হেল কমাণ্ডো – ৫

০৫.

এবোটাবাদ।

শুরু হলো পিফার-এর বার্ষিক রিইউনিয়ন। এই অভিজাত অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য নির্দেশ এল আনোয়ারের প্রতি। এ সময়ে সে আবার পুরানো অভ্যাস মত মাথা ন্যাড়া করেছে। যথাসময়ে সে এবোটাবাদ পৌঁছল। দুতিনদিন কেটে গেল বেশ হৈ-চৈ-এর মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের শেষ দিনে ডিনার পার্টি। গ্রীষ্মকালীন ডিনার-ইউনিফরম পরে পার্টিতে যোগ দিল আনোয়ার। এই ভোজ সভায় আগমন ঘটল বহু উচচপদস্থ সামরিক অফিসারের। তৎকালীন ১নং কোর-কমাণ্ডার (কয়েকটা ডিভিশন নিয়ে একটু কোর হয়) লে. জেনারেল আতিকুর রহমানও এলেন। এই জেনারেল সম্বন্ধে অনেক ভীতিকর কথা প্রচলিত ছিল। সামান্য ভুলত্রুটির জন্য তিনি নাকি ব্রিগেডিয়ারদের পিঠেও বেত দিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলতেন। তাই সমস্ত অফিসাররা এই জেনারেলের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত।

তাছাড়া আর্মিতে তো একটা প্রবাদই আছে, ডোন্ট গো ইনফ্রন্ট অভদি জেনারেলস অ্যাণ্ড বিহাইও দি ডাংকিজ। অর্থাৎ গাধার পেছনে গেলে গাধা লাথি মারে, আর জেনারেলদের সামনে ৫-হেল কমাণ্ডো গেলে দোষত্রুটি ধরা পড়ে।

আনোয়ার কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। হঠাৎ একজন বেয়ারা এসে ওকে জানাল, জেনারেল সাহেব ডাকছেন। ও বেয়ারাকে বলল, তুমি হয়তো ভুল করছ, তিনি তো আমাকে চেনেন না। তিনি নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ডেকেছেন। বেয়ারা আবার বলল, না স্যার, আমি ভুল করিনি। তিনি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন, লম্বা ন্যাড়া মাথা অফিসারকে ডেকে নিয়ে এসো। ন্যাড়া মাথার কথা শুনতেই আনোয়ার চমকে উঠল। মাথা ন্যাড়া করার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিতে দিতে দূরে দাঁড়ানো জেনারেলের দিকে তাকাতেই জেনারেল অঙ্গুলি ইশারায় ডাক দিলেন। দ্রুত জেনারেলের সামনে গিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল সে। জেনারেল আতিক মৃদু হেসে বললেন, রিল্যাক্স।

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর জেনারেল আতিক বললেন, তোমার ডিনার ইউনিফরমের কলারডগ দুটো মনে হচ্ছে উল্টাপাল্টা হয়ে আছে। এই সেরেছে রে! জেনারেল আতিক বোধহয় তার স্বভাবসিদ্ধ পরীক্ষা শুরু করলেন। এবোটাবাদের মনোরম পরিবেশে অফিসার্স মেসের বৈদ্যুতিক পাখার নিচে দাঁড়িয়ে ঘামতে শুরু করল আনোয়ার। হাত-পা অল্প অল্প কাঁপছে তার। জেনারেল সাহেব কিন্তু বলেই চলেছেন, বোধহয় এই ক্ষুদ্র জিনিস দুটো তোমার আর্দালি ভুল করে বাম কলারেরটা ডান কলারে এবং ডানেরটা বাম কলারে লাগিয়েছে। তুমিও নিশ্চয় তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলে, তাই আর্দালির এই ত্রুটি খেয়াল করোনি। ওহো, আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি ভীষণ ঘামছ। নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে গেছ? যাই হোক, তুমি চট করে বাথরূমে গিয়ে তোমার কলারডগ দুটো ঠিক করে এসো। মুখের ঘামও মুছে আসবে। বাথরূমের কাজ সেরে তুমি কিন্তু আমার কাছে ফেরত আসবে। কারণ তুমি এখন আমার মেহমান।

তিনি সারাক্ষণ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। আনোয়ার তাড়াতাড়ি বাথরূম সেরে আবার জেনারেল সাহেবের কাছে ফিরে এল। উনি আনোয়ারের পিঠে হাত দিয়ে হলঘরের এক কোণায় বসানো বার-কাউন্টারে এলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেনারেল আতিককে সবাই সভয়ে জায়গা করে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছে। সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টি। জেনারেল আতিক আনোয়ারের পিঠে হাত রেখে কথা বলছেন। বারম্যানকে নিজের জন্য হুইস্কি এবং আনোয়ারের পছন্দমত ড্রিংকস দেবার নির্দেশ দিয়ে বার কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল। একগ্লাস সেভেন-আপ হাতে নিয়ে জেনারেলের মুখোমুখি দাঁড়াল আনোয়ার। কোন কথা শুরু হবার আগেই তিনি বারম্যানকে বললেন, এই লেফটেন্যান্ট সাহেব আমার মেহমান, তিনি আজ রাতে যে-কোন ধরনের ড্রিংকস যত পরিমাণেই খান না কেন, সব বিল আমার নামে লিখবে।

আনোয়ারের পরিবার, শিক্ষা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন জেনারেল। কখনও বা নিজেই সকৌতুকে হো হো করে হেসে উঠছেন। ব্যাপার কি? আনোয়ারের মনে সন্দেহ! জেনারেলের মনে কোন দূরভিসন্ধি নেই তো? সেভেন আপের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে সে থ হয়ে গেল। হলের সমস্ত অফিসারদের দৃষ্টি ওদের দিকে। আনোয়ারের কমাণ্ডিং অফিসার চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছেন। জেনারেল সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হঠাৎ বলে উঠলেন, ওই দেখো, তোমার এ কমাণ্ডো কমাণ্ডিং অফিসার তোমাকে আমার সঙ্গে গল্প করতে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলা শেষ করে ফেরত গেলে তোমাকে তিনি হাজারো প্রশ্ন করবেন। তুমি কি জবাব দেবে তার প্রস্তুতি এখন থেকে নিয়ে নাও। অবশ্য এই কথা তুমি কাউকে বলবে না যে, আমি তোমার বন্ধু। জেনারেলের শেষের কথায় ও প্রতিবাদ করে বলল, স্যার, সিংহের সঙ্গে ইঁদুরের বন্ধুত্ব কিভাবে সম্ভব? সঙ্গে সঙ্গে তিনি কপট রাগে বললেন, তুমি একটা গাধা। কেন, ছোটবেলায় এই গল্পটা বইতে পড়োনি? একটা ইঁদুর কেমন করে জাল কেটে একটা সিংহকে মুক্ত করায় দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব। হয়েছিল? আর তুমি তো পদের দিক থেকে ইঁদুরের মত হলেও আকারে একটা ধেড়ে ইঁদুর। বুঝতে পেরেছ? আনোয়ার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ইয়েস, স্যার।

ইতোমধ্যে ডিনারের সময় হয়ে এলে জেনারেল আতিক আনোয়ারকে ছেড়ে দিলেন। আর সে ফিরে আসতেই শুরু হলো সবার কৌতূহলী প্রশ্ন। নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে কমাণ্ডিং অফিসার আগা আকবর শাহের কাছ থেকে ডাক এল। ওর ন্যাড়া মাথাই জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ, এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমাণ্ডিং অফিসার বললেন, ব্লাডি চ্যাপ, জেনারেল কি তোমার ন্যাড়া মাথার জন্য রাগ করেছেন? ও সবিনয়ে জানাল, জেনারেল সাহেব রাগ করেননি, বরং খুশিই হয়েছেন। ডিনার টেবিলে বসার শেষ ঘণ্টা ধ্বনি হয়ে গেল। সবাই দেশের প্রেসিডেন্ট ও সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শুরু করল ডিনার। বিলাসবহুল ডিনার শেষে সবাই বাইরে এসে দাঁড়াল। সেখানে সামরিক ব্যাণ্ডে বিভিন্ন ইংরেজি গানের সুর বাজছে।

জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আনোয়ার ব্যাণ্ডের তালে তালে লনের এক প্রান্তে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ড্যান্স করছে। নাচ তো নয় এলোপাতাড়ি হাত পা ছোঁড়াছুড়ি। সব অতিথিরা বাইরে এসে এই উদ্দাম নৃত্য উপভোগ করছে। সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যানুযায়ী এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদানকারী সর্বোচ্চ পদধারী অফিসারকে জলি গুড ফেলো বানানো হয়। জলি গুড ফেলোর অর্থ হলো, ব্যাণ্ডে একটা ইংরেজি সুর, হি ওয়াজ এ জলি গুড ফেলো বাজবে। আর সেইসঙ্গে জুনিয়র অফিসাররা প্রধান অতিথিকে কাঁধে তুলে নিয়ে ড্যান্স করবে। ওরা সবাই নাচতে নাচতে এক সময় ব্যাণ্ডমাস্টারকে ইঙ্গিত করল জলি গুড় ফেলল বাজানোর জন্য। ব্যাণ্ডে বেজে উঠল, হি ওয়াজ••ফেলল। নৃত্যরত জুনিয়র অফিসাররা উদ্ধৃঙ্খল জনতার মত ছুটে এসে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কাঁধে তুলে নিল জেনারেল আতিককে। জেনারেল আতিক জুনিয়রদের কাঁধের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। উদ্দাম নাচের সঙ্গে শুরু হলো নিচ থেকে সুড়সুড়ি দেয়া।

এই সুড়সুড়ির প্রধান লক্ষ্য হলো জেনারেলের আপত্তিকর জায়গায় হস্তক্ষেপ। তিনি লিভ মী, লিভ মী বলে চিৎকার শুরু করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেনারেল আতিককে জলি গুড় ফেলো করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ল সবাই। কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয়ার পর কাছেই দাঁড়ানো পদস্থ অফিসারদের হাঁপাতে হাঁপাতে বিশালদেহী জেনারেল, বললেন, ইউ সি, দিজ বয়েজ আর ভেরী নটি। দে হ্যাড বিন ফিঙ্গারিং মি। অর্থাৎ জানেন–এরা বড় পাজি। আমার পোঁদে আঙুল দিচ্ছিল।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘটল অট্টহাসির বিস্ফোরণ । এই ভাবেই শেষ হলো পিফার-এর রিইউনিয়ন।

খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আনোয়ারকে ব্রিগেড কমাণ্ডো ট্রেনিং-এ অংশ নিতে হলো। এই ট্রেনিং এর সময়সীমা ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। ব্রিগেড কমাণ্ডো ট্রেনিং শেষ হবার পর শুরু হলো ডিভিশন কমাণ্ডো ট্রেনিং। এটার পর শুরু হলো উইণ্টার কালেকটিভ ট্রেনিং। ক্যান্টনমেন্টের বাঁধাধরা জীবনের বাইরে এ ট্রেনিংটা ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। কিন্তু এই কালেকটিভ ট্রেনিং আনোয়ারের স্মৃতিতে একটা দুর্ঘটনার চিহ্ন স্বরূপ।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। পুরো ডিভিশনের বিশাল কনভয় খুব ভোরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো। বিশাল কনভয় নির্ধারিত সময়ে অতিক্রম করল স্টার্টিং পয়েন্ট। পনেরো থেকে বিশ মাইল বেগে এগিয়ে চলেছে কনভয়। বেলা প্রায় নটার দিকে ঝিলাম শহর অতিক্রম করল ওরা।

আনোয়ারের জীপ চলছে কনভয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে। হঠাৎ থেমে গেল কনভয়। তাড়াতাড়ি ও ওয়্যারলেসের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু ওয়্যারলেসে বিভিন্ন স্টেশনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল পুরো কনভয় থামেনি। কোম্পানী-কমাণ্ডার মেজর মোখতার শাহের সঙ্গে সে যোগাযোগ করল। মেজর মোখতার শাহ জানালেন, কনভয় ঠিকই এগিয়ে চলেছে। তবে তার ও আনোয়ারের মাঝামাঝি অবস্থানে কোন গাড়ি হয় বিকল হয়েছে, নতুবা কোন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে। মেজর শাহ ওকে নির্দেশ দিলেন ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে। আনোয়ার জীপ নিয়ে কনভয়ের লাইন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

আধমাইল মত যাওয়ার পর দেখতে পেল, ওর কোম্পানীর একটা বিশাল ট্রাকের নিচে একটি চকচকে নতুন কারের প্রায় অর্ধেক চাপা পড়ে আছে। সৈনিকরা ট্রাকটাকে ঠেলে পেছনের দিকে সরানোর চেষ্টা করছে। আনোয়ার জীপ থেকে নেমে দৌড় দিল দুর্ঘটনাস্থলের দিকে। ওকে দেখে কার-মালিক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। তিনি জড়ানো গলায় একহাত নেড়ে ওকে কিছু বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু কোন কথাই বোঝা গেল না। লোকটির মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল আনোয়ার। সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত বীভৎস আকার ধারণ করেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত। কথা বলার সময় রক্তের সঙ্গে থোকা থোকা ভাঙা দাঁত বেরিয়ে আসছে। কারের ড্রাইভার অচেতন অবস্থায় অনতিদূরে ঘাসের ওপর শায়িত। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা চারদিকের পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।

সবাই মিলে ট্রাক ঠেলে খানিকটা পেছনের দিকে সরাল। সঙ্গে সঙ্গে সবার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল আর্ত চিৎকার। বিশাল ট্রাকের চাপে সালোয়ার-কামিজ পরিহিতার সম্পূর্ণ ডান পা-টা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চামড়া ফেটে নরম হাড় মাংস রক্তের সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একটা হাতও ভাঙা । হাতের সাদা হাড় নরম মাংস ভেদ করে বেরিয়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে আনোয়ার লক্ষ করল, সালোয়ার-কামিজ পরিহিতার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে খোলা। সামান্য উদাস দৃষ্টি মেলে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। তাড়াতাড়ি সব আহতদের একটা রেকুয়িজিশন করা মাইক্রোবাসে করে নিকটবর্তী ঝিলাম সি.এম.এইচ.-এ পৌঁছল আনোয়ার। সেখানে সবাইকে ভর্তি করে আবার সে ফিরে এল কনভয়ে।

মে-জুন-জুলাই। শুরু হলো সামার কালেকটিভ ট্রেনিং। আনোয়ারদের ইউনিট ক্যাম্প করল দৌলত নগরে। ওরা প্রায়ই জীপে করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক্সারসাইজ এলাকা পরিদর্শনে বের হয়। এই এলাকায় বেশ কয়েকটা শুকনো নদী আছে। এই নদীগুলো এসেছে ভারতের দিক থেকে। ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টি হলে এদিককার শুকনো নদীগুলো ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানিতে অল্প সময়ে খরস্রোতা নদীতে পরিণত হয়। এধরনের একটা মরা নদীর পাড় ঘেঁষে ওদের ইউনিটের ক্যাম্প। এই শুকনো নদীটি প্রায় পৌনে এক মাইল চওড়া। একদিন সকালে মেজর খটক, লেফটেন্যান্ট আসিফ শাহ ও লেফটেন্যান্ট আনোয়ার বের হলো এক্সারসাইজ এলাকা পরিদর্শনে। জীপে ড্রাইভার সহ সঙ্গে রয়েছে একজন ওয়্যারলেস (পি আর সি-১০) অপারেটর ও ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার। বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনের পর বেলা ১১টার দিকে আকাশ মেঘলা হয়ে এল। মেজর খটক তাড়াতাড়ি জীপ চালিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছবার নির্দেশ দিলেন।

জীপ অতি দ্রুত এগিয়ে চলল ক্যাম্পের দিকে। দুটো শুকনো নদী পার হবার পর চমকে উঠল ওরা। সামনে ভারতীয় অঞ্চলে শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টি। তৃতীয় নদীটার সম্মুখে এসে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানি ইতোমধ্যেই এসে পড়েছে। ক্রমেই তীব্র হচ্ছে স্রোত। ওরা ভাবল, এটা পার হওয়া গেলেও সামনে চওড়া নদীটা কোনক্রমেই পেরুনো যাবে না। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, পেছনে ফেলে আসা শুকনো নদীগুলো পার হয়ে জি.টি, রোড ধরে ক্যান্টনমেন্ট হয়ে ক্যাম্পে পৌঁছুতে হবে। জীপ ফিরে চলল পেছনের দিকে। প্রথম নদীটার সম্মুখে এসে ওরা আবার থমকে দাঁড়াল। নদীটা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানিতে সংহার মূর্তি ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে পাক খাচ্ছে পানি। দেখে কোনক্রমেই বোঝার উপায় নেই, একটু আগেই জায়গাটা শুকনো খটখটে ছিল। কিন্তু এখন জীপ নিয়ে পার হওয়া অসম্ভব। আবার ফিরে চলল জীপ সামনে। তৃতীয় নদীটা তখনও ভয়াল রূপ ধারণ করেনি। পানির ভিতর দিয়ে জীপ চালিয়ে ওরা পার হয়ে গেল নদীটা।

কিন্তু ক্যাম্প সংলগ্ন নদীটার পাড়ে এসে সবাই দেখতে পেল ফ্ল্যাশ ফ্লাডের তাণ্ডব । ভীষণ আওয়াজে প্রচণ্ডবেগে পানি ছুটে । চলেছে। মাঝে মাঝে পানি ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা আটকে গেছে ফ্ল্যাশ ফ্লাডে। সবাই জীপ থেকে নেমে নদীর পাড়ে দাঁড়াল। মেজর খটক ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করলেন ক্যাম্পের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর নদীর অপর পাড়ে গাছের নিচে কর্নেল আকরাম রাজা, অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন তাইমুর শাহ ও আরও কয়েকজন অফিসারকে দেখা গেল। উভয় পক্ষই হাত নাড়ানাড়ি করল । আবার শুরু হলো ওয়্যারলেসে কথোপকথন। ওপার থেকে ওয়্যারলেসে অ্যাডজুটেন্ট কৌতুক করে বললেন সেনাবাহিনী থেকে ইঞ্জিনিয়াররা রওনা হয়ে গেছে ব্রিজ তৈরি করার জন্য। আর পিণ্ডি থেকে, কপ্টার রওনা হয়ে গেছে খাবার পৌঁছে দেবার জন্য। একে প্রচণ্ড ক্ষিধে, তার ওপর এধরনের কৌতুক, বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হলো ওদের। কৌতুকপ্রিয় মেজর খটক রেগেমেগে বললেন, ওকে, নাউ ইউ সি, হাউ ইনফ্যান্ট্রি ক্রসেস দ্য অবস্ট্যাকল।

জীপ পাহারার জন্য ড্রাইভার ও ওয়্যারলেস অপারেটরকে রেখে ওরা এগিয়ে গেল নদীর কিনারায় । পানির গভীরতা কোমরের চেয়ে সামান্য ওপরে। মেজর খটক, আনোয়ার ও ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার তিনজনই দক্ষ সাঁতারু। কিন্তু আসিফ শাহ। সাঁতারের ব্যাপারে একেবারে আনাড়ি। তাই নিরাপত্তার জন্য ওকে। সবচেয়ে উজানের দিকে রাখা হলো। ভাটির দিকে রইল মেজর খটক, আনোয়ার ও হাবিলদার। হাবিলদারের পরনে শুধু শর্টস।

কিন্তু ওরা তিনজন ইউনিফরম পরেই নামল পানিতে। প্রত্যেকের মাঝে দূরত্ব প্রায় দশ হাত । লাইনবন্দী হয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে। নদীর তিনভাগের একভাগ পার হবার পর শুরু হলো প্রচণ্ড স্রোত। স্রোতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বুটের তলা থেকে বালি সরে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পিছলে যেতে চাইছে পা। প্যান্টের পকেটে ও শার্টের ভিতরে পানি ঢুকে শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে। ইউনিফরম পরে বোকার মত পানিতে নামার জন্য ওরা নিজেদেরকে ধিক্কার দিল।

স্রোত ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মাঝে মাঝে পাক খাচ্ছে পানি। পানির দিকে তাকালে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড বেগে ওরা উজানের দিকে চলেছে। মাথা পর্যন্ত ঘুরে উঠতে চায়। সবাই দূরে গাছপালার দিকে তাকিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আর মাত্র পাঁচ ছয়শো গজ বাকি। হঠাৎ করে বেড়ে গেল গভীরতা। পানি যেন রুদ্র মূর্তি ধারণ করে প্রলয় নৃত্যরত। ওরা স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। এই অবস্থায় একবার পা পিছলে গেলে আর রক্ষা নেই। দক্ষ সাতারুর পক্ষেও পুনরায় ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব।  

ঠিক এই সময়ই ঘটল বিপদটা! মেজর খটকের হাত থেকে ফসকে গেল প্লাস্টিকের কাভারে মোড়া ম্যাপ। খটক ক্যাচ দি ম্যাপ বলে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়লেন পানিতে। তারপর তৃণখণ্ডের মত তীব্রবেগে আনোয়ারের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আনোয়ার দ্রুত অকাল আসিফ শাহের দিকে। শাহেরও পা পিছলে গেছে। সে-ও তীব্রবেগে স্রোতের টানে এগিয়ে আসছে। আনোয়ার আন্দাজ করল, শাহ ওর পাঁচ ছয় হাত দূর দিয়ে ভেসে যাবে। প্রাণপণে স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে এগুলো সে। আস্তে আস্তে দূরত্ব কমছে। ওদিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে শাই। আর মাত্র হাত দেড়েক। তাহলেই ওকে ধরে ফেলবে আনোয়ার। কিন্তু হাতখানেক বাকি থাকতেই তীব্র গতিতে শাহ ভেসে গেল। হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে যাবার সময় র চোখেমুখে পরিষ্কার মৃত্যু ভয়ের ছাপ দেখতে পেল আনোয়ার। আসিফ শাহকে ধরার জন্য ও নিজেও লাফ দিল। কিন্তু কার ধরা কে ধরে? প্রবল স্রোতের টানে ওরা ভেসে চলল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

ইতোমধ্যে ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে গেছে। শুধু শর্টস পরিহিত হাবিলদারের দ্রুত এগিয়ে চলতে তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না। মেজর খটকের হাত থেকে প্লাস্টিকের কাভারে মোড়া ম্যাপটা সামনে দিয়ে ভেসে যাবার সময় হাবিলদার ধরে ফেলল। আনোয়ার চিৎকার করে উঠল, আমাদের জন্য কোন চিন্তা কোরো না। তুমি শাহকে ধরো। ও সাঁতার জানে না। কিছুদূর ভেসে যাবার পর পেছন ফিরে চাইতেই সে দেখতে পেল, হাবিলদার শাহকে ধরে এগিয়ে চলেছে পাড়ের দিকে।

আনোয়ারের থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে রয়েছে মেজর খটক। স্রোতের তীব্রতা বেড়ে চলেছে ক্রমশই। সেইসঙ্গে ওদের ভেসে যাবার গতিও বাড়ছে। ওরা দুজনে অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে বেলেমাটিতে পা ঠেকিয়ে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু প্রবল স্রোতে মাটিতে পা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। চিৎ হয়ে ভাসছে ওরা। মাঝে মাঝে নাকে মুখে পানি ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রবল স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিনারায় পৌঁছানো অসম্ভব। তাই ওরা মাটিতে পা ঠেকিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য রীতিমত মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু ব্যর্থ হলো ওদের সমস্ত চেষ্টা। তীব্র স্রোতের বিপরীতে পা সোজা করাই সম্ভব হচ্ছে না। প্রাণান্ত পরিশ্রমের ফলে দুজনের শরীর ক্রমেই দুর্বল হয়ে এল। এইভাবে মাইল দেড়েক ভেসে যাবার পর স্রোতের গতিমুখের কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেল। এদিকে স্রোত অনেকটা কিনারাভিমুখী। মেজর খটক, ও আনোয়ার তীরের অনতিদূর দিয়ে ভেসে চলেছে-বড় অসহায়ের মত। হঠাৎ দুজন দেখতে পেল, নদীর ধার দিয়ে ওদের ইউনিটের একটি জীপ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের অতিক্রম করে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল জীপটি। জীপ থেকে নামল কয়েকজন দক্ষ সাঁতারু। সাঁতারুদল দ্রুত পানিতে নেমে পথ আগলে দাঁড়াল ওদের। ওরা ভেসে কাছে আসতেই সাঁতারুরা ওদের ধরে কিনারায় ওঠাল। ওরা কোনমতে সাঁতারুদের পিঠে হাত দিয়ে জীপে চড়ে বসল। জীপ এগিয়ে চলল ক্যাম্প অভিমুখে।

সন্ধ্যায় মেসে এই অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী নিয়ে শুরু হলো তুমুল হৈ-চৈ। মেজর খটকের সেই উক্তি-নাউ ইউ সি, হাউ ইনফ্যান্ট্রি ক্রসেস দি অবস্ট্যাকল। এই কথায় হাসির রোল উঠল চারদিকে। সবশেষে কর্নেল বললেন, মাই ডিয়ার ইনফ্রাস্ট্রিমেন, প্লীজ হ্যাভ সাম পেশেন্স। ফর গডস সেক, ট্রাই টু এভাললায়েট দ্য অবস্ট্যাকল বিফোর ক্রসিং ইট। আবারও উঠল হাসির রোল। ডিনার শেষে তাঁবুতে ফিরে এল আনোয়ার। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়ল সে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *