হ্যালো আইনস্টাইন!

হ্যালো আইনস্টাইন!

প্রথমেই কল্পনা করা যাক আমরা সমবেত হয়েছি এক প্রেক্ষাগৃহে।

প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভরতি। বসবার কোনও আসন খালি নেই। উপচে পড়ছে আগ্রহ, উৎসাহ, কৌতূহল।

যারা বসবার চেয়ার পায়নি, তারা দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকেই উদ্‌গ্রীব অপেক্ষায়। সবাই এসেছে আইনস্টাইনকে হ্যালো বলতে, তাঁর কথা শুনতে।

পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ একদৃষ্টে তাকিয়ে মঞ্চের দিকে। পরদা উঠতে এখনও কয়েক মিনিট বাকি।

কেন এইসব মানুষের এমন আগ্রহ? কারণ, মঞ্চের পরদা খুলে গেলেই দেখা যাবে এ-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীকে। তাঁরই জন্যে এত মানুষের ভিড়। সবাই তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে চায়। এ-যেন দুর্লভ এক তারকাকে দেখা। তাঁর কথা শুনতে চায়। যেন দৈববাণী শোনা।

তিনি আর কেউ নন— অ্যালবার্ট আইনস্টাইন! এ-নাম যেন ম্যাজিক। কী জাদু ওই নামে! আর কোনও বিজ্ঞানীর নামে কেন নেই এই জাদু? কেন নেই তাঁদের নিয়েও এত বিশ্বাস্য-অবিশ্বাস্য গল্প?

আইনস্টাইন— এই নামের মধ্যে যেন মিথ আর মিথ্যা একাকার হয়ে আছে!

ঠিক সময়ে পরদা সরে গেল। কল্পনা করুন, মঞ্চের মাঝখানে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন!

একটু দূরে অন্য এক চেয়ারে এক সুন্দরী— সেই মেয়েই এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা। প্রেক্ষাগৃহে যেন বিস্ফোরণ ঘটল— করতালির শব্দ। সমস্ত মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে। অভিনন্দন জানাচ্ছে এক যুগনায়ক অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে!

যাকে বলে স্ট্যান্ডিং ওভেশন।

উঠে দাঁড়ালেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। পরনে তাঁর ছাই রঙের টুইডের কোট। কালো ট্রাউজ়ার। মাথার চুলগুলি এলোমেলো। ঠোঁটে মৃদু হাসি। চোখ দুটি মমতাময়।

তিনি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন। সঞ্চালিকা হাতে মাইক নিয়ে বলতে শুরু করলেন— আপনারা বসুন। আমাদের অনুষ্ঠান এখুনি শুরু হবে। আজ আমাদের মধ্যে…

হাততালি থামছে না। যেন আবেগের সমুদ্রে প্লাবন এসেছে।

শ্রদ্ধা, ভালবাসা, প্রাণের আবেগ, গভীর বিস্ময়— সব মিশে গেছে ওই করতালিতে।

সঞ্চালিকা আবার বললেন, এবার আপনারা বসুন। আমাদের মধ্যে আজ এমন একজন মানুষ এসেছেন যাঁর সময় নষ্ট করার অধিকার আমাদের কারওর নেই।

ধীরে ধীরে স্তিমিত হল হাততালি। সবাই আসন গ্রহণ করল। যারা আসন পায়নি, তারা দাঁড়িয়েই রইল। আইনস্টাইন মঞ্চের উপর পুনরায় উপবিষ্ট হলেন।

সঞ্চালিকা বলতে শুরু করলেন— হ্যালো প্রফেসর আইনস্টাইন, শুভসন্ধ্যা। অনেক দিনের চেষ্টায় আজ আমরা আপনাকে পেয়েছি আমাদের মধ্যে। আপনি আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন।

আইনস্টাইন মৃদু হেসে, যেন কিছু মজা পেয়ে, তাকালেন সুন্দরী সঞ্চালিকার দিকে।

মা পলিন পিয়ানো শিল্পী হিসেবে ছিলেন বিশেষ দক্ষ। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেও হোক সংগীতপ্রেমী। ছ’ বছর বয়েস থেকে ছেলেকেও তাই বেহালা শেখালেন। মা পলিন আর ছেলে অ্যালবার্ট একসঙ্গে বাজাতেন, পিয়ানো আর বেহালা। তেরো বছর বয়েসে আইনস্টাইন বিশেষভাবে প্রাণিত হলেন মোৎসার্টের সংগীত শুনে। সেই থেকে সারাজীবন যেন নতুন উদ্যমে বাজালেন বেহালা।

বাবা হেরমান। ইঞ্জিনিয়র ছিলেন। অ্যালবার্টের বয়েস তখন পাঁচ। অসুস্থ হয়ে বিছানায়। বাবা তাকে একদিন একটি পকেট-কম্পাস দিলেন। অ্যালবার্ট অবাক হয়ে দেখল, এক অদৃশ্য শক্তি কম্পাসের কাঁটাটিকে ক্রমাগত একটি দিকেই ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এই বিস্ময় থেকেই সম্ভবত শুরু হল আইনস্টাইনের বিজ্ঞানবিমোহন।

জার্মানির উলম্-এ এই সেই বাড়ি যার একটি ফ্ল্যাটে জন্মেছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। পরের বছর অ্যালবার্টের বাবা-মা মিউনিখে সংসার পাতলেন।

তিন বছরের অ্যালবার্ট। তখনও কথা বলতে পারে না। বাবা-মা ভাবলেন, তাঁদের ছেলে সম্ভবত ব্যাহতবুদ্ধি।

অ্যালবার্টের বয়েস ১৪। বেপরোয়া কিশোর। যে-কোনও কর্তৃত্বের প্রতি তার প্রবল অবজ্ঞা। পরবর্তী জীবনে ভারী মজা পেতেন আইনস্টাইন এই কথা বলতে যে কর্তৃত্বকে অমান্য করে তিনি নিজেই এখন এক কর্তাব্যক্তি বিশারদ।

সুইৎজারল্যান্ডে জুরিখের কাছে আরাউ-তে এই সেই হাইস্কুল যেখান থেকে আইনস্টাইন ১৮৯৬ সালে ১৭ বছর বয়েসে গ্র্যাজুয়েট হলেন, ১৫ বছর বয়েসে জার্মান হাইস্কুল থেকে ‘ড্রপ-আউট’ হওয়ার পর।

জুরিখের ‘পলিটেকনিক’-এ ১৭ বছরের আইনস্টাইন শুরু করলেন কলেজজীবন। চার বছর পরে ১৯০০ সালে ফিজিক্স-এ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পেলেন। ফাইনাল পরীক্ষায় ‘লাস্ট’ হয়েছিলেন।

দু-বছর ধরে ফিজিক্স পড়ানোর চাকরি খুঁজে ব্যর্থ আইনস্টাইন অবশেষে বার্ন-এর এই বাড়ির তিন তলায় একটি সুইস পেটেন্ট অফিসে ‘থার্ড ক্লাস প্রভিশনাল টেকনিকাল এক্সপার্ট’-এর চাকরি জোগাড় করেন।

১৯ বছর বয়েসে সহপাঠিনী মিলেভার প্রেমে পড়লেন আইনস্টাইন। পাঁচ বছর পরে বিয়ে করলেন, অবশেষে চাকরি পাওয়ার পরেই। ১৯০৪-এ তাঁদের পুত্র সন্তান, হ্যান্স অ্যালবার্টের জন্ম।

বার্ন-এ দু-কামরার এই অতি সাধারণ ফ্ল্যাটে থাকতেন বউ আর ছেলেকে নিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। এখন সেখানে সুইস সরকারের আয়োজনে তৈরি হয়েছে আইনস্টাইন মিউজিয়াম।

১৯০৪ সাল। আইনস্টাইন ২৫। সুইস পেটেন্ট অফিসে দিনে আট ঘণ্টা কাজ করেন। সপ্তায় ছ’দিন। আর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ছেলেকে দোলনায় দোলাতে-দোলাতে রিসার্চ করেন তেলের ল্যাম্পের আলোয়। এক বছর পরে, ১৯০৫-এ পাঁচটি পেপার প্রকাশ করলেন আইনস্টাইন। বিংশ শতকের ফিজিক্সে তাঁর অন্তত তিনটি পেপার ঘটাল বিপ্লব।

এক দশক ধরে আইনস্টাইনের নাম ক্রমাগত মনোনীত হল নোবেল প্রাইজের জন্য। ১৯২১ সালে অবশেষে নোবেল প্রাইজ পেলেন তিনি ফটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট-এর সূত্রাবলী আবিষ্কারের জন্য। দ্য নোবেল কমিটি সেই উপলক্ষে এই ছবিটি প্রকাশ করে।

সারা বিশ্বজুড়ে আমন্ত্রিত হতেন আইনস্টাইন ভাষণ দেওয়ার জন্য। ছবিতে ভিয়েনায় ভাষণ দিচ্ছেন তিনি।

কোনও ভাবনায় আটকে গেলে কিছুক্ষণ মানসিক বিশ্রামের জন্যেই শুধু আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন না। বাজাতেন কোনও কোনও সামাজিক বা ‘পাড়ার’ অনুষ্ঠানেও বা তাঁর বাড়িতে ক্রিসমাস ক্যারোলাররা হঠাৎ চলে এলে তাঁদের সঙ্গেও বাজাতেন।

১৯৩০ সালে আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ। তাঁদের প্রতিটি আলাপচারিতাই ছিল নম্র, গভীর, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে হয়তো এইসব সাক্ষাৎকারের সঠিক বর্ণনা বোধহয়— ‘নন্‌-মিটিং অফ টু মাইন্ডস’।

দ্বিতীয় স্ত্রী এলসার সঙ্গে বোটে। ১৯১৯ সালে স্বামীপরিত্যক্তা এলসা-কে বিয়ে করেন আইনস্টাইন। সেই বছরের প্রথমদিকে আইনস্টাইনেরও বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে। এলসা অ্যালবার্টের আত্মীয় মা এবং বাবা, দু’দিক থেকেই। এলসা অ্যালবার্টের নিজের মাসতুতো বোন। আবার অ্যালবার্টের বাবা আর এলসার বাবা ছিলেন ‘তুতো’ ভাই।

১৯৩১ সালের এই ছবিতে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বেশ অন্যরকম— তাঁর সেই আলুথালু, অগোছালো রূপটি এখানে নেই।

১৯৪০ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন গ্রহণ করছেন মার্কিন নাগরিকত্ব। তবে হয়তো স্মৃতিমেদুর হয়েই তিনি সুইস নাগরিকত্বও রেখেছিলেন।

১৯৫৫ সালে মৃত্যু পর্যন্ত আইনস্টাইন প্রিন্সটনের এই সাধারণ বাড়িতেই থাকতেন। ১৯৩৬ সালে তাঁর স্ত্রী আকস্মিক মারা গেলেন। জীবনের শেষ ১৯ বছর একাই কাটালেন আইনস্টাইন— যদিও তাঁকে ঘিরে ছিল নিকট আত্মীয়বৃত্ত।

১৯৪৭: আইনস্টাইন ৬৮। প্রায়ই ভাষণ দিতেন তিনি, কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে নয়। এখনও তিনি চলেছেন তাঁর স্বপ্নের পিছনে। সেই স্বপ্ন হল, প্রকৃতির শক্তিগুলিকে একসূত্রে বাঁধা।

সঞ্চালিকা বলতে লাগলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে নিয়ে কত যে গল্প শুনেছি আমরা! সেইসব গল্পের কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, কেউ জানি না। শুধু এইটুকু নিশ্চিতভাবে জানি, তিনি অন্যমনস্ক অধ্যাপকের আদর্শ উদাহরণ। তিনি বিজ্ঞানের চিন্তায় সারাক্ষণ ডুবে থাকেন। তাই তিনি অন্য কাজ ভুলে যান। যেমন নাকি, তিনি একবার একটা পার্টিতে তাঁর বন্ধুদের নেমন্তন্ন করলেন। কিন্তু তিনি অপেক্ষাই করছেন। কেউ আসছে না। আরে, আসবে কী করে? তিনি যে বন্ধুদের কার্ড পাঠাতে ভুলে গেছেন!

তাঁর ডিম সেদ্ধ করার গল্পও আমরা অনেকে শুনেছি। ডিমটি হাতে ধরে আছেন। আর অন্যমনস্কভাবে ফুটন্ত জলে ফেলে দিয়েছেন হাতের ঘড়ি। তিনি নাকি নিজের হোটেলেও কখনও কখনও পথ চিনে ফিরতে পারেননি। পথ ভুলে বিভ্রাটে পড়েছেন।

আরও এক গল্প, একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাচ্ছেন আইনস্টাইন। যাওয়ার পথে স্ত্রীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আমি? আর কোথায় বা যেতে হবে? আর একদিন ট্যাক্সি করে প্রিন্সটনে যাচ্ছেন নিজের বাড়ি। বাড়ির কাছে গিয়েও বুঝতে পারছেন না কোন বাড়িতে ঢুকতে হবে। কারণ বাড়ির নম্বর ভুলে গেছেন। কী উপায়? বুদ্ধি করে ট্যাক্সিওলাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানেন কোথায় থাকেন আইনস্টাইন? ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, সেটা কে না জানে? সমস্যার সমাধান!

আর পাশের ফ্ল্যাটের এক ছোট্ট মেয়ে যে তাঁকে দিয়ে স্কুলের অঙ্ক করিয়ে নিত— সে-গল্প আমরা কে না জানি। কেন সেই একরত্তি মেয়ের অঙ্ক করে দিতেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন?

সেই খুদে মেয়ে যে বাড়ি থেকে আচার চুরি করে এনে আইনস্টাইনকে খাওয়াত!

সঞ্চালিকার শেষ কথায় হেসে ফেললেন আইনস্টাইন। তিনি এতক্ষণ সকৌতুকে সঞ্চালিকার কথা শুনছিলেন।

সঞ্চালিকা এবার সরাসরি তাকালেন আইনস্টাইনের দিকে। বেশ নাটকীয় মুহূর্ত। প্রেক্ষাগৃহ হঠাৎ এমনই নিস্তব্ধ যে যেন আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে।

সবাই অপেক্ষা করছে, সঞ্চালিকা কী প্রশ্ন করবেন আইনস্টাইনকে? সঞ্চালিকার প্রশ্নটি খুবই সাধারণ— অন্তত আপাতভাবে। সঞ্চালিকা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জন্ম থেকেই অনন্য, অসাধারণ?

আইনস্টাইন তখুনি কোনও উত্তর দিলেন না। যেন তিনি আরও কিছু শুনতে চান সঞ্চালিকার কাছে।

না কি, তিনি অন্যমনস্ক? সঞ্চালিকার কথা হয়তো তিনি শুনতেই পেলেন না?

সঞ্চালিকা আবার বলতে শুরু করলেন— ১৮৭৯-র ১৪ মার্চ। জার্মানির ছোট্ট শহর Ulm-এ জন্মালেন এই মানুষটি, আইনস্টাইনের দিকে তাকালেন সঞ্চালিকা। এই সেই মানুষ যিনি সম্পূর্ণ বদলে দিলেন আমাদের ভুবনভাবনা। আমাদের বিশ্ববীক্ষণে নিয়ে এলেন নতুন মাত্রা। হেরম্যান আর পলিন কছ্-এর পুত্র অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

বাবা-মা তো সদ্যোজাত পুত্রটির দিকে তাকিয়ে ভয় পেলেন। কেন? কারণ পুত্রটির মাথা তার দেহের তুলনায় বেশ বড় এবং ট্যারাবাঁকা।

এইরকম মাথা নিয়ে জন্মানো ছেলে কি মানসিকভাবে সুস্থ হবে? এই ভয় বাবা-মায়ের মন থেকে কিছুতেই গেল না।

অ্যালবার্ট একটু একটু করে বড় হল। এবার তো তার মুখে কথা ফোটার সময়।

কিন্তু সে একটিও কথা বলে না।

বাবা-মা নিশ্চিত অ্যালবার্টের মাথা ঠিকভাবে কাজ করছে না। অন্য শিশুদের চেয়ে তার বুদ্ধি কম। তাই নেওয়া হল ডাক্তারের মতামত।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মুচকি হেসে সঞ্চালিকার দিকে তাকালেন। তার ভাবটি এমন— বাঃ, মেয়েটি তো তাঁর সম্পর্কে বেশ জেনেশুনে, হোমওয়ার্ক করেই এসেছে।

শ্রোতা-দর্শকেরা মনে মনে ভাবল নাটক বেশ জমে উঠেছে। সবাই একাগ্র হয়ে শুনছে।

সঞ্চালিকা বলতে লাগলেন— ইতিমধ্যে অ্যালবার্টের একটি বোন হয়েছে। ডাকনাম মায়া (Maja)।

মায়া কী লিখেছেন জানেন? লিখেছেন— A sound skull is needed to be the sister of a thinker! ভাবুকের বোন হতে গেলে একটি বেশ শক্ত খুলির প্রয়োজন। কেন? কেন আবার, অ্যালবার্ট একে কথা বলতে পারত না, তার ওপর যা কিছু হাতের কাছে পেত ছুড়ে মারত বোনের মাথা লক্ষ্য করে!

আমরা কি ভাবতে পারি এহেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সত্যিই একদিন তাঁর অসামান্য বৈজ্ঞানিক প্রতিভার জোরে সম্পূর্ণ পালটে দেবেন আমাদের বিশ্বচেতনা?

কেমন ছাত্র ছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন?

প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন সঞ্চালিকা। শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নিজের ভাবনায় ডুবে আছেন। তাঁর মুখ দেখে ঠাওর হয় না তিনি ঠিক কী ভাবছেন।

নাটকীয়ভাবে কিছুক্ষণ থামলেন সঞ্চালিকা। প্রশ্নটিকে থিতিয়ে যেতে দিলেন দর্শকদের মনে।

তারপর বললেন, আমি আর এখন একটি কথাও বলব না, এই প্রশ্নের উত্তর আপনারা শুনুন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মুখ থেকে।

সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ। সব আলো নিভে গেছে। শুধু একটা আলোকবৃত্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের উপর। সেই আলোর মধ্যে তিনি উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, সবার মধ্যে তিনি আলাদা, অনন্য, স্বতন্ত্র।

তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, শুভসন্ধ্যা।

শব্দটি তাঁর মুখে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তুমুল করতালি। হাততালি থামতেই শুরু করলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

কেমন ছাত্র ছিলাম আমি?

আপনারা অনেকে এই প্রশ্নটির উত্তর জানতে চান, আমি জানি। এক কথায় এ-প্রশ্নের উত্তর কী করে দিই বলুন তো?

ছাত্র হিসেবে আমি ছিলুম ভালমন্দ মেশানো। অনেকেই যেমন হয় আর কী। খুব আলাদা কিছু নয়।

আমি অঙ্ক আর বিজ্ঞান ভালবাসতাম। ওই দুটোতে ভাল ছিলাম।

অসাধারণ ছাত্র বলতে যা বোঝায় আমি কিন্তু তা ছিলাম না। আমার বাবা আমার স্কুলের হেডমাস্টারকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার কোন প্রফেশনে যাওয়া উচিত। হেডমাস্টার বাবাকে বললেন, অ্যালবার্ট যে-কোনও প্রফেশনে যেতে পারে। কিন্তু ও যাই করুক, কোনওদিন কোনও কাজেই সফল হবে না।

শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে হাসির ঢেউ উঠল। কৌতুকের ঝিলিক খেলে গেল এ-যুগের মহত্তম বিজ্ঞানী, সফলতম ভাবুক অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চোখে।

আর একটি স্পট-লাইট এসে পড়ল সঞ্চালিকার উপর। আলোকবৃত্তে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে।

তিনি প্রশ্ন করলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে, বিজ্ঞানে আপনার আগ্রহ শুরু কবে থেকে?

আইনস্টাইন নাটকীয়ভাবে উত্তর দিলেন— আমার জীবনের প্রথম মিরাকল ম্যাগনেটিজম-এর সঙ্গে পরিচয়। আমার সঙ্গে বিজ্ঞানের ভালবাসার সম্পর্কের সূত্রপাত সেই থেকেই।

সঞ্চালিকা বিস্মিত— মিরাকল! কেমন মিরাকল?

আইনস্টাইন উত্তর দিলেন— আমার বয়েস তখন চার-পাঁচ হবে। বাবা তখন আমাকে একটা কম্পাস এনে দিলেন। কম্পাসের কাঁটাটা সব সময়ে উত্তর দিকে ঘুরে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! কেন! আমি তো অবাক। এটাই আমার জীবনে প্রথম মিরাকল।

সঞ্চালিকা বললেন— তারপর?

উত্তরে আইনস্টাইন বললেন— তারপর আর কী! সেই চার-পাঁচ বছর বয়সেই আমার মনে হয়েছিল, কোনও লুকনো শক্তি কম্পাসের কাঁটাটাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। আমি ক্রমশ বুঝতে পারলাম এই শক্তিকে বোঝবার একমাত্র উপায় বিজ্ঞান।

সঞ্চালিকা জানতে চাইলেন— ছেলেবেলায় বিজ্ঞান ছাড়া আপনার আর কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না? খেলাধুলো?

ওরে বাবা! খেলতে আমার একদম ভাল লাগত না। আমার ক্লাসের বন্ধুরা এইজন্যে আমাকে অদ্ভুত বলে ভাবত আর খ্যাপাত।

তা হলে বিজ্ঞান ছাড়া আর কী ভালবাসতেন? প্রশ্ন করলেন সঞ্চালিকা।

সংগীত।

সংগীত! কী ধরনের সংগীত?

অবশ্যই ক্লাসিকাল। এগারো-বারো বছর বয়েসেই আমি বেঠোভেন-মোৎসার্ট-এর সোনাটা বাজাতে পারতাম। বেহালায়।

সঞ্চালিকা কিছুক্ষণ থামলেন। সবাইকে অবাক হওয়ার সময় দিলেন। তারপর মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন— আপনার জীবনে প্রথম মিরাকলের কথা আপনি বলেছেন। আপনার জীবনে কোনও সেকেন্ড মিরাকল তা হলে আছে। তাই তো?

আইনস্টাইন সঞ্চালিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি শুধু সুন্দরী নন, আপনি বুদ্ধিমতীও। হ্যাঁ, আমার জীবনে অবশ্যই আছে সেকেন্ড মিরাকল।

আমরা কেউ বিশেষ জানি না আপনার জীবনে এই সেকেন্ড মিরাকলের কথা। জানাবেন?

আমার জীবনে সেকেন্ড মিরাকল ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি।

জ্যামিতি!

ঠিক তাই। এই আশ্চর্য ঘটনা আমার জীবনে ঘটল ঠিক বারো বছর বয়সে।

তারও নিশ্চয় একটা গল্প আছে, বললেন সঞ্চালিকা।

অবশ্যই। এই গল্প আমার জীবনে নিয়ে আসে ম্যাক্স।

কে এই ম্যাক্স?

খুব গরিব এক পোলিশ ছাত্র। মিউনিখে লেখাপড়া করত। ম্যাক্স একদিন আমাকে ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রির বইটা উপহার দেয়। তখন আমার বয়েস মাত্র বারো।

মিরাকলটা কী করে ঘটল?

বারো বছর বয়সে আমার পরিচয় ঘটল বিশুদ্ধ ভাবনার জগতের সঙ্গে। সেইটেই তো মিরাকল। কোনও দামি যন্ত্র বা লেবরেটরির সাহায্য ছাড়াই আমি এখন কিছু জাগতিক সত্যকে গভীরভাবে বুঝতে পারার পথ খুঁজে পেলাম— শুধুমাত্র আমার বোধবুদ্ধির শক্তি দিয়ে। এইটা তো মিরাকল।

আইনস্টাইন থামলেন। সঞ্চালিকাও নীরব। শ্রোতা-দর্শকেরা উদ্‌গ্রীব পরের প্রশ্নের জন্যে। তাঁরা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে একেবারে নতুনভাবে জানছেন।

সঞ্চালিকা খুব ধীরে নাটকীয়ভাবে প্রশ্ন করলেন, আপনি স্কুল পালিয়েছিলেন কেন?

আইনস্টাইন— আমাকে আমার শিক্ষকেরা অপছন্দ করতেন। আমিও তাদের অপছন্দ করতাম।

সঞ্চালিকা— আর কোনও কারণ?

আইনস্টাইন— আরও একটা কারণ, জার্মানিতে থেকে স্কুলে পড়লে আমাকে প্রাশিয়ান আর্মিতে মিলিটারি ডিউটি করার জন্যে পাঠানো হতই। এটা ছিল আমার রুচির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে।

সঞ্চালিকা— কীভাবে স্কুল পালালেন?

আইনস্টাইন— তাও বলতে হবে? একটি মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

সঞ্চালিকা— কী মিথ্যে?

আইনস্টাইন— আমাদের পারিবারিক ডাক্তারকে বললাম একটা নোট লিখে দিতে, যাতে বলা হল আমি যদি বাবা-মায়ের কাছে ফিরে না যাই আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে।

শ্রোতা-দর্শকেরা এবং সঞ্চালিকা সবাই আইনস্টাইনের কথায় হেসে উঠলেন।

সঞ্চালিকা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, স্কুল পালিয়ে বাবা-মায়ের কাছে যখন ফিরে গেলেন, তাঁরা কী বললেন?

তাঁরা অসহায়ভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এই ড্রপ-আউট ছেলেকে নিয়ে তাঁরা কী করবেন? তাঁরা বুঝলেন, আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে হাসি।

সঞ্চালিকা— আপনার দিক থেকে কিছু বলার ছিল না?

আইনস্টাইন— অবশ্যই ছিল। আমি বললুম আমি সুইত্জারল্যান্ডে জুরিখ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়তে যাব। সেখানেই পাঠাতে হবে আমাকে।

সঞ্চালিকা— তারপর?

আইনস্টাইন— তারপর খুব সিম্পল। এন্ট্রাস পরীক্ষায় ফ্রেঞ্চ, কেমিস্ট্রি, বায়োলজিতে ফেল করলাম।

দর্শক শ্রোতারা হাসতে লাগলেন। সঞ্চালিকাও না হেসে পারলেন না।

সঞ্চালিকা— তবু ভরতি হলেন কী করে?

আইনস্টাইন— অঙ্ক আর ফিজিক্সে এমন ভাল করলাম যে তার জোরেই ভরতি হয়ে গেলাম। কিন্তু পরের বছরে, আরও কিছু পড়াশোনার পর।

সঞ্চালিকা: আপনার জীবনে কোনও থার্ড মিরাকল?

আইনস্টাইন: আমার প্রথম প্রেম।

সবাই নীরব। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর জীবনে প্রথম প্রেমের কথা সত্যি বলবেন?

আইনস্টাইন ঘড়ি দেখলেন। ঘড়ি দেখলেন সঞ্চালিকা নিজেও। তাকালেন আইনস্টাইনের দিকে।

আমার প্রথম প্রেমের গল্প আর একদিন হবে। আজ থাক। ধীরে ধীরে মঞ্চ চলে গেল পরদার আড়ালে। জ্বলে উঠল প্রেক্ষাগৃহের আলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *