০০১. ক্যাপিটল হিলের পাশে

ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন / অনুবাদ : মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

[একটি বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। অসাধারণ এক ষড়যন্ত্র। এমন একটি থৃলার যা আপনি কখনও পড়েন নি…
দুনিয়া কাঁপানাে একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে সারা পৃথিবী যখন উদ্বেলিত, পর্দার অন্তরালে তখন ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা—খুন হতে থাকে বিজ্ঞানী, রাজনীতিক আর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা—পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। এরই মধ্যে চারজন সিভিলিয়ান বিজ্ঞানী আর সিক্রেট সার্ভিসের এক অফিসার পৃথিবীর সবচাইতে বিপদসঙ্কুল জায়গায় বিপজ্জনক এক পরিস্থিতির মুখােমুখি হলাে। পর্দার অন্তরালে থাকা শক্তিটি সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীবাসির কাছে কী লুকাতে চাচ্ছে? আর হতভাগ্য সিভিলিয়ান বিজ্ঞানীরা সেই রহস্য উন্মােচন করতে পেরেছিলাে কিনা ‘ডিসেপশন পয়েন্ট’-এ নিহিত আছে তার উত্তর।]

মুখবন্ধ

মৃত্যু এই অভিশপ্ত জায়গায় অসংখ্যভাবে আসতে পারে। ভূতত্ত্ববিদ চার্লস ব্রফি বন্য এই জায়গাটি বহু বছর ধরে সহ্য করে এসেছে, তারপরও কোনো অস্বাভাবিকতা আর দুর্ভাগ্য বরণের জন্য তাকে প্রস্তুত করে তোলে নি এই বন্য পরিবেশ।

ব্রফির ভূ-তত্ত্ব পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির স্লেড গাড়িটার চারটা হাসকি কুকুর তুন্দ্রা অঞ্চল দিয়ে যাবার সময় আচমকাই আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো।

“কি হয়েছে ছুরিরা?” স্লেড থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলো ব্রফি।

ঘন মেঘের ওপাশে একটি দু’পাখাওয়ালা পরিবহন হেলিকপ্টার নেমে আসছে। এটা অদ্ভূত, ভাবলো সে।ব্রফি এই সর্ব দক্ষিণে কোনোদিন কোনো হেলিকপ্টার নামতে দেখে নি। কপ্টারটা পঞ্চাশ গজ দূরে নামলে বাতাসের চোটে তুষাড়গুড়ো চারদিক উড়ে বেড়ালো। ভড়কে গিয়ে ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলো তার কুকুরগুলো।

কপ্টারের দরজা খুলে বের হয়ে এলো দু’জন লোক। পুরোপুরি সাদা চামড়ার পোশাক পরা আর তাদের হাতে অস্ত্র, ব্রফির দিকেই তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসছে লোকগুলো।

“ডক্টর ব্রফি?” একজন বললো।

বিস্মিত হলো ভূ-তত্ত্ববিদ। “আপনারা আমার নাম জানলেন কীভাবে? আপনারা কারা?”

“আপনার রেডিওটা বের করুন, প্লিজ।”

“কী বললেন?”

“যা বলছি তাই করুন।“

অবাক হয়ে ব্রফি তার পার্ক সোয়েটারের পকেট থেকে রেডিক্টা বের করলো।

“আমরা চাই আপনি এক্ষুণি একটি জরুরি বার্তা পাঠাবেন। আপনার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি একশো কিলোহার্জে কমিয়ে আনুন।”

একশ কিলোহার্জ? ব্রফি একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলো। এতো নিচু ফ্রিকোয়েন্সিতে কারো পক্ষে তো যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। “কোনো দুর্ঘটা কি হয়েছে?”

দ্বিতীয় ব্যক্তি তার রাইফেল ব্রফির মাথার দিকে তাক করলো। “ব্যাখ্যা করার সময় আমাদের নেই। যা বলছি তাই করুন।”

কাঁপতে কাঁপতে ট্রান্সজিস্টারটা ঠিক করে নিলো ব্রফি। প্রথম লোকটি এবার ছোট্ট একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো তার দিকে, তাতে কিছু কথা টাইপ করা আছে। “এই কথাগুলো ট্রান্সমিট করুন। এক্ষুণি।”

ব্রফি কাগজটার দিকে তাকালো, “আমি বুঝতে পারছি না। এই তথ্যটা সত্য নয়। আমি এটা ট্রান্সমিট করতে পারবো না।”

ভূ-তত্ত্ববিদের মাথায় রাইফেল দিয়ে চাপ দিলো লোকটি। বার্তাটা ট্রান্সমিট করার সময় কাঁপতে শুরু করলোব্রফির কণ্ঠ।

“ঠিক আছে, প্রথম লোকটি বললো। এবার আপনি এবং আপনার কুকুরসহ কপ্টারে উঠে পড়ন।”।

বন্দুকের মুখে ব্রফি তার কুকুরসহ স্রেড গাড়িটা নিয়ে উঠে পড়তেই কপ্টারটা সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম দিকে উড়ে গেলো।

“আপনারা আসলে কারা?” ব্রফি জানতে চাইলো, পার্কার নিচে ঘেমে গেছে সে। আর এই বার্তাটার মানেই বা কী?

লোকটা কিছুই বললো না।

কপ্টারটা খুব উঁচুতে উঠলে বাতাসের বেগ এসে খোলা দরজায় আঘাত হানলে স্লেডের সাথে সংযুক্তব্রফির চারটা হাসকি কুকুর ভয়ে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো।

“অন্তত দরজাটা তো বন্ধ করবেন,” বললো ব্রফি। “আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না আমার কুকুরগুলো ভয় পাচ্ছে।”

লোকটা এবারও কোনো জবাব দিলো না।

কপ্টারটা ৪০০০ ফিট উঁচুতে উঠতেই নিচে দেখা গেলো বরফের সারিসারি পর্বতমালা। আচমকা উঠে দাঁড়ালো লোক দুটো, কোনো কথা না বলেই কুকুরগুলোসহ ডেল্টা ধরে ফেলে দিলো খোলা দরজা দিয়ে নিচে। এই ভীতিকর দৃশ্যটা চেয়ে চেয়ে দেখলো ফি। মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো কুকুরগুলো।

লোকটা এবার ব্রফির কলার চেপে ধরতেই তীব্র চিৎকারে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তাকেও দরজার কাছে নিয়ে গেলো তারা। ভয়ে অসাড় হয়ে লোকটার শক্ত হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো ব্রফি, কিন্তু কোনো কাজ হলো না, কিছুক্ষণবাদেই সে নিচের সাদা বরফের পাহাড়ের ওপর আছড়ে পড়লো।

ক্যাপিটল হিলের পাশে অবস্থিত তুলোর বেঁস্তোরায় রাজনৈতিকভাবে ভুল মেনু, বেবি ভিল এবং হর্স কারপাচ্চিও রাখে, যা ওয়াশিংটনবাসীর শক্তিশালী নাস্তার ব্যাপারে একটি পরিহাসই বলা চলে। আজ সকালে তুলো খুব ব্যস্ত–এসপ্রেসো মেশিনের শব্দ আর মোবাইল ফোনের সংলাপ চলছে চারপাশে।

মেইতর দি, মানে হোটেল পরিচালক সকালে তার ব্লাডিমেরিতে যখন চুমুক দিচ্ছে তখন মেয়েটা ঢুকলো। তার দিকে চেয়ে বহুলচচিত একটি হাসি দিলো সে।

“শুভ সকাল,” বললো মেইতর দি। “আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”

মেয়েটা খুব আকর্ষণীয়, মধ্য তিরিশের হবে, পরে আছে ধূসর ফ্লানেলের প্যান্ট, রক্ষণশীল ফ্লাট আর আইভরি গলার ছাই রঙা ব্লাউজ। তার বুক টানটান-মুখটা একটু উপরের দিকে তোলা-তবে উন্নাসিক নয়, একটু শক্ত ধরণের। মেয়েটার চুল বাদামী আর তার চুলের কাটিং বর্তমানে ওয়াশিংটনের সবচাইতে জনপ্রিয় স্টাইল-অ্যাঙ্কর ওম্যান’-ঘাড় অবধি নামানো চুল। যৌনাবেদনময়ী হবার জন্য বেশ উপযুক্ত, কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি স্মার্ট এটা মনে করিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট নয়।

“আমার একটু দেরি হয়ে গেছে, মেয়েটা বললো, তার কণ্ঠ অননুমিত। “সিনেটর সেক্সটনের সঙ্গে আমার ব্রেকফাস্ট মিটিং রয়েছে।”

মাইতরে দি একটু অপ্রস্তুত হলো যেনো। সিনেটর সেজউইক সেক্সটন। সিনেটর এখানে নিয়মিতই আসেন, আর বর্তমানে তিনি দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় একজন মানুষ। গত সপ্তাহে, মঙ্গলবার বারোজন রিপাবলিকান সিনেটরকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের জন্য। অনেকেই বিশ্বাস করে, সিনেটর সাহেব বর্তমান প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে হোয়াইট হাউজের চাবিটা ছিনিয়ে নিতে পারবেন। এখন সেক্সটনের মুখ প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে আর ম্যাগাজিনে দেখা যাচ্ছে। তার ক্যাম্পেইন শ্লোগান দেখা যাচ্ছে সারা আমেরিকায় : খরচ করা বন্ধ করুন। নির্মাণ করা শুরু করুন।

“সিনেটর সেক্সটন তার নিজের বুথেই আছেন,” মাইতরে দি বললো। “আর আপনি?”

“রাচেল সেক্সটন। তার মেয়ে।”

কী বোকরে আমি, ভাবলো সে। মিলটা খুবই স্পষ্ট। মেয়েটার রয়েছে সিনেটরের মতোই অন্তর ভেদ করা একজোড়া চোখ আর চমৎকার শরীর-যাকে আভিজাত্য বলা যেতে পারে। “আপনার সাথে পরিচিত হওয়াটা সত্যি আনন্দের, মিস্ সেক্সটন।”

মাইতরে দি রাচেলকে ডিনার টেবিলের দিকে নিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলো পুরুষ মানুষের তীক্ষ্ণ চোখ মেয়েটাকে পরখ করছে, এটা খেয়াল করে সে একটু বিব্রত হলে…কেউ কেউ সতর্ক, বাকিরা তাও নয়। খুব কম মেয়েই তুলোতে ডিনার করে আর তার চেয়েও কম রেসল সেক্সটনের মতো দেখতে মেয়েরা।

“চমৎকার শরীর,” একজন বললো, এরইমধ্যে একজন নতুন বৌ জুটিয়ে ফেলেছে দেখছি!”

“এটা তার মেয়ে, গাধা, আরেকজন বললো।

মুখ টিপে হাসলো লোকটা। “সেক্সটনকে তো চিনি, হয়তো নিজের মেয়েকেও রেহাই দেবে না।”

***

রাচেল যখন তার বাবার টেবিলের কাছে পৌঁছালো তখন সিনেটর সাহেব সেলফোনে কারো সাথে নিজের সাম্প্রতিক কোনো সফলতা নিয়ে উচ্চ স্বরে কথা বলছেন। তিনি তার দিকে চেয়ে ইশারা করে মনে করিয়ে দিলেন যে, সে দেরি করে ফেলেছে।

আমি অনেকদিন তামাকে দেখি নি বাবা, ভাবলো রাচেল।

তার বাবার প্রথম নাম টমাস, যদিও এই নামটি বহু আগেই বদলে নিয়েছেন। রাচেলের ধারণা, তিনি অনুপ্রাস পছন্দ করেন বলেই এটা করেছেন। সিনেটর সেজউইক সেক্সটন। সাদা। চুল, সিলভার মুখের এক রাজনৈতিক জীব। দেখলে মনে হবে সোপ অপেরার কোনো ডাক্তার সাহেব।

“রাচেল!” তার বাবা ফোনটা রেখেই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে চুমু খেলেন।

“হাই, ড্যাড।” সে তাকে পাল্টা চুমু খেলো না।

“তোমাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

তাহলে তা শুরু হয়ে গেছে, ভাবলো সে।

“আমি তোমার মেসেজ পেয়েছি। কী ব্যাপার বলো তো?”

“আমি কি আমার মেয়েকে নাস্তা খেতে ডাকতে পারি না?”

রাচেল তার বাবার কাছ থেকে খুব কম অনুরোধই পেয়ে থাকে, আর তিনিও তার সঙ্গ খুব একটা কামনা করেন না, যদি না কোনো উদ্দেশ্য থেকে থাকে।

সেক্সটন কফিতে চুমুক দিলেন।”তোমার দিনকাল যাচ্ছে কেমন?”

“ব্যস্ত। আমি তোমার ক্যাম্পেইন দেখেছি, খুব ভালোই হচ্ছে।”

“ওহ্, এসব কথা থাক,” সেক্সটন টেবিলের সামনে ঝুঁকে ফিসফিস্ করে বললেন। “স্টেট-ডিপার্টমেন্টের সেই ছেলেটার ব্যাপার কি, যাকে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম?”

রাচেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রচণ্ড তাড়ায় সে হাত ঘড়িটা দেখলো। ”বাবা, তাকে ফোন করার মতো সময় আমার ছিলো না। আর আমি চাই তুমি এসব বন্ধ করো।”

“তোমার সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ জানি, রাচেল। তবে মনে রেখো, ভালোবাসা ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন।”

রাচেলের অনেক কিছুই মনে পড়ে গেলো, তবে চুপ থাকাটাই বেছে নিলো সে। “বাবা, তুমি আমাকে শুধু দেখতে চেয়েছো? বলেছিলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু।”

“তাই তো।” তার বাবা তাকে খুব ভালো করে পরখ করলেন।

রাচেল টের পেলো তার আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা তার বাবার চোখের চাহনিতে গুলিয়ে যাচ্ছে। লোকটার ক্ষমতাকে অভিশম্পাত দিলো সে। সিনেটরের চোখ দুটোই তার সেরা সম্পদ, এমন। একটি সম্পদ, রাচেলের মতে যা তাকে হোয়াইট হাউজে নিয়ে যাবে। এই তার চোখ অশ্রুসজল তো মুহূর্তেই বদলে যাবে সেটা, যেনো নির্মোহ আত্মার জানালা খুলে গেছে। সবার প্রতি যেনো একটি গভীর আস্থা তাতে। এটা আস্থারই ব্যাপার, তার বাবা সবসময়ই বলেন। এক বছর আগেই রাচেলকে হারিয়েছেন সিনেটর তবে খুব দ্রুতই দেশটা করায়ত্ত করতে পেরেছেন তিনি।

“তোমার জন্য আমার একটি প্রস্তাব রয়েছে,” সিনেটর সেক্সটন বললেন।

“আমাকে অনুমান করতে দাও,” নিজের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করলো সে। “কোনো বিখ্যাত তালাকপ্রাপ্ত তরুণী এক বৌ খুঁজছে?”

“ঠাট্টা কোরো না। তুমি আর সেই তরুণীটি নও।”

সেই সুপরিচিত কাঁপুনিটা টের পেলো রাচেল যা তার বাবার সাথে দেখা হলেই ঘটে থাকে।

“আমি তোমার জীবনটাকে টেনে তুলতে চাই,” তিনি বললেন।

“আমি জানতাম না আমি ডুবে যাচ্ছি, বাবা।”

“তুমি না, প্রেসিডেন্ট। দেরি হবার আগেই তোমার উচিত জাহাজ থেকে লাফ দেয়া।”

“আমরা কি এ ব্যাপারে কথা বলি নি?”

“নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো। আমার জন্য কাজ করতে পারো রাচেল।”

“আশা করি তুমি আমাকে এজন্যে নাস্তা খেতে ডাকো নি।”

সিনেটরের ঠাণ্ডা শীতল মেজাজটা একটু বিগড়ে গেলো। “রাচেল, তুমি কি বুঝতে পারছে না, তার হয়ে তোমার কাজ করাটা আমার নির্বাচনে বাজে প্রভাব ফেলবে?।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাচেল, “বাবা, আমি প্রেসিডেন্টের জন্য কাজ করি না। এমনকি তার সাথে দেখাও করি না। আমি কাজ করি ফেয়ারফ্যাক্সর হয়ে।”

“রাজনীতি হলো অনুধাবনের বিষয়, রাচেল। দেখে কিন্তু মনে হয় তুমি প্রেসিডেন্টের হয়েই কাজ করছে।”

বিরক্ত হলো রাচেল, চেষ্টা করলো নিজেকে শান্ত রাখতে। এই কাজটা পেতে আমাকে খুব খাটতে হয়েছে, বাবা। আমি এটা ছাড়ছি না।”

সিনেটরের চোখ দুটো কুকে গেলো। “জানো, তোমার স্বার্থপর আচরণ কখনও কখনও সত্যি

“সিনেটর সেক্সটন?” টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো একজন রিপোর্টার।

সেক্সটনের অভিব্যক্তি আচমকাই বদলে গেলো। হাফ ছেড়ে টেবিলের ঝুড়ি থেকে একটা ক্রইন্ট তুলে নিলো রাচেল।

“র‍্যালফ স্নিডান,” রিপোর্টার নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, “ওয়াশিংটন পোস্ট। আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”

সিনেটর হেসে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, “আমার সৌভাগ্য, র‍্যাফ। একটু জলদি করো। আমি চাই না আমার কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাক।

রিপোর্টার হাসলো। “অবশ্যই, স্যার।” একটা মিনি টেপ রেকর্ডার বের করলো সে। “সিনেটর, আপনার টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে আপনি আহ্বান জানিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান বেতন…নতুন পরিবারের জন্য ট্যাক্স ছাটাইয়ের কথা। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?”

“অবশ্যই। শক্তিশালী নারী আর পরিবারের একজন বড় ভক্ত বলতে পারো আমাকে।”

রাচেল মুখ টিপে হাসলো।

“আর পরিবারের বিষয়ে,” বললো রিপোর্টার, “আপনি শিক্ষার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছেন। আপনি খুবই বতিৰ্কত বিষয়ে বাজেট ছাটাই করে স্কুলগুলোকে দেবার পক্ষপাতি।”

“আমি বিশ্বাস করি শিরাই ভবিষ্যৎ।”

রাচেল বিশ্বাসই করতে পারছে না তার বাবা পপগান থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করছেন।

“শেষ প্রশ্ন, স্যার। আপনি বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ এগিয়ে। আছেন। প্রেসিডেন্ট নিশ্চয় ভড়কে গেছে। আপনার বর্তমান সফলতার ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?”

“আমার মনে হয় বিশ্বাস আর আস্থার সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকানরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে প্রেসিডেন্ট কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এ দেশে সরকার চালাতে গিয়ে প্রতিদিন খরচ বেড়েই যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে ঋণ। তাই আমেরিকানরা ভাবতে শুরু করেছে, সময় এসেছে খরচ কমিয়ে মেরামত শুরু করার।”

তার বাবার এই বাকসর্বস্ব বক্তৃতার মধ্যেই রাচেলের পেজারটা বেজে উঠলো, অন্য কোনো সময়ে এর আওয়াজ বিরক্তিকর মনে হলেও এখন রাচেলের কাছে আওয়াজটা খুবই সুমধুর বলে মনে হচ্ছে। কথার মাঝখানে ছেদ পড়াতে বিরক্ত হয়ে সিনেটর তার দিকে তাকালেন। রাচেল তার হাতব্যাগ থেকে পেজারটা বের করে তাতে কী মেসেজ রয়েছে দেখলো।

স্নিডান দাঁত বের করে সিনেটরের দিকে চেয়ে বললো, “আপনার মেয়ে খুবই ব্যস্ত দেখছি। আপনারা দু’জন এখনও ডিনার করার জন্য সময় বের করতে পারেন দেখে খুব। ভালো লাগছে।”

“যেমনটি আমি বলেছি, সবার আগে পরিবার।”

স্লিডান মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর শক্ত হলো তার চাহনি। “আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি স্যার, আপনি এবং আপনার মেয়ে আপনাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বগুলো কিভাবে সামলান?”

“দ্বন্দ্ব?” সিনেটর সেক্সটন নির্দোষভাবে মাথা দোলালেন, যেনো কিছুই বুঝতে পারছেন না। “কিসের দ্বন্দ্বের কথা বলছো?” রাচেল ভুরু কুচকে তার বাবার অভিনয়টা দেখলো। সে জানে এটার গন্তব্য কোথায়। শালার রিপোর্টার, ভাবলো সে। তাদের অর্ধেকই হলো রাজনীতিকদের পাপেটারিপোর্টার এমন একটি প্রশ্ন করবে, মনে হবে খুব কঠিন তদত্ত কিন্তু বাস্তবে সেটা সিনেটরের পক্ষেই যাবে অনেক বিষয়ে তার বাবা পরিষ্কার করে নিতে পারবেন এই প্রশ্নের জবাব দেবার মধ্য দিয়ে।

“তো স্যার…” রিপোর্টার একটু কেশে অস্বস্তির ভাবটা দূর করতে চাইলো। “দ্বন্দ্বটা মানে, আপনার মেয়ে আপনার প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করছে।”

সিনেটর সেক্সটন হাসিতে ফেঁটে পড়লেন, যেনো উড়িয়ে দিলেন প্রশ্নটা। “র‍্যালফ, প্রথমত, প্রেসিডেন্ট এবং আমি প্রতিপক্ষ নই। আমরা কেবল দু’জন দেশপ্রেমিক, যাদের রয়েছে দেশের মঙ্গল ভাবনা নিয়ে দু’ ধরণের মতামত বা চিন্তাভাবনা।”

রিপোর্টার চোখ কুঁচকালো, “আর দ্বিতীয়ত?”

“দ্বিতীয়ত, আমার মেয়ে প্রেসিডেন্টের কর্মচারী নয়। গোয়েন্দাসংস্থার লোক। সে হোয়াইট হাউজে গোয়েন্দা রিপোর্ট পাঠায়। এটা আসলে অতো বড় পদমর্যাদার নয়।” তিনি থেমে রাচেলের দিকে তাকালেন, “সত্যি বলতে কী, আমি নিশ্চিত নই, তুমি এখনও প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছে কিনা, তাই না?”

রাচেল তাকালো, তার চোখে আগুন। পেজারটাতে আবার শব্দ হলে তার দৃষ্টি ইনকামিং মেসেজটার দিকে গেলো।

–আরপি আরটি ডিআইএন আরও এমটি এটি–

এই শর্টহ্যান্ড নোটটার মানে বুঝতে পেরে চিন্তিত হলো সে। এটা অপ্রত্যাশিত এবং নিশ্চিতভাবেই খারাপ সংবাদ। তবে নিদেনপক্ষে বের হবার দরজাটা তো পেলো।

“জেন্টেলম্যান,” বললো সে। “আমার কাজে দেরি হয়ে গেছে।”

“মিস্ সেক্সটন,” রিপোর্টার খুব জলদি বললো, “যাবার আগে আপনি কি বলবেন, গুজব আছে, আপনার আজকের সাক্ষাতের আসল উদ্দেশ্যটা কি? আপনি নাকি চাকরি ছেড়ে বাবার ক্যাম্পেইনে যোগ দিচ্ছেন?”

রাচেলের মনে হলো কেউ তার মুখে গরম কফি ঢেলে দিয়েছে। প্রশ্নটা একেবারে বিগড়ে দিলো তাকে। তার বাবার মুখ টেপা হাসি দেখে টের পেলো প্রশ্নটা আগে থেকেই তৈরি করা ছিলো। তার ইচ্ছে হচ্ছে টেবিল ডিঙিয়ে ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করতে।

রিপোর্টার টেপরেকর্ডারটা তার মুখের কাছে ধরলো। “মিস্ সেক্সটন?”

রিপোর্টারের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাচেল। “র‍্যালফ, তুমি যেই হওনা কেন, শুনে রাখো, নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে সিনেটর সেক্সটনের হয়ে কাজ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আর তুমি যদি এটা না লিখে অন্য কিছু লেখো, তবে পাছা থেকে টেপ রেকর্ডারটা বের করার জন্য তোমার জুতোর হিলের দরকার হবে।”

রিপোর্টারের চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো, রেকর্ডারটা বন্ধ করে হাসিটা লুকাতে চাইলেী সে। “আপনাদেরকে ধন্যবাদ।” কথাটা বলেই চলে গেলো।

সঙ্গে সঙ্গেই মেজাজ খারাপের জন্য অনুশোচনা অনুভব করলো রাচেল। তার বাবার রগচটা ব্যাপারটা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। আর এজন্যেই সে তাকে ঘৃণা করে। শান্ত হও রাচেল, একদম শান্ত।

তার বাবাকে অসন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। “তোমার একটু আদব-কায়দা শেখার দরকার রয়েছে, রাচেল।”

নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলো রাচেল। “এই মিটিংটা শেষ।”

সিনেটরেরও মনে হলো মেয়ের সাথে পাট চুকিয়ে ফেলেছেন। সেলফোনটা বের করে একটা ফোন করলেন তিনি। “বাই, সুইটি। অফিসে এসে দেখা করে যেও, হ্যালো বলে যেও। আর ঈশ্বরের দোহাই, বিয়ে করে ফেলো, খুব জলদি। তোমার বয়স এখন তেত্রিশ।”

“চৌত্রিশ,” ঝট করে বললো সে।”তোমার সেক্রেটারি একটা কার্ড পাঠিয়েছিলো।”

তিনি যেনো জিভ কাটলেন। “চৌত্রিশ, প্রায় বয়স্ক এক কনে। তুমি হয়তো জানো, চৌত্রিশ বছর বয়সে আমি-”

“মাকে বিয়ে করে প্রতিবেশীদের অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলে?” কথাটা খুব জোরে শোনা গেলেও রাচেল অবশ্য এতো জোরে বলতে চায় নি। কথাটা আশপাশের লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করলো।

সিনেটরের চখ দুটো বরফের মতো জমে আছে, দুটো ক্রিস্টাল চোখ তার কাছে। বিরক্তি বলে মনে হচ্ছে এখন। “সাবধানে ডার্লিং।”

দরজার দিকে চলে গেলো রাচেল।

না। তুমিই সাবধানে থেকো, সিনেটর।

তিন জন লোক তাদের থার্মাটেক তাঁবুর ভেতরে চুপচাপ বসে আছে। বাইরে বইছে বরফের ঝড়ো বাতাস। তবুটা ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম হচ্ছে যেনো। অবশ্য কেউই সেটা আমলে নিচ্ছে না; তারা সবাইই এর চেয়েও আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আগেও দেখেছে।

তাঁবুটা একেবারে ধবে সাদা। সবার দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে সেটা। যোগাযোগের যন্ত্রপাতি, পরিবহন আর অস্ত্রশস্ত্র সব কিছু খুবই আধুনিক। দল নেতার ছদ্মনাম ডেল্টা-ওয়ান। পেশীবহুল আর ঘোলাটে চোখের এক মানুষ সে।

তীক্ষশব্দে বিপ করে উঠলো ডেল্টা-ওয়ানের হাতে থাকা সামরিক ক্রোনোগ্রাফটা। কাকতালীয়ভাবে বাকি দু’জনের ক্রোনোগ্রাফটাও বিপ করে উঠলো।

অতিবাহিত হলো আরো ত্রিশ মিনিট।

আবারও সময় হয়েছে।

হুট করে ডেল্টা-ওয়ান বাকি দুই সঙ্গীকে রেখে বাইরের অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়লো। ইনফারেড দূরবীন দিয়ে পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত দিগন্তরেখার দিকে তাকালো সে। সব সময় যেমনটি করে, স্থাপনার দিকেই ফোকাস করলো। সেটা ১০০০ মিটার দূরে-উষর। ভূখণ্ডের উপর অসদৃশ্যভাবে একটি অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সে এবং তার দল আজ থেকে দশ দিন আগে যখন থেকে এটা নির্মাণ করা হয়েছে নজরদারি করে যাচ্ছে। ডেল্টা-ওয়ানের কোনো সন্দেহই নেই যে, ভেতরের তথ্যটা পুরো বিশ্বকে বদলে দেবে। এটা . রক্ষা করতে গিয়ে এরইমধ্যে কতোগুলো জীবন হারিয়ে গেছে।

এই মুহূর্তে স্থাপনার বাইরে সবকিছুই খুব শান্ত বলে মনে হচ্ছে। তবে সত্যিকারের পরীক্ষাটা হলো, ভেতরে আসলে কী হচ্ছে।

ডেল্টা-ওয়ান তাঁবুর ভেতরে আবার ঢুকে তার সঙ্গী দু’জন সৈনিককে উদ্দেশ্য করে বললো, “ফাই করানোর সময় হয়েছে।”

উভয় সৈনিক মাথা নেড়ে সায় দিলো। তাদের মধ্যে ডেল্টা-টু নামের লম্বামতো লোকটি তার ল্যাপটপ কম্পিউটার খুলে ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাত রাখলো একটি জয়স্টিকে। হাজার মিটার দূরে এক বনের গভীরে লুকিয়ে থাকা মশার সমান আকৃতির একটি সার্ভিলেন্স রোবট ট্রান্সমিশনটা গ্রহণ করে জীবন্ত হয়ে উঠলো।

রাচেল সেক্সটন এখনও রাগে ফুঁসছে, লিসবার্গ হাইওয়ে ধরে ছুটছে তার সাদা ইন্টেগ্রা গাড়ি। চারিদিকের পরিবেশ শান্ত নিথর হলেও সেটা তাকে শান্ত করতে পারছে না। তার বাবার। সাম্প্রতিক কাজকর্ম নির্বাচনে হয়তো তাকে ভালো অবস্থানে নেবে, কিন্তু সেটা যে কেবল তার আত্মঅহমিকাতেই রসদ সরবরাহ করবে সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

লোকটার শঠতা সন্দেহাতীতভাবেই যন্ত্রণাদায়ক, কারণ তিনিই রাচেলের একমাত্র পারিবারিক সদস্য। রাচেলের মা তিন বছর আগেই মারা গেছেন। তার জন্য সেটা ছিলো চরম বিপর্যয়। তার হৃদয়ে এখনও মায়ের জন্যে তীব্র আবেগ রয়েছে। রাচেলের একমাত্র সান্ত্বনা, তার মা তার বাবার কারণে যে তীব্র দহনে জ্বলছিলেন সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

রাচেলের পেজারটা আবারও বিপ করলে তার চিন্তা ভাবনাকে বাস্তবে টেনে নিয়ে এলো সেটা। ইনকামিং মেসেজটা ঠিক আগেরটার মতোই:

-আর.পি আর.টি ডি.আই আর.এন আর,ও এস.টি এ.টি-

রিপোর্ট টু দি ডিরেক্টর অব এনআরও স্ট্যাট, মানে এনআরও’র ডিরেক্টরের সাথে এক্ষুণি দেখা করো! দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আরে বাবা, আমি আসছি।

সবসময় যে পথ দিয়ে যায় সেই পথ দিয়েই ছুটলো রাচেল। ব্যক্তিগত প্রবেশ পথের দিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে ভারি অস্ত্রসজ্জিত গার্ডদের একটি সেন্ট্রিবুথের কাছে গিয়ে থামলো সে। এটা হলো ১৪২২৫ লিসবার্গ হাইওয়ে। এই দেশের সবচাইতে গোপনীয় একটি ঠিকানা।

গার্ডরা যখন রাচেলের গাড়িতে আঁড়িপাতার যন্ত্র স্ক্যান করতে লাগলো তখন সে দূরের স্থাপনাটির দিকে তাকালো। ১০০০০০০ বর্গফুটের কপ্লেক্সটি ৬৮ একর জায়গা জুড়ে ওয়াশিংটন ডিসির উণ্ঠে ভার্জিনিয়ার ফেরারফ্যাক্সে অবস্থিত। বনটির সামনের অংশ কাঁচে ঢাকা, তাতে একটি সাদা স্যাটেলাইট ডিশের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সেগুলো রয়েছে ভবনের চারপাশে।

দুই মিনিট পর প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে গ্রানাইট পাথরের যে সাইন খোদাই করা আছে। ঠিক তার সামনে এসে গাড়িটা থামালো :

ন্যাশনাল রেকনেসান্স অফিস (এনআরও)

দুজন সশস্ত্র মেরিন বুলেটপ্রুফ রিভলভিং দরজাটা খুলে দিতেই রাচেল হনহন করে চলে গেলে তারা তার দিকে চেয়ে রইলো। এই দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে সবসময় যে অনুভূতিতে আক্রান্ত হয় এবারো সেই একই জিনিস টের পাচ্ছে সে… যেনো একটি ঘুমন্ত দৈত্যের পেটের ভেতরে ঢুকছে।

ভেতরে ঢুকেই লবিতে চারপাশে চাপা ফিসফাস শুনতে পেলো রাচেল। একটা বিশাল মোজাইক এনআরও’কে নির্দেশ করছে :

এমবেলিং, ইউ এস গ্লোবাল ইনফরমেশন সুপিরিয়টি, ডিউরিং পিস এ্যান্ড থ্রু ওয়ার

এখানকার দেওয়ালে সারিসারি ছবি টাঙানো : রকেট উৎক্ষেপন, সাবমেরিন, ইন্টারসেপ্ট স্থাপনাসমূহ-পর্বততুল্য সব অর্জন, যা কেবল এসব দেয়ালের ভেতরেই উদ্যাপন করা হয়।

সবসময়ের মতোই রাচেল টের পেলো বাইরের পৃথিবীটা মিইয়ে যাচ্ছে তার পেছনে। যেনো অন্য একটা পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছে সে। এমন এক পৃথিবী যেখানে সমস্যাগুলো ট্রেনের মতো গর্জে উঠলেও সমাধানটা ফিসফিস কণ্ঠের মতোই শোনায়।

রাচেল যখন চূড়ান্ত চেক পয়েন্টের দিকে এগোলো অবাক হয়ে ভাবলো, কী এমন সমস্যা হয়েছে যে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তার পেজারে দু’বার মেসেজ পাঠানো হলো!

“গুড মর্নিং, মিস্ সেক্সটন।” লোহার দরজার দিকে এগোতেই গার্ড হেসে বললো।

রাচেলও হেসে জবাব দিলে গার্ড একটা সোয়াব বা ছোট্ট তুলোর কাঠি বের করে রাচেলের হাতে দিলো।

“আপনি তো নিয়মটা জানেনই,” বললো সে।

রাচেল তুলোর কাঠিটা তার মুখে থার্মোমিটারের মতো ঢুকিয়ে দিয়ে জিভের নিচে দু’সেকেন্ড রেখে গার্ডের কাছে ফিরিয়ে দিলে গার্ড সেটা মেশিনের ছিদ্রের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। রাচেলের ডিএনএ সঠিক কিনা সেটা নিশ্চিত করতে মাত্র চার সেকেন্ড সময় ব্যয় করলো মেশিনটা। এরপরই ম্যাচিং লেখাটা ভেসে উঠলো মনিটরে।

গার্ড মুচকি হাসলো। মনে হচ্ছে আপনি এখনও আপনিই আছেন।” সোয়াবটা বের করে একটা পাত্রে ফেলে দিলো সে, সঙ্গে সঙ্গে ওটা নষ্ট করে ফেলা হলো। বোতাম টিপে বিশাল লোহার দরজাটা খুলে দিলো গার্ড।

ভবনের ভেতরে ঢুকতেই রাচেল অবাক হয়ে ভাবলো, ছয় বছর ধরে এখানে কাজ করেও এই প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম সে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। এই এজেন্সিটা অন্য ছয়টি ইউএস স্থাপনার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, দশ হাজারেরও বেশি কর্মচারী রয়েছে এখানে, আর প্রতিবছর এখানকার বাজেট হলো ১০ বিলিয়ন ডলার।

পুরোপুরি গোপনীয়তায় সর্বাধুনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তি তৈরি এবং ব্যবস্থাপনা করে থাকে এনআরও; বিশ্বব্যাপী ইলেক্ট্রনিক ইন্টারসেপ্ট, স্পাই স্যাটেলাইট, টেলিফোন যন্ত্রপাতিতে আঁড়িপাতার যন্ত্র লাগিয়ে দেয়া, এমনকি উইজার্ড নামে পরিচিত পৃথিবীর সাগর তল জুড়ে থাকা ১৪৫৬টি হাইড্রোফোনের একটি গোপন জালের যে নাভাল রিকোন নেটওয়ার্ক রয়েছে তা দিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র জাহাজ চলাচল মনিটরিং করে থাকে তারা।

এনআরও’র প্রযুক্তি কেবল আমেরিকাকে মিলিটারি দ্বন্দ্বেই বিজয়ীই করে নি বরং শান্তি কালীন সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাহায্য করা, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করার কাজে সিআইএ, নাসা এবং পলিসি মেকারদেরকে প্রয়োজনীয় ডাটা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে থাকে তারা।

রাচেল এখানে কাজ করে ডাটা সারসংক্ষেপকারী হিসেবে। সারসংক্ষেপ করা অথবা ডাটা বিশ্লেষণ করে এক পাতার সারসংক্ষেপ রিপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে স্বভাবজাত প্রতিভা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাচেল।

রাচেল এখন এনআরও’র প্রধান ডাটা সারসংক্ষেপকারী পদে হোয়াইট হাউজের লিয়াজো হিসেবে কর্মরত। এনআরওর ডাটা বিশ্লেষণ করে কোন্‌গুলো প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হবে সেই দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত। প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছেও এক পাতার একটি প্রতিবেদন পাঠায় সে।

যদিও কাজটা খুব কঠিন আর সময়সাপেক্ষ, তারপরও এটি খুবই সম্মানজনক একটি পদ। তার বাবার ছায়া থেকে বেড়িয়ে এসে স্বাধীনভাবে নিজেকে তুলে ধরতেও সাহায্য করেছে এই পদটি। সিনেটর অসংখ্যবার রাচেলকে তার পদ ছেড়ে দিয়ে তার সাথে যোগ দেবার প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু সিনেটর সেজউইক সেক্সটনের কাছে নিজেকে অর্পণ করতে ইচ্ছুক নয় রাচেল। তার মা তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন যে, একজন মানুষের হাতে যখন। অনেক বেশি কার্ড থাকে তখন সে কি করে বা কি হতে পারে।

মার্বেল ফ্লোরে প্রতিধ্বনিত হলো রাচেলের পেজারের শব্দ।

আবারো মেসেজটা দেখারও প্রয়োজন অনুভত্ব করলো না। লিফটে ঢুকে উপর তলায় চলে গেলো সে।

কোনো মামুলি লোকের পক্ষে এনআরওর ডিরেক্টরকে ফোন করাটা একদম বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এনআরওর ডিরেক্টর উইলিয়াম পিকারিং একজন ছোটখাটো মানুষ, পাণ্ডুর একটি মুখ, টেকো মাথার আর ঘোলাটে চোখের ব্যক্তি, যা দিয়ে সে দেশের সুগভীর গোপনীয়তাকে বের। করে আনে। তাসত্ত্বেও, যারা তার অধীনে কাজ করে তাদের জন্য পিকারিং পর্বতসম ব্যক্তি। তার আত্মম্ভরী ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রিয় দর্শন এনআর’ওতে কিংবদন্তী হয়ে আছে। লোকটার শান্ত শিষ্ট ভাবমূর্তি তার কালো সুটের পোশাকের সাথে মানানসই। তাকে ‘পাতি হাঁস’ বলে একটি ডাক নামে ডাকা হয়। একজন প্রতিভাবান কৌশলবিদ এবং কর্মক্ষমতার প্রতিভূ সে। নিজের জগৎটি সে পরিচালনা করে কোনো রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। তার মন্ত্র হলো : সত্য খুঁজে বের করো। তার ওপরেই কাজ করো।

রাচেল যখন ডিরেক্টরের অফিসে পৌঁছালো তখন সে ফোনে কথা বলছে। রাচেল তাকে দেখে সব সময়ই অবাক হয়: উইলিয়াম পিকারিংকে দেখে মনে হয় না সে এতো ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যে কিনা যখন তখন প্রেসিডেন্টকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে।

পিকারিং ফোনটা রেখে হাত নেড়ে তাকে ভেতরে আসতে ঈশারা করলো। “এজেন্ট সেক্সটন, বসুন।” তার কন্ঠ শক্ত হয়ে আছে।

“ধন্যবাদ, স্যার।” রাচেল বসলো।

উইলিয়াম পিকারিংয়ের সামনে লোকজন অস্বস্তিবোধ করলেও, রাচেল মানুষটাকে পছন্দই করে। সে তার বাবার একেবারে বিপরীত…শারিরীকিভাবে, মানসিকভাবে। সে খুবই ক্যারিশম্যাটিক আর নিজের কাজ পুরো দমে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবেই করে থাকে।

পিকারিং চোখের চশমা খুলে তার দিকে তাকালো, “এজেন্ট সেক্সটন, প্রেসিডেন্ট আমাকে আধঘন্টা আগে ফোন করে সরাসরি আপনার কথা বলেছেন।”

রাচেল তার সিটে নড়েচড়ে বসল। পিকারিং সরাসরি আসল কথায় যাবার জন্য বিখ্যাত। শুরুটা চমৎকার, সে ভাবলো। “আমার কোনো রিপোর্টে আশা করি কোনো সমস্যা হয়নি।”

বরং বলা যায়, তিনি বলেছেন, হোয়াইট হাউজ আপনার কাজে খুবই খুশি।”

রাচেল নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “তো, তিনি তবে চাচ্ছেনটা কী?”

“আপনার সাথে দেখা করতে চান। একান্তে এবং তা এক্ষুণি।

রাচেলের অস্বস্তিটা চাপা থাকলো না। একান্তে দেখা সাক্ষাত? কিসের জন্যে?”

“আচ্ছা, প্রশ্ন করেছেন। তিনি সেটা আমাকে বলেননি।”

এবার রাচেল খেই হারালো। এনআরও’র ডিরেক্টরের কাছ থেকে তথ্য গোপন করার অর্থ ভ্যাটিকানের কোনো ব্যাপার পোপের কাছ থেকে গোপন রাখা। ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিতে একটা জোক প্রচলিত আছে যে, যদি পিকারিং কিছু না জেনে থাকে, তো ধরে নিতে হবে ঘটনাটা আদৌ ঘটেনি।

পিকারিং এবার উঠে দাঁড়িয়ে জানালার সামনে পায়চারী করতে লাগলো। “তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেনো এক্ষুণি তোমার সাথে যোগাযোগ করে তোমাকে তার কাছে মিটিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেই।”

“এক্ষুণি?”

“তিনি ট্রান্সপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাইরে সেটা অপেক্ষা করছে।”

রাচেল চিন্তিত হলো। প্রেসিডেন্টের অনুরোধটা অদ্ভুত, কিন্তু পিকারিংয়ের চেহারাটা দেখে সে ঘাবড়ে গেলো। “আপনি অবশ্যই সময় চেয়ে নিয়েছেন।”

“আমি তাই করেছি!” পিকারিংয়ের মধ্যে আবেগের বিরল উপস্থিতি দেখা গেলো। প্রেসিডেন্টের সময়টা মনে হয় প্রায় অপরিপক্ক। আপনি এমন একজনের মেয়ে যে তাকে বর্তমানে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ করছে। আর তিনি আপনার সাথে একান্তে দেখা করতে চাচ্ছেন? আমি এতে অসঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি। আপনার বাবাও, নিঃসন্দেহ আমার সাথে একমত হবেন।”

রাচেল জানে, পিকারিং ঠিকই বলেছে –এই নয় যে, সে তার বাবাকে কিভাবে দেখে। “আপনি কি প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে পারছেন না?”

“আমার দায়িত্ব হলো, বর্তমান সময়ের হোয়াইট হাউজ প্রশাসনকে ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট দেয়া। তাদের রাজনীতি সম্পর্কে বিচার করে মন্তব্য করা নয়।”

ঠিক পিকারিংয়ের মতোই জবাব, রাচেল বুঝতে পারলো। পিকারিং কখনই রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করে না।

হতে পারে এটা নির্দোষ কোনো প্রস্তাব,” রাচেল বললো। আশা করলো প্রেসিডেন্ট কোনো ধরণের সস্তা ক্যাম্পেইনের ঊর্ধ্বেই থাকবেন। হয়তো, তার কিছু স্পর্শকাতর ডাটার সারসংক্ষেপ করার দরকার হয়েছে।”

“তেমনটি মনে হচ্ছে না, এজেন্ট সেক্সটন। হোয়াইট হাউজের তো এরকম যোগ্য লোক বহু রয়েছে। চাইলে তাদেরকে তারা পেতে পারে। প্রেসিডেন্টই ভালো জানেন কেন আপনাকে তাঁর দরকার। আর যদি তা না হয়, তাহলে তিনি ভালো করেই জানেন একজন এনআরও’র সম্পদকে অনুরোধ জানিয়ে, আমাকে তার কারণ না বলার মানেটা কী।”

পিকারিং সবসময়ই তার কর্মচারীদেরকে সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।

“আপনার বাবা ক্রমশ রাজনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন, পিকারিং বললো, “অনেক বেশিই পাচ্ছেন। হোয়াইট হাউজ অবশ্যই নার্ভাস আছে এ ব্যাপারে।” সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ‘রাজনীতি হলো একটি মরিয়া ব্যাপার। যখন প্রেসিডেন্ট তার প্রতিদ্বন্দ্বির মেয়ের সাথে গোপনে দেখা করতে চান, আমার ধারণা সেটা ইন্টেলিজেন্স-এর ব্যাপার না হয়ে অন্য কিছুই হবে।”

রাচেল শীতল অনুভ্র করলো। “আর আপনি ভয় পাচ্ছেন হোয়াইট হাউজ আমাকে রাজনীতিতে গুলিয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব?”

পিকারিং, একটু থামলো। “আপনি আপনার বাবা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন, সে ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করেন না। আর আমার খুব কম সন্দেহই রয়েছে, এটা প্রেসিডেন্টের ক্যাম্পেইন স্টাফরা জানে। আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে তারা আপনাকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছে।”

“আমি তবে কোনোটা ধরে নেবো?” ঠাট্টাচ্ছলে বললো রাচেল।

পিকচারিংকে দেখে মনে হলো খুশি হয়নি। সে তার দিকে দৃঢ়ভাবে তাকালো। “সতর্ক করে দেবার জন্য বলা, এজেন্ট সেক্সটন। আপনি যদি মনে করেন যে, আপনার পেশাদারিত্বের ব্যাপারের জন্য আপনার বাবার সাথে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হবে তবে আমার উপদেশ হলো, আপনি প্রেসিডেন্টের অনুরোধটা ফিরিয়ে দিন।”

“ফিরিয়ে দেবো?” রাচেল নার্ভাস হয়ে হাসলো। আমি কোনোভাবেই তার অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারি না।”

“না,” ডিরেক্টর বললো, “আপনি না, আমি সেটা পারি।”

তার কণ্ঠটা একটু গর্জে উঠলো যেনো। রাচেলের মনে পড়ে গেলো পিকারিংকে পাতিহাঁস বলেও ডাকা হয়। ছোটখাটো মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, পিকারিং রাজনৈতিক ভূমিকম্পের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি সে চায়।

“আমার চিন্তাটা খুব সহজ,” পিকারিং বললো। “আমার অধীনে যারা কাজ করে তাদেরকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমারই। আমার কোনো লোক রাজনীতির খেলার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হোক এটা আমি হতে দেবো না।”

“আপনার দিক নির্দেশনাটা তবে কি?”

পিকারিং দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আমার উপদেশ হলো, আপনি তার সাথে দেখা করেন। কোনো মন্তব্য করবেন না। প্রেসিডেন্ট যখন বলবেন তিনি কী চাচ্ছেন, আমাকে ফোন করবেন। আমি যদি মনে করি তিনি আপনার সাথে রাজনৈতিক খেলা খেলছেন, বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে এত দ্রুত তা থেকে বের করে আনবো যে, লোকটা বুঝতেও পারবে না, তাকে কী আঘাত করছে।”

“ধন্যবাদ স্যার।” রাচেল ডিরেক্টরের তরফ থেকে এক ধরণের সুরক্ষার আশ্বাস পেলে, যা সে তার বাবার কাছ থেকে পাবার জন্য বহুদিন ধরে উদগ্রীব হয়ে আছে। আপনি বলছিলেন, প্রেসিন্টে ইতিমধ্যেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন?”

“ঠিক তা না।” পিকারিং ভুরু কুচকে জানালার দিকে ইঙ্গিত করলো।

অনিশ্চিতভাবে রাচেল জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকালো।

একটি সাব-নোড় এমএইচ-৬০জি পেইভ হক হেলিকপ্টার বাইরের প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করছে। এ পর্যন্ত তৈরি করা সবচাইতে দ্রুত গতির কপ্টার এটি। এই পেইভ হটাতে হোয়াইট হাউজের সিল মারা রয়েছে। পাইলট পাশেই দাঁড়ানো, হাত ঘড়ি দেখছে।

রাচেল অবিশ্বাসে পিকারিংয়ের দিকে তাকালো। “হোয়াইট হাউজ মাত্র পনেরো মাইল দূরত্বের জন্য পেইভ হক পাঠিয়েছে?”

“মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট আশা করছেন হয় আপনি বিমোহিত হবেন, নয়তো ভড়কে যাবেন।” পিকারিং তার দিকে তাকালো। “আমার ধারণা আপনি এর কোনোটিই হননি।”

রাচেল মাথা নাড়লো। সে আসলে দুটোই হয়েছে।

চার মিনিট বাদে, রাচেল সেক্সটন এনআরও থেকে বেড়িয়ে হেলিকপ্টারের চড়ে বসলো। সিট বেল্ট বাধার আগেই কপ্টারটা উড়তে শুরু করলো। ভার্জিনিয়ার জঙ্গলের ওপর দিয়ে যাবার সময় রাচেল নিচের বৃক্ষসারির দিকে তাকিয়ে টের পেলো তার নাড়িস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সেটা এমনভাবে বাড়তে লাগলো যেনো তার মনে হচ্ছে হকারটা কখনই হোয়াইট হাউজে পৌঁছাতে পারবে না।

ঝড়ো বাতাসে থার্মাটেকের তাঁবুটা যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ডেল্টা-ওয়ান সেটা মোটেও লক্ষ্য করলো না। সে এবং ডেল্টা-থৃ তাদের কমরেডের দিকে চোখ রাখছে। জয়স্টিকটা নিয়ে গভীর মনোযোগর সাথে কাজ করছে সে। তাদের সামনের পর্দায় একটা লাইভ ভিডিও দেখা যাচ্ছে। সেটা ক্ষুদ্র রোবটের ক্যামেরা থেকে ট্রান্সমিট হচ্ছে।

নজরদারীর মোক্ষম একটা হাতিয়ার, ডেল্টা-ওয়ান ভাবলো। এই যন্ত্রটা সচল করলে প্রতিবারই তারা মুগ্ধ হয়। পরবর্তীতে মাইক্রো-মেকানিক্সের জগতে এই সত্যটা দূর কল্পনাকেও ছাপিয়ে যাবে।

মাইক্রো ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সিসটেম (এমইএমএস)-নজরদারীর উচ্চপ্রযুক্তির একটি নতুন এবং উন্নতমানের যন্ত্র, দেয়ালে ওড়ার প্রযুক্তি, তারা এটাকে এ নামেই ডাকে।

আক্ষরিক অর্থেই।

যদিও মাইক্রোস্কপিক, রিমোট কন্ট্রোলের রোবটটা শুনতে সায়েন্সফিকশান বলে মনে। হচ্ছে, কিন্তু ১৯৯০ এর দশকেই এটার অস্তিত্ব ছিলো। ডিসকভারি ম্যাগাজিন ১৯৯৭ সালের মে মাসে মাইক্রোবোট নিয়ে কভার স্টোরি করেছিলো। সেটাতে ওরা এক সাঁতার কাটা রোবটের ছবিও দিয়েছিলো। সাঁতার কাটাটা– লবনের দানার আকারে– মানুষের শরীরের রক্ত প্রবাহে সেটা ঢুকিয়ে দেয়া যাবে, ফ্যান্টাস্টিক ভয়েজ সিনেমাতে যেমনটি দেখানো হয়েছে। এগুলো এখন উন্নতমানের চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হচ্ছে ধমনীর অভ্যন্তরে কাজ করার জন্য, রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সেটা পরিচালনা করা হয়ে থাকে। ধমনীর ব্লকেজ চিহ্নিত করে কোনো রকম অস্ত্রোপচার ছাড়াই চর্বি কেটে ফেলা যায় এই যন্ত্রটি দিয়ে।

সেদিক থেকে, উড়ন্ত মাইক্রোবোট নির্মাণ করাটা আরো সহজ কাজ। কিটি হকের সময় থেকেই ক্ষুদ্র উড়ন্ত যান তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়। এ ধরণের প্রথম উড়ন্ত মাইক্রোবোট আকাশে উড়াতে সক্ষম হয় না, মানবহীন মহাকাশযান মঙ্গলে পাঠানোর গবেষণার অংশ হিসেবে। সেটা অবশ্য কয়েক ইঞ্চির দৈর্ঘ্যের ছিলো। এখন নানা প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। ফলে মাইক্রোবোট আর দূর কল্পনার বিষয় নয়, বাস্তব।

সত্যিকারের প্রচেষ্টাটি এসেছে বায়োমিনিকস নামের নতুন একটি ক্ষেত্র থেকে– ধরণীমাতাকে অনুকরণ করে। অতি ক্ষুদ্র ড্রাগন মাছিই হলো এসব রোবটের আদর্শ টাইপ। পিএইচ-টু মডেলের ডেল্টা-টু এক সেন্টিমিটার লম্বা– মশার আকৃতির– এটার রয়েছে সিলিকন দিয়ে তৈরি স্বচ্ছ দুটো ডানা। এজন্যে এটা শূন্যে ভালোমতো ভাসতে পারে।

মাইক্রোবোটের জ্বালানী গ্রহণের পদ্ধতিটি আরো একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রথম মাইক্রোবোট প্রোটোটাইপটি কেবলমাত্র উজ্জ্বল আলোর উত্স থেকেই সেলের মধ্যে দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারতো। সেটা অন্ধকারের জন্য উপযোগী ছিলো না। নতুন প্রোটোটাইপটি, কেবলমাত্র কয়েক ইঞ্চির চৌম্বক ক্ষেত্র থেকেই রিচার্জ করে নিতে পারে তার শক্তি গেলোকে। আধুনিক সমাজে, চৌম্বক ক্ষেত্র একটি সহজলভ্য জিনিস, সর্বত্রই রয়েছে বলা চলে– কম্পিউটার মনিটর, ইলেটুক তার, অডিও স্পিকার, সেলফোন- মনে হয় রিচার্জ করার কোনো ঘাটতিই কোনোদিন হবে না। একবার মাইক্রোবোট ছেড়ে দিলে, সেটা সীমাহীনভাবেই অডিও ভিডিও সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম হবে। ডেল্টা ফোর্সের পিএইচ টু এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চালু আছে, এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।

.

এখন, একটা পোকার মতো গোলাঘরের ভেতরে যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে, শূন্যে ভাসা মাইক্রোবোটটা নিঃশব্দে ছুটে বেড়াচ্ছে বিশাল ঘরটার মধ্যে। উপর থেকে মাইক্রোবোটটা নিরবে চক্কর দিচ্ছে, নিচে কতগুলো মানুষ-টেকনিশিয়ান, বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, অসংখ্য ক্ষেত্রের এক গেবষণাগার। পিএইচ-টু চক্কর দিতেই ডেল্টা-ওয়ান দু’জন পরিচিত মুখকে টার্গেট করলো, তারা কথা বলছে। তাদের কথা কোনো দরকার। সে ডেল্টা-টুকে বললো আরেকটু নিচে নেমে কথাবার্তা কোনোর জন্য।

ডেল্টা-টু রোবটের সাউন্ড সেন্সরটা বাড়িয়ে দিয়ে সেটা বিজ্ঞানীদের মাথার ঠিক দশ ফিট উপরে স্থির করে রাখলো।ট্রান্সমিশনটা ক্ষীণ হলেও শ্রবনযোগ্য ছিলো।

“আমি এখনও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না,” একজন বিজ্ঞানী বললেন। এখন থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে, এখানে আসার পর থেকে তার প্রবল উত্তেজনাটা একটুও কমেনি।

যে লোকটার সাথে তিনি কথা বলছেন তার অবস্থাও একই রকম। “আপনার জীবনে কি …আপনি ভেবেছিলেন যে এরকম কিছু দেখে যেতে পারবেন?”

“কখনও না।” বিজ্ঞানী জবাব দিলেন। এটাতো একটা চমৎকার স্বপ্নের মতো।”

ডেল্টা-ওয়ান যথেষ্ট শুনেছে। ভেতরের সবকিছুই প্রত্যাশানুযায়ীই ঘটছে। ডেল্টা-টু মাইক্রোবোটটাকে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে তার আগের লুকানো জায়গায় নিয়ে গেলো। সে এই জিনিসটাকে একটা ইলেক্ট্রক জেনারেটরের সিলিন্ডারের কাছে সবার অলক্ষ্যে পার্ক করলো পিএইচ-টুর এনার্জি-সেলসগুলো সঙ্গে সঙ্গেই পরের মিশনের জন্য রিচার্জ করতে শুরু করে দিলো।

রাচেল সেক্সটনের চিন্তাভাবনা সকালের অদ্ভুত ঘটনাবলীতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। পেইভ হক কপ্টারটি সকালের আকাশ চিড়ে ছুটতে লাগলো। চিজাপিক উপসাগরের দিকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত রাচেল বুঝতে পারেনি যে, তারা ভুল দিকে যাচ্ছে। কিছু বুঝতে না পেরে রাচেল উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো।

“হেই!” সে পাইলটকে চিৎকার করে বললো। “আপনি করছেন কি?” স্লেডের ঘরঘর শব্দে তার কথা কিছুই কোনো যাচ্ছে না। “আপনারতো আমাকে হোয়াইট হাউজে নিয়ে যাবার কথা।”

পাইলট মাথা আঁকালেন। “দুঃখিত, ম্যাম। আজ সকালে প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে নেই।”

রাচেল মনে করার চেষ্টা করলো, পিকারিং তাকে হোয়াইট হাউজের কথা বলেছিলেন কিনা, নাকি সেই ধরে নিয়েছে যে, তিনি সেখানে আছেন। “তাহলে প্রেসিডেন্ট এখন আছেন

কোথায়?”

“তার সাথে আপনার সাক্ষাপ্টা হবে অন্যখানে।”

“ধ্যাততারিকা। সেটা কোথায়?”

“খুব বেশি দূরে নয়।”

“আমি সেটা জিজ্ঞেস করিনি।”

“আরো ষোলো মাইল দূরে।”

রাচেল তার দিকে কটমট করে তাকালো। এই লোকটা নির্ঘাত রাজনীতিবিদ হবে। “আপনি কি বুলেটকে এড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নও এড়িয়ে যাবার কৌশল শিখে ফেলেছেন?”

পাইলট কোনো জবাব দিলো না।

.

কপ্টারটা চিজাপিক পার হতে সাত মিনিট সময় নিলো। যখন ভূমি আবার দৃষ্টিগোচরে এলো। তখন পাইলট উত্তর দিকের একটি সরু দ্বীপের উদ্দেশ্যে মোড় নিলো। রাচেল সেখানে এক সারি রানওয়ে এবং সামরিক ঘন দেখতে পেলো। পাইলট সেই জায়গাটাতে নেমে যেতে লাগলো। এবার রাচেল বুঝতে পারলো জায়গাটা কোথায়। ছয়টা লাঞ্চপ্যাড এবং রকেট টাওয়ারই বলে দেবার জন্য যথেষ্ট। একটি ভবনের ছাদে বিশাল করে লেখা আছে : ওয়ালপ আইল্যান্ড।

ওয়ালপ আইল্যান্ড হলো নাসার সবচাইতে পুরনো লাঞ্চ প্যাড। এখনও এটা স্যাটেলাইট লাঞ্চ করার জন্য এবং নিরীক্ষাধর্মী এয়ার ক্রাফট পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। ওয়ালপ হলো নাসার এমন একটি ঘাঁটি যেটা সবার অলক্ষ্যেই রয়ে গেছে।

প্রেসিডেন্ট ওয়ালপ আইল্যান্ডে আছেন?

এটাতো বোধগম্য হচ্ছে না।

পাইলট গতি কমিয়ে দিলো। “আপনি প্রেসিডেন্টের সাথে তার অফিসে দেখা করবেন।”

রাচেল ঘুরে তাকালো। লোকটা কি ঠাট্টা করছে, ভেবে পেলো না। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ওয়ালপ আইল্যান্ডেও একটা অফিস আছে?”

পাইলটকে দেখে সিরিয়াসই মনে হলো। “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেখানে চাইবেন সেখানেই তার অফিস হবে, ম্যাম।”

সে রানওয়ের শেষপ্রান্তে নির্দেশ করলো। দৈত্যাকৃতির অবয়বটা দেখেই রাচেলের হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম হলো। ৩০০ গজ দূরে হলেও, সে হালকা নীল রঙের ৭৪৭টা। দেখে চিনতে পারলো।

“আমি তার সাথে ওটাতে…”

“হ্যাঁ, ম্যাম। এটা তার বাড়ির বাইরের বাড়ি।”

রাচেল অভিজাত বিমানটার দিকে তাকালো, এটা খুবই উন্নতমানের সামরিক ভিসি-২৫এ বিমান। যদিও সারা দুনিয়া এটাকে অন্য নামে চেনে এয়ারফোর্স ওয়ান।

“মনে হচ্ছে আজ সকালে আপনি এখানে নতুন, পাইলট বললো।

উদাসভাবে মাথা নাড়লো রাচেল। খুব কম আমেরিকানই জানে, আসলে দুটো এয়ারফোর্স ওয়ান রয়েছে দেখতে হুবহু একই রকম, ৭৪৭ বি, একটার লেজে লেখা রয়েছে ২৮০০০ এবং অন্যটার লেজে ২৯০০০। দুটো প্লেনের গতিই ঘণ্টায় ৬০০ মাইল। এটাকে মোডিফাই করে শূন্যেই রিফুয়েলিং করার উপযোগী করে তোলা হয়েছে ফলে সীমাহীনভাবেই উড়তে সক্ষম এটি।

যখন প্রেসিডেন্ট অন্য দেশে ভ্রমণে যান, তখন প্রায়শই নিরাপত্তার খাতিরে সেই দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে অনুরোধ করা হয়, এই প্লেনেই দেখা সাক্ষাত করার জন্য। যদিও এটা করা হয়ে থাকে নিরাপত্তার জন্য, তারপরও, নিশ্চিতভাবেই আরেকটা উদ্দেশ্যও রয়েছে। দরকষাকষির সুবিধার্থে বেশি সুবিধা পাবার জন্য একটু ভীতির সঞ্চার করা। হোয়াইট হাউজে যাওয়ার চেয়ে, এয়ারফোর্সে ওয়ান-এ যাওয়া বেশিই ভীতিকর। এক ইংরেজ মহিলা কেবিনেট সদস্য একবার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলো, তিনি নাকি নিজের পুরুষাঙ্গটি তার মুখের দিকে নাড়িয়ে তাকে এয়ারফোর্স ওয়ানে যাবার আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। পরে, ক্রুরা ঠাট্টা করে প্লেনটার একটা ডাক নাম দিয়ে দেয়, ‘বিগ ডিক’ বা বড় লিঙ্গ’ বলে।

“মিস সেক্সটন?” ব্লেজার পরা সিক্রেট সার্ভিসের এক সদস্য কপ্টারের দরজার সামনে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে বললো, “প্রেসিডেন্ট আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”

রাচেল কপ্টার থেকে নেমে বিশাল আকৃতির বিমানটার দিকে তাকালো। উড়ন্তলিঙ্গের ভেতরে। সে একবার শুনেছিলো এই উড়ন্ত ‘ওভাল অফিসটার রয়েছে চার হাজার বর্গফুটের মতো জায়গী, চারটা পৃথক প্রাইভেট ঘুমানোর কোয়ার্টার, ছাব্বিশ জন ফ্লাইট সদস্যের ঘুমানোর বিছানা, এবং পঞ্চাশজন লোকের খাবার জোগান দেবার উপযোগী দুটো কক্ষ।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় রাচেল টের পেলো সিক্রেট সার্ভিসের লোকটা তার ঠিক পেছনেই, তাকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত ওঠার জন্য। বিমানের শরীরে কেবিনে ঢোকার দরজাটা দেখে মনে হয় কোনো বিশালপালি তিমি মাছের গায়ে একটা ফুটো। সে ভেতরে ঢুকতেই টের পেলো তার। আত্মবিশ্বাসের চিড় ধরছে।

সহজ হও, রাচেল, এটা কেবলই একটা প্লেন।

সিক্রেট সার্ভিসের এক লোক তার হাত ধরে সংকীর্ণ প্যাসেজ দিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো। তারা ডান দিকে ঘুরে একটু গেলো, তারপরই বিশাল আর জাকজমক একটা কেবিনে ঢুকে পড়লো। রাচেল ছবি দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলো।

“এখানে অপেক্ষা করুন,” লোকটা তাকে বলেই চলে গেলো।

রাচেল এয়ারফোর্স ওয়ানের বিখ্যাত কাঠের প্যানেলের কেবিনে একা দাঁড়িয়ে থাকলো। এই ঘরটা মিটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাদেরকে আপ্যায়ন করা হয় এখানে, প্রথমবার আসা কোনো যাত্রীকে অবশ্যই ভড়কে দেবার জন্য ব্যবহার করা হয়। ঘরটার প্রশস্ত পুরো বিমানটার প্রশস্তার সমান। ভেতরটার সাজসজ্জা খুবই নিখুঁত– কর্ডোভার হাতওয়ালা চামড়ার চেয়ার, গোল মিটিং টেবিল, পিতলের ল্যাম্প, সোফার পাশেই আর মেহগনি কাঠের বার।

বোয়িং নক্সাকাররা এই কেবিনটা ডিজাইন করার সময় খুব যত্ন করে এটার মধ্যে প্রশান্তি নামক জিনিসটা বজায় রেখেছে। প্রশান্তি’ এই শব্দটা এখন রাচেলের কাছে অচেনাই মনে হচ্ছে। একমাত্র যে জিনিসটা সে ভাবতে পারছে, সেটা হলো, কত বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কই না এখানে বসে আলোচনা করেছেন, পৃথিবীর আকার বদলে দেবার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!

এই ঘরের সব কিছুই যেনো ক্ষমতাকেই প্রকাশ করছে। হাল্কা তামাকের গন্ধ থেকে প্রেসিডেন্টের গোল সিলটা পর্যন্ত, সব কিছুতেই। কুশনে অলিভ ডাল আর তীর খামচে ধরে রাখা ঈগলপাখি এব্রয়ডারি করা। সেটা এমনকি কার্পেট থেকে কোস্টার মানে গ্লাসের নিচে রাখা প্যাডে পর্যন্ত খোদাই করা। রাচেল একটা কোস্টার তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো।

“এরইমধ্যে সুভেনির চুরি করা শুরু হয়ে গেছে?” তার পেছন থেকে গভীর একটা কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো।

রাচেল চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই হাত থেকে কোস্টারটা পড়ে গেলে হাটু মুড়ে তুলতে গিয়ে দেখতে পেলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছেন।

“আমি রাজা বাদশাহ নই, মিস্ সেক্সটন। হাটু মোড়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”

সিনেটর সেজউইক সেক্সটন তার লিমোজিনের ভেতরে প্রাইভেসিটা বেশ ভালোমতোই উপভোগ করছেন, গাড়িটা একেবেঁকে ওয়াশিংটনের সকালের ট্রাফিক জ্যাম পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে। সামনে বসে আছে তার চব্বিশ বছর বয়সী ব্যক্তিগত সহকারী গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ। মেয়েটি দৈনিক শিডিউল পড়ে শোনাচ্ছে তাকে।

আমি ওয়াশিংটন ভালোবাসি, তিনি ভাবলেন, কাশ্মিরি সোয়েটারের নিচে সহকারীর নিখুঁত শারীরিক অবয়বটা আঁচ করতে পেরে সমীহ করলেন। ক্ষমতা হলো সবচাইতে বড় আফ্রোদিসিয়াক…আর এটাই এই মেয়েটাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

গ্যাব্রিয়েল হলো নিউইয়র্কের আইভি লিগার, যে স্বপ্ন দেখে একদিন নিজেই সিনেটর হবে। সে তাও হতে পারবে, সেক্সটন ভাবলেন, সে দেখতে অবিশ্বাস্য রকমের আর চাবুকের মতোই তীক্ষ্ণ। তার চেয়ে বড় কথা, সে খেলার নিয়মকানুন ভালোই জানে।

গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ কৃষ্ণাঙ্গিনী হলেও তার গায়ের রঙ মেহগনির মতো, এটাই সেক্সটনের পছন্দ। সেক্সটন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে গ্যাব্রিয়েলকে বর্ণনা করেছেন, দেখতে হলেবেরি কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিলারি ক্লিনটনের মতো বলে। যদিও কখনও কখনও তিনি মনে করেন এটাও বুঝি কমই বলা হলো।

তিন মাস আগে, তিনি যখন গ্র্যাবিয়েলকে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়োগ করেন তখন থেকেই মেয়েটা তার জন্যে একটা বিশেষ সম্পদ হয়ে উঠেছে। আর সব চাইতে বড় কথা, সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তার মোলো ঘণ্টা কাজের সবচাইতে বড় সান্ত্বনা হলো, সে ঝানু রাজনীতিবিদদের সাথে থেকে কিছু শিখতে পারছে।

অবশ্য, সেক্সটন আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবলেন। আমি তাকে কাজ করার চেয়েও বেশি কিছু করতে প্ররোচিত করেছি, গ্যাব্রিয়েলকে নিয়োগ দেবার পর, সেক্সটন তাকে গভীর রাতের অরিয়েন্টেশন সেশন এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার প্রাইভেট অফিসে। অপ্রত্যাশিতভাবেই, তাঁর যুবতী সহকারী ভালোমতোই তৃপ্ত হতে এসেছিলো। খুব ধীর গতির, ধৈর্যের সাহায্যে, যুগ যুগ ধরে যে ব্যাপারে সেক্সটন একজন দক্ষ এবং ঝানু ওস্তাদ, তার জাদু দেখিয়েছিলেন,গ্যাব্রিয়েল’র আস্থা অর্জন করে, সাবধানে তার জড়তা দূর করে, শান্ত থাকার নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করে অবশেষে তাকে তার অফিসেই হরণ করেছিলেন।

সেক্সটনের খুব কম সন্দেহই ছিলো যে, সেই দ্বৈরথটা এই তরুণীর জীবনে সবচাইতে সেরা যৌন তৃপ্তির মুহূর্ত ছিলো। তারপরও, দিনের আলোতে গ্যাব্রিয়েল পরিষ্কারভাবেই অনুতপ্ত হয়েছিলো। বিব্রত হয়ে সে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলো। সেক্সটন রাজি হোননি তাই গ্যাব্রিয়েল থেকে গেলো। কিন্তু সে তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দিয়েছিলো। সম্পর্কটা কাজের বাইরে আর যাবে না।

গ্যাব্রিয়েল’র ভারি ঠোঁট দুটো এখনও নড়ছে,..”আমি চাই না তুমি আজ সন্ধ্যার সিএনএন’র বিতর্কে এভাবে কোনো কিছু না জেনে অংশ নাও। আমরা এখনও জানি না, হোয়াইট হাউজ কাকে তোমার বিরুদ্ধে পাঠাচ্ছে। আমি তোমার কাজে লাগবে এমন কিছু নোট টাইপ করে রেখেছি।” সে তার দিকে একটা ফোল্ডার বাড়িয়ে দিলো।

সেক্সটন সেটা নিলেন সাথে তার সুগন্ধী পারফিউমের সুবাসটাও।

“তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনছো না।” সে বললো।

“অবশ্যই শুনছি।” তিনি দাঁত বের করে হাসলেন। “সিএনএন’র বিতর্কটার কথা বাদ দাও। বাজে ব্যাপার হলো, হোয়াইট হাউজের উন্নাসিকরা কতিপয় নিচু স্তরের ক্যাম্পেইন শিক্ষানবীশকে পাঠাচ্ছে। আর ভালো ব্যাপারটা হলো, তারা বড়সড় কোনো হোমড়াচোমড়াকে পাঠাচ্ছে। আমি তাকে আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবো।”

গ্যাব্রিয়েল ভুরু তুললো। “চমৎকার। আমি সম্ভাব্য আক্রমণাত্মক বিষয়ের একটি তালিকা তোমার নোটে দিয়ে দিয়েছি।”

“কোনো সন্দেহ নেই।”

“একটা নতুন বিষয়ও আছে তাতে। আমার মনে হয়, তোমাকে গতরাতে ল্যারি কিং লাইভ-এ সমকামীদের নিয়ে করা মন্তব্যটির মোকাবেলা করতে হতে পারে।”

সেক্সটন কাঁধ ঝাঁকালেন। কথাটা খুব একটা শুনলেন বলে মনে হলো না। “বুঝেছি, একই লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারটা।”

গ্যাব্রিয়েল তার দিকে অসম্ভষ্ট হয়ে তাকালো। “তুমি এটার বিরুদ্ধে খুব শক্ত করেই কথা বলেছে।”

একই লিঙ্গের বিয়ে, সেক্সটন তিক্তভাবে ভাবলেন। আমার ওপর যদি সিদ্ধান্ত দেবার সুযোগ ঘটে, তবে ঐসব পাছা-মারাদের ভোটের অধিকার পর্যন্ত বাতিল করে দেবো। “ঠিক আছে, আমি সেটা দেখে নেবো।”

“ভালো। রেগে যেয়ো না। জনগণ কিন্তু মুহূর্তেই ঘুরে যেতে পারে। এখন তুমি বেশ ভালো করছে। সেটাই ধরে রাখো। বলটা মাঠের বাইরে পাঠানোর দরকার নেই আজ। কেবল সেটা নিয়ে একটু খেলবে।”

“হোয়াইট হাউজ থেকে কোনো খবর পেয়েছো?”

গ্যাব্রিয়েলকে খুশি মনে হলো। “আগের মতোই চুপ মেরে আছে। তোমার প্রতিপক্ষ “অদৃশ্যমান হয়ে গেছে।”

সেক্সটন তাঁর সৌভাগ্যের ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। কয়েক মাস ধরেই প্রেসিডেন্ট ভার নির্বাচনী প্রচারাভিযান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তারপর আচমকাই, এক সপ্তাহ আগে, তিনি ওভাল অফিসে নিজেকে বন্দী করে রেখেছেন। তখন থেকেই কেউ তাকে দেখেনি, তার কথা শুনতেও পায়নি। যেনো প্রেসিডেন্ট সেক্সটনের অভাবনীয় ভোটারদের পক্ষে নেয়াটাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাচ্ছেন না আর।

গ্যাব্রিয়েল তার মসৃণ কালো চুলে হাত বুলিয়ে বললো, “আমি শুনেছি হোয়াইট হাউজের স্টাফরাও আমাদের মতোই অন্ধকারে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট তার অদৃশ্য হবার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সেখানকার সবাই খুবই ভীত হয়ে আছে।

“কোনো সূত্র রয়েছে?” সেক্সটন বললেন।

গ্যাব্রিয়েল তার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালো। “আজ সকালে, আমি আমার হোয়াইট হাউজের লোকদের কাছ থেকে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ডাটা পেয়েছি।”

সেক্সটন তার চোখের চাহনিটা ধরতে পারলেন। গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ আবারো ভেতরের কিছু তথ্য বের করতে পেরেছে। তিনি ভাবলেন, গ্যাব্রিয়েল হয়তো প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ মহলের কারো কাছ থেকে ক্যাম্পেইন সিক্রেট বের করতে পেরেছে।

‘গুজব আছে যে, তার সহকারী বললো, কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে। প্রেসিডেন্টের অদ্ভুত আচরণটা শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে জরুরি ভিত্তিতে নাসার প্রধানের সাথে গোপন মিটিংয়ের পর থেকেই। প্রেসিডেন্টকে মিটিং থেকে বের হবার সময় খুবই বিধ্বস্ত লাগছিলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তার শিডিউল বদলে ফেলেন, তারপর থেকেই তিনি নাসার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।”

সেক্সট্রন নিশ্চিতভাবেই কথাটা পছন্দ করলেন। “তোমার ধারণা, নাসা আরো কিছু দুঃসংবাদ দিয়েছে?”

“সেটাই যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে।” সে আশাবাদী হয়ে বললো, “যদিও এতে করে পুরো বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে না, কেন তিনি সবকিছু এভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন।

সেক্সটন কথাটা মানলেন। যাইহোক, নাসা’র জন্য দুঃসংবাদই রয়েছে, তা না হলে প্রেসিডেন্ট সেটা আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারতেন। সেক্সটন প্রেসিডেন্টের নাসা’কে দেয়া ফান্ডের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ের স্পেস মিশনের ব্যর্থতা, বিশাল বাজেট আর ব্যয়, নাসার সম্মানকে ভুলুণ্ঠিত করেছে। সেজন্যেই সেক্সটনের এক আন অফিসিয়াল পোস্টারে একটি বাচ্চাকে দেখানো হয়েছে বিশালাকারের সরকারের যোগ্যতা আর বাহুল্যতার বিরুদ্ধে। মানতেই হবে, নাসা’কে আক্রমণ করাটা-আমেরিকার সবচাইতে প্রসিদ্ধ গর্বের বিষয়-বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাই করতে চান না। কেন না তাদের ধারণা এতে ভোট না বেড়ে কমে যেতে পারে। কিন্তু সেক্সটনের হাতে রয়েছে এমন একটি অস্ত্র যা খুব কম রাজনীতিকের হাতেই আছে-গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ, আর তার নিখাদ বুদ্ধি।

এই উদ্ভিনা যুবতী মেয়েটি সেক্সটনের নজরে এসেছিলো কয়েক মাস আগেই, যখন সে সেক্সটনের ওয়াশিংটনের ক্যাম্পেইন অফিসের সমন্বয়কারী হিসেবে কর্মরত ছিলো। সেক্সটনের প্রচারাভিযান খুব ভালো সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হলে, গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ তাকে দিক নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলো যে, তার দরকার নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যাম্পেইন চালানো। সে সিনেটরকে বলেছিলো, তার উচিত হবে নাসাকে আক্রমণ করা, এর বিশাল বাজেট আর ব্যর্থতা তুলে ধরা। যাতে প্রেসিডেন্ট হার্নির লাগামহীন খরচের চিত্র জনসম্মুখে উন্মোচিত করা যায়।

“নাসা আমেরিকার সৌভাগ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে,” গ্যাব্রিয়েল লিখেছিলো। সেই চিঠিতে অর্থনৈতিক বর্ণনা, ব্যর্থতা, আর অসাড়ত্বকেও তুলে ধরা হয়েছিলো। ভোটারদের কোনো ধারণাই নেই। তারা একেবারে ভড়কে যাবে। আমার মনে হয় আপনার উচিত নাসাকে রাজনীতির ইসু বানানো।

পরের সপ্তাহেও, গ্যাব্রিয়েল নাসা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাঠিয়েছিলো সিনেটরের কাছে। সেক্সটন যতোই পড়লেন ততোই বুঝতে পারলেন গ্যাব্রিয়েলের কথায় যুক্তি আছে। এমনকি সরকারী এজেন্সির নিরিখেও, নাসা অনেক বেশি বিধ্বংসী সংস্থা– ব্যয়বহুল, অকার্যকর, এবং সাম্প্রতিক ব্যর্থতায় নজ।

এক টিভি সাক্ষাতকারের সময়, উপস্থাপক যখন তাকে সরকারী স্কুলের ফান্ড বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা কোত্থেকে যোগাবেন, সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো, সেক্সটন। তখন মনস্থির করেছিলেন গ্যাব্রিয়েলের তত্ত্বটার পরীক্ষা করা গেলে মন্দ হয় না। আধো ঠাট্টাচ্ছলে, তিনি বলেছিলেন, “শিক্ষার জন্য টাকা? আমি স্পেস কর্মসূচীর বাজেট অর্ধেক কমিয়ে ফেলবো। আমার ধারণা, নাসা যদি বছরে পনেরো বিলিয়ন ডলার মহাশূন্যে ব্যয় করে, আমার উচিত হবে এই বিশ্বের বাচ্চাদের জন্য সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা।”

ট্রান্সমিশন বুথে, সেক্সটনের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার আতংকে শিহরিত হয়ে উঠেছিলো এহেন লামছাড়া মন্তব্যে। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিও স্টেশনের ফোন লাইনের রিং হওয়াতে ম্যানেজার ভেবেছিলো স্পেস প্রেমীরা হয়তো ঘিরে ধরবে তাদেরকে।

তারপরই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।

“পনেরো বিলিয়ন ডলার বছরে প্রথম ফোনকারী বলেছিলো। তার কথা শুনে মনে হলো সে দারুণ আঘাত পেয়েছে। আপনি কি বলছেন যে, আমার ছেলের অংকের ক্লাশ ছাত্রে পরিপূর্ণ হয়েছে, তার কারণ স্কুলগুলো প্রয়োজন সংখ্যক শিক্ষক রাখতে পারছে না। আর সেখানে কিনা নাসা বছরে পনেরো বিলিয়ন ডলার খরচ করে স্পেসের ধূলিকশার ছবি তোলে?”

“উম…তা ঠিকই বলেছেন,” সেক্সটন উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিলেন।

“একেবারেই ফালতু। এ ব্যাপারে কি প্রেসিডেন্টর কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে?”

“অবশ্যই রয়েছে।” সেক্সটন জবাব দিয়েছিলেন। আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করলেন, “একজন প্রেসিডেন্ট যেকোন এজেন্সির বাজেটেই ভেটো দিতে পারেন।

“তাহলে আপনি আমার ভোট পেয়ে গেছেন, সিনেটর সেক্সটন। স্পেস গবেষণায় পনেরো বিলিয়ন ডলার, আর আমাদের বাচ্চারা স্কুলে শিক্ষক পায় না। এটাতো অবিচার! গুড লাক, স্যার। আশা করি, আপনি এগিয়ে যাবেন।”

পরের জন ফোনে বললো, “সিনেটর, আমি কাগজে পড়েছি নাসা’র আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বাজেট বেড়ে গেছে, আর প্রেসিডেন্ট নাকি ভাবছেন সেই বর্ধিত বাজেট অনুমোদন। করে নাসার প্রজেক্টটাকে এগিয়ে নিতে। এটা কি সত্যি?”।

সেক্সটন এ কথায় লাফিয়ে উঠলেন যেনো। “সত্যি!” তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন আসল প্রস্তাবটা ছিলো একটি যৌথ উদ্যোগে স্পেস স্টেশন নির্মাণ করবার। সেটাতে বারোটি দেশ খরচ বহন করবে। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু হবার পরই বাজেট লাফিয়ে বেড়ে গেলে অনেক দেশই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালো। প্রজেক্টটা স্থগিত না করে প্রেসিডেন্ট বরং সেটার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়ে কাজটি সম্পাদন করার চেষ্টা করছেন। সবার খরচ একাই বহন করছেন। “এই আইএসএস প্রকল্পে আমাদের প্রথম বাজেট ছিলো আট বিলিয়ন ডলার, তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে একশ বিলিয়ন ডলারে!”

ফোনের লোকটা যেনো ভড়কে গেলো। “তবে প্রেসিডেন্ট কেন প্লাগিটা টেনে খুলে ফেলছেন না?”

সেক্সটনের ইচ্ছে করছিলো লোকটাকে চুমু খায়। একেবারে মোক্ষম প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এক তৃতীয়াংশ টাকা ইতিমধ্যেই কক্ষপথে খরচ হয়ে গেছে, আর প্রেসিডেন্ট আপনাদের ট্যাক্সের পয়সা সেখানে ঢেলেই চলছেন। সুতরাং প্রাগ টেনে খেলার মানে হবে, আপনাদের কয়েক বিলিয়ন ডলার শ্রাদ্ধ করা।”

ফোন আসতেই থাকলো। এই প্রথমবারের মতো, মনে হলো, আমেরিকানরা জেগে উঠে ভাবতে শুরু করলো যে নাসা তাদের জন্য একটি অপশন কেবল– কোনো জাতীয় অপরিহার্যতা নয়।

অনুষ্ঠানটা শেষ হবার পর দেখা গেলো নাসা’র কতিপয় মরিয়া সমর্থক ছাড়া, যারা মানুষের জ্ঞানের অম্বেষার দোহাই দিয়ে থাকে, প্রায় বেশিরভাগ শ্রোতাই সেক্সটনের মতের সাথে একমত পোষণ করে: সেক্সটনের নির্বাচনী প্রচারণা হলিশ্রেইলের মতোই কামনার বস্তু হয়ে গেলো–নতুন একটি ধারণা, এমন একটি ইসু, যা ভোটারদের নার্ভে আঘাত হানলো।

পরের সপ্তাহগুলোতে সেক্সটন তার প্রতিপক্ষকে কোনোঠাসা করে ফেললেন।

তিনি গ্যাব্রিয়েল অ্যাশকে তার নতুন ব্যক্তিগত ক্যাম্পেইন সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন, তাকে নাসা ইসুটা নিয়ে আসার জন্য প্রশংসা করলেন। হাতের ইশারায় সেক্সটন আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণীকে রাতারাতি রাজনৈতিক তারকা বানিয়ে ফেললেন। সেই সাথে তার বর্ণবাদী এবং সমকামী বিরোধী ইসুটাও মূহুর্তেই উধাও হয়ে গেলো।

এখন, লিমোজিনে একসাথে বসে, সেক্সটন জানতেন গ্যাব্রিয়েল আবারো নিজের মূল্যটা প্রমাণিত করতে যাচ্ছে। নাসা’র প্রধানের সাথে প্রেসিডেন্টের যে গোপন মিটিংয়ের নতুন তথ্যটা গ্যাব্রিয়েল দিলো, সেটা থেকে বোঝা যায়, নাসা আরো বড় কোনো সমস্যায় পড়েছে– সম্ভবত স্পেস স্টেশন থেকে আরেকটি দেশ তাদের ফান্ড দেবার প্রতীজ্ঞা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে।

লিমোজিনটা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট দিয়ে যাবার সময় সেক্সটন টের পেলেন তাঁর নিয়তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে।

পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক অফিসে ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করলেও প্রেসিডেন্ট জাখারি হার্নি গড়পতার উচ্চতার একজন, হালকা পাতলা গড়ন আর সংকীর্ণ কাঁধের মানুষ। মুখে ছোপ ছোপ দাগ, বাইফোকাল দৃষ্টি এবং পাতলা কালো চুল তাঁর। তার দেহসৌষ্ঠব যেমনই হোক না তাকে দেখলে মনে হয় যুবরাজের মতো, তিনি যাদেরকে নির্দেশ দেন, কথাটা তারা ভালমতোই জানে।

“খুশি হয়েছি আপনি ওটা তুলতে পেরেছেন বলে,” প্রেসিডেন্ট হার্নি বললেন। রাচেলের সাথে করমর্দন করার জন্য এগিয়ে আসলেন তিনি। তার হাতটা উষ্ণ আর আন্তরিক।

রাচেলের গলায় যেনো ব্যাঙ ঢুকে গেছে, সেটার সাথে লড়াই করলো সে। “অব…শ্যই মাননীয় রাষ্ট্রপতি। আপনার সাথে দেখা হওয়াটা খুবই সম্মানের।”

প্রেসিডেন্ট তার দিকে তাকিয়ে সহজ করবার জন্য একটা হাসি দিলেন। আর রাচেল এই প্রথম প্রত্যক্ষভাবে হার্নির কিংবদন্তীতুল্য বিতার আতিথেয়তা টের পেলো। লোকটার বিনয়ী হাসি আর উষ্ণতা কারোরই ভুলবার নয়। তার চোখে সবসময়ই প্রতিফলিত হয় মহত্ত্বতা আর আন্তরিকতা।

উস্ফুল্ল কণ্ঠে তিনি বললেন, “আপনি যদি আমার সঙ্গে একটু আসেন তো, আমি আপনার সম্মানার্থে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারি।”

“ধন্যবাদ, স্যার।”

প্রেসিডেন্ট ইন্টারকম টিপে তার অফিসে কফি পাঠিয়ে দিতে বললেন।

রাচেল প্রেসিডেন্টকে দেখে বুঝতে পারলো যে তিনি খুবই আমোদে রয়েছেন, বেশ আরামেই আছেন, অথচ তার সামনে এক কঠিন নির্বাচন। তিনি পোশাকও পরেছেন খুব সাধারণমানের, নীল জিন্স, পোলো শার্ট আর এলএলবিন হাইকিং বুট।

রাচেল কথাবার্তা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। “পাহাড় বাইতে যাচ্ছেন কি…মি: প্রেসিডেন্ট?”।

“মোটেই না। আমার ক্যাম্পেইন উপদেষ্টারা ঠিক করেছে আমার বেশভূষার নতুন রূপ দিতে হবে। আপনার কি মনে হয়?”

রাচেল আশা করলো তার কথাটা আসলে অতোটা সিরিয়াস না। “এটা খুবই… পৌরুষোচিত, স্যার।”

“ভালো। আমরা ভাবছি, এতে করে আপনার বাবার কাছ থেকে কিছু নারী ভোট কেড়ে নিতে সাহায্যে আসবে।” একটু পরেই প্রেসিডেন্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন। “মিস সেক্সটন, এটা ঠাট্টা করে বলেছি। আমার মনে হয়, আমরা দুজনেই জানি এই নির্বাচনে জিততে আমার পোলো শার্ট আর জিন্সের চেয়েও বেশি কিছু দরকার রয়েছে।”

প্রেসিডেন্টের খোলামেলা কথাবার্তা আর ভালো রসিকতার জন্য রাচেলের যে টেনশন হচ্ছিলো সেটা উবে গেলো। প্রেসিডেন্টের শারীরিক গঠন যাই হোক না কেন, তার কূটনৈতিক মেধা যথেষ্ট ভালো। কূটনীতি হলো এক ধরণের দক্ষতা, জাখ হার্নির সেটা রয়েছে।

রাচেল প্রেসিডেন্টের পেছন পেছন প্লেনের পেছন দিকে চলে গেলো। যতোই গভীরে তারা যাচ্ছে, ভেতরের সাজসজ্জা দেখে ততোই মনে হচ্ছে এটা কোনো প্লেনের ভেতরের কক্ষ নয়। অদ্ভুত বিষয় হলো, পুরো প্লেনটাই ফাঁকা।

“একা একাই ভ্রমণ করছেন, মি: প্রেসিডেন্ট?”

তিনি মাথা ঝাঁকালেন, “আসলে, এইমাত্র ল্যান্ড করলাম।”

রাচেল অবাক হলো। কোত্থেকে এসে ল্যান্ড করা হলো? এই সপ্তাহে তার ইন্টেলিজেন্স বৃফ-এ প্রেসিডেন্টের প্লেন ভ্রমণের কোনো কথা ছিলো না। মনে হচ্ছে, তিনি ওয়ালপ আইল্যান্ডকে নিরবে-নিভৃতে ভ্রমণ করার জন্য বেছে নিয়েছেন।

“আপনার আসার ঠিক আগেই আমার স্টাফরা প্লেন থেকে নেমে গেছে,” প্রেসিডেন্ট বললেন, “আমি খুব জলদিই হোয়াইট হাউজে ফিরে যাচ্ছি তাদের সাথে মিটিং করার জন্য। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আপনার সাথে অফিসে দেখা না করে এখানেই দেখা করতে।”

“আমাকে ভড়কে দেবার জন্যে?”

“বরং বলা চলে, আপনাকে সম্মান জানানোর জন্য, মিস সেক্সটন। হোয়াইট হাউজ আর যাইহোক প্রাইভেট কিছু না। আর আমাদের দুজনের সাক্ষাতটার খবর জানাজানি হলে আপনার বাবার সাথে আপনার সম্পর্কটা খারাপ অবস্থায় চলে যেতে পারে।”

“এটা আমি মানছি, স্যার।”

“মনে হচ্ছে আপনি খুব সূক্ষ্ম আর মাধুপূর্ণভাবে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন, আর আমি এটা নষ্ট করারতো কোনো কারণ দেখি না।”

রাচেল ব্রেকফাস্টের সময়ে তার বাবার সাথে মিটিংয়ের কথা স্মরণ করলো আর সন্দেহ করলো মাধুর্যপূর্ণ শব্দটার যোগ্য সে কিনা। তাসত্ত্বেও, জাখ হার্নি খুব দ্রভাবেই তার সাথে ব্যবহার করছেন, আর সেটা তাঁর করার দরকারও নেই।”

“আমি কি আপনাকে রাচেল বলে ডাকতে পারি?” হার্নি জিজ্ঞেস করলেন।

“অবশ্যই।” আমি কি আপনাকে জাখ নামে ডাকতে পারি?

“আমার অফিসে,” প্রেসিডেন্ট ভঁর অফিসে ঢোকার ইশারা করে দরজাটা নিজেই খুলে দিলেন।

এয়ারফোর্স ওয়ানের অফিসটা হোয়াইট হাউজের তুলনায় বেশিই আরামদায়ক, কিন্তু এর সাজসজ্জা খুব বেশি সংযমী। ডেস্কে কাগজের স্তূপ; আর এর পেছনে টাঙানো রয়েছে। ক্লাসিক একটা তৈলচিত্র, ঝড়ের কবলে পড়া তিন জন নাবিক বিশাল ঢেউ থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলেছে। মনে হয়, এটা জাখ হার্নির বর্তমান শাসনামলটার একটি রূপক চিত্র।

প্রেসিডেন্ট রাচেলকে ডেস্কের সামনে থাকা তিনটা চেয়ারের একটাতে বসার জন্য ইশারা করলে সে বসলো। রাচেল আশা করেছিলো প্রেসিডেন্ট ডেস্কের পেছনের চেয়ারটাতে বসবেন, কিন্তু তিনি রাচেলের সামনে থাকা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন ঠিক তারই পাশে।

সমকক্ষতা বোঝাতে চাচ্ছে, সে বুঝতে পারলো। গণযোগাযোগ বিষয়ে একজন ওস্তাদ।

“তো রাচেল,” হার্নি বললেন, চেয়ারে বসার সময় ক্লান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “আমি অনুমান করতে পারি, আপনি এখানে বসে খুবই দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন, আমি কি ঠিক বলেছি?”

“আসলে, স্যার, আমি খুবই হতবিহ্বল।”

হার্নি জোরে হেসে উঠলেন। “চমৎকার, প্রতিদিন তো আর আমি এনআরও’র কাউকে হতভম্ব করতে পারি না।”

“প্রতিদিনতো আর কোনো এনআরও’কে একজন প্রেসিডেন্ট এয়ারফোর্স ওয়ানে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনেন না। তাও আবার হাইকিং বুট পরা একজন প্রেসিডেন্ট।”

প্রেসিডেন্ট আবারো হাসলেন।

দরজায় টোকা পড়তেই বোঝা গেলো কফি এসে গেছে। একজন ক্রু হাতে করে ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো, প্রেসিডেন্টের ঠিক পাশেই মেয়েটা ট্রে-টা রেখে দিয়ে চলে গেলো।

“মাখন আর চিনি?” প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করে ঢালার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। “মাখন, প্লিজ।” রাচেলের নাকে সুগন্ধটা ভেসে এলো, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আমাকে নিজ হাতে কফি খাওয়াচ্ছেন?

জাখ হার্নি তার হাতে ভারি মগটা তুলে দিলেন। “একেবারে খাঁটি পল রিভিয়ার।” তিনি বললেন।”ছোট্ট একটা শৌখিনতা।”

রাচেল কফিতে চুমুক দিলো। তার জীবনের সেরা কফি এটা।

“যাইহোক,” প্রেসিডেন্ট বললেন, “আমার হাতে সময় কম, সুতরাং কাজের কথায় আসা যাক প্রেসিডেন্ট তার কফিতে এক চামচ চিনি ঢেলে নিলেন। “আমার ধারণা বিল পিকারিং আপনাকে সতর্ক করে দিয়েছে, যে আপনাকে এখানে ডেকে আনার একমাত্র কারণ আমার রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া?”

“আসলে, সত্যি বলতে কি স্যার, এটাই তিনি বলেছেন।”

প্রেসিডেন্ট হি হি করে হাসলেন। “ও সবসময়ই বাতিকগ্রস্ত।”

“তাহলে তিনি ভুল বলেছেন?”

“আপনি কি ঠাট্টা করছেন?” প্রেসিডেন্ট অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। “বিল পিকারিং, কখনও ভুল বলে না। সে যথারীতি ঠিকই বলেছে।”

গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ উদাসভাবে সিনেটর সেক্সটনের লিমোজিনে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। গাড়িটা সেক্সটনের অফিসের দিকে যাচ্ছে। ভাবছিলো কীভাবে সে আজ এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সিনেটর সেক্সটনের ব্যক্তিগত সহকারী, এটাই তো সে চেয়েছিল, তাই নয় কি?

আমি আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্টের সাথে একই লিমোজিনে বসে আছি।

গ্যাব্রিয়েল সিনেটরের দিকে তাকালো, তিনিও মনে হচ্ছে অন্য চিন্তায় নিমগ্ন। সে তার হ্যান্ডসাম ফিগার আর আচার ব্যবহারে মুগ্ধ। তাকে প্রেসিডেন্টের মতোই লাগছে।

গ্যাব্রিয়েল তিন বছর আগে কর্নেল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক বক্তৃতায় তাকে প্রথম দেখেছিলো। সে কখনও ভুলতে পারবে না কীভাবে তিনি শ্রোতাদের চোখে চোখ রেখে বলছিলেন, যেনো তাদের কাছে সরাসরি একটা বার্তা পাঠাচ্ছেন– আমার উপর আস্থা রাখুন। বক্তৃতা শেষে গ্যাব্রিয়েল লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছিলো।

“গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ,” সিনেটর বলেছিলেন তার ট্যাগে লেখা নামটা দেখে। “চমৎকার একটি নাম, চমৎকার একজন তরুণীর জন্য। তার চোখে ছিলো আশ্বস্ততার ছাপ।

“ধন্যবাদ, স্যার, গ্যাব্রিয়েল জবাব দিয়েছিলো, লোকটার সাথে করমর্দনের সময় লোকটার শক্তিও টের পেয়েছিলো সে। “আপনার বক্তৃতা সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে।”

“শুনে খুশি হলাম।” সেক্সটন তার হাতে একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে দিলেন। “আমি সব সময়ই উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীদের সন্ধান করি যারা আমার মতোই স্বপ্ন লালন করে। স্কুল শেষ করে আমার কাছে আসবেন। আমার লোকজন হয়তো আপনার জন্য একটা কাজ খুঁজে দিতে পারবে।”

গ্যাব্রিয়েল ধন্যবাদ দেবার আগেই সিনেটর আরেকজনের সাথে কথা বলার জন্য লে গিয়েছিলেন। এর পর থেকেই গ্যাব্রিয়েল সিনেটরকে টেলিভিশনে সরকারী ব্যয়ের বিরুদ্ধে। সোচ্চার হওয়া অবস্থান দেখে আরো মুগ্ধ হয়েছিলো। তারপর, আচমকা যখন সিনেটরের স্ত্রী গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গেলেন, তখন সিনেটরের নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক হয়ে ওঠা দেখে গ্যাব্রিয়েল মুগ্ধ হয়ে গেলো। সেক্সটন তাঁর ব্যক্তিগত শোক থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন এবং নিজের বাকি জীবন স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে জন সেবায় উৎসর্গ করবেন। গ্যাব্রিয়েল তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে তার সঙ্গে কাজ করবে এবং সেক্সটনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় নিজেকে যুক্ত করবে।

এখন সে অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ।

গ্যাব্রিয়েল সেই রাতটার কথা স্মরণ করলো, যে রাতে সে সিনেটরের সঙ্গে কাটিয়েছিলো। সে ঐ রাতটার কথা মাথা থেকে দূর করার চেষ্টা করলো। আমি কি ভাবছিলাম? সে জানতো, তার বাঁধা দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সে তা করতে পারেনি। সেক্সটন তার কাছে দীর্ঘদিন ধরেই একজন আদর্শ,..আর তাকে পেতেও চাইতো।

লিমোজিনটা ঝাঁকি খেলে সে বাস্তবে ফিরে এলো।

“ঠিক আছে তো?” সেক্সটন বললেন।

গ্যাব্রিয়েল একটু হেসে বললো, “ঠিক আছি।”

“তুমি সেই ব্যাপারটাই ভাবছো তাই না?”

সে কাঁধ ঝাঁকালো। “আমি এখনও এ নিয়ে চিন্তিত, হ্যাঁ।”

“ভুলে যাও সেটা। তুচ্ছ কাজটাই আমার প্রচারের জন্য সেরা কাজ হবে।”

তুচ্ছ কাজ, গ্যাব্রিয়েল বুঝতে পেরেছিলো, রাজনীতিতে এটার অর্থ হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে এমন তথ্য ফাঁস করা যে, আপনার প্রতিপক্ষ লিঙ্গ বর্ধক যন্ত্র ব্যবহার করে কিংবা স্টাড মাফিন পত্রিকার একজন গ্রাহক। এই কাজটা কোনো জৌলুসপূর্ণ কৌশল নয়, কিন্তু এটা যখন ঠিকমতো কাজ করে, তখন বেশ কাজে দেয়।

অবশ্য, এটা যখন হিতে বিপরীত হয়,..এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। হোয়াইট হাউজের জন্য, একমাস আগে, প্রেসিডেন্টের ক্যাম্পেইন স্টাফরা জনমত হারিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো একটা কেচ্ছা কাহিনী ফাঁস করে দেবে, তাদের ধারণা ছিলো কাহিনীটা সত্যি, সিনেটর সেক্সটন তার ব্যক্তিগত সহকারীর সাথে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। হোয়াইট হাউজের জন্য খারাপ খবর ছিলো যে, তাদের কাছে শক্ত কোনো প্রমাণ ছিলো না। সিনেটর সেক্সটন গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, সবচাইতে সেরা আত্মরক্ষা হলো শক্তভাবে আক্রমণ করা। তিনি একটা সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিলেন যে তিনি নির্দোষ এবং এই ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, তিনি বলেছিলেন। ক্যামেরার দিকে তীব্র যন্ত্রণায় তাকিয়ে, প্রেসিডেন্ট আমার স্ত্রীর স্মৃতিকে এভাবে জঘন্য মিথ্যা দিয়ে অসম্মান করতে পারেন।

সিনেটরের টিভি অভিনয়টা এতোটাই নিখুঁত হয়েছিলো যে, গ্যাব্রিয়েল নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো যে, তারা একসাথে কখনও ঘুমায়নি। এতে স্বাচ্ছন্দে সিনেটর মিথ্যে বলতে পারে দেখে গ্যাব্রিয়েলের মনে হলো তিনি অবশ্যই একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি হবেন।

পরে, যদিও গ্যাব্রিয়েল নিশ্চিত যে, সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শক্তিশালী ঘোড়াকেই সমর্থন করছে, তারপরও সে খবতে লাগলো সে সবচাইতে সেরা ঘোড়াকে সমর্থন করছে কিনা।

যদিও গ্যাব্রিয়েল সেক্সটনের মেসেজের ওপর এখনও আস্থা অটুট রেখেছে, তারপরও সে মেসেনজারের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *