হ্যাপি নিউইয়ার
পয়লা জানুয়ারিটা কেমন যেন! বড় বেশি অফিশিয়াল। ধর্মটর্ম নেই। কাগজে-কলমে আন্তজার্তিক আইন মোতাবেক বছরটা পাল্টে গেল। যে বছরের শুরুতে বাঙলা পাঁজি বেরোয় না, জ্যোতিষ মতে গ্রহ-নক্ষত্র ঘর বদলায় না, রাষ্ট্রফল, বর্ষফল, রাশি ও লগ্নফল জানা যায় না, সেই নববর্ষ আমাদের মনে তেমন কোনও দাগ কাটে না। আমাদের পঞ্জিকা একটা অসাধারণ ব্যাপার। আষ্টেপৃষ্ঠে বিজ্ঞাপন সাঁটা, জ্যালজেলে কাগজে ঘন করে ছাপা টাইট একটা বাংলা বছর। পাতায়-পাতায় তিথি নক্ষত্র। নির্ঘন্ট শুভ-অশুভক্ষণের উল্লেখ। মহাপুরুষদের ছবি। তাঁদের জন্মক্ষণ। মাস শুরুর পাতায় মাসফল, কি কি ভক্ষণ নিষিদ্ধ, কি ভক্ষণ উচিত তার নির্দেশ। পৃথিবীর আর কোথাও এমন একটি জিনিস প্রকাশিত হয় কি না আমার জানা নেই। পাঁজি ছাড়া নববর্ষ বড় সায়েবী ব্যাপার। ইংরেজ-ভজা সম্প্রদায় জাতে ওঠার জন্যে, বোতলামৃত পান করার জন্যে, বেতো কোমরে ধুমসো নিতম্ব দুলিয়ে এলভিস প্রিসলে হবার জন্যে, হ্যাপি নিউইয়ার বলে নৃত্য জোড়েন। আজকাল একটা রেওয়াজ হয়েছে, নিজেকে ভারতীয় না ভাবা। এই ভাবনার প্রতিফলন ভার্চুতেও নেই, আছে ভাইসে। তেনারা মানে সায়েবরা কাজেকর্মে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে নিজেদের দেশটাকে ঠেলে একেবারে গ্রহান্তরে পাঠিয়ে দিলেন, আর আমরা এখনও পড়ে আছি বয়েল গাড়ির যুগে। পৃথিবীর কোনও দেশে শহরের দেয়ালে-দেয়ালে ঘুঁটে দেওয়া হয়। কোনও দেশে পঞ্চাশ ভাগ মানুষ ফুটপাতে সংসার পাতে। যাঁরা পয়লা জানুয়ারি বিলেতি কায়দায় নর্তন কুর্দন করেন তাঁদের ট্যাঁকের জেরা অবশ্যই আছে। পেটে শুধু দুপাত্তর নেই, বিদ্যেও হয়তো আছে, তবে একটা ব্যাপারে তাঁরা অতিশয় উদাসীন, যেটা প্রায় অপরাধের পর্যায়ে চলে যায়, সেটা হল এই দেশ। স্বদেশে তাঁরা বিদেশি।
তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের কোনও মিল নেই। তাঁদের খানাপিনা, মেলামেশার জায়গা আলাদা। আলাদা তাঁদের পাড়া। প্রত্যেকেই টাকার কুমীর। তাঁদের কিছু সঙ্ঘ সংগঠন আছে, তার মাধ্যমে সমাজসেবা করেন দয়ার মনোভাব নিয়ে। একটু ওষুধ—বিষুধ বিতরণ করলেন, দু-একখানা কম্বল। ছানি কাটাবার ক্যাম্প করলেন হয়তো। পরিবার পরিকল্পনার কথা শোনালেন। এমন কিছু করলেন না, যাতে সমস্ত মানুষ মানুষের মতো বেঁচে থাকার ভরসা পায়। এ বড় শক্ত ঠাঁই, গুরু-শিষ্যে দেখা নেই। তাহলে ভাগাভাগিটা এভাবেই হোক—পয়লা জানুয়ারি পয়সাওয়ালাদের, আর পয়লা বৈশাখ বাকি সকলের। এই বাকির গ্রুপে আছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া, দিন আনি দিন খাই মানুষের দল। পয়লা জানুয়ারি আমাদের সকলের হবে কি করে। পার্কস্ট্রিট, ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের বিশাল ভালো দোকানের একটা কেকের যা দাম, একটি মাত্র কেক, সেই দামে আমার গোটা পরিবারের একদিনের বাজার খরচ হয়ে যাবে। এইটুকু গোলমতো একটা কেক। মুখে, জয় বাবা জানুয়ারি বলে ফেলা মাত্রই মিলিয়ে গেল। জানুয়ারিকে মনে রাখতে হলে আমার মতো চাষাড়ে লোককে ডজনখানেক খেতে হবে। এই হিসেবে গোটা পরিবার মানে ভিটেমাটি চাঁটি। বউয়ের গয়না সোনার দোকানে বাঁধা রাখতে হবে। তারপরে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলতে হবে—হ্যাপি নিউইয়ার। ছেড়ে দে মা।
আমার ওই পৌষ পিঠেই ভালো। সলিড, গায়েগতরে জিনিস। টরপেডোর মতো দেখতে। কাজেও তাই। টেস্ট একটু কম, তা হোক। ডজনখানেক খেলে শরীরের ওজন বাড়ে। মনে একটা পরলোক পরলোক ভাব আসে। কারণ সিদ্ধ পিঠের মতো অমন বিশুদ্ধ, বিস্বাদ বস্তু দুটি নেই।
পেটে আবার ঠাসা হয়েছে নারকেল কুরো। গুড় দিয়ে পাক করার পর চেহারাটা হয়েছে জর্দার মতো। নারকেল কোরা আর কাঠের চাকলায় খুব একটা তফাৎ নেই। আমার একটাই দু:খ, অমন গেরস্থ পোষা পয়লা বৈশাখ সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পেল না। একমাত্র পশ্চিম বাংলাতেই সরকারি ছুটির দিন। লোক্যাল ট্রেনের মতো লোক্যাল হলিডে। অথচ পয়লা জানুয়ারি কেমন সর্বভারতীয় স্ট্যাটাস পেয়ে বসে আছে। সায়েব-সুবোরা পিঠ চাপড়ালে এই রকমই হয়। বিদেশ যাকে বরণ করে স্বদেশে তার সম্মান লাখোগুণ বেড়ে যায়। যেমন আমাদের বরাত ভাই। সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা সর্বত্র ওই এক কেস। যেই ফরেন স্ট্যাম্প পড়ে গেল, অমনি কদর বেড়ে গেল। তা না হলে, আমার ঠাকুমা যে কাঁথাটা গায়ে দিতেন সেইটার দাম দশ হাজার টাকা হয়! এক সায়েব দেখে বললেন, ‘হোয়াট ইজ দিস?’
ঠাকুমা বললেন, ‘বাবা, একে বলে কাঁথা। ছেঁড়া কাপড় আর ছুঁচ সুতো দিয়ে আমি করেছি। চোখে ঘুলঘুলি চশমা লাগিয়ে।’ আমাকে দোভাষী হতে হল। কাঁথার তো আবার ইংরেজি হয় না। এটি দেব-এ নেই। সুবলচন্দ্রে নেই। বললুম, ‘দিস ইজ কানথা সায়েব।’
সায়েব সেটিকে খুলে নিয়ে চলে গেলেন। বাস কাঁথা জাতে উঠে গেল। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে যত ছেঁড়া কাঁথা ছিল সব প্লেনে চড়ে বিদেশে চলে গেল। ক্রিস্টি, সুদবিতে লেগে গেল কাঁথার অকসান। মিঞা ফারো কাঁথা গায়ে পার্টিতে নাচতে গেলেন। এলিজাবেথ টেলারের হিংসে হয়ে গেল। অভিমানে এমন মদ্যপান করলেন, এক কানের হীরের দুল হারিয়ে গেল। এই হল ব্যাপার।
আমাদের হারাধন কয়াল হঠাৎ খুব পয়সা করে ফেললেন। সাধারণে বলতে লাগল, হারাধনবাবু এখন রিচম্যান। আগে বলত, হাফ, হেরো, হেরো ব্যাটা। হারাধনের বয়েস তেমন বেশি নয়। হারাধনবাবু আগে হাতিবাগানে বাজার করতেন, এখন করেন নিউমার্কেটে। তিনি চারখানা বড় ছোট গাড়ির মালিক। গাড়ি হলে মানুষের দুটো জিনিস হয়। দুটো বললে ভুল হবে, অনেক কিছু হয়। পরে গুনে গেঁথে বলা যাবে। প্রথমে বাড়িতে কুকুর ঢোকে। সেই কুকুরকে গাড়ির পেছনের আসনে বসিয়ে মাঝেমাঝেই নিয়ে যেতে হয় কুকুর ক্লিনিকে চেক-আপের জন্যে। গাড়ি হলে, বাড়িতে প্রায়ই ফিশফ্রাই হয়। কারণ নিউমার্কেটে বোনলেশ ভেটকি পাওয়া যায়। কে আর এই বাজারে বাস ঠেঙিয়ে আনতে যায়। চালাও গাড়ি নিউমার্কেট। ফিশ এসে গেল। হয়ে গেল ফ্রাই। আর ফ্রাই হলে কি হয়; এসে যায় অনুষঙ্গ বোতল। কারণ জলপথেই বিচরণ করে মাছ, সে কাঁচাই হোক আর ভাজাই হোক। গাড়ি হলে পাড়ার দোকানে মাংস আর সন্দেশ খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মাংসের জন্যে তেল পুড়িয়ে গাড়ি ছুটল গরান হাটা। ছুটল সন্দেশপাড়ায়, ভীমনাগে কি নকুড়ে। গাড়ি এলে প্রায়ই দূরপাল্লার ভ্রমণ হয়। আর ঘরে এসে ঢোকে বড়—ছোট নানা মাপের ফ্লাস্ক, ব্যাগ, হট ক্যারিয়ার। আর আসে বাত আর ভুঁড়ি। এই নিউমার্কেটেই বড়দিন আর নিউইয়ারসের পাঠশালা। বন্ধু যেমন বন্ধুকে মাল ধরায় সেইরকম নিউমার্কেট দিশি সায়েবদের ধরায় পাঁজা পাঁজা গ্রিটিংস কার্ড। সারাবছর যাদের খোঁজখবর করা হল না, হঠাৎ তাদের কাছে পাঠান হল গ্রিটিংস কার্ড। ‘তোমার বছর শুভ হোক।’
আর শুভ হোক! বাটা বন্ধ ছিল, সবে খুলেছে। ফিলিপসে লকআউট। হ্যানিম্যানে তালা ঝুলছে। দোদুল্যমান, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থা। প্রায় সবই বন্ধ অথবা বন্ধ হবার মুখে। তবু বলছেন যখন, আগামী বছর শুভ হোক। নিউমার্কেটের কল্যাণে আমাদের কল্যাণ হোক। বড় মানুষ, তালেবর মানুষদের কাছে পাঁজা পাঁজা কার্ড আসে। অনেককেই চেনা যায় না। অনেকে আবার এমন খচরমচর সই করেন পাঠোদ্ধার দু:সাধ্য। নিজের গুরুত্ব আর স্ট্যাটাস বোঝাবার জন্যে অনেকে গ্রিটিংস কার্ডের প্রদর্শনী করে রাখেন বসার ঘরে, শো-কেসের মাথার ওপর। কেসের ভেতরে বিদেশ ভ্রমণের হাবিজাবি। প্যারিসে গিয়েছিলেন, এফেল টাওয়ার, নিউইয়র্ক, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। এইরকম আর কি? অনেক ওষুধ কোম্পানি প্যাকেটের গায়ে লিখে দেন, লিটারেচার অন রিকোয়েস্ট। সেইরকম বসার ঘরের ওই শোকেসে মালিকের অদৃশ্য লেখনি, জিগ্যেস করলেই মরবে। ডিটেলসে এমন ভ্রমণকাহিনি শুরু করবে, তোমার আধবেলা সব কাজ মাটি। সেই শোকেস-রূপী ভ্রমণ কাহিনির মাথার ওপর গ্রিটিংস কার্ডের মেলা। দু-পাল্লা কপাটের মতো ফাঁক করে দাঁড় করানো হয়েছে এক একটাকে। কয়েকটা আবার মাতালের মতো টলে পড়তে-পড়তে সামলে গেছে। এই মার্কেট থেকে পাঁজাকোলা করে আনা হয় ‘খ্রিসমাস ট্রি’। সদ্য জাতে ওঠা অনভিজ্ঞ বাবু বলছেন, সামনের বার আমাদের ছাদের টবে একটা লাগাব। গৃহিণী বলছেন, দ্যাখো না এটার শেকড় আছে কি না! ঘরে নড়বার চড়বার জায়গা নেই তার মাঝে ইয়া ধুম্বো এক ক্রিসমাস ট্রি। সে আবার ডেকরেশানের জন্যে নানা অনুষঙ্গ আলাদা কিনতে হল। জরির সুতো, ফিতে, জরির বল, তারা। বড় খোকা আবার অ্যাংলোপাড়ার কাগজের টুপি পরে ধেই নাচ জুড়লেন। সঙ্গে গান জুড়ে দিল ঢাউস স্পিকার—জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল, যাকে বলা চলে এক ধরনের হৃৎকম্প। অনেক বাড়িতে সরস্বতী প্রতিমা বিসর্জন করা হয় না। সেইরকম অনেক বাড়িতে মা সরস্বতীর পাশে খ্রিসমাস ট্রি রাখা হয়। ঝুলঝাল জড়ানো। তার ওপর সময় সময় হালকা জিনিসও ঝোলে; যেমন মেয়েদের ফলস হেয়ার। বাচ্চার জামা। টাটকা গাঁদা গুঁজে দিলেন কেউ। মনে করলেন—খ্রিসমাস ফ্লাওয়ার কবে বারোয়ারী খ্রিসমাস হবে! হল বলে। খ্রিসমাস ট্রি নিয়ে চলেছে বিসর্জনের মিছিল নেচে-নেচে। ছেলেরা আওয়াজ দিচ্ছে, খ্রিসমাস মায়ী কি জয়। পয়লা জানুয়ারি তো যুবশক্তি গ্রহণ করেছে। লাউডস্পিকার-এ-লতা, হাঁড়িতে মুরগি, বগলে বোতল। মার কাটারি মাগো। মাঝে-মাঝে লতাকে রিলিফ দিচ্ছেন কিশোর, এ আমার গুরু দক্ষিণা, এ আমার গুরু দক্ষিণা। যেমন গুরু তার তেমনি চেলা, তেমনি দক্ষিণা। কবে বারোয়ারী পিকনিক হবে। হল বলে। একদা স্বদেশি গান ছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, সেই সুরেই গান বেঁধে পুরবাসীর কাছে চাঁদা চাওয়া হবে, দরাজ হাতে চাঁদা ছাড় মা, দু-পাত্তর মাল খেয়ে আসি।
ইংরেজি বর্ষের শুরু জমিয়ে দিয়েছেন আমাদের দূরদর্শন। বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ এমন জমে ওঠে। ঘরে-ঘরে সব উন্মুখ। কেউ এলেন মুখে দুখিলি পান ঠুসে হাসাতে। মুঝে বাপুনে কহা। ঠেট হিন্দিতে, সে যেন পেটের খিল খুলে যাবার যোগাড়। তিনি যেতে না যেতেই এলেন একজোড়া মানব-মানবী। মানবের আবদার, গান শুনায়ু। সঙ্গে-সঙ্গে আসমান থেকে নেমে এলেন পরী। তিনি কোমরে মোচড় মেরে হৃদয় একেবারে পার্কের রেলিং-এর মতো মুচড়ে দিলেন। এলেন দাড়িওয়ালা উর্দু কবি। তিনি যত না শায়েরি বলেন, তার চেয়ে বেশি হয় হয় করেন। এলেন চিত্রাভিনেতা। তিনি দশ মিনিট রেল গাড়ি চালালেন মুখে। আর সর্বক্ষণ ধোঁয়া আর আলোর খেলা। যে বছর একটু পরেই মরবে তার ভেতরে এত মশলা ছিল কে জানত রে ভাই। সারাটা বছর তো আমরা হিমসিম খেয়েছি। প্রতি মাসেই মনে হত কবে পয়লা হবে। হাতে কিঞ্চিৎ অর্থরূপী কর্পূরের আগমন হবে। মূর্খের দল। এটুকু বুঝিনি মাস যেতে-যেতে বছর যায়। বয়সে যোগ হয় আর একটি বছর। মৃত্যুর সিঁড়ি বেয়ে জীবন উঠে গেল আরও একধাপ ওপরে। হঠাৎ মায়া-জগতের ঘড়িতে বারোটা বাজল। ফেটে গেল এক ঝাঁক বেলুন। কাগজের কুঁচো ঝরতে লাগল অবিরত ধারায়। ওদিকে নেপথ্যে খাটে উঠল মৃত বছর। অন্ধকারে চলেছে শবযাত্রীর দল—রাম নাম সত্য হায়।