০৬.
স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ হেডকোয়ার্টার, চেরাট। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাস। আনোয়ার আর্মি কমাভো লীডার কোর্সের জন্য এখানে এল। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ হেডকোয়ার্টারকে সংক্ষেপে এইচ.কিউ.এস.এস.জি. বলা হয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট থেকে প্রায় ৩০ জন অফিসার এই ট্রেনিং-এর জন্য চেরাট উপস্থিত হয়েছেন। চেরাট ক্যান্টনমেন্ট একটা অদ্ভুত জায়গা। পেশওয়ারের কাছাকাছি সমতল ভূমির মাঝখানে হঠাৎ করে জেগে ওঠা চরের মত পাঁচ হাজার ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর ক্যান্টনমেন্টটি। এটা আমেরিকানদের দ্বারা তৈরি। প্রধান ফটক ছাড়া অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। প্রধান ফটক থেকে আড়াই হাজার ফুট নিচে একটি চেকপোস্ট।
কাছাকাছি একটা পাহাড়ী গ্রামের নাম অনুসারে এই চেক পোস্টের নাম ছাপড়ি । ক্যান্টনমেন্টের প্রধান ফটকে আরও একটি চেকপোস্ট আছে। কঠোর সংরক্ষণের জন্য এই বাড়তি সতর্কতা। ভিতরে পাহাড়ের গা কেটে বানানো মসৃণ পিচঢালা পথ। পথগুলোর একপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। অপর পাশটা ঢালু হয়ে । নিচে নেমে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে অফিস, ঘরবাড়ি, খেলার মাঠ। পাহাড়ের বিভিন্ন চূড়ায়ও ঘরবাড়ি রয়েছে। পুরো ক্যান্টনমেন্টে লোকসংখ্যা প্রায় আট নয়শো। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে একটা রাস্তা থেকে পাঁচ ছয়শো ফুট নিচে একটা সমতল জায়গা। সেখানে একটি ছোট্ট বাজার। বাজার বলতে গোটা চারেক দোকান, একটা ব্যাংক ও একটা পুলিশ ফাঁড়ি। এই রাস্তার ঠিক অপর পার্শ্বে পাঁচশো ফুট উঁচু খাড়া চূড়ায় ট্রেইনী অফিসারদের আখড়া। রাস্তাটি থেকে আরও একটা পাথুরে রাস্তা বের হয়ে পাহাড় বেয়ে ওপরে আখড়ার দিকে উঠে গেছে। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে গোটা পাঁচেক গির্জা-যেগুলো এখন উপাসনালয়ের পরিবর্তে জিমন্যাসিয়াম, লাইব্রেরী, কিণ্ডারগার্টেন স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আনোয়ার পাকা রাস্তা অতিক্রম করে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়া পাথরের রাস্তা ধরে পৌঁছল অফিসার্স কোয়ার্টারে। বুঝতে পারল, এ পথে চলাচল করাটা এক সময় যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সন্ধ্যার আগে অফিসার্স মেসে এল সে। চা পানরত, অবস্থায় শুনতে পেল ওদের জন্য নবনিযুক্ত ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন এজাজ আকরামের নির্দেশাবলী:
(১) কোন ট্রেইনী সড়ক দিয়ে গমনাগমনের সময় হাঁটতে পারবে না। তাকে অবশ্যই দৌড়তে হবে।
(২) ট্রেনিং পিরিয়ডগুলো পরিবর্তনের সময় এক ট্রেনিং এলাকা থেকে অন্য ট্রেনিং এলাকায় হেঁটে যাওয়া চলবে না।
(৩) যে কেউ–গেট টেন বলা মাত্রই বিনা দ্বিধায় তার সামনে দশটা বুকডন দিতে হবে।
(৪) ট্রেনিং চলাকালীন কোন ট্রেইনী অফিসার পদের প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতে পারবে না। অর্থাৎ সবাইকে সিপাহীদের মত থাকতে হবে।
(৫) সপ্তাহে দুদিন করে চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা হবে। পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে অকৃতকার্যরা ছুটির দিনে বাইরে যেতে পারবে না।
(৬) কেউ এই ট্রেনিংগুলোর কোনরকম ত্রুটি করলে তাকে ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে পঁচিশশো ফুট নিচে ছাপড়ি চেকপোস্টে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। এই শাস্তিগুলো অবসর সময়ে দেয়া হবে।
চেরাট ক্যান্টনমেন্টের পিটি গ্রাউণ্ড। ট্রাউজারস, স্পোর্টস ভেস্ট ও বুট পরে পিটি গ্রাউণ্ডে এল আনোয়ার। শুরু হবে এয়ারবোর্ন পিটি। এই পিটি পৃথিবীর কঠিনতম পিটির একটি। অত্যাধুনিক কায়দায় শুরু হলো এয়ারবোর্ন পিটি। ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরে ঘাম গড়িয়ে পড়া শুরু হলো। প্রত্যেকের দেহের সমস্ত কাপড়-চোপড় ভিজে গেল। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলল এই পিটি। পিটি পিরিয়ড শেষ হবার পর মাইলখানেক দৌড়ে, পাঁচশো ফুট চড়াই অতিক্রম করে কামরায় পৌঁছতে হলো সবাইকে। কামরায় পৌঁছে তাড়াতাড়ি বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল আনোয়ার। শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলে দূর হয়ে গেল শরীরের ক্লান্তি। ইউনিফরম পরে সে আবার হাজির হলো মেসে। ব্রেকফাস্ট করতে করতে পুনরায় শুনতে পেল ক্যাপ্টেন এজাজের নির্দেশ–ব্রেকফাস্টের পর ট্রেইনীদের মেসের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
শুরু হলো ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে ওদের ট্রেনিং এলাকা ঘুরে দেখার পালা। প্রত্যেক ট্রেনিং এলাকার মাঝে দূরত্ব এক থেকে দেড় মাইল। কমাপ্তোদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ওদের এই দূরত্ব দশ মিনিটের মধ্যে দৌড়ে অতিক্রম করতে হলো। বেলা এগারোটায় টি-ব্রেক। টি-ব্রেকের পর ট্রেইনীদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো চীফ ট্রেইনার মেজর রউফের সঙ্গে। টকটকে ফর্সা, সুন্দর চেহারা ও স্মার্ট ফিগারের অধিকারী রউফকে দেখে প্রথম দর্শনে সবার ভাল লেগে গেল। তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কখনও রাগেন না। সব সময়ই একটা মিষ্টি হাসি তাঁর মুখে লেগে থাকে।– চিরকুমার চীফ ট্রেইনারের বক্তব্যে সমস্ত প্রশিক্ষণার্থী কমাণ্ডোরা বুঝল প্রকৃত কমাণ্ডা হতে হলে দৈহিক শক্তির চাইতে অনেক বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তির। রিয়েল কমান্ডোরা পৃথিবীর যে-কোন কঠিনতম অবস্থা হাসি মুখে মেনে নিতে পারে। প্রয়োজনে ওরা আলোর গতিতে ছুটবে। উলকার মত আঘাত হানবে লক্ষ্যবস্তুর ওপর। শেষ পর্যন্ত কমান্ডোরা মানবরূপী দানবে পরিণত হবে। পরিণত হবে রোবটে- যে শুধু কমাণ্ড ফলো করতে জানে। হৃদয় যাদের কাছে মৃত-অনুভূতির কোঠা শূন্য। জীবন যাদের কাছে তুচ্ছ।
বিকেলে সমস্ত ট্রেইনীরা খেলার মাঠে গেল। কুচি কুচি পাথরে ভরা মাঠ। মাঠের চতুর্দিকে অ্যাসল্ট কোর্সের জন্য বিভিন্ন ধরনের আঠারোটা অবস্ট্যাকল। খেলা শেষে ক্লান্ত শরীরে যে যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আনোয়ারসহ কয়েকজন ট্রেইনী পাকা রাস্তা অতিক্রম করার সময় না দৌড়ে একটু হাঁটা শুরু করল। পাথরের আড়াল থেকে হাবিলদার ইন্ট্রাকটর বলে উঠল-স্যার, আপনারা পাকা রাস্তা অতিক্রম করার সময় হেঁটেছেন, সন্ধ্যা ছয়টায় ছাপড়ি যাওয়ার জন্য মেইন গেটে হাজির হবেন। সারাদিনের ক্লান্তির পর সবাই যেখানে একটু বিশ্রাম করবে, সেখানে কিনা ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে চড়াই-উত্রাই অতিক্রম করে যেতে হবে ছাপড়ি। কথাটা ভাবতেই প্রত্যেকের মন বিষিয়ে উঠল।
কিন্তু ওরা তো এখন কমাণ্ডো হতে চলেছে-কমাণ্ড ওদের ফলো করতেই হবে। আনোয়ার তাড়াতাড়ি কামরায় এসে শরীরের ঘাম তোয়ালে দিয়ে মুছে ষাট পাউণ্ডের প্যাক পিঠে নিয়ে আবার ছুটল মেইন গেটের দিকে। কামরা থেকে মেইন গেটের দূরত্ব প্রায় এক মাইল। পাঁচশো ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় ওর কামরা। নির্ধারিত সময়ে মেইন গেটে পৌঁছে দেখল, অন্যান্য শাস্তিপ্রাপ্ত অফিসাররাও হাজির। প্রত্যেকেই প্রায় এক মাইল চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এসেছে। সবাই দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। একটা বিতৃষ্ণার ছাপ সবার চেহারায় স্পষ্ট।
ইট্রাকটর গোলাম আযম ওদের প্যাক কাঁটা দিয়ে ওজন করে দেখল। যাদের ওজন কম ছিল, তাদের প্যাকে পাথর ভরে ওজন ঠিক করে দেয়া হলো। হাবিলদার ওদের ছাপড়ি যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে দিল। ওরা প্যাক পিঠে. নিয়ে ছাপড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। গেট পার হবার পর হাবিলদারের চিৎকার শোনা গেল, হু আর ইউ? প্রত্যুত্তরে ওরা সমস্বরে বলে উঠল, কমাণ্ডো। হাবিলদারের আবার চিৎকার, লাউডার, হু আর ইউ? তীব্র চিৎকারে উত্তর ভেসে এল ক-মা-ণ্ডো।
হাবিলদার ইস্ট্রাকটর ওদের ধোঁকা দিয়েছে। পুরো রাস্তা দুর্গম। কোথাও কোথাও রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে শত শত ফুট উঁচুতে উঠে গেছে। আবার কোথাও সরু হয়ে নিচে নেমে এসেছে। কোথাও রাস্তার একপাশে উঁচু পাহাড়। অপর পাশে গভীর খাদ। একটু অসতর্কতার কারণে এ রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সবাই সতর্কতার সঙ্গে ছাপড়ির উদ্দেশে এগিয়ে চলল। রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে এই বিপদসংকুল দুর্গম পথ অতিক্রম করে ওরা পরিশ্রান্ত অবস্থায় ফিরে এল। আনোয়ার শাওয়ারের নিচে যাওয়ার আগে আর্দালিকে ঘরেই ডিনার সার্ভ করতে বলল।
সেনাবাহিনীতে কারও রূমে খাবার সার্ভ করা হয় না। খাবারের নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট পোশাক পরে মেসে উপস্থিত। হতে হয়। ডিনারে প্রত্যেক ঋতুতেই টাই পরার নিয়ম। কিন্তু কমাণ্ডোদের বেলায় এই সব নিয়মের বেশ কিছুটা শিথিলতা। আছে। কারণ কমান্ডোরা শারীরিক ভাবে ভীষণ পরিশ্রান্ত থাকে। তাই ওদের কিছুটা সুবিধা দেয়া হয়।
ব্রেকফাস্টের পর সকালে মাইলখানেক দৌড়ে ১নং প্রশিক্ষণ এলাকায় উপস্থিত হলো আনোয়ার। পাহাড়ের গা কেটে সুন্দর করে বানানো গ্যালারিতে বসে কিছুক্ষণ লেকচার শোনার পর শুরু হলো প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং। কমাণ্ডো ট্যাকটিক্স, বিভিন্ন রকম বিস্ফোরকের ব্যবহার, অপারেশনের সময় কমাপ্তোদের শত্রু এলাকায় অতর্কিত হামলার পথ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হলো ওদের। শেষে বলা হলো, কমাণ্ডোরা শত্রু এলাকায় হামলার সময় সবচেয়ে দুর্গম পথ ব্যবহার করবে। দুর্যোগপূর্ণ গভীর অন্ধকার রাত অপারেশনের জন্য কমাণ্ডোদের উপযুক্ত সময়। অপারেশনের সময় কমাপ্তোদের হামলা হবে অতর্কিত, গতি হবে ক্ষিপ্র।
এই কঠিন ট্রেনিং কিছুদিন চলার পর শুরু হলো কমাণ্ডোদের কারাতে ট্রেনিং। সাধারণ কারাতে ট্রেনিং-এর মত এটা নয়। এটাও কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ের একটা অংশবিশেষ। এতকিছুর মাঝেও সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে ছাপড়ি ভ্রমণ আনোয়ারের জন্য ডালভাত হয়ে উঠল। ওর মনে হত, এটাও বুঝি কমাণ্ডো ট্রেনিং-এর একটা অংশ। সেজন্য ও ষাট পাউণ্ড ওজন ভরে একটা প্যাক সব সময় ঘরে তৈরি করে রাখত। হাবিলদার ইন্সট্রাকটরের মুখ থেকে ছাপড়ি শব্দটা বেরুতেই প্যাকের স্ট্র্যাপের ভিতর দুই হাত গলিয়ে ছুটে যেত আনোয়ার ছাপড়ির দিকে। কোনরকম অজুহাত নেই, শরীর খারাপের কোন বালাই নেই, ও যেন যন্ত্রচালিত এক যন্ত্রদানব। শরীরের সমস্ত পেশীতে পাক ধরেছে। সামান্যতম মেদও রইল না। চেহারাতে ফুটে উঠল কাঠিন্য। দেহের প্রতিটি অঙ্গের গতি হলো ক্ষিপ্রতর।
শুরু হলো চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা। এই দৌড়ের সময় বুট পায়ে, রাইফেল হাতে, পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে, দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করে আবার ফেরত আসতে হবে। আড়াই হাজার ফুট ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পথ। রওনা দেয়ার পর থেকে ফিরে আসার সময় মাত্র চল্লিশ মিনিট। প্রথম দিন সবাই অকৃতকার্য হলো। আনোয়ারের দেড় মিনিট সময় বেশি লাগল। দৌড় শেষে প্রত্যেকের জিভ বের হয়ে এল। কিন্তু তবুও কমাণ্ডো গতিতে এগিয়ে চলল প্রশিক্ষণ। শেষে ও এই দুর্গম পথ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অতিক্রম করতে সক্ষম হলো।
এরপর শুরু হলো ইভনিং ট্রেনিং। এই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় নৈশ ট্রেনিং ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে খুবই সতর্ক রাখতে হত। তা না হলে যেকোন সময়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে; যা ইতোপূর্বে বহুবার ঘটেছে। নৈশ ট্রেনিং-এ যাবার সময় সবাই ব্রাশ দিয়ে জুতোর কালো কালি মুখে ও গলায় লাগিয়ে নেয়। সারা শরীর নেট দিয়ে জড়ানো ওদের। নেটের ফাঁকে ফাঁকে জংলীদের মত পাখির পালকের পরিবর্তে ছোট ছোট ডালপালা লাগিয়ে আনোয়ার যখন আয়নার সামনে দাঁড়াত, তখন নিজেকে কিম্ভুতকিমাকার দেখাত। কালো পালিশ লাগানো অবস্থায় চোখের সাদা অংশ ও মুখের সাদা দাঁত বের করে হাসলে চেহারাটা ভীতিকর হয়ে ওঠে। কালো মুখের ওপর সাদা দাঁতগুলো শানানো ছুরির মত ঝিকমিক করে। এধরনের ভীতিকর চেহারা নিয়ে নৈশ ট্রেনিং-এ বের হত আনোয়ার।
একদিনের কথা ওর আজও মনে পড়ে। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত। অন্ধকার রাতে রাস্তার ধারে কিম্ভুত ছিরি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। সেনাবাহিনীর দুজন সিপাহী রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। ওকে কাছ থেকে দেখেও মানুষ হিসেবে চেনার উপায় নেই। আস্ত একটা গাছ যেন দাঁড়িয়ে আছে । সিপাহী দুজন কাছে আসতেই আনোয়ার হিঃ হিঃ হিঃ করে হেসে উঠল। সেইসঙ্গে একটু নড়ে ওদের দিকে এগুতে শুরু করল। সিপাহী দুজন সচল গাছের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ ওদের সংবিৎ ফিরে আসতেই ওরে বাপ বলে পড়িমরি করে প্রাণের ভয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। তখন আনোয়ারের পক্ষেও হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
পরদিন আর্দালির কাছে সে শুনল, এই অভিশপ্ত পাহাড়ী অঞ্চলে একটা ভৌতিক দানবের মাঝে মাঝে আগমন ঘটে। সেই দানবটাকে গত রাতে দুজন সিপাহী দেখতে পেয়েছে। আর্দালি ওকে নৈশ ট্রেনিংয়ের সময় সাবধান থাকতে বলল। সেই দানবের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য আর্দালি নানারকম দোয়া-কালামও শিখিয়ে দিল। এই ট্রেনিংয়ের সময় সবচেয়ে বিপদে পড়ত ম্যারেড অফিসাররা । ট্রেনিং শেষে যখন তারা সেই অদ্ভুত চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরত, তখন তাদের গৃহিণীরা কিছুতেই দরজা খুলত । কারণ সেই চেহারা দেখে তাদের জ্ঞান হারানোটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ট্রেইনী অফিসারের স্ত্রীরা দরজার ফুটো দিয়ে দেখেও দরজা খুলত না। মনে মনে ভাবত, দৈত্য দানবেরা গলার স্বরও নকল করতে পারে। তখন ম্যারেড অফিসাররা ব্যাচেলরদের কামরায় এসে চেহারা পাল্টে, সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরত। . কিছুদিন পর কম্পাস-মার্চ ট্রেনিং-এর জন্য আনোয়ারকে পেশওয়ার থেকে ষোলো মাইল দূরে জানলাযাই নামক এক রেস্ট হাউজে যেতে হলো। একশো পাউণ্ডেরও বেশি ওজনের ভারী প্যাক পিঠে নিয়ে যখন সে হেঁটে জালোযাই রেস্ট হাউজে পৌঁছল, তখন মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। এরই নাম রেস্ট হাউজ? চারদিকে মাটির দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনা। ভিতরে মান্ধাতা আমলের একটা মাটির তৈরি ডরমেটরী-ব্যারাকের মত লম্বা ঘর। দরজা জানালাবিহীন ডরমেটরীর মেঝে ধুলোয় ভর্তি। সামনে সমতল জায়গাটায় বড় বড় গাছ। সেখানে একটা চাপাকল। এই হলো ম্যাপে নির্দেশিত তথাকথিত জালোযাই রেস্ট হাউজ।
কম্পাস মার্চে ওদের প্রতিদিন সকালে বা সন্ধ্যায় ম্যাপ দেখে দিক নির্দেশক ডিগ্রী, দূরত্ব ও গন্তব্যস্থলের বিবরণ দিয়ে দেয়া হয়। সন্ধ্যার পর কম্পাসে নির্ধারিত ডিগ্রী সেট করে রওনা হয় ওরা। সকালের মধ্যেই আবার ঘুরে আসতে হবে রেস্ট হাউজে। কম্পাস মার্চে প্রথমে নির্ধারিত দূরত্ব অতিক্রমের পর কোন পাথরের নিচে চাপা দেয়া কাগজ খুঁজে বের করতে হত। রাতে এই কাগজ খুঁজে বের করাটা ছিল বেশ কঠিন। সেই কাগজে লেখা থাকত পরবর্তী নির্দেশ। কখনও লেখা থাকে, এখানে অপেক্ষা করো। আবার কখনও লেখা থাকে, সম্মুখের রাস্তায় মাইল-স্টোনের কাছে অপেক্ষা করো। ওখান থেকে গাড়ি তোমাদের উঠিয়ে নেবে। আবার কখনও অন্য গন্তব্যস্থলের বিবরণ, ডিগ্রী ও দূরত্ব দেয়া থাকে। তখন শুরু হয় পুনরায় পথ চলা। মাঝে মাঝে এভাবে পায়ে চলা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। কম্পাস মার্চে সব সময় দুজন করে ট্রেইনীকে পাঠানো হয়। আগুপিছু করে ওরা অ্যাডভান্স করে। সামনের জনের কাজ হলো অন্ধকার রাতে কম্পাসের সাহায্যে আকাশের কোন তারাকে দিক নির্দেশক হিসেবে অনধিক পনেরো মিনিটের জন্য স্থির করে নিয়ে সেই তারার দিকে দৃষ্টি রেখে চলা।
পেছনের জনের কাজ হলো প্রতি একশো বিশ কদমে একশো গজ হিসাব ধরে নিয়ে দূরত্ব মাপা। এই প্রশিক্ষণে প্রতিবার চলার জন্য প্রায় তিরিশ চল্লিশ হাজার গজ অতিক্রমের নির্দেশ থাকে। এই দূরত্ব অতিক্রমকালে কম্পাসের ডিগ্রী সামান্যতম এদিক ওদিক হলে বা আকাশে স্থির করা তারা সামান্যতম সরে গেলে গন্তব্যস্থল হারিয়ে যায় । তখন গন্তব্যস্থল খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুঁচ খুঁজে বের করার সামিল হত। কিন্তু কমাণ্ডোদের কোন কাজকে কঠিন মনে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ কোন কাজকে কঠিন মনে করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়া হয় । কুইট–অর্থাৎ কমাণ্ডো কোর্স থেকে বিদায়।
কম্পাস, মার্চে বাঙালী সিনিয়র ক্যাপ্টেন রেজাউর রহমান (যিনি কমাণ্ডো মহলে বাড়ি বলে পরিচিত) ছিলেন আনোয়ারের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একদিন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন রেজা বের হলো নৈশ-কম্পাস মার্চে।
অন্ধকার রাত। রেজা গাইড হিসেবে আগে আগে চলেছে। জালোযাই রেস্ট হাউজের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলগুলোতে সিয়ার ফল আছে। সিয়ার ফল হলো একধরনের গর্ত, যেগুলো ভরা জ্যোৎস্নাতেও চোখে পড়ে না। কোন কোন সিয়ার ফলের গভীরতা সত্তর আশি ফুট পর্যন্ত। একবার চেরাট এলাকায় নৈশ কম্পাস মার্চ প্রশিক্ষণের সময় এয়ারফোর্সের একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ও একজন সার্জেন্ট এইরকম একটা সিয়ার ফলে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এমনই দুর্গম জায়গায় পড়েছিলেন যে, তাঁদের লাশ খুঁজে বের করাও প্রথমত সম্ভব হয়নি। পরে জায়গাটার ওপর শকুন উড়তে দেখে সেই লাশ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল, উদ্ধারকারীরা।
এই ঘটনা মনে পড়তেই ওদের সতর্কতা আরও বেড়ে গেল। রেজা ছড়ির সাহায্যে সামনের পথ পরীক্ষা করে করে এগুচ্ছে। ঘন অন্ধকারের জন্য দুই তিন কদম দূরে রেজা মাঝে মাঝেই আনোয়ারের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর রেজাকে মৃদুস্বরে ডেকে সাড়া নিচ্ছে, আর এগুচ্ছে আনোয়ার। এভাবে কিছুদূর চলার পর রেজার হঠাৎ কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ট্রেনিং-এর সময়, এই এলাকা শত্রুপক্ষীয় এলাকা হিসেবে বিবেচিত। সেজন্য ওর পক্ষে জোরে ডাকা কিংবা আলো জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়লে কল্পনাতীত নির্যাতন ভোগ করতে হবে।
ভয়ে ভয়ে, খুব সতর্কতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন রেজাকে একটু জোরে ডেকে উঠল আনোয়ার। বেশ নিচের দিক থেকে রেজার গলা শোনা গেল, সাবধান! আমি একটা গর্তে পড়ে গেছি। তাড়াতাড়ি কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে পেন-টর্চ জ্বালাল আনোয়ার । টর্চের আলোয় সামনে আট দশ ফুট নিচু একটা খাদ দেখা গেল । খাদের ভিতরে প্রায় হাঁটু সমান কাদাপানি। ক্যাপ্টেন কাদাপানির ভিতর চিৎ হয়ে পড়ে প্রায় ডুবে আছে। রেজার এই অবস্থা দেখে আনোয়ারের বেশ হাসি পেল। ও রেজাকে খাদ থেকে উঠিয়ে নিয়ে এল ওপরে। সেদিন সারারাত নোংরা কাদা পানিতে ভেজা পোশাকে রেজাকে কাটাতে হলো। এই ধরনের ছোটখাট দুর্ঘটনা কম্পাস, মার্চে প্রায়ই ঘটে। জালোই এলাকায় কম্পাস-মার্চ প্রশিক্ষণ শেষ করে আনোয়ার আবার ফিরে এল চেরাট ।
শুরু হলো বিস্ফোরকের ওপর প্রশিক্ষণ। বিস্ফোরকের সঙ্গে ডেটোনেটর, ফিউজ, প্রাইমার, মাইমাকর্ড লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো থেকে শুরু করে বাস্টিং মেশিন দিয়ে বিস্ফোরণ, বুবি ট্র্যাপ (বিস্ফোরকের ফাঁদ), ডাইরেকশনাল গ্রেনেড, গ্রেনেড় অ্যামবুশ, রকেট দিয়ে বুবি ট্র্যাপ, রাইফেলের বুলেট দিয়ে ডেটোনেটর বানানো, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে ট্রেনিং নিল সে। বিস্ফোরকের ওপর এই ধরনের ট্রেনিং পেয়ে আনোয়ার ধীরে ধীরে একজন বিপজ্জনক মানুষে রূপান্তরিত হলো।
চেরাট ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া শুরু হলো কমাণ্ডো ট্রেইনীদের। বিভিন্ন কলাকৌশলের ওপর মহড়া দিতে হবে সবাইকে। এই মহড়া চলাকালীন এক একজন কমাণ্ডোকে কমপক্ষে দেড়শো মাইল পায়ে হাঁটতে হবে। প্রত্যেকের পিঠে একশো বিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক। প্যাকে খাদ্যসামগ্রী, রান্নার সরঞ্জাম, অতিরিক্ত কাপড়চোপড় ও প্রশিক্ষণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে প্রত্যেকের সাব-মেশিনগান । হেভী মেশিনগান, মর্টার ও রকেট-লঞ্চার সবাইকে পালা করে বইতে হয়। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো পানির বোতল ও আনোয়ারের অতি প্রিয় সঙ্গী কমাণ্ডো নাইফ।
এই ট্রেনিং পিরিয়ডে বহুসংখ্যক ট্রেইড-কমাণ্ডো ওদের শত্রু হিসেবে কাজ করে। ট্রেইও কমাণ্ডোরা গাড়ি ব্যবহার করে প্রশিক্ষণার্থী কমাণ্ডোদের খুঁজে বেড়ায়। ওদের হাতে ধরা পড়া আর কেয়ামত নাজেল হওয়া সমান। ট্রেইনী কমান্ডোরা সবচেয়ে দুর্গম পথ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝেই ট্রেইনড কমাণ্ডোরা হামলা করে এদের সমস্ত খাবার নষ্ট করে দেয়। তখন সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এদেরকে বেঁচে থাকতে হয় । এইভাবে, এদের সারভাইভাল-ট্রেনিং বা বাঁচার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ট্রেনিংও হয়ে যায় ।
এই ট্রেনিং-এর সময় মরুভূমি এলাকায় পানির বড় অভাব দেখা দিত। রাতের কোন বালির ঢিবির আড়ালে ঘুমোনোর আগে আনোয়ার গায়ের ঘামে ভেজা দুর্গন্ধযুক্ত জামা-গেঞ্জি খুলে বালির ওপর বিছিয়ে দিত। সকালে উঠে শিশিরে ভেজা সেই জামা-গেঞ্জি নিংড়ে ঘাম মিশ্রিত শিশির বোতলে পুরত। এই দিয়েই জলের অভাব দূর করত সে। বিভিন্ন গাছের শিকড় কিংবা লতাগুল্ম চিবিয়েও এই অভাব কিছুটা দূর হত। মাঝে মাঝে মাটির রসও চুষে খেত ও। সারভাইভাল ট্রেনিং-এর পর প্রতিটা কমাণ্ডোর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেল। খাদ্যাভাবের দরুন দুনিয়ার সব মানুষ যদি মারা পড়ে, তবে কমাণ্ডোরা মরবে সব শেষে। কারণ ওরা জানে, কিভাবে প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। প্রয়োজনে ওরা সাপ, ব্যাঙ, কুকুর বা যে-কোন প্রাণী, এমনকি নরমাংস ভক্ষণ করতে প্রস্তুত। অখাদ্য কোন জিনিস পৃথিবীতে আছে বলে ওদের জানা নেই।
একবার এ ধরনের ট্রেনিং-এর সময় ট্রেইণ্ড কমান্ডোদের হামলায় ওদের সমস্ত খাবার ধ্বংস হয়ে গেল। প্রয়োজনীয় সঙ্কেতের অভাবে প্লেনও ড্রপ-জোনে কোন খাবার ড্রপ করল না । প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বেশ কয়েকদিন কাটল ওদের। আনোয়ার ও জনৈক পাঞ্জাবী কমাণ্ডো জঙ্গল এলাকা ছেড়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল খাবার সংগ্রহের আশায়। ট্রেনিং চলাকালীন কোন লোকালয় থেকে খাবার সংগ্রহ করা ভীষণ অপরাধ। তাই ওরা চোরের মত গা ঢাকা দিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে চলল গ্রামের দিকে।
গ্রামে ঢুকেই একটি বাড়ির দরজায় ওরা কড়া নাড়ল। একজন সুন্দরী যুবতী দরজা খুলে পশতুতে জিজ্ঞেস করল, কি চাই? ওরা উর্দুতে বলল, আমরা ক্ষুধার্ত। ডিম কিনতে চাই। মেয়েটি কোন কথা বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এই এলাকার লোকেরা পশতু ভাষী হলেও কিছু কিছু উর্দু বোঝে। ওরা মেয়েটিকে পশতুতে জিজ্ঞেস করল, পখতু পোয়ে অর্থাৎ পশতু জানো? মেয়েটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। ওরা আবার বলল, উর্দু পেয়ো? মেয়েটি ঘাড় নেড়ে না বলল। ওরাও পশতু জানে না। যা দুই একটা কথা জানে তা দিয়ে কোনমতেই মেয়েটিকে বোঝানো সম্ভব হবে না যে ওদের ডিম প্রয়োজন। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে, সময়ও কম। যে-কোন মুহূর্তে শত্রু দেখে ফেলতে পারে।
ওরা বুঝল কপালে কষ্ট আছে। আনোয়ার মেয়েটিকে হাত নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি বোঝে না। মাটিতে ডিমের ছবি এঁকে ধারণা দেবার চেষ্টা করল ওরা, মেয়েটি তাও বোঝে না। আহ্ মরণ! আনোয়ার মেয়েটিকে বাংলায় কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বসল। মেয়েটি হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। এবারে ওরা শেষ চেষ্টা করল। আনোয়ার মাটিতে বসে দুই হাত মুরগীর পাখা ঝাঁপটা দেয়ার মত করে কুক-কুরু-কুকরে ডেকে উঠল। পেছন দিক থেকে সদ্য পাড়া মুরগীর ডিম ধরে ফেলার ভঙ্গি করল আনোয়ারে সঙ্গী। এই দৃশ্য দেখে মেয়েটি খিল খিল করে হেসে লুটোপুটি খাওয়া শুরু করল। ওরা অধৈর্য হয়ে আকারে ইঙ্গিতে জানতে চাইল, বুঝতে পেরেছ কিনা? মেয়েটি বলল, এগগায়া এসতা? ওরা বুঝল, পশতুতে ডিমকে এগগায়া বলে। ওরা দ্রুত মাথা নেড়ে মেয়েটিকে এগগায়া আনতে ইঙ্গিত করল। পরক্ষণে মেয়েটি বাড়ির ভিতর থেকে ডিম এনে দিল। ডিম নিয়ে রাস্তায় চলতে চলতে ওরা বলাবলি শুরু করল, হায়রে, একজন কমাণ্ডোকে কতরকম পশুসুলভ গুণের অধিকারী হতে হয়। বাঘের মত হিংস্র, চিতার মত ক্ষিপ্র, গাধার মত ভারবাহী, ঘোড়ার মত ধাবন্ত, ঈগলের মত লক্ষ্য ভেদী দৃষ্টি, লেজ গোটানো কুত্তার মত ভীতু আবার প্রয়োজনে ডিমপাড়া মুরগী। কিন্তু ওরা তখনও জানে না, প্রয়োজনে ওদের আরও কতরকম হিংস্র পশুতে পরিণত হতে হবে।
হঠাৎ একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট এল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বারো মাইল দৌড়ের একটি পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী দুই ঘণ্টা চার মিনিটে, এই দূরত্ব অতিক্রম করেছে– পিঠে সত্তর পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। আনোয়ারদের ওপর নির্দেশ এল, এই রেকর্ড ব্রেক করার জন্য। ওরা এর আগে কখনও এতদূর পথ এমন গুরুভার প্যাক পিঠে নিয়ে পাড়ি দেয়নি। চার মাইল এবং ছত্রিশ মাইল দৌড় দিয়েছে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। সেখানে একেবারে সত্তর পাউণ্ড! ওদের কাছে ব্যাপারটা নিষ্ঠুর কৌতুক বলে মনে হলো। সবাই একটু প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতেই কড়া নির্দেশ দেয়া হলো, যে করেই হোক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর রেকর্ড ভাঙতেই হবে। অবশ্য ওরাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই রেকর্ড ওরা ভাঙবেই।
দৌড়ের পরীক্ষা শুরু হলো। ওদের প্যাকে সত্তর পাউণ্ড ওজনের পাথর ভরা। প্রত্যেকে স্ট্র্যাপ দিয়ে প্যাক পিঠের সঙ্গে আটকে নিল। সবাই দৌড়চ্ছে সামনে একটু কুঁজো হয়ে। স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো প্যাকের ফিতা পিঠের চামড়ার সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে। ইউনিফরম কিছুটা ওদের বাঁচাচ্ছে, চামড়া ছিলে উঠে যাওয়ার হাত থেকে। সুদীর্ঘ বারো মাইল পথ এই ভারী ওজন নিয়ে অতিক্রম করতে হবে; ভাবতেও ওদের মাথা গুলিয়ে উঠছে। কিন্তু প্রত্যেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবিরাম দৌড়াচ্ছে ভারতীয় সেনাদের রেকর্ড ব্রেক করার জন্য। আস্তে আস্তে ভারী প্যাকের ফিতার সঙ্গে ওদের চামড়ার ঘষা বাড়ছে। দৌড়ের তালে তালে সেই ফিতা থেকে থেকেই কাঁধের মাংস ছিলে দিচ্ছে। এক সময় ঘষা খাওয়া জায়গাগুলোতে প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হলো। তবুও ওদের ক্লান্তি নেই। প্রত্যেকের ভাবলেশহীন চেহারা। শান্ত, হিংস্রতার ভাব। ওরা নীরবে পৃথিবীর কঠোরতম যন্ত্রণা সইতে পারে, এমন একটা ভঙ্গি সবার চোখে মুখে ।
ইউনিফরমও শেষ রক্ষা করতে পারল না। চেপে বসা, স্ট্র্যাপের ঘষায় ওদের প্রত্যেকের কাঁধের চামড়া উঠে গেল। দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো সবার। তবুও ওরা দৌড়চ্ছে। বিশাল বুকের ছাতি ওদের উঠা নামা করছে অবিরাম। ইউনিফরম রক্তে লাল হয়ে গেল। শার্ট রক্তে ভিজল–সেইসঙ্গে প্যান্টও। শেষে পায়ের মোজাতে প্রবেশ করল রক্ত। তবুও ওরা দৌড়চ্ছে। ওরা যে কমাণ্ডো! যন্ত্রণা কি তা ওদের জানতে নেই, অসম্ভব বলে কিছু ওদের মানতে নেই। এক সময় বারো মাইলের শেষ সীমা এগিয়ে এল।
অবশেষে ভারতীয় সেনাদের রেকর্ড ব্রেক করল ওরা। প্রথম স্থান অধিকার করল গুলফরাজ নামে এক সিপাহী। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তার সময় লাগে এক ঘণ্টা বিয়াল্লিশ মিনিট। আনোয়ারের লাগে এক ঘণ্টা ছেচল্লিশ মিনিট। কয়েকদিন পর গোয়েন্দা রিপোর্টের সংশোধনী এল। ভারতীয় সৈনিকরা সত্তর পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে দৌড়ায়নি; ওরা দৌড়েছে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। সংশোধিত রিপোর্ট পড়ে ওদের প্রত্যেকের মেজাজ খিঁচড়ে উঠল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল দ্বিগুণ।