হেল কমাণ্ডো – ১৬

১৬.

স্লোয়ারফেয়ার। তুষারের দেশে শুরু হবে যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার জীপ নিয়ে চলেছে কালাম উপত্যকায়। এবারে লোক সংখ্যা দেড়শো । সঙ্গে রয়েছে দুমাসের উপযোগী রেশন। প্রথমে নওশেরা, তারপর রিসালপুর অতিক্রম করল ওদের ছোট্ট কনভয়। মালাকান থেকে শুরু হলো চড়াই উত্রাই।

কোথাও মসৃণ পীচঢালা পথ ঢালু হয়ে গভীরে নেমে গেছে। আবার কোথাও উঁচু তুষারাবৃত পাহাড় অতিক্রম করে গেছে। রাস্তার একপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। ঢালে সবুজ ফার ও পাইন গাছ বরফ আচ্ছাদিত, শুভ্র। অপরপাশে পাহাড়ী স্রোতস্বিনী। তিরিশ-চল্লিশ ফুট চওড়া, অগভীর। রূপালী চকচকে পাঁনি। স্রোতস্বিনীর প্রান্ত ঘেঁষে সবুজ খেত। খেতের কোল জুড়ে বিশাল উঁচু পর্বত-তুষারময়। অধিকাংশ জায়গায় স্রোতস্বিনীর জল ও রাস্তার উচ্চতা প্রায় সমান। এই সমতা অদ্ভুত বৈচিত্র্যময়। মনে হচ্ছে ওদের কনভয় স্রোতস্বিনীর জলের ওপর দিয়ে ভেসে, চলেছে।

সোয়াত। শু্যটিং স্পট। বহু পাকিস্তানী ছায়াছবির বহিদৃশ্যাবলী এখান থেকে গৃহীত হয়। বরফাচ্ছাদিত উঁচু পর্বত, মসৃণ পীচঢালা পথ, অগভীর পাহাড়ী নালা, সবুজ খেত–অপূর্ব! এখানেও পর্বতের ঢালে ফার ও পাইন গাছ কোমল বরফে জড়ানো। সারা প্রকৃতি জুড়ে এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসি। আনোয়ার মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দুচোখ ভরে দেখছে সোয়াতের অপরূপ সৌন্দর্য। এখান থেকে শুরু হলো স্রোতস্বিনীর ওপর চমৎকার সব কংক্রিটের ব্রিজ একের পর এক। রাস্তা বাঁক ঘুরে ব্রিজের ওপর দিয়ে ওপারে গিয়েছে। আবার সম্মুখের ব্রিজ ঘুরে এপারে এসেছে।

ওদের কনভয় এঁকেবেঁকে সোয়াত অতিক্রম করল। সোয়াত পার হয়ে ওদের প্রতিটি গাড়ির চাকার সঙ্গে অ্যান্টি স্কিড চেইন লাগানো হলো, যাতে কোন গাড়ির চাকা স্কিড় করে গভীর খাদে পড়ে না যায়। ওদের কনভয় অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। ভীষণ পিচ্ছিল রাস্তা, দুর্গম। রাস্তার একপাশে গভীর খাদ। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ। ছোট্ট কনভয়টি পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে।

কালাম উপত্যকা। গ্রীষ্মকালীন নিবাস। সী-লেভেল থেকে আট হাজার ফুট উঁচুতে। চারদিকে বরফাচ্ছাদিত পর্বত। পনেরো ষোলো হাজার ফুট উঁচু। পাইন গাছের লম্বা সারি এই পর্বতের ঢাল জুড়ে। গাছগুলোর সবুজ দেহ কোমল তুষারে জড়ানো। ছোট ছোট দুই-একটা মাটির বাংলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে। উপত্যকার একপ্রান্ত তিরিশ-চল্লিশ ফুট ঢালু। এই ঢালু প্রান্তের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে একটা খরস্রোতা পাহাড়ী নালা। স্বচ্ছ জলের নালাটি পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু রূপালী ট্রাউট মাছে ভর্তি । উপত্যকার ওপর তিনটে রেস্ট হাউজ, ইউরোপীয়ান ফিটিংস-এ সাজানো। প্রতিটি ঘরের ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন। সৈনিকরা রেস্ট হাউজের, অদূরে একটি স্কুল বিল্ডিংয়ে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করল। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার রইল রেস্ট হাউজে।

পরদিন সকাল । আরজুমান্দ মালেক ও আনোয়ার বেড়াতে বের হলো। ওদের পরনে গরম পোশাক, ও, পায়ে স্নো বুট। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ফার ও পাইন গাছে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে। সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুষ্ট ছেলের মত কৌন হ্যায়, কৌন হ্যায়, করে চিৎকার করতেই দরজা খুলে গেল। সেখানে দাঁড়ানো একটি যুবতী। পরিচ্ছন্ন সালোয়ার কামিজ পরিহিতা। অপূর্ব সুন্দরী। চমকে উঠল-মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে ওরা! ভাল করে দেখতেই ওদের ভুল ভেঙে গেল। লিজ টেলর নয়। তবে লিজের হুবহু প্রতিকৃতি। মেয়েটির মুখে স্মিত হাসি।

ওরা দুজন এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। ইঙ্গিতে ঘর সংলগ্ন মাটির বারান্দায় বসতে চাইলে মেয়েটি মৃদু হেসে বসতে আহ্বান জানাল ওদের। যুবতী ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, পশতু কিছুই বোঝে না। ওদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। বিরল পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে এরা। তবে পশতুর সঙ্গে অতি সামান্য মিল রয়েছে।

ইশারায় ভাব বিনিময় শুরু হলো সালোয়ার কামিজ পরিহিতার সাথে। মেয়েটি ইঙ্গিতে জানাল সে বাড়িতে এখন একা। বাড়ির– অন্যান্য লোকেরা কাজের জন্য শহরে গিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। আনোয়ার ও মালেক সেনাবাহিনীর লোক, তাও মেয়েটি বুঝে নিল। আনোয়ার দুএকটা পাহাড়ী শব্দ জানত। সে বলল, ওর উস্কা (পানি খাব)। যুবতী কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দুর্বোধ্য, পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে উঠল । কিন্তু আনোয়ার তার কিছুই বুঝতে পারল না। ও ইঙ্গিতে জানাল, সে দুএকটার বেশি পাহাড়ী শব্দ জানে না। যুবতী বরফ গলিয়ে পানি এনে দিল ওদের। পানি খেয়ে সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল।

রেস্ট হাউজ থেকে স্কুল বিল্ডিং মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। অথচ ওদের এই পথটুকু অতিক্রম করতে অনেক সময় লাগে। প্রায় গোলাকৃতি মাঠটি পুরু বরফে ঢাকা। আনোয়ার স্কি চালানো শিখছে, উঁচু পর্বতবেষ্টিত এই ক্ষুদ্র মাঠে। ওর পরনে অলিভ-গ্রীন ঢোলা ট্রাউজার্স, গায়ে গরম ফুল হাতা ভেস্ট, তার ওপর ফুল হাতা মোটা উলেন সার্জের দামী শার্ট, শার্টের ওপর ফুল হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা। গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ, পায়ে নাইলনের স্টকিং, তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কানাকা ফারের টুপি। বেশ কয়েকদিন অনুশীলনের পর ও একজন স্কিম্যান হয়ে গেল।

ক্রেভিজ ক্রসিং। দুপাশে উঁচু পর্বত। মাঝে গভীর গিরিখাদ। বিশেষ কায়দায় এই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার নাম ক্রেভিজ ক্রসিং। শুরু হলো অনুশীলন। একটা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী রকেট নিল ওরা। বের করে নিল ফিউজ। নিউট্রালাইজড হয়ে গেল রকেট। কোন বিস্ফোরণ ঘটবে না। অ্যাংকর আকৃতির তিনটা হুক ওয়েলডিং করে লাগানো হলো রকেটের বডিতে। রকেটের লেজের সঙ্গেও শক্ত একটা নাইলনের লম্বা কর্ড বাঁধা। শেলটাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো ওপাশের পর্বত লক্ষ্য করে। তারপর টেনে দেখে নিল ওরা ঠিকমত আটকেছে কিনা। একে একে ওরা পার হয়ে গেল নাইলনের রশির সাহায্যে গভীর ফাটল । শেষ হলো অনুশীলন ক্রেভিজ ক্রসিং।

ক্লিফ ক্লাইম্বিং। খাড়া পর্বতের চূড়ায় আরোহণ। নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বত। অ্যালুমিনিয়ামের পিটন (পেরেক) ওরা বিঁধিয়ে দিচ্ছে পর্বত গাত্রে। পিটন ধরে একে একে সবাই উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। ওদের প্রত্যেকের পিঠে ভারী ওজনের প্যাক। সারা শরীর বরফের দেশের উপযোগী পোশাকে আবৃত। পায়ে স্নো বুট। হাতে আইসঅ্যাক্স বা বরফ কাটা গাঁইতি। অমানুষিক পরিশ্রম শেষে ওরা পৌঁছল নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বতের চূড়ায়। শেষ হলো, ক্লিফ ক্লাইম্বিং।

স্কি-ইং। বরফের ওপর স্কি-ইং দারুণ রোমাঞ্চকর। আনোয়ার শুরু করল অনুশীলন। ওর পায়ে চামড়ার তৈরি স্কি-ইং বুট, স্টীলের মত মজবুত। মাথায় কান ঢাকা পারকা। পরনে ট্রাউজার্স ও পারকা-জ্যাকেট। প্রতি হাতে দুটো করে গ্লাভস । ওপরেরটাকে বলা হয় মিটন শেল। ভিতরেরটাকে বলা হয় মিটন ইনার । দুহাতে দুটো স্কি-ইং স্টিক। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ওর স্কি-ইং ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য প্রায় এক মাইল। সাঁ সাঁ করে সে এগিয়ে চলল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল গতিতে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে। ঠিক যেন একটা ছুটন্ত তুষার মানব।

ইনিশিয়ার ক্লাইম্বিং। পুরো দশ দিনের প্রোগ্রাম। এবার ওদের বহুদূর যেতে হবে বরফের মাঝে। চল্লিশজনের দল। এদের মাঝে একমাত্র অফিসার আনোয়ার-কমাণ্ডার। এই সৈনিকদের বলা হয়, আদার র‍্যাংকস। প্রত্যেকের পরনে অলিভ গ্রীন ট্রাউজার্স। গায়ে ফুলহাতা উলেন ভেস্ট, সার্জের মোটা শার্ট, ফুল-হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা; গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ। পায়ে নাইলন স্টকিং ও তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কান ঢাকা ফারের টুপি।

একশো পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের ভারী রূকস্যাক প্রত্যেকের পিঠে। রূকস্যাকে দশদিনের পুরো রেশন, গোলা বারুদ, বাড়তি কাপড়-চোপড়, স্কি বুট, চকোলেট, সিগারেট, স্নো বুট প্রভৃতি। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো হোলস্টারে পিস্তল, কম্পাস, পানির বোতল, মেডিসিন কীট ও কমাণ্ডো নাইফ। গলায় ঝোলানো বিনকিউলার। ডান কাঁধে ঝোলানো সাব-মেশিনগান। বাম কাঁধে একজোড়া স্কি-ও স্কি-ইং স্টিক ও ডান হাতে আইস অ্যাক্স; বরফ কেটে রাস্তা তৈরির জন্য ।

আদার র‍্যাংকসদের এগুলো ছাড়াও বাড়তি জিনিসপত্র বহন করতে হচ্ছে। গরু ও দুম্বার বড় বড় ঠ্যাং ও গ্যাসোলিনের ক্যান ওদের কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো। এছাড়াও রয়েছে স্টোভ, নব্বই পাউণ্ড ওজনের ওয়্যারলেস সেট, জেনারেটর, দুই ইঞ্চি মর্টার ও ছয়টা হেভী মেশিনগান। এগিয়ে চলেছে অভিযাত্রী দল। আগে চলেছে দুজন পাহাড়ী স্কাউট । তারপর কমাণ্ডার আনোয়ার, জেসিও নায়েক সুবেদার কবীর, আদার র‍্যাংকস জানস খান, আদার র‍্যাংকস আসলাম খান, মালেক নূর, শেরদিল ও জুলফেকার। পেছনে অন্যান্য সবাই। এদের মাঝে একমাত্র বাঙালী আনোয়ার। সকাল নয়টায় শুরু হয়েছে যাত্রা। দুর্গম পথ। কোথাও রাস্তা অত্যন্ত সরু, মাত্র ছয় ইঞ্চি চওড়া। পাশে গভীর গিরি খাদ। কোথাও রাস্তা আঁকাবাঁকা। পর্বতের ঢালে অসংখ্য পাইন গাছ। গাছের ডালপাতায় তুষার জমে আছে। বেলা বারোটায় কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্য। আনোয়ার ডাকল, জানস খান।

জ্বী, স্যার। বিশালদেহী জানস খানের গম্ভীর গলা শোনা গেল।

সবাইকে হুঁশিয়ার করে দাও। এখন বরফ গলে রাস্তা আরও পিচ্ছিল হয়ে যাবে।

অভিযাত্রী দল কালাম উপত্যকা থেকে এক হাজার ফুট উঁচুতে। ক্রমশ বাড়ছে সূর্যের তাপ। বরফ গলে রাস্তা ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে গেল। সবার চোখে প্রটেকটেড সানগ্লাস। সানগ্লাসবিহীন অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে স্নো ব্লাইনেসে আক্রান্ত হতে পারে ওরা। ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেন কমে আসছে। প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর পাঁচ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা। বিশ্রামের সময় গ্যাসোলিনের স্টোভে বরফ গলিয়ে প্রচুর জলপান করছে সবাই শরীরের ডিহাইড্রেশন পূরণ করার জন্য। দুপুর দেড়টার দিকে সবাই থামল। তাজা হান্টার বীফ, পরোটা, গরম মাংসের কাবাব ও কফি সহযোগে লাঞ্চ সারল ওরা।

আবার শুরু হলো ক্লাইম্বিং। রাস্তা ক্রমশই উঁচু হয়ে গিয়েছে। সম্মুখে সুউচ্চ পর্বতের চূড়া। অভিযাত্রীদল সতর্ক। বরফে পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। রাস্তার পাশে খাদের তলদেশ নজরে পড়ে না। সূর্য আস্তে আস্তে হেলে পড়ল পশ্চিমাকাশে। তাপমাত্রাও কমে এল সেইসঙ্গে। অভিযাত্রীদের চলার গতি বাড়ল কিছুটা । বরফ গলছে না, ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। দুহাজার ফুট অতিক্রান্ত হলো। সবাই পরিশ্রান্ত। বেলা চারটায় আনোয়ার নির্দেশ দিল, হল্ট।

জেসিও কবীর, শেরদিল, আসলাম খান রান্নার আয়োজন শুরু করল। জানস খান ও জুলফেকার স্নো-টেণ্ট খাঁটিয়ে দিল কমাণ্ডারের। স্নো-টেন্টগুলো একপিস কাপড়ের তৈরি। টেন্টের দুই মুখে দুটো চোঙ-টেন্টের প্রবেশ পথ। চোঙের গোড়ার দিকে নাইলনের নেট ঝোলানো। টেন্টগুলো সাত ফুট বাই চার ফুট। ভিতরে ছয় ইঞ্চি মোটা এয়ার ম্যাটরেস, ডবল পিপিং ব্যাগ ও একটা এয়ার পিলো। দ্রুত নেমে এল অন্ধকার। মৃত্যুশীতল নীরবতায় ছেয়ে গেল বরফের রাজ্য। প্রাণের কোন ছোঁয়া নেই। পর্বতচূড়াগুলো অস্পষ্ট। কিছুই আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আকাশ জুড়ে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ডিনার শেষে আনোয়ার ঢুকল টেন্টে। জেসিও কবীর ও জানস খান এসে শুভরাত্রি জানিয়ে গেল ওকে।

বরফের দেশে রাত-আনোয়ারের জীবনে এই প্রথম। ডবল পিপিং ব্যাগের ভিতরে এখন সে। চোখে তন্দ্রালু ভাব। রাত এলেই ওর মনটা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। ওর মনের গভীরে জেগে ওঠে এক টুকরো স্মৃতি। রাত ওর প্রিয়। ও যেন নিশাচর। শরীরের পেশীগুলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার, লোকালয় থেকে বহুদূরে বরফের দেশে।

পরদিনও একই ভাবে ক্লাইম্বিং করল অভিযাত্রী দল। পাঁচ দিন কেটে গেল ওদের বরফের রাজ্যে। কখনও পর্বতের ঢাল ঘেঁষে, পিচ্ছিল পথ বেয়ে, গভীর খাদের প্রান্ত ছুঁয়ে এগিয়েছে ওরা। ষষ্ঠ দিন, বিকেলবেলা। আবহাওয়া চমৎকার। ওরা যাত্রাবিরতি করল। জায়গাটা সমতল। সামনের দিকটা একটু ঢালু। কয়েকটা ঘন পল্লবিত পাইন গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রি-লাইন। তারপর কোন গাছপালা নেই। শুধু সীমাহীন বরফ। আনোয়ার সবাইকে স্নো-টেন্ট টাঙানো ও রান্নার আয়োজনের নির্দেশ দিল। ও আজ স্কি-ইংয়ে বেরুবে।

নায়েক সুবেদার কবীর বলল, স্যার, এখনি সন্ধ্যার অন্ধকার নামবে। পথে কোন বিপদ ঘটতে পারে, আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।

কবীর, বিপদ যদি ঘটেই, তবে সেটা মোকাবেলা করার মত ক্ষমতা আমার আছে। ভয় পেয়ো না। আমি নিরাপদেই ফিরে আসব। শেরদিল, আসলাম খান, সরফরাজ কেউ ওদের প্রিয় কমাণ্ডারকে একা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু কারও কথা শুনছে না সে। একাই যাবে স্কি-ইং করতে।

স্যার, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

কে? জানস খান। আনোয়ার ঘুরে তাকাল।

জ্বি, স্যার।

তোমরা অযথা ভয় পাচ্ছ। কিছুই হবে না–আমাকে একাই যেতে দাও। কমাণ্ডার যেন অনুমতি চাইল আদার র‍্যাংকস জানস খানের কাছে। কোমরের বেল্ট থেকে কমাণ্ডো-নাইফ খুলে এগিয়ে এল জানস খান। বাড়িয়ে ধরল আনোয়ারের দিকে। বলল, স্যার, এটা বুকে বিঁধিয়ে দিন। তাহলে আমি আপনার পথরোধ করে দাঁড়াব না। এই সুযোগে সবাই ওকে সঙ্গে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানাল। অগত্যা অনুরোধের চেঁকি গিলতে হলো কমাণ্ডারকে।

আগে আনোয়ার, পেছনে জানস খান। ঘণ্টায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল বেগে এগুচ্ছে দুজন। কয়েক মিনিট চলার পর সম্মুখে পড়ল একটা ঢাল। ঢালটি বেশ গভীর। তারপর আবার সমতল বরফ। আনোয়ার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেল। ওদের চলার গতি এখন ঘণ্টায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল। আনোয়ার ইশারা করতেই জানস খান দ্রুত পাশে চলে এল ওর। এগিয়ে চলল দুই তুষার-মানব পরম নিশ্চিন্তে।

ক্যাম্প এলাকায় সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। কেউ গ্যাসোলিনের চুলায় বরফ গলাচ্ছে। কেউ তৈরি করছে মাংসের কাবাব, কেউ পাইন গাছের শুকনো ডালপালা ভাঙছে। সেগুলো একটা বড় পাইনের নিচে স্থূপীকৃত। গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতেই শুকনো ডালপালা জ্বলে উঠল । কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওরা আগুনের পরশ নিচ্ছে শরীরে। সূর্য প্রায় অস্তমিত। তবুও আনোয়ার আর জানস খানের ফিরে আসার নাম নেই। হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল। ঝড় আসছে–তুষার ঝড়। দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্প এলাকায়। ওদের প্রিয় কমাণ্ডার ও সঙ্গী জানস খান তুষার ঝড়ের কবলে। যেভাবেই হোক ওদের উদ্ধার করতে হবে । আসলাম খান, শেরদিল, সরফরাজ সহ দশজন শক্তিশালী আদার র‍্যাংকসকে নিয়ে পরামর্শ করতে বসল জেসিও কবীর।

আনোয়ার ও জানস খান ফিরে আসছে ক্যাম্প অভিমুখে। হঠাৎ পেছনে শোঁ শোঁ আওয়াজ। থমকে দাঁড়াল দুজন। পেছনে তাকিয়ে খান বলে উঠল, স্যার, তুষার-ঝড়।

কুল ডাউন, জানস খান । মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আনোয়ার দ্রুত পকেট থেকে ম্যাপ বের করল। ক্যাম্পের দূরত্ব আর মাত্র দুমাইল । সম্মুখে তিরিশ গজের মধ্যে রয়েছে সেই ঢালটি ।

জানস খান।

স্যার।

তুষার ঝড় আসার আগেই আমাদের ঢালটি অতিক্রম করতে হবে। গেট অ্যাহেড। ওরা দুজন দ্রুত এগিয়ে চলল। পেছনে ধেয়ে আসছে ঝড় ।

ওরা ঢালের প্রান্তে। ঠিক সেই সময় এসে পড়ল ঝড়। চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ভারী বাতাস। বুলেটের মত বরফের কুচি ছুটছে।

জানস খান, ঢাল পার হও, কুইক। চিৎকার করে উঠল আনোয়ার। ওরা ঢলের প্রায় মাঝামাঝি। পেছন থেকে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় ওদের গতি দ্রুততর হলো । ঢালের নিচু জায়গা। এক্ষুণি ভরে যাবে কোমল বরফে । দ্রুত পার হতে না পারলে ওরা চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। প্রায় ষাট ডিগ্রী খাড়া চড়াই বেয়ে স্কি-ইং করে ওরা উঠে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক গজ। তারপর শুরু হয়েছে সমতল বরফ। আনোয়ার পার হয়ে গেল বরফের চড়াই । শেষপ্রান্তে সমতল বরফে আছড়ে পড়ল ওর ভারী শরীর। সঙ্গে সঙ্গে ছেয়ে গেল সারা শরীর বরফে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় ওর কানে এল একটা ক্ষীণ আর্তনাদ বাঁচাও। পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল আনোয়ার–জানস খান নেই। খান বলে চিৎকার করে ও লাফিয়ে পড়ল ঢালের প্রান্তে।

ঢালের প্রান্তদেশে শুয়ে পড়েছে সে। দেখছে নিচে-বরফের প্রচণ্ড মাতামাতি। কোমর বরফে ঢেকে যাচ্ছে ঢালের তলদেশ। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠল আনোয়ারের মন। ওর জন্যই জানস খান চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। মনে হয় আর বাঁচানো গেল না ওকে। আনোয়ার আবার চিৎকার করে উঠল, জানস খান! ডানদিক থেকে শোনা গেল জানস খানের দুর্বল আওয়াজ, স্যার। আনোয়ার দ্রুত এগিয়ে গেল। নিচে দেখা গেল খানকে। প্রায় চার ফুট গভীরে তখন সে। কোমল বরফরূপী মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধরত। ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে জানস খানের ভারী শরীর।

আনোয়ার দ্রুত স্কি-ইং স্টিক পুঁতল ঢালের প্রান্তে। জানস খান, তুমি আমার পা ধরো। বলে আনোয়ার শরীর নামিয়ে দিল নিচে। ও দুহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে স্কি-ইং স্টিক। জানস খান জড়িয়ে ধরল ওর ঝুলিয়ে দেয়া পা। ধীরে ধীরে উঠে আসা শুরু করল খান। আনোয়ার বুঝতে পারছে স্কি-ইং স্টিক বেঁকে যাচ্ছে ক্রমেই। যে-কোন মুহূর্তে উপড়ে যেতে পারে।

আনোয়ার শুধু বলল, একটু তাড়াতাড়ি, খান। ঠিক এই সময় ঢালের প্রান্তে হাজির হলো জেসিও কবীর। সঙ্গে দুজন আদার র‍্যাংকস ও দুজন স্কাউট। আনোয়ার ওদের দেখতে পেয়ে। দ্রুত ডাক দিল, কবীর, আমরা এদিকে। দ্রুত এগিয়ে এল উদ্ধারকারী দল। ঢালের প্রান্তে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করল জেসিও কবীর। তারপর তুষার ঝড়ের মধ্য দিয়ে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।

পরদিন সকাল। আবহাওয়া অপরিচ্ছন্ন, তুষারপাত হচ্ছে। সারাদিন ধরে চলল তুষারপাত । সারাটা দিন স্নো টেন্টের মাঝে কেটে গেল ওদের। অষ্টম দিনে আবহাওয়া মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। শুরু হলো অনুশীলন। বরফের ওপর ভারী অস্ত্রের ফায়ারিং এবং কাল্পনিক শত্রু এলাকা আক্রমণ। রাতে শুরু হলো নাইট রেইড। তারপর ফিরে আসার পালা। পর্বত বেয়ে ওঠার চেয়ে নামাটা আরও বিপজ্জনক, যে পথ ওদের অতিক্রম করতে সময় লেগেছিল আটদিন, সেই পথ ওরা নেমে এল সাত আট ঘণ্টার মধ্যে। কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়াই ফিরে এল অভিযাত্রী দল নিচে রেস্ট হাউজে।

রেস্ট হাউজের আরামদায়ক পরিবেশে ওরা বিশ্রাম নিল পুরো একদিন। বিশ্রামের জন্য হাতে এখনও দুদিন সময়। পরদিন সকাল। ঝলমলে রোদ উঠল আকাশে। চকচক করছে তুষার। অলস দিন। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বের হলো নির্জন পর্বতের ঢালের সেই যুবতীর উদ্দেশে। ঘরের সামনে গিয়ে ওরা চিৎকার করল, কৌন হ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই যুবতী। নীরবে স্বাগত জানাল ওদের।

কাছে যেতেই যুবতী বলল, কেনা (অর্থাৎ বসো। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বসে পড়ল মাটির বারান্দায়। আনোয়ারও মেয়েটিকে বলল, কেনা। যুবতী না বসে মিটিমিটি হাসতে লাগল। হঠাৎ সে কথা বলে উঠল। কিন্তু ওরা কিছুই বুঝল না। তারপর ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল ওদের উদ্দেশে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা বুঝতে পারল, মেয়েটি জানতে চাইছে, এতদিন ওরা কোথায় ছিল। এবারে ইঙ্গিতে ওরাও বুঝিয়ে দিল–ওই দূরে, উঁচু বরফের চূড়ায় গিয়েছিল ওরা। আনোয়ার বলল, এগগায়া এস্তা? দ্রুত এস্তা বলে ঘরের ভিতরে গেল মেয়েটি ডিম আনার জন্য। আরজুমান্দ মালেক বলল, শালা, খুব তত জমিয়েছিস! এবার নামটা জিজ্ঞেস কর।

কিন্তু কি করে?

যেভাবে ডিম আনতে বললি।

দ্যুৎ শালা। তারচে বরং তুই ইশারাতে নামটা জিজ্ঞেস কর।

মালেকের চোখ কপালে উঠল, আরে বিয়ে করবি তুই, আর নাম জিজ্ঞেস করব আমি?

মালেক, আমি বাঙালী মেয়েকেই বিয়ে করব। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আনোয়ারকে সিরিয়াস মনে হলো ।

নে, নে, তুই শালা বাঙালী প্রেমেই মত্ত থাক। এটাকে আমিই নিই।

বারান্দায় বসে ওরা আশপাশে ভাল করে দেখল। পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটা মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুজন ভাবছে, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কি অদ্ভুত জীবন! এই নির্জন বরফের রাজ্যে সুন্দরী যুবতাঁকে একা রেখে সবাই চলে গেছে শহরে। কাজ শেষে কবে ফিরবে কে জানে?

ঘর থেকে বেরিয়ে এল যুবতী। হাতে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের পরিষ্কার পাত্র। তাতে কাঁচা ডিম ভেঙে এনেছে। ওরা গপাগপ খেয়ে নিল। আরজুমান্দ মালেক ইশারায় জানতে চাইল যুবতীর নাম । বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করল মালেক। যুবতী কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত চেয়ে রইল। আনোয়ার উঠে দাঁড়িয়ে মালেককে বলল, আমি তোর নাম জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিবি। আনোয়ার বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার নিজের নাম উচ্চারণ করল। তারপর ফিরল মালেকের দিকে। ডাকল, আরজুমান্দ মালেক। মালেক দ্রুত উত্তর দিল। আনোয়ার ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নাম। তবুও যুবতী নিরুত্তর। এবার শুরু হলো প্রচেষ্টা। মালেক ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার উত্তর দিচ্ছে, আনোয়ার নাম জিজ্ঞেস করলে মালেকও দিচ্ছে জবাব। এরই মাঝে আনোয়ার চট করে ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিত করল–ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ নূরী।

আনোয়ার ও মালেক একসঙ্গে জানতে চাইল নূরী? যুবতী ঘাড় হেলিয়ে জানাল-ঠিক! আনোয়ার ইংরেজিতে বলল,

মালেক, তোর বৌয়ের নাম তো বেশ সুন্দর।

বেশ সুন্দর নয় খু-উ-ব সুন্দর। তোরই ভাবী তো? . শালা, আগে দেখ, তোর বৌ হতে ও রাজি আছে কিনা। আনোয়ারের কণ্ঠে রীতিমত কৌতুক।

বলিস কি! ও তো আমার বৌ হয়ে বসে আছে। দাঁড়া ওকেই জিজ্ঞেস করছি। মালেক নূরীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই নূরী, তোর স্বামী কে? আমি না?

নূরী একবিন্দুও বুঝতে পারল না ওদের কথা।

চল, আজ অনেক হয়েছে। আর একদিন আসা যাবে। মালেককে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার । ওরা বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ওদের ইঙ্গিতে আবার আসতে বলল। ওরা হাঁটা শুরু করল রেস্ট হাউজ অভিমুখে। মাটির বারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নূরী ওদের গমন পথের দিকে। কে জানে, পর্বতবাসিনী নূরী ওদের নিয়ে কি ভাবছে?

একটি গ্লেসিয়ার। বিশ হাজার ফুট উঁচুতে ম্যাপে নির্দেশিত এই গ্লেসিয়ারের চূড়ায় আরোহণ করতে হবে এবার অভিযাত্রী দলকে। ভিন্ন পথে এগিয়ে চলল ওরা। আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। সূর্য ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। সামনের পথ বেশ সরু হয়ে বেঁকে গেছে। পাশে গভীর খাদ। খাদের পাশ ঘেঁষে সরু পথ অতিক্রম করছে ওরা। সবাই সতর্ক। হঠাৎ শেরদিল চিৎকার করে উঠল, স্যার, সরফরাজ নিচে পড়ে গেছে।

আনোয়ার দ্রুত নায়েক সুবেদার কবীরকে নির্দেশ দিল, জলদি নিচে যাও এবং অবস্থা সম্পর্কে আমাকে ইনফর্ম করা, কুইক।

কবীর দ্রুত নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ওয়্যারলেসে শোনা গেল কবীরের কণ্ঠ। আনোয়ার সেট অন করে রেখেছে। স্যার, সরফরাজ ভাল আছে। তেমন কোন মারাত্মক আঘাত পায়নি। শুধু জেনারেটরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। ওভার।

ও কত ফুট গভীরে পড়েছে? ওভার। আনোয়ারের প্রশ্ন।

আবার ভেসে এল কবীরের কণ্ঠ, প্রায় বারোশো ফুট নিচে, স্যার।

ঠিক আছে, তুমি ওকে রেস্ট হাউজে রেখে ফিরে এসো । আমরা এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ওভার অ্যাণ্ড আউট। কেটে গেল যোগাযোগ।

সাতদিনের মাথায় আবহাওয়া ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । চারদিকে শোঁ শোঁ আওয়াজ। বাতাসে বরফের কুচি ছুটে বেড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের । আনোয়ার ক্যাম্প করতে নির্দেশ দিল । সবাই আশ্রয় নিল স্নো টেন্টের অভ্যন্তরে। একদিন একরাত পর আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এল। ওরা আবার শুরু করল যাত্রা। দশদিন পর অভিযাত্রী দল পৌঁছল ম্যাপ নির্দেশিত গ্লেসিয়ারের পাদদেশে।

বিশাল গ্লেসিয়ার। এটির আয়তন কত, তা অনুমান করা মুশকিল। চারদিক শুধু সীমাহীন বরফ। তারই মাঝে গ্লেসিয়ারটি গম্বুজের মত দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টিতে বিস্ময়। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মসৃণ বরফের দেয়াল-একেবারে খাড়া প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। শুরু হলো পিটনের সাহায্যে ক্লাইম্বিং। আট-নয় ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওরা পৌঁছল গ্লেসিয়ারের চূড়ায়। সুন্দর সমতল চূড়া। পিচ্ছিল বরফের আস্তরণ, অতি মসৃণ। এইসব গ্লেসিয়ারের চূড়া প্রায় সারা বছরই তুষার ঝড়ের মোকাবেলা করে। কখনও হালকা মাঝারি ধরনের, আবার কখনও বা প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হয় তুষার ঝড়। ওরা যখন চূড়ায় পৌঁছল, তখন মাঝারি আকারের ঝড় হচ্ছে সেখানে। * পায়ে সবাই ক্র্যাম্প-অন পরে নিল । ক্র্যাম্প-অনের নিচে ধারাল স্পাইক লাগানো। হাঁটার সময় স্পাইকগুলো বরফের ভিতর ঢুকে যায়। ফলে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে সহজেই চলাফেরা করা যায়।

অভিযাত্রী দল পরিশ্রান্ত। চটপট স্নো টেণ্ট খাটাল ওরা। জানস খান, শেরদিল, জুলফেকার ও জেসিও কবীর তৈরি করল একটি সুন্দর ইগলু। এটাই আনোয়ারের আবাস। ইগলুর দিকে চেয়ে আনোয়ার বলল, এক্সেলেন্ট! এবার তোমরা যে যার টেন্টে ঢুকে পড়ো। এরকম আবহাওয়ায় ফ্রস্ট-বাইটের আশঙ্কা পুরোমাত্রায়।

আবহাওয়া ভাল হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। আকাশ ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে তুষার ঝড় ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আবার স্তিমিত হয়ে আসছে। সেটা ক্ষণিকের জন্য। আট দশ দিন ওরা কেউ সূর্যের মুখ দেখেনি। ইগলুর অভ্যন্তরে কেটে গেল আনোয়ারের দুই দিন। তৃতীয় দিন ক্র্যাম্প-অন পায়ে ও বেরিয়ে এল ইগলুর বাইরে। চারদিক ভাল করে লক্ষ করল । আবহাওয়া কখন পরিষ্কার হবে বলা মুশকিল । এদিকে রেশনও প্রায় শেষ। আনোয়ার সবাইকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার অভিযাত্রী দল যাত্রা শুরু করল রেস্ট হাউজের উদ্দেশে। নিরাপদেই পৌঁছল ওরা।

পনেরো দিনের মাথায় প্রকৃতি ওদের একটি সুন্দর মিষ্টি সকাল উপহার দিল। পুব আকাশে রক্তিম সূর্য। প্রত্যুষের নতুন আলোয় হেসে উঠল বরফের রাজ্য। চারদিকে ঝলমল করছে মুক্তোর মত কোমল রূপালী বরফ। আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। গতকাল আরজুমান্দ মালেক দলবল নিয়ে ক্লাইম্বিং শেষে ফিরে এসেছে। ফিরেই আনোয়ারকে বলেছে, আজ নূরীকে দেখতে যেতে হবে।

আনোয়ার জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সম্মুখে দিগন্ত বিস্তৃত বরফ, উদীয়মান সূর্য-শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর চিন্তায়। হঠাৎ দরজায় নক হলো। ছেদ পড়ল আনোয়ারের চিন্তায়। ডাক দিল সে। কাম ইন প্লীজ।

হাই আনোয়ার, গুড মর্নিং। রূমে প্রবেশ করল আরজুমান্দ মালেক।

মর্নিং আনোয়ার ওকে একটি সোফা দেখিয়ে বসতে বলল ।

সোফায় বসে একটি সিগারেট ধরাল মালেক। লম্বা টান দিয়ে বলল, আনোয়ার, তুই আজকাল কি ভাবিস বল তো?

এমন কিছু নারে। আনোয়ার একটু অন্যমনস্ক।

দোস্ত, তুই আমার কাছে লুকোতে চাইছিস? প্লীজ, বল না । মাঝে মাঝে তোকে অন্যমনস্ক মনে হয় কেন? মালেকের কণ্ঠে অনুনয়।

ভাবছিলাম, শেষ জীবনটা কিভাবে কাটবে? আনোয়ারের ভাবলেশহীন কণ্ঠ।

আনোয়ার, ওটা তো তোর জন্য নির্ধারিত ব্যাপার। তোর মরণ হবে হয় বুলেটে-বেয়োনেটে, নয়তো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। আর যদি ভালভাবে কাটে তবে আমেরিকার কোন ফাইভস্টার হোটেল। পাশে…

নে, চুপ কর। পৃথিবীতে মৃত্যু অতি নিশ্চিত। আর মৃত্যুর সময়টা অতি অনিশ্চিত, একটু থেমে আনোয়ার আবার বলল, নূরীকে দেখতে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। এবারে কেটে পড়। টয়লেট আমাকে ডাকছে।

আমাকেও রেডি হতে হবে। নাস্তা সেরে তুই তাড়াতাড়ি আয়। রূম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল মালেক।

ও শিওর। বলল আনোয়ার।

পরিচ্ছন্ন সকালে দুজন আবার উপস্থিত হলো পাইন ঘেরা সেই পর্বতের ঢালে। আসার সময় মালেক চা, কফি ও চকোলেট সঙ্গে নিয়েছে নূরীর জন্যে। সারা রাস্তায় এই নিয়ে আনোয়ার ওকে খেপাল। মাটির বারান্দার সামনে গিয়ে ওরা নির্দিষ্ট সংকেত দিল, কৌন হ্যায়? পরিচিত গলা শুনে মেয়েটি খুলে দিল দরজা। একগোছা তাজা ফুলের মতই দাঁড়িয়ে রয়েছে নূরী। মুখে অতি পরিচিত মৃদু হাসি। নূরী ডাকল, দালতারাসা। (অর্থাৎ এখানে এসো) আনোয়ার জানত দালতারাসার অর্থ। মালেককে নিয়ে সে এগিয়ে গেল। নূরীর সামনে গিয়ে বলল চায়ে উস্কা(অর্থাৎ চা খাব)। নূরী ইশারায় বুঝিয়ে দিল ঘরে চা নেই। মালেক পকেট থেকে চা, কফি ও চকোলেট বের করে নূরীর দিকে এগিয়ে দিল। আনোয়ার ইশারা করল নূরীকে চকোলেট খাবার জন্য। চকোলেটগুলো বেশ সুস্বাদু। একটা মুখে পুরে ওদের দুজনের দিকে দুটো চকোলেট এগিয়ে দিল নূরী। ইশারায় ওদেরকেও খেতে বলল। আজ ওরা প্রথম নূরীর সঙ্গে ঘরের ভিতরে গেল। মাটির তাকে বিভিন্ন জিনিস সুন্দর করে সাজানো। টাঙানো দুটি দড়িতে কাপড়-চোপড়। একটিতে পুরুষের কাপড়, অপরটিতে মেয়েদের। পুরুষের কাপড়গুলো ভীষণ নোংরা, কিন্তু নূরীরগুলো পরিষ্কার ।

মাটির দেয়াল কেটে ছোট্ট একটি দরজা। আনোয়ার অনুমান করল, ওটাই নূরীর কিচেনে যাওয়ার পথ। নূরীকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো। তারপর দুজন নূরীকে নিয়ে কিচেন রূমে ঢুকল। ছোট্ট ঘরটি মাটির দেয়াল ঘেরা। কাঠ ও মাটির তৈরি ছাদ। দেয়ালে কয়েকটি খাঁজ-জিনিসপত্র রাখার জায়গা। ঘরের মাঝখানে ছোট উনুন। এককোণে শুকনো ডালপালা জড়ো করা। ওরা নূরীকে চা ও কফি বানানো শেখাল, নূরী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখল, কিভাবে চা, কফি বানাতে হয়। কফি তৈরি শেষে সামনের ঘরে ফিরে এল ওরা তিনজন। প্রত্যেকের হাতেই পট ভর্তি গরম কফি। আনোয়ার ও মালেক কফি পান শুরু করল। নূরী তাকিয়ে দেখছে ওদের। মালেকের ইশারায় নূরীও কফি নিল। কফি পান শেষে পুনরায় কিচেনে ঢুকল সে। দুটো পট হাতে ফিরে এল ও। পটভর্তি কাঁচা ডিম। ইশারায় ওদের খেতে বলল নূরী। আনোয়ার ও মালেক নূরীকে বোঝাচ্ছে, কফির পর এগুলো খাওয়া ঠিক নয়–কিন্তু ও অবুঝ। ভীষণ পীড়াপীড়ি শুরু করল । শেষে ওরা বাধ্য হয়ে খেয়ে ফেলল কাঁচা, ডিম। তারপর বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ইশারায় আবার ওদের আসতে বলল । কিছুদূর আসার পর পেছন ফিরতেই ওরা দেখতে পেল নূরীকে–দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দার ওপর। মালেক ও আনোয়ার দুজনেই হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে। নূরীও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল। বরফ ভেঙে ওরা এগিয়ে চলল রেস্ট হাউজের দিকে। একসময় ওরা হারিয়ে গেল নূরীর দৃষ্টি সীমার আড়ালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *