হে হিসাব
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি এবং বলে এসেছি হিসাব, পরে কলকাতায় এসে জেনেছি হিসেব।
হিসাব কিংবা হিসেব যাই হোক জিনিসটা সোজা নয়, জিনিসটাকে শেষ পর্যন্ত মেলাতেই হবে।
হিসেব যারা বোঝে ঠিকই বোঝে, যারা বোঝে না কখনও বোঝে না। প্রগলভ এক বণিক তাঁর এক নিম্নবিত্ত বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার চেয়ে সুখী।’
বন্ধুটি অবাক, মাত্র গতকালই তাঁর একটি কন্যাসন্তান হয়েছে এবং দুঃখের বিষয় এটি তাঁর সপ্তম কন্যা। তিনি বললেন, ‘এ কী বলছ সাধু? আমি গরিব মানুষ। আমার সাত-সাতটা মেয়ে আর তুমি কোটিপতি, সাতকোটি টাকার মালিক, আমি কী করে তোমার চেয়ে সুখী?’
কোটিপতি বললেন, ‘দ্যাখো সাত কোটির পরও আমার নিবৃত্তি হয়নি, আমার আরো চাই, কিন্তু সাত মেয়ের পরে তুমি কি আরও চাও?’
বলাবাহুল্য, বুদ্ধিমতী পাঠিকা অবশ্যই ধরতে পেরেছেন, যদি তিনি কন্যা-সন্তানের জননী হন তা হলে তো অবশ্য অবশ্য নিশ্চয়ই, এই দুই হিসেবের তুলনায় একটা বড় গোঁজামিল আছে।
হিসাব শব্দটি বাংলাভাষায় এসেছে সরাসরি আরবি থেকে। বাংলায় একটি চমৎকার শব্দ হিসাবনিকাশ, হিসাব ও নিকাশ দ্বন্দ্ব সমাস, প্রথম অংশটি তো আরবি আর দ্বিতীয় অংশ নিষ্কাশন থেকে নিকাশ, সংস্কৃত থেকে বাংলায় উদ্ভব শব্দ। তবে ‘হিসাব’ চলতি বাংলায় অনেকদিন হল ‘হিসেব’ হয়ে গেছে। এই নিবন্ধের নামে “হিসাব” শব্দ ব্যবহার করলেও আমরা রচনায় “হিসেব” শব্দটি ব্যবহার করছি।
হিসেব কিন্তু সবসময় মেলে না।
সব হিসেব কোনোদিন কখনও মেলে না। কত লোক আছে সারাজীবন ধরে হিসেব কষে যায়। খাতার পর খাতা ভরে যায় দীর্ঘ কাটাকুটিতে, পেনসিল ফুরনোর আগে পেনসিলের ইরেজার ফুরিয়ে যায়, কিন্তু হিসেব মেলে না। শ্লেট ছেয়ে যায় ধূসর অস্পষ্টতায়, শেষ পর্যন্ত হাতে থাকে সেই সুকুমার রায়ের “হ য ব র ল” বর্ণিত পেনসিল।
তবু ঠিক হাসিঠাট্টার কথা নয়। এমন অনেক দুর্ভাগ্য মানুষ আছে যাদের কোনও হিসেব কখনও মেলে না, সেই যে গানের কথা রয়েছে না যতবার আলো জ্বালাতে যাই, নিভে যায় বারে বারে। ভাগ্যের কাছে পরাজিত মানুষের দুঃখের গান, সে এই হিসেব না মেলারই গান।
এসব কথা যাক। দুঃখের কথা, বেদনার কথা আমার বলার প্রয়োজন নেই, এসব কথা বলার অনেক ভাল ভাল লোক আছে।
সুতরাং হালকা গল্প বলি। বহু পুরনো সব গল্প। শুধু লেখার জন্যে লেখা।
সেই মাস্টার মশাইয়ের কথা মনে পড়ছে যিনি ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমি যদি তোমার বাবাকে একশো টাকা দিই, আর তিনি যদি মাসে মাসে দশ টাকা করে আমাকে শোধ দেন তাহলে আট মাস পরে তাঁর কাছে আমার কত টাকা পাওনা থাকবে?’
প্রশ্ন শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রায় নির্বিকারভাবে ছাত্রটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, ‘একশো টাকা’।
উত্তর শুনে মাস্টার মশায় ধমকিয়ে উঠলেন, ‘সে কী! মাসে মাসে দশ টাকা করে আট মাসে শোধ দেওয়ার পরেও একশো টাকা পাওনা থাকে কী করে?’
ছেলেটি আবার একইরকম নির্বিকারভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ একশো টাকাই পাওনা থাকবে।’ তারপর মাস্টার মশাইকে দ্বিতীয়বার ধমকানোর সুযোগ না দিয়ে ব্যাখ্যা করে বলল, ‘আপনি তো আর আমার বাবাকে চেনেন না। আমার বাবা কোনও টাকাই শোধ দেবে না।’
এক্ষেত্রে মাস্টার মশাইয়ের হিসেব মিলল না ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাবে।
তবে অভিজ্ঞতাই সব নয়, জ্ঞান ব্যাপারটাও জরুরি।
স্কুলের নিচু ক্লাসে এক-দুই শেখাতেন দিদিমণি। খুব ছোট একটা মেয়েকে একদিন তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সুরমা বলো তো তিন আর এক যোগ করলে কত হবে?’
অনেক চিন্তা করে, অনেক মাথা ঘামিয়ে অবশেষে সুরমা বলল, ‘দিদিমণি বলতে পারছি না।’
তখন দিদিমণি বললেন, ‘তুমি ভারী কাঁচা অঙ্কে। তিন আর একে চার হবে, এই সামান্য যোগটুকু কষতে পারলে না?’
এবার কিন্তু সুরমা ঘাড় নেড়ে আপত্তি জানাল, ‘কিন্তু দিদিমণি তা তো হতে পারে না।’
দিদিমণি অবাক হলেন, ‘কেন হতে পারে না!’
সুরমা বলল, ‘আপনিই তো কালকে বললেন, দুয়ে-দুয়ে চার হয়। তা একবার দুয়ে-দুয়ে চার হয়ে গেলে, তারপর আবার কী করে তিন আর এক যোগ দিলে চার হবে?’
তবে সবাই যে একরকম হিসেব শিখবে, সবাইকে যে একইরকম হিসেব শিখতে হবে তার কোনো কথা নেই।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ বাইরের ঘরে বসে তার বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে গল্প। বাচ্চা মানে খুবই বাচ্চা এবং খুবই পাকা। তার নাম মনোরমা।
কথায় কথায় মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি গুনতে পারো, এক দুই গুনতে শিখেছ?’
মনোরমা বলল, ‘হ্যাঁ।’
আমি বললাম, ‘বলো দেখি।’
মনেরমা গড়গড় করে বলে গেল, ‘টেক্কা, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ।’
দশ পর্যন্ত গুণে মনোরমা থেমে গেল, কিন্তু শুরুতেই একের বদলে টেক্কা শুনে আমার কেমন খটকা লাগল।
আমি মনোরমাকে বললাম, ‘তার পরে?’
একট চুপ করে থেকে মনোরমা বলল, ‘গোলাম, বিবি, সাহেব।’
ভেতরের ঘর থেকে তখন চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, ‘থ্রি নো ট্রামপস,’ ‘ফোর ডায়মন্ডস’…।
তুমুল তাস খেলা চলছে। মনোরমার বাবা, মা, কাকা, পিসি তাদের বন্ধুবান্ধব দিনরাত তাস খেলছে। মনোরমার এক দুইয়ের হিসেবে দুয়েকটা তাস ঢুকে যাবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে।
পুনশ্চঃ
অবশেষে পাঠক-পাঠিকাদের হিসেবের দৌড় একটু পরীক্ষা করে দেখি।
একটা সোজা প্রশ্ন করছি।
বলতে পারেন, যদি কারো জন্ম হয় উনিশশো পঞ্চাশ সালে, তার এখন বয়েস কত?
এর উত্তর যত সোজা ভাবছেন, তা কিন্তু নয়। এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আপনাকে অবশ্যই একটা প্রশ্ন করে প্রশ্নকর্তার কাছে জেনে নিতে হবে যাঁর বয়েসের কথা জানতে চাওয়া হচ্ছে, তিনি কি পুরুষ না স্ত্রীলোক?
একেক জিনিসের হিসেব একেক রকম।