১৮
[মানবজীবনের লক্ষ্য মানুষে মানুষে ভ্রাতৃভাবে মিলন। এই উপলব্ধি দ্বারা শিল্পকর্মের পরিচালিত হওয়া আবশ্যক।]
আমাদের সমাজে শিল্প যে মিথ্যার কবলে পড়েছে তার কারণ এই : অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিরা গির্জা-নির্দিষ্ট (যা খ্রীষ্টীয় বলে অভিহিত) ধর্মশিক্ষায় বিশ্বাস হারিয়েছে। কিন্তু তৎপরিবর্তে মানুষ যে ঈশ্বরের সন্তান এবং পরস্পরে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ- যথার্থ খ্রীষ্টবাণীর এই মৌলিক নীতি তারা গ্রহণ করেনি। তারা বিশ্বাসবর্জিত জীবনই যাপন করে চলেছিল। শুধু ওই বিশ্বাসহীনতার শূন্যতাকে পূরণের জন্য কেউ বা ভন্ডামির সাহায্য গ্রহণ করেছিল,-ভান করেছিল যে তারা ওই গির্জা-প্রচারিত আজগুবি মতামতে এখনও বিশ্বাস করে। কেউ বা সদম্ভে নিজের বিশ্বাসহীনতাকে জাহির করছিল, কেউ বা সূক্ষ্ম নাস্তিক্যবাদ আশ্রয় করছিল, আবার কেউ কেউ গ্রীক সৌন্দর্যবাদে প্রত্যাবর্তন করে অহং-সর্বস্বতাকেই শ্রেয় আখ্যা দিয়ে তাকে ধর্মীয় মতবাদের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল। খ্ৰীষ্ট-বাণীকে যথাথ অর্থাৎ তার সম্পূর্ণ অর্থে গ্রহণ না করাই এই অসুস্থতার মূল কারণ। সম্পূর্ণ তাৎপর্য সহ ওই বাণীর স্বীকৃতি এর একমাত্র আরোগ্যের উপায়। এই স্বীকৃতি আমাদের যুগে শুধু সম্ভব নয়, অনিবার্য। আমাদের যুগে জ্ঞানের তুঙ্গ-শীর্ষে আরোহণ করে আজ নামে মাত্র ক্যাথলিক বা প্রোটেস্টান্ট-কোন ব্যক্তিই এ কথা বলতে পারেন না যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে গির্জা-প্রচারতি মতবাদে বিশ্বাসী : সে বিশ্বাস ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদে খ্রীষ্টই যে ঈশ্বর-এই ধারণায়, খ্রীষ্ট কর্তৃক পাপীদের উদ্ধার পরিকল্পনায় ইত্যাদি। স্বীয় অপ্রত্যয় বা নাস্তিক্য ঘোষণার সাহায্যে কিংবা সৌন্দর্য এবং অহং-সর্বস্বতার উপাসনায় প্রত্যাবৃত্ত হয়েও তিনি নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না। সর্বোপরি, তিনি আর বলতে পারেন না যে, খ্রীষ্ট উপদেশের প্রকৃত অর্থ আমাদের অজ্ঞাত। সে অর্থ আমাদের যুগের সকল মানুষের নিকট যে অধিগম্য হয়ে উঠেছে শুধু তাই নয়, বরং আজকের দিনের মানুষের সামগ্রিক জীবন সে শিক্ষার অন্তর্নিহিত ভাবের দ্বারা পরিব্যাপ্ত এবং সচেতন বা অবচেতনভাবে সে ভাব-নিয়ন্ত্রিত।
আমাদের খ্রীষ্টীয় জগতের মানুষ মানব-নিয়তিকে বিভিন্ন রূপে ব্যাখ্যা করেছেন : কেউ দেখেছেন তাকে মানব-প্রগতির মধ্যে (সে কথার অর্থ যাই হোক না কেন), কেউ দেখেছেন সাম্যবাদী পরিবেশে সকল মানুষের মিলনের মধ্যে, অথবা কোন কমিউন প্রতিষ্ঠার মধ্যে। কোন সর্বজনীন উপাসনা পদ্ধতি-নির্দেশিত মানবমিলনের দিকে, অথবা বহু রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধ মানবমিলনের দিকে তারা দৃষ্টিপাত করুন না কেন, কিংবা মানবভাগ্য সম্পর্কে তাদের সংজ্ঞা যত বিভিন্ন প্রকৃতির হোক না কেন,-আমাদের যুগের সকল মানুষ এ কথা স্বীকার করেই নিয়েছে যে, একমাত্র পারস্পরিক মিলনের সাহায্যেই মানুষের আকাঙ্ক্ষিত সর্বোচ্চ মঙ্গলের রাজ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আমাদের অভিজাত শ্রেণীর মানুষ (যতকাল ধনী ও জ্ঞানীর দরিদ্র ও অজ্ঞ শ্রমিকদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেন, ততকাল তাদের প্রভুত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে মনে করে) কখনও প্রাচীনত্বের আদর্শে ফিরে গিয়ে, কখনও অতীন্দ্রিয়বাদ বা হেলেনীয় জীবনবাদের, আবার কখনও বা উচ্চতর ব্যক্তিত্ববাদ (অতিমানববাদ)-এর আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের সুযোগ সুবিধাগুলিকে চিরকালীন করার উদ্দেশ্য জীবনের নতুন অর্থ উদ্ভাবনের জন্য যতই সচেষ্ট হোন না কেন, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাদের চতুর্দিকে স্পষ্ট প্রকাশমান এ সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, -আমাদের মঙ্গল নির্ভরশীল একমাত্র মানবমিলন ও মানবভ্রাতৃত্বের ওপর।
টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, প্রেস প্রভর্তি যোগাযোগের বাহন নির্মাণ এবং সর্বসাধারণের জন্য ক্রমবর্ধমান পার্থিব সমৃদ্ধি লাভের সুযোগ অধিগম্য হওয়ায় এ সত্যের নিজ্ঞান স্বীকৃতি দেখা যায়। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী কুসংস্কারের ধ্বংস সাধন, জ্ঞানের সত্য বিচ্ছুরণ, এবং আমাদের যুগের শ্রেষ্ঠ শিল্পসৃষ্টি মানবভ্রাতৃত্বের আদর্শকে অভিব্যক্তি দেওয়ায় এ সত্যকে সচেতন দৃঢ়তায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শিল্প মানবজীবনের একটি আধ্যাত্বিক সাধন-যার ধ্বংস কোন মতেই সম্ভব নয়। সুতরাং যে ধর্মীয় আদর্শপ্রভাব মানবজাতি জীবনধারণ করে, অভিজাত শ্রেণীর মানুষ কর্তৃক সে আদর্শকে গোপন করবার সকল প্রয়াস সত্ত্বেও সে আদর্শ লোকসমাজে উত্তরোত্তর অধিক পরিমাণে স্পষ্ট স্বীকৃত। আমাদের বিকৃত-সমাজের বিজ্ঞানে ও শিল্পে ক্রমেই অধিক পরিমাণে স্পষ্প স্বীকৃত। আমাদের বিকৃত-সমাজের বিজ্ঞানে ও শিল্পে ক্রমেই অধিক পরিমাণে সে আদর্শের আংশিক অভিপ্রকাশ ঘটছে। খ্রীষ্টীয় ভাবচেতনায় অনুলিপ্ত উচ্চতর পর্যায়ের ধর্মীয় শিল্প ক্রমেই অধিকতর পৌনঃপুনিকতায় সাহিত্যে, চিত্রশিল্পে এবং সাধারণ জীবননির্ভর সর্বজনীন শিল্পকর্মে সকলের বোধগম্য হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। এতে মনে হয়, আমাদের যথার্থ যুগাদর্শের সঙ্গে শিল্পকর্ম মানবমিলন এবং মানবভ্রাতৃত্ববোধের দিকে সবলে আকর্ষণ করে আমাদের। চিত্তে ধর্মীয় অনুভূতি সঞ্চার করে (ডিকেন্স, হুগো, দস্তয়েভস্কির সৃষ্টিকর্ম এ ধরনের; চিত্রশিল্পে মিলে (গরষষবঃ), বাস্তিয়ে লেপাঝ (Bastien Lepage), জুল ব্রেতোঁ (Jules Bretan), লেরমিত্তে (Lhermitte) এবং অপর কারো কারো সৃষ্টিকর্মে )। অপর পক্ষে সেই শিল্প অভিজাত শ্রেণীর পক্ষে যে অনুভূতি স্বাভাবিক কেবলমাত্র তাই প্রকাশ করে না, বরং যে অনুভূতি অ-ব্যতিক্রমে সকল মানুষের মিলন-সাধক তারই সঞ্চারে সক্রিয়। এখনও এ পর্যায়ের সৃষ্টিকর্মের সংখ্যা খুব স্বল্প হলেও তাদের প্রয়োজনীয়তা ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। সাম্প্রতিক কালে আমরা উত্তরোত্তর অধিকতর পরিমাণে জনসাধারণের জন্য পুস্তক প্রকাশ, চিত্র, কনসার্ট এবং রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের এখনও বহু দূরান্তবর্তী। তবে স্বাভাবিক পথ পুনরুদ্ধার প্রবণতায় সৎ যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সবেগে অগ্রসর হচ্ছে, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্য যে মানবমিলনে -এই স্বীকৃতির মধ্যে এ যুগের ধর্মীয় উপলব্ধি নিহিত। এই উপলব্ধি এতই পর্যাপ্ত পরিমাণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে,-যে ভ্রান্ত সৌন্দর্যতত্ত্ব অনুসারে সম্ভোগই শিল্পের লক্ষ্য্য বিবেচিত হয়, এখন জনসমাজ কর্তৃক সে ভ্রান্ত তত্ত্ব পরিত্যক্ত হওয়ামাত্র ধর্মীয় উপলব্ধি স্বভাবতই আমাদের যুগের শিল্পের পরিচালন ভার গ্রহণ করবে।
যে ধর্মীয় উপলব্ধি নিজ্ঞানে মানব-নিয়ন্ত্রণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে, যে মুহূর্তে তা সচেতন স্বীকৃতি লাভ করবে তখনই নিম্ন এবং অভিজাত শ্রেণীর জন্য শিল্পের বিভাজন অবিলম্বে স্বতই অন্তর্ধান করবে। তখন শিল্প হবে সর্বসাধারণের জন্য এক, ভ্রাতৃত্বের চেতনাময় এবং সর্বজনীন। এই অবস্থায় প্রথম যে শিল্প-সঞ্চারিত অনুভূতি আমাদের যুগের ধর্মীয় উপলব্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, যা মানবমিলনের সহায়ক নয়, বরং বিভেদসৃষ্টকারী, স্বভাবতই তা বর্জিত হবে। অতঃপর যে অকিঞ্চিৎকর স্বাতন্ত্র্যধর্মী শিল্পের ওপর বর্তমানে অযথা গুরুত্ব অর্পণ করা হয়, সে শিল্পকে অস্বীকার করা হবে।
এই পরিস্থিতি উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে যে শিল্প উদানীংকালে মানুষকে স্থূলতর এবং অধিকতর পাপাসক্তিপরায়ণ করে তুলবার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তৎক্ষণাৎ তার সেই স্বভাব থেকে মুক্তি ঘটবে। তখন শিল্প হবে সর্বযুগের প্রবণতা এবং আদর্শ অনুযায়ী এমন একটি মাধ্যম-যার সাহায্যে মানবজাতি ঐক্য এবং আনন্দময় কৃতার্থতার পথে অগ্রসর হবে।
এ তুলনা অদ্ভুত মনে হলেও আমাদের কালের এবং গোষ্ঠীর শিল্পজগতে যা ঘটেছে তা হল, কোন রমণী মাতৃত্বের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট নারী-সৌন্দর্যের আকর্ষণকে যখন সম্ভোগপিপাসু মানুষের নিকট বিক্রয় করে-তারই অনুরূপ।
বস্তুত আমাদের কালের এবং গোষ্ঠীর শিল্প বারবণিতায় পরিণত হয়েছে। এ তুলনা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার দিক থেকেও সত্য। বাবণিতার মতো কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বন্ধন স্বীকার না করে এ যুগের শিল্প সব সময় অলংকৃত, সর্বদা পণ্যযোগ্য এবং বারাঙ্গনার মতই না কুহকিনী ও সর্বনাশী।
শিল্পীচিত্তে কদাচিৎ প্রকৃত শিল্পপ্রেরণার আবির্ভাব ঘটতে পারে। মাতার গর্ভে শিশুর আবির্ভাবের মতো শিল্পও শিল্পীর জীবনচর্যার পরিণতি-উদ্ভুত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ক্রেতা পাওয়া মাত্রই কারিগর ও হস্তশিল্পী কর্তৃক ক্রমাগতই শিল্পসৃষ্টি হয়ে চলেছে।
স্নেহপ্রবণ স্বামীর স্ত্রীর মতো অকৃত্রিম শিল্পের কোন অলংকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কৃত্রিম শিল্পের সর্বদাই বেশ্যাদের অনুরূপ অলংকৃতি আবশ্যক।
যৌন মিলনাত্মক গর্ভ সঞ্চারের কারণ যেমন মাতার ভালোবাসা, তেমনি শিল্পী মনে সঞ্চিত অনুভূতির অভিব্যক্তি দেবার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনই অকৃত্রিম শিল্পসৃষ্টির কারণ। বেশ্যাবৃত্তির মতো কৃত্রিম শিল্পসৃষ্টির অভিপ্রায়ও উপার্জন।
স্ত্রীর ভালোবাসার পরিণতি যেমন জীবনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মানুষের জন্মদান, তেমনি অকৃত্রিম শিল্পের পরিণতিও জীবনের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন কোন অনুভূতির পরিচয় সাধন।
কৃত্রিম শিল্পের পরিণতি : মানুষকে কলুষিত করা, অতৃপ্ত আনন্দের সৃষ্টি এবং মানুষের আত্মিক শক্তির দুর্বলতা ঘটানো।
কলুষিত এবং গণিকাধর্মী শিল্পের যে প্রবল প্লাবনে আমরা নিমজ্জিত, তার পঙ্কিল স্রোত থেকে উত্তীর্ণ হবার জন্য আমাদের গোষ্ঠীর ও কালের মানুষকে এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করতেই হবে।