হৈমন্তী

হৈমন্তী 

অতি সামান্য একটি দৃশ্য,—বহুদূরে খোলা মাঠের উপর দিয়া চলিয়াছে একটি সাঁওতাল দম্পতি। পুরুষটির মাথায় এক বোঝা ধান, স্ত্রীলোকটির কোলে একটি শিশু। দ্রুত গতির সঙ্গে সঙ্গে গল্প হইতেছে, স্ত্রীলোকটি এক একবার মুখ তুলিয়া সঙ্গীর পানে চাহিতেছে। 

জীবনে তো কতই দেখাশোনা হইল, কিন্তু আজ হেমন্ত-অপরাহ্ণে এই ফসল তোলার নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর দৃশ্যটুকু সুরেশ্বরকে কেমন অন্যমনস্ক করিয়া দিয়াছে; দুইটি কেমন যেন একসুরে বাঁধা—সময় আর এই ঘরমুখি গতি; চোখ ফেরানো যায় না। ডেক-চেয়ারের অলস অঙ্ক ছাড়িয়া আর উঠিতে ইচ্ছা করিতেছে না। 

অথচ অমন অলসভাবে গা এলাইয়া পড়িয়া থাকিবার কথা নয়; মস্ত বড় রেলওয়ে সেতুর কনট্রাকট হাতে, অধীনস্থ ওভারসিয়ার এইমাত্র আসিয়া খবর দিয়া গেল—যে স্তম্ভটা সবচেয়ে বেশি উঠিয়াছে তাহাতে কী একটা ত্রুটি দেখা দিয়াছে, গাঁথুনি আরও তুলিবার পূর্বে সুরেশ্বরের নিজে একবার দেখা দরকার। 

সাঁওতাল পুরুষটি মাথার বোঝা নামাইয়া রাখিয়া পথের ধারটিতে বসিয়াছে। কী একটু কথা হইল, দুইটি হাত প্রসারিত করিয়া ধরিল, স্ত্রীলোকটি শিশুটিকে তুলিয়া দিল। 

অন্যমনস্কভাবে ওভারসিয়ারের পানে চাহিয়া সুরেশ্বর বলিলেন, ও গাঁথুনিটা আজ বন্ধ থাক। 

ছোকরা নূতন পাস-করা, উৎসাহী, বলিল, অথরিটিরা একটু তাড়া দিচ্ছে, কাজটা বড় আর্জেন্ট কিনা, ওভারটাইম দিয়ে চালানো হচ্ছে। আজ আবার— 

সুরেশ্বরের মুখে একটা অসহিষ্ণু হাসি ফুটিতে ছোকরা আর কথাটা বাড়াইল না, ‘তা হলে আজ বন্ধই রাখিগে’ বলিয়া চলিয়া গেল। সুরেশ্বর পূর্বের মতোই ডেক—চেয়ারে গা এলাইয়া পড়িয়া রহিলেন। 

অস্ত যাইবার অনেক আগেই সূর্য পাণ্ডুর হইয়া পড়িয়াছে। রোদটা যেখানেই আসিয়া পড়িয়াছে, একটা কাঁচা সোনার রং—তালগাছের মাথায় মাথায়, দূরের গ্রামখানিকে আড়াল করিয়া যে হরিৎপুঞ্জ তাহার গায়ে, যে কখানা বাড়ি একটু আধটু চোখে পড়ে তাহাদের দেয়ালে, খড়ের চালে,—সবখানেই যেন গলিত স্বর্ণের অবলেপ। শ্রেণিবদ্ধ তালগাছের মধ্য দিয়া বহুদূরে বাঁকা নদীর একটা ফালি দেখা যায়, তাহার পাশেও বিস্তৃত বালুচরের উপর কে যেন মুঠা মুঠা কাঁচা সোনা গুঁড়া ছিটাইয়া দিয়াছে। 

একটু দূরে কোথায় কতকগুলো বুনো ফুল ফুটিয়াছে—ফুল দেখা যায় না, শুধু মনে হয়, খুব সাধারণ না হইলেও এ গন্ধ যেন চেনা চেনা। একটা অস্পষ্ট স্মৃতি মনটাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। 

ইঞ্জিনিয়ার সুরেশ্বরের আটচল্লিশ বৎসরের জীবনে আজ এই হেমন্ত অপরাহুটি হঠাৎ বড় অপরূপ বোধ হইতেছে, অপরূপ যে শুধু সুন্দরেরই অর্থে এমন নয়, অল্পে অল্পে মনের কোথায় একটি বেদনা জমিয়া উঠিতেছে। শীতল হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে এই দিনটি যেন মৌন বিদায়ের দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া আছে, সুরেশ্বরের মনে হইতেছে, এ শুধু আজিকার দিনটির বিদায় নয়—ঋতুচক্র পূর্ণ করিয়া একটি বর্ষ যেন বিদায় লইতেছে—বসন্তে যাহার ছিল আরম্ভ, তাহার সামনে এইবার আসিয়া পড়িল শীতের সমাধি। তাহার আগে এই কয়টা দিন লইয়া হেমন্ত— ফসল কাটার সময়—একটা জীবনের পরিক্রমায় যা পাওয়া গেল তা ঘরে তুলিয়া একটু সোনার হাসি হাসিয়া লওয়া। 

সেই সাঁওতাল-দম্পতির দিকে আবার দৃষ্টি গেল,—পুরুষটি আবার মাথায় ধানের বোঝা তুলিয়া লইয়াছে, স্ত্রীলোকটির কোলে শিশু। গতি আরও চঞ্চল, ধানের শিষে দোল লাগিতেছে।…টুকরা টুকরা মেঘের গায়ে অস্তরাগ আরও গাঢ় হইয়া উঠিল। 

মনে হইতেছে, কতকগুলা এলোমেলো চিন্তা যেন একটা স্পষ্ট রূপ ধরিয়া ফুটিয়া উঠিবে। অন্তরের অন্তস্তলে কে যেন জীবনের লাভ-লোকসানের খতিয়ান লইয়া এক নূতন দৃষ্টিতে যাচাই, করিতে বসিয়াছে। যেটিকে পরম সম্পদ বলিয়া একদিন বুকের সমস্ত উত্তাপ দিয়া জড়াইয়া ধরা গিয়াছিল, মনে হইতেছে, সেটা যেন নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানে অবহেলার অঙ্গুলিক্ষেপণে পাশে ঠেলিয়া রাখা গিয়াছিল, সে এক অপূর্ব মোহন রূপে একবারে সামনেটিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কেমন একটা গোলমেলে কাণ্ড যেন—জীবনে কি সত্যই এত ভুল হইয়া গেল? না, এ জীবন-সন্ধ্যায় দৃষ্টিভ্রম? মধ্যাহ্নের স্পষ্ট আলোয় যার ছিল এক রূপ, সন্ধ্যায় তাহারই হইয়াছে রূপান্তর বৎসরের সন্ধ্যা, এদিকে জীবনের আকাশও সন্ধ্যার বিদা-রাগে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে যে। 

কাল পর্যন্ত—অথবা আরও ঠিকমতো বলিতে গেলে আজই এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত জীবনের শ্রেষ্ঠ কাম্য, জীবনের একমাত্র তপস্যা ছিল কাজ।…পরশু চিফ ইঞ্জিনিয়ার তদারকে আসিয়াছিল। বেশ একটু কৌতুকজনক ব্যাপার হইয়া গেল। লোকটা একেবারে নূতন, তাহার চেয়েও নূতন তাহার তদারকের পদ্ধতিটা! কালি—ঝুল-লাগা খাকি প্যান্ট আর হাফশার্ট পরা একজন সাহেব ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, অবিচ্ছিন্ন কাজের মধ্যে কয়েকবার নজরে পড়িল সুরেশ্বরের; কিন্তু পরিচয় লইবার না ছিল অবসর, না ছিল কৌতূহল। খুব বড় কনস্ট্রাকশন—পাশের জংশন স্টেশন হইতে প্রায়ই সাহেব-সুবোরা দেখিতে আসে কৌতূহলী দর্শক হিসাবে; এমন কি হাওড়া-লিলুয়া থেকেও ছুটি-ছাটায় অজ্ঞাতকুলশীল সাহেবদের আমদানি হয়; নিজের মনেই দেখে শোনে, ফিরিয়া যায়, কেহ-কেহ আসিয়া কিছু প্রশ্নাদিও করে। সন্ধ্যার একটু আগে একখানা আপ ট্রেনে সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার নামিল। জানা ছিল না, সুরেশ্বর স্টেশনে যান নাই; সেই ময়লা খাকি-পরা লোকটিকে লইয়া একেবারে অফিসে আসিয়া প্রবেশ করিল।…পরিচয় দিল।—রেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, যিনি এই নূতন আসিয়াছেন। তাহাকে ডাকিয়া লওয়া হয় নাই বলিয়া সুরেশ্বর একটু অপ্রতিভভাবে দুঃখ প্রকাশ করিলেন। একটু থামিয়া প্রশ্ন করিলেন, But how did you find the work, Sir? (কাজটা কেমন দেখলেন? ) 

লোকটা সত্যই একটু আমুদে, রহস্যপ্রিয়; মুখে অতিরিক্ত বিস্ময়ের ভাব ফুটাইয়া দুইটা হাত চিতাইয়া বলিল, But I did not see the work! (কিন্তু আমি কাজ তো দেখিনি! 

বেশ একটু বিমূঢ় ভাবেই চাহিয়া থাকিতে হইল, কিছু বলিতে পারিবার পূর্বেই সাহেব হঠাৎ আসিয়া করমর্দনের জন্যে হাতটা বাড়াইয়া বলিল, I was watching you at work, Mr. Gupta, and that was enough. (আমি তোমায় কাজ করতে দেখছিলাম, মিস্টার গুপ্ত, তাতেই সব বুঝে নিয়েছি।) 

সারা জীবন ধরিয়া ভালো কাজের জন্য মুখে, কাগজে বহুৎ প্রশংসা পাওয়া গিয়াছে, তবু নূতন ইঞ্জিনিয়ারের বলিবার ঢংটুকু বেশ নতুন আর শ্রুতিরোচক; শোনার পর থেকে কানে যেন লাগিয়া ছিল।—এই খানিকটা আগে পর্যন্ত, তাহার পরই সাক্ষাৎ হইল এই হেমন্ত গোধূলির সঙ্গে। অতবড় কথাটার কোনও যেন অর্থই নাই আর। 

শুধু অর্থই না-থাকা নয়, এই সব প্রশংসা জীবনে কী দিল সেই কথাই লইয়া পড়িয়াছে মনটা। 

***

বালুতট আরও রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। পুরুষটি তাহার উপর ধানের বোঝা নামাইয়া রাখিল। হাঁটুভরও জল নয়, নদীতে দুইজনে নামিয়া মুখ-হাত ধুইতেছে। এলোখোঁপায় জলের হাত বুলাইয়া মেয়েটি আবার জবাফুল দুইটি গুঁজিয়া দিল। কোলের ছেলেটা ধানের বোঝা মাথায় লইবে,—প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে; দম্পতি গ্রীবা ঘুরাইয়া দাঁড়াইল, ছেলে আম্বা দেখিয়া কী মন্তব্য হইতেছে, মাঝে মাঝে হাসিতে শরীর দুইটি উঠিতেছে দুলিয়া। 

***

মন হিসাব করিতেছে, এই সব প্রশংসা কী দিল জীবনে! শুধু কর্মে উদ্যম?—কিন্তু কাজই কি জীবন? আর কোনও পাওনা ছিল না এ জীবনে?…চারিদিকের এই ফসল তোলার দিনে, এই সোনালি বৈকালে সুরেশ্বরের এমন কিছু একটা পাইবার ইচ্ছা হইতেছে যা জীবনের শীতের সম্বল হইয়া থাকে, তা যদি স্মৃতিমাত্রই হয় তো তাই হোক, সেও তো নিঃসম্বলের কিছু।…নহিলে, জীবন থেকে বিদায় লইবার বেলায় এই অনুতাপই থাকিয়া যাইবে যে শুধু বঞ্চিতই হইয়াছে। 

বেশি দূরে হাতড়াইতে হইল না, সুরেশ্বরের হঠাৎ কালকের ঘটনাটি মনে পড়িয়া গেল। কালও সেটা একটু রেখাপাত করিয়াছিল মনে, কিন্তু আবার কাজের সংঘর্ষে মুছিয়া গিয়াছিল সে রেখাটুকু। 

কাল একটা ইন্টারভিউ ছিল। সুরেশ্বর বিজ্ঞাপন দিয়াছিলেন—একটি মেয়ে স্টেনোগ্রাফার চাই। সুরেশ্বর কোনওকালে দিবেন মেয়ে-স্টেনোর জন্য বিজ্ঞাপন, এটা আর সবার কাছে তো বটেই—সুরেশ্বরের নিকটও বড় অদ্ভুত ঠেকিয়াছিল প্রথমে। কিন্তু দিয়াছিলেন, কেন, অত ভাবিয়া দেখিবার অবসর হয় নাই, শুধু হাত লইয়াই কাজ হইল জীবনে, মন লইয়া তো নাড়াচাড়া করা হয় নাই।…সাক্ষাৎকারের মধ্যে মন যেন অল্প অল্প করিয়া স্বচ্ছ হইয়া উঠিতেছিল। দরখাস্ত পড়িয়া তিনজনকে বাছিয়া লইলেন। দুইজন ফিরিঙ্গি-কন্যা, একটি বাঙালির মেয়ে। বাঙালির মেয়েটি আই. এ. পাস, নাম মিস্ অমিতা সেন। 

সুরেশ্বর ফিরিঙ্গিদেরই ডাক দিলেন প্রথমে। বেশ স্মার্ট, ওরা যেমন হয়। যেটিকে পরে দেখিলেন সেইটিই বেশি ভালো মনে হইল। একটু বয়স হইয়াছে, কাজের অভিজ্ঞতা আছে। ওটিকেই রাখা মনে মনে ঠিক করিলেন। চিঠি দিয়া জানাইবেন বলিয়া দুইজনকে বিদায় দিলেন। 

এটা কিছু-বেশি মাসখানেক আগেকার কথা। বাঙালি মেয়েটিকে ডাকিবেন কি—না একটু স্থির করিতে মাসখানেক লাগিল।…আদৌ মেয়ে-স্টেনো রাখার মধ্যে যেটুকু মনোভাব স্পষ্ট ছিল তাহা এই—থাকুক না, অফিসটা একেবারে হালফ্যাশানের হয়, সাহেবসুবোরা আসে, ওরা সেই পুরোনো একঘেয়েমি একটু অপছন্দ করে। নিজের তিনি অবিবাহিত,—কিন্তু তা বলিয়া মেয়েদের অত ভয় করিবার কী আছে? বাঘও নয়, ভাল্লুকও নয়। 

এক মাস ভাবিয়া চিন্তিয়া বাঙালি মেয়েটিকেও একটা সুযোগ দেওয়া ঠিক হইল।…বাঙালি মেয়েরাও তো অফিসে বাহির হইতেছে আজকাল—এমন কিছু নূতন আর দৃষ্টিকটু হইবে না। 

কাল সকালে মিস্ অমিতা সেন আসিয়াছিলেন দেখা করিতে, কিন্তু তাহার পূর্বেই সুরেশ্বর মন স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন। মনস্থির এই যে মেয়ে-স্টেনোর পাট উঠাইয়া দিয়া এবারে ভালো অভিজ্ঞ পুরুষ-স্টেনোর জন্য নূতন করিয়া বিজ্ঞাপন দিবেন। 

এ ভাবান্তরটা আরম্ভ হইল চিফ ইঞ্জিনিয়ারের প্রশংসাটুকুর পর। যে কর্ম লইয়া সুরেশ্বরের জীবন, নতুন প্রশংসার অনুকূল বায়ুতে সেই কর্মের প্রতি অনুরাগ যেন হঠাৎ আরও শতগুণ বাড়িয়া গেল। এ জীবনে কর্মের যাহা অণুমাত্রও অন্তরায় তাহার উপর মনটা আবার বিরূপ হইয়া উঠিল। সুরেশ্বর নিজের মনের কাছে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করিলেন যে, মেয়ে-স্টেনো নিতান্তই অফিসটাকে শুধু অতি-আধুনিক করিয়া লওয়ার জন্যই নয়। এই নিঃসঙ্গ জীবনে একটা ক্লান্তি আসিয়াছে, শুধু পুরুষ—সান্নিধ্যে দিনগুলা হইয়া পড়িতেছে রুক্ষ;–ভাবিয়াছিলেন, থাকুন না কাছে এমন একজন কেউ, যে তাহার চলাফিরা দিয়াই এক কাগজ-কলম, লেজার-ফাইল, লোহা—ইস্পাত, কুলি-মজুর দিয়া ঘেরা দিনগুলাতে একটু পরিবর্তন আনিতে পারে। দোষ কী? 

প্রশংসা পাওয়ার পর মনে যে জোয়ারটা নামিল, তাহাতে তাহাকে এটাও মানাইয়া ছাড়িল যে, আছে দোষ। নারীর একটু সান্নিধ্যও একটা বিলাসিতা—সযত্নে পরিহার করিতে হইবে। সমস্ত জীবন এটুকুকেও খুব সাবধানে এড়াইয়া আসিয়াছেন বলিয়াই আজ তিনি কর্মজীবনে এতটা সাফল্যের অধিকারী। এ লঘুতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলিবে না। 

মনের এই রকম বজ্র-কঠোর অবস্থায় মিস অমিতা সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল। মিস সেনের বয়স হইবে বছর তিরিশ-বত্রিশ, এক-আধ বৎসর বেশি হওয়া ও অসম্ভব নয়। অনপচয়িত যৌবন বয়সের সীমানা পার হইয়াও লুপ্ত হইয়া যায় নাই একেবারে। তবে মুখে দৃষ্টিতে একটি যে ক্লান্তির ছায়া আছে তাহাতে অনুমান হয়, দেহ যেমনই থাক মনটা যেন প্রৌঢ়ত্বেরও গণ্ডি ডিঙাইয়া একেবারে বার্ধক্যের কাছাকাছি গিয়া পড়িয়াছে। একটা যেন বহুদিন অপেক্ষা করার শ্রান্তি।…সুরেশ্বরের মনে হইল এই রকমটা মনের ভ্রান্তিও হইতে পারে। 

একটা কথা; মহিলাটিকে দেখা মাত্রই সুরেশ্বরের ভ্রু দুইটি একটু কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল, স্মৃতিতে যেন একটু দোল লাগিল; তখনই সে ভাবটা সামলাইয়া লইলেন। একটু প্রশ্নোত্তর হইল। (নেহাৎ শুরু করা হিসাবে) —

আপনারই নাম মিস অমিতা সেন? 

আজ্ঞে হাঁ। 

(অস্বস্তির সহিত একটু চুপ করিয়া থাকার পর) 

অফিস সম্বন্ধে আপনার কোনও অভিজ্ঞতা আছে? 

বিশেষ নয়, স্টেনোর পোস্ট,—বাড়িতে শর্ট-হ্যান্ড আর টাইপ রাইটিংটা শিখেছি, তাই ভাবলাম— 

(সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যাইবে তাহা হইলে, একটি স্বস্তির নিশ্বাস পড়িল।) হুঁ। এর আগে কোথায় কাজ করতেন? 

স্কুলে—মিস্ট্রেসের পোস্টে। আই-এ-র বিশেষ কোনও প্রসপেক্ট নেই, তাই মনে করলাম— মেয়েছেলের মুখের উপর সহজভাবে দৃষ্টি ফেলায় অভ্যস্ত নয়, তবুও কথাবার্তার মধ্যে যতটুকু চাহিতে পারিতেছেন বা চাহিতে হইতেছে, তাহাতে স্মৃতিতে অল্প অল্প ঘা পড়িতেছে। কেমন যেন মনে হইতেছে, আর একটু বসুক, আরও দুইটা কথা জিজ্ঞাসা করি। 

অথচ মেয়ে-স্টেনো রাখা হইবে না এটা তো ঠিক হইয়া গেছে। 

নিজের মনের প্রতি কঠোর হইতে গিয়া সুরেশ্বর নবাগতার উপরই হঠাৎ একটু রূঢ় হইয়া উঠিলেন; একভাবে রূঢ়তাই বই কী। একটু বেখাপ্পাভাবেই বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু সরি, আমার বড্ড ভুল হয়ে যাচ্ছে মিস সেন, আপনাকে বসিয়ে রেখে, মানে —ইয়ে—আজ ম্যাটার অব ফ্যাকট এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা আমায় আপাতত স্থগিত রাখতে হচ্ছে—মানে, হঠাৎ এই রকম স্থির করতে হল—আপনাকে একটা টেলিগ্রাম ও করবার—তা, আমি সেকেন্ড ক্লাসের ফেয়ারটা দিয়ে দিচ্ছি—বোথ ওয়েজ—আর যদি ভবিষ্যতে কখন—মানে, যদি ভবিষ্যতে— 

কথাগুলা যেন গায়ে গায়ে জড়াইয়া মুখে মিলাইয়া গেল। সামনে দেখা যাইতেছে, মিস সেনের মুখটা দারুণ নিরাশায় একবার ছাইপানা হইয়াই সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় অপমানে রাঙা হইয়া উঠিল। উঠিয়া দাঁড়াইলেন, অতগুলা অবান্তর কথার জন্য একটাও কিছু না বলিয়া যুক্তকরে নমস্কার করিয়া বলিলেন, না, এতে ভাড়া দেওয়ার কী আছে? আমি আসি তবে। 

একটা যেন কী হইয়া গেল! সমস্ত শরীরটা যেন ঘিঘিন্ করিতে লাগিল খানিকক্ষণ,—এ কী একটা বিসদৃশ ব্যাপার!—নিতান্তই একটা লজ্জাকর কাণ্ড! 

তাহার পর দিবাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাজের স্রোত আসিয়া পড়িল, প্রবল উন্মাদনার মধ্যে সামান্য একটা ঘটনা লইয়া লঘু ওই অনুতাপটুকু কোথায় ভাসিয়া গেল! 

.

কিন্তু সত্যই কি গিয়াছিল ভাসিয়া? 

এখন মনে হইতেছে মনের কোথায় সুপ্ত ছিল, এই সময়টুকু অপেক্ষায়। 

সব যেন বিস্বাদ ঠেকিতেছে। সুরেশ্বর অফিসের পোশাকেই বারান্দায় ডেক—চেয়ারটা টানিয়া শরীর এলাইয়া দিলেন—সামনে রহিল পাহাড়তলির সুবিস্তীর্ণ উচ্চাঙ্গ প্রান্তর, আর হেমন্তের অপরাহু—আকাশের গায়ে একখানি যেন করুণ পূরবি রাগিণী। বেতালা সংগতের মতো দূরে পুলের গায়ে মাঝে মাঝে লোহা পেটার শব্দ হইতেছে। ওভারটাইমে জরুরি কাজ চলিতেছে। আজ সমস্ত সংযম লঙ্ঘন করিয়া মনটা একটি বিষণ্ণ মুখের ছবি চারিদিকে যেন ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।…চেনা মুখ কি?…যেন এক—এক বার খুব কাছে আসিয়া আবার মিলাইয়া যাইতেছে। মনে পড়িতেছে জীবনটা চিরদিনই এই রকম ছিল না, একটা সময় ছিল যখন ভালো লাগিয়াছিল কতকগুলি মুখ—বিভিন্ন সময়ে, বা একসঙ্গেই—কম বেশি করিয়া, তুলনার যাচাই-করা দৃষ্টিতে। সেই স্বপ্ন-বিলাসের যুগে বোধ হয় এই রকম একখানি মুখ পড়িয়াছিল চোখে। যতই নিবারণ করা যায়, মনটা ততই যেন সুদূরের সেই দিনগুলির পাতা উলটাইয়া উলটাইয়া কী একটা খুঁজিয়া বাহির করিতে চায়! অস্তরাগ যত গাঢ় হইয়া উঠিতে লাগিল, সংগ্রহের পথে সাঁওতাল দম্পতি যতই হইয়া পড়িতে লাগিল সুদূর, মনটা ততই যেন অধিকারের বাহিরে চলিয়া যাইতে লাগিল।…শুধুই খোঁজা, শুধুই হাতড়ানো— এ কে ছিল? কাহাকে আজ এমন রূঢ় বিদায় দেওয়া গেল? 

এমন সময় দূর ইতিহাসের পাতা ওলটানো বন্ধ হইল, পাওয়া গেছে; জীবনের কয়েকটি ঘটনা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। একখানি মুখ রেখায় রেখায় উঠিল বিকশিত হইয়া—সে এই মুখই, ঠিক এই মুখই তো—এইরকম শান্ত, নির্ভরশীল দৃষ্টি, আরও কচি বলিয়া আরও যেন নির্ভরশীল— 

হ্যাঁ, এই সুরেশ্বরের জীবনেও একবার রোম্যান্সের রেখাপাত হইয়াছিল—সে আজ প্রায় কুড়ি-বাইশ বৎসরের কথা। 

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস দিয়া সুরেশ্বর নূতন জীবনের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। আর কিছু করিবার পূর্বে তিনি ধর্মতলার একটি ভালো দোকানে গিয়া নিজের ফোটোটা তুলাইয়া লইলেন, বোধ হয় মনে হইল জীবনের এই সন্ধিক্ষণটিকে এই করিয়া একটু বিশিষ্ট করিয়া রাখা যাক, আজকের সুরেশ্বরও অন্যদিনের সুরেশ্বর হইতে একটু আলাদা হইয়া থাকুক। 

চেহারা লইয়া সুরেশ্বরের বরাবর একটু সুখ্যাতি আছে। সে সময় ভরা যৌবন, তাহার উপর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাপ দেওয়া অটুট স্বাস্থ্য। ফোটোটা যে দিন আনিতে গেলেন, ফোটোগ্রাফার মিস্টার ব্যানার্জি বলিলেন, আপনার একখানি ফোটো মাউন্টে বাঁধিয়ে আমার শো-কেসে রেখে দিলাম, নিশ্চয় আপত্তি করবেন না। ফোটোটি উঠেছে খুব ভালো, তা ভিন্ন— 

‘এমন চেহারাও সচরাচর চোখে পড়ে না’—এ কথাটা তো মুখ ফুটিয়া বলা যায় না। মৃদু হাস্যের সঙ্গে ওটুকু উহ্যই রাখিয়া দিলেন। সুরেশ্বরও একটু লজ্জিতভাবে হাসিয়া কহিলেন, না, আপত্তি আর কী, আমি নিজে তো শো-কেসে বন্ধ হচ্ছি না? 

আসুন দেখবেন। 

একটি খুব নূতন ডিজাইনের নিকেলের মাউন্টে হেলাইয়া দাঁড় করানো রহিয়াছে ফোটোটা, বেশ ভালো লাগিল সুরেশ্বরের।—নিজের সৌন্দর্য মর্যাদা পাইলে কার লাগে না ভালো? কিন্তু এর চেয়েও ভালো লাগিয়াছিল অন্য একটা ফোটো। বোধ হয় সাধারণ শিষ্টাচার বশেই ফোটোগ্রাফার সুরেশ্বরের ফোটোর ঠিক বাঁ পাশেই একটি কিশোরের ফোটো হেলাইয়া রাখিয়াছে, তাহার পাশেই একটি তরুণীর। মুখসাদৃশ্য দেখিয়া মনে হয় দুজনে ভাই-বোন। 

সমস্ত দিন এবং সমস্ত রাত না হইলেও তাহার বেশ একটা মোটা অংশ দুইটি নরম চোখ সুরেশ্বরের চোখের উপর দৃষ্টিপাত করিয়া রহিল। ব্যাপারটা কিছুই নয়, ফোটোর পাশে আর একটা ফোটো দাঁড় করানো আছে এই মাত্র, কিন্তু সে সময়ের যা মন, এই ঘটনাটুকুই সুরেশ্বরের নিকট অর্থে অর্থে যেন পূর্ণ হইয়া উঠিল। একটি অদ্ভুত আনন্দের সঙ্গে একটি অদ্ভুততর বেদনায় মনটি রহিল ভরিয়া। দুইটা দিন যে কী করিয়া কাটিল যেন বুঝিয়া ওঠা যায় না। তৃতীয় দিনে মনের সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করিয়া সুরেশ্বর শেষে হার মানিয়া ধর্মতলার দিকে যাত্রা করিলেন এবং অনেক আগে ট্রাম থেকে নামিয়া পায়ে হাঁটিয়া গিয়া দোকানে উঠিলেন! 

ফটোগ্রাফার মিস্টার ব্যানার্জি নমস্কার করিয়া অভ্যর্থনা করিলেন আসুন।

চোখ দুইটা একটু অবাধ্য ভাবেই শো-কেসের উপর গিয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গেই সংকোচে আসিল ফিরিয়া, তবে সেই দুইটি চক্ষুর স্মৃতিকে ওরই মধ্যে একটু স্পষ্ট করিয়া লইয়া সুরেশ্বর ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে বলিলেন, এই দিক দিয়েই একবার সারকুলার রোডের দিকে যাচ্ছিলাম, মনে করলাম, একবার আপনার দোকানটাও হয়ে যাই— 

বেশ করেছেন, বসুন। এদিকে এলেই আসবেন দয়া করে। 

একটু হইল এদিক ওদিক দুই-একটা কথা, তবে বেশ জমিল না; দোকান-দারের কাছে কাজ না থাকিলে জমে না কথা, তাহার উপর মনে এই কথাটাও চাপিয়া রহিল যে, এ-যাত্রার সঙ্গে সারকুলার রোডের কোনও সম্বন্ধই নাই। এই সময় জড়তা কাটাইয়া—আচ্ছা ‘তবে আসি’ বলিয়া সুরেশ্বর উঠিয়া পড়িলেন। সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় আর একবার শোক-কেসটার দিকে দৃষ্টিপাত করিবার বাসনা হইল, কিন্তু জড়তাটা অতদূর পর্যন্ত কাটানো গেল না! 

আবার গোটা তিনেক দিন কাটিয়া গেল, ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল, এ ভাবে কাটানো চলিবে না, একটা কিছু ব্যবস্থা করিতেই হবে। কিছু না হোক, মাঝে মাঝে একবার দেখাই চাই,—ওই ফোটোটিই। আর কিছু কি পোড়া ভাগ্যে জুটিবে? 

অনেকটা দূর—কোথায় বরানগর, কোথায় কলিকাতার একেবারে মাঝখানে ধর্মতলা! অবশ্য বরাহনগরের লোকের যে কলিকাতার কাজ থাকিতে মানা আছে এমন নয়, তবে প্রত্যেকটি কাজ পথেই পড়িবে, এই দোকানটির সামনে হইয়া—এ কথা লোককে কী করিয়া বিশ্বাস করানো যায়! 

এ দিকে ওই এক কাজ ভিন্ন অন্য কোন কাজে মনও বসিতেছে না। 

কিন্তু তর্ক লইয়াই মানুষ বাঁচিয়া নাই, চতুর্থ দিন বৈকালে সুরেশ্বর আবার দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

অপ্রত্যাশিত সুযোগ,—ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক দোকানে নাই। রহিয়াছে চাকর একটা। ছোকরা, দোকানপাট ঝাড়ে, এধার ওধার বাইরের কাজে যায়—এই রকম গোছের। 

জানাইল ব্যানার্জিবাবু বাহিরে গিয়াছেন। 

ফিরবেন কখন? 

আর আধঘণ্টাটাকে দেরি হবে বাবু—ফোটো তুলতে গেছেন, খুব বেশি তো তিন কোয়ার্টার? 

তিন কোয়াটার? তবেই তো! 

মুখটা কুঞ্চিত করিল, যেন আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা না হওয়ায় কী ক্ষতিটাই যে হইয়া গেল! 

তবুও শো-কেশটির দিকে যাইতে কেমন সংকোচ হইতেছে, ছোঁড়াটার কাছেও। অথচ এত সুযোগ, ফিরিতে ফিরিতে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া চলিয়া যাইতে মন সরে না। ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে সেদিন কথার অভাব ঘটিয়াছিল, ছোঁড়াটার সঙ্গে ততটা হইল না। সুরেশ্বর দুই-পা পায়চারি করিয়া যেন অন্যমনস্কভাবেই শো—কেসটার পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন, কতকটা নিজের মনেই বলিলেন, তাই তো!—তিন কোয়ার্টার! ভাবছি, অপেক্ষাই করে যাব কি না!…কী, একটু পরে ঘুরেই আবার আসব— 

চাকরটা প্রশ্ন করিল, কি দরকার বাবু, তিনি যদি এর মধ্যে ফিরে আসেন কী বলব? 

সে তুই গুছিয়ে বলতে পারবি না।…গেছেন কোথায় বল দিকিন? 

ভবানীপুরে—মিস্টার সেনের বাড়ি। 

তাহার পর বলিল, ওই যে শো-কেসে মিস্টার সেনের ভাই আর বুনের ফটো রয়েছে বাবু। তাঁর পরিবার এয়েচেন, আবার তাঁর ফটো নিতে গেছেন। 

এ পরিচয় দিবার তাৎপর্যটা কী সুরেশ্বর বুঝিতে পারিলেন না, বোধ হয় এইজন্য যে, ছেলেমানুষেরা একটা কথা জানিলে প্রকাশ করিবার জন্য সদাই উৎসুক থাকে। তবে ওঁর একটু সুবিধা হইল। সিঁড়ির গোটা তিন ধাপ নিচে না নামিলে শো-কেসের ফোটোগুলা ঠিকমতো দেখা যায় না, সুরেশ্বর নামিয়া আসিয়া প্রশ্ন করিলেন, কোন ফোটো? 

ছেলেটা নামিয়া আসিয়াছে, তাঁহার ফোটোর পাশে সেই মেয়েটির ফোটো দেখাইয়া বলিল, ওই যে মিস সেনের ফটোগেরাফ। 

সুরেশ্বরের বুকের ধুকধুকুনিটা হঠাৎ বাড়িয়া গেল।…মিস সেন!—সুরেশ্বরও বৈদ্য, পদবি গুপ্ত; একটা যেন দৈবনির্দেশ রহিয়াছে। আর একটা কথা, মিস সেনের ‘ফোটোটি এবারে সুরেশ্বরের ফোটোর পাশেই, ছেলের ফোটোটা তাহার পাশে। 

অতি সুমিষ্ট একটা সংকোচে সুরেশ্বরের সমস্ত শরীর মন যেন আচ্ছন্ন হইয়া গেল।…পরিবর্তনের ইতিহাসটা ছোঁড়াটাই বলিল, আমিই আজ ঝাড়বার মোছবার সময় এ রকম করে রেখে দিলুম, ভালো হল না বাবু? ওনার ফটোর দুপাশে দুটো ভালো ভালো ফটো রইল। হল না ভালো? 

নিষ্পাপ ছেলেমানুষের মন, সুরেশ্বর কী করিয়া বুঝায় ওকে যে, ভালো হইয়াও একদিক দিয়া একেবারেই ভালো হয় নাই?…কণ্ঠের জড়তা কাটাইয়া বলিল, তোর বাবু থাকতে দেবে না, আগেকার মতন করে দে। 

কেন? ঠিক থাকতে দেবে, দেখবেন আপনি এসে। আপনারা তিনজন সুন্দর একসঙ্গে কেমন মানাচ্চে…কখনও পালটাবেন না বাবু—দেখে নেবেন আপনি… 

নিজের সৌন্দর্যজ্ঞান সম্বন্ধে জিদ ধরিয়া বসিল,—ফোটোগ্রাফারের দোকানে কাজ করে—যে-সে নয় তো! সুরেশ্বরেরও কী মনে হইল, জিদটা ভাঙিবার জন্য খুব অতিরিক্ত চেষ্টা করিলেন না। ঘড়িতে দেখিলেন, আধ ঘণ্টা প্রায় হইয়া আসিয়াছে, সময় যেন পাঁচ-সাত মিনিটেই এতটা পথ সারিয়া লইল। 

তবে পারি তো আসছি ফিরে।—বলিয়া বাহির হইয়া গেলেন সুরেশ্বর। 

.

সৌভাগ্যই হোক বা দুর্ভাগ্যই হোক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রেরা রোম্যান্সের ছোঁয়াচ থেকে মুক্তই থাকে। না আছে শেলি, না আছে শেকসপিয়ার—নিশ্চিত্ত। সুরেশ্বরও ছিলেন, কিন্তু যখন লাগিল ছোঁয়াচ তখন যেন একেবারেই জীর্ণ করিয়া ফেলিল। 

বিশ্বাস করা শক্ত—কিন্তু সত্যই উপরি উপরি দুই দিন সুরেশ্বর দোকানটিতে হানা দিতে চেষ্টা করিলেন। উলটা দিকের ফুটপাথে বেশ খানিকটা দূরে আর নিরাপদ অন্তরালে দাঁড়াইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া থাকেন,–ফোটোগ্রাফার মিস্টার ব্যানার্জি একবার বাহির হইয়া গেলেই—আবার গিয়া জরুরি কাজের কথা পাড়িয়া ছোঁড়াটার কাছে বিরক্তি আর নৈরাশ্য প্রকাশ করিবেন। কী রকম যোগাযোগ, মিস্টার ব্যানার্জি পাদমপি নড়িলেন না। 

তৃতীয় দিন সুরেশ্বর আবার কপাল ঠুকিয়া ঢুকিয়া পড়িলেন। দেখিলেন, কপালের জোর আছে। মিস্টার ব্যানার্জির সাগ্রহে অভ্যর্থনা করিলেন, আসুন, অনেকদিন আসেননি এদিকে। 

ছোঁড়াটা তাহা হইলে সেদিন আসার কথাটা বলিতে ভুলিয়া গেছে। 

আসা কি সহজ?—হাসিয়া কথাটা একরকম শেষ করিবার পূর্বেই ছোঁড়াটা একটা পালকের ঝাড়ন হাতে করিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, উনি তো এসেছিলেন সেদিন, পরশু না তরশু…কবে যে এসেছিলেন বাবু? 

সুরেশ্বর সামলাইয়া লইয়া একটু হাসিয়া বলিলেন, না, তরশুই। সেই কথাই তো বলছিলাম—আসা তো সোজা নয় সেই বরানগর থেকে, তবু তো এসেছিলাম তরশু একবার। 

কোনও বিশেষ কাজ ছিল নাকি? এ ব্যাটা তো বলেনি আমায়! 

কাজ—মানে —–কাজ—এক রকম বলতে গেলে—

কপালের জোর ছিল, এই সময় একটি ছোট মোটর, দোকানের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এবং মিস্টার ব্যানার্জি হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। 

এক মিনিট।—বলিয়া সুরেশ্বরের নিকট ছুটি লইয়া তাড়াতাড়ি গিয়া ফুটপাথে নামিয়া দাঁড়াইলেন এবং একবার যুক্তকরে নমস্কার করিয়া লইয়া মোটরের দরজাটা খুলিয়া ধরিলেন। দুইজন তরুণী এবং একটি বছর দশ বারোর কিশোর মোটর থেকে নামিল। 

জীবনের সেই কয়েকটি মুহূর্ত আসিয়াছিল…সমস্ত ব্যাপারটি যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিয়া উঠিতেছে।…একজন তরুণী চেনা, ছেলেটিও—অবশ্য ফোটোগ্রাফে; ওদের ফোটো এখনও সুরেশ্বরের ফোটোর পাশে বসানো রহিয়াছে, আজও সিঁড়ি দিয়া উঠিবার সময় দেখিল। 

আগ্রহে, উদ্‌বেগে, এক প্রকারের ভয়েও সুরেশ্বরের সমস্ত অন্তরাত্মা কণ্ঠে আসিয়া জড়ো হইয়াছে। এত বড় যোগাযোগও হয় জীবনে!…গল্প করিতে করিতে চারজনে দোকানে উঠিয়া আসিলেন। বেশ বোঝা গেল, সেন পরিবারের সঙ্গে মিস্টার ব্যানার্জির বেশ পরিচয় এবং হৃদ্যতা আছে, হয়তো ফোটোগ্রাফ লইয়াই, হয়তো আরও পূর্বের জানাশোনা। ভিতরের ঘরে একটা ইজেলের উপর কাপড় ঢাকা একটা ব্রোমাইড এনলার্জমেন্ট ছিল, রং ফলানো হইতেছে, চারিজনে সেইটার সামনে গিয়া দাঁড়াইলেন; মিস্টার সেনের মায়ের এনলার্জমেন্ট—খানিকটা আলোচনা হইল। বাহিরে আসিয়া নিতান্ত নিরুদ্দেশ ভাবেই আরও দুই-একটা ফোটো দেখা-শোনার পর মিস্টার ব্যানার্জি ওঁদের পরিচয় করাইয়া দিলেন। নূতন মহিলাটি মিস সেনের ভ্রাতৃজায়া। সুরেশ্বর সেই প্রথম নমস্কার করিলেন মিস অমিতা সেনকে। কত মধুর। হৃদয়ের মধ্যে কী নূতন জগতের তোরণ খুলিয়া গেছে, নমস্কার নয় তো, করজোড়ে সেই স্মিতময়ীকে যেন সেই নূতন জগতে আমন্ত্রণ করিয়া লওয়া। 

আজ, কুড়ি বৎসর পরে সেই মিস অমিতা সেনকে করা হইল শেষ নমস্কার— বিদায়। 

***

সূর্য অস্ত গেছে, খণ্ড মেঘের গায়ে গায়ে শুধু রঙের প্রলেপ—যেন বুকের রক্ত ঢালিয়া গেল! শীতেল হাওয়া আরও একটু তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল। সাঁওতাল দম্পতি নদী পার হইতেছে, গতি আরও মন্থর।

***

এত কথা,—জীবনের সঙ্গে যে সবের সম্বন্ধ এত নিবিড় বলিয়া আজ মনে হইতেছে, আরও একদিন হইয়াছিল মনে—কোথায় ছিল চাপা এতদিন এসব? লোহার তলে? 

লোহার তলেই বটে, জীবনটাকেও নিষ্পেষিত করিয়া দিয়া গেল এই বোল্ট নাট, জয়েস্ট, অ্যাঙ্গল, শিট… 

পরিচয় পরিচয়ে একটু সম্বন্ধও বাহির হইয়া পড়িল।…লখনউয়ে সুরেশ্বরের কাকা থাকেন।—ডাক্তার হেম গুপ্ত।—ওমা, তিনি তো মিসেস সেনের ভগ্নীর জেঠশ্বশুর হন, অবশ্য একটু দূরসম্পর্কের!…কী আশ্চর্য! 

মিস্টার ব্যানার্জি হাসিয়া বলিলেন, আপনাদের বৈদ্যদের তো সম্বন্ধ না বেরুলেই আশ্চর্য—আমি তো এই জানি। 

নূতন প্রীতিতে হাসি একটু বেশি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কথাবার্তা আরও অন্তরঙ্গ হইয়া উঠিল, নিমন্ত্রণ পর্যন্ত গিয়া উঠিল। 

ছেলেটি কথা কহিতেছিল না, তবে অত্যন্ত কুতুহলী ছেলেমানুষি দৃষ্টিতে সুরেশ্বরের মুখের পানে থাকিয়া থাকিয়া তাকাইতেছিল; একবার দিদির কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কী বলিল, দিদি ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া চাপা গলায় বলিল—আচ্ছা থাক। 

সুরটা একটু ধমকের! 

গল্পের একটু বিরতি পাইয়া ছেলেটি এবার ভাজের কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কী বলিল। 

সত্যি নাকি? দেখি তো।—বলিয়া তিনি শো-কেসের দিকে পা বাড়াইলেন। একবার গ্রীবাটি ঘুরাইয়া বলিলেন, আসুন মিস্টার ব্যানার্জি, আপনার শো-কেসটা দেখি, সত্য বলছে, মিস্টার গুপ্তর ফোটোও নাকি ডিসপ্লে করেছেন।…মিস্টার গুপ্তও আসুন না; অমিতা এস। 

অমিতা গেল না; সিঁড়ি দিয়া উঠিবার সময়ই শো-কেসে তাহার নজর পড়িয়াছিল, দুই পা গিয়া রাঙিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তাহারই পার্শ্ব দিয়া সুরেশ্বর চলিয়া গেল; সেও রাঙিল; কিন্তু না গিয়া উপায় ছিল না। 

কত স্পষ্ট মনে পড়িতেছে আজ, কিন্তু কত অসময়ে! 

একটু এদিক ওদিক আলোচনা হইল,—হ্যাঁ, ফোটোটি বেশ উঠিয়াছে।… মিসেস সেনের মুখে একটি চটুল, খুব সূক্ষ্ম হাসি লাগিয়া আছে, কী যেন একটা বলিলেন, শেষ পর্যন্ত বলিয়াও ফেলিলেন, বেশ জায়গাটিও পেয়েছেন মিস্টার গুপ্ত! কনগ্র্যাচুলেট করছি। 

দুই দিকেই ঠাট্টার সম্বন্ধ তো? একদিকে না হয় একটু বেশি দূরের 

ভুলটা মিস্টার ব্যানার্জির এই এতদিনে চোখে পড়িল। খুব অপ্রতিভ হইয়া শো—কেসটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফোটো দুইটি আলাদা করিয়া বসাইয়া দিলেন! বেশ খানিকটা আগে পিছে করিয়া বলিলেন, সরি, চাকরটার কাজ গর্দভ! 

মুখে লজ্জায় চাপা কৌতুকে কী যে কয়েকটা মিনিট কাটিল! 

চাপা দিতে গিয়া যে ব্যাপারটি প্রকাশ হইয়া পড়িল, সেটা সবাইকেই অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে—নানা ভাবে। অমিতার ভাই শুধু নিরীহ কণ্ঠে বলিল, কেন সরালেন? বেশ তো ছিল। 

এই হইল সাতটি দিনের রোম্যান্স সুরেশ্বরের জীবনে — প্রথম এবং শেষ। 

বাড়ি আসিয়া সুরেশ্বর একটা অফিস-খামে চিঠি পাইলেন। খামের গায়ে প্রেরকের ঠিকানা দেখিয়া কম্পিত হস্তে খামটা ছিঁড়িয়া ফেলিলেন—নিয়োগপত্র।… দরখাস্ত একটা করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু এত বড় কন্ট্রাক্টরের ফারমে কলেজ ছাড়িয়াই এতবড় দায়িত্বের কাজ আশা করেন নাই। আর কী বিরাট একটা কাজ! 

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে উৎকর্ষপ্রাপ্ত শিরোপেশিগুলি কর্মের উন্মাদনায় সব একসঙ্গে যেন নাচিয়া উঠিল। কী একটা আনন্দ!—কী আনন্দ—এক মুহূর্তেই কোথায় ভাসিয়া গেল রোম্যান্স! ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট বয়—সে কি এই ফিনফিনে হালকা একটা রোম্যান্সের জন্য সৃষ্টি হইয়াছিল? সুরেশ্বরের জীবনের রোম্যান্স তো কাজ— কাজ—শুধুই কাজ— 

তাহার পর গিয়া একটানা কর্মের জীবন—সাফল্যের পর সাফল্য, যশের পর যশ, উন্মাদনার গায়ে উন্মাদনা—ডাইনে বাঁয়ে দেখিবার অবসর হয় নাই। রোম্যান্স এমন গেল ধুইয়া মুছিয়া যে অতি ঘরোয়া যে রোম্যান্স বিবাহ, সেটাকেও কেমন যেন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া মনে হইল—প্রায় হেয় একটা ব্যাপার।… রেলের প্রখ্যাত কন্ট্রাক্টর সুরেশ্বর গুপ্ত যেন একটা এক্সপ্রেস ট্রেনেরই উদ্দাম গতিতে একেবারে জীবনের এইখানটিতে আসিয়া দাঁড়াইলেন। 

আজ হেমন্তর অপরাহ্ণে আসিয়া গতি হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া গেল। কী আছে এই শীতল হাওয়ায়, কী আছে এই উদাস করা সোনালি রঙে? হেমন্তের দিনশেষে যে ঝিঁঝিটি ডাকে, তারও একটানা সুরে কি শুধু একটানা কান্নাই ভরা? 

কে ছিল অমিতা? সেই সচ্ছল অবস্থা কোথায় গেল? কেন গেল? অমিতাও বিবাহ করিল না কেন? আজ আসিয়াছিল কেন সে? জানিয়া শুনিয়াই কি? আর আশ্চর্য—একটি মাত্র বাঙালির মেয়েকে বাছিলেন সুরেশ্বর—সেও অন্য কেহ নয়, সেই বিশ বৎসর আগেকার সেই অমিতা। এত আশ্চর্য ব্যাপারও ঘটে জীবনে! অমিতাকে যায় না আর ফিরাইয়া আনা? 

.

সন্ধ্যা নামিয়া গেল। নিতান্ত মোহমায়ার মতোই অল্প একটু রঙের আমেজ আকাশের একেবারে উচ্চস্তরে এক-আধটা মেঘখণ্ডে এখনও লাগিয়া আছে; সেই সাঁওতালি দম্পতিটি নদী পারাইয়া গেছে, তীরের ঢালুতে দুইটি কালো রেখার মতো তাহাদের দেখা যায়—গতি মন্থর; তবু প্রাণবন্ত। পুরুষটির মাথায় ধানের ফসল সোহাগের দোল খাইতে খাইতে চলিয়াছে। 

এর পাশে কোথায় যেন সুরেশ্বর আরও দুইজনকে দেখিতে পাইতেছেন মাঝে মাঝে—দুইজনেরই অনেক আগে-পিছে, নিঃসঙ্গ শ্রান্ত ব্যর্থ…কেহ কাহাকেও পাইবে না জীবনে। নীড় নাই, সোনার ফসলও নাই;—শ্রান্ত সন্ধ্যায় কোথায় গিয়া কী গুছাইয়া তুলিবে? 

অস্তরাগের শেষতম আভাসটুকুও আকাশে মুছিয়া গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হৈমন্তী

হৈমন্তী

বৈদেহী বিচিত্র আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়
প্রচারিল আচম্বিতে অধরার অহেতু আকূতি :
অস্তগামী সবিতার মেঘমুক্ত মাঙ্গলিক দ্যুতি
অনিত্যের দায়ভাগ রেখে গেল রজনীগন্ধায়।।

ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্তলোহিত,
তরুণতরুণীশূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ,নিশাক্রান্ত বিষন্ন বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত ।।

নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত,
রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা ;
আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিনাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ।।

সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকন্ঠ বিতর্ক, বিচার,
প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর :
জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর ;
তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার ।।

যারা ছিল একদিন ; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা ;
যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয় ;
স্বয়ম্ভূ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ।।

ফুটিবে গীতায় মোর দুঃস্থ হাসি, সুখের ক্রন্দন,
দৈনিক দীনতা-দুষ্ট বাঁচিবার উল্লাস কেবল,
নিমেষের আত্মবোধ, নিমেষের অধৈর্য অবল,
অখণ্ড নির্বাণ-ভরা রমণীর তড়িৎ চুম্বন ।।

মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে,
স্থান পাবে, হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার :
বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার ;
আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *