হ্যালোউইন পার্টি

হ্যালোউইন পার্টি 

কতক্ষণ দৌড়াচ্ছি খেয়াল নেই। হৃৎপিণ্ডটা মনে হচ্ছে যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। একটা আশ্রয় দরকার। একটা নিরাপদ আশ্রয়। এমন আশ্রয় যেখানে অনেক লোক থাকবে। এমন আশ্রয় যেখানে আমি অনায়াসে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবো ওদের হাত থেকে। ওরা আমায় বাঁচতে দেবে না। উফ্ ঈশ্বর! আমাকে সাহায্য করো। 

মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম – Our father in heaven – holy be your name-your kingdom come-your will be done on earth as in heaven… do not bring us to the test – but deliver us from evil. 

প্রার্থনার শেষে amen বলার আগেই চোখে পড়ল বাড়িটা। চারিদিকের মৃত্যুপুরীর অন্ধকারের মাঝে একতলা বাড়িটা ঝলমল করছে আলোয়। আমার প্রাণে একটু ভরসা পেলাম। ওই তো। কাচের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রং-বেরঙের পোশাক পরা মানুষজন মেতে উঠেছে আনন্দে। মনে হচ্ছে কোনও পার্টি চলছে। ওঃ! হঠাৎ মনে পড়ল, আজ তো হ্যালোউইন। এই নিঃশব্দ নগরীতে এসে ভুলেই গিয়েছিলাম সারা পৃথিবী আজকে মেতে উঠেছে উৎসবে। একটু মন খারাপ হল বটে, কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ঢুকে পড়তে হবে ওই মানুষগুলোর মধ্যে। যাতে ওরা আমাকে খুঁজে না পায়। খুঁজে পেলেও এত মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই আক্রমণ করার সাহস করবে না ওরা। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে আছড়ে পড়লাম বন্ধ দরজার ওপর। কয়েক মুহূর্তের প্রতীক্ষা। আমি বারবার পিছনে তাকাচ্ছি আর দরজা ধাকাচ্ছি। অকস্মাৎ খুলে গেল দরজা। আমি কোনওদিকে না তাকিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। 

টের পেলাম আমার পিছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। এবার পিছনে ফিরে দেখলাম একঘর লোক অবাক হয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। না একটু ভুল বললাম। অবাক ভাবটা তাদের দৃষ্টিতে নয়, তাদের দাঁড়াবার কায়দায়। কারণ তারা সবাই কোনও না কোনও মুখোশে মুখ ঢেকেছে। খুব স্বাভাবিক। হ্যালোউইন পার্টিতে সবাই এভাবেই সাজে। ভেড়া, গরু, কুকুর, ঘোড়া, নেকড়ে ইত্যাদি মুখোশে সবার মাথা থেকে গলা সম্পূর্ণ ঢাকা। পোশাকেও বিচিত্র রঙের বাহার। একটু অস্বস্তি হলেও সবার দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানালাম। আরও কয়েকজন ভিতর থেকে এসে অন্যদের পিছনে দাঁড়াল। লক্ষ্য করলাম ঘরের ভিতরটা অস্বাভাবিক শান্ত। পার্টিতে এমন হওয়ার কথা নয়। কোনও গান বাজনা চলছে না, এমনকি নিজেদের মধ্যে কেউ কোনও কথাও বলছে না। শুধু দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে। মুখোশের আড়াল থেকে ওদের জোড়া জোড়া চোখগুলো আমাকে কেমন ঠান্ডা অনুভূতি দিচ্ছিল। একটু অপরাধবোধ হল। আমি এসে এদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটিয়েছি। আমি বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলাম। তারপর বললাম, ‘আমি আজ রাতটুকু শুধু আশ্রয় চাই। কাল ভোরেই আমি চলে যাব।’ 

আমার কথা শুনে তারা একে একে আবার ফিরে যেতে শুরু করল বড়ো বলরুমে। আবার নাচ শুরু হল। একে অপরের মুখোমুখি দুলে দুলে নাচতে লাগল গরু, ভেড়া, নেকড়ের দল। আমি একটু আশ্বস্ত হলেও কোথায় যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য আমার একটু পানীয় দরকার ছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজার পাশের সেলারে দেখতে পেলাম নানা ধরনের পানীয়ের সম্ভার। একটু ইতস্তত করলেও উঠে গেলাম সেখানে। একটা গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢেলে নিয়ে আবার গিয়ে বসলাম সোফায়। 

দু-চুমুক ওয়াইন পানের পরও অস্বস্তি কাটছে না দেখে একটু সচেতন হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম। হঠাৎ করেই বুঝে ফেললাম অস্বস্তির কারণটা। সারা বাড়ি জুড়ে এই যে এতগুলো লোক একে অপরের সঙ্গে তালে তালে নেচে চলেছে, তা সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। অর্থাৎ কোথাও কোনও গান বাজনা কিচ্ছু নেই, কারো মুখে কোনও কথা নেই। শুধু ঘরভর্তি লোক দুলে দুলে নাচছে। আমার গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। মাথার ভিতর কেউ একটা বলে উঠল কোথাও কিছু গোলমাল আছে। অথচ এখান থেকে বেরিয়ে যাব কোথায়? বাইরেও তো বিপদ। ওরা আসছে আমার খোঁজে। 

পায়ে পায়ে উঠে বলরুম থেকে ভিতরের ঘরের দিকে এগোলাম। করিডর দিয়ে হেঁটে গেলে দু-পাশে ঘর। বলরুমে যত আলো, ভিতরে ততই কম আলো জ্বলছে। 

নাইটবাশ্বের আলোয় করিডরের সাজসজ্জা মোটামুটি বোঝা গেলেও ঘরের ভেতরে অন্ধকার। পাশাপাশি দুটো ঘর। প্রথম ঘরের কারুকাজ করা লেসের পরদা সরিয়ে উঁকি মারলাম। প্রথমটায় অন্ধকারে কিছু দেখতে পেলাম না। তারপর আস্তে আস্তে চোখ সয়ে গেলে বুঝলাম বিছানায় পুরু গদিতে গায়ে লেপ চাপা দিয়ে কেউ শুয়ে আছে। 

আমি দরজার পাশের দেওয়াল হাতড়ে আলোর সুইচ খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও গেলাম। একটামাত্র সুইচ। সেটা জ্বালাতেই ঘর ভরে উঠল লাল আলোয়। এরকম ভৌতিক আলোয় সারা ঘরটাই যেন অপার্থিব লাগতে শুরু করল। ঘরের দেওয়াল বেয়ে যেন নামছে রক্তের স্রোত। সিলিং থেকে, মেঝেয় সর্বত্র রক্তের মতো ঘন কালচে লাল রং। আমি তাকিয়ে দেখলাম বিছানায় শোয়া ব্যক্তি কোনও মহিলা। তার সোনালী কোঁকড়া চুল লেপের বাইরে এলিয়ে রয়েছে বালিশের ওপর দিয়ে। কৌতূহল হল খুব। যে বাড়িতে হ্যালোউইন পার্টি চলছে, সে বাড়িতে একজন এমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে! খাটের পাশ ঘুরে শোয়া মেয়েটির মুখ দেখবো বলে সামনে গেলাম। কিন্তু সেখানেও সোনালী 

চুল মুখ আড়াল করে রেখেছে। আমি আস্তে আস্তে তার গা থেকে লেপের আবরণ নামাতে চাইলাম। কিছুটা নামতেই আমার বুকের রক্ত চলকে উঠল। লেপের নীচে কিচ্ছু নেই। কোনও দেহ না, কিচ্ছু না। ও… ওটা একটা মুণ্ডু! একটা কাটা মুণ্ডু। গলার ছিন্ন অংশ থেকে রক্ত বয়ে লেপের নীচে হালকা রঙের চাদর লাল হয়ে গেছে। নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে পিছিয়ে এলাম। এ আমি কোথায় এসে পড়লাম। এক ছুটে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। পাশেই আরও একটা ঘর। আতঙ্কে আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। তবু পায়ে পায়ে ঢুকলাম ঘরটায়। এ ঘরেও ঘন লাল আলো জ্বলছে। প্রায় পুরো ঘরটাই কাচের শোকেসে ঘেরা। আর সেগুলোর মধ্যে থরে থরে সাজানো… মানুষের মাথা। একটা উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বুঝলাম এগুলো সংরক্ষণের জন্য কোনও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছে, যার গন্ধ আমি পাচ্ছি। এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। গলা চিরে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। পালানোর পথ খুঁজতে হবে। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না। ওখানে সেই তাদের অদ্ভুত পার্টি চলছে, যারা ঘরের ভিতরে কাটা মুণ্ডু সাজিয়ে রেখে উৎসবে মাতে। কাজেই ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে এগিয়ে গেলাম পিছনের দরজার খোঁজে। একটু এগিয়ে পেয়েও গেলাম। কিন্তু দরজায় তালা লাগানো। আমি মরিয়া হয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলাম। দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া আলমারির পাল্লা ধরে টান দিতেই খুলে গেল। ভিতরে নানা ধরনের অস্ত্র সাজানো। ইলেকট্রিক করাত থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো চপার, আরও নানা মাপের ও নানা ধরনের অস্ত্র। একটু কেঁপে উঠলাম। নিঃসন্দেহে ঘরের ভিতরে যাদের মুণ্ডু রাখা, সেইসব হতভাগ্যদের হত্যা করতে এসব অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এসব ভাবলে চলবে না। আমি একটা বড়ো হাতুড়ি টেনে নিলাম। তারপর দরজার তালার উপর গায়ের জোরে মারলাম বাড়ি। প্রচণ্ড আওয়াজ করে তালাটা খসে পড়ল মেঝেয়। জানতাম এই শব্দ আমার হোস্টদের আকৃষ্ট করবে। তাই মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম পথে। একবার পিছনে ফিরে দেখলাম যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। একে একে সেই গরু ভেড়া কুকুর ঘোড়া নেকড়ের দল বেরিয়ে আসছে বাড়ি থেকে। তাদের হাতে চকচক করছে ধারালো অস্ত্রের ফলা। আমি দৌড়তে লাগলাম। কোন দিকে দৌড়োচ্ছি খেয়াল নেই শুধু প্রাণপণে দৌড়ে চলেছি। 

.

…কতক্ষণ দৌড়াচ্ছি খেয়াল নেই। হৃৎপিণ্ডটা মনে হচ্ছে যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে। একটা আশ্রয় দরকার। একটা নিরাপদ আশ্রয়। এমন আশ্রয় যেখানে অনেক লোক থাকবে। এমন আশ্রয় যেখানে আমি অনায়াসে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবো ওদের হাত থেকে। ওরা আমায় বাঁচতে দেবে না। উফ্ ঈশ্বর! আমাকে সাহায্য করো। 

মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম- “Our father in heaven – holy be your name-your kingdom come-your will be done on earth as in heaven… do not bring us to the test – but deliver us from evil. 

প্রার্থনার শেষে amen বলার আগেই চোখে পড়ল বাড়িটা। চারিদিকের মৃত্যুপুরীর অন্ধকারের মাঝে একতলা বাড়িটা ঝলমল করছে আলোয়। আমার প্রাণে একটু ভরসা পেলাম। ওই তো। কাচের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রং-বেরঙের পোশাক-পরা মানুষজন মেতে উঠেছে আনন্দে। মনে হচ্ছে কোনও পার্টি চলছে। ওঃ, হঠাৎ মনে পড়ল, আজ তো হ্যালোইন। এই নিঃশব্দ নগরীতে এসে ভুলেই গিয়েছিলাম সারা পৃথিবী আজকে মেতে উঠেছে উৎসবে। একটু মন খারাপ হল বটে, কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ঢুকে পড়তে হবে ওই মানুষগুলোর মধ্যে। যাতে ওরা আমাকে খুঁজে না পায়। খুঁজে পেলেও এত মানুষের মধ্যে নিশ্চয়ই আক্রমণ করার সাহস করবে না ওরা হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে আছড়ে পড়লাম বন্ধ দরজার ওপর। কয়েক মুহূর্তের প্রতীক্ষা। আমি বারবার পিছনে তাকাচ্ছি আর দরজা ধাক্কাচ্ছি। অকস্মাৎ খুলে গেল দরজা। আমি কোনওদিকে না তাকিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ..and the cycle continues… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *