পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

হোঁৎকাদার সেবাব্রত

হোঁৎকাদার সেবাব্রত

হোঁৎকাদা বলে—তালে ওই কথাই রইল। ঝুলনের মেলায় এবার সেবা-টেবার কাজে ফোর স্কোয়ার ক্লাবকে রেকর্ড করতেই হবে।

গুপিনাথ তখনও হুস-হাস শব্দে বৈঠকি দিয়ে চলেছে। এবার দল ফেলে হাঁকে—আড়াই শো!

অর্থাৎ নিদেন আড়াই শো বৈঠকি না দিয়ে ওর ব্যায়াম শেষ হয় না। ওদিকে পটলা ক্লাব-ঘরে তখনও হারমোনিয়ামে পোঁ-পোঁ শব্দ তুলে ক্লাবের উৎসবের জন্যে গান তুলছে। –কি গাব আজি কি শুনাব-

হোঁৎকাদা ধমকে ওঠে—ওই সব থামা দিকি! এখন কাজের কথায় আয়। অ্যাই শ্রীমতি তোর একটো থামা দিকি !

মতিলাল আমাদের ক্লাবের নাট্য-পরিচালক কাম হিরো। সামনের মাসে ক্লাবের নাটক, তারই মকশো করছিল। হোঁৎকাদার কথায় ওরাও এসে জুটেছে। হোঁৎকাদা বলে—সামনে এত বড় কাজ, এখন ক্লাবের প-প্রেটিজ বলে কথা! পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব তো উঠে পড়ে লেগেছে। আমরা বসে থাকব ?

মতিলাল বলে—কি করতে হবে? ফাইটিং ?

হোঁৎকাদা জানায়—সেবা! জনসেবা! মানে ভিড়ে কে কোথায় ছিটকে পড়ল, হারিয়ে গেল, খুঁজে আনতে হবে। কেউ পথ হারিয়েছে, অফিসে আনতে হবে। কেউ অসুস্থ তাকে ফার্স্ট-এড দিতে হবে। কোনো দুষ্টু লোক, মানে চোর পকেটমারকে বাধা দিতে হবে।

গুপি বলে—শেষের কাজটা আমিই করব।

হোঁৎকাদা বলে—সব অর্গানাইজ করতে হবে বুঝলে, জনসেবাই আসল কাজ বি–বিবেকানন্দ বলেছেন—জ-জীবে –

মতিলাল পাদপূরণ করে দেয় বাকিটা।

আমাদের গ্রামটা বিরাটই বলা যায়। এখনও অনেক ধসে পড়া জমিদার বাড়ি, খালবিল, গজিয়ে ওঠা আদকদের কাচের ঠাকুরবাড়ি, মোহান্ত মহারাজের বিরাট মন্দির, আরও অনেক ছোটবড় মন্দির, ঠাকুরবাড়ি আছে। ইদানীং বিজলিবাতির দৌলতে মন্দিরের বোল-বোলাও সাজ-গোজও বেড়েছে। ঝুলনের সময় তাই প্রতি ঠাকুরবাড়িতেই ঠাকুর সাজানো হয়। ধুমধাম করে মেলা বসে। আদকদের চত্বরে কলকাতার যাত্রাগানও হয়। নামী কীর্তনীয়ারাও আসেন। ক’দিনের জন্য গ্রামটা জমে ওঠে। আর আশপাশের গ্রাম থেকে আসে হাজার হাজার মানুষ । পথঘাট, বাজার, মেলার জায়গায় লোক ধরে না।

তাই হোঁৎকাদা এই সুযোগে জনসেবা করে কিছু পুণ্যি অর্জন, আর ক্লাবের নাম ফাটাবার সুযোগটা ছাড়তে চায় না। হোঁৎকাদা এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কালীতলার মাঠে একটা তেরপলের ছাউনি বানিয়ে নিজের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারখানা থেকে হাতল-ভাঙা চেয়ার, নড়বড়ে বেঞ্চ, আর কোত্থেকে একটা ফোল্ডিং টেবিল পেতেছে। লাল শালু দিয়ে ফোর স্কোয়ার ক্লাবের সেবা বিভাগের প্রচার করা হয়েছে। হোঁৎকাদা গ্রামের অনেক কিছুতেই থাকে । ফুটবল মাঠের রেফারি, প্রসেশনের লিডার, ব্যান্ড-পার্টির ম্যানেজার ইত্যাদি নানারকমে সে জনসেবা করে চলেছে। আজ খাকি হাফ-প্যান্ট, শার্ট আর মাথায় টুপি, বেল্টে হুইশেল ঝুলিয়ে প্যামসু পায়ে হোঁৎকাদা গোল দেহটাকে আরও গোলাকার বানিয়ে চেয়ার জাঁকিয়ে কম্যান্ডার সেজে বসেছে।

আর সেবকদেরও অভাব নেই। আমি, গুপি, মতি, পটলা ছাড়া পাড়ার ক্ষুদিরাম, দুকড়ি, দেড় ঠেঙে হরিপদ, কানা শশী, নুলো তারণ ইত্যাদি অনেকেই হোঁৎকাদার সেবাব্রতে সাড়া দিয়ে জমায়েত হয়েছি তার পতাকা তলে ।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের টেন্ট ওদিকেই। তাদেরও বাহার কম নয়। পশুপতিদা মাথায় ব্যান্ড-পার্টির পালক গোঁজা টুপি পরে বিউগিল নিয়ে সেজেছে। ওদের দলের পোশাকও জমকালো। ওদের ক্লাবের গদাই বলে—ভালো মানিয়েছে রে তোদের পিপেটিকে, গড়িয়ে দিলেই—

গুপি গর্জে ওঠে হোঁৎকাদার প্রতি এই মন্তব্যে। তাই গর্জে ওঠে—কথা বলবি না গদাই, তোকেই সেবা করে দেবে এক রদ্দায়। অবশ্য গুপির হাতের রদ্দা খেলে গদাইকে লাশ হয়ে যেতে হবে। তাই আমি থামাই ওদের—এই, সেবাদলের নিজেদের মধ্যে সেবা শুরু করবি নাকি?

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের তাঁবুতে ব্যান্ড বাজছে। ভিড় জমেছে ওখানেই। হোঁৎকাদাও হুইশেল বাজিয়ে দেড় ঠেঙে হরিপদ, কানা শশী, নুলো তারণ, লিকলিকে কার্তিকদের নিয়ে রীতিমত প্যারেড শুরু করিয়ে তালিম দিয়ে সেবাব্রতী করে ছাড়বে।

সন্ধ্যার পর থেকে ভিড় শুরু হয়। কাতারে কাতারে ছেলে মেয়ে, বুড়ো-বুড়ির দল চাল চিঁড়ে বেঁধে এসেছে। মন্দিরগুলোর দরজায় ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি চলেছে। বাঁশ পুঁতে দড়ি-দড়া বেঁধে ভিড় সামলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু জনস্রোতের চাপে, সব বানের মুখে খড়কুটো হয়ে ভেসে যাচ্ছে ।

হোঁৎকাদার গলা শোনা যায়—রেডি, স্টেডি বয়েজ। মহিলারা এদিকে—ওয়ান বাই ওয়ান । পুরুষদের গেট বন্ধ করে রাখো। হুঁশিয়ার-

আদকমশাইও রয়েছেন। ভিড় সামলাতে গিয়ে নুলো, তারণ ছিটকে পড়েছে, লিকলিকে কার্তিক চাপের চোটে কোনো দর্শনার্থীর ঘাড়ে উঠে ভিড় থেকে আত্মরক্ষা করছে।

আমরাও স্ট্রেচার নিয়ে তৈরি। দু-একটা বোধ হয় জখম হবেই। তবু সেবা করার সুযোগ পাব। কিন্তু মানুষগুলো যেন ইস্পাতের তৈরি! এত ভিড়েও কারো কিছু হয় না ! কলরব ওঠে—পুঁটু, কোথায় গেলি র‍্যা! অ-কুসুম-

–ছেলে হারিয়ে গেছে মা? হোঁৎকা এগিয়ে যায় ব্যগ্রভাবে।

বুড়ি দাঁত পড়া লালচে মাড়ি বের করে খিঁচিয়ে ওঠে—পুঁটু আমার হারাবে কেন র‍্যা মুখপোড়া? তুই হারা গে না!

পুঁটু, বঁচু কেউই হারায় না। কেউ আহতও হয় না। মেলার পর্বও ঠিক চলেছে। আদকমশাই বলেন—দারোয়ানদের বলে রেখেছি।

হোঁৎকাদা বলে—আমার সেবাদলও রেডি আছে আদকবাবু, মানে এবার ফোর স্কোয়ার ক্লাবের পেট্রন হতেই হবে। আপনার এখানেই তাই সেবাদলকে রেখেছি।

আদকমশাই জবাব দেয়—সেবাদল! ওরা কি করবে হে? যাক গে, এবার ডেকরেশনটা কেমন হয়েছে বল হোঁৎকা ? ফোকাস্, স্পষ্ট লাইট ওই ঠাকুরের ভ্যানিস-ট্যানিস সবই কলকাতার মিস্ত্রি এনে করিয়েছি।

আবার ভিড় আসছে জনস্রোতের মত। আমরাও ক্ষুণ্ন হয়েছি। আদকমশাই কেন মোহান্ত মহারাজের ঠাকুরবাড়িও ম্যানেজ করছি, কিন্তু ওরা যেন আমাদের চেনে না !

—রেডি বয়েজ। পুরুষদের গেট খুলে দাও। ওরা বের হয়ে গেলে মেয়েরা ঢুকবে আস্তে-

কোনরকমে সেবা করার সুযোগ খুঁজছি। রাত হয়েছে। হোঁৎকাদা বলে–চারিদিকে সাবধানী দৃষ্টি রাখবি। শুনছি, দু-একটা ছেনতাইও হয়ে গেছে।

ক্যাম্পের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে আছে কয়েকটা বুড়োবুড়ি—দুটো ছেলে। হোঁৎকাদা বলে—আপনাদের নাম বলুন।

বুড়ো গর্জে ওঠে—আমরা কি চুরির আসামি যে নাম-ধাম গাঁ-গোত্তর বলতে হবে? —আপনারা তো হারিয়ে গেছেন?

হোঁৎকাদার কথায় বুড়ি গর্জে ওঠে—সদাব্রত খুলেছ, খেতে থাকতে দেবে শোনলাম, আর যাত্রীদের চোর ঠাওরেছে!

মতিলাল বলে—সেবাব্রত নিইছি আমরা—সদাব্রত নয়।

—ঝ্যাটা মারি তোদের মুয়ে, আঁটকুড়োর ব্যাটারা! মশকরা করতে এসেছ! ওঠ রে মদনা, অ্যাই কালী, চত্বরে পড়ে ঘুমোবি চল।

ঘুমন্ত কিল্লিবিল্লিদের নিয়ে ওরা চলে গেল ।

রাত হয়ে গেছে। খিদেতে পেট জ্বলছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা-গতর টাটিয়ে গেছে, তবু সেবাদলের নামও কেউ করে না। আদকমশাইকে ধরে কিছু মোটা টাকার ডোনেশন তোলার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তাও হল না। ওদিকে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের তাঁবুর সামনে বেঞ্চ পেতে ভলেনটিয়ারদের লুচি, আলুর দম আর মিহিদানা ভোগ চলছে।

নুলো তারণ ওর ছেঁড়া জামা থেকে ব্যাচটা খুলে হোঁৎকাদার টেবিলে রেখে বলে—লুচি-ফুচি নাই, এতে আমিও নাই। কাল থেকে ওদের দলেই সেবা করব।

দেড় ঠেঙে হরিপদের ছোট এক ঠ্যাং-এর হাঁটুটা ছড়ে গেছে। ও বলে—আমোও নাই কাল থেকে।

হোঁৎকাদা বলে—সেবা মানেই নিঃস্বার্থ সেবা। দই লুচি আলুর দম মিহিদানা তো তুচ্ছ। যে কারণেই হোক পরদিন ফোর স্কোয়ার ক্লাবের অবস্থা সত্যই করুণ। মাত্র ক’জন টিম-টিম করছে। ওদিকে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের সামনে ভলেনটিয়ার আর ধরে না। নুলো তারণ, কানা শশী, লিকলিকে কার্তিকও চলে গেছে ওই ক্যাম্পে। বুকে ওদের ব্যাজ এঁটে সেবাধর্ম নিয়েছে। আর দেড় ঠেঙে হরিপদও যেত, কিন্তু এক ঠ্যাং জখম হওয়ায় আসতে পারেনি।

এদিকে আমরা মাত্র ক’জন। হোঁৎকাদা বলে—নীরবে নিঃস্বার্থে সেবা করবি। জ-জানিস

য-যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে

তবে একলা চল রে।।

লোকজনের ভিড় আজ অনেক বেশি। শহর থেকে রিজার্ভ বাসে লোকজন মেয়েরা আসছে। আজ আদকমশাই বলে—গেটে আমার দারোয়ানরাই থাকুক। তোমরা আশেপাশে থাক, অর্থাৎ তার দেউড়িতে তার ইউনিফর্ম পরা লোকজনই থাকবে, ওদিকে মোহান্ত মহারাজের মন্দিরের ভার আজ পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের, আর আদকমশাইয়ের মন্দিরের ভিতরেও পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের নেতা পশুপতিবাবু দলবল নিয়ে রয়েছেন। অর্থাৎ এবার আদক-কোম্পানির দরাজ টাকা ওরাই পাবে।

আমি বলি—এসব তুলে দাও হোঁৎকাদা। কি হবে ?

—মানে! হোঁৎকাদা গর্জে ওঠে—যদি ভালো না লাগে চলে যা তোরাও। আমি একাই সেবাব্রত নিয়ে থাকব।

মতিলাল থামায়—চুপ কর দিকি। কিন্তু কাজটা কি করব বল?

গোপীনাথ বলে—করার তো কিছু নেই। আদকমশাই, মোহান্ত মহারাজও জবাব দিলেন। হোঁৎকাদা বলে—পথেঘাটে ঘুরবি, কত বিপন্ন মানুষ রয়েছে তাদের সেবা কর।

মনের রাগ চেপে ভিড়ের মধ্যে পথে এদিক ওদিক ঘুরছি। হোঁৎকাদাও বের হচ্ছে মাঝে মাঝে। ওদিকে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ডিউটিতে রয়েছে ভলেনটিয়ার দল। গদাইও ব্যাচ পরে ভিড় ম্যানেজ করছে গেটে। আমাদের যেন চিনতেই পারে না।

ওদের লিডার পশুপতিবাবু ভিতরে যাবার মুখে শোনায়—বাজে ভিড় হটিয়ে দে গদাই, গেটের কাছ থেকে।

গুপিনাথ গজরাতে থাকে, পশুর বাবার জায়গা এটা! ঠিক আছে ।

গুপিকে টেনে নিয়ে আসি, কারণ রাগের মাথায় ওর জ্ঞানগম্যি থাকে না।

হঠাৎ খবরটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সারা মেলায় ওই ভিড়ের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে যায়। আর খবরের মূল ওই হোঁৎকাদা।

রাত হয়ে গেছে। দত্তদের রকে একটা লোক মরে পড়ে আছে। হইচই পড়ে যায়। হোঁৎকাদা বলে—কুইক। এখনও মরেনি, পালস্ আছে। স্ট্রেচারে নিয়ে চল।

ভিড় জমে গেছে পথের দু’ধারে। তার মধ্য দিয়ে আমি, মতিলাল, পটলা স্ট্রেচারে তুলে আনছি দশাসই দেহটাকে। জ্ঞান নেই। হোঁৎকাদা হাঁক পাড়ে ভিড় করো না কেউ, পথ দাও সেবাদলকে। ধীরে-নো জার্ক বয়েজ।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ছেলেরাও ঘাবড়ে যায়। তারা কেবল লোকই ঠেলেছে, ফাঁক থেকে আমাদের ক্লাব একটা মারাত্মক কেসকে তুলে এনেছে হাসপাতালে পাঠাবার জন্যে। এর মধ্যে ওই অজ্ঞান লোকটার আত্মীয়দের কাছেও খবর গেছে। ওর বৌ হবে বোধ হয়—ইয়া লম্বা চওড়া একটি কালো মহিলা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আসছে, পিছনে আসছে বেঁটেখাটো একটি তরুণ—ওর ছেলে বোধহয়।

হোঁৎকাদা বলে—ওকে ডিস্টার্ব করবেন না। এখুনি হাসপাতালে পাঠাতে হবে। বোধ হয় হার্ট অ্যাটাক্—সাংঘাতিক ব্যাপার।

—বাঁচবে তো গো? ও বাবু! মেয়েটি চিৎকার করে চলেছে।

কোনরকমে ওই দশাসই দেহখানাকে নড়বড়ে টেবিলে শুইয়ে দম নিচ্ছি। এতখানি পথ ওই পর্বতকে বয়ে আনা কম কথা নয় ! আমাদের ক্যাম্পের আশপাশে লোকের ভিড় আর ধরে না । নিমেষের মধ্যে ফোর স্কোয়ার দলের সেবাব্রতের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। হোঁৎকাদা লোকটার পালস দেখছে।

হঠাৎ কাণ্ডটা ঘটে যায়। বিরাট মুষকো লোকটা সটান টেবিলের উপর আড়িমুড়ি ছেড়ে সিধে হয়ে উঠে বসে চোখ কচলে নিজেকে তেরপলের ছাউনির মধ্যে এই অবস্থায় দেখে হকচকিয়ে যায়। ওপাশে বৌটা তখন চিৎকার করছে দেখে লোকটা গর্জে ওঠে—অ্যাই থামবি! তা এখানে কি করে এলাম রে? যাত্রা শুরু হবার আগে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম দত্তদের রকে বৌটা গর্জে ওঠে—তুমি নাকি মরে গেছলে গো।

লোকটা অবাক হয়—মরে গেছলাম! কোন্ ব্যাটা বলে ?

মেয়েটা হোঁৎকাকে দেখিয়ে বলে, ওই ছোঁড়াটা! ওমা কি মুখ গো ওটার? অ্যা! জলজ্যান্ত লোকটাকে মেরে ফেলছিল গো। ওরে আঁটকুড়ির ব্যাটা, ওই ছোঁড়াগুলো আবার খাটিয়ায় করে বয়ে আনছে।

—অ্যা! মরে গেছলাম! দেখাচ্ছি মজা! ইয়ার্কির জায়গা পাওনি? মোটা লোকটা গর্জে ওঠে বুনো মোষের মত ।

পায়ের দিকে ছিলাম আমি। লোকটা সজোরে আমার দিকেই লাথি ছুঁড়েছে। লাথি নয়, যেন একটা শালের গুঁড়িই এগিয়ে আসে। লাগলে থেঁৎলে যাব, তাই মাথা নিচু করে প্রাণ বাঁচিয়ে বেরুবার পথ খুঁজছি। সেবা করার পর যে এমনি কাণ্ড ঘটবে ভাবিনি। লোকটা হাত বাড়িয়ে ঠ্যাঙ ধরে ফেলেছে হোঁৎকাদারই। এবার বোধহয় হাসপাতালেই যেতে হবে হোঁৎকাদাকে। এমন সময় দাপাদাপিতে নড়বড়ে টেবিলটা মচমচ করে ওঠে। একটা পায়া মড়মড় করে ভাঙছে। মোটা লোকটা পড়বার আগেই সামলে নেবার জন্য লম্বা হাত বাড়িয়ে তেরপলের নীচেকার ছাউনির বাঁশটাকে ধরে ফেলেছে। কিন্তু ওই বিরাট দেহের চাপে টেবিলটা আছড়ে পড়ে, আর তেরপল সমেত বাঁশ ভেঙে ওই লোকটা, হোঁৎকাদা, সেই মেয়ে লোকজনই চাপা পড়ে গেছে। ওই ফাঁকে আমি তেরপলের তলা গলে কোনোরকমে হড়কে বের হয়ে মতিলালের হাত ধরে ভিড়ে মিশে যাই। বুকের ব্যাজটা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে ওদের দলে মিশে কেটে পড়ার পথ দেখছি। ততক্ষণে বিরাট কাণ্ড বেধে গেছে। লোকজন, যাত্রীরা চিৎকার করছে। কোরাস শোনা যায়—মার! মার! সেবাব্রতের ব্যাটাদের হাড় গুঁড়িয়ে দে মেরে

দম বন্ধ করে দৌড়চ্ছি বড় রাস্তা ছেড়ে। বড় বড় বাড়িগুলোর পেছনে একটা পুকুরের ধারে গাছ-গাছালির অন্ধকারে জায়গাটা থমথম করছে। ওইখানে এসে দাঁড়ালাম। লোকজন কেউ বিশেষ নেই এদিকে। আদকমশায়দের বিরাট বাড়িটার পেছনে বাগানে এসে পড়েছি। মতিলাল তখনও হাঁপাচ্ছে। গুপিনাথ রেডি আছে। আড়াইশো বৈঠকি দেওয়া ওর অভ্যাস। গুপিনাথ গুম হয়ে বলে—ঢের হয়েছে। এবার মানে মানে ঘরে ফিরে চল।

মতিলাল বলে—একটু দম নিতে দে। আর ওপথে নেই বাবা, ধরলে লাশ বানিয়ে দেবে। আকাশ বাতাসে ওঠে আনন্দের সুর। ওদিক থেকে মাইকে গানের সুর শোনা যায় । পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মাইকে ভলেনটিয়ারদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে-ভিড় সরিয়ে দাও । গেটে সারবন্দী যাত্রীদের যেতে সাহায্য করো ।

ওরাই এবার টেক্কা দিয়ে গেল। আর হোঁৎকাদার বোকামিতে ফোর স্কোয়ার ক্লাব এবার পথে বসে গেল ৷

মতিলাল বলে-সামনের মাসে ফাংশন-নাটক এসব হবে না ?

গুপি ধমকে ওঠে—যে নাটক করলি তাই সামলা এবার !

—হোঁৎকাদাকে রেসকিউ করবি না?

আমি ভয়ে ভয়ে বলি–মোটা লোকটা নির্ঘাৎ জোর ধোলাই দিয়েছে ক্যাপটেনকে। গুপিনাথ বলে–আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এখন বাড়ি চল। এখন আমার হাতে ক্লাবের ফেস্টুনটা। রডে বাঁধা ওই লাল শালুর ফেস্টুনটা হাতিয়ে দৌড়েছিলাম।

অন্ধকারে হঠাৎ কিসের শব্দে চমকে উঠি। কে জানে কেউ বোধ হয় টের পেয়ে গেছে, তাই ধরতেই এসেছে আমাদের। কিন্তু ব্যাপার দেখে অবাক হই। আদক-বাড়ির দোতলার মহল থেকে দড়ি ধরে একটা লোক এসে ঝুপ করে পড়েছে ওই জঙ্গলে। আর একজনও নামছে। তার হাতে একটা ছোট বাক্স। বলিষ্ঠ গাঁট্টাগোট্টা লোকটার পরনে কালো হাফ-প্যান্ট আর কালো গেঞ্জি। চমকে উঠে ঝোপের আড়ালে বসে আছি। ওদের কথাগুলো শোনা যায়। একজন বলছে—জোর হাতিয়েছি মাইরি! দু’দুটো গয়নার বাক্স। কর্তা গিন্নিরা ঝুলনের যাত্রা শুনছে। শুনুক যাত্রা! চল, হাজার তিরিশ টাকা তো হবেই। হীরের গহনা জড়োয়া সেট, চুনি পান্না, সোনা দানা। তা বড়লোক বটে।

গায়ে ঘাম দিচ্ছে। সামনেই বিরাট একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। আর দুটো লোকের হাতে হাজার হাজার টাকার চোরাই গহনা ।

গুপির মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে, অন্ধকারে দু’চোখ জ্বলছে। আমিও ওর হাতের চাপে সজাগ হয়ে উঠেছি। আমার হাতে ফেস্টুনের একটা রড, অন্যটা গুপি টেনে নিয়ে তৈরি হয়েছে।

ঝোপের মধ্যে বসে আছি আমরা, মশায়, কামড়াচ্ছে খেয়াল নেই। লোক দুটো ওই ঝোপের পাশে সরু পথ দিয়ে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই আমি সজোরে আগের লোকটার মাথাতেই রডের এক ঘা বসাতেই লোকটা সামনের দিকে ছিটকে পড়ল, আর গুপি পিছনের লোকটার পায়ে মারতে সে ছিটকে পড়েছে, তার উপর দুমদাম শব্দে আঘাত করছে গুপি।

মতিলাল ওর ভরাটি নাটুকে গলায় চিৎকার করে – চোর চোর! – চোওর।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই টর্চ, হ্যাজাক, লোকজন এসে পড়ে। ততক্ষণে ওই ফোর স্কোয়ারের ফেস্টুন-ফালা দিয়েই লোকদুটোকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছি। বাক্স দুটোও খুঁজে পাওয়া যায় হেজাকের আলোতে।

আদকমশাইও নিজে এসেছেন গোলমাল শুনে। দোতলার বারান্দা থেকে দড়িটা তখনও ঝুলছে। গহনার বাক্স দুটো দেখে চমকে ওঠেন তিনি। সর্বনাশ! এ যে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল ব্যাটারা !

আহত লোকদুটোকে আমরাই টেনে এনেছি। পুলিশ অফিসার এসে অবাক হল-আরে, একটা তো দাগি ডাকাত! আর রহমৎ তো খুনের ফেরারি আসামি! তোমাদের এই কাজ? লোকদুটো মারের চোটে ধুঁকছে। গুপি বলে—আরও দুঘা দিই স্যার।

বাধা দেন দারোগাবাবু—ঢের হয়েছে! আর থাক গুপিনাথ। উঃ! বিরাট একটা কেস ধরেছ তোমরা।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ক্যাপটেন পশুপতিবাবুকে ধড়াচুড়ো পরে আসতে দেখে আদকমশাই বলেন—আপনার ছেলেরা কি করে পশুপতিবাবু? ধড়াচূড়া পরে লুচি আলুর দমই খায় কেবল । দুটো লোক এদিক থেকে গিয়ে ভিতরের মহলে ঢুকে সর্বস্ব নিয়ে চলে যাচ্ছিল, দেখেনি?

ভিড় ঠেলে কাকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠি। চেনা যায় না হোঁৎকাদাকে। সেই লোকটা বোধহয় আচ্ছাসে মেরামত করে গেছে সেবাব্রতী হোঁৎকাদাকে। গালে প্লাস্টার, কপালে আব গজিয়ে চোখ ঢেকে গেছে, বাঁ হাতটা গলার সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে ব্যান্ডেজ করা। খাকি শার্টটা ফেটে ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জিও ঝুলছে। হোঁৎকাদা বলে ওঠে আদকমশাইয়ের কথায়—আমার সেবাদলের ছেলেরা স্যার অন্য ধাতুতে গড়া। নিঃস্বার্থ সেবাই তাদের ব্রত। আপনারা চাননি, তবু ওরা নীরবে সেবা করে গেছে আপনাদের।

আদকমশাইও কথাটা স্বীকার করেন এবার।

তাই এবার ফোর স্কোয়ার ক্লাবের বার্ষিক উৎসব বেশ জাঁকিয়ে করছি। লৌহ-ভীম গুপিনাথের ফিজিক্যাল ফিটস্, পটলার কণ্ঠ সংগীত, আর শ্রীমতিলালের পরিচালনায় নাটকও হচ্ছে। হোঁৎকাদা আপাতত ওই নিয়েই ব্যস্ত।

তোমাদেরও নেমন্তন্ন রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *