রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

হো-চি-মিন (১৮৯০-১৯৬৯) – ভিয়েতনামের মুক্তিদাতা পুরুষ

হো-চি-মিন (১৮৯০-১৯৬৯) – ভিয়েতনামের মুক্তিদাতা পুরুষ

১৪৯৮ সালে ভাস্কো-ডা গামার ভারতে আগমনের পর থেকেই ইউরোপের বণিকেরা আসতে শুরু করে এদিকে। ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), ইন্দোনেশিয়াতেও তারা শুরু করে ব্যবসাবাণিজ্য। আর সেই ব্যবসা করতে করতেই ভারতের মতো ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়াতেও সম্প্রসাতির হয় তাদের থাবা, শুধু বনিকের রূপে নয়, রাজশক্তির প্রাঞ্জল পরাক্রান্তি রূপেও এবং ওই একই পথে ভিয়েতনাম দখল করেছিল ফরাসিরা। তারপর দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এই বিদেশি শাসনের কবল থেকে মাতৃভূমিকে উদ্ধার করার জন্য, জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য যিনি সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদান করেছিলেন, ভিয়েতনামের সেই মহান বীর সন্তানের নাম হো-চি- মিন। তিনি ছিলেন ইন্দোচিনের মুক্তিদাতা পুরুষ।

হো-চি-মিনের জন্ম ১৮৯০ সালের ১৯ মে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের নগোআন প্রদেশের হোয়ং ট্রু গ্রামে। তাঁর বাল্যনাম ছিল নগুয়েন টাট থান।

পিতার নাম ছিল নগুয়েন শিহুয়ে এবং মার নাম ছিল হোয়াং থি লিয়েন। হো-চি- মিন ছিলেন বাবা-মায়ের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।

নগুয়েন পরিবারটি ছিল দেশপ্রেমিক। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরাও সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। হো-চি-মিনের বড় ভাই ও বোন স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই হো-চি-মিন নিজেও গোপন রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে শামিল হয়ে যান। একেবারে শৈশবকাল থেকেই তিনি বড়দের মুখে ফরাসিদের শোষণ ও নির্যাতনের কথা শুনে আসছিলেন এবং তখন থেকেই বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে তাঁর মনে জেগে উঠতে থাকে তীব্র ঘৃণা।

বাল্যকালে হুয়ে শহরের কুয়ক থোক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন হো-চি-মিন। তিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন মেধাবী। কিন্তু তবু উচ্চশিক্ষা লাভ করা তার ভাগ্যে হয়ে ওঠেনি। নির্যাতনকারী ফরাসি পদ্ধতির শিক্ষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি পড়া ছেড়ে দিয়ে থিয়েটার স্কুলে শুরু করেন শিক্ষকতা।

শিক্ষকতাও ভালো লাগল না। তিনি সব ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে চলে আসেন সায়গনে। কিন্তু এখানেও সেই একই পরাধীনতার অভিশাপ। তিনি দেশ ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমাবার পথ খুঁজতে লাগলেন।

একদিন সে সুযোগও এসে গেল তাঁর।

ইন্দোচীনের হাইফং বন্দর থেকে ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরে যাতায়াতকারী একটি জাহাজে চাকরি নিয়ে তিনি দেশ ছাড়েন। জাহাজে চড়েই পোর্টসৈয়দ ও আলেকজান্দ্রিয়া, আফ্রিকার অধিকাংশ বন্দর দেখার সৌভাগ্য হয় তাঁর। তারপর লন্ডন হয়ে এলেন মার্সেইতে। এখানে এসেই তিনি জাহাজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাগানের মালীর কাজ নিলেন। এখানেই এশিয়ার কয়েকজন বিপ্লবী নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে।

১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই সময় তাঁর সঙ্গে প্রগতিশীল বামপন্থি পুস্তক বিক্রেতা প্রাতিষ্ঠান হ্যান্সফিল্ড লাইব্রেরির পরিচয় হয়।

১৯১৭ সালে শেষ হয়ে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই সময় সংঘটিত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। ১৯১৮ সালে জার্মানি পরাজিত হয় সম্পূর্ণভাবে।

বিজয়ী মিত্রশক্তির বৈঠক বসে ভার্সাই শহরে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি সংবলিত ১৪ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এই বৈঠকে। ফলে বিশ্বের সকল পরাধীন দেশের জনগণের মধ্যে স্বীয় দেশের স্বাধীনতা লাভের উন্মাদনা সৃষ্টি হয়।

হো-চি-মিনও তখন ফরাসি উপনিবেশবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা দাবি করে ভার্সাই বৈঠকের নেতাদের কাছে পেশ করেন ৮ দফা দাবি।

সেদিন বিশ্বনেতৃবৃন্দ হো-চি-মিনের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেননি। কিন্তু তারা সেটা না করলেও ভিয়েতনাম তথা ইন্দোচীনের মানুষের মধ্যে এই দাবির কথা ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে। দলে দলে লোক ছুটে আসতে থাকে হো-চি-মিনের কাছে। তারা সবাই তাঁর নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। তারা তাঁকে তাঁদের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়।

এরপর হো-চি-মিন ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে টুরসে সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনে ফরাসি শাসনের কবল থেকে ইন্দোচীনের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯২৩ সালে তিনি বিশ্বের পরাধীন দেশসমূহের কৃষকশ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক কৃষক সংস্থার সম্মেলনে যোগদানের জন্য রাশিয়ায় যান।

১৯২৪ সালে তিনি পিকিং-এ অবস্থানরত ইন্দোচীনের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মস্কো থেকে পিকিং-এ চলে আসেন।

এই সময়ই হো-চি-মিনের পরোক্ষ নেতৃত্বে তাঁর জন্মস্থান নগোআনে কৃষক আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বড় বড় খামারগুলোর কৃষকরা জোর করে জমি দখল করে গড়ে তোলে সমবায়।

কিন্তু ফরাসি সরকার অবশেষে এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয় এবং অনেক নেতাকে তারা গ্রেফতার ও হত্যা করে। আর পিকিং-এ অবস্থানরত হো-চি-মিনকে দেওয়া হয় প্রাণদণ্ড। এর কিছুদিন পর পিকিং-এ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন হো-চি- মিন। ফরাসি সরকার দাবি করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্রিটেনের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর মধ্যস্থতায় হো-চি-মিন শেষ পর্যন্ত রক্ষা পান। তারপর হংকং থেকে হো-চি-মিন পালিয়ে সোজা চলে যান মস্কোতে।

১৯৩৮ সালে হো-চি-মিন মস্কো থেকে আবার চীনের মুক্ত এলাকায় ফিরে আসেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪০ সালে হিটলার ফ্রান্স দখল করে নেন। ১৯৪১ সালে ভিয়েতনামে কডেরং প্রদেশের টনকি এলাকায় একটি মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়। হো-চি-মিন ট্রান ছদ্মনাম নিয়ে এই মুক্তাঞ্চলে এসে ইন্দোচীনের বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন।

এই সময় ইন্দোচীনের বিপ্লবীরা জাপ আক্রমণের মুখে পলায়নপর ফরাসিদের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিতে সক্ষম হয়।

এরপর তিনি ইন্দোচীনের জাপবিরোধী প্রতিরোধ জোরদার করার জন্য মার্শাল স্ট্যালিনের সাহায্যলাভের আশায় রাশিয়া গমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে সীমান্ত পার হয়ে চীনে প্রবেশ করার পরই চিয়াং কাই-শেকের কুয়োমিনটাং বাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। পরে তিনি মাও-সে-তুং-এর সাহায়তায় মুক্তিলাভ মস্কো যাওয়া হলো না তাঁর। তাঁকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল ভিয়েতনামে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে হো-চি-মিন একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন এবং এই সম্মেলনেই গঠন করা হয় ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি কমিটি। একেই তিনি দেশের অস্থায়ী সরকার বলে ঘোষণা করলেন। তিনি হলেন এই অস্থায়ী সরকারের প্রধান। ভিয়েতনামকে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হলো। আবসান হলো দীর্ঘ ৮০ বছরের ফরাসি উপনিবেশবাদী শাসনের। ভিয়েতনাম হলো স্বাধীন।

এর পরও ফরাসিরা চীনের চিয়াং কাই-শেক সরকারের সহায়তায় ভিয়েতনাম পুনর্দখলের চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু হো-চি-মিনের প্রতিরোধ সংগ্রামের মুখে টিকতে তারা পারল না। দীর্ঘ ৫৮ দিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বিপ্লবীরা ফরাসিদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করল।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৫৪ সালে জেনেভায় ১৪ জাতির এক আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কম্বোডিয়া ও লাওস দুটো রাষ্ট্র এবং ভিয়েতনাম একটি রাষ্ট্র হলেও তাকে দুভাগে ভাগ করা হয়—উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে। কথা হয়, তিন বছরের মধ্যে তথা ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে ভিয়েতনাম আবার একত্রিত হবে।

কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত। ফ্রান্সে নির্বাসিত বাওদাইকে বসানো হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামে। বছর না যেতেই ফরাসিদের দালাল নাগো দিন দিয়েম উড়ে এসে জুড়ে বসেন ক্ষমতায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মদদ দিতে লাগল তাঁকে। এদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের জনগণ গণভোটের দাবিতে ও বিদেশি সৈন্য অপসারণের দাবিতে শুরু করল আন্দোলন।

এদিকে নগো দিন দিয়েমকে রক্ষা করার জন্য ১৯৫৫ সালে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামে শুরু করল সশস্ত্র হমলা। শুরু হলো যুদ্ধ। মার্কিনিরা ভিয়েতনামের মাটিতে শুরু করল পাইকারী হত্যাযজ্ঞ, সর্বাত্মক সামরিক অভিযানও।

ফলে ভিয়েতনামে গঠিত হলো জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট। হো-চি-মিনের নেপথ্য নেতৃত্বে ও চীনের সহযোগিতায় ভিয়েতনামি বিপ্লবীরা তাদের যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর করতে লাগল।

১৯৬৫ সালে নগো দিন দিয়েম জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফরমোজার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পনেরো লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে প্রতিরোধ লড়াই করেছে দক্ষিণ ভিয়েতনামের এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ।

১৯৬৯ সালে ভিয়েতনামের প্রতিরোধ যুদ্ধে ভিয়েতকং গণবাহিনীর বিজয় যখন দোরগোড়ায়, মার্কিন বিমানবাহিনী বিধ্বস্তপ্রায়, দুই ভিয়েতনামের একত্রীকরণের সংগ্রাম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক সেই মুহূর্তে ১৯৬৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিশ্বের শোষিত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা হো-চি-মিন মৃত্যুবরণ করেন।

হো-চি-মিন-এর মৃত্যু হলেও ভিয়েতনামের জনগণ তাঁদের প্রিয় নেতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে মার্কিন বাহিনীর ভিয়েতনাম ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ভেতর দিয়ে হো-চি-মিনের স্বপ্ন সফল হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *