পাঁচ
রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তিতে প্রমিতের চোখেও ঘুমের ছাপ বসে গেছে। তবে ঘুমায়নি। মায়ের দেওয়া কড়া চা পেয়ে ঘুমের রেশ কেটে গেছে বললে ভুল বলা হবে। বরং ঘটনার টানে চাপ খেয়ে মাথা আর শান্ত হচ্ছে না। অশান্ত সময়ে মিতুর জন্যও কোনো রাগ নেই। রোদ্দুরকে কাছে পেয়ে সব ক্ষোভ পানি হয়ে গেছে। গত রাতে কী ঘটেছে ভালো করে স্মরণ করতে চায় ও। কীভাবে মহাখালি ব্রিজের ওখানে গেল, তাও স্মরণ করতে পারছে না। একটা ঘোরের মধ্যে যেন কেটে গেছে পুরোটা সময়। চোখ খুলে হঠাৎ খেয়াল করল মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছেন।
মেয়ের মাথাটা আলতো করে সরিয়ে উঠে বসল ও। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে নিচু গলায় বলল, ভেবো না। শরীর ঠিক হয়ে যাবে। কোত্থেকে কী ঘটল বুঝে উঠতে পারছি না।
সায়েরা আমিনের মুখে প্রশ্ন নেই। কী কথা বলবেন তাও বুঝতে পারছেন না। বড়ো বিপদ ঘটে যেতে পারতো। এমন ভাবনার ঘোরে ডুবে থাকলেও বউমার এভাবে চলে যাওয়ার মধ্যে অশুভ কিছু ঘটার আভাস পাচ্ছেন। এক্সবুম শব্দটাও মাথায় তুষের আগুনের মতো দুশ্চিন্তার পোড়া ধোয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট জীবনটাকে আর ছোট মনে হচ্ছে না। নাতনি রোদ্দুরের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত তিনি। মা বাবার জীবনে সংঘাত থাকলে সন্তানের মনের ওপরও তার প্রভাব পড়ে, জানেন তিনি। আর হঠাৎ মলম পার্টির কবলে পড়ে সব খোয়ানোর চেয়েও বড় ক্ষতি হলো এমন একটা ভয়ংকর ঘটনা প্রমিতের ওপরও স্থায়ী দাগ বসিয়ে দিতে পারে। মায়ের মনে উড়ে উড়ে আসতে থাকে দুশ্চিন্তার ঝড়। যদিও বাইরে কোনো আভাস নেই এ ঝড়ের, তবে ভেতরে ভেতরে ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে সব।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে মাকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রমিত বলল, ভেবো না, আম্মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ছেলের আশ্বাসে মন ভরল না। তবুও স্বস্তি পেলেন।
বিণাকে বলেছি তোমার জন্য ভুনা খিচুড়ি রাঁধতে। রান্নাটা শেষ হোক। খেয়ে শোও। আর এ ফাঁকে রোদ্দুর খানিকটা ঘুমিয়ে নিক।
আরেক কাপ চা দাও তাহলে। কড়া করে দিয়ো।
টোস্ট বিস্কিট দিব?
দাও।
স্বাভাবিক কথা-বার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝে গেলেন ছেলে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এ বোধ তাঁর ভেতরের চাপ কিছুটা হলেও কমিয়ে দিল। কিচেনে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গিয়ে বললেন, বউমাকে কল করো, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলো। পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলল। খবরদার ওর দোষ ধরবে না। কে দোষ করেছে, কে ভুল করেছে এসব কথা না তুলে স্যরি বলে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি দূর করো। তোমরা সুখে আছো দেখলে ভালো লাগে। বেশি দিন বাঁচতে পারবো।
মায়ের কথা প্রতিদিন যেভাবে শোনে, এখনও সেভাবে শুনছিল প্রমিত। শেষ বাক্যটা শুনে চমকে উঠল। বেশিদিন বাঁচতে পারার অপর পিঠে মৃত্যুর কথাও যে ছাপ মেরে আছে, বুঝতে পারল। দুনিয়ার সব অঘটন যেন ও সইতে পারবে, মায়ের মৃত্যু না।
মুহূর্তেই মাথা নত হয়ে গেল। নরম হয়ে গেল মন। নিজের মুঠোফোন মলম পার্টি নিয়ে গেছে। মায়ের ফোনটা চেয়ে নিয়ে বারান্দায় এসে কল করল মিতুকে। সেট বন্ধ। হুম করে হতাশা আবার আক্রমণ করল ওকে। অস্থির হয়ে গেল। বুঝল মিতুকে দোষ দেওয়া যাবে না। নিজের দোষ থাকুক না থাকুক, বলতে হবে নিজেরই দোষ হয়েছে। নিজের দোষকে হ্যাঁ বলতে হবে। আর মিতুর দোষ আছে কথাটাকে বলতে হবে না। ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরে ঢুকে দেখল নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে রোদ্দুর। ওকে ডিস্টার্ব না করে ফিরে এলো বারান্দায়। কচি রোদ নেই। ক্রমশ তা কড়া হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মাথায় দার্শনিক ভাবনা উদয় হলো–জীবনও সব সময় সরল আর শুভ্র থাকবে না। কঠিন থেকে কঠিন হতে থাকবে। আলো আর আলোময় থাকবে না। আগুনময় হয়ে যাবে। কন্যা রোদ্দুর আর কন্যাস্নেহের বাঁধনে জড়িয়ে শিশু থাকবে না–তরুণী হয়ে বউ হবে। এক সময় কারও মা হবে। দাদি-নানি হবে। বর্তমানে সময়টাই আসল। মুঠোবন্দি বর্তমানকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। উড়িয়ে দেওয়াও। নিজেও বুড়ো হয়ে যাবে। মিতুও। সময়ের ফাঁক গলে বর্তমান মুহূর্ত চলে যাবে, স্মৃতির গুহায় ঢুকে আঁধারে ছেয়ে যাবে। অথবা তা কখনও কখনও ভেসে উঠবে। তখন আর জীবনটা খুঁজে পাওয়া হবে না। এসব ভাবনার জালে জড়িয়ে ঠিক করে ফেলল মিতুর কাছে নত হয়ে যাবে। ওর চাওয়াটা ধরতে হবে। ওর প্রয়োজন পূরণ করতে হবে।–এসব ভাবতে ভাবতে আবার কল করল প্রমিত।
না। এখনও সেট বন্ধ। এবার উদ্বেগ হানা দিল। এতক্ষণ ফোন বন্ধ রাখাটা ঠিক হয়নি। ওদের এত জিদ আর রাগ পুষে রাখাও ঠিক নয়। এসবও ভাবতে ভাবতে এবার কল করল শাশুড়ির নম্বরে। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে প্রশ্ন করলেন, বেয়াইন, প্রমিত ফিরেছে?
মা, আমি প্রমিত।
বাবা! বাঁচালে। তোমার কণ্ঠ শুনে মন জুড়িয়ে গেল। আম্মা, আমার বিপদ হয়েছিল। রাতে মলম পার্টির কবলে পড়েছিলাম। মোবাইল ফোন তো গেছে, সঙ্গে বারো হাজার টাকা আর হাত ব্যাগটায় রাখা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। তবে জানটা বেঁচেছে, এই যা। মলম পার্টি আমাকে পথে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে গিয়েছিল। দুইটা ছেলে উদ্ধার করে বাসায় দিয়ে গেছে। এখন ভালো আছি।
ও মাগো! কী বলো!
জি। আম্মা। তবে চিন্তা করবেন না। আমি ভালো আছি।
প্রসঙ্গ পাল্টে তিনি এবার প্রশ্ন করলেন, মিতু কোথায়? ওর মোবাইল সেট তত বন্ধ পাচ্ছি।
ও আপনাদের বাসায় যায়নি?
না, রোদ্দুরকে নিয়ে ভোরেই তোমাদের বাসার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। তারপর আর কোনো খবর নেই।
রোদ্দুর তো বাসায় আছে। ঘুমুচ্ছে এখন। আর মিতু আমাকে বাসায় দেখে, কোনো প্রশ্ন না করেই, রোদ্দুরকে রেখে রাগ করে সিএনজি অটো নিয়ে চলে গেছে। এতক্ষণ তো ওর বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা।
পৌঁছেনি। গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়ে লাইন কেটে দিলেন শাশুড়ি।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বাজ পড়ল। আলোশূন্য হয়ে বোকার মতো কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরে পেয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলে ফেলল সব কথা।
সায়েরা আমিনও ভীত হয়ে বললেন, ও কেবল তোমার বউ না, রোদ্দুরের মাও। এ বংশের বংশধরদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। অবহেলাও না।
আমিতো উপেক্ষা করিনি, অবহেলাও না। ওই তো কোনো কথা শুনে রাগ করে চলে গেল।
এ রাগের পেছনের ঘটনাও তত বড়। ঘটনা একদিনে তৈরি হয়নি। দিনে দিনে হয়েছে।
মিতুর দিকে মায়ের অনুভবের পাল্লা ভারী মনে হলো। প্রমিত অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
সায়েরা আমিন আবার বললেন, আমাদের মেয়েরা সহজে সংসার। ভেঙে বাপের বাড়ি যেতে চায় না। হয় শাশুড়ির জ্বালায় পালায় বা স্বামীর নির্যাতনে।
আমি তো ওকে নির্যাতন করিনি। তুমিও না। বরং মাঝে মাঝে দেখি তুমি আমার চেয়েও ওকে বেশি লাই দাও, ভালোবাসো। এখনও ওর পক্ষ নিচ্ছ।
নির্যাতন কখনও চোখে দেখা যায়। কখনও দেখা যায় না। তোমার আচরণের কারণে মনে কষ্ট পেতে পারে। কষ্ট দেওয়াও এক ধরনের জখম। নিপীড়ন।
ভুল বুঝে কষ্ট পেলে আমি কী করব?
ভুল ভেঙে গেলে সেটা মিটে যাবে তবে বিশ্বাসের ঘা খেলে সেটা মেয়েরা মুছতে পারে না। ভুলতেও না।
ছ্যাৎ করে শব্দটা আঘাত হানল বুকে। মিতু কি মাকে কোনো বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেছে? মায়েরা ছেলের দোষ দেখে না, বউমাদের দোষ খুঁজে বেড়ায় কেবল। অথচ মা এসব কী বলছেন!
বিশ্বাসের ঘা শব্দ দুটো বেশ জোরালোভাবে নাড়িয়ে দিল প্রমিতকে। নিজেকে খুঁড়ে দেখতে লাগল। অবিশ্বাস্য হওয়ার মতো কোনো কাজ করেছে ও! হঠাৎ মনে পড়ে গেল
এক্সবুমর কথা। ওর বিষয়ে কি কিছু জেনে ফেলেছে মিতু! মাগো! মিতু কি মাকে বলে দিয়েছে! এজন্যই মা সব কঠিন কঠিন কথা এমন শীতল কণ্ঠে বলে গেল! এসব ব্যাপারে মাকে প্রশ্ন করা চলে না ভেবে ফিরে এলো নিজের ঘরে। রোদ্দুর এখনও ঘুমাচ্ছে। মেয়ের মুখেও ও একটা ছায়া দেখতে পেল, কালো মেঘের ছায়া। কোথা থেকে এলো এ ছায়া! কীভাবে তাড়াবে ও এ ছায়া মেঘ? ভাবনার চাকায় গড়াতে গড়াতে ভাবল একবার কল করবে
এক্সবুমকে। নম্বরটা মুখস্থ নেই। কীভাবে কল করবে। হতাশ হয়ে আবার তাকাল রোদ্দুরের মুখের দিকে। ওর রোদ ঝলমলে মুখে রোদের আদর নেই। মেঘ কেবল গাঢ় হচ্ছে।
এমন হচ্ছে কেন? দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল কয়েক শ গুণ বেশি।
এবার সে এসে শুয়ে পড়ল মেয়ের পাশে। আবার তাকিয়ে রইল মেয়ের মুখপানে। ওই মুখে বসে আছে মেয়ের মায়ের মুখের আদল। একদম বাস্তব। একদম জ্যান্ত দৃশ্য যেন এটি। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগল। বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল। বুকে আতঙ্কজনক একটা তাড়না জেগে উঠে চেপে বসল। মিতু রাগ করে কোনো ভুল করে বসবে না তো! ভাবনাটা চলমান চিন্তার স্রোতে জট বাধিয়ে দেওয়ায় আবার প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে না তো! শুনেছে এমন ব্যথা হার্ট অ্যাটাকেই হতে পারে। শোনা কথা মাথায় চেপে বসতে দিতে চাইল না ও। তবু ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা জয় করবে কী দিয়ে। মেডিটেশনে থেকে এসেছে পজিটিভ চিন্তার কথা। যেকোনো ঘটনার মধ্যে থেকে ইতিবাচক উত্তরটা খুঁজে নেওয়ার কথা। ইতিবাচক চিন্তা কী হতে পারে এ মুহূর্তে, খুঁজতে লাগল ও। হঠাৎ উত্তর এসে গেল মাথায়–চট করে রেগে যায় মিতু। তার রাগ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণ পর শীতল হয়ে যাবে। হয় তার মার কাছে যাবে অথবা মেয়ের কাছে। দুটো জায়গা নিরাপদ। আর রোদ্দুর তো এখন আছে পাশে। রোদ্দুরের কাছে ছুটে আসবে নিশ্চয়। তখন সব কথা খুলে বলা যাবে। দারুণ তো! নিজেকে বাহবা দিল প্রমিত। নতুন ভাবনার ছোঁয়া পেয়ে মাথার চাপ কমে গেছে। ব্যথাটাও হালকা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের মাথায় আবার হাত রাখল ও। আর তখনই সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শের স্পন্দন ছুটে গেল মস্তিষ্কের দিকে। স্বস্তির অনুকম্পন টের পেতে থাকায় আবার উঠে মুঠোফোন হাতে নিয়ে বাইরে এসে কল করল মিতুকে।
সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না–যান্ত্রিক কথা শুনে মাথাটা আবার টনটন করে উঠল।
ছয়
মাম্মি! পানি দাও। বুটা শুকিয়ে যাচ্ছে! কন্যা রোদ্দুরের কথা স্পষ্ট শুনতে পেল মিতু। ঝিমুনি থেকে সচেতন হয়ে গেল ও। নিজেকে আবিষ্কার করল স্থবির বসে থাকা সিএনজি অটোতে। এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে বুঝল চারপাশে স্থির দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি আর গাড়ি। জ্যাম। মহাজ্যাম। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল প্রায় এক ঘণ্টা বসে আছে এখানে। মেয়ের স্বর শুনে অস্থির হয়ে ওঠায় ওর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছাও টনটন করে উঠল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে বুঝল ওটা বন্ধ আছে। রাগের মাথায় কখন বন্ধ করেছে তা মোটেই টের পায়নি। আঙুলের সিকিউরিটি স্পর্শ পেয়ে মোবাইল সেট খুলে গেল। কিছুটা সময় নিচ্ছে নেট কানেকশনের। চাকার মতো ঘুরছে নেট সংযোগকারী ওয়েভ। এই ফাঁকে চালকের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, জ্যাম না অন্যকিছু?
চালক মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল মিতুকে। তারপর জবাব দিল, জ্যাম। অন্যকিছুটাও জ্যাম।
সিগন্যাল বাতি চলছে না?
চলছে। লাল গিয়ে হলুদ হয়, হলুদ আবার সবুজ হয়। এই হাল চলছেই।
কোনো ঝামেলা হচ্ছে না তো সামনে?
ভিআইপি যাবে মনে হয়, আপা।
দেখে কথা বলছেন? নাকি না-দেখে?
অনুমানে বলছি।
ও।
সেট রেডি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে মেসিজের পর পর মেসিজ ঢুকতে লাগল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢুকল ওর মায়ের কল।
কোথায় তুমি, মিতু?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আসছি।
আসছি মানে কি?
মানে জ্যামে বসে আছি। বাসায় আসছি।
এলেই হবে? রোদ্দুরকে রেখে এসেছো। মেয়েটা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে! আর এটা কেমন রাগ! স্বামীকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছো। কেমন রাগ, বলো?
স্বামী বাসায় শুয়ে আছে। বিপদে নেই। আর এখন তার মেয়েকে নিয়ে ভালোই সময় কাটবে তার। এতে এত খেপার কী আছে!
শান্ত স্বরেই জবাব দিয়ে আবার বলল, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন আম্মু?
আশ্চর্য! মলম পার্টির কবলে পড়ে প্রমিত মহাখালি ফ্লাইওভারের ব্রিজের তলে পড়েছিল সারারাত। দুই তরুণ তাকে ভোরে বাসায় দিয়ে গেছে। ততক্ষণে তার চেতনা ফিরে এসেছে। আর তুমি কিনা তাকে না-দেখেই চলে এলে! ঘরে না ঢুকে কিছু জিজ্ঞেস না করে বেরিয়ে গেলে বাসা থেকে!
মিথ্যা বলেছে তোমাকে। শাশুড়িও মিথ্যা বলে আমাকে কৌশলে বাসায় ফিরিয়েছিল। সে ঠিকই রাতে ঘরে ছিল!
সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে না? মনগড়া ধারণা দিয়ে কি জীবন চলবে?
লেকচার দিয়ো না, আম্মু। ওর চালাকি আমি বুঝি। হাড়ে-হাড়ে, কোষে কোষে ওকে চিনে ফেলেছি আমি। তার সঙ্গে ঘর করা মানে নরকে বাস করা। নরকে থাকতে বলছে আমাকে?রোষের পারদ তুঙ্গে উঠে যাওয়ায় উত্তর না শুনে ও চট করে লাইন কেটে মুঠোফোনের সুইচ বন্ধ করে দিল। আর কী মেসিজ এসেছে, কে কে কল করেছে, কিছুই দেখার সময় পেল না।
আপা, লাইন ক্লিয়ার হয়ে গেছ। বোধ হয় বড় কোনো ভিআইপি গিয়েছিল। আশা করছি আর সময় বেশি লাগবে না। শান্ত হোন, আপা।
শুদ্ধ উচ্চারণে চালকের কথা শুনে চমকে উঠল ও।
শান্ত হোন কথাটা ওর গালে চড় বসিয়ে দিল। রেগে উঠতে গিয়েও রাগল না। দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রশ্ন করল, আপনি পড়াশোনা করেছেন!
চালক কথাটা শুনেছে স্পষ্ট। তারপরও মাথা ঘোরাল না। কথার জবাব না দিয়ে চুপ মেরে রইল। অটো চলছে। যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছে না। ধীরে ধীরে চলছে। সূর্য বেশ উপরে উঠে গেলেও কুয়াশা কাটছে না। শীতও যে খুব বেশি, তাও না। তবু কাঁধের শালটা গায়ে জড়িয়ে ঠিকঠাক হয়ে আবার প্রশ্ন করল, প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন। শোনেননি?
শুনেছি।
ভদ্রতা হচ্ছে শোনা কথার জবাব দেওয়া।
জানি।
তো! জবাব দিচ্ছেন না কেন?
প্রশ্নটা কেন করেছেন, জানতে পারি? বুঝলে জবাব দিব। আপনার প্রশ্নের পেছনের প্রশ্ন মাথায় টোকা দেয়নি। জবাব কী দিব, বলুন?
আবারও চমকে উঠল মিতু। এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে যে ছেলে সে নিশ্চয় উচ্চ শিক্ষিত হবে। জবাব ধরে নিল ও। পড়াশুনা করা ছেলেই মনে হলো চালককে। নিজে থেকে চুপ হয়ে গেল, উত্তর না পেয়ে খানিকটা অপমান বোধ করলেও নিজের দহনটা চাপা দিয়ে শান্ত হতে পারল। আর তখনই মাতৃস্নেহের খিদায় রোদ্দুরের জন্য কেমন যেন করতে লাগল। অস্থির অস্থির চনমনে অবস্থায় ও আবার হাতে নিল মুঠোফোন। আর ঠিক তখনই রেড সিগন্যালে আবার দাঁড়িয়ে গেল সিএনজি অটো।
এইটে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম চট্টগ্রাম জেলায়। এসএসসি পরীক্ষার সময় বাবা মারা যায়। আর পড়াশোনা হয়নি। রেজাল্টও ভালো হয়নি। তবে প্রচুর বই পড়ি। বই পড়াটা যদি শিক্ষাগত যোগ্যতা হয় তবে আমার জন্য তা বেশ উঁচুই হবে।
আরেকটা ধাক্কা খেল মিতু। ধারণা করেছিল চালক উচ্চ শিক্ষিত। মাস্টার্স পাস তো অবশ্যই করে থাকবে। ধারণা মিলল না। যে ছেলে এসএসসি পাস করতে পারেনি, তাকে উচ্চ শিক্ষিত বলা তো যাবেই না। শিক্ষিত বলাও উচিত নয়। তবে তার কথা বলার ধরনটা সুন্দর। কথার মানে তাকে শিক্ষিত বলা যেতে পারে।
বই পড়েন?
পড়ি। বললামই তো।
কার কার বই পড়তে ভালোবাসেন?
ওপারে শীর্ষেন্দু, সুনীল। আর এপারে সৈয়দ হক। হুমায়ূন।
বাহ! শীর্ষেন্দু পড়ে ফেলেছেন?
হ্যাঁ। তাঁর অনেক বই পড়েছি।
তাঁর বিখ্যাত দুটো বইয়ের নাম বলুন তো?
মানবজমিন, পার্থিব, দূরবীন।
বাব্বা! দুটোর জায়গায় তিনটে বইয়ের নাম বলে ফেলতে পারলেন!
আবার চলতে শুরু করল অটো। ঝাঁঝালো সব হর্ন বাজতে লাগল প্রায় সবকটা গাড়ি থেকে। আচমকা একটা ধাক্কা টের পেল মিতু। প্রচণ্ড ধাক্কায় ও উড়ে বাড়ি খেল চালকের পেছনে থাকা রডের গ্রিলের সঙ্গে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল মিতু।
স্পিড় সামলাতে না পেরে পেছনের চলন্ত অটো ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কা জোরালো না হলেও মিতুর আঘাতটা জোরালো হয়ে গেল। চালকের কোনো সমস্যা হয়নি। যাত্রীর কী অবস্থা হয়েছে দেখার জন্য পেছনে ফিরে বোঝার চেষ্টা করল সে।
যাত্রীকে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত সাইড করে অটো থামিয়ে ও দেখতে লাগল যাত্রীর অবস্থা। সর্বনাশ! কপাল ঢোল হয়ে ফুলে যাচ্ছে। রক্তপাত ঘটেনি বাইরে। ভেতরটা এত ফুলে গেল দেখে খানিকটা সময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাত্রীকে ওভাবে রেখেই ড্রাইভিং সিটে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ছুটে গেল হাসপাতালের দিকে। জরুরি বিভাগে এসে অটোর লক করা দরজা খুলে যাত্রীকে কোলে নিয়ে ছুটে গেল ও ডক্টরস ডিউটি রুমের দিকে। দুজন কর্তব্যরত নার্স ট্রলি নিয়ে ছুটে এসে শুইয়ে দিল রোগীকে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখলেন অবস্থা তত খারাপ নয়। চোখের কোণে আঙ্গুলের প্রেসার দেওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে শরীর নড়ে উঠল। চিকিৎসকের মুখের রেখা দেখে দুশ্চিন্তার দাগ উড়ে গেল। তারপর বললেন, জ্ঞান ফিরে আসবে। তবু ব্রেনের একটা ইমেজিং করা উচিত।
চালক কিছুটা অবাক হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বুঝতে পারছে না। প্রাথমিক চিকিৎসার একটা স্লিপ দিয়ে বললেন, এসব কিনে আনুন। আর এমআরআইর জন্য প্রস্তুত না থাকলে জোগাড় করে নিন।
আমি সিএনজি অটোচালক। ওনার কেউ না। চট করে ঘুরে চালকের মুখের দিকে আবার তাকালেন চিকিৎসক। কিছুক্ষণ ভেবে প্রশ্ন করলেন, ওঁনার পরিচয় পেয়েছেন?
না।
মুঠোফোনটা কোথায়? শেষ কল কোথায় করেছেন উনি, দেখে নিন।
সঙ্গে সঙ্গে চালক ছুটে এলো বাইরে। অটোর ভেতর খুঁজল। মুঠোফোন নেই। ব্যাগটাও। যাত্রীকে যখন ভেতরে নিয়ে গেল, তখন মনে হয়নি এসবের কথা। সড়কের পাশে এভাবে আর অটো রেখে দরজা খুলে কখনও সে দূরে যায়নি। বিপদের সময় কিছুই মনে ছিল না ওর। এখন এসে দেখে সব গায়েব। ভাগ্যিস অটোটাও গায়েব হয়ে যায়নি।
কী করবে এখন? অটো কার কাছে রেখে যাবে? যাত্রীর খোঁজ না নিয়ে চলে যাব? একের পর এক চিন্তা জেগে উঠতে লাগল ওর মাথায়।
হঠাৎ নজর এলো সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা অটোর দিকে। চালকের উদ্দেশে সব ঘটনা খুলে বলল প্রথম, তারপর অনুরোধ করল, ভাই একটু কি দেখে রাখবেন আমার অটোটা? আমার যাত্রীর অবস্থা খারাপ। ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। ডাক্তারকে বলে আসি মোবাইল ফোন আর ব্যাগ চুরির কথা?
উনি বিশ্বাস করবেন না। ভাববেন আপনিই মেরে দিয়েছেন। চালকদের প্রতি ভদ্র মানুষের কোনো ভালো ধারণা থাকে না।
মন খারাপ হয়ে গেল ওর। কথাটা ঠিক বলেছে, বুঝতে পেরেও মরিয়া হয়ে অনুরোধ করল, ভাই, যাব আর আসব। চিকিৎসককে না জানিয়ে তো আমার চলে যাওয়া উচিত হবে না।
আচ্ছা, যান। আমি যাত্রী পেয়ে গেলে অপেক্ষা করতে পারব না। বলে রাখলাম।
তাই সই। বলেই চালক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ডাক্তারের উদ্দেশে বলল, স্যার, ব্যাগ আর মোবাইল ফোন পেলাম না সিএনজির ভেতর। বোধহয় আমি ওনাকে নিয়ে ভেতরে আসার পর কেউ মেরে দিয়েছে।
কেউ, না কি আপনি, কে মেরেছে?
চালকের মাথায় বোমা পড়ল। হতভম্ব হয়ে বলল, আমি তো যাত্রীকে নিয়ে দৌড়ে এসেছি, স্যার।
যাত্রীকে নয়। সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। সুযোগ পেয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন। তো কপালে আঘাতটা কি আপনি করেছেন, না আপনার কথিত ছিনতাইকারী?
কী বলছেন, স্যার?
কিছু বলছি না, প্রশ্ন করলাম।
আমি এখন কী করব? রাস্তার পাশে রেখে এসেছি সিএনজি। হয় চুরি হয়ে যেতে পারে অথবা সার্জেন্ট এসে মামলা দিয়ে দিতে পারে। আমি যাচ্ছি।
যাচ্ছি মানে? ওনার অভিভাবক কে হবে?
আমি তো অভিভাবক নয়ই, সিএনজির অটোচালক?
দিন। আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দিন। যাচাই করে দেখি?
পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বের করে দিল ও। ভাগ্যিস এটা পকেটে ছিল। সাধারণত সিএনজির ভিতর ফোল্ডারে থাকে। আরও রোগী আসছে। সঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বজনদের ভিড়। চিকিত্সকের হাতে সময় নেই। তবুও ড্রাইভিং লাইসেন্সটা তিনি হাতে নিলেন। টেবিলে রেখে মুঠোফোনের ক্যামেরা অপশনে গিয়ে ছবি তুলে রাখলেন। রোগীর ফাইলের ঠিকানার জায়গায় লিখে রাখলেন সব তথ্য। তারপর বললেন, আলম, আপনাকে দেখে শিক্ষিত যুবকই মনে হচ্ছে। আর আপনি মানবিক কাজটাই করেছেন। তবু বলতে হয়, এটা পুলিশ কেস। তদন্তে প্রমাণিত হবে, কীভাবে ওনার আঘাতটা হলো, কীভাবে ব্যাগ আর মুঠোফোন খোয়া গেল, বিষয়টা নিয়ে খোঁজ-খবর করবে পুলিশ। ব্রট ডেথ বা ব্রট আনকনশাস অভিভাবকহীন রোগীদের নিয়ে ঝুঁকি পোহাতে হয়। আমাদের আদালতেও যেতে হয়। আপনিও সেই ভোগান্তির সঙ্গী হলেন।
আলম স্তব্ধ হয়ে গেল। ওদিকে রুজি রোজগারের উৎস সিএনজিটা নিয়েও চিন্তার চাপ বেড়ে গেল। পাহারার অটোর চালক যদি যাত্রী পেয়ে যায়, সে চলে যাবে। অরক্ষিত হয়ে যাবে তার সম্বল অটোটা। এসব ভাবনা থামিয়ে একবার ও তাকাল রোগিণীর মুখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মায়া টের পেল। এই অসহায় মানুষটাকে এভাবে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কেবল মনে পড়তে লাগল জ্যামে বসে তিনি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কেবল রাগ না, চিৎকার করছিলেন। চিৎকার করে লাইন। কেটে দিয়েছিলেন। মেয়েটা রাগী হলেও ভালো। শান্ত হওয়ার পর পড়াশোনার বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। আপন হয়ে গিয়েছিলেন দুচার কথায়। এমন বিপদে কী করা উচিত। ঝামেলায় তো জড়িয়ে গেল ও। পালিয়ে যাবে কোথায়?
আলম, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওনাকে অ্যাডমিশন দেওয়া হয়েছে। নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি দিয়েছি। যান। ওয়ার্ডবয় নিয়ে যাবে। রোগীর সঙ্গে থাকেন। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত, ওনার অভিভাবক না পাওয়া পর্যন্ত আপনিই এখন ডকুমেন্টেড অভিভাবক।
স্যার, যদি অভয় দেন একটা কথা বলি।
কী? বলুন। নির্ভয়ে বলুন।
ওনার একটা ছবি তুলে ফেসবুকে দিন। ওনার পরিচিত কারও নজরে পড়লে নিশ্চয় ছুটে আসবেন তারা। আর সবাইকে রিকোয়েস্ট পাঠান যেন তাঁরা শেয়ার দেন।
ভালো কথা বলেছেন। এটা করা যায় তবে অচেতন এ রোগীর কথা ইতিমধ্যে পুলিশে ইনফর্ম করা হয়ে গেছে। কেউ হারিয়ে গেলে বা নিখোঁজ হলে মানুষ প্রথমে নিকটের থানায় খোঁজ নেয়। সেখানকার তথ্য নিয়ে হাসপাতালে আসে। হারানো স্বজনকে পেয়ে যান তারা।
পুলিশের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেও আলম হাল ছাড়ছে না। আবার নিজের সিএনজি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেও মুক্তি পাচ্ছে না।
ডিউটি নার্স এসে বললেন, এই যে এ অজ্ঞান রোগীর সঙ্গে কে আছেন, ওয়ার্ডে নিয়ে যান এ সিট খালি করুন।
ব্যস্ততার মাঝেও রোগিণীর ছবি তুলে নিলেন চিকিৎসক। প্রয়োজনে ছবিটা ফেসবুকে দেওয়া যাবে। চট করে এটি দেওয়া উচিত হবে না। অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান যদি ফিরে আসে, তাহলে তো কথা নেই। এথিকস অনুযায়ী সব পথ বন্ধ হলে, পুলিশের কোনো সোর্স থেকে স্বজনরা খবর না পেলে তখন ফেসবুকে দেওয়া যেতে পারে, ভেবে রাখলেন তিনি।
রোগীকে ওয়ার্ডে-নেওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে ওয়ার্ডবয়। ট্রলির পেছন পেছন আলম যন্ত্রের মতো হেঁটে যেতে লাগল। তার মনে উদয় হতে লাগল যাত্রীর বলা শেষ কথাটা–বাবা! দুটোর জায়গায় তিনটে বইয়ের নাম বলে ফেলতে পারলেন!
সাত
ঘুম থেকে উঠেই মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল রোদ্দুর। প্রমিতের চোখেও নেমে এসেছিল রাজ্যের ঘুম। মেয়ের কান্নায় ওরও ঘুম ভেঙে গেল। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। তার আগে কল করল শাশুড়িকে।
মিতু বাসায় গিয়েছে, আম্মা?
না। ফেরেনি। তবে মোবাইলে কথা হয়েছে। রাগ করে লাইন। কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচ অফ করে দিয়েছে। বলেছিল জ্যামে বসে আছে। আর কল করেনি। সুইচ অন করেনি।
এখন কী করব? রোদ্দুর কাঁদছে ওর মায়ের জন্য।
তুমি এখন কেমন আছো?
ভালো বোধ করছি। মনটা অস্থির হয়ে আছে। টেনশন হচ্ছে। মিতু এখনও বাসায় ফেরেনি জেনে দিশেহারা লাগছে।
প্রায় দুপুর হয়ে গেল! এখনও আসছে না। মোবাইলও অন করছে না! কী করব বুঝতে পারছি না আমিও। তুমি রোদ্দুরকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে এসো। বলেই লাইন কেটে দিলেন তিনি। শাশুড়ির কথা শুনে ভীত হয়ে গেল প্রমিত। মিতুর যে রাগ তা থেকে যেকোনো ভয়াবহ কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে ভেবে দম বন্ধ বন্ধ লাগতে শুরু করল। রোদ্দুরের কান্না ওকে ভেঙেচুড়ে নতুনভাবে জাগিয়ে দিতে লাগল। একই সঙ্গে আলি আকবর স্যারের কথাও মনে হানা দিতে শুরু করেছে। নিজের দোষটা ধরার চেষ্টা করে ও আবিষ্কার করল সত্যিই কম সময় দিতে পারে পরিবারকে। তাতে মিতুর মনে। চাপ তৈরি হয়ে থাকা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক চাপ থেকে রেগে রেগে থাকে ও। হুট হুট তা সীমা ছাড়িয়ে যায় ঠিক। তবে সে যে স্বামীকে প্রাণপণে ভালোবাসে তার মধ্যে কোনো খাদ নেই। নিজেকে খুঁড়ে দেখতে গিয়েও ও আবিষ্কার করল জৈবিক সত্তার লালসার চিত্র। এক্সবুমর সঙ্গে সম্পর্কটার গভীরতা নেই। ফালতু মজা করতে করতে গভীরতা তৈরি হচ্ছে কিনা ভেবে শঙ্কিত হলো। একারণেই হয়তো মিতুকে না-বুঝে অবহেলা করে যাচ্ছে, নিজে তা বুঝতে পারছে না। আমি তো মিতুরই আছি। মিতুও আমার। এ বিশাসের ফাঁক দিয়ে অন্য কোনো চারাগাছ গজিয়ে উঠতে পারে ভেবেও শঙ্কিত হয়ে উঠল। নিজেকে ভালো করে আবিষ্কার করতে না পারলেও নিজের দোষত্রুটির গন্ধ পেয়ে চমকে চমকে উঠতে লাগল প্রমিত।
আব্বু, চলো। আম্মুর কাছে চলো। বাবার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল রোদ্দুর।
যাব। আগে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নাও।
না। আমি খাব না। আম্মুর কাছে যাব।
মেয়েকে কোলে তুলে নিল প্রমিত। মায়ের জন্য মনের আকুলতা ওর মধ্যেও দিশেহারা অবস্থা তৈরি করে ফেলল।
এ সময় সায়েরা আমিন এসে বোঝাতে লাগলেন নাতনিকে।
তোমার আম্মুর সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার নানু ভাইয়ের। সে ভালো আছে। ভেবো না।
আমি কথা বলব। মোবাইল ফোনে ধরিয়ে দাও। বলেই ও ছুটে গেল বাবার সেটের দিকে। বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলল, কল করো। আম্মুর সঙ্গে কথা বলব।
কিছুক্ষণ আগে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে ও জেনেছে মিতুর মোবাইল ফোন সুইচ অফ হয়ে আছে। কল করেও ধরা যাচ্ছে না তাকে। জেনেও মেয়ের আবদার পূরণের জন্য আবার কল করল।
মোবাইলটি বন্ধ আছে স্বয়ংক্রিয় শব্দ তিনটে আঘাত হানল মস্তিষ্কে। তারপর সেট ধরিয়ে দিলো মেয়ের কানে।
না, না। আমি আম্মুর কথা শুনব। আম্মুর কাছে যাব। শব্দ তিনটে রোদ্দুরকে আরও বেপরোয়া করে তুলল।
সায়েরা আমিন আবার নাতনিকে আদর করতে করতে এগিয়ে গেলেন। রোদ্দুর তাতে সাড়া না দিয়ে লাফ দিয়ে খাটে উঠে বালিশে মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে লাগল।
প্রমিত খাটে এসে পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, চলো, নানুর বাসায় চলো।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল রোদ্দুর। হাতের উল্টো পিঠ চোখ মুছে বলল, চলো।
আট
নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ঢুকে মাথা ধরে গেল আলমের। ফরমালিনের গন্ধ তো আছে, একই সঙ্গে রোগীর আর স্বজনদের ভিড় দেখে ঘাবড়ে গেল ও। কী করবে? কার সঙ্গে কথা বলবে? এক চালকের জিম্মায় রেখে আসা নিজের আয় রোজগারের উৎস অটোর চিন্তায়ও দিশেহারা হয়ে যেতে লাগল।
সব টেনশন চেপে বসছে। শুধু বসে যাচ্ছে তা নয়, চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। অসহায় আলম ট্রলির সঙ্গে হেঁটে চলে এলো নির্ধারিত বেড নম্বরের কাছে। খালি বেড পাওয়া যায় না বললে চলে। তবু বেড পাওয়া গেল। এ ওয়ার্ডে রোগীর চাপ কম থাকে। তবে হঠাৎ হঠাৎ চাপ বেড়ে যায়। এ মুহূর্তে কম। বেড়ে তোলার পর নড়ে উঠল মিতু।
যাত্রীকে নড়ে উঠতে দেখে শুকনো পরানটা ভিজে উঠল। উনি অপরিচিত যাত্রী, ভুলেও মনে এলো না কথাটা। ভেতরের কেউ, একদম গভীর থেকে, মমতলে টোকা দিয়ে পরম মমতায় জাগিয়ে তুলল। কপালে হাত রেখে আলম প্রশ্ন করল, চোখ খুলুন। এই যে আমি, আলম, অটোচালক, আছি আপনার পাশে।
চোখ খুলল না। নড়াচড়াও না। তবে চোখের পাতা খানিকটা কেঁপে কেঁপে ওঠায় কঠিন ভয়টা উড়ে গেল আলমের মন থেকে। উনি বেঁচে আছেন–বোধটাও স্বস্তি দিল। আর তার ফাঁক দিয়ে মনে পড়ে গেল নিজের অটোটার কথা।
কর্তব্যরত নার্সের উদ্দেশে বলল, আপা। আমি রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে এসেছি। নিরাপদ জায়গায় পার্কিং করে আবার আসছি। যেতে পারি?
আলমের মুখের দিকে তাকিয়ে নার্স বললেন, এমন সিরিয়াস রোগী ফেলে বাইরে যাবেন?
যাওয়ার কি ইচ্ছে হয় এমনি এমনি! প্রয়োজন আছে, আপা।
কৌশলে ও গাড়ি শব্দটা ব্যবহার করেছে। ড্রাইভার বা সিএনজি চালক নয়।
অ্যাডমিশন শিটের ওপর দেখলাম চালকের নাম লেখা আছে। আপনি কে হন ওনার?
ধরা খেয়ে আলম বলে দিল আসল কথা, ওনার কেউ না। আমি সিএনজি অটোচালক। কথাটা শোনামাত্র ত্বরিত মাথা ঘুরিয়ে আলমের মুখের দিকে তাকালেন নার্স। আর তখনই অ্যাডমিশন শিট দেখিয়ে বললো, দেখছেন, এটা?
না। কী এটা?
দেখুন সিল মারা আছে–পুলিশ কেস।
জরুরি বিভগের কর্তব্যরত চিকিৎসকের কথা যে কেবল কথার কথা ছিল না, বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে চুপ মেরে রইল ও।
ইচ্ছা করলেই আপনি চলে যেতে পারেন না। চলে গেলেও পুলিশ আপনাকে খুঁজে বের করবে। নানা ভোগান্তি চরমে উঠবে তখন। নার্স আবারও বললেন।
কথা বেরোচ্ছে না। আলমের কণ্ঠনালি অসাড় হয়ে গেছে। গলার ভেতরের পেশিও ঠেসে ধরেছে গলার স্বর। শাসও বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত।
কী? এমন ভয় পেলেন কেন? কোনো ক্রাইম করেছেন?
না। এবার দৃঢ় গলায় জবাব দিল আলম।
এমনি এমনি অপরিচিত রোগীর উপকার করতে এসেছেন?
না।
তো। কী স্বার্থ?
স্বার্থ নেই।
আপনি কি নিজেকে খুব মানবিক মনে করেন?
হ্যাঁ। জোরেই শব্দটি ব্যবহার করল আলম। হ্যাঁ-এর দাপুটে স্বর নার্সের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। চালকের স্বার্থটা বুঝতে পেরে আর কোনো প্রশ্ন না করে রোগীর সেবায় মন দিলেন তিনিও।
গলার স্বর খুলে যাওয়ার পর ভয় উড়ে গেছে। ভয়শূন্য আলম বলল, আমি যাব আর আসব। ধরে নিন আমিই ওনার অভিভাবক। পুলিশ কেস হয়েছে তার জন্য নয়, মনের টানেই তাকে পরিবারের হাতে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত আমার দায়িত্ব।
নার্স বাধা দিল না। উনি বুঝে গেছেন এ ছেলের মধ্যে ভণ্ডামি নেই। ঘটনার টানে হয়তো জড়িয়ে গেছে এমন দুঃখজনক ঘটনায়।
আরেকবার রোগীর কপালে হাত রাখল আলম। না। ঠাণ্ডা নয়। স্বস্তি পেল অনুভবে। তারপর দ্রুত বের হতে গিয়ে দেখল এক রোগীর বেডের পাশে, রোগী ঘুমুচ্ছে, ফ্লোরে পড়ে আছে আজকের নিউজ পেপার। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। পত্রিকার শিরোনাম দেখে ভীত হয়ে গেল তা নয়, মন খারাপ হয়ে গেল ওর। মেঝেতে পড়ে থাকা পেপারটা বেডের ওপর তুলে দিতে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়ে নিল আরও কয়েকটি গ্রাফিকেল উপস্থাপনার তথ্য : সড়ক দুর্ঘনায় ২০১৯ সালে মোট নিহত ৫.২২৭। এর মধ্যে পেছন থেকে ধাক্কায় নিহত হয়েছেন ১০৫।
ধাক্কা শব্দটা বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল। ওর অটোকে ধাক্কা দিয়েছে আরেক অটো। ধাক্কায় আহত হয়েছেন অচেনা মহিলা যাত্রী। ট্রিটমেন্ট শিটে লেখা হয়েছে নাম জানা নেই। বাহকের নাম তার। ধাক্কায় নিহত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বছরে ১০৫, সংখ্যাটা তো কম নয়। এ সংখ্যার অংশ হবে না তো আজকের অচেনা মহিলা যাত্রী? ভাবনার দাপটে কেঁপে উঠল পুরো শরীর। পেপারটা বেডে রেখে সে এগিয়ে গেল সামনে।
নয়
উবার থেকে নেমে একছুটে নানু বাড়ি ঢুকল রোদ্দুর। নানুভাইকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে ধরল ও। নানুর শাড়ির আঁচল টেনে চিৎকার করে রোদ্দুর বলতে লাগল, আমার মাম্মি কোথায়?
জবাব দিলেন না রোদ্দরের নানু আসমা বেগম।
তোমার মাম্মির সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা বলার পর আবার মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছে।
আসেনি কেন বাসায়? কোথায় গেছে? আমাকে ফেলে কোথায় গেছে? প্রশ্নের জবাবে জানা নেই কারও। সবাই চুপ হয়ে আছে।
রোদ্দুর কাঁদছে। কাঁদুক। ভাবলেন আসমা বেগম। প্রমিত একবার কন্যাকে জড়িয়ে ধরতে গেল।
এক ঝটকা দিয়ে দূরে সরে গেল রোদ্দুর। খাবার টেবিলে ছিল একটা ভরা গ্লাস। ছুঁড়ে মারল সে ওটা। দেয়ালে আছড়ে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
তুমি আমাকে ধরবে না। তোমার আদর চাই না। আমার মাম্মিকে বকেছো তুমি। আমার মাম্মিকে এনে দাও।
মেয়ের কষ্ট দেখে পাথর হয়ে গেল প্রমিত। রোদ্দুরের নানুও। নিজের প্রতি রাগ হলো। কেবলই মনে হতে লাগল রোদ্দুর বড় হয়ে কখনও ওকে শ্রদ্ধা করবে না। ঘৃণা করবে। আর এ কষ্টের কারণে মন থেকে ওকে দূরে ঠেলে দিবে। বউয়ের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, বিষয়টা থেকে বড়ো ঘটনা এখন কন্যার মমতা হারানোর ভয়।
ভয় নিয়ে আবার কল করল মিতুর নম্বরে। না। এখনও মুঠোফোন চালু করেনি সে! ভয় নয়। এবার ক্রোধ জেগে উঠতে লাগল ওর মনে। আর সঙ্গে বাজে চিন্তা–রাগেরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। ওকে যা শাস্তি দেওয়ার আছে দিক। কন্যাকে কেন দেবে। রাগ আর অভিমানের মিশ্র অনুভবে রোদ্দুরের সামনে থেকে সরে গেল প্রমিত। দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা উড়ে এসে রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে ধরল বাবাকে। শার্ট খামছে ধরে বলে বসল, তুমি কোথায় যাও। আমার মাম্মিকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও। তোমার বাড়িতে আর যাব না আমরা। এ বাড়িতে থাকব।
এতটুকু মেয়ের কথা শুনে প্রমিতের পা অবশ হয়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে মেয়েকে দেখে বলল, তোমার মা রাগ করে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। আমি জানি না কোথায় লুকিয়েছে। তুমি ভেবো না। রাগ কমে গেলে বাড়ি ফিরবে সে।
না, তুমি বকেছ মাম্মিকে।
বকিনি। তুমিই তো দেখেছো, আমাকে না দেখে আমাদের ঘরে না ঢুকে বাইরে থেকে চলে গেছে সে। আমি কখন বকলাম!
ঘটনা মনে পড়ল রোদ্দুরের। বাপি বকেছে দেখেনি সে। তবু মায়ের পক্ষ নিয়ে বলল, আরেক দিন বকেছো।
আচ্ছা বকেছি। এখন স্যরি। তোমার মাম্মি এলে স্যরি বলব।
কথা কানে তুলল না। সে আবার ছুটে গেল নানা ভাইয়ের কাছে।
আবার কল দাও, নানু।
আসমা বেগম নাতনির কথা রাখলেন। আবার কল দিয়ে রোদ্দুরের কানে ধরিয়ে দিলেন। সেট বন্ধ। ওর বুকের ধুকপুক বেড়ে গেল। কেন বেড়েছে জানে না ও।
ভাঙা গ্লাসের টুকরো জোড় দিতে গিয়ে হঠাৎ জানালার পাশে রাখা পেপার স্ট্যান্ডে চোখ গেল আসমা বেগমের। পেপারে হেড লাইনে চোখ গেল, ঢাবির ছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ। বুম করে মাথায় বোমা ফাটলেও দিনে দুপুরে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে না ভেবে নিজেকেই নিজে বোধ দিলেন। পেপারটা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ভেতরের একটা হেড লাইনে চোখ স্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবার তার শ্বাস বেড়ে গেল : বাড়ি থেকে রাগ করে রাস্তায় নেমে গাড়ির তলে চাপা খেয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে এক কিশোরী।
শ্বাস আরও বেড়ে গেল। রোদ্দুরের সে দিকে খেয়াল নেই। সে আবার খাটে উঠে শুয়ে পড়েছে। কিছুটা শান্ত মনে হচ্ছে তাকে। বাইরের দরজা দিয়ে রোদ্দুরকে দেখা যাচ্ছে। শান্ত হয়েছে দেখে প্রমিত দূর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল ওর দিকে। ঘরে ঢুকেই দেখল জানালার পাশে সোফায় বসে আছেন শাশুড়ি। হাঁপাচ্ছেন। সটান দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ও পাশে গিয়ে প্রশ্ন করল, খারাপ লাগছে, আম্মা?
কথা বলতে পারছেন না! এমন তো কখনও হয়নি। শ্বাসকষ্টের রোগ আছে, তাও জানেননি কখনও। জামাতার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না। খাটে শুয়ে দৃশ্যটা দেখল রোদ্দুর। নানুর কষ্টটা বুঝতে পারল। ছুটে এসে নানুর কোল ঘেঁষে বসার চেষ্টা করল সে। নানু তাকে আদর করতে পারছেন না দেখে বলল, বাপি। নানু ভাইকে ওষুধ দাও। নানু ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে।
অনেক কষ্টের মাঝেও বুকে সাহস ফিরে এলো। রোদ্দুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আসমা বেগম।
শাশুড়ির এ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল প্রমিত। কী করবে না করবে, বুঝতে পারল না। শশুরকে ফোন করার জন্য সেট অন করতে করতে দেখল শাস বাড়ছে না। কমছেও না। একই রকম আছে। দিশেহারা হয়ে কল করতে করতে বারান্দায় চলে এলো ও। হা কল ধরেছেন রোদ্দুরের নানা।
কী খবর, প্রমিত?
খবর ভালো না।
কেন? মিতু এখনও বাসায় ফিরেনি?
না। ওর জন্য নয়। আম্মা যেন কেমন করছে।
তোমার মা?
না। শাশুড়ি আম্মা।
বলো কি? কী করছে?
শাস কষ্ট উঠেছে ওনার।
ওর তো কখনও শাস কষ্ট রোগ ছিল বলে জানি না!
এখন হচ্ছে। আমি অ্যাম্বুলেন্স কল করেছি। আপনি হাসপাতালে চলে আসুন।
আলি আশরাফ চৌধুরী, প্রমিতের শশুর কিছুটা সময় স্তব্ধ থেকে বললেন। ওকে।
রোদ্দুর হাত বুলাতে লাগল নানুর বুকে। ও ভেবেছে নানুকে ধমক দিয়েছে বলে নানুর শাসরোগ উঠেছে। অবুঝ মনের ভেতর থেকে ভয় বেরিয়ে এলো। দিশেহারা হয়ে বলল, আমি আর গ্লাস ভাঙব না। তুমি ভালো হয়ে যাও, নানুভাই।