হ য ব র ল
০১.
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের পক্ষ হইতে অর্থসাহায্য চাওয়া হইয়াছে।
সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের সহকারী সভাপতি শ্ৰীযুত জানকীনাথ শাস্ত্রী লিখিতেছেন–
পূর্বে পরিষদে উপযুক্ত মেধাবী ছাত্রদিগকে আহার ও বাসস্থান দিয়া অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হইত। কিন্তু বর্তমানে জরুরি অবস্থায় আর্থিক অসুবিধার জন্য সে ব্যবস্থা রহিত করিবার উপক্রম হইয়াছে। যদি তাহাই করিতে হয় ও মেধাবী ছাত্রেরা সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করে, তবে পরিষদ চলিবে কাহাদের লইয়া? ধনী মেধাবী ছাত্র তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। দেশের বিত্তশালীদের বিবেচনা করিতে অনুরোধ করি যে, আজও বাজারে যে সমস্ত সংস্কৃত পুস্তকরাজি পাওয়া যায়, তাহা কাহার অধ্যবসায়ের ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের জন্য কতটুকু করিয়াছেন ও এইসব চতুম্পাঠী, টোল পরিষদ কতটুকু করিয়াছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা তো দুইখানা কাব্য তিনখানা নাটক লইয়া নাড়াচাড়া করেন, ভারতীয় দর্শনের জন্য তো রহিয়াছেন ইংরেজিতে রাধাকৃষ্ণণ ও দাশগুপ্ত। সরকার সাহায্যবর্জিত দেশীয় এই প্রতিষ্ঠানগুলি ও ইয়োরোপের, বিশেষত জর্মন পণ্ডিতমণ্ডলীই তো সংস্কৃতের শতকরা ৯৫ খানি পুস্তক বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও যাহারা দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হিসাবে গণ্য হইয়াছেন, তাহাদের মধ্যে কয়জন টুলো আর কয়জন নির্জলা মেড ইন বিশ্ববিদ্যালয়? উইনটারনিক্স-লেভিকে যেসব হিন্দু ও জৈন পণ্ডিতের দ্বারস্থ হইতে দেখিয়াছি, তাহারা তো খাঁটি টুলো। অনেকে ইংরেজি পর্যন্ত জানিতেন না। এ যুগের জ্ঞানীদের শিরোমণি প্রাতঃস্মরণীয় দ্বিজেন্দ্রনাথও তো টুলো।
আশ্চর্য যে, পাঠান-মুঘল যুগের ভিতর দিয়া চতুম্পাঠী, টোল সুস্থ শরীরে বাহির হইয়া আসিল। পণ্ডিতেরা অধ্যয়ন অধ্যাপনা করিলেন, পাণ্ডুলিপি বাঁচাইয়া রাখিলেন, নতুন টীকা-টিপ্পনী লিখলেন আর আজ ধর্মগন্ধ-বিহীন সদাশয় ইংরেজের আমলে, দেশে যখন জাত্যাভিমান বাড়িয়াছে, জাতীয়তাবাদের জয়পতাকা উড্ডীয়মান, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হইবার জন্য হার্দিক প্রচেষ্টা সর্বত্র জাজ্বল্যমান, তখন অর্থাভাবে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি লোপ পাইতে বসিয়াছে। যদি লোপ পায়, তবে এ-ও বলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংস্কৃতের বৈদগ্ধ্য বাঁচাইয়া রাখিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
***
এই সম্পর্কে আরেকটি কথা মনে পড়িল। কুলোকের বসায় পড়িয়া সেদিন বায়স্কোপে গিয়াছিলাম একখানা পৌরাণিক ছবি দেখিতে। যাহা দেখিলাম, সে সম্বন্ধে মন্তব্য না করাই প্রশস্ত। কিন্তু একটি জিনিস লক্ষ করিলাম। হিন্দিতে যে সংস্কৃত শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ হয় তাহা বাঙালি শ্রোতা দিব্য বুঝিতেছেন ও অর্ধশিক্ষিতা বাঙালি অভিনেত্রীরাও দিব্য শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্র পড়িতেছেন। তাহা হইলে কি বাঙলা দেশের স্কুল-কলেজে এখনও শুধু সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইবার সময় হয় নাই? মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কাশী হইতে পণ্ডিত আনাইয়া বাঙালিকে বেদমন্ত্র শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করিতে শিখাইয়াছিলেন। সে ঐতিহ্য আজ ক্ষীণ। মফঃস্বলের ব্ৰহ্মমন্দিরে সংস্কৃত উচ্চারণে বাঙলা পদ্ধতি আবার আসর জমাইয়াছে। বোম্বাইয়ের স্টুডিয়োর আবহাওয়া যদি বাঙালি অভিনেত্রীকে সংস্কৃত উচ্চারণ শিখাইতে পারে, তবে বাংলা দেশের স্কুল-কলেজ তাহা পারে না, সে কি বিশ্বাসযোগ্য?
গুরুজনদের মুখে শুনিয়াছি, গিরিশবাবুর কোরানের তর্জমা এককালে নাকি বহু হিন্দু পড়িতেন এবং তখন নাকি সে তর্জমার কদর হিন্দুদের মধ্যে বেশি ছিল; কারণ মুসলমানেরা তখনও মনস্থির করতে পারেন নাই যে, কোরানের বাংলা অনুবাদ করা শাস্ত্রসম্মত কি না।
পরবর্তী যুগে মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বিষাদ-সিন্ধু বহু হিন্দু পড়িয়া চোখের জল ফেলিয়াছেন (পুস্তকখানা প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ নহে; অনেকটা পুরাণ জাতীয়, বিস্তর অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ)। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিলেন। পরবর্তী যুগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গঙ্গোপাধ্যায় আরবি-ফারসি শব্দযোগে তাদের লেখায় কিঞ্চিৎ মুসলমানি আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইহারা লোকপ্রিয়তা হারাইলেন। তার পর আসিলেন নজরুল ইসলাম। সাধারণ বাঙালি হিন্দু তখন প্রথম জানিতে পারিলেন যে, মুসলমানও কবিতা লিখিতে পারেন; এমনকি, উক্তৃষ্ট কবিতাও লিখিতে পারেন। কাজী সাহেবের কবিতার ব্যঞ্জনা বুঝিবার জন্য প্রচুর হিন্দু তখন মুসলমান বন্ধুদের শহিদ কথার অর্থ, ইউসুফ কে, কানান কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কাজী সাহেব তাহার ধূমকেতু কাগজে মুসলমান সমাজের পঙ্কিল দিকটা যত না আক্রমণ করিলেন, তাহার অপেক্ষা বহু কম করিলেন ইসলামের সুন্দর ও মঙ্গলের দিকের বর্ণনা। ইতোমধ্যে মৌলানা আকরম খান প্রমুখ মুসলমান লেখকেরা ইসলাম ও তত্সম্বন্ধীয় নানা পুস্তক লিখিলেন। খুব কম হিন্দুই সেগুলি পড়িয়াছেন। তখনও মাসিক মোহাম্মদীতে ভালো ভালো প্রবন্ধ বাহির হয়, কিন্তু সাধারণ হিন্দু মোহাম্মদী কিনেন না; বিশেষত পদ্মার এপারে। সুখের বিষয়, মৌলবি মনসুরউদ-দীনের হারামণিতে সংগৃহীত মুসলমানি আউল-বাউল-মুরশিদিয়া গীত হিন্দু-মুসলমান গুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ লইয়া সঞ্চয়নখানি প্রকাশিত হয়।
বাঙালি-হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা লিখিত পুস্তক যে পড়েন না বা কম পড়েন, তাহার জন্য তাঁহাদের সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ মুসলমানদের ভিতর শক্তিমান লেখক বড় কম। একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, আজ যদি কোনও মুসলমান শরাবুর মতো সরল ভাষার মুসলমান চাষি ও মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকেন, তবে কোন হিন্দু না পড়িয়া থাকিতে পারিবেন। আরব্যোপন্যাসের বাংলা তর্জমা এখন হাজার হাজার বিক্রয় হয়– যদিও তর্জমাগুলি অতি জঘন্য ও মূল আরবি হইতে একখানাও এযাবৎ হয় নাই, আর সয়ীদ আইয়ুবের লেখা কোন বিদগ্ধ বাঙালি অবহেলা করেন? কিন্তু তিনি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন; মুসলমান জীবন অঙ্কিত করা বা মুসলমানি কৃষ্টি বা সভ্যতার আলোচনা তিনি করেন না। বাঙালি কবীরকে কে না চিনে?
মুসলমানদের উচিত কোরান, হদিস, ফিকাহ, মহাপুরুষ মুহম্মদের জীবনী (ইবনে হিসামের উপর প্রতিষ্ঠিত) মুসলিম স্থাপত্য শিল্পকলা ইতিহাস (বিশেষ করিয়া ইবনে খলদুন), দর্শন, কালাম ইত্যাদি ইত্যাদি–কত বলিব সম্বন্ধে প্রামাণিক, উকৃষ্ট সরল সস্তা কেতাব লেখা। লজ্জার বিষয় যে, ফারসিতে লেখা বাঙলার ভূগোল-ইতিহাস বাহার-ই-স্তানে গাইবির বাঙলা তর্জমা এখনও কেহ করেন নাই।
শুনিতে পাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামিক কালচার বিভাগ আছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু অধ্যাপকেরা নানারকম পুস্তক প্রবন্ধ বাঙলায় লিখিয়া বিশ্ব বিদ্যালয় নাম সার্থক করেন। মুসলমান অধ্যাপকেরা কি লেখেন? লিখিলে কি উজবেকিস্থানের ভাষায় লেখেন?
মুসলমানদের গাফিলি ও হিন্দুদের উপেক্ষা আমাদের সম্মিলিত সাহিত্য-সৃষ্টির অন্তরায় হইয়াছে। দুইজন একই ভাষা বলেন; কিন্তু একই বই পড়েন না? কিমাশ্চর্যমতঃপর!
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫.৮.১৯৪৫]
.
০২.
এক ইন্দো-আমেরিকান আড্ডায় ছিটকাইয়া গিয়া পড়িয়াছিলাম। আড্ডাধারীরা এ-কোণে ও-কোণে তিন-চার জনায় মিলিয়া ঘোট ঘোট দয়ের সৃষ্টি করিয়া হরেকরকম বিষয়ে আলাপচারী করিতেছিলেন। আর যে কোণে গিয়া পড়িয়াছিলাম সেখানে একজন মার্কিন দুঃখ করিয়া সেই সনাতন কাহিনী বলিতেছিলেন, গাড়িওয়ালারা বিদেশিদের কীরকম ধাপ্পা দেয়, দোকানিরা কীরকম পয়সা মারে, টিকিট কাটিতে হইলে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষটায় বলিলেন, অদ্ভুত দেশ, ফার্স্ট ক্লাস গাড়িতে পর্যন্ত মুখ ধুইবার জন্য সাবান-ভোয়ালে থাকে না; জিজ্ঞাসা করিলে রেল কর্মচারী বলে, যদি রাখা হয় আধঘণ্টার ভিতর সাবান-তোয়ালে কর্পূর হইয়া যাইবে। আমি উষ্মর সহিত একটা ঝাঁজালো উত্তর দিব দিব করিতেছি এমন সময় একটি জর্মন মহিলা বলিলেন, জর্মনিতে থার্ড ক্লাসেও সাবান-তোয়ালে থাকে ও সেগুলি চুরি যায় না। কিন্তু দুরবস্থার সময় এই নিয়ম খাটে না। ১৯১৮ সনে জর্মনির দৈন্য এমন চরমে পৌঁছিয়াছিল যে, সাবান-তোয়ালে মাথায় থাকুক গাড়ির সর্বপ্রকার ধাতুর তৈয়ারি রড, হ্যান্ডল, হক, কব্জা পর্যন্ত উপিয়া গিয়াছিল। জর্মনি হুনরি-কারিগরদের সকলেই ড্রাইভার-স্প্যানার চালাইতে ওস্তাদ। শেষ পর্যন্ত কার অভাবে গাড়িগুলির দরজা পর্যন্ত ছিল না। অথচ সেই জর্মনিতেই ১৯২৯ সালে কেউ যদি ভুলে বাথরুমে হাতঘড়ি ফেলিয়া আসিত তবে নির্ঘাৎ ফেরত পাইত। উত্তর শুনিয়া মার্কিনের চোখের উলটা দিক বাহির হইয়া আসিল। বলিলেন, কই, আমাদের দেশে তো এমনটা এখনও হয় নাই। আমি বলিলাম ব্রাদার, তোমরা আর দৈন্য দেখিলে কোথায়? মনে পড়িল হেম বাড়য্যের শেক্সপিয়ারের তর্জমা,
অঙ্গে যার অস্ত্রাঘাত হয়নি কখন,
হাসে সেই ক্ষতচিহ্ন করি দরশন।
***
বাড়ি ফিরবার সময় ওই খেই ধরিয়া অনেক কিছু ভাবিলাম। যান্ত্রিক সভ্যতা তো আমাদের হয় নাই। আমাদের যা কিছু বৈদগ্ধ্য-ঐতিহ্য-সভ্যতা এককালে ছিল তাহা বিরাজ করিত গ্রামের সরল অনাড়ম্বর জীবনকে জড়াইয়া। কৃষ্টির দিক দিয়া গ্রামগুলি তো উজাড় হইয়াছে কারণ গ্রামের কোনও মেধাবী ছেলে যদি কোনও গতিকে বিএ পাস করিতে পারে, তবে সে তো আর গ্রামে ফিরিয়া যায় না। গ্রাম তাহাকে কী চাকরি দিবে? ১২ টাকার স্কুলমাস্টারি, না ১৫ টাকার পোস্টমাস্টারি? এত কাঠখড় পোড়াইয়া, বুকের রক্ত জল করিয়া, স্বাস্থ্য বরবাদ করিয়া বিএ পাস করিল কি কুল্লে ১৫ টাকার জন্য? সে আর গ্রামে ফিরে না। সার শহরে চলিয়া যায়, তুষ ধামে পড়িয়া থাকে। অথচ একশত বৎসর পূর্বেও গ্রামের হিন্দু ছেলে নবদ্বীপ ভট্টপল্লি, কাশীতে অধ্যয়ন করিয়া দিগগজ পণ্ডিত হইয়া গ্রামেই ফিরিত; সেইখানেই বাস করিত। মুসলমান ছেলে দেওবন্দ, রামপুর পাস করিয়া ওস্তাদ-দত্ত মস্ত পাগড়ি পরিয়া সেই গ্রামেই ফিরিয়া আসিত, সেই গ্রামেই বাস করিত। তাঁহারাই গ্রামের চাষি-মজুরকে ধর্মপথে চলিবার অনুপ্রেরণা দিতেন।
গ্রামে শিক্ষাদীক্ষা আজ নাই, তবু তো চাষা-মজুর পশু হইয়া যায় নাই। আমি বহু কর্মীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু কেহই একথা বলেন নাই যে, দুর্ভিক্ষের সময় আমাদের চাষারা কুকুর-বিড়াল খাইয়াছে। কুকুরের সঙ্গে খাদ্য লইয়া কাড়াকাড়ি করিয়াছে কিন্তু এ সমাধান তাহার মাথায় আসে নাই যে, কুকুরটাকে মারিয়া তো জঠরানল নিবানো যায়! আরও শুনিয়াছি যে, গোরা সিপাহি টিনের খাদ্য ছুড়িয়া দিলে হিন্দু-মুসলমান স্পর্শ করে নাই; পাছে গরু বা শুয়োর খাইতে হয়।
অথচ সভ্যতার শিখরে উপবিষ্ট প্যারিস শহরের বাসিন্দারা নাকি দুর্দিনে কুকুর-বিড়াল। ইস্তক চড়ইপাখি পর্যন্ত সাফ হজম করিয়া ফেলিলেন।
ধর্মের গতি সূক্ষ্ম; কে সভ্য কে অসভ্য কে জানে?
[আনন্দবাজার পত্রিকা ১.৯.১৯৪৫]
.
০৩.
সেই ইন্দো-মার্কিন মজলিসের আরেক কোণে যখন ঘুরিতে ঘুরিতে পৌঁছিলাম, তখন শুনি এক মার্কিন বলিতেছেন, যাকে জিগ্যেস কর সেই বলে “টেগোর পড়–গিট্যাঞ্জলি, গাড়না, চিন্তা”; পড়েছি, সুখ পেয়েছি। কিন্তু আমি চিত্রকর, তোমাদের দেশে কেউ ছবি-টবি আঁকে না? আমি বলিলাম, কী অদ্ভুত প্রশ্ন, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অসিত হালদার ও নন্দলালের চেলা রমেন্দ্র চক্রবর্তী, বিনোদ মুখোপাধ্যায়, বিনায়ক শিবরাম মশোজি, রামকিঙ্কর বহিজ– এঁদের নাম শোনোনি? মার্কিন বলল, “ওই তো বিপদ, সকলেই বলে “নাম শোনোনি?” নাম তো বিস্তর শুনেছি। কিন্তু এদের ছবির অ্যালবাম কই– এক চক্রবর্তী ছাড়া! ১৫ থেকে ২০ টাকার ভিতর তুমি আমাদের যে কোনও গুণীর– দা-ভিঞ্চি, রেমব্রান্ত, সেজান্– যারি চাও উৎকৃষ্ট অ্যালবাম পাবে। ইস্তেক তোমাদের দেশের বাজার এগুলোতে ছয়লাপ করে রেখেছিল, যখন লড়াইয়ের গোড়ার দিকে এদেশে আসি। এই যে এঁদের নাম করলে, দাও না কারু “কমপ্লিট ওয়ার্কস”? বেশি দরকসর করব না– আমরা কারবারি, আদ্ধেকেই দাও না?
নতমস্তকে ঘাড় চুলকাইয়া টালবাহানা দিলাম, লড়াইয়ের বাজার; জাপানি-জর্মন প্রিন্টিং বন্ধ; লড়াইয়ের পরে। আমেরিকানটি ভদ্রলোক। লড়াইয়ের পূর্বে অ্যালবাম ছিল কি না সে বিষয়ে অতিরিক্ত অন্যায় কৌতূহল দেখাইয়া আমাকে বিপদগ্রস্ত করিলেন না।
শুনিতে পাই, সেই একমাত্র চিত্রকর যাহার অ্যালবাম পাওয়া যায়, সরকারের ব্যবহারে ত্যক্ত হইয়া অধ্যাপকের কর্ম ছাড়ি-ছাড়ি করিতেছেন। কারবারি মার্কিন চিত্রকর চিনে, কলচরড বাঙলা সরকার চিনে না।
***
যুদ্ধের ফলে নানা অপকার, নানা উপকার হইয়াছে। তাহার খতিয়ান করিবার সময় এখনও আসে নাই। তবু একটি জিনিসের কথা ভাবিলেই মন উৎফুল্ল হইয়া উঠে। আসাম হইতে চীনে মোটরে যাইতে পারিব।
হিউয়েন সাং মঙ্গোলিয়া, তুর্কিস্থান, কাবুল হইয়া ভারতবর্ষ আসেন। অসহ্য কষ্ট তাহাকে সহিতে হইয়াছিল, ত্রিশরণ তাঁহার সহায় না হইলে সে অসম্ভব দুস্তর মরুভূমি, সঙ্কটময় হিন্দুকুশ উত্তীর্ণ হইয়া তিনি তথাগতের পুণ্যভূমিতে পৌঁছিতে পারিতেন না। ভারতবর্ষে তিনি কাশ্মির, তক্ষশিলা, বিহার হইয়া বারেন্দ্রভূমি পর্যন্ত আসেন। সেখানে কামরূপের হিন্দুরাজার নিমন্ত্রণ পান। প্রথমে কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধচিত্তে যাওয়া না-যাওয়া সম্বন্ধে মনে মনে বিচার করিয়া শেষ পর্যন্ত লোভ সম্বররণ করিতে পারিলেন না।
কামরূপের রাজা তাহাকে উচ্চ পাহাড়ে তুলিয়া পূর্বদিকে হস্তপ্রসারণ করিয়া বলিলেন, ওই তো আপনার দেশ। আমার কতবার মনে হয়, আপনার দেশ একবার দেখিয়া আসি কিন্তু এদিকে কোনও পথ এখন নির্মিত নাই।
দেশের দিকে তাকাইয়া ভিক্ষু হিউয়েন সাংয়ের হৃদয় বিকল হইয়া গিয়াছিল। এত কাছে, অথচ এত দূরে! দুঃখ করিয়া ভাবিয়াছিলেন পথটি যদি থাকিত, তবে কত শীঘ্র কত অল্প কষ্টে তিনি আত্মজনের কাছে উপস্থিত হইতে পারিতেন।
বর্ষার নির্মম বৃষ্টির অবিশ্রান্ত আঘাতে এই রাস্তার মেরুদণ্ড ভাঙিয়া দেয়। তৈয়ারি হইয়াছে বটে, কিন্তু সরকার সেটিকে চালু রাখিবেন কি না বলিতে পারি না। যদি থাকে, নানা সুবিধার মধ্যে ভারত-চীনে মধ্যস্থতাবিহীন সরল (পথ কুটিল হওয়া সত্ত্বেও) যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রহিবে। আমরা মনের আনন্দে চীন ঘুরিয়া আসিব। হিউয়েন সাংয়ের আত্মা সন্তোষ লাভ করিবে।
***
স্থলপথ দিয়া বন্ধ ভারত হইতে আরেকটি জায়গায় অল্পায়াসে যাওয়া যায়– সে কাবুল। শরৎকাল আসিয়াছে, তাই মনে পড়িল। এখন সেখানে ফল পচিতেছে, খাইবার লোক নাই।
ধনীরা শিলং যান, মুসৌরি-সিমলা যান, কাশির পর্যন্ত অনেকে ধাওয়া করেন, কিন্তু কাহাকেও কাবুল যাইতে দেখি না। অথচ যাওয়া যে খুব কষ্টকর তাহা নহে। পেশাওয়ার হইতে কাবুল মাত্র দুই শত মাইল মোটরপথ। প্রথম কুড়ি মাইল, খাইবার পাশের ভিতর দিয়া– সে কী অপূর্ব, রুদ্র দৃশ্য! দুই দিকে হাজার ফুট উচ্চ প্রস্তর গিরি দুশমনের মতো দাঁড়াইয়া নিচে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তার উপর দিয়া কত চিত্র-বিচিত্র পোশাক, পাগড়ি পরিয়া কাফেলা-ক্যারেভান কাবুল চলিয়াছে, মাজার-ই-শরিফ চলিয়াছে, আমুদরিয়া পার হইয়া বোখারা যাইবে-আসিবে। এদিকে গজনি-কান্দাহার হইয়া হয়তো হিরাত পর্যন্ত যাইবে আসিবে। ঘোড়া-গাধা-উটের পিঠে কত রঙয়ের কার্পেট, কত ঝকঝকে সামোভার, কত কারাকুলি পশম। সন্ধ্যায় নিমলা পৌঁছিবেন সেখানে শাহজাহান বাদশার তৈয়ারি চিনার (সাইপ্রেস জাতীয়) বাগানের মাঝখানে নয়ানজুলির পাশে চারপাইর উপর না-গরম-না-ঠাণ্ডায় রাত কাটাইবেন– জলের কুলকুল শুনিয়া। ব্রাহ্মমুহূর্তে হাজার হাজার নরগিস (নারসিসস) ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে সুগন্ধে সঞ্জীবিত হইয়া চেতনালোকে ফিরিয়া আসিবেন।
সেইদিন বিকালে কাবুল। পথের বর্ণনাটা আর দিলাম না। যে একবার দেখিয়াছে ভুলিবে না। শরতের কাবুল কোনও হিল স্টেশনের নূন তো নহেই– অনেকাংশে উত্তম। প্রচুর ফল, উক্তৃষ্ট দুম্বার মাংস, হজমি পানীয় জল, রুদ্র-মধুর দৃশ্য ও কাবুলির সরল সহৃদয় বন্ধুত্ব। ঐতিহাসিক চিন্তার খোরাক পাইবেন বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী মোগল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, বাবুর বাদশাহের দীন স্নান কবর কাবুলের পর্বতগাত্রে দেখিয়া।
***
অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। ট্রামে প্রায়ই দেখি অসম্ভব ভিড়, অথচ চারিটি মহিলা চারিটি লেডিজ-বেঞ্চে আরামে বসিয়া আছেন। বসুন, আপত্তি নাই। কিন্তু যদি চারিটি মহিলা দুইখান বেঞ্চিতে বসিতেন, তবে অন্তত মহিলা না আসা পর্যন্ত চারিজন বৃদ্ধ বা ক্ষুদ্র ওই খালি দুই বেঞ্চিতে বসিতে পারেন বা পারে। কোনও কোনও মেয়ে বলেন, ট্রামে-বাসে ছেলেরা অভদ্র; ছেলেরা বলিবে মেয়েরা নির্মম।
লক্ষ করিয়াছেন যে, আজকাল ট্রামে-বাসে ছেলে-বুড়ো কমিয়া গিয়াছেন। ইহারা কলিকাতার এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যান কী প্রকারে, এখনও বুঝিয়া উঠিতে পারি না।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫.৯.১৯৪৫]
.
০৪.
মহাত্মা গান্ধী কয়েকদিন হইল কস্তুরবা স্মৃতিরক্ষা কমিটিতে বলেন, গ্রামের কুটিরগুলিতে আলোক স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা আনিবার জন্যই কস্তুরবা স্মৃতি ভাণ্ডারের উৎপত্তি। গ্রামের স্ত্রীলোকদিগকে মানসিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য। বনিয়াদি শিক্ষা বলিতে ইহাই বুঝায়। মহাত্মাজির প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
এই উপলক্ষে আমরা একটি বিষয়ের দিকে সকলের দৃষ্টি সবিনয় আকর্ষণ করি। যদি গ্রামে উপযুক্ত শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কোনওপ্রকার কুটিরশিল্পও প্রর্বতন করা যায় তবে গ্রামের উৎপাদনী শক্তি ও সঙ্গে সঙ্গে ক্রয় করিবার ক্ষমতা বাড়িবে। তবে প্রশ্ন এই যে, শহরের উন্নত কলকজা দিয়া যেসব জিনিস প্রস্তুত হইবে তাহার সঙ্গে কুটিরশিল্প প্রতিযোগিতা করিতে পারিবে না। জাপান এই সমস্যার সমাধান করিয়াছিল গ্রামের কুটিরশিল্পের সঙ্গে শহরের কারখানার ঘনিষ্ঠ যোগস্থাপন করিয়া। অর্থাৎ যন্ত্ৰজাত মালের অনেক ছোট ছোট অংশ এমন আছে সেগুলি গ্রামে বসিয়া অবসর সময়ে হাত দিয়া তৈয়ারি করা যায় বিশেষ বিচক্ষণতা বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। শহরের কারখানাই কুটিরকে কাঁচামাল ও টুকিটাকি যন্ত্রপাতি দেয় ও কারখানাই কুটিরে তৈয়ারি মাল সংগ্রহ করিবার ভার নেয়। কাজেই কুটিরশিল্পী এই ধান্দা হইতেও রক্ষা পায় যে গ্রামের বাজারে তাহার তৈয়ারি মাল কিনিবে কে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব ডাইরেক্টার শ্রীযুক্ত মণিলাল নানাবটী এককালে জাপানে এই সমস্যা সমাধানটি বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিয়া এদেশে ফিরিয়া এ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। বাংলা দেশের কয়েকজন যুবাকেও আমরা চিনি যাহারা বহু কলা শিখিয়া আসিয়াছেন। হয়তো তাঁহারাও এই বিষয়টি আলোচনা করিয়াছেন।
কস্তুরবা ফাণ্ডের অর্থ ব্যয় করিয়া শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনও কুটিরশিল্প প্রবর্তন করা হয় তবে তাহার জন্য আলাদা খবচ করিতে হইবে না। এইটি বিশেষ সুবিধা।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২২.৯.১৯৪৫]
.
০৫.
ছেলেবেলার একটি কবিতা মনে পড়িল, প্রাকশরতের বর্ণনা–
অনিচ্ছায় ভিক্ষা দেয় কৃপণ যেমতি
পড়ে জল সুবিরল সূক্ষ্মধার অতি।
সদাশয় সরকার যে কায়দায় রাজবন্দিদিগকে মুক্তি দিতেছেন, তাহাতেই কবিতাটি মনে পড়িল। সেদিন একজন অধুনা-নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, জেলে কীরকম দিন কাটিল? বলিলেন, প্রথম তিন বৎসর ভালই, কারণ মন স্থির করিয়া লইয়াছিলাম যে, সরকার যখন আর কখনও ছাড়িবেই না, তখন দুঃখে সুখে এইখানেই বাকি জীবনটা কাটাই। হঠাৎ দেখি সরকার ইহাকে ছাড়ে, উঁহাকে ছাড়ে। বন্ধু-বান্ধবীদিগের সঙ্গসুখ হইতে বঞ্চিত করিয়া সরকার একবার জেলে পুরিল, তার পর জেলের ভিতরে যাহাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হইল (তাহারাই তো প্রকৃত বন্ধু চাণক্য বলিয়াছেন, রাজদ্বারে যে সঙ্গে তিষ্ঠে সে বান্ধব, এ তো তারও বাড়া একেবারে ভিতরে, কারাগারে) তাহারাও একে একে চলিয়া যাইতে লাগিলেন। তখন দ্বিতীয়বার বন্ধুবিচ্ছেদ– ডবল জেল। খালাস পাইবার সময় আবার অনেক বন্ধুকে ফেলিয়া আসিয়াছি। এখন তেহারা জেলের সুখ পাইতেছি।
সরকারের অবৈতনিক মুখপাত্র হিসাবে বলিলাম, মেলা বন্ধুত্ব করা ভালো নয়। তোমাদের শঙ্কারাচার্যই বলিয়াছেন।
বন্ধু বলিলেন, বাড়ি গিয়া দেখি, মা একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছেন। শয্যাগ্রহণ করিয়াছেন। শুনিলাম, প্রথম তিন বৎসর ঠিক পাড়া ছিলেন, কিন্তু শেষের একমাস আশা-নিরাশায় দুলিয়া, অপেক্ষা করার ক্লান্তিতে, কে কে খালাস পাইয়াছে, কে কে পায় নাই, তাহাদের সঙ্গে মিলাইয়া আমার মুক্তির সম্ভাবনা কতটুকু হিসাব করিতে করিতে একদিন শয্যাগ্রহণ করিলেন। সংস্কৃত প্রবাদটি বুঝিলাম যে, অধমের নিকট হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াও সুখ নাই।
শুনিতে পাই বড় কর্তাদের কেহ কেহ নাকি বলিয়াছেন। পূজার পূর্বে অথবা পরে সকলেই খালাস পাইবেন। পূজার বিশেষ করিয়া পূজার পূর্বে ও পরে নিষ্কৃতিতে যে কী নিদারুণ পার্থক্য তাহা বুঝিবার মতো বাঙালি কি বড় দপ্তরে কেহই নাই।
***
মৌলানা আকরম খাঁ সাহেব সরকারকে হজযাত্রীদের সুবিধা করিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছেন।
মোগল বাদশাহ আকবর গুজরাট জয় করিলে পর মোগলরা প্রথম সন্দ্র দর্শন করে, প্রথম সমুদ্রবন্দর তাহাদের হাতে আসে। সেই বৎসরই হুমায়ুনের বিধবা মহিষী ও হারেম মহিলারা সুরট বন্দর হইতে নৌকাযোগে মক্কা যান। স্থলপথে যাওয়া বিপদসঙ্কুল ছিল বলিয়া ইতোপূর্বে মোগল মহিলারা কখনও হজ যাইতে পারেন নাই। কিছুদিন পরেই আকবর একজন মির উল হাজ অর্থাৎ হজ অফিসার (ইংরেজ সরকার যেন না ভাবেন যে তাহারাই সর্বপ্রথম এই সকর্মটি করিয়াছেন) নিযুক্ত করেন। আহমদাবাদবাসী সম্ভ্রান্ত পীর বংশীয় মির আবু তুরাব বহু হজযাত্রী ও ভারত সরকারের তরফ হইতে দশ লক্ষ টাকা সঙ্গে লইয়া সুরটের বন্দর-ই-হজ (তাপ্তি নদীতে একটা ঘাট এখনও এই নামে গুজরাতে সুপরিচিত) হইতে পাল তুলিয়া মক্কা পৌঁছোন। ভারত সরকারের পক্ষ হইতে ওই অর্থ মক্কার শরিফ (গভর্নর), আলিম উলেমা (পণ্ডিত-শাস্ত্রী) ও দীনদুঃখীদিগকে অতি আড়ম্বরে ও বদান্যতার সহিত বন্টন করা হয়। মক্কায় ভারতের জয়ধ্বনি উঠে; ভারতের হাজিরা সর্বত্র রাজার আদর পান। ফিরিবার সময় আবু তুরা পয়গম্বরের পদচিহ্নিত একখানা পবিত্র প্রস্তর আনয়ন করেন। আকবর নামায় বর্ণিত আছে বাদশাহ আকবর সেই প্রস্তরকে সম্মান প্রদর্শন করিবার জন্য আপন স্কন্ধে বহন করিয়াছিলেন। প্রস্তরখানি অদ্যাপি আহমদাবাদে আছে।
যতদূর মনে পড়িতেছে, হৃতগর্ব মোগল সম্রাট রফি-উদ্-দরজাতের সময় পর্যন্ত বৎসর বৎসর মির উল হাজ সরকারের পক্ষ হইতে অর্থ লইয়া মক্কা যাইতেছেন। মিরাত-ই-অহমদি নামক ফারসিতে লিখিত গুজরাতের ইতিহাসে এই সম্বন্ধে অতি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা আছে। পুস্তকখানির লেখক আলি মহম্মদ খান গুজরাত সুবার দেওয়ান বা রাজস্বসচিব ছিলেন। তখনকার দিনে রাজনীতি ও ধর্মনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত ছিল বলিয়া এই অর্থব্যয়কে অপব্যয় মনে করা হইত না। আজও পৃথিবীর যেকোনো এম্বেসি বিদেশে ইহা অপেক্ষা বেশি অর্থের অপব্যয় করেন।
ভারত যদি আজ স্বাধীন হইত তবে আকরম খাঁ সাহেবের মতো মৌলানার ধর্মেচ্ছা সরকার সানন্দে পূর্ণ করিতেন। মৌলানা সাহেবকে মুখ খুলিয়া বলিবার প্রয়োজনই হইত না।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ৬.১.১৯৪৫]
.
০৬.
লিখিতে মন চায় না। যেসব বন্ধুরা জেল হইতে খালাস পাইয়া আসিয়াছেন, তাঁহাদের অবস্থা দেখিয়া ও তাহাদের কারাকাহিনী শুনিয়া নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মে, মনে হয় এই অর্থহীন প্রলাপের কী প্রয়োজন? জানি, সহৃদয় পাঠকবৃন্দ অধমের লেখা সহ্য করেন, কেহ কেহ পত্র লিখিয়া তাহাকে উৎসাহিত করেন, কিন্তু যেসব কাহিনী শুনি, নিষ্কৃতদের যে ভগ্নস্বাস্থ্য দেখি তখন সে কাহিনী, সে অবস্থা সত্যের লেখনী সংযোগে পাঠকের হৃদয়মনে সঞ্চারিত করিতে পারি না বলিয়া বহু বত্সরে যে সামান্য সাধনা-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা পণ্ডশ্রম বলিয়া ধিক্কার দিই।
নিষ্কতদের অভিজ্ঞতা এতই সহজ, এতই সরল যে, তাহা প্রকাশ করিতে গিয়া বাক্যালঙ্কার বিড়ম্বিত, মার্জিত লিখনশৈলী অপমানিত।
সহৃদয় পাঠক এই ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্য মার্জনা করিবেন।
***
আমার এক বন্ধু যাহাকে বলে উন্নাসিক। অতি সদর্থে। তাঁহার জ্ঞানপিপাসা এতই প্রবল, দেশের মঙ্গলেচ্ছা এতই অনাবিল যে, বিদেশীয় কয়েকটি সাহিত্যসম্পদে গৌরবান্বিত ভাষা জানা সত্ত্বেও সেসব সাহিত্যের উত্তম উত্তম কাব্য-দর্শন পড়িবার তাঁহার সময় হইত না– নাটক-নভেল মাথায় থাকুন। তুলনামূলক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি– তাহাদের ইতিহাস ইত্যাদি পড়িতে পড়িতে তাঁহার সময় ফুরাইয়া যাইত।
কারাপীড়নে অধুনা তিনি আর কিছুতেই চিত্তসংযোগ করিতে পরিতেছিলেন না বলিয়া (সেতারখানাও ফেরত পাঠাইয়াছিলেন) আমার কাছে True Story, Detective Story জাতীয় তরল বস্তু চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন। দুঃখে-সুখে মিশ্রিত হৃদয় লইয়া পাঠাই। খবর পাইলাম সদাশয়, I. B, সেগুলি এ যাবৎ তাঁহাকে দেন নাই। সরকারের এই কি ভয় যে, তিনি ডিকেটটিভ গল্প হইতে আণবিক বোমা বানাইবার কায়দা রপ্ত করিয়া সর্বজনীন দাঁতব্য কারাগার প্রতিষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করিয়া দিবেন–না টু স্টরি হইতে আদিরসাত্মক গল্প পড়িয়া তাহার চরিত্রদোষ হইবে। সরকারের হেফাজতে যখন আছেন, তখন তাঁহার চরিত্র রক্ষা করা তো সরকার-গার্জেনেরই কর্ম!
***
আরেক বন্দি ছিলেন অরসিক। তিনি একখানা biology-র প্রামাণিক পাঠ্যপুস্তক চাহিয়া পাঠান। নামঞ্জুর। কয়েকজন রাজবন্দি একযোগে কারণটি অতি বিনয় সহযোগে জানিতে চাহিলেন। উত্তরটি অক্ষরে অক্ষরে তুলিয়া দিতেছি।
মশাই, আপনারা যে কখন কী চেয়ে বসেন, তার তো ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ এ biology, কাল ও biology পরশু সে biology!
রাজবন্দিদের কেহ দার্শনিক, কেহ ঐতিহাসিক, কেহ নৃতত্ত্ববিদ। সকলেই হতবুদ্ধি; ব্যাপারটা না বুঝিতে পারিয়া একে অন্যের মুখের দিকে তাকান। Biology যে আবার পঁচিশ কেতার হয় তাহা তো তাঁহারা কখনও শুনেন নাই!
রহস্য সমাধান হইল; I. B. নৈরাশ্যের দরদীয়া সুরে বলিলেন, কোনদিন যে শেষটার গান্ধীর biology চেয়ে বসবেন না তারই বা ভরসা কোথায়? তখন আমি কোথায় যাই বলুন তো?
I. B. বিদ্যাসাগর biology ও biography-তে মিশাইয়া ফেলিয়াছেন।
গুরু সাক্ষী, ধর্ম সাক্ষী, দোষ দিতেছি না। অত পাণ্ডিত্য না ধরিলে বড়কর্তা I. B.-র সেনসর হইবেন কেন? ইহার চেয়ে অল্প বিদ্যায়ও আইনস্টাইনকে রিলেটিভিটি শিখানো যায়, অফিসারটিকে আমরা সবিনয় সাবধান করিয়া দিতেছি। তিনি যদি হুঁশিয়ার হইয়া না চলেন, তবে একদিন দেখিবেন যে, তাহার গভীর পাণ্ডিত্যের সম্মান রক্ষার্থে অক্সফোর্ডের বড়কর্তারা তাহাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের তখতে বসাইয়া দিয়াছেন।
আরেক বন্দি অতি সুপুরুষ। কাঁচা সোনার বর্ণ, ঢেউ খেলানো বড় বড় কালো চুল, খগের মতো নাক, আর দরাজি কপাল। যতদিন বাহিরে ছিলেন মাতা ও স্ত্রীর উৎপাতে মাঝে মাঝে দাড়ি কামাইতেন– অর্থাৎ মুখমণ্ডল ঘন-বর্ষার কদম্ব-পুষ্পের সৌন্দর্য ধারণ করিলে পর। জেলে গিয়া পরমানন্দে তিনি দাড়ি গজাইতে আরম্ভ করিলেন। সময় বিস্তর বাঁচিল, রাগ করিলে উৎপাটন করিবার সুলভ সহজ বস্তু জুটি–আর চিন্তা-বিক্ষোভের কারণ তো হামেশাই উপস্থিত হইবে।
জেলে যে অতি আরামে আছেন এই বুঝাইবার জন্য তিনি সর্বদাই পত্নীকে রসে টইটম্বুর পত্র লিখিতেন। তাহারই একখানাতে নিজের তরুণ দাড়ির বর্ণনা দিয়া বলিলেন, চেহারাটা এখন অনেকটা ক্রাইস্টের মতো হইয়াছে।
মহারানি ভিক্টোরিয়ার ইস্তেহারের কথা আমরা আর পাঁচজন প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলাম। সর্ব ধর্মে সকলের সমান অধিকার অথবা এইরকম কিছু একটা ঠিক মনে নাই।
I. B.-র স্মরণশক্তি পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময়জনক ও হৃদিত্রাস-সঞ্চারক। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পাছে ক্রাইস্টপন্থি কাহারও মনঃপীড়ার সঞ্চার হয়, এই ভয়ে সেনসার এন্তার দুশ্চিন্তার ভার নামাইলেন ছত্রটি গিলোটিন করিয়া।
সহৃদয় পাঠক গীতা অথবা ওই জাতীয় কোনও পুণ্যগ্রন্থে আছে না, ধর্মসংস্থাপনার্থে শ্রীকৃষ্ণ যুগে যুগে অবতীর্ণ হন?
হে biology Biography অকিরণকারী নটবর সেনসর, তোমাকে বারবার নমস্কার—
নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোহস্তু তে সর্বত অব সর্ব
তোমাকে সম্মুখ হইতে নমস্কার, তোমার পশ্চাৎ দিকে নমস্কার তুমি যে অনন্তবীর্য অনন্তবিক্ৰম ধরো তাহাকে সন্দেহ করিবার মতো যুগ্ম-মস্তক কার স্কন্ধে?
খ্রিস্টধর্ম ওয়াজ ইন ডেঞ্জার– তুমি তারে করিলে উদ্ধার।
***
বৃথা বাক্যব্যয়। বর্তমান যুগ সাংখ্যের– অর্থাৎ Statistics-এর। তাই শুদ্ধ স্টাটিসৃটি নিবেদন করি।
১৯২০-এ অসহযোগ আন্দোলনে ভদ্রলোক যোগ দেন। ১৯২৭-এ নানাপ্রকারে প্রপীড়িত হইয়া মস্কো চলিয়া যান। ১৯২৮-এ অসুস্থ শরীর লইয়া বার্লিন। ১৯৩৩-এর কয়েক দিবস জর্মন জেল। ১৯৩৪-এ দেশে প্রত্যাবর্তন।
১৯৩৫ এখানে বৌন্ড ডাউন। ১৯৩৬-এর গ্রীষ্মে গ্রেফতার ও সাত মাসের জেল। ৩৭-৩৮ বাহিরে। সেপ্টেম্বর ৩৯-৪১ জেলে প্রায় এক বছর। ৪১-৪২ এক বৎসর বাহিরে। ৪২-এর এপ্রিল পুনরায় লক্ষ্ণৌয়ে গ্রেফতার ও বলি– তার পর ফতেহগড়– তার পর বাঙলা . দেশের জেল– সর্বকারাগারতীর্থ পরিক্রমা করিয়া এখন তিনি তথাগত- আজও তিনি জেলে। একটানা তিন বৎসর আট মাস। কত রোগশয্যা মৃত্যুদৰ্শন কত হাসপাতাল, আত্মীয়স্বজনের কত আকুলি বিকুলি কত কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কত প্রতিশ্রুতি কত আশানৈরাশ্যের সুখস্পর্শে পদাঘাত।
ইতোমধ্যে পত্নীর ছয় মাস কারাবাস, ভগ্নীৰ্শনাগতা শ্যালিকার তিন মাস ও নিরীহ পাঁচকের নয় মাস!
ভদ্রলোকের নাম শ্রীসৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভগ্নস্বাস্থ্যবশত ওজন কমায় তিনি এখন ছোটলোক এবং ছোট-লোকের সঙ্গই বাঞ্ছা করেন।
[আনন্দবাজার পত্রিকা, ১.১২.১৯৪৫]
.
০৭.
সহৃদয় পত্রলেখকগণের প্রতি আমার সকরুণ নিবেদন এই যে, আমি অতি অনিচ্ছায় অনেক সময় তাহাদের পত্রের উত্তর দিতে অক্ষম হই। তাহারা যেসব বিষয় লইয়া আলোচনা চাহেন সেগুলিও সবসময় করিতে সক্ষম হই না। তাহার প্রধান কারণ আনন্দবাজার বাংলা পত্রিকা অধিকাংশ পাঠক ইংরেজি জানেন না। কাজেই তাহারা বহু বিষয়ের রস গ্রহণ করিতে পারেন না। আমি প্রধানত তাঁহাদিগের সেবা করিতে চাহি বলিয়াই আনন্দবাজারে লিখি। গুণীরা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে লেখেন। আবার কোনও কোনও পাঠক শাসাইয়া বলিয়াছেন, সত্যপীর সাবান ইত্যাদি সামান্য বিষয় লইয়া আলোচনা করে কেন, সাবানের আলোচনাও তাহার নিকট হইতে শুনিতে হইবে নাকি?
আমার বক্তব্য, আমি অত্যন্ত সাধারণ রাস্তার লোক, ম্যান ইন দি স্ট্রিট। দুর্বলতাবশত মাঝে মাঝে পণ্ডিতি করিবার বাসনার উদ্রেক হয়। এবং করিতে গিয়া ধরা পড়িয়া লাঞ্ছিত হই। সহৃদয় পাঠক, আপনার কি সত্য সত্যই এই অভিলাষ যে, অধম প্রতি শুক্র শনি সিন্নি (শিরনি) ও পূজার পরিবর্তে বিদ্বজ্জনমণ্ডলী কর্তৃক তিরস্কৃত হউক?
অতঃপর বক্তব্য সাবান বস্তুটি বুদ্বুদসমষ্টি বলিয়া কি সে সম্বন্ধে আলোচনা বুদ্বুদেরই ন্যায় অসার? গুরুজন, জর্মন পণ্ডিত ও যোগীকে এক সাবানে সম্মিলিত করিতে সমর্থ হইলাম সে কি কম কেরানি? হায় পাণ্ডিত্য করিতে গিয়া বিড়ম্বিত হই, সাবানের মতো নশ্বর বস্তু লইয়া আলোচনা করিতে গিয়াও পণ্ডিতের যষ্টিতাড়না হইতে নিষ্কৃতি নাই। উপায় কী?
ভাবিয়াছিলাম অদ্য ইলিশ মাছ কী প্রকারে দম পোত রান্না করিতে হয় তাহা সবিশদ বর্ণনা করিব। সে অতি অদ্ভুত রান্না। আস্ত মাছখানা হাঁড়িতে রাখিবেন, আস্ত মাছখানা রান্না হইয়া বাহির হইবে। অনভিজ্ঞের কণ্ঠত্রাসসঞ্চারক ক্ষুদ্র কাঁটাগুলি গলিয়া গিয়াছে, বৃহৎ কাঁটাগুলোর তীক্ষ্ণতা লোপ পাইয়াছে।
পূর্ববঙ্গে কোনও কোনও অঞ্চলে এইপ্রকার রান্নার কায়দা এত গোপন রাখা হয় যে, মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় শপথ করিয়া যাইতে হয় যে, সে শ্বশুরবাড়ির কাহাকেও পঞ্চম মকারের বাঙালি বল্লভ এই ম কারটার গভীর গুহ্য তত্ত্বটি শিখাইবেন না।
সেই গোপন তত্ত্বটি আজ যবনিকান্তরাল হইতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাহির করিব মনস্থির করিয়াছিলাম। সর্বরহস্য সর্বকালের জন্য সমাধান করিয়া বহু মধুর নির্যাতন, পরিবারে পরিবারে দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান করিব ভাবিয়াছিলাম কিন্তু গম্ভীর পাঠকের তাড়নায় মনস্কামনা পূর্ণ হইল না।
ফলে ইলিশের কাঁটা আরও এক শত বৎসর বহু অনভিজ্ঞের গলায় বিধিবে–কিন্তু আমার তাহাতে পাপ নাই।
বাঙালদের কথাই হউক।
এক বাঙাল বেগুন চাহিতে গিয়া বাইগন বলিয়াছিল; তাহাতে ঘটির রসোদ্রেক হয় ও বারবার ব্যঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে থাকে, কী বলিলে হে? কী কথা বলিলে? বাঙাল লজ্জিত হইয়া কিছুক্ষণ নিজের উচ্চারণ লুকাইবার চেষ্টা করিয়া শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, বেশ কইছি, বাইগন কইছি, দোষ কী হইল? ঘটি আত্মপ্রসাদজাত মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, “বাইগন”! ছোঃ! কী অদ্ভুত উচ্চারণ। আর শোনো তো আমরা কীরকম মিষ্টি উচ্চারণ করি, “বেগুন”! বাঙাল চটিয়া বলিল, মিষ্টি নামই যদি রাখবা তবে “প্রাণনাথ” নাম দেও না ক্যান? চাইর পইসার প্রাণনাথ” দেও। একসের “প্রাণনাথ” দেও। হইল?
উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনা করিবার আদেশ উপস্থিত। পত্রলেখক বলিয়াছেন যে সংস্কৃত উচ্চারণ লইয়া যখন আমি এত মাথা ফাটাফাটি করিতে প্রস্তুত তখন বাঙলাকে অবহেলা করিবার কী কারণ থাকিতে পারে? বাঙলা উচ্চারণ কি সংস্কৃত উচ্চারণ অপেক্ষাও অধিক জরুরি নহে?
নিশ্চয়ই! কিন্তু মুশকিল এই যে, বাঙলা উচ্চারণ এখন অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থার ভিতর দিয়া যাইতেছে। প্রধানত রেডিয়োর কল্যাণে। পূর্ববঙ্গে এক ব্যাপক চেষ্টা দেখা যাইতেছে, মোটামুটি যাহাকে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণ বলা হয় তাহার অনুকরণ করিবার।
অথচ বেগুন অপেক্ষা বাইগনই আমার কানে মধুর শোনায়। কিন্তু মাধুর্যই তো শেষ কথা নয়। পশ্চিমবাংলা চ ও জ অপেক্ষা পূর্ববঙ্গের যে মোলায়েম চ জয়ের গার্হস্থ্য সংস্করণ আছে তাহা অনেক পশ্চিমবঙ্গবাসীরও ভালো লাগে, কিন্তু উচ্চারণ দুইটি যে ঈষৎ অনার্যোচিত তাহাতে সন্দেহ নাই। ভুল বলিলে ভুল বলা হয় না।
কিন্তু তর্ক ও আলোচনা করিবার পূর্বে প্রথম প্রশ্ন আমাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কী? বাঙলা প্রাণবন্ত, বর্ধনশীল ভাষা। তাহার নানা উচ্চারণ, নানা বর্ণ, নানা গন্ধ থাকিবে। থাকা উচিত। অথচ চট্টগ্রাম বাঁকুড়াকে বুঝিবে না। মেদিনীপুর শ্রীহট্টকে বুঝিবে না– সেকথাও ভালো নহে।
অধম যখন যেখানে যায় সেখানকার উচ্চারণ শিখিবার চেষ্টা করিয়া হাস্যাস্পদ হয়। ইহা ছাড়া যে অন্য কোনও সমাধান আছে ভাবিয়া দেখে নাই। পাঠক কী বলেন?
পূর্ববঙ্গের কথা উঠিলেই মনে হয় যে, তাহার লোক-সাহিত্যের প্রতি কী অবিচারই না করা হইয়াছে। এ যাবৎ, সেই অফুরন্ত সাহিত্য হইতে কতটুকু প্রকাশিত হইয়াছে? গীত, বারমাস্যা ছাড়াও আমির হামজা শুলে বাকওয়ালি প্রভৃতি বিদেশি কেচ্ছার পূর্ববঙ্গীয় রূপান্তর যে কী আনন্দদায়ক তাহা সুরসিক মাত্রই জানেন। লয়লা-মজনু শুষ্ক মধ্য আরবের নায়ক-নায়িকা, যেখানকার কবি গাহিয়াছেন– হে প্রিয়া, প্রার্থনা করি পরজন্মে যেন তুমি এমন দেশে জন্মও যে দেশের লোক জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিবার মতো বিলাস উপভোগ করিতে পারে।
সেই শুষ্ক আরবের নায়িকা লায়লি পূর্ববঙ্গের কেচ্ছায় অন্য রূপ গ্রহণ করিয়াছেন। নৌকায় চড়িয়া– উটে নহে, প্রিয়সন্দর্শনে যাইতেছেন। ছৈয়ের ভিতর হইতে হাত বাড়াইয়া কমল তুলিতেছেন, সিঙ্গাড়া তুলিতেছেন। পদ্ম খোঁপায় খুঁজিতেছেন।
পূর্ববঙ্গের কবির সাহস অসীম যে রসসৃষ্টি করিয়াছেন তাহা অপূর্ব।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ১২.১.১৯৪৬]