দুজনে।

গোঙানি শোনা গেল।

হাসি ফুটলো গোয়েন্দাপ্রধানের মুখে। গুহার ভেতরে ঢুকে গেছে ওরা, অথচ গোঙানি বন্ধ হয়নি।

খাইছে! ফিসফিস করে বললো মুসা। ফাঁকিটা ঠিকই দিয়ে দিলাম। ঢুকতে দেখেনি আমাদের।

তাই তো মনে হচ্ছে।

দ্রুতহাতে ডুবুরির পোশাক খুলে ফেললো দুজনে। পানি নিরোধক বাক্স থেকে মোম আর দেশলাই বের করে দুটো মোমবাতি ধরালো কিশোর। একটা দিলো মুসার হাতে। বললো, প্রতিটা সুড়ঙ্গের মুখের কাছে ধরবো এগুলো। শিখা যদি কাঁপে, বা কাত হয়ে যায়, বুঝবো বাতাস বইছে। আর না নড়লে বইছে না, তারমানে ওই সুড়ঙ্গ বন্ধ। সেটাতে ঢুকুবোই না। অনেক সময় বাঁচবে তাতে।

দারুণ বুদ্ধি করেছো!

একে একে সুড়ঙ্গমুখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলো ওরা। একটা মুখের কাছে। বাতি ধরতে সামান্য কাঁপলো শিখা। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলো না কিশোর। সরে এলো আরেকটা মুখের কাছে।

হঠাৎ একটা মুখের কাছে বাতি ধরতেই টান মেরে যেন শিখাটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিতে চাইলো অদৃশ্য শক্তি, নিভেই গেল বাতিটা।

পেয়েছি, কিশোর! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

আস্তে! কাছেপিঠে কেউ থাকতে পারে।

কান পতলো দুজনেই। পুরো আধ মিনিট স্তব্ধ নীরবতা। চেঁচিয়ে উঠেছে বলে মনে মনে নিজেকে বেশ কয়েকটা লাথি মারলো মুসা। তারপর আবার শোনা গেল গোঙানি, মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট।

যেটার মুখের কাছে আলো নিভেছে ওই সুড়ঙ্গ দিয়েই আসছে মনে হলো। পকেট থেকে শাদা চক বের করে সুড়ঙ্গমুখের দেয়ালের পাশে একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকলো কিশোর। টর্চ বের করে জ্বেলে ঢুকে পড়লো সুড়ঙ্গটায়।

.

ডামিগুলোর পাশে বসেই রয়েছে রবিন। পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে সাগরের পানিতে তলিয়ে গেল যেন কমলা রঙের সূর্যটা। বেগুনী-লাল গোধূলির রঙ আকাশে, ছায়া পড়েছে সাগরে। আহত পা-টা সাবধানে নাড়লো সে।

আধ ঘন্টা যাবৎ বসে বসে নিজে নিজেই বকবক করছে। তার মনে হচ্ছে, তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কে যেন। অদ্ভুত অনুভূতি। স্রেফ কল্পনা বলে জোর করে তাড়ানোর চেষ্টা করলো অনুভূতিটা, পারলো না।

অন্য দিকে মন সরানোর জন্যে মোনিং ভ্যালির ওপরে লেখা বইটা পড়তে আরম্ভ করলো। মাইন শ্যাফট বন্ধ করে দেয়ার অংশটা পড়তে পড়তে খাড়া হয়ে গেল পিঠ। আনমনে বিড়বিড় করলো, সর্বনাশ!

ডিন মারটিন আর কার্ল বেইরির কথা লেখা রয়েছে। ডেভিল মাউনটেইনের পাশে একটা পাহাড়ের ঢালে বাসা বানিয়ে থাকে দুজনে। খনির শ্যাফট বন্ধ করে দেয়ার পরে সব শ্রমিকেরা চলে গেলেও ওরা রয়ে গেল। সোনা আর হীরা খোঁজার জন্যে।

ভুরু কোঁচকালো রবিন। তাড়াহুড়ো করে পড়েছে কিশোর, বইয়ের এখান পর্যন্ত আসেনি। তাহলে নিশ্চয় জানতো ডেভিল মাউনটেইনে হীরা আছে, একথা বিশ্বাস করে মারটিন।

ঘনায়মান অন্ধকারে উদ্বেগ বাড়লো রবিনের। ডিন মারটিন সেদিন মিথ্যে বলেছে তাদের সঙ্গে। বলেছে গুহার বাইরে দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে আওয়াজ শুনে দেখতে এসেছে। সেটা সম্ভব নয়। দূরত্ব অনেক বেশি ছিলো। আসলে গুহার ভেতরেই কোনো একটা সুড়ঙ্গে বা অন্য কোথাও ছিলো বুড়ো।

দ্রুত মনস্থির করে নিলো রবিন। ঢালের আড়ালে নেমে এসে পড়ে থাকা বাকি কাপড়গুলো দিয়ে আরেকটা ডামি বানালো। ওটা নিয়ে ক্রল করে এগোলো। অন্য দুটোর কাছে এনে বসিয়ে দিলো ওটাকে। আশা করলো, অন্ধকারে কিছু বুঝতে পারবে না যে চোখ রেখেছে ওগুলোরে ওপর। আবার খানিক দূর নেমে ঝোপের আড়ালে আড়ালে পাড়ে উঠলো আরেক জায়গা দিয়ে। পথের অনেক দূর দিয়ে ঘুরে রওনা হলো ব্যাঞ্চের দিকে। মিস্টার হারভেকে জানাতে হবে সব কথা… ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে কিশোর আর মুসা।

আহত পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে রবিন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। সাইকেল বের করার ঝুঁকি নেয়নি, তাহলে চূড়ার ওপরের লোকটার চোখে পড়ে। যাওয়ার সম্ভাবনা। একশো গজও যেতে পারলো না, গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ কানে এলো। কাঁচা রাস্তা ধরে গতি কমিয়ে এগিয়ে আসছে গাড়িটা, হেডলাইট নিভানো। একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো রবিন। তার কাছ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে থামলো গাড়িটা।

একটা লোক নেমে প্রায় ছুটে চললো পর্বতের দিকে। পরনে কালো পোশাক। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

গুড়ি মেরে এগিয়ে গাড়ির পেছনে চলে এলো রবিন। দেখলো, নেভাডার নম্বর প্লেট লাগানো।

.

পর্বতের গভীরে গোঙানি লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে মুসা আর কিশোর। প্রথম সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আরেকটা গুহায় ঢুকলো। আবার মোমবাতি ব্যবহার করলো। এভাবে চলে তৃতীয় গুহাটায় এসে ঢুকলো। যে কটা গুহায় ঢুকেছে এ-পর্যন্ত, তার মধ্যে এটা ছোট। এটাতে তিনটা সুড়ঙ্গ পাওয়া গেল, যেগুলো দিয়ে জোরালো বাতাস বয়। আলাদা আলাদা না গিয়ে একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর।

প্রথম সুড়ঙ্গটা বেশ কিছু দূর এগিয়ে হঠাৎ তীক্ষ্ণ মোড় নিলো।

সাগরের দিকে গেছে, বললো মুসা। গন্ধ শুকছে বাতাসে।

তাহলে আর এগোনোর দরকার নেই। আমি শিওর, গোঙানিটা আসে উপত্যকার দিক থেকে। কম্পাস দেখলো। পুব, কিংবা উত্তর-পুবে যাওয়া উচিত।

এটা তো গেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে।

ফিরে এসে দ্বিতীয় সুড়ঙ্গটায় ঢুকে এগোলো। কিছু দূর এগিয়েই দক্ষিণ পশ্চিমে মোড় নিলো এটাও। আবার ফিরে আসতে হলো ছোট গুহায়।

অধৈর্য হয়ে উঠেছে মুসা। কিশোর, এই গোলক-ধাঁধায় কি কেবল ঘুরেই মরবো?

মনে হয়, ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। যতই পুবে সরছি গোঙানি বাড়ছে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৃতীয় সুড়ঙ্গে ঢুকলো মুসা। বাতাস জোরালো, আওয়াজও বাড়ছে। সোজা পুবে এগিয়েছে পথটা। এক জায়গায় এসে থেমে গেল দুজনেই। বায়ের দেয়ালে মস্ত গোল ফোকর। এই সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে চলে গেছে আরেকটা সুড়ঙ্গ।

খাইছে! এই প্রথম একটা সাইড টানেল দেখলাম।

হ্যাঁ, আলো ফেলে দেখছে কিশোর। এটা মানুষের তৈরি। মাইন শ্যাফট। বন্ধ করা হয়নি। দেখো দেখো!

বাতাসে বাইরের দিকে কাত হয়ে যাচ্ছে তার হাতের মোমের শিখা। এর অর্থ কি? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কণ্ঠ। সাইড টানেলটা থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে। নিশ্চয় খনিতে ঢোকার পুরনো কোনো পথ নতুন করে খোলা হয়েছে।

তাহলে শেরিফ কেন খুঁজে পেলেন না? কিংবা মিস্টার হারভে?

বলতে পারবো না, মুসা, মাথা নাড়লো কিশোর। কিন্তু… হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল চোখ।

শব্দটা মুসার কানেও আসছে। মাটি কোপানো হচ্ছে।

এসো, ফিসফিস করে বলে পাশের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো কিশোর।

মুসাও অনুসরণ করতে যাবে, এই সময় পেছনে শুনতে পেলো পায়ের। আওয়াজ। কিশোর…? বলেই চুপ হয়ে গেল।

পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে হালকা-পাতলা একজন মানুষ। কালো জ্বলন্ত মে। কালো সমব্রেরো, কালো জ্যাকেট, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতো পোশাক পরা ঠিক এই তরুণটির ছবিই সেদিন দেখিয়েছিলেন প্রফেসর হারকসন।

হেনরি ফিগারো! বাঁ হাতে পিস্তল।

.

১২.

মুসার দিকে পিস্তল উদ্যত রেখে বাঁ হাতে বাতাসে থাবা মারলো যেন ফিগারো।

চুপ থাকতে বলছে আমাদেরকে, কাঁপা কণ্ঠে বললো কিশোর।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো লোকটা। ওর তরুণ চেহারায় কোনো ভাবান্তর। নেই। পিস্তল নেড়ে ইশারা করলো ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে, খানিক আগে ওরা যেদিক থেকে এসেছে তার উল্টো দিকে।

উপায় নেই। আদেশ মানতে বাধ্য হলো দুই গোয়েন্দা। আরেকটা গুহায় এসে, ঢুকলো। ডানে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো ফিগাররা।

হাঁটছে তো হাঁটছেই। এই সুড়ঙ্গ থেকে সেই সুড়ঙ্গে, তারপর আরেক সুড়ঙ্গে, মাঝে মাঝে গুহা। মনে হলো যুগ যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ হাতঘড়িতে দেখলো মুসা, মাত্র পাঁচ মিনিট পেরিয়েছে।

থামো! পেছন থেকে বললো ফিগারো। এই প্রথম মুখ খুললল সে। কেমন যেন, ভোঁতা, শূন্য কণ্ঠস্বর। আরেকটা গুহায় ঢুকেছে ওরা।

থামলো ছেলেরা। যতোগুলো গুহায় ঢুকেছে, তার মধ্যে সব চেয়ে ছোট এটা। বাতাস ভ্যাপসা।

ওদিকে! দেয়ালের খুব সরু একটা সুড়ঙ্গমুখ দেখিয়ে বললো লোকটা।

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো দুই গোয়েন্দা। কিছুই করার নেই। ঢুকলো সুড়ঙ্গে। পেছনে ফিগারো। দশ কদম এগিয়ে দেখলো সামনে পাথর পড়ে পথ রুদ্ধ। ফিরে তাকালো দুজনে।

পাথরে তৈরি যেন ফিগারোর মুখ, কোনো পরিবর্তন নেই। পিস্তল নেড়ে, বাঁয়ের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো ওদেরকে। তারপর ঝুঁকে ইস্পাতের একটা ডাণ্ডা তুলে নিয়ে চাড় দিয়ে বড় একটা পাথর ঠেলে সরালো। ডাকলো, এসো!

ফোকরের কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিলো মুসা। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো, না। টর্চ জ্বালতে যাবে, এই সময় পেছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো ফোকরের ভেতরে, পাথুরে মেঝেতে। তার গায়ের ওপর এসে পড়লো আরেকটা দেহ। পেছনে পাথর লাগিয়ে আবার বন্ধ করে দেয়া হলো ফোকর। ঘন কালো অন্ধকারে হতভম্ব হয়ে গেল সে।

মুসা? পাশ থেকে ডাকলো কিশোর।

আছি। তবে না থাকলেই খুশি হতাম।

কবর দিয়ে গেল আমাদেরকে।

 দিলো। এখন মরবো, আর কী!

.

মোনিং ভ্যালির ধার ঘেঁষে র‍্যাঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন। পেছনে, যেন তাকে টিটকারি মারতেই গুঙিয়ে চলেছে গুহাটা।

কিশোরের ফন্দি কাজে লেগেছে, ভাবলো সে। এতোক্ষণে গুহায় ঢুকে গেছে। ওরা, অথচ আওয়াজ বন্ধ হয়নি। তবে খুশি হতে পারছে না রবিন। বইটা পড়ার পর থেকেই দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সফল হতে পারবে না কিশোর। ওই গোঙানির সঙ্গে মারটিন আর বেইরির কোনো সম্পর্ক থাকলে বিপদে পড়বে কিশোর-মুসা।

তারপর রয়েছে সেই লোকটা, যার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেভাডায়। কে সে? লোকটা চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছে রবিন, কিন্তু সে ফেরেনি। কিশোর আর মুসার বিপদের ভাবনা না থাকলে আরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো।

মোনিং ভ্যালিকে অনেক পেছনে ফেলে এসে তারপর পথে ওঠার ঝুঁকি নিলো রবিন। পথ ভালো হওয়ায় চলার গতিও বাড়াতে পারলো। যতোই আগে বাড়ছে, পেছনে কমে আসছে গোঙানি। তারপর কানে এলো এঞ্জিনের শব্দ।

কাছেই একটা ঝোপ দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে ওটার ভেতরে লুকালো রবিন।

সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেল গাড়িটা। চালকের মুখ দেখতে পেলো না, স্টিয়ারিং হুইলের ওপর নামিয়ে রেখেছে। তবে মাথার সমব্রেরো চিনতে পারলো। আর গাড়ির নম্বর প্লেট, নেভাডার।

 ব্যাপার কি? এতো তাড়াহুড়ো কেন লোকটার? পাহাড়ের ভেতরে কি করে এসেছে? একটা অশুভ চিন্তা বার বার মাথা তুলতে চাইছে, জোর করে দাবিয়ে। রাখছে ওটাকে রবিন। ঝোপ থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দৌড় দিলো র‍্যাঞ্চের দিকে।

লোকটাকে দেখতে পেলো না। পাশ থেকে হঠাৎ করেই এসে দাঁড়িয়েছে পথে! তার গায়ের ওপর দিয়ে পড়লো রবিন। আঁউক করে উঠলো। কঠিন হাত কাধ চেপে ধরলো তার।

মুখ তুললো রবিন। সেই লোকটা! গালে কাটা দাগ। চোখের ওপর পট্টি।

.

অন্ধকারে বসে রয়েছে মুসা আর কিশোর। মাঝে মাঝে এখনও কানে আসছে। গোঙানি, দূর থেকে, মৃদু।

দেখছো কিছু? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

কিচ্ছু না। আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি…, পাগলের মতোই হা হা করে হেসে উঠলো কিশোর।

হাসির কি দেখলে?

হাসবো না? বদ্ধ জায়গায় বসে আছি, অথচ কেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে ফিসফিস করে কথা বলছি। সঙ্গে টর্চ রয়েছে, জ্বালছি না। মাথা খারাপ হয়নি তো কি?

টর্চ জ্বেলে একে অন্যের দিকে চেয়ে হাসলো। কেমন বোকা বোকা, দেখালো দুজনের হাসিই। তারপর দেয়ালে আলো ফেললো মুসা।

বেরোবে কিভাবে? প্রশ্ন করলো সে।

ঠেলেঠুলে দেখবো প্রথমে পাথরটা সরানো যায় কিন্না, সহজে হাল ছাড়ে না। কিশোর। ফিগারোকে দেখে তো মনে হলো না তার গায়ে তেমন জোর আছে। অথচ সহজেই সরালো।

ঠেলা দিয়ে দেখলো মুসা। নড়লো না পাথর। কিশোরও হাত লাগালো। গায়ের জোরে ঠেলা দিলো দুজনে। নড়লো না পাথরটা। হাঁপাতে হাঁপাতে সরে এলো ওরা।

বাইরে থেকে কিছু দিয়ে আটকে দিয়েছে, কিশোর বললো। ঠেলে লাভ হবে

তাহলে আর কি? দারুণ একখান কর্ম করে গেছে! ব্যাটা কি আসলেই হেনরি। ফিগারো? প্রফেসর হারকসনের তো ধারণা, ফিগারো বেঁচে আছে।

 হয়তো আছে। তবে দেখে ওকে ফিগারোর মতো লাগলো না। ভুলে যাচ্ছো, ওর বয়স এখন প্রায় একশো হওয়ার কথা। অথচ যে আমাদেরকে আটকে গেল, সে একেবারে তরুণ, যেন সেই ঊনিশ শো আট সালের ফিগারো।

তাই তো!

তাছাড়া, লক্ষ্য করেছে, তার চেহারার কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি? কথা বলার সময় মুখ নড়ে না, কাপে না, এরকম মানুষ দেখেছো কখনও?

দেখিনি। কিন্তু… 

ব্যাটা মুখোশ পরে এসেছিলো। রবারের ওরকম মুখোশ কিনতে পাওয়া যায়, পরলে আসলের মতোই দেখায়। কথাও বলেছে সে খুব কম। হয়তো ভয়, গলা চিনে ফেলবো আমরা।

আমি চিনতে পারিনি। তুমি?

আমিও না। তবে একটা ব্যাপার শিওর, আমাদের ক্ষতি করার ইচ্ছে ছিল না। তাহলে এখানে আটকে রেখে যেতো না।

নেই মানে কি বলছো? জ্যান্ত কবর দিয়ে রেখে গেছে, এরচে বেশি আর কি করবে?

আরও অনেক কিছুই করতে পারতো। এখানে আমরা মরবো না। আগে হোক পরে হোক, আমাদেরকে খুঁজে বের করা হবেই। এবং এটা সে জানে। বাতাস আছে এখানে। দম বন্ধ হয়ে মরছি না। কোনো কারণে কিছুক্ষণের জন্যে আটকে দিয়েছে আমাদেরকে, যাতে কাজ সারতে পারে। কাজেই খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাদেরকে।

পারবো? তার চেয়ে চুপ করে বসেই থাকি। কেউ এসে খুঁজে বের করুক।

রহস্যের সামাধান করতে চাইলে আজ রাতের মধ্যেই করতে হবে। বসে থাকলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। যেদিক দিয়ে ঢুকেছি সেদিক দিয়ে বেরোতে পারবো না, অন্য দিক দিয়েই চেষ্টা করে দেখি। এসো।

সরু পথে কিশোরকে অনুসরণ করলো মুসা। চলেছে তো চলেছেই, সুড়ঙ্গ আর শেষ হয় না। অন্য কোনো সুড়ঙ্গও বেরোয়নি ওটা থেকে। ওদের মনে হলো মাইলের পর মাইল পেরিয়ে এসেছে। হঠাৎ, থমকে দাঁড়ালো ওরা। সামনেও পথ রুদ্ধ, পাথর পড়ে।

খাইছে! এবার? এবার কি করবো?

এরকম ভাবে আটকা পড়বো ভাবিনি, এই প্রথম সামান্য উদ্বিগ্ন মনে হলো গোয়েন্দপ্রাধানকে। ঝুঁকে পাথরগুলো ভালো করে দেখলো সে। উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মুসা, এই বড় পাথরটা সরানো হয়েছিলো!

ঝুঁকে মুসাও দেখলো। মেঝেতে ঘষার দাগ রয়েছে। একমত হলো কিশোরের সঙ্গে। দুজনে মিলে আবার পাথরটা সরানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। গর্তের মুখে এমনভাবে বসানো, হাত দিয়ে চেপে ধরার উপায় নেই, জোর পাওয়া যায় না, ফলে টেনে বের করা যায় না।

এই সুড়ঙ্গ নিশ্চয় লোকটার চেনা, চারপাশে আলো ফেলে দেখছে কিশোর। ঢোকে, বেরোয়। নিশ্চয় কোনো ডাণ্ডা-টাপ্তা দিয়ে চাড় দিয়ে…ওই যে, ডাণ্ডাটা। ওই তো, দেয়ালের ধারে।

তুলে আনলো মুসা। ডাণ্ডার মাথাটা চ্যাপ্টা, অনেকটা শাবলের মতো। গর্তের মুখে বসানো পাথরের ফাঁকে সহজেই ঢুকে গেল চ্যাপ্টা মাথাটা। জোরে চাড় দিতেই খুলে এলো পাথর। বেরিয়ে পড়লো কালো ফোকর। হাঁটু গেড়ে বসে : ওপাশে আলো ফেললো কিশোর। আরেকটা গুহা মনে হচ্ছে।

হামাগুড়ি দিয়ে গুহাটায় ঢুকে পড়লো দুজনে। সামনের দিকে আলো ফেলেই স্থির হয়ে গেল।

গুহার মাঝখানে বিরাট এক খাড়ি!

.

১৩.

টর্চের আলোয় চিকচিক করছে খুঁড়ির কালো পানি।

ঢোক গিললো মুসা। এখানেই তো বাস করেন বুড়ো মানুষটা!

 তার কথা যেন কানেই ঢুকলো না কিশোরের। তাহলে পুকুর একটা সত্যিই। আছে। ইণ্ডিয়ানদের কথাই ঠিক।

চলো, ভাগি!

খাড়ি আছে বলেই যে বুড়ো মানুষটাও থাকবে, এমন কোনো কথা নেই।

একটা কথা যখন সত্যি হয়েছে, আরেকটাও হতে পারে। কে জানে, অনেক দিন ধরে হয়তো আটকা পড়ে আছেন জনাব বুড়ো মানুষটা। হয়তো সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে তাঁর। ধরতে পারলে কোৎ করে গিলে ফেলবেন আমাদেরকে।

গুহার দেয়ালে আরেকবার আলো ফেলে দেখলো কিশোর। অনেকগুলো সুড়ঙ্গমুখ রয়েছে। দেখি, বেরোনোর পথ মেলে কিনা। মোম জ্বালো।

দুটো মুখ পরীক্ষা করা হলো। আরেকটা মুখ দেখতে এগোচ্ছে মুসা, কিশোরের ডাকে চমকে ফিরে তাকালো। প্রথমে কিছুই চোখে পড়লো না।

ওই যে দেখো…, ফিসফিস করে বললো কিশোর। ওই যে…

মুসাও দেখলো। খানিক আগে দ্বিতীয় যে সুড়ঙ্গটা পরীক্ষা করেছে, তার ভেতরে একটা খাজের মধ্যে বসে রয়েছে একটা ছোট্ট মানুষ। কালো পোশাক। কালো সমব্রেরো। কালো বুট। হাতে পুরনো আমলের একটা পিস্তল। তাদের দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে।

 পিস্তল ধরে রাখা হাতটা জীবন্ত নয়, আঙুলের শাচটা হাড় শুধু, তাতে মাংস নেই। কঙ্কাল!

আল্লাহরে! বলে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ঘুরে দিলো দৌড়। যে সুড়ঙ্গ দিয়ে গুহায় ঢুকেছে, আবার গিয়ে ঢুকলো ওটাতে।

কিশোরও ছুটলো তার পেছনে। ডাকলো, আরে থামো থামো, শোনো! কোথায় যাচ্ছো?

থামলো মুসা। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে।

কিশোরও বসলো তার পাশে। বেশি আতঙ্কিত হলে মাথার ঠিক থাকে না, ঠিকমতো কাজ করতে পারে না ব্রেন। এ-ধরনের পরিবেশে এই পরিস্থিতিতে এরকম হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। স্নায়ুকে উত্তেজিত করে নার্ভাস করে দেয় মানুষকে। অথচ, ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো, ওটা অতি সাধারণ একটা কঙ্কাল..

দুর! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা। তোমার লেকচার থামাবে দয়া করে?

ওই কঙ্কালটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

পারলে করোগে তুমি। আমি যাচ্ছি না। বললো বটে মুসা, কিন্তু কিশোর রওনা হতেই উঠে সুড়সুড় করে চললো তার পেছনে, যেন দেহের সঙ্গে ছায়া।

দ্বিতীয় সুড়ঙ্গে ঢুকলো দুজনে।

সমব্রেরোটায় আঙুল ছোঁয়ালো কিশোর, ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো ওটা।

খাইছে! সাহস বাড়লো মুসার। কালো জ্যাকেটটা ধরতে গেল। পোড়া কাগজের ছাইয়ের মতো কাপড়ের ওই অংশটা ঝরে পড়ে গেল কঙ্কালের শরীর থেকে। পিস্তল ধরা আঙুলগুলোতে হাত বোলাতে গেল সে। খসে পড়লো হাড়, খটাং করে পাথুরে মেঝেতে পড়লো পিস্তলটা। দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে অস্বাভাবিক শব্দ হলো। চমকে, লাফিয়ে সরে এলো মুসা।

ঝুঁকে দেখছে কিশোর। অনেক পুরনো কঙ্কাল..ওই পিস্তলটাও…মুসা, আর কোনো সন্দেহ নেই।

কিসের সন্দেহ?

কঙ্কালটা হেনরি ফিগারোর। আসলে ফিগারো, তার কথা বিচিত্র প্রতিধ্বনি তুললো গুহার উঁচু ছাতে বাড়ি খেয়ে। যেন বহু দূর থেকে আসা কোনো ভূতুড়ে কণ্ঠস্বর।

আসল ফিগারো? তারমানে এতোগুলো বছর এখানেই ছিলো সে, অথচ কেউ দেখেনি?

তাই তো মনে হয়। যে রাতে এই গুহায় ঢুকেছিলো, হয়তো সে-রাতেই মারা গিয়েছিলো হতভাগ্য মানুষটা, বিষণ্ণ শোনালো কিশোরের কণ্ঠ। কেউ ভাবতেই পারেনি তার আঘাতটা ছিলো মারাত্মক। তবে, সেকালে এমন সব আঘাত, এমন সব রোগে মানুষ মারা যেতো, যেগুলোকে আজকাল কেয়ারই করি না আমরা। মেডিক্যাল সাইন্সের অসাধারণ উ…

সে-রাতেই মারা গেছে কি করে বুঝলে? বাধা দিয়ে বললো মুসা। এমনও হতে পারে, অনেক দিন বেঁচে ছিলো ফিগারো। এখানেই বাস করেছে। তারপর একদিন মারা গেছে।

মাথা নাড়লো কিশোর। না, আমার তা মনে হয় না। দেখো, কঙ্কালটার ধারেকাছে কোনো খারারের চিহ্ন নেই। পানিও খেতে পারেনি বেচারা। গিয়ে টেস্ট করে দেখতে পারো, পুকুরের পানি নোনা।

অন্য কোথাও বসে খেয়েছে হয়তো।

হয়তো। কিন্তু তাহলে কি কারণে মারা গেল? কেউ হামলা চালিয়ে মেরে রেখে গেলে তারও চিহ্ন থাকতো। ধস্তাধস্তি কিংবা অন্য কিছু…অন্তত আরও দুয়েকটা কঙ্কাল পড়ে থাকতো।

হ্যাঁ, তোমার কথায় যুক্তি আছে।

আরেকটা ব্যাপার, কঙ্কালটার অবস্থান দেখো। মৃত্যুর আগে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিলো। হাতে পিস্তল, তারমানে আশঙ্কা করছিলো আক্রমণ আসতে পারে। শত্রুকে পাল্টা আঘাত হানার জন্যে তৈরি হয়েছিলো। দেখি, পিস্তলটা তোলো তো।

তুলে দেখলো মুসা। ভরা ম্যাগাজিন। একটা গুলিও খরচ হয়নি।

তারমানে শত্রু আসেনি। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। আর ওই আঘাতের কারণেই মারা গেছে বেচারা। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো, শেরিফ আর তার লোকদের চেয়ে এসব গুহাসুড়ঙ্গ অনেক বেশি চিনতো ফিগারো।

না চিনলেই বোধহয় ভালো হতো। ধরা পড়তো, তার জখমের চিকিৎসা। হতো।

কি হতো তাতে? চিকিৎসা করে ভালো করে নিয়ে গিয়েফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো। তার চেয়ে এই তো ভালো হলো। কিংবদন্তী হয়ে গেল হেনরি ফিগারো, তার অনুসারীদের কাছে হিরো হয়ে গেল।

তা হলো…

আর ওই কিংবদন্তী এখন কাজে লাগাচ্ছে কেউ একজন। ভয় দেখায়। যাতে গুহার কাছে কেউ না আসে। প্রশ্ন হলো, কেন?

হয়তো র‍্যাঞ্চ থেকে ভাগাতে চায় মিস্টার হারভেকে।

মনে হয় না। অন্য কোনো কারণ আছে। ভেবে দেখো, মিস্টার হারভেকে তাড়াতে চাইলে তিনি আসার পর পরই ভয় দেখাতো। অথচ গোঙানিটা শুরু হয়েছে মাত্র এক মাস আগে, তিনি আসার অনেক পরে।

 ঠিক বলেছো। আরেকটা ব্যাপার, কিশোর, উত্তেজিত হয়ে উঠলো মুসা। আজকের আগে আর কেউ কেন হেনরি ফিগারোকে দেখলো না? মানে জ্যান্ত ফিগারোকে, আমরা যাকে দেখেছি? শেরিফ আর মিস্টার হারভে যখন ঢুকলেন, তখন দেখা দিলো না কেন?

জানি না। তবে আজই প্রথম লোক ঢোকার পরে থামলো না গোঙানি। আজ রাতে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছি আমরা, গোঙানি থামেনি, ফিগারোও দেখা দিয়েছে। অবশ্যই নকল ফিগারো। তারমানে এই দাঁড়াচ্ছে, তাকে দেখতে পেয়েছিই গোঙানি থামেনি বলে।

মানে?

বলতে পারবো না, মুসা। তবে শিওর হলাম, শুধু প্রাকৃতিকূ কারণে গোঙায় না গুহাটা, আরও কোনো ব্যাপার আছে। কিছুক্ষণ আগে খোঁড়ার শব্দ শুনেছিলাম ৩ না? কে কি খুঁড়ছিলো দেখা দরকার।

তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার কি মনে হয়? সত্যি সত্যি হীরার খনি আছে এখানে?

খুঁড়ছে যখন, কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয় আছে, ঘুরিয়ে জবাব দিলো কিশোর।

চলো, মিস্টার হারভেকে গিয়ে জানাই।

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। রহস্যের সমাধান নিজে করতে না পেরে অন্য কারও সাহায্য চাওয়ার পক্ষপাতি নয় গোয়েন্দাপ্রধান। তবু কিছু কিছু বিশেষ সময়ে যখন তিন গোয়েন্দার জন্যে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে কাজ করা, সাহায্য নিতেই হয়। কথাটা, বলেছো ঠিকই। বেশ, চলো পিস্তলটা হাতে রাখো। দেখি, বেরোনোর পথ পাই কিনা?

আবার মোম জ্বেলে সুড়ঙ্গমুখ পরীক্ষা করতে লাগলো ওরা।

হঠাৎ পানিতে মৃদু আলোড়ন হলো, ঢেউ উঠলো। ভেসে উঠছে কি যেন!

পাঁই করে ঘুরে আলো ফেললো কিশোর। ধক করে উঠলো-বুক। কালো চকচকে একটা দেহ ভেসে উঠেছে।

হাঁ হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।

চকচকে কালো জীবটা উঠে আসছে খাড়ির পাড়ে। পানি ঝড়ছে পিচ্ছিল চামড়া থেকে।

.

১৪.

তোমরা এখানে কি করছো? জিজ্ঞেস করলো জীবটা।

মানুষ! পরনে কালো রবারের ওয়েট-স্যুট, পায়ে সুইম ফিন, পিঠে বাঁধা ডাবল এয়ার ট্যাংক।

ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুসা।

বদলে গেল কিশোরের চেহারা। গম্ভীর কণ্ঠে অনেকটা বড়দের মতো করে পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপনি এখানে কি করছেন, স্যার?…আমরা অনুমতি নিয়েই এসেছি, র‍্যাঞ্চের মালিকের কাছ থেকে। আপনি এসেছেন পানির তলা দিয়ে, কোনো গোপন পথে। অনধিকার প্রবেশ করেছেন।

মুখোশ খুললো লোকটা। সুন্দর চেহারা। সোনালি চুল। হাসলো কিশোরের দিকে তাকিয়ে। তারপর পিঠের এয়ার-ট্যাংক খুলে নামিয়ে রাখলো মাটিতে।

খোকা, এমনভাবে কথা বলছো যেন নেভির অ্যাডমিরাল। অনুমতি নিয়ে এসেছে কিনা সেকথা জিজ্ঞেস করিনি। আমি অবাক হচ্ছি, এই রাত দুপুরে হেনরি ফিগারোর গুহায় কি-জন্যে ঢুকেছো?

অ্যাডমিরাল? লোকটার কথার জবাব দিলো না কিশোর। নিশ্চয়ই! আপনি ফ্রগম্যান, না? নেভির লোক। চ্যানেল আইল্যাণ্ডস-এ নোঙর করেছে আপনাদের নৌ-বহর।

হ্যাঁ। একটা গোপন মিশনে এসেছি আমরা এখানে। আশা করি আমার সঙ্গে। দেখা হয়ে যাওয়ার কথাটা গোপনই রাখবে। অস্বাভাবিক কিছু দেখেছো এদিককার পানিতে?

না, জবাব দিলো মুসা।

 না বলতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। মনে পড়ে গেল পানিতে দেখা সেই অদ্ভুত জীবটার কথা। দেখেছি, স্যার। তিমিও না, হাঙরও না..

 হ্যাঁ হ্যাঁ, মুসারও মনে পড়লো। আকারটা অনেকটা সিগারের মতো। সাগরের দিকে চলে গেল।

সাবমেরিন, মুসা! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। এখন বুঝতে পারছি। ওটা একটা মিজেট সাবমেরিন, বামন ডুবোজাহাজ। সে-জুন্যেই শক্ত হয়ে ছিলো, চলার সময় শরীর বাকেনি। কিন্তু এঞ্জিনের শব্দ শুনলাম না কেন? পানির নিচে তো শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ায়।

কালো হয়ে গেল ফ্রগম্যানের মুখ। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস, বুঝেছো? টপ সিক্রেট, ওই যে এঞ্জিনের শব্দ হয় না। তোমাদেরকে বোধহয় আটকাতেই হচ্ছে।

আটকাবেন? প্রতিধ্বনি করলো যেন মুসা।

নীরবে চলে, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর। তারমানে সোনার সিসটেম ধরতে পারে না ওটার অস্তিত্ব। মুসা, টপ সিক্রেট তো হবেই। ফ্রগম্যানের দিকে ফিরে বললো, আমাদের আটকানোর দরকার নেই, মিস্টার

ক্রুগার, নাম বললো লোকটা। কমাণ্ডার ক্রুগার। সরি, আটকাতেই হচ্ছে। অ্যাডমিরালকে জানাবো। ছেড়ে দিলে কোনো অসুবিধে হবে না বুঝলে, তিনি ছেড়ে দেবেন।

বোদ্ধা মানুষের মতো মাথা ঝোঁকালো কিশোর। যেন কমাণ্ডারের কথা মেনে নিলো। আমার নাম কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু মুসা আমান। ড্রাইভিং বেল্টে ঝোলানো একটা পানিরোধক পাত্রের মুখ খুলে তাতে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো একটা খাম। তার ভেতর থেকে বের করলো একটা কার্ড আর একটা সার্টিফিকেট। বাড়িয়ে দিয়ে বললো, পড়ে দেখুন। বুঝতে পারবেন।

কার্ডটা তিন গোয়েন্দার। আর সার্টিফিকেটটা লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের।

পড়লো ক্রুগার।

একটা জরুরী কেসে জড়িয়ে পড়েছি আমরা, জানালো কিশোর। এই গুহায় ঢুকেছি সে-জন্যেই। আমি শিওর, কমাণ্ডার সাহেব, আপনার অ্যাডমিরাল আমাদেরকে সাহায্য করার কথাই বলবেন আপনাকে।

দ্বিধা করছে ক্রুগার। ছেলেটাকে মিথ্যুক মনে হচ্ছে না। কথাবার্তায় ওজন আছে, আর অপূর্ব সুন্দর কালো চোখ দুটোর পেছনে নিশ্চয় কাজ করছে ক্ষুরধার একটা ব্রেন। সার্টিফিকেটটা আসলই মনে হচ্ছে।

এক কাজ করুন না, পরামর্শ দিলো কিশোর। আপনার জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলুন, চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে একটা ফোন করতে। জিজ্ঞেস করতে বলুন তিন গোয়েন্দার কথা। আর কোনো সন্দেহ থাকবে না আপনার।

কিশোর, এখান থেকে উনি কি করে যোগাযোগ করবেন?

এটাও জানো না। জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকে ফ্রগম্যানদের! সঙ্গে লং রেঞ্জ রেডিও থাকে।

হাসলো কমাণ্ডার। সাংঘাতিক চালাক ছেলে তুমি। বেশ, বসো এখানে। আমি আসছি। বসে থাকো চুপ করে।

 গুহার অন্ধকার কোণে চলে গেল ক্রুগার। কৌতূহলী চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেরা, তবে দেখতে পেলো না কমাণ্ডার কি করছে।

অবশেষে হাসিমুখে ফিরে এলো কমাণ্ডার। সিকিউরিটি খোঁজ নিয়েছে। তোমাদেরকে আটকাতে হবে না।

এতো তাড়াতাড়ি জেনে ফেললেন? মুসা অবাক।

দরকারের সময় এর চেয়ে তাড়াতাড়ি করতে হয় আমাদেরকে।

মিস্টার কমাণ্ডার, কিশোর বললো। আমাদের ব্যাপারে তো অনেক খোঁজ খবর নিলেন। এবার আমি আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

আমাকে? হেসে মাথা নাড়লো কমাণ্ডার। সরি, ইয়াংম্যান। জবাব দিতে পারবো না। টপ সিক্রেট…

আপনার কাজের কথা জিজ্ঞেস করবো না, স্যার। আমি এই গুহার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে চাই। কাল রাতে আপনিই কি এসেছিলেন? যাকে দেখে। ফেলেছিলো আমার এই বন্ধুটি?

আমি না। আমার এক কলিগ গিয়ে রিপোর্ট করেছে, তাকে নাকি কে দেখে ফেলেছে।

যাক, বললো মুসা। একটা রহস্যের সমাধান হলো।

 আরেকটা কথা, আঙুল তুললো কিশোর। আপনারা কি গুহার ভেতরে কিছু পরিবর্তন করেছেন? মানে, কোনো সুড়ঙ্গের মুখ খুলেছেন, কিংবা নতুন কোনো গুহা খুঁড়েছেন?

না।

এমন কিছু করেছেন, যাতে গোঙানো শুরু করেছে একটা গুহা?

মোটেই না। ওই গোঙানি শুনে আমরাও অবাক হয়েছি। এই এলাকায় নতুন এসেছি আমরা, আর এই গুহায়ও ঢুকেছি মাত্র কয়েকবার। ভেবেছি, সব সময়ই বুঝি ওরকম গোঙায় গুহাটা।

আর, নিশ্চয় আপনাদের ওপর আদেশ রয়েছে, অলক্ষ্যে কাজ করার? আই মীন, কেউ যেন আপনাদের দেখে না ফেলে?

নিশ্চয়ই। তবে তোমরা ছাড়া এখানে আর কেউ দেখেনি আমাদের।

আপনারা দেখেছেন আর কাউকে, এ গুহায়?

মাথা নাড়লো কমাণ্ডার। না। বললামই তো, কেউ যাতে না দেখে ফেলে সেভাবেই থাকি আমরা।

বুঝেছি, হতাশ মনে হলো কিশোরকে।

সেটা বুঝতে পারলো ক্রুগার। আর কোনো প্রশ্নের জবাব যাতে না দিতে হয় সে-জন্যে তাড়াতাড়ি বললো, তোমরা কি পথ হারিয়েছো? সাহায্য লাগবে?

হ্যাঁ, জবাব দিলো মুসা। বেরোনোর চেষ্টাই করছিলাম। এই সময় আপনি এলেন।

চলো, পথ দেখিয়ে দিই। মনে রাখবে, আমাদেরকে যে দেখেছো, সাবমেরিন দেখেছো, কথাটা কাউকে বলবে না। মুখ একেবারে বন্ধ। ও কে?

ও কে, বলুলো মুসা।

বলবো না, স্যার, বিশ্বাস করতে পারেন, কিশোর বললো।

এসো আমার সাথে।

একটা সুড়ঙ্গ ধরে আগে আগে চললো কমাণ্ডার। পেছনে দুই গোয়েন্দা। কয়েকটা গুহা, সুড়ঙ্গ, শাখাসুড়ঙ্গ পার হয়ে এসে ঢুকলো একটা বড় গুহায়। এটা সেই গুহা, যেখানে আগের রাতে আরেকজন ফ্রগম্যানকে দেখেছিলো মুসা।

আশা করি এবার বেরোতে পারবে?

পারবো, স্যার। থ্যাংক ইউ, বললো কিশোর।

হাসলো ক্রুগার। গুড লাক। বলে একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে হারিয়ে গেল।

বেরোনোর জন্যে পা বাড়ালো মুসা।

কিশোর নড়লো না। তার চোখের দিকে চেয়ে গুঙিয়ে উঠলো মুসা, না না, বলো না। আর পারবো না…

মুসা, এখন আমি আরও শিওর হয়েছি, রহস্যের সমাধান আজ রাতের মধ্যেই করতে হবে। নকল ফিগারো জানে, আমরা বেরিয়ে যেতে পারবোই। তার মানে সে তাড়াহুড়ো করবে। আসলে, আমাদেরকে কয়েক ঘন্টা আটকে রাখতে চেয়েছে, যাতে কাজ সেরে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে।

আমি ওর পথের কাঁটা হতে চাই না।

এই আমাদের সুযোগ, মুসা, বোঝানোর চেষ্টা করলো কিশোর। লোকটা আমাদের আটকে রেখে ভাবছে, আর কোনো বাধা নেই। ফলে তেমন সাবধান হবে না। আমাদের জানতেই হবে কে কি খুঁড়ছিলো, আর কেন গোঙায় গুহাটা?

বেশ, জানবো। চলো, গিয়ে মিস্টার হরভেকে বলে লোকজন নিয়ে আসি।

গুহা থেকে বেরোলেই দেখে ফেলবে আমাদেরকে। হয়তো আর যেতেই দেবে না। তাছাড়া হাতে সময়ও নেই। যা করার জলদি করতে হবে।

কি করবো? কোনদিকে কোথায় ঢুকবো তাই তো জানি না।

পথ বের করে নেবো। আমরা এখন জানি ওই খোঁড়ার সঙ্গে গোঙানির সম্পর্ক আছে।

কিভাবে বুঝলে?

শেরিফ, মিস্টার হারভে, কিংবা খবরের কাগজে কোথাও কোনো রকম খোঁড়াখুঁড়ির উল্লেখ নেই। তারমানে যে খুঁড়ছে, ব্যাপারটা গোপন রেখেছে। কোনো একটা চালাকি করে। যখনই খুঁড়তে আসে, গোঙানিটা শুরু হয়। তারমানে দুটো ব্যাপারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।

বেশ, তা নাহয় হলো। এখন আমরা কি করছি?

এখন তোমার অসাধারণ ক্ষমতাটা ব্যবহার করো। অন্ধকারেও যেভাবে পথ। খুঁজে পাও। ওটা ব্যবহার করে সাইড টানেলটা খুঁজে বের করো।

মাথা ঝোঁকালো মুসা। গভীর ভাবে ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, কিশোর, মনে হয় উত্তর-পশ্চিমে যেতে হবে আমাদের।

কম্পাস দেখলো কিশোর। বায়ে হাত তুলে বললো, ওদিকে।

চলো।

আবার নোম জ্বালানো হলো। মুসার অনুমান ঠিক। সুড়ঙ্গমুখে মোম ধরতেই কাত হয়ে গেল শিখা।

উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে দুজনে। শোনা গেল আওয়াজটা।

গোঙানি! ফিসফিস করে বললো মুসা।

বন্ধ হয়নি।

কাছে এসে গেছি।

একটা সাইড টানেলের মুখ দেখা গেল। ওটার কাছে মোম ধরতেই প্রায় নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো বাতি, গোঙানিও জোরালো। ঢুকে পড়লো ওরা ওটাতে। ছোট সুড়ঙ্গ। বেরিয়ে এলো একটা ছোট গুহায়।

কিশোর, কোথায় এসেছি জানি।

মোম নিভাও, ফিসফিস করে বললো কিশোর। টর্চ জ্বালবো।

টর্চের মুখে হাত চাপা দিলো দুজনেই, ফলে খুব সামান্য আলো বেরোলো, মৃদু এটা আভা ছড়িয়ে পড়লো মাত্র। ওই আলোতেই পথ দেখে দেখে সেই সুড়ঙ্গে ঢুকলো মুসা, যেটা থেকে তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলো নকল ফিগারো।

জোরালো হচ্ছে গোঙানির আওয়াজ।

চলে এলো আরেকটা সাইড টানেলের মুখে, আরেকবার এসেছিলো ওখানে। শোনা গেল খোঁড়ার শব্দ।

আছে! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

এসো!

নিঃশব্দে শাখা-সুড়ঙ্গ ধরে এগোলো দুজনে। লম্বা, সোজাসুজি এগিয়েছে পথ। কিছুদূর এগিয়ে আলো দেখতে পেলো। থামতে ইশারা করলো কিশোর।

সুড়ঙ্গের পাশের দেয়ালে একটা মাইন শ্যাফটের ভেতর দিয়ে আলো আসছে। মুখের কাছে স্তূপ হয়ে আছে মাটি আর পাথর। খোঁড়ার শব্দ আসছে ওই গর্তের ভেতর থেকেই।

খুব সাবধানে এগিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো ছেলেরা। উজ্জ্বল আলো চোখ ধাধিয়ে দিলো তাদের। থেমে থেমে হয় গোঙানির শব্দ। থেমে গিয়েছিলো, হঠাৎ এসে যেন কানে ঝাপটা মারলো, এতো জোরে, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে। প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আবার।

কানে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে মুসা।

ওর হাত ধরে টানলো কিশোর, দেখো!

 চোখে সয়ে এসেছে আলো। দেখলো, ঝুঁকে রয়েছে একটা লোক। হাতে বেলচা।

ঢোক গিললো মুসা।

সোজা হলো মূর্তিটা। বেলচা ফেলে দিয়ে একটা গাঁইতি তুলে নিলো। স্পষ্ট দেখা গেল তার চেহারা। শাদা চুল, শাদা দাড়ি।

বুড়ো ডিন মারটিন!

.

১৫.

চুপচাপ দাঁড়িয়ে বুড়োর কাজ দেখছে দুই গোয়েন্দা। কয়েক মিনিট পর পরই কানে আঙুল দিতে হচ্ছে, গোঙানির আওয়াজের জন্যে। কিন্তু শব্দটা যেন শুনতেই পাচ্ছে না বুড়ো। একমনে গাঁইতি চালিয়ে যাচ্ছে। গর্ত করছে একটা দেয়ালের গোড়ায়।

মনে হয় আরেকটা পাথর ধস? কিশোর বলুলো।

বড় ধস।

ধসটা নতুন।

কুপিয়ে চলেছে বুড়ো। তার শক্তি দেখে অবাক হতে হয়। এই বয়েসের একজন মানুষের এতো ক্ষমতা! কিছুক্ষণ কুপিয়ে গাইতি ফেলে আবার বেলচা তুলে নিলো সে।

কিশোর! ওর চোখ দেখলে?

দেখেছে কিশোরও। কেমন যেন বুনো দৃষ্টি। আগের রাতে বুড়ো মানুষটার কথা বলার সময়ও ওর চোখ ওরকম হয়ে গিয়েছিলো।

স্বর্ণ-জ্বর!

কি বললে? বুঝতে পারলো না মুসা।

গোল্ড ফিভার। কিংবা এক্ষেত্রে বলতে পারো ডায়মণ্ড ফিভার। বইয়ে পড়েছি, প্রসপেক্টররা ওরকমই হয়ে যায় মাঝে মাঝে, যখন মনে করে কাছেই রয়েছে মূল্যবান ধাতু কিংবা পাথর। ওই সময় কোনো বাধাকেই বাধা মনে করে না ওরা।

খাইছে!

বেলচা দিয়ে খোঁড়া পার্থর আর মাটি সরিয়ে কোপানোর জন্যে আবার গাইতি তুলে নিলো মারটিন। তারপর আবার বেলচা, আবার গাইতি। মাঝেসাঝে থেমে কি যেন দেখছে, হেসে উঠছে আপনমনে। কেমন যেন বন্য হাসি। বাইরে বেরিয়ে লোকের সামনে ওরকম করে হাসলে ধরে নিয়ে গিয়ে সোজা পাগলা গারদে ভরে দেবে।

 বেলচা থামিয়ে বসে পড়লো আবার মারটিন। আলগা পাথর আর মাটিতে আঙুল চালালো। শক্ত হয়ে গেল শরীর। কি যেন একটা হাতে নিয়ে দেখলো। লণ্ঠনের আলোয়। চকচক করে উঠলো চোখ। মাটিতে ফেলে রাখা একটা চামড়ার। ব্যাগ তুলে নিয়ে তাতে ভরে ফেললো জিনিসটা।

হীরা? মুসা বললো।

মনে হয়।

ফিসফিসিয়ে কথা বলছে দুজনে। এতই ব্যস্ত বুড়ো, ওদের কথা কানেই। যাচ্ছে না।

হীরার খনি পেলো শেষতক?

পাথরের ধসটার দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। ভাবছে। দেখে তো সে-রকমই লাগছে। কিন্তু… কি আর কোনো কিন্তু নেই। হীরার খনিই পেয়েছে। আইনতঃ ওগুলোর মালিক এখন মিস্টার হারভে। তাই চুরি করে টৈাকে বুড়ো। রাতে আসে, কাউকে জানাতে চায় না। ভয় দেখিয়ে দূরে রাখে সবাইকে।

হয়তো। এখন আমি জানতে চাই, গুহাটা গোঙায় কেন?

হা। এবং কেন বন্ধ হয়ে যায়।

মিস্টার হারভে আর শেরিফ নিশ্চয় এই শ্যাফট দেখেছেন। শুধু দেখেননি বুড়ো মারটিনকে মাটি খুঁড়তে।

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে যাবে মুসা এই সময় গুহার ভেতরে ঘন্টা বাজতে শুরু করলো।

বিদ্যুৎ খেলে যেন মারটিনের শরীরে হাত থেকে বেলচা ফেলে লাফ দিয়ে, লণ্ঠনটার কাছে চলে এলো। বাতির পাশে ছোট একটা বাক্স। ঝুঁকে কি যেন করলো সে। বন্ধ হয়ে গেল ঘন্টাধ্বনি। তারপর লণ্ঠন আর চামড়ার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ছুটে এলো শ্যাফট দিয়ে।

কুইক! পালাও! বলে উঠলো কিশোর।

শ্যাফটের গোড়ায় জমে থাকা মাটি আর পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো ওরা। বাইরে বেরোলো মারটিন। সুড়ঙ্গমুখের কাছে লণ্ঠন আর, ব্যাগটা নামিয়ে, রাখলো।

আবার শুরু হলো গোঙানি।

তবে শেষ হতে পারলো না। মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল। বিশাল একটা পাথর গড়িয়ে এনে শ্যাফটের মুখে ফেললো মারটিন। দেখে মনে হবে এখন, বহুদিন ধরে পাথরটা ওখানে ওভাবেই রয়েছে। ওটা সুড়ঙ্গমুখে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল; গোঙানি।

পাথর দিয়েই… ফিসফিস করলো মুসাণ

হ্যাঁ। গোঙায় বাতাসের কারণে। শ্যাফটের মুখে পাথর চাপা দিলেই বন্ধ হয়ে যায়। আর ঘন্টাটা সঙ্কেত। চূড়ায় বসে যে চোখ রাখছে সে বাজিয়েছে। মনে হয়। কেউ গুহায় ঢুকতে আসছে।

অস্থির ভাবে সুড়ঙ্গে পায়চারি শুরু করলো বুড়ো। বিড়বিড় করছে। ছেলেরা যেখানে লুকিয়ে রয়েছে, সেদিকে চোখ তুলে তাকালো না একবারও। হঠাৎ করেই নিভিয়ে দিলো বাতিটা। মুহূর্তের জন্যে নীরব হয়ে গেল অন্ধকার সুড়ঙ্গ। তারপর। শুরু হলো বিড়বিড়ানি। আবার পায়চারি শুরু করেছে মারটিন।

অনেক প্রশ্ন ভিড় করছে মুসার মনে। নকল ফিগারো আসলে কে? এই রহস্যে কোথায় ফিট করছে সে? কিশোর কি তখন…

মুসা? কানের কাছে মুখ, ঠেকিয়ে বললো কিশোর। কে জানি আসছে!

 ভাবনায় ডুবে না থাকলে কিশোরের আগেই শব্দটা কানে আসতো মুসার। শুনতে পেলো এখন। খানিক পরেই দেখলো নেচে নেচে এগিয়ে আসছে আলো।

কার্ল? মারটিন জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, জবাব এলো আলোর পেছন থেকে। দুজন আসছে গুহায় ঢুকতে। চলো, ভাগি।

লণ্ঠন জ্বাললো মারটিন।

স্কুপের আড়ালে গুটিশুটি হয়ে বসে রইলো ছেলেরা। পারলে পাথরের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়। মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লোক দুজন।

গুহায় ঢুকবে কি করে বুঝলে? মারটিন বললো।

ঢুকবে। দুদিন ধরে গুহাটার কাছে বড় বেশি ঘোরাঘুরি করছে লোকে।

আর দুচার দিন সময় পেলেই হতো। কাজ শেষ করে ফেলতে পারতাম। খুব। হুঁশিয়ার থাকতে হবে। তীরে এসে তরী ডোবাতে চাই না। চলো, বেরিয়ে যাই।

হ্যাঁ, চলো।

বোঝা গেল, কার্ল বেইরিই চূড়ায় বসে পাহারা দিচ্ছেলো। ঘন্টা বাজিয়ে সঙ্কেত দিয়ে কোনো গোপন পথে দ্রুত নেমে চলে এসেছে।

সূড়ঙ্গমুখ থেকে পাথর সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল দুজনে, ভেতর থেকে আবার টেনে জায়গামতো লাগিয়ে দিলো পাথরটা। এরপর শুধু স্তব্ধ নীরবতা, আর গাঢ় অন্ধকার।

গেল কোন দিক দিয়ে? মুসার প্রশ্ন।

নিশ্চয় গুহা থেকে কোনো পথ পর্বতের বাইরে বেরিয়েছে। থাকতেই হবে। নইলে বাতাস ঢুকে শব্দ করতে পারতো না। হয়তো পুরনো কোনো শ্যাফট, বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, নতুন করে খোলা হয়েছে। ওই দুই প্রসপেক্টরের কাজ।

তাহলে মিস্টার হারভে আর শেরিফ জানেন না কেন? কেন বুঝতে পারলেন না?

তাঁরা যখন ঢোকেন, হয়তো বন্ধ থাকে। পর্বতের চূড়া থেকে নামারও কোনো গোপন পথ আছে, ভেতর দিয়ে। গোপন পথ আরও কতো আছে কে জানে! যাকগে। আমাদের যাওয়ার সময় হলো।

চলো।

টর্চের আলোয় পথ দেখে সেই বড় গুহাটায় ফিরে এলো দুজনে। আগের রাতে প্রথম যেটাতে ঢুকেছিলো।

সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। পাশের ছায়া থেকে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে। পড়লো কে যেন। কঠিন থাবায় চেপে ধরলো মুসার হাত। ধরেছি! কর্কশ। কণ্ঠস্বর।

ঝট করে মুসার হাতের টর্চ উঠে গেল ওপর দিকে, লোকটার মুখে ফেলেই চমকে গেল। গালে কাটা দাগ, চোখে পড়ি। চেঁচিয়ে উঠলো, কিশোর, পালাও!

জ্বলে উঠলো আরেকটা টর্চ। আরেকজনের হাতে।

১৬.

চুপ! একেবারে চুপ! কড়া গলায় আদেশ দিলো পট্টিওয়ালা। নড়লেই মরবে।

কিছু করার সাহস হবে না আপনার, মরিয়া হয়ে বললো কিশোর। ভালো চাইলে ছেড়ে দিন। আশপাশে আমাদের লোক আছে।

হেসে উঠলো পট্টি। ধাপ্পা দিতে চাইছো? ভালো। তা এসো না, বসে দুটো কথা বলি।

কিছু বলবে না, কিশোর! চেঁচিয়ে বললো মুসা।

দ্বিতীয়জন কথা বলে উঠলো। পরিচিত কণ্ঠ। অসুবিধে নেই। বলতে পারো। মিস্টার হারলিং একজন ডিটেকটিভ। চমকে দিয়ে একটু মজা করলেন তোমাদের সঙ্গে।

রবিন! দুই বন্ধুকে অবাক করে দিয়ে হাসিমুখে আলোর সামনে এসে দাঁড়ালো। বই পড়ার পরে কিভাবে সাহায্যের জন্যে ছুটেছে, জানালো সে। শেষে বললো, গাড়িটা চলে যেতেই ছুটলাম আবার। গিয়ে পড়লাম মিস্টার হারলিঙের হাতে।

ড্যাম হারলিং নাম জানালেন ডিটেকটিভ। একটা বীমা কোম্পানির হয়ে কাজ করছি। রবিন বললো তোমাদের কথা। সোজা চলে এলাম এখানে। সাহায্য আনার জন্যে র‍্যাঞ্চে গিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাইলাম না।

মিস্টার হারলিংও ভেবেছেন, তোমরা বিপদে পড়বে, রবিন বললো।

হ্যাঁ। যাদের পিছু নিয়েছে, ওরা ডেঞ্জারাস লোক।

তাহলে আপনি মিস্টার হারলিং, গোয়েন্দা, অবশেষে মুখ খুললো কিশোর। সংক্ষেপে জানালো গুহায় কি কি দেখেছে, কিছু কিছু কথা বাদ দিয়ে।

মাথা ঝাঁকালেন হারলিং। বললাম না, আমাদের দেখে ফেলেছে। দেখুক। বেশি দূর যেতে পারবে না। আর ওই ব্যাগের মধ্যে হীরাই রেখেছে, যেগুলোর পেছনে লেগেছি আমি।

কিসের হীরা?? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

ওগুলো খুঁজে বের করতেই এসেছি আমি, বুঝিয়ে বললেন হারলিং। ধুরন্ধর। এক রত্নচোরের পেছনে লেগেছি আমি। অনেকগুলো হীরা চুরি করেছে সে। ওর আসল নাম কেউ জানে না, বাড়ি কোথায়, তা-ও না। ছদ্মনাম স্যাড সাইপ্রেস। সারা ইউরোপের সব দেশের পুলিশ ওকে খুঁজছে। ওর পিছু নিয়ে এক হপ্তা আগে এসে পৌঁছেছি সানতা কারলায়। ওখানেই শুনলাম মোনিং ভ্যালির কথা। চট করে। মনে হলো, লুকিয়ে থাকার জন্যে এতো ভালো জায়গা আর হয় না। সাইপ্রেস হয়তো এখানেই লুকিয়েছে। দেখতে চলে এলাম।

ওর পিছু নিয়ে এসেছেন মানে? ওকে আসতে দেখেছেন?

দেখবো কি? ওর আসল চেহারা দেখতে কেমন তাই তো জানি না। পাঁচ বছর আগে ইউরোপ থেকে পালিয়েছে, পুলিশের তাড়া খেয়ে। ওখানকার পুলিশের ধারণা, আমেরিকায় চলে এসেছে সাইপ্রেস। নতুন কোনো ছদ্মবেশ নিয়েছে। ছদ্মবেশ ধরতে আর অভিনয় করায় ওস্তাদ সে। সেজন্যেই তাকে ধরা মুশকিল। বোঝাই যায় না কিছু।

নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটলো কিশোর। নিশ্চয় আপনার কোম্পানির বীমা করা কিছু হীরা চুরি করে পালিয়েছে?

হা। বছরখানেক আগে। ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসার পর অনেক দিন চুপ করে ছিলো, তারপর ওই প্রথম চুরিটা করলো। চার বছর ওর খোঁজ না পেয়ে পুলিশ ভেবেছিলো চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে সাইপ্রেস, কিংবা মারা গেছে। কিন্তু হীরা চুরির আলামত দেখেই ইন্টারপোল বলে দিলো, ওটা সাইপ্রেসের কাজ। ওরা শিওর, ও ছাড়া আর কেউ নয়।

 দা মোডাস অপার‍্যানডি, মানে, অপারেশনের পদ্ধতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপার, একমত হলো কিশোর। ওর বলার ধরন রহস্যময় মনে হলো মুসার কাছে। বড় বড় অপরাধীদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে, আর সে-কারণেই ধরা পড়ে। পদ্ধতি কিছুতেই বদলাতে পারে না ওরা। বেশি অভিজ্ঞ যারা, তারা খুব সামান্য নড়চড় করতে পারে। পুরোটা পারে না।

ঠিকই বলেছো, বললেন হারলিং। চার বছর চুপ করে ছিলো। কারণ নতুন দেশে নতুন বেশে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিলো। তারপর সুযোগ বুঝে করে বসলো হাত সাফাই।

নতুন কি ছদ্মবেশ নিয়েছে, আন্দাজ করতে পেরেছেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন। র‍্যাঞ্চের কেউ নয় তো?

হতে পারে। আমি জানলাম কিভাবে জানো? দুটো হীরা বিক্রি করেছে সে। প্রথমটা করেছে নেভাডার রিলোতে, আর দ্বিতীয়টা এখানে।

নেভাডা!

আপনার গাড়িতে তো নেভাডার প্লেট লাগানো। আমাদেরকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন, বললো মুসা।

না, আমি না। নেভাডার প্লেট লাগানো অন্য কেউ হবে। সানতা কারলা থেকে মোনিং ভ্যালিতে যাচ্ছিলাম, দেখি পথের ওপর সাইকেল পড়ে রয়েছে। সন্দেহ হলো। তাই নেমে এসে দেখছিলাম। তারপর দেখলাম, আরও লোকজন আসছে। ভাবলাম, ওরা তোমাদের তুলে নিতে পারবে। আমার পরিচয় তখন তোমাদের কাছে ফাঁস করতে চাইনি। তুলে আনলেই তো জিজ্ঞেস করতে, আমি কে? অনেক কষ্টে সাইপ্রেসের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি, সামান্য কারণে সেটা ভণ্ডুল করতে চাইনি। বুঝতেই পারছো, সাইপ্রেসের মতো একজন চালাক লোক নিশ্চয় টের পেয়ে গেছে তার পেছনে চর লেগেছে। হয়তো নেভাডাতে আমাকে দেখেও ফেলেছে সে। তাই আমিও ছদ্মবেশ নিলাম। চোখের ওপর কালো পট্টি লাগালাম, গালে কাটা দাগ বানালাম। তারপর এসেছি সানতা কারলায়। এতো কিছু করেও তাকে ধোকা দিতে পেরেছি কিনা কে জানে? বুঝে গিয়ে মনে মনে হয়তো হাসছে। সাইপ্রেস।

এ-জন্যেই লুকোচুরি খেলছেন? মানে, এরকম একটা…?

হ্যাঁ, রবিন কি বলতে চাইছে বুঝতে পারলেন হারলিং। সাইপ্রেসের নজর এড়িয়ে থাকতে চাইছি।

ওদের কথায় তেমন মন নেই, অন্ধকার গুহার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। হঠাৎ ঝিক করে উঠলো তার চোখের তারা, কেউ দেখতে পেলো না। ফিরলো। হীরাগুলো স্পেশাল কিছু, তাই না, মিস্টার হারলিং?

অবাক হলেন হারলিং। কি বোঝাতে চাইছে ছেলেটা? বললেন, আঁ! হ্যাঁ। কোনো জুয়েলারি কোম্পানি কিংবা দোকান থেকে চুরি হয়নি। হয়েছে স্যান ফ্রান্সিসকোর একটা মিউজিয়ম থেকে। আর ওগুলো…

রাফ ডায়মণ্ডস! বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর।আকাটা হীরা। খনি। থেকে যে অবস্থায় তোলা হয়েছিলো সেভাবেই রেখে দিয়েছিলো। ঠিক? আর ওগুলো ছিলো ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মণ্ড।

তুমি জানলে কিভাবে? সবগুলোই রাফ, তবে সব ইণ্ডাস্ট্রিয়াল নয়। মিউজিয়মে ডায়মণ্ড শো চলছিলো। দুনিয়ার অনেক দেশ থেকে হীরা. এনে রাখা হয়েছিলো মানুষকে দেখানোর জন্যে। কেন জানি না, বোধহয় রাফ ডায়মণ্ড বলেই, আর দেখতে সাধারণ পাথরের মতো বলেই বোধহয় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। সাইপ্রেসের চুরি করতে কোনো অসুবিধেই হয়নি, কারণ, পাহারা তেমন। কড়াকড়ি ছিলো না। কিন্তু তুমি এতো কথা জানলে কি করে?

ওরকম একটা পাথর এখানকার গুহায় পেয়েছি আমি। বাকিগুলো খুঁজে বের করছে মারটিন আর বেইরি। সব বোধহয় পায়নি এখনও। ওদের ব্যাগ থেকেই হয়তো কোনোভাবে শ্যাফটের মুখে পড়ে গিয়েছিলো পাথরটা। ..

তাহলে সত্যি সত্যি গুহায় আছে পাথরগুলো!

আনমনে মাথা দোলালো কিশোর। আমার বিশ্বাস, চুরি করার পরই এনে এখানে পাথরগুলো লুকিয়েছে আপনার সাইপ্রেস। অপেক্ষা করেছে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে। তার প্ল্যানমতোই হতো সব, মাঝখান থেকে মারটিন আর বেইরি বাগড়া না দিলে। বহু বছর ধরে এখানে সোনা আর হীরা খুঁজছে ওরা, সাইপ্রেসের পাথরগুলো পেয়ে ভেবেছে বুঝি খনিই পাওয়া গেছে।

কিন্তু এই এলাকায় কোনো হীরার খনি নেই!

 নেই। কিন্তু ওদের দুজনকে বোঝায় কে? তাদের বিশ্বাস, আছে। পাথরগুলো পেয়ে সেই বিশ্বাস আরও জোরালো হলো।

 তা ঠিক। কিন্তু একই জায়গায় পাথর জড়ো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওদের সন্দেহ হয়নি? খনিতে ওভাবে পাথর থাকে না।

 পেলে, হতো। তবে মনে হয় না এক জায়গায় পেয়েছে। ভালো করেই জানেন, স্যান অ্যানড্রিয়াস ফল্টের ওপর রয়েছে এই জায়গা। ফলে ওপরের মাটি খালি সরে যায়, আর ভূমিকম্প হয়,। গত কয়েক বছরে বড় ভূমিকম্প অবশ্য হয়নি। এখানে, তবে ছোট ছোট প্রায়ই হয়। গুহার ভেতরে ঢুকলেই তার প্রমাণ মেলে। যেখানে সেখানে পাথরের ধস।

তাতে কি? জানতে চাইলো মুসা।

তাতে? আমার মনে হয়, মাসখানেক আগে ছোট একটা ভূমিকম্প পাথরগুলোর অবস্থান নড়িয়ে দিয়েছিলো। ঝাঁকুনিতে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। ফলে এক জায়গায় পায়নি মারটিন। ভেবেছে, খনিই আবিষ্কার করে বসেছে।

খাইছে! ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ছড়ায়, তা কি সম্ভব?

সম্ভব, জবাব দিলেন হারলিং। হয় এরকম। আলগা মাটি সরে সরে যায় তো। আমি আরেকটা কথা ভাবছি এখন। হয়তো সাইপ্রেসকে খামোকা দোষ। দিচ্ছি। পাথরগুলো হয়তো ও চুরি করেনি, করেছে মারটিন আর বেইরি। এখানে এনে লুকিয়েছিলো, এখন তুলে নিচ্ছে।

কিন্তু, মিস্টার হারলিং, রবিন ধরলো কথাটা। ওরা দুজনে এখানে অনেক বছর ধরে আছে। সবাই চেনে। পাঁচ বছর নয়, আরও অনেক আগে এসেছে ওরা।

 হাসলেন হারলিং। আগেই বলেছি, সব রকম ছদ্মবেশ ধরায় ওস্তাদ সাইপ্রেস। হতে পারে, ওদেরই একজন সে। দুই বুড়োর কোনো একজনকে সরিয়ে দিয়ে। নিজে সেই ছদ্মবেশ ধরে এখানে আরামসে লুকিয়ে রয়েছে পাঁচ বছর ধরে।

হ্যাঁ, এটা হতে পারে!

বোঝার উপায় এখন একটাই। গুহায় ঢুকে খুঁজে বের করতে হবে ওদেরকে। এক কাজ করো। একজন, র‍্যাঞ্চে চলে যাও। শেরিফকে গিয়ে নিয়ে এসো। ইতিমধ্যে আমরা গুহায় ঢুকে মারটিন আর বেইরিকে আটকানোর চেষ্টা করি।

মুসা, তুমি যাও, কিশোর বললো।

ক্ষুব্ধ হলো মুসা। এতো কষ্ট করলাম। এখন নাটকের শেষ দৃশ্যে এসে আমাকে তাড়াতে চাইছো?

-তুমিই যাও, মুসা, হারলিং বললেন। রবিনের পা ভালো না। তাড়াতাড়ি করতে পারবে না। আর কিশোরকে আমার দরকার। টীম ওয়ার্ক করছো তোমরা। যে যেটা ভালো পারবে সেটাই তো করা উচিত।

আর প্রতিবাদ করলো না মুসা। তবে খুশিও হতে পারলো না। নীরবে সরে গেল সেখান থেকে।

.

মারটিন যে গুহাটা খুঁড়ছিলো, ওটার শ্যাফটের মুখের কাছে এসে দাঁড়ালো রবিন, কিশোর আর হারলিং। পাথরটা সরিয়ে ভেতরে আগে ঢুকলেন ডিটেকটিভ।

 ছোট গুহাটা শূন্য। ওপাশের দেয়ালে দেখা গেল সুড়ঙ্গমুখ, বোঝা গেল, ওটা দিয়েই পালিয়েছে মারটিন আর বেইরি। মানুষের তৈরি আরেকটা মাইন শ্যাফট, ঢালু হয়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। পিস্তল বের করে নিয়ে আগে আগে চললেন হারলিং। পেছনে চক দিয়ে দেয়ালের গায়ে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আঁকতে আঁকতে চললো কিশোর।

মনে হচ্ছে উত্তরের শৈলশিরার দিকে চলেছি আমরা, রবিন বললো। বইয়ে লেখা আছে, ওদিকেই ছাউনি বানিয়ে থাকে মারটিন আর বেইরি।

হবে হয়তো, বললো কিশোর। ছাউনির মেঝে থেকেই হয়তো কোনো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নিয়েছে, কিংবা খোঁড়া ছিলো, সেটা দিয়েই ঢোকে খনিতে। ফলে তাদেরকে ঢুকতে-বেরোতে দেখে না কেউ।

থেমে গেলেন হারলিং। সামনে পথ বন্ধ। পাথরের স্তূপের গোড়ায় অসংখ্য পায়ের ছাপ। নিচু হয়ে বড় একটা পাথর ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। জোরে ঠেলা দিতেই নড়ে উঠলো পাথরটা। সরাতেই বেরিয়ে পড়লো ফোকর। আর দুটো পাথর। সরাতে ঢোকার জায়গা হয়ে গেল।

হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেলেন ডিটেকটিভ। তাঁর পা দুটো অদৃশ্য হয়ে গেলে বসে পড়ে ওপাশে উঁকি দিলো দুই গোয়েন্দা। ওরাও ঢুকে পড়লো ভেতরে। বেরিয়ে এলো বাইরে। খোলা আকাশের নিচে। চারপাশে ঘন ঝোপঝাড়, গাছপালা। রবিনের অনুমান ঠিকই। ডেভিল মাউনটেইনের উত্তরের শৈলশিরাই এটা।

ঝোপের ভেতরে এই ছোট্ট মুখ কারো নজরে পড়বে না, হারলিং বললেন। এসো, যাই। আমার পেছনে থাকবে তোমরা।

এক পাশে সাগর, আরেক পাশে উপত্যকা। মাঝখানে এই শৈলশিরা। ওটার ওপর দিয়ে সাবধানে এগোলো তিনজনে। খানিক পরেই ছোট একটা কুঁড়ে চোখে পড়লো, আলো আসছে ভেতর থেকে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে এসে উঁকি দিলেন ডিটেকটিভ। রবিন আর কিশোরও মাথা তুললো।

পুরনো একটা টেবিলের দুপাশে বসে রয়েছে মারটিন আর বেইরি। টেবিলের ওপর পাথরের ছোট একটা স্তূপ।

.

১৭.

পিস্তল হাতে ভেতরে ঢুকে পড়লেন হারলিং। খবরদার, নড়বে না কেউ!

প্রায় অর্ধেক উঠে পড়েছিলো বেইরি, ধীরে ধীরে বসে পড়লো আবার চেয়ারে। জ্বলন্ত চোখে তাকালো হারলিঙের দিকে।

ছেলেদের দিকে চেয়ে মারটিন বললো, কার্ল, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বিচ্ছগুলোর ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার, শোনোনি…

ভুলই করেছি, বিড়বিড় করলো বেইরি।

কি চাই? ডিটেকটিভের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো মারটিন। পাথরগুলো? এগুলো আমাদের। খনিটা আমরা আবিষ্কার করেছি…।

কে করতে বলেছে তোমাদের? অন্যের জায়গায় রাতে চুরি করে যে মাটি খোড়ো, সেটাই তো একটা অন্যায়। তার ওপর পাথর রাখতে চাইছে। কতোখানি। বেআইনী কাজ করেছো, বুঝতে পারছো সেটা?

না, বুঝি না, গোয়ারের মতো বললো মারটিন। বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না। বিশ বছর ধরে ওই পাহাড়ের তলায় খুঁড়েছি আমরা, মাথার ঘাম পায়ে। ফেলেছি, তার কোনো দাম নেই?

থাকতো, যদি সত্যি সত্যি খনি পেতেন আপনারা, রবিন বললো। আর খনি। থেকে পাথর তুলে আনতেন। তাহলে মিস্টার হারভে নিশ্চয় একটা ভাগ দিতেন আপনাদেরকে।

খনি পাইনি তো কি পেয়েছি? পাথরগুলো এলো কোত্থেকে তাহলে?

খনি যে নয়, খুব ভালো করেই জানেন আপনারা, মিস্টার মারটিন, এই প্রথম কথা বললো কিশোর। এতোক্ষণ ঘরের জিনিসপত্র দেখেছে। একটা ছোট রেডিও, বুককেসে কয়েকটা বই, এক কোণে কয়েকটা পুরনো খবরের কাগজ।. একটা কাগজ এখন তার হাতে।

ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরলো চারজোড়া চোখ।

কি বলছো তুমি, কিশোর? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। কি করে বুঝলে?

ওখানে গোটা চারেক বই আছে, বুককেসটা দেখিয়ে বললো কিশোর। নতুন কেনা হয়েছে, হীরার খনির ওপর লেখা। আর এই পত্রিকাটায়, হাতের কাগজটা নাড়লো, স্যান ফ্রানসিসকো মিউজিয়মে হীরা ডাকাতির কথা লেখা আছে। এক বছরের পুরনো এটা। খবরটায় দাগ দিয়ে রেখেছে পেন্সিল দিয়ে।

মারটিন আর বেইরির দিকে চেয়ে ভুরু নাচালেন হারলিং। কী, কিছু বলবে?

কি আর বলবো? দীর্ঘশ্বাস ফেললো মারটিন। ঠিকই বলেছে ছেলেটা। জানি, ওটা হীরার খনি নয়। এ-অঞ্চলে কোথাও নেই ওরকম খনি।

দুটো পাথর পেয়েছিলাম, বেইরি জানালো। ভাবলাম বুঝি খনিই পেয়েছি। হীরার খনি সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্যে বইগুলো কিনে এনেছে ডিন। বই। পড়ে বুঝলাম, পাথরগুলো আফ্রিকান। তখন লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে বের করলাম পত্রিকাটা; কোথায় কবে ডাকাতি হয়েছে জানলাম। বুঝে ফেললাম, ডাকাতি করে এনে পাথরগুলো এখানে রেখে যাওয়া হয়েছে।

বেইরি থামতেই মারটিন বললো, যেহেতু চুরির মাল, ভাবলাম, পেয়েছি যখন আমরাই রেখে দেবো। চোরটা বাদে আর কেউ জানছে না এ-খবর। দুটো পাওয়ার। পর আরও খুঁড়তে লাগলাম। তারপর আর কি? দেখতেই পাচ্ছো এখানে..।

তবে খুঁড়তে গিয়ে একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল, মারটিনের কথার খেই ধরলো। বেইরি। একটা বন্ধ সুড়ঙ্গ খুলে দিলাম, আবার গোঙাতে শুরু করলো গুহাটা। ভেবেছিলাম, ভালোই হলো, ভয়ে কাছে আসবে না কেউ। নিরাপদে কাজ করতে পারবো। কিন্তু মিস্টার হারভে আর শেরিফ দেখতে এলেন। তদন্ত শুরু করলেন। বাধ্য হয়ে ঘন্টার ব্যবস্থা করলাম। ডিন যখন খুঁড়তো, পাহাড়ের চূড়ায় বসে আমি চোখ রাখতাম। কাউকে আসতে দেখলেই ঘন্টা বাজিয়ে সতর্ক করে দিতাম ডিনকে।

হাসলো মারটিন। ভালোই চলছিলো। এই ছেলেগুলোকেও ভয় দেখিয়ে একবার তাড়িয়েছি। কিন্তু আজ যে কিভাবে ঢুকে পড়লো…এই, কিভাবে ঢুকলে? কার্ল দেখলো না কেন?

জানালো কিশোর।

শুনে মুখ কালো করে ফেললো বেইরি। কিন্তু মারটিন হাসলো। চালাক ছেলে!

গম্ভীর হয়ে হারলিং বললেন, এতে হাসির কিছু নেই। চোরাই মাল চুরি করাও সমান অপরাধ।

চুরি করেছি কে বললো? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছি।

অ্যাক্সিডেন্টগুলো করালেন কেন? গরম হয়ে বললো রবিন। পাথর ফেলে আমাদেরকেও তো মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।

দেখো, প্রায় সবগুলোই অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো ওগুলো, ইচ্ছে করে ঘটানো হয়নি, বললো বেইরি। ওরকম পাথর ধসে পড়ে এখানে যখন-তখন। তাছাড়া গোঙানি শুনে নার্ভাস হয়ে যায় লোকে, অসাবধান হয়ে নিজেরাই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তবে, তোমাদের ওপর যেটা পড়তে যাচ্ছিলো, সেটা আমার দোষ। পাথরটা আলগা হয়ে ছিলো। তোমাদের ওপর চোখ রাখতে রাখতে এগোচ্ছিলাম। হোঁচট খেয়ে পড়লাম ওটার ওপর। ঠেলা লেগে গড়িয়ে পড়লো পাথরটা। বিশ্বাস করো, ইচ্ছে করে ফেলিনি।

কঠিন হলো হারলিঙের চোখ। গাধার মতো কাজ করেছে তোমরা! বলে, পাথরগুলো নিয়ে আবার চামড়ার ব্যাগে ভরতে শুরু করলেন। চেয়ে রয়েছে দুই বুড়ো। চোখের সামনে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এতোগুলো দামী পাথর, কিন্তু কিছুই বললো না। হারলিং বলছেন, আসল চোরটাকে ধরতে যেতে হবে এখন..

মিস্টার হারলিং, বাধা দিয়ে বললো কিশোর, চোরটার কথা ভেবেছি আমি.. সে জানে, মিস্টার মারটিন আর বেইরি খুঁড়ে বের করছে পাথরগুলো। ওগুলো নেয়ার জন্যে ফিরে আসবে…

পেছন থেকে কথা বলে উঠলো একটা চাপা, ভোতা কণ্ঠ, ঠিকই বলেছো তুমি। আমি এসেছি।

চমকে ফিরে তাকালো সবাই। দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নকল ফিগারো। মুখে মুখোশ। হাতে পুরনো আমলের পিস্তল।

নড়ো না কেউ, ঘরের সবাইকে সাবধান করলেন হারলিং। সাইপ্রেস ভয়ানক পাজী লোক। টেবিলে রাখা তাঁর পিস্তলটার দিকে আড়চোখে তাকালেন।

পিস্তল নাচালো নকল, ফিগাররা। না না, হারলিং, বোকামি করো না। পিস্তলের আশা ছাড়ো। যাও, দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও সবাই।

আদেশ পালিত হলো।

এই যে, তুমি, রবিনকে বললো নকল ফিগারো। ঘরের কোণে দড়ি আছে, দেখোএনে হারলিংকে বাঁধো শক্ত করে। জলদি!

রবিনকে দ্বিধা করতে দেখে হারলিং বললেন, যা বলছে করো।

দড়ি এনে হারলিঙের হাত-পা বাঁধলো রবিন। তাকে সরে যাওয়ার ইশারা করে নিজে এসে বাঁধন পরীক্ষা করে দেখলো সাইপ্রেস। সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে গেল দুই পা।

এখন দুজনে মিলে দুই বুড়োকে বাঁধো।

মারটিন আর বেইরিকে বাঁধলো দুই গোয়েন্দা। তারপর সাইপ্রেসের আদেশে কিশোরকে বাঁধলো রবিন। রবিনকে বাঁধলো, সাইপ্রেস নিজে। বাঁধা শেষ করে গিয়ে পাথরগুলো তুলে ব্যাগে ভরলো। খসখসে কণ্ঠে বললো, তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। পাথরগুলো রেডি করে রেখেছো আমার জন্যে। ভূমিকম্পে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। খুঁড়ে বের করা অনেক কষ্ট। কড়া নজর রেখেছিলাম অবশ্যই। এতো কষ্ট করে চুরি করে এনে হারাতে চায় কেউ? খিকখিক করে হাসলো চোরটা। তবে তোমরা তিন বিচ্ছু বড় জ্বালান জ্বালিয়েছে। স্কুবা ইকুইপমেন্টগুলো আনতে দেখেই বুঝেছি, কি করতে যাচ্ছে। তার ওপর পিছে লেগে ছিলো হারলিং। ভয়ই। পেয়ে গিয়েছিলাম। পাথরগুলো না হারাই! চলি। গুড বাই। বেরিয়ে গেল সে।

গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আমি একটা গাধা! আমাদেরকে ধরে যখন সুড়ঙ্গে আটকালো, তখনই বোঝা উচিত ছিলো আমার, খুঁড়ে পাথর বের করার ব্যাপারটা সে জানে। আমাদের যেখান থেকে ধরে এনেছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো খোঁড়ার শব্দ। হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিলো আমার। কেন ভাবলাম না, ব্যাটা আমাদের ওপর চোখ রেখেছে?

দুঃখ করো না, সান্ত্বনা দিলেন হারলিং। চমৎকার ভাবে এই রহস্যের সমাধান করেছে। গাধা তো আসলে আমি। কেন বুঝলাম না, মারটিন আর বেইরিকে ব্যবহার করছে সাইপ্রেস?

হু, দীর্ঘশ্বাস ফেললো রবিন। কিশোরের অনুমানই ঠিক। চোরটা সত্যি। ফিরে এলো।

কিশোর সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ভিলেনের চেহারাই যদি দেখা না গেল, রহস্যের এমন কিনারা করে লাভটা কি? পালিয়ে গেল। দেখতে কেমন। কোনোদিনই হয়তো জানবো না। মিস্টার হারলিংকেও আবার নতুন করে মরা। মাছের মতো হাঁ হয়ে গেল হঠাৎ তার মুখ।

কিশোর? ডাকলো রবিন।

কিশোর, হারলিং জিজ্ঞেস করলেন। কি হয়েছে?

চোখ মিটমিট করলো কিশোর। বহুদুর থেকে ফিরে এলো যেন। বাঁধন খুলতে হবে! ছাড়া পেতে হবে আমাদের! চেঁচিয়ে বললো সে। জলদি! নইলে ব্যাটাকে ধরতে পারবো না!

বিষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন হারলিং। বৃথা চেষ্টা, কিশোর। লাভ হবে না। ও এতোক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।

মনে হয় না…

বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ হলো। খানিক পরেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। দরজা। বিশালদেহী একজন লোক ঘরে ঢুকলেন, দুই গোয়েন্দা আগে দেখেনি। তাঁকে। ভুরু কুঁচকে তাকালেন পাঁচ বন্দির দিকে। কি ব্যাপার? গমগম করে। উঠলো ভারি কণ্ঠস্বর।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো দুই গোয়েন্দা। দুটো পরিচিত চেহারা চোখে পড়লো। তাদের। মুসা, আর মিসেস হারভে।

.

১৮.

বিশালদেহী মানুষটা সানতা কারলা কাউন্টির শেরিফ। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে বলে তিন গোয়েন্দার ওপর রেগে গেলেন। এমন একটা ভয়ানক চোরের পেছনে লাগতে কে বলেছে তোমাদেরকে।

ওই গুহায় আটকে যদি মেরে ফেলতো! বললেন মিসেস হারভে। ভাগ্যিস, দেয়ালে চিহ্নগুলো দেখতে পেয়েছিলো মুসা। নইলে তো জানাই যেতো না তোমাদেরকে কোথায় বেঁধে রেখেছে।

চুপ করে রইলো রবিন।

সরি, স্যার, শেরিফের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। আগে আপনাকে জানানোর সুযোগই পাইনি। তাছাড়া মিস্টার হারলিঙের দেখা পেয়ে গেলাম। তিনি অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। এলাম সঙ্গে সঙ্গে। চোরটা যে ওভাবে আমাদেরকে চমকে দেবে, ভাবতেই পারিনি।

তা ঠিকই বলেছে ওশেরিফ, হারলিং বললেন। গুহায় যে ডেঞ্জারাস এক ক্রিমিন্যালও ঢুকতো, জানতো না, ওরা। ওরা ঢুকেছিলো নিছক কৌতূহলের বশে, কিসে গোঙায় জানার জন্যে। সেকথা মিস্টার হারভেও জানেন।

যুতসই কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে আরও রেগে গেলেন শেরিফ। হারলিঙের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু ঘোঁৎঘোৎ করলেন।

আপনি যা-ই বলুন, শেরিফ, আবার বললেন হারলিং। কাজ দেখিয়েছে বটে ছেলেগুলো। বড়রা যা পারেনি, ওরকম একটা রহস্যের সমাধান করে দিয়েছে।

হাসলেন মিসেস হারভে। বড় হলে অনেক বড় গোয়েন্দা হবে ওরা।

তা হবে, এই প্রথম শেরিফের মুখে হাসি ফুটলো। আমরা যা পারিনি…কিন্তু চোরটা যে পালালো! তাকে ধরি কিভাবে?

আমার মনে হয় না পালিয়েছে, বোমা ফাটালো যেন কিশোর। একসঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল সবগুলো চোখ। চেষ্টা করলে এখনও ধরা যায়।

যায়?

অন্য সবাই কোথায়, স্যার? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

 অন্য সবাই? র‍্যাঞ্চের লোকদের কথা বলছো তো? তোমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে, জবাব দিলেন শেরিফ। কয়েকজনকে নিয়ে হারভে গেছে সৈকতে। আরও কয়েকজনকে নিয়ে কোহেন আর প্রফেসর গেছেন ডেভিল মাউনটেইনের ওপাশে।

ওদের সঙ্গে কোথায় আপনার দেখা হবে?

কেন? র‍্যাঞ্চে।

জলদি চলুন তাহলে।

 ভ্রূকুটি করলেন শেরিফ। যা বলার বলে ফেলো না এখানেই।

মাথা নাড়লো কিশোর। একদম সময় নেই, স্যার। বলতে অনেক সময় লাগবে।.জলদি চলুন, চোরটাকে ধরতে চাইলে।

ওর কথা শুনুন, শেরিফ, হারলিং বললেন। ওর ওপর ভক্তি এসে গেছে। আমার। সত্যি ধরে ফেলবে চোরটাকে। চলুন চলুন।

বেশ, দরজার দিকে এগোলেন শেরিফ।

শেরিফের দুজন ডেপুটি পাহারায় রয়েছে পাহাড়ের গোড়ায়। তাদের দুটো ঘোড়ায় উঠলো রবিন আর মুসা। আর শেরিফের সঙ্গে কিশোর। রুক্ষ তরাই অঞ্চল, এবড়োখেবড়ো। কঁকুনির চোটে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকাই দায়।

র‍্যাঞ্চের কাছে চলে এলো ওরা। কাউকে চোখে পড়লো না।

এবার বলো, শেরিফ বললেন। কাকে ধরতে হবে?

ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। আসবে, স্যার, শিওর আসবে। এলেই ধরতে হবে। আমাদেরকে খোঁজার ভান করে না পেয়ে ফিরে আসবে। ওত পেতে থাকবো আমরা। এলেই ধরবো।

ঘোড়া থেকে নামলেন শেরিফ। কিশোরকে নামতে সাহায্য করলেন। এবার খুলে বলো সব।

 স্যার, কিশোর বললো। কেবিনে কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে চোরটা…

র‍্যাঞ্চ হাউসের পাশ থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর হারকসন। এই যে, শেরিফ, খুঁজে পেয়েছেন তাহলে। ভেরি গুড। তোমরা ছেলেরা খুব একচোট দেখিয়েছো। ভুগিয়ে ছেড়েছো। নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি। যা চোখ পাথর।দেখতে পাইনি, কি করে যেন লেগে, কেটে গেল। ফিরে এসে ব্যাণ্ডেজ না বেঁধে আর পারলাম না।

সময় মতোই এসেছেন, প্রফেসর, শেরিফ বললেন। কিশোর পাশা এখন একটা গল্প শোনাবে আমাদের।

শান্ত কণ্ঠে কিশোর বললো, গল্প শোনানোর আর দরকার নেই, স্যার। প্রফেসরের দেহ তল্লাশি করলেই হীরাগুলো পেয়ে যাবেন। আবার হাতছাড়া করেছে বলে মনে হয় না। ওকে যে সন্দেহ করেছি, কল্পনাও করেনি নিশ্চয়। তাই এক না, মিস্টার স্যাড সাইপ্রেস?

সাইপ্রেস! শেরিফ অবাক।

 ছদ্মনাম। ওর ব্যাণ্ডেজ খুলে দেখুন, হীরাগুলো পেয়ে যাবেন।

ঘুরে দৌড় দিলো প্রফেসর হারকসন, ওরফে স্যাড সাইপ্রেস। কিন্তু পালাবে কোথায়? শেরিফ আর তার দুই সহকারীর কাছে পিস্তল রয়েছে। সহজেই ধরে ফেলা হলো চোরটাকে।

.

১৯.

ব্যাণ্ডেজের ভেতরই পাওয়া গেল তাহলে, বললেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার।

হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বললো। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেছিলো। সাইপ্রেস। নেভাডার লাইসেন্স প্লেট লাগানো ওটাতে। দুটো গাড়ি ছিলো তার। নেভাডার প্লেট লাগানোটা লুকিয়ে রাখতো মোনিং ভ্যালির একটা গিরিপথে, ওদিকে যেতে না কেউ। তাই কারও চোখে পড়েনি গাড়িটা। হেনরি ফিগারোর পোশাক আর মুখোশটা রাখতো গাড়ির মধ্যে।

 হুঁ, বিশাল ডেস্কের ওপাশে বসে আস্তে মাথা দোলালেন পরিচালক। ভীষণ চালাক। …যা-ই হোক, দুই বোকা বুড়োর কি খবর? মারটিন আর বেইরি?

হাসলো রবিন। ওরা বার বার কসম খেয়ে বলেছে, হীরাগুলো ফিরিয়ে দিতো। ওদের কথা বিশ্বাস করেননি শেরিফ। র‍্যাঞ্চের লোকদের ভয় দেখিয়েছে। বলে নালিশ করতে পারতেন মিস্টার হারভে। করেননি। তিনি মাফ করে দিয়েছেন দুই বুড়োকে। ফলে শেরিফও ছেড়ে দিয়েছেন তাদেরকে।

কিশোর, জানতে চাইলেন পরিচালক। কি করে বুঝলে, হেনরি ফিগারো, প্রফেসর হারকসন আর স্যাড সাইপ্রেস একই লোক?

সামনে ঝুঁকলো কিশোর। শুরু থেকেই প্রফেসরের ভাবভঙ্গি ভালো লাগেনি। আমার, খটকা লেগেছে। কয়েকবার ভেবেওছি, ও-ই হয়তো নকল হেনরি ফিগারো।

কিন্তু শিওর হলে কি করে, ও-ই স্যাড সাইপ্রেস?

কেবিনে বন্দি করার পর একটা কথা বলেছিলো, তাতেই…

দ্রুত আরেকবার রবিনের লেখা ফাইলের পাতা ওল্টালেন পরিচালক। তারপর মুখ তুললেন। কই, বিশেষ কিছু তো বলেনি সে?

কম বলেছে। তবে যা বলেছে, ধরা পড়ার জন্যে যথেষ্ট। আমাদের স্কুবা, ইকুইপমেন্টগুলো আনতে নাকি দেখেছে। কে দেখে থাকতে পারে? এমন কেউ, যে র‍্যাঞ্চে থাকে। তারপর রয়েছে তার কণ্ঠস্বর। অভিনয় করে অন্যরকম করার। চেষ্টা করেছে বটে; কিন্তু গলার স্বর, কথা বলার ধরন বদলালেই বা কতোটা: বদলাতে পারে একজন মানুষ? দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে শুরু করলাম, থামলো কিশোর। গাল চুলকালো। সে আরও বললো, হারলিং পিছু লাগাতে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো। ওই কথা থেকে দুটো সূত্র পেলাম। এক, নকল ফিগারো জানে। হারলিং কে। দুই, হারলিং যে তার খুব কাছাকাছি এসে গেছে, সেটাও জানে।

নিশ্চয়ই! একমত হলেন পরিচালক। হারলিং তোমাদেরকে বলেছে, স্যাড সাইপ্রেস তাকে চেনে। অথচ হারলিংকে তোমরা ছাড়া র‍্যাঞ্চের আর কেউ দেখেনি। তোমরা র‍্যাঞ্চের লোকের কাছে তার চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। শুনেই হুঁশিয়ার হয়ে গেছে সাইপ্রেস, তোমাদের কথা থেকেই বুঝে গেছে চোখে পট্টি লাগিয়ে হারলিংই ছদ্মবেশ নিয়েছে।

ঠিক তাই, স্যার।

কিন্তু, তোমাদের কথা তো র‍্যাঞ্চের আরও লোকে শুনেছে। তাদেরকে সন্দেহ। না করে শুধু প্রফেসরের ওপর নজর গেল কেন তোমার?

ওর পিস্তলটা, স্যার।

পিস্তল? বুঝতে পারছেন না পরিচালক। এমন কি বিশেষত্ব আছে ওটার…

ওটার কিছু নেই, স্যার, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। ওটাকে যেভাবে ধরা হয়েছে…মানে, আমি বলতে চাইছি, নকল ফিগারো বাঁ হাতে ধরেছিলো পিস্তলটা। হোলস্টার পরেছিলো বাঁ দিকে। অথচ কোনো বইতে উল্লেখ নেই যে আসল হেনরি ফিগারো বাইয়া ছিলো। তার ছবিতেও হোলস্টার ডান দিকে ঝোলানো দেখেছি। গুহায় তার কঙ্কাল পেয়েছি, তখনও ডান হাতে ধরা ছিলো পিস্তলটা…

এহহে! নিজের ওপরই বিরক্ত হলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। এই সহজ কথাটা একবারও ভাবলাম না! বইতে উল্লেখ নেই, ছবিতে রয়েছে হেনরি ফিগারোর ডান পাশে হোলস্টার। শুধু প্রফেসর হারকসনের বক্তব্য, ফিগারো ছিলো বাইয়া। নিজের ফঁদে নিজেই পড়েছে।

হ্যাঁ, হাসলো কিশোর। স্যাড সাইপ্রেস কিন্তু আসলেই ইতিহাসের প্রফেসর, স্যার। ইউরোপ থেকে পালিয়ে এসে ক্যালিফোর্নিয়ায় লুকিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছে, তাই বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি কেউ। হেনরি ফিগারোর ওপর একটা বইও লিখতে আরম্ভ করেছিলো, তাতে বলেছে, ফিগারো ছিলো বাঁইয়া। নিজেকে ফিগারো বলে চালিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিলো আগে থেকেই, তাই বাঁইয়ার ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে চেয়েছিলো।

চেয়ারে হেলান দিলেন পরিচালক। খুব জটিল একটা রহস্যের সমাধান করেছে এবার। অথচ সূত্র বলতে প্রায় কিছুই ছিলো না তোমাদের হাতে। শুধু বাইয়ার ব্যাপারটা দিয়েই…নাহ, ইউ আর অ্যা জিনিয়াস, ইয়াং ম্যান!

মিস্টার ক্রিস্টোফারের মতো মানুষের প্রশংসা পাওয়া যা-তা কথা নয়। গর্বে ফুলে উঠলো গোয়েন্দাদের বুক। মুসার দিকে চেয়ে ইশারা করলো কিশোর।

বাক্সটা এতোক্ষণ কোলের ওপর রেখে দিয়েছিলো মুসা। তুলে টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলো। নিন, স্যার। আপনাকে প্রেজেন্ট করলাম।

কী?

খুলেই দেখুন।

বাক্সটা খুলে ভেতরের জিনিসটা বের করলেন পরিচালক। দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলেন ওটার দিকে। আনমনে বিড়বিড় করলেন, হেনরি ফিগারোর পিস্তল!

হ্যাঁ, স্যার। মিস্টার হারভে আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন, আমরা দিলাম আপনাকে, রবিন বললো। আপনার ব্যক্তিগত জাদুঘরে রেখে দেবেন। আর মোনিং ভ্যালির ওপরে ছবি করলে, তাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।

থ্যাংক ইউ, মাই বয়েজ! থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ!

পিস্তলটা উল্টেপাল্টে দেখে টেবিলে রেখে দিলেন পরিচালক। সরাসরি তাকালেন কিশোরের চোখের দিকে। মিটিমিটি হাসছেন। আচ্ছা, ওই বুড়ো মানুষটার ব্যাপারে কি মনে হয় তোমার? ওটাই কি হেনরি ফিগারোকে মেরেছিলো?

পলকে বদলে গেল কিশোরের চেহারা। দৃষ্টি চলে গেল যেন বহুদূরে। আপনি তো জানেন, স্যার, কিংবদন্তী শুধু শুধু তৈরি হয় না। পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। হয়তো ওরকম কোনো কিছু একটা ছিলো গুহার ভেতরের খাড়িতে। হয়তো লক নেস মনস্টারের মতো কোনো দানব। ভাবছি, সময় করতে পারলে গিয়ে আরেকবার ঢুকবো গুহাটায়। দানব-রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করবো।

খাইছে! তাড়াতাড়ি দুই হাত নাড়লো মুসা। গেলে তুমি যাও। আমি বাবা ওর মধ্যে নেই।

হেসে উঠলো সবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *