পঁচিশ
অনুষ্ঠান ভালো লেগেছে রোদ্দুরের। স্কুল যে কত মজার হতে পারে, তা আগে বুঝতে পারেনি। মজার এ জগতে এসেও মনে আনন্দ স্থায়ী হলো না। অসুখী মন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা এগোতে লাগল নানা বাড়ির দিকে। হাঁটা পথ পেরোতে বেশেক্ষণ লাগল না। সারাক্ষণ রোদ্দুর ধরে আছে ওর বাপির হাত। মিতু আসছে পেছন পেছন। একবারেও ওরা দুজন কথা বলেনি। রোদ্দুর প্রথম খেয়াল করেনি। হঠাৎ খেয়াল করল মা পেছনে ধীরে ধীরে হাঁটছে।
তাড়াতাড়ি হাঁটো, মাম্মি। বাপির সঙ্গে কথা বলো।
কোনো জবাব পেল না রোদ্দুর।
বাপিকে দাওয়াত দিবে না? দুপুরে খেতে বলবে না? বাপির হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পেছনে এসে মাম্মিকে ধমক দিল রোদ্দুর।
পাথর মুখের মধ্যে হাসি ফুটল না। কন্যার কথায় সায় দিল না। আরও পাথর হয়ে যাওয়ায় ওর হাঁটার গতি আরও স্লো হয়ে গেল।
স্যার বলেছেন সন্তানের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতে। ভালো কাজে হ্যাঁ বলতেও বলেছেন। বাপিকে দাওয়াত দেওয়া ভালো কাজ না? হ্যাঁ বলবে না এ কাজে, মাম্মি?
মায়ের সাড়া পেল না। হ্যাঁ শুনতে আকুল মন নিঃশব্দ নার আঘাত খেয়ে দমে গেল। অভিমানে ফুলে উঠলেও কষ্ট সামাল দিয়ে, ছুটে এসে আবার বাপির হাত ধরে নিজেই বলল, আজ আমরা সবাই একসঙ্গে খাব।
পাথর হয়ে গেল প্রমিত। তারও ইচ্ছা করছে মেয়ের আবদার রক্ষা করতে। রক্ষা করতে পারবে না, জানে ও। ওদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে উবার কল করে এখন আবার ছুটতে হবে অফিসে। ডাইরেক্টর অ্যাডমিন বলে দিয়েছেন, মেয়ের স্কুলে হাজিরা দিয়ে অফিসে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ উপেক্ষা করা সম্ভব নয় এখন। শোকজেরই জবাব এখনও গৃহীত হয়নি। আবার অফিস আদেশ অমান্য করলে আর রক্ষা নেই। এদিকে মেয়ের দাবিও যৌক্তিক। যৌক্তিক দাবি পূরণ করতে হবে। বলেছেন প্রধান শিক্ষক। অযৌক্তিক দাবিকে না বলা যাবে, কৌশলে উপেক্ষা করতে হবে অশোভন আচরণ। রোদ্দুরের এখনকার আচরণ শোভন তো বটেই, মমতায় ভরা। বাপির জন্য তীব্র টান বোধ করছে। বাপিকে কাছে ধরে রাখার জোরালো ইচ্ছাটা পূরণ না হলে কী কষ্ট পেতে পারে ছোট্ট মেয়েটি, ভাবতেই পারছে না প্রমিত। কেবল বাবা হিসেবে নয়, সাধারণ একজন মানুষ হিসেবেও ভাবতে গেলে বুক ফেটে যাবে ওর। তবুও হাঁটতে হাঁটতে উবার কল করল প্রমিত। বাসার কাছে পৌঁছানো মাত্রই সেখানে হাজির হয়েছে উবার।
কে যাবে, বাপি?
আমার শাস্তি হতে পারে, চাকরিও চলে যেতে পারে এখন অফিসে না গেলে।
রোদ্দুর শূন্য চোখে একবার তাকাল ওর বাপির দিকে। তারপর করুণ কণ্ঠে বলল, যাও, আগে চাকরি বাঁচাও।
প্রমিত বুঝল এটি হচ্ছে রোদ্দুরের বুকভাঙা অনুমতি। এই অনুভূতির মধ্যে লুকিয়ে আছে বাবাকে কাছে ধরে রাখার গোপন ইচ্ছাও। আর প্রকাশ্য অনুমতির মধ্যে রয়েছে হ্যাঁ। সব সময় যে সব হ্যাঁ আনন্দ দিবে, তা নয়। ওর বুকটাকে কেটেকুটে ঝাঁঝড়া করে এ হ্যাঁ বেরিয়েছে, টের পেয়েও থামতে পারল না প্রমিত। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করে উবারে গিয়ে বসল। গাড়িতে ঢোকার আগে একবার তাকাল মিতুর দিকে।
মিতু একবারও তাকাল না ওর দিকে। উবার দ্রুত পেরিয়ে গেল বাড়ির গেট।
রোদ্দুর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকাল সামনে। উবার চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল।
হঠাৎ মনে হলো কড়া রোদ আঁধার করে দিয়েছে ওর চোখের জ্যোতি। কাঁদল না। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আবেগহীন রোদ্দুর রোবটের মতো হেঁটে গেল ঘরের মধ্য। নানুভাইয়ের ঘরে গিয়ে বলল, পানি খাব, নানুভাই। গলা শুকিয়ে গেছে।
ঠাণ্ডা মিশিয়ে দেব?
নানুভাইকে বললেও ও এগিয়ে গেল পানির ফিল্টারের দিকে। নিজেই খেল পানি। বাঁ হাত দিয়ে মুখ মুছে, নিজের ঘরে গিয়ে গুটিসুটি মেরে খাটে শুয়ে পড়ল ও।
একবার ঘুরে দেখে নিল ঘরটা। মাকে খুঁজল, মা নেই। ও একা। একদম একা।
খুট করে বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। রোদ্দুর বুঝল, মাম্মি ঘরে ঢুকেই লুকিয়ে যায়নি। ঘরেই আছে। তবু তার নিজেকে একা মনে হতে লাগল।
শুয়ে পড়লে কেন? কিছু খাবে না? মাম্মির স্বাভাবিক প্রশ্ন শুনে মনেই হলো না রাগ আছে তার মনে।
খিদে লাগলে খাব। জবাব দিয়ে পাশ ফিরে শুলো রোদ্দুর।
কিছুক্ষণ আগেই তো খাবারের কথা বলেছ?
বলেছি বাপিকে সঙ্গে নিয়ে সবাই একসঙ্গে খাব।
তখন খিদা ছিল, এখন নেই?
নেই। খেতে ইচ্ছা করছে না।
তোমার বাপি তো আর সব সময় পাশে থাকবে না। তখন খেতে হবে না? আমিও তো থাকব না। স্কুলে চাকরি নেব। আমার আব্বা তার ব্যবস্থা করেছেন। একা একাও খেতে হবে তোমাকে?
খিদা লাগলে খাব।
আচ্ছা। তোমার ইচ্ছা। জোর করব না। যখন খিদা লাগে উঠে খেয়ে নিয়ো।
যাক। মাম্মি চাপাচাপি করেনি। জোর করেনি খাওয়ার জন্য। এখন খেতেই পারবে না ও। নিজের ইচ্ছার দাম পেয়েও রোদ্দুরের মনে হলো ওর দাবিকে
হ্যাঁ বলেননি মাম্মি। ইচ্ছাকে দাম দিয়েছেন। মনটা কষ্টে ভরে গেল। মনের কথা শোনেনি। অথচ স্যার বলেছেন শিশুর মনটা বুঝতে হবে শিশুর বয়সে নেমে তার মতো করে। একা একা খেতে হবে না? মাম্মির বলা প্রশ্নটাও মাথায় উড়ে উড়ে আসতে লাগল। আর ধীরে ধীরে মন খারাপ হতে লাগল। মুখের ত্বকের ঝলমলে আলো ম্লান হতে হতে যেন ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে।
হঠাৎ মুঠোফোনে রিংটোন বেজে উঠায় মিতু রিসিভ করে বলল, কেমন আছো, আলম?
ওপাশ থেকে বলা উত্তর শুনতে পেলো না রোদ্দুর।
প্রথমে রিংটোন, তারপর আলম শব্দটা শুনে ও মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল মায়ের মুখ। ওই মুখ এখন আর গম্ভীর নেই। মাম্মিকে অনেক হাসিখুশি দেখাচ্ছে। তিনি বারবার বলছেন আচ্ছা, আচ্ছা। অপর পাশে আলম আংকেল কী বলছে শুনতে পাচ্ছে না। হঠাৎ শুনল মাম্মি বলছে, বেশ। বেশ। দুজনেই ঢুকে যাও আমাদের বাসায়। এসো দুপুরে একসঙ্গে খাব।
বাপিকে একবারও খেতে বলেনি মাম্মি! অথচ আলম আংকেলকে ডাকছে দুপুরের খাবার একসঙ্গে খেতে! শুনে আবারও পাশ ফিরে শুলো রোদ্দুর।
কিছুক্ষণ পর বাসার বাইরে সিএনজি অটোর আওয়াজ ভেসে এলো। মাম্মি বাইরে বেরোনোর পর খাট থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল রোদ্দুর। দেখল পর পর দুটো সিএনজি এসেছে। একটা থেকে নেমেছে আলম আংকেল। আরেকটা থেকে অচেনা একজন। বারান্দায় দাঁড়ানো মাম্মিকেও দেখা যাচ্ছে হাসি মুখে কথা বলছেন ওরা নেমে আসার পর। তা দেখে রোদ্দুর আবার এসে শুলো খাটে। এখান থেকে শুয়ে দেখা যায় বসার ঘর। দুজনই এসে বসেছেন একসঙ্গে। উল্টো পিঠে শুয়ে রইল রোদ্দুর।
.
আলম পরিচয় করিয়ে দিল, ওনার নাম রিয়াজ।
আচ্ছা, আচ্ছা। রিয়াজ। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার বন্ধু আর আপনার জন্য আমার জীবন রক্ষা পেয়েছে। অশেষ কৃতজ্ঞতা আপনাদের জন্য।
রিয়াজ বলল, আলমের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। পরিচয়ের মাধ্যম আপনি। ওনার সিএনজি অটো পাহারা দিতে গিয়ে যোগাযোগ হয়। সম্পর্ক হয়। এখন আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে গেছি। অটোচালক হিসেবে নয়। আপনার কারণে।
জি। আপা। আমার হাতে ছিল আঠার শ। আর ওনার হাতে তিন হাজার। উনি সহজে পঁচিশ শ টাকা দিয়ে দিলেন। আমি দিলাম ষোল শ। এভাবে একচল্লিশ শ টাকা হাতে পেয়ে আপনার চিকিৎসার জন্য আমার মনের জোর বেড়ে যায়। চিকিৎসক, নার্সরাও সহযোগিতা করেছেন। জেনি কেয়া মণ্ডল নামের এক নার্সও টাকা দিয়ে হেল্প করতে চেয়েছিলেন। পরে তো আর কারও সহযোগিতা লাগেনি। ভাইজান আর খালুজান এসে হাজির হন। আপনিও চিকিৎসক-নার্সের সেবায় দ্রুতই সেরে ওঠেন। আমরা আপনার জীবন রক্ষা করার কে? রক্ষা করেছেন তো উপর-ওয়ালা।
আপনার প্রতিও আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা, রিয়াজ সাহেব।
আমাকে রিয়াজ বলেই ডাকতে পারেন। আমরা আপনার ছোট ভাইয়ের মতোই। আলমকেও তো আলম বলছেন, তুমি করে বলছেন।
খালাম্মা কোথায়? রোদ্দুর? একই সঙ্গে প্রশ্ন করল আলম।
ভেতরে যাচ্ছি। আম্মা আর রোদ্দুরকে খবর দিচ্ছি। আর রিয়াজ অবশ্যই তোমাকে তুমি বলেই ডাকব।
ভেতরে গিয়ে মাকে ডেকে বলল, আম্মা, দেখো। আলম আর রিয়াজ এসেছে। এসো, ওদের সঙ্গে কথা বলো।
আলমকে তো চিনি। আগেও এসেছে। রিয়াজটা কে?
সেও অটোচালক। দুজনে মিলে আমার সিটি স্ক্যান করানোর জন্য ফান্ড করেছে। তোমরা যাওয়ার আগেই আমার চিকিৎসার জন্য সব করেছে।
শোনো। অটোচালকদের সঙ্গে এত মাখামাখি কি ভালো হচ্ছে?
কী বলছ তুমি, আম্মা? মাখামাখির কী দেখলে! তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক অকৃতজ্ঞ। খেপে উঠল মিতু।
মেয়েকে রাগতে দেখে চুপ করে গেলেন তিনি।
ওদের দুপুরে খেতে বলেছি। এসেছে। রান্না তো আছেই। তোমার জামাই বাহাদুর তো ঘরেই ঢুকল না! শাশুড়িকে বলে যাবে সেই সম্মানটুকুই দেখাতে পারল না। এমন জামাইয়ের জন্য হা-হুঁতাশ করে কী লাভ!
আসমা খাতুন বললেন, পুরুষ মানুষের অফিসে জরুরি কাজ থাকতে পারে না? জরুরি কাজে যেতে হয়েছে–এমন ভাবতে পারলে না?
তলে তলে দেখছি জামাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো! রোদ্দুরকেও তো এ অজুহাত দিয়েছে সে। তোমাকেও? ফোনে বলেছে?
না। ফোন করেনি। আমি অনুমান করে বলছি। কাজ-পাগল তোমার বাবার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। চট করে দোষ ধরা ঠিক না, মিতু।
অবাক হয়ে মিতু তাকাল মায়ের মুখের দিকে। তারপর মুখ চিপিয়ে রাগ দমন করে বলল, তুমি ওই বর্বর জামাইটার পক্ষ নিচ্ছো?
মেয়ের ভাষার ব্যবহারে চুপ হয়ে গেলেন, আগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন এমন সময়, ওকে কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই। যুক্তির ধারও ধারবে না সে। যা ভেবেছে, তাকেই একশ ভাগ সত্য বলে ধরে নিয়ে কথা চালাতেই থাকবে। এখন দাবি করেছে মেহমানদের সঙ্গে দেখা করার। জোরালো তাগিদ টের না পেলেও বসার ঘরে ঢুকে আসমা বেগম বললেন, তোমরা ভালো আছ, বাবারা?
জি। ভালো। বলেই আলম পরিচয় করিয়ে দিল রিয়াজকে। মিতুকে বলা সব কথা রিপিট করে বুঝিয়ে দিল রিয়াজের ভালো কাজের কথা।
তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে, রিয়াজ। বাসায় আসার জন্যও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
কী বলেন, খালাম্মা! কৃতজ্ঞতা জানাবেন কেন? আমরা এমনি এসেছি মিতু আপার ডাকে।
আচ্ছা। বেশ ভালো করেছে। এখন হাতমুখ ধুয়ে নাও। ওই যে, ওই দরজা ওয়াশ রুমের। বসার ঘরের পাশে আরেকটা দরজা দেখিয়ে দিলেন তিনি।
জি, খালাম্মা। আমি চিনি। আগেও এসেছিলাম না! বলল আলম।
আচ্ছা। আচ্ছা। তাহলে রিয়াজকে চিনিয়ে দাও। আর আমি টেবিল সাজাচ্ছি। মিতু তোমাদের সঙ্গে খেতে চেয়েছে। ব্যবস্থা করছি।
রোদ্দুর কোথায়? ওকে তো দেখছি না!
ও আছে ওর ঘরে। আসবে। আসবে। সেও খাবে তোমাদের সঙ্গে।
ভেতরে গিয়ে তিনি শুনলেন মিতুর ধমক। কন্যাকে ধমক দিচ্ছে সে। রোদ্দুরকে ধমক দেওয়া একদম অপছন্দ করেন তিনি। বললেন, আহ জোর করছো কেন। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। খেতে চাইলে খাবে, না চাইলে পরে খাবে। ওর পেটে খিদা তো নাও জাগতে পারে।
না বলে কিছু নেই। ওকে এখন খেতে হবে আমাদের সঙ্গে। মায়ের গলার জোর দেখে রোদ্দুর চাপ খেল, বুঝতে পারল না তা মা হিসেবে। কিছুটা ভয় পেয়ে রোদ্দুর বলল, খাব।
ছাব্বিশ
মাম্মি নেই ঘরে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল বেডসাইড টেবিলের ওপর আছে মুঠোফোনটা। চট করে হাতে নিয়ে কল করে বসল ওর বাপিকে।
মিতুর রিংটোন পেয়ে খুশি হয়ে সবুজ সিগনালে স্ক্রল করে প্রমিত ধরল কলটা। বোঝার চেষ্টা করল কার কল। চুপ করে রইল।
বাপি, চুপ করে আছো কেন?
মা! রোদ্দুর! তুমি!
হ্যাঁ। আমি।
আর কথা বলতে পারল না প্রমিত। ভেতরটা নড়ে উঠল। চোখ ফেটে পানি চলে এলো। কথা উড়ে গেল। নাকও ভরে গেল তরল পদার্থের ক্ষরণে।
খেয়েছে, বাপি?
মেয়ে উত্তর না পেলে কষ্ট পাবে। মেয়ের সঙ্গে সৎ হতে হবে। মেয়েকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কষ্ট দেওয়া মানে ইমোশনাল অ্যাবিউজ করা। আবেগে নির্যাতন করা। প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ। কথা থেকে শুনে এসেছে ও। একটু সময় নিয়ে বলল, খাইনি।
আমি জানি তুমি খাওনি।
কীভাবে জানলে?
আমার মন বলেছে। খাওনি কেন?
খিদা পায়নি তো।
একথাটাও তুমি ঠিক বলেছো। সত্য বলেছো।
কীভাবে বুঝলে?
আমারও খিদা চলে গিয়েছিল। আমার চলে যাওয়া খিদা দিয়ে তোমার খিদাটা বুঝেছি।
তুমি খাওনি? উত্তেজিত প্রশ্ন।
খেপে যেয়ো না। মাম্মি আমার ওপর খেপেছে। এ জন্য খেয়েছি। আলম আংকেল ও আরেকজন রিয়াজ আংকেল এসেছিল, সবাই মিলে খেয়েছি। আমার খেতে ইচ্ছা করেনি। তবু খেয়েছি।
কার সঙ্গে কথা বলছ, রোদ্দুর? হঠাৎ ঘরে ঢুকে মেয়েকে ঝাঁঝাল প্রশ্ন করল মিতু।
বাপির সঙ্গে।
তুমি কল করেছো? নাকি সে?
আমি।
যে গোঁয়ার তোমার বাপি! সে যে কল করবে না, জানি আমি। দাও। ফোন দাও। বলতে বলতে মুঠোফোনটা নিয়ে সুইচ অফ করে দিলো মিতু। লাইন চালু থাকায় সব শুনতে পেয়েছে প্রমিত। হা হা করে উঠল ওর মন। অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পেরেছিল। তাই ডিরেক্টর অ্যাডমিনের মন রক্ষা করতে পেরে নিজের কাজে মন দিয়েছিল। খিদে বোধ করেনি দেখে লাঞ্চের সময়ও খাবারের তাগিদ বোধ করেনি। মেয়ের আবদার অপূর্ণ রাখতে হয়েছে বুঝে কষ্টের চাপ দীর্ঘ হয়েছে। তার ওপর মিতুর এমন দুর্ধর্ষ ব্যবহার, বিশেষ করে কন্যার ওপর, মানতে পারছে না ও। এ জন্য খিদেটা আরও উড়ে গেল।
মুঠোফোনে রিংটোন হচ্ছে দেখে স্ক্রিনে চোখ রাখল প্রমিত। এক্সবুমের কল।
রিসিভ করে বলল, তুমি এখন কোথায়?
বাসায়।
একা?
হুম।
কী করো?
এই যে তোমাকে কল করেছি।
কেন?
এমনিতে। কারণ ছাড়া কল করা যায় না? দীর্ঘদিন ধরে তো। তোমার মধ্য পরিবর্তন দেখছি। যোগাযোগ করো না। কল দাও না। আজ এতক্ষণ কল ধরে আছ! বিস্ময় বালক! মন খারাপ?
হুম।
কেন?
পারিবারিক, অফিশিয়াল সব মিলিয়ে বলা যায় অনেক কারণের মূল কারণ ব্যক্তিগত জীবনযাপন।
কার, তোমার না তোমার বউয়ের!
দুজনের।
মানি না। তোমার না। তোমার বউয়েরই হবে। যে কড়া জিনিস তোমার বউ! তার সঙ্গে কথা বললে যেকোনো ছেলে গলে তরল হয়ে বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে!
হুম করে কথাটা আঘাত হানল মাথায়। আঁঝ করে উঠল কান। মেয়েরা সাধারণত ঈর্ষাপরায়ণ হয়। সহজে অন্য মেয়ের প্রশংসা করে। এ মেয়ে নিজেই এক্সএক্স বুমবুম। সে কিনা অন্যের প্রশংসা করছে! সত্যি বলছে, না মিথ্যা? যাচাই করবার ইচ্ছা হলো না। বিষয়টি উপেক্ষা করতে চাইল।
চুপ করে আছো কেন? আসবে নাকি আমার বাসায়। একদম একা আছি, আসবে?
সরাসরি আহ্বান শুনে বেপরোয়া হয়ে উঠল ভেতরটা। তারপর নিজেকে সামলে বলল, মাকে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে। পরীক্ষা করাতে হবে, ডাক্তারের নির্দেশ।
বেশ। বেশ। ভালো। ভালো। বউয়ের সেবা না করে মায়ের দিকে ঝুঁকছো, অ্যাপ্রিশিয়েটিং ইউ।
প্রশংসা শুনে ধন্য হলো না। আরও মলিন বিষাদে ডুবে যেতে লাগল প্রমিত। নিজের বায়োলজির মধ্যে ওলট-পালট ঢেউ উঠল না। তবু মনে হলো ওর সঙ্গে সময় কাটাতে পারলে ভালো লাগত এখন।
সাতাশ
সব পরীক্ষা করিয়েছে প্রমিত। দুইদিন লেগে গেল রিপোর্ট হাতে পেতে। মায়ের পাশে থাকতে পেরে ভালো লাগছে। নিজের অজান্তে মা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। মা তো আছে-এ বোধ থেকে তাঁকে একদম সময় দেওয়া হয়নি, বুঝতে পারছে প্রমিত, গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে মায়ের সঙ্গে। মা সহজে পুষে নিতে পারেন সন্তানের সব ঘাটতি। এজন্য মাঝে মাঝে পক্ষ নিয়েছিল তার বউমার। এ ধরনের পক্ষ নেওয়ার মধ্যেও আছে নিশ্চয় সন্তানের ভালো চাওয়া। ভাবতে ভাবতে হাতে পাওয়া রিপোর্ট গুছিয়ে কল করল ডা. মোহসেনাকে।
কল রিসিভ হচ্ছে না দেখে কিছুটা সময় গ্যাপ দিয়ে আবার কল করল ও।
নিশ্চয় কোনো জরুরি কাজে বিজি আছে সে। ভাবতে পারার কারণে অস্থিরতা কমে গেল। হঠাৎ মনে হলো আজ তো ছুটির দিন। ছুটির দিনে ব্যস্ত থাকার তো কথা না। কল রিসিভ করছে না কেন! আচ্ছা আচ্ছা। মনে পড়ে গেল এমন ভঙ্গিতে ভাবতে লাগল ঘরে থাকলে তো সব সময় মুঠোফোন মুঠিতে থাকে না। এদিক ওদিক পড়ে থাকে। অনেক সময় সাইলেন্ট মোডে থাকে। অনেক সময় থাকে টেবিলে কিন্তু তখন ফোন-ব্যবহারকারী থাকে হয়তো ওয়াশরুমে। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আবার কল করল প্রমিত।
ভাই, কে আপনি! বার বার কল করছেন! দেখছেন না ফোন ধরছি না।
এটা ডা. মোহসেনার নম্বর না?
হ্যাঁ। তারই নম্বর।
আপনি কে, ভাইজান? নরম করে প্রশ্ন করল প্রমিত।
আমি কে, তা জানার দরকার নেই। আপনি কে, তা বলুন আগে।
আমি রিপোর্ট দেখাতে চাই ওনাকে। আমার মায়ের রিপোর্ট।
আপনি রোগী?
রোগীর ছেলে, আমি।
ওই হলো। যখন-তখন ফোন করা কি উচিত? ডাক্তারদের জীবন বলে কিছু কি নেই?
স্যরি। ডিস্টার্ব করার জন্য।
স্যরি হওয়ার কিছু নেই। ভবিষ্যতে আর ডিস্টার্ব না করলেই খুশি হব। আপনার নাম লিখে রাখি, বলুন।
ধন্যবাদ। আমার নাম তো ওঁনার ফোনবুকে সেভ থাকার কথা।
তাই?
আচ্ছা দেখি। বলেই লাইন কেটে দিলেন তিনি।
আবার কি কল ব্যাক করবেন ভদ্রলোক? না মনে হলো। তবু অপেক্ষা। মায়ের রিপোর্ট বলে কথা। নিজের হলে উপেক্ষা করা যেতো। মায়েরটা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। অবহেলা করাও যাবে না। ভেবে স্বস্তি পেল না। মনে প্রশ্ন হানা দিতে লাগল–কে হতে পারে লোকটা? এমন কটাস কটাস কথা বলতে পারেন কে? মোহসেনার স্বামী!
ভাবতেই পারছে না ও। পিচ্চিকালের এমন মমতাময়ী বান্ধবীর স্বামী এমন কঠোর! নাহ্। মানতে পারল না প্রমিত। আচ্ছা, নিজেও কি মিতুর কাছে এমন স্বামী! এ ভাবনাটা মাথা গুলিয়ে দিল। আলি আকবর স্যারের কথা মনে পড়তে লাগল। নিজের দোষ ধরার কথা বলেছেন, বার বার। ধরতে কি পারা যায় নিজের দোষ? এ চিন্তাটাও উড়িয়ে দিতে পারল না। এক্সএক্স বুমবুম মোনালিসার প্রতি যে টান, সেটা কি? দোষের না! দোষেরই তো। ওর কাছে গেলে তো আর তা দোষের মনে হয় না। এটাই কি অনৈতিকতা? ওই টান কীভাবে আটকে রাখতে হয়। তাও জানা নেই। দেহ-প্রকৃতির মধ্যে এমন বেপরোয়া সাড়া জাগিয়ে দেন কে? সৃষ্টিকর্তা? না নিজের দুর্বলতা, নিজের স্খলন?
এখনকার খারাপলাগা অবস্থায় এক্সবুমকে কল করার ইচ্ছায় যেইমাত্র মুঠোফোনটা হাতে নিল সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক হয়েছে মোহসেনার নম্বর থেকে।
কল রিসিভ করে সাড়া দিল না ও।
এই! প্রমিত! চুপ করে আছো কেন?
মোহসেনা?
হ্যাঁ। কেন প্রশ্ন করেছ? ফোনবুকে আমার নাম নেই?
আছে। একটু আগে আরেক ভদ্রলোকের হাতে ছিল তোমার ফোনসেট। কল করে নানা জেরার মুখে পড়েছিলাম। বাপরে, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম!
কী বলছ এসব?
হ্যাঁ। সত্যি।
আরে আমার সেট তো এখনই খুললাম আমি। অফ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। আর কল লিস্টে বা মেসেজে তো কারও নাম দেখলাম না। কোনো মেসিজও পেলাম না।
কী ভুতুড়ে কথা। আমার সেটে তো আউটগোয়িং কলে তোমার নাম আছে!
আছে। থাকতে পারে। দেখো, মোহসেনা নামে অন্য কোনো নম্বর সেভ করে রেখেছে কিনা?
আচ্ছা দেখি।
না। পরে দেখো। এখন বলল রিপোর্ট সব পেয়েছো?
পেয়েছি।
আচ্ছা। তুমি চলে এসো। আমার হাজবেন্ড বাসায় নেই। বুয়াও আজ ছুটিতে। এখন আমি যেতে পারব না তোমাদের বাসায়। বরং তুমি আসো রিপোর্ট নিয়ে। আমার বাসার ঠিকানাটা লিখে নাও।
ঠিকানা লিখে লাইন কেটে নিজের কললিস্টে চোখ বুলিয়ে নম্বরটা মিলিয়ে নিল, একই নম্বর তো!
ভয় পেয়ে আবার কল করতে গিয়েও করল না ও। আঙুল থামিয়ে মনে মনে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মতো করে বলল, থেমো না এখানে। এগিয়ে যাও সামনে।
রহস্য কি? মাথা কি তালগোল পাকিয়ে গেছে? ভাবনার কূল না। পেয়ে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল ও। এমনভাবে লোকটা কথা বলেছে, পুরোই মনে হয়েছিল নিশ্চয় রাশভারী মোহসেনার হাজবেন্ড হবে লোকটা। নম্বর ঠিক অথচ কলের অস্তিত্ব নেই! এ কেমন কথা! হঠাৎ মনে পড়ে গেল আবার মোহসেনার কথা। স্বামী নেই। বুয়াও নেই বাসায়। একা যেতে বলল কেন? মোহসেনাও কি এক্সএক্স বুমবুম!
নাহ্। কিছুতেই না। ছোট বেলার বন্ধুর শেত-শুভ্র নির্মল মনটা ও দেখে ফেলেছে। ও কিছুতেই তেমন হবে না। তবুও কাঁপন উঠল বুকে। কম্পমান অবস্থায় ও মেসিজ অপশনে গিয়ে লিখল, তোমার বাসায় নম্বর আর লোকেশনটা মেসেজে দাও। সেন্ট করে মুঠোফোনটা টেবিলে রেখে ওয়াশ রুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে টেবিলে রাখা মুঠোফোনের ওপর চোখ যাওয়ার পর চমকে উঠল প্রমিত। অল্প সময়ে এক্সবুম মোনালিসা চার বার কল করে ফেলেছে! কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! তারপর মেসিজ অপশনে ঢুকে খুঁজে দেখতে লাগল মোহসেনার আকাক্ষিত মেসিজ।
না। মোহসেনা সাড়া দেয়নি। মেসিজ এসেছে মোনালিসার নম্বর থেকে। মেসিজটি ক্লিক করে তাজ্জব হয়ে গেল।
কী! মাথা বিগড়ে গেল নাকি? কতবার আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছ! আবার বাসার ঠিকানা চাচ্ছো কেন?
মাগো! কার মেসিজ কাকে পাঠালাম। ভেবে নার্ভাস হয়ে গেল প্রমিত। কী সব ঘটছে আজ!
মেসিজটা আবার মনোযোগ দিয়ে পাঠালো ও মোহসেনার নম্বরে। ওই নম্বরটায় কি জ্যান্ত ভূত বসে আছে? একবার কল ধরছে এক ভয়ংকর লোকে আবার কল চলে গেছে ভুতুড়ে নম্বরে! হচ্ছেটা কী!
এক মিনিটও অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। মেসিজ পাঠিয়েছে। এবার মোহসেনা। কী হলো? ঠিকানা তো লিখে নিলে! আচ্ছা আবার দিলাম। লেখার সময় প্রথমে মনোযোগ দেয়নি। মেসিজে মনোযোগ দিয়ে ঠিকানা পড়ে আগাগোড়া শীতল হয়ে গেল প্রমিত। এতো কাছে ওর বাসা! কী লীলা আল্লাহ্র। নিজের বউ চলে গেছে বাপের বাড়ি আর ছোট্টবেলার বন্ধুর বাসা এত কাছে! আবার ডেকেও পাঠিয়েছে একা বাড়িতে! বুয়াও বাড়িতে নেই! এত অধিকার ফলায় কেন সে! মানবলীলা বোঝা দায়, মেয়েদের বোঝা তো আরও বেশি কঠিন, ভেবেও চমকে চমকে উঠতে লাগল প্রমিত। রেডি হয়ে মাকে বলে রিপোর্টগুলো নিয়ে বাইরে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
আটাশ
মোহসেনাদের বাসাটা ছোট। ছিমছাম। দরজায় ছোট করে দুটো নেমপ্লেট লেখা : ডা. মামুন ও ডা. মোহসেনা।
প্রমিত বুঝে গেল। ওরা যুগল চিকিৎসক! মামুনের অবর্তমানে ডাকল কেন?
বাসায় দরজায় ডোরবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। মোহসেনা বোধহয় দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।
চিনতে অসুবিধা হয়নি তো?
না। একদম কাছে। তুমি আমার একদম নিকটতম প্রতিবেশী। ডাক দিলেই ছুটে আসতে পারব।
হ্যাঁ। আমার হাজবেন্ডও একই কথা বলেছে।
কী বলেছে?
বলেছে, সায়েরা আন্টিকে দেখভাল করতে অসুবিধা হবে না। আমার মায়ের মন ভালো করতে হলে তোমার মাকে সেবা দিতে হবে। পরিচর্যা দিতে হবে।
সে কোথায়?
আসছে। মিষ্টির দোকানে ঢুকেছে। কী মিষ্টি পছন্দ করো?
আরে আমি হলাম পেটুক মানুষ, যা পাই সব খাই। বাছবিচার নেই আমার।
না। না। সেটা ঠিক নয়। বলতে বলতে মোহসেনা ওর হাজবেন্ডের উদ্দেশে কল করে বলল, যা পাওয়া যায় নিয়ে এস। প্রমিত চলে এসেছে।
তাহলে মামুন জানে আমার আসার কথা?
হ্যাঁ। ওকে বলে রেখেছিলাম।
সে সন্দেহ করবে না?
কী বলো! এখানে সন্দেহের কী আছে? তোমার সঙ্গে কি আমার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে নাকি?
না। এমনি বলে ফেললাম।
তুমি তোমার বউকে সন্দেহ করো নাকি?
না। তা নয়। কেন যে মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না।
তোমার বউ তোমাকে সন্দেহ করে?
জানি না।
জানি না মানে? সন্দেহ তো ঘুণপোকার চেয়েও বড়ো ঘুণে ধরা জীবনের বিষ। বলতে বলতে ও প্রমিতের হাতে ধরা ফাইলটা খুলে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে কয়েকবার চমকে উঠেছে মোহসেনা। চোখ এড়াল না প্রমিতের।
খারাপ কিছু হয়েছে?
আরে না। ডায়াবেটিস এসে গেছে। এটা তো চিকিৎসাযোগ্য রোগ। ভিটামিন ডি-ও কম। এর ঘাটতি থাকলে হাড়গোড় আর পেশির নানা সমস্যা হয়। এটাও চিকিৎসাযোগ্য। ইউরিক এসিডও বাড়তি আছে। খাবার নিয়ন্ত্রণ করে আর ওষুধ দিয়ে ইউরিক এসিডের বাড়তি আক্রমণ শাসন করা যায়। আর একটা বিষয় আছে। এটা বুঝতে পারছি না। আমার স্যারের কাছে নিয়ে যাব। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।
শেষ ভরসার কথা শুনেও প্রমিতের মন ভালো হলো না। ভয় কামড়ে ধরল বুকে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে সে। ভাইবোন কেউ নেই। মা-ই তার সম্বল। আর আছে রোদ্দুর। সে আছে তার মায়ের দখলে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একাকী পথিক মনে হতে লাগল। পিচ্চিকালের বন্ধু এত কাছে এসেছে। সেও কাছের কেউ নয়। দূরের। কাছের হয়ে উপকার করে যাচ্ছে। তার ওপর ভরসা করা যায়। বলল, কখন দেখাবে তোমার স্যারকে। তিনি চেম্বার কোথায় করেন?
আরে, পাগল নাকি তুমি? চেম্বারে দেখাব কেন? আমাদের ওয়ার্ডে দেখাব।
হঠাৎ মুঠোফোনে ভাইব্রেশনে টের পেল। পকেট থেকে সেট বের করে দেখল মিতুর নম্বর থেকে কল এসেছে। নিশ্চয় রোদ্দুরের কল!
সবুজ সিগনালে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে কানেক্ট হয়ে গেল কল।
বাপি, কেমন আছ?
ভালো নেই, মা।
আমার দাদুভাই অসুস্থ হয়েছে। জানাওনি কেন আমাকে?
জানানোর সুযোগ পাইনি, মা।
এখন কোথায়?
আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড ডা. মোহসেনার বাসায় এসেছি তোমার দাদুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে।
তুমি কি ওই বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াও?
না। প্রয়োজনে এসেছি ওদের বাসায়?
ওই মহিলা কি কয়েকবার গেছে দাদুকে দেখতে, তোমার সঙ্গে গল্প করেছে?
গেছে। গল্প করেছি।
তাহলে মাম্মি ঠিকই বলেছে, তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে ভালো আছো।
এসব প্রশ্ন কে করতে বলেছে, তোমাকে?
আমি প্রশ্ন করছি। আমাকে উত্তর দাও। মাম্মিও জানতে চেয়েছে। শুনছে। স্পিকার লাউড আছে।
হ্যাঁ। শোনো। আমার পিচ্চি কালের বন্ধুটাকে বড়ো বেলায় পেয়ে ভালো লাগছে। বিপদেও আমার পাশে আছে। শুনেছো?
লাইন কেটে গেল। স্তব্ধ হয়ে মোহসেনার সামনে দাঁড়িয়ে রইল প্রমিত। ডা. মামুন এসে সরাসরি খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল প্রমিতকে। সম্ভাষণ জানিয়ে হ্যাঁডশেক করল। কোনো প্রশ্ন করতে পারল না। মুখ ফুটে আর কোনো কথাও বলতে পারল না।
কী ব্যাপার এমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মনে হচ্ছে আমার হাত থেকে টক দইয়ের হাড়িটা কেড়ে নেবেন। গালে একটা চড় মেরে দেবেন। যেমনটি মেরেছিলেন মোহসেনার ছোট বেলায়।
আবার স্তব্ধ হয়ে গেল প্রমিত। ওরা স্বামী-স্ত্রী কতো খোলামেলা। কী নির্ভেজাল ভাবে ওরা শেয়ার করে সব মজার কথা। নিজেদের সংকীর্ণ আর রাখঢাক, গোপন বৈশিষ্ট্যই তবে বড় বাধা দুজনের বন্ধনের! ভাবনাটা আবার ওকে ফিরিয়ে আনল বর্তমানে। ম্লান হেসে প্রমিত এবার বলল, এখন আর চড় দেওয়ার বয়স নেই। বরং চড় খাওয়ার বয়সে চলে এসেছি।
হো হো করে হেসে উঠল ওরা তিনজন। ওদের শিশুপুত্রও হাসির আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কোলে উঠে গেল।
আমাদের ছেলে। বলল মামুন।
বাহ! কিউট বেবি! কী নাম তোমার?
চা-দ। ভাঙা শব্দে নিজের নামটা উচ্চরণ করল সে।
ওর নাম চাঁদ। কারেকশন করে দিল মোহসেনা।
আরে! এত সুন্দর! চাঁদের নামেও ছেলেদের নাম হতে পারে!
পারে তো! তোমার মেয়ের নামও রোদ্দুর! বলল মোহসেনা।
সঙ্গে সঙ্গে মামুন বলল, রোদ্দুর! রোদ্দুরও নাম হতে পারে! ভালোই তো! সব সময় রোদের মতো তেজি হয়ে থাকবে সে!
আজকাল নামের মধ্যে পরিবর্তন আসছে। সুন্দর সুন্দর নাম রাখা হচ্ছে। জেনারেশনে নামের নতুনত্বের জোয়ার চলছে।
হ্যাঁ। তা বলতে পারেন। নতুনত্ব। তবে নাম নিয়ে টিজিংও হয়। আমার রোদ্দুরকে ওর বন্ধুরা খেপায়। বলে রোদ্দুর, তুমি কেবল দিনের। রাতের নও।
তাহলে তো চাঁদ কেবল রাতের, দিনের নয়।
মামুনের কথায় আবারও তিনজন হই হই করে হাসতে শুরু করল।
চাঁদকে একবার কোলে নিতে চাইল প্রমিত। হাত বাড়িয়ে মায়ের কোল থেকে অনেকটা কেড়ে নিতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ ওর গালে একটা চড় মেরে দিল।
স্তব্ধ হয়ে গেল মামুন-মোহসেনা দুজনই।
স্তব্ধ হয়েও হেসে দিয়ে প্রমিত বলল, যাক ছোট বেলার দেওয়া চড়টা বড়বেলায় ফিরে পেলাম। আর তখনই সবাই আবার একসঙ্গে হেসে উঠল।
উনত্রিশ
ভুল করে বাসার ঠিকানা চেয়েছো আমার কাছে। জানো সব, তবু ঠিকানাটা পাঠালাম। যদি আসো। মন ভালো করে দেব। মামুন মোহসেনার বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় বসে মেসিজ পেল প্রমিত, মন আসলেই খারাপ। মোহসেনার মতো এমন দরদি বন্ধু নিয়েও মিতু যা ভাবতে পেরেছে, ওকে আর সুস্থ মনে হচ্ছে না। নিজেও অসুস্থ কিনা বুঝতে পারছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, ও কী করছে না-করছে, কোথায় যাচ্ছে সব জেনে যায় কীভাবে? ওর পিঠে কি ক্যামেরা ফিট করে রেখেছে মিতু? হঠাৎ মনে হলো মাকে হয়তো কল করে থাকতে পারে রোদ্দুর। সরল বিশ্বাসে হয়তো তিনি একদিনের মোহসেনাকে ওর সামনে তুলে ধরেছেন। সেই বিশ্বাসকে হয়তো নোংরাভাবে দেখেছে মিতু। ভাবতে গিয়ে মন খারাপ হতে লাগল ওর। আর এ সময় এক্সবুমর মেসিজটাও মাথা গুলিয়ে দেওয়ায় ও রওনা দিল মোনালিসার বাড়ির উদ্দেশে। কী টানে ছুটছে ও? জানে না প্রমিত। এক মন বলছে, যেয়ো না। আরেক মন ওকে টেনে নিচ্ছে। কার শক্তি বেশি। যেয়ো না, না কি চলোর? ভাবতে পারল না প্রমিত। ভাবনারা ভাসমান ধুলোকণার মতো উড়তে লাগল মন-আকাশে। ভাবনারা দখল করে আছে মেঘ। বৃষ্টি ঝরলেই নেমে আসবে মাটিতে। কার ঘরে বৃষ্টি নামবে, মোনালিসার? মিতুর? এসব ভাবনাও যোগ হচ্ছে মূল চিন্তা স্রোতে। স্রোত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রমিতও। হঠাৎ খেয়াল করল রিকশা এসে থেমেছে এক্সবুমর বাড়ির সামনে। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির বাউন্ডারিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল বাসায় ঢোকার মূল দরজা। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মোনালিসা।
আশ্চর্য! ভার্চুয়াল জগতে সে যত খোলামেলা, এখানে অনেক বেশি সংযত। স্কার্ফ পরে দরজা খুলে বলল জানালা দিয়ে এই পথটার অনেক দূর দেখা যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে ফেলেছি তোমাকে। মন বলছিল তুমি আসবে।
মনটা ভালো নেই। মা অসুস্থ। বাচ্চা নিয়ে বউ উঠেছে তার বাপের বাড়ি। অফিসেও চলছে ষড়যন্ত্র, দলাদলি। সব মিলিয়ে নিজেকে আর খুঁজে পাই না নিজের ভেতর। চলে এলাম।
ভালো করেছ। বলেই মোনালিসা দরজা বন্ধ করার আগেই জড়িয়ে ধরে হাগ করল প্রমিতকে। এই আচমকা আচরণ যে অনাকক্ষিত, তা নয়। কিন্তু দেহ সাড়া দিল না। মনও না। সমান উচ্ছ্বাস দেখা গেল না ওর পরবর্তী কথাবার্তায়। কিছুটা ধাক্কা খেলো এক্সবুমর ভেতর হরিণ হয়ে থাকা মোনালিসা।
দরজা বন্ধ করার পর স্কার্ফ খুলে ফেলল সে। বোরখার মতো পড়া আলখেল্লাটাও। ভেতরে স্বাভাবিক ড্রেস। শালোয়ার-কামিজ পরনে। আলখেল্লা খুলছে দেখে ভীত হয়ে গিয়েছিল। ভেতরের ড্রেসটা দেখে স্বস্তি পেল প্রমিত।
কী খাবে? বলেই হাসা শুরু করল সে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির চিত্রশিল্প মোনালিসার প্রতিকৃতিও হার মানায়, তার হাসির ভেতর ডুবানো রহস্যের নানা কৌণিক অবস্থান থেকে দেখা যায়, এমন হাসির ছটার কাছে হার মানে সে বিকীর্ণ তাপ। ভার্চুয়াল জগৎ আর বাস্তব। জগতের মধ্যেও বিরাট ফাঁক দেখতে পেল প্রমিত। ভার্চুয়াল জগতে কথাবার্তা, ছবি লেনদেন আর আহ্বানের মধ্যে দেখেছে উগ্রতা। মুহূর্তের স্রোত ভেসে যাওয়ার বিষয়-আশয়। আর এখন দেখছে, রহস্যময়তার ভেতর এক লক্ষ্মী মেয়েকে।
এই যে আমাকে ডেকে আনলে, ভয় করছে না?
ভয় করবে কেন?
এ আহ্বান তো সমাজে মানে না, এমন একটা বিষয়।
সমাজের বিষয় সমাজের। আমার বিষয় আমার ঘরের। কী করবো বলো। বাচ্চা হয়নি। স্বামী বারো মাসের তের মাস থাকে বাইরে বাইরে। আমার প্রতি কি তার নজর আছে?
একদম নজর দেয় না?
নজর দেয় না তা নয়। গোয়েন্দা নজর প্রকট বায়োলজিক্যাল নজরও।
অপূর্ণতা পূরণ করতে ডাকো আমাকে?
হ্যাঁ। তুমিও তো অপূর্ণ থাকো। বউ দূরে, অপূর্ণ নও তুমি?
হঠাৎ মাথায় উড়ে এসে ঢুকে গেল এক বিষচিন্তা, বিষবান–মিতুও তার অপূর্ণতা কি মেটায় অন্য কাউকে ডেকে?
হা হা করে উঠল ভেতরের মন। ভেতরের চোখ দিয়ে ও দেখতে লাগল মিতুও বসে আছে কোনো পুরুষের সামনে, গাউন খুলে আহ্বান করছে পর পুরুষকে। জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে সে!
বুকের ভেতরটা খামছে ধরেছে। অক্টোপাসের আঁকড়ে ধরার চেয়েও বড় ধরা খেয়ে হাঁসফাস করতে লাগল ও। দূষিত চিন্তাটাকে তাড়াতে চাচ্ছে। সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। প্রবল বেগে মাথায় ঢুকে যাচ্ছে চিন্তা, অশোভন দৃশ্যকল্পের আক্রমণ।
কী হলো? এ মন গুটিয়ে যাচ্ছো কেন? এমন লাগছে কেন? অসুস্থ লাগছে?
না।
আদর করে দিই। না বললেই হলো। পরিবেশ বলছে হ্যাঁ, আর না বলে পার পেয়ে যাবে তুমি? যাওয়া উচিত?
না। আরও শক্ত করে বলল প্রমিত।
কঠিন না উপেক্ষা করতে পারল না মোনালিসা। উঠে ফ্রিজের কাছে গেল। তারপর ঠাণ্ডা পানি বের করে নর্মাল পানির সঙ্গে মিশিয়ে বলল, নাও। মাথা ঠাণ্ডা করো।
মাথা ঠাণ্ডা আছে। তবু দাও। পানির তৃষ্ণা মেটাই।
উপযুক্ত সময়ে না বলতে পেরেছে হ্যাঁও না আর হ্যাঁর অর্থ মস্তিষ্কে খোলাসা হয়ে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রমিতের মনে হলো রোদ্দুরকেও শেখাতে হবে। হ্যাঁ, বলার প্রয়োজনে যেন সে হা বলেই সাড়া দিতে পারে, অশুভকে যেন সে, না বলতে পারে।
বাইরে শোরগোল হচ্ছে দেখে জানালা দিয়ে উঁকি দিল মোনালিসা। পাড়ায় কয়েকটা ছেলে এসেছে। দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। এখনও ডোরবেল টেপেনি তারা। কী বলতে চায় ওরা! এমন তো কখনও হয়নি!
মোনালিসার কপালে চিন্তারেখার সমান্তরাল ৪টি লাইন ভেসে উঠল। দুই লাইনের মাঝে বেশ গভীর খাদও সৃষ্টি হয়ে গেছে। ফিরে এসে প্রমিতের সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রমিত।
কী হয়েছে?
বাইরে এলাকার ছেলেরা জড়ো হয়েছে।
কী চায় ওরা?
জানি না। কিছু বুঝতে পারছি না। ডোরবেল টেপেনি। দরজায় ধাক্কাও দেয়নি।
দরজার বাইরে খোলা জায়গায় আড্ডা দিতে আসেনি তো!
তা হতে পারে। তবে এর আগে তো এমনটা হয়নি।
দরজা খোলো। বাইরে যাও। কী চায় জানতে চাও।
ঠিক হবে ওদের ডিস্টার্ব করা?
ওরাই ডিস্টার্ব করবে আমাদের। মনে হচ্ছে ওরা বুঝে-শুনে এসে জড়ো হয়েছে এখানে।
মাথায় ঢুকছে না কিছু। বলল মোনালিসা।
বিপদে পড়লে তো ঢুকবে না কিছু। এটাই স্বাভাবিক। বিপদের আগেই ঢোকা উচিত ছিল। অনুচিত-অশোভন কাজে বাধা খাওয়া উচিত ছিল দুজনকেই। বলল প্রমিত।
উচিত-অনুচিত নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। যাই দরজা খুলে দেখি ওরা কী চায়?
আমাকে সম্ভবত ফলো করেছে।
হতে পারে। তেমন হলে বলব তুমি আমার আত্মীয়। আন্টি অসুস্থ, খবর দিতে এসেছে।
কী আত্মীয় বলবে?
বলব তুমি আমার কাজিন।
ওকে যাও। দরজা খোলো। ওরা জেরা করার আগে তুমিই খোলামেলা হও। কথা বলো।
ভয় দূর করে এগিয়ে গেল মোনালিসা। ভয় না থাকলেও মনে হলো পা কাঁপছে। বাড়িটাও কাঁপছে। দরজাও। বাইরের ঝড় নেই। মনে হলো ঝড় বইছে। অদৃশ্য নয়, দৃশ্যমান ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে সব।
দরজার হুক খুলে সামনে দাঁড়াল মোনালিসা। তার মাথা উদ্ধত, সরাসরি তরুণদের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী চাও তোমরা? এখানে জড়ো হয়ে শোরগোল করছো কেন?
চুপ হয়ে গেল সবাই। এত বড় গলার আওয়াজ কোনো অপরাধীর বলে মনে হলো না। একজন ফিসফিস করে বলে বসল, চোরের বড় গলা।
কী বলছ ফিসফিস করে। বলা কথার কনটেন্ট বুঝতে পেরে বিস্ময়সূচক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল মোনালিসা। প্রশ্নের মধ্যেও রয়েছে ধমক। ওরা আক্রমণ করার আগে নিজেই আক্রমণ করল ও।
একজন বলল, আমাদের চাঁদা লাগবে।
কিসের চাঁদা, ফুটবল টুর্নামেন্ট হবে। তার খরচপাতির জন্য।
আচ্ছা। সেটা বলো। এমনভাবে এখানে জড়ো হয়েছে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আর তোমরা তো সবাই ভদ্র ছেলে। সন্ত্রাসী বা হেরোইনচি মনে হচ্ছে না তোমাদের। ঠিক আছে। বিকেলে এসো। পাঁচহাজার টাকা দিয়ে দেব।
একজন বলল, পাঁচ হাজারের পাঁচের পর তিনটে শূন্যের বদলায় চারটা শূন্য বসাতে হবে, ম্যাডাম।
কী বলছ? এটা চাঁদা হলো না? সন্ত্রাসি চাহিদা?
জি, ম্যাডাম। এখনও জোর করিনি। তবু এটা জোরজবরদস্তির ব্যাপার, বিশেষ করে যারা আকাম-কুকাম করে তাদের কাজে সহায়তার জন্য মাস্তানি ফি।
কী বলছ, এসব?
ম্যাডাম। আপনার মর্যাদা যাতে হানি না হয় তা দেখার দায়িত্ব ফি দেবেন না? রাজি না হলে ডিমান্ড বেড়ে যাবে। পাঁচের পরিবর্তে বলব একের পর পাঁচটা শূন্য বসান। সেই অঙ্কটা দিয়ে দেন। আমরা চলে যাব। ভবিষ্যতে আর কোনো ক্লায়েন্ট ঢুকলে, যা আয় করবেন, তার অর্ধেক আমাদের ফান্ডে দেবেন। কেউ আপনাকে জ্বালাবে না।
এসব অশ্লীল কথা বলছো কোন সাহসে?
আপনি ফষ্টিনষ্টি করবেন, আর অশ্লীল কথা বলছি আমরা?
শোনো, উনি আমার কাজিন। আমার খালাম্মা অসুস্থ। ওনাকে দেখভালের জন্য আমাকে নিতে এসেছে। আমি এখন বেরোববা, ওদের বাসায় যাব। আজেবাজে কথা বলা কি শোভন হলো? তোমাদের ঘরে মেহমান আসে না?
দু-একজন তরুণ দোনোমনো হয়ে গেল। মোনালিসার উঁচু গলার সামনে ভেঙে পড়ল। কেবল দুজন শক্ত গলায় বলল, বিকেলে এসে পঞ্চাশ হাজার না পেলে আপনার কাজিন-ক্লায়েন্টের ভিডিও ক্লিপ ও ছবিসহ আপনার অন্তরঙ্গতার ছবি ছেড়ে দেব এলাকার ডিশ লাইনে, ফেসবুকেও।
তোমরা আমাকে ধমক দিচ্ছ? ব্ল্যাকমেইল করতে চাচ্ছো?
না। ম্যাডাম। ধমকও না ব্ল্যাকমেইলও না। বলতে বলতে মুঠোফোনের ফটোগ্যালারিতে ঢুকে একটু আগে তোলা ছবি ও ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে বললো, ছবিটা কিছুক্ষণ আগে আমার ক্যামেরায় তুলেছি। ফেসবুকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার আর আপনার ক্লায়েন্টের নাম ধরে ফেলেছি। দুজনের প্রফাইলে ঢুকে সবার পরিবারের সদস্যদেরও নাড়িভুড়ি বের করে ফেলেছি আমরা।
মোনালিসা দেখল ছবিতে সেক্সিভঙ্গিতে ও জড়িয়ে ধরেছে প্রমিতকে। ক্লিপে দেখল তার কানে একটা কামড় দিয়ে ভেতরে ঢুকে পরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ও। এসব দেখে ঘাম ছুটে গেল ওর।
কণ্ঠ নত হয়ে গেল মোনালিসার। বলল, কোনো ক্রাইম করিনি আমরা। ও আমার মেয়েবেলার ফিয়ানসে, এজন্য একটু আদর করেছি। আর অন্য কিছু করার স্কোপ আছে এখানে? ঘরে বুয়া আছে না?
ছবিটা কি পাঠিয়ে দেব আপনার হাজবেন্ডের আইডিতে। আর আপনার ক্লায়েন্টের ঘরে? পাঠাব?
নত হয়ে গেল মোনালিসা। বলল, দশ হাজার ক্যাশ টাকা আছে। সেটাই নাও। আর এ বিপদ ঘটিয়ো না আমাদের জীবনে।