হৈমন্তী সকাল
জেনেসিস আর্ট গ্যালারিতে শিল্পী সুহাস রায়ের একটি চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেল। ছোট মাপের প্রদর্শনীর জন্য গ্যালারিটি মন্দ নয়। কুড়িটি ছবি আর বারোটি স্কেচ দিয়ে প্রদর্শনী সাজিয়েছিলেন শিল্পী সুহাস রায়।
সুহাস স্মিত শিল্পী। রং-রেখা জুড়ে বিরাট কোনও বিপ্লবের মানসিকতা তাঁর নেই। স্নিগ্ধতাই তাঁর প্রকৃত মেজাজ। তিনি কাজ করেন টেম্পরায়, অয়েলে, অয়েল প্যাস্টেলে। ইন্ডিয়ান স্কুলের ধারা মেনে রং ব্যবহার করেন। ছবি থেকে কোনও রং লফিয়ে এসে চোখ ঠিকরে দেয় না। ‘লিমিটেড প্যালেটে’ কাজ করেন। বহু রং ব্যবহারের প্রলোভন তিনি জয় করেছেন। তাঁর ছবিতে আলো আছে। সে আলো ভোরের আলো। হেমন্তের ভোর। হৈমন্তী ঊষার কুয়াশার পাতলা চাদর তুলে সূর্য তাঁর আলোর বার্তা পাঠচ্ছেন। সেটি গ্রহণ করছে লকলকে একটি ঘাসের ডগা। যেন হাত প্রসারিত করে ধরতে চাইছে দিনের আর্শীবাদ। ডগায় ফুটে উঠেছে হিরের নাকছাবির মতো ছোট্ট একটি ফুল। বড় ভালোবাসার ছবি। আকাশের রং টারকোয়া ব্লু। ঘাসের ডগাটি ঘন নীল। ফুলটি নীলচে সাদা। কাজটি আমার চোখে মনে হয়েছে এক নম্বর কাজ। কঠিন কাজ। কারণ সারফেস হল কাচ। মিডিয়াম হল অয়েল। সুহাসবাবু গ্লাসপেন্টিং-এ তুলনাহীন। কাচের ওপর রং ধরানো সহজ নয়। তেল রঙে কোপাল ভার্নিস মিশিয়ে বারে বারে লাগিয়ে লাগিয়ে জমি তৈরি করে নরম কাপড় দিয়ে রং সরাতে হয়। অনেকটা এচিং-এর কায়দায় জমির রং তুলে নিয়ে ঢোকাতে হয় অন্য রং। অথবা একই রঙের হালকা ব্যবহারে ছবিটি সম্পূর্ণ হয়। মোনোক্রোম হলেও বেশ একটা মজা আছে। সারফেস ছবিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিছুটা। শিল্পীর দক্ষ হাতের ভূমিকা পরিচালকের। হৈমন্তী সকাল ফুটে উঠেছে কাচের মসৃণ জমিতে।
সুহাসবাবুর হাতে যেকোনও বস্তুই ছবি হয়ে ওঠে। জীবন-যন্ত্রণা নেই, আছে প্রকৃতিতে ভালোবাসার আনন্দ। আনন্দই ফুটে ওঠে ছবি হয়ে। টার্নারকে বলা হত, ‘পেন্টার অফ লাইট’। তিনিই নিজেকে দিয়েছিলেন এই বিশেষণ। সুহাস রায় হলেন প্রকৃতির শিল্পী। সকাল আর একটি ছবিতেও ধরা পড়েছে—শীতের সকাল। শীতের আর হেমন্তের সকাল শিল্পীদের আকর্ষণ করবেই। দিনের অবগুণ্ঠন খোলার রহস্যময়তা সুহাস রায়ের হাতে তার নিজ স্বরূপ পায়। আকাশের কোথায় কোনও চিড় ধরে একটু আলো বেরিয়ে এসে ধরণীর কোন বস্তুটিকে প্রথম জাগিয়ে তুলবে শিল্পী তা জানেন। আকাশ আর পৃথিবীর গোপনীয়তার একপাশে রং আর রেখা পাতার আয়োজন নিয়ে বসে আছেন শিল্পী-শিকারী। বেশ বোঝা যায় এই শিকারে তাঁর আধ্যাত্মিক আনন্দ আছে। শীতের সকালও কাচে আঁকা। কাচের জমিকে রং দিয়ে জমাতে পারলে ছবিতে আলাদা একটা মজা আসে, যা অন্য সারফেসে ভাবা যায় না। কাচের স্বচ্ছতা, আলোকময়তা, রং রূপ ও বিষয়বস্তুর মিলনে অদ্ভুত এক স্বপ্ন তৈরি হয়। কাচ শিল্পীর স্বাধীনতাকে যত বাধা দিতে চায়, শিল্পী ততই হতে থাকেন নেশাগ্রস্ত। সে এক চ্যালেঞ্জ। একটি ছবি শেষ করতে হয় তো তিন মাস লাগল তা লাগুক। শেষ যখন হল কাচ আর তখন শত্রু নয় সহযোগী বন্ধু। তার ছলছলে অঙ্গে পাতলা কুয়াশা, শিশিরের স্পর্শ, প্রকৃতির জাগরণ, দিনের আয়োজন।
এরপর সুহাস রায় ধরার চেষ্টা করেছেন, শেষবেলার সোনালি আলো। গাছপালার সবুজ কোথাও গাঢ়, কোথাও আলো মেখে সুহাস হলুদ। বনপ্রান্তরের পশ্চাৎভূমিতে দিন বিদায়ের পালা চলেছে। সুহাস রায়ের চরিত্ররা হল গাছপালা, উদ্ভিদের মখমল টানা জমি, আকাশ আর আকাশ-জমির মাঝের বর্ণময় শূন্যতা। মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতির রহস্যময়তা তাঁর ছবিতে তৈরি করে নির্জনতা, মন কেমন করানো উদাস একটা ভাব! ভয় হয় কোনোও প্রাণী যেন হঠাৎ না ঢুকে পড়ে এই আয়োজনে।
যেমন সাঁওতাল-বাড়ি। প্রখর দ্বিপ্রহরে ঝিম মেরে আছে প্রকৃতি। ছবির অগ্রপটে ডালপালায় মেলামেলি করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ দুটি গাছ। গুঁড়িতে ধরেছে বাদামি ছোপ। মধ্যপটে আকাশ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে একটি চালা। সদ্য ছাওয়া হয়েছে তার চালটি। সূর্য আছে সামনে। গাছের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িটির দরজায়। সামনের ভূমিটি আলোকিত হয়ে উঠছে। ছবি কথা বলে। গৃহবাসীরা গেছে কোন অরণ্যে জীবিকার প্রয়োজনে। বাড়ির প্রহরী দুটি ঋজু গাছ। আলো এসেছে অতিথি হয়ে। বন্ধ দুয়ারে ঘা মেরে বলতে চাইছে, খোলো দ্বার অন্ধকার।
স্থলপদ্ম ছবিটিও সুন্দর! প্রায় এক-রঙা। ভিরিডিয়ান গ্রিনের সমারোহে ভাসছে এক গুচ্ছ স্থলপদ্ম। স্থলপদ্ম ফুলের ভিন্ন একটা সৌন্দর্য আছে। আকারে—আকৃতিতে। পাপড়ি মেলার ধরনে। কাচের পটে নরম কাপড়ে করে রং লাগিয়ে পরিষ্কার কাপড়ের নুটি দিয়ে রং তুলে তুলে বের করে আনা হয়েছে পদ্মের নিখুঁত আকার।
কাচে আঁকা একটি পায়রার আদুরে কোমলতা এমন ফুটেছে, ভয় হয় এই বুঝি এক নিষ্ঠুর শিকারী বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিল্পী সুহাস রায়ের কাজের বিশিষ্ট একটি ধরন আছে, যা অবশ্য সব শিল্পীরই আছে। বিদেশে কাজ শিখেছেন—প্যারিসে। যার ফলে রঙের ব্যবহার সম্পর্কে অতি সচেতন। রঙের রং মেরে ফেলার ভারতীয় প্রথা গ্রহণ করেননি। মেটে মেটে ধূসর অস্পষ্ট ছবিতে তিনি বিশ্বাসী নন। গ্লাস পেন্টিং ছাড়াও তিনি অনবদ্য টেম্পারায়, প্যাস্টেলে। বাবলা গাছের আঠা আর জাপানি পোরসিলেন রং মিশিয়ে তৈরি করেন প্যালেট। তারপর কাগজের জমিতে সেই রং মসৃণ পাথর ঘষে ঘষে জমিয়ে তোলেন। কখনও মোটা কাগজে সেঁটে নেন তুলোট কাগজ। যার ফলে জমিতে আলাদা একটা টেকসচার আসে। শিল্পীর হাতে ড্রয়িং আছে। চোখে রং আছে। স্বভাবে ধৈর্য আছে। যার ফলে ডিটেলে তৈরি হয় নিখুঁত সুন্দর একটি ছবি। প্রদর্শনীতে টেম্পারার কাজ ছিল মাত্র তিনটি। আর অয়েল প্যাস্টেলের কাজ একটি। একটি মুখ। কোনও এক সাঁওতাল রমণীর। সেই মুখ। যে মুখের শ্যাম-শোভা বারেবারে ছায়া ফেলে যায় শিল্পীর মনে। শিল্পী সুহাস রায়ের চোখে যেকোনও বিষয়ই বিষয় হয়ে ওঠে।