হেল কমাণ্ডো – ১৭

১৭.

ফালাক শের। তেইশ হাজার ফুট উঁচু একটি বরফের চূড়া অভিযাত্রী দলের এবারের গন্তব্যস্থল। ম্যাপ অনুযায়ী উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রিলাইন। তারপর কোন গাছপালা নেই। শুরু হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত বরফ। কমাণ্ডার আনোয়ারের নেতৃত্বে এগিয়ে চলল অভিযাত্রী দল। আবহাওয়া পরিষ্কার নয়। যে-কোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। মাঝারি আকারের তুষার ঝড় বইছে। ওরা এগিয়ে চলল ঝড় উপেক্ষা করে। সারাদিন ধরে চলল ক্লাইম্বিং। বিকেলের দিকে কমাণ্ডারের নজরে পড়ল ঘন পল্লবিত ফার গাছের নিচে একটি মাটির ঘর । আনোয়ার নির্দেশ দিল, হল্ট।

পর্বতবাসী স্কাউটরা জানাল, এধরনের মাটির ঘর ট্রিলাইন অর্থাৎ উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত পাওয়া যাবে। এর আগে যারা ক্লাইম্বিং করেছে এপথে, ঘরগুলো তাদেরই পরিত্যক্ত। ওরা আরও জানাল, স্নো টেন্টের চাইতে মাটির ঘর অনেক বেশি আরামদায়ক। আনোয়ার স্থির করল সে আজ এই ঘরে ঘুমাবে।

ওপরে তুষারে ছাওয়া গাছের ছাউনি। দরজার একপাশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনতিদূরে জে.সি.ও. কবির, জানস খান, শেরদিল ও আসলাম খানের স্নো টেন্ট। কবির জানাল, স্যার, ডিনার রেডি। একটা পাইন গাছের নিচে বিশাল আগুনের কুণ্ডলী জ্বেলেছে ওরা শুকনো ডালপালা দিয়ে। জ্বলন্ত, কুণ্ডলীর চারপাশ ঘিরে বসল সবাই। দুম্বার মাংসের রোস্ট, গরম পরোটা, সঙ্গে স্কচ্ হুইস্কি, ফলের রস ও কফি। শেষ হলো ডিনার সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে কমাণ্ডার প্রবেশ করল মাটির ঘরে ।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। অবিরাম স্নো ফল হচ্ছে। আনোয়ারের মনে হলো, এই পরিবেশে মাটির ঘর পৃথিবীর যে কোন বিলাসবহুল প্রথম শ্রেণীর হোটেলের কামরার সমান। ভিতরে সুন্দর আরামদায়ক উষ্ণতা। ডবল পিপিং ব্যাগের নরম বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল কমাণ্ডার।

পাঁচদিন অতিক্রান্ত হলো। ষোলো হাজার ফুট উচ্চতায় ওরা। তুষার ঝড় লেগেই আছে–কখনও আবার তীব্র আকার ধারণ করছে। সামনের পথ আরও দুর্গম। প্রতি রাতে আনোয়ার পরম আবেশে ঘুমায় মাটির তৈরি ঘরে। একদিন রাতে স্নো-বেয়ারের চাপা গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল ওর। সারা ক্যাম্প এলাকায় শুরু হয়েছে হৈ চৈ। সবাই জেগে উঠেছে তুষার ভল্লুকের ক্রুদ্ধ গর্জনে।

স্যার কি জেগে আছেন? দরজার পাশে জানস খানের গলা শুনতে পেল আনোয়ার।

কিসের যেন গর্জন শুনতে পেলাম, খান?

তুষার ভল্লুক, স্যার।

আনোয়ার দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে। জানস খান দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান-লোডেড। সেদিন বাকি রাতটুকু ওরা জেগেই কাটিয়ে দিল। পরদিন সকালে আবার শুরু হলো যাত্রা।

ট্রি-লাইন পার হয়ে গেল। এখনও চার হাজার ফুট দূরে ফালাক শের। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। নেই কোন গাছপালা, নেই কোন জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব। এগিয়ে চলেছে চল্লিশজন অভিযাত্রী। প্রত্যেকেই সুঠামদেহী অকুতোভয়। তেইশ হাজার ফুট অতিক্রম করার পর কমাণ্ডার পুনরায় নির্দেশ দিল, হল্ট।

গভীর রাত। স্নো টেন্টের মাঝে সবাই নিদ্রায় মগ্ন। আনোয়ার ঘুমাচ্ছে একটি ইগলুতে। ঠিক এই সময় ঘুম ভেঙে গেল ওর। বাইরে নারী কণ্ঠের উচ্চস্বরের হাসি। নিশুতি প্রকৃতি জেগে উঠল যেন–একটানা শোনা যাচ্ছে হাসি। আনোয়ার দেখতে চাইল, কে এই নারী? কেন হাসছে গভীর রাতে এই দুর্গম এলাকায়? ও বেরিয়ে এল বাইরে। আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। কোমল আলোয় মুক্তোর মত টলটল করছে তুষার। ফুরফুরে বাতাসে সারা তুষাররাজ্য আন্দোলিত। বহুদূর দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। থেমে গেছে হাসি। কিন্তু কোথায় সেই নারী? কিছুই নজরে পড়ল না। কমাণ্ডার সম্মোহিতের মত চেয়ে আছে। স্থির অবিচল। ধীরে ধীরে ওর মনের প্রান্তে জেগে উঠল বহু দিনের পুরানো সেই স্মৃতি। মনে পড়ল সেই কথা, যা ও মনের নিভৃতে লালন করেছে সবার গোচরে।

আনোয়ার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারাদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার। মিছিল, মীটিং লেগেই আছে। দি ব্যালাড অফ এ সোলজার ছবিটি চলছিল ঢাকার একটি প্রেক্ষাগৃহে। ছবি শেষে বাইরে বের হতেই ও হতবাক! সারা ঢাকা শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের।ওরা হল ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। সারা শহর থমথমে। আর মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি। তারপর বাইরে থাকা চলবে না।

উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে চলেছে আনোয়ার একটি আশ্রয়ের সন্ধানে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সাতটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। তীব্র হুইসেল বাজিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি। আনোয়ার সম্মুখে একটি বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে পড়ল। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলল একটি মেয়ে।

বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই? প্রশ্ন করল সে মেয়েটিকে।

জ্বি-না!

আনোয়ারের মুখটা করুণ হয়ে উঠল। আর কিছু না বলে ও আবার ফিরে চলল রাস্তার দিকে।

শুনুন! পেছন থেকে মেয়েটির ডাক শুনতে পেল সে। কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করল মেয়েটি, কি ব্যাপার? আপনি তো কিছু বললেন না।

না, মানে পুরুষ মানুষ যখন নেই…

তাতে কি। বলুন।

আনোয়ার নিশ্চুপ।

মেয়েটি আবার বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সারা শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে।

 হ্যাঁ–সেজন্যই তো… আনোয়ার বলতে বলতে থেমে গেল। বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই। ও কি করে বলবে, আমাকে রাতটা এখানে থাকতে দিন।

আপনি ভিতরে আসুন।

মেয়েটি আনোয়ারকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল ।

আপনি মনে হয় কারফিউয়ের জন্য বিপদে পড়েছেন। তাই না? পুনরায় জানতে চাইল মেয়েটি । আনোয়ার প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল তখন। সব শুনে মেয়েটি বলল, আপনি তো আচ্ছা লোক। এত বড় বিপদে কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলেন?

না মানে… আনোয়ারের দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠ ।

আর মানে মানে করতে হবে না। আজ রাতটা এখানেই থাকবেন।

আনোয়ার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ।

আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি। বলে মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আনোয়ার চিন্তা করছে হলের অবস্থা। ওর যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে রূমে। ক্যাম্পাস এলাকায় নাকি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কে জানে, এখন ক্যাম্পাস এলাকার প্রকৃত অবস্থা কি? তাছাড়া আহসান, সাজেদ, নাজমুল সবাই হলে ছিল। ওরা কোন বিপদে পড়েনি তো? মেয়েটি প্লেটে কিছু ফলমূল ও মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকল, সবাই দেশের বাড়িতে বেড়াতে গেছে । বাড়িতে শুধু আমি, ছোট বোন ও চাকরাণী। আর কেউ নেই। নিন শুরু করুন-ততক্ষণ আমি রান্নাটা দেখি গিয়ে।

ঠিক আছে।

সরি। আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি। মেয়েটি ফিরে এল দরজার কাছ থেকে।

আনোয়ার।

ওয়াহিদা। বেরিয়ে গেল ও।

পরদিন সকাল। আনোয়ার বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল। ওয়াহিদা রেখে দিল আনোয়ারের ঠিকানা। তারপর প্রায়ই দেখা হত ওদের দুজনের। কত ঘটনা, কত স্মৃতি-আজও মনে পড়ে ওর। কাকুলে আসার আগের দিন আনোয়ার বিদায় নিতে গিয়েছিল ওয়াহিদার কাছে। সেদিন প্রায় সারারাত ওকে আটকে রেখেছিল ওয়াহিদা। ভোরের দিকে আনোয়ার ডাকল, ওয়াহিদা।

উঁ।

এবারে যেতে দাও।

আর একটু থাকো।

নেমে এল দুজনের মাঝে নীরবতা। একে অপরের দিকে চেয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে। কি মধুর স্বপ্নই না ছিল, সেদিনের সেই দৃষ্টিতে। আনোয়ার তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের একজন অফিসার। এবার অনেকদিন পর দেখা হলো ওদের। দুজনের মাঝে গভীর প্রণয়-ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

তুমি আমাকে প্রেম শেখালে, ওয়াহিদা। আনোয়ার বলল।

সেটা কি আমার অন্যায় হয়েছে? চোখ তুলে জানতে চাইল ও।

না, তা বলছি না। তবে…

কি তবে?

আমি একজন সৈনিক।

হ্যাঁ।

তাই বলছিলাম–আমার কাছে নারীর প্রেমের চেয়ে দেশপ্রেম অনেক বেশি বড়।

মানে… কি বলতে চাও তুমি? ওয়াহিদার বিচলিত কণ্ঠ।

ভয় পেয়ো না। এবার ফিরে এসেই…

কি?

তোমাকে বিয়ে করব। রাজি?

রাজি।

তারপর হেসে উঠল দুজন একসঙ্গে। বিদায়ের দিন। ঢাকা বিমান বন্দরের লাউঞ্জে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ

ওয়াহিদা প্রশ্ন করল, প্রেম জীবনকে কি দেয়?

প্রেম জীবনকে মহৎ করে। প্রেম জীবনে পূর্ণতা এনে দেয়। প্রেম জীবনকে আত্মকেন্দ্রিকও করে তোলে।

দেশপ্রেম?

দেশপ্রেম মানুষকে ত্যাগের আনন্দ জোগায়। উৎসর্গের প্রেরণা দেয়। ঘোষক মাইকে অনুরোধ জানাল, প্রত্যেক যাত্রীকে বিমানে আসন গ্রহণের জন্য। আনোয়ার বলল, আমি এস, এস, জি.-তে যোগ দিয়েছি।

এস. এস. জি.?

আমাকে কমাণ্ডো কোর্স করতে হবে।

কমাণ্ডো?

ভয়ের কিছু নেই। এটা তুমি কারও কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে। আনোয়ার ওর মুখের দিকে চেয়ে শেষে বলল, তুমি ভাল থেকো, ওয়াহিদা।

তুমিও।

খোদা হাফেজ।

খোদা হাফেজ। আনোয়ার এগিয়ে গেল প্লেনের গ্যাংওয়ের দিকে। গ্যাংওয়েতে দাঁড়িয়ে ও শেষবারের মত ওয়াহিদাকে বিদায় জানাল হাত নেড়ে। প্লেন হারিয়ে গেল দূর আকাশে। কিছুদিন পর একটি চিঠি পেল আনোয়ার। চিঠিতে লেখা…,

দি রিয়েল সোলজার,

এটাই আমার শেষ পত্র। দেশপ্রেম সত্যিই যদি তোমাকে ত্যাগের আনন্দ জুগিয়ে থাকে, উৎসর্গের প্রেরণা দিয়ে থাকে, তবে তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। মনে কোরো, আমিও তোমাকে ভুলে গেছি। ক্ষমা করে দিয়ো।

ইতি–

ওয়াহিদা।

এর কিছুদিন পর আনোয়ার শুনতে পেল, ওয়াহিদার বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখন অন্যের ঘরণী। কথাটা মনে হলে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে গোপন একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস।

অল রাইট ওয়াহিদা। তোমাকে ভুলতে পারব কিনা জানি না। তবে আমি কমাণ্ডো কোর্স করবই।

আনোয়ার ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ইগলুতে। পরদিন আর ক্লাইম্বিং করা গেল না। সামনে তুষার অত্যন্ত নরম। ওদের কারও কারও প্রায় গলা পর্যন্ত পুঁতে গেল তুষারের মধ্যে। অদূরে ফালাকশের দেখা যাচ্ছে। আনোয়ার নির্দেশ দিল, গো ব্যাক টু দি প্যাভেলিয়ন। অভিযাত্রীদল আবার ফিরে এল তেইশ হাজার ফুট নিচে, রেস্ট হাউজে।

.

স্নো ওয়ারফয়ার প্রায় শেষ। হঠাৎ করে নির্দেশ এল চেরাট ক্যান্টনমেন্ট থেকে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সবাইকে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছুতে হবে। কালাম উপত্যকায় ব্যস্ততার সাড়া পড়ে গেল। অ্যান্টি স্কিড চেইন সংযুক্ত কনভয় এগিয়ে চলল চেরাট অভিমুখে । সোয়াতের মাঝামাঝি পৌঁছনোর পর আনোয়ারের মনে পড়ল নূরীকে। ওকে বলা হয়নি। হয়তো আর কোনদিন দেখাও হবে না পর্বতবাসিনী নূরীর সঙ্গে। চারদিকে সোয়াতের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, সূর্যের সোনালী কিরণ। ফার ও পাইনের সারি । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শ্যামল প্রান্তর। ধবল স্রোতস্বিনীর বুকে মলয় তুলেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ। ওখানেই যেন চঞ্চল নূরী হারিয়ে গেছে। আনমনা আনোয়ার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মালাকান পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে এগিয়ে চলল কনভয়।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। রাওয়ালপিণ্ডির একটা প্রেক্ষাগৃহে দুজন অফিসারসহ আনোয়ার ছবি দেখছে। হঠাৎ ছবি দেখানো বন্ধ হয়ে গেল। লাউডস্পীকারে ধ্বনিত হলো, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ-এর মেজর আনোয়ার যদি হলের অভ্যন্তরে থাকেন, তবে তাঁকে দয়া করে চেরাট ক্যান্টনমেন্টে কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে অবিলম্বে রিপোর্ট করতে বলা হচ্ছে। সেদিন এধরনের ঘটনা পিণ্ডির প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে ঘটেছিল। ছবি দেখা বাদ দিয়ে আনোয়ার ছুটল ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে।

ড্রয়িংরূমে ঢুকতেই আনোয়ার দেখতে পেল, কমাণ্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আগা আকরাম রাজা পায়চারি করছেন। চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব। নাইট গাউনের ফিতা খোলা; অবিন্যস্ত চুল। টেবিলের ওপর কনিয়াকের বোতল। মৃদুস্বরে বললেন সি.ও. সিট ডাউন, আনোয়ার। ড্রয়িংরূমে পিন পতন নিস্তব্ধতা। দুজন বসে রয়েছে মুখোমুখি। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন আগা আকরাম রাজা, ব্যাপারটা টপ সিক্রেট। এইটুকু বলেই থেমে গেলেন তিনি। কি ব্যাপার? এ ধরনের ভূমিকা করে কখনও তো কথা বলেননি কমাণ্ডিং অফিসার। সন্দেহে দুলে উঠল আনোয়ারের মন ।

পুনরায় শোনা গেল সি.ও.-র কণ্ঠ, আমি একটা অর্ডার দেব । সেটা তোমার কাছে অন্যায় মনে হতে পারে। অ্যাণ্ড ইফ সো, তাহলে কি তুমি সেটা ক্যারি আউট করবে?

স্যার, আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, হোয়াট হ্যাজ টু বী ডান। কণ্ঠস্বরে মনে হলো আনোয়ার যেন বাণবিদ্ধ বাঘ। গমগম করে উঠল ড্রয়িংরূম। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন রাজা, আমাকে ভুল বুঝো না। এটা হাই অফিশিয়াল অর্ডার। ওকে, লেট মি থিংক এ কাপল অফ ডেজ মোর। আজ থাক, দুদিন পরেই তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করব । এসো, আনোয়ার।

ড্রয়িংরূম ছেড়ে বেরিয়ে এল আনোয়ার। সে বুঝে ফেলেছে হাই অফিশিয়াল অর্ডার। ওরা ওকে বাংলাদেশে পাঠাতে চায়– বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আনোয়ার সিদ্ধান্ত নিল, পালাতে হবে, যে করেই হোক। এরপর অনেক বাঙালী অফিসারদের (তাদের অনেকেই এখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত) সঙ্গে পালানোর ব্যাপারে সে গোপনে পরামর্শ শুরু করে। কিন্তু মিশন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগেই ওদেরকে বন্দী করা হলো। বন্দী অবস্থা থেকেও অনেক বাঙালী অফিসার পালিয়ে গেল ভারতে। ফলে কড়াকড়ি আরও বেড়ে গেল। বন্দীদের একজায়গায় বেশিদিন রাখা হত না। চেরাট, আটক, সাগাই, কোহাট, হরপপ্তা, ঘাজুরি প্রভৃতি ফোর্টে ওদেরকে বিছিন্ন অবস্থায় কড়া প্রহরাধীন রাখা শুরু হলো। তবুও আনোয়ার, সস্ত্রীক মেজর আবু তাহের (নিহত কর্নেল তাহের), মেজর মঞ্জুর (নিহত মেজর জেনারেল), ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীসহ বেশ কয়েকজন অফিসার সিদ্ধান্ত নিলেন পালানোর। দুর্ভাগ্যবশত আনোয়ার শেষ মুহূর্তে মূল দলে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়। পালিয়ে গেলেন মেজর মঞ্জুর ও তাহেরসহ দলের অন্যান্য সবাই। হতাশায় ছেয়ে গেল আনোয়ারের মন। মেজর তাহের ও মেজর মঞ্জুর দুজনেই ছিলেন পাক সেনাবাহিনীর জন্য ভীতির কারণ। পশ্চিমা কর্তৃপক্ষের সতর্কতা বেড়ে গেল চতুগুণ। আনোয়ারের জন্য সশস্ত্র সেন্ট্রির সংখ্যা বাড়ানো হলো। কিছুদিন পর একটি চিঠি পেল আনোয়ার। ইনিশিয়াল দেখেই চিনতে পারল মেজর তাহেরের লেখা। পালানোর ইংগিত অত্যন্ত কৌশলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও পালানোর সুযোগ মেলেনি আনোয়ারের। শেষ হলো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নিল বাঙালীদের বহু আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ । অবসান ঘটল শতাব্দীর কান্না বিজড়িত ইতিহাসের।

১৯৭৪ সাল। করাচী পোর্ট। একটি রুশ জাহাজে বাঙালী বন্দীদের শেষ ব্যাচটি উঠল। আনোয়ারের মনে মিশ্র অনুভূতি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা । আনোয়ার জাহাজের খোেলা ডেকে বসে রয়েছে। বিশাল বঙ্গোপসাগরের বুকে ছোট্ট খেলনার মত এগিয়ে চলেছে জাহাজখানা। মেঘমুক্ত নীলাকাশ। কূল নজরে পড়ে না। এলোমেলো বাতাস অতীতস্মৃতি রোমন্থন করতে মনকে নীরবে দোলা দিচ্ছে। মনে পড়ল লে. কর্নেল জাকির হোসেনের সেই উক্তি, আনোয়ার, তুমি জীবন নিয়ে এত রসিকতা করো কেন? জীবনটাই যদি শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে একটা বিরাট রসিকতা করে যায়? এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আনোয়ারের ঠোঁটে। এ হাসির যে কি অর্থ, তা মনে হয় একমাত্র ঈশ্বর-ই জানেন। পেন্সিল পিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় কয়েকটা আঁচড় দিতেই হঠাৎ ওয়াহিদাকে মনে পড়ল। তারপর একটা চিঠি লেখা শুরু করল আনোয়ার।

ওয়াহিদা,

এটা আমারও শেষ পত্র। এই কথাগুলো তোমাকে বলা প্রয়োজন। আমাদের অতীত বিশ্লেষণে তুমি যদি কারও কাছে ঘৃণ্য হও, সেটা আমার জন্য দুঃখজনক। মিথ্যে বলে নিজের অহমিকা প্রকাশ করতে আমি চাইনে। আজ আমার অখণ্ড অবসর। আজ আমি সত্যিই লোন রেঞ্জার, নিঃসঙ্গ। আমি ভুলতে পারি না আমার অতীতকে। ওকে আমি ভীষণভাবে ভালবাসি। কখনও সুখে, কখনও দুঃখে। কারণ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন তার প্রথম প্রণয় ভুলতে পারেনি।

মানুষ জন্মগতসূত্রে শান্তিবাদী। কেউ শান্তি চায় রাইফেলের ব্যারেলের মাধ্যমে, কেউ চায় তার অঢেল সম্পদ রক্ষার্থে, কেউ শান্তির জন্য রাজনৈতিক কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, কেউ শান্তি চায় অর্থের বিনিময়ে, আর কেউ কাউকে পরিত্যাগ করে। তুমি শান্তির অন্বেষায় চলেছ আমাকে পরিত্যাগ করে। আমার প্রার্থনা, তুমি সুখী হও।

জানো ওয়াহিদা, আমিও শান্তি চাই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আত্মিক, নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন আমারও কাম্য। আমার এ চাওয়া ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের শৃংখলমুক্ত। এভাবে ভাবতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। কারণ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে আমরা সবাই সমান ।

ওয়াহিদা, তুমি আর আমি কখনও হেঁটে যাব না স্বপ্নের সেই নীল বালুচরে। আর বিদায় জানানো হবে না অস্তগামী সূর্যকে। আর দেখা হবে না সাগর সৈকতের নরম বালিতে ভেঙে পড়া কোমল ঢেউগুলো। তোমার আর আমার মাঝে আজ কি দুস্তর ব্যবধান! এমনতো কথা ছিল না।

তুমি নও; তোমার দেয়া টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো আমার অনুপ্রেরণার উৎস। ওগুলো আমাকে পরম আনন্দে উৎফুল্ল করে, আবার কখনও অতি দুঃখে অশ্রু ঝরায়। বিদায়।

ইতি–

আনোয়ার।

আনোয়ার জাহাজের খোলা ডেকে বসে লিখল পত্রটি। তারপর ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে, ভাসিয়ে দিল বঙ্গোপসাগরের জলে। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ছিন্নপত্র হারিয়ে গেল গভীর জলের অন্তরালে। ক্রমেই চিটাগাং পোর্টের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আনোয়ার তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশির দিকে। ওখানেই যেন লুকিয়ে আছে ওর সুদূর অতীতের একটুকরো, মাতাল স্মৃতি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *