হ্যালুসিনেশন

হ্যালুসিনেশন

—“ডক্টর… আমি কি বেঁচে আছি?”

প্রশ্নটা শুনে ডাক্তারবাবুর ভুরুতে সামান্য ভাঁজ পড়ল।

মাথার উপরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। তাতে সামনের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও তার অস্পষ্ট ছায়া ছায়া অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল। নাকের উপর ভারি চশমার কাচ ওই আধা আলো আধা অন্ধকারেই চকচক করে উঠছে। মুখের চাপদাড়ির জঙ্গল বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছিল না।

মনস্বত্ববিদের ঘর যেমন হয়, এ ঘরটাও তেমনই। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। ডাক্তারবাবু টেবিলের ও প্রান্তে বসে আছেন, আর রোগি এ প্রান্তে। কাউকেই বিশেষ স্পষ্ট দেখার উপায় নেই। শুধু দেওয়ালে দুটো ক্ষীণ ছায়া মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে।

ডক্টর সিন্‌হা প্রশ্নটায় বেশ কৌতুকবোধ করলেন। আস্ত একটা জলজ্যান্ত লোক জিজ্ঞাসা করছে যে সে বেঁচে আছে কি না!

—“এমন মনে হচ্ছে কেন আপনার?”

লোকটা যেন একটু ইতস্তত করল। একটু উশখুশ করে উঠে বলল, “একটা সিগ্রেট খেতে পারি?”

এখানে ধূমপান মানা হলেও লোকটার অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবুর দয়া হয়। অসম্ভব ভয়ে সে জড়োসড়ো! গলার স্বর কাঁপছে! একটু যেন ফ্যাসফ্যাসেও!

—“নিশ্চয়ই,”

সে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগ্রেট ধরাল। হাত দুটোও থরথর করে কাঁপছে লাইটার জ্বালাতেই ডাক্তারবাবু তার চোখ দুটো একঝলক দেখতে পেলেন। কালো কুচকুচে চোখ। যেন অন্ধকার জমে আছে চোখে! একবারের জন্য যেন মনে হল, লোকটার চোখের মণিটা নেই!

মুহূর্তের জন্য হলেও চমকে উঠেছেন তিনি। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়েছেন। নাঃ, হয়তো লাইটারের সামান্য আলোয় তার চোখের ভুল হয়েছে। একটা স্বাভাবিক মানুষের চোখ এমন হতেই পারে না।

একেই বলে ইল্যুশন!

লোকটা সিগ্রেটে উত্তেজিত কয়েকটা টান মেরে যেন একটু শান্ত হয়। বলে,

—“ডক্টর, আপনি একটু দেওয়ালের দিকে তাকাবেন প্লিজ?”

এমন উদ্ভট আবদারে তিনি অবাক ও বিরক্ত দুই-ই হলেন। কিন্তু মনস্ত্বত্ববিদের চটে যাওয়ার উপায় নেই।

—“কেন?”

সে ফিসফিস করে বলে, “দেখুন তো দেওয়ালে ক-টা ছায়া দেখা যাচ্ছে?”

—“আপনি নিজেই তো দেখে নিতে পারেন…”

—“আমার ভয় করছে,” অসম্ভব ভীত, সন্ত্রস্ত গলা তার, “বলুন না। ক-টা দেখা যাচ্ছে?”

তিনি আরও অবাক, “সে কী! ক-টা আবার দেখা যাবে! দু’জন আছি, তা-ই দুটোই দেখা যাচ্ছে!”

—“তিনটে নয় তো?”

—“তিনটে! তিনটে কেন থাকবে?”

লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, “থ্যাঙ্কস। তাহলে তিনটে নেই…”

এবার বোধহয় ডক্টর সিন্‌হা ভদ্রলোকের বিষয়ে কৌতূহল বোধ করলেন। লোকটার হাবভাব কেমন যেন উদ্ভট! ত্রিশ বছরের কেরিয়ারে অনেক উদ্ভট রোগির দেখা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এমন রোগি দেখেননি। ওকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিলেন। তারপর আলতো গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,

—“কী হয়েছে আপনার? কী সমস্যা?”

— “বলব,” সে আস্তে আস্তে বলে, “বলব বলেই তো এসেছি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।”

—“কোথায়?”

লোকটা এবার অদ্ভুতভাবে তাকায় তার দিকে। ডাক্তারবাবুর মনে হল লোকটার চোখ যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল,

—“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন তো?”

—“কেন করব না?”

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তবে শুনুন, আমার নাম তপন মিশ্র। আমিও একজন ডাক্তার! সার্জেন। হেলথ কেয়ার নার্সিংহোমটা আমারই…।”

ড. তপন মিশ্রের কথা :

—“সেদিন রাত্রে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি! মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে! এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং!

আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলাম। ঘুম আসেনি। পাশেই আমার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না। কী যেন অস্বস্তি কাজ করছিল মনের মধ্যে। আমার বেডরুমের জানলার কাচে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের নীল আলো ঝলসে ঝলসে উঠছে। বাইরে যেন একটা নীল কুয়াশা কখন আস্তে আস্তে এসে জমাট বাঁধছিল। বৃষ্টির জলটাকেও যেন নীল মনে হয়।

ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। তখন সেটার ও প্রায় ফুরিয়ে আসার সময় হয়েছে। নীল শিখাটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই একটু একটু করে ক্ষীণ রশ্মিটুকুও মুছে যাচ্ছিল।

মোমবাতিটা যখন প্রায় নিবতেই চলেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই, একদম স্তিমিত আলোয় হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে!

অসম্ভব! কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না! চোখের সামনে কেউ নেই! অথচ দেওয়ালে ওটা তবে কার ছায়া!”

আখ্যানের শুরুতেই ড. তপন মিশ্র ঘেমে উঠলেন। সামনের গ্লাস থেকে একচুমুক জল খেলেন। ড. সিন্‌হা তাকে সময় দেওয়ার জন্যই হয়তো নিজেও একটা সিগ্রেট ধরালেন।

একটু দম নিয়েই ফের বলতে শুরু করলেন ড. মিশ্র,

—“সন্দেহ হল চোর-টোর ঢুকল কি না। ঘরে দামি জিনিস মানে, দামি ফার্নিচার তো আছেই। এছাড়াও গিন্নীর কিছু গয়না আর ক্যাশ কিছু টাকা ছিল।

বিছানার পাশেই একটা বন্দুক থাকে। লাইসেন্সড। নিজের সেফটির জন্যই রেখেছি। পয়সাওয়ালা ডাক্তার মানেই তার শত্রুর শেষ নেই। চোর-ডাকাতরা প্রায় টার্গেট করেই বসে থাকে। দুষ্কৃতকারীরাও আজকাল খালি হাতে আসে না। তাই এই ব্যবস্থা।

বন্দুক আর টর্চ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ঠিক তখনই মোমবাতিটা দপ্ করে একবার জ্বলে উঠে নিবে গেল।

জমাট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়! হাতেই টর্চটা ছিল। জ্বালাতে পারতাম। কিন্তু তার আগেই মনে হল, আমার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! তার গরম নিশ্বাস আমার গায়ে এসে পড়ছে! মনে হল অন্ধকারের মধ্যেও একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে!

— ‘কে?’

টের পেলাম নিজের গলাই কাঁপছে! টর্চ জ্বালানোর সাহসও পাচ্ছি না! কারণ আমি জানি সেই চোখ দুটো আমার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে! অন্ধকারেও তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। এমনকি তার ছায়া ছায়া অবয়বও দেখতে পাই! ঠিক আমারই দৈর্ঘ্যের, একই প্রস্থের, এমনকী আমার মতোই গাউন পরা একটা ছায়ামূর্তি! আর কী ঠান্ডা তার দৃষ্টি! কী শীতল তার উপস্থিতি! যেন একটা মৃতদেহ! রিগর মর্টিস হওয়া দু’হাতে ক্রমশই আমায় জড়িয়ে ধরছে!

আমার কী হল জানি না। সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারছিলাম না! চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! তবু ঠিক আন্দাজ করতে পারছি তার চোখদুটো! কী করে, কীভাবে, কিছুই জানি না!

দপ্ করে হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে দিলাম! আশ্চর্য! সামনে, পিছনে, পাশে— কোথাও কেউ নেই! দেওয়ালে আমার নিজেরই ছায়া পড়ছে… আর ঠিক তার পাশেই অবিকল আমার ছায়ার মতো আরেকটা ছায়া! যেন দুটো ছায়াই আমার। প্রথমটার মালিক আমি। দ্বিতীয় ছায়ার মালিক নেই! কোত্থাও নেই… অথচ ছায়াটা ক্রমশই যেন দেওয়াল ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমার বিস্মিত চোখের সামনেই ধরছে অস্পষ্ট অবয়ব…

চিৎকার করে উঠেছিলাম। সপাটে টর্চের এক বাড়ি বসিয়ে দিলাম ওর মাথা লক্ষ্য করে… আমার কপালটাও সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন করে উঠল। তারপর আর কিছু মনে নেই…”

ফের থামলেন ড. তপন মিশ্র। ড. সিন্‌হা তার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। কৌতূহলী স্বরে বললেন, “তারপর?”

—“পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল। কপালে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। মাথায় হাত দিতেই টের পেলাম, একটা ব্যান্ডেজের উপস্থিতি! আমার কপালে কেউ ব্যান্ডেজ করে রেখেছে!

— ‘কী হয়েছিল কাল রাতে?’ আমার স্ত্রী অপর্ণা বেড টি দিতে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘অমন চেঁচিয়ে উঠেছিলে কেন?

কালকের ঘটনার কথা ভেবে নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগছিল। একটা ছায়া কাল রাতে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে, অথচ কোথাও কোনও মানুষ ছিল না! তখন ভয় পেয়েছিলাম। এখন ভাবতেই গোটা ঘটনাটা উষ্ণ মস্তিষ্কের হাবিজাবি মনে হল।

কিন্তু মাথার চোটটা! এটা কীভাবে লাগল!

যাই হোক, ব্যাপারটা চেপেই গেলাম। স্ত্রী’কে বললাম রাত্রে উঠতে গিয়ে, অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে এই বিপত্তি!

স্ত্রী আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, ‘তোমার হাতে তো টর্চ ছিল। জ্বালাওনি কেন?’

প্রশ্নটাকে কোনওমতে এড়িয়ে যাই। ভাবলাম, ওটা দুঃস্বপ্ন! ভুলে যাওয়াই ভালো।

তখন কে জানত যে দুঃস্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি! সবে শুরু হল! সেদিন গোটা দিনটাই যেন একের পর এক দুঃসংবাদ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আগের দিন এক পেশেন্টের গল-স্টোন অপারেশন হয়েছিল। রাত্রেও দেখেছি সে ঠিক আছে। সামান্য ব্রিদিং প্রবলেম ছাড়া আর কিছু প্রবলেম ছিল না।

অথচ নার্সিংহোমে ঢুকতে না ঢুকতে সেই রোগির আত্মীয়রা আমার উপর প্রায় চড়াও হল! লোকটা মারা গেছে!

আমি তখনও বুঝে উঠতে পারিনি যে সে মারা গেল কী করে! কালও তো বেঁচে ছিল। অপারেশন সাকসেসফুল! তবে!

মৃত মানুষটির আত্মীয় স্বজনেরা আমায় ঘিরে প্রায় তান্ডব করছিল। সিকিউরিটি গার্ডরা ছুটে এসে কোনওমতে উদ্ধার করল। মাথায় তখনও কিছুই স্পষ্টভাবে ঢুকছে না। তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ঢুকে নাইট শিফটের ডাক্তারদের আর মেট্রনকে ডেকে পাঠাই। লোকটার মৃত্যুর কারণ জানা দরকার।

— ‘অক্সিজেন ডেফিশিয়েনসি স্যার।’ নাইট শিফটের ডাক্তার মাথা নিচু করে জানায়, ‘অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়ার পরই লোকটা মারা যায়।

— ‘কী আশ্চর্য! অক্সিজেন মাস্ক খোলা হল কেন?’, রাগে প্রায় কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতোই চেঁচিয়ে উঠি, ‘যখন দেখা যাচ্ছিল যে ব্রিদিং ট্রাব্‌ল সামান্য হলেও হচ্ছে, তখন মাস্ক খুলতে তোমাদের কে বলেছিল?’

—‘আপনিই বলেছিলেন স্যার,’ ও আমার দিকে তাকায়, ‘ওটা অপারেশন থিয়েটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল। আপনিই বলেছিলেন রিপ্লেস করতে।’

—’রিপ্লেস করতে বলেছিলাম। একেবারে খুলে দিতে তো বলিনি!’

—’নতুন কোনও ভরা সিলিন্ডার ছিল না অ্যাট দ্যাট মোমেন্ট।’ ডাক্তারটি আরও নম্র, ‘আপনাকে আমিই জানিয়েছিলাম যে নতুন সিলিন্ডার এসে পৌঁছোতে মিনিট দশ লাগবে। সিলিন্ডার না এসে পৌঁছোনো অবধি পেশেন্টের অক্সিজেন রিপ্লেস করবো কি না। কিন্তু আপনার আরেকটা আর্জেন্ট অপারেশন ছিল। ও.টি’র সিলিন্ডারটা দরকার ছিল। তাই আপনিই অর্ডার দিয়েছিলেন ও.টি’র সিলিন্ডারটা ফেরত আনতে।’

কী বলতে চায় ও? লোকটার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী! অপারেশন থিয়েটারে অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপস্থিতিটা বেশি জরুরি। দশ মিনিট পরেই তো নতুন অক্সিজেন চলে আসত। এমন তো নয়, যে আমি লোকটাকে মারার জন্যই ওকে অক্সিজেন দিতে বারণ করেছি! দশটা মিনিট যদি সে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে না পারে, তবে আমার কী করার আছে!

মাথাটা দপ করে গরম হয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে ঠান্ডা করি। এখন সামনে অনেক লড়াই। নার্সিংহোমে চিকিৎসার ত্রুটিগত কারণে মৃত্যু হলে তার দায়ভার অনেক! যে কোনও মুহূর্তে প্রেস এসে পৌঁছোতে পারে। তাদের কী বলব? কীভাবে চাপা দেব এই ঘটনাটাকে!

— ‘রিপোর্টে লিখে দাও যে লোকটির অবস্থা সিরিয়াস ছিল। গলব্লাডারে বেশিদিন ধরে স্টোন থাকার কারণে গ্যাংগ্রীন হয়ে গিয়েছিল। তাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি,’ আঙুল তুলে বলি, ‘কিন্তু অক্সিজেন ডেফিশিয়েন্সির কথা কোনওভাবেই যেন ফাঁস না হয়।’

— ‘কিন্তু স্যার, পোস্টমর্টেম হলে…’

— ‘আমি সামলে নেব, ‘

টাকা আর ক্ষমতার জোরে যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টকে পালটে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই সবাইকে বিদেয় দিয়ে একা কেবিনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। যাক, কোনওভাবে সামলে নেওয়া যাবে। বিশেষ চিন্তার কিছু নেই!

কিন্তু চিন্তার তখনও কিছু ছিল।

কেবিনে বসে চা খেতে খেতেই আবার সেই অস্বস্তি! দুটো চোখ খুব তীব্র দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে! অদ্ভুত সেই চাউনি! সামনাসামনি কেউ নেই, ঘরে আমি একা! অথচ সেই অশরীরী চোখ অনুভব করতে পারছি।

হঠাৎ কী যেন সন্দেহ হল, রিভলভিং চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে পিছনদিকে তাকাই। নাঃ, সেখানে কিছু নেই! কেউ নেই…! একদম ফাঁকা!

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সামনের দিকে ঘুরতে যাব, চোখে পড়ল পেছনের দেওয়ালে আমার ছায়া পড়েছে। কিন্তু একটা নয়! দুটো ছায়া! পাশাপাশি, দেওয়ালের সমান্তরালে দুটো একইরকম ছায়া। একটা আমার! আরেকটা আমার নয়! হতেই পারে না!

আমার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎগতিতে সামনের আয়নায় তাকালাম!”

ড. তপন মিশ্র সাইকিয়াট্রিস্টের হাত চেপে ধরলেন, “যা দেখলাম তা বিশ্বাস করবেন না। কেউ বিশ্বাস করে না।”

—“কী দেখলেন?”

—“দেখলাম আয়নায় আমার প্রতিচ্ছবি পড়ছে। আর আমার ঠিক পিছনেই আরেকটা লোক! তার পোষাক পরিচ্ছদ একদম আমার মতো! এমনকী তাকে দেখতেও হুবহু আমার মতোই! শুধু চোখদুটোয় কোনও মণি নেই! একদম ফাঁকা! অন্ধকার কোটরের মতো শূন্য চোখে তাকিয়ে সে হাসছে! অথবা আমিই হাসছি আমার দিকে তাকিয়ে!

একি অদ্ভুত রহস্য! কী অদ্ভুত যন্ত্রণা! কাউকে বলার উপায় নেই! অথচ সহ্য করাও যায় না! ওই হাসির মধ্যে যত না ব্যঙ্গ, তার থেকেও বেশি ঘৃণা! ইচ্ছে হল ওর গলা টিপে ধরি! আমি ডাক্তার… কাউকে খুন করা আমার পেশা নয়… কিন্তু, ওই মুহূর্তে… আমি… আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম…

ছায়াটার গলা টিপে ধরতেই মনে হল, লোহার মতো মজবুত দুটো হাত আমারও গলা সাপটে ধরেছে! শ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে… চোখে অন্ধকার দেখছি… অক্সিজেন… একটু অক্সিজেন…!

— ‘এ কী! এ কী স্যার! কী করছেন… কী করছেন!’

কানে এল চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ! বেশ কিছুক্ষণ চেতনা ছিল না। জলের ঝাপটায় হুঁশ ফিরল। চোখ মেলতেই প্রথম নজরে আসে মেট্রনের মুখ। সে উদ্বিগ্ন। জানতে চায়, ‘স্যার, আপনি নিজেই নিজের গলা অমন ভয়ানকভাবে টিপে ধরেছিলেন কেন?”

আবার একটু থামলেন ড. মিশ্র। কী যেন একটু ভেবে নিয়ে ফের বলতে শুরু করেছেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। তবে এইটুকু বুঝেছিলাম যে ওকে আক্রমণ করতে গেলে সে আঘাত আমার উপরই পড়ছে। ওর মাথায় বাড়ি মারলে, আমার মাথায় চোট পড়ে, ওর গলা টিপে ধরলে আমার শ্বাস বন্ধ হয়। যাই হোক না কেন, নিজেকে বাঁচাতে গেলে ওকে মারা চলবে না।

সেই হিসেব মতোই চলতে শুরু করলাম। অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে। কিন্তু যখনই চোখ পড়ে তখনই দেখি আমার সঙ্গে সঙ্গে দুটো ছায়া তাল মিলিয়ে চলেছে। একটা আমার, অন্যটা আমার নয়। রোগি দেখি, অপারেশন করি, সবই চলছে নিয়ম মতো। অথচ একমাত্র আমি জানি যে, কিছুই ঠিক নেই। সবসময় সেই ছায়া আমার পেছনে ওঁত পেতে বসে থাকে। তার সদাসতর্ক নজর আমার ওপর। ও আমায় পায়ে পায়ে ফলো করছে। ওকে ছেড়ে যাবার উপায় আমার নেই! অথচ সহ্য করার ক্ষমতাও নেই। সবসময় ভয়ে শিঁটিয়ে থাকি, যদি কেউ ওকে দেখে ফেলে। যদি জানতে চায়,

— ‘ডঃ মিশ্র, আপনার দুটো ছায়া পড়ছে কেন?’

এর মধ্যেই আরেক ঝামেলা এসে ঘাড়ে পড়ল। একটি বছর দশের বাচ্চা ছেলে হার্টের সমস্যা নিয়ে নার্সিংহোমে এসে ভরতি হয়েছিল। হার্ট রিপ্লেসমেন্ট করাতে হবে। ছেলেটির ভারি মিষ্টি চেহারা। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, সকলেই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু শুধু পছন্দ করলে তো চলবে না! তার বাবার অপারেশন করানোর পয়সা নেই। সে খালি কাঁদে আর আমার পায়ে ধরে,

— ‘ডাক্তারবাবু, আমার ছেলেটা যে দিনদিন নেতিয়ে পড়ছে! ওর অপারেশনটা করে দিন। আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।’

আচ্ছা মুশকিল! লোকটাকে বোঝানোই যায় না যে, আমার পায়ে ধরলে ওর ছেলে সুস্থ হবে না। ইমিডিয়েটলি সার্জারি করতে হবে। প্রয়োজন মতো হার্টও পাওয়া গেছে। কিন্তু সার্জারির ফি জমা না দিলে অপারেশন হবে কী করে?

সে কথা বলতেই সে ফের কেঁদে ফেলেছে, ‘আমি গরিব মানুষ। অত টাকা একসঙ্গে কোথায় পাবো? আপনি অপারেশনটা করে দিন। আমি একটু একটু করে সব টাকা শোধ করে দেব।’

আমার মাথা ফের গরম হয়ে যায়। মামাবাড়ির আবদার পেয়েছে! চিকিৎসা করানোর সময়ে নামকরা ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোম! আর টাকা দেওয়ার বেলায় দাতব্য হাসপাতাল! কীভাবে এরা! এত আধুনিক যন্ত্রপাতি, এত নামিদামী ডাক্তার, এত মেইনটেনেন্স, উন্নত পরিষেবা— এসব কী হাওয়া থেকে আসে!

ভাবছিলাম কেবিন থেকে লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দিই। কিন্তু পারলাম না। সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখি, অন্য আমিটা ঠিক আমার পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে! ওর চোখের অন্ধকার কোটর থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল! আমি কী ভাবছি, তা ও জানতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে! ভয় করছিল… ভীষণ ভয় করছিল! আমি পালাতে চাইছিলাম। ওর কাছ থেকে নিষ্কৃতি চাইছিলাম। একটা মানুষ, যে আমার মতোই দেখতে… যে আমার ভিতরের সমস্ত কথা, সমস্ত অভিসন্ধি জেনে ফেলছে, তাকে সহ্য করা বড্ড কঠিন!

— ‘স্যার…’

যখন ভাবছি ছেলেটার বাবাকে কী বলে বিদেয় দেব, ঠিক তখনই এক জুনিয়র ডাক্তার হুড়মুড় করে এসে ঢুকল আমার ঘরে। তার হাবেভাবে আশঙ্কা।

— ‘স্যার, তিনশো চারের পেশেন্ট কোলাপ্স করছে। প্লিজ ইমিডিয়েটলি আসুন।’

তিনশো চার মানে সেই বাচ্চা ছেলেটা। ওর বাবাও দেখলাম কথাটা শুনেই বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। কথাটার অর্থ সেও বুঝেছে।

মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিয়েছিল বাচ্চাটা! ওর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই। খাবি খেতে খেতে একসময় সে নিথর হয়ে গেল। আমি শুধু দেখলাম ওর নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট! শেষমুহূর্তে বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল।

ওর বাবা তখন পাথর! প্রয়োজনীয় টাকা জমা না দিলে যে সন্তানের লাশটা পাওয়া যাবে না সেটা বারবার বুঝিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু লোকটা যেন কিছুই বোঝে না! হাবা কালার মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল! তারপর হঠাৎই চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে!

আমি দেখলাম, ওর চোখ দুটো নেই! তার জায়গায় দুটো বীভৎস শূন্য কোটর আমার দিকে তাকিয়ে বীভৎস অট্টহাসি হাসছে। আশপাশের ওয়ার্ডবয়, সিস্টার, ডাক্তাররাও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন… বিশ্বাস করুন… তাদের কারুর চোখের মণি ছিল না! সবার চোখে শুধু জমাট অন্ধকার, যেন ওদের চোখ কেউ খুবলে তুলে নিয়েছে! অবিকল অন্য আমিটার মতো!

আমি পালিয়ে আসি। ওই শূন্য চোখ আমার কাছে বিভীষিকা! সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার গাড়ি কোথায় ছিল কে জানে! চাবিটাও দৌড়োতে গিয়ে পড়ে গেল। গাড়ি ছাড়াই আমি পাগলের মতো রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়োচ্ছি। পালাতেই হবে… পালাতেই হবে ওই বীভৎস চোখের কাছ থেকে।

রাস্তায় তখন অনেক মানুষের ভিড়! আমার চতুর্দিকে ওয়াটারপ্রুফে ঢাকা অনেকগুলো মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে! ছাতা মাথায় দিয়ে বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে। তার মধ্যে দিয়ে, জনস্রোত ভেঙে কোন ঠিকানায় দৌড়োচ্ছিলাম কে জানে! অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছিলাম, তবু থামিনি। থামব কেন? আমি অবধারিতভাবেই জানতাম ওই ওয়াটারপ্রুফগুলোর অন্ধকারে বা ছাতার তলায় যে মুখগুলো লুকিয়ে আছে, তার একটারও চোখ নেই! আমি জানতাম… একদম নিশ্চিতভাবে জানতাম!

দৌড়োতে দৌড়োতে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন রাত হয়ে গেছে। নিজের বাড়িটাকে দূর থেকে দেখে বড় কান্না পেয়ে গেল। ওই তো আমার শান্তির আশ্রয়! ওইখানে আমার স্ত্রী আছে, আমার সন্তান আছে। আমার বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ, আমার পরিবার এখানে থাকে! আজ থেকে আর নার্সিংহোম নয়, অন্য কোথাও নয়, পার্টি নয়, পেশেন্ট নয়। আমি শুধু আমার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাব। পিকনিক করব, বেড়াতে যাব, শপিং মলে শপিং করব। বাবাইকে কিনে দেবো তার মনমতো খেলনা। অপর্ণাকে পছন্দমতো শাড়ি…

দরজায় সজোরে নক করি। এই মুহূর্তে ভালোবাসার মানুষদের উষ্ণতা খুব প্রয়োজন। ভালবাসার কাছে আসতে পারে না অন্ধকার চোখেরা। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে তাড়া করে না দুঃস্বপ্নরা। আমি নিরাপদ বোধ করছিলাম…. ভীষণ ভীষণ নিরাপদ! আর কেউ আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না! আর দৌড় করাতে পারবে না!

অনেকক্ষণ ধরে নক করার পর দরজা খুলল বাবাই। আমার একমাত্র সন্তান। সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরে ওর ছোট্ট বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছি। আঃ! কী শান্তি! কী উষ্ণতা!

— ‘বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে!’ বাবাই প্রশ্ন করল, ‘তোমার গাড়ি কোথায়?’

আমি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ তুলে ওর দিকে তাকাই। ঠিক তখনই কাছেই প্রচন্ড শব্দে একটা বাজ পড়ল! তার নীল আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, বাবাইয়ের চোখদুটো নেই! একদম ফাঁকা! অন্ধকার জানলার মতো…”

ড. তপন মিশ্র বলতে বলতেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ড. সিন্‌হার হাত ধরে বললেন, “বিশ্বাস করুন ডক্টর, আমি আর পারছিলাম না, আমার জীবনে এমন একটা রহস্য এসে পড়েছে যার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই যাকে প্রত্যেকমুহূর্তে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছি আমি। কখনও সে আমার নিজের ছায়ায় দেখা দেয়, কখনও অন্যের মধ্যে। কখনও আয়নায় দাঁড়িয়ে হাসে, কখনও নানা রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছিলাম। একটা অস্বাভাবিক জীবনে কোনওমতে বেঁচে আছি। টের পাচ্ছিলাম একটু একটু করে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছি। হসপিটালে যেতেও ভয় করছিল… ওরা আমার দিকে আবার ওইভাবে তাকাবে। তা-ই আজ বিকেলে…”

ড. সিন্‌হা মন দিয়ে শুনছিলেন, “আজ বিকেলে কী?”

—“আজ বিকেলে ঠিক করলাম যে এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। অন্য আমিটাকে মারার একমাত্র উপায়, যদি আমি নিজেই মরে যাই।” ড. মিশ্র মুখ মুছলেন, “তা-ই আজ আমি…”

তার কথায় বাধা দিলেন ড. সিন্‌হা, “বুঝেছি। আপনার সমস্যা খুব গুরুতর নয়। আসলে এটা হ্যালুসিনেশনের প্রবলেম। চিন্তা করবেন না, সেরে যাবে। শুধু কিছুদিন ট্রিটমেন্ট দরকার।”

টিমটিমে বাতিটার পাশেই একটা বড় আলো থাকে। রোগিরা সবসময় অন্ধকার পছন্দ করে বলেই বড় আলোটা জ্বালান না তিনি। এবার প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য বড় আলোটার দরকার পড়ল!

কিন্তু আলোটা জ্বালিয়েই… চিৎকার করে উঠলেন ডক্টর সিন্‌হা!

সব যেখানে থাকার, আছে। দেওয়ালে দুটো ছায়া তখনও মুখোমুখি বসে আছে! তপন মিশ্রের ধরানো সিগ্রেটটা তখনও জ্বলছে!

কিন্তু… শূন্যে!

আর কেউ নেই!

ড. সিনহা অজ্ঞান হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে শুনতে পেলেন, কে

যেন ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল,

—“ডক্টর… আমি কি বেঁচে আছি?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *