হে মাতাল, অমোঘ মাতাল
ইংরেজি প্রবাদ আছে, পেয়ালা ও ঠোঁটের মধ্যে বহু কিছু ফসকিয়ে যায়। এক বিজ্ঞ মাতাল এই বিখ্যাত প্রবাদের উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাই আমি আর পানীয় পেয়ালায় ঢালি না, সরাসরি বোতল থেকে মুখে ঢেলে খাই।
বোতল বা পানীয়ের গল্প কত যে শুনলাম আর পড়লাম, আর তাই নিয়ে ছাই ভস্ম কত কী যে এ যাবৎ লিখলাম কিন্তু এর কোনও শেষ নেই। যাই লিখি না কেন এখন, এর কোনও গল্পই নতুন নয় আবার কোনও গল্পই পুরনো নয়।
প্রথমে সুরেশ আর পরেশের গল্পটাই ধরা যাক। সুরেশ এবং পরেশ দু’জনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং কৃতবিদ্য মদ্যপ। বহু, বহু, গ্যালন মদ্যপানের পর অবশেষে দু’জনে একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয়, আর মদ খাওয়া নয়। ছেড়ে দেওয়া ঠিক করে তারপরে নানা দিক বিবেচনা করে এক বোতল ব্র্যান্ডি সুরেশের কাছে রেখে দেওয়া হল, যদি দু’জনের মধ্যে কেউ কখনও অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে ব্র্যান্ডিটা তাঁর কাজে লাগবে।
একদিন কোনও রকমে কাটল, দু’দিনের মাথায় পরেশ আর সহ্য করতে পারলেন না, সুরেশের বাড়িতে সন্ধ্যায় গিয়ে বললেন, ‘ভাই সুরেশ, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। ব্র্যান্ডিটা একটু বার কর তো।’ অনুরোধ শুনে সুরেশ করুণ মুখ করে বললেন, ‘ভাই পরেশ ব্র্যান্ডি তো আর এক ফোঁটাও নেই। কালকেই আমি এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম পুরো বোতলটা খেয়েও সুবিধে হয়নি, শরীরটা আজও কেমন যেন ম্যাজ-ম্যাজ করছে।’
সুরেশ-পরেশের এই কাহিনীটি অবশ্যই কল্পিত, কিন্তু স্বাস্থ্যের সঙ্গে মদের কিছু একটা যোেগ রয়েছে। স্বাস্থ্যের অজুহাতে মদ্যপান শুরু করে কত লোক যে প্রতিষ্ঠিত মদ্যপে পরিণত হয়েছে। তার ইয়ত্তা নেই। বিলিতি মদ্যপানের আরম্ভেই অন্যের স্বাস্থ্যপানের রীতি আছে। এবং সেই জন্যেই সাহেবি নিষেধাজ্ঞা আছে, ‘দেখো অন্যের স্বাস্থ্যপান বেশি করতে গিয়ে নিজের স্বাস্থ্য নষ্ট, করো না।’
মদের গল্পে স্বাস্থ্যের কথা ভেবে লাভ নেই। আমার নিজের একটা পুরনো অভিজ্ঞতার কথা বলি।।
কয়েক বছর আগে দমদমের এক প্রান্তে এক প্রাচীন বাগানবাড়িতে একটা পার্টিতে নেমন্তন্ন ছিল। পান ভোজনের অতিরিক্ত অত্যাচার এড়ানোর জন্যে একটু দেরি করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম গৃহকর্তা তখনই প্রায় বেসামাল। আমরা নিমন্ত্রণ সেরে চলে আসবার অনেক আগেই তিনি দোতলার বারান্দার একপাশে একটা খাটিয়ায় শয্যাগত হয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হলেন।
গৃহকর্তাকে বাদ দিয়েই বেশ অস্বস্তির মধ্যে আমরা আমাদের খাওয়া-দাওয়া সারলাম। প্রচণ্ড মশা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশার আক্রমণ বাড়তে লাগল। আমরা চলে আসার সময় দেখলাম ঘুমন্ত গৃহকর্তাকে মশায় ছেঁকে ধরেছে। ভদ্রলোকের খাস ভৃত্য কাছেই ছিল, তাকে বললাম, খাটিয়ার উপরে একটা মশারি টাঙিয়ে দিতে। ভৃত্যটি বলল যে, তার মনিব মশারির নীচে শোয়া পছন্দ করেন না। ভোরবেলা উঠে বিছানায় মশারি টাঙানো দেখলে খেপে যাবেন।।
আমি তবু বললাম, কিন্তু মশার কামড়ে তো শেষ করে দেবে। চতুর ভৃত্যটি এতক্ষণে আসল কথাটি বলল, ‘বাবুকর্তা যখন বাগানবাড়িতে আসেন এই খাটিয়াতেই এইভাবে মশারি ছাড়াই শোন। তাতে তেমন কিছু হেরফের হয় না।’ আমাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টির জবাবে সে জানাল, প্রথম রাতে কর্তা এত বেহুঁশ থাকেন মশা কেন বাঘে কামড়ালেও টের পাবেন না। আর শেষ রাতের দিকে কর্তার মদমিশ্রিত রক্ত সন্ধ্যা থেকে পান করে মশাগুলো এত বেহুঁশ হয়ে যায় যে তারা আর কামড়ায় না।
এ রকম ক্ষেত্রে মদ বন্ধুরই কাজ করে, মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা কম কথা নয়। কিন্তু তবু মদ বন্ধু না শত্রু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আজও হয়নি।
এক পাদরি একবার তাঁর সাপ্তাহিক ভাষণে উপদেশ দিয়েছিলেন শত্রুকে ভালবাসতে। কয়েকদিন পরে শ্রোতাদের একজনের সঙ্গে তাঁর রাস্তায় দেখা, সে এক বোতল হুইস্কি হাতে বাড়ি ফিরছে। তিনি বোতলবাহককে বললেন, ‘সর্বনাশ, মদ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছ, মদ তো মানুষের শত্রু’। লোকটি বোতলটাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে পাদরিকে বলল, ‘কিন্তু পাদরিসাহেব, আপনিই না সেদিন বললেন, শত্রুকে ভালবাসতে, তাই তো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’
বন্ধুত্বের অন্য রকম একটা কাহিনী আছে। এক ভদ্রলোক আগে ব্যারাকপুরে থাকতেন, কিছুদিন হল বাসাবদল করে কলকাতায় চলে এসেছেন। এক শনিবার সন্ধ্যাবেলা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে ব্যারাকপুরে গেলেন। যথারীতি আড্ডা, গল্পগুজব, তারপর প্রথমে এক বোতল, পরে আরেক বোতল হুইস্কি আনা হল, ভদ্রলোক আর তাঁর পুরনো তিন-চারজন বন্ধু মনের আনন্দে পুনর্মিলন উৎসব উদযাপন করলেন।
রাত যখন প্রায় এগারোটা, যখন সকলেরই অবস্থা টলমল, লাস্ট ট্রেনের আর দেরি নেই। সবাই মিলে দুটো রিকশা ডেকে চললেন স্টেশনে। তাঁরা যখন স্টেশনে ঢুকেছেন তখন শেষ ট্রেন প্ল্যাটফর্মের থেকে ছাড়ছে। সবাই দৌড় দিলেন ট্রেনের দিকে।
এর পরের দৃশ্য, শূন্য প্ল্যাটফর্মে যাঁর কলকাতায় ফেরার কথা তিনি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, দূরে দ্রুতগতিতে ট্রেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর সেই ট্রেনে চলে যাচ্ছেন ব্যারাকপুরের বন্ধুত্রয়, যাঁরা সি-অফ করতে অর্থাৎ বিদায় জানাতে এসেছিলেন।
মদ্যপানের পর সুষ্ঠুভাবে বিদায় গ্রহণ করা খুব সোজা ব্যাপার নয়। কেউ টলতে টলতে বেরিয়ে যায়, কারও বেরনোর ক্ষমতা থাকে না, কার্পেটের এক প্রান্তে কিংবা সোফার ওপর পা ছড়িয়ে গড়ায়, কেউ অহেতুক ঝগড়া বাধিয়ে গালাগাল করতে করতে এবং ভবিষ্যতে আর কখনও আসবে না জানাতে জানাতে নিস্ক্রান্ত হয়। আরও এক ধরনের লোক আছে, তারা খুব আমুদে আর বিলাসী হয়ে পড়ে, এদের কেউ কেউ অন্যের ঘাড়ে বা পিঠে উঠে বেরনোর চেষ্টা করে। আবার এমন মাতালও পাওয়া যায়, অন্যকে ঘাড়ে বা পিঠে তোলাতেই তার আনন্দ। এরা অনেক সময় আনন্দের আতিশয্যে পার্টিস্থ কোনও মহিলাকে কাঁধে তুলতে চায়, তখনই বিপত্তি।
তবে এসব বিপত্তির ব্যাপারে অনেক মদ্যপই যথেষ্ট সচেতন। এক খ্যাতনামা মাতালকে দেখেছি, নাম বলা বারণ, তিনি পার্টিতে এসে দু’পেগ পান করার পরই সবার কাছে ‘গুড বাই ‘গুড নাইট’ বলে বিদায় প্রার্থনা করেন, খুবই বিনীতভাবে। তাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘সেকী আপনি এখনই, এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন নাকি?’ তিনি মধুর হেসে জবাব দেন, ‘না তা নয়, তবে যখন যাব তখন তো আর বিদায় গ্রহণ করার মতো অবস্থা থাকবে না তাই আগেই বিদায়ের ব্যাপারটা সেরে নিচ্ছি।’