হে নূতন
একটা অদ্ভুত সময়ে বাস করছি আমরা। কাল যেন অদ্ভুত অদৃশ্য বাড়ি। গোটা পৃথিবীর মানুষ তার মধ্যে ঢুকে গেছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় পৃথিবীটা সরতে সরতে একখান হয়ে গেছে। কেউ আর কারও থেকে দূরে নেই। ভাষা আলাদা, গাত্রবর্ণ, রকমসকম, বেশভূষার ধরণও ভিন্ন, কিন্তু সংস্কৃতি ও জীবনের মূল্যবোধ প্রায় একই রকম হয়ে এসেছে।
সেটা কেমন? অশান্ত, ক্ষিপ্ত, ধর্ম বিমুখ, পরিবার বিমুখ, দুর্মুখ, সেচ্ছাচারী। অতীত আর ভবিষ্যৎ মানুষকে আর তেমন ভাবায় না, বর্তমানটাই সব। যে কোনও ভাবে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বরক্ষার প্রয়াস। না পারলে আত্মবিনাশ। হত্যা ও আত্মহত্যা একালের অতি সহজ ঘটনা। কেউ আর তেমন মাথা ঘামায় না, উদ্বিগ্নও হয় না। গা-সহা ব্যাপার। আমি তো বেঁচে আছি! কার কী হচ্ছে জানার দরকার নেই। একান্নবর্তী পরিবার শুধু ভাঙেনি, সমাজও ভেঙে টুকরো টুকরো। সমস্ত ইঁট খুলে খুলে পড়ে গেছে। সমস্ত মশলা ঝরে গেছে।
দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে-অবস্থায় পড়ে আছে সেইটাই তার সংস্কৃতি। দারিদ্র্য, সংশয়, অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা, ভয়, সন্দেহ। চাই কিন্তু পাই না। চাওয়া যত বাড়ছে না পাওয়ার ব্যবধানও তত বড় হচ্ছে। হতাশার পরিসর বিশাল হচ্ছে। ক্ষোভ ঘনীভূত হতে হতে সমাজের সর্বস্তরে বিক্ষোভ ফেটে পড়ছে। মানুষ বারুদের ওপর বসে আছে।
দুশো বছর আগে টমাস রবার্ট ম্যালথাস এই আশঙ্কাই করেছিলেন। জন্মের হার কমাও। না কমাতে পারলে পরিণতি? The result would be increasing starvation and deprivation, mass deaths through famine and desease, and a rending of the social fabric. অনাহার বাড়বে, বাড়বে বঞ্চনা, দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে শয়ে শয়ে মানুষ মরবে, সমাজের বাঁধন খুলে পড়বে। ম্যালথাস বিরোধীরা অবশ্য অন্যকথা বলতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, that while things were troubled at the moment, the growth of human understanding, the capacity for self-improvement and break throughs the knowledge would one day lead to a society that was much more equitable, free of crime and disease, free even of war. ডাগউইন, কনভরসেট প্রমুখ চিন্তাবিদগণ এইরকমই আশাবাদী ছিলেন। আপাতত দুর্দিন, কিন্তু সুদিন আসবেই। মানুষের বোধবুদ্ধি বাড়বে। আন্তোন্নতি ঘটবে, জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, এমন সমাজ তৈরি হবে, যে সমাজে মানুষের কোনও বৈষম্য থাকবে না, অপরাধ থাকবে না, রোগ ব্যাধি থাকবে না, এমনকী যুদ্ধও থাকবে না। কোথায় কী! চারপাশে তাকালে কবির মতোই প্রশ্ন জাগে, Did we come here to laugh or cry? Are we dying or being born ? আমরা হাসতে এসেছি, না কাঁদতে? আমরা মরছি না জন্মাচ্ছি!
এই প্রশ্ন আছে, জনে জনে, কণ্ঠে কণ্ঠে, কিন্তু উত্তর নেই। কারণ আমরা টের না পেলেও বিশ্বজোড়া উত্তাল তরঙ্গে ভাসছি। তৃতীয় ঢেউয়ের দোলায় দুলছি।
প্রথম ঢেউ হল কৃষির আবিষ্কার। মানুষ চাষবাস শিখল। জমির সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা হল। বনচারী গৃহী হল, ঋষি হল। ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল তপোবন। তৈরি হল গুরুকুল। বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ ভক্ত হল। কণ্বমুনির আশ্রমে বিচরণশীল পোষা হরিণ। দুষ্মন্ত, শকুন্তলার প্রেম। দস্যু রত্নাকর হঠাৎ কাতর হলেন—মা হিংসী। তপস্যায় হলেন বাল্মীকি। রাম গেলেন রাজাদেশে বনবাসে। হল সীতাহরণ। লঙ্কার ভারতভুক্তি। কুরুক্ষেত্রে প্রথম ভারতবাসী সমর। ভগবান উপহার দিলেন গীতা। তিন রাজবংশ লোপাট, কৌরব, পাণ্ডব, যাদব। যুগ শেষ। কালের কলিতে প্রবেশ।
বিলেতের এই ঢেউ অন্য চেহারা নিল। যন্ত্র, উন্নত বীজ, সেচ আর যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিতে, মানুষের বিত্ত, বৈভব, স্বাস্থ্য উন্নত হল। ম্যালথাস সাহেবের মহাদুর্ভিক্ষের ভবিষ্যদ্বানী মিলল না; কারণ সেই সময়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকে লোহার হালের, দূরপাল্লার ভারী জাহাজ তৈরি হয়েছে। সাহসী, ভাগ্যাণ্বেষী, উচ্চাকাঙ্খী ইংরেজের দল দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সাগরপারের দেশে।
১৭২০ সালের পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ইংল্যান্ড আর ওয়েলসে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ১ শতাংশ। ১৭৫০-এ বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ। ১৮০০ সালের কাছাকাছি এসে বৃদ্ধির হার দাঁড়াল ১০ শতাংশ। ফরাসি বিপ্লবের প্রাককালে প্যারিসের জনসংখ্যা ৬ থেকে ৭ লাখের মধ্যে। এই জনসংখ্যার প্রায় একলাখ ছিল নিরাশ্রয় ভিখিরি, ভ্যাগাবণ্ড। সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টির সহজ উপাদান। লন্ডনের চেহারা আরও সাংঘাতিক। ১৭৫০-এ যে জনসংখ্যা ছিল ৫,৭৫,০০০। ১৮০১-এ বেড়ে দাঁড়াল ৯,০০,০০০। শহরের চারপাশে থিকথিক করছে হকার, পকেটমার, বদ ছেলের দল আর অপরাধী। সে যুগের ইংরিজি সাহিত্যে এই সমাজের বিবরণ আছে। ম্যালথাস সমাজ ও সংস্কৃতির এই চেহারা দেখেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্রমোন্নতিতে মৃত্যুর হার কমেছিল।
গ্রামাঞ্চলে অবস্থা চিরকালই খারাপ। শহরের মানুষ তবু সুখে থাকে কাজে কর্মে, ব্যাবসা বাণিজ্যে। সেই সময়কার ইংল্যান্ডের গ্রামের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়। দলে দলে চলে আসতে শুরু করল শহরে, লন্ডনে। যা হয়েছে কলকাতার ক্ষেত্রে। গজিয়ে উঠল ঝুপড়ি, বস্তি, জল নেই, আলো নেই, শীতের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্যে উত্তাপের ব্যবস্থা নেই, পরিচ্ছন্নতার অভাব। রোজগারের আশায় কোনও রকমে দিন গুজরান। রাশি রাশি বাচ্চা। না আছে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কর্মসূচি, না আছে উত্তম পরিধেয়। গ্রাম থেকে আসা জীবিকাচ্যুত কৃষক শ্রেণির মানুষ রাগে ফুঁসছে। যন্ত্র এসে জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। তারা ভেঙে ফেলতে চায় চাষের যন্ত্র। বিদ্রোহ দানা বাঁধছে। যে বছর চাষ কম হয়, দাম বেড়ে যায় রুটির, তখন আন্দোলনও প্রবল আকার ধারণ করে। প্রশাসনকে তখন দমন নীতি প্রয়োগ করতে হয়।
তবু ম্যালথাসের আশঙ্কা পুরো হল না একটি মাত্র কারণে। দলে দলে ইংরেজরা বেরিয়ে পড়ল অন্যদেশে ভাগ্য খুঁজতে। সংখ্যাতত্ব জানাচ্ছে ১৯২০ সালে ২ লাখের সামান্য কিছু বেশি ইংরেজ দেশ ছেড়েছিল, দশকে দশকে এই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৮৫০ সালে হল ২.৫ মিলিয়ান, ১৯১৪ সালের কাছাকাছি সময়ে গিয়ে দাঁড়াল ২০ মিলিয়ান। এই দেশভাগের ঘটনা না ঘটলে ১৯০০ সালে ইংলন্ডের জনসংখ্যা হত ৭০ মিলিয়ান। সেই জায়গায় হল ৪১ মিলিয়ান। ইংল্যান্ড বিপর্যয় সামলেছিল এই ভাবে। বিশ্বজোড়া উপনিবেশ গড়ে উঠল, ছলে, বলে, কৌশলে সেকালের বিখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের প্রত্যুত্তরে বললেন, উত্তর আমেরিকা আর রাশিয়ার সমভূমি ইংল্যান্ডের শস্যক্ষেত্র, শিকাগো আর ওড়েসা আমাদের খামার, কানাডা আর বাল্টিক আমাদের কাষ্ঠ সংগ্রহের অরণ্য, অস্ট্রেলিয়া আমাদের ভেড়ার বিচরণ ভূমি, আর্জেন্টিনা আর পশ্চিম আমেরিকা আমাদের গোলা, পেরু পাঠায় রুপো, দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে আসে সোনা, হিন্দু আর চিনেরা আমাদের জন্যে চায়ের চাষ করে। কফি, চিনি আর মশলার জন্যে আছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ। স্পেন আর ফ্রান্স আমাদের দ্রাক্ষাপুঞ্জ। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল আমাদের ফলের বাগান আর তুলোর ক্ষেত।’
ইংরেজ জাতির এই ছিল বিস্তৃতি। জাতটা বেঁচে গেল এই কারণে।
কৃষি বিপ্লবের ঢেউ সামলাতে লেগেছিল হাজার বছর। দ্বিতীয় ঢেউ শিল্প বিপ্লব। আমাদের জীবন ও সংস্কৃতিতে এই রূপান্তরের পর্যায় প্রায় তিনশো বছরে একটা থিতু অবস্থায় আসতে পেরেছিল।
ঐতিহাসিক মন্তব্য, ‘‘Thus ‘the power of population’ was answered, ‘not so much by the power in the earth’ itself, but by the power of technology the capacity of the human mind to find new ways of doing things…’’ [Paul Kennedy] বিপুল জনবৃদ্ধির চাপ সামলাতে মানুষ আর শুধু ভূমির ওপর ভরসা করে রইল না, যন্ত্র ও কারিগরী বিদ্যার শক্তিকে কাজে লাগাল, মানুষের উদ্ভাবনী মন নিয়োজিত হল কাজ করার নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারে। ইংল্যান্ড ম্যালথাসের আশঙ্কিত ফাঁদ তিন দরজা কেটে বেরিয়ে গেল, দেশত্যাগ, কৃষি বিপ্লব ও শিল্পায়ন, অনেক দেশের পক্ষেই তা সম্ভব হল না, যেমন ভারত। ঊনবিংশ শতকের মধ্যেই ভারতের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে, দ্বিগুণ, চতুর্গুণ হয়ে গেল। উৎপাদন পড়ে রইল অনেক পেছনে। এর ওপর চেপে বসল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে বৃটিশ সরকারের নির্বিচার শোষণ।
গরুর গাড়ি, আটচালা, চণ্ডীমণ্ডপ, পাঠশালা, শুভঙ্করী, নিষ্প্রদীপ গ্রাম, জমিদার ডাকাত, ঠ্যাঙাড়ে, পানাপুকুর, ম্যালেরিয়া, বসন্ত, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, বাবু বাঙালি, বাঈনাচ, ডেপুটি নীলকর সাহেব, পাদ্রি, এই হল চিত্র। বাঙালি কবির সমঝোতা এইভাবে,
দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।
আউল, বাউল আর ফকিরের জীবন ও জীবনদর্শনে এই জীবনের সঙ্গে সামাল দিয়ে চলার পথ খুঁজে পাওয়া গেল। বেদান্ত ভাঙা ধর্ম ভোগ ছেড়ে ত্যাগ বৈরাগ্যের পথ ধরার নির্দেশ দিল। হাজার হাজার মন্দির তেত্রিশ কোটি দেবতায় ভরে গেল। জাঁকিয়ে বসলেন হিন্দু পুরোহিতের দল। সংস্কার ঘুচে গিয়ে এল কুসংস্কার। প্রতিষ্ঠিত দল তাগা, তাবিচ, ঝাড়ফুঁক, ভূতপ্রেতের ধর্ম। উপবাসের ধর্ম তৈরি হল! দুর্ভোগকেই বলা হল শ্রেষ্ঠ ভোগ।
অবতার এবার আর কুরুক্ষেত্রে এলেন না। এলেন কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণেশ্বরে। সব রকমের প্রথা ভাঙা এক নির্মল গৃহী সন্ন্যাসী। বিদ্রোহের সুর, খালি পেটে ধর্ম হয় না।’ তাঁর শিষ্য বিবেকানন্দ আরও সাহসী। বললেন, ‘গীতার আগে ফুটবল।’ এক নতুন সংস্কৃতির সিংহদুয়ারে এসে দাঁড়াল মানব। যে জগতের কথা, ভোগের আগে ত্যাগ নয়, ভোগের পরে ত্যাগ। যে জগতের কথা, সত্যই ধর্ম, জ্ঞানই ধর্ম। সত্যের সংজ্ঞা—ঈশ্বরই সত্য। যে জগতের কথা—দরিদ্র বলে ধার্মিক নই, ধার্মিক বলেই দরিদ্র।
বিশ শতকের শেষ পর্যায়ে আমরা এসে পড়েছি তৃতীয় ঢেউয়ে। The third wave. সেই ঢেউয়ের ধরনটা কেমন, tearing our families apart, rocking our economy, paralyzing our political systems, shattering our values . পরিবার ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে, অর্থনীতি দোদুল্যমান, রাজনীতি অচল, মূল্যবোধ চুরমার। যে সভ্যতায় আমরা ঢুকছি, তেমনটি আগে আর কখনও আসেনি। শিল্পসভ্যতার বিরোধী এই নতুন যুগ হল, হাইলি টেকনোলজিক্যাল।
এই যুগের লক্ষণ—যন্ত্র মানুষের যান্ত্রিক সভ্যতা। হৃদয়হীন ধর্মহীন বস্তু মানব। শব্দ, যন্ত্র, গতি, নির্বোধ উল্লাস, নির্মম উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা, চট জন্ম, চট মৃত্যু! অ্যালভিন টফলারের উক্তিতে ‘The emergent civilization writes a new code of behaviour for us’—মানব আচরণের নতুন সংজ্ঞা ও সংকেত তৈরি করছে—সেটা কী!