হেল কমাণ্ডো – ৯

০৯.

থ্রা। এক সেকেণ্ড, দুই সেকেণ্ড, তিন সেকেণ্ড; আবার কমাণ্ড, ডাউন। নিরাপদ আড়ালে মাথা নিচু করল আনোয়ার। সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো আওয়াজ দ্রিম। শুরু হলো বিস্ফোরকের ওপর অনুশীলন।

সময় মাত্র চার সেকেণ্ড। এই সময়ের মধ্যে এক্সপ্লোসিভ ফিউজ লাগিয়ে লক্ষ্যস্থলে নিক্ষেপ করতে হবে। ভীষণ বিপজ্জনক এই অনুশীলন। সময়ের একটু এদিক ওদিক হলেই মুসিবত! প্রাণনাশ নতুবা মারাত্মক দুর্ঘটনা। প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজনাপূর্ণ। তবুও এই অনুশীলন ঘিরে একটা ছেলেমানুষী আনন্দের ভাব আছে। এখানে শেখানো হলো, ঘরে বসে বিস্ফোরক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র বানানোর কৌশল। হাতের কাছে গ্রেনেড নেই; সে অবস্থায় বিস্ফোরক দিয়ে গ্রেনেড় বানিয়ে ফেলতে পারে কমাণ্ডোরা। দশ-বারোজন শত্রুর দলকে একা অ্যামবুশ করতে হবে; বানিয়ে ফেলল ডাইরেকশনাল গ্রেনেড। শক্রর ট্যাংক বা গাড়ি উড়িয়ে দিতে হবে, সেজন্য নিজ হাতে প্রস্তুত স্বয়ংক্রিয় রকেটই যথেষ্ট। তাছাড়াও শেখানো হলো, বুবি ট্র্যাপের সাহায্যে কিভাবে শত্রু খতম করতে হবে। কিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় (যেমন চিনি) জিনিস দিয়ে মারণাস্ত্র বানাতে হবে।

টানেল অ্যামবুশ প্রশিক্ষণও ঝুঁকিপূর্ণ। পাহারারত সেন্ট্রিদের পরাজিত করে কিংবা ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে টানেলে প্রবেশ করতে হত। ছুটে গিয়ে টানেলের মাঝামাঝি জায়গায় ট্রেন লাইনের নিচে বিস্ফোরক লাগায় কমাণ্ডোরা। বিভিন্ন বিস্ফোরকে প্রাইমাকর্ড লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য ওরা কর্ডের দুদিকেই সুইচ লাগাত। যে-কোন দিক থেকে ট্রেন এলেই যাতে বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রেন টানেলে প্রবেশ করার পূর্বেই ওদের অ্যাকশন শেষ করতে হত। কারণ প্রচণ্ড গতিতে টানেলে প্রবেশ করত ট্রেনগুলো। ট্রেন বেরিয়ে যাবার পর টানেলের বাতাসও তীব্রগতিতে ট্রেনের পিছু ধাওয়া করে। ফলে টানেলের ভিতর পার্শিয়াল ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি হয়। এই প্রচণ্ড বাতাসের টান বেশ ভারী বস্তুকেও টানেলের ভিতর থেকে ছিটকে নিয়ে যেতে পারে। তাই কমাণ্ডোদের ট্রেনের সময়সূচী সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। যদিও টানেল রক্ষণাবেক্ষণকারীদের নিরাপত্তার জন্য টানেলের গা কেটে ছোট ছোট ফোকর বানানো থাকে, কিন্তু এই ফোকরগুলো অ্যাকশন-পার্টির কমান্ডোদের সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। টানেলে ট্রেন প্রবেশ করার পর কেউ যদি নিরাপদ স্থান খুঁজে না পায়, তবে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

পিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি একটা টানেল অ্যামবুশ করতে বলা হলো ওদেরকে। ঝুঁকিপূর্ণ মিশন। একটু অসতর্কতার ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। চোখের পলকে ঘটে যাবে ঘটনা। তাই আনোয়ারদের ছোট কমাণ্ডো দলটি সতর্ক। রাত একটায় এইচ আওয়ার (হামলার সময়)। সোয়া একটার মধ্যে অ্যাকশন পার্টি কাজ শেষ করল। রাত দেড়টার সময় খাইবার মেল টানেলে প্রবেশ করবে। ওরা কাজ শেষে টানেলের বাইরে অপেক্ষা করছে। এই সময় অপারেশন পরীক্ষার জন্য টানেলে প্রবেশ করলেন মেজর ভর্দগ। এর পরের কাহিনি মেজর ভর্দগের মুখ থেকেই শোনা যাক:

আমি মেজর ভর্দগ বলছি। একাদশতম অ্যাডভান্সড় কমাণ্ডেী কোর্সের ট্রেইনী অফিসারদের নিয়ে টানেল হামলায় গেছি। টানেলটি রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি। কাবুল ও সিন্ধু নদীর সঙ্গমস্থলের পাশেই এক পাহাড়ী অঞ্চলে। চীফ ট্রেইনার হিসেবে প্রত্যেক অপারেশনের ছোটখাট দোষ-ত্রুটি শুধরে দেয়া আমার দায়িত্ব। এধরনের অপারেশনে যে কোন অপারেশনের মতই কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। শুধু অ্যাকশন-পার্টির কাজ একটু অন্য ধরনের। রাত একটায় এইচ আওয়ার দেয়া হয়েছে। দেড়টায় খাইবার মেল টানেলে প্রবেশ করবে। আমি অ্যাকশন পার্টিকে সোয়া একটার মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছি। সেন্ট্রিদের ওপর হামলা করার পর যখন অ্যাকশন-পার্টি এক্সপ্লোসিভসহ টানেলের ভিতর ঢুকল, তখন আমি বাইরে হামলাকারী বিভিন্ন গ্রুপের অবস্থান ও কার্যক্রম পরিদর্শন করছিলাম।

রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি টানেলে ঢুকলাম, বিস্ফোরক কি ভাবে লাগানো হয়েছে তা পরীক্ষার জন্য। একটা, ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে দেয়া হত। বিস্ফোরকের সংযোগকারী প্রাইমাকর্ড যেন কোনমতেই সুইচের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে। প্রাইমাকর্ড সুইচের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে সত্যিকারের বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। সেইসঙ্গে এও বলে দিলাম প্রকৃত যুদ্ধের সময় শত্রু এলাকায় যেন এর উল্টোটি না হয়। তাহলে সমস্ত প্রাণান্ত চেষ্টা তামাশায় পরিণত হবে।– অ্যাকশন-পার্টি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সেরে টানেলের বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি যখন টানেলে প্রবেশ করি তখন দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমার সঙ্গে রয়েছে দুজন হাবিলদার ইস্ট্রাকটর। টর্চ জ্বেলে এক্সপ্লোসিভ ও প্রাইমাকর্ডের সংযোগগুলো পরীক্ষা শুরু করলাম। এই সময় ট্রেন টানেলে প্রবেশ করল। আমি হাবিলদারদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলে নিজেও টানেলের গা কেটে বানানো ছোট্ট একটি গর্তে ঢুকে পড়লাম। সারা টানেল জুড়ে শুধু গুম গুম শব্দ হচ্ছে। ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে ছুটে আসছে খাইবার মেল। আর মাত্র পনেরো বিশ গজ, তারপরেই ট্রেন সুইচের ওপর দিয়ে চলে যাবে। সেইসঙ্গে পয়েন্ট টু টু ক্যাপ টুস টুস করে আওয়াজ তুলবে। তাহলেই বুঝতে হবে অপারেশন সাকসেসফুল।

আমি তখনও টর্চ জ্বেলে এক্সপ্লোসিভ ও প্রাইমাকর্ডের সংযোগ পরীক্ষা করছি। সুইচ থেকে ট্রেনের ব্যবধান আর মাত্র কয়েক ফুট। আমার টর্চের আলো পড়ল সুইচের ওপর। শরীরের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। হঠাৎ করে মুখ থেকে তীব্র আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল, ইউ বাস্টার্ড, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? চোখের সম্মুখে টানেলটা মৃত্যুকূপে পরিণত হলো। বিরাট একটা বিস্ফোরণ, হাজারো কণ্ঠের আর্তচিৎকার, সেইসঙ্গে আমারও শেষ আর্তচিৎকার চাপা পড়বে কংক্রীটের চাইয়ের নিচে। কারণ প্রাইমাকর্ডের সঙ্গে সুইচের সত্যিকারের সংযোগ ঘটানো রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। চোখ বন্ধ করে মুখ লুকালাম টানেলের গায়ে ছোট গর্তের মধ্যে। শেষবারের মত স্মরণ করলাম সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ।

মৃত্যু-ফাঁদ অতিক্রম করল খাইবার মেল । কিন্তু একি? আমি এখনও বেঁচে আছি কিভাবে? বিস্ফোরণ ঘটল না কেন? নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সংবিৎ ফিরে আসতেই কোনমতে সুইচের কাছ গেলাম। তখনও আমি থর থর করে কাঁপছি। সুইচের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কোন এক উল্লুক অফিসার যেমন ভুল করে বিপজ্জনক সংযোগ ঘটিয়েছে, ঠিক তেমনি আরেক উল্লুক ভুল করে প্রাইমাকর্ড রেল লাইনের ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে প্রাইমাকর্ড গাড়ির চাকার নিচে পড়ে কেটে যাওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটতে পারেনি। টানেল থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে যা-তা বলে গালাগালি দিলাম। পরে হেডকোয়ার্টারে এসে রিপোর্ট করে বলেছিলাম, দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সত্যিকারের এক্সপ্লোসিভের জায়গায় মাটি দিয়ে এক্সপ্লোসিভ বানিয়ে পরবর্তী ট্রেনিং-এ ব্যবহার করতে হবে।

এরপর শুরু হলো ১৮ দিনের চূড়ান্ত মহড়া। মহড়ায় অংশ নিল মোট ষোলোজন ট্রেইনী কমাণ্ডো-ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল, ক্যাপ্টেন আফজাল, ক্যাপ্টেন ডা. আজম, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ, ক্যাপ্টেন মালেক, ক্যাপ্টেন আফজাল জানজুয়া, ক্যাপ্টেন মো. নূর, ক্যাপ্টেন জায়েদী, ক্যাপ্টেন চিমা, ক্যাপ্টেন জামসেদ, ক্যাপ্টেন মঞ্জুরুল হক আওয়ান, ক্যাপ্টেন নাজির, ফ্লাইং অফিসার ততাফায়েল বাজোয়া, ফ্লাইং অফিসার আশরাফ খান ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার।

ম্যাপে এই মহড়ার দূরত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হলো। লাহোরের মাইল দশেক দূর থেকে চেরাটু পর্যন্ত তিনশো ষাট মাইল। সময় দেয়া হলো আঠারো দিন। এই সময়ের মধ্যে দূরত্ব অতিক্রম করে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। পথে ট্রেইণ্ড কমান্ডোরা শত্রুপক্ষ হিসেবে কাজ করবে। ওদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলের মহড়া করতে করতে এগিয়ে যেতে হবে । ওদের সঙ্গে মাত্র একদিনের রেশন দেয়া হলো। কারণ দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হবে সারভাইভাল ট্রেনিং। সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বাকি সতেরো দিন বেঁচে থাকতে হবে ওদের।

রাতের অন্ধকার নামার পর পরই ওরা সবাই বেরিয়ে পড়ল। ভোরের দিকে লাহোর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ছাঙ্গাবাঙ্গা ফরেস্টে পৌঁছল সবাই। এখানে দিনের বেলায় ওদের লুকিয়ে থাকতে হবে। সকালবেলা কয়েকজন ইন্সট্রাকটর ওদের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আটক করলে সবাই সিদ্ধান্ত নিল, জঙ্গল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস ও খাবার যতদূর পারা যায় সংগ্রহ করতে হবে। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হলো, ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলের ভেতর। ক্যাপ্টেন আজম ও ক্যাপ্টেন আফজাল গেল পাখি শিকারের উদ্দেশে। বাজোয়া ও আওয়ান সহ চারজন গেল বিভিন্ন লতাগুল্মের সন্ধানে। এরা চারজনই কৃষি বিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রী। ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল ও ক্যাপ্টেন মালেককে দূরবীনের পাওয়ার গ্লাস খুলে আগুন জ্বালানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। কয়েকজন জঙ্গলের মধ্যে ফলমূলের সন্ধানে বের হলো। আনোয়ার খালিহাতে গেল মাছ ধরবার জন্য ছাঙ্গাবাঙ্গার লেকে।

লেকের পাড়ে গিয়ে চিন্তা করতে লাগল সে। খালিহাতে কিভাবে মাছ ধরা যায়। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে বেশ শক্ত একটা শুকনো লতা ছিঁড়ে নিয়ে এল আনোয়ার। লতা দিয়ে তৈরি হলো ছিপের সুতো। সঙ্গের সেফটি পিন হলো বড়শী। ফাতনা হিসেবে একটা সরু শুকনো গাছের ডাল ব্যবহার করল ও। ড্যাগার দিয়ে লেকের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল কেঁচো। কেঁচো দিয়ে বানানো হলো মাছের টোপ। তারপর বড়শী পানিতে ফেলে ও চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল, শিকারের আশায়। অনেকক্ষণ কেটে গেল; কিন্তু মাছের আঁশও মিলল না। শেষে বিরক্ত হয়ে লতাটার মাঝখানে গোল করে একটি লুপ বানিয়ে তার ভিতরে হাত ভরে লেকের পাড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতে টান পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল। আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল-মনে হয় সাত-আট সের ওজনের একটা মাছ আটকেছে বড়শীতে। আস্তে আস্তে লতা টানতে শুরু করল ও। কিছুক্ষণ টানার পর শিকারের মাথা পানির ওপর ভেসে উঠল। মাছ নয়–একটা বিরাট আকারের কাছিম। পেটে প্রচণ্ড খিদে। শিকার দেখে মোটেও নিরাশ হলো না সে। কাছিমের মাংস বেশ নরম ও সুস্বাদু। একবেলা পেটপুরে ভালোমত খাওয়া যাবে।

লতা ধরে ধীরে ধীরে টানছে আনোয়ার। কাছে যেয়ে শিকারের গলা চেপে ধরবে–কিন্তু সেয়ানা কাছিম। বিপদের গুরুত্ব টের পেয়ে হাঁচকা টান দিল। সোজা হয়ে গেল পিন। পালিয়ে গেল শিকার। নিরাশ হয়ে ফিরে এল আনোয়ার। এসে দেখল ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল ও মালেক পাওয়ার গ্লাসের সাহায্যে বহু কষ্টে আগুন জ্বালিয়েছে। উনুনের ওপর খালি পানি সেদ্ধ হচ্ছে। আগুন জিইয়ে রাখার জন্য আনোয়ার শুকনো ঘাস ও লতা দিয়ে লম্বা একটা দড়ি বানাল। আগুন ধরিয়ে একটা গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে রাখল দড়িটা।

বেলা প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে উদ্ভিদ সংগ্রহকারী দল ফিরে এল। এরা নিয়ে এল প্রচুর পরিমাণে একজাতীয় গুল্ম লতা। লতাগুলো তেতো। দ্বিতীয়বার সেদ্ধ করার পর পানিতে লবণ (ওদের শুধুমাত্র লবণ ও পানিতে মেশানো ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে) দিয়ে সুপ তৈরি করল। লবণ মিশ্রিত লতাগুল্মের সুপ সবাই খেলো পেট পুরে। ফেরৎ এল আরেক দল। এরা নিয়ে এল অচেনা গাছের সুগন্ধি পাতা ও ছাল । এগুলো দিয়ে তৈরি হলো হালকা পানীয়। এটা সবুজ চায়ের সুন্দর বিকল্প। শুধু চিনির অভাব ওদের নিরাশ করল। কিন্তু ছাল সংগ্রহকারীর একজন আশ্বাস দিল জঙ্গলের মধ্যে একটা বড় মৌচাক রয়েছে। মৌচাক ভেঙে সে নিজেই মধু সংগ্রহ করে আনবে।

মৌচাক সংগ্রহকারী অফিসারের সঙ্গে দুজন গেল গ্রাউণ্ড-শীট নিয়ে চাক সংগ্রহ করে আনার জন্য। প্রায় ঘন্টাখানেক পর গ্রাউণ্ড শীটে করে বয়ে আনা হলো একটা বিরাট মৌচাক। সেইসঙ্গে মৌচাক ভাঙায় দক্ষ অফিসারকেও বয়ে আনতে হলো। গ্রাউণ্ড-শীট ও ডাল দিয়ে বানানো স্ট্রেচারের ওপর শায়িত আহত অফিসার। মৌমাছির দংশনে অফিসারের সমস্ত শরীর ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে। মৌমাছির হুলে আক্রান্ত অফিসারকে দেখে মানুষ বলে চেনার জো নেই। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ওরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, পৃথিবীর যে কোন কঠিনতম হামলায় ওরা প্রস্তুত। কিন্তু মৌচাক হামলায় নয়। আহত অফিসারকে ইন্ট্রাকটরদের জীপ এসে লাহোের সি.এম.এইচ, এ নিয়ে গেল। সারভাইভাল ট্রেনিং-এ সবাই যেভাবেই হোক বেঁচে থাকবে। কিন্তু মৌমাছি দ্বারা আক্রান্ত ট্রেইনী অফিসার বাঁচবে কিনা, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। প্রত্যেকে দুটো করে পানির বোতল মধুতে ভরে নিল। ওরা আরও সংগ্রহ করল আগামী দশ-বারো দিন চলার উপযোগী গাছের ছাল ।

সন্ধ্যার একটু আগে ফেরৎ এল পাখি শিকারীর দল। ওরা নিয়ে এল চড়ুই পাখির মত ছোট ছোট ষোলোটা পাখি। প্রত্যেকের ভাগে একটা করে পাখি পড়ল। নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। পাখিগুলো আধপোড়া হওয়ার আগেই ওরা নিভিয়ে ফেলল আগুন। গুল্মের সুপ, সেদ্ধ ভেজিটেবল ও সবুজ চা খেয়েছে সবাই। খাদ্যগুলো প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা। আগুনে আধ ঝলসানো পাখিটাকে কাগজে মুড়ে পকেটে পুরল আনোয়ার। ওটা দিয়ে রাতের ডিনার হবে। সিগারেটখোরদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। কেউ কেউ শুকনো পাতা বিড়ির মত পেঁচিয়ে টানছে। শুকনো পাতার বিড়ি টানার সঙ্গে সঙ্গে সবাই শুরু করল কাশতে। রাগের চোটে পাতার বিড়ি ফেলে দিল আনোয়ার।

ওরা এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের মাঝে লুকোচুরি খেলতে । খেলতে। ট্রেই কমান্ডোরা পিছু ধেয়ে আসছে। ট্রেইনী দল সতর্ক। সারভাইভাল ট্রেনিং-এ ওদের চুরি করার অনুমতি আছে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর পথে পড়ল একটা মুলার খেত। খেত কিছুটা খিদে মিটাল ওদের। মধ্যরাতে একটা অ্যামবুশ পয়েন্টে পৌঁছল ট্রেইনীরা। মিশন শেষে সবাই প্রাণপণে দিল ভো দৌড়।

মিশন সাকসেসফুল। শত্রুরা সজাগ হয়ে গেছে। ওরা দৌড়চ্ছে প্রাণপণে। ভোর হয়ে এল। লুকিয়ে থাকার মত জায়গা খোঁজা শুরু করল সবাই। চারদিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন জঙ্গল নেই, নেই কোন পাহাড়। নিরাপদে লুকিয়ে থাকার মত তেমন কোন সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল না। এলাকাটা বসতিপূর্ণ, সমতল। এধরনের জায়গা ট্রেইনীদের জন্য বিপজ্জনক। যে-কোন মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা।

ফক্স-হোল বা শিয়ালের গর্ত এখন লুকানোর একমাত্র উপায়। সবাই সিদ্ধান্ত নিল ফক্স-হোল বানানোর। একটা কাঁটা ঝোপে । আচ্ছাদিত জায়গায় আটটি ফক্স-হোল তৈরি করল ওরা। গর্তগুলোর মাটি বহুদূরে লুকিয়ে রাখা হলো; যাতে কারও দৃষ্টিগোচর না হয়। প্রতিটি গর্তের মুখ বন্ধ করার জন্য মাপ মত একটা করে মাটির চাপড়া কাটা হলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য গর্তগুলোর ওপরে ছোট ছোট ছিদ্র রাখা হলো। গর্তে ঢোকার আগে প্রাতঃকৃত্য সেরে, সঙ্গে ক্যানভাসের ছাগল ভরে পানি নিয়ে গর্তে ঢুকল সবাই। প্রতিটি গর্তের মুখে মাটির চাপড়া দিয়ে বন্ধ করে ওরা দুজন করে আশ্রয় নিল এক একটি গর্তে। শীতের দিন বলে ফক্স-হোলগুলো আরামদায়ক। ভিতরটা বেশ গরম। সারাটা দিন ওদের শুয়ে বসে কেটে গেল। আহারস্বরূপ জুটল রাতে খেত থেকে চুরি করা মুলা। পেটে প্রচণ্ড খিদে ঢুঁ মারছে।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ফক্স-হোল থেকে বের হয়ে এল ওরা। আবার শুরু হলো অন্ধকারে পথ চলা। কিছুক্ষণ চলার পর সামনে পড়ল একটা পল্লী। পল্লীবাসীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকটা অবস্থাপন্ন কৃষকের বাড়ি খুঁজে ওরা চুরির মিশন চালাল। সৌভাগ্যক্রমে কৃষকদের রান্নাঘর থেকে রুটি ও রান্না করা তরকারি পাওয়া গেল। চুরি করা মুলার সালাদ, রুটি ও তরকারিসহযোগে ওরা রাতের আহার সারল।

 আহার শেষে আবার শুরু হলো পথ চলা। অন্ধকার ওদের কাছে অনেকটা স্বস্তির কারণ-শত্রুরা সহজে খুঁজে পাবে না। চলতে চলতে ওরা বুঝতে পারল, সামনে ঘন গাছপালা। মনে হচ্ছে বড়-সড় একটা বাগান। জায়গাটা সমতল এবং নিচু। বাগানে প্রবেশ করার পর প্রত্যেকের মাথাই শক্ত গোলাকৃতি জিনিসের সঙ্গে ঠুকে যেতে লাগল। হাত দিয়ে ধরে বুঝল ওরা, গোল গোল ফলগাছ থেকে ঝুলছে। ছিঁড়ে মুখে দিয়ে স্বাদ নিতেই বোঝা গেল নাশপাতি। প্রত্যেকের প্যাক পকেট ইত্যাদি আর খালি রইল না। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ওরা আবার লুকিয়ে পড়ল, জনবসতি থেকে অনতিদূরে একটি ঝোঁপের ভিতর ।

সবাই ঝোঁপের ভিতর নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। ঝোঁপের আশপাশ দিয়ে লোক চলাচল করছে। সারাদিন সামান্য পরিমাণে বেঁচে যাওয়া রুটি ও নাশপাতি খেয়ে কেটে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতেই ওরা বেরিয়ে এল ঝোঁপের ভেতর থেকে। আবার শুরু হলো যাত্রা। প্রতি রাতে ওরা একটা করে অপারেশন চালাচ্ছে। সেইসঙ্গে কিছু না কিছু খাদ্য সামগ্রীও চুরি করছে। দিনের বেলায় ফক্স-হোলে লুকিয়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে, এইভাবে এগিয়ে চলেছে ওরা।

একদিন ফক্স-হোলে বিপর্যয় ঘটল। তখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি। গর্তে ঢোকার আগে সবাই কাছাকাছি একটা নালা থেকে ছাগাল ভরে পানি নিল। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ওদেরকে ট্যাবলেট সরবরাহ করা হত। প্রথম দিকে ওরা পানিতে ট্যাবলেট মেশালেও শেষের দিকে আর মেশাত না। রাতের অন্ধকারের জন্য কেউ বুঝতে পারেনি। পানির স্বাদ স্বাভাবিক হলেও তা ছিল ভীষণ নোংরা ও কালো রঙের। তার ওপর ট্যাবলেট মেশানো হয়নি। বেলা ১২টা থেকে শুরু হলো বিপত্তি। নোংরা পানির ক্রিয়ায় প্রত্যেকের পেটে গোলমাল দেখা দিল। শেষে আনোয়ার বাধ্য হয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে দেখতে পেল, ওর মত অন্যান্য অফিসারও এদিক ওদিক ছুটছে। প্রত্যেকের পাতলা পায়খানা দেখা দিয়েছে। চূড়ান্ত এক্সারসাইজে এধরনের অঘটনের জন্য ইন্ট্রাকটররা ভীষণ বকাবকি করলেন। শেষে সাবধান করে দিলেন, বনজঙ্গল এলাকায় কেউ যেন পানিতে বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মেশাতে না ভুলে।

চূড়ান্ত এক্সারসাইজ বলে শত্রুর দল ভীষণ সতর্ক। শত্রুরা প্রায়ই অতর্কিতে হামলা করছে। এরাও প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে। কোনমতেই শক্রর হাতে ধরা দিচ্ছে না। শত্রুর তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে ওদের খাদ্য সংগ্রহের অভিযান স্তিমিত হয়ে গেল। ফলে মাঝেমধ্যে সবাইকে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। কখনও ফক্স-হোলে, কখনও গভীর জঙ্গলে আবার কখনও বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিচ্ছে ওরা। একে অভুক্ত অবস্থা তার ওপর প্রচণ্ড উত্তেজনা ও দৈহিক পরিশ্রম-প্রত্যেকের শরীর ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এ চলার যেন কোন শেষ নেই; দিন বুঝি আর ফুরাবে না। এইভাবে সারভাইভাল ট্রেনিংয়ের দশটা দিন পার হয়ে গেল। এখনও আটদিন বাকি।

এগারো দিনের মাথায় কমাণ্ডোদের জন্য একটি ছোট প্লেন গোপনীয় জায়গায় রেশন ড্রপ করল। কিন্তু শক্ররা অতর্কিতে হামলা করে সমস্ত রেশন নষ্ট করে দিল। ছয়-সাত দিন হলো সবাই প্রায় অভুক্ত। কখনও রাতের আঁধারে পায়ের নিচে সরদা (এক প্রকারের তরমুজ) ও মুলার খেত পড়েছে। এই কয়দিন খেত থেকে চুরি করা মুলা ও সরদা আহার হিসেবে জুটেছে। ক্ষুধার তাড়নায় ওরা প্রায় অস্থির। শত্রুর হামলায় সমস্ত রেশন নষ্ট হয়ে গেল। আবার প্লেন থেকে তিন-চার দিন পর রেশন ড্রপ করা হতে পারে। সে রেশনও শত্রুর হামলা থেকে রক্ষা পাবে কিনা জানা নেই। অসহ্য ক্ষুধা ও মানসিক উত্তেজনা ওদেরকে রীতিমত হিংস্র করে তুলল।

প্রত্যেকের শরীর থেকে চর্বি উধাও হয়েছে। নিতম্বের হাড় চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরে গেছে সকার গাল। চোয়ালের হাড়গুলোও রীতিমত উঁচু উঁচু হয়ে আছে। মাথায় এলোমেলো রুক্ষ চুল। প্রত্যেকের শীতল দৃষ্টি কেমন যেন হিংস্রতা মাখানো। তবুও ওরা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলেছে বহুদূরে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে।

পাঞ্জাবের গাছপালা ভর্তি সমতলভূমি অতিক্রম করল ওরা। শুরু হলো পাথুরে মরুভূমি এলাকা। চারদিকে ধু-ধু বালি, পাথর ও ছড়ানো ছিটানো কাটা গাছ। লুকিয়ে থাকার তেমন কোন জায়গা নেই। পানীয় জলের তীব্র অভাব। ওরা একটু থমকে দাঁড়াল। কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিষ্প্রাণ মরুভূমির দিকে। একে প্রচণ্ড পরিশ্রম, তার ওপর ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে উপবাস। সম্মুখে বিস্তীর্ণ মরুভূমি, যেখানে খাদ্যের বিন্দুমাত্র আশা নেই। নিষ্ঠুর দৃষ্টি মেলে ওদের দিকে চেয়ে আছে মরুভূমি–যেন সবাইকে গ্রাস করে নেবে। ওদের সমস্ত অনুভূতি যেন অবলুপ্ত হতে চলেছে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত এগোচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সতর্ক–সাপ, ব্যাঙ বা অন্য যে-কোন ধরনের প্রাণী যেন নজর এড়িয়ে না যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন প্রাণীই ওদের নজরে পড়ল না। পড়লে হয়তো সাপ, ব্যাঙের মাংস দিয়ে কিছুটা ক্ষুধা নিবৃত্তি হত ওদের।

এক এক করে চোদ্দদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। সারাদিন ওরা কাঁটা ঝোঁপ অথবা কোন পাথরের গুহায় লুকিয়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে। পানীয় জলের অভাব ওদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলল। কাঁটা গাছের রসাল শিকড় চিবিয়ে পানীয় জলের অভাব কিছুটা দূর করছে ওরা। একদিন ওরা একটা পাথুরে গুহায় নির্জীবের মত লুকিয়ে আছে। হঠাৎ গুহার বাইরে ছাগলের ভা ভঁা, আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ শোনামাত্র কয়েকজন লাফিয়ে উঠল। এইসব মরু এলাকায় পাহাড়ী অধিবাসীরা মাঝে মাঝে গরু ছাগল চরাতে আসে। এরা দুর্দান্ত সাহসী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির । পাহাড়ের গায়ে কিছু কিছু গুল্ম লতা ও শ্যাওলা জাতীয় ঘাস জন্মে। এইগুলো ছাগলের প্রিয় খাদ্য। এধরনের কোন পাহাড়ী মনিবের একপাল ছাগল চরতে চরতে ক্ষুধার্ত কমাণ্ডোদের গুহার সম্মুখে হাজির হয়েছে। হেল কমাখো

ওরা কয়েকজন মিলে দ্রুত একটা সাদা রঙের বড় ছাগল কম্বলে পেঁচিয়ে গুহার মধ্যে নিয়ে এল। ছাগল সবার মাঝে কিছুটা যেন স্বস্তি এনে দিল। ঝলসানো ছাগলের মাংস অন্তত একবেলা পেট পুরে খাওয়া যাবে। কয়েকজন ছুটল জ্বালানি কাঠের সন্ধানে। একজন প্যাক থেকে জুতোর কালি বের করল। ব্রাশ দিয়ে সাদা ছাগলের রং কালো করে ফেলা হলো, যাতে মালিক চামড়া দেখলেও বুঝতে না পারে যে এটা তার ছাগল। সবাই জ্বালানি কাঠের জন্য অপেক্ষা করছে। এই সময় গুহামুখে পশতুতে অকথ্য গালিগালাজ শোনা গেল। একজন বন্দুকধারী পাঠান তার হারানো ছাগল খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে পাঠানটা গুহামুখে এসে দাঁড়াল। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, গুহাতে ওরা কারা। পরনে সেনাবাহিনীর পোশাক অথচ নোংরা, গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ।. চোখ-মুখ বসে গিয়েছে। সবাই নির্জীব, সঙ্গে প্রত্যেকের মেশিনগান ও সাব-মেশিনগান।

বন্দুকধারী পাঠান কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রুক্ষ কণ্ঠে বলল, আমি গুহার ভেতরটা দেখতে চাই। কমাণ্ডোদের একজন জিজ্ঞেস করল, কেন দেখতে চাও? আমার একটা সাদা রঙের ছাগল হারিয়ে গেছে–পাঠান পূর্বের কণ্ঠেই জবাব দিল। তৎক্ষণাৎ কমাােদের একজন বলে উঠল, আমাদের সঙ্গে একটা কালো রঙের ছাগল আছে। এটা আমরা বহুদূর থেকে নিয়ে এসেছি। এখানে কোন সাদা ছাগল নেই। তবুও আমি দেখব বলে বন্দুক বাগিয়ে পাঠান ঢুকল গুহার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে প্রভুভক্ত ছাগল মনিবকে দেখে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে উঠল। ব্যস, গোমর ফাঁক। ছাগল বেহাত।

ছাগল হাতছাড়া হওয়াতে ওদের চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। চূড়ান্ত এক্সারসাইজ বলে ওরা এ-ধরনের অবস্থা চুপচাপ মেনে নিল। নইলে পাঠানের রক্তপান করতেও ওরা দ্বিধাবোধ করত না। কিছুক্ষণ পর জ্বালানি সংগ্রহকারী দল জ্বালানি নিয়ে ফিরে এল। শিকার হাত ছাড়া হওয়ার কথা শুনে মিনিটখানেক নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল ওরা। শেষে ইটস অল রাইট বলে পয়েন্ট টু টু রাইফেল নিয়ে কয়েকজন বের হলো পুনরায় শিকারের উদ্দেশে।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর শিকারী দল ফেরৎ এল। সঙ্গে নিয়ে এল রাইফেলের গুলিতে আহত করে জবাই করা নাদুসনুদুস একটা কুত্তা। সবাই জবাই করা কুত্তার চামড়া ছাড়াচ্ছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু প্রত্যেকের চেহারা দ্বিধাহীন। পেটে খিদের প্রচণ্ড দাবানল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চামড়া ছাড়ানো শেষ হলো। কুত্তার মাংস চর্বিযুক্ত। মাংসগুলো খণ্ড খণ্ড করে আগুনে ঝলসে রোস্ট তৈরি করল ওরা। সন্ধ্যাবেলা রান্না শেষে খেতে বসল সবাই। কুত্তার মাংসের রোস্ট, সেইসঙ্গে চা। বেশ কদিন পর সবাই একটু সুস্থবোধ করল। কুত্তার মাংস ভক্ষণ–এটা ওদের কাছে এমন কোন ব্যাপারই নয়। প্রয়োজনে ওরা যে-কোন প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করতে পারে।

এখন পেটে প্রচণ্ড খিদে আর নেই। শরীর আগের চেয়ে অনেক ঝরঝরে। বহুদিন পর একটি রাত ওদের পার হলো আরামে। পরদিন বিকেলে প্লেন থেকে ড্রপ জোনে কিছু রেশন ড্রপ করা হলো। সৌভাগ্যক্রমে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে রেশন সংগ্রহ করল ওরা। রেশন পেয়ে সবাই চাঙা হয়ে উঠল আবার। চলার গতিও বেড়ে গেল ওদের। চেরাট আর বেশি দূরে নয়। সময়ও, প্রায় শেষ, সতেরো দিন পার হয়ে গেল। সবাই দ্রুত এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে। আঠারোতম দিনে ওরা সবাই পৌঁছে গেল চেরাটে। পৌঁছে হিসেব করে দেখা গেল, তিনশো ষাট মাইলের জায়গায় শত্রুর তাড়া খেয়ে প্রায় চারশো মাইল অতিক্রম করতে হয়েছে ওদের। এভাবে শেষ হলো ফাইনাল এক্সারসাইজ।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *