ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

হোলিমে গোলি

হোলিমে গোলি

ফাল্গুন মাস। কোথায় বসন্ত? কোথায় সেই দখিনা বাতাস। কোকিলের কুহু সহসা আর কি কানে আসে? শিল্প-সভ্যতা আর হু-হু করে বেড়ে ওঠা শহর আমাদের সব গ্রাস করে নিয়েছে। বিশাল-বিশাল অট্টালিকা। পায়রার খুপরি। অসংখ্য মানুষের কল-কোলাহল। ক্ষতবিক্ষত জীবন যুদ্ধ। কলকারখানার চিমনি। আকাশের গায়ে কালো ধোঁয়া আধুনিক সভ্যতার মরণ-ফলক লিখছে। ভূপাল আমাদের ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। গণ কবরেই যাবে আমাদের এই উদাসীন, উদ্দাম গণতন্ত্র। কোথায় বসন্ত!

বসন্ত নেই। সবুজ বনানী ধীর ধ্বংসের পথে। স্বচ্ছ সরোবর বুজিয়ে উঠছে মানুষের বাসস্থান। বর্ষশেষে গাছের পাতায় পাতায় হলুদ আগুনের স্পর্শ আর তেমন করে লাগে না। ধর্ম এখন রাজনীতিকের হাতিয়ার। রাধা আর কৃষ্ণ এখন বোম্বাই সিনেমার প্যান্ট আর জিনস পরা নায়ক নায়িকা। রাগ সংগীতকে গলাধাক্কা দিয়েছে ‘রক’ আর ‘ডিসকো’। কে আর গাইবে সেই বিখ্যাত ঠুংরি।

।। হোলি খেলত নন্দকুমার ।।

ভারতবর্ষে একসময় ছটি ঋতু বড় স্পষ্ট ছিল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। এখন গ্রীষ্ম আর বর্ষা ছাড়া বাকি ঋতু বড়ই লাজুক। উত্তর ভারতে শীতের কামড় থাকলেও অবশিষ্ট ভারতে একটু শীত শীত ভাব ছাড়া আর কিছুই নেই।

বসন্তই যখন নেই, বসন্ত উৎসব থাকে কি করে। শীতের পর প্রকৃতি যখন সবুজের সাজঘর থেকে প্রেমিকের মতো চপল চরণে প্রজাপতির নৃত্যে আর কোকিলের তানে বেরিয়ে আসছে তখন তাকে আবাহন জানাবার উল্লাসে মানুষ আবীর ছুড়ে দিত বাতাসে। রঙের পিচকিরি ছিট তো পরস্পরের গায়ে। প্রকৃতি রঙিন। মানুষ রঙিন। মন রঙিন।

সবুজ প্রকৃতি ক্ষর গ্রীষ্মে ক্রমশ তামাটে হতে থাকে। মৃত্তিকায় ফাটল ধরে। তৃষ্ণার্ত বসুন্ধরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সজল মেঘের কামনায়। বসন্তে যার বন্দনা, গ্রীষ্মে তার সাধনা। বর্ষার বর্ষণে তৃপ্তি। হেমন্তে পূর্ণতা। শীতে বিশ্রাম। প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্ক যখন ছিল মা তার সন্তানের মতো তখন মানুষ ছিল সুখী। প্রকৃতিকে জয় করতে চেয়ে প্রকৃতিকে আমরা শত্রু করে ফেলেছি। সন্তান এখন খুনীর চেহারা ধরেছে। প্রকৃতি আর আমাদের জননী নয়। ক্রীতদাসী। প্রকৃতি থেকে সরে আসার সাধনায় আমরা সফল।

হোরি বা বসন্তোৎসব আসলে বৈষ্ণবদের উৎসব। রাধা আর কৃষ্ণের দ্বাপর লীলার পরিচয় জানা না থাকলে এই উৎসবের তাৎপর্য বোঝা যাবে না। আজ আমরা ধর্মে ধর্মে বিভেদ টানছি। স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এক ধর্মকে আর এক ধর্মের বিরুদ্ধে খাড়া করে দিচ্ছি। এক ভাষাভাষী আর এক ভাষাভাষীকে সহ্য করতে পারছে না। অথচ এই হোরি উৎসবে হিন্দু আর মুসলিম সামিল হত একদা। ‘ফাগুয়া’র আমেজ গাঢ় হত ওস্তাদের গানে। হোরির গান হিন্দু ওস্তাদ যেমন গেয়ে থাকেন, মুসলমান ওস্তাদও সমান আবেগে পরিবেশন করেন। ধর্ম কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। হিন্দস্তানী রাগ-সংগীতের বেশির ভাগ দাদরা আর ঠুংরি রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক।

ইংরেজ শাসনে আমাদের একজন মাত্র শত্রু ছিল। সে হল ইংরেজ। সেই এক মহাশত্রুকে হাটাতে একটা জাতীয় সংহতি ও ঐক্য তৈরি হয়েছিল। এক জাতি। এক প্রাণ। একতা। কথার কথা ছিল না। সেই মহান শত্রু অপসৃত হওয়ার পর আমাদের ঐক্যবোধের বাঁধন খুলে পড়ে গেল। আমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে দাঁড়ালুম। আসলে আমরা মারতে আর মার খেতে ভালোবাসি। সাতচল্লিশের পর থেকেই আমাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়েছে। সারা বছরই আমাদের হোরি চলেছে। রঙের বা আবিরের নয়। রক্তের। দেশে প্রেমই নেই, তো প্রেমের উৎসব।

প্রকৃতির সবুজে প্রাণের সাড়া। আর আমাদের সবুজে অসংখ্য মনোবিকারের হলুদ ছোপ। এখনও আমরা শিল্প-সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছতে পারিনি। পশ্চিমী শিল্প সভ্যতার পায়ের তলায় হামা দিচ্ছি। কিন্তু সেই অসম্পূর্ণ শিল্পবিপ্লব আমাদের গ্রামীণ, কৃষি সংস্কৃতির গলা টিপে ধরেছে। গ্রামকে আমরা ভালোবাসি না। শহরের বিজলী সভ্যতার আকর্ষণে মানুষ শহরমুখো। স্বাভাবিকতা ভুলে অস্বাভাবিকতার প্রেমিক আমরা। গ্রামের গাছতলার চেয়ে শহরের ফুটপাথের ঝুপড়ি আমাদের প্রিয়। ভারতবাসীর প্রত্যেকে কোনওদিনই জীবনযাত্রার একটা সুস্থ মানে পৌঁছতে পারবে না। বিশাল অর্থনৈতিক ব্যবধান থাকবেই। বিশাল ধনী আর নগ্ন ফকির এই তো আমাদের জীবনের দুই মেরু। গ্রাম, কৃষি সবুজের সংস্পর্শ, গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে জীবনকে পবিত্র করার একটা উপাদান ছিল। সে জীবনে দারিদ্র্যতার মানবিকতাকে খুন করতে পারত না। আর বিশ্বাসকে অবিশ্বাসে বিষিয়ে দিতে পারত না। যা শহর পেরেছে। গ্রামে মানুষ মানুষ। শহরে দরিদ্র মানুষ ভিখারি। পাপের শিকার। বাইরেটা মানুষের ভেতরে পশুর অবস্থান।

আমাদের পরিকল্পনার ভুলে, আমরা সমৃদ্ধি তো পেলামই না। উলটে আমাদের মনুষ্যত্ব, সুস্থ সংস্কৃতি, পবিত্রতা সবই হারাতে বসেছি। লক্ষ্যভ্রষ্ট, অপবিত্র মানুষের বেঁচে থাকায় কোনও সৌরভ থাকে না। আমাদেরও নেই।

আমাদের জীবনের মতোই আমাদের উৎসব। স্বাধীনতা দিবস পালন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি আমলারা গুটিকয় কর্মচারীর সামনে পতাকা উত্তোলন করে প্রথা পালন করেন। সারাদেশের মানুষ বাঁধন ছেঁড়া উল্লাসে ছুটে আসে না। প্রজাতন্ত্র দিবসের সরকারি আড়ম্বর রাজধানীর পথে। অধিকাংশ মানুষ জানেই না প্রজাতন্ত্র কাকে বলে। গণতন্ত্র বলতে বোঝে ভোটের অধিকার।

সমস্ত লৌকিক উৎসব এখন অসভ্যতারই নামান্তর। মিশনারিরা যখন মন্তব্য করেছিলেন Humanity in its worst form is Hinduism তখন আমরা ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। বলেছিলাম সে কী কথা, হিন্দুরা নিকৃষ্ট মানুষ! আমাদের সমস্ত উৎসবের অশালীনতা দেখেই যে এই উক্তি, তখন আমরা তা বুঝিনি। আজও বুঝি না। বুঝলে আমাদের দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতীপুজো, শিব অথবা গণেশের পুজো এমন কদর্য চেহারা নিত না। ধর্ম নেই, ভক্তি নেই, সামান্যতম শৃঙ্খলা নেই। পুজো মানে মণ্ডপ। পুজো মানে বিসর্জনের অসভ্য মিছিল। চাঁদার জুলুম। অষ্টপ্রহর ফিলমের গান। সারাদেশ জুড়ে পুতুল খেলা। হিন্দু ধর্মের যাঁরা প্রবক্তা, তাঁদের উচিত অবিলম্বে বারোয়ারি তামাশা বন্ধ করা। তা না হলে ধর্ম বলে আর কিছু থাকবে না।

বসন্ত উৎসব বা হোলি বহুকালই তার স্নিগ্ধ মাধুর্য হারিয়েছে। সংঘবদ্ধ উৎপাতের চেহারা নিয়েছে। একদল মানুষের অসভ্য আনন্দ আর একদল মানুষের নিরানন্দের কারণ। যে উৎসবে পুলিশ ডাকতে হয় প্রাণে বাঁচার জন্যে সে উৎসব উৎসবই নয়। সংঘবদ্ধ অত্যাচার।

চলন্ত ট্রেনে ইটপাটকেল ছোড়া, কাদা এবং অন্যান্য নোংরা জিনিস নিক্ষেপ কোনও উৎসবের অঙ্গ হতে পারে কি। একমাস আগে থেকেই এই অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। তাণ্ডব শুরু হয় হোলির দিনে। কলকাতার বাসে বেলুন ছোড়া শুরু হয়ে যায় একমাস আগে থেকেই। কলকাতার বাস-ট্রাম, মিনি আকণ্ঠ যাত্রী বোঝাই হয়ে যাতায়াত করে। বাতাসহীন কফিনের মতো। যাত্রীরা এমনিতেই ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে। বেলুনের আচমকা আঘাত থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য জানলা বন্ধ করতেই হয়। সে যে কি নির্যাতন, এই একমাস যাঁরা নিত্য বাসে-ট্রামে যাতায়াত করেন তাঁরাই জানেন। এর নাম হোলি। বেলুনে নোংরা জল ভরে সজোরে ছুড়ে মারা। আমরা অনেক কিছুরই খবর রাখি না। ভারী বেলুনের আঘাতে কতজন দৃষ্টিশক্তি হারালেন তার হিসেব কে রাখছে। যার গেল তার গেল। নির্বোধ কিছু মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতায় একটি উৎসবের গলিত চেহারা। রুচি সম্পন্ন অধিকাংশ মানুষ এই উৎসবকে এখন ঘৃণার চোখে দেখেন। এর মধ্যে ভালো আর কিছু নেই। স্যাডিজম, রাউডিজম, র‌্যাগিং তিনটি মিলেমিশে এক সুবিকৃত চেহারা নিয়েছে হিন্দুর দোলযাত্রা। কুঞ্জবনে কৃষ্ণ আর অষ্টসখী পরিবৃতা রাধা পরস্পর পরস্পরের অঙ্গে আবির আর গুলাল মাখাচ্ছেন পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে কোয়েলিয়া ডেকে ডেকে সার হচ্ছে, এই মধুর মনোহর দৃশ্য আর মনে আসে না।

নেশাগ্রস্ত একদল হামলাবাজ রং আর আবিরের বদলে, চাকার তেল কালি, আলকাতরা, নর্দমার পাঁক, ধাতব বিষাক্ত রং নিয়ে নিরীহ নর-নারীকে আক্রমণ করছে নরখাদকের উল্লাসে। এই তো পরিচিত দৃশ্য। যা বলাৎকারেরই নামান্তর। উৎসবের ছাড়পত্র নিয়ে এক ধরনের ধর্ষণ। যাঁরা খবর রাখেন তাঁদের অজানা নয় এই একটি দিনে চোখে ওইসব উগ্র পদার্থ লেগে বহু মানুষ চিরকালের মতো অন্ধ হয়ে যায়। মেয়েদের ওপর অশ্লীল আক্রমণ স্বাভাবিক ঘটনা।

ভারত এমন একটি দেশ, যে দেশে মহিলারা আজও ভোগ্যপণ্য। যে-কোনও ভাবে তাদের কদর্য একটা স্তরে নামিয়ে আনতে না পারলে সুখ নেই। সবচেয়ে বড় আনন্দ শৃলতাহানি। মুখে আমরা অনেক ভারী ভারী কথা বলি। সাজ পোশাকে সাহেব। কিন্তু মনে মনে আমরা বিকৃতি নিয়ে ঘুরছি। ভেতরে আমাদের নেকড়ের খিদে। বেদ, বেদান্ত, গীতা, উপনিষদ আমাদের বাইরের সাজ পোশাক। ভেতরে বইছে ভোগ্যের নর্দমা। সুযোগ এলেই ম্যানহোলের ঢাকা খুলে যায়। ধর্মীয় উৎসব হল সেই সুযোগ। অন্য কোনও ধর্মে এতটা বিকৃতি আছে কী? দোষ হিন্দু ধর্মের নয়। আমরা এই ধর্মের অসীম উদারতার সুযোগ নিচ্ছি। যে যেভাবে পারছি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছি। আড়ালে থেকে নিজেদের পাশবিক ইচ্ছার পরিতৃপ্তি খুঁজছি।

সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে বিকৃত করে অর্থবান মানুষ। কৃষি-সংস্কৃতি আর শিল্প-সংস্কৃতিতে তাই এত তফাৎ। খেটে খাওয়া মানুষ যারা ফসল ফলায় ঘাম ঝরায় তারা ঈশ্বরের অনেক কাছাকাছি। সৃষ্টি কর্তার প্রিয়জন। ভগবত বিশ্বাস মানুষকে পবিত্র করে। আচার-আচরণে একটা সহজ সরল মাধুরী এনে দেয়। অর্থবান মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মবিস্মৃত ভোগী; তাদের সব আায়োজনেই ফুটে ওঠে আসুরিক ভাব। পান, ভোজন, রমণ। ভোগবিকৃত উৎসবের আয়োজন। প্রাচীন কলকাতার বাবুরা দুর্গাপুজো করতেন, সে পুজোয় ধর্মও ছিল না ভক্তিও ছিল না। ইংরেজ প্রভুরা আমন্ত্রিত হতেন। মদের ফোয়ারা ছুটত। বাঈ নাচ। প্রসাদ, ফলমূল নয়, বাবুর্চির হাতে তৈরি খাসা কাটলেট।

বিসর্জনের দিন বাবুরা নেশায় চুর হয়ে রাস্তায় নাচতে বেরোতেন। সঙ্গে গোরা, ব্যান্ড, ঢাকঢোল, কাড়ানাকাড়া। প্রতিমাকে নৌকোয় তুলে, দেবীকে সাক্ষী রেখে ভাড়া করা মেয়েমানুষ নিয়ে বেলেল্লাপনা। এই বাবুরাই রাস্তায় সং নাচিয়ে, পায়রা উড়িয়ে, মোসায়েব পুষে, মেয়ে মানুষ রেখে পয়সার শ্রাদ্ধ করে গেছে। এ শুধু কলকাতার বাবুরা নয়, সারা ভারতের সমস্ত অর্থবান মানুষেরা একই পথে চলেছে এবং চলবে। নিজেকে জাহির করা। সমাজের কথা, সংস্কৃতির কথা না ভেবে নিজেদের ভোগের আগুনে ঘি ঢালা।

উঁচুতলার অপসংস্কৃতি নীচের তলায় নেমে আসতে বেশি সময় নেয় না। রুচির চেয়ে কুরুচির আকর্ষণ অনেক বেশি। তাছাড়া মগজ ধোলাইয়ের পুঁজিবাদী কল জোর চলেছে। সপ্তাহে কমপক্ষে তিন থেকে চারটি সিনেমা বাজারে নেমে আসছে বোম্বাই কল যার বিষয়বস্তু—অবৈধ প্রেম, খুন, রাহাজানি আর রেপ।

ভারতীয় মার্গ সংগীত কবর হয়ে গেছে। মিঞা তানসেন, বৈজু বাওয়ারা, শাঙ্গ দেব চাপা পড়ে গেছেন। ইয়াঙ্কি ভাইয়েরা মদত দিচ্ছেন সুর সাপ্লাই করে। ডিসকো। পপ। নৃত্য মানে কোমর দোলানো, নিতম্ব ঘোরানো, যৌনতার প্রদর্শন। পুরুষের আদর্শ—দেশগঠন, সমাজ সংস্কার, সমাজসেবা নয়। মেয়েছেলে ধরো, বিছানায় তোলো আর বোতল বগলে ইন্দো-আমেরিকান সুরে গেয়ে যাও, ম্যায় শরাবী হুঁ।

মানুষের ভেতর থেকে দেবতাকে নয়, পশুটাকে টেনে বের করে আনো। যাঁরা শাসনে আছেন তাঁরাও এইটাই চান। মনুষ্যত্ব ঘুমিয়ে পড়ুক। পশুকে পাশবিক শক্তিতে বশে রাখা অনেক সহজ। যে মানুষ ভাবে, চিন্তা করে, বিকশিত হতে চায় সেইসব মানুষকে গুলি দিয়ে, লাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

রাজা, মহারাজা, সামন্ত রাজা, জমিদার, ডিকটেটার, ডেমক্র্যাট সকলেরই এক কায়দা। নৈতিকতার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে সরীসৃপ করে দাও। পাঁকে ডুবিয়ে রাখো শূকরছাঁনার মতো।

হোলি সেই কারণেই হয়ে উঠেছে বিকৃত যৌনাচার। পতিতালয়ের উৎসব। সারা দেশের শান্তি প্রিয় মানুষ তটস্থ। রাস্তা থেকে যানবাহন তুলে নিতে হয়। ট্রেন বন্ধ। বাজার হাট, দোকানপাট বন্ধ। দাঙ্গার পর দেশের যা অবস্থা হয়, অনেকটা সেই অবস্থাই নেমে আসে পল্লীতে পল্লীতে। উন্মত্ত জনতার এক একটি দল। বীভৎস জন্তুর মতো মাতাল চেহারা। মুখে তাদের বিকৃত হে রে রে রে চিৎকার। ছেচল্লিশের দাঙ্গার কথা মনে পড়ে যায়।

দিন যত এগোতে থাকে, থানায়-থানায় জমতে থাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর। মাথা ফাটাফাটি। রক্তারক্তি। রঙের উৎসব শেষে রক্তের উৎসব।

কেথায় গেল সেই শান্ত, সুন্দর, বৈষ্ণব অথবা মুঘল বাদশাহী মেজাজ। ঘরে আবিরের বিছানা। তার ওপর দামি কার্পেট। আতরের গন্ধ। আবিরের ফরাসে আসর বসিয়েছেন নামজাদা ওস্তাদ। আমীর, ওমরাহ, অমাত্যরা বসেছেন গোল হয়ে। বাইরে বসন্তের বাতাসে কাঁপছে গাছের নবীন সবুজ পাতা। ওস্তাদ গান ধরেছেন বসন্ত বাহারে। যেই সমে এসে পড়েছেন, সবাই চাপড় মারছেন কার্পেটে। সারা ঘর ভরে যাচ্ছে সুগন্ধী, মিহি, লাল আবিরে। চিকচিক করে বাতাসে ভাসছে অভ্ররেণু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *