হেল কমাণ্ডো – ৮

০৮.

মালাকান পাহাড়ী অঞ্চল।

চারদিকে পাথরের উঁচু উঁচু চূড়া। চূড়াগুলোর সানুদেশে উত্রাই। উত্রাইগুলোর মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে পায়ে চলা পাহাড়ী পথ। অকুতোভয় পাহাড়ীরা এই পথ ব্যবহার করে। ওদের পরিশ্রমী খচরগুলোও এপথে চলাচল করে। সারাটা এলাকা জুড়ে কেমন একটা রুক্ষ নিষ্ঠুর ভাব।

ধূসর প্রকৃতিতে প্রাণের কোন ছোঁয়া নেই। ছড়ানো ছিটানো অজস্র বোল্ডার জায়গাটাকে আরও নিষ্প্রাণ করে তুলেছে। পাহাড়ের উচ্চতার জন্য দূরে দৃষ্টি যায় না। চতুর্দিকে পাহাড়ের প্রাচীর। তাই দূরের খোলা আকাশও নজরে পড়ে না। কোথাও কোথাও পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে গভীর খরস্রোতা নালা। মালাকান-রিসালপুর-নওশেরা প্রধান সড়কগুলো এইসব পাহাড়ের গা কেটে তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় সড়কগুলোর একপাশে উঁচু পাহাড়। অপর পাশে গভীর গিরিখাদ।

ওরা ছুটে চলেছে মালাকান হিলসের এই দুর্গম এলাকায়। এবারও প্রত্যেকের পিঠে গুরুভার প্যাক। স্ট্র্যাপগুলো এবারও ওদের কাঁধের মাংস চিরে ঢুকে যেতে চাইছে। ওদের কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝুলছে পানির বোতল ও প্রিয় কমাণ্ডো নাইফ। প্রত্যেকের হাতে সাব-মেশিনগান। মর্টার হেভী মেশিনগান ও ওয়্যারলেসের ভারী জেনারেটরগুলো ওরা যথারীতি পালা করে বইছে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। ওরা সাতদিন একনাগাড়ে ছুটছে। পেছনে দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাড়া করে আসছে শত্রুরূপী ট্রেইণ্ড কমাণ্ডোরা। শত্রুরা কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও গাড়িতে করে এগিয়ে আসছে। ওদের হাতে কোনক্রমেই ধরা পড়া চলবে না। ধরা পড়লেই অমানুষিক নির্যাতন। জ্বলন্ত সিগারেট ধীরে ধীরে নাকের ভিতর দিয়ে গলিয়ে দেবে। পোড়া মাংসের কটু গন্ধেও শত্রুদের ভাবলেশহীন নিষ্ঠুর চেহারার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওদেরকে পৌঁছুতে হবে আরও একশো বিশ মাইল দূরে আটক দুর্গে। তবেই ওরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে।

মালাকান অঞ্চলের রাত। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। আনোয়াররা পাহাড়ী পথ ব্যবহার করছে না। তাতে শক্রর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। পাহাড়ী নালার ভিতর দিয়ে এগুচ্ছে ওরা। বেশ, কিছুদূর চলার পর ম্যাপ দেখল সবাই। ম্যাপ অনুযায়ী নালা বেয়ে ওপরে উঠলেই মালাকান অঞ্চলের প্রধান সড়ক। সড়কের পাশ ঘেঁষে শুরু হয়েছে উঁচু পাহাড়। হঠাৎ ওরা বুঝতে পারল, শক্ররা খুব কাছেই। মুহূর্তে ওরা সতর্ক হয়ে গেল। শুরু হলো মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে পাথরের চাইয়ের আড়ালে লুকোচ্ছে। আবার এগিয়ে যাচ্ছে।

এইভাবে চলতে চলতে রাত প্রায় দশটার দিকে মালাকান সড়কের পাদদেশে পৌঁছুল দলটা। সবাই স্থির করল, সামনের পাহাড় ডিঙাতে হবে। নইলে শক্রর চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। ওরা নালার গা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করল। ওপরে উঠেই টের পেল, শক্ররা নিচে চেঁচামেচি করছে। কারণ শুক্ররা ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছে। এই সময় হঠাৎ ওদের টহলদার জীপের আওয়াজ শোনা গেল। ওরা দ্রুত পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। টহলদার জীপ ওদের পাশ কেটে সোজা চলে গেল। ফিরে আসতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। এই সময়ের মধ্যে পাহাড়ে চড়ার একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে হবে। ওরা দ্রুত পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে ওঠার পথ খোঁজা শুরু করল সবাই।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও তেমন কোন সুবিধাজনক জায়গা পাওয়া গেল না। সব জায়গাই খাড়া প্রাচীরের মত। ওরা পাগলের মত একটু ঢালু জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

হঠাৎ দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখা গেল। দ্রুত এগিয়ে আসছে গাড়ি। তখনও ওরা পাহাড়ে ওঠার মত জায়গা খুঁজে পায়নি। টীম লীডার ক্যাপ্টেন জানজুয়ার নির্দেশ এল, স্টার্ট ক্লাইম্বিং। শুরু হলো খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠা। ওরা একটা সরু পথ বেয়ে ওপরে উঠছে। পথটা ফুট খানেক চওড়া। কোথাও কোথাও তারও কম। গাড়ি এগিয়ে আসতেই সবাই পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেল। একে একে টহলদার। গাড়িগুলো নিচের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। শুরু হলো বিরামহীন গতিতে ওদের পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা।

রাতের গভীরতা ক্রমেই বাড়ছে। খাঁ খাঁ করছে চারদিকের নিস্তব্ধ পাথুরে প্রকৃতি। ঘন কুয়াশায় পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন জানজুয়া বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে আনোয়ারের থেকে। আনোয়ার চার হাত-পা ব্যবহার করছে ওপরে ওঠার জন্য। এক হাতে পাথুরে পথ পরীক্ষা করতে হচ্ছে। আলগা পাথরের ওপর শরীরের চাপ পড়লে পা ফসকে যেতে পারে। পাহাড়ের গা ছুঁড়ে বেরিয়ে রয়েছে ছোট বড় নানা সাইজের পাথরের কোণা । নিচে ছড়ানো রয়েছে তীক্ষ্ণ ভোঁতা নানা আকারের বোল্ডার। পা কিংবা হাত ফস্কালে মৃত্যু অনিবার্য।

আনোয়ারের হাতের নখগুলো ব্যথা করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের চোখা কোণা নখের নরম মাংসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে সে। শরীরের সমস্ত পেশী ফুলে ফুলে উঠছে। সারা শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়া শুরু হলো। গত কয়েকদিন ধরে একনাগাড়ে উপবাস। তার ওপর অমানুষিক পরিশ্রম। ওদের প্রত্যেকের শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখের পাতা নিজেদের অজান্তেই ভারী হয়ে আসছে।– হঠাৎ হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল আনোয়ারের। বাঁ পা-টা ফকে গেছে। ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না শরীরের। প্রচণ্ড চাপ পড়ায় বাম হাতও ফসকে গেল। বাঁ দিকটা সম্পূর্ণ শূন্যের ওপর ভেসে আছে। ডান হাতের জন্য শরীরটা এখনও পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। ডান পায়ে তেমন শক্তি পাচ্ছে না ও। দেহের প্রচণ্ড চাপ এখন ডান হাতের ওপর। ধীরে ধীরে ডান হাতের কব্জিও শিথিল হয়ে আসছে।

আনোয়ারের চোখে-মুখে তীব্র কাঠিন্য ফুটে উঠল। ওপরে ফুরফুর করে বাতাস বইছে। দীর্ঘ শ্বাস নিল সে। বাঁ পা দিয়ে শক্ত অবস্থান খুঁজছে। কিন্তু পা-টা তেমন কোন অবস্থান খুঁজে পাচ্ছে না। ওর মাথার শিরাগুলো দপ দপ করে লাফাতে শুরু করল। এই বুঝি শুরু হলো পতন। ডান হাতটা থরথর করে কাঁপছে। কব্জি খুলে যেতে শুরু করল। আনোয়ার ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎ ওর বাঁ হাতের নিচে শক্ত একটা পাথরের কোণা হেল পড়ল। ও দ্রুত চেপে ধরল সেটা। ডান হাতের কব্জিতে আবার কিছুটা শক্তি ফিরে এল। সেই সঙ্গে ডান পায়েও শরীরের চাপ পড়ল। বাঁ পা দিয়ে আবার খোঁজা শুরু হলো নিরাপদ কোন সাপোর্ট। কিছুক্ষণ খোঁজার পর খানিকটা ওপরের দিকে পাহাড়ের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা একটা শক্ত কোণা পাওয়া গেল। আনোয়ার আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ওর বুকের ছাতি দ্রুত ওঠানামা করছে। সবার অলক্ষ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা।

এই সময়ে সবাই ক্যাপ্টেন জানজুয়াকে বিশ্রামের কথা বলল। একটু ওপর থেকে টীম লীডারের নির্দেশ ভেসে এল, এই বিপদসংকুল খাড়া জায়গায় কোনমতেই বিশ্রাম করা যাবে না। শুরু হলো আবার বিরামহীন গতিতে ওপরে ওঠা। ক্ষুধা পীড়িত শরীরে ওদের চলার গতি ক্রমশই মন্থর হয়ে আসছে। হাত পায়ের পেশীগুলো ব্যথায় টনটন করছে। শরীর যেন আর নড়তে চাইছে না। সারা শরীরের স্নায়ুগুলো বিরোধিতা শুরু করল। রাত প্রায় একটা । জানজুয়ার গলা ভেসে এল, হল্ট। ওদের বিশ্রামের নির্দেশ দেয়া হলো। জায়গাটা ফুট খানেক গর্ত ও দুই তিন ফুট চওড়া একটা নালার মত।

কেউ ছোট্ট একটু বসার জায়গা পেল। কেউবা পাহাড়ের গায়ে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে লাগল। আনোয়ার সাব মেশিনগানটা পিঠ থেকে নামিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল। নিজেও দাঁড়াল হেলান দিয়ে। সঙ্গে পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলো। প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা চকোলেট পেল ও। সেটা মুখের ভিতর চালান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। পরম তৃপ্তির সঙ্গে সিগারেটটা শেষ করল ও। তারপর শুরু হলো বিশ্রাম। ওদের মনে হচ্ছে, এরচেয়ে বড় সুখ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। বিশ্রাম নিতে নিতে এক সময় ক্লান্ত দেহে পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।

মালাকান পাহাড়ের বিপজ্জনক একটি রাত বিদায় নিল। পুব আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি মারছে। পাহাড়ের গুহাবাসী পাখিগুলো ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে আহারের সন্ধানে। এই সময় ট্রেইনী কমাণ্ডোদের ঘুম ভেঙে গেল । তখনও আনোয়ার ঘুমোচ্ছে । পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে-পরম নিশ্চিন্তে। ভয়ার্ত হল্লায় ওর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই প্রচণ্ড বিস্ময়! অবিশ্বাস্য দৃশ্য! শীতল শিরশিরে একটা ভাব বিদ্যুতের মত সারা শরীরে সংক্রামিত হলো। মনে হলো দৃশ্যটা পৃথিবীর প্রসিদ্ধতম কাল্পনিক গল্প লেখকের ধারণারও বাইরে।

মালাকান পাহাড়ের খাড়া প্রাচীরের কোলে ওরা দাঁড়িয়ে আছে–মাটি থেকে প্রায় ছয় সাতশো ফুট ওপরে। খাড়া প্রাচীর। তাকালেই কলজে হিম হয়ে আসে। সুউচ্চ প্রাচীরের শেষ সীমা নজরে পড়ে না। বসন্ত রোগীর মুখের মত ছোট বড় নানা আকারের অসংখ্য পাথর। প্রচণ্ড রোদে দগ্ধ পাথরগুলো তামাটে, বর্ণের। মহাকালের বিভীষিকার মত দাঁড়িয়ে আছে মালাকান পাহাড়। এই বিভীষিকার কোলে বন্দী ওরা–ষোলোজন ট্রেইনী কমাণ্ডো অফিসার, যার মধ্যে মাত্র একজন বাঙালী-আনোয়ার ।

দিনের আলো ফুটে উঠল। সবারই এক প্রশ্ন। কিভাবে ওরা এখানে উঠল? রাতের অন্ধকারে কিছু চোখে পড়েনি। তাই ওরা অন্ধের মত এই বিপদ-সংকুল খাড়া পাহাড়ে চড়তে পেরেছে। কিন্তু দিনের আলোয়…! এই মরণপথে কেউ পা বাড়াতে রাজি হবে কি? ওপরের দিকে চাইলে মাথা ঘুরে ওঠে। খাড়া প্রাচীরের শেষ সীমানা দেখা যাচ্ছে না। নিচের দিকে চাইলেও শিউরে উঠতে হয়। নামা অসম্ভব। প্রত্যেকে বুঝল, মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। আনোয়ারের শরীরের প্রতিটি পেশী শক্ত হয়ে উঠল। মন থেকে, সমস্ত ভীতির চিহ্ন মুছে গেল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে মানুষ বোধ হয় সমস্ত আতঙ্ক ভুলে এইরকম স্থির হয়ে যায়। ওর তাই মনে হলো।

ওপর থেকে টীম লীডার জানজুয়ার দৃঢ়কণ্ঠ ভেসে এল, উই উইল ক্লাইম্ব। সবাইকে বলা হলো অন্ধের মত ওপরে উঠতে হবে, রাতে যেভাবে উঠেছে। সেই সঙ্গে হুশিয়ার করে দেয়া হলো, কেউ যেন পাহাড়ের চূড়ার দিকে না তাকায়। আশপাশেও তাকানো চলবে না। চোখের দৃষ্টি সামনে চলার পথের ওপর নিবদ্ধ রাখতে হবে। মনে যেন কোন রকম নৈরাশ্য ছায়া ফেলতে না পারে। ওরা টিকটিকির মত ওপরে উঠতে লাগল মালাকান পাহাড়ের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের গা বেয়ে।

নানা রকম কথাবার্তা বলছে আর এগুচ্ছে সবাই। এই ভয়ঙ্কর পরিবেশটা হালকা করার এটা একটা কৌশল ওদের। প্রত্যেকের শরীর গড়িয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। পথ যেন আর ফুরায় না । ওদের মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে এভাবে চলতে হবে। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে নৈরাশ্যের ছায়াপাত যে ঘটছে না, তেমন নয়। কিন্তু ওদের প্রচণ্ড সহ্যশক্তি ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের কাছে নৈরাশ্য বারবার মাথা নত করছে। ওরা আজ অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় একশো ভাগ। কিন্তু চলার গতির সঙ্গে বাঁচার ক্ষীণ আশা ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ওরা জানে প্রতিটি পথের শেষ আছে। এ চলাও এক সময়ে শেষ হবেই। কিন্তু তারপর? তারপর ওদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?

বহুক্ষণ চলার পর ওপর থেকে টীম লীডার জানজুয়ার কণ্ঠ শোনা গেল, এখান থেকে পাহাড়ের খাড়া ঢাল অনেকটা কমে গেছে। আমি চূড়ার প্রায় কাছাকাছি। শাবাশ, সবাই ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসো। এই কথায় সবার মাঝে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সবাই ওপরের দিকে উঠছে। ক্রমশ খাড়া পাহাড়ের চূড়া এগিয়ে এল-ষোলোজন মৃত্যু পথযাত্রী কমাণ্ডো অফিসারের প্রত্যাশিত গন্তব্যস্থল। এক সময়ে এই কঠিনতম পথের অবসান ঘটল। সবাই নিরাপদে পৌঁছল চূড়ায়। সেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক অবিশ্বাস্য চমক!

চূড়াটা সমতল। মখমলের মত সবুজ ঘাসের গালিচার আচ্ছাদনে ঢাকা। ঘন সবুজ কোমল ঘাসগুলো। কয়েকটা আপেল গাছ, পাকা পাকা সোনালী আপেলে ভর্তি। বড় বড় কয়েকটা অচেনা গাছও ওদের চোখে পড়ল। গাছগুলোর নিচে বহুদিনের শুকনো পাতা ও ডালপালা স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে। সোনালী : আপেল গাছগুলোর অনতিদূরে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। ওরা যেন বিভীষিকার রাজ্য পেরিয়ে রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করেছে। কিছুক্ষণ আগেও ওরা ছিল মৃত্যু-ভয়ে ভীত। এখন ওরা প্রাণ প্রাচুর্যে উজ্জ্বল। ওরা কেউ কেউ নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট বলে ঘোষণা করল। আবার কেউ কেউ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে ঘোষণা করল।

ওদের মধ্যে কয়েকজন লেগে গেল রান্নার কাজে। কয়েকজন ছুটল জ্বালানি কাঠ আনতে। বাকি কয়েকজন গেল আপেল সংগ্রহ করতে। সবাই আপেল গাছের ডাল ভেঙে দাঁতন বানাল। এদিকে চুলো দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা কফি তৈরি হয়ে গেল। সবাই জ্বলন্ত চুলার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল। কেউ চা, কেউ কফি পান করে ছুটল ফোয়ারার উদ্দেশে। ফোয়ারার স্বচ্ছ পানি নিয়ে সবাই চঞ্চল। বালকের মত মাতামাতি শুরু করে দিল। দীর্ঘদিন কারও গোসল নেই। পরম তৃপ্তিতে ওরা সাবান দিয়ে গোসল শুরু করল। গোসল তো নয় যেন সোয়ানবাথ।

গোসল শেষে ফিরে এসে দেখল, ওদের খাবার তৈরি। প্রত্যেকে গরম গরম পরোটা, ডিম ওমলেট ও ভাজা হান্টার-বীফ পেট পুরে খেলো। শেষে সরবরাহ করা হলো গাছ থেকে পাড়া, প্রচুর আপেল। প্যাক থেকে প্রত্যেকে কাপড়চোপড় বের করে নরম ঘাসের ওপর বিছানা পাতল। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মোলোজন ক্লান্ত কমাণ্ডো সৈনিক।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। চারদিকে বেশ ঠাণ্ডা। সান্ধ্যকালীন চা-পর্ব শেষ করে কয়েকজন নৈশভোজের আয়োজন শুরু করে দিল। আনোয়ারসহ বাকি কয়েকজন একটা বড় আগুনের কুণ্ডলীর পাশে তাস নিয়ে বসে গেল। রাত আটটার দিকে ঘোষণা করা হলো, ডিনার প্রস্তুত। সবাই ছুটল ডিনারের জন্য। গরম পরোটা, ডিম ওমলেট, ভাজা হান্টার বীফ, আচার, পেঁয়াজের সালাদ সহযোগে ডিনার শেষ। হলো ওদের। আবার শুরু হলো তাস খেলা। খেলার ফাঁকে ফাঁকে চা ও কফি চলতে থাকল। রাত প্রায় এগারোটার দিকে খেলা শেষে সবাই নরম ঘাসের ওপর পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।

ঘন পল্লবিত গাছের নিচে ওরা শুয়ে আছে। মাথার ওপরে। সামিয়ানার মত করে পঞ্চ টাঙানো। ওরা লোকালয় থেকে বহু দূরে। যেখানে শক্রর কোন ভয় নেই। তাই ওরা পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রারত। অথচ আনোয়ারের দুচোখে ঘুম নেই। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল সে। তারপর এগিয়ে গেল সোনালী আপেল । ভর্তি গাছের নিচে। অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু  অসংখ্য তারার ঝিকিমিকি সারা আকাশ জুড়ে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ দূর । আকাশে হারিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সম্মুখে অসীম প্রান্তর ঘন কুয়াশায় ঢাকা। নিচে মালাকান সড়ক। নীরব, নিথর,

স্পন্দনহীন। দূরে পাহাড়ী নালাগুলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। চূড়ায় ফিরে এল আনোয়ার। চিরসবুজ ঘাসগুলোও যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। সোনালী আপেলের ভারে গাছের ডালগুলো নুয়ে আছে। স্বচ্ছ পাহাড়ী ফোয়ারার প্রস্রবন থেকে কুল কুল শব্দ ভেসে আসছে। গভীর মমতা মাখানো পরিবেশ। কি অপূর্ব!

ও যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গেল। কত সুন্দর এই পৃথিবী, কি বিচিত্র তার রূপ! অথচ ওর মনের মাঝে এক বিষাক্ত দুঃস্বপ্ন ওকে মাঝে মাঝে তাড়া করে। সে জানে না, এই বিপজ্জনক কমাণ্ডো জীবনের পরিসমাপ্তি কোথায়? এক সময় আনোয়ার ধীরে ধীরে বিছানার দিকে ফিরে এল। তারপর ঘন পল্লবিত গাছের নিচে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল। হারিয়ে গেল গভীর ঘুমের রাজ্যে।

মালাকান পাহাড়ে কাটল দ্বিতীয় রাত । সকালে নাস্তা সেরে শুরু হলো পোকার খেলা। সারাটা দিন তাস হাসি তামাসা ও গল্প গুজবের মধ্য দিয়ে কেটে গেল একসময় আবার অন্ধকার হয়ে এল। আকাশে জ্বলে উঠল অসংখ্য তারার বাতি। ওরা আগুনের কুণ্ডলী জ্বালল শুকনো তালপাতা দিয়ে। দাউ দাউ করে কুণ্ডলী জ্বলছে। আগুনের চারপাশে ঘিরে বসে রাতের আহার সারল সবাই। আবার ঘুমিয়ে পড়ল ওরা মালাকান পাহাড়ের চূড়ায়।

মালাকানে তৃতীয় রাত পার হলো। সবাই স্থির করল আগামীকাল সকালে আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। ময়লা কাপড়চোপড় ফোয়ারার পানিতে কেচে নিল ওরা। একদিনের চলার উপযোগী খাবারও তৈরি করা হলো। বিকেলের দিকে চূড়া থেকে নামার রাস্তা খোঁজা শুরু হলো। খুঁজতে খুঁজতে ওরা চূড়ার পেছনের দিকে ঢালু একটা পথ পেয়ে গেল। ব্যস, ওদের সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে গেল। আবার মালাকান পাহাড়ে নেমে এল রাত । ওরাও ঘুমিয়ে পড়ল চূড়ায় কোমল ঘাসের ওপর পাতা বিছানায়।

মালাকান পাহাড়ে চতুর্থ রাত পার হলো। সকালে উঠে সবাই তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। যাত্রার আয়োজন প্রায় শেষ। সবাই ছুটল সোনালী আপেল গাছের দিকে। প্রত্যেকে পকেট ভর্তি করল আপেল দিয়ে। তারপর সেই স্বপ্নরাজ্য ছেড়ে ওরা আবার এগিয়ে চলা শুরু করল আটক দুর্গের উদ্দেশে। যেতে যেতে হঠাৎ আনোয়ার পেছন ফিরে চাইল, মায়াবিনী রূপসী মালাকান চূড়া ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। মনে মনে বলল, বিদায় রূপসী নন্দিনী। হয়তো আর কোনদিন তোমার কাছে ফিরে আসা হবে না। বাকি পথ সবাই নিরাপদে অতিক্রম করে পৌঁছে গেল আটক দুর্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *