০৩.
সাব ওঠো, সাব ওঠো ডাকে আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখল, মাথার কাছে বুড়ো আদালী দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মেইন লাইট ও টেবিল ল্যাম্প দুটোই জ্বালানো। ফায়ারপ্লেসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ফ্লাস্ক থেকে দুকাপ গরম বেড টি খেয়ে, একটা সিগারেট ধরাল ও। আদালী শেভিং-মগে গরম পানি এনে ছোট্ট টিপয়টার ওপর রাখল। সেই সঙ্গে শেভ করার সমস্ত সরঞ্জাম এগিয়ে দিল। গরম পানি দিয়ে শেভ করে মুখ টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। বাথরূম থেকে ফিরে এসে ঘড়ি দেখল–সাড়ে পাঁচটা। সর্বনাশ! আর মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘর থেকে বেরুতে হবে। ভোরের গাঢ় তুষারাচ্ছন্ন অন্ধকার তখনও কাটেনি। প্রকৃতি তখনও সুপ্তির কোলে আধো ঘুমন্ত।
এখন পর্যন্ত নতুন ক্যাডেটদের কাছে ইউনিফরম পৌঁছেনি। চেস্ট অভ ড্রয়ার খুলে ফায়ার প্লেসের সামনে আনোয়ার কাপড়চোপড় পরে নিল। দরজা খুলতেই কনকনে ঠাণ্ডা ঝাঁপটা মারল মুখে। দুহাতের তালু ঘষে গরম রাখতে হচ্ছে। গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে আনোয়ার ছুটে চলল জি.সি. অফিসের দিকে।
নির্ধারিত সময়ের আগে সবাই জি.সি. অফিসের সামনে সমবেত হলো। প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে লাফাচ্ছে এবং দুহাতে তালু ঘষে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছে। হঠাৎ বাজখাই গলায় আদেশ হলো, ফল ইন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল ওরা। ইতোমধ্যে আনোয়ারদের কোম্পানীর জন্য একজন সিনিয়র ক্যাডেটকে কোম্পানী সার্জেন্ট মেজর বা সি.এস.এম. বানানো হয়েছে। প্রথমে প্রত্যেক প্লাটুন সার্জেন্টরা প্যারেড টেস্ট বা উপস্থিত রিপোর্ট হস্তান্তর করল সি.এস.এম.-এর কাছে। অতঃপর সি.এস.এম.-রা হাবিলদার স্টাফের কাছে প্যারেড হস্তান্তর করল। এরপর শুরু হলো হাবিলদারের নির্দেশে বিভিন্ন প্লাটুনের ডবল মার্চ। দৌড়ে দৌড়ে নতুন ক্যাডেটদের মিলিটারি একাডেমীর বিভিন্ন জায়গা দেখানো শুরু হলো । আনোয়ারদের প্লাটুনকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো কোথ বা অস্ত্রাগারে। এরপর পিটি গ্রাউণ্ড, ড্রিল গ্রাউণ্ড, হলস অভ স্টাডিজ পেরিয়ে ওদের নিয়ে আসা হলো এঙ্গেল হল নামে একটা লেকচার গ্যালারিতে। সেটা দেখার পর শর্ট ফায়ারিং রেঞ্জ, সিনেমা হল, লাইব্রেরী হয়ে ওরা এল ডাইনিং রূমে ব্রেকফাস্টের জন্য।
ব্রেকফাস্ট রেডি। টেবিলের ওপর প্রত্যেকের জন্য একটা করে বড় প্লেট, দুধ ভর্তি পট, চিনির পট, এক গ্লাস করে পানি ও কয়েকটা কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট রাখা। আনোয়ার কোয়ার্টার প্লেট থেকে ন্যাপকিন নিয়ে কোলের ওপর বিছিয়ে দুধ চিনি মিশিয়ে কর্মক্ষের খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষ না হতেই ওয়েটার এসে পুটো করে এগ ফ্রাই ও চাহিদা মত ওমলেট দিয়ে গেল । সেইসঙ্গে কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট উঠিয়ে নেয়া হলো এবং শুরু হলো নাস্তা ।
প্রত্যেকের সামনে রাইস প্লেট। প্রচুর স্লাইস করা পাউরুটির সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাখন, জ্যাম, জেলী স্থূপীকৃত ভাবে সাজানো টেবিলের ওপর। শেষে লবণ ও গোল মরিচের পাত্র দিয়ে গেল ওয়েটার নাস্তা শেষে পর পর দুকাপ চা খেয়ে হল রূম থেকে বেরিয়ে এল আনোয়ার। একটু নিভৃত জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে টান দিল সে।
আবার প্রত্যেকে জি.সি, অফিসের সামনে জড়ো হলো এবং শুরু হলো স্থান পরিদর্শন। বিভিন্ন জায়গা দেখিয়ে শেষে ওদের নিয়ে আসা হলো পি.এম.এ.-র লাইব্রেরীর সামনে। লাইব্রেরী থেকে সবার জন্য পাঠ্য বই ও পি.এম.এ.-র মনোগ্রাম অঙ্কিত খাতা ইস্যু করা হলো। এর আগে প্রত্যেকের জন্য খাকি কাপড়ের তৈরি কাঁধ থেকে ঝুলন্ত লম্বা ফিতে দিয়ে জড়ানো ব্যাগ (যাতে বইপত্র নেয়া হয়) বা স্যাচেল ইস্যু করা হয়েছিল। এরপর ওদের আবার জি.সি. অফিসের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। এবার শুরু হলো কুচকাওয়াজের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। একই জিনিস বারবার দেখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও নবাগত ক্যাডেটদের ভুল হতে থাকল। কিন্তু হাবিলদার ইন্সট্রাকটর ধৈর্য সহকারে একই জিনিস বারবার দেখিয়ে দিল ওদের। কুচকাওয়াজের মান মোটামুটি ভাল না হওয়া পর্যন্ত নবাগতদের ড্রিল গ্রাউন্ডে নেয়া হবে না। কারণ ড্রিল গ্রাউণ্ডে পূর্ণ সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করা হয়, এবং একজন অ্যাডজুটেন্ট পদধারী অফিসার সালাম গ্রহণ করেন। বেলা প্রায় এগারোটার দিকে নবাগত ক্যাডেটদের জন্য টি ব্রেক হলো ।
টি ব্রেক শেষে সবাই নোটিশ বোর্ডে গিয়ে লিখে নিল ট্রেনিং প্রোগ্রাম। সেইসঙ্গে সেদিনের মত ছুটি হলো ওদের। আনোয়ার ও রূমমেট ঘরে ফিরে এল। ঘরের আসবাব বলতে দুটো সিঙ্গেল খাট, দুটো সিঙ্গেল সোফা, একটা পড়ার টেবিল, দুটো চেয়ার, একটা বড় কাঠের আলমারি ও দুটো চেস্ট অভ ড্রয়ার। চেস্ট অভ ড্রয়ারের সবচেয়ে ওপরের তাকে দুটো হাফ ড্রয়ার। যার প্রত্যেকটিতে রাখতে হবে ইস্ত্রি করা রুমাল, মোজা, আণ্ডারওয়্যার, গেঞ্জি এবং খেলার পোশাক। দ্বিতীয় তাকের ফুল ড্রয়ারে রাখতে হবে ইস্ত্রি করা ইউনিফরম। তৃতীয় তাকের ফুল ড্রয়ারে রাখতে হবে বেসামরিক কাপড় এবং সবচেয়ে নিচের তাকে রাখতে হবে ব্যবহৃত ময়লা কাপড়চোপড়। বিরাট আলমারির হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে আগামীতে ব্যবহারের জন্য ইউনিফরম অথবা বেসামরিক শার্ট, প্যান্ট বা ওভারকোট। ফিল্ড সার্ভিস মার্চিং অর্ডার রাখতে হবে আলমারির ওপরের দিকে বানানো একটা তাকে। চকচকে বুট ও অন্য জুতা রাখতে হবে আলমারির নিচের তাকে।
চেস্ট অভ ড্রয়ারের ওপর কাপড়ের আচ্ছাদন বিছিয়ে রাখতে হবে শেভিং কিট। মাথা আঁচড়ে চিরুনি পরিষ্কার করে ব্রাশের সঙ্গে ভালভাবে আটকে রাখতে হবে। বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতে হবে, ব্যবহৃত শেভিং ক্রীমের টিউব যেন টোল খেয়ে না থাকে। চিরুনির সঁতের ফাঁকে যেন ময়লা অথবা চুল না থাকে। কারণ এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিকেলে প্লাটুন সার্জেন্ট এলেন চেস্ট অভ ড্রয়ার পরীক্ষা করতে। তিনি যেভাবে চিরুনি আলোর সামনে ধরে এক চোখ বন্ধ করে পরীক্ষা করলেন, তাতে আনোয়ারের মনে হলো, চিরুনি পরিষ্কার করার মত কঠিন কাজ দুনিয়ায় আর নেই। শেভিং কিটের বেলাতেও একই অবস্থা। শেভিং কিট এবং চিরুনি, এ দুটোর কোনটার অবস্থাই প্লাটুন সার্জেন্টের মনঃপূত হলো না। এর পরে শেভিং কিট এবং চিরুনির অবস্থা এরকম থাকলে শাস্তি দেয়া হবে বলে প্লাটুন সার্জেন্ট পরীক্ষা শেষ করলেন। শেভিং কিট এবং চিরুনি এর চাইতে পরিষ্কার রাখা আনোয়ারের পক্ষে অসম্ভব।
কি করা যায়–চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় একটা সুন্দর বুদ্ধি খেলে গেল ওর। আর এরপর থেকে প্লাটুন সার্জেন্ট ওর চেস্ট অভ ড্রয়ারে সবসময় ঝকঝকে শেভিং কিট ও চিরুনি ব্রাশ দেখতে পেতেন, যা কখনই ওর শাস্তির কারণ হয়নি। এর পশ্চাতে যে রহস্য লুকিয়ে ছিল তা হলো, এমন একসেট শেভিং কিট ও চিরুনি প্লাটুন সার্জেন্ট পরীক্ষার সময় দেখতে পেতেন, যেগুলো ও কখনই ব্যবহার করত না। ব্যবহৃত শেভিং কিট ও চিরুনি ব্রাশ আনোয়ার চেস্ট অভ ড্রয়ারের ময়লা কাপড়-এর মধ্যে লুকিয়ে রাখত। আর প্রদর্শনী স্বরূপ সাজিয়ে রাখত সদা-নতুন সরঞ্জামগুলো।
পড়ার টেবিলও নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখতে হত। ব্যবহারের সময় ছাড়া অ্যাশট্রের মধ্যে কোন সিগারেটের টুকরো বা ছাই পাওয়া গেলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। বাথরূম পরিষ্কারের দায়িত্ব সুইপারের হলেও তা পরীক্ষা করার দায়িত্ব ক্যাডেট বা তার আদালীর। টুথব্রাশ, পেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, টয়লেট পেপার, তোয়ালে ইত্যাদি পরিষ্কার অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। বেলা প্রায় দেড়টার দিকে ঘর গোছানো শেষ করে আনোয়ার বের হলো মেসের উদ্দেশে।
খাওয়া শেষ করে ঘরে আসার সময় ঘটল বিপদ। দূরে বিল্ডিংয়ের জানালায় দাঁড়ানো এক সিনিয়র ক্যাডেটের হাতে ধরা পড়ে গেল আনোয়ার। কাঁচের জানালা খুলে সিনিয়র চিৎকার করে বলে উঠল, ইউ ইডিয়ট, হোয়াই ডিড নট ইউ উইশ? ও সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সালাম দিয়ে বলল, স্যার, আমি আপনাকে দেখতে ইনি। সিনিয়র আবার চিৎকার করে উঠলেন, দ্যাখোনিটা কেন? যাও ওই গাছটাকে এক লক্ষবার সালাম দাও। সামনে ছিল একটি গাছ। গাছটিকে সম্মুখে রেখে আনোয়ার জপে যেতে লাগল, স্লামালেকুম, স্যার, স্লামালেকুম, স্যার, স্লামা… আবার সিনিয়র ক্যাডেটের চিৎকার শোনা গেল, লাউডার। ওর গলার স্বর এক পর্দা বেড়ে গেল। সিনিয়র সাহেব এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি পূর্ববৎ চিৎকার করলেন, আই সে লাউডার, ইউ ব্লাডি ইডিয়ট। এবারে ও গগনবিদারী কণ্ঠে বৃক্ষ মহারাজকে সালাম জানাতে শুরু করল। মনে মনে বলল, হে অজানা অচেনা বৃক্ষ, তোমার জীবনই সার্থক।
বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ওর কাঁধে ও মাথায় তুষার জমতে লাগল। মাঝে মাঝে আনোয়ার কাঁধ ও মাথা ঝাঁকিয়ে জমে থাকা তুষারকণা ফেলে দিচ্ছে। এটা সিনিয়র সাহেব দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ডোন্ট মুভ, ইউ শিট। ঠায় দাঁড়িয়ে গাছটাকে সালাম জানাচ্ছে সে। কোনরকম নড়াচড়া নেই। ফলে ক্রমেই তুষার জমে কাঁধ ও মাথা ভারী হতে লাগল। এইভাবে ঘণ্টা দুই অতিবাহিত হবার পর সিনিয়র মহোদয় চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, কেটে পড়ো এবার। এখন থেকে চোখ-কান খোলা রাখবে। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার রূমের উদ্দেশে ভোঁ দৌড়।
সে-রাতে ঘটল আরও একটা মজার ঘটনা। আনোয়ার ও রূমমেট একসঙ্গে ডিনার খেতে মেসে গিয়েছিল। ডিনার শেষে ওরা রূমে ফিরে আসছে। তুষারপাতের জন্য দূরের কোন জিনিস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। এই ঝাঁপসা অন্ধকারে ওরা দেখতে পেল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন চিৎকার করে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। কাছে গিয়ে দেখে, সে আর কেউ নয়, ওদেরই বুড়ো আদালী। সিনিয়ররা প্রতিদিন যখন তখন রূমে এসে ওদের নিয়ে মর্মান্তিক কৌতুক শুরু করে দেয়। এই পাঁচ ছয়শো ক্যাডেটের মধ্যে কে সিনিয়র আর কে জুনিয়র তা প্রথমে বুঝে ওঠা সত্যিই মুশকিল। কিন্তু পদে পদে কঠিন শাস্তি আনোয়ারকে কে কি তা সহজেই বুঝিয়ে দিল। ঘরে বাইরে এই প্রচণ্ড শাস্তি একেবারে অসহ্য। ওরা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোন রাজ্যের বাসিন্দা, যেখানে নির্মমতা কৌতুক বলে গণ্য।
পরদিন রাতে ডিনার খেয়ে আনোয়ার ঘরে ফিরে আসতেই দেখতে পেল দরজার সামনে একজন সিনিয়র ক্যাডেট দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি কান ফাটানো কণ্ঠে ও বলে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। সিনিয়র সাহেব বললেন, ওপেন দ্য ডোর। রূমে ঢুকে তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, আজ রাতে প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটকে ভীষণ শাস্তি দেয়া হবে। তুমি আমার রুমে চলো। তাহলে শাস্তি থেকে খানিকটা রেহাই পাবে। ও তাড়াতাড়ি সিনিয়র ক্যাডেটকে অনুসরণ করল। রূমে ঢুকে সিনিয়র সাহেব আনোয়ারকে গান গাইতে অনুরোধ জানালেন। অনেকদিন পর ও প্রাণ খুলে গান গাইল। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্যাডেট এসে ঘুরে গেল। কিন্তু অন্য একজন সিনিয়রের সঙ্গে থাকায় আনোয়ার শাস্তি পেল না। ওদের মধ্যে কেউ কেউ আনোয়ারকে জিজ্ঞেস করল সে হাত দেখতে জানে কিনা, ও না সূচক জবাব দিল। কিন্তু এ ব্যাপারে সিনিয়রদের প্রচণ্ড আগ্রহ ওর নজর এড়াল না।
সেদিন বাঙালী সিনিয়র ক্যাডেটের সাহায্যে রক্ষা পেলেও পরবর্তী শাস্তির ভয় আনোয়ারকে আতঙ্কিত করে রাখল। সে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এরপর থেকে আনোয়ারের রূমে সব সময় তালা ঝুলতে দেখা যেত। রূমের, গরাদবিহীন পেছনের জানালাটাই সে ব্যবহার করে। আর সিনিয়ররা শাস্তি দিতে এসে রূম তালাবদ্ধ দেখে ফিরে যায়। ভাবে আনোয়ার হয়তো বাইরে কোথাও শাস্তি পাচ্ছে। অথচ তখন হয়তো সে রূমের ভেতরেই দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এই পদ্ধতি ওর শাস্তির মাত্রা বেশ কিছুটা কমিয়ে দিল।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনোয়ার চিন্তা করতে লাগল, শাস্তি থেকে আর কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। রাত গম্ভীর হয়ে এল, তবু ও চিন্তা করেই চলেছে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল। হাত দেখার ভান করলে কেমন হয়? ব্যাপারটা বিপজ্জনক হলেও ভালভাবে অভিনয় করতে পারলে উতরে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি দেখা দিল। এবার ও হবে হস্তরেখাবিদ।
পরদিন লাঞ্চের পর গতরাতে পরিচিত বাঙালী সিনিয়র ক্যাডেটের রূমের উদ্দেশে রওনা হলো আনোয়ার। পথে বেশ কয়েকজন সিনিয়রের হাতে ধরা পড়ল । কিন্তু অমুক সিনিয়র ক্যাডেট ডেকেছেন বলাতে ওকে সবাই ছেড়ে ছিল। শেষে এক সিনিয়রের হাতে আটকা পড়ল সে। তিনি মহা নাছোড়বান্দা! জানতে চাইলেন অমুক সিনিয়র কেন ডেকেছেন? জবাবটা ওর মুখ থেকে ফস্ করে বেরিয়ে এল, ওঁর হাত দেখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র সাহেব আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, ইউ নো পামিস্ট্রি? ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সিনিয়র সাহেব আবার বললেন, তা আমার হাত দেখছ কখন? একটু বিজ্ঞের মত চিন্তা করে আনোয়ার বলল, আফটার ডিনার, স্যার। পাঠক! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সেদিন নিজের সুন্দর অভিনয়ের জন্য সে নিজেই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। শুরু হলো ওর হাত দেখার পালা।
দলে দলে সিনিয়র ক্যাডেটরা আনোয়ারের কাছে ভিড় জমায়। আর সে পাকা গণকের মত প্রত্যেকের হাতের তালু টিপে উল্টেপাল্টে, বিভিন্ন কাল্পনিক রেখা টেনে হাত দেখে। তাতে কেউ হলো ব্রিগেডিয়ার, কেউ হলো মেজর জেনারেল, কেউ হলো লে. জেনারেল, কেউ যুদ্ধে পদক প্রাপ্ত, আবার কেউবা হলো বিদেশী কোর্সে মনোনীত। প্রত্যেককে শেষে অবশ্য একথাও বলে দিল যে বর্তমান হস্তরেখাতে তাদের এই চিহ্ন রয়েছে। ভবিষ্যতের গ্রহ নক্ষত্রের স্থান পরিবর্তনের ফলে এবং কর্মফলের কারণেও তাদের এইসব ভাগ্য রেখার পরিবর্তন ঘটতে পারে।
আনোয়ার একজন গায়ক, আনোয়ার একজন হস্তরেখাবিদ। সর্বোপরি সে ভীষণ কৌতুকপ্রিয়। এখন পি.এম.এ.-তে আনোয়ার একটি জনপ্রিয় নাম। আনন্দের আতিশয্যে একদিন তো সে পি.এম.এ.-র কঠিন নিয়ম-কানুনও ভুলতে বসেছিল। সেদিন ও খেলার মাঠ থেকে সোজা একদৌড়ে ক্যাফেটেরিয়ায় হাজির। অথচ প্রথম দুই মাস নতুন ক্যাডেটদের জন্যে ক্যাফেটেরিয়াতে যাওয়া নিষেধ। ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকেই দেখা হয়ে গেল সেই সিনিয়র বাঙালী ক্যাডেটের সঙ্গে। আনোয়ারকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন। কাছে ডেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কেন এসেছ? চুপসে গিয়ে আনোয়ার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি আবার বললেন, এসেই যখন পড়েছ, তখন চুপচাপ আমার পাশে বসে পড়ো।
একটু পরেই পেছন থেকে চাপা গর্জন শোনা গেল, হোয়াই আর ইউ হিয়ার? ঘাড় না ফিরিয়েই আনোয়ার বুঝতে পারল বি.এস.এম. স্বয়ং। ভয়ে জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর। নিজের বোকামির জন্য চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। ভয়ঙ্কর শাস্তি আসন্ন। ওর সঙ্গের সিনিয়র ক্যাডেট দ্রুত বলে উঠলেন, স্যার, আই হ্যাভ ব্রট হিম হিয়ার। বি.এস.এম. তখন কিছু না বলে ঘুরতে ঘুরতে ক্যাফেটেরিয়ার অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। ক্যাফেটেরিয়ায় খুব ভীড়। খালি চেয়ার না পেয়ে বি.এস.এম. আবার ফিরে এলেন। একমাত্র আনোয়ারের পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। বি.এস.এম. অনুমতি নিয়ে খালি চেয়ারটায় বসে ওকে লক্ষ করে বললেন, খাবারের অর্ডার দিয়েছ? আনোয়ার বলল, না, স্যার। বি.এস.এম. ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য কিছু অর্ডার দিলেন এবং আনোয়ারকে বললেন, যা খাবে ওয়েটারকে বলো, আমি বিল পে করব। জেনে রেখো, পি.এম.এ.-তে সব সময় সিনিয়ররা বিল পে করে থাকে। ওর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল । মনে মনে বলল, দাঁড়াও বি.এস.এম. বাবাজী, বহুদিন পর সুযোগ পেয়েছি। ওয়েটারকে বড় দুই প্লেট শিক কাবাব, চিকেন টিক্কা আর বেশ কিছু মিষ্টি দিতে বলল। অর্ডার দেয়ার ধরন দেখে বি.এস.এম. আড়চোখে কটমট করে তাকালেন আনোয়ারের দিকে। খাওয়া শেষে ও পর পর দুকাপ কফি শেষ করে বি.এস.এম.-কে বলল, স্যার, আমি কি উঠতে পারি-স্টাডি পিরিয়ডের সময় হয়ে এসেছে। বি.এস.এম.-এর সংক্ষিপ্ত উত্তর: পুশ অফ। আনোয়ার ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে কামরায় হাজির।
এরপর থেকে পি.এম.এ.-তে পুরোমাত্রায় ট্রেনিং ও ক্লাস শুরু হলো। তোর ছয়টা থেকে পরবর্তী চল্লিশ মিনিট পিটি। তারপর ব্রেকফাস্টের বিরতি। সাড়ে সাতটা থেকে আবার ড্রিল। প্রত্যেকটা পিরিয়ড চল্লিশ মিনিটের জন্য। প্রতি পিরিয়ডের মাঝে আবার দশ মিনিট বিরতি। ক্লাসে প্রথম দিন ইন্সট্রাকটর এসে বিভিন্ন সাবজেক্ট যেমন–ট্যাকটিকস, অ্যাডমিনিসট্রেশনের লজিস্টিকস, অর্গানাইজেশন অভ আর্মি, অ্যাকাউন্টিং প্রভৃতি বিষয়ে প্রেসিজ সরবরাহ করলেন। বেলা এগারোটার সময় টি ব্রেক।
কিছুদিন পর নবাগত ক্যাডেটদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য পি.এম.এ.-র বাইরে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। ইতোমধ্যে তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শেষে শুরু হলো অস্ত্র প্রশিক্ষণ। এই দায়িত্বে ছিলেন তদানীন্তন বাঙালী ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ (পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হন এবং ১৯৭৫ সালে সিপাহী বিপ্লবে নিহত হন)। কিন্তু গুলি চালনায় আনোয়ার মোটেও ভাল করতে পারছে না। একদিন খালেদ মোশাররফ ওকে কাছে ডেকে চাপা গলায় বেশ বকাবকি করলেন। তারপর থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে গুলি চালানোতে ওর দক্ষতা বেড়ে গেল। চাকুরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ও ছিল একজন দক্ষ মার্কসম্যান। একটা চাইনিজ সাব-মেশিনগান ও প্রয়োজন মত গুলি থাকলে যে-কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা ওর জন্য অত্যন্ত সহজ ছিল। মাঝেমাঝে সাব-মেশিনগানটাকে আদর করে চুমু খেয়ে ও বলত, শাবাশ দোস্ত, কাজের সময় যেন বিগড়ে না যাস।
পি.এম.এ.-তে সবচেয়ে ভীতিকর ছিল ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট ফায়ারিং। কাঁধের ওপর রকেট লঞ্চার রেখে লক্ষ্যস্থির করতে হত। ল্যঞ্চারের ওপর গাল ঠেকিয়ে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজ কানে বাড়ি খেত। তারপর দীর্ঘদিন কানের ভিতর ভোঁ-ও-ও-ও-ও, ভোঁ-ও-ও-ও-ও আওয়াজ হত । মহড়ার সময় সবচেয়ে দুর্লভ ছিল বিশ্রাম । দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আশ্রয় নেবার জন্য বিভুয়োক বা দুইজনের শোবার উপযোগী মাটি থেকে ফুট তিনেক উঁচু ছোট তাঁবু সরবরাহ করা হত। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে বিভুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। পাহাড়ী ঢালে বিভুয়োকে অবস্থানকালীন রাতে বৃষ্টি এলে সবাই ভিজে চুপচুপে হয়ে যেত। তখন সবাই শীতে কাঁপতে কাঁপতে, বৃষ্টিকে অকথ্য গালি গালাজ করতে করতে পার করে দিত বাকি রাতটুকু।
পি.এম.এ.-তে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের নাম কেয়াদৎ। এই প্রশিক্ষণ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে চলত। ক্রমাগত সাতদিন প্রত্যেককে প্রায় সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হত পায়ের ওপর। তাই নবাগত ক্যাডেটরা প্রশিক্ষণ শেষে এই মহড়ার নাম দিল কেয়ামত। এই কেয়াদৎ বা কেয়ামতের সময় ব্রেকফাস্ট, হ্যাঁভারস্যাক লাঞ্চ, ডিনার ইত্যাদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেত ওরা। পানির অভাবে মাঝে মাঝে গর্তে জমে থাকা পানির মধ্যকার ব্যাঙ সরিয়ে সেই পানি খেতে হত ওদের। কেয়াদৎ নামধারী কেয়ামত, থেকে পি.এম.এ.-তে ফেরৎ আসার পর শুরু হলো চূড়ান্ত ভাবে লিখিত, শারীরিক, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি চালনার পরীক্ষা । প্রতিটি পরীক্ষাতে আনোয়ার ভাল করল এবং সেইসঙ্গে পি.এম.এ.-কে বিদায় জানানোর সময় এগিয়ে এল।
শুরু হলো পাসিং আউট প্যারেড রিহার্সেল। এই পাসিং আউট প্যারেডের স্যালুট গ্রহণ করে থাকেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে স্যালুট গ্রহণ করেন প্রধান সেনাপতি। এই পাসিং আউট প্যারেডের জন্য প্রত্যেক ক্যাডেটকে কঠোরভাবে অনুশীলন নিতে হয়। ক্রমাগত কয়েকদিন কঠোর অনুশীলনের পর এগিয়ে এল আনোয়ারের সৈনিক জীবনের স্মরণীয় দিন; যেদিনটি প্রতিটি সামরিক অফিসার যে-কোন অবস্থাতে অতি সহজেই স্মরণ করতে পারে।
১৯৬৬ সালের পহেলা জুলাই। পাসিং আউট প্যারেড। পি.এম.এ. নববধূর সাজে সজ্জিতা। বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ প্যাণ্ডেলের নিচে বহু বিদেশী কূটনীতিক, সাংবাদিক, উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ও তাদের পত্নী, বহু যুবতী ও কয়েক হাজার অভ্যাগতের ভীড়। প্যারেড শুরু হলো। নবাগত ক্যাডেটরা ব্যাণ্ডের তালে তালে সারিবদ্ধ ভাবে প্যারেড করতে করতে প্রবেশ করল ড্রিল গ্রাউণ্ডে। প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুসা দাঁড়ালেন ডায়াসে। জেনারেল মুসাকে জেনারেল স্যালুট দিল ক্যাডেটরা। এরপর শুরু হলো নবাগত ক্যাডেটদের শপথ গ্রহণ। শপথ গ্রহণের পালা শেষ হবার পর পি.এম.এ. কালার প্রদান করা হলো। ড্রিল গ্রাউণ্ডের এক প্রান্ত গ্যালারির মত উঁচু হয়ে আবার ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এবার ব্যাণ্ডের তালে তালে সবাই এগিয়ে গেল সেই গ্যালারির দিকে। ক্রমশ উঁচু হয়ে যাওয়া গ্যালারি বেয়ে ওরা নিচের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই একদৃষ্টে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটা উপভোগ করল। সেইসঙ্গে শেষ হলো আনোয়ারের ক্যাডেট জীবন। বহু সুখ ও দুঃখের স্মৃতিতে ভরা পি.এম.এ.-কে ও সত্যিই ভালবেসে ফেলেছিল।
.