হোমিওপ্যাথি

হোমিওপ্যাথি

শিবুখুড়ো দিবানিদ্রা উপভোগ করিয়া বেশ বেলা করিয়াই উঠিলেন। হাত-মুখ ধুইয়া কাঁধে ভিজা গামছাটি ফেলিয়া রকের কিনারায় গিয়া বসিলেন এবং চারিদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, কোথায় সব, এক ছিলিম পাব নাকি?

খুড়োর পরিচয়টা একটু দিয়াই আরম্ভ করি তাহা হইলে। কবে যে বিশেষ কাহার খুড়ো ছিলেন, গ্রামের কেহ বলিতে পারে না, তবে গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মুখেই ওই এক সম্পর্কের বুলি। এই আমাদের কথাই ধরি না। কাকা ‘শিবু খুড়ো’ বলিতেন। আমি জ্ঞান হওয়ার পর দুই-একবার ঠাকুরদা’ বলিবার চেষ্টা করি; কিন্তু এমন অস্বস্তিকর শোনায় আর নিজেকে এমন গ্রামের বাহিরের লোক বলিয়া বোধ হয় যে, সে প্রয়াস ছাড়িয়া দিই। এই তো আমার অবস্থা। ছেলেটাও সেদিন আসিয়া বলিল, বাবা, শিবু খুড়ো বলেন যে—। বললাম, বেরো, ব্যাটার সম্পর্কজ্ঞান দেখ না!

যা হোক, শিবু খুড়ো রকের কিনারায় আসিয়া বসিলেন। রাঙাখুড়ী পিতলের প্রদীপ আর পিলসুজ মাজিতেছিলেন, প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল; তামাকের ফরমাশ শুনিয়া আরও খানিকটা তেঁতুলের ছিবড়া লইয়া মাজা জিনিস দুইটা আর একবার কষিয়া কষিয়া মাজিতে শুরু করিয়া দিলেন। খুড়ো একবার আড়চোখে দেখিয়া নিরুপায় ভাবে বসিয়া রহিলেন; কারণ, তাঁহার তামাক সাজিয়া লওয়া তো দূরের কথা, নিজের জলটি পর্যন্ত গড়াইয়া লইবার হুকুম নাই।

খুড়ী বলেন, আমি যেদিন ম’রে তোমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাব, সেদিন থেকে নিজে সব ক’রো—আশ মিটিয়ে; তদ্দিন আর এ লোক-দেখানো কেন?

খুড়ো, বিশেষ করিয়া কলিকালে সংসারের অসারতা সম্বন্ধে গুনগুন করিয়া একটি গান গাহিতে যাইতেছিলেন; কিন্তু তাহাতে পিলসুজ মাজার শব্দটা বেশি ঝাঁজালো হইয়া গেল দেখিয়া থামিয়া গেলেন। তখন তাঁহার মনটা বড়ই অপ্রসন্ন হইয়া গেল, এবং মরিয়া হইয়া খুক-খুক-খুক করিয়া তিনবার একটু কাশিলেন। খুড়ী একবার আড়চোখে চাহিয়া আবার কাজে লাগিলেন।

খুড়ো আবার বুকটা চাপিয়া ধরিয়া চার-পাঁচবার কাশিলেন; বলিলেন, এবার কাশিটা যেন জাঁকিয়ে এল, দিব্যি ক’রে পাড়বে আর কি!

খুড়ী সামনাসামনি হইয়া ফিরিয়া অস্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বলিলেন, যখন রোগ না থাকবে, তখন তো ‘উঃ গেলাম গো, মল্লাম গো’ করবে; এখন সত্যিই যখন কাশিটা হয়েছে একটু, যাও না একবার নবীন ডাক্তারের কাছে। রাতটা যদি বেড়েই থাকে, নয় একবার ডেকে পাঠাই।

কিসের জন্যে? ওরা সব কি বিশ্বাস করে, আমার কিছু হয়েছে? এই সারা জন্মটা কিছু না কিছু একটিতে ভুগছিই; ওরা কি কখনও বলেছে—হ্যাঁ, শিবু খুড়ো, এই অসুখটা তোমায় কাবু করেছে বটে? আসবে, সেই কাঁকড়াবিছের মত অস্তরটা দিয়ে একবার এখানে টিপবে, একবার ওখানে টিপবে, তারপর ‘কই খুড়ো, তোমার তো কিছুই দোষ নেই’–আরে বাপু, আমার কি দোষ? তোরা পারবি নি রোগ ধরতে, আর আমার হবে দোষ?

সে যদি বলে—কোন রোগ নেই তো তাই মেনে নিতে হবে, অত বড় একটা ডাক্তার। তোমার আবার খুঁতখুঁতনি রোগও তো আছে!

ছাই ডাক্তার, অ্যালোপ্যাথিতে আছে কি যে, বড় ডাক্তার হবে? হ্যাঁ, সে কথা কবিরাজি সম্পর্কে বলা চলে। সেই কোন্ ছেলেবেলা অনুকূল কবরেজ শুধু একবার নাড়ীটি টিপে ব’লে দিয়েছিল—সারা জীবনটা নানান খানায় ভুগবে বাস্, তারপর থেকে নাগাড়ে জের টেনে চলেছি, একটি না একটি লেগেই আছে। সেসব প্রাতঃস্মরণীয় লোক ছিলেন। খক-খক-খক—

খুড়ী তামাক সাজিয়া আনিয়াছিলেন, বলিলেন, ধর। আগুনটা ভাল ধরে নি, একটু ফুঁ দিয়ে নাও, ছিষ্টির কাজ প’ড়ে রয়েছে। না, দাও, কাজ কি ওটুকু উবগারেতে, আমিই ধরিয়ে দিচ্ছি। কাঁধ থেকে ভিজে গামছাটা নামিয়ে কেতাত্ত কর দিকিন, এইসব অত্যাচারেই, আর সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমিয়ে শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয়েছে। হবে না!

ওই, ওইখানেই তোমাদের সঙ্গে আমার মেলে না! ডাক্তার এসেও ওই কথাই বলবে, বিদ্যেবুদ্ধিতে মেয়েমানুষের সামিল কিনা। অথচ যার রোগ সে বলছে, না, ওই শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয়েছে ব’লেই সন্ধ্যে পর্যন্ত উঠতে পারি না। কিন্তু কে শোনে, নিজের কথাই পাঁচ কাহন। এইসব দেখে-শুনেই তো শেষ বয়সে হোমিওপ্যাথি বইটা কিনলাম। হ্যাঁ, একটা শাস্ত্র বটে! পাওয়া গেল বইটা? খোঁজ না, দেখি একবার কি ওষুধ বলে এমন অবস্থায়! খক-খক—থক–

কি! আবার তুমি ব’স তো তোমার সেই জগদ্দল বই আর মাকড়শার ডিম ভরা শিশি নিয়ে, কি কাণ্ডটা করি দেখ তো! বই গেছে, আপদ গেছে; রাজ্যির রোগ বিদেয় হয়েছে। থাকলেই পাতা ঘেঁটে মিলিয়ে মিলিয়ে হরেক রকম রোগ জড়ো করবে। আমার শরীরটাও তো ওই ক’রে পাড়বার চেষ্টা করেছিলে।

শিবু খুড়ো চুপ করিয়া গেলেন। বুকটা চাপিয়া খুব জোরে কয়েকবার কাশিয়া বলিলেন, হু-হু ক’রে বেড়ে চলেছে। এইখানটায় যেন একটা ব্যাথাও উঠছে ব’লে বোধ হচ্ছে।

রাঙাখুড়ী দৃঢ়স্বরে বলিলেন, তা হ’লে নবীন ডাক্তার কাল এসে একবার দেখুক, কচি খোকার মত বায়নাক্কা চলবে না, এই ব’লে দিলাম।

আর নবীন ডাক্তার যদি তোমার মত এসে বলে, ও কিছু নয়, রাত্তিরবেলা ঘুমিয়ে একটু শ্লেষ্মা হয়েছে?

রাঙাখুড়ীর বিদ্রূপটুকু ধরিতে দেরি হইল না; অধর দংশন করিয়া বলিলেন, বটে। তাহার পর সহজভাবেই বলিলেন, তা হ’লে নিশ্চিন্দি হব, বুঝব, এ তোমার সেই চিরকেলে বুজরুকি।

তুমি নিশ্চিন্দি হবে আমি ম’লে-ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলিয়া ফেলিয়া কিন্তু খুড়ো আর সেখানে বসিতে সাহস করিলেন না; হুঁকা লইয়া হনহন করিয়া ঘরে ঢুকিয়া পড়িলেন। রাঙাখুড়ী ঝংকার দিয়া উঠিলেন, দেখ, বাড়তে বাড়তে মুখ বেড়েই যাচ্ছে। যত মনে করি, সামনে সাবিত্রীর বেরতোটা আসছে, কাজ কি কথা কয়ে; কিন্তু তোমার ইচ্ছে নয় যে, কেউ মুখ বুজে থাকে। বলি, মরার ভয় দেখাও কাকে গা? ‘ম’লেই নিশ্চিন্দি হও’। হ্যাঁ, হইই তো; এস, এইবার মুখ খুলেছে, আজই মর না—ওঃ, বড় সুখের সংসার, বড় সোহাগের সোয়ামী! আমার আবার ঘটা ক’রে সাবিত্রীর বেরতো, ঢাক পিটিয়ে লোক-হাসানো! যম কোন্ সাহসে তোমায় নেবে? তারও গেরস্তর ঘর, একেবারে উস্তম-কুস্তম হয়ে যাবে না। ভাবলাম, বেরতোটা আসছে, ক্রমাগতই ঘাটের রুগীর মত খক খক করবে কেন, দেখুক ডাক্তার একবার। ও-ম্মা!

.

তাহার পরদিন বিকালে রাঙাখুড়ী ঘুঁটে দেওয়ার জন্য গোবরের তাল মাখিতেছিলেন এবং মাঝে মাঝে বাম হাতে আঁচল ধরিয়া চক্ষু মুছিতেছিলেন, এমন সময় নবীন ডাক্তার অসিয়া উপস্থিত হইল, বলিল, কি রাঙাখুড়ী, খুড়ো আবার কি হিড়িক লাগিয়েছে?

খুড়ী বাম হাতের উলট। ঠিক দিয়। মাথার কাপড়টা ঠিক করিয়া লইলেন, কহিলেন, কে জানে বাপু, কাল বিকেল থেকে তো কাশতে আরম্ভ করেছেন, আর ক্রমাগতই ‘এবার আর ব্রতর যোগাড় ক’রে কি হবে’ এই বুলি। রোগ আছে কি নেই, শুধু মনের সন্দোতে এ রকম গাল-পাড়া কার সহ্যি হয় বল তো বাছা? তাই অভিরামকে বললাম, নবীনকে একবার আসতে বলিস। যাও, দেখ একবার।

নবীন ডাক্তার ভিতরে গিয়া ডাকিল, খুড়ো, কোথায় আছ গো?

এই যে ভাই, এস, হঠাৎ কি মনে ক’রে?—বলিয়া শিবু খুড়ো রকে আসিয়া দাঁড়াইলেন। আর যে যাহাই করুক, তিনি কাহাকেও সম্পর্কবিরুদ্ধ সম্ভাষণ করেন না।

প্রশ্ন শুনিয়া নবীন একটু থতমত খাইয়া গেল। কিন্তু খুড়োকে সে কিছু আজই দেখিতেছে না। সে ভাবটা সামলাইয়া গিয়া বলিল, না। এই এদিক দিয়ে একবার পালেদের ওখানে যাচ্ছিলাম, রাঙাখুড়ী বললেন, তোমার নাকি একটু কাশি হচ্ছে কাল থেকে, তাই—

কাশি!—বলিয়া খুড়ো যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। আর তুমি এত বড় ডাক্তার হয়ে সেটা বিশ্বাস করে নিলে? আমার কখনও অসুখ হতে দেখেছ তোমরা?

নবীন ডাক্তার মনে মনে হাসিয়া বলিল, না, অমন নীরোগ শরীর তো দেখাই যায় না। আমি রাঙাখুড়ীকে সেই কথাই তো বলছিলাম। বললেন, তবুও তুই একবার দেখে আয় বাপু; বাজে খকখকানি শুনে শুনে আমার পিত্তি জ্ব’লে খাক হয়ে যাচ্ছে।

খুড়ো অত্যন্ত বিরক্তভাবে মুখটা একটু কুঁচকাইয়া রহিলেন; বলিলেন, না না, ওসব মেয়েলী কথায় কান দিও না। আমার আবার অসুখ! আর অসুখ হলেই বা করি কি বল—সংসারে কে কার?

সে কি কথা খুড়ো? তবে হ্যাঁ, রাঙাখুড়ীর আবার একটু রোগবাই আছে—মেয়েমানুষ কিনা। আচ্ছা তবে আসি।—বলিয়া নবীন বাহির হইয়া যাইতেছিল, খুড়ো খক খক করিয়া দুইবার কাশিলেন। নবীনের ঠোঁটে একটু চটুল হাসি দেখা দিল, পিছন ফিরিয়া যাইতেছিল বলিয়া খুড়ো সেটা দেখিতে পাইলেন না। দাঁড়ায় না দেখিয়া খুড়ো আরও জোরে তিন- চারবার কাশিলেন, এবং তাহাতেও ফল হইল না দেখিয়া অস্ফুটস্বরে ডাক্তারকে ‘হারামজাদা, বদমায়েস’ বলিয়া প্রকাশ্যে কহিলেন, এই রকম এক-আধবার কাশছিলাম, কি রকম বোধ হচ্ছে বল তো? তোমার কানটা এই বয়সেই যায় বুঝি, একটু নজর রেখো।

নবীন হাসি সামলাইয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। বলিল, খুব সহজ কাশি খুড়ো; না ব’লে দিলে কানেই লাগে না, এর জন্যে রাঙাখুড়ী যে কেন ভেবে মরছেন—

আচ্ছা, যখন এসেছ, দেখবে তো একবার দেখে নাও তোমার সেই আদাড়ে যন্ত্রটা নিয়ে—কেন যে ওগুলো ব্যবহার কর তোমরা, বুঝতে পারি না।

নবীন আর একটা হাসি কোনমতে চাপিয়া বলিল, তা হ’লে চল একবার ঘরে।

খুড়োকে বিছানায় শোয়াইয়া নবীন স্টেথোস্কোপ দিয়া বুক পিঠ চারিদিক পরীক্ষা করিল! দুষ্টামি করিয়া সত্য কথাটাই বলিল, দেখছি, তোমার কথাই ঠিক খুড়ো; হার্টের অ্যাকশন দিব্যি চলছে, কোনও দোষ নেই বুকে।—বলিয়া নিশ্চিন্তভাবে স্টেথোস্কোপটা গুটাইয়া-সুটাইয়া পকেটে পুরিল।

কুড়ো শুইয়া শুইয়াই দুই-তিনবার কাশিলেন, তাহার পর অনেক দিনের রুগীর মত নাক-মুখ সিঁটকাইয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন। একটুখানি চুপ করিয়া একবার পকেটের যন্ত্রটার দিকে কটাক্ষ করিয়া কহিলেন, কত দিয়ে কিনেছিলে?

তেরো টাকা দিয়ে।

একে জিনিসগুলোই ভুয়ো, তারপর আবার সস্তার মাল; ডবল নিউমোনিয়া হ’লে ওতে কিছু সাড়া পাও? আমার যেন মনে হচ্ছে, বুকে হয়েছে একটা কিছু।—তা থাক্‌ ও তোমাদের কর্ম নয়, একবার অমর্ত কবরেজকে ডাকতে হচ্ছে। তাদের এসব ভড়ং-টড়ং নেই, নাড়ী দেখেই ধ’রে দেবে’খন।

কাকে ডাকতে হচ্ছে?—বলিয়া হাতের আঙুলের গোবর পরিষ্কার করিতে করিতে রাঙাখুড়ী আসিয়া দরজায় দাঁড়াইয়া উগ্র শাসনের স্বরে বলিলেন, নবীন যা বলে, তাই হবে; অন্য কবরেজ-বদ্যি বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে পাবে না, এই ব’লে দিলাম!—বলিয়া ত্রিসীমানার নিশানা-স্বরূপ দেওয়ালে একটা গোবরের বৃত্তাংশ টানিয়া, তাঁহার বিধান সম্বন্ধে রোগীর মতামত জানিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিলেন।

বলা বাহুল্য, রোগী কোন মতামত দিল না। রাঙাখুড়ী ডাক্তারের দিকে চাহিয়া প্ৰশ্ন করিলেন, কি রকম দেখলে বাবা? সত্যি, না আমার হাড়-জ্বালানো বুজরুকি? আমার তো মনে হয়, এতটুকুকে এতখানি করা হচ্ছে।

খুড়ো দুইবার জোরে কাশিয়া হাঁপাইয়া বলিলেন, না, বুজরুকি, দেখতে পাচ্ছ না?— বলিয়া বুকটা চাপিয়া, অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া আবার কাশিলেন।

ডাক্তার রাঙাখুড়ীরই সমর্থন করিয়া বলিল, সামান্য একটু যেন সর্দি হয়েছে ওপরে ওপরে। একটা ওষুধ দিচ্ছি; কাশিটা শুকনো না থেকে নরম হয়ে যাবে’খন।

হ্যাঁ, দাওখ’ন। আমার মিছিমিছি ঢঙ অসহ্যি, চোপোর দিন মিছামিছি গালাগালও অসহ্যি। কেন গা, কিসের জন্যে?

ডাক্তার একটা প্রেসক্রিপশন লিখিয়া দিয়া বলিল, এইটে দুবার ক’রে খেও। আর খুড়ো, তামাকটা একটু কমাও এ কটা দিন, তার পরে তো আছেই।

শিবু খুড়োর পিত্তি জ্বলিয়া যাইতেছিল, বলিলেন, হ্যাঁ, তোমার হাত থেকে বেরিয়ে আবার আমি বেঁচে থাকলে, তবে তো? সাবিত্রীর কাজ অনেক সোজা ছিল, তাকে তো আর তোমাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয় নি। যমকে ঠেকানো অনেক সোজা।

খুড়ী গর্জিয়া উঠিলেন, দেখ! তাহার পর বাঁ হাতে নবীনের হাতটা খপ করিয়া ধরিয়া বলিলেন, ওঠ, এক্ষুনি ওঠ; এ পাপপুরীতে এসে মিছিমিছি গাল খেয়ে মরছ গা! ওর কি কিছু হিতাহিত-জ্ঞান আছে? চোখের একটু পরদা আছে? মরবার সাধ হয়েছে তো মরুক, ওইখানে প’চে গ’লে মরুক; কার ব’য়ে গেছে? বেরতো নিয়ে কথায় কথায় এত ঠেস দেওয়া কিসের? আহা, ভারি আমার সত্যবানের মত সোয়ামী, সোয়াগ ক’রে সাবিত্রীর বেরতো করতে বসেছি! মুয়ে আগুন আমার, মুয়ে আগুন আমার বেরতোর, আর মুয়ে আগুন তার, যে—

খুড়ো রাঙাখুড়ীর দিকে চাহিয়া খক-খক করিয়া তিনবার কাশিলেন। ডাক্তার বলিল, আর থাক্ খুড়ী; ওষুধটা যেন খাওয়ানো হয় ঠিক রকম।

.

শিশির ঔষধ কয়েক দাগ শেষ হইয়াছে। খুড়ো যে সেবনের দ্বারাই শেষ করিয়াছেন, রাঙাখুড়ী এ কথা বিশ্বাস করেন না। সর্দিটা আরও একটু বাড়িয়াছে। খুড়ি বলিতেছেন, নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে কুপথ্যি করেছ, কোনও গুণে তো ঘাট নেই।

খুড়ো বলিতেছেন, অ্যালোপ্যাথি ওষুধটাই একটা মস্ত বড় কুপথ্যি যে।

খুড়ী বলিলেন, কিংবা বোধ হয় দাগের দাগ ঢেলে নিয়ে ফেলে দিচ্ছ; তুমি সেও পার।

খুড়ো উত্তর দিলেন, তা যে করিনি, তার প্রমাণ অসুখটা বেড়ে গেছে, কমে নি।

খুড়ী রাঁধিতেছিলেন। আর কিছু না বলিয়া কড়াটাতে খুন্তির গোটাকতক ক্রুদ্ধ ঘা দিয়া অস্বাভাবিক ক্ষিপ্ততার সহিত হাতটা ধুইয়া ফেলিলেন। ঘর হইতে শিশিটা বাহির করিয়া ক্রোধকম্পিত হস্তে হড়হড় করিয়া খানিকটা ঔষধ গেলাসে ঢালিয়া কৃত্রিম শান্ত স্বরে বলিলেন, খেয়ে ফেল।

খুড়ো অকৃত্রিম শান্ত ও করুণ স্বরে বলিলেন, প্রায় আড়াই দাগ যে!

রাঙাখুড়ী ঝংকার দিয়া উঠিলেন, হ্যাঁ, দেখেছি আড়াই দাগ। অনেক দেখে দেখে চোখ দুটো ক্ষ’য়ে গেছে বটে, কিন্তু কানা হই নি একেবারে। নাও। নেবে? না—

খুড়ো ভয়ে ভয়ে বলিলেন, এই দাও না; আমি শুধু বলছিলাম, পুরো তিন দাগ ক’রে দিলে হ’ত না? হিসেব ঠিক থাকত।—বলিয়া, একটু মুখ বিকৃত না করিয়া ভাল ছেলের মত দুই দাগ ঔষধ গিলিয়া ফেলিলেন; তাহার পর আবার কহিলেন, নবীন নেহাত মন্দ ডাক্তার হয় নি, কি বল? খক-খক-খক—একটু যেন বেড়েছে আজ।

রাঙাখুড়ী বলিলেন, মন্দ হতে যাবে? এমন নামডাক বেরিয়েছে কি অমনই?

হুঁ। তবে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কিনা, রোগ সারাতে পারে না, এই যা। তা সে তো আর ও-বেচারীর দোষ না। এই দেখ না, সর্দিটা বেড়ে গেছে, বললাম; তা বললে, আয়োডাইড দিয়েছি কিনা, সর্দিটাকে নরম করবে একটু। অথচ আমি জানি, আসলে তা ব্যাপার নয়। তুমি দেখছি বড় অত্যাচার কর নিজের শরীরের ওপর; এখনও স্নান করনি বুঝি? আবার সামনে অমন পাহাড়-পানা ব্রতটা আসছে।

রাঙাখুড়ীর মেজাজ জল হইয়া গেল; বলিলেন, নাও, তুমি সুভালয় ভালয় সেরে ওঠ বাপু, তখন আমার বেরতো আর অর্চা।

তুমি পড়লেও তো আমার মনেও এই কথাই হবে? না, ছেলেমানুষি রাখ; আগে নেয়ে নাওগে। কদিনে যেন আধখানা হয়ে গেছ।

যাই; হ্যাঁ কি বলছিলে? সর্দিটা কেন বেড়েছে?

নবীন তো বলছে, আয়োডাইড দিয়েছি, তাই একটু নরম হয়েছে সর্দিটা। অথচ আমি জানি, কি ব্যাপার; কাল অমাবস্যা গেল, তাই একটু রসবৃদ্ধি হয়েছে। এসব কথা কবরেজ হ’লে সট ক’রে ধ’রে ফেলত। শাস্ত্র তো কবিরাজি, নাড়ীটি টিপলে, তারপর অনর্গল রোগের কুলুজি আওড়ে গেল; আর দ্বিতীয় কথাটি—না, আমি অমর্ত কবরেজকে ডাকতে বলছি না; তবে শত্রুরও যশ গাইতে হয়।

তোমার কবরেজকে যদি বিশ্বাস হয় তো না-ডাকবেই বা কেন? আগে বললেই হ’ত। সত্যিই তো বাপু, রোগ কোথায় কমবে, না বেড়েই যাচ্ছে। অথচ প্রায় আড়াই দাগ ওষুধ একসঙ্গে দিব্যি খেয়ে ফেললে। তুমি আমায় বল, অথচ নিজের শরীর সম্বন্ধে তোমারই নিজের কোন চাড় নেই; তা হক কথা বলব বাপু, হ্যাঁ!

যাঃ, মাছ চড়িয়ে এসেছিলে বুঝি? গেল বুঝি পুড়ে! ওই তো একমুঠো খাওয়া তোমার, তাতে মাছটা গেল পুড়ে! একবার নয় দেখব জেলেপাড়ায়?

না, তোমার আর অসুক-গায়ে বেরুতে হবে না। ঠাকুর দয়া ক’রে আমার পোড়া মাছটুকুই জন্ম জন্ম বজায় রেখে যান—এই ভিক্ষে (চক্ষে অঞ্চল দিলেন)। তোমার সাবুটুকু আগে দিই, তবে নাইব। তা হলে বাপু, আসুক অমর্ত কবরেজ একবার; ও আদাড়ে ওষুধ আর খেয়ে কাজ নেই। কি যে আমার অদিষ্টে আছে, মা সতীরাণীই জানেন।

দিনটা বেশ অভঙ্গ শান্তিতে কাটিল। রাঙাখুড়ী ক্রমাগতই খুড়োর চিকিৎসা সম্বন্ধে অভিমতে সায় দিয়া গেলেন, এবং খুড়ো সকরুণ কাশি এবং তাঁহার প্রতি চিকিৎসা-জগতের নিদারুণ কাহিনীর দ্বারা খুড়ীর করুণা উদ্বেগ করিয়া গেলেন। সন্ধ্যার দিকে খুড়ো মনের শান্তিতে বিছানায় শুইয়া শুইয়া তামাক টানিতেছিলেন, বাহিরে অমৃত কবিরাজের গলা শোনা গেল, খুড়ো!

খুড়ো আপনি আপনি বলিলেন, বাব্বা! খবর পেয়েছে, কি ছুটেছে, কেউ তো আর ডাকে না ওদের। এক গেলেন তো এক জ্বালাতে এলেন। ডাকিলেন, এই যে, এস। তাহার পর র‍্যাপারটা টানিয়া লইয়া বিরক্তভাবে পাশ ফিরিয়া শুইলেন।

অমৃত কবিরাজ ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, রাঙাখুড়ী ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কি, অসুখটা কি?

খুড়োর কাশি আসিতেছিল, প্রাণপণে চাপিয়া সেইরূপ অবস্থাতেই বাঁ হাতটা বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, দেখই না বাপু; তোমাদের তো আবার সেই গুমরটুকু ষোল আনা আছে যে, নাড়ী দেখেই হাঁড়ির খবর পর্যন্ত ব’লে দিতে পার। আমায় আর তবে বকাও কেন; একে কোমরের বেদনায় মরছি—

অমৃত কবিরাজ বাড়িটার সহিত খুব পরিচিত ছিল, একবার চারিদিকে চাহিয়া বলিল, রাঙাখুড়ী গেলেন কোথায়?

অসুখ তার নয়, আমার। বলিয়া খুড়ো উঠিয়া বসিয়া খক খক করিয়া কাশিয়া বলিলেন, কোমরে ব্যথা হয়েছে শুয়ে শুয়ে; কদিন থেকে সর্দিতে ভুগছি, নবীন ডাক্তার অত বড় অ্যালোপ্যাথ, সে-ই হার মেনে গেল তো তোমাদের গাছগাছড়ায় কি করবে বল? বাঁ হাত, না ডান হাত দেখবে?”

কবিরাজ বিনাবাক্যব্যয়ে খুড়োর বাঁ হাতটা তুলিয়া লইয়া দেখিতে লাগিল, একটু পরে মাথা নাড়িয়া বলিল, হুঁ, দুটো দিন উপোস দিতে পার?

খুড়ো বিরক্তভাবে চাহিয়া বলিলেন, কেন, দিনান্তে ছটাক খানেক যে সাবু খাচ্ছি, সেটা কি ভূরিভোজন হয়ে যাচ্ছে নাকি? বলতো তাও বন্ধ ক’রে দিই; তোমাদের আশ মেটে, গিন্নিরও আমার জন্যে বাজে মেহন্নৎ একেবারে জন্মের মত কমে যায়। না বাপু, তোমাদের এ কর্ম নয়। গিন্নীকে একশো বার বললাম, ওগো, এ কালরোগে ধরেছে। একটু শান্তিস্বস্ত্যয়ন কর, কে শোনে? একবার কবিরাজিটা দেখই না! আরে বাপু কবিরাজি তো তুমিও করতে পার। ক্রমাগত মাসখানেক ধ’রে উপোস করাও আর জোলাপ দাও—উপোস করাও আর জোলাপ—

খুড়ী আধা-ঘোমটা টানিয়া দুয়ারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন, খাটের দিকে চাহিয়া কবিরাজকে প্রশ্ন করিলেন, কি রকম দেখা হ’ল?

তেমন কিছু নয়; একটা উপোস দিলেই শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যাবে; একটা বড়িও দিয়ে যাচ্ছি। খুড়ো কিন্তু উপোসের নামে—

খুড়ো তাড়াতাড়ি জুড়িয়া দিলেন, মহাখুশি। তা তোমার খুড়ীও জানেন, উপোস পেলে আমি রাজত্ব চাই না, অমন জিনিস আছে?—বলিয়া কথা যাহাতে না বাড়ানো হয় সেজন্য অমৃত কবিরাজের দিকে মিনতির দৃষ্টিতে চাহিলেন।

খুড়ী দেওয়ালের দিকে চাহিয়া বলিলেন, খাওয়া তো কিছুই নেই; এক চুমুক ক’রে সাবু খান; এর ওপর আবার উপোস: আমি তো বলছিলাম, শুকনো শুকনো কিছু যদি একটু খেতে দিতে—। শরীরে কিছু নেই ভুগে ভুগে, দুনিয়ার অরুচি।

অমৃত কবিরাজ মনে মনে বলিল, তোমাদের অন্ত পাওয়া দায়। প্রকাশ্যে কহিল, তা উপোস যে নেহাতই দরকার, তেমন কিছু নয়। ঘি মরিচ দিয়ে দুটো চিড়েভাজা খেতে পারেন। কিংবা খুড়ো, কি খেতে মন যায় বল দিকিন?

খুড়ো উৎফুল্লভাবে ‘গরম গরম’ বলিয়া আরম্ভ করিতে যাইতেছিলেন, খুড়ী বলিয়া উঠিলেন, পোড়া কপাল আমার, উনি এক্ষুনি ব’লে বসবেন, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মিছরি আর নেবুর শরবৎ হ’লে ভাল হয়। আর মেলা লোভ বাড়িয়ে কাজ নেই। অভিরামকে সঙ্গে দিচ্ছি, ওষুধটা তা হ’লে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

খুড়ো ভগ্নোৎসাহ হইয়া করুণভাবে কয়েকবার কাশিলেন। ‘গরম গরম’ কি তাহা আর প্রকাশ করিয়া বলিবার সাহস হইল না, কবিরাজ চলিয়া গেলে রাঙাখুড়ীর মন যোগাইবার জন্য বলিলেন, ভাগ্যিস তুমি ছিলে, নইলে উপোস করিয়েই আমার দফা—

খুড়ী কিঞ্চিৎ উষ্মার সহিত বলিলেন, কেন, উপোসটা কি খারাপ জিনিস, না, ডাক্তার- বদ্যিরা মুখ্যু?

খুড়ো থতমত খাইয়া বলিলেন, না, উপোস জিনিসটা তো খুবই ভাল; আমিও তো—

খুড়ী আরও একটু রাগিয়া বলিলেন, ভাল ব’লে কি তোমার এই কাহিল শরীরে এখন শোভা পায়?

খুড়ো ধাঁধার মধ্যে পড়িয়া ‘না—সে আমি—তোমার গিয়ে’, করিতেছিলেন। ধমক দিয়া খুড়ী বলিলেন, আর থাম বাপু, জ্বালিও না।

খুড়ো চুপ করিয়া রহিলেন, একটু পরে বলিলেন, হোমিওপ্যাথির সেই বইটা পাওয়া গেল?

খুড়ী বিছানাটা গুছাইতেছিলেন, গম্ভীরভাবে বলিলেন, গেল।

এ ‘গেল’র অর্থ বুঝিতে খুড়োর বাকি রহিল না। আরও খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেন, শাস্ত্রটা উঁচুদরের; ওটা বের করতে কত লোক যে প্রাণপাত করেছে—

খুড়ী সোজা হইয়া দাঁড়াইলেন; তাহার পর স্থির কণ্ঠে বলিলেন, তা হ’লে আসল কথাটা বলব? তোমার মত হাজার লোকেও প্রাণপাত করলে সে শাস্তোর আর বের করতে পারবে না, তাকে অনেক দিন উনুনে পুড়িয়ে ছাই ক’রে দিয়েছি।

.

ভগবানের ‘চিড়িয়াখানা’য় এক প্রকৃতির মানুষ আছে, যাহারা অসন্তুষ্ট থাকিলেই ভাল থাকে। পৃথিবীর সর্বপ্রকার শুভ-অশুভ, সর্বপ্রকার আনন্দ-উৎসবের দিকে তাহারা সমানভাবে নাসিকা কুঁচকাইয়া সারাটা জীবন যদি কাটাইয়া দিতে পারে, তাহা হইলেই ভাবে, সার্থকতার চরম হইল। প্রকৃতি দেবী তাঁহার এই রকম খুঁতখুঁতে সন্তানদের লইয়া একটু বিব্রত হইয়া পড়েন এবং সাধ্যমত তাহাদের কাছে বিশেষ করিয়া সুখের এবং স্বস্তির সরঞ্জাম আগাইয়া দিয়া মন যোগাইবার চেষ্টায় থাকেন; কিন্তু ফল হয় ঠিক উলটা। তাহারা নিজের মনের তিক্তরসে সব জিনিসই জরাইয়া লইয়া মুখটা চিরকালই বিকৃত করিয়া থাকে। মাঝে পড়িয়া বিশ্ব-সংসারের আনন্দ-উপকরণের খানিকটা অপচয় ঘটে মাত্র। স্নেহান্ধ সকল মায়ের মতই প্রকৃতি মায়ের এ ভুলটা রহিয়াই গেল।

আমাদের খুড়ো ঠিক এই প্রকৃতির লোক। কিছুরই অপ্রতুল নাই অথচ অসন্তোষের সীমা নাই। খুড়োর কাণ্ডকারখানা দেখিলে এই রকমই মনে হয় যে, বিধাতার ভাল-মন্দ সমস্ত বন্দোবস্তই নিরপেক্ষভাবে পণ্ড করিবার অভিসন্ধি লইয়াই তাঁহার জীবন। সব ছাড়িয়া তাঁহার এই শরীরের কথাই ধরা যাক না। অসুস্থ কথাটা যেমন কেহই পছন্দ করে না সেই রকম তিনিও করেন না; কিন্তু সুস্থ থাকিলে আরও চটিয়া যান। এইজন্য, যেমন অষ্টপ্রহর ডাক্তার- বৈদ্য না হইলে চলে না, সেই সঙ্গে ইহাও সমানভাবে সত্য যে, ডাক্তার-বৈদ্য দেখিলেই তাঁহার আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠে এবং কথায় কথায় তাদের অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করিবার জন্য সজাগ থাকেন। শুধু বাক্যের দ্বারাই নহে, কায়মনের দ্বারাও, অর্থাৎ প্রায়ই নিজের বিবেক এবং কখন কখন নিজের স্বাস্থ্য বলি দিয়াও—

আসলে কোন রোগই ছিল না খুড়োর, শখের কাশি কাশিয়া যাইতেছিলেন। রাঙাখুড়ী যে সেই আড়াই দাগ ঔষধ খাওয়াইয়া দিলেন, সেই হইতে একটা কাশি হইয়াছিল। কবিরাজী ঔষধ খাইয়া সেটুকুও সারিয়া গেল। অবশ্য কাশি সেই রকমই চলিয়াছে আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে কবিরাজির নিন্দা। খুড়ী থাকিলে বাড়ে, কাশির জ্বালায় তিনি তো পালাই পালাই ডাক ছাড়িয়াছেন।

বিকালবেলা রাঙাখুড়ী বাহিরে গিয়াছেন, ফিরিতে অনেকক্ষণ লাগিবে। খুড়ো সুস্থ শরীরে নিশ্চিন্ত মনে কাশি-টাশি বন্ধ করিয়া ঘরে বসিয়া তামাক টানিতেছেন এবং টানের ফাঁকে ফাঁকে কখনও নীচু গলায়, কখনও বা ভাবের আধিক্যে গলা উঁচু করিযা দেহতত্ত্ববিষয়ক একটা রামপ্রসাদী গাহিয়া যাইতেছেন। অমৃত কবিরাজ আসিয়া উঠানে দাঁড়াইল। রাঙাখুড়ী আছ নাকি?—বলিয়া একটা হাঁক দিতে যাইতেছিল, কিন্তু খুড়োর অসমসাহসিক গান শুনিয়া বুঝিল, খুড়ী বাড়ি নাই। অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া কান পাতিয়া শুনিল, তাহার পর নিঃশব্দে দুয়ার পর্যন্ত গিয়া হঠাৎ একেবারে সামনাসামনি হইয়া কহিল, এই যে, খুড়ো, ভাল আছ দেখছি, কাশিটা তো একেবারেই নেই।

পরাজয়ের ক্ষোভে খুড়োর প্রথমটা বাক্যস্ফুর্তি হইল না। মূঢ়ের মতো একটু চাহিয়া সামলাইয়া লইবার জন্য একবার কাশিয়া লইয়া বলিলেন, হ্যাঁ, তোমার গিয়ে একটু যেন আজ—

কবিরাজ শেষ করিতে না দিয়াই বলিল, না, একটু কেন? বেশই ভাল আছ। আমি এই প্রায় আধ ঘণ্টার ওপর এসে বাড়িতে বসে আছি কিনা; ভাবলাম, সাড়াশব্দ নেই, এরা সব কোথাও গেছেন নিশ্চয়, একটু ব’সে যাই। তা কই, অত যে কাশি ছিল তোমার, একবারও তো শুনতে পেলাম না; কেউ ফিরছে না দেখে উঠছিলাম, এমন সময় তোমার গান কানে গেল, দিব্যি শ্লেষ্মালেশহীন গলা!

খুড়োর নিজের এই অসতর্কতার জন্য আত্মধিক্কারে মনটা ভরিয়া গিয়া মুখটা বিকৃত হইয়া গেল।

তখন ভাবলাম, বাবা, গঙ্গাধর সেনের নিজের বিধান মিলিয়ে তোয়ের করা ওষুধ, এর আর নড়চড় হবার জো আছে!

খুড়ো মুখটা নামাইয়া শুনিতেছিলেন; কুটিল আড়চোখে একবার দেখিয়া আবার চক্ষু নামাইয়া লইলেন; শুধু বলিলেন, হুঁ, তা একদিনের ফলে কিছু বোঝা যায় না, কালও একবার এস।

দরকার হবে না, রোগের গোড়া মেরে ফেলেছি খুড়ো, গঙ্গাধর সেনের নিজের গড়া সূত্র—শ্লেষ্মায়াং পিত্তযুক্তায়াং’—সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি একেবারে। আর আমায় প্রাণের চেয়েও ভালবাসতেন কিনা, ‘অমৃত’ নাম নিতে অজ্ঞান হতেন।

খুড়ো মুখ টিপিয়া একটু মাথা নাড়িলেন। নাম নিতে অজ্ঞান হতেন! আর মলেন বুঝি হাতের ওষুধ খেয়ে? যাক, তুমি কাল একবার এস। কাশিটা হঠাৎ চাপা পড়ল, আমি তেমন ভাল বুঝছি না, বোধ হয় চিকিৎসার কোন দোষ হয়েছে।

তা নয়, আসব’খন একবার বেড়াতে বেড়াতে। আজ রাত্তিরটা একটু সাবধানে থেকো।

খুড়ো একটু শ্লেষের হাসি হাসিয়া বলিলেন, এত বড়াইয়ের পর তেরাত্তিরের ভয় ঢুকল নাকি? তোমাদের কবিরাজিকে চিনতে পারলাম না দাদা।

অমৃত কবিরাজ হাসিয়া জবাব দিল, আমাদের কবিরাজি কিন্তু তোমাকে—এই গিয়ে, তোমার অসুখকে টপ ক’রে চিনে ফেলেছে খুড়ো। কেমন, নয়? আচ্ছা, আসি।

খুড়ো বলিলেন, এস। কবিরাজ পিছন ফিরিলে, চাপা গলায় বলিলেন, বেটা গোয়েন্দা কোথাকার! আচ্ছা র’স, জান কবুল।

তাহার পর অসাবধান নিজেকে এবং দাম্ভিক গঙ্গাধর-শিষ্যদের জব্দ করিবার জন্য উঠিলেন। ভাঁড়ার-ঘরের তাকে একটা বড় বাটিতে একটি বাটি দই ছিল; তাহার প্রায় অর্ধেকটা সাবাড় করিয়া, বেড়াল গিয়া যাহাতে তাহার কীর্তি ঢাকা দিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে দুয়ারটা খুলিয়া রাখিয়া বাহিরে আসিলেন। তাহার পর তামাক সাজিয়া, আর যাহাতে ভুল না হইয়া যায় সেই মতলবে, হুঁকায় মুখ দিয়া সুদে-আসলে কাশি শুরু করিয়া দিলেন।

খানিক বাদে রাঙাখুড়ী ফিরিলেন, প্রশ্ন করিলেন, কি বললে অমর্ত কবরেজ?

খুড়ো খুব জোরে কাশিতে কাশিতে ভাঙা ভাঙা কথায় বলিলেন, কাশির আওয়াজ শুনতেই পেলে না।

খুড়ী কিছু বুঝিতে না পারিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন। তাহার পরেই রান্নাঘরের খোলা দোরে চক্ষু পড়িল, ওই গো, সব্বনাশ হয়েছে!—বলিয়া ছুটিলেন।

দইয়ের ছত্রাকার! বিড়ালটা ইতিমধ্যে কখন আসিয়া বাটি ফেলিয়া দই ছড়াইয়া খুড়োর দোষ নিশ্চিহ্ন করিয়া মুছিয়া দিয়া গিয়াছে।

খুড়ো হুঁকায় দুইটা টান দিয়া বারচারেক কাশিয়া নির্লিপ্তভাবে একবার চাহিয়া বলিলেন, দোরটা বুঝি খুলে রেখে গিয়েছিলে? তা বেড়ালের তো আর সর্দি হয় নি যে, কবরেজের শাসন মানবে—

আর শেষ করিতে হইল না; খুড়ী রান্নাঘরের বাহিরে আসিয়া দুইটা হাত ঝাঁকিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন, আর তুমি কোন্ চুলোয় ছিলে? একটা বেড়াল তাড়িয়েও উবগার জীবনে হ’ল না? কি কাজে এলে? কোথায় গেল অলপ্পেয়ে বেড়াল? মুয়ে আগুন, মুয়ে আগুন। পেলে একবার দই খাওয়ার শখটা জন্মের মত ঘুচিয়ে দিই—পাড়ার আবাগীরা বেড়াল পুষেছে—নিজেদের পেটে খুদ জোটে না, বেড়ালের দই-ক্ষীর চাই, যে মুখে দই খেয়েছে, সে মুখে নুড়ো জ্বালব, তবে

খুড়ো দই-খাওয়া মুখের সম্বন্ধে এ রকম উৎকট গালাগালি আর সহ্য করিতে না পারিয়া সদয়ভাবে বলিলেন, আর থাকগে—আহা, ষষ্ঠীর বাহন—

খুড়ি আরও ঝাঁজিয়া উঠিলেন, হক-কথা বলতে ডরি না, বলি আমার আবার ষষ্ঠীর বাহন কি গো? একটাও পেটে ধরলাম? ভারি আমার ষষ্ঠী। তাঁর বাহনকে আবার সোহাগ ক’রে দই-সন্দেশ খাওয়াতে হবে! ভাগাড়ে দোব না অমন দই-খেকো—

খুড়োর মুখে তখনও দইয়ের স্বাদ লাগিয়া রহিয়াছে; আর সহ্য করিতে না পারিয়া রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, তোমার আবার সাবিত্রী-ব্রত কেন গা? এ গালগুলো কি আমার ওপর পড়বে না?

রাঙাখুড়ী একেবারে থ হইয়া গেলেন; চোখ-মুখ কপালে তুলিয়া ঠাণ্ডা আওয়াজে প্ৰশ্ন করিলেন, তোমার ওপর পড়বে! কেন শুনি?

খুড়ো সেই মেজাজেই বলিলেন, পড়বে বইকি, একশো বার পড়বে—

রাঙাখুড়ী অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।

আমার দোষেই যদি দই খেয়ে গিয়ে থাকে তো বেড়ালের মুখে আগুন দেওয়ার মানেটা কি? তাকে ভাগাড়ে দিলে কে ভাগাড়ে গেল! আমি কি ঘাস খাই! এটুকু আর বুঝতে পারব না? ভাগাড়ে তো গিয়েই আছি—অষ্টপ্রহর গালমন্দ খেয়ে আর শরীরে খক-খক-খক—শরীরে আছে কী?—সাবিত্রী-ব্রতর এইবার তো উদ্যাপন? যম আসবে, আর দুজনায় ছেঁড়া-ছেঁড়ি পড়ে যাবে—

রাঙাখুড়ী একদৃষ্টে চাহিয়া শেষকালে বলিলেন, এই তো? বলি, এই তো? আচ্ছা, রইল এ সংসার! আবার যদি ও সংসারের কোন কথায় থাকি তো আমার অতি বড় কোটি দিব্যি। উড়ে যাক পুড়ে যাক, যা কিছু হোক!—বলিতে বলিতে রান্নাঘরে আঁচল বিছাইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া বর্তমান ঘটনার সহিত নিঃসম্পর্ক নানা কথা তুলিয়া কান্না শুরু করিয়া দিলেন।

.

খুড়োকে আজ আর জোর করিয়া কাশিতে হইতেছে না—দই যেন কথা শুনিয়াছে। কাশির চোটে রাঙাখুড়ী ত্যক্তবিরক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। খুড়োর মনটা খুবই প্রসন্ন। কথা কাটাকাটি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। খুড়ী বলিয়াছিলেন, যত ডাক্তার-বদ্যি দেখছে, ততই কি তোমার রোগ বেড়ে যাচ্ছে? পেঁচার সবই উলটো?

খুড়ো উত্তর দিয়াছিলেন, সাবিত্রী-ব্রতের আগে সোয়ামী করবার কথা কিনা—একের পর এক যমদূত আসছে।

রাঙাখুড়ী কাজের মধ্যে হঠাৎ থামিয়া ‘কি’! বলিয়া তাঁহার সুদীর্ঘ মন্তব্যের সূচনা করিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় বাহিরে আওয়াজ হইল, খুড়ো!

এই যে, এস। নাম করতেই হাজির। খুড়ীর দিকে একটু চাহিয়া লইয়া বলিলেন, অমর্ত কবরেজ। যমের সবচেয়ে হুঁশিয়ার চর কিনা।

কেমন আছ আজ?—বলিতে বলিতে অমৃত কবিরাজ ভিতরে প্রবেশ করিল।

খুড়ো কাশিতে কাশিতে বিজয়ের পৌরুষে বাঁ হাতটা বাড়াইয়া দিয়া কবিরাজের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। নাড়ী দেখিয়া অমৃত কবিরাজের ভূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। খুড়ো মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কি গো, গঙ্গাধর স্যানের সূত্র বলে কি? হুঁ হুঁ, আমি বললাম, এ রোগ সারানো তোমাদের কর্ম নয়, তা গঙ্গাধর স্যানই হোন, আর—

অমৃত কবিরাজ গুরুর নামের অমর্যাদা সহ্য করিতে না পারিয়া চটিয়া উঠিল, বলিল, নিশ্চয় কোন অনাচার হয়েছে, এই ব’লে দিলাম, নইলে যে ওষুধ—

খুড়ো বলিলেন, একটা বেড়ালে কাল রান্নাঘরে দই ছড়িয়ে আমার পা ঘেঁষে চ’লে গিয়েছিল, এই পর্যন্ত তো জানি—

কবিরাজ একটু মৌন থাকিয়া কি ভাবিল, তাহার পর দুই-তিনবার ‘তা হ’লে তা হ’লে, করিয়া হঠাৎ খুড়োর মুখের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, ‘আচ্ছা, দইটা খুব টক ছিল কি?

মনে খুব স্ফূর্তি থাকিলে লোকে একটু অসাবধান হইয়া পড়ে। খুড়ো সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়া ফেলিলেন, কই, না। এবং সঙ্গে সঙ্গে সামলাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন, সে আমি কি ক’রে জানব? বাঃ, এ যে তোমার অন্যায় প্রশ্ন দেখছি, কাকে যে কি মাথামুণ্ডু জিজ্ঞেস কর—

ইহার পরে এ বিষয়ে আর কোন কথা হইল না। কবিরাজ একবার রাঙাখুড়ীর দিকে চাহিয়া মুখ নীচু করিল, রাঙাখুড়ী একবার খুড়োর দিকে চাহিয়া মুখ নীচু করিলেন, আর খুড়ো কাহারও পানে না চাহিয়া মুখটা গোঁজ করিয়া রহিলেন।

একটু পরে কবিরাজ বলিল, তা হ’লে এখন ওই ওষুধটাই চলুক রাঙাখুড়ী। ভাল হয়ে যাবে’খন। আমায় আবার চৌধুরীদের বাড়ি যেতে হবে একটু। গোপাল চৌধুরীর ঠিক এই অসুখ। এই ওষুধ তো তাঁকেও দিচ্ছি, বেশ সেরে উঠেছেন। আর সারতেই হবে কিনা। গঙ্গাধর সেনের নিজের হাতে গড়া সূত্র।—বলিয়া উঠিয়া যাইতেছিল, ঠিক এই সময় লেজ উঁচাইয়া একটা হৃষ্টপুষ্ট বেড়াল মন্থর গতিতে বাড়িতে আসিয়া প্রবেশ করিল, কবিরাজ খুড়োকে প্রশ্ন করিল, এই বেড়ালটা বুঝি? বেটী মিষ্টি দই খেয়ে চেহারা বেশ বাগিয়েছে তো! কবিরাজ চলিয়া গেলে খুড়ী উগ্রভাবে খুড়োর দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন, বলিলেন, তাই ষষ্ঠীর বাহনের ওপর এত দরদ! না?

এবং সঙ্গে সঙ্গে অমোঘ নিশানায় হাতের কাছের একটা ঘটি নিঃশঙ্ক ষষ্ঠীর বাহনের পিঠের মাঝখানে বসাইয়া বলিলেন, খা দই—মিষ্টি থকথকে দই—

খুড়ো হুঁকাটা হাতে করিয়া ঘরে গিয়া বসিলেন।

এই গেল খুড়োর চিকিৎসার ইতিহাস।

আরোগ্যের ইতিহাসটা এতটা জটিল নয়, তবে কৌতুকজনক বটে এবং বৈজ্ঞানিকদের বোধ হয় একটু ধাঁধায় ফেলিবে। হাতযশটা লইলেন রাঙাখুড়ী।

দুই দিন হইয়া গিয়াছে। কাশি কমে না তবে কতটা আসল কতটা ভেজাল বলা কঠিন। খুড়ো শান্তি-স্বস্ত্যয়নের উপর খুব জোর দিতেছেন, তাহার সমান্তরালে হোমিওপ্যাথি চলুক, এই তাঁহার মত। নূতন একখানা ‘হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা’ আসিয়াছে ও একটা ছোট ওষুধের বাক্স। খুড়ি কোন গোলমাল করেন নাই, এবারে সাবিত্রী ব্রতর জন্য গোটাকতক বেশি টাকা বাহির করিয়া দিয়া খুড়ো এ বিষয়ে আপাতত তাঁহার মুখ বন্ধ করিয়াছেন। কাশির আওয়াজে নাক সিঁটকাইতেছেন এবং ক্রমাগতই ছিদ্র অন্বেষণে নিজেকে সজাগ রাখিতেছেন। যা দুই-একটা পাওয়া যাইতেছে,সে সম্বন্ধে সদ্য সদ্য হক-কথা বলিতে না পারায় মন গুমরাইতেছেন, তবে আশা—একদিন না একদিন এসব কাজে লাগিবেই।

খুড়ো বইখানার পাতা উল্টাইতেছিলেন। বাহিরের পাট সারিয়া রাঙাখুড়ী একখানা কাঁথা সেলাই করিতে বসিলেন। খুড়ো বার দুয়েক কাশিলে প্রশ্ন করিলেন, কেমন আছ আজ?

মুখটি চুন করিয়া খুড়ো বলিলেন, আর কেমন আছি! এতে যেমন লিখছে, তাতে তো দেখছি, বড় জটিল ব্যাধি দাঁড়িয়ে গেছে।

খুড়ীর উত্তরের প্রত্যাশায় একটু থামিয়া বলিলেন, পুরোপুরি ব্রায়োনিয়ার সিমটম।

খুড়ী বইটার উপর আগাগোড়াই চটা, কোন উত্তর করিলেন না।

খুড়ো বলিলেন, চমৎকার শাস্ত্র—

খুড়ী ছোট করিয়া বলিলেন, হ্যাঁ।

খুব সাদা কথা, সিমিলিয়া সিমিলিবস কিউরেন্টিস অর্থাৎ বিষস্য বিষমৌষধি, অর্থাৎ কিনা বিষ দিয়েই বিষ তাড়াতে হবে। ধর, তোমার রাজযক্ষ্মা হয়ে

খুড়ী চোখ পাকাইয়া বলিলেন, কার কি হয়েছে?

খুড়ো কথা ফিরাইয়া বলিলেন, এই ধর—ধর, অমৃত কবরেজের রাজযক্ষ্মা-

খুড়ী ছুঁচসূতা ছাড়িয়া দিয়া আরও উগ্রভাবে চাহিলেন। খুড়ো থতমত খাইয়া বলিলেন, ধরধর, এই তোমার বেড়ালটার রাজযক্ষ্মা হয়েছে। তখন দেখতে হবে, এমন কি বিষ আছে, যাতে রাজযক্ষ্মা সুস্থ শরীরে হতে পারে। সেই বিষ রোগীর শরীরে সাঁদ করাতে হবে। অর্থাৎ ভেতরে যে রোগ রয়েছে, বাইরে থেকেও সেই রোগের—

খুড়ী ক্রুদ্ধ হস্তে কাঁথাটা গুটাইয়া ফেলিয়া বইটার দিকে অঙ্গুলি দেখাইয়া বলিলেন, এক্ষুনি বন্ধ কর বলছি এমন অলুক্ষণে বই—এক্ষুনি। আচ্ছা থাক, পড়, যত ইচ্ছে পড়–

খুড়ো কিছুই বুঝিতে না পারিয়া খুড়ীর দিকে চাহিয়া কাশিলেন। খুড়ী সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ চড়াইয়া খক-খক-খক করিয়া চারবার কাশিয়া সেলাই করিতে লাগিলেন।

খুড়ো বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, এ কি, তোমারও কাশি হয়েছে যে! কখন থেকে? এইমাত্র আরম্ভ হ’ল।

তা হ’লে এক দাগ নক্সভূমিকা খেয়ে নাও। লক্ষ্মণগুলোও একবার—

এই খাচ্ছি দাও।—বলিয়া খুড়ী উঠিয়া ঔষধের বাক্সটা তুলিয়া লইলেন এবং সেটাকে নিজের তোরঙ্গের মধ্যে পুরিয়া স্বস্থানে আসিয়া বসিলেন। চাবিটা আঁচলে এমন করিয়া বাঁধিলেন যে খুড়োর আর বুঝিতে বাকি রহিল না যে, ও বাক্স আর এ জন্মে বাহির হইবার নয়।

চুপ করিয়া থাকা অস্বস্তিকর বোধ হইতে লাগিল বলিয়া খুড়ো খক খক করিয়া দুইবার কাশিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে খুড়ী বুকটা চাপিয়া এমন কাশি কাশিতে লাগিলেন যে খুড়োকে হুঁকা হাতে করিয়া বাহিরে গিয়া বসিতে হইল।

কিন্তু ঔষধ ধরিল। ছয়-সাতবার এই রকম কাশি-বিষের মাত্রা সেবন করিয়া খুড়োর অসুখটা অনেকটা কমিয়া আসিল। কানের কাছেই কাশির চোটে রাত্রে ঘুমের ব্যাঘাত বিলক্ষণই হইল বটে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাহাতে রোগটা কমিল বই বাড়িল না।

তাহার পরদিন খুড়ী ঔষধের মাত্রা চড়া করিয়া দিলেন, অর্থাৎ খুড়োর কাশির অপেক্ষা না রাখিয়া নিজেই প্রথমে কাশিতে কাশিতে উঠিলেন। খুড়োর ঘুম ভাঙিয়া গেলে খুড়োকে তামাক সাজিয়া দিয়া কাশিতে কাশিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কেমন বোধ হচ্ছে?

এবারের শৈত্যে খুড়োর একটু কাশি আসিয়াছিল, কিন্তু খুড়ির উগ্র কাশির কথা স্মরণ করিয়া, অতি কষ্টে বেগটাকে দমন করিয়া বলিলেন, না, আজ যেন একটু ভাল আছি বলে বোধ হচ্ছে, গলাটা সামান্য খসখস করছে একটু।

ওটা কিছু নয়, তামাক খাওয়াটা ছেড়ে দাও, দু’দিন, ওইজন্যে হয়েছে।—বলিয়া খুড়ী গোটাকতক বিষ-কাশি কাশিলেন।

খুড়ো মুখটা একটু বাঁকাইয়া লইয়া বলিলেন, হুঁ কাশিটা তামাক খেয়েই তো হয়; আবার যাদের সে অভ্যেস নেই, তাদের–

ও পাপ ধোঁয়াও সহ্যি হয় না, কেশে মরি।—বলিয়া খুড়ী সেই উৎকট কাশি কাশিতে লাগিলেন।

খুড়ো নিজের বিদ্রুপের এইরকম উল্টা পরিণতিতে ক্ষুব্ধ হইয়া এবং কাশির উৎপাত হইতে পরিত্রাণের জন্য হুঁকা লইয়া গটগট করিয়া বাহিরে গিয়া রকে বসিলেন। এ কয়দিনে অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, অথচ কাল হইতে প্রাণ খুলিয়া কাশা হয় নাই; রোয়াকের কিনারায় নিরিবিলিতে পেয়ারাতলাটিতে বসিয়া, হুঁকায় একটা লম্বা সুখটান দিয়া নিশ্চিন্ত মনে গলা ছাড়িয়া কাশির স্রোত খুলিয়া দিলেন।

স্রোত বেশি নামিবার পূর্বেই রাঙাখুড়ী আসিয়া দাঁড়াইলেন, হ্যাঁ, একটা কথা মনে প’ড়ে গেল; আমি বলি কি

আর শেষ করা হইল না। সে যা কাশির বান ডাকিল, তাহাতে পূর্বের স্রোতটি তো চাপা পড়িলই, স্রোতের উৎস-শিলাটিকেও একেবারে বিপর্যস্ত করিয়া তুলিল।

খুড়ো হুঁকোটা ডান হাতে ধরিয়া বাঁ হাতটা বারণের ভঙ্গীতে খুড়ির দিকে বাড়াইয়া এবং মুখটা তাঁহার দিক হইতে ঘুরাইয়া বলিলেন, হয়েছে, হয়েছে গো, ক্ষ্যামা দাও, আমি পাজি, আমি নচ্ছার, আদিখ্যেতা করি, কাশি-টাশি আমার সব বুজরুকি, স-ব স্বীকার করছি, ক্ষান্ত দাও, এই নাক-কান মলছি, আর কক্ষণও কাশব না, সান্নিপাতিক হলেও না, বাব্বাঃ উঃ, কাল সমস্ত রাত—

খুড়ী অনেক কষ্টে থামিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, কি হ’ল আবার—খক- খক—আমি বলি কি, যখন তোমার কাশিটি নেহাতই ছাড়বে না—খক-খক—বাক্সটা না হয় বের ক’রে দোব? না হয় একটু হোমিওপ্যাথিই খেয়ে দেখ না—খক-খক-খক—বেশ তো, বিষ দিয়েই যদি—

খুড়ো মাথা আর হাতের যুগপৎ ঝাঁকানি দিয়া উগ্রভাবে কহিলেন, হয়েছে খু-ব হোমিওপ্যাথি খাওয়া হয়েছে, ব্যাগ্যতা করি, যাও এখন, আর অ্যালোপ্যাথি ডোজে হোমিওপ্যাথি তোমায় দিতে হবে না, উঃ, কাল সমস্ত রাত, বাব্বা!

এই অকিঞ্চিৎ ঘটনাটুকুর পর খুড়োকে আর কেহ কাশিতে শুনে নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *