পনের
নিউরোইমেজিং বিভাগের সিটি স্ক্যান কক্ষের সামনে লম্বা লাইন। ট্রলিতে রোগী। প্রত্যেকের গায়ে জড়ানো সাদা বেড কাভার। প্রত্যেক ট্রলির সঙ্গে একজন করে দাঁড়ানো। কোন ট্রলিতে আছে মিতু, বোঝা যাচ্ছে না। ওর সঙ্গে কেউ আছে নিশ্চয়। ওয়ার্ডবয়? নার্সঃ নার্সের ড্রেসে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটি ট্রলি দূর থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ চোখ গেল দরজার মুখে ঢোকার অপেক্ষায় থাকা একটা ট্রলির পেছনের স্ট্যান্ডের দিকে। পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে কমলা রঙের ড্রেসের একাংশ। ও-ই কি মিতু? পাশ কেটে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখল পাশে দাঁড়ানো আছে এক তরুণ। কে এ সুদর্শন তরুণ! এ প্রজন্মের তরুণদের মতো ছোট ছোট দাড়ি, এ সময়ের-ফ্যাশনে। কে এই তরুণ! মিতুর অতি আপন কেউ কি? পাশে গিয়ে প্রথমে দেখে নিলো মিতুর মুখ। হ্যাঁ। মিতুই। ওর চোখ বোজা। চমকে উঠল। ভয়ও বেড়ে গেল। মিতুর সিরিয়াস কিছু হয়ে গেলে সমালোচনা আর আক্রমণের মুখোমুখি নিজেকেও দাঁড়াতে হবে।
কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল প্রমিত।
অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছিল আলম।
চমকে উঠে প্রশ্ন করল, কে আপনি?
উত্তর না দিয়ে প্রমিত প্রশ্ন করল, আপনি কে?
দুই জনের দুই প্রশ্ন থেকে মিসাইল গতিতে ছুটে আসা কে আপনি আর আপনি কে এর মধ্যে শব্দপথে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে গেল। কোথাও বিস্ফোরণের শব্দ ঘটল না। তবে বিস্ফোরিত অদৃশ্য আগুন নেভানোর জন্য প্রমিত শান্ত কণ্ঠে বলল, আমি ওর হাজবেন্ড!
উনি ম্যারেড! উফ! বাঁচালেন! নাম না-জানা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। রোগিণীকে নিয়ে বিপদে ছিলাম।
নিজের মগ্নতার মধ্যেই ডুবে আলম আবার বলল, আপনি যে ওনার হাজবেন্ড, প্রমাণ কী? কীভাবে জানলেন যে তিনি এখানে আছেন?
আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আপনি দেননি। গম্ভীর হয়ে শীতল কণ্ঠে এবার বলল প্রমিত।
আলমের দুশ্চিন্তা টুটে গেল। স্বস্তি নিয়ে বলল, নাম না-জানা ওনার এখন আইনগত অভিভাবক আমি। ওনার টিকেটে দেখুন লেখা আছে আমার নাম। আর ড্রাইডিং লাইসেন্স নম্বর। আর দেখুন এই যে, টিকেটের পাশে মারা আছে একটা সিল।
প্রমিত দেখল স্টামপ্যাডের ছাপ : পুলিশ কেস। তার পাশে লেখা আলম। লাইসেন্স নম্বরও।
ওদের কথা চালাচালির মধ্যে পেছন থেকে এসে দাঁড়ালেন আলি আশরাফ চৌধুরী। পিতৃত্বের তীব্র টানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের শেকল ছিঁড়ে গেল। প্রমিতকে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি বাইরে দাঁড়াও। কেবল কথার জোরে নয়, হাতের ধাক্কায়ও সরিয়ে দিলেন ওকে।
প্রমিত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। শ্বশুরের ব্যবহারে কষ্ট পেলেও ভেঙে গেল না। কোনো কথা না বলে গোঁয়াড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। শ্বশুর ওকে আবার ধাক্কা দিলেন।
আলম বলল, আপনি কে। ওনাকে ধাক্কাচ্ছেন কেন?
ওরে আমি পুলিশে দেবো। ধাক্কা তো দূরের কথা।
আপনি কে?
আমি মিতুর বাবা। ওর আসল গার্জেন।
পারিবারিক সংঘাত আছে ভেবে দূরে দাঁড়িয়ে রইল আলম। প্রমিতও খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন সময় ডাক এলো, আলমের রোগী আসুন ভেতরে।
মনিটর কক্ষে রোগীর ডকুমেন্টস হাতে নিয়ে ঢুকে গেলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।
সিটি স্ক্যান মেশিন অপারেটর, টেকনিশিয়ান প্রশ্ন করলেন, আপনিই আলম?
না। আমি আলি আশরাফ চৌধুরী। ওর বাবা।
সেকি! আমরা তো জেনেছি রোগীর অভিভাবকের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
আমরা খোঁজ পেয়ে এসে গেছি।
আচ্ছা। ভালো হলো। কথা বলতে থাকলেও তার চোখ স্থির হয়ে রইল মনিটরিংয়ের স্ক্রিনে।
খারাপ কিছু হয়েছে?
সরাসরি উত্তর না দিয়ে টেকনিশিয়ান বললেন, মনে হচ্ছে ব্রেনে কংকাশন (Concussion) হয়েছে।
এমন ঘটে কেন?
সাধারণত কপালে ঘুষি খেলে এমন হতে পারে। কপালে টুস থেকেও হতে পারে। এ অবস্থায় রোগী সাময়িক অজ্ঞান হয়ে থাকে। মাথাব্যথাও থাকতে পারে। মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হতে পারে, মেমোরিও ডিস্টার্ব হতে পারে, ব্যালেন্সের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিষয়টা কি সিরিয়াস? প্রশ্ন করলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।
না। সিরিয়াস না। ঠিক হয়ে যাবে। প্রফেসর স্যাররা আসল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিবেন। আমার অল্প নলেজ থেকে যা বললাম তা শতভাগ মেনে নেওয়ার দরকার নেই।
আলম সাহেব কোথায়?
উনি বাইরে আছেন।
ওনাকে ডাকুন আমরা ফিল্মটা উপরে পাঠিয়ে দেব ওনার হাত দিয়ে। স্যাররা ওটা দেখে পরবর্তী চিকিৎসার প্লানিং করে দেবেন।
আলি আশরাফ চৌধুরী বেরিয়ে এসে বললেন, আপনিই আলম?
জি।
ভেতরে যান। আপনার হাতে ওরা ফিল্মটা দেবেন। ওটা নিয়ে আপনাকে উপরে যেতে হবে। যেহেতু আপনিই কাগজে-কলমে মিতুর অভিভাবক এখন, আপনাকে ছাড়া ওরা মিতুর দায়ভার আমাদের হাতে দেবেন না।
ভেতরে ঢুকে গেল আলম। রোগীসহ বুঝে নিল যাবতীয় কাগজপত্র আর সিটি স্ক্যানের ফিল্মটা।
প্রমিত এগিয়ে এসে জানতে চাইল, মিতু কেমন আছে?
জবাব দিলেন না আলি আশরাফ চৌধুরী। আরও গম্ভীর হয়ে তিনি সরে গেলেন সামনে থেকে। প্রমিতও অভিমানে আক্রান্ত হয়ে রোগীকে নিয়ে বাইরে আসা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল।
.
ওয়ার্ডে আসার পর ঘুম থেকে জেগে গেল রোদ্দুর। মাকে সিটে জায়গা দেওয়ার জন্য এক লাফে ও নেমে এলো বেড থেকে। তারপর মায়ের গালে হাত বুলিয়ে আদর দিয়ে বলতে লাগল, মাম্মি! মাম্মি! আমি রোদ্দুর। চোখ খোলো।
চোখের পাতা নড়ে উঠল। কেঁপে উঠল পুরো শরীর। আসমা বেগমও মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন, দেখো, মিতু। আমি তোমার আম্মা। দেখো আমাকে। পাশে দাঁড়িয়ে আলম বলল, ভয় নেই বলেছেন সিটি স্ক্যানের রেডিও-গ্রাফার। এখন দেখি ওই ওয়ার্ডের অধ্যাপক স্যার কী বলেন?
আসমা বেগম জিগ্যেস করলেন, আপনি কে?
রোদ্দুরও একই প্রশ্ন করে বসল, আপনি কে?
আমার নাম আলম। আমি একজন সিএনজি চালক। আমিই ওনাকে নিয়ে এসেছি জরুরি বিভাগে।
আপনাকে ভিডিও ফুটেজে দেখেছি আমি। সিএনজি থেকে মাম্মিকে কোলে করে নিয়ে এসেছেন।
মাথা নিচু করে আলম জবাব দিল, হ্যাঁ।
ওর বাবা আর হ্যাঁজবেন্ড গিয়েছিল নিচে। ওরা কোথায়? প্রশ্ন করলেন আসমা বেগম।
ওয়ার্ডের বাইরে আছেন।
ওরা। দেখেছেন? মিতুর খবর জানেন?
জি। ওনারা বাইরে আছেন। এখন আপনাদের হাতে রোগীকে দিয়ে আমি চলে যাব।
না। যাবেন কেন? দাঁড়ান। ওরা সবাই আসুক।
সিটি স্ক্যানের ফিল্মটা হাতে দিয়ে দেখতে দেখতে ওয়ার্ড প্রধান, অধ্যাপক রোগীর কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, ভয় নেই। অপারেশন লাগবে না। ব্রেনের ভেতর কোনো ক্ষতি হয়নি, রক্তপাত ঘটেনি। ইডেমা নেই, ফোলা নেই। কনজারভেটিভ চিকিৎসা চলুক, আশা করি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবেন তিনি। বলতে বলতে তিনি রোদ্দুরের মাথায় হাতই ছোঁয়ালেন। আদর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খুশি রোদ্দুর?
না। খুশি না। মাম্মি কথা বললে খুশি হবো।
কথা বলবে। কানের কছে গিয়ে ফিসফিস করে তুমি জানিয়ে দাও তোমার আসার কথা। জেগে যাবেন তোমার মাম্মি।
রোদ্দুর সত্যি সত্যিই দুহাত দিয়ে মায়ের মুখ মুছতে লাগল, তারপর বলতে লাগল, মাম্মি আমি এসেছি।
আলমের সঙ্গে হ্যাঁন্ডশেক করলেন অধ্যাপক। জুনিয়র চিকিৎসকরাও। তাকে বাহবা দিয়ে বললেন, কত নিউজ তো আজকাল ফেসবুকে ভাইরাল হয়। আমি মনে করি আপনি যে কাজটি করেছেন তা ভাইরাল হওয়া উচিত। মহান কাজ করেছেন। অভিনন্দন। আপনাকে।
আরেকজন অটোচালক, ওনার নাম রিয়াজ, উনি হেল্প না করলে আমার পক্ষে মিতু আপার পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হতো না। উনিও সহোযোগিতা করেছেন।
আমার বিশ্বাস আপনাদের দুজনার প্রতি ফ্যামিলি কৃতজ্ঞ থাকবে চিরকাল।
ষোল
প্রমিতের মা, সায়েরা আমিন বললেন, অসময়ে শুয়ে থাকলে হবে? ওঠ। বউমার কাছে যাও। রোদ্দুরের কছে যাও। ওদের নিয়ে এসো।
মিতু পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। হাসপাতাল থেকে ওদের বাসায় গেলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লগাবে। ও সব কথা বলতেও পারছে না। কেন হাসপাতালে তাকে যেতে হলো তাও পরিষ্কার নয়। এদিকে শ্বশুর মশাই ধরে নিয়েছেন আমি ওকে মেরেছি। আমিই দায়ী। আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। ওরা আমার কথা শুনতে চাচ্ছেন না। দুর দুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। ও বাড়িতে আমার কি এখন যাওয়া উচিত?
কেন? তোমার শাশুড়ি তো সব জানে! তিনি বুঝিয়ে বলেননি তোমার শ্বশুরকে?
তা তো জানি না।
রোদ্দুর কিছু বলেনি?
বলেছে হয়তো। ও কি আর সব ঘটনা বুঝেছে? বুঝলেও গুছিয়ে বলতে পারবে? কেন বেওয়ারিশ রোগী হয়ে অচেতনভাবে হাসপাতালে ওকে ভর্তি হতে হলো তাও পরিষ্কার নয়। তাছাড়া এক তরুণ বলছে, সে সিএনজি চালক, সুদর্শন ওই তরুণের কথাবার্তা, আর ওর প্রতি সেবাযত্নের বহর দেখেও মনে প্রশ্ন জেগেছে। প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মন তৃপ্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না।
যোগাযোগের ঘাটতি হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। ওরাও ভুল বুঝবে। তুমিও। বিষয়টা কি ভালো হবে? যাও। নিজের দোষ থাকলেও তা ধরো। শুধরাও। নাতনির কাছে থাকো। বউমার কাছেও।
কি বলছো, আম্মা? ওদের পক্ষ হয়ে কথা বলছো?
পক্ষ-বিপক্ষের কথা নয়। ভুল-আর শুদ্ধের কথা। তুমি ভুল করলে তুমি শুদ্ধ হও। সে করলে সে হবে শুদ্ধ। দুজনের শুদ্ধ-জীবনের ভেতর থেকে বেড়ে ওঠে শিশু। রোদ্দুরের ভালোর জন্যই চাইব তোমাদের সমস্যা মিটিয়ে নাও।
বারবার আমার ভুলের দিকে আঙুল তুলছো তুমি। আমি কি ওকে। বের করে দিয়েছি ঘর থেকে না কি ও-ই আমার খোঁজ না নিয়ে রাগ করে বেরিয়ে গেছে? আমি কি ওকে আঘাত করেছি, মেরেছি? ওর বাবা তো সেই ব্লেমটা দিল আমার ঘাড়ে।
এটাই তো ভুল বোঝাবুঝি। বিষয়টা ক্লিয়ার না করলে শ্বশুরের ভুল ভাঙবে না। মামলা করে বসতে পারেন তিনি। যে রাশভারী লোক।
তুমি বলো! আমার দায় ঠেকেনি।
দায় তোমার! তোমার বউ, তোমার কন্যা, তোমার শশুর শাশুড়ি। এসব কাজে নিজের মাকে ব্যবহার করতে নেই, বাবা। নিজের সমস্যা নিজে মেটাও। সেটাই ভালো হবে। আর শ্বশুর শাশুড়িকে সম্মান না করলে কখনও বউমার মন পাবে না।
আমার শাশুড়ি বোঝাতে পারলেন না শশুরকে? কোথায় গিঁট বুঝি না আমি? মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে সপ্তম আকাশে তুলে রেখেছেন তারা। আর তাই অল্পতেই রেগে যায়। খেপে যায়। অল্পতেই বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠে! এভাবে কি সংসার চলবে, আম্মা?
না, চলবে না। এজন্য তো বলছি বোঝার চেষ্টা করো বউমাকে। কেন সে রাগ করে বোঝো আগে। তারপর শোধরাও। সে ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি তো দেখছি সাংঘাতিক নিষ্ঠুর, আম্মা। বারবার আমাকে শোধরাতে বলছো! তাকে কিছু বলবে না।
বলব। তাকেও। সে তো তোমাকে বেশি বেশি কাছে পেতে চায়। সময় বেশি চায় তোমার। দিতে পারো? যেটুকুন সময় পাও তাও তো ল্যাপটপ, মুঠোফোন, আর কম্পিউটারে বসে থাকো। বউদের মনে আহ্লাদ থাকতে পারে না?
ছেলের উত্তেজিত স্বর শুনেও সায়েরা আমিনের গলার স্বর নরম হলো না। আর সবল ও দৃঢ়ভাবে যা বলার তাই বলে যাচ্ছেন, নিজের ছেলের পক্ষে গীত গাইছেন না দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রমিত। তারপর নজর দিল মুঠোফেনের দিকে। ভাইব্রেশন মোডে থাকায় শব্দ বেরোয়নি। চট করে তাকিয়ে দেখল কল করেছে
এক্সবুম। লাইনটা কেটে দিয়ে চুপ হয়ে গেল।
সায়েরা আমিন আবার বললেন, মুঠোফোনে যার-তার সঙ্গে কথা বলার নেশা কমাও। বউ-বাচ্চার দিকে নজর বেশি দাও। সংসারের দিকে তাকাও।
মায়ের এমন আদর্শ কথা আর সুবচন এর আগে শোনেনি প্রমিত। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাই আপন মায়ের ভেতর সে আবিষ্কার করল দৃঢ়চেতা আরেক নারীকে। যিনি টলবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। মনে হলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে ও বলল, শেষমেষ তুমিও মিতুর পক্ষ নিচ্ছো?
না। কোনোদিন না। কারও পক্ষ নেওয়া উচিত নয় কোনো শাশুড়িকে। আমি মিতুর শাশুড়ি। তেমার মা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মাকে নিউট্রাল থাকা ভালো। নইলে সজ্ঞাত আরও বাড়ে।
তুমি তো নিউট্রাল নেই, আম্মা। একদম মিতুর পাল্লায় উঠে বসে আছো। সে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাগে মুঠোফোনের সুইচ বন্ধ করে, সিএনজির গ্রিলের সঙ্গে নিজের কপালে আঘাত হেনে অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, একদম মনে করতে পারল না সে-কথা। উল্টো নিজের ছেলের দোষ ধরে ওর পাল্লায় উঠে গেলে!
মিতু যে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাগের মাথায় রডের সঙ্গে ট্রুস মেরেছে, কে বলল তোমায়?
ওর মা বলেছে।
ওর মা কি দেখেছে? টেলিফোনের অপর মাথায় বসে কি কলারকে দেখা যায়? নাকি নিজে নিজে অনুভব করেছেন?
সেটা ওর মাকে জিজ্ঞেস করো।
জিজ্ঞেস করে জেনেছি। রাগ করে মিতু মুঠোফোনের সুইচ অফ করেছে ঠিক। মাথায়-আঘাত করেনি।
এটাও ওদের একতরফা কথা। দেখলাম একটা সুদর্শন ছেলে তার দেখাশোনা করছে। বিষয়টাও আমার ভালো লাগেনি।
অফ হয়ে গেলেন সায়েরা আমিন। তার মনে পড়ে গেল
এক্সকুমর কথা। এমন কেউ কি জোগাড় করে নিয়েছে মিতুও? তৃতীয়জনের কি আগমন ঘটে গেছে? দুজনের সম্পর্কের কি পচন শুরু হয়েছে–এসব কথা ভাবতে গিয়ে মাথা তার জ্যাম হয়ে গেল।
কোথাও সমস্যা হচ্ছে না তো তোমাদের মধ্যে?
সমস্যার বাকি কী আছে আম্মা, কথায় কথায় রাগ করে ও নিজেদের বাড়িতে চলে যায়। সমস্যার কি বাকি আছে কিছু?
এসব সমস্যার সঙ্গে মান-অভিমান জড়িয়ে থাকে। তা কাটিয়ে ওটা যায়। তৃতীয়জনের আগমন ঘটলে সম্পর্ক নাশ হয়ে যায়। ভয়টা কাটিয়ে ওটা যায় না।
জানি।
তুমি শিওর? ওর জীবনে তৃতীয় কেউ এসেছে?
মনে হলো। তাই বললাম।
মনে হওয়া, বা অনুমান করে এ ধরনের ভাবনা মনে ঠাই দিতে নেই। চোরের মন পালাই পালাই করে। নিজে কোনো কিছু চুরি করলে অন্যকেও সহজে চোর মনে হয়। এসব ভাবনার আগে পরিষ্কার করে সব জেনে নেবে। নিজেকেও ঘেটে দেখবে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কি না। কথা শেষ করে সায়েরা আমিন চলে গেলেন সামনে থেকে। মায়ের ধারালো কথা শোনার পর প্রমিতের আর বলার কিছু থাকল না।
সতেরো
মায়ের সামনে লাইন কেটে দিলেও মা চলে যাওয়ার পর
এক্সবুমকে কল করার জন্য মাথা ঘুরিয়ে একবার দরজার দিকে তাকাল প্রমিত। খোলা দরজা দিয়ে মায়ের ঘর পর্যন্ত দেখা যায়। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মায়ের মুখ মলিন। মলিন মন নিয়ে তিনি এদিকে আর আসবেন না ভেবে সে কল ব্যাক করল।
কী ব্যাপার এভোয়েড করছে আমাকে? কল ধরেই কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল
এক্সবুমর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মোনালিসা।
দোষ ধরছো কেন? সবাই কথায় কথায় দোষ ধরলে কি আর বাঁচা যায়?
সবাই মানে? কে? কে?
মাও দোষ ধরে, বউও। অফিসের বসও। তুমি হচ্ছে রিলাক্স করার জায়গা। মনের বারান্দা। তুমিও ঝুল বারান্দায় বসে মনের ধুলোময় মাকড়সার জাল বুনে যাচ্ছো?
দোষ করলে তো দোষ ধরবে। না-করলে কেন দোষ ধরার প্রয়োজন হবে?
কী দোষ করলাম?
সময় দিয়েছ আমাকে? বারবার কল করি। ঠিক উত্তর দিয়েছো?
তুমি হচ্ছো লুকোচুরির সম্পর্ক। সবার সামনে কি তোমার সঙ্গে কথা বলা যায়, যাবে? বুঝতে হবে না?
বোঝার জন্যই তো বার বার কল করি। আর না-বুঝিয়ে, না উত্তর দিয়ে বার বার তুমি কেটে দাও। ছোট্ট করে মেসিজ দিয়ে রাখলেই তো পারো। বলল মোনালিসা।
পেরেশানির মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে। দিশেহারা লাগছে। এর মধ্যে মা-ও বিরুদ্ধপক্ষ হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় দোষ ধরে, আর ছেলের বউয়ের পক্ষে নেয়। এমন মার কথা তো এ জনমে শুনিনি।
মায়েরা তো সংসার কুরুক্ষেত্রে সব সময় ছেলের পক্ষ নেয়। বউয়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। তোমার মা বউয়ের পক্ষে যাচ্ছে। কেন?
জানি না। কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যান আমার দিকে তাকিয়ে।
আশ্চর্য!
আর কথা বাড়াতে পারল না। ওর ঘরে হুট করে শব্দ হওয়ায় মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল গোয়েন্দার মতো চুপিসারে মা এসে হাজির হয়েছেন আবার। এবারও লাইন কেটে মায়ের উদ্দেশে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?
বলতে এসেছিলাম, ওঠো। গোসল করো। খেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাও। রোদ্দুর আর ওর-মার খোঁজ নিয়ে এসো।
শুনলাম। তুমি যাও এখন।
যাবই তো। এসব আর তোমাকে বলতে চাই না। তোমার ইচ্ছা মতো তুমি চললা, মন যা চায় তাই-ই করো। স্বজনদের ইচ্ছা অনিচ্ছারও দাম দিতে হয়। কথাটা-ও তোমার মাথায় তুলে দেওয়ার ইচ্ছা নেই আর।
কঠিন কথা শুনে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল প্রমিত। উঠতে গিয়ে কোমরে চোট লাগল। উহ্ শব্দ করে কোমরে হাত দিয়ে ও বসে পড়ল আবার।
উহ্ শব্দটা শঙ্কার উড়াল তির ছুঁড়ে দিল সায়েরা আমিনের কানে। কথা শেষ করে দরজার বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। না গিয়ে মাতৃত্বের খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রায় চিৎকার দিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হলো? ব্যথা পেয়েছো?
মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলো না প্রমিত। কেবল মনে মনে অনুভব করল মা তো মা-ই। মায়ের মতোই আছেন। সন্তানের ব্যথা তার মনেও উৎকণ্ঠা জাগায়। সন্তানের ভালো ছাড়া মা কি আর কিছু ভাবতে পারে! ভাবনার ডালপালার আড়াল থেকেও আকাশের চাঁদ দেখা গেল। মায়ের মনও। এই মুহূর্তে মায়ের উদ্বেগ ওষুধের মতো ব্যথা উপশম করে দিলে। শান্ত, সুবোধ বালকের মতো ও এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। মা চলে গেলেন কিচেনের দিকে। ছেলের প্রিয় নাশতা তৈরি করতে মন দিলেন।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে আরেকবার চমকে উঠল প্রমিত। ভেবেছিল মা বিরুদ্ধপক্ষ হয়ে গেছেন।
এ মুহূর্তে ও টেবিলে সাজানো দেখল পরোটা, ডিমভাজা আর প্রিয় আইটেম গরু ভুনা। সঙ্গে কাঁচা লংকা, পেঁয়াজ কাটা আর একবাটি ফুলকপি ভাজি। প্রত্যেকটা আইটেমই প্রমিতের প্রিয়। খাবার সাজিয়ে তিনিও বসলেন টেবিলে। হাউজ গভর্নেস বিণা এসে প্রশ্ন করল, ভাইজান, কী চা খাবেন? গ্রিন টি না গরুর দুধ-চা?
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে প্রমিত জবাব দিল, গরুর দুধ-চা।
বিনা চলে যাওয়ার পর মা খেতে লাগলেন। নিজের প্লেটে তুলে নিলেন কফিভাজি আর ডিম পোচ। ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন গরু ভুনার বাটি। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। ঘরের আকাশে মেঘ গুডগুড করতে লাগল। হয় ঝড় আসবে, নয় বৃষ্টি, বুঝতে অসুবিধে হলো না প্রমিতের। ও নিশ্চিত হয়ে গেল মায়ের মাথায় কেবল উড়াল মেঘ নয়, দুর্ভাবনার ঝড় বইছে। এ ঝড়ের উৎস কী? বোঝার চেষ্টা না করে চুপচাপ খেতে লাগল ও। আর তখন ভাইব্রেশন মোডে রাখা মুঠোফোন সেটের ঘো ঘো আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। নিজের। ঘর থেকে।
ফোন রিসিভ করার জন্য খাওয়া ছেড়ে প্রমিত উঠে গেল নিজের ঘরের দিকে। বাঁ হাতে কানের কাছে ধরে কিছুটা ধমকের সুরে বলল, রাখো। খেতে বসেছি। তারপর সুইচ অফ করে আবার খেতে এলো টেবিলে। সায়েরা আমিন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন না কলটার ব্যাপারে। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, গ্রামীণের নম্বরটা তুলে নাও। নতুন সেটও কেনা দরকার। বাংলালিংকটা সিম ব্যবহার করছো এখন। দুটো সেট থাকা ভালো। একটা হারালে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।
প্রমিত সুবোধ ছেলের মতো বলল, তুলতে যাব। ইতিমধ্যে গ্রামীণে কল করে নম্বরটা অফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
তোমার অফিসের ঝামেলাটা কী? কী এত কাজ? সব সময় অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে আসতে হয়! কেন?
কেনর জবাব নেই আমার হাতে। এত কাজ এত অল্প সময়ে করা যায় না। বাসায় আনতে হয়। ইচ্ছাকৃত আনি না।
তা ঠিক। তবে স্ত্রীকে সময় দিতে হবে না? বাচ্চাকে সময় দাও? নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখেছো?
না। তেমন করে ভাবিনি। ভাবি ওরা তো আছেই, পাশে। আলাদা ভাবে কী সময় দেব?
কোয়ালিটি টাইম কি দাও? দিতে হবে না ওদের? সম্পর্ক কি এমনি এমনি মজবুত হয়? হয় না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে জানতে হয়।
চেষ্টা করব।
আজেবাজে সম্পর্ক আসল সম্পর্কে ফাটল ধরায়।
হ্যাঁ। জানি।
হ্যাঁ বললেই হলো? হ্যাঁর ভেতরের হ্যাঁটা খুঁজে বের করতে হবে না? যত্ন করতে হবে না হ্যাঁর অর্থটা?
হ্যাঁ। হবে।
যাও। খেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাও। সপ্তাহ খানেক ছুটি নাও। ওদের সঙ্গে থাকো।
যাব। থাকব।
সহজে ছেলে রাজি হয়ে গেল দেখে মায়ের মনও খুশি হয়ে গেল। খুশি মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল উপদেশ আর উপদেশ। প্রতিটা কথা মাথায় তুলে নিল প্রমিত।
আঠার
শশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হলেও যাত্রপথ ঘুরিয়ে আলি আকবর স্যারের বাসায় ঢুকল প্রমিত। তিনিও বের হচ্ছিলেন। বাড়ির গেট পেরিয়ে প্রমিতকে ঢুকতে দেখে বারান্দায় থমকে গেলেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন ওর ভেতরটা। ওর পায়ের চাপে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে দেখলেন বেদনার চিহ্ন। শীতের কোমল রোদের মাঝেও ওর মুখে মেখে আছে চৈত্রের ধুলো। স্যারকে প্রথমে দেখতে পায়নি প্রমিত। হঠাৎ নজর গেল তার ওপর। কাছে গিয়ে টুপ করে বসে পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, আপনার কাছেই এলাম, স্যার।
কোনো দুঃসংবাদ?
কষ্ট না পেলে কি আপনার কাছে আসি, স্যার!
শোনো, প্রমিত। অন্তরে সিঁধ কেটে কেবল চোর ঢোকে না, চুরি করে নিয়ে যায় না সব। দিয়েও যায়–কিছু কষ্ট আর চোখের জল। বিষাদ তখন জমে যায়। মুখেও তা ভেসে ওঠে। যেমন ফুটেছে তোমার মুখে।
কঠিন কথা, স্যার। সহজ করে বলুন।
সিধটাকে ঠিক করে নাও। বাকিটা এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
সিঁধ কে কেটেছে, স্যার?
নিজের অন্তরের সিঁধ নিজেই কাটি। নিজেই সব চুরি হওয়ার পথ তৈরি করে দিই আমরাই।
আজকে দার্শনিকের মতো কথা বলছেন। এসব দর্শনতত্ত্ব ভালো লাগছে না।
শোনো, নিজে কি ভুল করেছে, সেটা আগে ধরো। ভুল-সিধ ধরতে না পারলে ছারখার হয়ে যায় জীবন। অন্যের দোষ খুঁজতে যেয়ো না। নিজের দোষটা ধরো।
আম্মাও একথা বলেছেন। আপনিও। এখন বলছেন, আগেও বলেছেন। মুরব্বি হিসেবে উপদেশ দেওয়া ছাড়া আর কিছু বলতে জানেন না?
মুরব্বিরা হলেন জীবনঝড় পেরিয়ে আসা বটবৃক্ষ। শেকড়ে কী বেদনা কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তা তারা জানেন। তাদের জানাটাও জানিয়ে যেতে হবে নতুন গজানো শেকড়কে। নইলে ঝড় এলে নতুন শেকড় টুটে যেতে পারে। মাটিহীন শূন্যতায় ঝুলে যেতে পারে। রসকষহীন মাটি থেকে রসদ নিতে ব্যর্থ হবে। সেই ব্যর্থতার দায়ভার বটবৃক্ষের কাণ্ডেও প্রভাব ফেলে।
মিতু তো আমার সঙ্গে হিংস্র আচরণ করে।
শোনো, প্রমিত, মন দিয়ে শোনো, হিংস্রতার আড়ালে ওত পেতে থাকতে পারে কোমলতা। সেটা কি দেখনি কখনও?
না। স্যারের কথার জবাব দিতে ইচ্ছা হলো না। নিজে থেকে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, এসব আদর্শ কথা দিয়ে জীবন চলে না। ওর হিংস্র আচরণের ভেতর থেকে আগুন ঝলসে ওঠে। আমি জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি আগুনে। আর আপনি কেবল উপদেশ বাণী ঝেড়ে সমস্যা মেটাতে চান। আমি আর আসব না আপনার কাছে।
আগুনটা স্থির হতে দাও। দেখবে আগুনের তলে লুকিয়ে আছে। বরফ শীতল নদী। সে নদীর স্রোতটাকে চেনার চেষ্টা করো। দুজনই। এ কথা শুনে এবার অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাল প্রমিত। স্যারের পেছনে দাঁড়ানো ম্যামের ওপর চোখ গেল তার। তিনিও শুনছিলেন জীবন-সঙ্গীর কথা। প্রমিতের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পর এগিয়ে এসে তিনি বললেন, শোনো বাবা, বড়ো বড়ো কথা শিক্ষক হিসেবে বলা যায়। স্বামী হিসেবে বলা যায় না। স্ত্রী হিসেবেও না। বড়োদের পরামর্শ নেবে, ঠিক আছে। সেই পরামর্শটা নিজের বোধ দিয়ে মেপে দেখতে হয়। বিচার করতে হয়। তারপর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে হয়। অন্যের দয়ায় নয়। নিজেকে নিজেই দয়া দেখাতে হয়।
চমকে গেল প্রমিত। প্রাণে টুস মারা কথা ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিল। এ সময় কম্পন উঠল পকেটে রাখা মুঠোফোনে। কল করেছে এক্সবুম, মোনালিসা।
লাইনটা কেটে আবার তাকাল ম্যামের মুখ পানে।
স্বামীর উদ্দেশে উনি বললেন, ছেলেটাকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখবেন? বসতে বলবেন না?
বসবে, প্রমিত?
না, স্যার। আজ আর বসব না।
আচ্ছা, তাহলে চলো, আমিও বাইরে যাচ্ছি। একসঙ্গে বের হই।
সেকি! ওকে কিছু খেতে দিব না?
স্ত্রীর কথা শুনে আলি আকবর স্যার বললেন, ওর ভেতর আগুন জ্বলছে। অস্ট্রেলিয়ার ঘনবনে লাগা দাবানলের চেয়েও বড়ো আগুন জ্বলছে। ওর দহনবেলায় ওকে পুড়তে দাও। ওর ধোঁয়া ওকে দেখতে দাও। জ্বলন্ত আগুনের অগ্রভাগ থেকে ছড়িয়ে যাওয়া সাদা ধোয়া একদিন বরফ দিবে ওকে। কষ্টকে তখন বরণ করতে পারবে, আগুনকেও হ্যাঁ বলতে শিখবে ও।
প্রমিত আবারও চমকে উঠল। মুঠোফোনে আবারও ভাইব্রেশন হচ্ছে। মোনালিসা ডাকছে। হাত বেয়ে মুঠোফোনের কম্পন উঠতে লাগল উপরে। ছড়িয়ে যেতে লাগল মস্তিষ্কে, দেহজুড়ে। তাপ বাড়ছে দেহের। মুঠোফোনের তাপে নিভে যাচ্ছে আবেগক্ষরিত কষ্টের আগুন। কোন্ আগুন তেজস্বী। কোন্ আগুন বেশি জ্বালায়, বেশি পোড়ায়। কোন্ আগুনের অগ্রভাগের ধোঁয়াকে হ্যাঁ বলতে হবে, জানে না ও। দ্বৈত আগুনের শিখা তাকে পোড়াতেই লাগল।
না। প্রমিত যেয়ো না তুমি। বসো। ঝালমুড়ি আর চা খেয়ে যাও। বললেন ম্যাম।
কথাটা শুনে থমকে গেলেন আলি আকবর স্যার। সামনে না বাড়িয়ে পেছন ফিরে এলেন। বারান্দায় রাখা মোড়া টেনে একটাতে নিজে বসলেন, অন্যটাতে বসতে বললেন প্রমিতকে।
ভেতরে চলে গেছেন ম্যাম। কিছুক্ষণ পর ঝালমুড়ি নিয়ে এলেন। দুই বাটি, চামচসহ, দুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চা আনতে গেলেন ভিতরে।
স্যার বললেন, বার বার তোমার মুঠোফোনে ভাইব্রেশন হচ্ছে। কেটেও দিচ্ছো তুমি। কে ফোন করছে? ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয় জেনেও জিজ্ঞেস করলাম।
একদম ভেতর থেকে চমকে উঠল প্রমিত। তো তো করে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইল।
মিতু করেছে? তোমার কন্যা রোদ্দুর?
না। সরাসরি প্রশ্ন না এড়িয়ে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল প্রমিত।
সত্য বলেছো। ভালো লাগছে। কিছু সত্য আছে অন্তরের সিধটাকে ধরিয়ে দিতে পারে। ওটা ধরো। ওটা বন্ধ করো। রোদ্দুর আর মিতুর কাছে যাও।
যাব। বিতর্ক না করে সরাসরি জবাব দিল প্রমিত।
চা এসে গেছে। দুধ-চা। গরম ধোঁয়া উঠছে কাপ থেকে। প্লেটটা হাতে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আবার কেঁপে কেঁপে উঠল মুঠোফোন।
ঝপ করে কাপটা পড়ে গেল হাত থেকে। চা ছড়িয়ে গেল চারপাশে। কিছুটা পড়েছে প্যান্টে। কালো প্যান্টের দাগ বাইরে থেকে দেখা গেল না। অথচ দাগটা বসে গেল কালোর আড়ালে। একবার সেদিকে তাকাল প্রমিত।
কালোর গভীরে বসে যাওয়া দুষ্টু দাগটা দেখা যাবে না। দেখে লাভ নেই। বললেন স্যার।
না। লাভ নেই কে বলল। গ্লাস থেকে একটু পানি ঢেলে জায়গাটা তাড়াতাড়ি ভিজিয়ে দাও। দাগ বসার সুযোগ পাবে না। হালকা হয়ে যাবে। বললেন ম্যাম।
প্রমিত গ্লাস হাতে নিয়ে দাগটা বার বার পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিল। তারপর স্বস্তি নিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন, ম্যাম।
জীবনটাও এরকম, প্রমিত। কালের আড়ালে জীবনেও দাগ বসে যেতে পারে। নোংরা সংক্রমণে দাগ আঁটোসাঁটো বসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতও তৈরি করে। জীবন থেকে দুর্গন্ধ বের করে তা ছড়িয়েও দিতে পারে। জীবনের এসব ঘটনায়ও দ্রুত পানি ঢালতে হয়।
ঠিক বলেছেন, স্যার।
দেরি হলে অনেক দাগ আর ওঠে না। শোধরানো যায় না বহু বড়ো দাগ। ছোট দাগও তছনছ করে দিতে পারে জীবন।
স্যার, সব কিছুর ভেতর থেকে অপনি আদর্শ কথা, দর্শন টেনে বের করেন। তবে এ কথাটা ভালো লেগেছে এ কথাটাকে অবশ্যই
হ্যাঁ বলব আমি।
উনিশ
শ্বশুরবাড়িতে যেতে যে মায়া আর আদরের টান থাকে, উভয় পক্ষের, তার ঘাটতি টের পেতে লাগল প্রমিত। নিজের কোনো তাগিদ নেই। তারপরও বাসায় ঢুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছে বাসায় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সে অনুষ্ঠানের খবর জানতো না ও। অনাহূতের মতো ঘরে ঢোকার সঙ্গে দেখল বসে আছে আলম। কথা বলছে মিতু। ওকে সুস্থ আর স্বাভাবিক মনে হলো।
প্রমিতকে বসার ঘরে ঢুকতে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলম সুন্দরভাবে সম্বোধন করে বলল, আসোলামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম বলে দাঁড়িয়ে রইল প্রমিত। চট করে উঠে দাঁড়াল মিতু। ওর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না। ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। মিতু ভালো আছে দেখে ভালো লাগল। ও হাঁটছে। উঠে যাওয়ার মধ্যে আগের মতো ক্রুদ্ধতা দেখল না। ওর আসাটা কি অপছন্দ করল সে? কথা না বলে এভাবে উঠে গেল কেন?
আলম বলল, ভালো আছেন?
ভালো। আপনি যা করেছেন, বিপদের সময় যেভাবে মিতুর পাশে ছিলেন, তার তুলনা চলে না।
প্রশংসা শুনে লাজুকভাবে বসে রইল আলম। তার বসে থাকার মধ্যে আছে সংকোচ, আছে শিষ্টতা। টের পেল প্রমিত। তবুও মনে প্রশ্ন উড়ে এলো
ও আসলেই সিএনজি চালক নাকি সিএনজিতে মিতুর সহযাত্রী ছিল। কী সম্পর্ক ওদের। ছেলেটা সুদর্শন। আভিজাত্যের ছাপ না থাকলেও তার মধ্যে আলদা কিছু একটা আছে, ভাবতে ভাবতে ভাবনার চোরা সিঁধ দিয়ে মাথায় ঢুকে গেল, ওর জীবনের এক্সবুমর মতো মিতুর কেউ নয় তো ছেলেটা!
কঠিন যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠতে লাগল ওর পুরো শরীর। ভাবনাটা তাড়াতে চাইলেও পারল না। কালো জোকের মতো তা আমূল ঢুকে যাচ্ছে মগজের ভেতর। মস্তিষ্ক আলোময় হচ্ছে না। বরং ও অনুভব করছে আদিম মোমের তাপে গলে যাওয়ার মতো গলে গেছে মিতু। সেই উত্তাপে সুস্থতা ফিরে পেয়েছে মিতু। অহমিকা পুড়ে যেতে লাগল। ধোঁয়াহীন তাপে ও মিশে যেতে লাগল শূন্যে। নিজে নিজে খুঁড়ে তোলা সিঁধ দিয়ে বিষধর সাপ ঢুকে যাচ্ছে অনবরত। টের পেয়েও তা ঠেকানোর চেষ্টা করল না। বরং খুউব খুশি হয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ওই দিন সিটি স্ক্যানের পেমেন্টটা তো আপনিই জমা দিয়ে রশিদ কেটেছিলেন। টাকাটা কি ফেরত পেয়েছিলেন, আলম সাহেব?
আপনার শ্বশুর সেটা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। আমি নেইনি।
আপনার মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ।
আর কথা বাড়ানো গেল না। রোদ্দুর ছুটে এসেছে ভেতরের ঘর থেকে। বাপির গলা জড়িয়ে ধরে কোলে বসে গেল সে। সমান উচ্ছ্বাসে প্রমিত সাড়া দিতে পরল না এ মুহূর্তে। মেয়ে কোলে এসে ঢুকলে যে শান্তি পেত, অন্তর জুড়ে যে রোদ ছড়িয়ে যেত, সেরকম কিছু ঘটল না। বরং মনে হলো কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আচমকা পুরো আকাশ। নিজের ভেতেরের অন্ধকূপটা আরও আরও আঁধারে ঢেকে যেতে লাগল।
রোদ্দুর বলল, আমরা এ বাড়িতে থাকব। আর ওই যে, ওই স্কুলে আমাকে ভর্তি করাবে মাম্মি। বলেছেন নানাভাই।
কথা বলে ও দরজা খুলে দেখিয়ে দিল বাড়ির সামনে বড়ো মাঠটা। মাঠের ওপাশে একটা স্কুলের সাইনবোর্ড ঝুলছে।
ওর আঙুল অনুসরণ করে প্রমিতও দেখল স্কুলটি। এর আগেও দেখেছে। এখন মনে হলো নতুন করে দেখছে। মনে হলো এখানে কোনো কালে স্কুল ছিল না। নতুন করে গজিয়ে ওঠা স্কুলটাকে ওর শত্রু মনে হওয়ায় চুপ মেরে গেল।
তুমি কি আমাদের সঙ্গে থাকবে, বাপি?
কী উত্তর দিবে। উত্তর না হলে কষ্ট পাবে রোদ্দুর। হ্যাঁ হলে পাবে মিতু আর নিজের মা। নিজের মধ্যে কী জাগবে? কষ্ট না দ্বন্দ্ব? না কি হতাশা-বিষাদ?
কোনো উত্তর নিয়ে ভাবতে চাইল না। তবে বলল, আমি যেখানে থাকব, সেখানে তুমি নিরাপদ থাকবে, যদি থাকো আমার সঙ্গে। মনে রেখো, বাবা মানে একটা নিরাপদ আশ্রয়।
কথার ভেতরের কথাটা ধরতে পারল না রোদ্দুর। খুশি হয়ে বাপির শরীরের সঙ্গে আরও সেঁটে থেকে বলল, তোমার আম্মাকেও নিয়ে এসো।
কোথায়?
এ বাড়িতে! দাদুভাই একা থাকলে কষ্ট পাবে না!
মেয়ের সরল প্রশ্ন শুনে আরেকবার নড়ে উঠল প্রমিত। ওর মাকে একা রাখার প্রশ্নই আসে না। তবু মেয়ের মন ভাঙতে চাইল না। যা ভাবছে সে, ভাবুক। তার সরলতা দিয়েই সে ভাবছে। তবু ফাঁকে বলল, বাপ্পি কে ছাড়া থাকলে তোমার কষ্ট হবে না?
মুখে জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে কেঁদে ফেলল রোদ্দুর। তারপর উঠে ছুট দিল ভেতরের ঘরের দিকে। প্রমিত স্তব্ধ হয়ে গেল। আলম আরও বিব্রত হয়ে চুপসে গেল।
এ সময় ভাইব্রেশন মোড় থেকে মুঠোফোনের সিগন্যাল আসতে লাগল। এক্সবুম মোনালিসা!
লাইন কেটে দিলেও গলতে থাকা মমতার মোমপোড়া ধোঁয়া বন্ধ হয়ে গেল। মেয়ের স্নেহের ধারাটা সরে গেল ভিন্ন খাতে! আলমের উপস্থিতিটা আবারও মগজে ঢুকিয়ে দিল বিষজ্বালা। মিতুর এক্সবুম কি আলম?
ভেতরের কোলাহল থেমে গেল না। দুর্ভাবনার গর্জন এক্সবুম থেকে স্থান পেল আবার মিতুর ক্রোধের ওপর। সব দোষ মিতুর। হুটহাট বাবার বাড়িতে চলে এলে মেয়েদের মন বসে না শ্বশুরবাড়িতে। মন টেকে না। আর তখনই স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির কেবল বাজে দিকগুলো দেখতে থাকে তারা, সুন্দর বিষয় আমলেই আনে না। শোনা
এসব কথা এখন সত্যি মনে হচ্ছে। আর এই কঠিন সত্যেটা আঘাত হানে শিশুমনে। দেখতেই পাচ্ছে ও। বাবাকেও সঙ্গে রাখতে চায় রোদ্দুর! মার সঙ্গে তো থাকবেই, বাবার সঙ্গেও।
আলি আশরাফ চৌধুরী তার মেয়েকে প্রটেকশন করতে গিয়ে রোদ্দুরকে ছিনিয়ে নিতে চায় তার বাবার কোল থেকে। এ অধিকার কে ওনাকে দিয়েছে! এসব ভাবতে গিয়ে রোষ, ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। সে মনোভাবের মধ্য থেকে, হুঁশ করে প্রশ্ন ভেসে এলো, আলম সাহেব, কে আপনাকে নিমন্ত্রণ করেছে আজ?
মিতু আপা। সহজ সরর উক্তি আলমের।
দ্বিতীয় আর প্রশ্ন না করে থেমে গেল প্রমিত। মনে হলো ধীরে ধীরে সীমা লঙ্ঘন করছে মিতু। এক সময় হয়ত সে পেরিয়ে যাবে নো পয়েন্ট অব রিটার্ন। বিষয়টাকে হালকা করে দেখার উপায় নেই। সিরিয়াসলিই দেখতে হবে। ক্ষুব্ধ মনের ধোঁয়াশা ভেদ করে কোনো সিদ্ধান্ত বের হচ্ছে না। ধোঁয়া আর আগুন তাপে পুড়ে যেতে লাগল প্রমিত।
বউয়ের অশোভন আচরণের কারণে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে। কন্যার টানে বসে থাকতে চাচ্ছে মন। আকর্ষণ-বিকর্ষণ দ্বন্দ্বের ছোবল বসে গেল মনে।
আপা তো অসুস্থ, পুরোপুরি সুস্থ হননি। তার ওপর রাগ না করে কন্যার মন জোগান।
কথাটা মনে ধরেছে প্রমিতের। বউয়ের এ অশোভন আচরণটা উপেক্ষা করে কন্যার মনে দাবি পূরণটাকে গুরুত্ব দিতে হবে ভেবে বসে রইল ও।
আলম বলল, রাগ কমে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই দিন আপনার শ্বশুর সাহেব না বুঝে প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিলেন।
এ কথার উত্তর না দিয়ে আলমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল প্রমিত। না-বুঝে দুশব্দের বাক্যটাও মিশাইল ছুঁড়ে দিল প্রমিতের মনে। প্রমিতের ক্ষতে মলম লেপে দিল মিশালইটি। একই মিশাইল এক পক্ষের জন্য উপকারী হলেও অন্যের জন্য ধ্বংসের কারণ হতে পারে। এতসব ভালো চিন্তার মধ্যে আবার বিষধর ছোবল খেল প্রমিত। ওর মনে চিন্তা উড়ে এসে জুড়ে বসল : আমার পক্ষ নেওয়ার কারণ কি! আমাকে জয় করে স্ত্রীর সঙ্গে গোপনে নৈকট্য পাওয়া?
হা হা করে উঠল ভেতরের মন। আর সঙ্গে সঙ্গে তখন দেহে শিথিলতা জেগে উঠল, চারপাশেও।
নিজের কোষে কোষে ভাঙনের ধ্বনি ছড়িয়ে দিতে লাগল শোকের আর্তনাদ। ধ্বনি বাইরে প্রতিধ্বনিত হলো না। কেবল অনিবার্য হয়ে ওঠা শোক মুখে আসন নিল ছায়ারূপে। মুখোশের আবরণের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো, আপনার বাসা কোথায়?
ওই যে পাশের পাড়াতে থাকি আমি।
কে আছে সঙ্গে?
কেউ নেই। একা থাকি।
তিরন্দাজের সুচালো তির আবার ঢুকে গেল বা পাঁজর ভেদ করে। কতদূর গেল, কোন্ ঠিকানা বিদ্ধ করল তা, এ মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারল না প্রমিত।
আবার ভাইব্রেশন হচ্ছে। মুঠোফোন ডান মুঠিতে ধরা ছিল। চোখ গেল স্ক্রিনে। ওর মা ফোন করছেন।
বলল, আম্মা।
কোথায়, তুমি?
ওই বাড়িতে। শশুরবাড়ি শব্দটা এড়িয়ে প্রমিত জবাব দিল।
রোদ্দুর আছে পাশে? বউমা?
ওরা ভেতরের ঘরে।
তাহলে তুমি কোথায়?
বসার ঘরে।
কী করছ?
কথা বলছি।
কার সঙ্গে?
মিতুর সুহৃদ, আলম সাহেবের সঙ্গে। ওনাকে আজ এ বাসায় দাওয়াত দিয়েছে মিতু।
ঝিমঝিম করে উঠল সায়েরা আমিনের মাথা। কানেও সোঁ সোঁ আওয়াজ ঢুকতে লাগল চারপাশ থেকে। থরথর করে কেঁপে ওঠল তার হাত। কথা বা প্রশ্ন বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে। চুপ হয়ে আছেন বুঝে প্রমিত বলল, রাখি।
লাইন কেটে প্রমিত আবার ঘুরে তাকাল আলমের দিকে। মার প্রতিটা প্রশ্নর সত্য উত্তর দিতে হয়েছে। আলম বাসায় না থাকলে কয়েকটা কথার মিথ্যা জবাব দেওয়া যেত। মায়ের মনে অযথা আঘাত হানতে চায়নি সে কিন্তু দিয়ে ফেলেছে। আলমকে নিমন্ত্রণ করার বিষয়টা নিশ্চিত মায়ের মনে কুড়ালের ঘা মেরেছে। এই বয়সী মানুষ এত বড় ধাক্কা সইবার ক্ষমতা কম রাখতে পারে এসব কথা মাথায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবার কলব্যাক করল মাকে। মা কল রিসিভ করল না। প্রথম পালসটায় সাড়া না পেয়ে একটু পর আবার কল করল ও। সামনে বসা আলমের কথা ভুলে গেল। মায়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। আবারও সাড়া পেল না। আবার কল করল প্রমিত। না, সাড়া নেই। ঘামতে শুরু করল পুরো শরীর। সোয়েটারটা খুলে এবার কল করল হাউজ গভর্ন্যান্স বিণার নম্বরে।
কী, ভাইজান?
আম্মা কোথায়? তিনবার কল করেছি। ফোন ধরেননি!
আচ্ছা। দেখছি। এ ঘর ও ঘর খুঁজে এসে বিণা বলল, খালাম্মা গোসলে ঢুকেছে। ফোনডা খাটেই আছে।
আচ্ছা। শান্তি নিয়ে আরও বলল, গোসল থেকে বেরোলে বলো আমাকে কল করতে।
লাইন কেটে চুপচাপ বসে আছে প্রমিত। ভেতরটা আনচান করছে বললে ভুল হবে; উথাল-পাতাল করছে।
ভাইয়া, আপনাকে অস্থির লাগছে! মলিন লাগছে।
আগেরবার আলম সম্বোধন করেছিল ভাইজান বলে। এবার ভাইয়া বলল। ভাইজান থেকে ভাইয়াতে নামতে চায় কেন? ঘনিষ্ঠ হতে চায়?
ভাইজানের সঙ্গে শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকে। দূরত্বও। আর ভাইয়ার সঙ্গে ঘরোয়া সম্পর্ক। ঘরে সিঁধ কাটতে চায় সে? গোপনে নয়, প্রকাশ্যে? আলি আকবর স্যারের কথা মনে পড়ছে। তার কথা মানতে পারছে না প্রমিত। স্যার বলেছিলেন, নিজের অন্তরে সিঁধ নিজেই কাটি। নিজেই সব চুরি হওয়ার পথ তৈরি করে দিই আমরাই। না। সব সিধ নিজেরা কাটি না। অন্যেরাও কাটে। অন্যে চুরি করে নিয়ে যায় না সব। দিয়েও যায় কিছু কষ্ট আর চোখের জল। জল নয় কেবল মলিন বিষাদেও ঢেকে যায় মন। সেই বিষাদ কি দেখে ফেলেছে আলম? পেরেছে নিশ্চয়। ধূর্ত লোকেরা সাদামাটা মানুষের ভেতরটা দেখে ফেলতে পারে। ভাবতে ভাবতে ও উঠে দাঁড়াল। বাসায় যাওয়ার জন্য ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল, এ সময় মায়ের সঙ্গে থাকাটাই জরুরি। নিজের কন্যাকেও কাঁদিয়ে রেখে যেতে চায় না ও। দুই ভাবনা থেকে ভেতরে ঘরের দিকে গিয়ে দেখে রোদ্দুর নেই ওই ঘরে। পড়ার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল পড়ার টেবিলে রোদ্দুরকে বসিয়ে রেখেছে। ওর সামনে বই ভোলা। পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে আছে মিতু। মুখের শক্ত পেশি বলে দিচ্ছে কঠিন প্রতিযোগিতা টপকাতে সে মেয়ের মাথার ওপর খড়গ ঝুলিয়ে দিয়েছে। আরেকটা কারণও হতে পারে–বাবা থেকে কন্যাকে আড়াল রাখা। ও আসার আগে তো ওরা পড়ার টেবিলে ছিল না, আলমের সঙ্গেই আড্ডা দিচ্ছিল মিতু। এখন পড়ানোর জন্য এত সিরিয়াস হয়ে গেল কেন?
ভাবতে ভাবতে মেয়ের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল প্রমিত। ছলছল চোখে রোদ্দুর তাকাল বাপির মুখের দিকে। মেয়ের চোখের ভেতর থেকে ছুটে এলো অদ্ভুত এক শক্তি। মায়ার ঘূর্ণি উঠল বুকে। ওই চোখ আকুল হয়ে বলছে, বাপি। তুমি যেয়ো না। থাকো আমার সঙ্গে।
মেয়ের অনুভব মাথায় নিয়ে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ও তাকাল মিতুর মুখের দিকে। ওই মুখ থেকে ঝরতে দেখল ঘৃণা আর বিদ্বেষের আগুন। এই আগুন যেন অস্ট্রেলিয়ার ঘন বনে লাগা আগুনের শক্তির চেয়ে বেশি বেপরোয়া শক্তি। পুড়িয়ে দিচ্ছে জীবন, যৌবন, সংসার।