০০১. স্মোকি মাউন্টেনে

ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন / অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান

[ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়েছে, তবে কিছু কিছু জায়গায় পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।]

ডিজিটাল ফরট্রেস সবচে ভাল এবং বাস্তবধর্মী টেকনো-থ্রিলার, গত কয়েক বছরে এমন বই বাজারে আসেনি… জমাট বাঁধানো প্রতিটা মিনিট।

–মিডওয়েস্ট বুক রিভিউ

আমেরিকার সবচে গোপন এবং সবচে মূল্যবান ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এন এস এ। এর অব্যর্থ, অসাধারণ কোড ব্রেকিং মেশিন এমন এক কোডের সম্মুখীন হল যা ভাঙা যাচ্ছে না। এজেন্সি সাথে সাথে তাদের চিফ ক্রিপ্টোগ্রাফার সুসান ফেচারের শরণাপন্ন হল। গণিতবিদ মেয়েটা একই সাথে মেধাবী এবং রূপবতী। ব্যাপারটা ধরতে পারার পর কেঁপে উঠল গোটা প্রতিষ্ঠান। এন এস এ কে জিম্মি করা হয়েছে। বন্দুকের মুখে নয়, নয় বোমার মুখে; বরং এক অসাধারণ, অপ্রতিরোধ্য জটিল কোডের দ্বারা। ইউ এস ইন্টেলিজেন্সকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে সেটা। ক্রমবর্ধমান গোপনীয়তা আর মিথ্যার বেড়াজালে আটকা পড়েও সুসান তার বিশ্বস্ত এজেন্সিকে রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। সবদিক থেকে প্রতারিত হয়ে অবশেষে সে নেমে পড়ল নিজ দেশকে রক্ষার কাজে… নিজেকে রক্ষার কাজে… ভালবাসার মানুষটাকে রক্ষার কাজে।

এক্সাইটিং… সাইবার মাইন্ডেড পাঠকদের তৃষ্ণা মিটাতে পারবে এটা সহজেই।

–বুকলিস্ট

.

একটা ঋণ স্বীকার করে নিতে হয়: সেন্ট মার্টিন্স প্রেসে আমার সম্পাদক টমাস ডানের কাছে, অসাধারণ মেধাবী মেলিসা জ্যাকবসের কাছেও। আমি ঋণী নিউ ইয়র্কে আমার এজেন্ট জর্জ ওয়েসার, ওলগা ওয়েসার আর জ্যাক এলওয়েলের কাছে। তাদের সবার কাছে, যারা বইটা শুরু করার পিছনে অবদান রেখেছে, নেপথ্যে থেকেছে কাহিনীর কাজ করার সময়। আর বিশেষত আমার স্ত্রী ব্লিথের প্রতি, তার মনের জোর আর ধৈর্যের কারণে।

আরো… একটা বিশেষ ধন্যবাদ এন এস এর সাবেক দু কর্মকর্তার প্রতি যারা সহায়তার হাত না বাড়িয়ে দিলে এ বইটা লেখাই হত না।

*

শুরুর কথা

প্লাজা ডি এসপানা
সেডিল, স্পেন
সকাল ১১:০০

বলা হয়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে সব পরিষ্কার হয়ে যায়, এখন এনসেই টানকাডো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, কথাটা একেবারে সত্যি। বুকের একপাশ চেপে ধরে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার আগ মুহূর্তে সে তার কাজের ভুল দিকটা ধরতে পারে।

লোকজন চারধার থেকে ভিড় জমাচ্ছে, ঝুঁকে আসছে তার উপর, চেষ্টা করছে সাহায্য করার। কিন্তু দেরি হয়ে গেল, অনেক বেশি দেরি হয়ে গেল। এখন আর কিছু করার নেই।

কাঁপতে কাঁপতে সে বা হাতটাকে উঁচু করে ধরে। খুলে দেয় মুষ্ঠিবদ্ধ কয়েকটা আঙুল। মনে মনে বলে, আমার হাতের দিকে দেখ।

চারপাশের লোকজন তাকায় তার হাতের দিকে, আঙুলগুলো বাঁকা। জন্মগতভাবে অক্ষম টানকাডো। সেটা জানানো তার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মূল ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কেউ। তারও বোঝানোর মত শক্তি নেই।

বাঁকা আঙুলে গেঁথে আছে একটা সোনালি আঙটি। আন্দালুসিয়ান সূর্যের দীপ্তিতে মুহূর্তের জন্য ঝিকিয়ে ওঠে সেখানকার চিহ্নগুলো। অস্তাচলে যাচ্ছে দিবাকর। এনসেই টানকাডো জানে এটাই তার জীবনের শেষ রাত।

* *

অধ্যায় : ১

স্মোকি মাউন্টেনে এখন তারা। বিছানার পাশে শুয়ে বসে আয়েশ করে ব্রেকফাস্ট করার মজাই আলাদা। ডেভিডের চোখমুখ হাসছে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে, কী বল অনন্যা, বিয়ে করবে আমাকে?

ক্যানোপি বেড থেকে চোখ সরিয়ে ভাবে মেয়েটা, ও-ই একজন। চিরদিনের জন্য। গহিন, সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে টের পায় ঠিক ঠিক দূরে, বহুদূরে কোথাও ঝনঝন করে বাজছে ঘণ্টা।

হাতড়ে বেড়ায় মেয়েটা নেই। সে নেই পাশে। দু হাতে কিছু ধরা পড়ছে না।

ফোনের শব্দে সম্বিৎ ফিরে আসে। ভেঙে যায় সুখ স্বপ্ন। হাত বাড়ায় সুসান ফ্লেচার, রিসিভার তুলে নিয়ে বলে, হ্যালো?

সুসান, ডেভিড বলছি। ঘুম ভাঙিয়ে দিইনি তো? বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে সে হাসল, আমি তোমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছিলাম। এস, খেলা কর।

হাসল এবার ডেভিডও, বাইরে এখনো অন্ধকার।

হুম। তাহলে অবশ্যই চলে এস, এবং খেল। উত্তরের দিকে যাবার আগে তাহলে একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস লুকায় ডেভিড। সেজন্যেই কল করেছি। আমাদের একসাথে যাওয়াটা মনে হয় হবে না।

কী?

সরি। শহর ছেড়ে বেরুতে হবে যে! কালকে ফিরে আসব। সকালে আমরা প্রথম কাজটা সেরে ফেলতে পারি। এখনো হাতে পাক্কা দুটা দিন আছে।

কিন্তু আমিতো রিজার্ভ করে ফেলেছি। স্টোন ম্যানোরে আমাদের পুরনো কামরাটাই দখল করেছিলাম।

আমি জানি, কিন্তু–

আজ রাতে আমাদের স্পেশাল কিছু হবার কথা ছিল, ছমাস পূর্ণ হবার সেলিব্রেশন। তোমার মনে আছে, আমরা এ্যানগেজড, মনে আছে না?

সুসান, এবার আর দীর্ঘশ্বাস ঠেকাতে পারে না সে, আমি সত্যি সত্যি এখন যেতে পারব না। তারা বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্লেন থেকে তোমাকে কল করে সব খুলে বলব।

প্লেন? হচ্ছেটা কী? ইউনিভার্সিটি কোন দুঃখে…?

বিশ্ববিদ্যালয় না। ফোন করে সব বুঝিয়ে বলব, বললাম তো। এখন যেতেই হবে, ওরা কল করছে। খবরাখবর পাঠাব নিয়মিত। কথা দিলাম।

ডেভিড! চিৎকার দিল এবং সুসান, কী ব্যাপার—

দেরি হয়ে গেছে। ডেভিড তুলে রেখেছে ফোনটা।

সুসান ফ্লেচার ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করল একটা ফোন কলের জন্য। কলটা আর কখনোই এল না।

.

সেদিন বিকালে বাথ টাবে আধশোয়া হয়ে ফেনায় ডুবে থেকে সুসান ফ্লেচার চেষ্টা করল যেন স্টোন ম্যানোর আর স্মোকি মাউন্টেনকে ভুলে থাকা যায়। কোথায় থাকতে পারে সে? ভেবে কূল পায় না মেয়েটা। কেন কল করছে না।

আস্তে আস্তে চারপাশের পানি গরম থেকে কুসুম গরম, কুসুম গরম থেকে একেবারে শিতল হয়ে পড়ে, কিন্তু তার কোন খেয়াল নেই। অবশেষে উঠে বসে কর্ডলেসের আওয়াজ পেয়ে। ধড়মড় করে উঠে বসে সে, ছলকে পড়ে পানি, চলে যায় সিঙ্কে রাখা কর্ডলেসের দিকে।

ডেভিড?

স্ট্র্যাথমোর বলছি।

আশাহত হল সুসান, ও। কণ্ঠ থেকে হতাশাটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না কিছুতেই, শুভসন্ধ্যা, কমান্ডার।

আরো তরুণ কাউকে আশা করছিলে নাকি? ভদ্রোচিত কৌতুক ঝরে পড়ছে তার কণ্ঠ থেকে।

না, স্যার। সে একটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, ব্যাপারটা আসলে তা না–

অবশ্যই তা। উচ্চস্বরে হেসে উঠল লোকটা, ডেভিড বেকার দারুণ মানুষ। কখনো তাকে হারিয়ে ফেল না।

থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।

হঠাৎ একটু সিরিয়াস হয়ে গেল কমান্ডারের কণ্ঠ। সুসান, কল করেছি কারণ তোমাকে এখানে প্রয়োজন।

আজ শনিবার, স্যার। সাধারণত:এ দিনে আমরা–

আমি জানি। শান্ত তার কণ্ঠ, কিন্তু প্রয়োজনটা জরুরি।

উঠে বসল সুসান। জরুরি! কমান্ডার স্ট্র্যাথমোরের কণ্ঠে কখনো এ কথাটা উচ্চারিত হয়নি। ইমার্জেন্সি? ক্রিপ্টোতে? সে কল্পনাও করতে পারে না। ইয়েস ইয়েস স্যার। বলল সে আমতা আমতা করে, আমি হাজির হব যত দ্রুত সম্ভব।

আরো দ্রুত বানিয়ে ফেল সেটাকে।

.

সুসান ফ্লেচার খুব দ্রুতহাতে তোয়ালে ছেড়ে নেয়, পরে নেয় পোশাক। তারপর গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে পাহাড়ি আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচার পায়তাড়া করার আগে কুজেটের দিকে এগিয়ে যায় একটা ব্লাউজ আর স্কার্ট তুলে নেয়ার জন্য। ইমার্জেন্সি? ক্রিপ্টোতে?

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ভেবে পায় না সুসান, আর কত খারাপ হতে পারে আজকের দিনটা।

সে জানেও না, কতটা খারাপ হতে পারে।

অধ্যায় : ২

মৃত, শান্ত কোন সাগরের ত্রিশ হাজার ফুট উপরে একটা লিয়ারজেটের ছোট, ডিম্বাকার জানালা দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে ডেভিড বেকার। জানতে পেরেছে, বিমানের ফোন বিকল। সুসানকে কল করার কোন উপায় নেই।

কী করছি আমি এখানে? প্রশ্ন তোলে সে নিজের কাছেই। কিন্তু উত্তরটা একেবারে সরল। এখানে এমন সব মানুষ আছে যাদের কাছে খুব কমই না বলা হয়।

মিস্টার বেকার, সরব হয়ে উঠল লাউড স্পিকার, আর আধঘন্টার মধ্যে আমরা চলে আসছি।

নড করল বেকার অদৃশ্য কণ্ঠের প্রতি। ভাল, খুবই ভাল।

শেড তুলে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল সে। বিফল মনোরথে শুধু ভাবতে পারল মেয়েটার কথা, ঘুম এল না কিছুতেই।

অধ্যায় : ৩

সুসানের ভলভো সেডান একটা দশফুটি সাইক্লোন ফেন্সের আড়ালে গা ঢাকা দিল। তরুণ এক গার্ড হাত রাখল গাড়ির ছাদের উপর।

আইডি, প্লিজ।

সুসান এগিয়ে দিল তার আইডি এবং যথারীতি ত্রিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল। লোকটা সেটা কম্পিউটারে পরীক্ষা করেই ফিরে এসে বলল, ধন্যবাদ, মিস ফ্লেচার। গার্ড লোকটা একটা সাইন দেয়ার সাথে সাথে হাট হয়ে খুলে গেল দরজা।

আরো আধমাইল সামনে সেই একই ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হল সুসানকে। সেই একই রকম ইলেক্ট্রিফাইড বেড়া। চলে এস, লোকজন… এখানে আমি মাত্র কয়েক মিলিয়ন বার এসেছি।

শেষ চেকপয়েন্টে এসে একটা ধাক্কা খেল সে। গম্ভীর মুখের হিংস্র দুটা কুকুর সহ এক গার্ড উদিত হল। হাতে মেশিনগান। তার লাইসেন্স প্লেটে এক নজর বুলিয়ে নিয়ে যেতে দিল তাকে। আরো আড়াইশ গজ যাবার পর সামনে দেখা দিল এমপ্লয়ি লট-সি। অবিশ্বাস্য। ভাবে সে। ছাব্বিশ হাজার কর্মচারি এবং বার বিলিয়ন ডলার বাজেট; যে কেউ ভাবতে পারে তারা আমাকে ছাড়াই ছুটির দিনে এখানে ঢু মারবে। সুসান তার ইঞ্জিনের দিকে নজর দেয়। থামিয়ে দেয় সেটাকে।

সামনের সুদৃশ্য এলাকা পেরিয়ে আরো দুটা চেকপয়েন্টের ঝামেলা চুকিয়ে হাজির হল মেয়েটা সেই জানালাবিহীন টানেলের সামনে। তার পরই নিউ উইং। একটা ভয়েস স্ক্যান বুথ পথ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এন এস এ) :
ক্রিপ্টো ফ্যাসিলিটি
অগোরাইডজ পার্সোনেল ওনলি

অস্ত্র হাতে গার্ড চোখ তুলে তাকাল; আফটারনুন, মিস ফ্লেচার

ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকায় সুসান, হাই, জন।

আজকে আপনাকে আশা করিনি।

হ্যাঁ, আমিও না। প্যারাবোলিক মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে যায় সে, সুসান ফ্লেচার, পরিষ্কার কণ্ঠে বলে শব্দ দুটো। কম্পিউটার সাথে সাথে তাকে চিনে নেয়। তারপর খুলে যায় বন্ধ দুয়ার।

.

সিমেন্টের কজওয়ে ধরে এগিয়ে যাবার সময় গার্ড তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে লক্ষ করেছে, মেয়েটার চোখের দৃষ্টি আজ একটু নিষ্প্রভ, কাঁধ আজো টানটান, বাদামি, চুলগুলো একটু এলোমেলো হয়ে কাঁধের উপর ছড়ানো। প্রস্তুত হবার সময় পায়নি, গুছিয়ে ওঠার আগেই চলে এসেছে, বোঝা যায়। জনসল বেবি পাউডার যে তার গায়ে লেগে আছে, টের পাওয়া যাচ্ছে গন্ধে, সাদা ব্লাউজের নিচে ব্রা ঠিক ঠিক দেখা যায়। হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে খাকি স্কার্ট, তার নিচে খোলা পা… সুসান ফ্লেচারের পা।

ভাবা কঠিন, তাদের আই কিউ একশো শত্তুর। একবার ভেবে নে গার্ড।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার গমনপথের দিকে। তার পর মাথাটাকে একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায় নিজের কাজে।

.

সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে যাবার পর পরই একটা গোলাকার দরজা পথ আগলে পাড়ায়। বিশাল অক্ষর খোদিত সেটার গায়ে। ক্রিপ্টো।

দীর্ঘশ্বাস লুকাতে লুকাতে সে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় সাইফার বক্সের উপর। তারপর তার একান্তই নিজস্ব পাঁচ ডিভিটের পিন কোড প্রেস করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাবো টনের স্ল্যাব গা ঝাড়া দিয়ে সরে যেতে শুরু করল। কাজের দিকে মন দেয়ার চিন্তা করছে সুসান। কিন্তু সেটা বারবার চলে যাচ্ছে অন্য কারো দিকে।

ডেভিড বেকার। সে আর কখনো কাউকে ভালবাসেনি, এ লোকটাকে ছাড়া। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সবচে তরুণ ফুল প্রফেসর। মেধাবী ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ স্পেশালিস্ট, এ্যাকাডেমিয়ার জগতে সে একজন সেলিব্রিটি। জন্ম থেকেই বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি আর ভাষার প্রতি ভালবাসা আছে তার। ছটা এশিয়ান ভাষার সাথে সাথে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ আর ইতালিয়ানে হাতযশ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইটমোলজি (শব্দের উৎপত্তিবিদ্যা) আর লিঙ্গুইস্টিক্স (ভাষা ও তার গঠনবিদ্যা) পড়ায় এবং এ বিষয়ে আসা একশো একটা প্রশ্নের জবাব দেয় বিনা দ্বিধায়।

গায়ের রঙ একটু ঘন–সবজু চোখের সাথে আকর্ষণীয় এক মানুষ। বয়স পঁয়ত্রিশ। তার স্পষ্ট চোয়াল দেখলে বারবার সুসানের মনে পড়ে যায় পাথরে খোদিত মূর্তির কথা। ছ ফুটেরও বেশি লম্বা বেকার তার যে কোন সহকর্মিরচে দ্রুত নড়তে পারে স্কোয়াশের সময়। সাথের খেলোয়াড়কে নাস্তানাবুদ করে দেয়ার পর তার কাজ একটা ঝর্ণার মধ্যে মাথা ডুবিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করে নেয়া। ঘন, কালো চুলকে ভিজিয়ে নেয়া। তারপর সোজা এগিয়ে যাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে, একটা ফুট শেক আর সেইসাথে বিশেষ ধরনের রুটি-ব্যাগেল এগিয়ে দিবে।

সে সবচে কম বয়েসি প্রফেসর, স্বাভাবিকভাবেই তার বেতনও সবচে কম, এখনো টাইম স্কেলে তেমন বাড়েনি। তাই যখনি একটু টাকার দরকার পড়ে–স্কোয়াশ ক্লাবের সদস্য ফি দিতে হয় বা পুরনো ডানলপটাকে একটু নতুন রূপ দিতে হয়, বিনা দ্বিধায় কাজে নেমে পড়ে। ওয়াশিংটন আর তার আশপাশের এলাকায় বিদেশি ভাষা থেকে অনুবাদ করে দেয়ার কাজ করে। সাধারণত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ। এমনি একটা কাজের সময় সে সুসানের সাথে পরিচিত হয় প্রথম বারের মত।

সকালের জগিং থেকে মাত্র ফিরেছে বেকার তার তিন কামরার ফ্যাকাল্টি এ্যাপার্টমেন্টে। দেখতে পেল, আনসারিং মেশিনটা রিঙ্ক করছে। এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস হাতে নিয়ে মনোযোগ দিল প্লেব্যাকের দিকে। এমন বার্তা সে হরদম পায়। একটা সরকারি সংস্থা তার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছে যেন কয়েক ঘণ্টা পর অনুবাদের কাজটুকু করে দেয়। মজার ব্যাপার হল, বেকার কখনো সেই প্রতিষ্ঠানের নাম-গন্ধও জানতে পারেনি।

তাদের নাম নাকি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। বলল বেকার তার কয়েকজন কলিগের কাছে ফোন করে।

আপনি বলতে চাচ্ছেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল?

না। তারা নামটা বলেছে এজেন্সি। এন এস এ। কখনো নাম শুনিনি।

জি এ ও ডিরেক্টরি চেক করল বেকার সাথে সাথে। সেখানেও তেমন কোন সংস্থার নাম নেই। স্কোয়াশ খেলার এক পুরনো সঙ্গির কাছে ফোন করল সাথে সাথে। আগে সে ছিল পলিটিক্যাল এ্যানালিস্ট। পরে কংগ্রেস লাইব্রেরির রিসার্ট ক্লার্কের পদে কাজ করেছে। বন্ধুর ব্যাখ্যা শুনে অবাক হয়ে গেল ডেভিড।

পরে দেখা গেল, এন এস এ যে শুধু আছে তাই নয়, এটাকে পৃথিবীর সবচে প্রভাবশালী সরকারি সংস্থার একটা হিসাবে গণ্য করা হয়। তারং. পৃথিবীর ইন্টেলিজেন্স ডাটা সেখানে এসে জড়ো হয়, একই সাথে তাদের দ্বারাই ইউ এস এর গোপন তথ্যগুলোকে আর সব ব্যাপার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে গত অর্ধ শতাব্দি ধরে। মাত্র তিন শতাংশ আমেরিকান সেটার অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন।

এন এস এ, বলেছিল তার এক বন্ধু মানে হল, নো সাচ এজেন্সি।

আগ্রহ আর কৌতূহলের একটা মিশ্রণ নিয়ে বেকার সেই এজেন্সির অফার গ্রহণ করল। গাড়ি দাবড়ে গেল আরো সাইত্রিশ মাইল দূরে, সেই প্রতিষ্ঠানের আটষট্টি একর জুড়ে থাকা দানবীয় হেডকোয়ার্টারের দিকে। মেরিল্যান্ডের ফোর্ট মিডে সেটাকে বনানীর মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অগুণিত সিকিউরিটি চেকপয়েন্টের নানা ধরনের ভ্যাজাল পেরিয়ে সে মাত্র দু ঘন্টার জন্য একটা হলোগ্রাফিক গেস্ট পাস পেল। তারপর জানানো হল, এখন তার কাজ মাত্র একটা, তাদেরকে অন্ধ সমর্থন দিতে হবে ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিভিশনের কাছে। ক্রিপ্টোগ্রাফিক ডিভিশন- একদল এলিট গণিতবিদ। তাদের পরিচয়- কোড ব্রেকার।

প্রথম এক ঘণ্টা যেন কোড ব্রেকাররা টেরও পায়নি বেকার এখানে হাজির আছে কি নেই। একটা বিশালাকার টেবিলের চারপাশে ঝুঁকে এসে এমন এক ভাষায় কথা বলছে যা স্বয়ং বেকারও কখনো শোনেনি। তাদের আলোচনায় অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ জায়গা পাচ্ছে- স্ট্রিম চিপার, সেল্ফ-ডেসিমেটেড জেনারেটর, নাপস্যাক ভেরিয়েন্ট, জিরো নলেজ প্রটোকল, ইউনিসিটি পয়েন্ট। বেকার বোকার মত বসে বসে কেবল শুনল তাদের কথকতা। গ্রাফ পেপারে কাজ উঠে আসছে, ঝুঁকে থাকছে কম্পিউটার প্রিন্ট আউটগুলোর উপর, মাথার উপরে প্রজেক্টরে উঠে আসা সংখ্যাগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে হরদমঃ।

JHDJAJKHDHMADO/ERTUTJLH+JGJ326 5 JHALSENHKHHHFAF OHHDFGAF/FS? WE ০Hr73450spJF28/HHRTYFHLF4303 95 JSPJF2J08901HJ98 YHFIOBDEWRTO3 JOJR8 45HOROQ+JTDEU 4TQEFQE // OUJV 06UYOIHD934 JTPUFIAJERO9qU4 JRGU IVJPODUw495PE ORTUGVJH3p 4E/IKKO MFFUERHFGVDQ394IKURMG+UNHVS 90ER IRK/0956Y7UDPOIKIOJP9F8760QUERQI

তারপর, একজনের নজর পড়ল বেকারের উপর। জানাল যে সে উপস্থিত হয়েছে এর মধ্যেই। সামনের টেক্সটটা একটা কোড। সাইফার টেক্সট- এই নাম্বার আর প্রতাঁকের গোলকধাঁধায় অন্য কিছু বোঝানো হচ্ছে। কোন একটা ভাষা। এখান থেকে বাড়তি অক্ষরগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে। তারপর বেরিয়ে আসবে ক্লিয়ারটেক্সট। তারা বেকারকে ডেকেছে কারণ তাদের ধারণা মূল ভাষাটা চায়না ম্যারিনের। ক্রিপ্টোগ্রাফাররা ডিসাইফার করার পর তাকে সে ভাষা থেকে কথাটুকু অনুবাদ করতে হবে।

পরের দুঘণ্টা জুড়ে বেকার অসংখ্য ম্যান্ডারিন সিম্বলকে অনুবাদ করে দিল। কিন্তু যতবারই সে একটা সমাপ্তিতে এল বাক্যগুলো শেষ করে, ততবারই ক্রিপ্টোগ্রাফাররা মাথা নাড়ল হতাশ হয়ে।

তারপর একটু সহায়তা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে বেকার, জানায় যে এ। পর্যন্ত যত শব্দ তাকে দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সাধারণ একটা মিল থাকছে। থাকছে একটা ধারা। সেগুলোর সবই কাঞ্জি ভাষার সাথে যুক্ত। সাথে সাথে কামরার মধ্যে নেমে এল জমাট নিরবতা। মরান্টে নামের লোকটা ছিল ইন চার্জ। চেইন স্মোকার। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল বেকারের দিকে।

আপনি বলতে চান এ সিম্বলগুলোর মাল্টিপল মিনিং আছে?

নড করল বেকার। সে ব্যাখ্যা করল যে কাঞ্জি হল একটা জাপানি লেখ্য ভাষা যা আসল চাইনিজ শব্দগুলোর আদল বদলে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সে। ম্যান্ডারিন শব্দের অর্থ করে দিচ্ছিল কারণ সেটাই করতে বলা হয়েছে এতক্ষণ।

মরান্টে কেশে উঠল, জিসাস ক্রাইস্ট! তাহলে কাঞ্জি চেষ্টা করা যাক।

জাদুমন্ত্রের মত এবার সবকিছুর অর্থ দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠল।

কিন্তু হাল ছাড়বে না ক্রিপ্টোগ্রাফাররা। তারা এবার ঝামেলায় ফেলে দিল বেচারা বেকারকে। শব্দগুলো উল্টাপাল্টা করে বারবার অনুবাদ করতে দিল তাকে।

এটা আপনার নিরাপত্তার জন্যই করা হচ্ছে। আপনি পরে মনে রাখতে পারবেন না কী কী অনুবাদ করেছিলেন।

হাসল বেকার। তারপর অবাক হয়ে দেখল, আর কেউ তার সাথে তাল মিলাচ্ছে না।

সবশেষে যখন কোডটা ভাঙা গেল, বেকার কল্পনাও করতে পারল না সে কতটা ভয়ানক রহস্যের সুরাহা করে দিয়েছে। এন এস এ খুব সিরিয়াসলি এ কোড ব্রেকিংটাকে গ্রহণ করল। তারপর বেকারের পকেটে যা পুরে দিল সেটার পরিমাণ পুরো মাসের বেতনেরচেও বেশি।

বেরিয়ে যাচ্ছিল সে একের পর এক বিচিত্র সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট দিয়ে। শেষে এক জায়গায় এসে থেমে যেতে হল। সিকিউরিটি গার্ড কথা বলছিল ফোনে, তার দিকে তাকিয়ে বলল, মিস্টার বেকার, এখানে অপেক্ষা করুন, প্লিজ।

কোন সমস্যা? বেকার আশাও করেনি মিটিংটা এত দীর্ঘ হবে। বিকালের স্কোয়াশ খেলার সময় চলে যাচ্ছে।

শ্রাগ করল গার্ড, ক্রিপ্টোর হেড আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান। মহিলা চলে আসবেন যে কোন মুহূর্তে।

মহিলা? হাসল বেকার। এবার এন এস এর ভিতরে একজন মহিলাকেও দেখতে হবে তাকে।

তাতে কোন সমস্যা আছে কি? পিছন থেকে মহিলার কন্ঠ বলে উঠল।

বেকার ঘুরে দাঁড়াল এবং দাঁড়িয়েই স্থবির হয়ে গেল। এন এস এর ক্রিপ্টোর প্রধান যে এ মেয়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই, বুকের ব্যাজই সে কথা সগর্বে প্রচার করছে, কিন্তু আরো একটা ব্যাপার বাকি থেকে যায়, তাকে কোনমতেই মহিলা বলা যায় না, বরং এক তন্বী তরুণী, যার মধ্যে আকর্ষণের সবটুকু ব্যাপার পরিপূর্ণভাবে বিকশিত।

না। আমতা আমতা করে বলল বেকার, আমি আসলে…

সুসান ফ্লেচার, হাসল মেয়েটা মোহনীয় ভঙ্গিতে, সামনে বাড়িয়ে দিল ক্ষীণ হাত।

হাত বাড়াল সেও, ডেভিড বেকার।

কগ্রাচুলেশন্স মিস্টার বেকার, শুনলাম আপনি আজ বাজিমাৎ করে দিয়েছেন। চমৎকার কাজ। আমার সাথে এ নিয়ে একটু কথা বলতে কোন আপত্তি নেই তো?

কেন, অবশ্যই নেই। কিন্তু মানে… আমার একটু তাড়া ছিল। ভেবে পায় না সে কী করে পৃথিবীর সবচে সেরাগুলোর মধ্যে একটা ইন্টেলিজেন্স অর্গানাই জেশনের কাছে বলবে যে তার স্কোয়াশ ম্যাচটা শুরু হয়ে যাবে আর মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে এবং তাকে সেখানে থাকতেই হবে। তার সেখানে গর। হাজির থাকার কোন নজির ছিল না কখনোই। ক্লাসে কখনো কখনো দেরি করে ডেভিড বেকার, কিন্তু স্কোয়াশ- কখনোই না।

আমি খুব বেশি সময় নিব না। এ পথে, প্লিজ।

দশ মিনিটের মধ্যে বেকার এন এস এর কমিশারির মধ্যে বসে বসে পপোভার আর ক্র্যানবেরি জুস উপভোগ করতে করতে কথা বলছিল এন এস এর ক্রিপ্টোগ্রাফির রূপবতী হেড সুসান ফ্লেচারের সাথে। আটত্রিশ বছর বয়সে হেড অব ক্রিপ্টোগ্রাফি হওয়া মুখের কথা নয় এবং সে অনুভব করছে এমন আকর্ষণীয়। মহিলা জীবনে খুব কম দেখেছে। কোড আর কোড ব্রেকিং নিয়ে কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। হাজার হলেও, ব্যাপারটার সাথে ভাষা এবং ভাষা বিজ্ঞানের অদ্ভুত মিল আছে, এবং এর সাথে সে আগে কখনো তেমনভাবে পরিচিত ছিল না।

এক ঘন্টা পর, যখন বেকারের আর কোন আশাই নেই স্কোয়াশ খেলায় অংশ নেয়ার, তখন সুসান বারবার ইন্টারকমের ডাককে অস্বীকার করলে হেসে ওঠে দুজনেই। তারা ঝুঁদ হয়ে গেছে আলোচনায়। হাজার হলেও, কাছাকাছি বিষয়ের দুজন সেরা মানুষ কথা বলছে নিজের নিজের বিষয় নিয়ে এবং বারবার তাদের। বিষয়গুলোর মধ্যে মিল এবং চমক খুঁজে পাচ্ছে। একজন লিঙ্গুইস্টিক মরফোলজির অসাধারণ দিকগুলো নিয়ে কথা বলছে তো আরেকজন কথা বলছে সুডো র‍্যান্ডম নাম্বার জেনারেটর নিয়ে। যেন দুটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে আলাপ করছে আতশবাজির রকমফের নিয়ে, উত্তেজিতভাবে।

সুসান তাকে ডেকেছিল অন্য একটা মতলবে। ব্যক্তি ডেভিড বেকারের ব্যাপারে সে একেবারেই নিরাসক্ত। লোকটাকে ডেকেছে এশিয়াটিক ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিভিশনে ট্রায়াল দেয়ার জন্য। পরীক্ষামূলক একটা চাকরি। তরুণ প্রফেসর সাফ সাফ জানিয়ে দিল সে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসবে না। সুসান সিদ্ধান্ত নিল, পেশাদারি কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করবে না। তার আস্তে আস্তে অনুভূতি বদলে গেল। যেন সে একটা স্কুলগার্ল, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। একটু আলাপ করে নিলে কী হয়? এবং সত্যি সত্যি কিছু হল না।

.

খুব ধীরে ধীরে একটা সখ্য গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। দুজনের কাজেরই পর্বতপ্রমাণ চাপ, তবু কাজের ফাঁকে একটু ছুটি মিলে গেলেই হল। হেঁটে চলে জর্জটাউন ক্যাম্পাস ধরে, রাতে ডিনারে বসে কখনো কখনো, চলে যায় বিশেষ বিশেষ লেকচারে বা কনসার্টে। অবাক হয়ে সুসান লক্ষ্য করে, আর সব বারেরচে বেশি বেশি হাসছে সে। প্রাণখোলা হাসি। আস্তে আস্তে টের পায়, লোকটার রসবোধ প্রখর। এন এস এর হাড়ভাঙা খাটুনি আর খটমটে কাজের বাইরে যাবার, হাফ ছেড়ে বাঁচার একটা সুযোগ পায় সে।

হেমন্তের এক বিকালে, সকার খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে তারা, প্রশ্ন তোলে সুসান, কী খেলা খেলতে যেন পছন্দ কর তুমি? খোঁচা দেয় সে, জুচিনি?

খেলাটার নাম স্কোয়াশ।

বোবা দৃষ্টি দেয় সুসান তার দিকে।

এটা আসলে জুচিনির মতই, শুধু কোর্টটা ছোটখাট।

তাকে ঠেলে দেয় সুসান।

জর্জটাউনের লেফট উইং একটা দারুণ শট নিচ্ছে, কর্নার কিক। উল্লাস প্রকাশ পেল দর্শকদের সারি থেকে।

আর তুমি? প্রশ্ন তোলে বেকার, কোন খেলাধূলা কর না?

আমি স্টেয়ারমাস্টারের ব্ল্যাকবেল্ট।

কুঁচকে গেল বেকার। এমন কোন খেলাই আমি ভালবাসি যেটা তুমি জিতে যেতে পারবে।

মিষ্টি হাসি সুসানের ঠোঁটে, অনেক বেশি অর্জন করে ফেলেছি আমরা, তাই না?

জর্জটাউনের তারকা ডিফেন্ডার একটা পাস ব্লক করে ফেলেছে। আবার হৈচৈ উঠল। সামনে ঝুঁকে এসে সুসান কানে কানে ফিসফিস করল, ডক্টর।

বেকার চোখ ফিরিয়ে নিল তার দিকে।

ডক্টর। প্রথমে মনে যে শব্দটা আসে সেটা বলতো!

বোবার চাহনি দিয়ে তাকায় বেকার। ওয়ার্ড এ্যাসোসিয়েশনস?

স্টান্ডার্ড এন এস এ প্রসিডিউর। আগে আমাকে জানতে হবে কার সাথে আছি। আবার বলে সে, ডক্টর।

ত্যাগ করল বেকার, সেও কম যায় না শব্দ শব্দ খেলায়। সিউস।

সুসান তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, আচ্ছা! এটা চেষ্টা কর… কিচেন।

একটুও দ্বিধা করল না সে, প্রফেসরও চতুর, বেডরুম।

ভ্রু কুচকে সুসাম জবাব দেয়, আচ্ছা, তাহলে ক্যাট।

গাট। পাল্টা গুলি চালাল বেকার।

গাট?

হ্যাঁ। ক্যাটগাট। চ্যাম্পিয়নের স্কোয়াশ র‍্যাকেটের সুতা।

ভাল।

আর তোমার মতামত কী?

একটা মিনিট চুপ করে থাকল সুসান। তুমি আসলে একেবারে বাচ্চা বাচ্চা। সেক্স্যুয়ালি ফ্রাস্টেটেড স্কোয়াশ ফ্রেন্ড।

শ্রাগ করল বেকার, হয়ত তাই ঠিক।

.

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে কয়েকটা কথা জ্বালিয়ে মারল বেকারকে।

কোথায় সে ম্যাথমেটিক্স শিখেছে?

এন এস এ তে কীভাবে ঢুকল?

এমন হল কীভাবে সে?

সুসান বলেছিল, সে দেরিতে ফোঁটা ফুলের মত। সেই স্কুল থেকেই তার অঙ্কের প্রতি আসক্তি। তার আন্টি ক্লারা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে বলত এ অসাধারণ মেধার জন্য, এবং দোষ দিতে বলত আর সব ব্যাপারে নিরুৎসাহের জন্য।

ক্রিপ্টোগ্রাফির উপর তার নজর সেই জুনিয়র হাইস্কুল থেকেই। কম্পিউটার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক গাটম্যান তার জন্য একটা ভালবাসার কবিতা লেখে, তারপর সেটাকে এনক্রিপ্ট করে দেয় নাম্বার সাবস্টিটিউশন স্কিম দিয়ে। অর্থ জানার জন্য উসখুস করে সুসান, কিন্তু লোকটা কখনোই মানে জানিয়ে দেয়নি। হাল ছাড়ার পাত্রী নয় সে, বাসায় নিয়ে যায় কোডটাকে, সারা রাত লাইট জ্বেলে। বসে থাকে সেটার উপর, তারপর বের করে অর্থটা প্রতিটা অঙ্ক এক একটা অক্ষরের প্রতিনিধিত্ব করছে।

আস্তে আস্তে ডিসাইফার করে সে সবটুকু লেখা। তারপর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়ে দেখে, প্রতিটা নাম্বার মিলে মিলে গিয়ে চমৎকার এক কবিতার রূপ নিয়েছে। ঠিক সে মুহূর্তেই সে জেনে যায়, প্রেমে পড়ে গেছে। বাকি জীবন কাটবে তার ক্রিপ্টোগ্রাফি আর কোড নিয়ে।

প্রায় বিশ বছর পরের কথা, সে এর মধ্যেই মাস্টার্স করে বেরিয়ে গেছে জন হপকিন্স থেকে। গণিতে। এম আই টি থেকে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে কাজ করেছে নাম্বার থিওরির উপর, ডক্টরাল থিসিস জমা দিয়েছে- ক্রিপ্টোগ্রাফিক মেথডস, প্রটোকলস, এ্যান্ড অ্যালগরিদমস ফর ম্যানুয়াল এ্যাপ্লিকেশন্স।

স্বভাবতই, এ লেখা শুধু তার প্রফেসর পড়েনি; কিছুদিন পরেই সে একটা ফোনকল এবং প্লেনের টিকেট পেয়ে যায় এন এস এ থেকে।

ক্রিপ্টোগ্রাফির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই এন এস এর কথা জানে। বিশ্বে ক্রিপ্টোগ্রাফির তীর্থস্থান হল এই এন এস এ। সাধারণত প্রতি বছর তারা পৃথিবীর সেরা সেরা গণিত মেধার জন্য খুবই উঁচু দর হাঁকে, চমৎকার অফার দেয়। কিন্তু এসবের উপরই তীক্ষ্ণ চোখ রাখে এন এস এ। তাদের সবাইকে যে সংস্থাটা অফার দেয় তা নয়, কিন্তু যাদের দেয় তাদের জন্য থাকে দ্বিগুণ বেতন। এন এস এর কিছু প্রয়োজন সেটাকে ত্বড়িৎগতিতে কিনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। দুরুদুরু বুক নিয়ে সুসান ওয়াশিংটনের ডালাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে হাজির হয়। সেখানে এন এস এর এক ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল, সোজা নিয়ে যায় ফোর্ট মিডোসে।

সেখানে আরো একচল্লিশজন ছিল যারা সে বছর একইভাবে একটা ফোনকল আর একটা টিকেট পেয়েছে। আটাশ বছর বয়সে সুসান ছিল সবচে কম বয়েসি। এবং একই সাথে, সেই ছিল একমাত্র মেয়ে। ইনফরমেশনাল সেসনের বদলে একটা দারুণ ইন্টেলিজেন্স টেস্টিং সেশন চলল। সেইসাথে চলল আরো নানা ধরনের পরীক্ষা। পরের সপ্তাহে আরো ছ জনের সাথে সুসানকেও আবার ডাকা হল। সেই গ্রুপ আবার হাজির হল। পলিগ্রাফ টেস্ট, ব্যাকগ্রাউন্ড সার্চ, হ্যান্ডরাইটিং এ্যানালাইসিস আর অশেষ সময় ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারভিউ চলল। এমনকি তাদের যৌন জীবনও বাদ পড়ল না তা থেকে।

যখন সুসানকে প্রশ্ন করা হল সে কখনো কোন জন্তুর সাথে সেক্স করেছে। কিনা, সে আর একটু হলেই বেরিয়ে যেত। কিন্তু আগ্রহই সেখানে টেনে রাখল। সেই বিখ্যাত বিভ্রান্তির দুর্গ তে প্রবেশ করা, পৃথিবীর সবচে গোপনীয় গণিত ক্লাবে- এন এস এতে যোগ দেয়া।

বেকার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে তারা প্রশ্ন তুলেছিল তুমি কখনো কোন জন্তুর সাথে সেক্স করেছ কিনা সে বিষয়ে?

শ্রাগ করল সুসান, রুটিন ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের অংশ।

যাক… কোনক্রমে একটা মিনমিনে হাসি যোগাড় করল বেকার, কী বললে তুমি?

সাথে সাথে টেবিলের নিচ দিয়ে একটা লাথি মেরে বসল মেয়েটা, একটু অপ্রতিভভাবে দ্রুত বলল, আমি তাদের বললাম, না! তারপর বলল, এবং এই গত রাতের আগে সেটা ছিল সত্যি কথা।

.

সুসানের চোখে, একটা মানুষের পক্ষে নিখুতের যত কাছে যাওয়া সম্ভব, ততটা কাছে ডেভিড। শুধু একটা ব্যাপার; যতবার তারা বাইরে যেত, ততবার সে চেকটা তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করত। সুসান প্রতিবার দেখত, বেচারা তার একদিনের বেতনের সমান টাকা খরচ করে ফেলছে তাদের দুজনের খাবারের বিল দিতে গিয়ে। প্রতিবাদ করতে শিখেনি সুসান, কিন্তু তবু ব্যাপারটা তার কাছে ভাল ঠেকত বা। আমি এত টাকা আয় করি যা দিয়ে কী করব ভেবে পাই না কখনো, ভাবত সে, ব্যয়টা আমারই বহন করা উচিৎ।

এই একটা ব্যাপার, সব খরচ তারই করতে হবে, এ ভাবনাটা ছাড়া আর সব দিক দিয়ে একেবারে ঠিক। সে সহানুভূতিপূর্ণ, স্মার্ট, মজাদার, আর সবচে বড় কথা, সুসানের কাজের প্রতি তার স্বচ্ছ একটা কৌতূহল আছে। স্মিথসোনিয়ানের দিকে ট্রিপ নেয়া, বাইকে করে ঘুরে বেড়ানো বা সুসানের কিচেনে একটা স্প্যাগোটি পুড়িয়ে নেয়া, সব ব্যাপারে ডেভিডের আগ্রহ খুব। সর্বক্ষণ তাকে প্রশ্ন তাড়া করে ফিরছে, সুসানও বিনা দ্বিধায় গোপনীয় ব্যাপারগুলো বাদে সব বলে যাচ্ছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাপারে। ডেভিড যাই শুনত তাই তাকে উৎফুল্ল করে তুলত।

উনিশো বাহান্নর নভেম্বরের চার তারিখ রাত বারোটা এক মিনিটে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এ প্রতিষ্ঠানটা উদ্বোধন করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সারা পৃথিবীর সবচে সফল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এই এন এস এ। এ প্রতিষ্ঠানের সাত পাতার পরিচিতির একটাই অর্থঃ এটা যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করবে তার গোপনীয় তথ্যগুলোকে রক্ষা করার মাধ্যমে এবং বিদেশি শক্তিগুলোর তথ্য উদ্ধার করে।

এন এস এর মূল অপারেশন বিল্ডিংয়ের ছাদে পাঁচশোরও বেশি এ্যান্টেনা আছে। সেইসাথে আছে বিশাল দুটা র‍্যাডোম যেগুলো দেখতে একেবারে গলফ বলের মত। ভবনটাও জান্তব- বিশ লাখ স্কয়ার ফুট সি আই এ হেডকোয়ার্টারেরচে দ্বিগুণ। ভিতরে আশি লাখ ফুট দীর্ঘ টেলিফোন তার আছে, আছে আশি হাজার স্কয়ার ফুট ফিক্সড উইন্ডো

সুসান তাকে কমনিটের কথা বলল। সি ওএম এ আই টি। এটা এজেন্সির আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ডিভিশন-সেখানে কী আছে না বলে কী নেই সেটা বলাই নাকি শ্রেয়, বলেছিল সে। লিসেনিং পোস্ট, কৃত্রিম উপগ্রহ, গুপ্তচর, আর সুতা দিয়ে তারা বেঁধে রেখেছে সমস্ত পৃথিবীকে। প্রতিদিন হাজার হাজার যোগাযোগ এবং কথাবার্তা ইন্টারপ্রিট করা হয়। এসবই পাঠানো হয় এক জায়গায়, এন এস এ। সি আই এ, এফ বি আই বা ইউ এস ফরেন পলিসি এডভাইজর- সবাই এন এস এর ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্টারপ্রিটেশনের মুখাপেক্ষী।

বেকার স্থাণুর মত বসে থেকে শোনে, তারপর প্রশ্ন তোলে, আর কোড ব্রেকিং? কোথায় তোমরা এসব কর?

সুসান ব্যাখ্যা করে কীভাবে বিভিন্ন শত্রুভাবাপন্ন দেশের কাছ থেকে আসা অভ্যন্তরীণ কথাবার্তা তারা বের করে, কীভাবে কাজ করে টেরোরিস্ট গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে, কীভাবে দেশের ভিতরেও এসব তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো সময়মত না পেলে আজকের এই আমেরিকার কথা ভাবাও যেত না। যে কোন সময় ধ্বসে পড়ত এই সুসভ্য অবয়ব। সুসানের আগের কাজ ছিল কোড স্টাডি করা। কোড ব্রেক করা আর সেগুলো নিয়ে এন এস এ কে আরো সুসজ্জিত করা। এ কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্যি নয়।

ভালবাসার মানুষের কাছে নির্জলা মিথ্যা বলতে খারাপ লাগলেও সুসানের করার কিছু নেই, সত্যি কথাগুলো সব সময় বলা যায় না। কয়েক বছর আগেও কথাগুলো সত্যি ছিল, কিন্তু এখন আর তা নেই। এখন এন এস এ একটু বদলে গেছে। ক্রিপ্টোগ্রাফির পুরো ভুবনটা বদলে গেছে আমূল। পানের নতুন কাজের ক্ষেত্র ক্লাসিফাইড, এমনকি অনেক দন্ডমুন্ডের বিধাতারাও জানে না সে সম্পর্কে।

কোডগুলো, নাচার হয়ে প্রশ্ন তুলল বেকার, কীভাবে বুঝতে পার কোত্থেকে শুরু করতে হবে? বলতে চাচ্ছিলাম… ভাঙ কীভাবে?

মৃদু হাসি সুসানের ঠোঁটে, আর কেউ জানুক চাই না জানুক, তোমার এসব জানার পূর্ণ অধিকার আছে। বিদেশি কোন এক ভাষা নিয়ে গবেষণা করার মতই ব্যাপারটা। প্রথমে বিদঘুঁটে কোন অচেনা ভাষা মনে হবে এগুলোকে। একেবারে বেড়াছেঁড়া অবস্থা, তারপর আস্তে আস্তে চিনতে শুরু করবে, একে একে অর্থ বেরিয়ে আসতে লাগলেই বাকিটা মিলে যাবে। পরিষ্কার একটা অনুবাদ দাঁড় করাতে পারলেই বোঝা যাবে কী বোঝানো হচ্ছে।

খুশি হয়ে নড় করল বেকার। সে আরো আরো জানতে চায়।

জানাতে পারলে খুশি সুসানও। সে একেবারে শুরু থেকে একটা শর্ট কোর্স দিতে শুরু করল। প্রথমে জানাল কাইজারের সেই বিখ্যাত পারফেক্ট স্কয়ার সাইফার বক্স দিয়ে।

ব্যাখ্যা করল সে, কাইজার ছিল ইতিহাসের প্রথম কোড রাইটার। যখন থেকে তার পদাতিক বার্তাবাহী পথে এ্যাম্বুশে পড়তে শুরু করল, তাদের গোমর সব ফাঁস হয়ে যেতে শুরু করল, আর না পেরে কোডের আশ্রয় নিল কাইজার। এমনভাবে ভাষাকে পাল্টে দিল সে যাতে এর কোন অর্থই আর বের করা না যায়। প্রতিটা বার্তাতেই নিখুঁত বর্গ শব্দ থাকত। ষোল, পঁচিশ বা একশো এবং এরকম আরো অনেক। যা সে বোঝাতে চাইত, সেভাবে বর্গ করা থাকত। লোকজনকে জানিয়ে দিল সে, যখনি কোন বার্তা আসবে, অক্ষরগুলোকে সাজিয়ে নিতে হবে বর্গাকারে। যখনি তা করে উপর থেকে নিচে পড়া হয়, একটা নিখুঁত মেসেজ চলে আসে।

সময়ের সাথে সাথে কাইজারের এ রীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আস্তে আস্তে তা আরো জটিল আকার ধারণ করে, ছড়িয়ে পড়ে অনেকের মাঝে। কম্পিউটারের উপর ভিত্তি না করে এনক্রিপশনের হিড়িক পড়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টায়। এনিগমা নামে এক অসাধারণ এনক্রিপশন মেশিন তৈরি করে নাৎসিরা। এতে লাগানো ছিল আদ্যিকালের এক টাইপরাইটার, সেটার লুপগুলো এমন চমৎকারভাবে বসানো ছিল যে কোন কথা টাইপ করলেও একটা অর্থহীন কোড বেরিয়ে আসত। শুধু অন্য কোন এনিগমা মেশিন থাকলে কাজ চলবে, নাহয় ভো ভো। কথাগুলো সেই মেশিনে সেভাবে বসাতে পারলেই অর্থ বেরিয়ে আসবে।

যেন জাদুমন্ত্র চালানো হয়েছে বেকারের উপর। সে শুধু শুনে যায় অবাক বিস্ময়ে। শিক্ষকই ছাত্রে পরিণত হয়েছে।

দ্য নাটক্রাকারের একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক অনুষ্ঠানে, এক রাতে সুসান প্রথম বারের মত ডেভিডকে একটা কোড ভাঙতে দেয়। হাতে কলম নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ডেভিড ঐ এগারো অক্ষরের কোডের দিকে।

HL FKZC VD LDS

অবশেষে, সেকেন্ড হাফের লাইট নিভে গেলে, ধরে ফেলল সে অর্থটা। খুব সহজ একটা কাজ দিয়েছে মেয়েটা। প্রতিবার, প্রথম অক্ষরকে পরের অক্ষরে বসিয়ে দিতে হবে, ব্যস, বেরিয়ে যাবে অর্থ। যেখানে এ আছে, সেখানে বসবে বি। আবার বি এর জায়গায় সি। এভাবেই। খুব দ্রুত সে অর্থটা বের করতে থাকে, তারপর ভেবেও পায় না কী করে এ সামান্য কথায় তার এত ভাল লাগছেঃ

খুব দ্রুত সে অর্থটা বের করে নিয়ে সাথে সাথে জবাব লিখে দেয়ঃ

LD SNN

সুসান পড়ে নেয় লেখাটা। তারপর তাকিয়ে থাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

.

বেকারের হাসার কথা, তার বয়স পঁয়ত্রিশ, আর এ বয়সে কিনা তার হৃদপিন্ড এমন কোন আবেগে ধ্বক ধ্বক করছে যেমনটা হবার কথা ছিল আরো প্রায় দু যুগ আগেই। এ জীবনে আর কোন মেয়ের প্রতি সে এতটা আকৃষ্ট হয়নি। মেয়েটার সেই ইউরোপিয় চেহারা আর বাদামি চুল মনের ভিতরে কী যেন এক অনুভূতি এনে দেয়। সুসানের বয়স আর যাই হোক, টিন এজারের না। কিন্তু তাতে কী, আছে তার ব্যক্তিত্ব, সেইসাথে আছে পরিমিত মাত্রার আকর্ষণীয় দেহ সৌষ্ঠব। আকর্ষণীয় বুক আর একেবারে সমতল পেট যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। মাঝে মাঝেই ডেভিড ঠাট্টা করে বলে, সুসানই তার দেখা প্রথম সুইম স্যুট মডেল যার একটা পুরোদস্তুর ডক্টরেট ডিগ্রি আছে এ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স আর নাম্বার থিওরির উপর। পরের মাসগুলোয় তারা আস্তে আস্তে টের পেতে থাকে যে তাদের এতোদিনে এমন কোন মানুষের সাথে দেখা হয়েছে যে বাকি জীবন সঙ্গ দিতে পারে।

প্রায় দু বছর কেটে গেল তারপর, আরো আরো ভালভাবে চিনল তারা একে অন্যকে। তারপর ডেভিড় কথাটা তুলল। স্মোকি মাউন্টেনে একটা উইকএন্ডের ট্রিপে কথাটা পেড়েছিল ডেভিড। স্টোন ম্যানোরের এক বিশাল খাটে শুয়ে ছিল তারা তখন।

ডেভিডের হাতে কোন আঙটি ছিল না, প্রস্তাব দিল সে, তারপর অপেক্ষা করল। কোন ঋণাত্বক জবাব না পেয়ে এগিয়ে এল সে সুসানের দিকে, তারপর, নাইটগাউন খুলে ফেলতে ফেলতে বলল, আমি এটাকে হ্যাঁ বলে ধরে নিচ্ছি।

ক্যাম্পফায়ারের আলোয় বাকি রাত কাটাল তারা ভালবাসায়।

সেই জাদুময় সন্ধ্যা কেটে গেছে আজ থেকে ছ মাস আগে। তখনি ডেভিডকে অপ্রত্যাশিতভাবে মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ ডিপার্টমেন্টের প্রধান করা হয়। এরপর আর পিছু ফিরে দেখার কোন অবকাশ ছিল না।

অধ্যায় : ৪

একটা বিপ শব্দ করে খুলে গেল ক্রিপ্টো ডোর। ভিতরে চলে আসছে সুসান, সেইসাথে তার বিষণ্ণতা। দরজাটা খুলে গিয়ে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে পূর্ণ তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে আবার বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যেই ঢুকে পড়তে হবে। চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে প্রবেশ করছে সুসান। তার প্রবেশের নোট নিয়ে নিল একটা কম্পিউটার।

যদিও তিন বছর আগে ক্রিপ্টোর বর্তমান আকার ধারণের আগ থেকেই সে এ বিভাগকে ভাল করেই চেনে, তবু, পুরো ব্যাপারটা এখনো বিস্ময় এনে দেয়। মূল রুমটা বিশাল, গোলাকার, পাঁচতলা পর্যন্ত উঁচু! কেন্দ্রীয় চূড়ার দিকে উঠে গেছে। একশো বিশ ফুট। উপরটা স্বচ্ছ। প্লেক্সিগ্নাসের গম্বুজটার সাথে মিহি করে মিশে আছে পলিকার্বনেট। এটা শুধুই বুলেটপ্রুফ বা বম্বফ নয়, দু মেগাটনের বিস্ফোরনকেও বেমালুম গিলে নিতে পারবে। উপর থেকে সূর্যের আলো কোমল হয়ে নেমে আসে, আর ভিতরের ধুলা সব সময় একটা বিচিত্র ঘুর্ণি তুলে উপরে উঠতে থাকে অহর্নিশি। উপরের শক্তিশালী ডিআয়োনাইজিং সিস্টেমের কল্যাণে।

আর নিচের দিকেও জাদু আছে। সেখানে তাকালে, সূর্যের আলো যদি পড়ে বা লাইটের আলো, ঠিক ঠিক বোঝা যায়, মেঝেটা শুধু কালো নয়, কালো এবং স্বচ্ছ হয়ে নেমে গেছে অনেকটা নিচে। কালো বরফ।

মেঝে থেকে একটা আদ্যিকালের টর্পেডোর মত উঠে গেছে বিশাল, মিশকালো এক গড়ন। তার জন্যই ডোমটা তৈরি। নিচের মেঝেতে ফিরে আসার আগে এটা তেইশ ফুট উপর থেকেই বিচিত্রভাবে বেঁকে গেছে, যেন কোন অতিকায় খুনি তিমি। জমে গেছে। বিচিত্রভাবে বাঁকা এবং নিখুঁত: এটাই সেই বিখ্যাত ট্রান্সলেটার, পৃথিবীর সর্বকালের সবচে বেশি খরুচে কম্পিউটিং মেশিন যেটার অস্তিত্ব মোটেও স্বীকার করে না এন এস এ।

হিমবাহের মতই, এ মেশিনের নব্বইভাগ ক্ষমতা আর আকার লুকিয়ে আছে মেঝের নিচে। এর মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে অনেক অনেক নিচে। সোজা ছ তলা নেমে যেতে হবে মাটির গভীরে সিরামিকের এক কামরায়। বিশাল এক কামরা, দেখলে ভিড়মি খেতে হয়। ভিতরে ঢুকলে প্রথমে মতিভ্রম হতে পারে, মনে হতে পারে কোন রকেটের ভিতরে এসে হাজির হয়েছে দর্শক। অতিকায় রকেট। ভিতরে অজস্র বাটন, কি বোর্ড, তারের মারপ্যাঁচ। সেইসাথে আছে হিসহিস করতে থাকা ফ্রেয়ন কুলিং সিস্টেম। কিন্তু এখানকার শব্দ এখানেই মরে যায়, ক্রিপ্টোকে তাই সদা সমাহিত- চির শান্ত বলে ভুল হয় প্রথম দেখায়।

.

ট্রান্সলেটার হল মানুষের টেকনোলজিক্যাল অগ্রগতির এক বিচিত্র প্রকাশ। প্রয়োজনে জন্ম নেয়া এক দানব। উনিশো আশির দশকে এন এস এ অবাক হয়ে দেখেছে কী করে পৃথিবীর মধ্যে টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে রাতারাতি বিপ্লব ঘটে গেল। এর ফলে পৃথিবীর ইন্টেলিজেন্সে চিরকালের জন্য একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। তারপর চোখের সামনে আরো রেনেসাঁ চলে এল, মানবজাতি প্রবেশ করল যোগাযোগের নতুন জগতে, ইন্টারনেটে। তারপর আরো দ্রুত মহামারীর মত ছড়িয়ে গেল ই-মেইল।

অপরাধী, সন্ত্রাসী আর গুপ্তচরেরা তাদের ফোনকল টেপ হতে দেখে দেখে একেবারে নাচার হয়ে পড়ল। এরপর আশ্রয় নিল ই-মেইলের। ই-মেইল, অসাধারণ এক প্রযুক্তি, এটা আর কোন ফোন লাইনের ভিতর দিয়ে চলে না, ইচ্ছা হলেই তাকে খুড়ে দেখা যায় না মাটির তলা থেকে। চলে যায় আলোর গতিতে, আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার অপটিক্স দিয়ে। এটা আর অন দ্য এয়ার হয় না। তাই এর মত নিরাপদ আর কিছুই নেই, অন্তত তাই মনে হল তাদের।

অন্যদিকে, এন এস এর টেকনো গুরুদের কাছে একেবারে বা হাতের খেল হয়ে গেল এই ই-মেইল নিয়ে কাজ কারবার করাটা। ইন্টারনেট মোটেও নতুন কোন হোম কম্পিউটার রেভুলুশন নয়, যেমনটা মনে করছে সাধারণ মানুষ। তিন দশক আগে ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স আবিষ্কার করে এ ব্যাপারটা, জন্ম দেয় ইন্টারনেটের। পারমাণবিক যুদ্ধের সময় যেন সরকারি, বিশেষ করে সামরিক সব কম্পিউটারের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগটা ঠিক থাকে সেজন্যই অনেক অনেক অতিকায় কম্পিউটারকে একে একে জুড়ে দিয়ে গড়া হয় সেই নেটওয়ার্ক, কালক্রমে, তিন দশকে যেটা এখন মানুষের হাতের খেলনা, যে কোন মানুষের, যে কোন সময়ে। ইন্টারনেটের উপর শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে রেখেছে এন এস এ সেই আদ্যিকাল থেকেই, নেটওয়ার্কিংয়ের ভ্রুণ যখন মাত্র জন্ম নিচ্ছে। ই-মেইল দিয়ে লোকজন যে অবৈধ ব্যবসা করছে সেটা আর গোপন নেই মোটেও, যা তারা মনে করছে। এফ বি আই, ডি ই এ, আই আর এস আর অন্যান্য ইউ এস ল ইনফোর্সমেন্ট এজেন্সি এই এন এস এর সহায়তা নিয়ে- এন এস এর দামি দামি হ্যাকারের সহায়তা নিয়ে উপভোগ করতে শুরু করে অসাধারণ এক জোয়ার; গ্রেফতার এবং ধরপাকড়ের সীমা না মানা স্রোত এসে ভাসিয়ে দেয় সবকিছু।

স্বভাবতই, যখন পৃথিবীর মানুষ দেখতে পেল যে আমেরিকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা যুক্তরাষ্ট্র তাদের ই-মেইলের উপর ছুরি চালাচ্ছে তখন তারা তেতে লাল হয়ে ওঠে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সবখান থেকে। এমনকি নতুন নেট পোকারা, যারা শুধু উপভোগ করার জন্য ই-মেইল ব্যবহার করে, তারাও টের পেল, আস্তে আস্তে তাদের ব্যক্তিগত কাজের ভিতরেও নাক গলাচ্ছে অন্য কেউ। ই-মেইলকে আরো আরো নিরাপদ এবং ব্যক্তিগত করে রাখার জন্য সারা দুনিয়ার প্রোগ্রামাররা কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লাগল। খুব দ্রুত তারা একটা পথ খুঁজে বের করল এবং এর পর থেকেই একটা বিচিত্র ব্যাপার শুরু হল। যে কোডের ব্যাপারটা এতদিন ছিল শুধু রাষ্ট্রীয় এবং গোপনীয় বিষয়- সেই কোডিং, সাইফারিং আর এনক্রিপশন চলে এল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়, নিরাপত্তার খাতিরে।

পাবলিক কি এনক্রিপশন একই সাথে একটা চতুর এবং খুবি সাধারণ পদ্ধতিতে পরিণত হয়। একেবারে ঘরে বসা সাধারণ মানুষের কাছে, হাতে হাতে চলে এল এমন সব প্রোগ্রাম যা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক চিঠি চালাচালিকে একেবারে দুর্বোধ্য করে ছাড়ল। সে প্রোগ্রাম যদি রিসিভারের কাছে থাকে তাহলেই অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব।

কাজ খুব সোজা, প্রথমে একজন ব্যবহারকারী একটা চিঠি লিখবে, তারপর এনক্রিপশন সফটওয়্যারের ভিতর দিয়ে চালনা করবে, ব্যস, কেল্লা ফতে। যে কেউ সেটাকে পেয়ে গেলেও কোন কাজে লাগবে না। একটা ফালতু, এলোমেলো পত্র পাবে তারা।

এর অর্থ উদ্ধার করতে হলে প্রেরকের পাস-কি পেতেই হবে। অনেকটা পিন কোডের মত নাম্বারের অর্থ যা বের করা সম্ভব অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর, বেশিরভাগ সময় সম্ভবও হয় না। পাস-কিগুলো সাধারণত অনেক লম্বা এবং জটিল হয়ে থাকে।

এবার একজন ব্যবহারকারী নিশ্চিন্তে তার খবরা খবর পাঠাতে পারে। যদি পথে ধরাও পড়ে যায়, কোন চিন্তা নেই, যাদের হাতে ডিসাইফারের উপায় আছে। তারাই শুধু অর্থ বের করতে পারবে।

এন এস এর মাথায় বাড়ি পড়ল খুব দ্রুত। এখন আর কোন সাধারণ পেন্সিল বা গ্রাফ পেপারের সহায়তায় সেগুলোর সুরাহা করা যাচ্ছে না। এগুলো পুরোদস্তুর কম্পিউটার জেনারেটেড হ্যাঁশ ফাঙশন।..

প্রথম প্রথম পাস-কি গুলো খুবই ছোট ছিল যার ফলে এন এস এর কম্পিউটার অর্থটা আন্দাজ করে নিতে পারত।

খুব সোজা। পাস কি যদি দশ সংখ্যার হয়, তাহলে কম্পিউটার ০০০০০০০০০০ থেকে ৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ পর্যন্ত প্রতিটা সংখ্যা পরীক্ষা করবে। আজ অথবা কাল, কম্পিউটার ঠিক ঠিক অর্থটা বের করে ফেলবে। কিন্তু দিন পাল্টে গেছে। হু হু করে বাড়ছে কম্পিউটারের ক্ষমতা। মাত্র দশ ডিজিটের কয়েক ট্রিলিয়ন কাজ নিয়ে পরীক্ষা করে তার অর্থ বের করা এখন কম্পিউটারের জন্য বা হাতের খেল। খুব বেশি সময় লাগার কথা নয় মানুষের হিসাবে, কয়েক দিন। এ পদ্ধতিটাকে নাম দেয়া হল ব্রুট ফোর্স এ্যাটাক।

সময় প্রয়োজন, কিন্তু অর্থ ঠিক ঠিক বেরিয়ে আসবে।

এরপর এগিয়ে এল উনিশো নব্বইয়ের দশক। পাস-কি গুলো এখন আর মাত্র দশ ডিজিটের নয়। হয়ে গেছে পঞ্চাশ বা তারও বেশি সংখ্যা নির্ভর। একই সাথে সেখানে কাজে লাগানো হচ্ছে সেই মান্ধাতার আমলের ০১২৩৪৫৬৭৮৯ এর বদলে আস্কির পুরো ২৫৬ সংখ্যা। যেখানে আগের গাণিতিক সংখ্যায় ধরা হত মাত্র দশটা মূল সংখ্যা, শূণ্য থেকে ন, সেখানে শূণ্য থেকে ন পেরিয়েও আরো নানা সংখ্যা, যেমন এ, বি, এবং এরও বাইরে আরো দু শতাধিক। তার সাথে যোগ দিল সিম্বল। যুক্ত হল টেন টু দ্য পাওয়ার ওয়ান টুয়েন্টি। অর্থাৎ একের পিছনে একশো বিশটা পর্যন্ত শূণ্য। এবার বিপত্তি বাধল। এ নিয়ে খেলা করা আর একটা তিন কিলোমিটার লম্বা সমুদ্র সৈকত থেকে সঠিক বালুকণাটা বের করা একই কথা।

ধারণা করা হল, একটা সত্যিকার সফল ব্রুট ফোর্স এ্যাটাক করতে হলে একটা স্ট্যান্ডার্ড সিক্সটি ফোর বিট কি দিয়ে এন এস এর সবচে দ্রুতগতির কম্পিউটারেরও গলদঘর্ম হয়ে উঠতে হবে। টপ সিক্রেট ক্যারি/জোসেফসন-টু দিয়ে উনিশ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। যতদিনে অর্থ বেরিয়ে আসবে তার আগেই যা ঘটার ঘটে যাবে।

ভার্চুয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্ল্যাকআউটে পড়ে গিয়ে নাচার হয়ে গেল এন এস এ। হুমকির মুখে পড়ে গেল জাতীয় নিরাপত্তা। কী করা যায়, ধর্ণা দিল তারা প্রেসিডেন্টের কাছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্টও এর মর্ম বুঝে নিল যথা সময়ে। তারাতাড়ি অর্থ বরাদ্দ করা হল, রাশি রাশি টাকা। তারপর এন এস এ পদক্ষেপ নিল, শূণ্যের উপর ইমারত গড়বে তারা। পৃথিবীর প্রথম ইউনিভার্সাল ডিজিটাল কোড ব্রেকিং মেশিন বসাবে। এজন্য যত টাকা যাক, যাক যত শ্রম, শুধু সময়ের মধ্যে গড়ে নিতে হবে একে।

সব কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, সাইবার ইঞ্জিনিয়ার এবং সব:বিশেষজ্ঞ এক সাথে চিৎকার করে উঠল, এ জিনিস বানানো অসম্ভর অবাস্তব স্বপ্ন দেখছে এন এস এ। কিন্তু একচুল নড়বে না প্রতিষ্ঠানটাঃ সব করা সম্ভব। শুধু সময় প্রয়োজন হতে পারে।

পাঁচ বছর, পাঁচ লাখ মানুষের কর্মঘন্টা এবং এক দশমিক ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করল এন এস এ আবারো। একটা দুটা বা দশটা নয়, ত্রিশ লাখ প্রসেসর বসানো হল এজন্য। প্রতিটা আকারে বর্তমানের স্টান্ডার্ড প্রসেসরেরচে বড়, স্ট্যাম্প সাইজের। আভ্যন্তরীণ প্রোগ্রামিংয়ের সমুদ্রও পেরিয়ে এল তারা। তারপর সিরামিকের খোলস বসিয়ে দেয়া হল যত্ন করে।

জন্ম নিল দানব। ট্রান্সলেটার।

ট্রান্সলেটারের কাজে হাজার হাজার মানুষ হাত দিয়েছে, আলাদা আলাদাভাবে কাজ করেছে, কিন্তু কেউ জানতে পারেনি কী আছে এর ভিতরে। পুরোটা সম্পর্কে মাত্র কয়েকজন জানতে পারে, ব্যস। বাকিরা মিথ্যা কথায় ভুলে থেকেছে। কাজের নীতি ছিল দশের লাঠি একের বোঝা।

এই ত্রিশ লাখ প্রসেসর কাজ করবে এক নীতিতে। সমান্তরালভাবে। উপরের দিকে তাদের গাত উঠতে থাকবে অসম্ভব চোখ ধাঁধানো গতিতে। অকল্পনীয় জটিলতায় বসানো কোডও এখন আর ট্রান্সলেটারের কাছে মুড়ির মোয়া বৈ কিছু নয়। এ মাল্টিবিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের মাস্টারপিসে শুধু প্রসেসরগুলো যে প্যারালালি কাজ ভাগ করে এগিয়ে যাবে তাই নয়, এর মূলমন্ত্রে এমন কিছু পদ্ধতি ঢুকিয়ে দেয়া হয় যাতে পাস কি আর কোড ব্রেকিঙয়ে দক্ষতা বেড়ে যাবে বহুগুণে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিঙয়ে নতুন একটা যুগের জন্ম দিয়েছে ট্রান্সলেটার। এখন আর এতে ডাটাগুলো বাইনারি হিসাবে জমা থাকবে না, এর কাজ হবে না বাইনারিতে,  হবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে।

এক বুধবারের সকাল। অক্টোবর মাস। প্রথমবারের মত পরীক্ষা করা হবে এই দানবীয় কম্পিউটার-সংযোজনকে। সবাই জানে, এর গতি হবে অসাধারণ, কিন্তু একটা ব্যাপার, ক্ষমতা আর গতিটা কতটা অসাধারণ হবে?

বারো মিনিট পরে জবাব এল। যখন একটা বিশাল আর জটিলতম কোডের জবাব এগিয়ে এল একেবারে প্রিন্ট আউট সহ, সবাই তাজ্জব বনে গেল। এই মাত্র ট্রান্সলেটার চৌষট্টি ক্যারেক্টার কোডের রহস্য ভাঙল। দশ মিনিটেরও কম সময়ে। গত দু দশকের মধ্যে এন এস এর দ্রুততম যে কম্পিউটার ছিল তারচে দশ লাখ গুণেরও বেশি দ্রুত।

অপারেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর, কমান্ডার ট্রেভর জে স্ট্র্যাথমোর আর.এন.এস এর অফিস অব প্রডাকশন আনন্দে ধেই ধেই নৃত্য শুরু করে দিল, এরই নাম। সাফল্য। এবার অন্য রকম পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমে প্রজেক্টের স্বার্থে হাজার হাজার লোককে কাজে লাগানো হয়েছিল। তারা মূল ব্যাপার কিছুই জানত না। কিন্তু হাতেগোণা কিছু মানুষ ছিল, যারা হর্তাকর্তা এবং যাদের না জানিয়ে প্রজেক্ট। শুরু করার কোন উপায় ছিল না। এবার তাদের চোখে ধুলো দেবার পালা। না, এ প্রজেক্টে কোন সাফল্য আসেনি। একেবারে চুলোয় গেছে পুরো শ্ৰম আর টাকাটা। এমনকি ক্রিপ্টোর অনেকেও থেকে গেল আঁধারে, শুধু এন এস এর দন্ডমুন্ডের বিধাতারা জানতে পারল, প্রতিদিন ট্রান্সলেটার শত শত কোড ভাঙছে। ড্রাগ লর্ড, টেরোরিস্ট আর আধার জগতের রাঘব বোয়ালেরা এবার একে একে টোপ গিলতে শুরু করল। আগেই তারা সেলুলার ফোনের উপর ভরসা ছেড়ে দিয়েছিল, এবার সাধের ই-মেইলের জটিলতম এনক্রিপশনও হাতের তালুর মত স্পষ্ট।

তাদের ধারণা ছিল, আর কখনো গ্র্যান্ড জুরির সামনে তাদেরই কণ্ঠস্বরের রেকর্ড শুনতে হবে না। এন এস এ স্যাটেলাইট আর তাদের ভুলে যাওয়া কোন কথাবার্তা হাজির করে বিপাকে ফেলে দিবে না। ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং আর কখনোই ছেলের হাতের মোয়া নয়।

কিন্তু বিধি বাম, তারা আসল ব্যাপারের কিছুই জানতে পারল না।

এন এস এ এবার কোমর বেঁধে লেগেছে, সব ধরশের কম্পিউটার এনক্রিপশন সফটওয়্যার চলে আসছে তাদের কছে। যোগাড় করছে তারা। প্রকাশ্যে। সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে যারা বাক বিতন্ডা করে তারাও এবার তোড়জোড় শুরু করল। সবার ই-মেইল পড়ে ফেলবে এন এস এ, তা হবে না। আদালতে গড়াল ব্যাপারটা। তারপর, ঠিক যেমনটা চেয়েছিল এন এস এ, আদালত তাদের বিপক্ষে গেল। ই-মেইল চালাচালিতে এনক্রিপশন চলল আগের মতই, শুধু সারা পৃথিবীর গোপন কোড ওয়ালারা জানতে পারল যে এন এস এ আর কখনোই তাদের গোপন কথা জেনে ফেলতে পারবে না।

অধ্যায় : ৫

আর সবাই কোথায়? খালি হয়ে যাওয়া ক্রিপ্টো ফ্লোরে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন তুলল সুসান। কোন ইমার্জেন্সি?

যদিও এম এস এর বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টই সারা সপ্তাহ সরম থাকে, মুখর থাকে কর্মকর্তা কর্মচারীর পদচারণায়, তবু শনিবারে ক্রিপ্টোর ভিতরে বিরাজ করে নিরবতা। ক্রিপ্টোগ্রাফিক গণিতবিদের দল সাধারণত কাজের নেশায় মত্ত থাকে তাদের চিরাচরিত স্বভাবের কারণে। একটা অলিখিত নিয়ম আছে এখানে, সারা সপ্তাহ অমানুষিক খাটুনি দেয়ার পর তারা একটু আধটু আয়েশ করবে, কাজ করবে না শনিবারের দিনটায়। এন এস এ তে ক্রিপ্টোগ্রাফাররা খুবি মূল্যবান, একটা দিন ছাড় না দিয়ে তাদের কাজের আঁচে পুড়িয়ে মারার পক্ষপাতি নয় কর্তৃপক্ষ।

এগিয়ে যাচ্ছে সুসান, তার সামনে জ্বলজ্বল করছে মহামূল্যবান মহার্ঘ্য, ট্রান্সলেটার। আট তলা নিচে, মাটির গভীরে যে জেনারেটগুলো বসানো আছে সেগুলোর গুমগুম শব্দ যেন আজ একটু বেশি করেই টের পাওয়া যাচ্ছে। অফ আওয়ারে কখনোই কাজ করা পছন্দ করে না সুসান। এর সাথে মিল আছে অন্য আরেকটা ব্যাপারের, কোন এক বিশালদেহী জানোয়ারের পাল্লায় যেন আটকে গেছে সে বিশাল কোন আপাতঃ শূণ্য খাঁচায়। দ্রুত এগিয়ে গেল সে কমান্ডারের অফিসের দিকে।

স্ট্র্যাথমোরের কাঁচঘেরা ওয়ার্কস্টেশনের চলতি নাম দ্য ফিসবোল। কমান্ডারের ভারি ওক কাঠের পাল্লা দেয়া দরজার সামনে হাজির হল সুসান। সেখানে এন এস এর প্রতীক আকা আছে, একটা বিশাল বিকটদর্শন ঈগল পায়ে আঁকড়ে রেখেছে পুরনো দিনের স্কেলিটন কি। এ দরজার ওপাশে তার দেখা সেরা মানুষগুলোর একজন বসে।

কমান্ডার স্ট্র্যাথমোর, ছাপ্পান্ন বছর বয়সী ডেপুটি ডিরেক্টর অব অপারেশন, সুসানের কাছে পিতৃতুল্য এক মানুষ। এ সেই লোক যে সুসানকে এখানে টেনে এনছিল, এখানটাকে, এন এস এ কে একটা বাসা হিসাবে গণ্য করার কথা বলেছিল। এক দশক আগে, সুসানের এখানে যোগ দেয়ার সময় স্ট্র্যাথমোর ছিল ক্রিপ্টো ডেভেলপমেন্ট ডিভিশনের প্রধান। এ এলাকা ছিল নতুন ক্রিপ্টোগ্রাফারদের ট্রেনিং সেন্টার, তীর্থস্থান। এখানে সাধারণত শুধু নতুন পুরুষ ক্রিপ্টোগ্রাফাররাই যোগ দিত। এসব বৈষম্যের ধার ধারত না স্ট্র্যাথমোর। যখন সুসান যোগ দিল পুরুষ শাসিত এ অঞ্চলে, সাফ সাফ বলে দিল কমান্ডার, সুসান ফ্লেচার তার দেখা সবচে মেধাবী ক্রিপ্টোগ্রাফি রিক্রুটদের একজন এবং সে মেয়েটাকে হারাতে চায় না কোন যৌন কেলেঙ্কারিতে ফাঁসিয়ে দিয়ে। কিন্তু একজন এ ব্যাপারটা নিয়ে মজা করতে চাইল তখন।

এক সকালে, কিছু পেপারওয়ার্ক করার জন্য সুসান গিয়েছিল নিউ ক্রিপ্টোগ্রাফারস লাউঞ্জে। তখন তার প্রথম বছর চলছে। সেখানে, নোটিশবোর্ডে তার একটা ছবি দেখে ভিড়মি খেয়ে যায় মেয়েটা। একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।

স্রেফ প্যান্টি পরে শুয়ে আছে সে বিছানায়।

ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। সোজা হিসাব, কোন এক ক্রিপ্টোগ্রাফার নোংরা কোন পত্রিকা থেকে অর্ধনগ্ন ছবি নিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে সেখানে সুসানের মাথার ছবি বসিয়ে দিয়েছে। ফলাফলটা ভালই হল।

স্ট্র্যাথমোর পদক্ষেপ নিল সাথে সাথে। কী করে সে চিনতে পারল লোকটাকে সেটা এখনো এক রহস্য। দু ঘন্টা পর ভিন্ন একটা নোটিশ দেখা গেল বোর্ডেঃ

এমপ্লয়ি কার্ল অস্টিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে
অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যক্রমের দায়ে।

সেদিন থেকেই আর কেউ কখনো ঘটায়নি তাকে। সবাই জানে, সুসান ফ্লেচার হল কমান্ডার স্ট্র্যাথমোরের আদরের দুলালী।

কিন্তু নবাগত ক্রিপ্টোগ্রাফাররাই শুধু এতে সচেতন হয়ে গেল তা নয়, আগের রাঘব বোয়ালেরাও সমীহ করে কমান্ডারকে, কারণ স্ট্র্যাথমোর তার ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে অনেকগুলো ইন্টেলিজেন্সের কাজ করে দিয়েছে যা এখনো ভুলতে পারেনি সিনিয়ররা। আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে উপরে উঠছে ট্রেভর স্ট্র্যাথমোর, ধীরে ধীরে তার তীক্ষ্ণ বিচার বুদ্ধি আর জটিল অবস্থা নিয়ে সরল সমাধানের ব্যাপারগুলো আরো ভালভাবে চোখে পড়ছে সবার। এন এস এর জটিলতার ভিতর দিয়ে তার দৃষ্টি চলে খুবই স্বচ্ছভাবে। এখানে সে ভালভাবেই বেছে নিতে পারে ভাল আর মন্দকে।

কারো মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে স্ট্র্যাথমোর একজন দেশপ্রেমী, দূরদৃষ্টির অধিকারী এবং একই সাথে মিথ্যার বেসাতি করা ভুবনে একজন সৎ মানুষ।

সুসানের এখানে হাজির হবার পর থেকে চোখের সামনে দেখা গেল স্ট্র্যাথমোর রকেটের গতিতে উপরের দিকে উঠছে, ক্রিপ্টো ডেভেলপমেন্টের প্রধান থেকে দ্রুত চলে গেছে পুরো এন এস এর দ্বিতীয় প্রধানের পদে। ডিরেক্টর লিল্যান্ড ফন্টেইন ছাড়া আর কেউ নেই তার মাথার উপর। রহস্যময় এক মানুষ এই রহস্যপুরীর কর্ণধার ডিরেক্টর। তাকে কখনো কেউ দেখেছে বলে দাবী করে না। মাঝে মাঝে কণ্ঠ শোনা যায়, এ পর্যন্তই। ভয় পায় তাকে, সবাই।

তার আর স্ট্র্যাথমোরের মধ্যে সরাসরি দেখা হয় খুব কম সময়েই, এবং যখন হয়, দানবে দানবে একটা নিরব যুদ্ধ গড়ে ওঠে নিমিষে। ফন্টেইন হল দানবদের মধ্যে দানব, কিন্তু তাকে থোড়াই পরোয়া করে স্ট্র্যাথমোর। একজন মুযিযাদ্ধার মতই সে মুখোমুখি হয় ডিরেক্টরের, তারপর একে একে তার যুক্তিগুলো জানায় অথবা খন্ডন করে অপর পক্ষের বাক্যবাণ। ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্টের কাছেও এতটা নাস্তানাবুদ হতে হয় না ফন্টেইনকে যতটা সমস্যায় পড়তে হয় স্ট্র্যাথমোরের সামনে।

.

সিঁড়ির মাথায় চলে গেল সুসান। নক করার আগেই বেজে উঠল স্ট্র্যাথমোরের ইলেক্ট্রনিক ডোরলক। হাট হয়ে খুলে গেল দরজা, ভিতর থেকে ইশারা করল কমান্ডার। ভিতরে আসতে হবে সুসানকে।

আসার জন্য ধন্যবাদ, সুসান, আমি আসলেই তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।

কোন প্রয়োজন নেই। হাসল সুসান। বসল ডেস্কের বিপরীত প্রান্তে।

শক্তপোক্ত লোক এই কমান্ডার। মাংসল শরীর। নাকটা ঈগলের মত। বাদামি চোখ। সেখানে সব সময় খেলা করে নিশ্চয়তা। কিন্তু আজ যেন একটু অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে কমান্ডারের চোখেমুখে।

আপনাকে একটু অস্থির মনে হচ্ছে। বলল সুসান।

ভালই আছি।

কথাটা আমি বলব, সুসান ভাবে।

স্ট্র্যাথমোর এরচে বেশি অস্থির কখনোই ছিল না। পাতলা হতে থাকা চুল নড়ছে, কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, এই এয়ার কন্ডিশনারের আওতায় থেকেও। আধুনিক এক ডেস্কের সামনে বসে আছে বয়েসি কমান্ডার ডেস্কটায় দুটা কিবোর্ড, এক কোণে সুদৃশ্য কম্পিউটার মনিটর। রাশি রাশি প্রিন্ট আউট সামনে। দেখলে প্রথম নজরে মনে হবে কোন এলিয়েন ককপিট।

টাফ উইক? প্রশ্ন তুলল সুসান।

শ্রাগ করল স্ট্র্যাথমোর সাথে সাথে একই রকম। সিভিলিয়ান প্রাইভেসি রাইট নিয়ে আমার পিছনে ফেউয়ের মত লেগে আছে ই এফ এফ।

মুখ বাঁকিয়ে হাসল সুসান। ই এফ এফ বা ইলেক্ট্রনিক্স ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন হল দুনিয়াজোড়া কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের একটা দল। শক্তিমান একটা সিভিল লিবার্টি কোয়ালিশন গঠন করেছে তারা। লক্ষ্য একটাই, কারো নজরদারির বাইরে থাকতে চায় তারা, কোন রকম চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করতে চায়। বিভিন্ন সরকারের বিশেষ করে আমেরিকার হস্ত ক্ষেপ বরদাস্ত করবে না তারা কখনোই। এন এস এ কেও না।

মনে হচ্ছে সাধারণ কোন কাজ? জবাব দাবি করল সুসান। তাহলে সেই অতি জরুরি কাজটা কী যেজন্য টেনে আনলেন এখানে?

এক মুহূর্ত বসে থাকল স্ট্র্যাথমোর। ডেস্কের উপরে থাকা কম্পিউটার ট্র্যাকবলে আঙুল বোলাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে সুসানের দিকে তাকাল। ট্রান্সলেটারের কোন একটা কোড ব্রেকিংয়ে কত সময় নিতে দেখেছ তুমি?

কথাটায় কোন মানে খুঁজে পেল না সুসান। এজন্য সে আমাকে ডেকে এনেছে?

আসলে… একটু ইতস্তত করল সে, কয়েক মাস আগে একটা কমনিট ইন্টারসেপ্টে পড়েছিলাম। সময় লেগেছিল ঘন্টাখানেক। কিটা একেবারে যাচ্ছেতাই রকমের লম্বা। দশ হাজার বিট বা এমন কিছু একটা।

এক ঘন্টা, না? আচ্ছা, আমরা যে কিছু কিছু বাউন্ডারি প্রোব করি সেগুলো?

শ্রাগ করল সুসান, আপনি যদি এতে ডায়াগনস্টিক্সও ধরেন, সময়টা বেড়ে যাবে।

সময়টা কতটুকু বাড়ছে।

সুসান ভেবে পাচ্ছে না না কী নিয়ে কথা বলছে স্ট্র্যাথমোর। স্যার, আমি গত মার্চে একটা এলগরিদম নিয়ে কাজ করেছিলাম, এক মিলিয়ন বিট কি নিয়ে। সাথে ছিল ইল্যিগাল লুপিং ফাংশন আর সেলুলার অটোম্যাটা। ট্রান্সলেটার সেটাকেও ভেঙেছিল।

কতক্ষণ?

তিন ঘন্টা।

ভ্রু বাঁকিয়ে ধনুকের মত করে ফেলল স্ট্র্যাথমোর, তিন ঘন্টা? এতক্ষণ?

সুসান একটু আশাহত হল। গত তিন বছর ধরে তার কাজ পৃথিবীর সবচে গোপন কম্পিউটারকে আরো ভালভাবে টিউন করা। ট্রান্সলেটারকে এত দ্রুতি দিয়েছে যে প্রোগ্রামগুলো সেগুলোর বেশিরভাগই তার করা। এক মিলিয়ন বিট কি আসলে বাস্তব নয়।

ওকে, বলল স্ট্র্যাথমোর, তার মানে একেবারে অবাস্তব অবস্থাতেও সবচে জটিল আর লম্বা কি এর সুরাহা করতে ট্রান্সলেটারের সময় লেগেছে তিন ঘন্টা?

নড করল সুসান। হ্যাঁ। কমবেশি।

মুখ তুলল স্ট্র্যাথমোর, তারপর কী একটা কথা বলতে গিয়েও বলল না। থেমে গেল। আমতা আমতা করে বলল, আসলে ট্রান্সলেটার কিছু একটার সম্মুখীন হয়েছে… থেমে গেল, কথাটা শেষ না করেই।

তিন ঘন্টারও বেশি?

নড করল আবার স্ট্র্যাথমোর।

নতুন কোন ডায়াগনোসিস? সিস-সেক ডিপার্টমেন্ট থেকে?

না। বাইরের ফাইল।

আরো কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সুসান, কিন্তু তা আর এল না। বাইরের ফাইল? আপনি ঠাট্টা করছেন, তাই না?

যদি তামাশা করতে পারতাম, ভালই হত। আমি সেটাকে গত রাত সাড়ে এগারোটায় কিউ করিয়েছি। এখনো ভাঙেনি।

সুসানের চোয়াল স্কুলে পড়ল সাথে সাথে। একবার তাকিয়ে দেখল ঘড়ির দিকে,তারপর আবার স্ট্র্যাথমোরের চেহারায় চলে গেল তার দৃষ্টি। এখনো চলছে? পনের ঘন্টারও বেশি সময় ধরে?

সামনে ঝুঁকে এল স্ট্র্যাথমোর, তারপর মনিটরটা ঘুরিয়ে দিল সুসানের দিকে। পুরো স্ক্রিন কালো হয়ে আছে, আর এক কোণায় একটা ছোট বক্সে লেখা উঠেছেঃ

টাইম ইন্সডঃ ১৫:০৯:৩৩
এ্যাওয়েইটেড কিঃ———-

হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সুসান। একটা টাস্কের উপর ট্রান্সলেটার কাজ করছে গত পনের ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। সে জানে, কম্পিউটারের প্রসেসরগুলো প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ লাখ কি নিয়ে কাজ করে একটা সমাধানে আসতে পারে। ঘন্টায় দশ হাজার কোটি। ট্রান্সলেটার যদি এখনো কাজ করতে থাকে তাহলে স্বীকার করতেই হবে, কিটার আকার বিশাল। দশ বিলিয়ন ডিজিটেরও বেশি। অসম্ভব।

একেবারে অসম্ভব! ঘোষণা করল সে। এরর ফ্ল্যাগের ব্যাপারটা চেক করে দেখেছেন? হয়ত কোন গ্লিচে আঘাত করেছে আর

গ্লিচ? হঠাৎ কোন সমস্যায় পড়া? না। রান করছে ক্লিয়ারলি।

তাহলে পাস কি কত লম্বা হবে একবার ভেবে দেখুন!

মাথা নাড়ল স্ট্র্যাথমোর, স্বাভাবিক কমার্শিয়াল এ্যালগরিদম। মনে হয় কোন সিক্সটি ফোর বিট কি।

অবাক হয়ে জানালা দিয়ে নিচে, ট্রান্সলেটারের দিকে তাকাল সুসান। অভিজ্ঞতা থেকে সে ভালভাবেই জানে, একটা সিক্সটি ফোর বিট কির সুরাহা করতে দশ মিনিটের বেশি লাগে না ট্রান্সলেটারের। কোন না কোন ব্যাখ্যা তো অবশ্যই আছে।

নড করল স্ট্র্যাথমোর, আছে। ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হবে না।

একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল সুসান। ট্রান্সলেটারে গন্ডগোল?

না, কম্পিউটারটা ভালই আছে।

তাহলে কোন ভাইরাস?

আবারো মাথা নাড়ল স্ট্র্যাথমোর, নো ভাইরাস। শুধু আমার কথা শুনে যাও।

সুসানের এখানে কোন রকম সুবিধা বোধ হচ্ছে না। ট্রান্সলেটার এখনো এমন কোন কোডের সম্মুখীন হয়নি যেটা ভাঙতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। সাধারণত স্ট্র্যাথমারের প্রিন্ট মডিউলে জবাব চলে আসে কয়েক মিনিটের মধ্যে।

সে একবার ডেস্কের পিছনের হাই স্পিড প্রিন্টারের দিকে তাকাল। সেখানে কোন। প্রিন্ট আউট নেই।

সুসান, শান্ত সুরে বলল স্ট্র্যাথমোর, প্রথমে ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু একটা মিনিট শুধু চুপ করে শুনে যাও, একটু চুষে নিল সে ঠোঁট দুটা, ট্রান্সলেটার যে কোডের উপর কাজ করছে সেটা এক কথায় ইউনিক। এর আগে এমন কোন কিছুর সামনে পড়িনি আমরা। থামল স্ট্র্যাথমোর, যেন কথাগুলো তাকে আঘাত করবে, এটা একটা আনব্রেকেবল কোড।

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সুসান। আনব্রেকেবল? এর মানে কী?

আনব্রেকেবল বলে কোন কোড এই ইহধামে নেই। গাণিতিকভাবে এটা প্রমাণিত যে আগে বা পরে, ট্রান্সলেটার ঠিক ঠিক আসল কথাগুলো বের করে আনতে পারবে।

আই বেগ ইউর পারডন, স্যার?

এ কোডটা আনরেকেবল। যন্ত্রের মত একই কথার পুনরাবৃত্তি করল কমান্ডার।

আনব্রেকেবল? এখনো সুসান বিশ্বাস করতে পারছে না যে পৃথিবীর সবচে বড় কোড ব্রেকিং প্রতিষ্ঠানে সাতাশ বছর ধরে দাপটে কাজ করা লোকটা এ শব্দ বেছে নিয়েছে।

আনব্রেকেবল, স্যার? বার্গফস্কি প্রিন্সিপলের ব্যাপারে…

ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে সুসান বার্গফস্কি প্রিন্সিপলের কথা শুনেছে। শিখেছে এ বিষয়টা। ব্রুট ফোর্স টেকনোলজির সর্বশেষ মাইলফলক ছিল এ নীতিটা। এ নীতিই স্ট্যাথমোরকে উজ্জীবিত করেছিল ট্রান্সলেটারের মত এক দানব তৈরি করার কাজের জন্য। প্রিন্সিপলে বলা আছে, যদি একটা কম্পিউটার যথাযথ চেষ্টা করেও একটা কোড ভাঙতে না পারে, তবু, গাণিতিকভাবে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব। একটা কোডের কখনো এ নীতি থাকে না যে সেটা ডিফাইন করা যাবে না। শুধু মানুষের হাতে যথেষ্ট হাতিয়ার থাকে না সেটাকে ভেঙে ফেলার জন্য।

মাথা নাড়ল স্ট্র্যাথমোর, এ কোডটা ভিন্ন।

ভিন্ন?

একটা আনরেকেবল কোড হল গাণিতিকভাবে অসম্ভব কোন ব্যাপার। আনব্রেকেবল বলতে কিছু নেই, কোড বানানোই হয় সেটাকে ব্রেক করে নেয়ার জন্য। স্ট্র্যাথমোর তা জানে।

ঘামে ভেজা কপালে হাত বুলিয়ে নিল কমান্ডার। এ কোডটা একেবারে আনকোরা নতুন এক এনক্রিপশন এ্যালগরিদমের প্রোডাক্ট। এমন কোন এ্যালগরিদম, যার মুখোমুখি হইনি আমরা এর আগে।

এখন সুসানের মনে আরো বেশি দোদুল্যতা দেখা দিল। এনক্রিপশন এ্যালগরিদম শুধুই গাণিতিক সূত্র। টেক্সটকে কোডে রূপান্তরিত করে, ব্যস। গণিতবিদ আর প্রোগ্রামাররা হররোজ দু চারটা নতুন এ্যালগরিদম তৈরি করে। এমন শত শত এ্যালগরিদম বাজারে চালু আছে- পিজিপি, ডিফাইন হেলম্যান, জিপ, আইডিয়া, এল গামাল। ট্রান্সলেটার এসবেরই কোড ভাঙে প্রতিনিয়ত। কোন সমস্যা নেই। ট্রান্সলেটারের কাছে সব কোডই ভাঙার মত। কোন এ্যালগরিদম দিয়ে সেগুলো লেখা হয়েছিল সেসবের ঘোড়াই পরোয়া করে সে।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, শ্রাগ করল সে, আমরা কোন রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কথা বলছি না। কোন জটিল ফাংশনও আলোচ্য বিষয় নয়। কথা বলছি ব্রুট ফোর্স নিয়ে। পিজিপি, লুসিফার, ডিএসএ- যেটাই হোক না কেন, কোন সমস্যা নেই। এ্যালগরিদম এমন একটা কি জেনারেট করে যেটাকে ভাঙা সম্ভব না মনে করা হয় এবং আমাদের ট্রান্সলেটার সেটাকে অনুমান করে একে একে কাজ করতে থাকে। আল্টিমেটলি থলের বিড়ালটা বেরিয়ে আসে।

স্ট্র্যাথমোরের জবাবটা একজন শিক্ষকের মত, যার ধৈর্যের কোন অভাব নেই, হ্যাঁ, সুসান, ট্রান্সলেটার সব সময় কি টা বের করে ফেলবে- যদি সেটা বিশাল হয়, তবুও। অবশ্য–

অবশ্য কী?

অবশ্য একটা ব্যাপার থেকেই যায়, কম্পিউটার যদি জানতেই না পারে যে সে কোডটা ভেঙে ফেলেছে, তাহলে সে কাজ চালিয়েই যাবে।

আর একটু হলেই চেয়ার থেকে পড়ে যেত সুসান, কী?

যদি কম্পিউটার ঠিক ঠিক আসল কি টা ধরে ফেলে এবং বুঝতে না পারে যে সে আসল সত্যিটা অনুধাবন করে ফেলেছে এবং বুঝতে না পারার কারণে সেটা চলেই যাচ্ছে, তাহলে সমস্যাটা দেখা দিবে। হতাশ দেখাচ্ছে স্ট্র্যাথমোরকে, আমার মনে হয় এ এ্যালগরিদমটায় কোন একটা রোটেটিং ক্লিয়ারটেক্সট আছে।

বাতাস টানল সুসান।

রোটেটিং ক্লিয়ারটেক্সট ফাংশনের ব্যাপারটা প্রথম প্রকাশিত হয় উনিশো সাতাশিতে। একজন হাঙ্গেরিয় গণিতবিদ জোসেফ হার্ন এ বিষয়ে লেখালেখি করে। ব্রুট ফোর্স কম্পিউটারগুলো কাজ করে দেখে বোঝার মত ওয়ার্ড প্যাটার্ন নিয়ে। হার্ন একটা এনক্রিপশন এ্যালগরিদম প্রস্তাব করে যে এ এ্যালগরিদমে এনক্রিপশন ছাড়াও সময়ে সময়ে ক্লিয়ারটেক্সটটাকে বদলে ফেলা হবে। তাত্ত্বিকভাবে, এর ফলে আঘাত করা কম্পিউটার কখনোই আসল অর্থটা বের করতে পারবে না। ব্যাপারটার সাথে বাস্তবের তেমন কোন মিল ছিল না। সোজা হিসাব। মানুষকে যদি এখনি মঙ্গলে গিয়ে থাকতে বলা হয় তাহলে লোকে যেভাবে তাকাবে, সেভাবে মূল্যায়ন করেছিল কথাটাকে অন্যান্য গণিতবিদেরা। এমন ব্যাপার শুধু কাগুঁজে বাঘ, বাস্তবে পাওয়া যাবে না।

কোথায় পেলেন আপদটাকে? দাবি করল সে।

খুব ধীরে সাড়া দিল কমান্ডার, একজন পাবলিক সেক্টর প্রোগ্রামার লিখেছিল এটাকে।

কী? সুসান ভেঙে পড়ল তার চেয়ারের উপর। এ পৃথিবীর তাবৎ বড় বড় প্রোগ্রামার বসে আছে আমাদের নিচের তলাগুলোয়! আমাদের সবাই একত্রে কাজ করেও কোন রোটেটিং ক্লিয়ারটেক্সট ফাংশনের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। আপনি কি বলতে চান যে কোন এক পাংক তার পিসি নিয়ে এ অসাধ্য সাধন করেছে?

স্ট্র্যাথমোর কণ্ঠ আরো নামিয়ে আনল সুসানকে শান্ত করার জন্য। আমি তাকে আর যে নামই দেই, পাংক বলে ডাকব না।

কথা শুনছে না সুসান। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আর কোন ব্যাখ্যা না থেকেই যায় না। কোন না কোন গ্লিচ, কোন ভাইরাস, বা আর কিছু, কিন্তু আনরেকেবল কোড? অসম্ভব।

স্ট্র্যাথমোর তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, সর্বকালের সবচে মেধারী ক্রিপ্টোগ্রাফিক মাথাগুলোর মধ্যে একটা থেকে বেরিয়েছে এ কাজ।

আর কখনো কোন বিষয় নিয়ে সুসানের এত বেশি সন্দেহ ছিল না। সর্বকালের সবচে মেধাবী ক্রিপ্টোগ্রাফিক মাথাগুলো বাস করে তার অধীনে। স্বাভাবিক ভাবেই, সে ঠিক ঠিক জানতে পারত এ কাজ সম্পর্কে।

কে? দাবি করল সে।

আমি নিশ্চিত তুমি ধারণা করতে পারবে। বলল স্ট্র্যাথমোর, সে আর যাই হোক, এন এস এর ভক্ত নয়।

আচ্ছা, তাহলে কাজ অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল।

ট্রান্সলেটার প্রজেক্টে কাজ করেছিল সে। তারপর নিয়মগুলো ভেঙেছে। প্রায় ইন্টেলিজেন্স দুঃস্বপ্নের জন্ম দিয়েছে। তাকে সরিয়ে দিয়েছি আমি।

সাদা হয়ে যাবার আগে সুসানের মুখে একটু অনিশ্চয়তা খেলা করল। ও মাই গড…।

নড করল স্ট্র্যাথমোর, সে সারা বছর এ ব্যাপারটা নিয়ে গলাবাজি করেছিল। বলেছিল, ব্রুট-ফোর্স রেজিস্ট্যান্ট একটা এ্যালগরিদম গড়ে তুলছে।

কি-কিন্তু… মনে মনে অবলম্বন হাতড়ে বেড়াচ্ছে সুসান, মনে করেছিলাম ব্লাফ দিচ্ছে। কিন্তু সত্যি সত্যি এমন কাজ করবে তা তো…

তাই ঠিক। দ্য আলটিমেট আনব্রেকেবল কোড রাইটার।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সুসান। কিন্তু তার মানে…

স্ট্র্যাথমোর কথাটা শেষ করে দিল, হ্যাঁ, এনসেই টানকাড়ো এইমাত্র ট্রান্সলেটারকে একেবারে অকেজো করে দিয়েছে।

অধ্যায় : ৬

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এনসেই টানকাডো জীবিত ছিল না তবু সে ইতিহাসের সবটা তার নখদর্পণে। ঠিক ঠিক এখনো মনে আছে, সে যুদ্ধের শেষদিকে, তাদের দেশ যখন কোণঠাসা, আজ অথবা কাল যখন তাদের আত্মসমর্পণ করতেই হবে, এমন এক সময়ে শুধুমাত্র পরীক্ষা করার জন্য প্রথমটা এবং তারপর কোন এক উন্মত্ত ক্রোধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত করা হয় তার দেশের উপর। মারা যায় এক লাখেরও বেশি লোক।

হিরোশিমা, সকাল আটটা বেজে পনের মিনিট, আগস্টের ছ তারিখ, উনিশো পয়তাল্লিশ সাল- ধ্বংসের নজিরবিহীন নমুনা দেখা গেল। মেনে নিয়েছে টানকাডো। শুধু একটা ব্যাপার কিছুতেই মানতে পারেনি। তার মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। কিন্তু তার আগের বছর কটা তার বেঁচে থাকা ছিল মারা যাবারচেও যন্ত্রণাদায়ক। তেজস্ক্রিয়তা পেয়ে বসেছিল।

উনিশো পঁয়তাল্লিশে, তার জন্মের অনেক আগে, বেশ কয়েকজন বন্ধু সহ মা গিয়েছিল হিরোশিমায়। সেখানে পোড়া মানুষগুলোর সেবার জন্য। সেখানেই সে হিবাকুশায় পরিণত হয়। হিবাকুশা- রেডিয়েটেড মানুষ। উনিশ বছর পর, ছত্রিশ বছর বয়সে, ডেলিভারি রুমে অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণে জানতে পারে সে, মারা যাচ্ছে। একই সাথে এটাও বুঝতে পারে যে তার একমাত্র সন্তান আর কখনো আলোর মুখ দেখবে না।

এনসেই কখনোই তার বাবাকে দেখতে পায়নি। একে স্ত্রী হারানোর শোক, সেইসাথে এমন এক সন্তানের জন্মের কথা জানতে পারে সে যে এ রাতটাও টিকবে কিনা সন্দেহ। ভেঙে পড়ে সে। বাকিটা না দেখেই চলে যায় হাসপাতাল থেকে। প্রতিবন্ধী সন্তানকে ছেড়ে যায় চিরকালের জন্য। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এক বাসায়। পালক করে।

প্রতি রাতে তরুণ টানকাড়ো তার হাতের বাঁকা আঙুল মুচড়ে দিত। অব্যক্ত বেদনায় মুষড়ে পড়ত। ভেবে হয়রান হত কী করে সে দেশটার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া যায়, যেটা তার মাকে ছিনিয়ে নিয়েছে, ছিনিয়ে নিয়েছে বাবাকে, যে বাবা থেকেও নেই; যার সন্ধান আর কখনো পাওয়া যাবে না।

এনসেইর বারো বছর বয়সের ফেব্রুয়ারিতে এক কম্পিউটার কোম্পানি পালক বাবা-মাকে জানায়, তারা হাতের দিক দিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নতুন কি বোর্ড আবিষ্কার করেছে। সেটা তারা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। রাজি হল সে পরিবার।

যদিও এনসেই টানকাড়ো কখনো কম্পিউটার চোখে দেখেনি, তবু কেন যেন মনে হল সে আগে থেকেই জানে কী করে তা ব্যবহার করতে হয়। কম্পিউটারটা তার সামনে এমন এক জগত খুলে দেয় যেটার কথা সে কখনো কল্পনা করেনি। সেটাই পরিণত হয় তার জগতে। আস্তে আস্তে বড় হয় সে। কম্পিউটারের ক্লাশ নিয়ে নিয়ে আয় করতে শুরু করে। তারপর একটা বৃত্তিও জুটে যায় দোশিসা ইউনিভার্সিটিতে। দ্রুত টোকিওতে তার একটা নাম ছড়িয়ে পড়ে, ফুগুসা কিসাই প্রতিবন্ধী জিনিয়াস।

টানকাড়ো ধীরে ধীরে জানতে পারে পার্ল হারবার সম্পর্কে। জানতে পারে জাপানি যুদ্ধাপরাধের কথা। আমেরিকার প্রতি অন্ধ আক্রোশ আস্তে আস্তে সরে যায় মন থেকে। মনেপ্রাণে পরিণত হয় এক আদর্শ বৌদ্ধে। বাল্যকালের প্রতিশোধ স্পৃহা উবে যায়- ক্ষমাই আলোকিত হবার উপায়, শিখতে থাকে সে।

বিশ বছর বয়সেই সে আন্ডারগ্রাউন্ড প্রোগ্রামারদের মধ্যে নাম কুড়িয়ে ফেলে। আই বি এম তাকে একটা ওয়ার্ক পারমিট আর যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পথ করে দেয়। দেয় টেক্সাসে ঢোকার পথ। সুযোগটা লুফে নিল টানকাডো। তিন বছর পর ছেড়ে দিল আই বি এম। নিউ ইয়র্কে বসে বসে নিজেই প্রোগ্রাম রাইট করা শুরু করে। পাবলিক কি এনক্রিপশনের জগতে ঢুকে গেল সহজেই। এ্যালগরিদম লিখতে লিখতে ভাগ্যের দুয়ার খুলে দিল নিজেই।

আর সব এনক্রিপশন এ্যালগরিদম লেখকের মত সেও এন এস এর নজরে পড়ে যায়। ব্যাপারটা নজর এড়ায় না তার, এখন সে এমন এক সংস্থার কাছে চলে যেতে পারছে যেখানে থেকে সে দেশটার একেবারে হৃদপিন্ডে জায়গা করে নিতে পারবে এককালে যাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত। সিদ্ধান্ত নিল, ইন্টারভিউতে যাবে। সব দ্বিধা চলে গেল কমান্ডার স্ট্র্যাথমোরের সাথে দেখা হবার পর তারা খোলামনে টানকাডোর অতীত নিয়ে কথা বলল। কথা বলল ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। পলিগ্রাফ টেস্টে অংশ নিল সে। অংশ নিল পাঁচ সপ্তাহের গভীর সাইকোলজিক্যাল টেস্টে। পেরিয়ে গেল সব। ঘৃণাটা উবে গ্ৰেছে বুদ্ধের প্রতি ভালবাসার কারণে। চার মাস পর এনসেই টানকালো কাজে নেমে পড়ল। কাজে নেমে পড়ল ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে।

বড় বেতন থাকা সত্বেও টানকাড়ো একা একা দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিত। লাঞ্চে যোগ দিত না আর সবার সাথে। বাকিরা তাকে খানিকটা সমীহও করত। সে এমন এক প্রোগ্রামার, এমন এক মেধা, যা সচরাচর চোখে পড়ে না এন এস এর জায়গাতেও। সে দয়ালু, সৎ, নির্বিরোধী, নিশ্চুপ। নৈতিকতা তার কাছে হিমালয়সম। এ কারণেই এন এস এ থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়াটা তার কাছে একেবারে দারুণ আঘাত হয়ে আসে।

.

ক্রিপ্টোর আর সব স্টাফের মত টানকাডোও ট্রান্সলেটার প্রজেক্টে যোগ দেয়। সারা পৃথিবীর অপরাধী এবং বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ইন্টারনেট যুদ্ধের দানব এই মেশিন।– যখন প্রোগ্রামিং করার সুযোগ এল, ট্রান্সলেটার স্টাফরা বলল যে এটাকে দারুণভাবে সাজানো সম্ভব। এন এস এ যেন এটাকে একেবারে ভালভাবে সাজাতে পারে সে চেষ্টা করবে তারা সর্বতোভাবে।

ক্ষেপে গেল টানকাভো। এর মানে, ট্রান্সলেটার, তার হাতে গড়া কম্পিউটারটাকে ব্যবহার করা হবে সারা পৃথিবীর সব মানুষের চিঠিগুলোকে তাদের অজান্তে খোলার কাজে এবং তা আবার বন্ধ করে দেয়ার কাজে। যেন পৃথিবীর প্রতিটা টেলিফোনে একটা করে আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্ট্র্যাথমোর বোঝানোর চেষ্টা করল, ট্রান্সলেটার আসলে আইন প্রয়োগের একটা অস্ত্র। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। টানকাভোর স্থির বিশ্বাস, সারা পৃথিবীর মানবাধিকার নষ্ট করা হবে এর মাধ্যমে। সে সাথে সাথে নিজেকে সরিয়ে নিল আর যোগ দেয়ার চেষ্টা করল ইলেক্ট্রিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের সাথে। সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে যে কোন মানুষের গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই। সব ভূলুষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে কারো কারো প্রতারণার কারণে। এন এস এর আর কোন উপায় নেই। থামাতে হবে টানকাডোকে।

টানকাভোর কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল অন লাইনে। এখনো সে ট্রান্সলেটারের কথা বলেনি। কিন্তু আশাঙ্কত হয়ে পড়েছে এন এস এর ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। তার নামে কুৎসা রটানো হল।

টানকাডো বুঝতে পারল, এসবই ইন্টেলিজেন্স গেম।

স্ট্র্যাথমোরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। এগিয়ে গেল সে স্রাথমোরের দিকে, তারপর বলল, আমাদের সবারই নিজ নিজ গোপন কিছু ব্যাপার আছে। অধিকার আছে সেগুলোকে গোপন রাখার একদিন আমি চেষ্টা করব যেন সেটা বজায় থাকে।

অধ্যায় : ৭

সুসানের মন ঝড়ের বেগে উড়ে যাচ্ছে। এনসেই টানকাডো এমন এক প্রোগ্রাম লিখেছে যেটার কোডগুলো ভাঙা সম্ভব নয়। চিন্তাটাকে কোনক্রমে গিলে ফেলল সে।

ডিজিটাল ফোর্ট্রেস, বলছে স্ট্র্যাথমোর, সে এ নামেই ডাকছে এটাকে। এ হল সবচে মেধাবি ইন্টেলিজেন্স উইপন। এটা যদি একবার মার্কেটে নামে, তাহলে তৃতীয় শ্রেণীর যে কোন মানুষও এমন সব কোড পাঠাতে পারবে যা ভাঙার সাধ্য নেই এন এস এর। গুলি করে মারা হবে আমাদের ইন্টেলিজেন্সকে।

কিন্তু সুসানের মনে ডিজিটাল ফোট্রেসের রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে না। এখনো এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান। সে সারা জীবন কাটিয়ে দিবে কোড ব্রেক করতে করতে। সব সময় আলটিমেট কোডের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে যাবে। যে কোন কোডই ভাঙা সম্ভব- বার্গফস্কি প্রিন্সিপল! তার মনে হল কোন অবিশ্বাসী ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে।

এ কোড ছড়িয়ে পড়লে ক্রিপ্টোগ্রাফি কাগুঁজে বাঘ হয়ে যাবে। ফিসফিস করে সুসান, এ নামে কোন বিজ্ঞানের অস্তিত্বই থাকবে না।

এটা আমাদের সমস্যা নয়।

আমরা কি টানকাডোর মুখ এঁটে দিতে পারি না? জানি সে আমাদের মনে প্রাণে ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা কি তাকে কয়েক মিলিয়ন ডলার অফার করতে পারি না? শুধু রাজি করতে হবে, কাউকে যেন এটা দিয়ে না বসে।

হাসল স্ট্র্যাথমোর, কয়েক মিলিয়ন ডলার? এর মূল্য কত সে সম্পর্কে কোন ধারণা আছে তোমার? পৃথিবীর প্রতিটা সরকার কোটি কোটি ডলার দাম উঠাবে। নেমে পড়বে নিলামে। তুমি কি প্রেসিডেন্টকে বলতে পারবে যে, আমরা ইরাকিদের কোড ধরতে পারছি কিন্তু ভাঙতে পারছি না? এটা শুধু এন এস এর একার মাথাব্যথা নয়, পুরো ইন্টেলিজেন্স কম্যুনিটির জন্য হুমকি। আমাদের ফ্যাসিলিটি সবাইকে সুবিধা দেয়- এফ বি আই, সি আই এ, ডি ই এ; তারা সবাই অন্ধ হয়ে যাবে। ড্রাগের কারবারিরা জোর তালি: বাজাবে। বেশিরভাগ কর্পোরেশন টাকা ট্রান্সফার করবে আই আর এস এর নাকের ডগায় বসে বসে। অপরাধিরা বসে বসে গল্প করবে আমাদের কিছু না জানিয়েই নরক হয়ে উঠবে পুরো দুনিয়া।

ই এফ এফ এর কাজের ক্ষেত্র বেড়ে যাবে।

ই এফ এফ কিছুই জানে না। জানে না আমরা এখানে কী করছি। আরো। হতাশ হয়ে স্ট্র্যাথমোর বলল, তারা যদি জানতেও পারত যে আমরা শুধু এ কোড ভিসাইফার করে করে কতগুলো সন্ত্রাসী হামলা থেকে দেশকে বাঁচিয়েছি তাহলে একেবারে বদলে ফেলত সুর।

সুসান মেনে নিল কথাটা। একই সাথে এও ভাবল, ই এফ এফ এখনো জানে ট্রান্সলেটার কত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রান্সলেটার একাই ডজন ডজন হামলা থেকে বাঁচিয়েছে অনেক এলাকাকে, কিন্তু সে কথা কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ পাবে না। হাইলি ক্লাসিফাইড। এসব তথ্য বাইরে প্রকাশ হলে মানুষের মাথায় বাজ পড়বে। আমেরিকার মানুষ এখনো জানে না, এই গত বছর তাদের মাটিতে একটা নয়, দুটা পারমাণবিক হামলা হতে গিয়েও হয়নি ট্রান্সলেটারের কল্যাণে।

শুধু পারমাণবিক হামলাই আসল কথা নয়। গত মাসেও শেরউড ফরেস্ট কোডনেমের এক দল নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করার জন্য। দু দিন ধরে সে দলের কর্মিরা স্টক এক্সচেঞ্জের চারপাশে সাতাশটা অবিস্ফোরক ফ্লাক্স পোড় বসায়। সেগুলো বিস্ফোরিত হবে না, বিস্ফোরণ ঘটাবে অন্য পথে। ম্যাগনেটিক বিস্ফোরণের ফলে এমন তরঙ্গ উঠবে যে এক্সচেঞ্জের সব চৌম্বক ডাটা হাপিস হয়ে যাবে চিরকালের জন্য। কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক, সব ধরনের ডিজিটাল কপি এবং ম্যাগনেটিক ফিতায় রাখা তথ্য, এমনকি ফ্লপি ডিস্কের সব উপাত্তও হাওয়া হয়ে যাবে মুহূর্তে। কে কীসের মালিক তার আর কোন প্রমাণ থাকবে না।

এ কাজটার জন্য একেবারে নিখুঁত সময়ের হিসাব প্রয়োজন, চৌম্বকক্ষেত্রটা গড়ে তুলতে হবে এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের হিসাবে। তার জন্য সবগুলোতে কাউন্ট ডাউনের প্রয়োজন। সেই কাউন্ট ডাউন আসছে ইন্টারনেট টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে। দু দিনের কাউন্ট ডাউনের সময় পোডগুলোর ভিতরের ঘড়ি অসংখ্য ডাটার স্রোত বইয়ে দেয়। এন এস এ সেসব ডাটা দেখে মনে করে একেবারে নির্দোষ তথ্যস্রোত।

কিন্তু ট্রান্সলেটার সেটাকে ডিসাইফার করার পরই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। জানা যায়, এগুলো আসলে কোন এক বিশেষ সময়ের অপেক্ষায় কাউন্ট ডাউন। আসল সময়ের তিন ঘন্টা আগেই পোডগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। তারপর আনা হয় সরিয়ে।

সুসান জানে, ট্রান্সলেটারের অস্তিত্ব না থাকলে এন এস এ একেবারে কানা হয়ে যাবে। সময় নির্দেশের দিকে তাকায় সে। পনের ঘন্টা হতে চলল। যদি এখনো কোডটা ভাঙা যায়, তাও দিনে যেখানে দেড়শ কোড ভাঙা হত সেখানে দুটাও সম্ভব না। সেই দেড়শ কোডের সময়েও অনেক ই-মেইল পড়ে থাকত লাইনে।

.

গতমাসে টানকাড়ো আমাকে কল করেছিল, স্ট্র্যাথমোর বলল, সুসানের চিন্তায় বাধা দিয়ে।

চোখ তুলে তাকাল সুসান, টানকাডো আপনাকে কল করেছিল?

নড করল সে, আমাকে সাবধান করে দেয়ার জন্য।

আপনাকে সাবধান করে দেয়ার জন্য? সে তো আপনাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে।

কল করে বলল, এমন একটা কোড আবিষ্কার করেছে যেটাকে ভাঙা সম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করিনি।

কিন্তু সে কোন দুঃখে আপনাকে জানাতে যাবে? নাকি বিক্রি করতে চায় সেটা?

না। ব্ল্যাকমেইলিং।

অবশ্যই। সে চেয়েছিল আপনি যেন তার নামটা থেকে সমস্ত কালিমা দূর করে দেন।

না। ঝামটা দিল স্ট্র্যাথমোর, টানকাড়ো ট্রান্সলেটার চেয়েছিল।

ট্রান্সলেটার?

হ্যাঁ। আদেশ করেছে, আগে সবার সামনে ট্রান্সলেটারের অস্তিত্বের কথা ফাস করে দিতে হবে। আমরা যদি জানিয়ে দিই যে মানুষের ই-মেইল খুলে পড়ার মত সামর্থ আছে আমাদের, তাহলেই ধ্বংস করা হবে ডিজিটাল ফোর্ট্রেসকে।

সুসানের চোখে মুখে দ্বিধা।  

শ্রাগ করল স্ট্র্যাথমোর, যাই হোক, অনেক দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যেই। সে তার ইন্টারনেট সাইটে ডিজিটাল ফোট্রেসের একটা সৌজন্য সংখ্যা পোস্ট করে দিয়েছে। যে ইচ্ছা করে সেই সেটাকে নামিয়ে নিতে পারবে।

কী করেছে?

এ হল প্রচারের এক পন্থা। ভয় পাবার কোন কারণ নেই। যে কপিটা পোস্ট করা হয়েছে সেটা এনক্রিপ্টেড। সবাই এটাকে ডাউনলোড় করতে পারবে কিন্তু কেউ খুলতে পারবে না। এটা আসলেই জিনিয়াস। সত্যি। ডিজিটাল ফোট্রেসের সোর্স কোড এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে।

এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুসানের চোখমুখ, তাইতো! সবাই এটাকে নিতে পারে, কিন্তু খুলে দেখতে পারবে না ভিতরে কী আছে।

তাই। টানকাড়ো একটা গাজর ঝুলিয়ে দিয়েছে সবার চোখের সামনে।

আপনি কি এলগরিদমটা চোখে দেখেছেন?

কমান্ডারের চোখমুখে দ্বিধা, না। বললাম না, এটা এনক্রিপ্টেড?

সুসান এবার দ্বিধাটা নিজের দিকে টেনে নিল, তাহলে আমাদের হাতে তো ট্রান্সলেটার আছে। সেটা দিয়ে ডিক্রিপ্ট করলে দোষ কোথায়?

তাকিয়ে থাকল সে স্ট্র্যাথমোরের চোখের দিকে। তারপর আচমকা বুঝে ফেলল সবটা। বলল, মাই গড! ডিজিটাল ফোর্ট্রেসকে এনক্রিপ্ট করা হয়েছে এটা দিয়েই? তাকে দিয়েই তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে তাকে?

স্ট্র্যাথমোর এবার হাসল। কাষ্ঠ হাসি। বিংগো!

সুসান এবার অথৈ সাগরে পড়ল। ডিজিটাল ফোর্ট্রেসকে এনক্রিপ্ট করা হয়েছে যে প্রোগ্রাম দিয়ে সেটার নামই ডিজিটাল ফোর্ট্রেস। টানকাড়ো এক অসাধারণ গাণিতিক আবিষ্কার করেছে কিন্তু সেটা লুকিয়ে আছে সেটার ভিতরেই।

এ তো বিগলম্যানের সিন্দুক! বলল সে।

এবারো নড় করল স্ট্র্যাথমোর। বিগলম্যানের সিন্দুকের কথা গণিত জগতে যারা একটু জটিল পর্যায়ে গেছে তারা সবাই জানে। এক লোক এমন এক সিন্দুকের ডিজাইন করল যেটাকে ভাঙা যাবে না, যেটার ভিতর থেকে কোনক্রমেই বের করা যাবে না কোন জিনিস। সে সেটা বানায়, তারপর যে বু প্রিন্ট দিয়ে বানায় সেটাকেই আটকে রাখে সে সিন্দুকের রহস্যের নিরাপত্তার জন্য। এখন, না ভাঙা যাবে সে সিন্দুক, না পাওয়া যাবে তার ব্লু প্রিন্ট।

আর ফাইলটা কী করে ট্রান্সলেটারে এল? প্রশ্ন তুলল সুসান।

আর সবার মত আমিও এটাকে টানকাডোর ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করেছি। এন এস এ এখন ডিজিটাল ফোট্রেসের গর্বিত মালিক, সমস্যা একটাই, খুলতে পারছি না।

এবার আর টানকাডোর প্রশংসা না করে পারে না সুসান। সে তার আবিষ্কারকে সবার সামনে তুলে দিয়েছে, এমনকি ট্রান্সলেটারের সামনেও। শুধু খোলার পথটা রাখেনি–যেন প্রমাণিত হয়ে যায় পুরো ব্যাপারটা।

স্ট্র্যাথমির তার হাতে ধরিয়ে দিল একটা নিউজপেপার ক্লিপিং। নিকি সিমবান নামের এক জাপানি লেখাটা লিখেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। জানিয়েছে জাপানি প্রোগ্রাম রাইটার এনসেই টানকান্ডো এমন এক প্রোগ্রাম লিখেছেন যেটার কোড ভাঙা কারো কম্ম নয়। ফর্মুলাটার নাম ডিজিটাল ফোর্ট্রেস নেটে পাওয়া যাবে ফ্রি। প্রতি মুহূর্তে এর দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে নিলাম ডুকার আগেই। যদিও সেটা জাপানের কৃতিত্ব, বহু আমেরিকান কোম্পানি সেটাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। ফর্মুলাটা আসলে বানোয়াট বলে সে, আরো বলে, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

প্রচারের আরেক পথ?

সায় দিল স্ট্র্যাথমোর, এ মুহূর্তে প্রতিটি জাপানি কোম্পানি সেটাকে ডাউনলোড করছে। ভাঙার চেষ্টা করছে। প্রতি সেকেন্ডে তারা যত ব্যর্থ হচ্ছে ততই বেড়ে যাচ্ছে এর মূল্য।

এর কোন মানে হয় না। প্রতিটা নতুন কোডিংই আনব্রেকেবল যে পর্যন্ত না ট্রান্সলেটার সেটার গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। এখনকার সাধারণ কোডগুলোই তো তারা ভাঙতে পারে না, ডিজিটাল ফোর্ট্রেসকে ভাঙবে কী করে? তাদের কাছে সেসব প্রোগ্রাম আর ডিজিটাল ফোট্রেসের মধ্যে পার্থক্য কী?

কিন্তু এ তো দারুণ কাজ। বলল স্ট্র্যাথমোর, সব কোম্পানিই বুলেটপ্রুফ কাঁচ বানাবে কিন্তু কোন কোম্পানি যদি মানা করে দেয় তাদের কাঁচের দিকে গুলি করতে, সবাই উৎসুক হয়ে পড়বে। চেষ্টা করবে সেটা ভাঙার।

আর জাপানি কোম্পানিগুলো মনে করছে ডিজিটাল ফোর্ট্রেস ভিন্ন রকমের? বাজারের আর সব কোডিং সফটওয়্যারেরচে ভাল?

টানকাডোকে হয়ত কোন দাম দেয়া হত না। কিন্তু অনেক আগে থেকেই সবাই জানে সে একটা জিনিয়াস। তার নাম আগে থেকেই উপরে। হ্যাকারদের কাছে সে নমস্য। টানকাডো যদি বলে তার কোড আনব্রেকেবল, তাহলে সেটা আসলেই আনব্রেকেবল।

কিন্তু মানুষ জানে যে বাকি সব কোডও আনব্রেকেবল।

হ্যাঁ… বলল স্ট্র্যাথোর, সে মুহূর্তটার জন্য।

সে মুহূর্ত বলতে কী বোঝায়?

স্ট্র্যাথমোর গোগন করল না দীর্ঘশ্বাস। বিশ বছর আগে কেউ কল্পনাও করেনি যে আমরা বিশ বিটের স্ট্রিম চিপার ভাঙতে পারব। কিন্তু আস্তে আস্তে এগিয়ে এসেছে টেকনোলজি। সব সময় এগিয়ে আসছে। সফটওয়্যার নির্মাতারা এখন। আন্দাজ করতে শুরু করেছে যে ট্রান্সলেটারের মত কম্পিউটারের অস্তিত্ব থাকতে পারে। টেকনোলজি বেড়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। প্রতি মুহূর্তে পাবলিক কি এলগরিদমগুলোর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। কালকের কম্পিউটারের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে ভাল এ্যালগরিদম লাগবেই।

আর ডিজিটাল ফোট্রেসই সেই সোনার চাবি?

ঠিক তাই। যে এ্যালগরিদম স্বয়ং ব্রুট ফোর্সকে ফাঁকি দিতে পারে সেটা যে কোন কম্পিউটারের কাছেই নিরাপদ। তা আজকের তোক বা আগামীর। নিমেষে সেটা পৃথিবীর চাহিদা হয়ে যাবে।

ঈশ্বর আমাদের সহায় হোক, কোনক্রমে বলল সুসান, আমরা কি নিলামে নামতে পারি?

মাথা নাড়ল স্ট্র্যাথমোর, টানকাডো আমাদের সুযোগটা ঠিকই দিয়েছে। পরিষ্কার করে দিয়েছে তার ব্যাপারগুলো। এতে ঝুঁকিও কম নেই। যদি ধরা পড়ে যাই, রাষ্ট্র হয়ে যাবে, আমরা তাকে ভয় পাচ্ছি। সবাই জেনে যাবে, আমাদের হাতে একটা কম্পিউটার আছে কোড ব্রেকিংয়ের জন্য। জেনে যাবে, তার কোডটা আসলেই আনব্রেকেবল।

হাতে সময় আছে কতটা?

স্ট্র্যাথমোর আরো মুষড়ে পড়ল, কাল দুপুরে সবচে বড় নিলামকারীর হাতে তুলে দিবে।

তারপর?

ব্যবস্থাটা এমন ছিল যে সে সর্বোচ্চ নিলামকারীর হাতে পাস কি-টা তুলে দিবে।

পাস কি?

খেলার আরেক অংশ। সবার হাতেই এর মধ্যে এ্যালগরিদমটা চলে গেছে। এখন শুধু পাস-কির অপেক্ষা।

সুসান মুখ ঝামটা দিল, তাইতো!

সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, এমন হওয়াই স্বাভাবিক। টানকাডোর হাতে একটা পাস কি আছে। সেটা হয়ত এখন তার পকেটের কোন এক কোণায় কাগজে দুমরে মুচড়ে পড়ে আছে। হয়ত চৌষট্টি ক্যারেক্টারের কোন সরল চাবিকাঠি। এ একটা জাদুর কাঠিই পারে পুরো পৃথিবীর বুক থেকে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের তথ্য সংগ্রহকে ডুবিয়ে দিতে।

ব্যাপারটা কল্পনা করে সুসান মনে মনে বিষম খেল। সবচে বেশি দর ডাকা কোম্পানির হাতে টানকাডো পাস কি টা তুলে দিচ্ছে। তারা খুলে ফেলছে ডিজিটাল ফোট্রেসকে। তারপর তারা হয়ত এ্যালগরিদমটাকে কোন টেম্পার প্রুফ চিপে বসিয়ে দিবে। তারপর, পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রতিটা কম্পিউটারে হয়ত একটা করে ডিজিটাল ফোট্রেস বসে যাবে। কোন কম্পিউটার কোম্পানি এখনো একটা এ্যালগরিদম চিপ বানায়নি, সে কথা কল্পনাও করেনি কারণ কয়েকদিন পরই সেটার আবেদন ফুরিয়ে যাবে। রোটেটিং ক্লিয়ারটেক্সট ফাংশন থাকায় ডিজিটাল ফোট্রেসের আবেদন কখনো ফুরাবে না। কোন ব্রুট ফোর্স এ্যাটাক এর টিকিটাও ছুতে পারবে না। এ হবে একেবারে আনকোরা এনক্রিপশন স্ট্যান্ডার্ড। ফলে সব কোড হয়ে পড়বে আনব্রেকেবল। ব্যাঙ্কার, দালাল, টেরোরিস্ট, স্পাই সবার হাতে চলে যাবে এটা।

মহা গন্ডগোল।

তাহলে আমাদের সামনে অপশন আছে কী কী সব সম্ভাবনার কথা ভাবছে সুসান।

আমরা তাকে আর সরিয়ে দিতে পারব না, তুমি যদি অপশন বলতে সেটাই বোঝাও।

সুসান ঠিক এ কথাটাই জানতে চেয়েছিল। এত বছরের ক্যারিয়ারে সুসান একটা গুঞ্জন শুনতে পেয়েছে এখানে, খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে গেলে এন এস এ খুবি দক্ষ কিছু লোককে ভাড়া করে। পৃথিবীর সেরা খুনিদের। ইন্টেলিজেন্স ক্যুনিটির নোংরা কাজগুলো সারে এ পথে।

স্ট্র্যাথমোর মাথা ঝাঁকাল, টানকান্ডো খুব চতুর। সে এমন কোন বিকল্প আমাদের হাতে ছেড়ে দেয়নি।

সে সুরক্ষিত?

ঠিক তা নয়।

গা ঢাকা দিয়েছে?

স্ট্র্যাথমোর এবার ত্যাগ করল, জাপান থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। ফোনের মাধ্যমে নিলামটা পরীক্ষা করার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আমরা জানি কোথায় আছে এখন।

আর তা জানার পরও আপনারা কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন না?

না। কারণ তার ইনস্যুরেন্স। কোন এক অজ্ঞাত তৃতীয় পক্ষের কাছে সে এ পাস কির কপি দিয়ে রেখেছে… যদি তার কিছু হয়ে যায়…।

অবশ্যই, ভাবছে সুসান, একজন গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল, তাহলে আমার মনে হয় যদি টানকাভোর ভালমন্দ কিছু একটা ঘটে যায় তাহলে তৃতীয় পক্ষ সেটাকে নিলামে চড়িয়ে দিবে?

এরচেও খারাপ। টানকাডোর উপর ফুলের টোকা পড়লেও তার সহায়তাকারী সেটাকে প্রকাশ করে দিবে।

বিভ্রান্ত দেখাল সুসানকে, তার থার্ড পার্টি প্রকাশ করে দিবে?

নড করল স্ট্র্যাথমোর, ঠিক তাই। পৌঁছে দিবে ইন্টারনেটে। প্রকাশ করবে সংবাদপত্রে। ছাপিয়ে দিবে বিলবোর্ডে। মোট কথা, খুলে দিবে সারা দুনিয়ার কাছে।

এবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল সুসানের, সে ইন্টারনেটে দিয়ে দিবে ফ্রি ডাউনলোডের জন্য?

ঠিক তাই। টানকাডো হিসাব করে নিয়েছে–সে যদি বেঁচে নাই থাকে- টাকা দিয়ে আর কী হবে? যাবার আগে পৃথিবীকে একটা উপহার দেয়া যাক।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সুসান। টানকাডো একটা আনব্রেকেবল কোড তৈরি করেছে। তারপর জিম্মি করেছে আমেরিকার নিরাপত্তাকে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে। কণ্ঠ এখন পরিষ্কার। আমাদের অবশ্যই টানকাডোর সাথে যোগাযোগ করতে হবে! জিনিসটা রিলিজ না করার জন্য তাকে কোন না কোন পথে রাজি করানো যাবে। সর্বোচ্চ দরের তিনগুণ হাঁকতে পারি আমরা। পরিষ্কার করে দিতে পারি তার নাম! যাই হোক, কিছু না কিছু তো করতেই পারি!

অনেক দেরি হয়ে গেল, স্ট্র্যাথমোর বলল। লম্বা করে শ্বাস নিল একটা, এনসেই টানকাডোকে আজ সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে স্পেনের সেভিলে।

অধ্যায় : ৮

দ্বৈত ইঞ্জিনওয়ালা লিয়ারজেট সিক্সটি রানওয়েতে আলতো করে নেমে এল একটা পাখির মত। স্পেনের, এস্ত্রেমাদুরা ক্রল করে এগিয়ে আসছে।

মিস্টার বেকার? একটা কণ্ঠ চিড় ধরাল নিরবতায়, চলে এসেছি।

উঠে একটু আড়মোড়া ভাঙল বেকার। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তার কোন লাগেজ নেই। তাতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। বলা হয়েছে, ভ্রমণটা একেবারে সংক্ষিপ্ত হবে। আসা আর যাওয়া।

মূল টার্মিনালের পাশে একটা একা হ্যাঙারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল প্লেনটা মৃদু গুঞ্জন তুলতে তুলতে। উপরে স্পষ্ট দিবাকর। আলো ছড়াচ্ছে সূর্যটা। একটু পর পাইলট এগিয়ে এসে হ্যাঁচের কাজ শুরু করে দিল। ক্যানবেরি জুসটা নামিয়ে রাখল সে ভিজা বারে। তারপর চাপিয়ে নিল স্যুটকোট।

একটা মোটা ম্যানিলা এনভেলাপ বের করল পাইলট। আপনাকে এটা দেয়ার কথা। বলল সে। হাতে ধরিয়ে দিল বেকারের। উপরে নীল কালিতে লেখাঃ

কিপ দ্য চেঞ্জ

বেকার বের করল মোটা লালচে নোটের তাড়াটা। কী ব্যাপার…

স্থানিয় কারেন্সি। পাইলট বলল।

আমি জানি এটা কী। কিন্তু এ তো… এ তো বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আমার শুধু ট্যাক্সির ভাড়া প্রয়োজন। মাথার ভিতরে বাকি কথাটা ঝাড়ল সে, এখানে এমন কী কাজ আছে যে জন্য হাজার ডলার প্রয়োজন?

আমার কাজ আমি করছি, স্যার। পাইলট চলে গেল ককপিটে। পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।

ভারি এনভেলাপটা নিয়ে নেমে এল বেকার নির্জন হ্যাঙারে। তারপর রেখে দিল সেটা বুক পকেটে। পেরিয়ে গেল রানওয়ে। শুরুটা অদ্ভুত বলতেই হবে। মাথা থেকে সরিয়ে দিল সে চিন্তাটা। ভাগ্য ভাল হলে স্টোন ম্যানোরে যাবার একটা উপায় বেরিয়ে যেতে পারে।

আসা এবং যাওয়া, নিজেকে বলল সে আসা এবং যাওয়া।

সে জানে না, কোন পথ নেই।

অধ্যায় : ৯

সিস্টেম সিকিউরিটি টেকনিশিয়ান ফিল চার্ট্রাকিয়ান ক্রিপ্টোতে ঢোকার পায়তাড়া ভাজছে। কাল কিছু পেপারওয়ার্ক ফেলে গিয়েছিল। সেগুলো নিতে হবে। কিন্তু ঘটনা এমন ঘটবে না।

ক্রিপ্টো ফ্লোর থেকে সিস-সেক ল্যাবে যাচ্ছে সে। সাথে সাথেই চোখে পড়ল, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে আশপাশে। ট্রান্সলেটারের কাজ তদারকির জন্য কেউ নেই। সেইসাথে কম্পিউটারের স্ক্রিনটা বন্ধ। আজব ব্যাপার। ট্রান্সলেটারের স্ক্রিন কখনো বন্ধ থাকে না।

ডাক ছাড়ল চার্ট্রাকিয়ান, হ্যালো?

কেউ জবাব দিল না। ল্যাব একেবারে ঝাড়া পোছ। যেন অনেক ঘন্টায় কেউ এখানে পা ফেলেনি।

চার্ট্রাকিয়ান মাত্র তেইশ বছরের ছেলে। সিস-সেকে নতুন এলেও তার ট্রেনিংয়ে কোন ত্রুটি ছিল না। সে ভাল ভাবেই জানে কথাটা- সিস-সেকে কেউ না কেউ সর্বক্ষণ ডিউটিতে থাকবে। এটাই নিয়ম। বিশেষত শনিবারে থাকবেই, কারণ ক্রিপ্টোর লোকজন তখন এখানে ঢু মারে।

সাথে সাথে মনিটরের পাওয়ার অন করে দেয়ালের চার্টের দিকে তাকাল। কে এখন ডিউটিতে আছে? নামের লিস্টটায় চোখ বুলাতে বুলাতে জোরে দাবি করল। শিডিউল অনুসারে এক তরুণ ছেলের কাজে থাকার কথা। ল্যাবের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিরক্তি ঝাড়ল সে, তাহলে সেই মহামানব এখন কোথায়?

মনিটর টার্ন অন করে বুঝতে পারল হয়ত স্ট্র্যাথমোরের ইচ্ছাতেই সিস-সেক এখন খালি। স্ট্র্যাথমোরের ওয়ার্ক স্টেশনের ঢাকনা সরানো। তার মানে বস এখন ভিতরেই আছে। শনিবারে তাকে দেখে অবাক হবার কিছু নেই। কাজ পাগল মানুষটা শনি-রবি বোঝে না। তার এখানে থাকা চাই বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিন।

একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে চার্ট্রাকিয়ান একেবারে পরিষ্কার। যদি বস দেখতে পায় সিস-সেকে কোন মানুষ নেই তাহলে অনর্থ ঘটে যাবে। তরুণ উজবুকটা তার চাকরি খোয়াবে। একবার ভাবল চার্ট্রাকিয়ান, ফোনটা তুলে সর্বনাশ ঘটাবে নাকি ছেলেটার? একটা অলিখিত নিয়ম আছে সিস-সেকে, সবাই সবার পিছনটায় নজর রাখবে। ক্রিপ্টোতে সিস-সেকরা দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ। এ মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কর্মক্ষেত্রে সবার সেরা ক্রিপ্টোরা আর সিস-সেকদের সহ্য করা। হয় কারণ তারা খেলনাগুলোকে সচল রাখে।

চার্ট্রাকিয়ান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। তুলে নিল ফোন। কিন্তু সেটা কানের কাছে যাবার আগেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তাকিয়ে থাকল মনিটরের দিকে। নির্নিমেষ।

না। বিল চার্ট্রাকিয়ান তার ছোট্ট চাকরির জীবনে কখনো এমন বিদঘুঁটে ব্যাপার দেখেনি। ট্রান্সলেটারের মনিটরটায় উঠে আছে কিম্ভুত একটা তথ্যঃ

টাইম ইলম্পিডঃ ১৫:১৭:২১

পনের ঘন্টা সতের মিনিট! অসম্ভব!

সাথে সাথে স্ক্রিনটাকে রিবুট করল সে। চেষ্টা করল বোঝার, কোন ভুল তথ্য দেয়নি তো সেটা? প্রাণ ফিরে পেল মনিটরটা আবারো। একই কথা বলছে। টিকটিক করে সরে যাচ্ছে সেকেন্ডের কাটা।

শিতল একটা স্রোত উঠে এল চার্ট্রাকিয়ানের শিরদাঁড়া বেয়ে। ক্রিপ্টোর সিস সেকের একটা মাত্র কাজঃ ট্রান্সলেটারকে ভাইরাস ফ্রি রাখতে হবে।

চার্ট্রাকিয়ান জানে, পনের ঘন্টার কাজ চলার একটা মাত্র অর্থ আছে। ইনফেকশন। একটা দুষ্ট ভাইরাস চলে গেছে কম্পিউটারের ভিতরে। কুরে কুরে খাচ্ছে ট্রান্সলেটারের প্রোগ্রামিং। মুহূর্তে চার্ট্রাকিয়ান তার ট্রেনিংয়ের সময়ের কথা মনে করল। কখনো এখানে মনিটর সুইচ অফ করা থাকে না। এসব ভুলে গেল সে। এখন শুধু ভিতরে কী ঢুকেছে সেটা নিয়ে চিন্তা।

একটা ইনফেক্টেড ফাইলের ভিতরে ঢোকা কি সম্ভব? ভেবে পায় না সে। সিকিউরিটি ফিল্টারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু হতে পারে কি?

গান্টলেটের ভিতর দিয়ে প্রতিটা ফাইলকে যেতে হয় ট্রান্সলেটারে ঢোকার জন্য। পাওয়ারফুল সার্কিট লেভেল গেটওয়ে ধরে এগিয়ে যায় সেটা। কোন অযাচিত প্রোগ্রাম ধরা পড়লে সাথে সাথে সেটাকে বাতিল করে দিতে হয়।

এরপর সেগুলো হাতে চেক করে দেখার পালা। তখন; গান্টলেটের সে অপরিচিত প্রোগ্রামটাকে চেখে দেখে হাতেনাতে বুঝে নিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে তবেই ঢোকানো হয় ট্রান্সলেটারে।

কম্পিউটার ভাইরাস আর জীবন্ত ভাইরাস দুটা দু ধরনের। কম্পিউটার ভাইরাস এক ধরনের প্রোগ্রাম যা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যারের বারোটা বাজায় আর সাধারণ ভাইরাস মানুষ, অন্য প্রাণী এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাকটেরিয়াকে নষ্ট করে। দুয়ের মধ্যে মিল একটাই। দুজনেই আশ্রয়দাতার সর্বনাশ করে।

কখনো এন এস এর এ বিশাল কম্পিউটারের গায়ে ভাইরাসের আচড় পড়েনি। কারণ, এটার নিরাপত্তা অসম্ভব শক্তিশালী। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করা যায় না যে এটা সর্বক্ষণ অসংখ্য ফাইল নিয়ে কাজ করে, সেগুলো টেনে আনে বাইরে থেকে, নেট থেকে। ব্যাপারটার সাথে বহুজনের সাথে সেক্স করার মিল আছে। এ কাজ করতে থাকলে নিরাপত্তা থাক চাই না থাক, কোন না কোন সময় ইনফেকশনের ভয় থেকেই যায়।

সব চেক করল চার্ট্রাকিয়ান। না, কোন সমস্যা নেই। সব ফাইল ক্লিন। এমন। সমস্যার কথা সে আগে চিন্তাও করেনি।

একটা ভাইরাস পোব। এখন আমাকে একটা ভাইরাস প্রোব চালাতে হবে।

চার্ট্রাকিয়ান জানে, প্রথমেই স্ট্র্যাথমোর যা করতে বলবে, তা হল একটা ভাইরাস প্রোব। সিদ্ধান্ত নিল সে। ভাইরাল প্রোব সফটওয়্যার লোড করে সেটাকে লঞ্চ করল। মিনিট পনের সময় লাগবে।

পরিষ্কার হয়ে ফিরে এস। কোন ঝামেলা নেই, জানিয়ে দাও ড্যাডিকে।

কিন্তু কেন যেন তার মনে হচ্ছে, এটা মোটেও কিছুই নয় গোছের কিছু নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ঘাপলা আছে এখানে। ঘাপলা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *