হে স্বাধীনতা তুমি
আমরা চলেছি স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলতে অনেকটা দূরে। ধরলা নদী পেরিয়ে বাঁশুয়া খামার সেই মৌজার নাম। কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গীতালদহ সীমান্তে। ওদিকে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা। আর আছে ঠিক সীমান্তে ওপারে সেই মোগলহাট। ধরলা নদীর ওপারে মোগলহাটের কথা আমি অনেক শুনেছি। ঐ হাট বসিয়েছিল এক মোগল ফৌজদার। মোগল ফৌজদার কোচবিহার জয় করতে আসছিল রংপুর থেকে। ধরলা নদীর ধারে, ওপারে তাঁবু ফেলে কদিন বিশ্রাম। খোঁজ খবর আসছে স্বাধীন রাজ্য কোচবিহার থেকে। রাজার দত্তক পুত্র দীননারায়ণ সিংহাসনের লোভে মোগল ফৌজদারকে ডেকে এনেছিল এই রাজ্যে। একটি বছর কোচবিহার ছিল মোগলের অধীন। ফৌজদার সিংহাসনে বসিয়েছিল দীননারায়ণকে। এ হলো অষ্টাদশ শতকের তিরিশের দশকের কথা। এক বছর পর কোচবিহারের রাজা ভুটানের রাজার সাহায্যে আবার জয় করে নেন নিজ রাজ্য। এ হলো ইতিহাসের কথা। কিছু সত্য। কিছু কল্পনা। হয়তো অনেক সত্যই হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু চিহ্ন নিয়ে সেই সময় টিকে আছে। মোগলহাট সেই চিহ্ন। আমরা মোগলহাটে যেতে পারব না, সেই হাট বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আমার দেশ নয়। কিন্তু আমার পিতৃপুরুষের দেশ। স্বজন বন্ধুদের দেশ। ভারত আমার দেশ। আমার ও আমার সন্তানদের দেশ। আমরা চলেছি এক নতুন ভূখন্ডকে স্বাধীন ভারতের অংশ ঘোষণা করতে। গত রাতে ঠিক বারোটার সময় আকাশে ছিল পরিপূর্ণ চাঁদ, মেঘের ভিতর থেকে তা মুখ বাড়িয়েছিল মধ্য মশালডাঙা মৌজায় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন দেখতে। রাত বারোটার সেই কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান ছিল ছিটমহল বিনিময় সমিতির। অনেক ফানুস উড়েছিল, অনেক আলোর ঝলকানি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম কত উল্লসিত মুখ, ছিটমহলের বাসিন্দারা পেল নিজ দেশ নিজ দেশের ভিতরেই। গ্রামগুলির অদ্ভুত এক অলীক এক পরিচয় ছিল, দেশের ভিতরে বিদেশ। ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ। তারা আজ ১লা আগস্ট থেকে হয়ে গেল ভারতের ভিতরে ভারত। গত ৬ই জুন ২০১৫ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় বসে যে স্থলসীমা চুক্তি করেছেন, তাতেই এই ঘোষণা ছিল। প্রশাসন ১লা আগস্ট সকাল নটায় ভারতের একান্ন ছিটমহলেই ভারতের পতাকা উত্তোলন করে সেই স্বাধীনতায় শিলমোহর দেবেন। আমরা, আমি, তরুণ বন্ধু সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রশাসনের সঙ্গী হলাম। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শীতল বসু বললেন, ৫১ ছিটের ভিতরে দিনহাটা মহকুমায় আছে ১৯টি ছিট-মৌজা।
ছিটমহল বিনিময় সম্পূর্ণতা পাবে সেখানে প্রশাসন ভারতের পতাকা উত্তোলন করলে। প্রশাসনিক স্বীকৃতি ছিল না বলেই তো ছিটমহলের একান্ন গ্রাম ছিল রাষ্ট্রহীন। আর রাষ্ট্রহীন হওয়ার যে ভয়ানক অপমান, লাঞ্ছনা ছিটমহলের মানুষ ১৯৪৭ থেকে এই ২০১৫ পযর্ন্ত ভোগ করেছে তা অবর্ণনীয়। আসলে সে ছিল বন্দী দশা। ভারতের ভিতরের ভূখণ্ড, কিন্তু তা আগে পাকিস্তান পরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহলগুলির যোগাযোগ নেই বছর তিরিশ আগে কাঁটাতারে সীমান্ত ঘিরে ফেলার পর থেকে। যদিও ধরলার ওপারে কাঁটাতার নেই। তাই বাঁশুয়া খামার মৌজাটি স্থলভূমিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যদিও সেই বাংলাদেশে যেতে হলেও ভারতীয় গ্রাম দড়িবশ ও ঝালি ধরলা পার হতে হতো। এক দেশের ভিতর দিয়ে আর এক দেশে। শুনলাম সবর্ত্র এবার কাঁটাতার বসে যাবে। স্থলসীমা চুক্তির জন্যই অপেক্ষা করছিল প্রশাসন। ছিটমহলবাসীর বন্দীদশা এমনই ছিল, গ্রাম থেকে বেরিয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে পা রাখলেই পুলিশ কিংবা সীমান্তরক্ষীদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সবুদ ছিল না। আবার বাংলাদেশেও তারা অবাঞ্ছিত। আইনত বাংলাদেশী হলেও কোনো পরিচয়পত্র নেই। ভারতের ভিতরে বাস। সেই নেই রাজ্যের বাসিন্দারা এতদিনে পায়ের তলায় মাটি পেল। সেই মাটি এক দেশ পাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি রাষ্ট্রের পতাকা তুললে।
১লা আগস্ট সকালে দিনহাটা থেকে রঙপুর রোড ধরে রওনা হলাম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনে। স্বাধীনতা উদযাপনে। আমি তো ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা দেখিনি। স্বাধীন দেশে জন্মেছি। স্বাধীন দেশে বড় হয়েছি। পরাধীনতা, বন্দীদশা ইত্যাদির সঙ্গে আমার কেন, আমরা যারা যাচ্ছি গীতালদহর দিকে বাঁশুয়া খামারের পথে, তাদের কোনো পরিচয় হয়নি এতটা জীবনে। আমিই বোধ হয় সিনিয়র ছিলাম সেই যাত্রা পথের সঙ্গীদের ভিতর। আমিও জানি না রাষ্ট্রহীনতা এক ব্যক্তি মানুষের জীবনে কতটা অভিশাপ হয়ে আসতে পারে। ছিটবাসী আপনি আপনার সন্তানটিকে পালস পোলিও খাওয়াবেন। সন্তানের মা সন্তান কোলে পালস পোলিও শিবিরে গেল। স্বামীর নাম, ঠিকানা? ছিটমহল হলে মাকে সন্তান নিয়ে ফিরে আসতে হবে। অগত্যা মূল ভূখন্ডের কোনো ব্যক্তির নাম ঠিকানা, স্বামীর নাম আর ঠিকানা হলো সেই মায়ের। সন্তানের পিতৃপরিচয় বদল করে তবে না পালস পোলিও খাওয়ানো। কত লজ্জা আর অসম্মান। ইস্কুলে ভর্তি হতে হলেও সেই পিতৃপরিচয় বদলীকরণ। ছিটমহল তো বিদেশ। মানুষের মৌলিক অধিকার ছিটমহলবাসীর ছিল না। আপনার ১৬-১৭ বছরের কন্যাকে যদি তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় মাস্তান, কার কাছে যাবেন অভিযোগ নিয়ে? ছিটমহল যে বিদেশ, সেখানকার মানুষের অভিযোগ ভারতীয় থানা নেবে কেন? অথচ গ্রামগুলি ভারতের ভিতরেই। কত যে অপমান আর লাঞ্ছনা, তার ফিরিস্তি দিলে কাহিনি অনেক বড় হয়ে যাবে। বন্দীর যে অধিকার থাকে তাও ছিল না তাদের। আজ ১লা আগস্ট, আজ সমস্ত লাঞ্ছনার অবসান। আজ তাই আর পুরোন ক্ষতের কথা নাই বা তোলা হলো। গতকাল রাত বারোটার পর থেকে ছিটমহলের পরিচয় বদল হয়ে গেছে। কোচবিহার জেলার অভ্যন্তরের ৫১টি ছিটে ভারতের পতাকা উড়বে আজ।
রংপুর থেকে কোচবিহার আসার প্রাচীন পথ ছিল এইটা। শুনেছি দেশ ভাগের আগে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গে আসার যে রেলপথ ছিল, শিয়ালদহ থেকে রাণাঘাট হয়ে পোড়াদহ, পাকশি জংশন হয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পদ্মা পার হয়ে নাটোর ঈশ্বরদি সান্তাহার জংশন হয়ে এইদিকে, তার একটা শাখা লালমনিরহাট হয়ে গীতালদহ দিয়ে কোচবিহারে ঢুকত। সেই লাইনের পরিত্যক্ত রেলব্রিজ আছে গীতালদহে ধরলা নদীর উপর। আমরা রংপুর রোড ধরে অনেকটা পথ গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে গ্রামের পথ ধরে ধরলা নদীর দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শীতল বসু বললেন, গন্তব্য কাশেমের ঘাট। সেখানে বি.এস.এফ আমাদের জন্য স্পিড বোট রেখেছে নদী পার হয়ে বাঁশুয়া খামার ছিটে যাওয়ার জন্য। ধরলা বাংলাদেশে যে নদীর নাম, যে বিস্তৃত নদীর কূলে আমরা পৌছলাম, সেই নদীই আমাদের কোচবিহারের অন্যত্র শিঙ্গিমারি নদী। শিঙ্গিমারি নদীকে আমি পেয়েছিলাম বাতৃগাছি পার হয়ে বাংলাদেশি ছিটে ঘেরা ভারতীয় ভূখন্ড মদনাগুড়ির গায়ে। এই শিঙ্গিমারি আরো উত্তরে মাথাভাঙার দিকে মানসাই নদী। মানসাই নদীর নামই আরো উত্তরে পাহাড়ের কোলে জলঢাকা। এক নদীর নাম ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। কত বড় এই নদী। ভরা শ্রাবণে তার ওকূল দেখা যায় না। মাঝে চরও পড়েছে। কাশেমের ঘাট নামটিও প্রায় তিনশো বছর আগের ইতিহাসকে ছুঁয়ে আছে। ছিটমহলের উৎপত্তি তার সঙ্গে হয়তো জড়িত। মোগল ফৌজদার কাশেম আলি কোচবিহারের রাজা উপেন্দ্রনারায়ণের কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের পর এই ঘাট থেকে ধরলা নদী পার হয়ে রঙপুরের পথে পালিয়েছিল। সন ১৭৩৮। মোগলরা এক বছর কোচবিহার দখলে রেখেছিল। আর তখন মোগল সৈন্যরা যে গ্রামগুলিতে বসত করেছিল, সেই গ্রামই এখন ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ, কেন না মোগল সৈন্যরা কোচবিহার রাজ্যে বাস করে মোগল ফৌজদার অর্থাৎ বাংলার নবাবের প্রতি আনুগত্য রেখেছিল। তাদের খাজনা জমা পড়ত রঙপুরে। খাজনা যিনি পাবেন, তাঁরই অধীনতায় গিয়েছিল মৌজাগুলি।
কাশেমের ঘাটে বি,এস,এফের চৌকি। নদী পেরিয়ে কেউ এলে পরিচয় পত্র দেখাতে হয় এখানে কেন না বিস্তীর্ণ সীমান্ত কাঁটাতারহীন অরক্ষিত। নদী পেরিয়ে ওপারেও একটি চৌকি আছে। ঘাট থেকে বি,এস,এফের স্পিড বোটে উঠে আমরা চললাম ওপারে। একটিতে আমরা, আর একটিতে দৃপ্ত সীমান্ত প্রহরীরা। আমাদের সঙ্গেও দুজন আছেন। নদীর ভিতর থেকেই পুরোনো রেলব্রিজ দেখা গেল। বন্যায় ওই রেলব্রিজ নষ্ট হয়েছে। আর ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্রিজটি সাক্ষী হয়ে আছে অবিভক্ত বাংলার। বাতাস হচ্ছে। জল খলখল করছে। আমার মনে পড়ছে গত ডিসেম্বরে এই নদী পেরিয়েছিলাম বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি ঘাটে। গন্তব্য ছিল বাংলাদেশের ভিতরে ভারতীয় ছিট দাশিয়ারছড়া। হয়তো এই নদীপথে সেই ফুলবাড়ি ঘাট বেশি দূর নয়। দেশভাগ, সীমান্ত সমস্তটা কত আলোকবর্ষ দূরত্ব যে করে দিয়েছে এ ঘাট থেকে ও ঘাটে, তা মেপে দেখার উপায় নেই। ওপারে ঘাটও সেই কাশেমের ঘাট। ঘাটে উঠে হাঁটাপথ এক কিলোমিটারের মতো। অনেকটা চর। মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা চলছেই। বালি উড়ছে দমকা বাতাসে।
চর ভেঙে আমরা বাঁশুয়া খামারের পথে। আমাদের পথ দেখাচ্ছেন বি.এস.এফ কমান্ডার। মস্ত তার চেহারা। হরিয়ানা থেকে এসেছেন। আমার ঝোলাটি নিতে চাইলেন। দিলাম না। কিন্তু ভাল লাগল। পাটক্ষেতের ভিতর দিয়ে পথ। তারপর আবার জমির আল। উঁচু জমি তাই আমন চাষ এইটুকু পথে নেই। শুধুই পাট। আর সব্জি। আমরা মিনিট পনের হেঁটে পৌঁছে গেলাম ছিটে। যেতে যেতে শুনলাম দূরে কোথাও উলুধ্বনি। বিয়ে না হলে কেন তা হবে এই সকালে। হয়তো গায়ে হলুদের সুস্নিগ্ধ বাতাস বয়ে আনছে ওই মঙ্গলস্বর। স্বাধীনতা পাচ্ছে একটি গ্রাম, পাশের গ্রামে বিয়ে। মঙ্গলধ্বনি। এই মঙ্গলধ্বনি কিন্তু স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলনের জন্যও। সমস্ত কিছু শুভ হতে যাচ্ছে।
এই ছিট খুব ছোট। আয়তন ২৪ একর ৫৪ শতক। সবুজ মাঠের ভিতর পতাকা তোলার প্রস্তুতি সারা। এখানে আট ঘর মানুষ। বাকিটা জমি। কুটির টিনের। ঘেরা আছে সুপুরিবনের সারি দিয়ে। পাশের মৌজা দড়িবশ ও ঝাল্লি ধরলার মানুষ এসে ভীড় করেছেন মাঠে। তাঁদের কারো কারো জমি আছে এখানে। ছিটের জমি, দখল আছে কিন্তু বেচতে হলে সেই লালমনিরহাট। রেজিস্ট্রি করার উপায় নেই। ছিট অপবাদ ঘুচলে সব হবে। চাষীবাসি মানুষের সবই তো জমি। বেচাও হয় বিপদে পড়লে, টাকার দরকার হলে, অসুখবিসুখে বা মেয়ের বিয়ে দিতে হলে। আবার কেনাও হয় হাতে টাকা এলে। টাকা আসে চাষবাস ভাল হলে। কেনা বেচা চলতেই থাকে। সেই কেনা বেচায় ছিটমহল ছিল না। তবে টাকা নিয়ে দু-পাঁচ বছরের চাষের স্বত্ব ছেড়ে দেওয়া হতো। সেই সব প্রথার অবসান হবে। নদীর ওপার, মূল ভূখণ্ড থেকে ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের আনা হয়েছে প্যারেডের জন্য। সকলের শাদা পোশাক। শাদা পোশাকে স্পোর্টস ইন্সট্রাক্টর। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পতাকা তুলে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাঁশুয়া খামার তা ঘোষণা করবেন। তিনি মাইক্রোফোনে বললেন সমস্ত কথা। দিনটি পুণ্য। স্বাধীনতার চেয়ে বড় অর্জন আর কিছু হয়না। মুক্ত হচ্ছে ছিটমহল আর তার বাসিন্দারা। প্যারেড শুরু হলো। আমি, বন্ধু তরুণ সাংবাদিক অনমিত্র অবাক হয়ে দেখছি আর সব মানুষের মুখ। তাঁরা অভিভূত। ৬৮ বছরের গ্লানি পতাকা উঠে গেলে কেটে যাবে। ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার এমনই স্নেহ আর ভালবাসা। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পতাকা তুলতে লাগলেন। পতাকা উঠল। বাতাসে পতপত করে উড়ছে। পতাকার উড়ানে যেন মুক্ত মানুষের, মুক্ত মাটির উল্লাস। সকলে ঘিরে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে। কী এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। গরিব মানুষ তারা। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তারা গলা মিলিয়েছে জাতীয় সঙ্গীতে। এরপর প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আব্দুল কালামের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোকের কারণে পতাকা অর্ধনমিত করা হলো। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নানা জনকে আহ্বান করলেন তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য। অনেকেই বললেন। ছিটের বাসিন্দা এক গৃহবধূ বললেন অন্তরের কথা। এতদিন প্রতিবেশির তাচ্ছিল্য পেয়েছেন শুধু। হয় তো ঘৃণাও করত তারা। আজ তা থেকে মুক্ত হতে পেরেই তিনি আনন্দিত। ছিটের মানুষ সেই অপবাদ ঘুচবে যে এ জীবনে তা কল্পনাও করেননি। ভেবেছিলেন ছিটেই মাটি নিতে হবে তাঁর শ্বশুর, দাদা শ্বশুরের মতো। ছিটের মাটি কি আসল মাটি? সেই মাটিতে কি মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে পারে? কিন্তু এখন দেশের মাটিতে ঘুমোনোর অধিকারও অর্জন হলো যেন। খুব ভালো লাগছে তাঁর। আনন্দাশ্রু আঁচলে সামলালেন। এখন কোমর বেঁধে বাঁচতে হবে। বাঁচার অধিকার আদায় করতে হবে। হাঁটতে পারেন না, শরীর পেছন দিকে বেঁকে গেছে। কোনো রকমে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসেছিলেন এক মধ্য বয়সী। বেঁচে থাকার কষ্টের ছায়া তাঁর দেহ জুড়ে। তাঁর মুখে হাসি ফুটেছে। স্বাধীনতার এত দাম যে তা আগে দেখিনি।
আসছি ফিরে। আবার নদীঘাট। কাশেমের ঘাট। পিছনে ফিরে তাকালাম। পাট ক্ষেতের আড়ালে চলে গেছে গ্রাম আর মানুষ। হয় তো আর কখনোই আসা হবে না এখানে। কিন্তু মনে থাকবে সেই হাসিমুখখানি। তাঁর হাতে মিষ্টান্নের প্যাকেট দিয়েছিলাম আমি। তিনি নিলেন। কথা বলতে পারেন না মনে হয়। দেহ কাঁপছে। আমার দেশের নাগরিক হলেন তিনি আজ থেকে। তাঁর মুখে হাসি ফোটানোই এখন প্রশাসনের বড় কাজ। পতাকার মর্যাদা তাতেই রক্ষিত হয়। স্বাধীনতা হোক আকাশের মতো। রৌদ্র ছায়া তুমি স্বাধীনতা। মুছে দিও সব অপমান, সমস্ত লাঞ্ছনা।
স্বাধীনতা তুমি,
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান
বয়েসি বটের ঝিলমিল পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
-শামসুর রহমান