হ্যাঁ – ৩০

ত্রিশ

মনের আকাশে জটাবাধা মেঘ জড়ো হলেও ঝড় এলো না। প্রবল বেগে বৃষ্টি ঝরল না। আপাতত মেঘের জট খুলে খুলে হালকা হয়ে উড়ে উড়ে চলে গেলেও মনের আকাশটা থম মেরে রইল। যেকোনো সময় প্রবল বাতাসের তোড়ে উড়ে যেতে পারে সব। মুহূর্তের মাঝে তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে যাপিতজীবন। পৃথিবীর ধ্বংসলীলা কীভাবে ঘটতে পারে, সেকেন্ডের ব্যবধানে কীভাবে চুরমার হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে; তারও প্রমাণ পেয়ে গেছে প্রমিত। বাসায় ফিরে একবার মায়ের ঘরে যাওয়ার ইচ্ছা হলো। আকস্মিক থেমে গেল সে ইচ্ছার টান। নিজের ঘরে ঢোকার আগে কিচেনের দিকে চোখ গেল। হাউজ গভর্নর বিণা এসে বলল, রোদ্র মা-মণি ফোন দিছিলো। হের দাদুভাইয়ের অসুখ হইছে, হুনাইছি।

আর কিছু বলেছ?

বাসায় কেডা কেডা আহে জিগাইছিল।

কী বলেছ উত্তরে?

ডা. মোহসেনা আফা বাসায় আইছেন। খালাম্মার সেবা দিছেন, কইছি।

মনে মনে বলল, তাহলে বাসার সব খবর বিণার মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ওই বাড়িতে। কথার ভেতর গ্যাপ থাকছে। গ্যাপে গ্যাপে জটিল ভাবনারা মাকড়সার জাল বুনছে মিতুর মগজে। ওই জটাজাল কীভাবে খুলবে, জানে না প্রমিত। কথাই তো বলে না মিতু। আচমকা ওর নিজের ভাবনা অ্যাটাক করল ওকে–আগে তুমি বলো?

না। ও-ই তো বলে না। সেও বলে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সমস্যার গিঁটও শক্ত হচ্ছে। আর রোদ্দুরের গলার ফাঁস লাগছে সেই গিঁটে। মেয়েটা হাঁসফাঁস করছে। বেশ বুঝতে পারে মাকে ছাড়া তার চলবে না। বাপিকেও সঙ্গে রাখতে চায়। দাম্পত্য সম্পর্কের দ্বিমুখী চাপে ক্ষতি হচ্ছে মেয়ের। বোঝার বাকি নেই। তার ওপর বিষফোঁড়ার মতো ক্ষত তৈরি করে দিল মোনালিসার আহ্বান, নিজেকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিলো নিজেই। একটু একটু করে আলো ঢুকছে মাথায়। নিজের দোষটার জট পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে নোংরা মনে হচ্ছে। নোংরা অবস্থায় মায়ের ঘরে না ঢুকে ও ঢুকল বাথরুমে।

গোসল সেরে ভালো কাপড় চোপড় পড়ে মায়ের ঘরে ঢুকে ও দেখল মা শুয়ে আছেন বিছানায়।

মাথার কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখল প্রমিত।

চমকে উঠে চোখ খুলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন ওই চোখে বয়ে যাচ্ছে প্রবল বড়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসতে বসতে বললেন, পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে ভেবো না। বয়স হয়েছে, যা হবার হবে। আমি খুশি হব বউমা যদি রোদ্দুরকে নিয়ে এ বাসায় ফিরে আসে।

ওদের ফিরে আসার বিষয়টা আমার হাতে নেই, আম্মা। মিতুর হাতেও নেই। নিয়তির হাতে চলে গেছে, তাও বলতে পারি না। এখানে আমার রাশভারী শশুরও জড়িয়ে গেছেন। নাতনিকে ওদের বাসায় পাশে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। ওই স্কুল ছেড়ে রোদ্দুরও হয়ত আসতে চাইবে না। মিতুরও সেখানে চাকরি হয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে আমাদের কোনো দাবি টিকবে বলে মনে হয় না। তুমি বললেও শক্ত গিট খুলবে বলে আশা করতে পারছি না।

বসা থেকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন তিনি। মনে হতাশা লাগছে না কেবল, দেহেও বোধ করছেন হতাশার ছাপ। স্বামীর কথা মনে পড়ছে। অল্প বয়সে স্বামী মারা গেছেন। তারপর আর বিয়ে করেননি। নানা প্রলোভন আটকে বুক আগলে মানুষ করেছেন প্রমিতকে। ভালোই কেটেছে জীবন, বলা না গেলেও বলা যায় অঘটন তেমন ঘটেনি। এখন ছেলের বিবাহিত জীবনটা তুমুল ঝড় তুলেছে। ছেলের বউয়ের সঙ্গে নিজের কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। বউমার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছেন সব সময়। তবু কী ঘটে গেল। নিজের ছেলেকেও স্বচ্ছ ভাবতে পারছিল না। সম্পর্কে অস্বচ্ছতায় ডুবে যাচ্ছে সংসার। তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

আমার দেহের চিকিৎসা করে কী হবে? মনটায় শান্তি না পেলে এ সুস্থতার কী প্রয়োজন?

মায়ের কঠিন প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেল প্রমিত। মায়ের কষ্ট আর অভিমান মিলেমিশে এ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল ও। কিছুক্ষণ পর বলল, মোহসেনা বলেছে রিপোর্ট ভালো। তবে কিছু বিষয়ে ওর স্যারের সঙ্গে কথা বলবে। হাসপাতালে নিয়ে যাবে তোমাকে, আম্মা।

হাসপাতালে গিয়ে আমি কি সুস্থ হব? রোদ্দুর আর বউমা ছাড়া এ বিরান ঘরে আমি কি ভালো থাকতে পারব? কী মনে হয় তোমার?

প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না প্রমিত। মায়ের কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল।

ডোরবেলের শব্দ হলো এ সময়। কে এলো? ঝটিতে প্রশ্ন জাগল মনে। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে কি ফিরে এসেছে মিতু? রোদ্দুর?

না। ওরা নয়। বিণা এসে জানাল, পাশের বাড়ির একজন লোক আপনারে খোঁজে। ডাকছেন।

বসার ঘরে বসতে দাও। আমি আসছি।

নিজের ঘরে ফিরে কাপড় চোপড় ঠিক করে বসার ঘরে এসে চমকে উঠল প্রমিত। বাসায় এসেছেন এ পাড়ার নামকরা এক সেলিব্রেটি, আরজুভাই। তিনি তুখোড় খেলোয়াড়। সজ্জন। লেখকও।

আরজুভাই! আপনি! আমাদের বাসায়! কী সৌভাগ্য আমার!

থমথমে কণ্ঠে আরজুভাই বললেন, বসো, কথা আছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। কীভাবে শুরু করব। তবে তোমার কোনো ক্ষতি হোক সম্মানের হানি হোক, চাই না আমি। কীভাবে তোমার উপকার করা যায় সেই বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি।

দম বন্ধ হয়ে গেল প্রমিতের। বুকের স্পন্দনও যেন থেমে গেছে। কথা উড়ে গেছে মুখ থেকে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ও আরজুভাইয়ের দিকে।

বসসা, প্রমিত। বসো। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এলাকায় তোমার অনেক সুনাম। আমি চাই না মুহূর্তেই সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাক।

গলাটা জমে যাচ্ছে। চোখেও ঝাপসা লাগছে। মাথাটা হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল। ঝঝ শব্দের তুফান আসছে দূর থেকে। কোনো শব্দ বের হচ্ছে না প্রমিতের মুখ থেকে।

আমার মনে হচ্ছে, তোমার বড় কোনো শত্রু আছে। ফটোশপে গিয়ে এমন অনেক ছবি বানানো যায়। নানা ধরনের অ্যাপসও আছে। একজনের ছবি কাট করে এনে আরেক জনের বুকের ওপর পেস্ট করা যায়। বুঝেছো? ঘাবড়াবে না। প্রয়োজনে শত্রুকে চিহ্নিত করতে হবে। আইটিতে মামলা করতে হবে।

আরজুভাই থামার পরও প্রমিত কিছু বলছে না। সে আসলে কিছু যে বুঝতে পারছে না, আঁচ করতে পারছে না, তা নয়। তবু হঠাৎ কণ্ঠস্বরে বেরিয়ে এলো

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আরজুভাই।

এই তো! আমাদের প্রমিত নির্মল। আমি ছেলেদের বলেছি এটা ভুয়া পোস্ট। এই পোস্টের কারণে আমাদের পাড়ার মান যাবে না। প্রমিতের বিরুদ্ধে স্ক্যানডাল ছড়ালেও বাজে কিছু ঘটবে না।

প্লিজ, খখালাসা করে বলুন।

তুমি কিছুই জানো না?

না। কি হয়েছে?

এই যে দেখো, আমার মুঠোফোনে ভাইরাল ক্লিপ দেখো। বলেই নিজের সেটটা প্রমিতের হাত তুলে দিলেন আরজুভাই।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল প্রমিত। ওর চোখ কাঁপছে না। পাপড়ি পড়ছে না। স্থির, গোলাকার পাথরচোখে ও দেখল নিজেকে। মোনালিসা সেক্সি ভঙিতে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। লম্বায় প্রায় ওর সমান। সে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে প্রমিতের কানে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওকে। মোনালিসাকেও। দুষ্টুমি করে তার নম্বরটা সেভ করেছিল এক্সবুম হিসেবে। সেই বুমের বিস্ফোরণ দেখল। নিজের মাথার ওপর তা বিস্ফোরিত হয়নি, হয়েছে আকাশজুড়েও। ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে এই সংক্ষিপ্ত ভিডিও ফুটেজ। রোধ করার উপায় নেই আর। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ ধরনের ছবি আজকাল ছাড়ে না। খুউব একটা অশ্লীল দৃশ্য নয় ভেবে হয়তো তারা এটাকে তুলে নেয়নি। এর মধ্যে এটি যদি পৌঁছে যায় মিতুর হাতে! রোদ্দুর যদি দেখে! কী হবে! ওর মা এক্সবুমের সন্ধান পেয়েছিল আগেই। সন্তানকে সাবধান করেছে পদে পদে। মনে পড়ে যেতে লাগল মায়ের বিধি-নিষেধের কথা, সাবধানবাণীর কথা! কিছুই ঢোকেনি মাথায়। আবেগের ঘোরে ছুটে গেছে এক্সবুমের কাছে। তারও নিশ্চয় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিংবা হবে না। নিজের ক্ষতির পাহাড় যে ভয়াবহ হবে, তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।

আরজুভাই প্রশ্ন করলেন, এটা ফেক তো, ঠিক না?

হ্যাঁ। না। কিছুই বলতে পারল না প্রমিত। বোবা হয়ে ভিডিও ক্লিপটি কয়েকবার দেখল। তারপর হতবিহ্বল আর কিংবর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল আরজুভাইয়ের মুখের দিকে।

তুমি ভেবো না। সবাইকে বলে দিব এটা ফটোশপের কাজ। ফেক ক্লিপ। কথা শেষ করে তিনি উঠে গেলেন। প্রমিত কোনো মতেই তাঁকে বলতে পারল না, না, এটা ফেক নয়, সত্যি।

একত্রিশ

আপনি অফিসে এসেছেন? অফিসে আসার সাহস পেয়েছেন!

কেন? কোনো বড় অপরাধ করে ফেলেছি?

ডাইরেক্টর অ্যাডমিনের প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল প্রমিত। ওর গলার শক্ত জোর দেখে দমে গিয়ে মিউ মিউ কণ্ঠে তিনি বললেন, এ ধরনের নোংরা ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে আমি অফিসে আসতাম না।

প্রকৃত অপরাধী হলে আসতাম না, কিছুটা অপরাধী আর পুরোটা নিরাপরাধী হলেও কি আসা উচিত নয়?

দমে গেলেন তিনি। কিছুটা সময় হাতে নিয়ে বললেন, এমডি স্যার এসেছেন। আপনার খোঁজ নিয়েছেন। যাবেন এখন দেখা করতে?

যাব।

আচ্ছা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেকেছেন অবশ্যই যাওয়া উচিত। কিন্তু আমার ডিলটা আপনার মনে রাখা উচিত। চেয়ারম্যান স্যারের কথা মাথায় রেখে এমডি স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।

হ্যাঁ। না। কিছু না বলে প্রমিত ভেবে নিয়ে বলল, আপনার কথা আমার মনে আছে। আমার দেয়া কথাও।

ওকে। যান ভেতরে যান।

ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল প্রমিত। এমডি স্যারের টেবিলে শোভা পাচ্ছে ফাইলের পর ফাইল। বুঝল অনেক কাজ জমে গেছে। এটা কি তবে স্যারের বিদেশ থাকার কারণে?

মাথা টেবিলে খুঁজে এমডি স্যার বললেন, মিস্টার প্রমিত আমিন, আপনি আমার প্রিয় সহকর্মী। আমি চাইব আমার সঙ্গে সৎ থাকবেন আপনি। সত্য ছাড়া মিথ্যা বলবেন না। মিথ্যা বলেছেন শুনলে আপনার প্রতি আস্থা চলে যাবে। সেটা আমার জন্য চাপের ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে, আপনারও চাকরির সমস্যা হবে তখন।

জি। স্যার। আমি জানি। আস্থা আর বিশ্বাসের সঙ্গে বলছি আপনার সঙ্গে কখনও মিথ্যা বলিনি। বলবও না।

তো, শুনলাম আপনার ওয়াইফের অসুস্থতার কথা বলেছেন আপনি। অথচ আমাকে বলেছিলেন আপনার মা অসুস্থ।

দুটোই সত্য। আমার স্ত্রী অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সে জন্য অফিসে আসতে পারিনি। আর আমার মা সেদিন অসুস্থ হয়ে গেল তার বউমার অ্যাকসিডেন্টের কথা ও কিছু আচরণের কথা শুনে। আপনি যখন কল করেছেন তখন চিকিৎসক ছিল মায়ের পাশে। আমিও।

সব কথা শুনে প্রমিতের চোখের দিকে তাকালেন এমডি। ওই চোখে সত্যি সত্যি বিশ্বাসের আলো দেখতে পেলেন। অফিস ষড়যন্ত্রের প্রমাণও হাতে পেয়ে গেলেন। নিশ্চয় নিজের প্রিয়ভাজন প্রমিতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে ভেবে বললেন, যান। কাজ করুন। আর আমার কিছু কাজও আপনাকে গুছিয়ে দিতে হবে।

আচ্ছা, স্যার।

মাথা নিচু করে নয়, উঁচুতে তুলে ধরে প্রমিত বেরিয়ে এলো ঊধ্বর্তন বসের কক্ষ থেকে। সরাসরি চলে গেল নিজের কক্ষে। ওর টেবিলেও অনেক কাজ জমে গেছে। ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর আবার ইন্টারকমে কল এলো।

এমডি স্যার বললেন, দ্রুত আমার কক্ষে আসুন।

ডাইরেক্টর অ্যাডমিনের কক্ষ পাশ কাটিয়ে প্রমিত হাজির হলো নির্ধারিত কক্ষে।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তিনি নিজের মুঠোফোন সেট দেখিয়ে বললেন, দেখুন তো এটা আপনার ভিডিও কি না?

ভাইরাল পোস্ট কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেল প্রমিত।

মাথা ঝাঁকিয়ে ও জবাব দিল, জি, স্যার। আমার।

বলেন কি?

ফেইক ছবি? ফেটোশপে এডিট করা?

না। স্যার। সত্য। বলল প্রমিত।

এ মুহূর্তে প্রমিতের সততা আলোড়িত করল না এমডিকে। বরং বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, নিশ্চয় আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে।

জি স্যার। ছবিটার আধখানা দৃশ্য সত্য আর আধখানা বানোয়াট।

শোনেন, সত্যমিথ্যা এখন বিবেচনার বিষয় নয়। চেয়ারম্যান সাহেব ভিডিও ক্লিপটা আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনার বিরুদ্ধে জোরালো অ্যাকশন নিতে বলেছেন। প্রতিষ্ঠানের ইমেজও নষ্ট হতে পারে আমাদের সঙ্গে আপনার সংশ্লিষ্টতায়–এমন কথাও বলেছেন তিনি।

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রমিত।

মেয়েটি কে?

আমার কাজিন হয়। এক সময় ঘনিষ্ঠতা ছিল।

তাহলে ঘটনা সত্য?

পুরোটা নয়। আংশিক সত্য। আমি দায়ী নই। দায়ী হয়ে গেছি। মায়ের অসুস্থতার খবর জানাতে গিয়েছিলাম ওর বাসায়। আর ও নিজেকে সামলাতে পারেনি। ক্লিপে দেখুন স্যার, আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। যা করার ওই করছে। আমার কোনো ইনটেন্ট ছিল না খারাপ কিছুর। অথচ দেখুন পোস্ট ভাইরাল করে দিয়ে পেছনের শত্রুরা আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।

তা বুঝেছি আমি। তবু ছাড় দিতে পারছি না। আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে বরখাস্ত করতে। আমি ছুটি দিলাম দশ দিনের। উইদাউট পে। বরখাস্ত করলাম না। নিজেকে অশ্লীলতার দায়মুক্ত করতে হবে। অফিস থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবেন, এখন আসুন। আমি স্যরি। আমি ব্যথিত।

বরখাস্ত না হলেও তার চেয়ে বড় ভারী অপমানের বোঝা চেপে বসল ঘাড়ে। এ ঘাড় আর সোজা হবে কিনা জানা নেই। ওর মনে হতে লাগল চারপাশ ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে। উপর থেকেও চেপে আসছে ছাদ, পাশ থেকেও অফিসের দেয়াল তেড়ে আসছে ওর দিকে। এই চাপ সইতে পারব তো। ভাবল ও।

অফিসের গেট পেরিয়ে ফেরার পথে একবার ফিরে তাকাল প্রমিত। নিজের করে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটিকে। এর ইট-সুরকি, চারপাশের বাগানের গাছ-গাছালি সব অতি আপন হয়ে গিয়েছিল। এ পরিবেশ ছেড়ে যেতে হবে। আবার আসতে পারবে তো! বেতন ছাড়া দশ দিনের ছুটি দীর্ঘায়িত হবে না তো? এসব প্রশ্ন একবার উঁকি দিলেও চাপা পড়ে গেল আগুনলাগা জ্বলুনির তলে। তবু যাপিতজীবন চলছে। চলবেই।

আবার পেছন ফিরে তাকাল ও। সবাই জেনে গেছে ভিডিও ক্লিপটির খবর। সবাই জেনে গেছে বরখাস্ত হয়েছে ও। সবাই ধরে নিয়েছে চাকরিও চলে যাবে। আপনদের আর আপন মনে হচ্ছে না। কেউ উঁকি দিয়ে দেখল না, ওর নীরব বিদায়ের ঘণ্টায় কেউ শোকে কাতর হলো না। মুহূর্তের মধ্য সবাই কেমন করে পর হয়ে গেল, বুঝতে পেরে দিশেহারা হয়ে যেতে লাগল প্রমিত। এখন ভয় রোদ্দুরকে নিয়ে। মাকে নিয়ে। এ দুজন নিশ্চয় সইতে পারবে না এমন পরিণতি। মিতুও না। যতই রাগ করে দূরে যাক, তার ভালোবাসাও তীব্র। হিংস্রতার পাশাপাশি ভালোবাসার উচ্চতাও ওর হিমালয় সমান। ও নিশ্চয় ঘা খাবে। প্রচণ্ড আঘাত পাবে। এ আঘাত ওরা কীভাবে সামাল দিবে, ভেবে কূল পেল না।

.

উবারে চড়েই বাসায় এসেছে প্রমিত। মার কাছে থাকা জরুরি ভেবেই ছুটে এসেছে বাসায়। আম্মা যদি ক্লিপটি দেখেন, নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন অ্যাটাক ঘটে যাবে। সন্তানের কোনো স্থলন সইতে পারবেন না তিনি। আনন্দ-দিনের কথা চাপা পড়ে যাবে। মনখারাপের দিনগুলো মাথাচাড়া দেবে, নিশ্চিত। আর অফিসের বসের কাছে যেমন ক্লিপটি পাঠানোর জন্য লোকের ঘাটতি হয়নি তেমনি মায়ের কাছে। পাঠানোর জন্য লোকের অভাব হবে না। আর মিতুর চোখে ধরা খেতেই হবে। সরাক্ষণ যেভাবে ফেসবুকে মাথাগুঁজে রাখে তার থেকে নিষ্কৃতি ঘটবে না।

দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পরই হাউজ গভর্নর বিণা হাতে তুলে দিল একটা খাম। সেই রিসিভ করেছে কিছুক্ষণ আগে স্পেশাল ডাকে আসা খামটি।

নিজের ঘরে ঢোকার আগে খামটি খুলল প্রমিত। দ্বিতীয় ধাক্কা খেল ও। মিতু ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে! আর মোনালিসার সঙ্গে ভিডিও ফুটেজ থেকে তোলা একটা স্থির চিত্র।

ভাবনায় নিজের কথা জাগল না। মিতুর কথাও নয়। মায়ের কথাও নয়। ভাবনারা ওলট-পালট ঢেউ তুলে হৃৎপিণ্ডের শেকড় ছিঁড়ে প্রশ্নাকারে বেরিয়ে এসেছে–কেমন আছে রোদ্দুর? সে কি জানে কী বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল তার জীবনে?

মাকে তিনটে খবর জানাতে হবে। ভিডিও ক্লিপের খবর, অফিসের খবর আর ডিভোর্সের। ভিডিওটাও আড়াল করা যাবে না। আশেপাশের কেউ না কেউ তা দেখিয়ে যাবে মাকে। বুঝতে বাকি নেই। অফিসে সুহৃদের অভাব ছিল না। শত্রুরও। সুহৃদদেরও দেখেছে মুখ ফিরিয়ে নিতে। এলাকার আরজুভাই মুখ ফিরিয়ে নেননি। রক্ষা করতে এসেছিলেন ওকে। এমন মানুষ বিরল। বিরল মানুষ কেউ কি আছেন, পাশে দাঁড়ানোর? মিতুর উচিত ছিল ওকে রক্ষা করার। বুকে আগলে রাখার। ভুল পথ থেকে ওকে ফেরানোর। ফেরায়নি। দোষের পর দোষ দিয়ে গেছে। ভুলের পর ভুল করে গেছে নিজে। ভাবতে ভাবতে মায়ের ঘরে ঢুকল প্রমিত।

এত তাড়াতাড়ি এলে কেন অফিস থেকে, প্রমিত?

চুপ হয়ে আছে ও। কী উত্তর দেবে। সব কথা একসঙ্গে বলে দেওয়া কি উচিত হবে? নাকি ভেঙে ভেঙে আলাদা করে বলবে ঘটে যাওয়া তিনটে ঘটনা? প্রশ্নভরা মন নিয়ে ও একবার তাকাল খোলা জানালা দিয়ে বাইরে। বাইরের আকাশটা অনেক বড়। খোলাকাশের মতো বুক পেতে কি সব মেনে নিতে পারবেন আম্মা! ঘৃণা করবেন না সন্তানকে? হঠাৎ মনে পড়ে গেল এক গুণিজনের কথা। টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে, তরুণদের উদ্দেশে বলা কথা থেকে, ও শুনেছিল যে-কথা মা-বাবাকে বলা যাবে না, ধরে নিয়ে সেটা ভালো কাজ নয়, ধরে নিয়ে সেখানে বিপদ আছে। আবারও মনে পড়তে লাগল মুঠোফোনে বেশি কথা বললে মা শঙ্কিত হতেন, প্রসঙ্গ টেনে মিতুর পক্ষ নিতেন। মিতুকে স্ত্রী হিসেবে বেশি সময় দেওয়ার কথা বলতেন, অফিসের কাজ বাসায় না এনে স্ত্রী-কন্যার জন্য কোয়ালিটি টাইম বরাদ্দ রাখার কথা বলতেন। কেন বলতেন? মায়ের মনে অদৃশ্য কোনো শক্তি কি আগেই জানান দিয়ে রেখেছিল সন্তানের বিপদের সংকেতের সতর্কতা! মা কি এক্সবুম সম্পর্কে কিছু টের পেয়ে গিয়েছিলেন? প্রশ্নটাও কাঁপিয়ে দিলো ওকে। ঘটনার পর ঘটনা আর তার কথাবার্তা মিলাতে মিলাতে এক জায়গায় ধরা খেয়ে যাচ্ছে। ছেলের অনৈতিক যোগাযোগ মাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল বলে মনে হচ্ছে। ভাবনারা একই সুতোয় গেঁথে এই সত্য তুলে ধরেছে–আম্মা বোধ হয় টের পেয়ে গিয়েছিলেন এক্সবুমর কথা। এ জন্য প্রায়, মা হয়ে, সন্তানের বিপক্ষে কথা বলতেন। সে-কথা চলে যেতো মিতুর পক্ষে।

ছেলের বিমর্ষ অবস্থা দেখে সায়েরা আমিন বুঝে গেলেন বড় কোনো ঘটনা ঘটে গেছে।

শোনো প্রমিত, শোনো বাবা, শোনো, মনোযোগ দিয়ে শোনো। যেকোনো বিপদে পৃথিবীর সব প্রাণীকূলের মা তার সন্তানের পাশে থাকেন। আমিও তোমার পাশে আছি। সবাই ছেড়ে গেলেও মায়েরা সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারে না। তোমার রোদ্দুরকেও ছেড়ে যাবে না ওর মা। কী হয়েছে খুলে বলো। এ সময় তোমাকে অফিস থেকে কখনও ফিরতে দেখিনি। আমি আমার সন্তানের পক্ষ নিয়ে হ্যাঁ বলব। সন্তান যা বলবে, তা আমারও বলা। শুধু বলছি, মায়ের সঙ্গে মিথ্যা বোলো না, লুকিয়ো না কোনো ঘটনা।

তুমি সব সইতে পারবে না। আমিও বলতে পারছি না।

সইতে পারব। বলো। তুমি কষ্টে আছে, তোমার জীবনে বড় কোনো ঘটনা ঘটে গেছে, তোমাকে ভেঙে ফেলছে–এটার চেয়ে বড় কষ্টের কিছু নেই, বাবা। বলো।

মায়ের আশ্বাসে ভেতরের জড়তা পুরোটা উড়ে গেল বলা যাবে না। অতলে। গোপন বাধা থাকলেও সব খুলে বলল প্রমিত।

সায়েরা আমিন চুপ করে থাকলেন না। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। ছেলের কাঁধে হাতে রাখলেন, মন খারাপ ছিল তোমার। খারাপ মন তোমাকে ভুল পথে টেনে নিয়ে গেছে। ভুল থেকে বিপদ হয়েছে। ভুল থেকে শিক্ষাও হয়। তোমার ক্ষতি হয়েছে, সুনামের ক্ষতি কম ক্ষতি নয়। সম্মানহানি অনেক বড়ো ক্ষতি। এত বড়ো ক্ষতি থেকেও তুমি কিছু শিখেছে। শিখোনি? অনৈতিক সম্পর্ক কখনও সুখের হয় না। কষ্ট বাড়ায়, যন্ত্রণা তাড়ায়। জীবনও ছারখার করে দেয়। আর তোমার জীবনও বিপদের মুখে পড়েছে। এ বিপদে শক্ত থাকতে হবে। আমি আছি তোমার পাশে। তোমার ভুলের পক্ষে সাফাই গাইব না। তোমার বিপদে পাশে থাকব। সেটাই আমার মনের ভেতর থেকে জেগে ওঠা হ্যাঁ। তোমার অনৈতিক সম্পর্কটাকে না-ই বলে যাব। তবে তোমার ইন্টেন্ট অব অ্যাক্টটাকে নিরীহ আর বোকার মতো কাজ হিসেবে দেখব।

মা একজন শিক্ষক ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। কিন্তু এখন মাকে মনে হলো ক্লাসের দুর্দান্ত এক শিক্ষক। এ শিক্ষকের প্রতি মাথা নত হয়ে এলো প্রমিতের। মনের জোর বেড়ে গেল। খুলে বলল অফিসের কথা, পাড়ার আরজুভাইয়ের কথাও।

জোর করে তোমাকে অফিস থেকে অবসরে পাঠায়নি, জোর করে তোমাকে বরখাস্ত করেনি অফিস। তোমার কথা শুনেছেন। না-শুনে তোমার এমডি রায় দেননি। অবিচার করেননি। ঘটনার বিচারে এসব কিছু ঘটতে পারতো। ঘটেনি। তুমি ভেঙে পোড় না। শক্ত থেকো। একদিন নিশ্চয় ওরা তোমাকে ডেকে নেবে। নিশ্চয় তোমার কাজ আর যোগ্যতার দাম পাবে। আমার মন বলছে সে কথা।

মায়ের মনের কথা সন্তানের জন্য ফলে যায়। জানে ও। ফলেছে এমন অনেক ঘটনা। মায়ের এ জোরও প্রমিতের বুকে ঢুকে শক্ত

শেকড় গেড়ে বসাল। তিনি আবারও বলতে লাগলেন, বিপদে তোমার পাশে কেউ নেই, তা নয়। আরজু পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা সামাজিক সাপোর্ট। এভাবে সাধারণত কেউ দাঁড়ায় না। বিপদের সময় পাশ থেকে সরে যায়। বিপদে আসল বন্ধু চেনা যায়। শোনোনি কথাটা? তোমার বিপদে সবাই ছেড়ে যায়নি তোমাকে। তোমার আরজুভাই আছে। আর তোমার মা-তো আছেনই।

আবার সাপোর্ট পেয়ে সহজ হয়ে গেল প্রমিত।

আমি শঙ্কিত বউমাকে নিয়ে। আমি আতঙ্কিত রোদ্দুরকে নিয়ে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললেন সায়েরা আমিন।

মায়ের শংকা প্রমিতের মনে সামুদ্রিক ঝড়ের কেন্দ্রস্থলের মতো প্রবল ঘূর্ণি তুলল। ডিভোর্স লেটারের কথা বলবে কি বলবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। হঠাৎ সায়েরা আমিনের চোখ গেল প্রমিতের হাতে ধরা স্পেশাল ডাকে আসা খামটার দিকে।

ওটা কি, প্রমিত?

নিজের হাতে ধরা খামটার দিকে এতক্ষণে চোখ গেল প্রমিতের। মায়ের প্রশ্ন শোনার পরই বুঝল এভাবে এটা হাতে রাখা উচিত হয়নি। মা দেখে ফেলেছেন। লুকোনোর সুযোগ নেই। প্রশ্নটা এড়ানোরও আর কোনো উপায় নেই। মুখে উত্তর না দিয়ে প্রমিত খামটা তুলে দিল মায়ের হাতে।

এটা কিসের চিঠি? আমাকে দিচ্ছো কেন?

প্রমিত উত্তর দিল না। বেডসাইড টেবিল থেকে চশমাটা তুলে মায়ের হাতে দিয়ে বলল, তুমি পড়ো।

সায়েরা আমিন পড়লেন। নির্বাক হয়ে গেলেন। পাশে বসে মায়ের হাতটা চেপে রাখল প্রমিত। এতক্ষণ যেভাবে মনের জোর দিয়ে সন্তানকে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছিলেন তার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট রইল না মায়ের মনে। ভেতরটা কেঁদে উঠল। বাইরে তার প্রকাশ নেই। আকস্মিক বুক খামছে ধরেছেন। চোখ বুজে মাথাটা ছেলের ঘাড়ে রেখে ফিসফিস করে বললেন, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাবা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোর বাবাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না। তোকে সুখী দেখে যেতে পারলাম না। সন্তান অসুখী, কোনো বাবা-মা তা মানতে পারে না, বাবা।

বত্রিশ

প্রমিতের ফোন পেয়ে মোহসেনা বলল, এমন কিছু ঘটতে পারে, আঁচ করতে পেরেছিলাম আমি।

এখন কী করব?

অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এসো, ঠিকানাটা দাও। কুইক।

হাত কাঁপছে প্রমিতের। ঠিকানা লিখতে পারছে না। চোখ ঝাপসা লাগছে। বুক শুকিয়ে গেছে। জিহ্বা-ঠোঁট পানি শূন্য হয়ে গেছে। তবু লিখল ও। মেসিজ অপশন থেকে সেন্ট করে মায়ের কপালে হাত রাখল। বিণা এসে পানি তুলে দিতে চাইল মুখে। সায়েরা আমিন এক চুমুক পানি খেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আমার বংশধর রোদ্দুরকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

আমি কল করছি। বলেই বিণা ছুটে গেল কিচেনে। তার ফোন চার্জে বসানো সেখানে।

প্রমিত বলল, আম্মা! আম্মা!

বিড়বিড় করে যাচ্ছেন সায়েরা আমিন, রোদ্দুর! রোদ্দুর!

অল্প সময়ের মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ শুনে পাড়ার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। কোন বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকবে বোঝার চেষ্টা করল অনেকে। পাড়ার আরজুভাই দেখলেন অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে প্রমিতদের বাসার সামনে। তিনিও ছুটে গেলেন সেখানে। অবস্থা কী হতে পারে আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনিও। সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে প্রমিতকে সান্তনা দিয়ে বলছেন, ভেবো না প্রমিত, আমরা আছি তোমার পাশে। পাড়ার সবাই তোমার পাশে আছে।

একদম জ্ঞানহারা হয়ে যাননি সায়েরা আমিন। তার কানেও ভাসা ভাসা শব্দগুলোর অর্থ পৌঁছে গেল। তিনি বিড়বিড় করেই চলেছেন, রোদ্দুর! রোদ্দুর!

আরজু ভাই বলল, উনি কী বলছেন, প্রমিত?

আমার মেয়ের নাম রোদ্দুর। নাতনিকে খুঁজছেন তিনি।

কোথায় সে। ডাকো তাকে।

আমার স্ত্রী ওকে নিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি।

খবর দাও। ওদের আসতে বলো।

ভাইজান, আমি কল করে জানাইছি ভাবিজানকে। কইছি খালাম্মার অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে নেওনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স আইছে। বলল বিণা।

কী বলল, আসবে তো!

আসার কথা কিছু কননি। হুনেছেন আমার কথা। কইলেন আমার শাশুড়ির যত্ন নাও।

প্রমিত বলল, ও আসবে না। রোদ্দুরকে পাঠাতে বললো। আমার শাশুড়িকে বলল ওকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। অ্যাম্বুলেন্স এসে যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি।

দুজন অ্যাম্বুলেন্স কর্মী স্ট্রেচার নিয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রমিতের বুকটা খামছে ধরল। বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়। মাও কি চলে যাচ্ছেন! ভাবনাটার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পরাল না ও। বেপরোয়া চিন্তা বুক ভেঙে দিল। চিৎকার করে কাঁদল না, কেবল চোখ ফেটে গড়াতে লাগল লোনাজল।

বিণা বলল, ভাইজান, হাতে টেহা-পয়সা আছে?

এতক্ষণ টাকার কথা মাথায় আসেনি। দ্রুত গিয়ে নিজের ড্রয়ার খুলে যা পেয়েছে পকেটে ঢুকিয়ে ছুটে গেল অ্যাম্বুলেন্সের দিকে। ততক্ষণ কর্মীরা ওর মাকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে ফেলেছে। আরজুভাই বললেন, ওঠো। আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

ততক্ষণে পাড়ার অনেকে এসে ভিড় করেছে অ্যাম্বুলেন্সের পাশে। কী হয়েছে? কী হয়েছে? প্রশ্ন করছে। কারও জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর নেই। অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে লাগল হাসপাতালের দিকে। সাইরেনের আওয়াজ কাঁপিয়ে দিলো পুরো এলাকা।

.

জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ইসিজি করিয়ে রিপোর্ট চোখের সামনে ধরে বললেন, এনটিরিওর এমআই। মানে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ঠিক সময়ে এসেছেন। আমরা রোগীকে সিসিইউতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এর মধ্যেই ছুটে এসেছে ডা. মোহসেনা। সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমার আন্টি।

দ্রুত নিয়ে যান। আমি ফোন করে দিচ্ছি। সিসিইউতে মাত্র একটা সিট খালি আছে। বললেন চিকিৎসক।

পেশেন্ট ট্রলিতে তুলে রোগিণীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সিসিইউতে। ডা. মোহসেনা হাঁটছেন ট্রলির পাশে। একবার ও তাকাল প্রমিতের মুখের দিকে হাঁটা স্লো করে প্রমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবো না।

এই মুহূর্তে এই দুটো শব্দের ওজন কত হতে পারে বুঝল না প্রমিত। এটুকুন বুঝল সহস্র মণ ওজন ওর ওপর চেপে বসেছিল। ভেবো না কথাটা মুহূর্তেই সে চাপ উড়িয়ে দিল। সাহস বেড়ে যাওয়ায় এবার ফোন করতে উদ্যত হলো। রোদ্দুরকে আনা দরকার ভেবে ও ফোন করল মিতুর নম্বরে।

আশ্চর্য! ভেবেছিল রোদ্দুরকে কানেক্ট করতে পারবে না। পারল। মিতু ফোনটা ধরিয়ে দিয়েছে রোদ্দুরের হাতে।

বাপি। আমি আসছি। আমার দাদুভাই ভালো আছে তো!

প্রমিত জবাব দিতে পারল না। তার চোখের জল সামাল দিতে পারল না। হু হু করে কান্না জুড়ে দিল। ফোনে আর কথা বলতে পারল না। আরজুভাই ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরার সঙ্গে সঙ্গে শুনল, বাপি আমি রোদ্দুর! আমি আসছি। তুমি কাঁদছ কেন, বাপি? আমার দাদুভাই ভালো আছে তো?

আরজুভাই বললেন, ভালো আছে। তোমরা আসো। আমরা সিসিইউর সামনে আছি। তিন তালায়।

আপনি কে?

আমি সবার আরজুভাই। তোমাদের পাড়ার লোক। তোমার বাপির সঙ্গে আছি। তোমর দাদুভাই তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন।

লাইন কেটে দিল রোদ্দুর। তার ভেতর তাড়া কাজ করছে।

.

দাদুভাই আমাকে ডাকছে। আমাকে দেখতে চাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চালান। মিতু শক্ত করে ধরে আছে রোদ্দুরের হাত। সেও পাথর হয়ে বসে আছে গাড়িতে। আসমা বেগম ধরে আছেন মিতুর হাত।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল সিসিইউর সামনে।

বাপিকে দেখেই সে ছুটে গেল তার দিকে। ঠিক এ সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মোহসেনা।

এসেছে? রোদ্দুর এসেছে?

আমি রোদ্দুর।

বাহ্! ঠিক সময়ে এসেছে। এখনও জ্ঞান আছে। তোমার দাদুভাই বিড়বিড় করে তোমার নাম জপছে। চলো। তোমাকে নিয়ে যাই ভেতরে।

খুব সহজে মোহসেনার হাত ধরে বলল, বাপি, মাম্মি ওরা যাবে না?

না। ওনাদের যেতে দেবে না। তোমাকেও দিবে না। আমি ডাক্তার তো। তাই তোমার অনুমতি নিয়েছি। তোমার দাদুভাইয়ের চিকিৎসার জন্য তোমাকে দরকার।

ভেতরে ঢুকে গেল রোদ্দুর। মিতু এগিয়ে গেল আরজুভাইয়ের দিকে। আমি রোদ্দুরের মা। আর আপনাকে আমি চিনি। আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। এ বিপদে আপনি পাশে আছেন জেনে সাহস পেয়েছি।

মনে মনে মিতুর উদ্দেশে প্রমিত বলল, তোমার সাহসের দরকার কি? তোমার ডিভোর্স লেটারই তো আম্মাকে এখানে পাঠিয়েছে। মুখ ফুটে বলল না সে-কথা। হজম করে চালন করে দিল ভেতরে।

আরজুভাই বললেন, আপনি এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন দেখে ভালো লাগছে। বিপদে সবাইকে পাশে থাকতে হয়। একজোট থাকতে হয়। আর আপনি যে কারণে কষ্ট পেয়েছেন তা ফেক। ফটোশপে বানানো ফেসবুকের অশুভ কাজ। এমনটা আপনাকে ঘিরে ঘটতে পারে। আমাকে ঘিরেও।

দপ করে নিভে গেল মিতু। মনে মনে বলল, ও! আপনার কাছে রিজনিং করেছে। নিজের অপকর্মের সাফাই গেয়েছে! এটা মোটেই ফটোশপের কাজ নয়। রিয়েল। ও তো একটা দাগি আসামি, ক্রিমিনালের চেয়ে বড় ক্রিমিনাল। আপনাকে বোকা বানিয়েছে। ভাবনাটা থেমে গেল। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। ঠিক এ সময় সেখানে হাজির হলো একটা তরুণ। আরজুভাইকে চিনতে পেয়ে জিগ্যেস করল, আরে ভাই! আপনি এখানে?

বাবলু, তুমি! তুমি এখানে কী করছো?

আমার এক রোগী আছে আইসিইউতে। এখন ভলো। আমরা বাইরে ঘোরাফেরা করছি।

তোমাকে তো দলে দেখি না, খেলা ছেড়ে দিয়েছো?

না। ছাড়িনি। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আগে ক্যারিয়ার। সঙ্গে খেলার সুযোগ পেলে খেলব।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনে প্রমিত তাকাল তরুণটির মুখের দিকে। চেনা চেনা লাগছে তাকে।

খেলা ছেড়ো না। বিশ্ববিদ্যালয় টিমে ঢুকে যেয়ো।

আচ্ছা। আপনার পরামর্শ মাথায় রাখব।

এসো। আমাদের দলেও প্র্যাকটিসে এসো ছুটি-ছাটায় ঢাকায় এলে।

জি। কয়েক মাস আগে গিয়েছিলাম আপনাদের এলাকায়। মলমপার্টির কবলে পড়েছিল আপনার এলাকার একজন। ভোরে তাকে আবিষ্কার করি মহাখালি ওভার ব্রিজের তলে। জ্ঞান ফিরেছে দেখে তাকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম।

প্রমিত এগিয়ে এসে বাবলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই আমিই সেই লোক। আমার মায়ের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন আপনি।

ইয়েস। আপনাকেও চেনা চেনা লাগছিল আমার। এখন ক্লিয়ার। ফেসটা চিনতে পারছি।

জি। আমিই ফখরুল হায়দার। ডাক নাম বাবলু। এ নামেই চেনেন সবাই। আরজুভাইয়ের টিমেও খেলেছি আমি। আর আমার আরেক বন্ধুর নাম ডাবলু। সেই আপনাকে দেখে চিৎকার করে আপনার কাছে ছুটে গিয়েছিল। আপনার সেন্স ফিরেছে দেখে আমরা যাত্রা ঘুরিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে আপনাকে বাসায় দিয়ে এসেছিলাম।

আরজুভাই বললেন, খেলোয়াড়রা অনেক মানবিক হয়। তোমার মানবিক কাজের কথা শুনে একজন খেলোয়াড় হিসেবে গৌরববোধ করছি।

আসমা বেগম শুনতে পেলেন ওদের কথোপকথন। মিতুও।

মেয়র হাত চেপে ধরে আসমা বেগম বললেন, দেখেছো, কী ভুল বুঝেছিলে? ভুল থেকে কীভাবে ভুলের পর ভুল ঘটে যাচ্ছে দেখেছো, মিতু?

মিতু স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখের কঠিন পেশি শিথিল হয়ে গেল।

এমন সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রোদ্দুর। সঙ্গে মোহসেনাও।

রোদ্দুর বলল, দাদুভাইকে আদর করে দিয়ে এসেছি। আমাকে দেখে রোদ্দুর রোদ্দুর বলা থেমে গেছে। মনে হয়েছে দাদুভাই খুশি হয়েছে।

সবার উদ্দেশে মোহসেনা বলল, চিকিৎসা চলছে। আল্লাহ ভরসা। তুমি ভেবো না, প্রমিত।

হঠাৎ রোদ্দুর বলল, তুমি বাপিকে চেনো?

হ্যাঁ। চিনি। তোমার বাপি আমার পিচ্চিকালের বন্ধু!

তুমি আমার বাপিকে কানে কামড় দিয়েছিলে? ফেসবুকে দেখেছি।

না। আমি নই, মা। অন্য কেউ।

অন্য কেউটা কে, বাপি? তোমাকে কামড় দিল কেন সে? মাম্মি ভীষণ রাগ করেছে। বলেছে তোমাকে ডিভোর্স দেবে। ডিভোর্স কী? সবার উদ্দেশে প্রশ্ন করল রোদ্দুর।

আরজুভাই বললেন, ডিভোর্স মানে তোমার মা তোমার বাবার সঙ্গে থাকবেন না। আলাদা হয়ে যাবেন। তোমার মা ভুল বুঝেছেন। ওটা মিথ্যা ছবি।

মিতু আবার মনে মনে বলল, ওটা মিথ্যা নয়।

প্রমিতও মনে মনে বলল, ওটা মিথ্যা নয়। তবে আমি পুরোপুরি দায়ী নই। আর তোমার মার তো আলম আছে। তোমার মা কি দায়ী না?

দুজনের কেউ মুখ ফুটে কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল কেবল।

এবার আরজুভাইয়ের হাত ধরে রোদ্দুর বলল, না। আমি ডিভোর্স মানি না। বাপি আর মাকে আলাদা হতে দেবে না।

আসমা বেগম বললেন, আমিও মানি না।

রোদ্দুর এবার মায়ের হাত ধরে বলল, তোমরা আবার একত্র হও। এসো বাপির হাত ধরো। ধরো, ধরো বাপির হাত ধরো। বলল, তোমরা আলাদা হবে না। বলো। আমাকে হ্যাঁ বলল, মাম্মি। বাপি, বলল আমাকে হ্যাঁ বলে।

রোদ্দুরকে বুকে জড়িয়ে ধরল মিতু। তারপর ছোট্ট করে বলল, হ্যাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *