হ্যাঁ-ভূত, না-ভূত – চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
বেলা দশটার সময় রান্নাঘরের দরজার সামনে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে কিটান। বিছানা থেকে উঠেই সটান চলে এসেছে ও এখানে। চুল উশকোখুশকো, জামাটা কোঁচকানো, পায়ে ঘরে—পরার স্যান্ডালটাও গলাতে ভুলে গেছে।
মার এখন খুব তাড়া। যদিও ভাল্লু—কিটান দুজনেরই গরমের ছুটি চলছে তবু বাবার তো আর সামার ভেকেশন নেই। ফলে বাবার অফিসের ভাত, টিফিন সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে ‘মশলাটা ভালো করে বাটো’, ‘ঘরের কোণে আজও ধুলো রয়ে গেল’ এইসব টুকটাক কাজের কথাও বলতে হচ্ছে আরতিদিকে। আর ওদের, দু—ভাইবোনের ঘুম ভাঙলেই তো কোনোমতে চোখ ধুয়ে, দাঁত মেজে রাজ্যের খিদে নিয়ে ডাইনিংটেবলে এসে বসবে। ছুটির দিন বলে কথা, বায়নার কি শেষ আছে! আজ আলুপরোটা, তো কাল চাওমিন, পরশু স্যান্ডউইচ…পরোটাটা উলটে দিয়ে মা এপাশ ফিরতেই কিটানকে দেখতে পেলেন। ‘কীরে, অমন চোরের মতো মুখ করে ঘুম ভাঙতেই এসে দাঁড়ালি কেন? কিছু চাই? ভাল্লুর সঙ্গে ঝগড়া করলি বুঝি সকাল—সকাল?’ কিটান তীক্ষ্ন, সরু গলায় জানতে চায়, ‘মা, তুমি ভোরবেলা আমার ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলে?’ প্রশ্নটা করতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে গেল ওর।
আসলে হয়েছে কী, গরমের ছুটি শুরু হতেই কিটানও একা ঘরে শোয়া শুরু করেছে। ভাল্লু তো অনেকদিনই ওর ঘরে একা শোয়, কিন্তু কিটান মা—র পাশ ছেড়ে ঘুমোতে পারত না। যদিও ওর ক্লাসের অনেক মেয়েই একা—একা শোয়। বাবা অমরেশবাবু অবশ্য একটু আপত্তি করছিলেন প্রথমটায়, ‘একা একা মেয়েটা ভয় পায় যদি!’ কিন্তু মা বললেন, ‘না, না! এখন থেকে একা শোয়া প্র্যাকটিস না করলে চলবে কেন? বড়ো হচ্ছে, মনের জোর বাড়াতে হবে না?’ তা, মনের জোর বাড়াতে আপত্তি নেই কিটানের। ভাল্লু সারাক্ষণ ‘ভিতু! ভিতু!’ বলে খেপায়। মাত্র দু—বছরের বড়ো দাদার দাদাগিরি একদম সহ্য হয় না ওর। এদিকে আবার দাদাকে ছাড়া চলেও না। সে যাইহোক, একা শোয়া ভালো এইজন্য যে, অনেক রাত অবধি জেগে গল্পের বই পড়তে পারে ও। তা ছাড়া একা শুতে রাজি হয়েছে ও কিছুটা ভাল্লুর সঙ্গে রেষারেষি করেও। কিন্তু মা—র সঙ্গে শর্তও করে নিয়েছে একটা, সারা রাত আলো জ্বলে থাকবে ঘরে। মা প্রথমদিকটায় এই শর্ত নিয়ে একটু খুঁতখুঁত করে, পারমিশন দিয়েছেন শেষে। তো, সেটা নিয়েই ঝামেলা বেধেছে আজ। রোজই আলো জ্বেলে রেখে ঘুমোয়, তারপর ভোরবেলা ঘুমটা ভাঙলে টলতে টলতে কোনোমতে আলো নিবিয়ে আবার বিছানায় ধপাশ। কিন্তু আজ পাঁচটার সময় ঘুম ভাঙার পর আলো নেভাতে গিয়েই ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকের ভেতরটা। ওমা! আলো জ্বলছে না তো! যাইহোক বাথরুম সেরে বিছানায় শুয়ে ভয়ে ঘুম আসছিল না কিছুক্ষণ। কে নেভাতে পারে আলো, এই প্রশ্নটাই মাথার মধ্যে আনাগোনা করছিল বারবার। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠেই ছুটে এসেছে তাই মা—র কাছে। ভাল্লুদাদা খিক খিক করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার মতো, বলল, ‘তোর যখন এতই ভয়, একা শোয়ার সাহস দেখাতে যাস কেন?’ কিটান ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাল্লুর ওপর। ওদের মারামারি ছাড়াতে গিয়ে মা হাঁফিয়ে উঠলেন, চাটুতে পরোটাও পুড়ে গেল। আরতিদি গালে হাত দিয়ে বলল, ‘মনে হয় তোমার ঘরে রাতের বেলা তেনারা কেউ এসেছিল কিটান দিদিমণি’। মা ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে তাড়াতাড়ি কিটানকে বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, নানি—ই এসেছিলেন তোর ঘরে আলো নেভাতে। দেখতিস—ই তো, কাজ না থাকলেও ঘরে আলো—পাখা জ্বালিয়ে রাখলে মা কত রাগ করতেন!’ কিটানের মুখটা মুহূর্তের মধ্যে ঝলমল করে উঠল। আরে, তাই তো! নানি মারা গেছেন বছরখানেক হল। খুব ভালোবাসতেন কিটানকে। শাসনও করতেন অবশ্য। কিন্তু, জন্ম থেকে নানির আঁচল ধরে—ধরেই বলতে গেলে এই এতটা বড়ো হল কিটান! এবার আর একটুও ভয় লাগছে না কিটানের! ও ঘরে এসে, খাটে বসে—বসে পা দোলাতে লাগল খুশিমনে। গল্পটা কিন্তু এখানে শেষ নয়। বরং, তোমরা বলতে পারো যে, গল্পের শুরু—ই এই এখান থেকে!
পরদিন স্কুল। কিটান আর ভাল্লু তো স্কুলের বাসে চেপে বসেছে। নামার সময় যে যার মতো দুপদাপ করতে করতে নেমে পড়ে, যদিও মা বাসে ওঠার সময় পইপই করে ভাল্লুকে বলে দেন, ‘বোনকে ফেলে আগে নেমে যেয়ো না যেন।’ কিন্তু ভাল্লু কোনোদিনই সেটা খেয়াল না রেখে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে—করতে নেমে যায়। ভাল্লুদাদার সঙ্গে ঝগড়া হয় যখন, এইতো পরশুদিন—ই কিটানকে যখন ও কিছুতেই কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখতে দিচ্ছিল না তখন কিটানের মাথায় অ্যায়সা রাগ উঠে গেছিল যে ও মাকে প্রায় বলে ফেলছিল আর কী, যে ভাল্লুদাদা বাস থেকে নামার সময় নিজেই আগেভাগে নেমে যায় রোজ। শেষে, দাদার ওপর মায়া হওয়ায় সেটা বলে দেয়নি আর। তো, সেদিনও ভাল্লু বাস থেকে তড়বড় করে নেমে গেছে, কিটান বাসের সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে আর অমনি পেছন থেকে কী যেন বলে উঠেছে বিনু। আর, ও অন্যমনস্কভাবে সেটা শুনতে—শুনতে পা বাড়াতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। নাকমুখ সিমেন্ট বাঁধানো মেঝেয় থেঁতলে যেত নির্ঘাত, কিন্তু ওর মনে হল মুহূর্তের মধ্যে কে যেন ওকে শক্ত হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল মাটিতে। চমকে গেছিল কিটান। তখনই ভাবল, ‘নানি নয় তো?’ কিটান এখন বেশ বুঝতে পারে নানি ওর সঙ্গে—সঙ্গে আছেন। এই তো পরশুদিন, অঙ্ক পরীক্ষার শেষে খাতা জমা দিয়ে ফেলতে যাবে, হঠাৎ কেমন মনে হল, ৩ নম্বর অঙ্কটা একটু রিভাইস করে দেখি। ব্যাস, যা ভেবেছে তাই, ১৪—তে ৪—এর আগে ১ বসাতে ভুলে গেছে ও। যা বরাবর হয়ে আসছে। যাকে বাবা বলেন, কেয়ারলেস মিসটেক। এটাও নানি—ই করে দিয়েছে, কিটান জানে। ও শুনেছে, নানি খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলেন। এর মধ্যে কবে যেন স্কুল থেকে ফিরে সন্ধে হওয়ার আগে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারম খেলতে বসেছে কিটান, রেডটাকে টার্গেট করে স্ট্রাইকার মেরেই ও বুঝতে পারল, কোনো চান্স নেই, কারণ রেড বসে আছে খুব বেয়াড়া জায়গায়, কিন্তু টুপ করে সেটা ঢুকে গেল পকেটে। বন্ধুরা অবাক। কিন্তু নানি যে দারুণ ক্যারম খেলতেন সে তো কিটানের নিজের চোখেই দেখা।
এসব কথা এতদিন কাউকে বলেনি ও। ভাল্লুদাদাকে তো নয়—ই। বললে ও এমন খেপাতে শুরু করবে যে কিটানের চোখের জল বার করে ছেড়ে দেবে একেবারে।
কিন্তু সব হিসেব গোলমাল করে দিলেন তীর্থঙ্কর স্যার। কিটানদের স্কুলের ফিজিক্যাল সায়েন্সের নতুন টিচার। দু—দিনেই ওঁর সঙ্গে বেদম ভাব জমে গেল কিটানের। ও প্রায় তীর্থঙ্কর স্যারের পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে পোষা বেড়ালের মতো। বিজ্ঞানের কত নতুন আবিষ্কারের কথা, কুসংস্কার মুক্ত হওয়ার কথা, এসব ওঁর মুখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে কিটান। বলব না, বলব না, করেও একদিন টিফিনের সময় স্যারের কাছে একটা লেসন বুঝে নিতে গিয়ে নানির গল্প করে ফেলল কিটান। বুকটা দুরদুর করছিল। কিটানের এত ফেভারিট তীর্থঙ্কর স্যার যদি রাগ করেন কিংবা হেসেই উড়িয়ে দেন সবটা! কিন্তু উনি খুব মন দিয়ে শুনলেন, তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কাল টিফিন খাওয়া হয়ে গেলে একবার আসিস তো আমার কাছে।’
পরদিন টিফিন পিরিয়ডে তীর্থঙ্কর স্যারের কাছ থেকে যখন ছুটি মিলল তখন মাথা ভোঁ ভোঁ করছে কিটানের। স্যার খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর পর মানুষ তার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে আসতে পারে না। তাহলে আলো নিবিয়ে দেওয়া? অঙ্ক ঠিক করা? ক্যারমের রেড ফেলা? ‘এসবও তুই নিজেই পেরেছিস, অথচ নানি করে দিচ্ছেন এটা ভাবতে তোর খুব ভালো লাগছে, মনে অনেক জোর পাচ্ছিস, তাই ভাবছিস। আজ হয়তো বুঝবি না, কিন্তু বড়ো হয়ে আমার কথাগুলো মিলিয়ে দেখে নিস।’
না, কিটানও যুক্তি দিয়ে ভেবে—ভেবে বুঝতে পারছে যে সবটাই তার মনগড়া। কিন্তু একইসঙ্গে কোথায় যেন একটা ফাঁকা—ফাঁকা লাগছে ওর। আর, তখনই বিদ্যুচ্চমকের মতো ওর মাথার মধ্যে একটা আলো জ্বলে উঠল যেন, কে যেন বলল, ‘নানি সঙ্গে—ই আছেন, শুধু কিছু করে দিতে পারেন না এই আর কী!’ কে বলে উঠল কথাটা! কে জানে, নানি—ই হয়তো বলে দিলেন এটা, সান্ত্বনা দিলেন কিটানকে! পাশ ফিরে, বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে কিটান।